#আমার_প্রথম_সকাল (০২)
#ফাহমিদা_মুশাররাত
.
ছেলেবেলায় বাবার সঙ্গে করে আনা খবরের কাগজের শিরোনামে বেশ কয়েকবার পড়েছিলাম, যৌতুকের জন্য গৃহবধূ নির্যাতন। এখন যুগ বদলেছে এখন আর শ্বশুরবাড়ির লোকেরা গায়ে হাত তোলে না, এখন ছোড়ে কথায় কাদামাটি। হাতের মারের চেয়ে আঘাতের মার বেশ কষ্ট দায়ক। সহজে হজম করে যেমন নেওয়া যায় না তেমনি প্রতিবাদস্বরূপ কিচ্ছুটি বলাও যাবে না। তার কারণ তারা পরেরবাড়ি লোক, মেয়েদের জন্মের মুখ্য উদ্দেশ্যই হলো পরের বাড়ির লোকেদের সঙ্গে মানিয়ে চলা। পরের বাড়ির লোকজন এবার সে যেমনই হোক। তোমার কর্ম তুমি কর, কিছু বললে কেবল চুপচাপ শুনে যাও। মেয়ে মানুষের এতো মুখে মুখে তর্ক করা সাজে না। নাহলে বাবা মায়ের বদনাম হবে যে। শ্বশুর শ্বাশুড়ি কিছুক্ষণ আগের খবরখানা তাদের ছেলের কানে তুলে দিতে ভুল করলেন না। যা জুনাইদের জিজ্ঞাসাবাদের ধরণেই স্পষ্টত প্রতীয়মান।
” সকাল! আমি কি শুনছি এসব? ”
” কি শুনছেন? ” আমি কণ্ঠস্বর যথেষ্ট শান্ত রেখে বললাম।
জুনাইদ ভনিতা ছাড়াই আমায় বলল, ” মা বকা দেওয়ায় তুমি না-কি ইচ্ছে করে রান্নাঘরে বটিটা রেখেছ যাতে মায়ের পা কেটে যায়? ”
অধর জুড়ে এবার আমার হাসি ফুটল। কেন হাসছি তা আমি নিজেও জানি না। খুব সম্ভব মাথার স্ক্রু ডিলে হয়ে গেছে। বললাম, ” আর কি কি বলেছে আপনার মা? ”
” মা কিছুই বলেনি আমায়। বলেছে… ” জুনাইদ বোধহয় বুঝল বউয়ের নিকট বাবা মায়ের নালিশের কথা বলতে হয় না! তাই তো ঝটপট কথার প্রসঙ্গ বদলে ফেলল। ” যাকগে বাদ দেও। ঠিক মতো ইফতার করেছ? ”
” হু! ” ইচ্ছে করেই কথাটা লুকলাম। অন্যথায় ওসব খাবার গলায় এ মুহুর্তে বিষের ন্যায় লাগবে যে!
” মিথ্যে বলছ কেন? আমি জানি তুমি খাওনি! ”
” জানলে জিজ্ঞেস করছেন কেন? ”
” আমার জিজ্ঞেস করার অধিকার আছে তাই! ”
” ওহ্হ! ” ছোট করে জবাব দিয়ে মৌনতা বজায় রাখলাম। কথা বলার মতো বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। জুনাইদ সেটাও বুঝল। মিনিট দু’য়েক মৌন থাকার পর ওপাশ থেকে জুনাইদকে নাম ধরে ডাকতে শোনা গেল,
” সকাল! ”
” হুম! ”
” খেয়ে নেও। নাহলে শরীর খারাপ করবে। আমি এসে যেন তোমাকে সুস্থ সবল পাই। ”
” কীভাবে পাবেন শুনি? ”
” মন খারাপ করো না সকাল। আমি বাবা মা’কে বলে দেবো। যাও খেয়ে নেও কেমন? ” বলেই ফোন রাখল জুনাইদ।
মানুষটার সাথে থেকে অন্তত এতটুকু বুঝেছি, সে যথেষ্ট ধৈর্যশীল এবং বুঝদার একজন মানুষ। সন্তান হিসেবে যেমন নিজের অবস্থানটা ধরে রাখতে চেষ্টা করে, স্ত্রীয়ের কাছেও স্বামী হিসেবে তাই! কিন্তু এতো দিকে আসলে সামলে ওঠার ক্ষমতা সব সময় সবার হয়ে ওঠে না। কখনো কখনো কাউকে না কাউকে আত্নত্যাগ করে চলতে হয়। তবে জুনাইদের প্রতি এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র অভিযোগ নেই। কখনো করতে হয়ওনি। কারণ আমার ধারণা জুনাইদ আগে থেকে সব বুঝে যায়। এও বুঝে যায় সর্বদা দোষ একদিকে থাকে না। কখনো সখনো বিপরীত দিক থেকেও ঘটে থাকে। অভিযোগ আমার শ্বশুর শ্বাশুড়ির প্রতিও না! আছে কেবল আমাদের সমাজ ব্যবস্থার ওপর। মানুষ সভ্য প্রাণী। বেঁচে থাকতে তাদের দলবদ্ধ হয়ে বাঁচতে হয়। দলবদ্ধতার জের ধরেই উৎপত্তি হয়েছিল সমাজের। অথচ সেই সমাজই একসময় হয়ে ওঠে সমাজের মানুষগুলোরই মানসিক যন্ত্রণার কারণ। সমাজের তৈরি করা অবাঞ্ছিত কিছু নিয়মশৃঙ্খলার কারণেই আজকাল বেশিরভাগ আত্নহত্যার মতো ঘটনাগুলো প্রবল মাত্রায় বাড়ছে। সমাজের কিছু লোকমুখে প্রচলিত মতবিশ্বাসের কারণে অনেক বাবা মাকে মেয়ে সন্তানের চিন্তায় হৃদরোগের জন্য অকালে মরতে হচ্ছে। মাঝে মাঝে ধিক্কার জানাতে ইচ্ছে করে এহেন সমাজ ব্যবস্থাকে।
★
শ্বাশুড়ি মুখ ফুলিয়ে বসে আছেন। জুনাইদ কিছুক্ষণ আগে উনার কাছে ফোন করেছিল। জানিয়েছে শ্বাশুড়ি একাউন্টে কিছু টাকা পাঠিয়েছে, ইফতারি সমেত প্রয়োজনীয় যা যা লাগবে তারা যেন নিজেদের মতো সব কিনে নেয়। সেই সঙ্গে নিজের বউয়ের সম্পর্কে অনুরোধ করে এও বলল, তাকে যেন আর ওসব ব্যাপারে কিছু না বলেন তারা! শ্বাশুড়ি ওপর থেকে ছেলের কথায় সায় দিলেও অন্তর থেকে বেজায় রেগে গেলেন। আমাকে তাই নজরে পড়তে তিনি ফোঁড়ন কাটলেন, ” কী খাইয়ে বশ করেছ আমার ছেলেকে? ”
” কি বলছেন এসব? আমি কেন আপনার ছেলেকে……
” তা নয়ত কী? তোমার মা’কে দিয়ে তাবিজ-কবচের ব্যবস্থাটাও করে ফেললে বাহ্! ”
” আমি আপনার ছেলেকে তাবিজ করতে যাবো কেন? ”
” নাহলে জুনাইদ আমার ছেলে হয়ে নিজের শ্বাশুড়ির গুণগান গাইবে কেন হ্যাঁ? ” রাগে গজগজ করতে করতে তিনি বললেন, ” শোন একটা কথা তোমাকে বলে রাখছি, আমার ছেলেকে একদম আমার থেকে কেড়ে নেওয়ার চিন্তা মাথাতেও আনবা না। তাহলে তো বোঝই! ”
” মা আপনার ছেলে কিন্তু আমারও স্বামী! ” কথাটি না বলে থাকতে পারলাম না। তাতে করে উনার রাগে ভাটা তো পড়লই না বরঞ্চ রাগ উল্টো দাউ দাউ করে বাড়তে লাগল। ” কি বললে! ধমকে যে বললে জুনাইদ তোমার স্বামী! তা স্বামীটা এলো কই থেকে শুনি? ওকে তো আমিই পেটে ধরেছি। দশ মাস পেটে ধরছি, জন্মের পর লালন পালন করে এতদূর এনেছি। আর উনি অল্প কয়দিনে এসেই স্বামী দাবী করে। হুহহহহ একেবারে উনার স্বামী! ” তাচ্ছিল্যের সহিত কথাগুলো বললেন।
উনার কথার প্রতিত্তোরে আর কিচ্ছুটি বলার মুখ রইল না আমার। মৌনতা বজায় রেখে নিজের কাজে মন বসালাম।
রান্নাঘরে আজকের ইফতারের আয়োজন করছিলাম। চুলায় ছোলা এবং আলু প্রেসার কুকারে করে সিদ্ধ করতে দিয়ে নামাজের জন্য যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে আমার দেবর জামিলের ডাক পড়ল। ” ভাবী একটু এদিকে আসেন তো! ”
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জামিল। দেখে মনে হচ্ছে কোথাও বের হচ্ছে। সাধারণত নিজের ঘরের বাহিরে খুব একটা বের হতে দেখা যায় না তাকে। কিন্তু এখন বোঝাই যাচ্ছে একেবারে আঁটসাঁট বেঁধে তৈরি হয়ে সে নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। কাঁধে ঝোলানো একটা ব্যাগও নজরে পড়ল। কৌতুহলের বসবর্তী হয়ে জানতে জিজ্ঞেস করলাম, ” জ্বি! কোথাও যাচ্ছেন আপনি? ”
” হ্যাঁ ভাবী। সোমাদের ওদিকে যাবো। ” সোমা হলো আমার দেবরের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীয়ের নাম। সম্পর্কে আমার জা হয় সে। দেবরের ও বাড়ি যাওয়াটা অবান্তর কিছু নয়। তারওপর প্রেমের বিয়ে বলে কথা! বউয়ের জন্য তাই তার মনটাও সর্বদা উতলা হয়ে থাকে। কিন্তু বের হওয়ায় আগে নিজের মা’কে না ডেকে আমাকে ডাকার কারণটা ঠিক ধরতে করতে পারলাম না। বললাম,
” ভাইয়া কি কিছু বলবেন? নাহলে আমি রান্নাঘরে যেতাম নইলে পানি শুকিয়ে ছোলাগুলো কুকারের তলায় লেগে যাবে যে। ”
কথাটা বলতে বলতে সত্যিই জোরেসোরে পঞ্চমবারের মতো প্রেসার কুকাকের সিটি বাজল। চুলাটা বন্ধ করে দেওয়াটা জরুরী মনে হতেই সেদিকে ছুটে যাচ্ছিলাম ওমনি পেছন থেকে জামিলের ডাক পড়ল, ” জুতার র্যাক থেকে আমার নতুন জুতা জোড়া এনে দেন তো! ”
কম না হলেও র্যাকে তার জুতার সংখ্যা সাত ছাড়িয়ে। র্যাকে কোনো পুরনো জুতো নজরে পড়েনি। এ মুহুর্তে তাই তার নতুন জুতা নির্বাচন করাটাও বিরাট কষ্টসাধ্য কাজ বলে মনে হলো। তারওপর রান্নাঘরে না গেলেও বাড়বে বিপদ। শ্বাশুড়ি টের পেলে খবর করে ফেলবেন।
” ভাবী তাড়াতাড়ি করেন আমার দেরি হয়ে যাবে। ”
” বলছিলাম, ভাইয়া আমি তো আপনার জুতা ঠিক মতো জানব না তাই না? আপনি যদি একটু কষ্ট করে নিয়ে নিতেন? ”
” মানে কি? আমি যদি নিজে গিয়ে নিতে পারতাম তাহলে কি আর আপনাকে ডেকে আনতাম? ”
” তাহলে আপনি একটু দাঁড়ান আমি চুলাটা বন্ধ করে আসি। ”
আমার কথায় জামিল বেজায় বিরক্তবোধ করল। নিজেই নিজের জুতা জোড়া খুঁজে আনতে গেল হনহন করতে করতে আর বলতে বলতে,
” নখরামি বাদ দিয়ে দেন ভাবী। আমার ভাই দেখি আপনারে রাখছে আমি হইলে এই দুয়ার দিয়ে এনে ঐ দুয়ার দিয়ে বের করতাম আপনারে। মা শুধু শুধু আপনার সাথে চেঁচায় না ঠিকই আছে। যে যেমন তার কর্মফলও তেমন! ”
চলবে…….
[ ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন! ]