অতঃপর_তুমি পর্ব-১৭

0
5647

#অতঃপর_তুমি
#পর্ব-১৭
Writer: ইশরাত জাহান সুপ্তি

অভ্র চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর মফিজ ভাই গাড়ি নিয়ে এলেন।বুঝতে পারলাম গাড়িটি অভ্রই পাঠিয়েছে।আমি বলে দিলাম আমি এখন যাবো না,তাকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে।মফিজ ভাই কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলেন।
একটি সিএনজি করে আমি আমাদের বাড়িতে চলে আসলাম।অভ্র’র বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিলাম বাবা মার কথা মনে পড়ছে তাই আমি এ বাড়ি এসেছি।বাবা আর কিছু বললেন না।

বাড়িতে এসে সবার সামনে হাসি খুশিই থাকলাম।কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না।মা যদি একটুও আন্দাজ করতে পারে কিছু তবে আর রক্ষে নেই।প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে পাগল বানিয়ে ফেলবেন।
দুপুরে সবার সাথে বসে একসাথে ভাত খেলাম।বাবা একটি বড় বোয়াল মাছ এনেছিলেন।আমি এসেছি দেখে ভীষণ খুশি হয়েছেন।মাকে বললেন,খুব ভালোমতো রান্না করতে আমার জন্য।দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর রুমে এসে ফোনটা হাতে নিতেই স্ক্রিনে ‘অভ্র’ নামটা ভেসে উঠে কল বাজতে শুরু করলো।আমি ঝটপট সাইলেন্ট করে নিলাম।কললিস্ট চেক করে দেখলাম এর আগে অনবরত একশো তিন বার কল দিয়েছিলন।ফোনে পুনরায় উনি কল দিলেন।এখন শুধু ভ্রাইব্রেট হচ্ছে।ফোনটা বালিশের নিচে চাপা দিয়ে আমি মুখ গুঁজে রইলাম।
দরজা ঠেলে মার ভেতরে প্রবেশ করার আওয়াজ পেতেই নিজেকে ঠিক করে মার দিকে ফিরে হেঁসে বললাম,
‘মা,এসো।’
‘অরু,ঘুমিয়ে গিয়েছিলি?’
‘না মা ঘুমাই নি।তুমি এখানে বসো তো।’

মা আমার পাশে বসলেন।মায়ের হাতটা নিজের মুখের কাছে টেনে নিয়ে বললাম,
‘মা এবার আমি অনেকদিন থাকবো কিন্তু তোমাদের কাছে।’
‘তা থাকবি।ও বাড়িতে বলে এসেছিস তো?’
‘হ্যাঁ,অভ্র’র বাবাকে বলে এসেছি।’

অভ্র’র নামটা মুখে নিতেই মুহুর্তের মধ্যে মনটা কেমন যেনো বিষন্নতায় ভরে গেলো।
মা বললেন,
‘তোর পরীক্ষা কবে অরু,পরীক্ষার দিনগুলোতে কি আমাদের এখানেই থাকবি।’

আমার ধ্যান অন্য কোথাও ছিলো।বালিশের নিচে অনবরত ভ্রাইব্রেট হওয়া ফোনের দিকে।মায়ের শেষোক্ত কথাটা শুনে আমি চমকে উঠে বললাম,
‘শুধু পরীক্ষার দিনগুলো কেনো মা!পরীক্ষার আগ পর্যন্ত আমি এখানেই থাকবো।’

‘তোর শ্বশুরবাড়ির লোকজন কি এতোদিন থাকতে দিবেন?’
‘থাকতে দিবে না কেনো?আমি থাকবো।’
মা আমার থেকে যাওয়ার এতোটা জোর শুনে একটু অবাক হলেন।
আমার মাথায় তখন অন্য কথা ঘুরছে।আমি চাইছি অভ্র’র থেকে যতটুকু সম্ভব দূরে থাকতে।তার সামনে আমার আর এখন পরতে ইচ্ছে করছে না।তার জীবনে আমি আর বিরক্ত হয়ে থাকতে চাই না।
অভ্র এই বাড়িতে কখনো আসে না এই একটাই এখন সহায়।এই মুহুর্তে আর যা কিছুই হোক আমি উনার কাছে ঐ বাড়িতে যেতে চাই না।তাই তার জানা শোনার বাইরে থাকতে চাই।তার থেকে দূরে।অনেক দূরে….

২১.
সারাদিন আমি শুধু ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই কাটালাম।কাল ভার্সিটি থেকে এ বাড়ি আসার পর আর ঘর থেকেই বের হইনি।আজ ভার্সিটিও যাই নি।ফোন বন্ধ করে রেখে দিয়েছি।কিচ্ছু ভালো লাগছে না।ইচ্ছে করছে কিছু সময়ের জন্য নিজেকে এই বাস্তব পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখি।চেনা জানা কেউ থাকবে না।অচেনা মানুষদের ভীড়ে শুধু আমি একা থাকবো।যেখানে কেউ কারো দিকে কৌতুহল রাখবে না।রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কাঁদলেও কেউ অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকবে না।চোখের পানি আড়াল করার জন্য বাথরুমের আশ্রয় নিতে হবে না।কান্নার শব্দ ঢেকে রাখবার জন্য পানির কল ছেড়ে রাখতে হবে না।
যেখানে কান্না পেলে কাঁদতে পারবো,হাসতে চাইলে হাসতে পারবো।নিজের সাথে জোরে জোরে কথা বলতে পারবো।
ভাবতে হবে না কেউ দেখে ফেললো না তো?
কেউ কিছু মনে করলো না তো?
সবার থাকবে একক নিজস্ব পৃথিবী।অন্যের জীবন নিয়ে দখলদারী করার এতো সময় কই!
কিন্তু এমনটা কি আদৌও সম্ভব?যাই হয়ে যাক আমাকে এখানেই থাকতে হবে এখানে কষ্ট আছে,দুঃখ আছে,বিরক্তি আছে।কিছুটা সময় নিজেকে একান্ত ভাবে দিতে চাইলেও দিতে পারবো না।বিরক্ত মুখে কাকের কা কা ডাক শুনতে হবে,রাস্তায় চলতে থাকা কানে তব্দা লাগানোর মতো গাড়িগুলোর হর্ন শুনতে হবে,রান্নাঘর থেকে টুম্পার ক্যাচ ক্যাচ করা গলার আওয়াজ শুনতে হবে।রুমের দরজা বন্ধ করে দু দন্ড একটু একা থাকতে পারবো না।মা সন্দেহের চোখে তাকানো শুরু করে দিবে।এখানে কষ্ট পেলেও হাসতে হবে।কান্না পেলেও চেঁপে রাখতে হবে।এখানে শুধু ভাবতে হবে অন্যদের নিয়ে।অন্যরা কি ভাববে?অন্যরা কি করবে?

বাস্তব পৃথিবীর ধার্য করা সুনির্দিষ্ট নিয়ম।একে ভাঙতে পারবো আমার এতো ক্ষমতা কই!
এই পৃথিবীতে তুমি ভালো আছো কি নেই সেটা মূখ্য নয়।ভালো থাকো বা না থাকো ভালো থাকার অভিনয়টা তোমাকে ভালো মতো পারতেই হবে।এটাই মূখ্য।

বিকেলের দিকে এক মগ আগুন গরম কফি নিয়ে ছাদে চলে আসলাম।ছাদ থেকে শুধু ব্যস্ত নগরীর যানবাহনের আসা যাওয়াই চোখে পড়ে।কারো দু মিনিট থেমে থাকার সময় নেই।মাথাটা ঝিম মেরে রয়েছে এতোক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার জন্য।হঠাৎ ছোটো মামা এক বালতি পানি নিয়ে ছাদে আসলেন।আমাকে দেখে একগাল হেঁসে বললেন,
‘কিরে অরু,তোর ঘুমটা অবশেষে ভাঙলো তবে।এতো ঘুমাতে তুই পারিস কিভাবে?’

ছোটো মামার কথায় আমি হেঁসে দিলাম।

‘মামা,পানি ভরা বালতি নিয়ে তুমি ছাদে কি করছো?’

‘গাছের গোড়ায় পানি দেবো।দেখছিস না এই সব ভাঙা বালতিতে আমি একশো একটা আম গাছের চারা লাগিয়েছি।’

‘এতো গুলো আম গাছ দিয়ে তুমি কি করবে?’

‘আমি ঠিক করেছি এই চারাগুলো আরো একটু বড় হলে ঢাকা শহরের সব ভিক্ষুকদের একটা একটা করে বিলিয়ে দেওয়া হবে।’

আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ঢাকা শহরের ভিক্ষুকরা আম গাছের চারা নিয়ে কি করবে?’

‘কি করবে মানে?গাছ লাগাবে।তারপর সেই গাছ থেকে আম হলে সেই আম খেয়ে থাকবে।তাদের আর ভিক্ষা করে খেতে হবে না।গাছের ছায়ার নিচে আশ্রয়ও পাবে।মাঝে মাঝে আম বিক্রি করে সঞ্চয় করবে।বিশাল বড় পরিকল্পনারে অরু,ঢাকাশহরে আমি তো দেখছি আর ভিক্ষুকই থাকবে না আবার দেখবি পুরো শহরটাও গাছে গাছে ভরে যাবে।তোর ছোটো মামা দেখবি ফেমাস হয়ে যাবে।প্লানটা কেমন রে অরু?’

আমি মুখে হাত দিয়ে একটা হাই দিয়ে বললাম,’ভালো।’

মামার মাথায় আবারো একটা বিষয় নিয়ে পাগলামো ঢুকেছে।এখন তিনি এই কাজ পুরো দমে করবেন।তারপর কিছু দিন যাওয়ার পরই বিরক্ত হয়ে ফেলে দিবেন।এইবার দুই বছর পর বিদেশ থেকে ফিরে মামা আবার এই নতুন পাগলামো শুরু করলেন।বাবা নিশ্চয়ই মামার কান্ডে মহা বিরক্ত হয়েছেন।মামার মহা পরিকল্পনায় ব্যগ্র না দেওয়ার জন্য আমি সেখানে থেকে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম।মামা হঠাৎ পেছন থেকে ডেকে উঠে বললেন,

‘জানিস অরু,দুবাইতে একজন এস্ট্রোলোজারের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে।তিনি মানুষের দাম্পত্য জীবন নিয়ে ভবিষ্যত বাণী দেন।দুবাইয়ের সব ইয়াং মেয়েরা বিয়ে করার আগে তার থেকে ভবিষ্যত বাণী শুনেই বিয়ে করেন।লোকটার সাথে আমার দারুণ সম্পর্ক হয়েছে।বলেছে আমাকেও এই বিদ্যা একটু আধটু শেখাবে।’

‘তুমি এসব শিখে কি করবে?তুমি তো বিয়েই করোনি।’

‘আহা!বিয়ে করিনি তাতে কি শিখে রাখায় তো কোনো দোষ নেই।’

‘তা তোমার ইচ্ছা তুমি শেখো।এখন কি আমি যাবো নাকি আমাকে নিয়েও তুমি কিছু বলতে চাও?’

‘তোকে কিছু বলার জন্য এসব শেখার প্রয়োজন নেই।তুই একটা লক্ষ্মী মেয়ে।তোর সংসারটা হবে সবচাইতে সুখী,ভালোবাসাময়।দেখে নিস।’

মামার কথায় আমি একটা ছোট্ট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাদ থেকে চলে আসলাম।অনেকরাত পর্যন্ত শুধু টিভিই দেখলাম।এই পর্যন্ত একবারের জন্যও ফোন অন করিনি।সারা রাত ঠিকমতো ঘুম আসলো না।দিনে এতোটা ঘুমানো একদমই ঠিক হয়নি।

ভোর হয়ে আসলো বলে।এখনো বাইরে অন্ধকার আছে।হালকা ঘুম ঘুম চোখে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছি।এমন সময় কলিং বেলটা বেঁজে উঠলো।চারিদিকের নিস্তব্ধতার জন্য আওয়াজটা খুব করে কানে বাঁজলো।আমি একবার বারান্দা দিয়ে দেখতে পাওয়া বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আবার বিরক্ত মুখে নিজের রুমের দরজাটার দিকে তাকালাম।এতো সকাল সকাল দুধ ওয়ালা ছাড়া আর কেই বা আসবে।তবে আজ এতো তাড়াতাড়ি দুধওয়ালা কেনো আসলো বুঝলাম না।এমনিতে তো আলো ফুটলে তবে আসে।
মা হয়তো নামাজ পড়তে দাঁড়িয়ে গেছেন।তাই আমিই বিছানা ছেড়ে উঠে গায়ে সাদা ওড়নাটা জড়িয়ে নিলাম।ঘুম ঘুম চোখে ঢুলতে ঢুলতে রান্না ঘর থেকে দুধ রাখার পাত্র টা নিয়ে এক হাত দিয়ে চোখ ঘষতে ঘষতে দরজা খুলেই সোজা পাত্রটা বাড়িয়ে দিলাম।
তারপর বেখেয়ালী ভাবে সামনে তাকাতেই আমি পুরো স্তব্ধ হয়ে গেলাম।কারণ সামনে দুধ ওয়ালা নয় হালকা আকাশি রঙের শার্ট গায়ে অভ্র দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণের জন্য মনে হলো আমি অন্য কোনো জগতে আছি।পরীক্ষা করার জন্য নিজের হাতে একটা চিমটি দিতে ইচ্ছে করছে।কিন্তু আমি এতটাই অবাক হয়ে গেছি যে চোখের পলক ফেলতেও ভুলে গেছি।বিয়ের পর অভ্র এ বাড়িতে একবারও আসেনি।সবাই ধরেও নিয়েছিলো অভ্র আর এ বাড়িতে কখনো আসবে না।
কিন্তু আজ উনি এসেছেন তাও আবার এতো ভোরে।আচ্ছা!অভ্র কি সত্যিই এসেছেন না আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখছি?

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে