অনিয়ন্ত্রিত মন পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0
953

#অনিয়ন্ত্রিত_মন
#jannat_Nur
#শেষ_পর্ব

মরিয়মের বাড়িতে একদিন থেকেই লুৎফর তার বাড়িতে চলে এসেছে। লুৎফর তার মায়ের সঙ্গে কথা বলার জন্য মায়ের রুমে আসলো। বৌমা কবে আসবে এ কথা জিজ্ঞেস করার সঙ্গে সঙ্গে লুৎফর বলল।

” মরিয়ম আর এখানে আসবে না সে তার সন্তানকে ছাড়া এ বাড়িতে থাকতে চাচ্ছেন না, এটা নিয়ে আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তুমি কি চাও আমার স্ত্রীকে নিয়ে এ বাড়িতে আমি না থাকি।

” তাহলে তুই এটাই বুঝাতে চাচ্ছিস মরিয়মের ছেলেকে নিয়ে যদি এই বাড়িতে থাকতে না দেই তুই এখানে থাকবি না, অন্য কোথাও চলে যাবি তোর স্ত্রীকে নিয়ে?

” হে আমার এটাই করতে হবে, কারণ তোমরা যখন মানবে না আমার তো আর কোন উপায় নেই।

” বাহ সুন্দর কথা বলেছিস, নিজের রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যাবি অন্যের সন্তানের জন্য। এটার জন্যই তোকে পেটে ধরেছিলাম।

” আমি বাবা হতে পারিনি বাবা হওয়ার জন্য আমার বুকে কতটা হাহাকার ছিল সে হাহাকারটা তোমরা বুঝবে না। ছেলেটাকে যদি আমি আমার সন্তানের মত মানুষ করি ছেলেটা আমাকে নিজের বাবা মনে করবে। এখানে তোমাদের সমস্যাটা কি? আমি ওই শিশুটাকে লালন পালন করলে আল্লাহ আমার ভালো করবে তোমরা যদি সাহায্য করো তোমাদেরও ভালো হবে। কিন্তু তোমরা তা না করে ছেলেটাকে মায়ের বুক থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাচ্ছো। তুমিও তো মা, মা হয়ে আরেকজন মায়ের সন্তানকে দূরে সরাতে বলতে তোমার খারাপ লাগে না।

” ঠিক আছে তুই যা ভালো মনে করিস তাই কর, মনে করব আজকে থেকে লুৎফর নামের আমার কোন ছেলে নেই। যা অন্যের ছেলেকে নিয়েই ভালো থাক। বউ পেয়েছিস এখন মা দিয়ে কি করবি মায়ের কোন দরকার নেই।

” তাহলে তুমি মরিয়মের ছেলেকে এই বাড়িতে মেনে নিবে না এটাই তোমার শেষ কথা?

” হ্যাঁ এটাই আমার শেষ কথা, আর তুই যে আমার ছেলে এটাও আমি আর কখনো মনে করব না।

লুৎফর আর কোন কথা না বলে বাড়ি থেকে সোজা চলে আসলো গাজীপুরে, এখান থেকে লুৎফর ব্যবসা পরিচালনা করে তাই তার ব্যবসা ক্ষেত্রের পাশেই বাসা ভাড়া ব্যবস্থা করল। পরের দিন চলে আসলো মরিয়মের বাড়িতে। এত তাড়াতাড়ি সব কিছু ব্যবস্থা করে লুৎফর চলে আসবে এটা ভাবতে পারিনি মরিয়ম। সে ভেবেছিল লুৎফর হয়তো তার কথা রাখবে না তার মায়ের ভয়ে। এবারও ভুল প্রমাণিত হলো মরিয়ম। লুৎফর বাড়িতে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। চিপস আইসক্রিম বিস্কিট অনেকগুলো খাবার নিয়ে এসেছে রাইয়ানের জন্য। বাবার কোলে গিয়ে অনেক খুশি রাইয়ান। লুৎফর ছেলের জন্য এত এত খাবার নিয়ে এসেছে এটা দেখে সায়মা অবাক হয়ে গেল। সায়মা ভাবছে সত্যি লুৎফর ছেলেটাকে তার নিজের ছেলে হিসাবে মেনে নিয়েছে। সায়মাকে দেখে মরিয়ম বলল, ভাবীবাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে এখান থেকে কিছু খাবার নিয়ে বাচ্চাদের দেন।

” মরিয়ম রাইয়ানের কি ভাগ্য দেখছো সে তার নিজের বাবার আদর পেল না আর যে তার বাবা না সে তাকে কত আদর করছে, কতগুলো খাবার কিনে নিয়ে এসেছে তার জন্য। তোমার ভাই ও তো কখনো এতগুলো খাবার কিনে নিয়ে আসেনি আমাদের বাচ্চার জন্য। দেখো তুমি তো বিয়ে করতে চাও নাই বিয়ে না হলে কি রাইয়ান এমন আদর পেত।

” হ্যাঁ ভাবী কথাটা ঠিক বলেছেন, আমি এই লোকটাকে বিয়ে করেছি বলেই আমার ছেলে এতগুলো খাবার চোখে দেখতে পারছে, সে বাবার আদর পাচ্ছে। ভাবী বিয়ে করার আগে কিভাবে বিশ্বাস করতাম বলেন! আমি তো ভেবেছিলাম দুনিয়ার সব লোক আকবরের মত আর আপনাদের মত। ভালো মানুষ আছে সেটা আমার বিশ্বাস হতে চাইনি।

” আমাদের মত? আমরা তোমাকে কি করেছি! তুমি তো বিয়ে করতে চাও নাই জোর করে বিয়ে দিলাম তাতেও আমাদের দোষ হল?

” না ভাবী বিয়ে দিয়ে দোষ করেন নাই এই যে বলছেন রাইয়ান বাবার আদর পাচ্ছে, এতগুলো খাবার রাইয়ানকে তার বাবা এনে দিয়েছে এটা দেখে হয়তো আপনার এখন আফসোস হচ্ছে। কিন্তু আপনারা নিজের লোক ছিলেন কখনো কি আমার ছেলেকে আদর করেছিলেন? বাবা নেই এটা মনে করে আমার ছেলের প্রতি কোন সহানুভূতি দেখিয়েছেন? আপনাদেরকে বাদ দিলাম আপনারা আমার রক্তের না কিন্তু আমার রক্তের ভাই তারাও তো আমার সন্তানের প্রতি অবহেলা করেছে। নিজের সন্তানদের জন্য নতুন নতুন জামা কাপড় কিনে নিয়ে এসেছে আর আমার ছেলের জন্য ঈদ ব্যতীত কোন নতুন কাপড় কেনা হয় নাই। আপনাদের ছেলের পুরাতন শার্ট প্যান্ট পরে আমার ছেলে বড় হচ্ছে। ভালো কোন খাবার খেতে পারেনি আমার ছেলেটা, আপনাদের বাচ্চাদের জন্য খাবার নিয়ে আসলে রুমে বসিয়ে খাওয়াতেন। কখনো ভাবতেন না মরিয়মের ছেলেটার হাতে সামান্য পরিমাণ খাবার তুলে দেই। আপনারা পরিবারের মানুষ হয়ে আমার অবুঝ সন্তানের সঙ্গে নির্দয়ের মতো ব্যবহার করেছেন, সেখানে অন্য একটা মানুষ আমার ছেলেকে কিভাবে সন্তান হিসেবে মেনে নেবে এটাই আমি চিন্তা করতাম। আল্লাহ আমার সহায় আছে তাই হয়তো লুৎফর সাহেবের মতো ভালো মনের একজন মানুষ পেয়েছি।

মরিয়মের কথা শুনে সায়মার জবাব দেওয়ার মতো ভাষা ছিল না, সে তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হয়ে গেল। আড়াল থেকে কথাগুলো পপি শুনলো, সে নিজেও মরিয়মের সন্তানের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিল তাই সে আর কিছু বলতে পারল না মরিয়মের কথার জবাবে। মরিয়মের মা খুব খুশি হলো এই কথাগুলো তিনি তার ছেলের বউদের বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু বলার সাহস পাচ্ছিলেন না।

লুৎফর মরিয়মকে নিয়ে শহরে চলে আসলো, এখানে এসে মরিয়ম তার সন্তানকে নিয়ে দুঃখের সঙ্গে অনেক ভালো আছে। মরিয়মের স্বপ্ন আজকে সত্যি হতে চলেছে, সে যেমন সংসার চেয়েছিল তেমন সংসার তাকে দিতে পেরেছে লুৎফর। মরিয়ম উপলব্ধি করে রাইয়ানকে লুৎফর অনেক বেশি ভালোবাসে। একজন পিতা তার সন্তানকে যতটা ভালোবাসতো, সে ভালোবাসাটাই লুৎফর রাইয়ানকে দিচ্ছে। মরিয়মের জীবনে আর কোন চাওয়ার নেই সে অনেক খুশি।

কাউকে কাঁদিয়ে কষ্ট দিয়ে কখনো কেউ সুখী হতে পারে না, সেটার শাস্তি দেরিতে হলেও পেতে হয়। সেই শাস্তিটাই পাচ্ছে আকবর আলী। শান্তাকে বিয়ে করার পাঁচ বছরেও তাদের সংসারে বাচ্চা হয়নি, অনেক চিকিৎসা করিয়েছে কিন্তু বাচ্চা হচ্ছে না। এই কারণে শান্তা সবসময় আকবর আলীকে দোষারোপ করে আসছে। ঘর জামাই থেকে আকবর আলী বুঝতে পেরেছে তার কোন মূল্যই নেই শান্তার পরিবারে। শান্ত তাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে চলে, তার কথার কোন মূল্য দেয় না। আকবর কিছু বলতে গেলে শান্তা ধমকের সুরে বলে, তুমি চুপ করো ঘরজামাই থেকে বড় বড় কথা বলতে এসো না। আকবর অনেকবার ভেবেছে শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসবে, কিন্তু শান্তা তার বাবার বাড়ি থেকে চলে আসবে না। আকবর চলে আসতে চাইলে সন্তান তাকে শাসিয়ে বলে দেনমোহরের ৫০ লাখ টাকা আর আমার বাবা চাকরি নিয়ে দিয়েছিল ১২ লাখ টাকা, সব টাকাগুলো দিয়ে তারপর তুমি চলে যাও। আকবর জানে এতগুলো টাকা সে যোগাড় করে তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে পারবে না, তাই তার বাধ্য হয়ে অবহেলা অনাদর সহ্য করে শান্তার বাড়িতে থাকতে হচ্ছে। শান্ত তার ইচ্ছামত উশৃংখল জীবন যাপন করছে, আকবর কিছু বলার সাহস পায় না। আকবর এখন উপলব্ধি করে এটা তার পাপের শাস্তি। মরিয়মের সঙ্গে এবং নিষ্পাপ শিশুটির সঙ্গে যে অন্যায় সে করেছে সে শাস্তি হয়তো আল্লাহ তাকে দিচ্ছে। তাই তাকে বাবা হওয়ার সৌভাগ্য আর দিচ্ছে না। আকবর এখন অনুশোচনা করে চোখের জল ফেলে, কিন্তু চোখের জল ফেলে এখন আর কোন লাভ নেই। আকবর জানতে পেরেছে মরিয়ম বিয়ে করে অনেক সুখে আছে। এটা শুনে এখন তার আফসোস লাগে, কেন সে শান্তার পাল্লায় পড়ে এত ভালো একজন স্ত্রীকে জীবন থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।

মরিয়ম প্রেগন্যান্ট হয়েছে, লুৎফরের চাওয়া এবার তাদের কন্যা সন্তান হোক। লুৎফর মরিয়মকে বলে আমাদের তো একটা পুত্র সন্তান রয়েছে আর একটা কন্যা সন্তান হলেই যথেষ্ট, দুটি সন্তানকে আমরা ভালোভাবে মানুষ করব। খুশিতে মরিয়মের চোখের পানি চলে আসে, মরিয়ম উপলব্ধি করে লুৎফরের মত স্বামী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এবং মনে মনে ভাবে যাকে ভালবেসে এতটা বিশ্বাস করে বিয়ে করেছিলাম সেই মানুষটাই আমার বিশ্বাসের মূল্য রাখল না। আর যাকে অবিশ্বাসের দোলাচলে বিয়ে করেছিলাম সেই মানুষটাই আমার ভরসার স্থল হয়ে গেল। আসলে মানুষ চেনা খুব কঠিন, কে ভালো কে মন্দ মুখ দেখে বোঝা যায় না। কোথায় লুৎফর আর কোথায় আকবর দুজনের ভেতর আকাশ-পাতাল পার্থক্য।

সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে