অনুভবে পর্ব-৪+৫

0
463

অনুভবে
পর্ব-৪
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

আজকেই নিজের শান্তিকে বিদায় জানিয়ে রেখো। সভ্যের সাথে বেয়াদবি করে কেউ এত সহজে ছাড় পায় না। আর তা খুব জলদিই বুঝে যাবে।”
ইনারা সভ্যের বুকে হাত রেখে তাকে ঠেলে পিছিয়ে বলে, “আপনি আমাকে অন্যকেউ মনে করছেন।”
“তাই বুঝি? আমার তো মনে হলো তোমার চেহেরা, কন্ঠ, চুল, কথা বলার ধরন সব মেয়েটার সাথে মিলে। সে ছাড়া আজ পর্যন্ত কেউ আমার মুখের উপর এত খারাপ কথা বলার সাহস পায় নি। কেবল মেয়েটা আর তুমি ছাড়া। আর সে কী শব্দ ছিলো যেন? অসভ্য। এটাও কী কাকতালীয়ভাবে মিলেছে?”
“মিলতেই পারে।”
বাঁকা হাসে সভ্য, “আগামীকাল সকাল সাতটার দিকে। নাউ গেট লস্ট।”
ইনারা ভেংচি কেটে ফিরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল, “অসভ্য একটা। কথা বলার ধরনও শিখে নাই।”
“আমি এখনো এখানেই আছি।”
ইনারা এক দৌড় দিয়ে পালালো এবার। সভ্য বিরক্তির নিশ্বাস ফেলে বলে, “পাগল একটা।”
.
.
“শালা তোর ভাইয়ের উপর পুলিশ কেস করা দরকার। সে আমাকে জানাবে না জোহান ট্রাভেলিং এর জন্য বাংলাদেশের বাহিরে গেছে। পনেরোদিন পর আসবে। আমিও তাহলে তখন জয়েন করতাম।” ইনারা রাগে ফোঁপাতে ফোপাঁতে ঘরে আসে। রুমে ঢুকতে না ঢুকতেই সুরভিকে কল করে বকা দেওয়া শুরু করে। অফিসের কিছু ফর্মালিটি পূরণ করার সময় সে জানতে পারে জোহান বাংলাদেশে নেই। প্যারিসে গেছে সে। এখানেই তার মেজাজ বিগড়ে গেল।

সুরভি বলে, “ভাইয়াও জানতো না ওর যাবার খবর। এছাড়া তোর জন্য কী চাকরিটা বসে থাকতো? তুই আজ না গেলে হয়তো অন্যকেউ পেয়ে যেত তারপর? ভাই তুই কত লাকি আমি তাই ভাবি, মানুষ বছরের পর বছর চাকরি খুঁজে পায় না আর তুই চাওয়ার আগে পেয়ে গেলি।”
“ভাবতে গেলে তোর কথাটা ভুল না।”
“কোনটা? অন্যকেউ চাকরি পেয়ে যেত তা, না’কি লাকি এটা?”
“দুটোই। কিন্তু সম্ভবত অসভ্য আমাকে চিনেছে। জীবন হারাম করার কথা বলছিলো।”
আঁতকে উঠে সুরভী, “বলিস কী? তাহলে এখন?”
“তাহলে আর কি? সেও ইনারাকে চিনে না। তাকেই আঙুলের ইশারায় নাচাবো। কার সাথে পাঙ্গা নিচ্ছে বুঝতে পারছে না। কিন্তু আমি বুঝি না ওই অসভ্যের পিছনে সবাই এত পাগল কেন? যেখানেই যাই সকলে ওই অসভ্যেরই গুণগান গায়।”
“প্রথমত ওর নাম সভ্য। আর গুণগান গাওয়ার কারণ হলো সে সবার থেকে আলাদা। আসল জীবনে যেমন মিডিয়াতেও তেমনই থাকে। অন্যান্য সেলিব্রিটির মতো ক্যামেরার সামনে একদম অন্যমানুষ হয়ে যায় না। আর তার গানের কন্ঠ সবচেয়ে বেস্ট। আর হায় তার লুক, এত হ্যান্ডসাম। দেশের বাহিরেও মেয়েরা পাগল ওর জন্য।”

সভ্যের এত প্রশংসা শুনে ইনারা জোহানকে পিছিয়ে রাখে কীভাবে? সে-ও বলে, “এইসব ছাগলগিরি। আমার জোহানের মতো কেউ হ্যান্ডসাম না। ফর্সা, লালচে চুল, হাইট ৫ ফিট ৮ ইঞ্চি, চেহেরা মাশাল্লাহ আর ব্যক্তিত্ব সুবহানাল্লাহ। ওই অসভ্যের মতো না। আর কীসের এত হ্যান্ডসাম? দেখা যায় ব্যাঙের মতো।”
“তোর জোহান থেকে সবাই ওকে বেশি পছন্দের বলেই তো তোর সহ্য হয় না। তুই আমাকে জোহানের বর্ণনা যেহেতু দিয়েছিস সেহেতু আমিও সভ্যের বর্ণনা দেই। সভ্যের উচ্চতা ৫ ফিট দশ, রঙ ফর্সা এবং শ্যামলার মাঝারে, সুকাঠামো দেহ, চাপ দাঁড়ি আছে যা তার উপর অসম্ভব ভালো দেখায় এবং চেহেরার কথা বললে এশিয়ার সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ফেসের মধ্যে তার নামও আসে। আর কিছু বলতে চাস?”
“তুই ওই অসভ্যের জন্য আমার সাথে তর্ক করছিস কেন?”
“কারণ তোর যেমন জোহান ফেভারিট তেমন আমার এবং প্রিয়র সভ্য ফেভারিট। তোর ওকে পছন্দ না বলে আজেবাজে বকবি না-কি? আচ্ছা ভালো কথা, ভাইয়া তো আমাদের সভ্যের সাথে পরিচয় করাবে না। তুই করিয়ে দে না প্লিজ।”
“ওই অসভ্যের জন্য আমার সাথে তর্কাতর্কি করে আইসোস দেখা করাতে বলতে। শালী জাহান্নামের চৌরাস্তায় যেয়ে মর।”
ইনারা কল কেটে যায় পঞ্চসুরের গান ছাড়ে। স্ক্রিনে জোহানকে দেখতেই সে বলে, “জোহান তুমি চিন্তা করো না। যে যাই বলুক না কেন আমার জন্য তুমিই সবচেয়ে বেস্ট। আমি তোমাকে এত্তগুলো ভালোবাসি।” পরক্ষণেই স্ক্রিনে আসে সভ্য। তাকে দেখেই মুখ বানায় ইনারা। মিনমিন করে বলে, “ফাজিল, বেয়াদব, দানব, কথা বললে মনে হয় যেন মুখ দিয়ে মরিচ ঝরে, তাও কেন যে সবাই তাকে এত ভালোবাসে!”

“ও প্রেমবিলাসী শুনো তো হৃদয়ের কথা,
তুমি তুমি তুমিতে আমি হই দিশেহারা…”

হঠাৎ ইনারার ঠোঁটের কোণে হাসি এঁকে উঠে সভ্যের গলায় এই পঙক্তি শুনে। সে বলে, “আচরণ হোক ঝাল মরিচের মতন, তবে এটা সত্যি তার কন্ঠ মধুর মতো। তার কন্ঠে যে অন্যরকম এক জাদু আছে সে কথা অস্বীকার করা যায় না।”
.
.
সকাল সাড়ে সাতটা বাজে। খালাজান ইনারাকে গত দেড় ঘন্টা ধরে উঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। সে উঠে নি। সবে হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে তার সকল তাড়াহুড়ো। সে দ্রুত তৈরি হয়ে না খেয়েই দৌড়ে বেরিয়ে যায়। খালাজান খুব ডাকে তাকে কিন্তু তার সময় থাকে না। সে যাবার আগে কেবল খালাজানের গাল টেনে বলে, “খালাজান খেতে বসলে দেরি হয়ে যাবে আর জলদি না গেলে এক রাক্ষস আমাকে কাঁচা গিলে খাবে। আমি বাহির থেকে কিছু খেয়ে নিব।” বলেই সে খালাজানের গালে চুমু খেয়ে দৌড়ে যায়।

সভ্যের দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছে গাড়ি ফেরত পাঠিয়ে দেয় ইনারা। সে সব সময় এমনই করে এসেছে। তার আসল পরিচয় কাওকে জানানো মানা। মুশতাক কড়া ভাবে আদেশ দিয়েছে। অবশ্য এতে কোনো আপত্তি নেই ইনারার। সে আরও খুশি এমন সাধারণ মেয়েদের মতো জীবনযাত্রা করে। অভিনেত্রী সাইয়ারা এবং পরিচালক মুশতাকের মেয়েকে কেউ সাধারণ জীবন যাপন করতে দিবে না। যে চাইলেই সেভাবে বাঁচতে পারতো না যেভাবে আজ কেবল সাধারণ ঘরের ইনারা হয়ে বাঁচছে। আর সেভাবে বাঁচতে গেলে অনেক মিথ্যে মানুষকে ঘিরে হতো তার জীবন। যারা কেবল তার টাকা এবং খ্যাতির পিছনে ছুটে বেড়াত। তখন কীভাবে প্রিয় এবং সুরভীর মতো ভালো এবং সৎ বন্ধু পেত সে?

পনেরো মঞ্চিলের এপার্টমেন্ট। সাইদের দেওয়া কার্ড দেখানোর পর দারোয়ান তাকে ঢুকতে দেয়। দ্বিতীয়তলাতেই জিম। সে ভেতরে ঢোকার পূর্বে নিজেকে সাহস দেয়। নিশ্চিত সে সভ্যের কাছ থেকে বকা খাবে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতরে ঢুকে দেখে ব্যায়াম করছে। কানে হেডফোন। ঘামে ভেজা সম্পূর্ণ। তাকে এভাবে দেখে গতকালের সুরভীর কথা মনে পড়ে। আগে কখনো সভ্যকে যাচাই করে সে দেখেনি। সুরভি যেভাবে বলেছিলো তা মনে করে যাচাই করতে থাকে তাকে। খানিকটা আকর্ষিত হয় সে। বিড়বিড় করে বলে, “মিথ্যে নয়, দেখতে তো আসলেই হ্যান্ডসাম।” পরক্ষণে সে নিজের মাথায় টোকা মেরে বলল, “ছিঃ ইনারা! তুই জোহানের শত্রুর উপর কীভাবে আকর্ষিত হতে পারিস। জোহানের শত্রু মানে তোরও শত্রু।”

কিছু শব্দ শুনে সভ্য মুখ তুলে তাকায়। ইনারাকে দেখে নিজে উঠে দাঁড়ায়, “এটা তোমার সাড়ে ছয়টা?”
“আপনি তো এখনো ব্যায়াম করছেন। আমি এত তাড়াতাড়ি এসে কী করতাম?”
“অতিরিক্ত কথা বলো। আজ তোমার কারণে আধাঘন্টা বেশি করতে হয়েছে, নাহলে আমাদের এপার্টমেন্টে সোজা দশটায় ঢুকতে পারতে। এতক্ষণ বাহিরে বসে থাকতে হতো। এখন ওই ব্যাগ তুলে আমার পিছনে আসো।”
ইনারা খানিকটা প্রভাবিত হয় সভ্যের কথায়। তার কষ্ট হবে বলে সে অপেক্ষা করেছে শুনে মনে হলো লোকটা এতটাও খারাপ না। কিন্তু ব্যাগটা উঠাতেই সে ধারণাও ভুল মনে হলো।
“এটা তো অনেক ভারী। আপনি একটা মেয়েকে এত ভারী ব্যাগ কীভাবে উঠাতে বলেন?”
সভ্য ইনারাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখে, “দেখে তো মনে হয় না তুমি মেয়ে। চুপচাপ নিয়ে আসো। এমনিতেই তোমার জন্য আমার রুটিন বিগড়ে গেছে।”
ইনারার মেজাজ খারাপ হয় খুব। সে বকতে বকতে তার পিছনে যায়।

এপার্টমেন্টে ঢুকে দুইজনে সোজা যায় সভ্যের রুমে। সভ্য কোনো কথা না বলেই ওয়াশরুমে ঢুকে যায় আর ইনারা তার ব্যাগ মেঝেতে রেখে বলে, “অসভ্যটার জন্য আমার কোমর ভেঙে গেল। ব্যাগের মধ্যে কী মানুষ নিয়ে ঘুরে না-কি এত ভারী কেন?”
ইনারা রুমে চোখ বুলায়। ধূসর এবং সাদা রঙের মিশ্রণে সম্পূর্ণ কক্ষ সাজানো। কক্ষটা ধূসর রঙের এবং আসবাবপত্র বেশিরভাগই সাদা। সাদা হওয়া সত্ত্বেও এক ফোঁটা ময়লাও দেখা যাচ্ছে না। সব চকচকে। এত পরিষ্কার রুম দেখেই ইনারার কেমন যেন লাগে। তার মনে পড়ে নিজের রুমের কথা। খালাজান সারাক্ষণ তার কক্ষ পরিষ্কার করে এবং সে রুমে ঢোকার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই সব ওলট-পালট করে দেয়। সে কোনো সময় নিজের কক্ষ পাঁচ মিনিটের বেশি পরিষ্কার দেখে নি। তার পরিষ্কার রুম সহ্যই হয় না।

ইনারা কক্ষটা ঘুরে দেখতে থাকে। বিছানার পাশে কতগুলো গিটার। বিভিন্ন রঙের। সে কৌতুহল নিয়ে সম্পূর্ণ রুমে ঘুরে দেখতে শুরু করে। দেয়ালো লাগানো একটি সেল্ফ-এ কতগুলো বই, ডায়েরি এবং ফটোফ্রেম। ছবিগুলো কেবল পঞ্চসুরের সদস্যদের সাথে। বেশিরভাগ ছবিতেই কেবল সভ্য, ইরফান, ঐশি এবং সামি। জোহানের তেমন কোনো ছবি নেই। কেবল একটি ছাড়া। সে ছবিতে পাঁচজনই আছে। ছবিটা পুরনো মনে হচ্ছে। ছবিতে একটি সোফায় বসা ইরফান, সভ্য এবং জোহান। জোহান প্রায় সভ্যের উপর আধশোয়া হয়ে বসে আছে এবং মেঝেতে সামি, ঐশি বসা। সকলে কোনো কথায় খুব হাসছে। কেবল সভ্যের হাসি তেমন গাঢ় না। সে ক্যামেরার দিকে মৃদু হাসি নিয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু সেল্ফের অন্য কোনো ছবিতেই সভ্যের হাসি নেই বললেই চলে। এমনকি তাকে এত বছরে কোনো গানের ভিডিও, ইন্টারভিউ কোথাও হাসতে দেখে নি সে। কিন্তু এই ছবি দেখে মনে হচ্ছে জোহান এবং সভ্য খুব ভালো বন্ধু। এত ভালো বন্ধু হলে হঠাৎ করে কী হলো তাদের মাঝে?

দরজা খোলার শব্দ শুনতেই সে ফ্রেমটা সেল্ফে রেখে দিলো। সভ্য গোসল করে বেরিয়ে আসে। তার পরা কালো গেঞ্জি এবং টাউজার। সে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বলে, “টেবিলের নোটপ্যাডে আজকে সিডিউল লেখা। আগামীকাল থেকে এটা তোমার কাজ। আর সকলের নাম্বার রেখে দিবে। কল করে সবাইকে মনে করানো দায়িত্ব তোমার। আর তুমি সবসময় আমার সাথে থাকবে।”
“কেন?” আঁতকে উঠে ইনারা।
সভ্যের কপাল কুঁচকে গেল। সে ইনারার দিকে তাকায়, “কেন মানে? আমি টিম লিডার। তাই সব দায়িত্ব আমার থাকে। আর আমার নিয়ন্ত্রণেই দলের সকল কাজ হয়। তাই স্বাভাবিকভাবেই আমার সাথেই তোমার থাকতে হবে।”
ইনারা চোখেমুখে সাথে সাথে উদাসীনতা ছড়িয়ে গেল। সে কাঁদোকাঁদো গলায় বাচ্চাদের মতো করে বলে, “আমার ভাগ্যের উপর এমন ঠাডা পরসে কেন?”
“ঠাট্টা আবার কী?”
“ঠাট্টা না তো, ঠাডা। ঠাডা চিনেন না? মানে বজ্রপাত। আঞ্চলিক ভাষা। আমার এক বন্ধুর থেকে শিখলাম। আমার ফেভারিট শব্দ। জীবনে যখন অনেক খারাপ কিছু হয় তখন কারণ আমার জীবনে খালি ঠাডাই পরে। জীবনটাই ঠাডাময়।”
“অতিরিক্ত কথা বলো তুমি।” বিরক্ত হয় সভ্য।
“তো একটু কথা শুনলে কী আপনার হাইট কমে যাবে?”
“কমলেও তোমার থেকে তো লম্বা থাকবো।”
“আপনি একটু মিষ্টিভাবে কথা বলতে পারেন না?”
“তোমার সাথে? না।”
“কেন আমাকে দেখলে কী আপনার মরিচ লাগে?”ইনারা সভ্যের সামনে সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল।
“এই মেয়ে আমার সাথে এসব আজেবাজে ভাষা ব্যবহার করবে না।”
“একশোবার করবো। কী করবেন আপনি?”
“চাকরি থেকে বের করে দিব।”
মুহূর্তে ইনারার কন্ঠস্বরের পরবর্তন ঘটে। সে মৃদুস্বরে বলে, “জ্বি স্যার, আপনি যেমন বলবেন তেমনই হবে।”

সভ্য বিরক্ত হয়। কিন্তু সাথে তার হাসিও পায়। তবে তা প্রকাশ করে না। আয়নার সামনে যেয়ে নিজের চুল ঠিক করতে থাকে সে। এমতো সময় ইনারা বলে, “একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করি?”
“না।”
“আচ্ছা জিজ্ঞেস করেই ফেলি। ছবি দেখে মনে হলো আপনি এবং জোহান অনেক ভালো বন্ধু। তাহলে এখন আপনাদের মাঝে এত সমস্যা কেন?”
সভ্য থমকে যায়। সে কিছু মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ থেকে তাকায় ইনারার দিকে। তার দৃষ্টি ক্রোধিত। চোয়াল শক্ত। সে এগিয়ে এসে দাঁড়ায় ইনারার সামনে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “কাজের জন্য এসেছ, কাজ করো। অতিরিক্ত গভীরে যাবার চেষ্টা করলে নিজেই এই খালে ডুবে যাবে।”
ইনারা মুখ ফুলিয়ে নেয় বাচ্চাদের মতো, “আপনি কেবল ধমক দিয়েই ভয় পাওয়াতে পারেন। এখন বলবেন চাকরি থেকে বের করে দিব।”

ইনারার বুঝে উঠার পূর্বেই সভ্য তার হাত ধরে এক হ্যাঁচকা টানে নিজের কাছে টেনে আনে। চোখে চোখ রাখে। কী ভয়ানক দৃষ্টি! ইনারা বোধহয় জীবনে এই প্রথম এত ভয় পেল কারও কাছ থেকে। সাথে এই প্রথম কারও এতটা কাছে এসে নিজেকে ছাড়াতে পারলো না। কেমন শিউরে ওঠে তার হৃদয়খানি৷ তা কি ভয়ে?

সভ্যের চোখজোড়া কৃষ্ণকালো। পলকগুলো কী ঘন! তার চক্ষুজোড়া দেখে মনে হয় হাল্কা সুরমামাখা। অথচ তা প্রাকৃতিক। ইনারা খানিকটা বিরক্তবোধ করল। একটি পুরুষের চক্ষু এত সুন্দর থাকবে কেন?

সভ্য তার সাথে নয়নবন্ধন করে রেখেই বলে, “আমি চাকরি থেকে বের করা ছাড়াও আরও অনেককিছু করতে পারি। আমি নিশ্চিত তুমি তার অভিজ্ঞতা নিতে চাইবে না যার জন্য ভবিষ্যতে তোমার আফসোস করতে হয়।”

চলবে…..

অনুভবে
পর্ব-৫
নিলুফার ইয়াসমিন ঊষা

সভ্য তার সাথে নয়নবন্ধন করে রেখেই বলে, “আমি চাকরি থেকে বের করা ছাড়াও আরও অনেককিছু করতে পারি। আমি নিশ্চিত তুমি তার অভিজ্ঞতা নিতে চাইবে না যার জন্য ভবিষ্যতে তোমার আফসোস করতে হয়।”

সভ্য ভাবে এতটুকুতেই ইনারা ভয় পেয়ে যাবে। আর কোন কথা বলবে না। অথচ ইনারা তার চোখে চোখ রেখেই দিল গলায় বলল, “আমিও দেখতে চাই আপনি এমন কি করেন যার কারণে আমার আফসোস করতে হবে।”
সভ্য তার নির্ভীকতা দেখে হতদম্ব হয়ে যায়। তোর চোখ দুটো বিস্ময়ে বড় হয়ে আসে। কিন্তু তা সে মুখে বলে না। সোজা বেরিয়ে যায় কক্ষ থেকে।

ইনারাও নোটবুক নিয়ে দৌড়ে গেল সভ্যের পিছনে। সে গেল রান্নাঘরে। ওপেন এরিয়া থাকায় ইনারা ডাইনিং টেবিলে বসে নোটবুক চেক করতে থাকে। যেন এটা তার নিজেরই ঘর। এতগুলো কাজ দেখে সে থতমত খেয়ে যায়, “আমি বুঝেছিলাম আপনাদের কেবল রেকর্ডিং এবং স্যুট থাকে। কিন্তু এখানে দেখি আজকের দিনের কাজই এক পৃষ্ঠা ভর্তি।”
“সবে কনসার্ট শেষ হবার কারণে আমরা ফ্রী আছি। সাধারণত আরও বেশি হয়। বাই দ্যা ওয়ে, নাস্তা করেছ তো?”
“আপনি যে এত তাড়াতাড়ি ডাকলেন৷ করব কীভাবে?”
“টোস্ট অমলেট খাও?”
“আপনি বানাবেন?” ভ্রু কপালে তুলে বলে ইনারা।
“অন্য কিছু খেলেও বলতে পারো।”
“না ডিম ভাঁজি আর পাউরুটি ভাঁজাই চলবে।”
“ওটাকে টোস্ট বলে।”
“তো পাউরুটি ভাঁজে ই তো তাই না?”
“তোমার সাথে তর্ক করাটাই বৃথা।”

সভ্য নিজের কাজ শুরু করলো এবং ইনারা নোট ভালো মতো দেখতে থাকে। মাঝে একবার সে চোখ তুলে তাকায়। সভ্যের রান্নার কৌশল দেখে থমকে যায়। প্রফেশনাল সেফদের মতো রান্না করছিলো সে। অন্তত তার কাছে মনে হলো। দ্রুত এবং কৌশলগত ভাবে। চোখের পলকে এক কাজ শেষে অন্য কাজ শুরু করেছে। আর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে ইনারা। উঠে কুড়কুড় করে যেয়ে সভ্যের পাশে দাঁড়ায়। ভালো করে দেখতে থাকে সভ্যের রান্না করা। ইতিমধ্যে সে অবশ্য সভ্য যাচাই করল। তাকে আকর্ষণীয় দেখাচ্ছিলো। একটু বেশিই। এমন রাক্ষসকে তার কিভাবে আকর্ষণীয় লাগতে পারে? বুঝে উঠতে পারছে না সে।

সভ্য অমলেট করার মাঝখানে টোস্ট করার জন্য পাউরুটি আনার জন্য পিছনে ঘুরতেই ইনারার সাথে ধাক্কা লাগে। পরে যেতে নেয় ইনারা। সঠিক সময়েই সভ্য তাকে ধরে নেয় কোমর জড়িয়ে। ইনারা চোখ চেপে ধরে রেখেছে। সাথে সভ্যের গেঞ্জিও মুঠোয় বন্দী করেছে৷ যেন ভয় পেয়েছে সে৷ তার মাথায় হুডির ক্যাপ নিচে পরে তার স্বর্ণোজ্জ্বল কেশ খুলে যায়। সভ্য তীক্ষ্ণ হেসে বল, “যাক তাহলে তুমিও ভয় পাও।”
ইনারা প্রথমে এক চোখ খুলে নিশ্চিত হয় সে এখনো মেঝেতে পড়ে নি। তারপর মুখ ফুলিয়ে বলে, “কে বলল আমি ভয় পেয়েছি? আমি একদম ভয় পাই নি।”
“তাহলে আমাকে এভাবে ধরে রেখেছ কেন?”
ইনারা খেয়াল করে সে সভ্যের গেঞ্জি আঁকড়ে ধরে রেখেছে। সে তা ছেড়ে দিয়েই বলে, “আপনি আমাকে ধরেছেন বলে। আপনি আমাকে ধরেছেন কেন?”
“আচ্ছা যাও ছেড়ে দিলাম।”
বলেই সভ্য ইনারাকে ছেড়ে দেয়। সে মেঝেতে পড়তেই চিৎকার করে উঠে আর বলে, “হায় আমার কোমর ভেঙে গেল।”

সভ্য হাসি চাপা দিয়েই তার পাশ কাটিয়ে পাউরুটি নিয়ে টোস্টারে দিলো। ইনারা তা দেখে যেমন অবাক হয় তেমন রাগান্বিতও, “আপনি আসলেই অসভ্য। এভাবে আমাকে ছেড়ে দিতে আপনার একটুও মায়া লাগলো না?”
“না।”
“আই হেইট ইউ।”
“আর তোমার হেইটে আমার কী আসে যায়? কে বলেছিলো আমার পিছনে ভূতের মতো এসে দাঁড়িয়ে থাকতে?”
সে কান্নার ঢঙ করে উঠে দাঁড়ায়। একপাশে যেয়ে মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সভ্য কোনো কথা বলে না। কেবল নিজের কাজ করতে থাকে। ইনারার আবার কথা বলার রোগ আছে। কথা না বলতে পারলে তার ভালো লাগে না। তাই সে রাগ ভুকে নিজেই বলল, “আপনি এতকিছু একা খাবেন?”
“না, পাশের ফ্লাটে ইরফান এবং সামি থাকে। ওদের জন্য। সামির জন্য এভাকাডো টোস্ট এবং ইরফানের জন্য রুটি, ডিম।”
“বলেন কি?”
“আগে সবাই একসাথে থাকতাম। কিন্তু ওরা ঘর এলোমেলো করে রাখতো। আর আমার এলোমেলো কিছু পছন্দ না। ভুলেও আমার ঘরের এক জায়গায় রাখা জিনিস অন্য জায়গায় রাখবে না।”
ইনারা জোরপূর্বক হাসে। বিড়বিড় করে বলে, “আমার দ্বারা এটা অসম্ভব।”
মুখে আবারও জিজ্ঞেস করে, “আপনি এত ভালো রান্না কোথা থেকে শিখলেন?”
“সবাই-ই এসব পারে। বিশেষ কিছু না।”
“আমি তো চুলাও জ্বালাতে পারি না।”
কথাটায় সভ্যের কপাল কুঁচকে যায়। সে ইনারার দিকে তাকিয়ে বলল, “তাহলে সব রান্না কে করে?”
“খালাজান। সে আমাকে ছোট বেলা থেকে পেলে বড় করেছে।”
“আপন খালা?”
“না, আপন খালা না। কিন্তু এর থেকে বেশি। আগে আমার মা’য়ের জন্য কাজ করতো। এরপর আমাকে বড় করেছে।”
“সাইদ বলল তুমি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তোমাদের অনেক অভাব তাই চাকরির জন্য এসেছ। তাহলে তোমার পরিবার তোমাকে অন্যকাওকে দিয়ে লালন-পালন করা কীভাবে এফোর্ড করতে পারলো?”
প্রশ্নটার জন্য প্রস্তুত ছিলো না ইনারা। সাইদ যেহেতু আইজাকে ভালো করে চিনে সেহেতু সে তার পরিবারের ব্যাপারে জানে। আইজার কথা আজ পর্যন্ত সে-ও কাওকে সত্যিটা বলে নি। সাইদ যে সবাইকে এমন গল্প শোনাবে তা তাকে প্রথমেই বলা হয়েছিলো। কথা বলার মাঝে সভ্য এত ক্ষুদ্র ব্যাপার নিয়েও মাথা ঘামাবে সে ভাবে নি। এ কোন বিপদে পড়ে গেল সে?

ইনারা আমতা-আমতা করে বলে, “অবস্থা আগে এত খারাপ ছিলো না আরকি। আর খালাজান আমাদের পরিবারের মতোই।”
“আচ্ছা এখন তুমি টেবিলে যেয়ে বসো, আর বকবকানি কমাও। তোমার কথা শুনে শুনে আমাদের মাথা ব্যাথা হয়ে গেছে।”
ইনারা ভেংচি কাটে, “আর আপনার সাথে কথা বলার জন্য আমি তো মরে যাচ্ছি।” বলে সে চলে গেল।
“নাটকবাজ একটা।”

সভ্য সকালের নাস্তা দেবার পর ইনারা খুব মজা করেই খায়। খাবার ভীষণ ভালো লাগে তার কাছে। কিন্তু সভ্যের প্রশংসায় সে নারাজ। সে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা জোহানের সাথে আপনার বন্ধুত্ব ব্যাপার ছাড়া তাকে নিয়ে কোন প্রশ্ন করা যাবে?”
উত্তর দেয় না সভ্য। কিন্তু ইনারা ঠিকই প্রশ্ন করে, “জোহানের সাথে যে অভিনেত্রী দীপার সম্পর্ক আছে তা কী সত্যি?”
“সত্যি না হলে কি তোমার মনে হয় তোমার চান্স আছে?”
“থাকতেই পারে।”
“তুমি ওর টাইপের না।”
“আপনি যেন খুব জানেন।”
“জানি দেখেই বলছি।”
কথাটা শুনে খুব বিরক্ত হয় ইনারা, “আপনি চিন্তাভাবনা করে কথা বলতে পারেন না? টিভিতেও দেখি আপনার কথাগুলো এমন। নির্বিকারে বলা এসব কথাগুলো সে অন্যকে আঘাত করতে পারে তা বুঝেন না?”
“প্রশ্ন করেছ, সত্যি উওর দিলাম। তা কটু শোনা গেলে আমি কি করতে পারি? আমি মাধুরি মিশিয়ে কথা বলতে পারি না।”
ইনারা বিড়বিড় করে কতগুলো বকা দিলো সভ্যকে। তা ঠিকই শুনতে পায় সভ্য, “এমন ইঁদুরের মতো মিনমিনে কথা না বলে চুপচাপ খাও। মানুষ এত কথা কীভাবে বলতে পারে বুঝি না।”
“আপনি তো মানুষ না, রোবট।”
সভ্য এইবার আসলেই বিরক্ত হয়ে তাকায় ইনারার দিকে। চোখ রাঙিয়ে বলে, “তোমার কী আসলেই এই চাকরিটার প্রয়োজন আছে না-কি বলো তো।”
এই প্রশ্নটা শুনে ইনারা কথা বলা তো দূরের কথা সভ্যের দিকে আর তাকায়ও নি। চুপচাপ খেতে থাকে কেবল।

খাবার শেষে সভ্য রুমে যায় কোম্পানিতে রওনা দেবার উদ্দেশ্যে তৈরি হতে। তৈরি হয়ে এসে দেখে ইনারা সোফাতেই ঘুমিয়ে পরেছে। সভ্য ভালো করে দেখে ইনারাকে। কী শান্ত এবং নিসাড়! অথচ জেগে থাকলে কথা বলতে বলতে মাথা এলোমেলো করে দেয়। এখন কেমন গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে সে। সভ্য তার রুম থেকে একটি পাতলা কম্বল এনে ইনারার উপর দিলো। এই প্রক্রিয়ায় খুব কম সময়ের জন্য হলেও সে ইনারাকে খুব কাছের থেকে দেখতে পায়। তার ফর্সা গাল গোলাপি রঙের আভা ছড়িয়ে আছে। ঠোঁটজোড়া মিষ্টি গোলাপি রঙের। তার কেশবাহারে সোনালী রঙের এক আভা আছে। যা তার ফর্সা ত্বকের সাথে মিশে আরও সুন্দর দেখায়। তাকে মায়াবী দেখায়, কিন্তু তার মুখে আকর্ষণীয় ভাবটা কম। হয়তো গোলগাল মুখের কারণে তার মাঝে এখনো বাচ্চামো ভাবটা আছে এ-কারণেই। সভ্য হেসে বলে, “এখন কত নীরবে ঘুমুচ্ছে, জাগ্রত অবস্থায় শান্তি দেয় না। তবে আমিও কম নই। তোমার পাওয়া শাস্তি না পূরণ করে যেতে দিব না।”
সভ্য উঠে যেতে নিলেও আরেকটিবার তাকাল ইনারার দিকে। সোফার একটি বালিশ তার মাথার নিচে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

ইনারা নড়ে-চড়ে উঠে। এক মিষ্টি ধ্বনি বাজে তার কানে। ধীরে ধীরে পলক খুলে তাকায় সে। অপেক্ষা করতে করতে কখন যে তার চোখ লেগে আসলো সে বুঝতে পারে নি। এক কন্ঠ শুনে সে নিদ্রার দেশ থেকে বেরিয়ে আসে। আশেপাশে তাকায় সে। সে মুগ্ধময় কন্ঠের খোঁজে উঠে। সভ্যের কক্ষ থেকেই শব্দটা ভেসে আসছে। স্বাভাবিক। তার বাসায় অন্য কে এমন গান গাইবে? তবে তার গানের স্বর টিভি, রেডিও অথবা ইউটিউবের মতো লাগছে না। অন্যরকম লাগছে। আরও মধুর। আরও মুগ্ধতায় ভরা। সে হাওয়ায় মিশানো গীতের মাধুরি অনুসরণ করেছে সভ্যের কক্ষে। কক্ষের ওপারে এক বিশাল ব্যালকনি। পর্দা লাগানো থাকায় তা সকালে দেখে নি ইনারা। এত উপরে আশেপাশে আকাশ ছাড়া নেই। নীল আকাশে দোল খাওয়া মেঘ এই পরিবেশের মুগ্ধতা বাড়ায়। এত উপর থেকে এত সুন্দর দৃশ্য আগে দেখে নি ইনারা। সে মুগ্ধ হয়। এই মুগ্ধময় দৃশ্যের শোভা বাড়াচ্ছে সভ্যের গান,
“মেঘ সায়রে ভাসবো আবার তুমি আমি মিলে
স্বপ্ন তোমার রূপকথার
আমার স্বপ্ন তুমি
ও প্রিয়তমা, ও প্রিয়তমা তোমার স্বপ্নে বাঁচি আমি,
আমার হৃদমাঝারে কেবল তুমি…”

চলবে…..

[দয়া করে ভুল ক্রুটি ক্ষমা করবেন।]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে