আমার পূর্ণতা পর্ব-১৩+১৪

0
588

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ১৩

তাফসির ভাইয়ের কথায় বড় মা ন্যাকা কান্না করে বললো—

” থাক তোর আর শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না। যা বোঝার বুঝেছি আমি।”

” বুঝেছো ঠিকই তবে প্রাচুর্যের মতো দু লাইন বেশি।”

এতোক্ষণ তাফসির ভাই আর বড় মা’র কাহিনী দেখে মনে মনে হাসছিলাম আমি। কিন্তু তার মধ্যে আমার নাম উঠতেই হাসি ভুলে রেগে তাফসির ভাইকে বললাম—

” আপনার সব সময় আমার নামই কেনো উঠাতে হয় তাফসির ভাই? মানে যে কথায় বলবেন না কেনো লাস্টে আমাকে খোঁচা না মেরে কথা শেষ করবেন না। সমস্যা কি আপনার?”

” তুই আবার আমার মুখে মুখে তর্ক করছিস? আমি বুঝি না এতো সাহস তোর আসে কোথা থেকে যে একটু কিছু বললেই তর্ক শুরু করিস?”

তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন—

” ছোট মা দেখেছো তোমার মেয়ের অবস্থা? বড়দের এক পয়সার ও সন্মান করে না তোমার মেয়ে।”

তাফসির ভাইয়ের কথায় মা চোখ পাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন—

” তুই কি দিন দিন বেয়াদব হচ্ছিস প্রাচুর্য? এই শিক্ষা দিয়েছিলাম তোকে? কি হলো বল!! বড়দের মুখে মুখে তর্ক করার শিক্ষা দিয়েছিলাম? তুই তো মানুষের সামনে আমার মান সন্মান ডুবাবি দেখছি।”

সবার মধ্যে মায়ের আমাকে করা অপমানে চোখ ঝাপসা হয়ে উঠলো আমার। আজব তো। এখানে আমার কি দোষ? উনি যে কন্টিনিউসলি আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে কোই তখন তো কেউ কিছু বলে না। আর আমি একটু কিছু বললেই তো দোষ। থাক সে তার ছেলেকে নিয়ে। আমি এখানে আর এক মুহুর্ত ও বসবো না ভেবে রুমের দিকে জোর পায়ে হাঁটা ধরলাম। তখন পেছন থেকে শুনতে পেলাম বড় মা বলছেন মা কে—

” ওকে এতো বকাঝকা করলি কেনো শাহানা? ছোট মানুষ ও। আমি আমার ছেলেকে ও তো চিনি। সব সময় মেয়েটার পেছনে লেগে থাকে। তাফসির এরপর ওর পেছনে লাগলে কিন্তু মার খাবি একদম”

তারপর আর কোনো কথা কানে আসলো না। ততোক্ষণে আমি রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি। খুব রাগ হচ্ছে তাফসির ভাইয়ের উপর। কিন্তু ওনাকে তো কিছু বলা সম্ভব না তাই নিজেই মনে মনে ফুসছিলাম। হঠাৎ চোখ পরলো ব্রেসলেট টার উপর। রাগে হাত থেকে খুলেই ছুড়ে মারলাম সেটা। গিয়ে পরলো দরজার সামনে। সেই মুহুর্তে ঘরে আসলো রাদিয়া আপু। নিচ থেকে ব্রেসলেট টা উঠিয়ে নিজের কাছে রাখলো। তারপর দরজা বন্ধ করে আমার পাশে এসে বসলো। আপুকে দেখে আমি মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলতে লাগলাম। তখনই আপু আমার কাধে হাত রেখে বললো—

” বনু?”

আপু ডাক দিতেও আমি কোনো উত্তর দিলাম না। চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। আমাকে কিছু বলতে না দেখে আপু পুনরায় বলে উঠলেন—

” কি হয়েছে আমার সোনা বনুর? এটুকু কথায় এতো রাগ করতে হয় নাকি?”

” এটাকে তোমার এটুকু কথা মনে হচ্ছে আপু? মা সবার সামনে আমাকে কিভাবে বললো দেখলে না? ফুপ্পি, ভাবি সবার সামনে আমাকে অপমান করলো তোমার ভাইয়ের জন্য। আর এটাকে তোমার এটুকু মনে হচ্ছে? ”

” আচ্ছা আমি বুঝেছি তো বনু। ছোট মা ভুলে বকে ফেলেছে। আর তুই সবার ছোট আদরের তো তাই তোকে আদর ও যেমন করে আবার ভালো ও তেমন বাসে। আর দেখ সামি,সাদনান তো সারাক্ষণ পড়া নিয়ে থাকে। মেজো মা ওদের বইয়ের থেকে উঠতেই দেয় না তাই ওরা দুষ্টুমি করার সুযোগ পায় না তেমন। দেখলি না এখানে ও বই এনেছে ডিসেম্বরে ওদের ফাইনাল পরীক্ষা বলে। তাই পরিবারের ছোট মেয়ে হিসেবে সবাই তোকেই ছোট ভাবে। আর ছোট দের দোষ পরিবারে একটু বেশিই হয়। তা বলে এতো মন খারাপ করতে হয় না।”

” সবাই আমাকে ভালোবাসলেও তোমার ভাই বাসে না আপু। সব সময় আমাকে অপমান করে।”

” ওর কথা বাদ দে। সময় আসলেই বুঝবি ওকে। এখন তারাতাড়ি চোখের পানি মুছে ফেল তো। চল আমরা বাইরে থেকে ঘুরে আসি। তোর আবির ভাইয়া ট্রিট দেবে সবাইকে। ”

” না আমি যাবো না আপু। যেখানে ওই শয়তান বিলাই টা থাকবে সেখানে আমি যাবোই না আর। না জানি আবার কখন অপমান করে বসে।”

” আরে না না। ও থাকবে না। ও বাইরে গিয়েছে। এখানে নাকি ওর কোন ফ্রেন্ড আছে তাই তার সাথে মিট করতে গিয়েছে। এখন তুই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয় তো। আমিও যেয়ে রেডি হয়ে আসছি।”

—————————

চট্টগ্রাম আরও তিন দিন থাকার পর চৌধুরী পরিবার ফিরে এলো ঢাকায়। সুফিয়া, মাহিন বা দিয়ানা কেউই আসতে দিতে চাই নি এতো তাড়াতাড়ি। তবুও কিছুই করার ছিলো না কারোরই। কারন প্রাচুর্যের পরীক্ষা সামনে, অফিস আছে সবার তার উপর আবার নতুন বিয়ে হয়েছে রাদিয়ার। বিয়ের পর যদি এতোদিন বাপের বাড়ি থাকে তবে বিষয়টা খারাপ দেখায়। তাই ইশতিয়াক চৌধুরীর কথায় সবাই ফিরে আসলো নিজো গৃহে। তবে সেদিনের পর থেকে প্রাচুর্য পুরোপুরি এড়িয়ে চলছে তাফসির কে। তাফসির প্রথম প্রথম বিষয়টা খেয়াল না করলেও একসময় সে ঠিকই বুঝতে পারে যে প্রাচুর্য এড়িয়ে চলছে তাকে। তখন থেকে শুরু হয় তার অস্থিরতা। হাজার বার প্রাচুর্যের সাথে কথা বলার চেষ্টা করলেও শেষে এসে ফলাফল শুন্যই ছিলো। কথা বলা তো দুরেরই কথা। তাফসিরকে দেখলেও একরকম এড়িয়ে চলা শুরু করলো প্রাচুর্য। এতে ভেতরে ভেতরে রাগে বা অস্থিরতায় তাফসির ফেটে গেলেও প্রকাশ করে নি তা। তবে মনে মনে প্রাচুর্যের এমন কাজ কর্মে ঠিকই ফুসছিলো। আর এদিকে প্রাচুর্য সব কিছুই খেয়াল করেছিলো প্রথম থেকেই। তবে না বোঝার ভান করে ছিলো।

এমনই একদিন সকাল বেলা প্রাচুর্য বের হলো কলেজে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু তখনই বাধ সাধলো তাফসির। সে একা হেঁটে হেঁটে কিছুতেই কলেজে যেতে দেবে না প্রাচুর্যকে। সেই নিয়ে যাবে আবার সে-ই বাড়িতে নিয়ে আসবে। অন্তত যতোদিন বাংলাদেশে আছে ততোদিন। বাড়ির মেয়েকে নিয়ে আর রিস্ক নেবে না কেউ-ই। কিন্তু প্রাচুর্যের এক কথা সে কিছুতেই তাফসিরের সাথে যাবে না তো যাবেই না। সবাই কারন জিজ্ঞেস করলেও নির্দিষ্ট কোনো কারন দেখাতে পারলো না প্রাচুর্য। তখন মেজাজ খারাপ হলো তাফসিরের। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো তার। হাত মুষ্টি বদ্ধ করে গরম চোখে তাকালো প্রাচুর্যের দিকে। যা দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে আসলো প্রাচুর্যের। কিন্তু তবুও গাঁট হয়ে এক জায়গায় ঠাঁই বসে থাকলো। যেনো যায় হয়ে যাক না কেনো এমন বেয়াদব লোকের সাথে সে কিছুতেই যাবে না। দেখা গেলো আবার অপমান করলো তাকে। কিন্তু দ্বিতীয় বার আর সহ্য করবে না সে।
কিন্তু এইবার ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেলো তাফসিরের। সে বুঝে উঠতে পারলো না কি এমন হয়েছে যে এই মেয়ে এমন নাটক শুরু করেছে। তাদের কথার মধ্যেই নিজের ঘর থেকে বের হয়ে এলেন শাহানা। এতোক্ষন তিনি এখানে উপস্থিত ছিলেন না। কিন্তু নিচ থেকে এতো চেঁচামেচির আওয়াজে কি হয়েছে দেখতে বাইরে এলেন তিনি। প্রাচুর্য এক পলক মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে বসে পরলো আগের মতো। তখন শাহানা তাফসিরের দিকে তাকিয়ে বললেন—

” কি হয়েছে আব্বু? তোরা সবাই এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? আর এতো চেচামেচি কিসের?”

” কি হয়েছে সেটা আমাকে না জিজ্ঞেস করে তোমার মেয়েকে জিজ্ঞেস করো ছোট মা। আধা ঘন্টা ধরে বলছি যে প্রাচুর্য চল তোকে কলেজে দিয়ে আসি। আগের দিন যে ঘটনা ঘটেছে তাতে এখন তোর একা একা যাওয়া সেফ না। কিন্তু তোমার মেয়ে নাটক শুরু করেছে। সে নাকি আমার সাথে যাবে না।”

তাফসিরের কথায় শাহানা প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে বললেন—

” কি সমস্যা তোর? ওর সাথে যাবি না কেনো? আগের দিনের পরও শিক্ষা হয় নি তোর?”

প্রাচুর্য অনড়ভাবে বললো—

” মা আমি তো একবার ও বলি নি যে আমি যাবো না। আমি শুধু ওনার সাথে যেতে চাই না। অন্য কাউকে বলো এগিয়ে দিয়ে আসতে।”

” হ্যাঁ অন্যকেউ তো তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বসে আছে এখনো তাই না?”

” কেনো বাবা আছে না? বাবাকে বলো আমাকে নিয়ে যেতে।”

” তোমার বাবারা সবাই সেই সাত সকালে বেড়িয়ে গেছে অফিসের জন্য। আজকে মিটিং আছে অফিসে তাই সব কিছু রেডি হওয়ার জন্য আগে আগেই বেড়িয়ে গেছে বুঝেছো? এখন তাফসির ছাড়া গতি নেই তোমার। আর আজকে না তোর ক্লাস টেস্ট? আর তুই এখনো বসে আছিস?”

” মা বললাম তো…

প্রাচুর্য কথা শেষ করার আগেই শাহানা দাতে দাত চেপে বললেন—

” তোমার কোনো কথা বা নাটক আমি দেখতেও চাই না আর শুনতেও চাই না। তুমি ওর সাথে যাচ্ছো তো যাচ্ছোই। এবার আর একটা কথাও বললে চড় একটাও নিচে পরবে না বলে দিলাম। এবার ভদ্র মেয়ের মতো চলে যাও।”

শাহানার থ্রেড দেওয়াতে আর কিছু বলতে পারলো না প্রাচুর্য। মুখ ফুলিয়ে ব্যাগ নিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেলো বাইরে। তার কিছুক্ষণ পরে তাফসির ও এলো হাতে চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে। গাড়ি বের করে ফ্রন্ট সিটের দরজা খুলে দিলো প্রাচুর্যকে ওঠার জন্য। প্রাচুর্য একপলক তাফসিরের দিকে তাকিয়ে উঠে বসতেই তাফসির গাড়ি স্টার্ট দিলো।
.
.
.
প্রাচুর্যদের কলেজের সামনে আসতেই গাড়ি ব্রেক কষলো তাফসির। প্রাচুর্য নেমে যেতে উদ্যত হলেই প্রাচুর্যের ডান হাত টেনে ধরলো তাফসির। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে হাতে নিয়ে সামনে তাকিয়েই বললো—

” আমাকে ইগনোর করার কারন জানতে পারি?”

” অবশ্যই। কেনো পারবেন না? আপনাকে ইগনোর করার কারন আপনি আমাকে অপমান করেন। আর সেটা একবার দু’বার নয়। প্রত্যেক কথায় কথায় আমাকে অপমান করেন এবং খোঁচা দিয়ে কথা বলেন যেটা সহ্য হয় না আমার।”

” হাতের ব্রেসলেট খুলে ফেলে দেওয়ার ও কি কারন এটা?”

তাফসির এ কথা বলতেই প্রাচুর্য চুপ হয়ে গেলো। তাফসির পুনরায় বললো—

” শুধু নিজের অপমান টা-ই দেখলি? আর এটা করে যে আমাকে অপমান করলি তখন?”

#চলবে

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ১৪

” এখানে অপমানের কি দেখলেন?”

” অপমান না বলছিস? এইযে হাত থেকে ব্রেসলেট খুলে ছুড়ে মারলি এটা তো অপমান-ই। ”

তাফসিরের কথায় ভ্রু কুঁচকে উঠলো প্রাচুর্যের। কারন কথাটা তাফসির একটু করুন সুরেই বলেছে। প্রাচুর্যের মনে হলো এখন তাফসির নাটক করছে। কারন এই সামান্য কারনে এখানে অপমানের কি দেখলো সে। আর অপমান করলেও অন্তত তার থেকে তো কম করেছে। কিন্তু এখন এতো কিছু ভাবার সময় নেই। অলরেডি ঘন্টা দিয়ে দিয়েছে কলেজের। তাই প্রাচুর্য ব্যস্ত কন্ঠে বললো—

” তাফসির ভাই আমি যায় এখন। ঘন্টা দিয়ে দিয়েছে। আরেকটু দেরি হলে স্যার ঢুকতে দিবে না ক্লাসে।”

প্রাচুর্যের কথায় তাফসির পকেট থেকে ব্রেসলেট বের করে প্রাচুর্যের হাতে পরিয়ে দিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো—

” আর কখনো যেনো এটা খুলতে না দেখি। যদি কখনো খুলিস তবে সেদিন দেখবি আমি কতোটা খারাপ।”

গম্ভীর অথচ শান্ত কন্ঠে প্রাচুর্যকে থ্রেড দিয়ে হাত ছেড়ে দিলো তাফসির। কিন্তু তখনও প্রাচুর্য অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তাফসিরের দিকে। যা দেখে তাফসির বললো—

” যা। ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। ছুটির সময় নিতে আসবো। ভদ্র মেয়ের মতো চলে আসবি। এখানেই অপেক্ষা করবো।”

———————

রিয়া সাধারণত সব সময় একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। তার বন্ধু বান্ধব নেই বললেই চলে। ক্লাসমেট কারোর সাথে দেখা হলে হাই হ্যালো পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। এর বেশি কিছু না। আর তার এমন একা থাকার সব থেকে বড় কারন হলো তার মা। ছোট থেকেই তার মা তাকে বন্ধু বান্ধব এর সাথে খুব কমই মিশতে দিয়েছে। কোথাও গেলে সাথে করে নিয়ে গেছে এবং সাথে করে এনেছে। বাড়িতে থাকলে বেশির ভাগ সময়ই বই নিয়ে বসিয়ে রাখতো। খেলাধুলা ও খুব কমই করেছে ছোট কালে। অন্য আর পাঁচটা ছেলে মেয়ে যখন খেলাধুলা করেছে তখন দেখা গেছে তার মা তাকে ঘরে দরজা বন্ধ করে পড়াচ্ছে। এখন সামি,সাদনানের সাথেও ঠিক তাই করছে। আর সেই স্বভাব এখনো পর্যন্ত থেকে গেছে তার। সে পারে না সহজে কারো সাথে মিশতে বা বন্ধুত্ব করতে। বাড়ির মানুষ গুলোই যে তার সব। অবশ্য তারা সাথে থাকলে বাড়তি কোনো বন্ধুর দরকার পরে না তার। তবে ইদানীং তার বন্ধু হয়েছে একটা। মেয়ে বন্ধু নয় ছেলে বন্ধু। বন্ধুত্বের শুরুটাও হয়েছিলো খুব সাধারণ ভাবেই। এখনো তার মনে পরে সেদিন টার কথা যেদিন প্রথম দেখা হয়েছিলো আরফানের সাথে।

সেদিন ছিলো সোমবার। চট্টগ্রাম যাওয়ার আগে। রিয়া ভার্সিটি শেষ করে বাড়ি ফিরছিলো তখন। সে বেশিরভাগ সময়ই বাড়ির গাড়িতে যাতায়াত করে। সময় বিশেষ হয়তো রিকশা ব্যবহার করে। তবে নিত্যদিনের মতো সেদিনও গাড়িতে আসছিলো সে। কিন্তু পথিমধ্যে ভিড় দেখে ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলে জিজ্ঞেস করলো—

” আঙ্কেল এখানে এতো ভিড় কেনো? কোনো সমস্যা হলো নাকি?”

” তাতো জানি না মামনি। হয়তো কিছু হয়েছে।”

এর মধ্যেই গাড়ির জানালায় ব্যস্ত ভাবে টোকা দিলো কেউ। রিয়া জানালার কাচ নামাতেই সুঠামদেহের অধিকারী একজন যুবক বলে উঠলো —

” ম্যাডাম একটু সাহায্য করবেন? পাশে একটা এক্সিডেন্টে হয়েছে। গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। প্লিজ একটু সাহায্য করুন।”

লোকটির কথা শুনে ড্রাইভার রিয়ার দিকে তাকালো। কিন্তু এদিকে চিন্তায় পরে গেলো রিয়া। পরমুহূর্তেই ভাবলো মানুষের উপকার করা উত্তম কাজ। কোনো মানুষকে এমন আহত রেখে চলে যাওয়া মনুষ্যত্বের ভেতর পরে না। তাই সে আহত ব্যাক্তিকে নিয়ে আসতে বলে ফ্রন্ট সিটে চলে গেলো। সাথে সাথে রাস্তার কিছু লোক মিলে ধরে একজন মধ্যবয়স্ক লোককে গাড়িতে উঠিয়ে দিলো। সাথে উঠে বসলো চশমা পড়ুয়া সেই সুঠাম দেহের পুরুষটি। সাথে সাথেই তাড়া লাগিয়ে বললো হসপিটাল যাওয়ার জন্য কারন লোকটি গুরুতর ভাবে আহত। যুবকটির কথা মতো ড্রাইভার ও গাড়ি চালাতে শুরু করলো। তার মধ্যে এবার রিয়া পেছনে ফিরে তাকালো আহত লোকটির দিকে। বয়সে হয়তো বড় বাবা অর্থাৎ ইশতিয়াক চৌধুরীর বয়সের হবেন। রিয়া এবার সেই সুঠাম দেহের যুবকের দিকে ফিরে তাকালো। বয়স হয়তো বেশি হবে না। তাফসিরের মতোই হবে। তার থেকে দু-এক বছরের ছোট হতে পারে। কিছুটা উজ্জ্বল শ্যামলা ধরনের যুবকটির দিকে তাকিয়ে রিয়া জিজ্ঞেস করলো—

” ওনার কি হয়েছে? এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?”

” উনি আসলে রিক্সা চালান। আমি লোকমুখে যা শুনলাম তা হলো উনি নাকি রিকশা ঘুরিয়ে আনতে যাচ্ছিলেন তখন বিপরীত দিক থেকে একটা সিএনজি আসছিলো। তখন সেই সিএনজি এসে ওনার রিকশার সাথে সংঘর্ষ হয়। তখন উনি ছিটকে নিচে পরেন। দেখে মনে হচ্ছে হাত ভেঙে গেছে আর মাথা ফেটেছে।”

” খুবই দুঃখ জনক ঘটনা। ইশ এখন কি হবে ওনার পরিবারের? চলবে কিভাবে ওরা। দেখে তো মনে হচ্ছে অনেকদিন কাজ করতেও পারবে না।”

রিয়ার কথায় লোকটি চিন্তিত ভঙ্গিতে বললো—

” চিন্তা করবেন না ম্যাডাম। আল্লাহ কোনো ব্যবস্থা করে দেবেন। ”

” বার বার ম্যাডাম ম্যাডাম করছেন কেনো? আমার নাম রিয়া। রিয়া বলে ডাকুন। ম্যাডাম ডাকলে নিজেকে অনেক বড় বড় লাগে।”

” বেশ তবে তাই হোক। রিয়া বলেই ডাকবো।”

” আপনার নাম?”

” আমার নাম আরফান। আরফান খন্দকার।”

এর মধ্যেই গাড়ি এসে থামলো হসপিটালের সামনে। ড্রাইভার ও আরফান মিলে হসপিটালের ভেতরে নিয়ে গেলো লোকটিকে। সাথে সাথে নিয়ে যাওয়া হলো চেক-আপ করানোর জন্য। আরফান যা ভেবেছিলো তাই মাথা এবং হাতে ইনজুরি হয়েছে। রক্ত লাগবে এক ব্যাগ। সাথে অপারেশনের জন্য কাউন্টারে ৩০ হাজার টাকা জমা দিতে হবে। যা শুনেই মুখ শুকিয়ে গেলো আরফানের। আরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে রিয়া হয়তো কিছুটা আন্দাজ করেছে তাই আর কিছু না বলে তার একাউন্ট থেকে টাকা তুলে রিসিপশনে জমা দিলো। তখন লোকটি রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো—

” আপনাকে ধন্যবাদ রিয়া এভাবে সাহায্য করার জন্য।”

” এখানে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই মিস্টার আরফান। কাউকে বিপদে সাহায্য না করার শিক্ষা আমি পাই নি।”

” নিঃসন্দেহে আপনার পরিবারের মানুষ মহৎই।”

” উমম বলতে পারেন তা ঠিক। আমার পরিবারের মানুষ গুলো অনেক ভালো।”

” বেশ তবে চলুন কফি খেয়ে আসি। ওনার অপারেশন করতে সময় লাগবে অনেক। ততোক্ষণ গল্প করা যাক।”

” বেশ চলুন তবে।”

সেই থেকেই পরিচয় দু’জনের। আরফান সেদিন নাম্বার নিয়েছিলো রিয়ার। যদিও সেটা দরকারি কাজেই। তবে তার পর থেকেই কথা চলছে তাদের।

———————

আজ প্রাচুর্যের কলেজে ক্লাস টেস্ট হওয়ার কথা থাকলেও তা ক্যানসেল হলো কোনো কারন বশত। তবে ক্লাস হলো সবগুলো। তাই প্রাচুর্য সব ক্লাস শেষ করে কলেজ থেকে বের হতেই দেখলো তাফসির গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফোন টিপছে। প্রাচুর্য মনে মনে বেশ বিরক্ত হয়ে বিরবির করে বললো—

“দেখো এমন এটিটিউড নিয়ে দাড়িয়ে আছে যেনো কোন প্রেসিডেন্ট। দেখে মনে হচ্ছে ভাজা মাছটা ও উল্টে খেতে জানে না। অথচ আমি তো জানি এই লোকটা কি পরিমান শয়তান। ”

প্রাচুর্যকে বিরবির করতে করতে গাড়ির দিকে আসতে দেখেই তাফসির সোজা হয়ে দাঁড়ালো। প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে বললো—

” এমন পাগলের মতো বিরবির করছিস কেনো?”

প্রাচুর্য দাঁত বের করে হেঁসে কথা পাল্টিয়ে বললো—

” বলছিলাম যে আজকে আপনাকে খুব সুন্দর লাগছে তাফসির ভাই। একদম তুর্কীর হিরো দের মতো।”

প্রাচুর্যের কথা তাফসিরের বিশ্বাস হলো না। কারন সে খুব ভালো করেই প্রাচুর্যকে চেনে। কিন্তু তবুও কিছু না বলে চললো বাড়ির দিকে।
.
.
.
.
রাত তখন প্রায় নয়টা। এ সময় বাড়ির তিন গিন্নি সিরিয়াল দেখতে ব্যস্ত থাকে এবং তিন কর্তা বাইরে যান চা খেতে এবং একটু হাটাহাটি করতে। আর মেয়েরা নিজেদের রুমে ব্যস্ত থাকে নিজেদের পড়ালেখা নিয়ে। বাংলাদেশে আসার পর তাফসির সন্ধ্যার পরপরই বাইরে চলে যায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। তবে আজ তার ব্যতিক্রম ছিলো। আজ অফিসের ভিডিও কনফারেন্স ছিলো। ছুটিতে থেকেও শান্তি নেই। এতো দুর থেকেও তার কনফারেন্সে জয়েন্ট হতে হচ্ছে। দীর্ঘ দু ঘন্টা ইংলিশে বকবক করার পর অবশেষে শেষ হলো কনফারেন্স। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তার সাথে মাথা ব্যাথা তো আছেই। তাই পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ালো তাফসির। দোতলা থেকে লিভিং রুম স্পষ্ট দেখা যায়। তাই দোতলায় দাড়িয়ে মা’কে ডেকে বললো এক কাপ ব্লাক কফি দিয়ে যেতে। ছেলের কথা শুনে মিসেস ফারাহ উঠে গেলেন ছেলের জন্য কফি বানাতে। হঠাৎ তার কিছু একটা মনে পরতেই তাড়াতাড়ি কফি বানিয়ে ছুটলেন ছেলের রুমের দিকে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে