অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -২৪

0
2070

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_২৪

কীভাবে যেন একটু একটু করে বেলা ফুরিয়ে যেতে লাগে প্রতিনিয়ত।দিন কেটে গিয়ে রাত আসে আর রাত পেরিয়ে দিন।আর মাহার প্রতিটা দিনই কাটে আরাফাতকে নিয়ে।সেদিনের পর থেকে লিপি ও তার পরিবারের সাথে আরাফাতদের কারও কোনো সম্পর্ক নেই।আরাফাত আর মাহার মধ্যে ঝামেলা সৃষ্টি করারও এখন আর কেউ নেই লিপির মতো।এক আপদ বিদেয় হয়েছে তাদের বাসা থেকে।

বিয়ের পর থেকে এখনও পর্যন্ত আরাফাতকে ফেলে নিজের বাবার বাসায় গিয়েও থাকে নি মাহা।সর্বক্ষণ আরাফাতের সাথে থেকেছে,তাকে সঙ্গ দিয়েছে,আরাফাত একবারও নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করার সুযোগ পায় নি।ছায়ার মতো তার সাথে লেপ্টে ছিলো মাহা।এত এত ভালোবাসাময় সেবাযত্ন উপেক্ষিত হয় নি,দীর্ঘ দেড়টা মাস পর আরাফাত পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায়।এখন সে অনায়াসে হাঁটতে পারে,হাত দিয়ে সবকিছু করতে পারে ঠিক আগের মতো।শুধু ভারী কিছু বহন করা আর বেশিসময় হাঁটাহাঁটি অথবা দৌড়াদৌড়ি করা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।নয়তো আবারও হাতে পায়ের জোড়া ছুটে বিচ্ছিরি অবস্থা হতে পারে।

আরাফাত তো মাহা বলতে অজ্ঞান।মাহাও আরাফাতের প্রতি এত দূর্বল যে তাকে নিজের থেকে দূরে রাখার কথা কল্পনাতেও কখনো আনতে পারে না।যদিও আজতক দুজনের কেউই কাউকে নিজেদের প্রণয়ের কথা জানায় নি।তবে মনে মনে একজন আরেকজনকে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে।
আরাফাত অফিসে যাওয়া শুরু করেছে সুস্থ হওয়ার পর থেকেই।সবকিছুতে আগের ন্যায় মনযোগ দিয়েছে সে,এবারে কাজেকর্মে আর কোনো হেলাফেলা নেই।সবকিছু নিয়মমাফিক হচ্ছে।

মাহার বুকে মাথা না রাখলে আরাফাতের রাতের ঘুম হাওয়া হয়ে যায়।এটা এমনই এক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যা এত সহজে কখনোই যাবে না।বাসায় এসে আগে মাহার চেহারা না দেখলে তার বুকের ভেতর প্রচন্ড রকমের অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়।যদি এটাই ভালোবাসা হয় তাহলে হ্যা,আরাফাত ভালোবাসে মাহাকে।প্রচন্ড পরিমাণে ভালোবাসে।আরাফাত এখন নিজের হাতে খাবার খেতে পারে,যদিও দিনে একবার হলেও মাহার হাতে মাখানো খাবার না খেলে তার মন পেট কিছুই ভরে না।তাদের দুজনের জুটি দেখে সবাই কখনো মাশা-আল্লাহ বলতে ভুলে না।মাহা যে কী পরিমাণ পসেসিভ আরাফাতকে নিয়ে তা সকলেই জানে।
__________

সকাল ৭ টা বাজে,
আকাশকে মেঘের ছায়ার অন্ধকার গ্রাস করে নিয়েছে।এখন বাংলাদেশে আষাঢ় মাসের শুরু।সূর্যের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না আকাশে,মেঘের ঘনঘটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে একটু পরই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে ধরণীর বুকে।

আরাফাত মাহার সাথে একদম লেপ্টে ঘুমিয়ে আছে এখনো।৯ টায় অফিস,অথচ নবাবের এখনো ঘুমই ভাঙে নি।এত আরামদায়ক পরিবেশে বউয়ের উষ্ণতা ছেড়ে ঘুম থেকে ওঠে তৈরি হয়ে অফিসে যাওয়ার মোটেও ইচ্ছে করছে না আরাফাতের।মাহা তাকে নিজের থেকে ছাড়াতে গেলে আরাফাত আরও বেশি করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রাখে।মাহা আরাফাতকে মৃদু কন্ঠে ডাকতে লাগে।

-‘এই যে জনাব!ওঠো এখন ঘুম থেকে।আর কত ঘুমাবে?অফিস যেতে হবে না?হুম?’

মাহা ক্রমাগত আলতো ভাবে ধাক্কা দিয়ে আরাফাতকে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে।আরাফাত একটু উমম শব্দ করে নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে গেল।মাহা এবার আরাফাতের কাছ থেকে নিজেকে বহুত কষ্টে ছাড়িয়ে নিয়ে শোয়া থেকে ওঠে বসলো।খোঁপা বেঁধে হামি দিতে দিতে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।

বেশ কিছুক্ষণ পর ভেজা মুখে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো মাহা।মাহা চলে যাওয়ায় আরাফাতের ঘুমও তৎক্ষনাৎ ভেঙে গেছে।বিছানার ওপর বসে আড়মোড়া ভেঙ্গে চোখ কচলে ঘুম সরানোর চেষ্টা করছে সে অনবরত।আসলে এমন একটা দিনে সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠা টা খুব মুশকিলই বলা চলে।মাহা আরাফাতের দিকে তাকিয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,

-‘গুড মর্নিং জনাব আরাফাত সাহেব।অবশেষে আপনি ঘুম থেকে জাগ্রত হলেন।’

-‘ধ্যাত,মজা করো না তো হানি।এত আরামের একটা ঘুমে ছিলাম।কিন্তু তুমি তা আর পূর্ণ হতে দিলে কই?এত কিউট একটা ওয়েদারে না ঘুমানোটা পাপের সমতুল্য।’ আরাফাত জড়ানো কন্ঠে বিরক্তি নিয়ে বললো কথাগুলো।

মাহা আরাফাতের কাছে এসে তাকে ঠেলে ঠেলে বিছানা থেকে নামিয়ে দিয়ে বললো,’দ্রুত গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো যাও।সকালের ঘুম শরীর খারাপ বানিয়ে দেয়।এত ঘুমাতে হবে না।মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসো ততক্ষণে আমি রুম গুছিয়ে ফেলি।গো ফাস্ট রাইট নাউ।’

মাহার তাগাদাতে আরাফাত টলোমলো পায়ে হেঁটে ওয়াশরুমে চলে গেল।মাহা ঠোঁট জোড়া প্রশস্ত করে হেসে বিছানা গোছানোতে মন দেয়।

আরাফাত ফ্রেশ হতে গিয়ে একদম গোসল করে বেরিয়ে এলো।অফিসে আজকে একটা জরুরি মিটিং আছে।আর গোসল করে অফিসে গেলে শরীর ও মন দুটোই তরতাজা থাকবে।
মাহা আরাফাতের কাপড় চোপড় বের করে বিছানার ওপর সাজিয়ে রাখলো।আরাফাত কোমড়ে শুধু তোয়ালে প্যাঁচিয়ে বেরিয়ে এসেছে।তারপর বিছানার ওপর বসে প্যান্ট পরলো।মাহার এখন আর এসবে লজ্জা লাগে না তেমন।অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।আরাফাতের যাবতীয় সব সেবাযত্ন করতে করতে এখন তার সাথে এতটাই ফ্রি হয়ে গেছে যে আরাফাত এখন যদি তার সামনে কাপড়বিহীন চলে আসে তাও তার মধ্যে তেমন একটা রিয়াকশন দেখা যাবে না।ছোটবেলা থেকেই মাহার লজ্জা পাওয়ার পরিমাণ কম।লজ্জা নারীর ভূষণ,বলা যায় এটা মাহার ক্ষেত্রে একটু কম মেলে।

মাহা আরাফাতের মাথার চুল ভালো করে মুছে দিতে দিতে জানতে চাইলো,’আজকে তোমার কী খেতে মন চাইছে বলো!নাশতায় আজ কী খাবে?’

আরাফাত মাহার পেটে মাথা রেখে বললো,’এমন আন্ধার মার্কা ওয়েদারে চিনিগুড়া চালের ভুনা খিচুড়ির সাথে ঝাল করে বুট ডাল ভূনা ও ডিমভাজা খেতে মন চাইছে।’

-‘আচ্ছা একটু অপেক্ষা করো আমি দেখি আজকে এমন মেনু করা হয়েছে কী না!না হলে কিছুসময় দাও আমি বানিয়ে নিয়ে আসবো।’ মাহা আরাফাতের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে কন্ঠে বললো।

আরাফাত সায় দিয়ে বললো,’আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি যাও।আর আমি একটু আমার ফাইলগুলো চেক করে নিই ততক্ষণে।’

-‘ওকে।’

মাহা রুম থেকে প্রস্থান করলো তৎক্ষনাৎ।আরাফাত ল্যাপটপ আর ফাইল কতগুলো নিয়ে বসলো চেক করতে।
__________

মাহা রান্নাঘরে এসে দেখলো মিসেস মুমতাহিনা চুলায় কী যেন রান্না করছেন।কাছে গিয়ে দেখে ভুনা খিচুড়ি।মাহা খুশি হলো খুব।সে তবুও মিসেস মুমতাহিনাকে জিজ্ঞেস করলো,

-‘এত সকালে ঘুম থেকে উঠে ভুনা খিচুড়ি রান্না করছো যে মামণি?’
মিসেস মুমতাহিনা শিশুসুলভ হাসি ফুটিয়ে জবাব দিলেন,
-‘জানিস মা তোর বাবাই আজ হঠাৎ করে বললো ভুনা খিচুড়ি খেতে ইচ্ছে করছে তার।আর এরকম পরিবেশে আমার দুই ছেলেও ভুনা খিচুড়ি খুব পছন্দ করে, তাই আরকি তৈরি করছি।এইতো হয়ে যাবে আর মিনিট খানিক পর।’

-‘ভালোই হলো।আজ তোমার ছেলেও আমাকে বলছে ভুনা খিচুড়ি খাওয়ার কথা।’

-‘আরাফাত বলেছে বুঝি?’

-‘হ্যা।সাথে বুট ডাল ভুনা আর ডিম ভাজাও খেতে মন চাচ্ছে তার।’

-‘ওহ,তাহলে তুই এক কাজ কর মা।ডাল ধুয়ে ভিজিয়ে রাখা আছে দেখ।ওগুলো একটা ডেগচিতে নিয়ে পানি ঢেলে চুলায় বসিয়ে দে।বাকিটুকু আর তোর করতে হবে না।আমি আছি।তুই বরং আরাফাতের জন্য এককাপ গরম চা নিয়ে রুমে যা।’

-‘তুমি একা করবে কেন মামণি?আমি বরং হেল্প করি তোমায়!’

-‘হেল্প করার জন্য জেনি আছে তুই চিন্তা করিস না।বেশিসময় লাগবে না তো,একটু পরই তৈরি হয়ে যাবে সব।’

-‘আচ্ছা তুমি তোমার কাজ করো আমি বরং ডিমগুলো ভাজি।একদম না করতে পারবে না।’ মাহা নাছোড়বান্দার মতো কাজ করতে লাগলো।মিসেস মুমতাহিনাও আর জোর করলেন না।যা মন চায় করুক,সমস্যা নেই।

মাহা পটু হাতে ডিম ভাজছে একের পর এক।খিচুড়ি রান্না শেষ।এখন মিসেস মুমতাহিনা ডাল ভুনা করছেন শুধু।ইশানীও এসে কাজে হাত লাগালো।ইশানী দুই ভাইয়ের টিফিন তৈরিতে মনযোগ দিয়েছে।বৃষ্টি দেখে লিসা,নিসা,রিহাদ ওরা আজ স্কুলে যাবে না।তাই এক্সট্রা কিছু তৈরি করারও কোনো ঝামেলা নেই।

সব তৈরি হওয়ার পর মাহা আরাফাতের জন্য একটা ট্রে তে করে খাবার বেড়ে নিয়ে রুমে চলে এলো।আজকে যে যার ব্রেকফাস্ট নিজেদের রুমেই করবে।তাদের পরিবারে এমন কোনো সিস্টেম নেই যে বাধ্যতামূলক একসাথে ডাইনিং এ বসে খাবার খেতেই হবে।বরং যার যখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবেই খেতে পারে সকলে, কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

আরাফাত ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি,ডাল ভুনা,ডিম ভাজা,আর কড়া লিকারের দুধ চা দেখে জিভ চাটলো ঘনঘন।এখনই জিভে পানি এসে গেছে তার।খাওয়ার জন্য তর সইছে নাহ।মাহা ট্রে টা রাখতেই কাজটাজ সব ফেলে হামলে পড়লো সে খাবারের ওপর।মাহা হাসলো শুধু কিছু বললো না।আরাফাতের সাথে সেও সুস্বাদু মজার খাবারটা মিস না করে খেতে বসে গেল।সমস্ত খাবার চেটেপুটে শেষ করলো দুজন।তৃপ্তির ঢেকুর তুললো আরাফাত।আজকের মুডটা মনে হচ্ছে অনেক ফুরফুরে থাকবে।

বেলা পৌনে নয়টা বেজে গেছে প্রায়।আরাফাত তৈরি হয়ে গেছে অফিসে যাওয়ার জন্য।
সঠিক সময়ে ব্যাগ হাতে মাহাকে হাসিমুখে বাই বলে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।আরাফাতকে জনাব এরশাদ নিজে গাড়ি চালাতে মানা করেছেন।নতুন একটা গাড়ি কিনেছে আরাফাত মাহার পছন্দে।তবে সেই গাড়ি ড্রাইভার চালায়।তার চালানো নিষিদ্ধ।

মাহা আরাফাতের পিছু পিছু বাহিরে এসেছে।আকাশের বুকে অন্ধকার হয়ে মেঘ জমাট বেঁধে বসে আছে।কখন যে হুড়মুড়িয়ে ঝরে পড়বে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই।মাহা ড্রাইভারের কাছে একটা ছাতা দিলো।কখন প্রয়োজন পড়ে বলা যায় না।আরাফাত গাড়িতে বসে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহার দিকে।সে যতই মাহাকে দেখে ততই তৃষ্ণা জাগে তার মনে।মনে হয় এই দেখার কোনো শেষ নেই।মাহা আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বললো,

-‘অফিসে পৌঁছে একটা ফোন করবে আমায়।মনে থাকবে তো?’

-‘অবশ্যই।এটা ভুলে যাওয়া সম্ভব নাকি?তুমি আছো তো সবসময় মনে করিয়ে দেয়ার জন্য।’ আরাফাতের ঠোঁটের কোণে একটুকরো স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠে।আরাফাতের হাসি দেখে মাহাও হাসলো।আরাফাত হাত নেড়ে টাটা দেখালো।ড্রাইভারও তৎক্ষনাৎ গাড়ি স্টার্ট করে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেছে।আরাফাত লম্বা একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে গা এলিয়ে বসেছে পিছনের সিটে।শরীর এখানে থাকলেও মন যে পড়ে রয়েছে মাহার নিকট।এই মেয়েটার জন্য দিওয়ানা সে।অতীতের সমস্ত কালো অধ্যায়ের স্মৃতিগুলো মাহা একলহমায় মুছিয়ে দিয়েছে।এখন চাইলেও কিছু মনে পড়ে না অতীতের কথা।মাহার ছোঁয়ায় মনে হয় জাদু আছে।নয়তো এই কয়েকমাসে এত পরিবর্তন,কী করে সম্ভব?
________

মাহা বারান্দায় বসে আছে চুপচাপ।বাইরে ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে অনবরত।আরাফাত অফিসে পৌঁছে গিয়েছে প্রায় ঘন্টাখানেক হবে।প্রতিদিনকার মতো ফোন দিয়ে পৌঁছে যাওয়ার খবর জানিয়েছে সে মাহাকে।

মাহা হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ধরতে ধরতে ভাবলো,এখনই মোক্ষম সুযোগ আরাফাতের মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা বের করার।মাহা জানে আরাফাত তাকে অনেক ভালোবাসে,তাও সে ওর মুখ থেকেই শুনে নিজের কলিজাটা ঠান্ডা করতে চায়।একটা সুখের সংসার সাজাতে চায় যেখানে তাদের দুজনের মধ্যে কোনো জড়তা থাকবে না।সেই সংসারে বাচ্চা কাচ্চা থাকবে,আরাফাত আর মাহা দুজন দুজনকে প্রচন্ড ভালোবাসবে এমনই একটা সুন্দর গোছানো সংসার তার বহুদিনের লালিত স্বপ্ন।সেই স্বপ্ন তো বাস্তবে রূপান্তর করতে হবে তাই না?সেজন্যই একটা ট্রিকস করার প্রয়োজন।
_________

আজকে মাহা আরাফাতকে না জানিয়ে বিকেলেই নিজের বাসায় রওনা দিলো।বৃষ্টি এখনো অবিরাম ধারায় ঝরে যাচ্ছে।থামাথামির কোনো নামই নেই।আসার সময় বাসার সবাইকে জানিয়ে এসেছে যে সে বাবার বাসায় যাচ্ছে কয়েকদিনের জন্য।তার খুব মন চাচ্ছে পরিবারের সকলকে দেখতে,তাই মিসেস মুমতাহিনাও বাঁধা দিলেন না।থাক মেয়েটা এতদিন ধরে এখানে আরাফাতের সেবায় মশগুল ছিলো।তারও তো ইচ্ছে করে নিজের বাবার বাসায় গিয়ে থাকতে।তাই আর তিনি বাঁধা দিলেন না।উল্টো নিজের হাতে রান্না করা তরকারি,আচার সব বাটিতে আর বয়ামে ভরে দিয়েছেন।

মাহা গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে চারপাশ দেখছে।রাস্তাঘাটে মানুষ আছে ঠিকই তবে বৃষ্টির কারণে তুলনামূলক কম লোকজন দেখা যাচ্ছে।বৃষ্টি এত জোরবেগেও হচ্ছে না আবার আস্তেগতিতেও হচ্ছে না।মাঝারি গতিতে পড়ছে।এই কয়েকদিনের মেঘেই রাস্তাঘাট কাঁদা পানিতে টইটুম্বুর।

রাস্তায় জ্যাম ছিলো বিধায় বাসায় পৌঁছাতে আধাঘন্টা সময় লেগেছে মাহার।বাসায় পৌঁছে মাহা ড্রাইভারকে চা বিস্কুট খাইয়ে গাড়িসমেত ওই বাসায় পাঠিয়ে দিলো।মিসেস মিনারা তো মেয়েকে পেয়ে ভীষণ খুশি।তার চাইতেও বেশি খুশি হয়েছে জাওয়াদ।সে তো পুঁপি এসেছে পুঁপি এসেছে বলে চেঁচাচ্ছে খুশির ঠেলায়।

রাহাত বাসায় নেই।জনাব আতিকও বাসায় নেই।দুজনেই তাদের কর্মস্থলে রয়েছেন।তবে জনাব আতিক যেই ফোনে স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছেন মাহা এসেছে, তিনি তৎক্ষনাৎই রওনা দিয়েছেন বাসায় আসার জন্য।আজ কতটাদিন পর মেয়ে বাসায় এসেছে।এই আনন্দে তিনি মেয়ের পছন্দের টাটকা মাছ, মাংস, সবজি আনার জন্য বাজারের দিকে গাড়ি ঘুরালেন।

মাহা জিমিকে কোলে নিয়ে ইরার সাথে সোফায় বসে গল্প করছে।আরাফাত এই নিয়ে দুবার ফোন দিয়েছে তাকে।সেও কল রিসিভ করে স্বাভাবিকভাবে তার সাথে কথা বলেছে।আরাফাত বিন্দুমাত্র টের পায় নি যে মাহা ও বাসা থেকে চলে এসেছে।

-‘ভাবী আমি বরং রুমে যাই।ক্লান্ত লাগছে খুব।একটু ঘুমাবো।’ মাহার ভালো লাগছে না কিছু।তাই সে রুমে চলে যাওয়ার বাহানা খুঁজছে।

-‘আগে সন্ধ্যার নাশতা করে যাও মাহা।তারপর ঘুমিও।’

ইরা ফুলমতিকে ডেকে বললো নাশতার ট্রে নিয়ে আসতে।ফুলমতিও আজকে খুশিতে বাকবাকুম করছে।মাহা আসায় যেন এ বাড়িতে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছে।এখন অনেক বেশি প্রাণবন্ত লাগছে সবকিছু।মিসেস মিনারা ফুলমতির হাতে একটা ট্রে ধরিয়ে দিয়ে নিজেও একটা ট্রে নিয়ে এসে মাহার পাশে বসলেন।আদুরে কন্ঠে বললেন,

-‘নে মা।খা!তোর পছন্দের সব নাশতা বানিয়েছি।’

মাহা স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে তাদের সাথে টুকটাক গল্প ও আড্ডার সহিত সন্ধ্যার মজাদার নাশতা খেতে লাগলো।একটুপরই জনাব আতিক এসে হাজির।মেয়ের জন্য দুহাতে ব্যাগ ভরে বাজার সদাই করে নিয়ে এসেছেন তিনি।এসেই মেয়ের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন।মাহাও আর ওঠে যেতে পারলো না।বরং সবার সাথে মন খুলে খোশগল্প করতে লাগলো।
__________

আরাফাত ক্লান্ত হয়ে বাসায় প্রবেশ করলো।চারিদিকে তাকিয়ে মাহাকে খুঁজলো একবার, পেল না।মনে মনে ভাবলো হয়তো রুমে আছে।মিসেস মুমতাহিনা এসে ছেলেকে বললেন রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে।আরাফাতও কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে এলো।রুমে এসেও মাহাকে দেখতে পেল না।তবে তেমন একটা মাথা না ঘামিয়ে পরণের কাপড় পাল্টে ফ্রেশ হতে চলে গেল ওয়াশরুমে।ফ্রেশ হয়ে এসেও মাহাকে দেখতে পায় না সে।এবার ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো তার।
“আজব তো,কোথায় আজকে হানি!এতক্ষণ লাগে নাকি রুমে আসতে?সে জানে না এমন সময় আমি বাসায় আসি!” আনমনে বিরবির করে আরাফাত।

এবার আর ধৈর্য্য ধরতে না পেরে মাহাকে জোরে জোরে নাম ধরে ডাকতে লাগে সে,

-‘হানিই,,এই হানি!কই তুমি?হানি!রুমে আসো!’

দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে ডাকছে মাহাকে আরাফাত।ওর ডাক শুনে মিসেস মুমতাহিনা দ্রুত রুমের সামনে এসে বললেন,

-‘কাকে ডাকছিস তুই?মাহা এখন কোথা থেকে আসবে?ও তো তার বাবার বাসায় গিয়েছে আজকে বিকেলে!কেন তোকে বলে যায় নি?’ মিসেস মুমতাহিনা অবাক।তিনি মনে করেছেন আরাফাত জানে মাহার যাওয়ার ব্যাপারে।

আরাফাত হতভম্ব মিসেস মুমতাহিনার কথা শুনে।সে মনে হচ্ছে ভুল শুনতে পেয়েছে।কান চুলকে জিজ্ঞেস করলো,
-‘কী বললে আম্মু?হানি বাসায় নেই?বাবাইদের বাসায় গিয়েছে?কই আমাকে তো বলে যায় নি!’

মিসেস মুমতাহিনা বললেন,’ও আর এমনকি!হয়তো মনে নেই তোকে বলার কথা।মেয়েটা এতদিন ধরে নিজের বাবার বাসায় যায় না।মুখ ফুটে বলেও না কখনো।আজ যখন বললো তখন আমিও মানা করি নি।থাক ক’টাদিন ওখানে গিয়ে।মনটা ফ্রেশ হবে!’

-‘তাই বলে আমাকে জানিয়ে যাবে না?এটা কেমন কথা হলো?আমি ওর হাসবেন্ড হই!’ চড়া কন্ঠে বললো সে।মেজাজ বিগড়ে গেছে আরাফাতের।মূলত বাসায় এসে মাহাকে না দেখেই তার মাথাটা গরম হয়ে গেছে।

-‘এত হাইপার হচ্ছিস কেন বাবা?এখানে তো সে ভুল কিছু করে নি।নিজের বাবার বাসায় যেতে আবার অনুমতি চাইতে হবে কেন?যাকগে আমি যাই তুই রেস্ট নে কতক্ষণ।আমি চুলায় তরকারি বসিয়ে এসেছি।’ মিসেস মুমতাহিনা এই বলে চলে গেলেন রান্নাঘরে।আরাফাত দুম করে দরজা লাগিয়ে বিছানার ওপর এসে বসলো।সন্ধ্যার আগেও মাহাকে কল দিয়েছিলো সে,তখনও তো এ ব্যাপারে কিছু বলে নি।তবে এরকম কেন করলো সে।

-‘সে জানে না,আমার তাকে না দেখলে ক্লান্তি দূর হয় না।তার গায়ের সুবাস না শুঁকলে আমার ঘুম আসে না।তবে আজ এভাবে আমাকে ছেড়ে কেন চলে গেল।আমি মেনে নিতে পারছি না!’ আরাফাত করুন কন্ঠে বিরবির করছে।রাত একটুও পার হবে না মাহাকে ছাড়া।ঘুম আসা তো দূরের কথা।

সহ্য করতে না পেরে মাহার ফোনে কল দিলো সে।কিন্তু রিং হয়ে যাচ্ছে মাহা রিসিভ করছে না।বেশ কয়েকবার কল দিয়েও যখন মাহার তরফ থেকে কোনো রেসপন্স পাওয়া গেল না তখন মেজাজ তুঙ্গে ওঠলো আরাফাতের।আছাড় মেরে বিছানার ওপর ফোন ফেললো সে।মাহা কাজটা মোটেও ভালো করে নি।মোটেও না।
_________

মাহা কিছুক্ষণ বারান্দায় বসে তারপর রুমে এসে শুয়ে আরাফাতের কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেল।না জানি মানুষটা এখন কী করছে।রাত দশটায় সবার সাথে তুমুল আড্ডা দিয়ে ডিনার সেরেছে সকলে।খাওয়া শেষে বাকিরা সজাগ থাকলেও মাহা ঘুমাবে বলে নিজের রুমে চলে এসেছে।অল্প কতটুক ভাত খেয়েছে সে।গলা দিয়ে ভাত নামে নি তার।তারপরও কেউ যাতে সন্দেহ না করে এজন্য একটু তো এক্টিং করতে হয়েছে।

এদিকে আরাফাত একটা দানাও খেতে পারে নি।মিসেস মুমতাহিনা এত বলেকয়েও আরাফাতকে খাওয়াতে পারেন নি।আরাফাত নিজের রুমে চুপচাপ এসে আধশোয়া হয়ে বসে আছে।চোখ সিলিংয়ের দিকে আটকে আছে।এমন সময় তার চোখ গেল সেন্টার টেবিলের কোণের দিকে।একটা সাদা কাগজ দেখা যাচ্ছে।সে আনমনে কাগজটা হাতে নিয়ে খুলে দেখলো গোটা গোটা অক্ষরে কয়েকটা লাইন লেখা আছে তাতে।চিরকুটই বলা যায়।

“তুমি যখন তোমার জ্ঞানে এসেছিলে,তখন তোমার প্রথম কথাটাই ছিলো তুমি আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মানো না।তখনই মেনে নিয়েছিলাম তোমার কথা।ওয়াদা করেছিলাম তুমি সুস্থ হয়ে গেলে তুমি তোমার পথে আর আমি আমার পথে চলে যাবো।
আজ তুমি সুস্থ হয়েছো,তাই আমিও আমার কথা রাখলাম।চলে এসেছি তোমাকে সকল বাঁধন থেকে মুক্ত করে।আমার থেকেও সুন্দরী কোনো মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হও।ভালো থেকো।”

আর কিছু লেখা নেই।কিন্তু এতোটুকুই যথেষ্ট ছিলো ছিলো আরাফাতের মেজাজ গরম করে দেয়ার জন্য।কাগজটাকে দলামোচড়া করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো,

-‘বললেই হয়ে গেল নাকি!তখন বুঝি নি তাই ওসব বলেছিলাম।কিন্তু এখন আমি জানি আমার প্রাণ ভোমরা কে?সো তোমার এসব ফাউ কথা ধরে বসে থাকবো না আমি।আমার তোমাকে চাই মানে চাই।এবং সেটা এক্ষুনি।আই ব্যাডলি নিড ইউ হানি!আই মিস ইউ সো মাচ।আমি এক্ষুনি আসবো তোমার কাছে।আমার ভালো থাকার মেডিসিন দূরে থাকলে আমিও ভালো থাকতে পারবো না।আমার তোমাকে এই মুহুর্তে চাই।নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তোমাকে ছাড়া।’

কাগজটা ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে ফোন হাতে রুম থেকে ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলো আরাফাত।এই মুহূর্তে তার মাহার কাছে যাওয়া অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজন।নাহলে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটবে আত্মার।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে