অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -২৩

0
1782

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_২৩

আরাফাত বিছানার ওপর শুয়ে আনমনে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনাটাকে উল্টে পাল্টে বিশ্লেষণ করছে সে।কী সাহস মেয়েটার ভাবা যায়!কারও কোনো তোয়াক্কাই করে না।আজকে লিপিকে কী নাকানিচুবানিটাই না খাওয়ালো ভাবতেও বারবার অবাক লাগছে আরাফাতের।

মাহা রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেছে ঘন্টাখানেক হবে।আরাফাতের উদাসীনতা যেন দুটি চড়ুই পাখি উপলব্ধি করতে পারলো তাই তো তারা জানালার শিকে এসে বসে চুইই চুইই করে ডেকে আরাফাতের মনযোগ তাদের দিকে আকর্ষণ করেছে।আরাফাত চড়ুইদের কর্মকাণ্ড লক্ষ করতে গিয়ে যাবতীয় চিন্তাদি সব আউড়ে গেল।এর কিছুক্ষণ পর রুমে মাহার আগমন ঘটে।হাতে রেস্টুরেন্টের একটা ব্যাগ।আরাফাত মাহাকে দেখে শোয়া থেকে ওঠে বসে।চড়ুই দুটো মাহার আগমনে ভরকে গিয়ে ফুরুৎ করে পালিয়ে গেল।

মাহা মুচকি হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে ব্যাগ খুলে আরাফাতের হাতে দুটো হামবার্গার,ফ্রেঞ্চ ফ্রাই,চিকেন ফ্রাইয়ের প্যাকেট,কোক,দই ও সসের মিনিপ্যাক ধরিয়ে দিয়ে বললো,
-‘নাও,এগুলো খাও!আজকে তোমার পছন্দের ফাস্ট ফুড আনিয়েছি ড্রাইভার ভাইকে দিয়ে।’

আরাফাত খুব খুশি হলো খাবার গুলো দেখে।এক্সিডেন্টের পর থেকে ফাস্ট ফুড শব্দটাই যেন হারিয়ে গেছিলো জীবন থেকে।আজ হয়তো মাহা রাহাতের থেকে পারমিশন পেয়ে তার জন্য এসব খাবার আনিয়েছে।কারণ বাংলাদেশের ফাস্ট ফুড গুলো বেশিরভাগই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি হয়,যা খেলে আরাফাতের এই অসুস্থ অনেক শরীরের ক্ষতি হতো সাথে ঔষধগুলোও কাজ করতো না।শরীরে অনেক বাজে একটা এফেক্ট পড়তো তখন।তাই রাহাতের নিষেধ করার ফলে বাসায় তেমন একটা ফাস্ট ফুড আনা হতো না।

আরাফাত এসব খেতে অনেক পছন্দ করে।তাই আরাফাত স্বভাবসুলভ মিষ্টি হেসে বললো,
-‘থ্যাংকিউ!আমার খুব ইচ্ছে করছিলো এসব খেতে।জানি না কী করে তুমি বুঝতে পারলে!’

-‘ম্যানশন নট!আর তোমার কখন কী মন চায় তার সব খবর আমি রাখি,এসব জিজ্ঞেস করে জেনে নিতে হয় না।’ মাহা আরাফাতের কপালের ওপর থেকে চুল সরিয়ে দিতে দিতে বললো কথাটা।

-‘ওহ,তা তুমি খাবে না হানি?’ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে।

-‘নাহ,তুমি খাও আমি একটু আসি।’

-‘আবারও কোথায় যাচ্ছো?’ আরাফাত অসহায় কন্ঠে জানতে চাইলো। ‘এখানে একটু বসো না। একা একা বসে থাকতে থাকতে বোরড হয়ে গেছি আমি।’

মাহা আরাফাতের গেঞ্জির কলার ঠিকঠাক করে দিয়ে মৃদু হেসে বললো,
-‘জগে পানি নেই।পানি নিয়ে তারপর আসছি।’

আরাফাতের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে মাহা মুচকি হেসে সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে খালি জগটা হাতে নিয়ে রুম ত্যাগ করলো।আরাফাত মাহার যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো পলকহীন।এই মেয়েটা তাকে এত বুঝে কীভাবে?আরাফাত নিজেও নিজের মনের কথা এতটা ঠাহর করতে পারে না ঠিক মতো,অথচ মাহা কী করে জানি সব বুঝে যায়।এতটা স্বামীপরায়ণ মেয়ে সে খুব কমই দেখেছে।মাঝেমধ্যে আরাফাতের মনে হয়,মাহাই তার একমাত্র সোলমেট!
_________

লিপি প্রায় ২ ঘন্টা সময় ধরে ঠোঁটের ওপর অবিরাম ঠান্ডা পানি ঢেলেছে।ঠোঁট জ্বলার কারণে বেহুঁশ হবার উপক্রম তার।পানি ঢালতে ঢালতে ক্লান্ত হয়ে গেছে বেচারি।জ্বলুনির পরিমাণ কিছুটা কমতেই সে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।এতক্ষণ ওয়াশরুমের ফ্লোরে বসে মগ দিয়ে পানি ঢালছিলো এই অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে।শাওয়ারও ছাড়া ছিলো।পুরো গোসল করে ভেজা গায়ে বেরিয়ে এসে অতঃপর রুমের ভেতর কাপড় পাল্টেই বিছানার ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে সে।মারাত্মক ক্লান্ত থাকায় চোখ বন্ধ করা মাত্রই ঘুমিয়ে গেল।এত ধকল শরীরটা আর নিতে পারছে না।মাহা আজকে তাকে খুব ভালো একটা শিক্ষা দিয়েছে।এই শিক্ষার তাসির বহুদিন থাকবে।
___________

আজকে জনাব এরশাদ সমস্ত কাজ শেষ করে সন্ধ্যার পরপরই বাসায় চলে এসেছেন।বিকেলে একবার এসে জরুরি ডকুমেন্টসের ফাইল নিয়ে আবারও চলে গিয়েছিলেন তিনি।
আজকে সাইফও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসেছে।তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।অবসাদজনিত সমস্যায় পড়েছে।কালকে এত জার্নি করে এসে আবার সকালে অফিসে চলে যাওয়ায় শরীরটাও ক্লান্ত লাগছে তার ভীষণ।তাই এসেই সে নিজের রুমে চলে গেছে রেস্ট নিতে।রিহাদও তার বাবার পিছু পিছু ছুটলো।

মিসেস মুমতাহিনা স্বামীর সাথে সোফায় বসে চা বিস্কুট খাচ্ছেন আর টুকটাক গল্প করছেন।মাহা তার চারাগাছগুলোকে গ্যারেজের ভেতর রেখে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে মিসেস মুমতাহিনার অপজিটের খালি সোফায় এসে বসেছে।

মাহার দিকে তাকিয়ে জনাব এরশাদ বললেন,
-‘গাছ সব কিনে এনেছিস মামণি?’
-‘হ্যা বাবাই।সব জোগাড় করে ফেলেছি।কাল শুধু লাগানোর পালা।’
-‘গুড জব!গাছ লাগানো খুবই ভালো একটা কাজ।আই এপ্রেশিয়েট ইউ।ক্যারি অন!’

মিসেস মুমতাহিনা মুখ ঝামটি মেরে মাহার দিকে তাকিয়ে বললেন,’দেখ দেখ,কীভাবে ফটর ফটর করে ইংরেজিতে কথা বলছে।’

-‘সো হোয়াট? তোমার এত জ্বলছে কেন শুনি?’ জনাব এরশাদ স্ত্রীকে রাগানোর জন্য বললেন।মিসেস মুমতাহিনা সত্যি সত্যিই রেগে গেলেন।তিনি বললেন,’আমার সামনে ইংরেজিতে ফরফর করবে না বলে রাখলাম।যা বলার সোজাসাপ্টা বাংলায় বলবে বুঝেছো?’

-‘হ্যা বেগম বুঝেছি।’ জনাব এরশাদ আর তাঁকে চটাতে চাইলেন না।শেষে বউ রাতে মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে রাখবে।পরে দেখা যাবে রাগানোর ফল রাতেই বুঝিয়ে দিয়েছে ভালো করে।থাক বাবা দরকার নেই বউকে চটানোর।যা বলছে তা মেনে নেয়া যাক।

তাদের খুনসুটি দেখে মাহা হাসছে।এমনসময় আরাফাত ক্রাচে ভর দিয়ে ধীরলয়ে হেঁটে হেঁটে লিভিং রুমে এলো।মাহা বসা থেকে ওঠে আরাফাতের হাত ধরে জনাব এরশাদের পাশে বসিয়ে দিলো।জনাব এরশাদ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

-‘হাঁটতে কী এখন আগের মতো কষ্ট হয় বাপ?’

-‘না আব্বু।এখন একাই ক্রাচে ভর করে হাঁটতে পারি।তেমন একটা কষ্ট হয় না।’ স্বগতোক্তি করলো আরাফাত।

মিসেস মুমতাহিনা গদগদ কন্ঠে মাহার প্রশংসা করে বললেন,
-‘আমার মেয়েটা কত যত্ন করে তোর বাবা।নয়তো এত জলদি তোর সুস্থতা আশা করা আমাদের জন্য স্বপ্ন ছিলো একপ্রকার।মেয়েটা প্রতিদিন হাতে পায়ে মালিশ করে দেয়,নিয়মমাফিক ঔষধ খাইয়ে দেয়,তোর সবদিক খেয়াল রাখে।অন্য কোনো মেয়েকে বউ করে আনলে কখনোই এত জানপ্রাণ সঁপে সেবা করতো না,যতোখানি সেবা মাহা করে থাকে।চোখে চোখে রাখে তোকে সর্বক্ষণ,কখন কী প্রয়োজন সবদিকেই নজর রাখে।আল্লাহ জানেন তুই কোন পূণ্য করেছিস,নয়তো মাহার মতো মেয়েকে কী নিজের বউ করে পেতিস?পছন্দ করেছিলি তো একটা কালনাগিনীকে।’

-‘আহ মামণি, এসব পুরনো কথা বাদ দিয়ে নাশতা করো!’ মাহা বাঁধ সেধে কথাটি বললো।আরাফাত চোরাচোখে মাহার দিকে একপলক তাকালো।সত্যিই মাহা তার অনেক সেবা করে।এখনকার যুগে এমন আদর্শ স্ত্রী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর বলা যায়।

মাহা একটা কাপে কেতলি থেকে গরম চায়ের লিকার ঢেলে তাতে দুধ চিনি পরিমাণ মতো দিয়ে চামচ নেড়ে ভালো মতো মিশিয়ে আরাফাতের হাতে ধরিয়ে দিলো।আরাফাত মুচকি হেসে চায়ের কাপ হাতে নিয়ে তাতে তৎক্ষনাৎ চুমুক বসালো।

এমন সময় লিপি লিভিং রুমে এসে হাজির হলো।ওকে কিছুটা বিধ্বস্ত লাগছে দেখতে।লিপির চোখে দাউদাউ করে প্রতিশোধের আগুন জ্বলছে।
তাকে দেখে মাহার মুখের পেশি রাগে শক্ত হয়ে গেছে,আরাফাতও অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো ওর পানে।জনাব এরশাদ হাসিমুখে লিপিকে বললেন,

-‘কী খবর তোমার লিপি?সন্ধ্যার নাশতা খেয়েছো তো?নাহলে বসে যাও আমাদের সাথে!’

লিপি কোনো কথাবার্তা ছাড়াই মাহার কাছে এসে মাহাকে থাপ্পড় মারতে গেল।বেচারি মরিচ লাগানোর প্রতিশোধ না নিলে শান্তি পাবে না মনে।মাহার দিকে তেড়ে যেতে দেখে সকলে অবাক।মিসেস মুমতাহিনা হায়হায় করে বলে উঠেন,

-‘আরে আরে,কী করছিস তুই লিপি?’

লিপি যেন প্রতিশোধের নেশায় পাগল হয়ে গেছে।মাহার গালে থাপ্পড় পড়ার আগেই মাহা লিপির হাত মুচড়ে বাঁকিয়ে পিঠের দিকে ধরে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো।আরাফাতের মাহাকে নিয়ে চিন্তা নেই,বরং কিছুটা ভয় হচ্ছে লিপির জন্য।কারণ মাহার যে পরিমাণ রাগ,সেই রাগ যদি একবার লিপির ওপর ঝাড়তে শুরু করে তবে বেচারা লিপি একদম ভস্মীভূত হয়ে যাবে।

-‘ছাড় আমার হাত,আজকে তোকে আমি মেরেই ফেলবো।অনেক সহ্য করেছি আর নয়।আজকে তোকে মেরে দরকার পড়লে আমি জেলের ভাত খাবো।তাও তোকে খুন করবো আমি।’ লিপি উন্মাদের মতো আচরণ শুরু করেছে।জনাব এরশাদ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছেন।তিনি কন্ঠে কঠোরতা টেনে বললেন,

-‘এসব কেমন ব্যবহার লিপি?তুমি মাহার সাথে এমন বিহেভিয়ার কেন করছো!’

লিপি এসব শোনায় মন দিচ্ছে না।সে বাইন মাছের মতো ছটফট করে মাহার হাতের বাঁধন থেকে পিছলে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় মত্ত।মাহা এবার কোনো কথা ছাড়াই ঠাস ঠাস করে তার দুই গালে দুই চড় বসিয়ে দিলো।লিপি একটুর জন্য থমকে গেল।চোখে যেন মাহার আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হচ্ছে।মিসেস মুমতাহিনা এসে লিপিকে ধরলেন।মাহার দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি।কারণ ওনারা জানেন মাহা যুক্তিসঙ্গত কোনো কারণ ছাড়া কারও সাথে লাগতে যায় না।মিসেস মুমতাহিনা মাহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-‘লিপি তোর থেকে বয়সে বড় হয় মাহা!তুই তার গায়ে হাত তুললি কেন?’

এবার লিপি আগ বাড়িয়ে মাহা কিছু বলার পূর্বেই কান্না করে হড়বড়িয়ে বলে উঠে,

-‘খালামণি,তুমি একটা ডাইনিকে তোমার ছেলের বউ করে এনেছো গো।মেয়েটা খুবই বাজে।জানো আজকে ও আমার ঠোঁটে নাগা মরিচ ডলে দিয়েছিলো খালামণি।একটুর জন্য আমি প্রাণে বেঁচে গেছি।আমার একটাই দোষ ছিলো তা হলো আমি তাকে বলেছি শুধু সে আরাফাতের যোগ্য নয়।এ কথা বলতেই আমার ওপর এত অত্যাচার করলো তোমার ছেলের বউ।কত খারাপ হলে এমনটা কেউ করতে পারে।আমি এখানে আসার পর থেকেই ও আমাকে দেখতে পারে না।কতবার আমার ক্ষতি করার ট্রাই করেছে তাও আমি কিছু বলি নি।কিন্তু আজ আমার সহ্যের বাহিরে চলে গেছে সব।’

মাহা ক্রুর হাসি দিয়ে বললো,
-‘তাই নাকি বাবুটা!আমি তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছি।বাহ ভালোই গল্প ফেঁদেছো তো।তাহলে আজকে তোমার আসল মুখোশটা খুলে দিই কী বলো?’

এতক্ষণে লিভিং রুমের হইচই বাকিদের কানে চলে গেছে।সাইফ,ইশানী,লিসা এসে হাজির হয়েছে লিভিং রুমে।তারা এতক্ষণ সব শুনেছে।সাইফ এবার মাহার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘লিপি যা যা বললো তা কী সত্যিই নাকি মাহা?কেন জানি আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।’

-‘একটু অপেক্ষা করেন ভাইয়া,আজকে আপনার সো কল্ড খালাতো বোনের মনের প্যাচগোছ সব আপনাদের দেখিয়ে দিবো।জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’ মাহার জন্য খুব ভালো একটা সুযোগ করে দিয়েছে লিপি।যদি অন্যভাবে প্যাচিয়ে কোনো বুদ্ধি করতো তবে একটু প্যারায় পড়তে হতো মাহাকে।মাহা এই পর্যন্ত যতটুকু বুঝতে পারছে তা হলো লিপির মাথায় বিন্দুমাত্র ঘিলুও নেই।যদি থাকতো তবে এভাবে সবার সামনে হাঁটে হাঁড়ি ভাঙতো না।যেখানে তার নিজের দিকেই সকলে আঙ্গুল তুলবে।

এদিকে লিপি নিজের চিপায় নিজেই ফাঁসতে যাচ্ছে।মনে মনে নিজেকে কষে একশোটা লাথি মারছে।প্রতিশোধ তো অন্যভাবেও নেয়া যেতো।আজকে কী দরকার ছিলো সবার সামনে এভাবে রাগের মাথায় এই সিনক্রিয়েট করার।এজন্যই মা তাকে বকে,বলে,”তোর শুধু বালের এই রাগ খানাই আছে।ঘটে সিকিটুকু বুদ্ধিও নেই।এই গোবর ভরা মাথা থেকে মাস্টার মাইন্ড প্ল্যান বের করা জীবনেও সম্ভব না!” আজ মনে হচ্ছে মায়ের কথাটাই সঠিক।নয়তো এভাবে কেউ বোকার মতো যেচে এসে ফাঁসে?আগেই বোঝা উচিৎ ছিল যে নিসা মাহাকে সব বলে দিয়েছে,যার ফলে সে সমস্ত কাহিনি জেনে গেছে।লিপির এখন গলা ছেড়ে কাঁদতে মন চাইছে।কী কল্পনা করেছিলো আর কী হয়ে গেল!

মাহা লিসার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘নিসা কই লিসা?ওকে ডেকে আন তো একটু!’

লিসা আমতা আমতা করে বললো,
-‘আপু,আসলে নিসার জ্বর ওঠে গেছে পায়ের ব্যথার চোটে।এখনও ঘুমিয়ে আছে।জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে ওর।’

জনাব এরশাদ এবার গমগমে গলায় বললেন,
-‘আমার মেয়েটার জ্বর ওঠলো কীভাবে?সকালেও তো ভালো দেখে গিয়েছিলাম।আর ব্যথা পেল কীভাবে মুম?’

-‘আমিও তো জানি না।কীভাবে জ্বর এলো?’ মিসেস মুমতাহিনা চরম মাত্রায় অবাক।

এবার লিপি ঘামতে লাগলো।আল্লাহ জানেন কী লেখা আছে কপালে।

মাহা এবার সবার দিকে তাকিয়ে লিপির দিকে আঙ্গুল তাক করে জবাব দিলো,

-‘নিসাকে আজ তোমার গুণধর বোনঝি মেরেছে দেখেই জ্বর এসেছে।সে আজ যা করেছে তা জানলে তোমরা ওকে নির্ঘাত বাসা থেকে বের করে দেবে!’ মাহা তাচ্ছিল্য হাসলো।

এবার সকলের নজর গেল লিপির দিকে।লিপি তো চোরের ন্যায় এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।এমন একটা জায়গায় আছে সে বর্তমানে যেখান থেকে একপাও নড়া যাবে না।খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সে আজকে এই বাসায় তার শেষ দিন।

সাইফের মাথা এবার গরম হয়ে গেল।ক্রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-‘নিসাকে তুমি কেন মেরেছো লিপি?কী করেছিলো সে?তোমার সাহস হয় কী করে ওর গায়ে হাত তোলার?’

মাহা এবার আরাফাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
-‘তুমি এক্ষুনি এই মুহুর্তে তোমার সাথে লিপি যা যা অসভ্যতামি করেছে তা সব অকপটে খুলে বলবে।শুরু করো এবার!’

আরাফাত প্রথমে একটু আমতা আমতা করলো।তারপর ধীরে ধীরে সমস্ত কিছু খুলে বলতে লাগলো।আরাফাতের মুখ থেকে এসব শুনে ঘৃণায় গা গুলিয়ে এলো সবার।ইশানী ছি বলে উঠে।মিসেস মুমতাহিনা এবার ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলেন লিপির গালে।হেয় কন্ঠে বললেন,

-‘ছি ছি ছি,ঘরে কালসাপ ঢুকিয়ে রেখেছি আমি এতদিন।এত খারাপ তুই জানতাম না তো।কীভাবে পারলি তুই এই কাজটা করতে।আরাফাত তোর ভাই হয়,সাথে সে একটা বিবাহিত ছেলে।তুই,, ছি আমার ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে।অনেক ভালো করেছে মাহা তোকে শায়েস্তা করে।আরও দেওয়া উচিত ছিলো।’

-‘শুধু কী তাই!নিসার সামনে এমন কুকর্ম করায় নিসা তাকে কয়েকটা কথা শুনিয়েছিলো বলে নিসাকে থাপ্পড় মেরে মাটিতে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছে ও।ওর পা বেকায়দা ভাবে মোচড় খেয়ে মচকে গিয়েছে।আর এই ব্যথার চোটে জ্বর এসেছে আমার বোনটার।’ মাহা কথাগুলো যুক্ত করে বললো।

জনাব এরশাদ এবার সোজা মিসেস মুমতাহিনাকে বলে দিলেন,
-‘এই মুহূর্তে যেন তোমার বোনঝি আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।এত খারাপ কোনো মেয়ের জায়গা এখানে হবে না।অনেক হয়েছে।আর না।আমার পরিবারে আর কোনো অশান্তি আমি চাই না।এক্ষুনি চলে যেতে বলো।’

মিসেস মুমতাহিনা এবার লিপির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-‘যা তোর জামাকাপড় সব গুছিয়ে নিয়ে আয়।সসম্মানে তোর বাসায় যাবি।আর কোনো কথা হবে না এখানে।যা দ্রুত যা।’

লিপি সকলের দিকে একবার ক্রোধান্বিত দৃষ্টি হেনে হনহন করে নিজের রুমে চলে গেল।মিনিট দশেক পর বেরিয়ে এলো লাগেজ হাতে।মিসেস মুমতাহিনা ড্রাইভারকে বলে দিয়েছেন লিপিকে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসতে।লিপি সবার দিকে তাকিয়ে বললো,

-‘আজ আমি এখান থেকে যেভাবে অপমানিত হয়ে যাচ্ছি,অভিশাপ দিলাম তোমাদের সংসারে যেন কখনোই সুখশান্তির ছোঁয়াও না লাগে।আর হ্যা মাহা তোকে বললাম,যেই স্বামীর জন্য এতকিছু করছিস,সেই তোকে ছেড়ে দিয়ে অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে।তোর সংসার বেশিদিন টিকবে না,বড়াই থাকবে না তোর মনে রাখিস!’

-‘আরে যা যা,তোর দেয়া অভিশাপ ঘুরেফিরে তোর উপরই পড়বে।মনে রাখিস শকুনির দোয়ায় কখনো গরু মরে না।’

মাহার তাচ্ছিল্যের সহিত বলা কথা শুনে পিত্তি জ্বলে গেল লিপির।রেগেমেগে হনহন করে বাসা থেকে সোজা বেরিয়ে গেলো কারও তোয়াক্কা না করে।মিসেস মুমতাহিনা ড্রাইভারকে ইশারা দিয়ে বললেন তার পিছন পিছন যেতে।হাজার হোক মেয়েটাকে এভাবে একা একা যেতে দেয়া যায় না।ওর এই খারাপ হওয়ার পিছনে ওর মা বাবার যথেষ্ট অবদান আছে।নয়তো সুশিক্ষা পেলে মেয়েটা ভালোই হতো।

জনাব এরশাদ রাগে গজগজ করতে করতে নিসা’দের রুমে চলে গেলেন।মিসেস মুমতাহিনাও ছুটলেন পিছু পিছু।মেয়ের অবস্থা কী জানার জন্যই এত ব্যাকুলতা।সকলেই গিয়ে নিসাকে দেখে এলো।ভালোই জ্বর এসেছে তার গায়ে।সাইফ ডক্টরকে কল দিয়েছে বাসায় আসার জন্য।
___________

এসব ভেজাল শেষ করতে করতে রাত বাজে এখন পৌনে বারোটা।রাতের খাওয়া সবাই আজ একসাথে করতে পারে নি।সকলের মন মেজাজ বিগড়ে আছে।একসাথে বসে খাওয়ার মুড নেই কারও।তাই যে যার রুমে বসেই রাতের খাবার সেড়েছে আজ।মিসেস মুমতাহিনা আজ লিসা নিসার সাথে থাকবেন।নিসাকে ডক্টর এসে দেখে গিয়েছে।ডক্টর আশ্বস্ত করে বলে গেছেন জ্বর এক-দুদিন হয়তো স্থায়ী হবে এরপর কমে যাবে।

মাহা আরাফাতের মাথার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে বিলি কেটে দিচ্ছে।আরাফাত পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে রেখেছে।মাহার পেটে মাথা রেখে আরাম করে শুয়ে আছে সে।হঠাৎ মাহার দিকে চোখ ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘লিপি যে তোমাকে অভিশাপ দিয়ে গেল,তার কোনো বাজে এফেক্ট আমাদের ওপর এসে পড়বে না তো?’

মাহা মুচকি হেসে প্রতুত্তরে জবাব দিলো,
-‘কেউ যখন অন্য কাউকে বদদোয়া করে,তখন তার সাথে থাকা ফেরেশতারা তার জন্যও পাল্টা সেই একই দোয়া করে আমিন আমিন বলতে থাকেন।বুঝলে কিছু?’

আরাফাত সশব্দে হেসে ফেললো।মাহাও তার সাথে তাল মিলিয়ে হাসছে।দুজনের হাসির ঝংকার সারারুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে