আমার প্রথম সকাল পর্ব-০৪

0
329

#আমার_প্রথম_সকাল (০৪)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
সকাল আটটা নাগাদ! শ্বশুর বাজার থেকে দেশি মুরগী এবং মাঝারি আকারের রুই, মৃগেলসহ দুই তিন পদের মাছ কিনে আনলেন। সাধারণত রমজান মাসে এতো সকাল সকাল বাজার বসবার কথা না। শ্বশুর ফজরের নামাজের পর কিছুক্ষণ বিশ্রামের নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন আড়ৎ থেকে তাজা মাছ ক্রয় করতে। জেলেরা সাত সকালে তাজা মাছ এনে আড়ৎতে বিক্রির উদ্দেশ্যে বসে পড়ে। বিকেলে হাটের মাছ হয় বরফ দিয়ে রাখা থাকে যার ফলে ততক্ষণে বেশিরভাগ মাছ কিনে আনার পর নরম এবং অনেক সময় দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করে দেয়। নয়তো মাছ পানির মধ্যে মৃত ভেজানো থাকে। সে তুলনায় জ্যান্ত মাছ থাকার সুবিধার্থে সকালে বসা আড়ৎ এর মাছে ভেজালের সম্ভাবনাও খুব কম থাকে। গতকাল জুনাইদের পাঠানো টাকা তুলেছিলেন শ্বশুর। টাকা তুলে আসার পথেই এনেছিলেন যাবতীয় মাসকাবারি ও কিছু কাঁচা বাজার। জুনাইদ যখন দেশে টাকা পাঠায় তখন শ্বশুর দুই হাত ভর্তি বাজার নিয়ে বাড়ি ফেরেন। আজও ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। সামনে ঈদ। ঈদের আগে আগে মুরগীর দাম বেড়ে যায়। তাই ঈদের দশ দিন আগেই তিনি কিনে এনে একদম সেরে ফেলেছেন। ঘরের কোণায় শ্বশুরের হাঁক ডাক শুনে অগত্যা সারাদিনের ক্লান্তিতে চক্ষু জুড়ে নেমে আসা শান্তির ঘুমকে বিদায় জানিয়ে ওঠতে হলো আমাকে।

ইতিমধ্যে শ্বশুরকে এভাবে ফিরতে দেখে শ্বাশুড়ি শ্বশুরের সঙ্গে চেচামেচি করা শুরু করে দিয়েছেন। উনার একটাই কথা কি দরকার ছিল এক সাথে এতো বাজার করার। ঈদের পর উনার ছোট ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান তখনই কত খরচ পড়বে সেসব জোগাড় করবেন কোথা থেকে তিনি? শ্বশুর জানালেন, যার বিয়ে সে নিজেই করুক গে। এতো ভেবে কাজ আছে, বাঁচব আর কতদিন? ইচ্ছের অপূর্ণ রেখে মরতে নেই।

শ্বশুরের মুখে এমন কথা শুনে শ্বাশুড়ি তেঁতে ওঠলেন। ” জামি এতো টাকা পাবে কোথায় হ্যাঁ? নিজে তো ঠিকই আমাপা লোকজন ডেকে আনবেন। এসবের বন্দোবস্ত করবেটা কে? ”

শ্বশুর বললেন, ” সে চাকরি করে কিসের জন্য যদি নিজের বিয়েতে খরচ দিতে না পারে? ”

” চাকরিতে আর কত টাকাই বা পায়। ও দিয়ে এখন আর কিছুই হয়না। বিয়েতে প্রচুর খরচাপাতি আছে। তখন তো জুনাইদই একমাত্র ভরসা। এভাবে খরচ করলে কি পরে সব দিতে পারবে? ”

” এখানে জুনাইদ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যা দেবে জামিল দিবে। ”

” জুনাইদ দিতে পারবে না মানে? জামিল জুনাইদের ভাই না.? ভাইয়ের জন্য ভাই খরচ করতে পারবে না। তাইলে সে কিসের ভাই? বাপ হয়ে এতো বড় কথাটা আপনি কোন মুখে বলতে পারলেন? ”

” মা হয়ে তুমি যেই মুখে পারছ সেই মুখে। জুনাইদের মা জুনাইদের ওপর আর চাপ দিও না। এমনিতেই নিজের সব উজাড় করে দিয়ে দিছে ছেলেটা। ওর ও ভবিষ্যৎ আছে। ”

” ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে ভাবা যাবে। আগেভাগে ভাবলে কিচ্ছু হয় না। বড় ছেলেদের সংসারে একটু বেশিই দেওয়া লাগে জুনাইদের বাপ। ”

স্বামী স্ত্রী দুইজন নিজেদের মতো ঝগড়া করে দু’জন দু’দিকে চলে গেছে। দু’জনের ফ্যাসাদের মাঝখানে পড়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের মতো কাজ চালিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে। কাজ শেষ না করলে শ্বাশুড়ি এসে আবার আমার ওপর রাগারাগি শুরু করবেন। আপাতত সাতসকালে যেচে পড়ে গালমন্দ খাওয়ার সখ হয়নি। মায়ের কাছে থাকতে একা কখনো এসব করতে হয় নি আমায়। মামা এসে প্রতি মাসে মাসকাবারি বাজার সমেত, মাছ, মাংস যা যা লাগত সব বাজার করে দিয়ে যেতেন। বাড়ির আসেপাশের জায়গায় আমি আর রাফা মিলে সখের বশে কয়েকটা সবজির গাছ যত্নের সহিত লাগিয়েছিলাম। যাতে কাঁচা বাজার শেষ হলে মা’কে কষ্ট করে বেশিরভাগ সময় বাজারে যেতে না হয়। এমনকি সামান্য যত্ন করতে পারায় সেগুলোয় বেশ ভালো ফলনও দিত। যেদিন কলেজ যেতাম সেদিন নিজেদের মন মতো দু-একটা তরকারি কিনে ফেরার পথে নিয়ে আসতাম। মামা মাছ মাংস এনে দিলে ওগুলো আমি আর মা মিলে বসে কেটে ফেলতাম অনায়াসে। কখনো এতো কিছু এক সাথে কাটতে হয়নি আমাকে বিয়ের আগ পর্যন্ত। ভাগ্যিস তখন মায়ের সাথে হাতে হাতে করে সব শিখে নিয়েছিলাম। নাহলে শ্বাশুড়ি এ নিয়েও কথা শোনাতে ছাড় দিতেন না। এখন এতো কিছু পারার পরেও শ্বশুর শ্বাশুড়ির মতে আমাকে আমার মা কোনো কাজই শেখায়নি। না শিখে আসলে তো কথাই ছিল না!

প্রায় ঘন্টা দুয়েকের মতো সময় লেগে যায় আমার সব কিছু কাটাকুটি শেষ করতে করতে। শ্বাশুড়ি একটা বারের জন্যেও এদিকে মুখ ফিরিয়ে দেখেনি। ঘরে এসব ধুতে ঝামেলা লাগে বিধায় পুকুর পাড়ে চলে গেলাম বটি এবং মাছ মাংসের ঝুড়িসহ। পুকুর পাড়ে এগুলোকে রেখে দূরে ময়লাগুলো ফেলতে গেছিলাম যাতে এদিকটায় দুর্গন্ধ না ছড়ায়। আসার সময় পথে পাশের বাড়ির জুনাইদের দুঃসম্পর্কের এক ফুপুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে। দেখা মাত্রই তিনি বলে ওঠলেন, ” কিগো জুনাইদের বউ! এইবার কি ইফতারি খাওয়াইবা না কাউরে? ”

ফুপু একা মানুষ। ছেলেমেয়ে নেই। স্বামী গত হয়েছেন বছর দশেক আগে। সেই থেকে ভাইয়ের ভিটেয় থাকেন। উনার ভাইয়ের পরিবারও হতদরিদ্র। খেটে খাওয়া মানুষ, দিন এনে দিন খায়। তাই তিনি এদিক সেদিক গিয়ে এসে খান। উনার এ নিয়ে সমস্যা হয় না। হাতে হাতে দুই একটা কাজ করে দিলে মাসেও কিছু টাকা পান। ও দিয়েই উনার ঔষধ ও একা মানুষ হিসেবে যাবতীয় ভরণপোষণের খরচা উঠে যায়। সেই থেকে আবার নাকি নিজের ভাইকেও দেন৷

” ফুপু আপনাকে তো দেখাই যায় না। ইফতারের সময় আসিয়েন। ইফতারের দাওয়াত আপনার কেমন? ” তিনি মৌন সম্মতি প্রদান করলে আমিও চলে আসি পুকুর ঘাটে। কিন্তু শেষ রক্ষা বোধহয় হলো না। অঘটন একটা আমার সঙ্গে না ঘটলে বোধহয় খুব একটা ভালো হতো না। পুকুর ঘাটে রেখে যাওয়া মাছের বড় একটি মাথা বিড়াল ইতিমধ্যে মুখে করে নিয়ে গেছে। সেটা দেখেছেন আমার জেঠি শ্বাশুড়ি। তিনি চিৎকার করে শ্বাশুড়িকে ডাকা শুরু করলেন।

” জুনাইদের মা কোথায় গেলি? এই জুনাইদের মা, জুনাইদের মাআআআআআ…..

শ্বাশুড়ি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন পুকুর পাড়ে। ” কি হইছে ভাবী.? এমনে ডাকেন কেন? ”

” দেখ বিড়াল তোগো মাছ নিয়া ভাগছে। ”

শ্বাশুড়ি আঁতকে উঠলেন। ” কেমনে ভাবী? ”

” আরে তোর জুনাইদের বউ মাছ রাইখা বাগানের ভেতর গেছে। তখনই সুযোগ মতো বিড়াল মাছের একটা বড় মাথা নিয়ে ভাগছে। ”

জেঠি শ্বাশুড়ির মুখে এমন কথা শোনা মাত্রই শ্বাশুড়ি রেগে মুহুর্তের ব্যবধানে অগ্নিসর্মা রূপ ধারণ করলেন। ” একটা কাজও কি তুমি ঠিক মতো করতে পারো না সকাল? একলা একলা সব কাটছো ভালো কথা। এইজন্য এমনে পালাই রাখি যাইবাগা? ”

” আমি তো সামনে ময়লা ফেলতে গেছিলাম৷ বেশিক্ষণ হয় নাই আম্মা। ”

” গায়ে লাগে না তো, স্বামীর টাকার প্রতি কোনো দয়ামায়া নাই। আমার ছেলেটা যে কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে টাকাগুলা পাঠায় সেগুলো তো তোমার গায়ে লাগব না। বোঝো তো খালি নিজের বাপের বাড়িরটা, কেমনে না দিয়ে বাঁচতে পারে মা।কেবল এই চিন্তায় থাক। কই বাপের বাড়ি থেকে তো পারলা না একটা কানা কড়িও আনতে। হিম্মত থাকলে বাপের বাড়ি থেকে এনে এমনে পালাই রাখিও তো দেখি কত পারো! সাধে কি আর বলি বেছে বেছে ফকিরের বাচ্চা একটারে ঘরে তুলছি! ”

কথায় আছে জোর যার মুল্লুক তার! শ্বাশুড়ির ক্ষেত্রে যেন সেটি বেশ প্রযোজ্য। তিনি যখন যেভাবে পারছেন কথা শুনিয়েই যাচ্ছেন শুনিয়েই যাচ্ছেন। মাঝে মধ্যে দুই একটা কথার জবাব যে দেবো সে পথটাও তিনি অবশিষ্ট রাখেন না। একটা বললে পরবর্তীতে সেই কথাটা ঠিক এমনভাবে ফিরিয়ে দেন যাতে করে নিজের আত্মসম্মানবোধ থেকেও বলা না যায়। বিয়ের আগে কখনো কারোর নিকট আমাকে এতোটা অপদস্ত হতে হয়নি। ষোলকলা যেন এখানেই পূর্ণ করে দেওয়ার পরিকল্পনা আগে থেকে করে রেখেছিলেন সৃষ্টিকর্তা।

বিকেলের দিকে জামিল বাড়ি ফিরে আসে। হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। বোঝা যাচ্ছে বউকে নিয়ে কেনাকাটা করে তবেই বাড়ির দিকে মুখ করেছে। বাড়িতে ঢুকে শ্বাশুড়িকে ডেকে উনার হাতে একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল। শ্বাশুড়ি তুলে নিয়ে খুশিতে আটখানা হয়ে বললেন, ” কি ব্যাপার বাপ! এতো কেনাকাটা কার জন্য? ”

” তোমার আর বাবার জন্য। সোমাকে নিয়ে আজকে মার্কেটে গিয়েছিলাম। বিয়ের পর প্রথম ঈদ। কেনাকাটা না করে দিলে কি আর হয়? তাই ওর আর ওর পরিবারের জন্য টুকটাক কেনাকাটা করতে হয়েছে। ”

সোমার পরিবারকে দিয়েছেন শুনে শ্বাশুড়ির কৌতুহলের মাত্রা বেড়ে গেল। ” ওদের পরিবারের জন্য মানে? ”

” আরে নতুন জামাই না? না দিলে তো লোকে কত কথা বলবে। তাই দিয়েছি। ”

” হ্যাঁ। তাও বটে। ” শ্বাশুড়ি দম ফেললেন। পরক্ষণে বললেন, ” তোকে কিছু দেয়নি তোর শ্বশুর শ্বাশুড়ি? ”

” হ্যাঁ। ঈদের কেনাকাটা করতে হাতে টাকা তুলে দিয়েছে। সাত হাজার টাকা! ”

শুনে শ্বাশুড়ির চোখ চকচক করতে লাগল। ” যাক ভালোই হয়েছে। একেই বলে কপাল। শ্বশুড় বাড়ি থেকে মানুষ কত কিছু পায়। খালি আমার জুনাইদটা ছাড়া। ছেলেটার কপাল আসলেই খারাপ। কোন কুক্ষণে যে এমন ফকিন্নি বংশের সাথে আত্নীয়তা করতে গেছি কে জানে? ”
শেষের কথাগুলো শ্বাশুড়ি জোরে জোরে আমাকে শুনিয়ে বলছিলেন। অথচ আমার মা-ও গতবার ঈদ উপলক্ষে মেয়ে জামাইকে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু জুনাইদ সে টাকা নেয়নি। উল্টো নিজের পকেট থেকে টাকা বের করে মায়ের হাতে গুঁজে অনুরোধের সহিত দোয়ার আবেদন করে জানিয়েছিল, ” আমাকে ক্ষমা করবেন মা! আপনি এ টাকা নিজের কাজে ব্যয় করবেন। আমাকে আল্লাহ যথেষ্ট দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।। দয়া করে পুনরায় সেধে আমাকে ছোট করবেন না। আমার আত্মসম্মানটা বড্ড বেশি সেখানে আঘাত হানবেন না! ”

খুশিতে সেদিন মায়ের চক্ষুযুগল অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠেছিল। জুনাইদ আগে আগে বেরিয়ে এলে মা আমাকে আসার পথে জুনাইদের আড়ালে বলেছিল, ” কোনো পূণ্য না করলে জামাইয়ের মতো জামাই তোর কপালে জুটত না। সবসময় জামাইয়ের দিয়ে খেয়াল রাখবি, মুখে মুখে ভুলেও তর্ক করবি না! ”

কথাটা মা মোটেও মিথ্যে বলেনি। আমার মনে এ নিয়ে হামেশাই প্রশ্ন জাগে জুনাইদের মতো ছেলের জন্ম এমন একটা পরিবারে কিভাবে হলো? যেখানে ওর মা, বাবা, ভাই, তিনজন একই রকম এবং সে এতো ব্যতিক্রমধর্মী। জুনাইদের মাও হয়তো নিজের দাম্ভিকতার আড়ালে বড় কোনো পূন্য করেছিলেন। বিনিময়ে আল্লাহর তরফ থেকে পুরস্কার স্বরূপ জুনাইদের মতো ছেলেকে উনি গর্ভে ধারণ করেছিলেন। আমার চোখে দেখা নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন সৎ পুরুষ জুনাইদ নামক মানুষটি। যার মাঝে অন্যকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের মাধ্যমে নিজেকে বড় করবার মতো মনোভাব পোষণ করতে আমি আজ অব্দি দেখিনি!

চলবে…..

[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে