#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
চতুর্ত্রিংশ পর্ব (৩৪ পর্ব)
জাহাঙ্গীর সাহেব ও নার্গিস পারভিন বাসায় চলে অনেকক্ষণ হলো। আহনাফ এখনো ছাদেই দাঁড়িয়ে আছে। একপাশের দেয়াল ঘেষে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। চিন্তায় এখন শুধুই সারাহ্ আর তার বেবি। ফোন বেজে উঠলো, আহনাফ চমকে উঠে পকেটে হাত দেয়।
ফোন বের করে আননোন নাম্বার দেখে কপাল কুঁচকায়। রিসিভ করতে ভ°য় করছে ওর। সাত পাঁচ ভেবে শেষে রিসিভ করে নেয়,
“আসসালামু..”
সালাম শেষ করার আগেই অপরপাশ থেকে অপরূপা বলে,
“কি ব্যাপার মিস্টার আহনাফ ফয়েজ? সারাহ্-কে কয়দিন লুকিয়ে রাখবেন? বউকে বাঁচাতে গিয়ে বাবাকে হা°রাবেন না তো?”
আহনাফের ভ°য়টা বেড়ে গেল। বাবা তো বাসায় একা। তবুও নিজেকে শক্ত রাখে সে। এভাবে ভে°ঙে পড়লে তো চলবে না।
“কে বলছেন?”
অপরূপা মৃদু হেসে বলল,
“রূপকথার অপরূপা আমি৷ তাহসিনার মৃ°ত্যুর সময় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানে, দুচোখ ভরে দেখেছি তার মৃ°ত্যুর কষ্ট।”
আহনাফ জবাব দিতে পারলো না। ওর কানে ওর ভালোবাসার মৃ°ত্যুর বর্ণনা বেজে চলেছে।
“তাহসিনার আপু, আপু বলে চিৎকার আর তাহমিনার ইমতিয়াজ বলা মিলেমিশে গিয়েছিল সেদিন। (একটু থেমে) ইশ, কেন যে ভিডিও করিনি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভিডিও হতো তবে।”
পাশে বসা শাফিনের দিকে তাকায় অপরূপা। আহনাফের ঢাকায় আসার সংবাদ জামিলের মাধ্যমে পেয়েছে ওরা। সেদিন জামিলের সাথে কি আচরণ আহনাফ করেছে তাও জানে। তাই আহনাফকে মানসিকভাবে দুর্বল করতেই এই ব্যবস্থা।
অপরূপা একটু জোরেই বলে,
“আরেকটা কথা, সারাহ্ প্রেগন্যান্ট তো। সামলে রেখো, প্রেগন্যান্ট মেয়েগুলো কিন্তু বেশি সুন্দরী হয়।”
“হেই, কেন বলছেন আমাকে এসব? আপনি..”
আহনাফের কথা শেষ হওয়ার আগেই কল কে°টে দেয় অপরূপা। আহনাফ কলব্যাক করলেও নাম্বার বন্ধ দেখায়।
অপরূপা ফোন রেখে বলে,
“দুলালের কোনো খোঁজখবর নেই কেন?”
“জার্মানি গেছে যতদূর শুনেছি। এখন কোনো খোঁজখবর নেই।”
“জার্মানি গিয়ে ম°রে গেছে নাকি?”
শাফিন হাসলো। ওর অন্ধকার অধ্যায়ের পুরোটা জুড়েই আছে অপরূপার স্থান। তার কু°কর্মের সম্পূর্ণ ভাগিদার এখন অপরূপা৷
এদিকে আহনাফ আব্বাস সাহেবকে কল দেন। আব্বাস সাহেব রিসিভ করলে আহনাফ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“কোথায় আছো বাবা?”
আব্বাস সাহেব হাসলেন। বলেন,
“বাড়িতে এসেছি, এখন তোমার বড়কাকার সাথে কথা বলছি। বাসায় একা একা ভালো লাগে না।”
আহনাফ স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে। বাবা তার ভালো আছে, একা নেই। আঁধারের রহস্যে ক্রমাগত হাতড়ে যাচ্ছে, কিছু কালো পাখি খবর দিচ্ছে কিন্তু ধরা দিচ্ছে না। এ বিহ্ব°লতার সমাধান পাচ্ছে না, আঁধারের শেষপ্রান্তেও পৌঁছাতে পারছে না।
______________________________________
রাত পৌনে একটা, নিজেদের বাসায় চলে এসেছে ইমতিয়াজ-মৃত্তিকা। বাসায় আসার পর থেকে এখনো ইমতিয়াজ একরুমে বসে আছে। রুমের দরজা বন্ধ, মৃত্তিকা ডাকলেও জবাব দেয় না।
তাহমিনার ওড়না হাতে নিয়ে ফ্লোরে বসে আছে ইমতিয়াজ। এ কেমন যন্ত্রণা সে জানে আর আল্লাহ্ জানে। ওড়নাটা নাকের কাছে নিয়ে তাহমিনার ঘ্রাণ অনুভব করে সে। কানের কাছে বেজে উঠে সেই ডাক,
“আমার তাজ।”
ওর তাজ ওর ডাকে সারা দেয়নি, ওকে বাঁচাতে পারেনি।
ডাইনিং এ বসে মৃত্তিকা একদৃষ্টিতে দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর উঠে গিয়ে আবারো দরজায় নক করতে নিয়ে দেখে দরজা খোলা। মৃত্তিকা দরজা ঠেলে ভিতরে এসে ইমতিয়াজের দিকে তাকালো। ধীরে ধীরে ওর সামনে গিয়ে বসে। হাতের মুঠোয় থাকা ওড়নাটা দেখে।
“তোমাকে দূরে থাকতে বলেছি না?”
ইমতিয়াজের কন্ঠটা অন্যরকম শোনালো। মৃত্তিকা ওর চোখের দিকে তাকায়, অনবরত কেঁদেছে মানুষটা। চোখ লাল হয়ে আছে, যেন এখনই র°ক্ত ঝরবে৷ ওর গালে থাকা অশ্রু মুছতে গেলে ইমতিয়াজ বাধা দিয়ে বলল,
“দূরে থাকতে বলেছি, কেন বারবার কাছে আসছো?”
হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠে ইমতিয়াজ,
“যাও।”
মৃত্তিকা সরে যায়। একটু দূরে গিয়ে বসে। এরকম অবস্থায় মানুষকে কখনো একা ছেড়ে দিতে হয় না। ছোট বাচ্চাদের মতো আগলে রাখতে হয়।
“মৃত্তিকা?”
বেশ কিছুক্ষণ পর ইমতিয়াজ আলতো সুরে ডাকে ওকে। মৃত্তিকা তাকাতেই বলে,
“মিনা খুব কষ্ট পেয়েছিল, আমাকে ডেকেছিল, আমি যাইনি বলে আরো কষ্ট পেয়েছিল। (একটু থেমে) বেবিটাও ডেকেছিল তাই না?”
মৃত্তিকা দ্রুত ওর কাছে যায়। ইমতিয়াজের কথায় বোঝা যাচ্ছে তার মানসিক অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছে। মৃত্তিকা ওর দুগালে ধরে বলল,
“ইমতিয়াজ, আমার দিকে তাকাও। এমন করো না প্লিজ। তুমি তো শক্ত মানুষ, এমন কেন করছো।”
ইমতিয়াজ ওকে সরিয়ে দেয়। মৃত্তিকা সরে না বরং ওকে ধরে টে°নে উঠায়। ইমতিয়াজের শরীর নি°স্তে°জ হয়ে গেছে, মৃত্তিকা ওকে বিছানায় বসিয়ে বলে,
“ইমতিয়াজ, শান্ত হও। একটু ঠান্ডা হয়ে ভাবো, এভাবে হাল ছেড়ে দিলে ওরা পার পেয়ে যাবে।”
ইমতিয়াজ চুপ করে বসে থাকে। আর দশজন মানুষের মতো ভাবনার শক্তি তার নেই। মৃত্তিকা ভাতের প্লেট নিয়ে আসে। ছোট ছোট লোকমা দিয়ে খাইয়ে দেয় নিজ হাতে।
______________________________________
সকাল সকাল তানজিমের সাথে দেখা করতে এসেছে আহনাফ। সামিহাও সাথে এসেছে। একপ্রকার জো°রাজু°রি করেই বেরিয়েছে আহনাফের সাথে। ঢাবির কার্জন হল এরিয়ায় এসেছে ওরা। তানজিম এখানেই আসার কথা। সামিহা জানে না আহনাফ এখানে কেন এসেছে।
তানজিম রিকশা থেকে নেমে ওদের দিকে এগিয়ে আসে। সামিহা ওকে দেখে হাত নেড়ে বলল,
“হাই।”
“হ্যালো।”
তানজিমও হাত নাড়ে।
আহনাফের সাথে সামিহাকে দেখে একটু অবাক হয় তানজিম। আহনাফের বিয়েটা পরিকল্পিত এইটুকু জানলেও আহনাফ কাকে বিয়ে করেছে তা তানজিম জানে না।
তানজিম কাছে আসতেই সামিহা আহনাফকে বলে,
“ওর নাম তানজিম, আমার ফ্রেন্ড।”
তানজিমের দিকে তাকিয়ে বলল,
“উনি হলো আহনাফ, আমার আপুর একমাত্র হাসবেন্ড।”
তানজিম মুচকি হেসে বলল,
“সারাহ্ আপু?”
“হ্যাঁ তো।”
বেশ ঢং করে কথাটা বলে সামিহা।
তানজিম আহনাফের সাথে কোলাকুলি করে বলে,
“কেমন আছো ভাইয়া? তোমার শ্যালিকা আমার ক্লাসমেট। আচ্ছা চলো, যাওয়া যাক।”
“তোমরা একজন আরেকজনকে চেনো?”
ঠোঁট উলটে প্রশ্ন করে সামিহা।
আহনাফ হেসে ওর গাল টে°নে ওর মতো ঢং করে বলে,
“হ্যাঁ তো।”
সামিহা গাল ফুলিয়ে সামনে সামনে হাঁটতে থাকে। আহনাফ একটু নিচুস্বরে তানজিমকে বলে,
“বিয়েটা পরিকল্পিত, কে করেছে এই পরিকল্পনা?”
তানজিম হাঁটার গতি কমিয়ে সামিহার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“হুম, কালরাতে কোনো এক মেয়ে কল দিয়েছিল। নাম অপরূপা। ও আবার তাহসিনার কথা বলছিল। আবার এই মেয়েটাই সারাহ্-র কিডন্যাপের কথা বলেছে।”
তানজিম রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“আপুকে সাবধানে রাখেন। উনি এমন একজনের নজরে পড়েছে যে নারী°পা°চারের সাথে যুক্ত আর (একটু থেমে) মানসিকভাবেও অসুস্থ বোধহয়।”
“মানে? কে সে?”
সামিহা ফিরে দৌড়ে ওদের কাছে আসে।
“কি কথা বলছো?”
আহনাফ মাথা নেড়ে বলল,
“কিছু না, চলো।”
ওরা দোয়েল চত্বর পর্যন্ত গেল। ওখানে রাস্তার পাশে গড়ে ওরা ছোট ছোট দোকানে সামিহাকে কিছু জিনিসপত্র দেখতে বলে ওরা আবারো একটু দূরে সরে।
“ভাইয়া, উনার নামটা আমি বলতে চাচ্ছি না। আমার জীবনের ইম্পোর্টেন্ট একজন।”
“উনি তোমার বোনদের মে°রেছে।”
তানজিম চুপ করে অন্যদিকে তাকায়। আহনাফ বলে,
“দেখো, তোমার সারাহ্ আপু অসুস্থ। নিজেকে রক্ষা করার মতো শক্তি ওর নেই, এখন সে এক থেকে দুইয়ে আছে। রি°স্ক নিতে চাই না আমি।”
তানজিম তবুও চুপ। আহনাফ চিন্তায় পড়ে, এমন কে হতে পারে ওর জীবনের এতো গুরুত্বপূর্ণ কেউ।
“আচ্ছা চলো।”
ফিরে তাকিয়ে সামিহাকে কোথাও দেখে না। আহনাফ এদিক ওদিক তাকিয়ে তানজিমকে বলে,
“সামিহা কোথায়?”
তানজিম চমকে উঠে আশেপাশে দেখে৷ পাগলের মতো এদিকসেদিক ছোটাছুটি করে সে। ভ°য়ে ওর হৃদপিণ্ডের গতি বেড়েছে। ঘেমে-নেয়ে একসারা হয়ে গেছে। আবার কোনো বি°পদ ওর না হয়ে যায়।
আহনাফের নজর রাস্তার অপরপাশের পুলিশ পোস্টের দিকে যায়৷ সামিহা ওখানে দাঁড়িয়ে ওকে চুপ থাকতে বলে। আহনাফ কপাল কুঁচকায়।
তানজিম ওকে দেখে দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে যায়। আহনাফও যায় ওর পিছুপিছু। তানজিম গিয়েই ওকে জড়িয়ে ধরে, আহনাফ একটু দূরে দাঁড়িয়ে যায়। সামিহা নিজেই বোকাবনে গেছে, এটা সে আশা করেনি। সে তো শুধুই তানজিমের সাথে মজা করতে চেয়েছিল।
তানজিম নিজের মুখটা ওর কানের কাছে এনে বলে,
“কতটা ভ°য় পেয়েছিলাম জানিস?”
সামিহা আলতো করে ওর পিঠে হাত রেখে চোখ বুজে ফেলে, তানজিমের আজকের স্পর্শটা অন্যরকম। তানজিম দূরে সরে যায়। একটু অ°স্বস্তি নিয়েই বলে,
“এগুলো বা°জে ধরনের রসিকতা, সামি।”
ওর ঘা°ব°ড়ে যাওয়া মুখটা দেখে সামিহা হাসে। আহনাফ ফোনে কথা বলার অজুহাতে দূরেই থাকে। তবে চিন্তা হতে থাকে সামিহাকে নিয়ে৷ তানজিমের সাথে তার সম্পর্ক গভীর, কিন্তু তানজিমের যা ফ্যামিলি তাতে কোনো মেয়ে কি আদৌ নিরাপদ?
______________________________________
দুইদিন পর, আজ সোমবার। কলেজে আজ সাইক্রিয়াটিস্ট এসেছে, ছাত্রছাত্রীদের মানসিক অবস্থা উন্নতির জন্য এটা একটা সাধারণ ব্যবস্থা। ডাক্তার আরিফা ইসলাম ছাত্রীদের সাথে কথা বলছে আর ডাক্তার নাইম আহমেদ ছাত্রদের সাথে কথা বলছে।
হলরুমের বাইরে সারাহ্ দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ছাত্রছাত্রীরা ডাক্তারদের সাথে কথা বলছে। আহনাফ এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“তুমিও ডাক্তার দেখাবে নাকি?”
সারাহ্ কপাল কুঁচকে বলল,
“না, ক্লাস নেই তাই দাঁড়িয়ে আছি।”
বারান্দার দেয়াল ঘে°ষে দাঁড়িয়ে আহনাফ বলে,
“দেখিয়ে নাও, তোমার মানসিক স্বাস্থ্য ভালো না।”
সারাহ্ ওর পিঠে একটা চা°প°ড় দিয়ে বলে,
“ঠিক আছি আমি।”
“স্টুডেন্টরা দেখবে।”
সারাহ্ ভ্রূ উঁচিয়ে বলে,
“স্টুডেন্টদের সামনে যখন হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন, তখন দেখেনি?”
আহনাফ মুখ বাঁ°কিয়ে হাসলো। তারপর বলে,
“সকালে ক্লাস ছিল?”
“হ্যাঁ, ছিল।”
“দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে অসুবিধা হয়?”
সারাহ্ ব্যা°ঙ্গা°ত্মক ভাষায় বলল,
“আমি কি নয়মাসের প্রেগন্যান্ট?”
আহনাফ ফিক করে হেসে দেয়। বলে,
“আস্তে কথা বলো, মানুষ শুনবে।”
সারাহ্ও হাসে। মাথানিচু করে তাকায় নিজের উদরে, একটা প্রাণ বেড়ে উঠছে এখানে। সে অনুভব করতে পারে আহনাফের সন্তান আর ভালোবাসার নির্দশনকে
হুট করে লজ্জা লাগতে শুরু করে তার। নিরবে হলরুমের ভিতরে চলে যায়। ডাক্তার আরিফার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো সে। আরিফা ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
“কি অবস্থা সারাহ্ ম্যাম? আপনার মা আর বেবি ভালো আছে?”
সারাহ্ চোখ বড় করে তাকায়। ওর মায়ের কথা এই মহিলা কেন জিজ্ঞাসা করলো আর ওর প্রেগ্ন্যাসির বিষয়ট কিভাবে জানলো।
এই আরিফা ইসলামের কাছেই মমতাজ বেগমের চিকিৎসা করানো হয়েছিল। সে পরোক্ষভাবে শাফিনের সাথে যুক্ত আছে।
______________________________________
ইমতিয়াজ এসেছে উত্তরা, শাফিনের বাসায়। দুইদিন নিজেকে ঘরব°ন্ধী রেখে আজ অনেক ভেবেচিন্তে এখানে চলে এসেছে। বেল বাজাতেই সুরভি এসে দরজা খুলে দেয়। আটমাসের অন্ত:সত্ত্বা সুরভির হাঁটতে চলতেও সমস্যা হচ্ছে।
ইমতিয়াজকে দেখে হাসিমুখে বলল,
“ভাইয়া, কেমন আছেন? ভিতরে আসুন।”
ইমতিয়াজ ধীরপায়ে ভিতরে যায়। বলে,
“মামা আছে?”
“না, আপনি বসুন আমি কল করছি।”
ইমতিয়াজ শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করে বলল,
“এখুনি কল দিন।”
সুরভি শাফিনকে কল করে কিন্তু শাফিন ফোন বন্ধ করে রাখায় কল যায় না। সুরভি ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলে,
“বাবার ফোন বন্ধ।”
ইমতিয়াজ সোফায় বসে বেশ শান্ত গলায় বলে,
“ব্যাপার না, আমি অপেক্ষা করছি।”
এদিকে মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। সকালে উঠে হঠাৎ করে তাকে না দেখে মেয়েটা পাগল প্রায় হয়ে গেছে। গো°র°স্থানে গিয়েও খুঁজে এসেছে, পায়নি।
“কোথায় গেলে ইমতিয়াজ?”
বাসায় এসে বেডরুমে দাঁড়িয়ে কথাটা বলে সে।
এমনসময় সদর দরজায় শব্দ হয়। মৃত্তিকা দরজা খুলেই ভিতরে চলে এসেছিল। ইমতিয়াজ এসেছে ভেবে রুমের বাইরে এসে দেখে শাফিন। মৃত্তিকার মাথায় যেন র°ক্ত চড়ে যায়।
শাফিন দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলল,
“ঘটনা দেখো দেখি, আহারে মেয়েটা স্বামীকে খুঁজছে। (একটু থেমে) ইমতিয়াজ তোমাকে ভালোবাসে না?”
মৃত্তিকার কাছে আসতে আসতে বলে,
“ভালোবেসে স্পর্শ করেছে কখনো?”
মৃত্তিকা মনের ভ°য় চেহারায় আনার মেয়ে নয়। একজায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে আছে সে। শাফিনের গতি সুবিধার নয় বোঝা যাচ্ছে।
“তোমার মা কিন্তু আমার আপন বোন নয়, চাচাতো বোন। রাহা সুলতানা, নামটা আমার মা পরিবর্তন করে রেখেছে রিপা বেগম।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকায়,
“চাচাতো বোন মানে?”
“ওর নয়মাস বয়সেই ওর বাবা-মা মারা যায়৷ ওর মা মানে তোমার নানীও কিন্তু মারা যাওয়ার সময় প্রেগন্যান্ট ছিল, তাহমিনার সাথে যা হয়েছে তার সাথেও সেটাই হয়েছিল। (জোরে হাসে) আমার বাবা সেদিন যা করেছে তাহমিনার সাথে তাই করেছি আমি।”
মৃত্তিকা ঘৃ°ণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। হঠাৎ মনে হলো শাফিন জেনেছে দুলালের আ°টকে রাখার কথা। নাহলে নিজে থেকে এতো কথা বলবে কেন?
মৃত্তিকা আন্দাজে একটা ঢি°ল ছুঁড়ে। জিজ্ঞাসা করে ফেলে,
“দুলাল কোথায়?”
শাফিন মাথা নেড়ে বলে,
“গুড কুয়েশ্চন, আমি নিয়ে গেছি। তোমার বাবা তাকে আটকে রাখতে পারেনি।”
শাফিন চেয়ার টে°নে বসে মুখ বাঁকিয়ে ব্য°ঙ্গ করে বলল,
“রিপাকে আমি বিয়ে করতাম, কিন্তু রিপা বিয়ে করে ওই শরীফকে। শরীফ রাগি মানুষ, তার রাগকে কাজে লাগিয়ে রিপার সংসার শেষ করেছি। (একটু থেমে) আজ তার মেয়ের সংসারও শেষ হবে।”
শাফিন উঠে দাঁড়ালে মৃত্তিকা ওর পায়ে লা°থি দেয়। গায়ের ওড়না খুলে শাফিনের গলায় পেঁ°চিয়ে ধরে শক্ত করে। শরীরের পুরো শক্তি দিয়ে টে°নে বলে,
“তুই ম°রে যা, সব ফে°ত°না ম°রে যাবে। অ°মানুষ, রাস্তার কুকুরও তোর চেয়ে ভালো। ম°রে যা, শাফিন ম°রে যা।”
শাফিন আর যাই হোক একজন পুরুষ। মৃত্তিকা তার শক্তির সঙ্গে পেরে উঠা কঠিন। বেশ অনেকক্ষণ দ°স্তাদ°স্তি হলো দুজনের মধ্যে। শাফিন ওড়নার প্যাঁ°চ খুলে মৃত্তিকার গালে চ°ড় বসায়। ক্লান্ত মৃত্তিকা মাটিতে লু°টিয়ে পড়ে, কিন্তু হার মানে না। চেয়ারের কোণায় লেগে কপাল ফুলে উঠে।
মৃত্তিকা উঠে দাঁড়ানোর আগেই শাফিন ওর গলা চেপে ওকে ফ্লোরের সঙ্গে মিশিয়ে বলে,
“নি°স্তার তোমার নেই মিউকো, মায়ের আদরের মৃত্তিকা।”
মৃত্তিকা তাকে ধা°ক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজেও সরে যায়। উঠে বেডরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে ফেলে।
“এ শরীরে ইমতিয়াজের ছাড়া অন্যকেউ স্পর্শ না করুক। হে আল্লাহ্, আমাকে আমার স্বামীর জন্য পবিত্র রাখো।”
প্রাণপণে রবকে ডেকে যাচ্ছে মৃত্তিকা। কোনো একটা আলৌকিক ঘটনা ঘটে যাক, মৃত্তিকা নিজের সম্মানটুকু বাঁচাতে চাচ্ছে।
চলবে….
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
পঞ্চত্রিংশ পর্ব (৩৫ পর্ব)
“মিউকো, মিউকো।”
শরীফের কন্ঠ শুনে মনে কোথাও একটা সাহস পায় মৃত্তিকা। প্রথমবার সে তার বাবাকে ভ°য় না পেয়ে আছে। দরজা খুলে দেখে শরীফ দাঁড়িয়ে আছে, শাফিন নেই। ইমতিয়াজ সদর দরজা খুলে দ্রুত বাসায় প্রবেশ করে।
মৃত্তিকার ওড়না ডাইনিং এর ফ্লোরে পড়ে আছে, কপালে কা°টা দাগ, ঠোঁটের কোণায় র°ক্ত জমেছে, কেঁদে কেঁদে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ইমতিয়াজ ওর অবস্থা দেখে আরো ঘাবড়ে যায় আর ইমতিয়াজকে দেখে মৃত্তিকার কলিজায় পানি আসে। মৃত্তিকার ওড়নাটা হাতে তুলে নেয় ইমতিয়াজ।
মৃত্তিকা গিয়ে সোজা ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ ভ°য় পেতে থাকে শাফিন খারাপ কিছু না করে ফেলেছে। আবারো হয়তো কেউ ওকে ডেকেছে আর ও সাড়া দেয়নি।
মূলত শাফিনের বাসায় আসা খেয়াল করে মৃত্তিকার দিকে নজর রাখা শরীফের সেই লোক। শরীফ দুলালকে খোঁজায় ব্যস্ত ছিল, দুলালকে ঠিক কখন বা কিভাবে শাফিন নিয়ে গেছে সে জানে না। শরীফ মৃত্তিকার খবর পেয়ে ইমতিয়াজকে জানায় আর নিজেও ছুটে আসে। তবে ওরা আসার আগেই শাফিন বেরিয়ে গেছে। প্রায় দেড়ঘন্টা সময় লেগেছে ওদের আসতে, এতোক্ষণ মৃত্তিকার অবস্থা কি ছিল তা কেবল আল্লাহ্ই জানে।
ইমতিয়াজ ধীরে ধীরে ওর মাথায় হাত বুলায়। বলে,
“মৃত্তিকা।”
ইমতিয়াজের বুকে মাথা ঠেকিয়ে ক্রমাগত কেঁদেই যাচ্ছে মৃত্তিকা। শরীফ ওদের পাশ কা°টিয়ে বেরিয়ে যায়। যেহেতু ইমতিয়াজ চলে এসেছে তাই ওর এখানে আর কোনো দরকার নেই।
ইমতিয়াজের শার্টে বারবার চোখ মুছছে মৃত্তিকা, কিন্তু মাথা তুলে না। ইমতিয়াজ আলতো হাতে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“বলেছিলাম না এসো না এই কাপুরুষের কাছে।”
ইমতিয়াজের পিঠে খা°মচে ধরে মৃত্তিকা। কেন সে বারবার নিজেকে দোষারোপ করে। এসবে ওর কি দোষ?
ইমতিয়াজ চেয়ার টে°নে ওকে বসিয়ে দেয়। তারপর দরজা বন্ধ করে এসে ওর সামনে ফ্লোরে বসে বলল,
“শাফিন এসেছিল?”
মৃত্তিকা ঢোক গিলে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। ওর ওড়না গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বলে,
“কি হয়েছে?”
মৃত্তিকার কান্নার বেগ বেড়ে যায়। ইমতিয়াজ ওকে দ্রুত জড়িয়ে ধরে। হঠাৎ জোরে জোরে নিশ্বাস নিয়ে মৃত্তিকা জ্ঞান হারায়। প্রচন্ড ভ°য় আর উ°ত্তে°জনা থেকে এটা হওয়া স্বাভাবিক। ইমতিয়াজ ওকে কোলে তুলে নেয়। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে মুখে হালকা পানির ছি°টা দিতেই জ্ঞান ফিরে।
মৃত্তিকা চোখ খুললে ইমতিয়াজ উঠে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওর হাত ধরে বলল,
“থাকেন না আমার কাছে কিছুক্ষণ।”
ইমতিয়াজ পাশে বসে। পিঠের দিকে বালিশ দিয়ে বসেছে। মৃত্তিকা এখনো তার হাতটা ধরে রেখেছে। ইমতিয়াজ হাত ছাড়িয়ে ওর ঠোঁটে আঙ্গুলের স্পর্শ করে। র°ক্ত জমে আছে এখানে। মৃত্তিকা মিনমিনে কন্ঠে বলে,
“চ°ড় দিয়েছে।”
ইমতিয়াজ কপালের কোণায় আঙ্গুল ছোঁয়াতেই মৃত্তিকা বলে,
“পড়ে গিয়েছিলাম, চেয়ারে লেগেছে।”
মৃত্তিকা ইমতিয়াজের গা ঘেষে শুয়ে বলল,
“মামের আসল নাম রাহা সুলতানা আর মাম তাদের আপন বোন না, চাচাতো বোন। মামের প্যারেন্টসকে শাফিনের বাবা মে°রেছে আর ওই লোকটাকে আমি এতোদিন নিজের নানা ভাবতাম।”
মৃত্তিকা কান্না করে দেয়। ইমতিয়াজ চেয়ে আছে ওর দিকে। কতটা অসহায়ত্ব কাজ করছে মেয়েটার মধ্যে।
মৃত্তিকা ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
“মামের মাকে মা°রার সময় উনি প্রেগন্যান্ট ছিল, আর ওই লোকটা তাকেও তাহমিনার মতো…”
কথা শেষ হওয়ার আগেই ইমতিয়াজ ওর মাথাটা বুকে চেপে ধরে বলল,
“থামো প্লিজ, থামো।”
মৃত্তিকা থামলো। চুপ করে ইমতিয়াজের বুকে পড়ে রইলো। জীবন শেখাচ্ছে কিভাবে কষ্টিপাথরে ঘ°ষে সোনা চিনতে হয়, কিভাবে পু°ড়ে পু°ড়ে সোনা খাঁটি হয়। ইমতিয়াজও চোখ বন্ধ করে। কষ্ট হয়তো মাথায় নিয়েই জন্মেছে সে। জন্মের পর মা আর যৌবনের শুরুতে বাবাকে হারিয়ে জীবনে অনেক ধা°ক্কা খেয়েছে সে। স্ত্রী-সন্তানকে বাঁচাতে না পারার আ°ক্ষে°প যেমন আছে, তেমনি আজকে মৃত্তিকার প্রতিও সে অনুতপ্ত। শরীফ না থাকলে ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে খুব একটা সময় লাগতো না। ইমতিয়াজের হাতের বন্ধন আরো শক্ত হয়।
মৃত্তিকা ধীরে ধীরে উঠে বসে। ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রয়োজনে এ জীবন দিয়ে দিবো, তবুও তুমি ছাড়া আর কারো স্পর্শ আমার সহ্য হবে না।”
ইমতিয়াজ সোজা হয়ে বসে। ওর শার্টের বুকের কাছের বোতাম খুলে মৃত্তিকা ওর ঘন লোমে আবৃত বুকে হাত দেয়। এলোমেলো চুলের মেয়েটার আবেদনময়ী দৃষ্টি লক্ষ্য করে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকার চুলগুলো মুখের উপর থেকে সরিয়ে দেয়। মৃত্তিকার হক আছে ওর উপর, এসব আবেদন সে করতেই পারে। তবে আপাতত ইমতিয়াজ তাতে সারা দিতে চাচ্ছে না।
মৃত্তিকাকে আবারো জড়িয়ে ধরে বলে,
“কিছুদিন সময় দাও, মৃত্তিকা।”
মৃত্তিকা কিছু বলার আগেই কলিং বেল বাজে। দুজনেই চমকে উঠে বসে। ইমতিয়াজ উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেখে তানজিম, সাথে সামিহা আর মিউকো। মিউ মিউ করে ভিতরে চলে আসে সে। তানজিমের সাথে কথা বলতে বসে ইমতিয়াজ, বিষয় শাফিন।
সামিহা দৌড়ে মৃত্তিকার কাছে যায়৷ মৃত্তিকার জন্য কিছু উপহার এনেছে সে৷ একটা মাঝারি শপিং ব্যাগ মৃত্তিকার হাতে দিয়ে বলে,
“তোমার বিয়ের গিফট, তখন দিতে পারিনি তাই এখন দিলাম।”
মৃত্তিকা খুলে দেখে ভিতরে কাঁচের চুড়ি, হিজাব আর কয়েকটা ব্রুচ। মুখ টি°পে হাসে মৃত্তিকা। সামিহা ওর হাত ধরে বসে পড়ে।
______________________________________
কলেজ থেকে ফেরার পর সারাহ্ চুপচাপ আছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, এখনো কোনো কথা নেই। সারাহ্ ভাবছে নিজের মায়ের কথা, মা কি লুকাচ্ছে? কেন লুকাচ্ছে?
ভেবেচিন্তে উপায় না পেয়ে মাকে কল করে সারাহ্। মা রিসিভ করতেই সারাহ্ কোনো সূচনা ছাড়াই বলে,
“মা, তোমাকে এতো মানুষজন কিভাবে চিনে? আর এরা আমার আশেপাশেই কেন ঘুরঘুর করে?”
নার্গিস পারভিনের হাতপা থ°রথ°র করে কাঁপতে লাগলো। মেয়ের কোনো ক্ষতি না হয়ে যায়, এই ভ°য়ে তার মন আনচান করতে শুরু করলো।
সারাহ্ হয়তো মায়ের অবস্থা বুঝেছে। শান্তভাবে বলল,
“কি লুকাচ্ছো আমার থেকে আম্মু?”
নার্গিস পারভিন নিরবে কাঁদলেন। অনেকক্ষণ চুপ থেকে তারপর বলে,
“কিছুই না। ওরা তোমাকে বা সামিহাকে চাইছে না, ওরা আমাকে চায়।”
সারাহ্-র চোখ কো°ট°র থেকে বের হয়ে আসার উপক্রম হয়। ভ°য় জড়ানো কন্ঠে বলে,
“কেন? কি চায় ওরা?”
নার্গিস পারভিন মাথা নেড়ে বলেন,
“তা আমি সঠিক জানি না। তবে রিপাকে যেমন ধোঁকায় ফেলে দেশে এনেছিল আর খু°ন করেছিল, সেভাবে আমাকেও করবে।”
“রিপা?”
“সরি, ভুল নাম বলেছি। ওর নাম রাহা।”
সবকিছু যা একটু গোছানো ছিল তাও পেঁচিয়ে গেল সারাহ্-র। নার্গিস পারভিন মেয়ের অস্থিরতা বুঝলেন।
সারাহ্-র মনে পড়ে আহনাফকে কিছুদিন আগে কোনো এক রাহা কল করেছিল। আহনাফ কি মাকে বলেনি? হয়তো বলেনি। যদি রাহা খু°ন হয়ে থাকে তবে আহনাফকে কে কল দিয়েছিল।
নার্গিস পারভিন আশেপাশে তাকিয়ে রুমের দরজা চাপিয়ে দিয়ে এসে বললেন,
“যা যা এখন বলবো তা মনোযোগ দিয়ে শুনো। কথার মাঝে কথা বলো না আর বেশি মানুষের মাঝে জানাজানি করো না। কারণ তাতে আরো কয়েকটা লা°শ পড়বে।”
সারাহ্ চমকে উঠে। আরো কয়েকটা লা°শ পড়বে মানে কি? এর আগে কার লা°শ পড়েছে?
“রাহা আমার ফ্রেন্ড, ওর নাম রিপা করেছিল ওর চাচি অরফে পালিত মা। ওর বাবা মায়ের কথা ও জেনেছিল, তাদেরকে নির্মমভাবে হ°ত্যা করেছিল তাদেরই ভাই আর ভাবি। যদিও এসব সে অনেক পড়ে জানতে পারে। কলেজ লাইফে আমার অন্য দুই ফ্রেন্ড পর পর দুই সপ্তাহে আ°ত্ম°হ°ত্যা করেছিল, তবে সেটা আ°ত্ম°হ°ত্যা না খু°ন ছিল। খু°নটা করেছিল রিপার ভাই শাফিন। আমার ওই দুজন ফ্রেন্ড তখন প্রেগন্যান্ট ছিল, (একটু থামে) শাফিন প্রেগন্যান্ট মেয়েদের প্রথমে (আবারো থামে) রে°প করে তারপর খু°ন। ইয়াং বয়সে সে এসব করে বেড়াতো। রিপা এসব জেনেছিল, তবে শাফিন আর তার মায়ের ভ°য়ে চুপ ছিল। দশ দশটা বছর পর আমাকে এসব জানিয়েছে। তবে (লম্বা একটা বিরতি নেয়) তবে তার আগে রিপা যখন প্রথমবারের মতো প্রেগন্যান্ট হয় তখন শাফিন ওকে কলেজের রুমে আটকে রেখেছিল। আর ওকেও…”
নার্গিস পারভিন কান্না করে দেন। সারাহ্ নির্বিকার হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“কি হয়েছিল উনার?”
কিছুক্ষণ পর কান্না থামিয়ে শান্তভাবে বলেন,
“সেদিন আমি আর রোমি ওকে বাঁচিয়েছিলাম, তখন থেকেই আমরা শাফিনের নজরে চলে আসি। তোমার নানা এসব জানতে পেরেই দ্রুত আমার বিয়ে দেন। বিয়ের পর শাফিন আর আমাকে খুঁজে পায়নি বা খুঁজতে চায়নি। কিন্তু রিপা আর আমার সম্পর্ক টিকে থাকায় এতো বছর পর সে আমাকে খুঁজে নিয়েছে। কিসমত এতোই খারাপ যে আমার মেয়েদের দিকেই তার নজর গেছে।”
সারাহ্-র হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। নিজের পেটে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে। জমে থাকা অশ্রুতে সিক্ত হয় ওর কপোল। মায়ের কথাগুলো এখনো তার কানে ক্রমাগত বেজে চলেছে। প্রতি°শো°ধ°পরায়ণ একজন মানুষ প্রতি°শো°ধের স্পৃ°হায় এখন কি ওর সন্তানকেও শেষ করে দিবে?
ফোনের ওপাশে নার্গিস পারভিন বারবার মেয়েকে ডাকছেন,
“সারাহ্, মা আমার। কথা শুনো মা।”
নার্গিস পারভিনের কথা শেষ হয় না, কিন্তু সারাহ্ আর শুনে না। ফোনটাও তুলে না। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দাঁড়ালো আয়নার সামনে। মা ডাকটা শুনতে পারবে তো সে? আধো আধো কন্ঠে কেউ মা ডাকবে, ছোট হাতগুলো ওর আঙ্গুলকে ধরে রাখবে। আসবে তো সেই দিন?
“ঐশী?”
সারাহ্ দ্রুত চোখ মুছে ফেললেও আহনাফ ঠিকই ওর কান্না ভেজা মুখটা দেখে ফেলে। আহনাফ এগিয়ে এসে বলল,
“কাঁদছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
সারাহ্ নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পড়ে। একটু জোরেসোরে বলতে থাকে,
“আমি ম°রে যাবো আহনাফ, আমার বেবিকে মে°রে ফেলবে ওরা।”
আহনাফ ওকে উঠিয়ে বিছানায় বসায়৷ চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“হুশ, এসব বলে না। বলে না। কারা মা°রবে? আমি আছি না, ভ°য় নেই।”
আহনাফ ওর ঠোঁটে হালকা চুম্বন করে। সারাহ্-র কান্নার বেগ কমে যায়। একটু শান্ত হয় সে।
“আহনাফ, আমি না থাকলে আপনি কি তাহসিনার মতো আমাকেও ভালোবাসবেন?”
আহনাফের জীবনের সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন বোধহয় এটাই। ‘আমি না থাকলে’ এই একটা কথা ওর বুকে ঘা°য়ে°ল করলো। সেই রিসোর্ট, সেই কান্না, কেউ র°ক্তা°ক্ত নিথর দেহগুলো। একে একে সবগুলো দৃশ্য আবারো জীবন্ত হয়ে উঠে। ভুলতে না পারা অসমাপ্ত গল্পের পুনরাবৃত্তি হলে তা মেনে নেয়া যায় না। আহনাফও পারবে না আর মেনে নিতে।
______________________________________
তিনদিন পর, অফিসে আজ সন্ধ্যায় এক অনুষ্ঠান আছে। ঘটনা খুবই সাধারণ, বায়ারদের সামনে প্রমোশনপ্রাপ্ত কয়েকজনকে সম্মানিত করা আর শ্রমিক অ°সন্তোষ নেই এটাই প্রমাণ করা। এই পরিকল্পনা শরীফের, মৃত্তিকার মত নেই তবে ইমতিয়াজ অনুমতি দিয়ে দিয়েছে।
ইমতিয়াজের ইচ্ছায় তৈরি হচ্ছে মৃত্তিকা। হাফ সিল্কের শাড়ির সাথে হিজাব আর হালকা মেকআপ। সামিহার দেয়া চুড়িগুলো বের করে পড়ছে, এরমধ্যে কয়েকবার ইমতিয়াজ এসে তাড়া দিয়ে গেল। মৃত্তিকা দ্রুত গতিতে তৈরি হয়।
সামিহার দেয়া চুড়িগুলো মৃত্তিকার হাতের তুলনায় বড় হলো। একে তো সিল্কের শাড়ি আবার এতো বড় বড় চুড়ি। এগুলো ঠিক করতে করতে বাইরে এসে ইমতিয়াজকে বলল,
“আমাকে ঠিকঠাক লাগছে?”
ইমতিয়াজ ফোন স্ক্রল করছিল। ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মৃত্তিকাকে দেখে থমকে গেল। এ কোন মৃত্তিকাকে দেখছে সে। ইমতিয়াজকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা লজ্জায় পড়ে গেল। ইমতিয়াজের এমন দৃষ্টি ওর অচেনা।
মৃত্তিকা মৃদুস্বরে বলল,
“শুনুন, আমি কি পালটে ফেলবো?”
ইমতিয়াজ ওর দিকে এগিয়ে এলো। হিজাবের ব্রুচটা সোজা করে দিয়ে আবারো তাকালো ওর মুখের দিকে। লাজুকতায় ছেড়ে গেল মৃত্তিকা। কিছু বলতে নিলে ইমতিয়াজ ওর ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বলল,
“চুপ, সারাদিন এতো বকবক করো কেন?”
মাথানিচু করে ফেলল মৃত্তিকা, আড়চোখে তাকালো বেসিনের উপরে থাকা আয়নার দিকে। ইমতিয়াজের দৃষ্টি এখনো ওর দিকে নিবদ্ধ। ওমা, দেরি হচ্ছে না ওদের?
ইমতিয়াজ ওর যতকাছে আসছে ততই হৃদপিণ্ডের গতি বাড়ছে, ওষ্ঠদ্বয় কেঁপে কেঁপে উঠছে। আবারো সে ইমতিয়াজের ছোঁয়া পেতে উন্মাদ হচ্ছে। চোখ বন্ধ করলো সে।
হুট করে ইমতিয়াজ সরে গেল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে চোখে পরপর কয়েকবার পলক ফেলে দ্রুত বলল,
“তাড়াতাড়ি চলো, দেরি হচ্ছে তো।”
মৃত্তিকা চোখ খুলে ইমতিয়াজকে আর দেখলো না। সে ততক্ষণে বেরিয়ে গেছে। এতোকাছে এসেও ভালোবাসা না পাওয়ার আ°ক্ষে°পগুলো ওকে প্রতিনিয়ত পো°ড়া°চ্ছে।
______________________________________
“কোথায় যাবে দুলাল?”
দুলাল ফেরদৌসী অফিস পার্টিতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কারো কথা শুনে পিছনে ফিরে দেখলো শাফিন। দুলাল টাই বেঁধে বলে,
“তোমার তাতে কি?”
দুলাল আর শাফিনের মধ্যে অনেক কথা কা°টাকা°টি হয়েছে। মূলত ইমতিয়াজকে সবটা বলে দেয়াই প্রধান কারণ। শাফিন এসে দুলালের শরীরে পারফিউম দিয়ে বলল,
“রাগ করো না। আমি তোমার জন্য গিফট এনেছি।”
ব্যাগ থেকে একটা কাঁচের বোতল বের করে তার দিকে এগিয়ে দিলো। বোঝা যাচ্ছে এতে পারফিউম আছে। মুখ খুলে পুরো বোতল দুলালের গায়ে ঢেলে দিলো শাফিন। দেরি না করে ঝটপট পকেট থেকে গ্যাস লাইট বের করে শরীরে আ°গু°ন লাগিয়ে দেয়।
তারপর সে দ্রুত ফ্ল্যাট ত্যাগ করে। গ্যাস সিলিন্ডারের মুখটা আগেই শাফিন খুলে ফেলেছে, দুলালের স্ত্রীকে ড্রইংরুমে বেঁধে রেখেছে। কিছুক্ষণ পরই সিলিন্ডার বি°স্ফো°রণ ঘটে, শাফিন শ°য়°তা°নি হাসি দিয়ে স্থান ত্যাগ করে। খবরে হেডলাইন হবে, সিলিন্ডার বি°স্ফো°রণে মা°রা গেছে শিল্পপতি দুলাল ফেরদৌসী ও তার স্ত্রী।
চলবে….
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ষট্ ত্রিংশ পর্ব (৩৬ পর্ব)
অফিসের পার্টি স্থ°গিত হয়ে গেছে। কারণ সহজ, দুলালের দু°র্ঘ°ট°না। বেঁচে থাকা কঠিন হলেও আল্লাহ্ তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। শরীরের নব্বই শতাংশ অংশ পু°ড়ে গেছে, কন্ঠনালি পু°ড়ে গেছে। তার স্ত্রীর শরীরের সত্তর শতাংশ অংশ পু°ড়েছে। দুজনের অবস্থাই ভয়াবহ, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ণ ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হয়েছে দুজনকে।
অফিসে খবরটা পেয়ে শরীফ ওদেরকে দেখতে আসলেও ইমতিয়াজ আর মৃত্তিকাকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছে। এসবের পিছনে যে শাফিন আছে তা বুঝতে খুব একটা বুদ্ধি খাটানোর প্রয়োজন নেই।
বাসায় এসে মৃত্তিকা ব্যাগটা টেবিলে রেখে বলল,
“সবকিছুর একটা লিমিট থাকে, কোথায় থামতে হবে সেটা জানা উচিত। একের পর এক খু°ন করেই যাচ্ছে। আর..”
মৃত্তিকার কথার মাঝেই ইমতিয়াজ বলে,
“আর আমরা হাতপা গু°টিয়ে বসে ভাবছি পরের পালা কার।”
মৃত্তিকা ইমতিয়াজের চোখের দিকে তাকালো। তার দৃষ্টি স্থির। ইমতিয়াজ পলক ফেলে বলল,
“শাফিনের মৃ°ত্যু আমার হাতেই হবে।”
মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলে,
“কেন তাকে মা°রবেন? তাকে মে°রে নিজে বাঁচতে পারবেন? (একটু থেমে) আপনার কিছু হলে আমি কি করবো?”
“তুমি আমাদের সন্তানকে নিয়ে থাকবে।”
মৃত্তিকা চমকে উঠে। এ কোন কথা বলে দিলো ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা রুমে চলে আসে। হিজাবটা খুলে রেখে হাত দিয়ে চুল গোছাচ্ছে। কাঁধ পর্যন্ত এসেছে তার চুলগুলো। ইমতিয়াজ ওর পিছনে এসে দাঁড়িয়ে সেও হাত দিয়েই চুল গোছানো শুরু করে।
মৃত্তিকা আয়নার দিকে তাকিয়েই বলল,
“আমাকে নকল করছেন কেন?”
“কোথায় দেখলে আমি তোমাকে নকল করছি। আমি তো আমার চুল ঠিক করছি।”
ইমতিয়াজ মৃদু হেসে উত্তর দিলো।
মৃত্তিকা নিজের মেকআপ উঠাতে উঠাতে বলল,
“আমি স্পষ্ট দেখছি আপনি আমাকে নকল করছেন।”
ইমতিয়াজ জোরে হেসে দেয়। কিছুক্ষণ দুজনের হাসাহাসি চলে। তারপর বেশ সিরিয়াস হয়েই ইমতিয়াজ জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার মনে হয় দুলাল আর তার স্ত্রী বাঁচবে?”
মৃত্তিকা মাথা নাড়িয়ে বলে,
“আল্লাহ্ ভালো জানে, (একটু থেমে) কিন্তু আপনি কেন বলেছেন শাফিনের মৃ°ত্যু আপনার আপনার হাতে?”
“তোমার মনে হয় না তাহমিনার প্রতি°শো°ধ না নিলে তাহমিনার কাছে আমি ক্ষমা পাবো না? সবটা জেনেও আমি চুপ করে আছি, শান্তি কি পাচ্ছি আমি?”
মৃত্তিকা ইমতিয়াজের দিকে ফিরে বলে,
“আর আমি শান্তি পাবো আপনাকে ছাড়া?”
দুজনের দৃষ্টি দুজনের দিকে নিব°দ্ধ হলো। মৃত্তিকা একটা ঢোক দিলে গিলে ইমতিয়াজের কাছে এসে মিনমিনে স্বরে বলল,
“আমি যেরকম বাবা ছাড়া বড় হয়েছে আপনি কি চান আমাদের সন্তানও সেই ভাবেই বড় হবে?”
ইমতিয়াজ উত্তর না দিয়ে চলে গেল। মৃত্তিকা আবারো আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজের মুখ পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মৃত্তিকা জানে ইমতিয়াজের কাছে এ প্রশ্নের কোনো জবাব নেই।
ঘন্টাখানেক দুজনে আর কোনো কথাই বলল না। মৃত্তিকা নিজের মতো রান্না করলো, দুজনে রাতের খাবার খেলো, এশার নামাজ পড়লো। কিন্তু চুপ।
নামাজ শেষে জায়নামাজ গুছিয়ে রাখছে মৃত্তিকা, তখনই ইমতিয়াজ বলে,
“চলো তোমার বড়মণির বাসায়।”
“এখন? মানে এই রাতে?”
“হুম, আমি হসপিটালে যাবো তাই তোমাকে রেখে যাবো।”
ইমতিয়াজ টিশার্ট খুলে শার্ট পড়তে থাকে। মৃত্তিকা বলে,
“কোনো দরকার আছে ওখানে যাওয়ার?”
ইমতিয়াজ ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“বাটন লাগিয়ে দাও।”
মৃত্তিকা কপাল কুঁচকে মৃদু হেসে শার্টের বোতাম লাগানো শুরু করে। ইমতিয়াজ বলে,
“শত হোক সে আমাদের পার্টনার আর এখানে পুলিশ কে°ইস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সো যেতেই হবে।”
“আমি একা থাকতে পারবো।”
মৃত্তিকার অভিমানী সুরটা ইমতিয়াজ এক তুড়িতে বুঝে গেল। বারবার কাছে এসেও এক না হতে পারার আ°ক্ষে°প তো মৃত্তিকার রয়েছে। ইমতিয়াজ ওর দুইগালে হাত দিয়ে কপালে চুম্বন করে বলল,
“তুমি যেমন আমাকে ছাড়া শান্তি পাবে না, তেমনি আমিও তোমাকে ছাড়তে পারবো না।”
মৃত্তিকা মাথা তুলতে নিলে ইমতিয়াজের ঠোঁটের সাথে ওর চোখের পাপড়ির স্পর্শ হলো। ইমতিয়াজ হেসে দেয়, মৃত্তিকা ওর কলার টে°নে কাছে নিয়ে আসে। এরমাঝেই মিউকোর হানা, মিউমিউ ডাকে ইমতিয়াজের কাছে আসে। মৃত্তিকা সরে যায়। ইমতিয়াজ মিউকোকে কোলে নিয়ে বলল,
“কোনো মিউকোই আমাকে ছাড়ে না, যেতে তো হবে নাকি?”
মৃত্তিকা হিজাব পড়তে শুরু করে। লাজুকতা তার চোখে আর উপচে পড়া হাসিতে।
______________________________________
দুইদিন পর, দুলালের ভাই ও শ্যালক মিলে এই দু°র্ঘট°নায় মামলা করেছে। দুলালের স্ত্রী কিছুটা কথা বলতে পেরেছে, সে পুলিশকে জানিয়েছে কেউ একজন বাসায় এসেছিল এবং ইচ্ছাকৃতভাবেই এ ঘটনা ঘটেছে। ব্যস, সেই একজনকে খোঁজা শুরু। সিসিটিভি ফুটেজে শাফিনকে স্পষ্ট দেখা গেছে। ছবি দেখানোর পর দুলালের স্ত্রী তাকে চিনতেও পেরেছে। দোকান থেকে তাকে গ্রে°ফ°তার করে নিয়ে গেছে পুলিশ। দেশের বড়বড় টিভি চ্যালেনে দেখাচ্ছে এই খবর, শিল্পপতি দুলাল ফেরদৌসীকে হ°ত্যা°চেষ্টার মা°ম°লায় গ্রে°ফ°তার তারই বন্ধু শাফিন।
কলেজের অফ পিরিয়ডে ফোনে স্ক্রল করার সময় নিউজটা চোখে পড়ে আহনাফের। শাফিনের চেহারা সে দেখেই চিনে ফেলে। তাহলে তার আন্দাজ সঠিক, শাফিনই সেই লোক।
আহনাফ আপন মনে ভাবে,
“তবে কি তাহসিনার দু°র্ঘ°টনায় এর হাত আছে?”
আহনাফ ঢাকায় যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তবে সারাহ্-কে একা ফেলে যাওয়াটাও ঠিক নয়, আবার ওর এই অবস্থায় সফর করাটাও ঠিক নয়। তবুও একটা রিস্ক সে নিতে চায়। বাবাকে বুঝিয়ে হলেও সারাহ্-কে রেখেই যাবে সে।
আব্বাস সাহেবকে কল করে আহনাফ। বাবাকে বোঝানো খুব একটা কঠিন কাজ নয়। আব্বাস সাহেবকে সবটা বুঝিয়ে বলতেই উনি বুঝলেন। তবে তাহসিনার পরিবারের কথাটা আহনাফ এড়িয়ে গেল, বাবার কাছে এটা বলা লজ্জার।
কলেজ ছুটির সময় সারাহ্-র সাথে দেখা। সে পুকুরের কাছে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আহনাফ ওর কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে বাইরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ঢাকায় যাবো আজকে।”
“কেন? কোনো সমস্যা?”
অটোতে বসে আহনাফ বলল,
“সমস্যা না, আমি গাড়ি দেখতে যাবো, কিনবো আমি। তুমি বাসায় থাকবা।”
সারাহ্ আহনাফের হাত জড়িয়ে ধরে বলল,
“আমিও যাবো।”
“বাচ্চাদের মতো বিহেভ করো না।”
আহনাফ একটু ধ°মক দেয়। সারাহ্ হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসে।
বাসায় এসে আহনাফ রুমে গেল। প্রতিদিনের মতো আজকেও দুপুরের খাবার গরম করে রেখেছেন আব্বাস সাহেব, রান্না তো সারাহ্ সকালেই করে যায়।
আহনাফ ফ্রেশ হয়ে এসে সারাহ্-কে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে বলল,
“কি গো, চুপ যে?”
সারাহ্ বালিশে হেলান দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। আহনাফ এসে ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলল,
“মাথা টি°পে দাও, ব্য°থা করতেছে।”
সারাহ্ ওর মাথায় হাত দেয় না। আহনাফ আবারো বলল,
“একটু স্বামী সেবা করো, সওয়াব হবে।”
সারাহ্ অভিমান করে বলে,
“আপনি বউকে ব°কেন, সওয়াব পাবেন।”
আহনাফ জোরে হেসে উঠে বসে। সারাহ্-র গলায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়, বরাবরের মতোই সারাহ্-র বাধা উপেক্ষা করে সে। সারাহ্-র মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল,
“মান করে না ঐশী রানী।”
সারাহ্ অন্যদিকে মুখ ঘুরালে আহনাফ ওর গালে তর্জনী আঙ্গুল স্পর্শ করায়। সারাহ্ চোখ বন্ধ করে বলল,
“শুয়ে পড়ুন, মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।”
ওর ঘনঘন নিশ্বাস আহনাফ অনুভব করে। মুচকি হেসে বলল,
“আগে খেয়ে নাও, তারপর স্বামী সেবা করো।”
সারাহ্ দ্রুত উঠে চলে যায়। এই লোকটা একটা ব°জ্জা°তের সেরা। যখন তখন যেরকম উপায়ে হোক ওকে লজ্জা দিতেই হবে। আহনাফ হেসে উঠে ডাইনিং এ আসে।
______________________________________
পরদিন সকালে, হাসপাতাল থেকে থানায় এসেছে ইমতিয়াজ, মৃত্তিকাও সাথে এসেছে। দুলালের দু°র্ঘ°ট°নার পর হাসপাতালে থাকছে ইমতিয়াজ, পুলিশের নানান জিজ্ঞাসার মুখে মৃত্তিকাকে সে ফেলতে চাচ্ছে না। তাই এই দূরত্ব তৈরি।
শাফিনের সাথে কাউকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না। দূর থেকে তাকে দেখে মৃত্তিকা। শাফিন র°ক্ত°চক্ষু নিক্ষেপ করে মৃত্তিকার দিকে, মৃত্তিকা ওর নজর দেখে। পুলিশের মাঝ থেকেই শাফিন হাত উঁচিয়ে আঙ্গুল উপরে নিচে দিয়ে মৃত্তিকার শরীর ইঙ্গিত করে। ইমতিয়াজ এগিয়ে যেতে নিলে মৃত্তিকা ওকে বাধা দেয়।
ইমতিয়াজের হাত ধরে বলল,
“প্লিজ, ঝা°মেলা কইরেন না। আমার ভ°য় লাগছে তার দৃষ্টিতে।”
ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে নিয়ে বাইরে আসে। আহনাফ এসেছে, ইমতিয়াজ ওর সাথে হ্যান্ডশেক করে। আহনাফ ভ্রূ উঁচিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“অবশেষে সে ধরা পড়লো।”
ইমতিয়াজ বাঁকা হাসে। বলে,
“তোমার মনে হয় লিগ্যাল ওয়েতে ওর কিছু করা যাবে? এতোগুলো খু°ন ঠান্ডা মাথায় করেছে, এখন তাড়াহুড়ায় ধরা পড়েছে। জন্মগত শ°য়°তান সে, ওকে..”
ইমতিয়াজ কিছু বলতে নিলে মৃত্তিকা ওর শার্টের হাতায় মু°ঠ করে ধরে। মৃত্তিকা জানে সুযোগ পেলে ইমতিয়াজ শাফিনকে মে°রে ফেলবে।
ইমতিয়াজ থেমে গিয়ে পিছনে তাকায়। মৃত্তিকা নিচুস্বরে বলে,
“আর কিছু বলিয়েন না।”
ইমতিয়াজ ওর কথা শুনে, আর কিছুই বলে না।
আহনাফ হেসে অন্যদিকে চলে যায়। সাংবাদিকদের ভীড় আছে এখানে। হঠাৎ একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে যে দুলাল ফেরদৌসী মা°রা গেছে। ইমতিয়াজ খবরটা শুনেই শরীফকে কল করে সত্যতা জানতে চাইলে উত্তর আসে,
“সবটাই সত্য, এইতো কিছুসময় আগেই সে মা°রা গেছে।”
তাহমিনাকে কিভাবে মা°রা হয়েছিল তা শুধু দুলালই জানতো। মৃত্তিকা ওইটুকু অংশ ভিডিও করেনি। ইমতিয়াজ একটু আশাহত হয়।
“মৃত্তিকা, চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আমি হসপিটালে যাবো।”
“আমিও যাবো।”
“জে°দ করো না।”
মৃত্তিকা ওর হাত ধরে বলে,
“আপনাকে একা ছাড়লে আমার খুব চিন্তা হয়।”
মৃত্তিকার শত অনুরোধ ইমতিয়াজ শুনে না। ওকে বাসায় রেখেই সে হাসপাতালে যায়। দুলাল ফেরদৌসীর ছেলে কলরব এসেছে, বাবার ম°র°দেহ নিয়ে অঝোরে কাঁদছে।
ইমতিয়াজ থমকে যায়, মনে পড়ে নিজের সেই দিনের কথা। কত আর বড় ছিল, কলেজে পড়তো। বাবার লা°শে°র খাটিয়া বয়ে নেয়ার ক্ষমতা তো তখন ছিল না। তবুও নিতে হয়েছিল। ওই গো°র°স্থানের গেইট পর্যন্ত সবাই আদর করেছে, এরপর যেন সবটাই পালটে গেল। সব চিত্র এলোমেলো হলো।
দুলালের পো°ড়া দেহটা দুইদিন হাসপাতালে কুঁ°কড়েছে, নিজের চোখের সামনে যে পা°পগুলো সে করতে দিয়েছিল। তিনজন জলজ্যান্ত মানুষকে অ°মানুষের মতো হ°ত্যা করেছিল, তার প্রতি°শো°ধ প্রকৃতি নিয়েছে৷ এখন সেই হাশরের ময়দানের ফয়সালার অপেক্ষা করবে সে, অপেক্ষা করবে ইসরাফিল (আ.) এর শি°ঙ্গায় ফুৎকারের। তার আগে থাকবে এক জীবন, যার নাম কবর।
______________________________________
বিকালে সুরভি এসেছে বাবাকে দেখতে। শর্ত দেয়া আছে দূর থেকে দেখতে হবে। যেহেতু দুলাল মা°রা গেছে তাই সে এখন খু°নের আসামী। পুলিশ তো আর জানে না যে সে একটা খু°ন করেনি, এর আগেও এসবের অনেক রেকর্ড তার আছে আর সে এসব থেকে বের হয়েও এসেছে। শাফিন বেশ নিশ্চিন্ত আছে, পুলিশ ওর কিছুই করতে পারবে না সে জানে।
নয়মাসে পড়তে আর কিছুদিন বাকি আছে সুরভির। এইতো কিছুদিন পরই সে মা হবে। বাবার হাতে সন্তানকে তুলে দেয়ার খুশি ওর আর নেই। তানজিমের কাছ থেকে তাহমিনার কথা সে শুনেছে। এখনো যে স্থির আছে এটাই বেশি।
শাফিনের থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়ালো। দুচোখে তার অশ্রুধারা। বাবার গ্রে°ফ°তারের দুঃখ নয় এটা। তাহমিনার জন্য এ কান্না। সে কি তার মেয়ের বয়সী ছিল না? তার কি নিজের স্বপ্ন পূরণের অধিকার ছিল না?
সুরভি একটু এগিয়ে গিয়ে শাফিনকে বলে,
“আমাকে দেখে তোমার লো°ভ হয়নি বাবা?”
কতটা কষ্ট, কতটা অসহায়ত্ব থেকে একটা মেয়ে তার বাবাকে এই কথাটা বলতে পারে তা কেবল আল্লাহ্ই জানেন। সুরভি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে নিতে বেরিয়ে আসে। দেলোয়ারা থানায় আসেননি। উনি এখনো শাফিনের এসব ঘটনা বিশ্বাস করতে পারছেন না।
চলবে….