অন্যরকম অনুভূতি পর্ব -০৭

0
1947

#অন্যরকম অনুভূতি
#লেখিকা_Amaya Nafshiyat
#পর্ব_০৭

আরাফাতকে তার নিজের রুমের বিছানায় শুইয়ে দেয়া হয়েছে।রাহাত তার হাতে ক্যানোলার মাধ্যমে সেলাইন লাগিয়ে দিলো।আরাফাতকে ২৪ ঘন্টা দেখেশুনে রাখার জন্য এবং তার যাবতীয় সবদিক খেয়াল রাখার জন্য দুজন ছেলে নার্স রাখা হয়েছে।মাহা ড্রয়িং রুমে বসে আছে।অন্য কোনো দিকে ধ্যান নেই তার,কীভাবে আরাফাতকে নিজের করা যায় মনে মনে সেই প্ল্যান কষতে ব্যস্ত সে।

রাহাত এসে মাহার পাশে বসলো।ইশানী চা বিস্কুট নিয়ে এসেছে ট্রে তে করে।মি.এরশাদ শুকনো মুখে বসে আছেন কপালে হাত রেখে।সাইফ উদাসীন হয়ে বসে আছে চুপচাপ।মি.আতিক চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনযোগ সহকারে চা খাচ্ছেন।সবাই আরাফাতকে নিয়ে চিন্তায় আছে।কীভাবে তাকে সুস্থ করে তোলা যায় সেই চিন্তা ভাবনা চলছে সবার মনে।গলা খাঁকারি দিয়ে রাহাত কথা শুরু করলো;

রাহাত:-ইয়ে বলছিলাম,আরাফাতকে যদি বিয়ে দেয়া যেত তাহলে বোধ হয় ভালো হতো।

সাইফ বাঁধ সেধে বললো;

সাইফ:-কী বলিস?এই অবস্থায় বিয়ে কীভাবে সম্ভব?

রাহাত:-দেখ আমি যা বলছি ভেবেচিন্তেই বলছি।বিয়ে হলে ওর দ্রুত সুস্থ হওয়ার চান্স আছে।এমন কাউকে ওর স্ত্রী করে আনা প্রয়োজন যে কীনা নিজের সর্বস্ব দিয়ে তার যত্ন করবে।নার্স রা যা করবে তার থেকে বহুগুণে কেয়ার করবে নিজের স্ত্রী।এখন ওর মস্তিষ্কের ওপর যে খারাপ প্রভাবটা পড়েছে তা হয়তো বিয়ের পর স্ত্রীর সান্নিধ্যে থেকে কেটেও যেতে পারে।

রাহাতের কথায় যুক্তি আছে তাই সাইফ পাল্টা কিছু না বলে চুপ হয়ে গেল।মি.এরশাদ দুই আঙ্গুল দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে চিন্তিত সুরে বললেন;

মি.এরশাদ:-তা নাহয় বুঝলাম।কিন্তু এত ভালো মেয়ে কোথায় পাবো?কোনো মেয়েই তো এমন অবস্থায় আরাফাতকে বিয়ে করতে রাজি হবে না।

রাহাত:-হুম,সেটা আমিও চিন্তা করছি।সুস্থ থাকলে মেয়েদের লাইন পড়ে যেত ওর পিছে।আর এখন একটা মেয়েও পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনের জন্য।

মাহা এতক্ষণ গালে হাত রেখে তাদের কথোপকথন শুনছিলো।মনে মনে বললো;

“আমাকে তো তোমাদের চোখে পড়বে না কোনোদিন।ঘরের কাছেই এত ভালো মেয়ে রেখে অন্য দিকে খুঁজতেছে পাগলের দল।আমি চিন্তায় মরি কীভাবে তাকে নিজের করবো আর ওরা তাকে অন্য কোথাও বিয়ে দেয়ার প্ল্যান করছে।হুহ,যত্তসব ফাউল।”

মি.আতিক এতক্ষণে কথা বললেন;

মি.আতিক:-রাহাতের কথাই ঠিক মনে হচ্ছে আমার কাছে।ওকে বিয়ে দিলেই বরং সুস্থ হয়ে ওঠবে।ওই বদমাশ মেয়ের কাছ থেকে যে শকটা পেয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে ভালো একটা মেয়েকে দরকার।যে কীনা তাকে নিজের মতো করে আগলে রাখবে।

মিসেস মিনারা:-বলা যতো সহজ মনে হচ্ছে,করা কিন্তু ঠিক ততোটাই কঠিন।এত ভালো মেয়ে কোথায় পাবে?যে মেয়েগুলো বিয়ে করতে রাজি হবে সে মেয়েগুলো নির্ঘাত সম্পত্তির জন্য রাজি হবে।বিয়ের আগে একরূপ দেখাবে,বিয়ের পর আরেক রূপ দেখাবে।তার থেকে ভালো এখন এসব চিন্তা বাদ দাও।নিজেরা ওর টেককেয়ার করে সুস্থ করার চেষ্টা করা যাক বরং।

রাফি:-হুম এটাই বোধ হয় ভালো হবে।নিজেরাই আপ্রাণ চেষ্টা করি ওকে সুস্থ করে তোলার।

আর কোনো কথা হলো না।রাহাত আরাফাতকে একবার চেক-আপ করে বিদায় নিয়ে মাহা ও বাবা মাকে নিয়ে রওনা দিলো নিজের বাসার উদ্দেশ্যে।মিসেস মুমতাহিনা অবশ্য না খাইয়ে ছাড়লেন না তাদের।

☁️

সময় তার নিজস্ব গতিতে চলছে।এরপর প্রায় কেটে গেছে আরও অনেকগুলো দিন।আরাফাতের হাত পা আস্তে ধীরে রিকোভার করতে শুরু করলেও ওর মস্তিষ্কের আঘাতটা রয়েই গেছে।কন্ঠনালিও ঠিক হয় নি।কোনোরকম কোনো কথা বলতে পারে না।একপ্রকার বাক প্রতিবন্ধীর মতো।কারও কথায় কোনো রেসপন্স করে না এখনও।আগে যেমন ছিলো এখনও তেমনই আছে।একটা মেয়েকে ঠিক কতো পরিমাণ ভালোবাসলে কারও এমন অবস্থা হতে পারে তা ভেবে কুল পায় না কেউ।

মাহা ভাইয়ের আদেশমতো পড়াশোনায় মন দিয়েছে।যদিও একদিন পর পর আরাফাতকে দেখতে যায় সে।মাহা ঠিকঠাক সুযোগ পাচ্ছে না পরিবারের কাউকে নিজের মনের কথা বলার জন্য।রাহাতের চেহারা দেখলেই ওর ভয়ে আত্মা কাঁপে।সেখানে কীভাবে আরাফাতের কথা তুলবে ভেবে পায় না সে।তাও বেচারি সঠিক সময়ের অপেক্ষায়ই অধীর আগ্রহে বসে আছে।একটা না একটা সুযোগ তো আসবেই।

তেমনই একদিন একটা সুযোগ সে পেয়েই গেল।
আজকে মাহা ভার্সিটিতে না গিয়ে দুপুরের পর সোজা চলে এসেছে আরাফাতদের বাসায়।ওদের বাসায় ছেলেমানুষ কেউ নেই আজ।সবাই সবার এতদিনের জমানো কাজকর্ম গুলো সম্পন্ন করতে গিয়েছে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে।লিসা নিসা এবার ক্লাশ টেনে পড়ে।ওরাও স্কুলে গিয়েছে।আরাফাত ঘুমিয়ে আছে নিজের রুমে।ইশানীও ছেলেকে নিয়ে নিজের রুমে ঘুমাচ্ছে।সজাগ শুধু মিসেস মুমতাহিনা।তিনি কিছুক্ষণ কথাবার্তা বললেন মাহার সাথে।অতঃপর ওনার বোনের কল এলো ওনার ফোনে।ওনিই দিয়েছিলেন কল কিন্তু ওনার বোন ব্যস্ত ছিলো বিধায় ফোন ধরতে পারেন নি।এখন কল দিয়েছে।মিসেস মুমতাহিনা বোনের সাথে কথা বলতে লাগলেন।ফোন লাউডে দেয়া ছিলো বিধায় মাহা সব শুনছে সোফায় বসে।

“কী রে ফোন দিয়েছিলি মনে হয়!আমি একটু ব্যস্ত ছিলাম বিধায় দেখি নি।”

মিসেস মুমতাহিনা:-ওহ,কেমন আছো আপা?

“হ্যা আছি ভালোই।তুই কেমন আছিস?”

মিসেস মুমতাহিনা:-এই তো আছি কোনোরকম।

“তোর ছেলের কী অবস্থা?উন্নতি হচ্ছে নাকি ওর?”

মিসেস মুমতাহিনা একটা দীর্ঘঃশ্বাস ছেড়ে জবাব দিলেন;

মিসেস মুমতাহিনা:-না আপা।অবস্থা তেমন একটা ভালো নয়।পুরোপুরি সুস্থ হতে সময় লাগবে কিছু।বুঝোই তো কতবড় এক্সিডেন্ট হয়েছে ওর।

“তা আর বলতিস?তোর ছেলের মাথানষ্ট পুরো!এত ভালো ভালো মেয়ে রেখে কী না প্রেম করলো এক বারো ভাতারি মেয়ের সাথে।আর এই মেয়ের কারণে ওর এই অবস্থা।আমার মেয়ে কোন অংশে কম ছিলো?সুন্দর,স্মার্ট,শিক্ষিত মেয়ে আমার,পাগল ছিলো আরাফাতের জন্য।কিন্তু একটু পাত্তাই দেয় নি আমার মেয়েকে।এখন হলো তো!”

মিসেস মুমতাহিনা নিরবে হজম করে গেলেন বড় বোনের কটুবাক্যগুলো।শুনতে খারাপ লাগলেও সত্যি কথাই বলেছেন ওনি।

মিসেস মুমতাহিনা:-এখন তো আর কোনো বাঁধা নাই আপা,তুমি বললে লিপিকে আমার পুত্রবধূ করে নিয়ে আসি।আরাফাত আর কিছু বলবে না।আমি চাই লিপি আমার ছেলের বউ হয়ে আসুক।এখন তুমি যদি,,

মিসেস মুমতাহিনা কথা সম্পূর্ণ করতে পারলেন না।ওপাশ থেকে কর্কশ কন্ঠে ভেসে আসলো;

“মাথা নষ্ট হয়ে গেছে নাকি তোর?তোর ছেলে সুস্থ সবল হলে একটা কথা ছিলো,এখন এই অবস্থায় ভাবলি কী করে তোর ছেলের সাথে আমার মেয়ের আমি বিয়ে দেবো?তোর ছেলে কোনোদিন ভালো হবে কীনা তারই কোনো গ্যারান্টি নেই,আর আমি আমার ফুটফুটে মেয়েটার জীবন নষ্ট করবো তোর ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে!এসব বলতেই ফোন করেছিস তাই না?যখন প্রস্তাব দিয়েছিলাম তখন তো একদম মা ছেলের পায়া ভারী হয়ে গিয়েছিলো।এখন আবার যেচে আমার পায়েই এসে পড়ছো দেখি।এতদিন তো আমার কথা মনে পড়ে নি,তাহলে এখন কী নিজেদের স্বার্থের জন্য কল করেছিস?”

বোনের কাছ থেকে এমন কিছু শুনবেন বলে আশা করেন নি মিসেস মুমতাহিনা।কষ্ট লাগছে ভীষণ ওনার।এই বোনের ছেলেমেয়েদের পড়ার খরচ চালিয়েছেন তিনি নিজে।স্বামী জুয়ারি বলে সংসারে কোনো খরচ আনতে পারতো না।সেই মিসেস মুমতাহিনা নিজের স্বামীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিয়ে বোনকে সাহায্য করে এসেছেন।আর আজ তার বোন তার সাথে এমন ব্যবহার করছে।সাহায্যের প্রতিদান মানুষ এভাবেই দেয় বুঝি।আজ ছেলেমেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে রোজী রোজগার করছে বলে এমন অহংকারী হয়ে গেল তার মায়ের পেটের আপন বড় বোন!ভাবতেই ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ওনার।আপনজনদের বলা কটুকথা বুকে তীরের বেগে আঘাত হানে।ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় মন।

মাহার তো এসব শুনে মেজাজটাই বিগড়ে গেছে।এই মহিলাকে সে কোনোকালেই পছন্দ করে না।কেমন দাম্ভিক দাম্ভিক ভাব মহিলার।যেন সে বিল গেটসের বউ।যেমন মহিলা তেমন তার মেয়ে,এই মেয়েটার হাত চাইছেন কেন মামণি?বুঝতে পারছে না মাহা।মিসেস মুমতাহিনার ধরা কন্ঠে বলা কথায় ধ্যান ভাঙে তার।

মিসেস মুমতাহিনা:-আমার ছেলে যখন সুস্থ ছিলো তখন তো তুমি একদম পিছনে পড়ে ছিলে তাকে নিজের মেয়ের জামাই বানাবে বলে!আর আজ সে এক্সিডেন্ট করে সাময়িক অসুস্থ বলে সাথে সাথে মুখ ফিরিয়ে নিলে?এই তোমার লীলা?বাহ!আমার ছেলেটা আজ এতদিন হলো এক্সিডেন্ট করে বিছানায় পড়ে আছে,অথচ তুমি তাকে একটাদিন দেখতেও আসো নি!তুমি নাকি ব্যস্ত?কীসের এত ব্যস্ততা যে নিজের বোনপোকে একবার চোখের দেখাও এসে দেখে যেতে পারো নি?তাও কিছু বলি নি তোমায়।যাইহোক,এমন বোন না থাকাই ভালো বলে আমি মনে করি।আপনের চাইতে পর মানুষ অনেক ভালো হয় শুনেছিলাম,এখন তা হারে হারে মিলে গেল।ভালো থেকো,আর কখনো কল দিবো না তোমায়।মরে গেলেও আর খোঁজ খবর নেয়ার দরকার নেই।

মিসেস মুমতাহিনা ওনার বোনকে আর কিছু বলতে না দিয়ে খট করে ফোন কেটে দিলেন।চোখ থেকে ওনার অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছে।মাহার ভীষণ খারাপ লাগছে দেখে।মহিলাটি নিজের বোনের সাথে এমন ব্যবহার না করলেও পারতো।এত খারাপ কোনো মানুষ হয়?মাহা তার মামণির কাছে গিয়ে দুহাত দিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।মিসেস মুমতাহিনা এবার বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলেন।তিনি আজ অনেক কষ্ট পেয়েছেন নিজের বোনের কথায়।এমনিতেও প্রচুর মনোকষ্টে ভুগছেন তিনি।ছেলের এই অবস্থা সবমিলিয়ে যাচ্ছে-তাই পরিস্থিতি!

মিসেস মুমতাহিনা কেঁদে কেঁদে বললেন;

মিসেস মুমতাহিনা:-মাহা রে,দুনিয়ার মানুষ এত স্বার্থপর কেন?নিজের আপন বোনও সেই লিস্ট থেকে বাদ গেলো না।আপন লোকেরাও স্বার্থের জন্য ব্যবহার করে আমায়।আমার খুব কষ্ট হয় রে মা।

মাহা:-মনখারাপ করো না মামণি।এসব আত্মীয়দেরকে তুমি বয়কট করে চলো।হাজার নিজের আপন মায়ের পেটের বোন হোক না কেন,এদেরকে এড়িয়ে চলো।দরকার নেই এমন আপন লোকের যাদেরকে বিপদের সময় পাশে পাওয়া যায় না।নিজেকে শক্ত রাখো মামণি।আমরা সবসময় তোমাদের সাথে আছি।

মিসেস মুমতাহিনা কান্না থামিয়ে নিজেকে সামলে কোনোমতে মাহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন;

মিসেস মুমতাহিনা:-দোয়া করি মা অনেক বড় হো জীবনে।নিজের আপনজনকে কখনো এভাবে কষ্ট দিবি না।সবসময় লয়্যাল হয়ে থাকবি।আগলে রাখবি।

মাহা:-অবশ্যই মামণি।

মাহা এবার একবুক সাহস অর্জন করে মামণিকে নার্ভাস হয়ে বললো;

মাহা:-মামণি,তোমার কাছে একটা জিনিস চাওয়ার আছে আমার।তুমি অভয় দিলে তবেই চাইবো!

মিসেস মুমতাহিনা কষ্টমিশ্রিত মলিন একটা হাসি দিয়ে বললেন;

মিসেস মুমতাহিনা:-বলে ফেল মা।আমার কাছে এত ভয় পাওয়ার কী বোকা মেয়ে?তুই কিছু চাইবি আর আমি না দিয়ে পারি বল?

মাহা একমুহূর্ত চুপ থেকে অতঃপর আসল কথাটা বলেই দিলো;

মাহা:-আমি আরাফাত ভাইয়াকে বিয়ে করতে চাই মামণি।আমি বাল্যকাল থেকেই ওনাকে ভালোবেসে আসছি।কখনো বলি নি।লামিয়ার সাথে ওনার রিলেশনের কথা শোনার পর সাহস করে আর নিজের মনের কথাটা বলতে পারি নি।মনের কথা মনেই থেকে গেল।আজ যেহেতু তাঁর জীবনে কেউ নেই,তাই সেই জায়গাটা আমি নিতে চাই।করুণা করে নয় মামণি।আমি তাকে ভালোবাসি বলেই বিয়ে করতে চাই।ওনার সুখের জন্যই তাকে লামিয়ার সাথে মেনে নিয়েছিলাম।বাঁধা দিই নি একটুও।কিন্তু এখন আর না বলে পারছি না মামণি।তুমি প্লিজ কিছু একটা করো।

মিসেস মুমতাহিনা বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন।এই মুহূর্তে তার কেমন রিয়েক্ট করা উচিৎ তিনি তা ভেবে পাচ্ছেন না।মাহাকে যে তিনি কী বলবেন সেটা খুঁজতে হিমশিম খাচ্ছেন।পরিস্থিতি যদি সহজ সাবলীল থাকতো তবে কপট রাগ দেখিয়ে মেয়ের এত পাকা কথা শুনে কান টেনে ধরতেন তিনি।কিন্তু এখন তো মজা উড়ানোর মতো পরিস্থিতি নেই।

তবে মারাত্মক অবাক হয়েছেন তিনি মাহার এত সিরিয়াসলি বলা কথাগুলো শুনে।তিনি মাহার থেকে এমন একটা কথা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না।অস্ফুটস্বরে বলে উঠলেন তিনি;

মিসেস মুমতাহিনা:-এসব কী বলছিস মাহা?তোর মাথা ঠিক আছে তো?তুই বুঝতে পারছিস তুই কী বলছিস?

মাহা দৃঢ় কন্ঠে বললো;

মাহা:-আমি সজ্ঞানে থেকে সত্যি কথাই বলছি মামণি।সত্যি বলতে তো কোনো ভয় পাওয়ার কথা না!ভালোবাসি তাই সেটা বলে দিলাম।তোমার ছেলে তো কখনোই আমায় পাত্তা দেয় নি।সে নাকি আমাকে সবসময় নিজের বোনের নজরে দেখে আসছে।কিন্তু আমি তো তাকে কখনো ভাইয়ের নজরে দেখি নি।আমি ছোটবেলা থেকেই সবসময় চাইতাম আরাফাত ভাইয়া যেন আমার বর হয়।তোমাকে তো কতবার বলতাম,তুমি হেসেই উড়িয়ে দিতে।সিরিয়াসলি কখনো নাও নি।

মিসেস মুমতাহিনা বিভ্রান্ত হয়ে বললেন;

মিসেস মুমতাহিনা:-আমি তো মনে করতাম তুই মজা করে বলতি ওসব।সত্যিকার অর্থে তো সিরিয়াসলি নেই নি কখনো।তখন কী আর জানতাম যা বলছিস সত্যি বলছিস?

মাহা:-আচ্ছা মামণি,আমাকে কী আরাফাত ভাইয়ার সাথে মানাবে না?হয়তো গায়ের রঙটা আরাফাত ভাইয়ার গায়ের রঙ থেকে অনেকটাই মান্দা,এজন্য তুমি বোধহয় আমাকে নিজের ছেলের বউ রূপে পছন্দ করতে চাইছো না?তোমার বোনজি লিপি তো আমার থেকে মারাত্মক সুন্দরী আর স্টাইলিশ,আমি তো ওর মতো না।এজন্য তুমি,,

মাহা মনখারাপের ভান সাথে কিছুটা চালাকি এড করে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কথাগুলো বলছিলো,মিসেস মুমতাহিনা ধমক দিয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন;

মিসেস মুমতাহিনা:-চুপ পাগল মেয়ে!একটা থাপ্পড় দিবো এসব ফাউল কথা বললে!তুই জানিস তুই কতোটা সুন্দর?গায়ের রঙ ফর্সা হয়ে গেলেই কী সব সুন্দর হয়ে যায়?আমার বোকা ছেলেটাও তো সুন্দরের পিছনে দৌঁড়ে নিজের আজ এই অবস্থা করলো।সুন্দরী ছিলো তো কী হলো?চরিত্রের তো কোনো ঠিকঠিকানা ছিলো না!এমন সৌন্দর্যের গুষ্টি শুদ্ধো বিনাশ হোক।আর রইলো লিপির কথা।লিসার কাছ থেকে শুনেছি ওরও নাকি নাগর আছে।তোর মতো এত ভালো মেয়ের পায়ের নখের যোগ্যও তো কোনোটা হবে না।তুই তো একপিসই আছিস রে মা!তোকে অপছন্দ করে কার সাধ্য?

মিসেস মুমতাহিনা মাহার থুতনি ধরে শেষের কথাগুলো বললেন।মাহা সলজ্জ হাসলো।সে জানে মিসেস মুমতাহিনা তাকে প্রচুর ভালোবাসেন।নিজের মায়ের কাছে যেমন অনায়াসে কোনোকিছুর আবদার করা যায়,তেমনই এই মামণির কাছেও অকপটে সব আবদারের ঝুড়ি খুলে বসে মাহা।মায়ের পরে এই মামণিই তাদের আরেক মা।ওনার ভেতর ওনার বড় বোনের মতো কোনো প্যাঁচগোছ নেই।একদম সহজ সরল একজন মানুষ।

হালকা একটু কষ্ট পেলেও ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদেন।অন্যের দুঃখের গল্প শুনেও কাঁদেন,নিজের কষ্টেও কাঁদেন,দুঃখের কোনো নাটক বা মুভি দেখলেও কাঁদতে কাঁদতে ভাসিয়ে ফেলার মতো ট্যালেন্ট নিয়ে জন্মেছেন ওনি।ওনার স্বামী তো তাঁকে ছিঁচকাঁদুনে মহিলা বলে ব্যঙ্গ করেন সবসময়।নতুন বিয়ের পর মি.এরশাদ একদিন কী কারণে রেগে গিয়ে একটা ধমক মেরেছিলেন মিসেস মুমতাহিনাকে।সেদিন কী কান্নাটাই না করেছেন ওনি।মি.এরশাদ এখনো সেদিনের কথা বলেন আর হাসেন।তারপর আর কোনোদিন মারা তো দূরে থাকুক,একটা ধমকও দেন নি কখনো স্ত্রীকে।আদরে আদরে মুড়িয়ে রেখেছেন সবসময়।

মাহা মিসেস মুমতাহিনার হাত ধরে বললো;

মাহা:-একটা সুযোগ দিয়ে দেখো মামণি।তোমার ছেলেকে এই বছরের মধ্যেই একদম সুস্থ করে তোলবো আমি কথা দিচ্ছি।আমার ভালোবাসার জোরে ওনাকে আমি সুস্থ করবো।অন্য কারও সাথে ওনাকে বিয়ে দিতেই পারো কিন্তু আমি যেভাবে আগলে রাখবো নিজের ভালোবাসা দিয়ে অন্য কেউ আমার মতো করে সেটা কখনোই করতে পারবে না।এতটা বছর ধরে যদি একাধারে ভালোবেসে আসতে পারি,তবে বাকিটা জীবন কেন পারবো না বলো?তোমরাই তো চাও এমন কেউ একজন স্ত্রী হয়ে আসুক যে কীনা তোমাদের ছেলেকে অনেক ভালোবাসায়,আদর,যত্নে আগলে রাখবে!আজ আমি মেয়ে হয়ে তোমার ছেলের হাত চাইছি,ফিরিয়ে দিয়ো না মামণি!

মাহার করুন কন্ঠে বলা কথাগুলো মিসেস মুমতাহিনার একদম হৃদয় স্পর্শ করে গেল যেন।সত্যিই তো এমন একজনকে চাইছেন তিনি ছেলের বউ হিসেবে।চোখের সামনে এত ভালো মেয়ে রেখে কী না তিনি দুনিয়া হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।মাহাই তো আরাফাতের বউ হিসেবে পারফেক্ট হবে একদম।মাহার কথা শুনে পুরোপুরি গলে গেলেন তিনি।তবে মাহার পরিবারের কথা ভেবে একটু দমে গেলেন।বললেন;

মিসেস মুমতাহিনা:-তোকে নিজের পুত্রবধূ করার জন্য আমি একপায়ে রাজী আছি।তোর বাবাইকে বললে সেও ফট করে রাজী হয়ে যাবে।এখন কথা হলো গিয়ে তোর বাবা আর ভাইকে নিয়ে।ওরা কী রাজী হবে তাদের বাড়ির ছোট মেয়ে আমাদেরকে দিয়ে দিতে?

মিসেস মুমতাহিনার কন্ঠে চিন্তার রেশ বিদ্যমান।মাহা একবিন্দু দেরী না করে ফট করে বলে উঠলো;

মাহা:-বাবাই যদি একবার প্রস্তাব দেন আব্বুর কাছে,তাহলে ড্যাম শিওর আব্বু রাজী হয়ে যাবেন।কারণ আব্বুর জানে জিগার ন্যাংটা কালের দোস্ত হলেন বাবাই।এত বছরের ফ্রেন্ডশিপ বলে কথা।প্রস্তাব নাকচ করার কোনো প্রশ্নই আসে না।আর রইলো কথা ভাইয়ার।ভাইয়া চায় আমি পড়াশোনা কমপ্লিট করে একজন ভালো পদের সরকারি চাকুরিজীবি হই।যদিও আমার কোনো ইচ্ছা নেই সরকারি চাকরি করার।তো সে এখন চায় না আমার বিয়েশাদি হোক।তবে মনে হয় না বাবাই প্রস্তাব দিলে রিজেক্ট করবে বলে।গাইগুই করলেও শেষে রাজী হয়ে যাবে ঠিকই।বিয়েটা শুধু সময়ের ব্যাপার।

মিসেস মুমতাহিনা:-তাহলে তো হয়েই গেল।আজকেই তোর বাবাইকে বলবো মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসার কথা।কয়েকদিনের মধ্যেই প্রস্তাব নিয়ে যাবো ইনশাআল্লাহ।এখন বুঝতে পারছি আমার ছেলের জন্য একমাত্র তুই-ই পারফেক্ট।শুধু শুধু আমার সো কলড বোনকে ফোন দিয়ে যেচে অপমানিত হতে গেলাম।

মিসেস মুমতাহিনার কথা শুনে হেসে ফেললো মাহা।মুহূর্তেই সহজ হয়ে গেল পরিবেশ।মাহা হাফ ছেড়ে বাঁচল।সে ভাবে নি এত সহজে তার কাজ হাসিল হয়ে যাবে।মনে মনে ভীষণ খুশি সে।ফাইনালি ভালোবাসার মানুষটা তার হতে যাচ্ছে।উফফ,কী শান্তি।নিজেকে পালকের মতো হালকা মনে হচ্ছে এবার।

একটু পর লিসা নিসা চলে এলো বাসায়।মাহাকে দেখামাত্রই দৌড়ে এসেছে দুই বোন।

লিসা:-আপু তুমি কখন এলে?

মাহা:-এই তো একটু আগে এসেছি।

নিসা:-আজকে আপুকে যেতে দেবো না।আপু আমাদের বাসায় আজ তোমার থাকতেই হবে।

মিসেস মুমতাহিনা নিসার কথা শুনে বললেন;

মিসেস মুমতাহিনা:-তোদের আপুকে এবার সারাজীবনের জন্য নিয়ে আসবো আমাদের বাড়িতে।তখন আর যেতে পারবে না কোথাও।

কথাটা বলেই তিনি মুচকি হেসে বসা থেকে ওঠে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।লিসা নিসা হাবলার মতো তাকিয়ে আছে ওনার যাওয়ার পানে।মাহা কিছুটা লজ্জা পেল ওনার কথা শুনে।লিসা নিসা মনে করলো তাদের আম্মু মজা করেছেন তাদের সাথে।তাই তারা অতোটা মাথা না ঘামিয়ে মাহাকে ধরে একপ্রকার টেনে নিজেদের রুমে নিয়ে গেল।

দুই বোন গল্পের ঝুড়ি খুলে বসেছে যেন।তাদের কথা ফুরোচ্ছেই না।মাহা গালে হাত দিয়ে তাদের দুজনের কথা শুনে যাচ্ছে।লিসা একটা আনরেডি থ্রিপিসের প্যাকেট মাহার দিকে এগিয়ে দিয়ে হাসিমুখে বললো;

লিসা:-আপু এটা তোমার জন্য অনেক আগে কিনেছিলাম।কিন্তু এতদিন দেয়া হয়ে ওঠে নি এত এত ঝামেলার কারনে।মনেই ছিলো না।এখন মনে হলো।

মাহা:-আমার জন্য এসব কিনতে গেলি কেন?

নিসা:-মনে আছে আপু আমরা একবার প্ল্যান করেছিলাম যে সেইম ডিজাইনের ড্রেস পরে ফটোশুট করবো!এজন্য কিনেছিলাম,কিন্তু কে জানতো এমন দূর্ঘটনা ঘটবে?

মন খারাপ করে কথাটা বললো নিসা।মাহা মুখের হাসি বজায় রেখে বললো;

মাহা:-মন খারাপ করিস না পাগল।সবকিছু আবারও আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।

লিসা:-তাই যেন হয় আপু।এখন চলো আমরা ভাইয়াকে দেখে আসি।

মাহা দুরুদুরু বুকে বসা থেকে ওঠে দাঁড়ালো।আরাফাতের কাছে বা সামনে গেলে সে সবসময়ই এমন নার্ভাস হয়ে যায়।হয়তো ভালোবাসার মানুষ বলে।অন্য কারও সামনে গেলে কখনোই এমন ফিলিংস আসে না।এ যেন এক অন্যরকম অনুভূতি!

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে