অতঃপর_তুমি পর্ব-১৯

0
5083

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-১৯
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

অভ্র’র কথা শুনে স্যার একগাল হেঁসে বললেন,
‘অভ্র!রোল নাম্বার থার্টি টু তোমার স্ত্রী?’
‘জ্বি স্যার।’
‘নাম কি মা তোমার?’

অভ্র’র কথায় বিদ্যমান আমার অবাকের মাত্রা এখনো কমেনি।স্যারের কথা কানে যাওয়ার পর অভ্র’র থেকে দৃষ্টি সরিয়ে স্যারের দিকে তাকিয়ে নমনীয় স্বরে বললাম,
‘অরু।’

‘অরু?বাহ!বেশ মিলেছে তো,অভ্র অরু।’

স্যার জোরে জোরে হাসতে লাগলেন।অভ্র আবারো বলল,
‘স্যার,আজ কি কোনো ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে?’
‘না।তেমন ইম্পর্টেন্ট তো কিছু নেই।এই একটু আগের পড়া টপিক নিয়েই আলোচনা করা হবে।’

‘স্যার,আজ তাহলে অরুকে কি আমি নিয়ে যেতে পারি?একটু দরকারী কাজ ছিলো।’

জোবায়ের স্যার আবারো একগাল হেঁসে বললেন,
‘না না কোনো অসুবিধা নেই।তুমি নিয়ে যেতে পারো।’

অভ্র আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিয়ে হাত ধরে গাড়িতে বসিয়ে দিলো।স্যারের কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে আছি।কি সুন্দর তিনি অভ্রকে ক্লাস বাদ দেওয়ার পারমিশন দিয়ে দিলেন।অথচ এই কথাটাই যদি অন্যকেউ বলতো তবে নরম ভাষায় কতগুলো বদহজম হওয়ার মতো কথা শুনিয়ে দিতেন।

গাড়ির সিট বেল্ট বেঁধে অভ্র আরো একবার আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি দিলো।মুখের মধ্যে আমার তখন অবাক ভাব টাই সর্বত্র বিচরণ করছিলো।উনার হাসি দেখে আমি পুনরায় মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে ঘুরে তাকালাম।
রাগটা আমার এখনো কমে নি।উনি কি ভেবেছেন?এতো সহজেই আমি গলে যাবো!যদিও আমি বেশিক্ষণ রাগ হয়ে থাকতে পারি না।এবং এই মুহুর্তেও বুঝতেও পারছি রাগটা কমে কমে যাচ্ছে বলেই।তাই তাড়াতাড়ি নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছি।অভিমান টাকে শক্ত করে ধরে রাখছি।বলবো না আমি তার সাথে কথা।কিছুতেই না।

গাড়ির সামনে রাখা পানির বোতলটা হাত বাড়িয়ে নিলাম।নতুন বোতল,এখনো মুখ খোলা হয় নি।আর আমিও শত চেষ্টা করেও খুলতে পারলাম না।দাঁত খিঁচ দিয়ে জোর দিয়েও কোনো লাভ হলো না।অভ্র আমার কান্ড দেখে হেঁসে ফেললো।নজর সামনে রেখেই বা হাতটা বাড়িয়ে বলল,
‘আমার হাতে দাও।’

আমি দিলাম না।পুনরায় জোর খাটাতে লাগলাম।ফলস্বরূপ যা হলো,বোতলের মাঝখানে অধিক চাপপ্রয়োগের ফলে ছিপিটা হুট করে খুলে যাওয়ায় কিছু পানি আমার মুখে ছিটকে পড়লো।অভ্র সম্মুখ দৃষ্টি রেখেই মুখ চেঁপে চেঁপে হাসতে লাগলো।আমি সরু চোখে তার দিকে তাকালাম।
কিছুক্ষণ পর আবারো তাকিয়ে দেখি তার মুখে এখনো সেই হাসি।ইশ!এমন কি হয়েছে যে তার হাসি থামতেই চাইছে না।তার শয়তানি হাসি দেখে আমার গা জ্বলে গেলো।এবার আর দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম না।কটমট চোখে তার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলাম।তার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ আমার নজরে পড়লো তার ঘাড়ে বাম কানের ঠিক দু ইঞ্চি নিচে একটি ছোট্ট কালো তিল আছে।কালো চুলের নিচে এবং হালকা আকাশি রঙের শার্টের উপরে ফর্সা ঘাড়ের মধ্যখানটায় কালো তিলটি একদম নজর কেড়ে রেখেছে।রাগী ভাব ভুলে এবার আমি ভ্যাবলার মতো তার ঘাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম।অভ্র এখন নিচের ঠোঁটটি আলতো করে কামড়ে ধরে বাম দিকের রাস্তায় গাড়ি টার্ন করায় ব্যস্ত।তার এই তিলটি তো আগে কখনো খেয়াল করি নি।তিলটি উদ্ধার হওয়ায় এখন মনে হচ্ছে অভ্র’র সৌন্দর্য্য যেনো আরো দ্বিগুণ বেড়ে গেলো।

হঠাৎ আমার খেয়াল হলো আমি অনেকক্ষণ যাবৎ মুখ হা করে তার ঘারের তিলটির দিকেই তাকিয়ে আছি।সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সংযত করে মুখের মধ্যে রাগী ভাবটা ফুটিয়ে তুলে সামনে তাকালাম।
কি অবস্থা অরু!তুই রাগ হয়ে আছিস।রাগের মতো করেই থাকবি আর তুই কিনা যার উপর রাগ করেছিস তার ঘাড়ের তিল খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিস।
ইশ!অভ্র যদি আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফেলতো তবে কি ভাবতো!
সামনে তো তাকিয়েছি কিন্তু বারবার ঘুরে ফিরে আমার নজরটা শুধু সেই ছোট্ট তিলের দিকেই যাচ্ছে।শুধু একটু আরেকটু দেখতে ইচ্ছে করছে।তিলটায় মনে হচ্ছে কি যেন একটা আকর্ষণীয় ক্ষমতা আছে।আমাকে খুব করে টানছে।

মনে মনে নিজেই নিজেকে একটা কঠিন গালি দিলাম।অরু,তুই যে এতোটা বেহায়া আগে তো জানতাম না।একটা ছেলের দিকে কোনো মেয়ে এভাবে তাকিয়ে থাকে!তাকিয়ে থাকবে ছেলেরা।তুই দেখি মেয়ে জাতির নামটাই ডুবিয়ে ফেলবি।
অভ্র যদি একবার বুঝে ফেলে তখন কি হবে!দোষটা কি শুধু আমার একার?দোষ তারও আছে।একটা ছেলে এতোটা সুন্দর হতে যাবে কেনো!আবার সেই সৌন্দর্য্য বাড়াতে অদ্ভুত ভাবে ভ্রু কুঁচকে তাকাবে,নিচের ঠোঁট আলতো করে কামড়ে ধরবে,মিষ্টি করে হাসবে,হুটহাট করে ঘাড়ের মধ্যে থেকে একটি অতি মন কড়া তিল বেড়িয়ে আসবে এসব কি!সব সৌন্দর্য্য কি তার একাই নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা নাকি!

নিজের উপর আর অভ্র’র সৌন্দর্য্যের উপর চরম বিরক্ত হয়ে অবশেষে বাড়ি পৌঁছালাম।
অভ্র গাড়ি থামাতেই দ্রুত পায়ে রুমে চলে আসলাম।এরপর রুম থেকে বারান্দায়।বারান্দায় আসতেই রীতিমতো একটি ধাক্কা খেলাম।বারান্দার বাম দিকের কর্ণারে গোলাপ ফুলের টবের পাশেই শেগুন কাঠের একটি নতুন টেবিল রাখা।টেবিলের উপরে থাকা বড় বড় বইয়ের তাকগুলো ভরে আছে উপন্যাসের বই।দেখেই আমার রক্ত বিন্দুতে যেন আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো।
সেই কিশোরী বয়সের প্রথম থেকেই উপন্যাসের প্রতি আমার চরম দূর্বলতা আছে।এভাবে একসাথে এত্তগুলা উপন্যাসের বই দেখে আমার খুশি যেনো বাঁধ ছাড়া হয়ে গেলো।হাত বাড়িয়ে প্রথমেই যেই বইটা হাতে এলো তা হলো শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিণীতা বইটি।আমার সবথেকে প্রিয় পছন্দের উপন্যাস।প্রফুল্লিত হয়ে ভারী মলাট টা পাল্টাতেই প্রথম সাদা পৃষ্ঠায় চোখে পড়লো পাঁচ শব্দের একটি লেখা “SORRY”।তার নিচে বইয়ের ভাঁজে রাখা একটি লাল গোলাপের পাঁপড়ি।একটি শুধুমাত্র একটি গোলাপের পাঁপড়ি।আমার ঠোঁটে আনমনেই ছোট্ট হাসি ফুটে উঠলো।উপরের বাম দিকের কর্ণার থেকে আরেকটি বই হাতে নিলাম সেখানেও একই কান্ড।এভাবে এলোমেলো ভাবে যতগুলো বই হাতে নিলাম সবগুলোতেই দেখতে পেলাম সেই একই লেখা ” SORRY” আর একটি করে গোলাপ ফুলের পাঁপড়ি।তাক ভর্তি বইয়ে তিনি ক্ষমা সূচক শব্দটি আর একটি গোলাপের পাঁপড়ি রেখে দিয়েছেন।এমন অদ্ভুত অদ্ভুত আইডিয়া গুলো তার মাথায় আসে কি করে!অদ্ভুত হলেও সুন্দর।খুব সুন্দর।
স্যরি বলার সবথেকে সুন্দর উপায়।

পেছনে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখলাম অভ্র আর তুতুল কান ধরে মুখে একটা ইনোসেন্ট ইনোসেন্ট ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমি পেছনে ঘুরতেই অভ্র হাঁটু গেড়ে কান ধরেই মাটিতে বসে পড়ল।তুতুল এখনো দাঁড়িয়ে আছে বিধায় উনি তুতুলের মাথায় আস্তে করে একটা বারি দিয়ে নিচে ইশারা করে বসতে বললেন,
তুতুলও হাঁটু গেড়ে বসে পরে উনার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,
‘মামা,বসার জন্য কিন্তু ডেইরি মিল্কের বড় প্যাকেটটা দিতে হবে।’

দুজনের কান্ড দেখে খিলখিল করে হাসতে লাগলাম।অভ্র আর তুতুল দুজনেই হকচকিয়ে আমার দিকে তাকালো।

পরেরদিন ভার্সিটি যেতেই শাওন কোথা থেকে দৌঁড়ে এসে বলল,
‘অরু,আই এম রিয়েলি স্যরি।তুমি যে অভ্র ভাইয়ার বউ তা আমি একদমই জানতাম না।তুমি প্লিজ কিছু মনে করো না।অভ্র ভাই আমার উপর ভীষণ রাগ করেছে।’

শাওনের কথায় আমি বেশ হকচকিয়ে গেলাম।

‘তোমাকে এই কথা কে বলেছে?’

‘কে আবার!অভ্র ভাই বলেছে।ভাইয়াকে একটু বলে দিবা আমি শুধরে গেছি।যদি আমার বড় ভাইকে বলে দেয় তাহলে আমার আর রক্ষে নেই।’

আমাকে হতভম্ব বানিয়ে দিয়ে শাওন চলে গেলো।আমি আরো একটু এগোতেই গেটের দারোয়ান ভাই আমার দিকে দৌঁড়ে এসে বললেন,
‘ভাবী ভালো আছেন?কোনো অসুবিধা হইলে আমারে বলবেন?’

আমি অবাক হয়ে বললাম,’ভাবী?’

‘হো ভাবীই তো।আপনি আমগো অভ্র ভাইয়ের বউ তায় আমাগো ভাবী লাগেন না।’

দারোয়ান ভাই যাওয়ার পর আরো অনেকেই আমাকে অভ্র’র বউ বলে সম্বোধন করে গেলো।আমি হতবাক হয়ে ক্যাম্পাসের মাঝে দাঁড়িয়ে রইলাম।কি আশ্চর্য্য!উনি কি ভার্সিটিতে এসে জনে জনে বলে গেছেন নাকি আমি তার বউ!

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে