অনিয়ন্ত্রিত মন পর্ব-০২

0
743

#অনিয়ন্ত্রিত_মন
#jannat_Nur
#দ্বিতীয়_পর্ব

সকাল ১০ টার দিকে এসআই নুরুল আলম দুইজন কনস্টেবল সঙ্গে নিয়ে আকবর আলীর বাড়িতে এসেছে। আকবর আলী নাস্তা করে বিছানায় এসে শরীর এলিয়ে দিল। তখনই একজন ঘরের ভিতর ঢুকে বললো আপনার বাসায় পুলিশ এসেছে আপনাকে ধরে নিয়ে যেতে। কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আকবর আলী ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল। তখনই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে এসআই নুরুল আলম আকবর আলীকে বলল, আপনি কি আমাদের সঙ্গে সসম্মানে থানায় যাবেন নাকি ধরে নিয়ে যেতে হবে। আপনি আপনার প্রথম স্ত্রীকে রেখে তার অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। আবার তার গায়ে হাত তুলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। আপনার তো ভয়াবহ শাস্তি হবে।

” না স্যার আমি তাকে তাড়িয়ে দেইনি বা তার গায়ে হাতে তুলিনি। সে নিজের ইচ্ছায় তার বাবার সঙ্গে চলে গিয়েছে।

” একদম মিথ্যা বলবেন না, আপনি যে আপনার স্ত্রীকে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছেন এবং আপনার শ্বশুরের গায়ে হাত তুলেছেন এটা আমরা তদন্ত করেছি। আপনার বাসায় ঢোকার আগেই আপনার আশেপাশের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুনেছি আপনার শ্বশুর আপনার বিরুদ্ধে যা অভিযোগ করেছে তা একবিন্দু মিথ্যা না। আপনার প্রথম স্ত্রীকে চার মাসের শিশু সন্তানসহ তাকে কিভাবে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন! তাকে নাকি সারারাত বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলেন, আর আপনি আপনার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঘরে আনন্দ উল্লাস করেছেন। আপনার আনন্দ উল্লাস থানায় নিয়ে বের করব।

আকবর আলীকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেলে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শান্তা তার বাবার কাছে ফোন করে তাড়াতাড়ি আকবরকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে বলল। মেয়ের দুশ্চিন্তা দেখে শান্তার বাবা আরাফাত মোল্লা মেয়েকে অভয় দিয়ে বলল, তোর দুশ্চিন্তা করতে হবে না তুই তো জানিস তোর বাবার হাত কতটা উপরে। আমি আকবরকে ছাড়িয়ে আনবো। ওই মেয়েটা আকবরের নামে মামলা করে আকবরের একটা চুলও ছিড়তে পারবে না। বাবার কথা শুনে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলো শান্তা। সে জানে তার বাবার অনেক ক্ষমতা আছে। আকবরকে কয়েকদিনের ভিতরে জামিনে ছাড়িয়ে নিয়ে আসতে পারবে।

এদিকে বাবার বাড়িতে এসে কয়েকদিনে মরিয়ম বুঝতে পারল বিয়ের আগে বাবার বাড়িতে মেয়েদের যতটা আদর ভালোবাসা থাকে, বিয়ের পর সেই মেয়ে ফেরত আসলে তাকে আর আগের মত কেউ ভালবাসে না। তখন অবহেলার চোখে তাকে দেখা হয়। মরিয়ম মনে মনে ভাবে, আকবরের কাছ থেকে চলে এসে কি ভুল করলাম! না আসলে কি করতাম, সে বিয়ে করে নিয়ে এসে আমাকে পর করে দিল। আমি প্রতিবাদ করায় আমাকে সারারাত অবুঝ বাচ্চাসহ বাহিরে দাঁড় করিয়ে রাখলো। তাহলে আমি কি করতাম চলে না এসে। আর আমার বাবা সেটা বলতে যাওয়াতে আমার বাবার গায়ে হাত তুললো। তাইতো আমি চলে আসলাম। আমি কি ভুল করেছি না কি ঠিক করেছি এখন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। আকবরকে জেলে দিয়ে মনে হয় ঠিক করলাম না, সে তো আমাকে নিয়ে সংসার করতে চাইবে না। ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আর সতীনের সঙ্গে সংসার করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। কি করবো আমি। এমন ভাবতে ভাবতে কান্না করছিল মরিয়ম। তখন তার ছোট ভাইয়ের বউ এসে পাশে বসলো, পাশে বসে জিজ্ঞেস করল।

” আপা আপনি কান্না করছেন কেন?

” আমার ভাগ্যটাই তো হয়েছে কান্না করার জন্য, নাহলে কি এই শিশু বাচ্চাটাকে আজকে এতিম হতে হয়। আমার সঙ্গে যদি আকবারে ডিভোর্স হয়ে যায় তাহলে তো আমার রাইয়ান বাবার আদর থেকে বঞ্চিত হবে। আর আমি বা তাকে নিয়ে কিভাবে চলবো। মেট্রিক পরীক্ষা দিতে পারিনি বিয়ে হয়ে গেল। এ সামান্য পড়াশুনা দিয়ে কিছুই করতে পারবো না, আমার ছেলেকে আমি মানুষ করবো কিভাবে।

” সেটাই যদি বুঝতে তাহলে ধৈর্য ধরে স্বামীর বাড়িতেই থাকতে। তুমি যে ভাবছো তোমাকে ডিভোর্স দেওয়ার পর তোমার ছেলেকে তোমার সঙ্গে রাখবে, আকবর যদি ডিভোর্সের পরে তার ছেলেকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চায় তখন তো তাকেই দিয়ে দিতে হবে।

রুমের ভেতর প্রবেশ করতে করতে কথাটা বলল মরিয়মের বড় ভাবী সায়মা। সায়মার কথার জবাবে মরিয়ম বলল।

” কেন আমার ছেলেকে আকবরের কাছে দিয়ে দিতে হবে! মায়ের অধিকার বেশি, আমি আমার ছেলেকে আমার কাছেই রাখবো। যখন ১২ বছর হবে তখন ছেলের মতামতের উপর ভিত্তি করে সন্তানকে মা নয়তো বাবার কাছে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর আপনি বলছেন আকবর আমার ছেলেকে নিয়ে যাবে সে নিতে চাইলে আমি দেব নাকি। আমাকে যে সংসারে থাকতে দিল না সেই সংসারে আমার ছেলেকে নিয়ে অবহেলায় অনাদরে মানুষ করবে এটা আমি বেঁচে থাকতে খেতে দেবো না।

” কথা তো ভালোই বলতে পারো ছেলেকে যে রাখবে ছেলের ভরণ পোষণ কে দিবে! তুমি তোমার ভাইয়ের সংসারে থাকবে তোমার বাবার তো প্রমোশন হয়েছে তাদের টাকা দিয়ে সংসার কয়দিন চলবে! সে টাকা দিয়ে কি তোমার সন্তানকে তারা মানুষ করবে? আর সেটা করতে চাইলে কি আমরা হতে দেব। সে টাকার উপরে আমাদের এবং সুমনদের অধিকার বেশি। এখানে তোমার এবং তোমার ছেলের অধিকার ততটা নেই, তোমাকে আমরা খুশিতে যা দেবো তাই পাবে।

” ভাবী আপনি এই কথা কেমন করে বলতে পারছেন! আমি সন্তান হারা হই, আমার সন্তান মায়ের আদর ভালোবাসা ছাড়া বড় হোক আপনি এটাই চান? আপনারও তো সন্তান আছে আপনি কি বুঝেন না সন্তান ছাড়া থাকতে একটা মায়ের কতটা কষ্ট হবে। আপনারা যদি একটু সাহায্য করেন তাহলে তো আমার সন্তানটাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আমি থাকতে পারবো।

” আমি এত দয়ালু হতে পারব না, আর তোমার ভাইয়া বলে দিয়েছে তোমার সন্তানের দায়িত্ব নিতে পারবে না। বেশি বুঝে আকবরের নামে মামলা করে তাকে জেলে পুরে দিয়েছো, সে কি আর তোমাকে রাখবে? বের হয়ে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। আমরা কোন দায়িত্ব নিতে পারব না, সুমন আর সুমনের বউ যদি তোমার বাচ্চার দায়িত্ব নিতে চায় নিবে। আর এটা বলতে পারো তোমার মা-বাবা তোমার দায়িত্ব নিবে। বললাম তো পেনশনের যা টাকা আছে ওই টাকা আমাদের অধিকার বেশি। আর তোমার বাবা এখন চাকরি করে না তারাই আমাদের সংসারে বসে বসে খাবে তোমার সন্তানকে বড় করবে কি দিয়ে।
কি সুমনের বউ তুমি চুপ করে আছো কেন? নাকি তোমরা দায়িত্ব নিবে।

বড় জা এর কথা শুনে ছোট জা পপি কি বলবে বুঝতে পারছে না। তাকে চুপ করে থাকতে দেখে মরিয়ম বলল, প্লিজ ভাবী তুমি বড় ভাবীর মত নিষ্ঠুরের মতো আচরণ করো না। তুমি অন্তত আমার কষ্টটা বুঝতে চেষ্টা করো। পপি মরিয়মের হাত ধরে বলল।

” আচ্ছা তুমি আগেই ভেঙ্গে পরো না আমরা আছি তো। আগে কি হয় সেটা দেখো, তুমি যদি চাও তোমার ছেলেকে আকবরের কাছে দিবে না তাহলে দিতে হবে না।

পপির কথা শুনে সায়মা মুখ ভেংচি কেটে রুম থেকে চলে গেল। পপি মরিয়মকে বুঝিয়ে বলল, বড় ভাবীর কথাই মনে কষ্ট পেয়ো না। সব মানুষ তো আর সবার কষ্ট বুঝে না। যাই হোক সবকিছু আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও।

” ভাবী আমার জীবনটা কেন এমন হলো! কেন আমাকে রেখে আকবর আরেকটা বিয়ে করল। আমি কি দেখতে শুনতে এতটাই খারাপ ছিলাম! আমার কথা তো ভাবলো না, তার নিজের ছেলের কথাটাও একবার চিন্তা করলো না। মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কিভাবে। আগে যদি বুঝতাম এই মানুষটা এতটা নিষ্ঠুর কখনোই তাকে ভালবাসতাম না, তার সঙ্গে বিয়েতে রাজি হতাম না।

” যা হবার হয়েছে এখন আর বলে কি হবে সবই কপাল।

কয়েক মাসের ভেতরে আকবর জেল থেকে বের হয়ে আসলো। শান্তার বাবার উঠাবসা এমপি মন্ত্রীদের সঙ্গে। তার অনেক ক্ষমতা, এই কারণে আকবরকে জেল থেকে বের হতে বেগ পেতে হলো না। শান্তার বাবা আরাফাত মোল্লা গ্রামে এসেছে, স্থানীয় চেয়ারম্যানকে নিয়ে সালিশে বসলো। আকবর মরিয়মকে তালাক দিবে। মরিয়ম এর যত টাকা দেন মোহর আছে সবই পরিশোধ করে দিবে আরাফাত মোল্লা। তিনি তার মেয়েকে সতীনের সংসারে থাকতে দিবে না, আরাফাত মোল্লা চায় তার মেয়ের একার সংসার।

চেয়ারম্যান রহিম উদ্দিন বিচারে বসে মরিয়মকে জিজ্ঞেস করল, তোমার কি ইচ্ছা আছে সতীন নিয়ে সংসার করার! নাকি তুমি ডিভোর্স নিতে চাও?

” কোন মেয়ে পারেনা তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে আনার পরে সেটা সহ্য করতে। আমিও সহ্য করতে পারিনি। এই কারণে সে আমাকে সারারাত বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে আমার চার মাসের ছোট সন্তানকে নিয়ে। আমি বাহিরে ছিলাম, আমার অনেক কিছু হয়ে যেতে পারতো। সেই দিকে তার খেয়াল ছিল না সে তার স্ত্রীকে নিয়ে ঘরের ভিতরে রং তামাশা করেছে। আমি তাকে বারবার ডেকেছি দরজা খুলে দিতে, সে আমাকে বলেছে এটাই আমার শাস্তি। আচ্ছা আমি তো পরের মেয়ে, আমার বাচ্চাটা তো তার সন্তান ছিল! তার প্রতিও সে মায়া করেনি। তাহলে বলুন আমি কিভাবে তার সঙ্গে থাকবো। সে আমাকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই এমনটা করেছিল। আর আমার বাবা যখন গিয়েছে আমার বাবার গায়ে হাত তুলেছে। সে মেয়ের জামাই হয়ে আমার বৃদ্ধ বাবার গালে কিভাবে থাপ্পড় মারবে।

রহিম উদ্দিন আকবরের কাছে জানতে চাইলো, মরিয়ম যা বলল সেটা সত্যি কিনা? তুমি তোমার শ্বশুরের গায়ে হাত তুলেছ, শিশু একটা বাচ্চাকে নিয়ে মেয়েটাকে সারারাত বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছো। এই কাজটা কি তুমি ঠিক করেছ?

” চাচা আমি যাই করে থাকি এখন আমি এটাই চাচ্ছি মরিয়মকে ডিভোর্স দিয়ে দেবো। আমি তার সঙ্গে ভালো ছিলাম না। সে একটা অপয়া তাই আমি দ্বিতীয় বিয়ে করেছি, তার দেনমোহরের টাকা আমি পরিশোধ করে দিয়ে দেবো।

” দেনমোহরের টাকা পরিশোধ করে দিবি, কিন্তু তোর সন্তানের দায়িত্ব কে নেবে? তোর সন্তানকে নিয়ে যাবি। আমার বোনকে আমরা রাখব তোর সন্তানকে আমরা রাখবো না।

মরিয়ম এর বড় ভাই মামুর কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে মরিয়ম চিৎকার করে বলল, না আমার ছেলেকে আমি দেবো না। ওই অমানুষটা আমার ছেলেকে নিয়ে মেরে ফেলবে, আমি আমার ছেলেকে দেবো না।

মরিয়মের মা-বাবা ভাই ভাবী অনেক চেষ্টা করেও মরিয়মের বুক থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিয়ে দিতে পারল না। বাচ্চা দিয়ে দিলে মরিয়ম আত্মহত্যা করবে এমনটা বলার পর বাচ্চাটা মরিয়মের কাছে রাখার জন্য রাজি হলো মরিয়মের বাবা। দেনমোহরে টাকা পরিশোধ করে মরিয়মের ডিভোর্স হয়ে গেল। মরিয়ম ভালো করে বুঝতে পারল তার সন্তানকে নিয়ে এই পরিবারে থাকা খুব একটা সহজ হবে না। কিভাবে তার সন্তানকে মানুষ করবে এ দুশ্চিন্তায় মরিয়মের মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে