অনুভবে (২য় খন্ড)
পর্ব ৩
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা
“আমার পিছনে আসো।” সভ্য ইনারাকে বলল। অনেকটা আদেশের সুরে। ইনারা কপাল কুঁচকে বলল, “এক্সকিউজ মি, আপনি আমাকে আদেশ দিচ্ছেন কোন সাহসে?”
“তোমার কাজ করতে আমার সাহায্য লাগবে তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে চুপচাপ আমার পিছনে আসো।”
ইনারার কাছে আর কোনো উপায় রইল না। সে পিছনে যায় সভ্যের। কিন্তু বিড়বিড় করে তাকে কতগুলো বকা দেয়। রুমে যেয়ে সভ্য আবারও আদেশের সুরে বলে, “টেবিলে আমার ফাইল আছে তা ব্যাগে ঢুকিয়ে দেও।”
“নিজের কাজ নিজে করুন।”
“সাহায্য লাগবে কি-না তা বলো।”
ইনারা বিরক্ত হয়ে তার কাজ করে। অন্যদিকে সভ্য আয়েশে সোফার উপর পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে।
এক কাজ শেষ হতেই অন্যকাজ দেয় সে ইনারাকে, “আমার ওয়ালেট আর ঘড়ি যেন কোথায় রেখেছি। একটু খুঁজে দেও। আর ড্রেসিং টেবিলে রাখা ঘড়িটা না। আমার আজ কালো ঘড়ি পরতে মন চাচ্ছে।”
“আমি আপনার রুমের একটা কিছু চিনি না। কীভাবে খুঁজব?”
“তোমার ব্যাপার।”
“আমাকে বিরক্ত করার জন্য তো এখন আপনার সবই মন চাইবে।”
“চুপচাপ কাজ করো। আর আমার রুমের একটা কিছু যেন এদিক থেকে ওদিন না হয়।”
ইনারা প্রচন্ড বিরক্ত হয়। সে এক এক করে রুমের সকল স্থানে খোঁজ নেয়। কিন্তু সহজে পায় না। অবশেষে সভ্য উঠে বলে, “হয়েছে হয়েছে। তোমার অপেক্ষায় থাকলে আর আমার অফিসে যাওয়া লাগবে না।” সে উঠে আলমারি থেকে তার ঘড়ি এবং ওয়ালেট বের করল। ইনারা রেগে উঠে, “আপনি জানতেন আপনি এসব কোথায় রেখেছেন তাহলে আমাকে জ্বালাচ্ছিলেন। কেন?”
“সিম্পল উওর। তোমাকে জ্বালানোর জন্য।”
ইনারা বিরক্ত হয়ে খুব, “এবার আপনার হয়েছে?”
আলমারি থেকে আরেকটা টাই বের করে সভ্য বলল, “আমার আজ টাই পরে যেতে মন চাইছে। পেরিয়ে দেও।” ইনারার দিকে টাই এগিয়ে দিল সে।
“আপনি বাচ্চা না-কি আপনাকে পরিয়ে দিতে হবে।”
“কোনো নিউজ পেপারে কল দেবার মতো কি সময় আমার কাছে আছে? চিন্তা করতে হবে।”
ইনারা কক্ষের অপর প্রান্ত দৌড়ে এসে সভ্যের হাত থেকে টাই নিয়ে বলে, “এখন সময় থাকার কথা।”
সে বিরক্ত ভাব নিয়েই সভ্যের শার্টের টাই বাঁধতে শুরু করে।
আর সভ্য তাকে বিরক্ত করে মজা পায়। ইনারাকে বিরক্ত করার মতো আনন্দ যেন সে অন্য কিছুতে পায় না। মনে মনে হাসলেও তা ঠোঁটে আঁকে না সে। ইনারার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মাথার ছোট ছোট চুলগুলো কপালে এসে খেলা করছে। এই মুহূর্তে সভ্যের তার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নেওয়া উচিত কিন্তু সে পারে না। তার চোখ দুটো যেন চুম্বকের মতো আটকে আছে তার সামনে দাঁড়ানো কন্যাটার উপর। সে অপলক তাকিয়ে আছে এবং ইনারার মুখ থেকে বিড়বিড় করা বকা শুনছে। হঠাৎ ইনারা বকা থামিয়ে বলে, “একটা কথা বলুন তো আপনার দাদা আমাকে এত সাহায্য করল কেন?”
“কী সাহায্য?”
“এই’যে আমাকে আর্থিকভাবে এই তিনবছর সাহায্য করেছে। সে না থাকলে হয়তো আমি….ওহ আপনি হয়তো এসব জানেন না। এসব জানায় আপনার কোনো স্বার্থও নেই। তাই না?”
সভ্য তাকায় ইনারার দিকে। কিছু মুহূর্ত চুপ থাকে সে। তারপর বলে, ” আমার স্বার্থ কেন থাকতে যাবে?”
ইনারা ওক মুহূর্তের জন্য থেমে যায়। তার বুকের ভেতর ভারী হয়ে আসে। সে বহু কষ্টে নিশ্বাস নেয়। বলে, “তাইতো। আপনার দাদা আমার জন্য অনেক কিছু করেছে। একদিনে আমার পৃথিবীটা উল্টাপাল্টা হয়ে গিয়েছিলো। আমার পাশে কেউ ছিলো না। সে না থাকলে হয়তো আমি মরেও যেতে পারতাম সেদিন। আপনাকে এসব বলার কারণ হলো যেন আপনি বুঝেন আমি আপনাকে সাধে বিয়ে করি নি। আপনার দাদার শর্ত ছিলো উনি আমার জন্য যা করেছেন তার পরিবর্তে উনি একটা জিনিস চাইবে তা দিতে হবে। আমি আপনার সাথে বিয়ে করে তার শর্ত পূরণ করেছি। কিন্তু দুই বছরের জন্য কেন সে আপনার সাথে বিয়ে করতে বলল আমি বুঝতে পারছি না।”
“দাদাজান বিয়ে করতে বলেছিল। দুইবছরের কন্টাক্ট আমি করেছি।”
ইনারা চকিতে তাকাল সভ্যের দিকে। এক মুহূর্তের জন্য দু’জনের দৃষ্টি মিলল। তারপর ইনারা চোখ নামিয়ে নিলো। তার চোখ কেন যেন ভিজে আসছে।
“ওহ,” ইনারা মৃদুস্বরে বলল, “আর আপনার দাদাজান এ বিয়ে কেন করাতে চাইল?”
“আমি কীভাবে বলতে পারি?”
“আপনি কিছু না জেনেই আমাকে বিয়ে করে নিলেন?”
“তোমার যেমন নিজের কারণ ছিলো বিয়ে করার তেমন আমারও ছিলো।”
“হুম, গতকাল শুনেছি। কোম্পানির জন্য, তাইতো?” অভিমানের সুরে বলল ইনারা। কিন্তু সভ্য তার কথার অভিমান ধরতে পারে না। সে উল্টো বলে, “জোহানের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো না’কি। তোমাদের মধ্যে এত ভালোবাসা। তাহলে তিনবছর ধরে তার সম্পর্ক তোমার বোনের সাথে কীভাবে?”
ইনারা থেমে যায়। জোহান ও আইজার কথা শুনে গা জ্বলে উঠে তার। আইজা তার সবচেয়ে কাছের মানুষের মধ্যে একজন ছিলো এবং সে কয়েকমাসে জোহানকেও সে ভালো বন্ধু মনে করেছিলো। অথচ দুইজনই কেবল তার বিশ্বাসের অমর্যাদাই করে নি, বরং তার ও তার প্রিয়র সম্মানের তামাশা বানিয়েছিল।
সে সভ্যের টাই সেভাবেই রেখে ফিরে যেতে নিয়ে বলে, “আর পারব না।”
সভ্য তার হাত ধরে নেয়। তাকে নিজের দিকে ফিরায়, “কেন? পারবে না কেন? এতক্ষণ পারলে এখন পারবে না কেন? উওর দেও।” জোর গলায় বলল সভ্য। সে ভাবল জোহানের কথা তুলায় ইনারা এমন করছে। এ ভেবে তার মেজাজ অজান্তেই খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু সে ইনারার চোখে জল দেখে থমকে যায়। তার বুক কেঁপে উঠে। মুহূর্তে তার রাগ হলে যায়।
ইনারা সভ্যের ক্রোধিত দৃষ্টিতে তাকায় সভ্যের দিকে। কঠিন গলায় বল, “কারণ আমার আপনার প্রশ্নের উওর দেবার ইচ্ছা নেই। না এখনের প্রশ্নের, আর না আগের। আর আমি যা চাই না, তা হবে না।”
ইনারা এক ঝটকায় সভ্যের হাত সরিয়ে দিয়ে রাগে সেখান থেকে বের হয়ে যায়।
সভ্য সেখানেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়। ইনারার দৃষ্টি দেখে এক মুহূর্তের জন্য সেই ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সামনে কিছু বলার সাহস হয় নি তার। পরক্ষণেই জোহানের কথা মনে পড়ে তার। সে নিজের টাই আবার খুলতে খুলতে হতাশাজনক গলায় বলল, “ও কি এখনো তোমার উপর প্রভাব ফেলে প্রণয়ী? এত বছর পরেও! আচ্ছা তোমার এ ক্রোধিত দৃষ্টি কী ওকে দেখে নম্র হয়ে যাবে? সব ভুলে আগের মতো মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকবে ওর দিকে?”
সভ্য আলমারিতে টাই রাখতে যেয়ে তার চোখ পরে ড্রয়েরের উপর। সে ড্রয়েরটা খুলে এক ছোট সিন্দুক থেকে বের করে রূপালী বালা। এ বালাটি ইনারার। তার ও ইনারার প্রথম দেখার স্মৃতি এটা। এখনো তার কাছে সুরক্ষিত। যত্ন করে রাখা
.
.
দিন কেটে বিকেল পেরিয়ে এলো। এতক্ষণ হাসনা ছিলো। তার সাথে কথা বলে অনেক সময় কাটায় ইনারা। হাসনা চলে যাবার পর একটু ঘুরাঘুরি করে। খালাজানকে কল দেবার জন্য তার ফোনে বাংলাদেশের সিম ঢুকায়। রহমান গতকালই দিয়েছিলো সিমটি। সিম ফোনে ঢুকাতেই দুটি নাম্বার আসে কেবল। রহমান ভাইয়ের ও সভ্যের। সভ্যের নাম দেখে মেজাজ খারাপ হয় তার। সে সাথে সাথে তার নাম পরিবর্তন করে রাখে, ‘মিঃ অসভ্য’। খালাজানের নাম্বার তার মুখস্থই ছিলো। তাকে কল করে কিছু সময় কথা বলে। তবে বিয়ের ব্যাপারে কিছুই জানায় না। তারপর সে কল দেয় সুরভিকে।
সুরভি ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজগোজ করছিলো। তার ফোন বাজলো। আননোওন নাম্বার বলে সে কল উঠায় না। আজ তার তাড়া আছে। মা সে কখন থেকে বকছে জলদি তৈরি হবার জন্য। তাই তাড়াহুড়ো সুরভির। কিন্তু ফোন একাধিকবার বাজায় সে কল ধরে নেয়।
“হ্যালো, কে?” সুরভি জিজ্ঞেস করে।
“আমি।”
সুরভীর ইনারার কন্ঠ চিনতে এক মুহূর্তও লাগে না, “শালী তুই কোথায় ছিলি? তোকে কতবার কল দিয়েছি জানিস? খালাজানকে কল দিয়েও তোকে পাই নি। গতকাল যে চিন্তায় ছিলাম…”
সম্পূর্ণ কথা শেষ হবার আগেই ইনারা বলে উঠে, “চিন্তায় কেন? কী হয়েছে?” তার কন্ঠে চিন্তা স্পষ্ট।
সুরভি তার কন্ঠ শুনেই বুঝতে পারে সে চিন্তিত। প্রিয়’র সাথে ঘটনাটা হবার পর ইনারা তাকে নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তা করে। তাই সে শান্ত হয়। বলে, “চিন্তার কিছু নেই। নিপা আপু আছে না? আব্বুর বন্ধুর মেয়ে তার আজ বিয়ে। গতকাল হলুদে দেখে কয়জন আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। এর মধ্যে একজনের ছেলেকে বাবা আগের থেকে চিনে। তার পছন্দ। মা’য়েরও না’কি তার পরিবার অনেক পছন্দ হয়েছে। আজ বিয়েতে গেলে কথা বলবে।”
“বলিস কি! ছেলের নাম কি, কি করে, বয়স কত, ব্যবহার কেমন, দেখতে কেমন, কোথা থেকে পড়াশোনা করেছে?”
“থাম থাম মিস এক্সপ্রেস। আমি এখনো ছেলেকে চিনি না। আজ গেলে দেখব।”
“এসে সব তথ্য আমাকে জানাবি। প্রথমেই ওয়ার্নিং দিয়ে দিবি যে তোকে একটুও যদি কষ্ট দেয় তাহলে তার আর রক্ষা হবে না। তার জীবন তছনছ করে দিব।”
“বাবারে পোলায় এই হুমকি শুনে দৌড়ে পালাবে।”
হাসে ইনারা। বলে, “আচ্ছা তাহলে তুই যা। এসে বিস্তারিত জানাবি কি হয়েছে।”
“আচ্ছা।” সুরভি ফোন রেখে আবার আয়নার দিকে তাকাল। তার মা’য়ের ডাক পরতেই সে দ্রুত করে লিপ্সটিক দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। কমলা রঙের একটি গাউন পরেছে সে। সাথে একই রঙের স্টোনের কানেরদুল ও আংটি। একবার ভেবেছিলো চুল বেঁধে ফুল দিবে কিন্তু মা’য়ের ডাকে দ্রুত উঠে এলো সে। পার্স নিয়ে বের হতেই দরজায় সে পেল মা’কে।
“এইত্তো মা, আমি রেডি।”
“হে আল্লাহ এ কি! তোকে না বলেছিলাম সে লাল রঙের শাড়িটা পরতে। লাল রঙে তোকে সুন্দর লাগে। এ রঙে তোকে আরও কালো লাগে তো।”
“লাগুক।”
“এ মেয়ের আমি কি করব। তোকে আজ সুন্দর লাগা প্রয়োজন। কালো দেখা গেলে যদি ওরা বিয়েতে পিছিয়ে যায়।”
সুরভি বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে। আর তার মা’য়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে, “আমার সুইট আম্মুটা দেখো অন্যরা আমার ব্যাপারে কি ভাবলো না ভাবলো আই ডোন্ট কেয়ার। আমার যা পছন্দ, যেমন পছন্দ আমি তেমনি থাকব। আর হ্যাঁ, সাদার বিপরীত কালো হয়। কালোর বিপরীত সুন্দর হয় না। ফর্সা, কালো সব সুন্দর।”
“কিন্তু সবাই তো এ কথা বুঝবে না।”
“সবার বুঝা লাগবে না। আচ্ছা তুমি বলো তোমার চোখে আমি সুন্দর না?”
“তুই তো আমার কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে।”
“কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো। যখন কেউ আমাদের ভালোবাসে তখন তার চোখে আমরা সবচেয়ে বেশি সুন্দর হয়ে যাই। তাই নো চিন্তা, ডু ফুর্তি। বিয়েতে যাচ্ছো ওভাবে মুখ গোমড়া না রেখে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা দেও দেখি।”
“পাগল দেখি আয়। তোর বাবা আর সাইদ গাড়িতে বসে আছে।”
সাইদের নাম শুনতেই চুপ হয়ে যায় সুরভি। গম্ভীর ভাব এসে পড়ে তার মুখে। সে আর কথা আগায় না। চুপচাপ গাড়িতে যেয়ে বসে এবং গাড়িতে সম্পূর্ণ সময় চুপ করেই থাকে। তার মা, বাবা ও সাইদ গাড়িতেও অনেক গল্প করে কিন্তু সুরভি একটা কথাও বলে।
তিন বছর হলো, সে সাইদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কোনো কথাই বলে না। তার উপর অনেক অভিমান আছে সুরভির। কারণ একটাই সাইদ আজও আইজাকে ভালোবাসে। তার সাথে কাজও করে। এতকিছুর পরও। এমনকি তিনবছর আগে যখন সে প্রিয়’র জন্য পুলিশের কাছে গিয়েছিল তখন তাকে আটকানোর জন্য প্রায় দুইমাস রুমে বন্দী রাখা হয়েছিল। এমনকি মা বাবাকে দিয়ে আটকানোর জন্য কসমও কাটিয়েছিল। কেবল আইজার জন্য। যার জন্য সুরভি কেবল তার বন্ধুদেরই হারায় নি। তার ভাইকেও হারিয়েছে। সে যে ভাইকে এত সম্মান করতো, এত ভালোবাসতো। যে সবসময় তাকে বুঝতো, তাকে সাহায্য করতো, সবসময়ই অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতো। সে তো কতবছর আগেই হারিয়ে গেছে। সুরভি তার ফোনের ওয়ালপেপার দেখল। তার, ইনারার ও প্রিয়র ছবি দেওয়া ওয়ালপেপারে। তার বুকের ভেতরটা ভারী হয়ে আসে। নিশ্বাস ফেলতে কষ্ট হয়। সে চোখ বন্ধ করে হেলান দিলো সিটে। সাথে সাথে সে চমকে উঠে। দ্রুত আবার ফোনের দিকে তাকায়। দেখে ইনারা যে নাম্বার থেকে কল দিয়েছিল তা বাংলাদেশের। সে হতবাক। সে আগে নাম্বারটা খেয়ালই করে নি। ইনারা বাংলাদেশে? না, এ কি করে হতে পারে? এমন হলে তো ইনারা তাকে জানাত। সুরভি অপেক্ষা করল, তার পরিবারের সামনে সে ইনারাকে কল দিতে পারবে না।
বিয়ে বাড়িতে পৌঁছাতেই সুরভি বর বধূর সাথে দেখা করে সাবধানতার সাথে সরে পরে সেখান থেকে। হলের শেষ দিকে যেতে যেতে ফোন বের করে কল দেবার চেষ্টা করে সে ইনারাকে। তার দৃষ্টি ছিলো ফোনের উপরই। সে ফোনের দিকে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একজনের সাথে ধাক্কা খায়। ফোন পরে যায় তার হাত থেকে। সুরভী এমনিতেই ছিলো চিন্তায়। ইনারাকে কল না করা পর্যন্ত তার শান্তি হবে না। তাই দ্রুত তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, “সমস্যা কী ভাই? চোখ নাই না’কি?”
সে নিচে বসে তার ফোন উঠাল। তার সাথে আরেকটি ফোনও নিচে পড়ে গিয়েছিলো। ফোনের স্ক্রিনে ভেসে ছিলো একটি ছবি। একটি ছেলে একটি মেয়ের কপালে চুমু খাচ্ছে। সুরভি দুটো ফোনই তুলল। উঠে দাঁড়িয়ে সামনে তাকিয়ে বলল, “দেখে হাঁটতে পারেন না?”
সে চোখ তুলে দেখল তার সামনে দাঁড়ানো একটি পুরুষ। বয়সে তার থেকে বড়ই মনে হলো। ছবির সাথে লোকটার মিল আছে। তবে ছবিটা অনেক আগের মনে হচ্ছে।
সুরভি তার দেখা হওয়া সবাইকেই প্রথম দেখায় গভীর ভাবে যাচাই করে। এর ক্ষেত্রেও বিপরীত হলো না। সুরভির থেকে যদি ছেলেটার ব্যাপারে বর্ণনা চাইতো তাহলে সে বলতো, “লম্বা, শ্যামলা রঙের এক যুবক। যার চুল এলোমেলো। চোখে একটি সরু ফ্রেমের চশমা লাগানো। আর অবশ্যই তাকে এত বড় চুলে মানায় না, নাহয় এ চুলের সাথে চশমা মানায় না। সে ছবিতে তাকে হাজারোগুণ বেশি সুদর্শন দেখাচ্ছিল।”
“আপনি নিজেও দেখে হাঁটতে পারতেন।” স্বাভাবিক গলায় বলে তার দাঁড়ানো পুরুষটা, “কিন্তু আমারও ভুল ছিলো, তাই সরি।” বলে ঝট করে ফোনটা সুরভিরে হাত থেকে নিয়ে চলে গেল। সরি বললেও তার মুখে কোনো দুঃখপ্রকাশ ছিলো না। ছেলেটাকে মিনিটখানেক এর মতো দেখেছে সে। আর সম্পূর্ণ সময় সে মুখটাকে গোমড়া করে ছিলো।
এসব কথা মাথা থেকে ঝেড়ে দিয়ে সে ইনারা কল দিবে তখনই তার মা পিছন থেকে এসে বলে, “বলেছিলাম না আমার পাশ থেকে নড়বি না? মাইর দিব একটা তোকে।জলদি আয়, যে ছেলেটার কথা বলেছিলাম ওরা এসেছে। তোকে দেখতে চাইল।”
এবারও সুরভি ইনারাকে কল দিতে পারে না। তাকে একপ্রকার টেনে নেয় তার মা। একটি টেবিলের সামনে এসে দাঁড় করায়। তার বাবা আরেকটি বয়স্ক লোকের সাথে কথা বলছিলেন। সুরভিকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। সুরভিও তাকে সালাম দেয়। তিনি সালামের উওর দেবার পূর্বেই একটি মেয়ে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে, “সুরভি আপু, তোমাকে কত সুন্দর দেখাচ্ছে।”
মেয়েটা আরুহি। ক’দিন আগে এনগেজমেন্ট এর তার সাথে দেখা হয়েছিলো। খাতিরও জমেছিল বেশ। এখন সে বুঝতে পারছে হঠাৎ করে তার জন্য বিয়ের প্রস্তাবটা কী করে আসে। সবই আরুহির কেরামতি।
তার সামনে দাঁড়ানো বয়স্ক লোকটা শব্দ করে হেসে বললেন, “আমার মেয়ে তো বিগত ক’দিন থেকে তোমার কথাই বলছে মামনী। তোমার প্রশংসা থামছেই না। আমি তারপর তোমার খোঁজ করে দেখলাম। দেখি তুমি তো আমাদের আলমগীর সাহেবের মেয়ে। উনাকে কত বছর ধরে চিনি। উনার শিক্ষা কখনো খারাপ হতেই পারে না। আমার মনে হলো উনার ঘরের মেয়ে আমাদের বাসা আসবে এর থেকে বেশি সৌভাগ্য কি হতে পারে আমাদের।”
বাবা তখনই বলে উঠেন, “আরে আলাউদ্দিন ভাইসাব কি বলেন এসব! আপনার সুনাম কেবল আমাদের গ্রামেই না, আশেপাশের সব জায়গায়। এমনকি ঢাকাতেও। আপনার ছেলের প্রস্তাব আমার মেয়ের জন্য এসেছে এটা আমাদের সাত কপালের ভাগ্য। একারণেই তো এক দুই ভাবলাম না দুইজনের দেখা করানোর আগে।”
“আমরা এত কথা বলছি। আগে ছেলে মেয়েরা তো একে অপরকে দেখে নিক। আরুহি যেয়ে নিজের ভাইয়াকে ডেকে আনো।”
কথাটি শেষ না হতেই আরুহি দৌড় দিলো। সকলে আবার গল্প করতে শুরু করে। কিন্তু এদিকে তো সুরভীর অবস্থা খারাপ। হঠাৎ তার ভয় ভয় লাগতে শুরু করলো। মনে কেমন একটা অশান্তি হচ্ছিল। নার্ভাস লাগছিল। লজ্জা লাগছিল। হঠাৎ এমন হওয়ার কারণটা সে ঠিক ধরতে পারল না। সে চোখ নামিয়ে দেয়। অস্থিরতায় দুইহাতের আঙুল দিয়ে খেলতে শুরু করে।
সুরভী আজ পর্যন্ত কোনো সম্পর্কে জড়ায় নি। এমনকি কারও সাথে দু’ একটা প্রেমের কথাও বলে নি। প্রেমের অনেক প্রস্তাব পেয়েছিল সে। কিন্তু কারও দিকে ফিরেও তাকায় নি। সে সবসময়ই চেয়েছিল তার বাবা মা’য়ের পছন্দে বিয়ে করবে এবং এই জীবনে কেবল একজনকেই ভালোবাসবে। তার বিয়ে জিনিসটা তার জন্য অনেক বিশেষ। এই প্রথম বিয়ে উপলক্ষে কোনো ছেলের সাথে দেখা করবে সে। তার হৃদস্পন্দন কেমন দ্রুত দৌড়াচ্ছে। সে শুনল আরুহি বলল, “বাবা দেখো আহনাফ ভাইকে নিয়ে এসেছি।”
আহনাফ…
তাহলে ছেলেটার নাম আহনাফ। সুরভির অস্থিরতা বাড়লো। তার আঙুলের খেলা আরও দ্রুত হলো। সে ভয়ে এক ঢোক গিলে।
আরুহির কন্ঠ শুনতে পায় সে, “আপু দেখো, উনি আমার আহনাফ ভাইয়া।”
সুরভি লজ্জামাখা দৃষ্টি তুলে তাকায়। তার দৃষ্টিতে যেমন লজ্জা, তেমন অস্থিরতা। কিন্তু চোখ তুলে তাকাতেই মুহূর্তে তার সকল স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। নিরাশা ঘিরে ধরে তাকে। পুরুষটিকে একটু আগে দেখেছিল সে। তার সাথে ধাক্কা খেয়েছিল। তার ফোনের ছবি দেখেছিলো। অন্য মেয়ের সাথে। ছবিতে সে অন্যমেয়ের কপালে চুমু খাচ্ছিল। সে কী ভুল দেখেছিল? ছবিটা সত্য হলে কেন সে সুরভির সাথে দেখা করতে রাজি হলো। হাজারো প্রশ্ন যখন সুরভির মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো তখনই আলাউদ্দিন বলে উঠলেন, “আহনাফ এদিকে তো আমরা কথা বলছি। তুই ও সুরভি একটু ওদিকে কথা বলে আসো। একে অপরের সাথে পরিচিত হও। দুইজন রাজি থাকলে আমরা বিয়ের কথা আগাব।”
.
.
ইনারা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সভ্যের দিকে। সন্ধ্যাতেই সে এসে হাজির। তার আসার পরপরই ইনারা জানতে পারে আজ হাসনা রাতের রান্না করে যায় নি। কারণ সভ্য তাকে বলেছিল আজ রাতের রান্না ইনারা করবে।
সভ্য সোফায় বসে ফাইলে কিছু কাজ করছিল। ফাইল থেকে চোখ না তুলেই সে বলে উঠলো, “আমি জানি আমি অনেক হ্যান্ডসাম তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হবে না।”
“রসিকতা করছেন? হাসা লাগবে? আপনি হাসনা আপুকে বলেছিলেন যেন আজ রাতের রান্না না করে।”
“হ্যাঁ।”
“কোন দুঃখে?”
“আহা তুমি ঘরের নতুন বউ তোমার একটা শখ আছে না নিজের স্বামীর জন্য রান্নাবান্না করবে। তাকে ভালোমন্দ খাওয়াবে।”
“না, আমি এমন ফালতু শখ রাখি না। আর কে বউ? আমি কারও বউ না। আমাদের কন্টাক্টে বিয়ে হয়েছে রিমেম্বার? আর আপনি নিউজপেপারে ছবি দিতে এখনো বলেন নি কেন?”
সভ্য এবার তাকায় ইনারার দিকে। বাঁকা হেসে উঠে দাঁড়ায়। ইনারার দিকে এগিয়ে এসে সে বলে, “আমার তো মনে আছে কিন্তু তুমি যেভাবে অধিকার জমাচ্ছো এতে তো আমার অন্যকিছুই মনে হচ্ছে।”
“আর কী মনে হচ্ছে জনাবের?”
“যে তুমি আমার উপর অধিকার জমিয়ে এটা মনে করাতে চাইছ যে আমি তোমার স্বামী।”
“ওহ প্লিজ স্বপ্ন দেখা বন্ধ করুন। না আমি আপনাকে আমার স্বামী স্বীকার করি, আর না এই বিয়েকে। আর আমাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর মতো কোনো সম্পর্ক আছে না’কি? আজব যত্তসব কথাবার্তা। ” বলে ইনারা চলে যেতে নিতেই সভ্য তার ধরে টান দেয়। ইনারা কাছে আসতেই তার কোমরে হাত রেখে আরও কাছে টেনে নেয়।
ইনারা হতভম্ব। চকিতে তাকায় সে সভ্যের দিকে, “কী করছেন?”
“তুমিই তো বললে স্বামী স্ত্রীর মতো কোনো সম্পর্ক নেই। তাই তৈরী করছি।”
“আপনি অসভ্যতা করছেন।”
“তোমার জন্য তো আমি সবসময় অসভ্য নতুন কি?”
ইনারা নাড়াচাড়া করতেই সভ্য তাকে আরও কাছে টেনে নেয়। কাছে আসতেই সভ্যের চোখে চোখ পড়ে। স্তব্ধ হয়ে যায় সে। এত বছর পর আজ আবার তার হৃদয়ের স্পন্দন দিশেহারা হয়। নিশ্বাস হয় বেগতিক। তার ভেতরটা দুর্বল হয়ে পড়ে।
সভ্য ইনারার সাথে কেবল মজা নিচ্ছিল এতক্ষণ। কিন্তু আকস্মিকভাবে তাকে একটু বেশিই কাছে টেনে নেয়। এতটুকুও ঠিক ছিলো। কিন্তু ইনারার লজ্জামাখা চোখদুটো তার জন্য নেশার মতো কাজ করে। তার চোখদুটো এমনিতেই নীল সমুদ্রের মতো গভীর। এর উপর তার চোখের লজ্জার মায়া এই হৃদয়কে সামলানোটা মুশকিল করে দেয়। মেয়েটা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর মৃদুস্বরে বলে, “আ..আপনি ঠিক কর..করছেন না।”
তার কন্ঠটা সভ্যের হৃদয়ের অবস্থা আরও বেহাল করে দেয়। সে ইনারার চুলে হাত দিয়ে মুহূর্তে তার খোঁপা খুলে দেয়। মুহূর্তে ঝরে পড়ে তার সোনালী চুলগুলো। বাতাসে তার চুলগুলো এলোমেলো হয়ে যায়। ইনারার এই অবাধ্য কেশ তাকে মাতাল করার জন্য যথেষ্ট। সে ইনারার দিকে ঝুঁকে তার গালে নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া বসাতেই ইনারা চোখ বন্ধ করে নেয়। কেঁপে উঠে সে।সভ্যের শার্ট হাতের মুঠোয় আঁকড়ে ধরে। ইনারার কানের কাছে ঠোঁট আনে। তাকে পুরনো এক কথা মনে করায়, “তুমি জানো তোমার চোখজোড়া সায়রের মতো। যে কাওকে মুহূর্তে ডুবাতে বা ভাসাতে পারে।”
চলবে…
[দয়া করে ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন।]