#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-২
আমি ঘরদোর গুছিয়ে ভালো একটা জামা পরে নিলাম। ঘড়িতে পাঁচটা বাজে। সে ফোন করেছিল চল্লিশ মিনিট আগে। তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি বড়জোর আধঘন্টার রাস্তা৷ এসে পড়ল বলে।
আমি ফোন হাতে নিয়ে দক্ষিণের বারান্দায় গিয়ে টুল পেতে বসলাম। সময় যেন যায় না। আশেপাশে গাড়ির শব্দ শুনলে উঠে দাঁড়াই। মনে হয় যেন সে এসেছে। কিন্তু সে আর আসে না।
সন্ধ্যা হওয়ার মুখে আমি বুঝে গেলার সে আর আসবে না। জ্বরটা সম্ভবত বেড়েছে। আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। লাইট জ্বালাতেও ইচ্ছে হলো না। মুখের সাথে মনটাও তেঁতো হয়ে এসেছে। এমন কী করে করে মানুষ? কাউকে বলে কয়ে তারপর না আসাটা কোন ধরনের ফাজলামো?
মাগরিবের আজান পড়ল বলে, ঠিক এমন সময় কলিংবেল বাজলো। আমি ভাবলাম বাড়ির লোক এসেছে। অনেক কষ্টে পা টেনে টেনে গিয়ে দরজা খুলে দেখি সে এসেছে। হাতে ফুলের তোড়া। আমি ভীষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইলাম। সে বলল, “ঢুকতে দেবেন না?”
দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম। সে ঢুকে সোফায় গিয়ে বসল। আমি দরজা লাগিয়ে ভেতরে যেতে যেতে আবিষ্কার করলাম আমার জ্বর সেরে গেছে। একটুও খারাপ লাগছে না। কি আজব!
সে পকেট থেকে চকলেট বের করে আমায় দিল। বললাম, “আমি চকলেট খাই না।”
সে হা করে অবাক হয়ে তাকালো। “সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
“কেন?”
“এমনি।”
“আচ্ছা আপনার ছোট বোনকে দিয়ে দেবেন তাহলে। তো শরীর কেমন?”
“এখন ভালো।”
“একটা কথা বলার ছিল।”
“পরে বলবেন, আমি একটু চা বানিয়ে আনি।”
সে হাসলো। ঠোঁট ভাজ করা কি সুন্দর হাসি! বলল, “আমি চা খাই না।”
“কেন?”
“যে কারনে আপনি চকলেট খান না সে কারনে।”
আমি একটু অবাক হলাম। এ এমন রহস্য করে কথা বলছে কেন? সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “আমি যাই তাহলে।”
“মাত্রই তো এলেন।”
“আমার আরেকটু বসার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু দেরি করে ফেলেছি আসতে। আপনার বাড়ির সবাই চলে এলে তারা খারাপ ভাবতে পারে। আপনাকে দেখতে এসেছিলাম। দেখা শেষ। এখন যেতে হবে।”
“কিছু খেয়ে যেতেন। এভাবে খালি মুখে গেলে…”
সে হেসে বলল, “আরেকদিন।”
“আর কখনো আসবেন?”
সে কপালে আঙুল দিয়ে অদৃশ্য রেখা টেনে বলল, “এখানে লেখা থাকলে আসব।”
“শুনুন…”
“বলুন।”
“আপনি আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?”
“জোগাড় করেছি। ফোন নাম্বার নিশ্চয়ই এমন কিছু নয় যেটা পাওয়া যাবে না।”
“কিন্তু কেন?”
সে পকেট থেকে ভাজ করা কাগজ দিয়ে বলল, পড়ে দেখবেন, তাহলে বুঝতে পারবেন।”
মাগরিবের আজান পড়ে গেছে। চারদিকে অদ্ভূত নিরবতা। সে চলে যেতে গিয়ে ফিরে এল। আমার কাছাকাছি এসে কপালে আলতো করে হাত রাখলো। হাতটা ভীষণ ঠান্ডা। যেন ফ্রিজের পানিতে অনেকক্ষণ চুবিয়ে রেখেছিল। অদ্ভূত শীতলতা কপাল থেকে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। আমি কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। সে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, “জ্বর আছে। ঔষধ খেয়েছেন?”
“হুম।”
“নিজের খেয়াল রাখবেন।”
আমার ভেতর থেকে অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। বললাম, “রাখব।”
সে চলে যাওয়ার পর দরজা লাগাতে গিয়ে মনে হলো সে কী যেন বলতে চেয়েছিল। বলল না কেন? জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। ততক্ষণে গাড়িটা চলে গেছে ধোঁয়া উড়িয়ে। সন্ধ্যের ম্লান আলোটা তখনো ঝুলে আছে। নারকেল গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। চাঁদকে বললাম, “দেখো তো ঠিক করে পৌঁছুলো কি না?”
চাঁদ যেন আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে লজ্জা পেয়ে পাতার আড়ালে লুকিয়ে গেল।
সে বের হওয়ার দশ মিনিটের মাথায় বাড়ির সবাই চলে এলো। মেলা থেকে গাদা গাদা জিনিস কিনে এনেছে। হুট করেই নিরবতা থেকে ভয়ানক চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। ঝিনু বড় আপার ছেলের সাথে ঝগড়া করছে, কী নিয়ে যেন দু’জন টানাটানি করছে। ছোট ভাবী কোথায় কী করেছে সেসব ফিরিস্তি দিচ্ছে। বাবা চড়া গলায় ধমকাচ্ছেন সবাইকে। আমার এসব সহ্য হলো না। গা গুলিয়ে উঠল হঠাৎ। মাথাটা ঘুরে গেল। চোখের সামনেটা আলো থেকে আস্তে আস্তে আবছা হয়ে এল।
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন আমি আমার ঘরে। অল্প পাওয়ারের নীল আলো জ্বলছে। ঘরে আর কেউ নেই। উঠে বসলাম আস্তে আস্তে। দুর্বল লাগছে এখনো। মোবাইলটা পাশেই আছে। হাতে নিয়ে দেখি সাড়ে নয়টা বাজে। তার চিঠিটা মোবাইলের কভারের ভেতর রেখে দিয়েছিলাম। সেটা বের করে মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে পড়তে শুরু করলাম।
কিন্তু তখুনি মা চলে এলেন। লুকিয়ে ফেলতে হলো চিঠি৷ মায়ের হাতে ভাতের প্লেট৷ মনে পড়ল সারাদিন কিচ্ছু খাইনি। এভাবে না খাওয়ার অভ্যাস আমার আছে, তবে আজ তার আসার ধাক্কাটা সহ্য করতে পারিনি। কোনোরকম কথাবার্তা না বলে খেয়ে নিলাম। মা অবাক হয়ে গেলেন। কিছু বুঝলেন নাকি! মা’কে দ্রুত বিদায় করে চিঠি নিয়ে বসলাম।
সুন্দর টানা হাতের লেখা। বলপয়েন্ট দিয়ে লেখা হয়েছে, তবে কিছু লাইনের নিচে নীল রঙের জেলপেন দিয়ে দাগ দেয়া। লেখায় কোনো সম্বোধন নেই। সরাসরি কাহিনী।
“আমি যখন ইন্টারে পড়ি, তখন ক্লাসে একটা মেয়ে পড়তো। নাম ধ্রুপদী সরকার। আমি একপ্রকার পাগল ছিলাম ওর জন্য। ওকে দেখার জন্য কলেজে যেতাম, ওর চোখে পড়তে এহেন হাস্যকর কাজ নেই যা করিনি। কিন্তু ধর্ম ভিন্ন বলে পাত্তা পাইনি কোনোদিন। খুবই রেস্ট্রিকটেড ফ্যামিলির মেয়ে ছিল। ইন্টার শেষ হওয়ার পরপর ওর বিয়ে হয়ে যায়। এখন ও ইংল্যান্ড থাকে। দুটো ছেলে আছে। তবুও আমি ওকে ভুলতে পারিনি। কখনো কোনো নারীকে নিজের জীবনে কল্পনা করতে গেলে শুধু ধ্রুপদীর মুখটাই ভাসতো। হাসছেন নিশ্চয়ই, আপনাকে আমি বলে বোঝাতে পারব না প্রথম প্রেম বিষয়টা ঠিক কেমন। বিশ্বাস করবেন, আমি এখনো যখন কলেজের দিনগুলোর কথা মনে করি, আমার বুকের ভেতর জ্বালাপোড়া করতে থাকে। মনে হয় একটা বার যদি ফিরে যেতে পারতাম!
এতদিন এত মেয়ে দেখতে গিয়েছি, কাউকেই ভালো লাগেনি৷ সবার মধ্যে আমি ধ্রুপদীকে খুঁজতাম। তবে আশ্চর্যের কথা শুনবেন, ধ্রুপদীর জায়গাটা কেউ নাড়িয়ে দিয়ে থাকলে সেটা আপনি। কেন আমি বলতে পারব না৷ ধ্রুপদীর সাথে আপনার বাহ্যিক কোনো মিল নেই। সে দেখতে গ্রীক দেবীদের মতো ছিল। নিঁখুত আর চোখ ধাঁধানো সুন্দর। আপনি অন্যরকম৷ হয়তো খুব সাধারণ, তবে সবার নতো নন।
সেদিন আপনাকে দেখার সময় প্রথমবার আমার ধ্রুপদীর সাথে তুলনা করতে ইচ্ছে হয়নি। শুধু আপনার সাথেই সময়টা কেটেছে৷ অন্যকেউ মনের মধ্যে উঁকি দেয়নি।
আপনাকে এসব কেন বললাম জানি না। শুধু জানিয়ে রাখতে চাইছিলাম। আপনার প্রশ্নগুলোর উত্তর হয়তোবা পেয়ে গেছেন। কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করে নেবেন।
আপনার কাছে একটা প্রশ্ন রইল, চোখের দেখার ভালোলাগা আর ভালোবাসার মধ্যে কতটুকু তফাৎ? ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা হওয়া যায়? নাকি দুটো ভিন্ন জগতের শব্দ? একটার সাথ অন্যটার সম্পর্ক নেই?”
চিঠি পড়ে পাক্কা দশ মিনিট আমি স্ট্যাচু হয়ে বসে রইলাম। বুঝতেও পারলাম না কী হচ্ছে এসব। তবে বুকের ভেতর হাতুড়িপেটা শুরু হলো। নিঃশ্বাস আটকে আসতে থাকলো।
আমি আর ঝিনু এক ঘরে ঘুমাই। বড় আপা এলে আমাদের সাথেই শোয়। আপার ছেলে আয়াশটা ভীষণ দুষ্টু৷ ঘুমানোর আগে ইচ্ছেমতো চেঁচামেচি লাফালাফি করতে থাকে। ঝিনু যোগ দেয় তার সাথে। আমি আজ এসবের মধ্যে থাকতেই পারলাম না। উঠে নিঃশব্দে চলে গেলাম ছাদে। অস্থিরতায় টিকতে পারছি না একদম।
ঠান্ডা বাতাস বইছে। রেলিং ঘেঁষে লাগানো গাছের পাতাগুলো কাঁপছে। বাতাসে মাটির ঘ্রাণ। আকাশে ঘন করে মেঘ জমেছে। বৃষ্টি হবে বুঝি!
একটু পরেই সে ফোন করলো। ধরতেই প্রথম কথাটা বলল, “চিঠিটা পড়েছেন?”
আমি উত্তর দেয়ার আগেই কে যেন মোবাইলটা কান থেকে টেনে নিয়ে গেল। পেছনে ঘুরে দেখি মা। তিনি মোবাইল কানে দিয়ে বললেন, “কে বলছেন?”
ওপাশ থেকে সম্ভবত কিছু বলল না সে। মা কয়েকবার হ্যালো হ্যালো করে রেখে দিলেন। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “কার সাথে কথা বলছিলি লুকিয়ে ছাদে এসে?”
আমি ফট করে বলে দিলাম, “রং নাম্বার।”
মা বিশ্বাস করলেন কি না কে জানে! ভাগ্যিস তার নাম্বার সেভ করিনি। মা বললেন, “জ্বর নিয়ে বাতাসের মধ্যে ছাদে এসেছিস কেন? যা নিচে।”
আমি নিচে চলে গেলাম। নিচে যেতে যেতে তার নাম্বারে মেসেজ করলাম, “স্যরি। মা চলে এসেছিল।”
মেসেজের ডেলিভারি রিপোর্ট এলো না। তখনো আমি জানতাম না সেদিনের কথোপকথন টুকুই তার সাথে আমার শেষ কথা। সেদিনের পর থেকে তার নাম্বারটায় না ফোন ঢুকলো, না কোনো ফোন এলো। মেসেজও যেতো না৷ প্রথমে ভেবেছিলাম ব্লক করেছে৷ পরে অন্য নাম্বার দিয়ে চেষ্টা করে বুঝলাম, সে আসলে নাম্বারটা ব্যবহার করছে না।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু
#অপূর্ব_সমাপ্তি
পর্ব-৩
প্রায় এক সপ্তাহ পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করে রইলাম, সে বুঝি ফোন করবে। তারপর মেনে নিলাম, নিজেকে বুঝিয়ে নিলাম এটা একটা দুঃস্বপ্ন ছিল, যেটা কেটে গেছে। এখন আর এসব নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না।
ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। সারা বছর কিছু পড়িনি। এখন প্রয়োজন দিনরাত এক করে পড়াশুনা করা। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বই নিয়ে বসলেই আর পড়তে ইচ্ছে করে না। মনে হয় জীবন থেকে পড়াশুনা নামক বিষয়টা টেনেহিঁচড়ে বের করে দেই। শরীরে অসম্ভব আলস্য জায়গা করে নিয়েছে।
পরীক্ষা হচ্ছে। টেনেটুনে পাশ করার মতো পরীক্ষা দিচ্ছি। প্রশ্নপত্র পেয়ে পাশ নাম্বার ওঠার মতো লিখে আর পারলেও লিখতে ইচ্ছে করে না। হাত গুটিয়ে বসে অন্যদের লেখা দেখি। শেষ পরীক্ষাটা ভয়ানক খারাপ হলো। পাশ নিয়ে সন্দেহ। সেদিন বাড়ি ফেরার সময় মনে হলো, ভুল হয়ে গেছে। একটা ভুলকে পাত্তা দিতে গিয়ে নিজের জীবন নিয়ে জুয়া খেলাটা কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের কাজের মধ্যে পড়ে না।
পরীক্ষা শেষে কাজ নেই। বাড়িতে শুয়ে বসে দিন কাটে। সেসব কাহিনী ভুলে গেছি মোটামুটি। অন্তত নিজেকে তাই বলে সান্ত্বনা দেই। শুধু মাঝে মাঝে রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে কপালে কারো ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পাই। সাথে রজনীগন্ধার সুবাস!
বছরটা ঘুরে গেলো। পরের বছর শীতকাল চলে এলো। শীতকালটা আমার ভারি পছন্দ। খেয়ে-পরে-ঘুমিয়ে শান্তি। সবাই যখন মোটা জামাকাপড় গায়ে দিয়ে শীতে কাঁপে আমি পাতলা জামা পরে বাতাসের মধ্যে দৌড়ে বেড়াই। গায়ে কাটার মতো শীত বেঁধে। আমার ভেতরটা জুড়িয়ে যায়।
সকালে সবাই যখন লেপ মুড়ি দিয়ে আরাম করে ঘুমোয়, আমি তখন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ি। চাদর গায়ে দিয়ে বাগানের মধ্যে দিয়ে ঘুরি। একটু সোনালী রোদের আলো দেখা দিলে গায়ের মেখে নেই।
এক সকালে একটা বিশাল গাড়ি এসে বাড়ির বাইরে দাঁড়ালো। আমি তখন গোলাপ গাছের আগা ছেটে দিচ্ছি। কৌতুহল নিয়ে তাকালাম।এত সকালে গাড়ি করে কে এল! আমাকে অবাক করে দিয়ে গেট খুলে এক মহিলা ঢুকলেন। সুন্দর ফরসা চেহারা, গায়ে সিল্কের শাড়ি জড়ানো, গলায়-হাতে-কানে স্বর্ণের অলঙ্কার। পুরো শরীরজুড়ে আভিজাত্য উপচে পড়ছে। সকালবেলা এমন মূর্তি দেখে হা হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মুখটা চেনা চেনা মনে হলেও ঠিক চিনতে পারলান না। আগে কখনো দেখেছি বলেও মনে পড়ে না। তার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। তিনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার বাবা বাড়ি আছেন?”
উনাকে ভেতরে নিয়ে বসিয়ে দিয়ে চলে গেলাম আমি। বাবা বসার ঘরেই ছিলেন। মায়ের কিছুদিন ধরে জ্বর। দুই ভাবীই এদিকে বাপের বাড়িতে গেছে। আমাকে রান্নাবান্না সব করতে হচ্ছে। আমি তার জন্য কিছু চা-নাস্তা নিয়ে গেলাম। দেখলাম বাবার সাথে কী বিষয়ে খুবই গম্ভীরভাবে আলোচনা করছেন। আমাকে দেখে চুপ হয়ে গেলেন দুজনে। আমি নাস্তার ট্রে রেখে ভিতরে গিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম কাজে। এর মাঝে ভুলেও গেছি উনার কথা। অনেকক্ষণ পর তিনি বের হলেন বাড়ি থেকে। আমি তখন ছাদে আচার শুকোতে দিতে এসেছি। ঝিনু দৌড়ে এসে বলল, “আপি জানিস কে এসেছিলো?”
“কে?”
“মনে আছে গত বছর তোকে দেখতে এসেছিলো তাদের কথা? ওইযে অনেক মিষ্টি এনেছিলো যে..সেই ছেলের মা।”
আমাকে যেন কেউ জোরে ধাক্কা দিল। কোনোমতে বললাম, “কেন এসেছে?”
“তোর সাথে সেই ছেলেটার বিয়ের কথা বলতে।”
আমি এবার সোজা আকাশ থেকে পড়লাম। হা হয়ে যাওয়া মুখটা দেখো ঝিনু বলল, “তারা অনেক তাড়াতাড়ি বিয়ে করাবে বলেছে। তুই কি করবি নাকি পালিয়ে যাবি?”
আমি আরও অবাক হয়ে বললাম, “পালাবো কেন?”
“এই মহিলা শ্বাশুড়ি হলে তোকে জ্বালিয়েই মেরে ফেলবে। কি কাটা কাটা কথা!”
“ধুর! যা তো!”
“ভালো বুদ্ধি দিলাম…”
“বাবা কী বলেছে শুনেছিস?”
ঝিনু ঠোঁট উল্টে বলল, “জানি না, বাবাকে জিজ্ঞেস করো।”
আমার মাথায় তখন একশো একটা লাল নীল বাতি জ্বলছে, নিভছে। একদৌড়ে আমি ঘরে চলে এলাম। তক্ষুনি ফোন বাজলো। সেই নম্বরটা। হাজারখানেক বার পড়ে পড়ে মুখস্থ নম্বর!
“হ্যালো!”
“ভালো আছেন?”
বহুদিন পর আমার শ্রবণযন্ত্রের শুষ্ক মরুভূমিতে দু’ফোঁটা বৃষ্টিপাত হলো। ভয়ানক তৃষ্ণার্তের মতো ফোঁটাদুটো গিলে নিলাম। চোখ বুঝে অতিকষ্টে কান্না চেপে বললাম, “এতদিন পর কী মনে করে?”
“আমার মা যায়নি আপনাদের বাড়িতে?”
“এসেছিলেন।”
“তাহলে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন!”
হঠাৎ খুব রাগ হলো। এটা কেমন কথা? বললাম, “আমি কী বুঝব? আপনাদের কাজকর্ম কোনোটাই আমার মাথায় ঢুকছে না। বিয়েটা কোনো ছেলেখেলা না। আমি আপনাকে বিয়ে করব না৷ অনেক ফাজলামো করেছেন। এসব নিয়ে ঘাটাঘাটি না করলেই ভালো হবে।”
“আপনি শুনুন তো আগে!”
“কী শুনব?”
“সমস্যা এটাই তো যে আমি নাম্বার বন্ধ রেখেছিলাম? এর ব্যাখ্যা আছে..”
“কী ব্যাখ্যা?”
“অস্থিরতা বাড়াতে চাইনি তাই।”
“কিসের অস্থিরতা?
অনেকক্ষণ চুপ করে রইল সে। আমিও এদিকে চুপ। কিছু না বলেও সব বুঝিয়ে দেয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা চলল। অভিমানের পাহাড় ঠেলে মনের যোজন যোজন দূরত্ব পেরিয়ে সেই না বলা কথাগুলো যখন বোঝা গেল না তখন সে বলল, “সেদিন নাম্বারটা ইচ্ছে করে বন্ধ করিনি, হাত থেকে পড়ে মোবাইল ভেঙে গিয়েছিল। আমার একটাই মোবাইল। তাই সেটা ঠিক করা পর্যন্ত কথা বলতে পারছিলাম না। পরদিন সকালবেলা মোবাইল ঠিক করে আনার মাঝখানের সময়টুকু পাগলের মতো কেটেছে। রাতে একফোটা ঘুম হয়নি। সকালে সিমটা চালু করার সময় মনে হলো আপনার সাথে কথা বলাটা উচিত হবে না। আগে সবকিছু ঠিক করব, তারপর বাকি কাজ।”
তার কথার কিছুই আমি বুঝলাম না। বললাম, “যা বলার ভালো করে বলুন।”
“বুঝিলে বলতে গেলে সময় করে বলতে হবে৷ শুধু এতটুকু জানুন, সেদিন রাতে কেমন করে যেন বুঝে গিয়েছিলাম আপনাকে আমার ভীষণ প্রয়োজন। তাই চাচ্ছিলাম আপনাকে পুরোপুরি পেতে, অন্ধ সম্পর্কে জড়িয়ে আবার কষ্ট না পেতে। আর সেটার ব্যবস্থা করতেই এতদিন লেগে গেল।”
“মানে আপনার মা’কে রাজি করাতে?”
“হ্যাঁ, যেটা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।”
আমি কিছু বললাম না। সে বলল, “আমি মায়ের অবাধ্য হতে পারি না। সে যত কাটাছেঁড়াই করুক না কেন আমার জীবনের সাথে। একটা ঘটনা বলি, আমি যখন মায়ের গর্ভে এসেছিলাম, তখন আমার মায়ের বিয়ের বয়স মাত্র চার মাস। মায়ের বয়সও কম। আঠারো বছর। কেউই চায়নি বাচ্চাটা রাখতে। মায়ের বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি প্রত্যেকেই বাচ্চা নেয়ার বিরুদ্ধে ছিল। মা তাদের বিপক্ষে গিয়ে একপ্রকার যুদ্ধ করে আমাকে জন্ম দিয়েছে। আমার জন্মের পর মায়ের শরীরে রক্তশূন্যতা, শরীর ব্যথাসহ আরও নানা রকমের রোগ স্থায়ী বাসা বানিয়ে নিয়েছে। এই বয়সেই বুড়ো মানুষের চেয়ে বেশি ব্যাধি নিয়ে বাস করেন তিনি৷ তবুও বাকি দুই ভাইবোনের চেয়ে আমাকে বেশি ভালেবাসেন। তার জীবনের সমস্ত ত্যাগ-তিতিক্ষার সিংহভাগই করেছেন এই আমার জন্য। আমার থেকে আশাও করেন অনেক বেশি। তার জীবনের সবচেয়ে দামী সময়টা আমার জন্য উৎসর্গ করা। তাই বুঝতেই পারছেন নিশ্চয়ই ব্যাপারটা!”
আমি মৃদু স্বরে বললাম, “বুঝেছি। আপনার মা এখন রাজি হয়েছে?”
“হ্যাঁ। আমি তাকে বোঝাতে পেরেছি।”
“আপনি কেমন আছেন?”
সে হেসে বলল, “এইতো ভালোই। আপনি এত শুকিয়ে গেছেন কেন? মনে হয় দিন দিন ছোট হচ্ছেন।”
“আপনি আমাকে দেখলেন কোথায়?”
“কথা বন্ধ করেছি বলে দেখাও বন্ধ করব এমন কোনো কথা আছে নাকি?”
আমি ঢোক গিললাম। মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী কাঁপছে। পায়ের তলায় সুড়সুড়ির মতো অনুভূতি! সেও বোধহয় কথা খুঁজে পাচ্ছিলো না আর। শুধু চুপচাপ মোবাইল কানে দিয়ে বসে থাকা। কতক্ষণ কেটেছে জানা নেই, আমার ডাক পড়লো। ফোন কেটে দিলাম।
ডেকেছেন বাবা। বসার ঘরে পত্রিকা হতে বেশ গম্ভীর মুখে বসে আছেন। আমি যেতেই বললেন, “বসো। তোমার সাথে জরুরি আলাপ আছে।”
“বলো বাবা।”
“তুমি নিশ্চয়ই জেনেছ সকালে ভদ্রমহিলা কেন এসেছিলেন?”
“হ্যাঁ বাবা।”
“সম্বন্ধটা এনেছিলেন তোমার আফজাল চাচা৷ জানোই তো তার মাঝে লুকোছাপা কিছু নেই। সোজাসুজি সব বলে দেয়। তারা যখন তোমাকে দেখে গিয়েছিল, আমার স্পষ্ট মনে আছে তার দু’দিন পর সন্ধ্যায় আফজাল আমাকে ফোন করে বলেছিল, তারা বলেছে তোমার মেয়ে দেখতে ভালো নয়, পড়াশুনায় ভালো নয়, সাজগোজের বালাই নেই তাই তাদের পছন্দ নয়। মেয়ে তাদের ছেলের যোগ্য নয়।
আমি সেদিন কতটা কষ্ট পেয়েছি তুমি হয়তো জানো না। আমার পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে তুমি আমার সবচেয়ে লক্ষী মেয়ে। তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি আমি নিজেও জানি না। শুধুমাত্র বাহ্যিক কিছু বৈশিষ্ট্য দেখে কাউকে রিজেক্ট করে দিয়ে আবার তার সাথে সম্বন্ধ করতে যাওয়ার কারনটা আমাকে ভদ্রমহিলা সোজাসুজি বলেননি। তুমি নিশ্চয়ই আশা করো না আমি তাদের সাথে সম্পর্ক করব।”
বাবার কথা শুনে শরীর ঝিমঝিম করে উঠল। কী বলছে এসব!
বাবা বলে গেলেন, “আমি উনাকে সোজা না করে দিয়েছি। অনেকভাবে বুঝিয়েছেন, আমি মানিনি। প্রয়োজন নেই সম্পর্কের৷”
আমি মাথা নিচু করে ফেললাম। চোখে পানি চলে এসেছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছে। বাবাকে কী করে মুখ ফুটে বলব, আমি এখানেই বিয়ে করতে চাই। তাই কি বলা যায়? বললে তো সবটা বলতে হবে!
বাবা উঠে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “মা, তোমার অনেক ভালো বিয়ে হবে। এই সম্বন্ধটা নিঃসন্দেহে ভালো ছিল। যে কেউ শুনলে বলবে এমন জিনিস না করে জীবনের বিরাট ভুল করেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো মা, আল্লাহ যার সাথে যার জুটি ঠিক করেছেন, বিয়ে তার সাথেই হবে। তুমি এই ছেলের চেয়ে লক্ষগুণ ভালো ছেলে পাবে। বলে দিলাম আমি।”
বাবা চলে গেলেন। আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। সব তো চুকেবুকে গিয়েছিল। তবে নতুন করে পুরানো ক্ষত খুঁচিয়ে ঘা করা কেন? আচ্ছা সে তো এতক্ষণে জেনে গেছে কী হয়েছে। তবে সে কী ভাববে? কষ্ট পাবে খুব? আমাকে ভুল বুঝবে না তো? কত কত চিন্তারা মাথায় শুঁয়োপোকার মতো কিলবিল করতে শুরু করলো। বের হয়ে এলাম ঘর থেকে। শীতের মধ্যদুপুরে কড়া রোদের নিচে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলাম। একটু পর চারদিক অন্ধকার হয়ে এলো। জ্ঞান হারালাম আমি।
জ্ঞান ফিরলো বিকেলে। তাকিয়েই প্রথম যে মুখটা দেখলাম তাতে চমকে উঠে বসতে গেলাম। কিন্তু শরীরে বল পেলাম না। শুধু চমৎকার সুন্দর গোলাপ পাপড়ির মতো দুটো চোখকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম। সে হয়তো জোরেই কথা বলছে। কিন্তু আমার কানে আসছে খুব ধীরে…মনে হচ্ছে যেন বহুদূর থেকে কেউ টেনে টেনে কথা বলছে। শব্দগুলো ভেঙে ভেঙে কানে প্রবেশ করছে…
“এই…মেয়ে…এত… অল্পতে… জ্ঞান… হারালে… চলে…?”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু