#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
অষ্টাবিংশ পর্ব (২৮ পর্ব)
“রাত কয়টা বাজে দেখেছেন? ১২ টা বেজে গেছে। এখনো এই বই নিয়েই পড়ে আছেন।”
সারাহ্ আপন মনে আহনাফকে বকাবকি করে যাচ্ছে। আহনাফ বইটা বন্ধ করে বলে,
“রেগে আছো নাকি?”
“না, তাতা থৈ থৈ করছি আমি।”
দাঁত খিঁ°চিয়ে বলল সারাহ্।
আহনাফ বইটা রেখে চেয়ারে বসে বলে,
“আপনি এমনি করিয়া দন্ত বাহির করিলে আপনাকে বৃহৎ আকৃতির একখানা প্রানীর মতন দেখায়। তাহার সুবিশাল লে°ঙ্গুর ঝুলিয়া থাকে। অধুনা বিজ্ঞানীরা তাহাকে মনুষ্যকূলের আদিপুরুষ রূপে গণ্য করিয়া থাকে।”
সারাহ্ রেগে গিয়ে বলে,
“আমাকে বানর বললেন?”
“আহা, তাহা আমি কখন বলিয়াছি। আমি তো তাহার দন্তের সঙ্গে আপনার দন্তের বড়ই মিল পাইয়াছি। তাহারা অতি সুখে দন্ত বাহির করে আর আপনি অতি রাগিয়া তাহা প্রকাশ্যে দন্ত বাহির করো। ইহা পার্থক্য নহে, ইহা কালের বিবর্তন।”
সারাহ্ রেগে জোরে জোরে বিছানা ঝাড়তে শুরু করে। আহনাফ এখনো ক্রমাগত হেসে যাচ্ছে। ঝা°ড়ুটা ছু°ড়ে ফেলে সারাহ্ শুয়ে বলে,
“আমার পাশে আর কেউ শুতে আসবে না, এই বলে রাখলাম।”
আহনাফ উঠে এসে খাটে বসতে বসতে বলল,
“ইহা আপনার একান্ত সম্পত্তি নহে। ইহাতে আমার নিজস্ব অংশ খানিক রইয়াছে। আপনি ইহাতে আসিয়াছেন বলিয়া ইহা সম্পূর্ণ রূপে আপনার ব্যক্তিগত হইয়াছে বলিয়া আমি মান্য করিবো না।”
“আপনার সাধু ভাষা…”
সারাহ্ উঠে আহনাফকে ধরে ঠেলতে ঠেলতে বারান্দায় নিয়ে বলে,
“যতক্ষণ সাধু ভাষা জবান থেকে না যাচ্ছে, ততক্ষণ ঘরে আসবেন না।”
আহনাফ বুকে হাত বেঁধে বলে,
“ইহাও আমার অপরাধ নহে। কাল খানিক পূর্বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস পড়িয়া আমার এরূপ অধঃপতন হইয়াছে। আগামীকল্য হইতে আমি শুধরাইয়া যাইবো।”
“চুপ।”
ধমকে উঠে সারাহ্। আহনাফ হেসে দেয়। সারাহ্-র গাল টে°নে দিয়ে বলে,
“রাগিলে আপনাকে…”
আহনাফের কথার মাঝে ওকে ঝারি দেয় সারাহ্,
“ঘরে যাবেন না আর মুখ বন্ধ রাখবেন।”
সারাহ্ চলে যেতে নিলে আহনাফ ওকে টে°নে কাছে নিয়ে আসে। দুহাত আলতো করে আহনাফের বুকের কাছে রাখে, চঞ্চলতা থেমে গিয়ে দুজনেই শান্ত হয়েছে।
ডানহাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে সারাহ্-র কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়। সারাহ্ চোখ তুলে তাকায়। দুজনের দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো, একই চাওয়া দুজনের অথচ তা প্রকাশ হলো না।
সারাহ্ সরে রুমে চলে আসে, আহনাফ বারান্দায় গ্রিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায়। চাঁদ যে অর্ধপূর্ণ, মিটিমিটি জ্বলতে থাকা তারাগুলো চাঁদের পূর্ণতার আশায় ছ°টফ°ট করছে। ঠিক যে ছ°টফ°টানি হচ্ছে আহনাফ আর সারাহ্-র মনে।
______________________________________
বিছানায় শুয়েও ঘুম নেই মৃত্তিকার। পাশে সুরভি বেশ আরামেই চোখ বুজেছে সেই কখন। এখন তো নাক ডাকাও শুরু করেছে।
মৃত্তিকা পাশবালিশটা জড়িয়ে ধরে ভাবছে, শুধুই ভাবছে। ভাবনায় ইমতিয়াজ আর ওর বাবার মাঝের ঘটনা নেই। ভাবনায় কেবলই ইমতিয়াজ। ইমতিয়াজের হাতের স্পর্শ আর কথা, দুটোই সে অনুভব করছে। কিন্তু ইমতিয়াজকে বিয়ে করার অর্থ ওকে আবারো বিপদে টেনে ফেলা। লজ্জা, ভয়, সংশ°য়ের বে°ড়াজালে পড়ে আছে সে।
চিন্তা করতে করতে কোনো একসময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। ফজরের সময় সুরভির ডাকে ঘুম ভাঙলো।
“মিউকো, উঠো।”
“হুম।”
চোখ কচলে কচলে উঠে বসে মৃত্তিকা। সুরভি তার মায়ের রুমে চলে যায় নামাজের জন্য। মৃত্তিকা এখানেই নামাজ পড়ে নেয়।
নামাজ শেষে মাত্রই জায়নামাজ গুছিয়ে রাখছে তখন শাফিন সাহেব এসে বলে,
“মিউকো, মা মিউকো।”
“জি, মামা। বলেন।”
শাফিন সাহেব ভিতরে এসে চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
“আজ অফিসে যাবা?”
মৃত্তিকা জায়নামাজ রেখে বিছানার কোণায় বসে বলে,
“যেতে হবে মামা, ইমার্জেন্সি।”
শাফিন সাহেব মাথা নাড়েন। মৃত্তিকা নিজে থেকেই বলে,
“কোনো সমস্যা?”
“কলরবের বাবার কোম্পানিতেই কেন জয়েন দিতে হলো?”
মৃত্তিকা সামনে ঝুঁ°কে বলে,
“জয়েন দেইনি, শেয়ার কিনেছি।”
“হ্যাঁ, সেটাই। এখানে কেন করতে হলো? ওরা তোমাকে ভালো নজরে দেখে না।”
মৃত্তিকা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
“সেটা তাদের নজরের সমস্যা, আমার নয়।”
শাফিন সাহেব উঠে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ওকে, যা ভালো বুঝো।”
মৃত্তিকা কিছুক্ষণ দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর সে বিছানা নিয়ে নেয়। রাতে ভালো ঘুম হয়নি, এখন তো একটু ঘুমানো লাগবেই।
______________________________________
আজ সকালের নাস্তা বানাচ্ছে আহনাফ নিজে। খিচুড়ি আর ঝাল ঝাল গরুর গোশত। সারাহ্ আহনাফের এসব কাজে খুবই বি°র°ক্ত। রান্নাঘর সবসময় গোছানো আর পরিষ্কার রাখতে পছন্দ করে সারাহ্, অথচ আহনাফ এখানে আসা মানেই হলো এর চেহারা পালটে ফেলা।
“অনেক হয়েছে ফয়েজ স্যার, এবারে গিয়ে তৈরি হয়ে নিন।”
সারাহ্ এসে কাজে হাত দিতে দিতে কথাটা বলল।
আহনাফ গেল না। পালটা জবাব দেয়,
“ফয়েজ স্যার বলবা না। সাদাবের আব্বু, সাইদার পাপা বলবা।”
সারাহ্ চোখ কুঁচকে তাকিয়ে ব্য°ঙ্গসুরে বলে,
“কোথায় সেই সাদাব আর সাইদা। একটা রুমে আর একটা পেটে?”
আহনাফ হেসে ওর দিকে এগিয়ে এসে গালে চুম্বন করে বলল,
“রেডি হয়ে নাও, আমার রান্না প্রায় শেষ।”
“এটা দূরে থেকেও বলা যায়।”
আহনাফ গোশত বাটিতে নিতে নিতে বলে,
“এভাবে দূরে থাকলে সাদাব-সাইদা আর আসবে না। পরে আমি বুড়ো হয়ে যাবো।”
“ছি, মুখের কি ছিরি।”
সারাহ্ রুমে চলে গেল। আহনাফ বেশ কিছুক্ষণ আপন মনে খিলখিলিয়ে হাসলো। সারাহ্ আসার পর ওর জীবনের খুব সুন্দর একটা মোড় এসেছে।
খাবার টেবিলে বসে আব্বাস সাহেব আহনাফকে বললেন,
“শুক্রবারে তোমার ছোটফুফু আর ছোটফুপা আসবে।”
আহনাফ মাথানেড়ে বলল,
“তা তো ভালো কথা।”
আব্বাস সাহেব আবারো বলেন,
“উনারা তিন-চার দিন থাকবেন, তাই গেস্টরুমটা পরিষ্কার করে ফেলো।”
সারাহ্ পাশ থেকে বলে,
“বাবা, গেস্টরুম পরিষ্কারই আছে। আমি উইকলি খালাকে দিয়ে পরিষ্কার করাই।”
“ভেরি গুড।”
আব্বাস সাহেব প্রশংসা করলেও আহনাফ খাবার মুখে ঠু°সে গমগমিয়ে বলল,
“বড় বড় গুড়ের বৈয়াম।”
সারাহ্ বুঝতে পারলো ওকে ঠে°স দিয়ে কথাটা বলা হয়েছে। রেগে চোখ ছোট করে তাকালেও আব্বাস সাহেবের সামনে কিছু বলে না।
আব্বাস সাহেব দুজনের দৃষ্টিই খেয়াল করেছেন। উনি না দেখার ভাণ করেই আহনাফকে বলেন,
“তোমার ছোটফুপা কিন্তু তোমার বিয়ের প্রস্তাব এনেছিল, তাই কোনো প্রকার সমালোচনা যেন না হয়।”
আহনাফ হাত নেড়ে বলল,
“আরে, কিসের সমালোচনা? তোমার এমন অতি গুণবতী অলরাউন্ডার পুত্রবধূ থাকতে আবার সমালোচনা কিসের?”
আব্বাস সাহেব ছেলের পরিবর্তন খেয়াল করছেন। যে ছেলে আগে বেছে বেছে কথা বলতো, সেই ছেলেই এখন দশটা উত্তর তৈরি করে কথা শুরু করে।
______________________________________
“তোমার মনে হয় ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে ভালো রাখবে? আবার তোমার মতো হবে না তো?”
পল্লবীর রাগি রাগি কন্ঠে শরীফ প্রতিবাদ করে না। আরাম কেদারায় বসে সি°গা°রেটের ধোঁয়া ছাড়তে থাকে। পল্লবী সি°গা°রেটটা নিয়ে পায়ের নিচে পি°শে ফেলে।
শরীফ ওর দিকে তাকায়। পল্লবী বলে,
“তুমি অন্যের কথায় নিজের সংসারে আ°গু°ন দিয়েছিলে। ভাবিকে তো কষ্ট কম দাওনি, আবার আমাদের সামনে ভাবিকেই ভি°লে°ন করেছিলে। আর এখন যখন ভাবি নেই তখন তুমি বুঝলে যে তুমি ভুল। (একটু থেমে) ওই ইমতিয়াজ ছেলেটা বিবাহিত, এর আগেও তার স্ত্রী ছিল। যদি সে মৃত্তিকাকে ভালোবাসতে না পারে?”
শরীফ নির্বিকার হয়ে জবাব দিলো,
“ইমতিয়াজ কেয়ারিং, মৃত্তিকা ওইখানেই ভালো থাকবে।”
“আমিও জানি সে কেয়ারিং, কিন্তু ভালোবাসা আর কেয়ার এক নয় ভাইয়া।”
শরীফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি মৃত্তিকাকে দেখতে যাবো কাল, মেয়েকে বউ সাজলে মায়ের মতো লাগে কিনা তা আমাকেও দেখতে হবে।”
পল্লবী মুখ ভেং°চায়।
“আবারো না কোনো গ°ন্ডগোল লাগে।”
শরীফ রুমে চলে যায়। পল্লবী সি°গা°রেটটা ফেলে দিয়ে নিজের এপ্রোন নিয়ে বেরিয়ে পরে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
______________________________________
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা, ইসরাতের সাথে আলোচনায় ব্যস্ত মৃত্তিকা। ইসরাত শনিবারে ইতালিতে ফিরে যাবে, ফিওনা চলে গেছে প্রায় দেড়মাস। এর আগে টুকটাক অনেক কিছুই মৃত্তিকাকে শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে ইসরাত।
কথা শেষে যাওয়ার সময় ইসরাত আবারো ফিরে আসে। বলল,
“তুই সত্যি বিয়ে করছিস?”
মৃত্তিকা আলতো করে হেসে বলল,
“কাল বাসায় আসলেই দেখবি দ্বিধার দেয়াল কিভাবে ভে°ঙেছি।”
ইসরাত মুচকি হাসে। বিয়ে নিয়ে মৃত্তিকার মধ্যে চলা বিরতিহীন দ্বিধাকে গুড়িয়ে দিয়েছে সে। এখন শুধুই ওই মুহূর্তের অপেক্ষা।
দুজনে একসাথে অফিস থেকে বের হয়। তারপর দুজনে নিজের গন্তব্যে রওনা দেয়।
বাসায় এসেই মৃত্তিকা নিজের ট্রলি খুলে। মায়ের জিনিসপত্র কিছু বের করাই ওর উদ্দেশ্য। কিন্তু ট্রলি খুলেই সে অবাক, সব যে এলোমেলো। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কেউ ওর ট্রলিতে কেউ ঘা°টাঘা°টি করেছে।
সন্দেহের তী°রটা সুরভির দিকেই দেয় মৃত্তিকার। এ রুমে তার আনাগোনা বেশি হয়।
সুরভি এসে বলল,
“কালকে কি শাড়ি পড়বে নাকি লেহেঙ্গা?”
মৃত্তিকা শব্দ করে ট্রলিটা বন্ধ করে বলে,
“রুমে কে এসেছিল আপু? আমার ব্যাগ কে ধরেছে?”
সুরভি ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কেউ না তো। রুমে কেউ আসেনি।”
মৃত্তিকা আড়চোখে ওকে শুধু দেখে, কথা না বাড়িয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ব্যাগে যেহেতু কেউ ধরেছে তার মানে কিছু খুঁজতে এসেছিল। কি হতে পারে? মৃত্তিকা অনবরত ভাবতে থাকে।
______________________________________
ফজরের আযান দিচ্ছে। মৃত্তিকা ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজের জন্য তৈরি হয়। সুরভি এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। সুরভিকে একটু ডেকেই নামাজে দাঁড়িয়ে যায় মৃত্তিকা।
নামাজ শেষে বেশ লম্বা সময় জায়নামাজে কাটায় সে। আজকের দোয়াও বেশ দীর্ঘ হয়। সবকিছু ঠিক থাকলে আজকে সন্ধ্যায় সে ইমতিয়াজের স্ত্রী হবে। দোয়ায় প্রতিদিনের মতো মাম থাকলেও আজ ইমতিয়াজের নামও উচ্চারণ হয়েছে। সংসারটা যেন সুখের হয়, শরীফের মতো ব°দ°মেজাজি আর অ°ত্যা°চা°রী কেউ যেন জীবনে পদার্পণ না করে। চোখের কোণায় ফোঁটায় ফোঁটায় জল জমতে থাকে।
এদিকে ইমতিয়াজের অবস্থাও একই। আজ তার মোনাজাতে বাবা, মা, তাহমিনার পর মৃত্তিকার নাম এসেছে। যে মানুষটাকে স্বেচ্ছায় সে নিজের জীবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। পর্যাপ্ত সম্মান যেন দিতে পারে সেই দোয়া করছে উভয়ে। যেন দুজনের দোয়া একই প্রান্তে মিলে গেছে।
______________________________________
ঘূর্ণনশীল ঘড়িটা ঘুরে চলছে অবিরাম। সকাল পেরিয়ে মধ্যদুপুরে এসেছে সময়টা। আহনাফ কলেজ থেকে বের হয়েছে। উদ্দেশ্য ঢাকায় যাবে, তাই একটু আগে আগেই বের হয়েছে।
গেইটের কাছে সারাহ্ তাড়াহুড়ো করে এসে বলল,
“কেন যাচ্ছেন বলেন নাই তো? আমার চিন্তা হচ্ছে।”
আহনাফ একটু নিচুস্বরে বলে,
“এক বন্ধুর বিয়েতে যাচ্ছে। রাতারাতিই ফিরে আসবো।”
“না থাক, রাত করে আসা লাগবে না।”
“বউটা একা কেমনে থাকবে?”
বলে আহনাফ চোখ টি°পে দেয়। সারাহ্ সরে যায়।
“ঠিক আছে, সাবধানে যাবেন।”
সারাহ্-কে বিদায় জানিয়ে আহনাফ রওনা দেয় ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেছে। প্রথমেই যায় কাকরাইলে সেখানে তানজিমের বাসার সবার সাথে দেখা হয়। মমতাজ বেগম আর লুৎফর রহমান ওকে দেখেই খুব খুশি হয়েছে। মূলত মমতাজ বেগমই ওকে দাওয়াত দেয়ার কথা বলেছিল।
তানজিমকে ইমতিয়াজকে কল দেয়। সে বাসায় আছে, এখনো তৈরি হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ইমতিয়াজ আসে, আহনাফের সাথে কুশল বিনিময় হয় তার। সকলে একসাথে রওনা দেয় উত্তরা মৃত্তিকার মামা শাফিন সাহেবের বাসার উদ্দেশ্যে।
গাড়িতে ইমতিয়াজ একটু শান্তই রইলো। বাসায় আসার আগে সে গিয়েছিল গো°র°স্থানে। তাহমিনার কবরের কাছে কিছুটা সময় কাটিয়েছে।
এদিকে মামের হালকা গোলাপী বেনারসি শাড়িটা পড়েছে মৃত্তিকা। সুরভিকে সন্দেহ হতে থাকলেও আজ সুরভিই তাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। শাড়ির সাথে মাথায় আবার হিজাব পড়িয়ে দিয়েছে সে। ইসরাত আসলেও ওকে সাজানোতে হাত দেয়নি সে, এসবে যে বড্ড কাঁচা।
মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে সুরভি বলল,
“দারুন লাগছে।”
মৃত্তিকা উত্তর দেয় না। সুরভি ওর নিরবতাকে লজ্জা বলে ধরে নিলেও একটা আসলে রাগ ছিল। সুরভি রুম থেকে বেরিয়ে গেলে মৃত্তিকা মনে মনে একটা কথাই বলে,
“মুখোশধারী মানুষগুলোর মধ্যে কি তুমিও আছো আপু?”
ইমতিয়াজসহ সকলে চলে এসেছে। ড্রইংরুমে মৃত্তিকা তাদের কথা শুনতে পাচ্ছে, তবে ইমতিয়াজের কোনো কন্ঠস্বর পায়না।
কিছুক্ষণ পর সুরভি আর তানজিম রুমে আসে। তানজিম ওকে দেখে একটা চওড়া হাসি দিয়ে বলল,
“বাহ আপু, তোমাকে আজকে অন্যরকম লাগছে।”
তানজিমের কথায় সুরভি হেসে বলে,
“মিউকো, চলো। তোমার ডাক পড়েছে।”
তানজিম বলে,
“আমি নিয়ে আসছি, তুমি যাও।”
সুরভি কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। তানজিম মৃত্তিকার সামনে বসে বলল,
“ছোট ভাই তো আমি তোমার। বে°য়া°দ°বি করেছি, কষ্ট দিয়েছি, ক্ষমা করবে না?”
মৃত্তিকা ওর গোছানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
“রাগ নেই আমার। এভাবে মনের কথা বলে দেয়া মানুষগুলো অনেক ভালো। কিন্তু যাদের মুখে মধু আর অন্তরে বি°ষ?”
“তোমার বাবার কথা বলছো?”
মৃত্তিকা কিছু না বলে আয়নার দিকে তাকায়। শুধু কি ওর বাবাই মি°থ্যা চেহারা নিয়েছে? না, আশেপাশে এমন অনেক আছে।
দেলোয়ারা দরজার কাছ থেকে বলল,
“মিউকো।”
তানজিম মৃত্তিকার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে,
“তাহসিনা আপুকে এভাবে নিতে পারিনি, তোমাকে নিতে তো পারি?”
মৃত্তিকা ওর হাত ধরে। বোনকে নিরাপদে, যত্নে নিয়ে আসে বিবাহস্থলে। ইমতিয়াজের দিকে আড়চোখে তাকালো মৃত্তিকা। কালো পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা, পৃথিবীর সবচেয়ে সাদামাটা একটা সাজ নিয়েছে সে। মৃত্তিকার দিকে একবার তাকায় ইমতিয়াজ। দুচোখে লজ্জা আর ভয়ের সাথে কিছুটা বিব্রত অবস্থাও নজরে পড়ে।
পাশাপাশি বসানো হলো দুজনকে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হলো। কোনোরকম ঝা°মেলা ছাড়াই বিয়ে সমাপ্ত হলো। তবে পুরো সময় জুড়ে মমতাজ বেগম আর সুরভি এখানে উপস্থিত নেই। মৃত্তিকা বিষয়টা লক্ষ্য করেও নিরব থাকে।
তানজিম বলার পর আহনাফ মৃত্তিকাকে চিনতে পেরেছে। সেদিনের ওই ভদ্রমহিলা রিপা বেগমের একমাত্র মেয়ে।
বাসার সদর দরজা খোলা আছে। দরজা ঠেলে ভিতরে আসে মৃত্তিকার বাবা শরীফ। বিবাহ পরবর্তী মোনাজাত চলছে, মৃত্তিকার নজর উনার দিকে পড়তেই দাঁড়িয়ে যায়। ইমতিয়াজ একহাতে ওকে ধরে বসিয়ে দেয়। মৃত্তিকা তাকায় ইমতিয়াজের দিকে, ইমতিয়াজ এখনো নিজের মোনাজাত ভঙ্গির হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
চলবে……
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ঊনত্রিংশ পর্ব (২৯ পর্ব)
“তোমাদের সম্পর্ক অটুট থাকুক।”
শরীফ কথাটা বলে মৃত্তিকার মাথায় হাত বুলাতে আসলে মৃত্তিকা সরে যায়। ইমতিয়াজের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
শরীফ আসার কারণে একটু আগেই বাসায় তুলকালাম করেছে শাফিন সাহেব আর মমতাজ বেগম। ইমতিয়াজ বরাবরের মতো এবারেও চুপ, আহনাফ তো এসব বিষয় সম্পর্কে জানেই না।
মৃত্তিকা ইমতিয়াজের পিছনে দাঁড়িয়ে ওর পাঞ্জাবির হাতা মু°ঠ করে ধরে৷ এমন আচরণে ইমতিয়াজ একটু অবাক হয়।
শরীফ আর কিছু না বলে চলে যায়। মেয়ে এখনো তাকে ভ°য় পায় বা ঘৃ°ণা করে৷ ঠিক যেরকম ছোটবেলায় লুকিয়ে যেতো, তেমনি আজও লুকিয়েছে। তবুও শরীফ এটা ভেবে স্বস্থি পেয়েছে অন্তত মৃত্তিকা লুকানোর মতো কেউ তো আছে।
শরীফকে নিয়েই একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে শাফিন সাহেব। তানজিম একপর্যায়ে বলে,
“মামা, এবারে থামেন। যথেষ্ট হয়েছে।”
মমতাজ বেগম ইমতিয়াজকে বলেন,
“গেস্টরুমটা এতোক্ষণ ধরে ঠিক করেছি, তোমাদের আজকে আর বাসায় যাওয়ার দরকার নেই।”
মৃত্তিকা এসে সোফায় গু°ম মে°রে বসে রইলো। ইমতিয়াজ বলল,
“মা, যেতেই হবে। (একটু থেমে) আসলে বাসায় বিড়ালটা একা তো।”
মমতাজ বেগম শাফিন সাহেবের দিকে তাকালো। শাফিন সাহেব মুচকি হেসে বললেন,
“বিদায় তো দিতেই হবে। আজ দেই বা কাল।”
সকলে একসাথে রাতের খাবার খেলো, তারপর বিদায়ের ঘন্টা বেজে উঠে। ইমতিয়াজ, মৃত্তিকা, লুৎফর রহমান ও তানজিম চলে গেলেও মমতাজ বেগম গেলেন না। উনি ভাইয়ের সাথে থাকবেন। আহনাফ ওদের সাথেই নিচে নামলো।
কথাবার্তা শেষে যাওয়ার সময় তানজিম ছুটে এসে আহনাফকে ধরে বলে,
“ভাইয়া, সাবধানে যাবেন। আজ রাতে অনেককিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে।”
আহনাফ চোখ কুঁচকে বলল,
“কি হবে?”
তানজিম পেছন ফিরে বাকিদের চলে যেতে ইশারা করে। ইমতিয়াজকে বলে,
“তোমরা যাও, আমি পড়ে আসবো।”
তারপর আহনাফের দিকে ফিরে ফিসফিস করে বলল,
“যে সত্যের জন্য মুখ খুলে আমার আপুরা মা°রা গিয়েছিল তা আমি জেনেছি। একটা খুনি পরিবারের সন্তান আমি, যারা নিজের মেয়েদেরও হ°ত্যা করতে দুবার ভাবে না।”
এক নিশ্বাসে কথাটা বলে দেয় তানজিম। আহনাফের মাথায় যেন হঠাৎ করে আকাশ ভে°ঙে পড়ে। খু°ন, খু°নি পরিবার সব কথা ছাড়িয়ে তাহসিনার পরিকল্পিত মৃ°ত্যু°র সংবাদ ওকে ভিতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। তানজিমের দিকে নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে আছে।
নিজের চোখের কোণায় জমা পানিটুকু মুছে তানজিম বলল,
“এই র°ক্তে খু°ন ঘুরছে ভাইয়া। (একটু থেমে) তোমার বিয়েটাও ওদের পরিকল্পনার অংশ।”
আহনাফের অবাকের পাল্লা আবারো ভারি হয়। ও তো নিজের বিয়ের কথা এখানে কাউকে বলেই নি। তবে তানজিম কি করে জানলো? প্রশ্নগুলো মনের মধ্যেই ঘুরতে থাকে, জবান যেন বন্ধ তার।
তানজিম একটা ঢোক গিলে, গলাটা ভা°রি হয়ে গেছে। চুল নেড়েচেড়ে বলল,
“ইমতিয়াজ ভাইয়া হয়তো কিছু জানে আর মিউকো আপুও।”
আহনাফ একটু দূরে চলে যায়। চোখ মুছে নিজেকে শান্ত করে আবারো এগিয়ে আসে। তারপর বলে,
“খু°নি পরিবার মানে কি? কে কে আছে এর পেছনে?”
তানজিম চুপ করে থাকে। যেন কিছুই আর বলতে চায় না।
“তোমার মনে হয়না অ°ন্যায় হয়েছে জেনে চুপ থাকা আরো বড় অ°ন্যায়।”
আহনাফের কথার উত্তরে তানজিম বলে,
“প্রতি°বাদ করেও লাভ হবে না। (একটু থেমে) আর দুই একজনে এতো বড় কাজ করেনি, এখানে আরো অনেকে আছে।”
তানজিম হাত ঘড়িতে সময় দেখে বলে,
“তুমি সাবধানে থেকো, ওরা তোমার জীবনটাও নিয়ন্ত্রণে নেয়ার চেষ্টা করবে।”
তানজিম বাসার ভিতরে চলে যায়।
আহনাফের মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে একটা আওয়াজ বের হয়,
“তাহু।”
সে স্থির হয়ে গেছে। হয় পুরো পৃথিবী থমকে গেছে আর নাহয় পুরো পৃথিবীর মাঝে ও নিজে থমকে গেছে।
______________________________________
কিছুক্ষণ আগেই বাসায় এসে পৌঁছেছে ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। ঘড়িতে এখন রাত দশটা। ইমতিয়াজ দরজা খুলে ভিতরে গিয়ে বলল,
“বাসায় এমন কেউ নেই যে আপনাকে আদর আপ্যায়ন করে ভিতরে আনবে।”
মৃত্তিকা ভিতরে আসতে পা বাড়ালে ইমতিয়াজ নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়। মৃত্তিকা ওর দিকে তাকালে চোখের ইশারায় হাত ধরে ভিতরে আসতে বলে। মৃত্তিকা তাই করলো।
“আপনি কিন্তু মানসিকভাবে বেশ শক্ত একজন মেয়ে, তবুও তখন ভয়ে আমার পিছনে কেন লুকিয়েছেন?”
মৃত্তিকা কিছু বলে না। ইমতিয়াজ কি করে জানবে মৃত্তিকার জীবনে ভরসা করার মতো পুরুষ সে একাই। মৃত্তিকা যতই নিজেকে সামলাতে পারুক না কেন, সেও চায় কেউ তাকে আগলে রাখুক।
মৃত্তিকার হাত ধরে ওকে শোবার রুমে নিয়ে গিয়ে বলল,
“রেস্ট নিন আমি একটু আসছি।”
ইমতিয়াজ বেরিয়ে গেল। ডাইনিং এ মিউ মিউ শব্দ শুনে মৃত্তিকা সেদিকে যায়। বিড়ালটা টেবিলের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে। সদর দরজার দিকে তাকিয়ে বুঝলো ইমতিয়াজ বাইরে থেকে লক করে গেছে।
মৃত্তিকা বিড়ালটার গায়ে আলতো করে হাত বুলায়। একটু আদর করে আবারো রুমে ফিরে আসে।
ঘন কুয়াশায় পথ চলতে যেমন কষ্ট হয়, তেমনি অবস্থা মৃত্তিকার। পথ তো আছে কিন্তু দৃষ্টি সীমানার বহু দূরে মনে হচ্ছে। কে যে নিজের আসল চেহারা দেখাচ্ছে আর কে যে ভ°ন্ড তাই বোঝা মুসকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আয়নার সামনে গিয়ে হিজাব খুলে, শাড়ির আঁচলে দেয়া ভাঁজগুলো খুলে সমস্ত আঁচল মেলে দেয়। ছোট ছোট চুলগুলোতে হাত বুলায় সে। আয়নাতে দেখতে থাকে নিজেকে।
সকলে তো ওকে সুন্দরী বলে। ফর্সা গায়ের রঙ, উঁচু নাক আর হালকা-পাতলা ঠোঁট ওকে সুন্দরী করেছে। অনেকে তো ওকে পাকিস্তানি মেয়ে বলেও সম্মোধন করে।
দরজা খোলার শব্দ হয়। মৃত্তিকা শাড়ির আঁচল তুলে রুমের দরজার দিকে যায়। ইমতিয়াজ এসেছে, হাতে একটা ব্যাগ। যতটুকু বোঝা গেল এটা বিড়ালের খাবার।
মৃত্তিকা ভিতরে চলে আসলো। ইমতিয়াজ ডাইনিং এ বিড়ালকে খাবার দিচ্ছে। রুমের দরজা খোলা থাকায় দৃশ্যটা দেখা যাচ্ছে। মৃত্তিকা বিছানায় বসে চেয়ে রইলো সেদিকে।
ইমতিয়াজ এসে ওর মুখোমুখি বসে। মৃত্তিকা একবার ওর দিকে তাকিয়ে আবারো দৃষ্টি সরায়।
“আপনি কি জানেন আপনাকে কে বা কারা হত্যা করতে চায়?”
ইমতিয়াজের সরাসরি প্রশ্নে মৃত্তিকা চেয়ে থাকে ওর দিকে। ইমতিয়াজ একটু সামনে এগিয়ে বলে,
“আপনার বাবাকে সন্দেহ করেছিলেন কিন্তু উনাকে তো এসবের সাথে যুক্ত বলে মনে হলো না।”
মৃত্তিকা এবারেও চুপ করে আছে। ইমতিয়াজের রাগ হয়৷ একটু ধ°ম°ক দিয়েই বলে,
“কথা কি কানে যাচ্ছে?”
মৃত্তিকা কান্না করে দেয়। মনে হলো অনেকক্ষণ কাঁদবে কিন্তু খুব দ্রুতই সে চোখ মুছে বলে,
“তিনটা খু°ন, আমার প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল। প্রথমে ভেবেছিলাম সবকিছুর জন্য বাবা দায়ী, কিন্তু আমি ভুল।”
ইমতিয়াজ খুব সিরিয়াস একটা চেহারা করে বসে বলল,
“তবে আপনি সবটাই জানেন?”
“না, সব জানি না। কিছুটা জানি, বাকিটা শুধুই অনুমান।”
“আপনার জানা আর অনুমান সবই বলুন।”
মৃত্তিকা কয়েকবার ঘনঘন ইমতিয়াজের দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করে,
“তাহসিনার বিয়ের আগেও আমি আর মাম বহুবার দেশে এসেছিলাম। কখনোই বড়মণি বা মামার বাসায় যাইনি। আমরা রোমি আন্টির বাসায় যেতাম। সেখানে উনারা আমার অগোচরে কোনো কিছু নিয়ে কথা বলতো। প্রচুর আগ্রহ থাকতো আমার তাদের কথায়, আমি লুকিয়ে শুনতে চাইতাম। বেশ কয়েকবার একটা নাম শুনেছি, রাহা সুলতানা।”
ইমতিয়াজ মনোযোগ দেয়। মৃত্তিকা আবারো বলে,
“কলরবের বাসায় গিয়েছিলাম আমি। বিয়ে ঠিক হওয়ার কয়েকদিন পরের ঘটনা এটা। কলরবের বাবা আমাকে দেখিয়ে কলরবের ফুপ্পির সাথে একটা কথা বলেছিল- ও হলো রাহার মেয়ে। কথাটা ফিসফিসিয়ে বলছিলো, যেন আমি না শুনি।”
মৃত্তিকা পাশের টেবিল থেকে পানি নিয়ে পান করে। ইমতিয়াজ বলে,
“এই রাহা সুলতানা কে? রিপা আন্টি?
মৃত্তিকা গ্লাসটা রেখে মাথা নেড়ে বলল,
“জানি না, এটা জানার জন্যই আমি দেশে থেকে যাই। কলরবের বাবাকে লুকিয়ে অনুসরণ করি। সব ক্ষেত্রে নয়, উনার অফিসেই বেশি অনুসরণ করতে পেরেছিলাম। তবে তেমন কিছুই জানতে পারিনি।”
মৃত্তিকা একটু থামে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“মামার বাসায় আমার উপর হা°ম°লা হয়েছিল। স্টোররুমে আমি সামিহা আর সারাহ্-র ফ্যামিলির ছবি দেখেছিলাম, রোমি আন্টির ফ্যামিলি ফটোও ছিল। (একটু থামে) জ্ঞান হারানোর আগে কলরবের বাবাকে আমি দেখেছিলাম, উনিই আমার উপর হামলা করেছিল। এতোটা আমি ভাবতে পারিনি।”
মৃত্তিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচুস্বরে বলে,
“মামার উপর আমার সন্দেহ তীব্র।”
এবারে ইমতিয়াজ উঠে দূরে গিয়ে উলটো দিকে ফিরে দাঁড়ায়। অনেকক্ষণ রুমে নিরবতা বিরাজ করতে থাকে।
পিনপতন নিরবতা ছি°ন্ন করে মৃত্তিকা বলে,
“সুস্থ হওয়ার পরও আমি এজন্যই মামার বাসায় থেকেছি। মামা কারো সাথে কথা বলার সময় রাহা নামটা উচ্চারণ করেছে। কিন্তু আমার থেকে দূরত্ব রেখে চলেছে। (একটু থেমে) আমার মনে হয় মামের নামই রাহা।”
ইমতিয়াজ অন্যদিকে ফিরেই বলল,
“এখানে তাহমিনার দোষটা কোথায়?”
এই উত্তর মৃত্তিকার জানা নেই। ছাড়া ছাড়া কিছু ঘটনা জানে সে। সম্পূর্ণ ঘটনা জানতে চেয়েও এখনো জানতে পারেনি সে।
ইমতিয়াজ ফিরে তাকিয়ে বলল,
“কি দোষ ছিল আমার মিনার?”
ওর কন্ঠে ভূমি পর্যন্ত কেঁ°পে উঠবে হয়তো।
মৃত্তিকা কাঁ°পা কন্ঠে বলল,
“একটু বসুন, আমার কথা শেষ হয়নি।”
ইমতিয়াজ বসে না, তবে শান্ত থাকে। মৃত্তিকা ডানহাত দিয়ে বামহাত ঘ°ষতে ঘ°ষতে বলল,
“ক°ফি°নের ভিতরে আমার জ্ঞান এসেছিল, সজ্ঞানে ছিলাম অনেকক্ষণ। দুজনে কথা বলার সময় বলেছিল- সেদিন তাহমিনা আর তাহসিনার সাথে মিউকোকেও পাঠানো দরকার ছিল। রিপার মেয়ে রিপার সাথে চলে গেলে আর এতো ঝা°মেলা হতোই না। (একটু থেমে) ওরা প্রমাণ লো°পা°ট করছে, কিন্তু সেটা এই তিন খু°নের নয়। তার আগেও কোনো খু°ন হয়েছে।”
“পুরোনো খু°নের রেশ ধরেই নতুন কোনো খু°ন, সেটা ধামাচাপা দিতে আবারো…”
কথা শেষ না করেই ইমতিয়াজ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজায়। মনের এমন এক উথাল-পাতাল অবস্থা যা কাউকে বোঝানো যাবে না। রাগ, ক্ষো°ভ বেড়ে গেল হঠাৎ। ড্রেসিংটেবিলের উপরে থাকা সুগন্ধির বোতল মাটিতে ছুড়ে ফেলে। কাঁচের বোতল ভে°ঙে একাকার। এমন ঘটনায় মৃত্তিকা ঘা°ব°ড়ে যায়।
একে একে ড্রেসিংটেবিলের সবকিছু ফেলে দেয়। টেবিলের বইগুলোও ছুঁ°ড়ে ফেলে। ইমতিয়াজের এমন আচরণ মৃত্তিকা অচেনা। এতোটাই ঘা°ব°ড়ে গিয়েছে যে ওকে থামানোর মতো চিন্তা মাথায়ই আসছে না।
বি°ধ্ব°স্ত একটা রুমের মাঝে ইমতিয়াজ চেঁচিয়ে উঠে “তাহমিনা” বলে। জানলার গ্রিলসহ কেঁ°পে উঠলো শব্দে।
______________________________________
রাত একটার কাটা ছুঁইছুঁই, তবুও ঘড়িটা থামছে না। চলছে অবিরাম, রাত গভীর হচ্ছে।
আহনাফকে একের পর এক কল করছে সারাহ্। চিন্তায় চিন্তায় তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে আসবে নাকি থাকবে তা এখনো জানে না। সেই যে ঢাকায় গিয়ে জানিয়েছিল তারপর আর কোনো কথা নেই।
আব্বাস সাহেব বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছেন। আহনাফ চলে আসবে এমন চিন্তা নিয়ে দশটায় উনি রুমে চলে গেছেন।
সারাহ্ কি করবে বুঝতে পারছে না। চিন্তিত সারাহ্ শেষে কান্না শুরু করে দেয়। ফ্লোরে বসে হাঁটুতে দুইহাত দিয়ে মাথা নুইয়ে কাঁদছে সে।
এদিকে আহনাফ কাকরাইল এসেছে। গো°র°স্থানে রাতে লোকে ভ°য় পায়, আসতে চায় না। আহনাফ এসে বসে আছে। এক নিস্তব্ধতার মাঝে আহনাফের নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।
তাহসিনার দুর্ঘটনার পর নিজেকে যতটা সামলে নিয়েছিল আজকে তার চেয়ে বেশি এলোমেলো হয়ে গেছে সে। ফোনটা যে অনবরত কাঁ°পতে কাঁ°পতে থেমে গেছে সে খেয়াল ওর নেই।
______________________________________
ঘর পরিষ্কার করেছে মৃত্তিকা। ইমতিয়াজ বিছানায় বসে আছে। হাত কে°টে গেছে, গাল আর গলার দিকেও ক্ষ°ত হয়েছে। মৃত্তিকা বাধা না দিলে হয়তো আরো বড় ধরনের কিছু হতে পারতো।
ইমতিয়াজের হাতে ব্যা°ন্ডে°জ লাগাচ্ছে মৃত্তিকা। এতোক্ষণ সে কাছে ঘেষতে দেয়নি। এখন নিরব। মৃত্তিকা স্যাভলন লাগানো তুলা নিয়ে গালে লাগাতেই ইমতিয়াজ ব্য°থায় একটু নড়ে উঠলো।
“সরি, আস্তে আস্তে দিচ্ছি।”
কথাটা বলে খুব আলতো হাতে স্যাভলন লাগায় মৃত্তিকা। ব্যা°ন্ডে°জ লাগাতে গেলে ইমতিয়াজ বাধা দেয়। মুখে বলে,
“লাগবে না।”
মৃত্তিকা ব্যা°ন্ডে°জ রেখে দিলো। সবকিছু ঠিকঠাক করে রেখে চুপচাপ রুমে একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকে। ইমতিয়াজ ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“তখন আপনি আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলেন।”
মৃত্তিকা বলতে চাচ্ছে, কিন্তু ইমতিয়াজের যা প্রতিক্রিয়া তাতে এখন কথা বলতেই ভ°য় পাচ্ছে সে।
ইমতিয়াজ বুঝতে পারে মৃত্তিকা ওকে ভ°য় পাচ্ছে। ইমতিয়াজ শান্ত গলায় বলল,
“এখানে এসে বসুন।”
মৃত্তিকা এসে ইমতিয়াজের পাশে বসলো। ইমতিয়াজ বলল,
“ইনসাফ বলে একটা কথা ইসলামে আছে৷ জানেন তো বাবা আমাকে সবসময় ইনসাফের কথা বলতো। স্ত্রীদের প্রতিও ইনসাফ আছে। (একটু থামে) ভয় পাবেন না, জা°নো°য়ারের মতো ব্যবহার আপনি পাবেন না। একটু আগের ঘটনা আমার রাগের ফল। আপনি রাগের কারণ নন।”
মৃত্তিকা একটা ঢোক গিলে বলল,
“যদি সত্যি আমার মামা এসবে যুক্ত থাকে?”
মৃত্তিকার চোখে কোণা দিয়ে গড়িয়ে পড়া জলটুকু ইমতিয়াজ মুছে দিলো। মৃত্তিকা চোখ তুলে তাকায় ওর দিকে।
সত্যি তো হলো ইমতিয়াজ মৃত্তিকাকে ভালোবেসেছে, নিজ ইচ্ছায় স্ত্রীরূপে গ্রহণ করেছে। তার অর্থ তো এই নয় যে সে তাহমিনাকে ভুলে গেছে।
একাধিক স্ত্রীর প্রতি কিভাবে ইনসাফ করতে হয় তা নিয়ে অনেক কোরআনের আয়াত ও হাদিস জানা আছে ইমতিয়াজের। কোরআন-হাদিসকে কি কেউ ভুল বা মি°থ্যা বলতে পারবে? জীবন তো কোরআনের আলোতেই সাজাতে হবে।
চলবে…..
#অনুভূতিরা_শব্দহীন
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
ত্রিংশ পর্ব (৩০ পর্ব)
ফজরের আযান দিচ্ছে। আহনাফ গো°র°স্থানের পাশের মসজিদে নামাজের জন্য যায়। ওযু করে নামাজ পড়ে আবারো চলে আসে পূর্বের স্থানে।
পুব আকাশে একটু একটু করে উঠে আসছে সূর্য। আকাশ লাল হয়ে উঠেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো সাদা হয়ে যাবে। আলোতে ভরে যাবে সবকিছু, মানুষের আনাগোনা বাড়বে৷
এদিকে সারাহ্-র অবস্থা যাচ্ছেতাই। জায়নামাজে বসে অসম্ভব কান্না করে যাচ্ছে শেষরাত থেকে। কি যেন এক অজানা ভয় তার। তার আহনাফ হারিয়ে যাবে, চলে যাবে তার জীবন থেকে। আ°শংকা আর আ°ত°ঙ্কে কান্না করছে সে। চোখ পানি শুকিয়ে যাক, তবুও আল্লাহ্ তার দোয়া কবুল করুক।
ফজরের পর আবারো আহনাফের নাম্বারে ডায়াল করে। ফোনের কাঁ°পুনি অনুভব করে আহনাফ। ফোন বের করে সারাহ্-র নাম্বার দেখে কে°টে দেয়। আবারো কল আসে, আহনাফ কে°টে দেয়। কয়েকবার কে°টে দিয়ে পরে বি°র°ক্ত হয়ে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে।
গো°র°স্থানে প্রবেশ করা শরীফের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে ফোনটা। আহনাফ উনার দিকে তাকিয়ে আবারো অন্যদিকে ঘুরে যায়। শরীফ ফোনের উপর দিয়েই হেঁটে আসে। রিপা বেগমের কবর জিয়ারাত করে।
আহনাফকে ঠায় বসে থাকতে দেখে বলল,
“এখানে বসে আছো? তাও এতো ভোরে?”
আহনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আপনার কোনো সমস্যা?”
শরীফ মাথা দুলিয়ে বলল,
“না, আমার কি সমস্যা হবে? এমনিতেই জিজ্ঞাসা করলাম।”
তাহসিনার কবরের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শরীফ বলে,
“ওই তো রিপার সাথে মা°রা যাওয়া ব্রাইড। তাহসিনা তাবাসসুম।”
আহনাফ মাথা নেড়ে শুধুই সম্মতি জানায়৷ শরীফ বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“এখানে এভাবে থাকলে শরীর খারাপ করবে, বাসায় চলে যাও।”
শরীফ তো বেরিয়ে গেল, কিন্তু আহনাফ গেল না। সে দাঁড়িয়ে আছে। তাহসিনাকে কেউ কেন মা°র°বে, তাও তারই পরিবারের কেউ। ঘন মেঘ আহনাফের মনকে ঘিরে ফেলেছে, বারেবারে ব°জ্র°পা°ত হচ্ছে কান ফাটানো তীব্র শব্দে। আহনাফ এখন শুধুই বৃষ্টির অপেক্ষা করছে।
______________________________________
সকাল আটটা, মৃত্তিকা বেশ আরামেই ঘুমাচ্ছে। সারারাত সজাগ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে একেবারে ঘুমিয়েছে সে। রুমে এসি চলছে, হালকা বেগুনি রঙের কম্ফোর্টার গায়ে জড়িয়ে রেখেছে। যদিও সে এটা নিজে থেকে দেয়নি, কিছুক্ষণ আগে ইমতিয়াজ দিয়ে দিয়েছে।
ইমতিয়াজ এখন ব্যস্ত সকালের নাস্তা তৈরিতে। রুটি, ডিম আর চা, এরচেয়ে বেশি ঝা°মেলা সে সকালে করতে চায় না। নাস্তা টেবিলে রেখে রুমে উঁকি দিয়ে মৃত্তিকাকে ঘুমাতে দেখে ইমতিয়াজ আর ওকে ডাকাডাকি করে না। নিরবে ওয়াশরুমে চলে যায়।
খানিকক্ষণ পরে মৃত্তিকা আপনা থেকেই জেগে উঠে। চোখ খুলে গায়ে কম্ফোর্টার দেখে। ওয়াশরুমে পানির শব্দে বুঝতে পারে ইমতিয়াজ ওখানে। উঠে ঝিম মে°রে বসে থাকে।
ইমতিয়াজ গোসল সেরে বেরিয়ে ওকে বসে থাকতে দেখে বলল,
“ঘুম হয়েছে?”
মৃত্তিকা মৃদুস্বরে বলল,
“হুম।”
“ফ্রেশ হয়ে নেন, নাস্তা ঠান্ডা হয়ে যাবে।”
মৃত্তিকা হেলেদুলে ওয়াশরুমে যায়। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে দেখে ইমতিয়াজ বিছানা গুছিয়ে ফেলেছে। ডাইনিং এ উঁকি দিয়ে মৃত্তিকা বলে,
“আপনি একা একা সব করেন?”
ইমতিয়াজ আলতো হেসে বলল,
“তো কে আর করবে?”
মৃত্তিকা চেয়ার টেনে বসে বলে,
“আমি করতে পারতাম, আপনার তো হাত কা°টা।”
ইমতিয়াজ কিছু না বলে ওর প্লেটে রুটি-ডিম তুলে দিয়ে নিজেও খেতে বসে। মৃত্তিকা ওর জবাবের আশায় চেয়ে থেকে ব্যর্থ হয়ে খাওয়া শুরু করে।
“আপনি কি আজ অফিস যাবেন?”
ইমতিয়াজের সোজাসাপ্টা প্রশ্নে মৃত্তিকা জবাব দেয়,
“না, আজকে ছুটি। কাল যেতে হবে।”
“ওহ।”
মৃত্তিকা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনিও যাবেন আমার সাথে।”
“আমার তো ডিউটি আছে।”
“আপনি কাল থেকে অফিসে যাবেন আর আমি বাসায় থাকবো।”
ইমতিয়াজ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলে,
“ওয়েট, আপনার অফিসে আমি কি করবো? বিজনেসের কিছুই আমি বুঝি না।”
মৃত্তিকা খেতে খেতে বলল,
“ও কি আর একদিনে বুঝে নাকি? ধীরে ধীরে বুঝে যাবেন। (একটু থেমে) আর আমার অফিস মানে কি? আমারটা কি আপনার না?”
“রি°স্ক নিচ্ছেন ম্যাডাম।”
“আমি জানি, আমি কি করছি।”
ইমতিয়াজ হেসে আবারো খেতে শুরু করে৷ খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে মৃত্তিকা ইমতিয়াজকে দেখে। কাল রাতে কি ভ°য়ং°কর রূপই না সে নিয়েছিল, অথচ এখন কতটা হাসিখুশি।
“কোম্পানির বাকি দুটি শেয়ার কে কিনেছে জানেন?”
ইমতিয়াজের কথায় মৃত্তিকা চমকে উঠে। এতোক্ষণ সে একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিল। ঠোঁট উলটে বলে,
“শিউর তো জানি না, তবে একজন ডাক্তার।”
ইমতিয়াজ একটু হেসে বলল,
“আপনার বাবা।”
ইমতিয়াজের টিশার্ট ধরে টে°নে মৃত্তিকা ওকে কাছে এনে বলে,
“ওই লোকের সাথে আপনার এতো ঘনিষ্ঠতা কেন?”
ইমতিয়াজ ওর হাতের দিকে তাকালে মৃত্তিকা টিশার্ট ছেড়ে দেয়। বি°র°ক্তি প্রকাশ করে মৃত্তিকা বলল,
“ওই লোকের হাত থেকে আমি নিস্তার চেয়েও পাচ্ছি না।”
“নিস্তার পাননি বলেই বেঁচে আছেন। নাহলে মৃত্তিকা নামটা নিশ্চিহ্ন হতো।”
মৃত্তিকা জানে ওর বাবা ওকে বাঁচিয়েছে, ইমতিয়াজই চিঠি মাধ্যমে বলেছিল। তবুও সে বাবাকে বিশ্বাস করে না, ভরসা করে না বরং ঘৃ°ণার চোখে দেখে।
খাওয়া শেষে মৃত্তিকা প্লেট, কাপ ধুয়ে রেখে ডাইনিং এ এসে দেখে ইমতিয়াজ বিড়ালকে হারনেস পড়াচ্ছে। বিড়ালটি বারবার নড়াচড়া করছে আর ইমতিয়াজ তাকে বকাবকি করে হারনেস পড়াচ্ছে। মৃত্তিকা এসব দেখে হেসে রুমে আসে।
ইমতিয়াজ বলে উঠে,
“মিউকো, চল ঘুরতে যাই।”
মৃত্তিকা খুশিমনে এসে বলে,
“হ্যাঁ, চলুন।”
ইমতিয়াজ ফিরে তাকিয়ে জোরে হেসে দেয়। কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলে,
“আমার বিড়ালের নাম মিউকো আর আপনি মৃত্তিকা।”
মৃত্তিকা লজ্জা পেয়ে ভিতরে চলে আসে। ইমতিয়াজ তার বিড়ালকে ডাকছিল আর মৃত্তিকা ভেবেছে ওকে বলছে। ইমতিয়াজ বের হওয়ার আগে মৃত্তিকা বলে,
“ওই মিউকোর সাথে এই মিউকোকেও একটু বাইরে নিয়ে যাবেন?”
ইমতিয়াজ হেসে বলল,
“চলেন।”
______________________________________
“আহনাফ এখনো বাসায় আসেনি?”
আব্বাস সাহেবের কথায় সারাহ্ মাথানেড়ে বলল,
“না, বাবা।”
“কল দিয়েছিল? কোন কাজে আছে?”
“চলে আসবেন হয়তো।”
আব্বাস সাহেব নিজের রুমে চলে যায়। সারাহ্ রান্নাঘরে যায়। কাজের খালা, আলেয়া খাতুন, এখানে কাজ করছে। আজ মেহমান আসবে, আহনাফের ছোটফুপা আর ফুফু। কাজ তো অনেক, গোছাতে হবে।
সারারাত নির্ঘুম সারাহ্ কাজে মন দিতে পারছে না। আহনাফ যে একটাবারের জন্যও কল দিলো না। ওর ছ°টফ°টানি কে বুঝে?
একের পর এক সবজি কা°টায় ব্যস্ত হয় সে। কিছুক্ষণ পর কলিং বেল বাজলে আলেয়া খাতুন যাওয়ার আগেই সারাহ্ ছুটে যায়। দরজা খুলে আহনাফকে দেখে স্বস্থির নিশ্বাস ফেলে সে। কিন্তু আহনাফের অবস্থা যে এলোমেলো, যেন বিশাল ঝ°ড় গেছে তার উপর দিয়ে।
“কি হয়েছে আপনার?”
চিন্তিত সারাহ্-র প্রশ্নের জবাব আহনাফ দেয় না। শান্ত চাবি দেয়া পুতুলের মতো হেঁটে সে ভিতরে চলে যায়।
রুমে গিয়ে ধুম করে ফ্লোরে বসে পড়ে সে। সারাহ্ এসে আহনাফকে দেখে আরো অ°স্থির হয়ে যায়।
ওর পাশে গিয়ে বসে বলল,
“আপনি ঠিক আছেন? আহনাফ।”
আহনাফ শান্ত চোখে ওর দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখেমুখে অ°স্থিরতা, লাল ফুলে উঠা চোখ দুটো সারারাতের কান্নার সাক্ষী হয়ে আছে। ওর গালে আলতো করে হাত দেয়। সারাহ্ ওর গা ঘেষে বসে বলল,
“বলবেন না আমায়? কোনো ভুল করেছি আমি?”
আহনাফ ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে বলে,
“মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, আমি ঘুমাবো। চিরনিদ্রায় চলে যাবো আমি।”
“চিরনিদ্রা” কথাটা শুনে সারাহ্ ভ°য় পায়, কাঁ°পা হাতে আহনাফের চুলে বিলি কাটে। আহনাফ আরাম করে শোয়।
“আপনার সাদাব-সাইদাকে না দেখে চিরনিদ্রায় কেন যাবেন?”
আহনাফ মাথাতুলে ওর দিকে তাকায়। কাঁদোকাঁদো মুখেও সারাহ্ জোরপূর্বক হেসে বলে,
“কয়েকদিন ধরে অনুভব হচ্ছিল, কাল জানতে পেরেছি।”
“কি?”
নিষ্প্রাণ হয়ে প্রশ্ন করে আহনাফ।
সারাহ্ একহাতে ওর চুলে বিলি কেটে, অন্যহাত দাঁড়িতে রেখে বলল,
“শীঘ্রই আপনি সাদাবের আব্বু, সাইদার পাপা হবেন ইনশাআল্লাহ ফয়েজ স্যার।”
মন খারাপের মাঝেও এ এক খুশির খবর হয়ে এলো। পরিবার যে দুই থেকে তিনে যাচ্ছে। আহনাফ উঠে বসে সারাহ্-র গালে, কপালে পাগলের মতো চুমো দেয়। লাজুক সারাহ্ সেই আহনাফের বুকেই আশ্রয় পায়। শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে আহনাফ।
তাহসিনার মৃ°ত্যু নিয়ে সারাহ্-কে আর কিছুই জানায় না আহনাফ। তবে সারাহ্-কে ও হারাতে দিবে না, আগলে রাখবে শেষ র°ক্ত°বিন্দু পর্যন্ত। তানজিমের কথা অনুযায়ী এ বিয়ে যদি পরিকল্পিত হয়ে থাকে তবে স্বার্থের জন্য সারাহ্-র প্রাণ নিতে এক মুহূর্ত সময়ও তাদের লাগবে না।
“ঐশী আমার, আমার অপ্রকাশিত প্রেমটুকু তোমার জন্য রইলো।”
মনের কথা মনে থাকে, আহনাফ থাকে চুপ।
______________________________________
দুপুর দুইটা, জুম্মার নামাজ পড়ে বাসায় এসেছে ইমতিয়াজ। মৃত্তিকা নামাজ শেষে মিউকোকে নিয়ে বসে আছে।
ইমতিয়াজ এসে বলে,
“চলুন, বাইরে কোথাও লাঞ্চ করে আসি?”
সকালে অনেকক্ষণ ওরা বাইরে ঘুরেছে। গোরস্থানে গিয়ে জিয়ারাত করে বাসায় ফিরতে ফিরতে আযান দিয়ে দিয়েছিল। তাই তাড়াহুড়ো করে আর রান্নার ঝা°মেলা করতে নিষেধ করে ইমতিয়াজ।
মিউকোকে বাসায় রেখে দুজনে বাইরে যাবে। মৃত্তিকা তৈরি হয়ে নেয়। স্কার্ফটা দেয়ার সময় ইমতিয়াজ বলে,
“কাল আপনাকে হিজাবে সুন্দর লাগছিল।”
মৃত্তিকা ফিরে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
“মানে আমি হিজাব পড়বো? কিন্তু ওটা তো সুরভি আপুর ছিল। আমার হিজাব নেই।”
ইমতিয়াজ উঠে গিয়ে আলমারি খুলে একটা হিজাব বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“এটা পড়ুন।”
“কার এটা? তাহমিনার?”
ইমতিয়াজ উত্তর না দিয়ে মৃত্তিকাকে হিজাব পড়িয়ে দেয়। মৃত্তিকা অনুভব করে ওর প্রতিটা স্পর্শ। হিজাব পড়িয়েই ইমতিয়াজ বাইরে চলে যায়। মৃত্তিকা আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল,
“আজ সৌন্দর্যটা সত্যিই অন্যরকম।”
হ্যাঁ, অন্যরকম, ভীষণ অন্যরকম একটা দিন কাটায় ইমতিয়াজ ও মৃত্তিকা। দুপুরের লাঞ্চ রেস্টুরেন্টে করে বিকাল পর্যন্ত ঘুরে বেড়ায় আশেপাশেই।
বিকালে রমনার দিকে যায়। ভীড় আর মানুষ মৃত্তিকার অপছন্দ। ভীড়মুক্ত স্থান খুঁজে খুঁজে ব্যর্থ হয়ে ইমতিয়াজ যখন বলে,
“হুমেনের ভীড়।”
মৃত্তিকার জবাব ছিল,
“আমরা এলিয়েন।”
হাওয়াই মিঠাই দেখে মৃত্তিকা ইমতিয়াজের হাতে খোঁ°চা দিয়ে বলে,
“কটন ক্যান্ডি খাবেন?”
“হাওয়াই মিঠাই, সংক্ষেপে শুধু মিঠাই।”
দুটো হাওয়াই মিঠাই কেনা হলো। প্যাকেট খুলে মৃত্তিকা বলে,
“চিয়ার্স।”
ইমতিয়াজ “চিয়ার্স” বলে দুজনে মিঠাই ধা°ক্কা দিতেই তা একসাথে লেগে গেল। মৃত্তিকা ঠোঁট উলটে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয়। ইমতিয়াজ মুগ্ধ হয়। মেয়েটার হাস্যোজ্জ্বল চেহারা যে বড়ই দুর্লভ। মৃত্তিকা খাওয়ার সময় নাকে, গালে মিঠাই লেগে আঠা আঠা অবস্থা।
ইমতিয়াজ টিস্যু এগিয়ে দিলে মৃত্তিকা গালে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“মুছে দেন।”
“পিঁপড়া হওয়া উচিত ছিল আমার।”
ইমতিয়াজের কথার অর্থ বুঝতে চেয়েও বুঝে না মৃত্তিকা।
রাত পর্যন্ত ঘুরাঘুরি করে রাতের খাবার নিয়েই বাসায় ফেরে দুজনে। শরীরটা ক্লান্ত হলেও মনটা বেশ ফুরফুরে। মৃত্তিকার জীবনে এই হাসিটুকুর বড্ড বেশি অভাব ছিল। আজ তা পূর্ণতা পেয়েছে।
মৃত্তিকার চালচলনে বোঝা যাচ্ছে সে খুশি, প্রচন্ডরকম খুশি। এই মন ইমতিয়াজ ভা°ঙবে না, ওর শত কষ্ট হোক ও মৃত্তিকাকে কষ্ট বুঝতে দিবে না। তাহমিনার স্থান হয়তো মৃত্তিকা পাবে না, তবে হৃদস্পন্দের কোনো এক ছন্দে সে থাকবে আজীবন। ইমতিয়াজের ভালোবাসা বড্ড বেশি অপ্রকাশ্য।
প্রকাশ না করলেও কিছু প্রেম হয়৷ ভালোবাসা সৃষ্টিকর্তা থেকে পাওয়া এক নেয়ামত। এর উপর কারো প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ থাকে না। সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছানুসারে কারো মনে কারো জন্য প্রেমের শুরু হয়। কঠিন লাগছে কথাটা?
আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত একটা হাদিস বলি,
রাসুল (সা.)-ও আপন স্ত্রীদের পালা বণ্টন করে বলেছেন, ‘হে আল্লাহ, আমার যতটুকু সাধ্য ছিল আমি ইনসাফ করার চেষ্টা করেছি— আর যে বিষয়টি আমার সাধ্যে নেই (অর্থাৎ কোনো স্ত্রীর প্রতি বেশি ভালোবাসা), সে বিষয়ে আমাকে ভ°র্ৎ°স°না করবেন না।’ (সুনানে তিরমিজি, ৩/১৮৫, হাদিস : ১১৪০; মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা, হাদিস : ৪/৪১৪)
______________________________________
দুপুরে বাসায় মেহমানরা এসেছে। বাসার কেউ এখনো নতুন অতিথির সুসংবাদ সম্পর্কে জ্ঞাত নয়। আহনাফ কাউকে জানাতে চায় না। সকলের অজানা থাকুক, সারাহ্-কে নিয়ে কোনো প্রকার ঝুঁ°কি সে নিবে না।
আহনাফের ফুপা, ফুফুর সাথে ড্রইংরুমে বসে আলাপ করছে আব্বাস সাহেব। আহনাফ ও সারাহ্ কিছুক্ষণ সেখানে ছিল। কিন্তু সারাহ্-র শরীর খারাপ লাগায় রুমে চলে আসে।
সারাহ্ বিছানায় শুয়ে আছে আহনাফ এসে পাশে শুয়ে বলল,
“আমার সাইদা কি করছে?”
সারাহ্ ওকে একটা চিমটি দিয়ে বলে,
“সাইদা ঘুমাচ্ছে।”
হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় সারাহ্ উঠে বসে বলল,
“কাল সারারাত কোথায় ছিলেন?”
“টেনশনে ছিলাম।”
সারাহ্ কপাল কুঁচকায়। আহনাফ হেসে বলল,
“সাদাব বা সাইদা যে আসছে তা আমি জানতাম, এরজন্যই টেনশনে ছিলাম।”
সারাহ্ গাল ফুলিয়ে বসে বলল,
“মি°থ্যা কথা। বাসায় এসেই কেমন যেন ছিলেন আপনি?”
আহনাফ উঠে ওর ঘাড়ে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
“চুপ থাকো, এতোকিছু নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। নিজেকে নিয়ে আর বেবিকে নিয়ে ভাবো।”
আহনাফ চায় থাকুক ওর কষ্টগুলো সারাহ্-র অজানা। সত্য যেমনি বের করবে, ঠিক তেমনি সে সারাহ্-কেও র°ক্ষা করবে।
চলবে……