আমার পূর্ণতা পর্ব-১১+১২

0
565

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশী_ইসলাম
পর্বঃ ১১

বেলা ৮ টা বেজে ৩০ মিনিট। তাফসির রুমে প্রবেশ করে পকেট থেকে ফোন বের করে টেবিলের উপর রাখলো। তারপর ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে। সে এতোক্ষণ বাড়িতে ছিলো না। সকালে জগিং করতে গিয়েছিলো। ফিরলো মাত্রই।

তাফসির ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে হাতে এসির রিমট তুলে নিলো। তারপর এসি অন করে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। ঘরের মোটা পর্দা গুলো এখনো জানালার গ্লাস ঢেকে আছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সরানো হয় নি তা। সাধারণত সে অন্ধকার রুমই পছন্দ করে। অন্ধকার রুমে তার শান্তি অনুভব হয়। তাই বেশিরভাগ সময়ই ঘরে আলো পৌছায় না। কিন্তু বাড়িতে থাকলে মিসেস ফারাহ প্রতিদিন এসে পর্দা সরিয়ে দেয় যাতে ঘরে আলো বাতাস প্রবেশ করে। আবার তাফসিরকেও বকাঝকা করে ঘর সব সময় অন্ধকার করে রাখার জন্য। তবুও তাফসির কিছু বলে না। উপভোগ করে মায়ের দেওয়া বকা গুলো। এতো গুলো বছর খুব মিস করেছে মা’কে। প্রিয় মানুষ গুলো ছাড়া দুরে থাকার কষ্ট অনুভব করেছে প্রত্যেক মুহুর্তে।

এর মধ্যেই টেবিলের উপর মৃদু শব্দ করে ফোন বেজে উঠলো তার। সোফা থেকে উঠে দাড়ালো তাফসির। টেবিল থেকে ফোন হাতে নিতেই দেখলো শাহিনের কল। তাফসির ফোন রিসিভ করে কথা বললো কিছুক্ষণ। কথা বলা শেষ করে ফোন নামাতেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠলো আধ ঘন্টা আগে দেওয়া রিয়ার আইডি থেকে আসা মেসেজ খানা। যা দেখেই কপাল কুচকে উঠলো তাফসিরের। ” আপনার কয়ডা লাগে তাফসির ভাই?” মেসেজ খানার মানে বুঝলো না সে। কনটাক্ট লিস্টে যেয়ে রিয়ার নাম্বার বের করে ডায়াল করলো তাতে।

রিয়া প্রাচুর্যের সাথে গল্প করছিলো তখন। দুজনে মিলে আলোচনা করছিলো চট্টগ্রামের বিভিন্ন টুরিস্ট স্পট সম্পর্কে। বিকালে কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায় বা কাকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলবে তা নিয়ে গভীর আলোচনা তাদের। এর মধ্যে পাশে থাকা ফোন খানা ভাইব্রেট হলো তার। ফোন হাতে নিয়ে তাফসিরের নাম দেখতেই অবাক হলো সে। ভাবতে থাকলো হঠাৎ তাকে ফোন দেওয়ার কারন। রিয়াকে এতো ভাবনা চিন্তা করতে দেখে প্রাচুর্যর কৌতুহল হলো। সে রিয়াকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বললো—

” কি হলো আপু? কি ভাবছো এতো? কে কল দিয়েছে? ফোনটা রিসিভ করো।”

” তাফসির ভাই ফোন দিয়েছে প্রাচুর্য। আমি ভাবছি একই বাড়িতে পাশাপাশি রুম হওয়ার পরও আমাকে ফোন দেওয়ার কারন।”

” এতো ভাবাভাবি পরে কইরো। আগে রিসিভ করো নাহলে কেটে যাবে আবার। অলরেডি দু’বার ফোন দেওয়া হয়ে গিয়েছে।”

ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে ফোন রিসিভ করলো রিয়া। কিন্তু রিসিভ করতেই তাফসির থেকে ধমক খেলো প্রথমে ফোন রিসিভ করতে এতো দেরি হওয়ায়। রিয়া চুপসে গিয়ে মিন মিন করে বললো—

” সরি ভাইয়া। বুঝতে পারি নি। ফোন কাছে ছিলো না তো তাই “___তাফসিরের কাছ থেকে বাচতে মিথ্যা বললো রিয়া।

” ২ মিনিটের মধ্যে আমার রুমে আয়।”

” আসছি ভাইয়া।”

তাফসির কল কাটতেই চিন্তায় পরে গেলো রিয়া। তাফসির আবার তাকে ডাকলো কেনো? কোনো দরকার ছাড়া তো ডাকা মানুষ না সে। কিন্তু ডেকেছে নিশ্চয়ই কোনো জরুরি দরকার তাই আর কিছু না ভেবে উঠে দাড়ালো রিয়া। রিয়াকে উঠতে দেখেই প্রাচুর্য বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকলো কিন্তু রিয়া কোনো উত্তর দিলো না। শুধু বললো— ” জানি না। তাফসির ভাইয়া ডাকছে এক্ষুনি।” বলে রুম থেকে বের হয়ে গেলো।

রিয়া তাফসিরের রুমের সামনে যেয়ে দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে দিলো তাফসির। রিয়া ভেতরে ঢুকে তাফসিরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো—

” কি হয়েছে ভাইয়া? ডাকলে যে? কোনো সমস্যা?”

” এসব কি মেসেজ দিয়েছিস? আমার কয়ডা লাগে মানে? এসব কি ধরনের কথা রিয়া?”

” আমি দিয়েছি? কোই আমি তো তোমাকে কোনো মেসেজ দি নি।”

” তাহলে কি আমি মিথ্যা বলছি? তোর আইডি থেকে ভুত এসে মেসেজ দেই নি নিশ্চয়?”

” বিশ্বাস করো ভাইয়া আমি দিই নি। আমি জানি না কে দিয়েছে। আচ্ছা মেসেজের সময় টা বলো তো। কখন এসেছে মেসেজ?”

” ৭ টা ৫০ মিনিটে।”

“তখন তো…..এক মিনিট এক মিনিট তখন তো প্রাচুর্য ছিলো রুমে। তার মানে ওই দিয়েছে মেসেজ।”

” মানে টা কি? ও কেনো দেবে এই মেসেজ?”

” দাঁড়াও আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করছি।”

” না তোর কিছু বলা লাগবে না এখন। আমার রুমে পাঠিয়ে দে। যা বলার বা জিজ্ঞেস করার আমি করছি।”
.
.
প্রাচুর্য শুয়ে শুয়ে ম্যাসেন্জারে কথা বলছিলো প্রিয়তীর সাথে। এর মধ্যে ঘরে প্রবেশ করলো রিয়া। প্রাচুর্যকে দেখেই মেজাজ খারাপ হলো তার। মেয়েটা কিনা তার আইডি দিয়েই এমন মেসেজ করলো তাফসির ভাইকে? কেনো দিয়েছে তার বুঝতে বাকি নেই আর। এমনিতেই সে কিনা ভয় পায় তাফসিরকে আবার তার ফোন দিয়েই মেসেজ দিলো। সাহস কতো বড় মেয়ের। রিয়া রাগে বিছানার উপর থেকে বালিশ নিয়ে ছুঁড়ে দিলো প্রাচুর্যের গায়ে। তাতে হাতে থাকা মোবাইল ফোন ধাপ করে পরলো প্রাচুর্যের নাকের উপর। খানিক ব্যাথা পেয়ে নাক ডলতে ডলতে উঠে বসলো প্রাচুর্য। রিয়ার দিকে তাকিয়ে মুখ খিচিয়ে বললো—

” কি সমস্যা আপু? বালিশ ছুঁড়ে মারলে কেনো? দেখলে না ব্যাথা পেলাম।”

” শুধু তো বালিশ ছুঁড়ে মারলাম। কিন্তু তোকে তো থাপড়ানো উচিত।”

” আজব তো। আমি আবার কি করলাম?”

” কি করেছিস সেইটা ভাইয়া ভালো বলবে। যা ভাইয়া ডাকছে তোকে।”

” উনি আবার আমাকে ডাকছে কেনো? আর তুমি না এতোক্ষণ ওনার ঘরে ছিলে? কি বললো উনি?”

” এতো প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। তুই যাবি কিনা বল। নাহলে যেয়ে বলে আসছি তুই যেতে পারবি না। তখন বুঝবি মজা।”

” এই না দাঁড়াও যাচ্ছি। একটু সময় তো দিবে বাবা।”

প্রাচুর্য তাফসিরের ঘরের সামনে এসে ব্রেক কষলো। নক করা ছাড়াই দরজার হাতল ঘুরালো সাথে সাথে খট করে খুলে গেলো দরজাটা। প্রাচুর্য দরজা দিলে খানিকটা মাথা ঢুকালো ঘরের মধ্যে। উঁকি দিয়ে তাফসিরের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলো। তাফসির তখন সোফায় বসে মোবাইল টিপছিলো। প্রাচুর্য তাফসিরের উদ্দেশ্যে বললো—

” তাফসির ভাই ভেতরে আসবো?”

তাফসির ফোন থেকে মাথা উঠিয়ে প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে বললো—

” আয়”

প্রাচুর্য ভেতরে ঢুকে সোজা হয়ে দাড়ালো। তাফসির সামনে রাখা সেন্টি কফি টেবিলের উপর ফোন রেখে উঠে দারালো। পকেটে দু’হাতে ভরে প্রাচুর্যের দিকে তাকিয়ে বললো—

” অন্যের ফোন দিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বলছিস কেনো?”

” আমি আবার কি বললাম?”

প্রাচুর্যের কথায় তাফসির হাতে ফোন উঠিয়ে নিলো। পাওয়ার বাটন টিপে ফোনের নিচে স্ক্রিনের উপর আলতো স্পর্শ করতেই খুলে গেলো লক। সাথে সাথে উন্মুক্ত হলো প্রাচুর্যের দেওয়া ম্যাসেজ। তৎক্ষনাৎ প্রাচুর্যের মনে পরলো সকালে বলা কথা টা। মনে মনে ভয় পেলেও প্রকাশ করলাম না বিশেষ। ফোন থেকে মাথা উঁচিয়ে তাফসির ভাইয়ের দিকে তাকাতেই উনি দুই ভ্রু নাচালেন। তা দেখে হকচকিয়ে গেলো প্রাচুর্য। রুমের অন্য দিকে তাকানোর ভান করে বললো—

” ঠিক ই তো বলেছি তাফসির ভাই। আপনার কয়টা লাগে বলুন তো।”

” কি শুরু করেছিস তুই? থাপ্রিয়ে গাল লাল করে ফেলবো। সেই কখন থেকে কয়টা লাগে কয়টা লাগে শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে আমার। আর একবার যদি ওই কথা মুখে আনিস তবে তোর একদিন কি আর আমার একদিন।”

” আরে রাগ করছেন কেনো? কথাটা তো শুনবেন আপনি। আপনার কয়ডা লাগে মানে হলো গার্লফ্রেন্ড। আপনার কয়ডা গার্লফ্রেন্ড লাগে তাই বললাম।”

” তা আমার কয়টা গার্লফ্রেন্ডকে দেখেছিস তুই?”

” এখনো পর্যন্ত একটা কে ও দেখি নি। তবে জানি আপনার ২ টা গার্লফ্রেন্ড।”

” সিরিয়াসলি প্রাচুর্য? আমার দুইটা গার্লফ্রেন্ড অথচ আমি নিজেও জানি না বাহ। আচ্ছা বল কে কে?”

” কে কে তাতো আমিও জানি না। কিন্তু দেখেছি আপনাকে ফোনে একজন আই লাভ ইউ লিখেছিলো। আপনি যে আধ ঘন্টা ফেলায় তার সাথে চ্যাট করেছেন এটাও দেখেছি। এই গেলো একজন। আরেকজন হলো আজকে সকালের মেয়েটি। যার সাথে বত্রিশ পা-টি দাঁত বের করে কথা বলছিলেন। এবার বুঝলেন তো ওই কথার মানে?”

” তুই যে একটা গাধা তাতো আমি আগে থেকেই জানতাম তবে এখন পুরোপুরি সিওর হলাম। গাধামির ও একটা লিমিট থাকে কিন্তু তুই সেইটাও ক্রস করছিস।”

” এখানে গাধামির কি করলাম? মানুষ বলে শোনা কথায় কান দিতে নেই। কিন্তু আমি তো শুনি নি প্রথমটা নিজের চোখে দেখেছি। আর দ্বিতীয় টা যদিও শোনা কথা কিন্তু যিনি বলেছেন তিনি তো মিথ্যা বলবে না কোনোদিন।”

আমার কথা শুনে তাফসির ভাই চোখ গরম করে বললেন—

” তুই এক্ষুনি বের হ আমার রুম থেকে। এক সেকেন্ড ও যেনো আমার চোখের সামনে না দেখি। তোরে আমার সহ্য হচ্ছে না বা*। যা বের হ।”

তাফসিরের কথায় অপমান বোধ করলো প্রাচুর্য। রুম থেকে বের হতে হতে বললো—

” অপমান করলেন তো তাফসির ভাই? ঠিক আছে চলে যাচ্ছি। তবে এর শোধ আমি নিবো দেখিয়েন।”

————————

চট্টগ্রাম সাধারণত পাহাড়, সমুদ্র, উপত্যকা ও বন বনানীর কারনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম লীলাভূমি। চট্টগ্রামের মানুষদের ভাগ্যবতী বলায় চলে কারন যখন মন খারাপ হয় তখন অনায়াসে সমুদ্র বিলাস করতে পারে বা ইচ্ছে হলেই পাহাড় দেখতে পারে। তাছাড়া ও চট্টগ্রামে আছে চোখ জুড়ানো সৌন্দর্যে ঘেরা মনোরম স্থান। কিন্তু এতো এতো জায়গা থাকতে প্রাচুর্যের সমুদ্র দেখতে ইচ্ছা হলো আজ। তাই সকাল থেকেই বড় বাবার কানের ধারে ঘ্যান ঘ্যান শুরু করলো যাতে সে সবাইকে নিয়ে যায়। কিন্তু ইশতিয়াক চৌধুরী আগেও অনেকবার চট্টগ্রাম এসেছে অফিসের কাজে। তখন তিনি বেশ কয়েকবার দেখেছে সমুদ্র তাই আর সেখানে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। আর ঘুরাঘুরি এমনিও তার বিশেষ পছন্দ নয়।

ইশতিয়াক চৌধুরী যান নি বলে যাওয়া হলো না ইকরাম ও ইনসাফ চৌধুরীর সাথে বাড়ির গিন্নিদের। যেহেতু বাড়ির কর্তারা ই যাচ্ছেন না তাই তাদের ও যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মেয়ের আবদার বলে কথা। ইশতিয়াক চৌধুরী পুরন না করে পারেন না। তাই বললেন বাড়ির অন্যদের ঘুরে আসতে। তাই দুপুর দুপুর খেয়ে বেরিয়ে পরলো সবাই চট্টগ্রাম পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত দেখার উদ্দেশ্যে। সাথে মাহিন আর তার স্ত্রী দিয়ানা ও আছে বটে।

চট্টগ্রাম সমুদ্র সৈকত বন্দরনগরী চট্টগ্রামের একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। এটি মুলত কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। চট্টগ্রাম শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত পতেঙ্গা। ১৯৯১ সালে ঘুর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ সৈকত। কিন্তু বর্তমানে রক্ষণাবেক্ষণের পর সৈকতের সৌন্দর্য বেড়েছে অনেক সাথে দিনের পর দিন জনপ্রিয়তা ও লাভ করছে।

প্রাচুর্যরা ঘোরাফেরা করে সমুদ্র সৈকতে অবস্থিত রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো। অর্ডার করলো বিভিন্ন ধরনের সি-ফুড। এতোক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত সে। কিন্তু এখনো শেষ হয় নি সব। খাওয়া শেষ করে সবাই যাবে রেস্টুরেন্টের বিপরীত পাশে অবস্থিত বার্মিজ মার্কেটে। সমুদ্র সৈকতে এসেছে আর বার্মিজ মার্কেটে যাবে না তা তো হতেই পারে না। তাই তারা তাড়াতাড়ি খেয়ে বার্মিজ মার্কেটে গেলো কেনাকাটা করতে। সবার জন্য বিভিন্ন ধরনের জিনিস কিনলো। সাথে বন্ধু মহলের জন্য কেনাকাটা করতেও ভুললো না প্রাচুর্য।

প্রায় রাত সাড়ে দশটা নাগাদ বাড়িতে ফিরলো তারা। একবার জ্যাম লাগলে সহজে ছাড়তেই চাই না তাই এতো দেরি হলো তাদের। সবাই ক্লান্ত থাকায় খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে রুমে চলে গেলো।
প্রাচুর্য মায়ের সাথে কথা বলে রুমে আসছিলো। রিয়া আগেই চলে গিয়েছে রুমে। মিসেস শাহানা প্রাচুর্যকে ডাকায় দেরি হলো তার।
প্রাচুর্য রুমে ঢোকার আগ মুহুর্তে কল এলো ফোনে। স্ক্রিনে তাফসির ভাই নাম দেখেই ভ্রু কুঁচকে উঠলো তার। আজকে সন্ধ্যায় নাম্বার নিতে না নিতেই এখন কল বাহ!! প্রাচুর্য রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে তাফসির বললো—

” এক্ষুনি রুমে আয় আমার।”___বলেই কল কেটে দিলো।

চলবে?

#আমার_পূর্ণতা
#রেদশি_ইসলাম
পর্বঃ১২

শরতের বিকেল। শিমুল ফুলের মতো পেজা তোলা মেঘ ভেষে বেড়াচ্ছে স্বচ্ছ আকাশে। ছাঁদের একপাশে লাগানো শিউলি ফুলের গাছটা থোকায় থোকায় ভরে উঠেছে শিউলি ফুলে। মৃদু মিষ্টি শীতল বাতাসে দুলে উঠছে ছাদে লাগানো বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। ছাদের মাঝখানে অবস্থিত সাদা রং করা দোলনায় দুলছে নব দম্পতি অর্থাৎ রাদিয়া আপু ও আবির ভাইয়া। আর তাদের বিভিন্ন পোজের ছবি তুলে দিচ্ছে রিয়া আপু। এই পর্যন্ত না হলেও প্রায় একশোর অধিক ছবি তোলা হয়েছে তার কিন্তু তবুও একটা ছবি যদি পছন্দ হতো রাদিয়া আপুর। পাশে আবির ভাইয়ার দিকে তাকাতেই ব্যাপক হাসি পেলো আমার। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে বউয়ের ছবি তোলার চক্করে বেজায় বিরক্ত সে। এর মধ্যে রিয়া আপু নিচে ধাপ করে বসে পরলো। তা দেখেই রাদিয়া আপু চেঁচিয়ে বলে উঠলো—

” এই এই তুই বসলি কেনো? আমি বলেছি তোকে একবার ও বসতে?”

” মাফ চাই আপু। আমি আর পারবো না তোমাদের ছবি তুলতে। বিশ্বাস করো হাত একদম ব্যাথায় টনটন করছে।”

” মাত্র তো এই কয়টা ছবি তুললাম তার মধ্যেই হাত ব্যাথা হয়ে গেছ তোর? অকর্মার ঢেঁকি কোন জায়গার।”

” আপুরে দুইশো টা ছবিকে তোমার মাত্র মনে হচ্ছে? আচ্ছা পোজ দিতে দিতে তুমি ক্লান্ত হচ্ছো না? ভাইয়ার মুখের দিকে তাকাও একটু। তোমার যন্ত্রণায় না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে কিছু করতে।”

রিয়া আপুর কথায় আবির ভাইয়ার দিকে ফিরলেন রাদিয়া আপু। কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন—

” সত্যি আবির? তুমি কি বিরক্ত হচ্ছো?”

আপুর কথায় মুখে জোর পূর্বক হাসি টেনে আবির ভাইয়া বললেন—

” একদম না সোনা। আমি একটুও বিরক্ত হচ্ছি না। শালিকা তো মজা করছে তোমার সাথে। ডোন্ট আপসেট বউ। তুমি যত্ত ইচ্ছা ছবি তোলো। এইযে দেখো আমি তোমার পাশে চুপ করে বসে আছি”

রাদিয়া আপু দাঁত বের করে হেঁসে রিয়া আপুকে ভেঙ্গিয়ে দিলেন। তা দেখে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলো রিয়া আপু।

ওদের কাহিনি দেখে হাসলাম আমি। তাদের দুইজনকে ড্রামা বাজ ছাড়া কোনো অংশে কম মনে হচ্ছে না। এর মধ্যেই হাতে থাকা ফোনে টুং করে শব্দ হলো। স্ক্রিনে ভেষে উঠলো ইন্টারনেট প্যাকেজ এর ম্যাসেজ। তাই আর পাত্তা না দিয়ে ফোন নামিয়ে রাখতে গেলাম। তখনই নজর পরলো হাতের ব্রেসলেট খানায়। যেটা গতকাল তাফসির ভাইয়া পরিয়ে দিয়েছেন।

গতকাল রাতে যখন উনি আমাকে কল দিয়েছিলেন তখন অবাক হলাম বটে। সন্ধ্যায় উনি নাম্বার নিয়েছিলেন আমার তবে রাত হতে না হতে ওনার রুমে ডাকলেন কেনো বুঝতে পারলাম না। তাই কোনো দরকারি কাজ হবে ভেবে গেলাম ওনার রুমে। তখন তাফসির ভাই রুমে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলেন আর কফি খাচ্ছিলেন। উনি এখানেও সাথে করে ল্যাপটপ আনতে ভুলেন নি। বড় মা দেখার পর যদিও জিজ্ঞেস করেছিলেন কেনো তবে উনি বলেছিলেন জরুরি কাজ আছে নাকি। তাই এ নিয়ে আর কোনো কথা বলেনি কেউ।
তাফসির ভাই আমাকে দেখতেই চোখের ইশারায় ওনার পাশে বসতে বললেন। আমি ওনার পাশে বসতেই উনি আমার দিকে পাশ ফিরে তাকালেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম—

” হঠাৎ ডাকলেন যে তাফসির ভাই? কিছু বলবেন?”

” তো না বললে কি তোর চেহারা দেখার জন্য ডেকেছি?”

” ডাকতেও পারেন বলা তো যায় না।”

” সব সময় এক লাইন বেশি বুঝিস কেনো?”

” কি করবো বলুন এটা তো আমার স্বভাব ”

” তুই ও যেমন তোর স্বভাব ও তেমন। বলদ।”

তাফসির ভাইয়ের কথায় আমি চেতে গিয়ে বললাম—

” আপনি কি আমার সাথে ঝগড়া করতে এখানে ডেকেছেন? নাকি কিছু বলবেন? আমার এতো ফাও সময় নেই আপনার সাথে ঝগড়া করার। কি বলবেন তাড়াতাড়ি বলুন।”

” এক থাপ্পড় দেবো বেয়াদব। বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানিস না? গুনে গুনে তোর থেকে আট বছরের বড় আমি। আট বছর মানে বুঝিস? তারপরও তুই আমার সাথে গলা উঁচু করে কথা বলছিস?”

ওনার কথায় চুপসে গেলাম আমি। মাথা নিচু করে বললাম—

” দুঃখিত তাফসির ভাই। আর হবে না।”

তাফসির ভাই কন্ঠ নরম করে বললেন—

” তোর হাত দে তো”

” কেনো? আমার হাতে আবার কি করবেন?”

এ কথা শুনে তাফসির ভাই চোখ গরম করে আমার দিকে তাকাতেই আমি তাড়াতাড়ি হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি ডান হাত দিয়ে আমার হাত ধরে বাম হাত পকেটে ঢুকিয়ে কাগজে প্যাকেট করা কিছু একটা বের করলেন। তারপর প্যাকেট ছিড়ে বের করলেন ডেইজি ফুল ও ছোট্ট পাথরের সংমিশ্রণে তৈরি একটি ব্রেসলেট। উনি যে হাত ধরে ছিলেন সে হাতে পরিয়ে দিলেন ব্রেসলেট টি। তারপর অস্ফুটস্বরে বললেন ” পার্ফেক্ট”

আমি এতক্ষণ হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম সবকিছু। মানে কি? উনি আমার জন্য ব্রেসলেট এনেছেন তা আবার পরিয়েও দিলেন? এটাও সম্ভব? বিশ্বাস হচ্ছে না তো আমার। তাই অবিশ্বাসী কন্ঠে ওনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—

” এটা কি আমার জন্য তাফসির ভাই?”

” না এটা আমার গার্লফ্রেন্ডের জন্য। তোর হাতে পরিয়ে ট্রায়াল দিচ্ছিলাম। বলদ কোথাকার!! তোর জন্য না হলে কি তোর হাতে পরাতাম? এটুকু ও বুঝিস না?”

” হঠাৎ আমাকে এতো সুন্দর একটা ব্রেসলেট দেওয়ার কারন?”

” এতো কথা শুনে তুই কি করবি? যা বের হ আমার রুম থেকে।”

ওনার কথা শুনে মনে মনে খুব খুশি হলাম আমি। কেনো তা জানি না। হয়তো ব্রেসলেট টা আমার খুব পছন্দ হয়েছে তাই।

হঠাৎ রিয়া আপুর ধাক্কায় বাস্তবে ফিরে আসলাম। আমাকে এমন ভাবনা চিন্তা করতে দেখে রিয়া আপু বললেন—

” এই প্রাচুর্য এতো কি ভাবছিস? সেই কখন থেকে ডাকছি শুনছিস ই না।”

” সরি আপু। একটা জিনিস ভাবছিলাম। আচ্ছা কি বলবে বলো।”

” নিচে যাবো চল। রাদিয়া আপু আর আবির ভাইয়া চলে গেছে কিছুক্ষণ আগে। এখন আমাদের ও যেতে হবে। দেখেছিস সন্ধ্যা নেমেছে? তাড়াতাড়ি চল নাহলে ছোট মা রাগ করবে আবার।”

” হ্যাঁ চলো আপু।”
.
.
মাহিন ভাইয়া দের ফ্ল্যাটে আসতেই দেখলাম ড্রয়িং রুমে বসে গল্প করছেন বড় মা, মেজো মা, ফুপ্পি ও মা। বাবারা কেউ বাড়িতে নেই। বিকেল হতে না হতেই বেরিয়েছেন তিন ভাই। তবে কোথায় গেছেন তা জানা নেই। আমি আর রিয়া আপু গিয়ে মা’দের পাশের সোফায় বসে পরলাম। সুফিয়া ফুপ্পি আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসলেন। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন—

” যাই বলো না কেনো শাহানা তোমার মেয়ে টা দেখতে কিন্তু মাশাল্লাহ হয়েছে। আমার আরেকটা ছেলে থাকলে নিঃসন্দেহে আমার ছেলের বউ করতাম।”

ফুপ্পির কথায় আমি লজ্জা পেলাম একটু। তার মধ্যে মা বললেন—

” শুধু আমার মেয়ের কথা বলছো কেনো আপা? আমাদের বাড়ির বাকি ছেলে মেয়ে গুলোর কথা ও বলো। সবাই-ই মাশাআল্লাহ।”

” হ্যাঁ হ্যাঁ তাইতো। আমাদের সব ভাইয়ের ছেলে মেয়েই সোনার টুকরো।”

এর মধ্যেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসলেন দিয়ানা ভাবি। সাথে আছেন ফুপ্পি দের হ্যাল্পিং হ্যান্ড। তার হাতের ট্রে তে নানা রকমের খাবার। দিয়ানা ভাবি এসেই আমাদের সামনের টেবিলে সব খাবার রাখতে বললেন। তার কথা মতো হ্যাল্পিং হ্যান্ড সব খাবার রেখে চলে গেলেন। তারপর ভাবিও তার আধ ভাঙা বাংলা ইংলিশ মিশিয়ে সবার সাথে গল্পে মেতে উঠলেন।

হঠাৎ চোখ পরলো তাফসির ভাইয়ের রুমের দিকে। উনি ফোনে কথা বলতে বলতে বের হচ্ছেন। হয়তো বাইরে যাচ্ছিলেন। তার মধ্যেই ডাক দিলেন সুফিয়া ফুপ্পি। উনি ফোন নামিয়ে বললেন—

” জ্বি ফুপ্পি?”

” কোথায় যাচ্ছিস আব্বু?”

” এইতো একটু বাইরে যাচ্ছিলাম ফুপ্পি। কেনো কিছু বলবে?”

” এদিকে আয়। বোস একটু। দেখ তোর ভাবি কি কি বানিয়েছে। খেয়ে তারপর যা।”

ফুপ্পি কথায় সায় জানিয়ে ভাবিও ডাকলেন তাফসির ভাইকে। উনি এসেই বসে পরলেন আমার পাশ ঘেষে। খেতে খেতে ভাবির দিকে তাকিয়ে বললেন—

“বাহ ভাবি তুমি তো খুব ভালো রান্না করো। একদম বাঙালিদের মতোই হয়েছে।”

” সব ই মা শিখিয়েছেন। উনি আমাকে বলতে গেলে একদম হাতে ধরিয়েই শিখিছেন। দ্যাট’স হোয়াই আমি এসব পারি। আর তোমার ভাইয়া বাংলা শিখাচ্ছেন। InshaAllah one day I will be able to speak Bengali completely ”

” আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা থাকলো ভাবি।”

এর মধ্যেই পাশ থেকে সুফিয়া ফুপ্পি বলে উঠলেন—

” তা বিয়ে কবে করবি আব্বা? বোনের তো বিয়ে হয়ে গেলো। এখন তো তোর পালা ”

” করবো ফুপ্পি। আর দু এক বছরের মধ্যেই করে ফেলবো।”

” তা কোনো মেয়ে টেয়ে পছন্দ আছে নাকি? থাকলে বল। বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার।”

” আছে ফুপ্পি। তবে বউ এখনো ছোট। আর একটু বড় হোক।”

তাফসির ভাইয়ের কথায় পাশ থেকে বড় মা বিস্ময় নিয়ে চিল্লিয়ে বলে উঠলেন—

” কি বললি তুই? তোর পছন্দ আছে অথচ আমি একবার ও জানলাম না? আমাকে একবার ও বললি না তুই? আমি এখন এতো টাই পর হয়ে গেলাম আব্বা? ”

” আরে মা তোমাকে তো বলতেই চেয়েছিলাম কিন্তু এখনো তেমন সময় হয়ে উঠে নি তাই বলি নি।”

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে