Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 53



হৃদয়হরণী পর্ব-১২+১৩

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:১২
#তানিশা সুলতানা

ভালোবাসলে না কি মানুষ অন্ধ হয়ে যায়? ছোঁয়াও কি অন্ধ হয়ে গেলো? সাদির দোষ গুলো সে দেখতেই পায় না। তার শুধু ভালো দিক গুলোই মনে থাকে। ভালো ব্যবহার?
সাদি কখনো ছোঁয়ার সাথে ভালো ব্যবহার করেছে? কথাই বলে না ঠিকঠাক ভাবে আবার ভালো বিহেভিয়ার করবে? হুহহ এটা হাস্যকর। ছোঁয়া আয়নায় নিজেকে দেখছে। ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। কোথায় ভুল আছে তার?
হুমম ভুল আছে তো। নাকটা বোচা। মায়াবী চেহারা না। চোখ দুটো টানাটানা নয় বড়বড়। গোলাপি ঠোঁট নেই তার। তার তো কালচে ঠোঁট। কোনো ছেলেকে আকৃষ্ট করার মতো রূপ নেই তার। তাহলে তাকে সাদি কি করে ভালোবাসবে? কি দেখে বিয়ে করবে?
এই প্রথমবার নিজের চেহারা নিয়ে অসন্তুষ্ট ছোঁয়া। মনে হচ্ছে আর একটু সুন্দর হলে কি হতো?
তবুও সে সাদিকে ভালোবাসে। ভীষণ ভালোবাসে। একটু বেশিই ভালোবাসে।

চোখ বন্ধ করে লোকটার পাশে অন্য কাউকে চিন্তা করলেই অস্বাভাবিক ভাবে বুক কাঁপতে থাকে। অস্থির লাগে। মরে যেতে ইচ্ছে করে।
নিজের এই পাগলামি ধরণের অনুভূতি সে কার কাছে শেয়ার করবে? কাকে বলবে সে তার এই কঠিন রোগের কথা? কে বুঝবে তাকে?

“ছোঁয়া এখনো চেঞ্জ করিস নি? এভাবে তোকে হলুদ কে মাখালো? এই হলুদ উঠবে? তুই একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করিস সব সময়। বড় হবি কবে তুই? এরকম বাচ্চামি কিন্তু এখন আর মানায় না তোকে।

সিমি চোখ পাকিয়ে বলে। ছোঁয়ার কানে সিমির কথা গুলো ঢোকে না। সে তার ভাবনার জগতে বিভোর।
সিমি খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে ছোঁয়ার দিকে। তারপর এগিয়ে গিয়ে ছোঁয়াকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।

” আপি আমি না পাগল হয়ে যাচ্ছি। ভালো লাগে না আমার। হাসতে পারছি না। দম বন্ধ লাগে।
সিমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ছোঁয়ার থুতনিতে হাত দেয়।

“দেখ ছোঁয়া তুই এখনো অনেক ছোট। ভালো মন্দ বোঝার বয়স তোর হয় নি। বয়স কতো তোর? ষোলো পেরিয়ে সতেরো। আর সাদি ভাইয়ের বয়স জানিস? ত্রিশ পেরিয়ে যাবে কিছুদিন পরেই। তোদের দুজনকে মানাবো বল?
এখন তো তুই বুঝতে পারছিস না। কিন্তু কিছুদিন পরে যখন অরেকটু বড় হবি বান্ধবীদের বর দেখবি তখন আফসোস করবি।

ছোঁয়া গম্ভীর গলায় বলে
” ওনাকে না পেলে আমি আফসোসে আফসোসে মরেই যাবো।
“এমন কথা বলবি না আর। বাবা মা শুনলে তোকে আস্ত রাখবে না। নিজের অনুভূতি কন্ট্রোল করতে শিখ।

ছোঁয়া বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে।
” তুই আমাকে বুঝতেই পারিস না আপি। তোর কাছে কিছু শেয়ার করা মানে বিপদে পড়া। যা তুই এখান থেকে।

সিমি আর কিছু বলে না। একে বোঝানোর ক্ষমতা তার নেই। তাই সে কাপড় পাল্টে নিতে বলে চলে যায়।

___

সাদি সেলিম চৌধুরীর রুমে এসেছে। সেলিম খবরের কাগজ পড়ছে। সকালে পড়তে পারে নি। সময় পায় নি। তাই এখন একটু সময় বের করে পড়ছে। আজকে সে অনেকটাই খুশি। কালকে সাদির বিয়েটা হয়ে গেলে মেয়েকে নিয়ে ঢাকার শহর ছেড়ে দিবেন তিনি। সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে।
সাদি সেলিম চৌধুরীর সামনে নিজের ফোনটা ধরে। মুহুর্তেই চোখ দুটো বড়বড় হয়ে যায় ওনার। খবরের কাগজ রেখে ফোনটা নিজের হাতে নেয়। এক পলক সাদির দিকে তাকিয়ে ফোনে থাকা পিকটা ভালো করে দেখতে থাকে। এতোখন খুশি মনে থাকলেও এখন তার মুখটা থমথমে হয়ে যায়।
ফোনটা খাটে রেখে সাদির দিকে তাকায় তিনি

“প্রাক্তন তো থাকতেই পারে। ইটস নরমাল সাদি।

সাদি বুকে হাত গুঁজে সেলিমের চোখে চোখ রেখে বলে
” পাস্ট তো থাকতেই পারে। ইটস নরমাল চাচ্চু। ছোঁয়াকে দিয়ে দিন আমায়।

সেলিম রেগে যায়। হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলে। কটমট চোখে তাকায় সাদির দিকে।
“সাদি চুপচাপ বিয়েটা করে নে। আমায় রাগিয়ে দিস না।

” আপনিও চুপচাপ বিয়েটা ভেঙে দিন। আমায় রাগিয়ে দিয়েন না।
রাগে সেলিমের চোখ দুটো লাল টকটকে হয়ে যায়।
“সাদি ভুলে যাস না আমি তোর চাচ্চু
” আপনিও ভুলে যাবেন না আমি আপনার ভাইয়ের ছেলে।
সেলিম আর বলার মতো কথা খুঁজে পায় না।
“আমাকে চোখ না রাঙিয়ে নিজের মেয়েকে সামলে দেখান। মৌমাছির মতো সে ঠিক ছুঁটে আসবে।

বলেই সাদি নিজের ফোনটা নিয়ে চলে যায়। সেলিম নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে খবরের কাগজ ছিঁড়ে ফেলে। তাতেও রাগ কমে না তার।

__
সারা রাত দুজন চাতক পাখির ঘুম হয় না। একজন বিছানায় এপাশ ওপাশ করে রাত পার করে আরেকজন ছাঁদে বসে। ফজরের নামাজ শেষে ছোঁয়া জায়নামাজ গুটিয়ে গায়ে পাতলা চাদর জড়িয়ে ছাঁদে চলে যায়। ভালো লাগছে না তার। আর মাত্র কিছুখন তারপরেই সাদি হয়ে যাবে অন্য কারো। ছোঁয়া সয্য করবে কি করে?
আনমনে ছাঁদের দরজা খুলে সামনে পা ফেলতেই চমকে ওঠে ছোঁয়া। কেনোনা সাদি দোলনায় বসে আছে। দৃষ্টি তার ফ্লোরে। এলোমেলো চুল কুঁচকানো টিশার্ট খালি পায়ে। এরকম সাদিকে ছোঁয়া প্রথমবার দেখছে। বরাবরই লোকটা গোছানো।
ছোঁয়া মুখটা মলিন করে জুতো খুলে সিঁড়িতে রেখে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় সাদির দিকে। সাদির পাশে বসে পড়ে। সাদি তাকায়ও না একবার। ছোঁয়া বিরক্ত হয়। মনে মনে কয়েকটা গালিও দেয়।
একবার তো পাশ ফিরে তাকাতে পারতো।
ফ্লোর বেশ ঠান্ডা।

ছোঁয়া একটা কাশি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। তবুও সাদির কোনো ভাবান্তর হয় না।
ছোঁয়া এবার নাক ফুলিয়ে বলে ওঠে
” বিয়েটা সত্যি সত্যিই করবেন তাহলে?

এবার সাদি ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়া তাকিয়েই ছিলো তাই চোখাচোখি হয়ে যায়। চোখ নামিয়ে নেয় ছোঁয়া। লোকটার চাহনি ভয়ংকর। ওই চোখে তাকিয়ে থাকা সম্ভব না।
সাদি জবাব দেয় না।
ছোঁয়া মাথা নিচু করে আবারও বলে ওঠে
“আপনি কি আমাকে বুঝবেন না? না কি একটুখানি পেছন পেছন ঘুরছি বলে ভাব দেখাচ্ছেন? আমি না হয় একটু অসুন্দর। কিন্তু মানুষ তো। তাই না? এভাবে ইগনোর কেনো করছেন আমায়? প্রবলেম কি আপনার? আমি য
ছোঁয়ার বলার মাঝেই সাদি ফট করে বলে ওঠে
” পালাবে আমার সাথে?
বলেই সাদি দাঁড়িয়ে যায়। বা হাতে নিজের চুল গুলো পেছনে ঠেলে পা বাড়ায় ছাঁদ থেকে নামার জন্য। ছোঁয়াও দাঁড়িয়ে যায়। সাদি কি বললো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে তার। জিজ্ঞেস করবে কি? না থাক
আবারও বসে পড়ে দোলনায়।

সাদি দরজা ওবদি গিয়ে থেমে যায়। পেছন ঘুরে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। মেয়েটা ভাবছে। সাদি ফোঁস করে শ্বাস টেনে বলে
“আমার থেকে কখনো কিছু পাবে না। লাভ, কেয়ার, সিমপ্যাথি, এটেনশন কিছুই পাবে না।
জাস্ট আমার পাশের রুমে থাকার জায়গা পাবে। ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।
আর হ্যাঁ আমার বয়স ৩১ ছুঁই ছুঁই।

বলেই বড়বড় পা ফেলে চলে যায় সাদি। ছোঁয়া ভাবতে থাকে সাদির কথা। কি বলে গেলো?

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:১৩
#তানিশা সুলতানা

টেনশনে ছোঁয়া শান্তিতে নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। কিভাবে যাবে? কোথায় যাবে? কোথায় থাকবে? বিয়ে করবে কি করে? টাকা পাবে কোথায়?
পায়চারি করতে করতে ছোঁয়ার পা ব্যাথা হয়ে গেছে৷ সেই সকাল থেকে পায়চারি করছে। একটা দানাও তার পেটে পড়ে নি৷ কিন্তু সাদি দিব্যি আছে৷ গাণ্ডেপিণ্ডে গিললো। এখন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে প্যান্ডেল দেখছে। প্রচুর টাকা খরচ করেছে তার বাবা৷

“সাদি তুমি কোনো গন্ডগোল করবে না।

সেলিমের আওয়াজ শুনে সাদি পেছন ঘুরে তাকায়। কিন্তু কোনো কথা বলে না।
সেলিম এগিয়ে আসে। দাঁড়িয়ে যায় সাদির মুখোমুখি
” দেখ সাদি মায়া ভালো মেয়ে। রিলেশন এখনকার মেয়েরা দুই একটা করেই থাকে। আর একটা সেলফি তোলা খারাপ কিছু না। হতে পারে ছেলেটা মায়ার কোনো কাজিন।

সাদি সেলিমের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। লোকটা ভীষণ স্বার্থপর। নিজের স্বার্থের জন্য যা খুশি করতে পারে।
সেলিম আবারও বলে
“আমার মেয়ে আমার কলিজা। সাদি তুই ভালো করেই জানিস তুই স্বাভাবিক না। তোর সাথে আমার মেয়ে ভালো থাকবে না। তুই কোনো কথাবার্তা ছাড়া মায়াকে বিয়ে করে নিবি।

সাদি রেলিং এর ওপর বসে পড়ে। জবাব দেয় না। সাদির থেকে জবাব না পেয়ে সেলিম বিরক্ত হয়। সাথে এটাও বুঝে যায় এই ছেলে জবাব দেবে না।
” আমার মেয়ের চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে বিয়ের জন্য প্রস্তুতি নে।

বলেই সেলিম চলে যায়। ছোঁয়া সাদির রুমে আসছিলো। সেলিমকে দেখে চুপটি করে ফুলদানির পেছনে লুকিয়ে পড়ে। কারণ বাবা একটু আগে পই পই করে বলে দিয়েছে “সাদির আশেপাশে না যেতে”
বাবা তো আর জানে না তার মেয়ে সাদির সাথে পালানোর প্লানিং করছে৷
সেলিম সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই ছোঁয়া পা টিপে টিপে সাদির রুমে ঢুকে পড়ে। রুমে সাদিকে না দেখে বেলকানিতে চলে যায়।
সাদিকে রেলিং এর ওপর বসে থাকতে দেখে বুক কেঁপে ওঠে ছোঁয়ার। আতঙ্কে উঠে সাদির হাত ধরে টেনে নিচে নামায়। সাদি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে। ছোঁয়ার হাত পা কাঁপছে। ঠিক ভাবে শ্বাস টানতে পারছে না মেয়েটা। যেনো এই মুহুর্তে ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে।

সাদি দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে। এই টুকুনি মেয়ে এতোটা গভীর ভাবে কি করে ভালোবাসতে পারে ভেবে পায় না সাদি।
“আই এম ওকে

সাদির কথায় ছোঁয়া ছলছল চোখে তাকায় সাদির দিকে।
” এখানে আর বসবেন না প্লিজ।
সাদি ফোঁস করে শ্বাস টেনে বেলকনিতে থাকা চেয়ারে বসে পড়ে। চোখ দুটো বন্ধ করে প্রশ্ন করে
“ভেবেছো?

” নাহ
আমার ভাবতে হবে না। আমি আপনার সঙ্গ চাই না, আপনার সঙ্গী হতে চাই। আপনার ভালো সময়ে না আপনার খারাপ সময়ে আপনার কাঁধে হাত রাখতে চাই। পাশের রুম কেনো আমাকে কিচেনে থাকতে দিলেও হবে। আপনার থেকে কখনো কিছু পাওয়ার আশা করি না আমি। আপনাকে শুধু দিতে চাই। অফুরন্ত ভালোবাসা দিয়ে আপনার জীবনটা রাঙিয়ে দিতে চাই।

সাদি মন দিয়ে ছোঁয়ার কথা শুনে। কিন্তু সাথে সাথে কোনো জবাব দেয় না। মনে মনে কিছু একটা চিন্তা করে বলে
“পার্লারে চলে যাও। সেখান থেকে সামির তোমায় নিয়ে আসবে।
ছোঁয়া মাথা নারায়।
সে ভীষণ খুশি। দুটো লাফ দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সাদি সামনে বলে পারছে না।

” আর শুনো
জেনে বুঝে আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছো। পরে আফসোস করতে পারবে না।

ছোঁয়া সাদির ঘন কালো চাপ দাঁড়ির দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়
“আফসোস যখন করবো তখন নাহয় বাবু সোনা বলে আফসোস মিটিয়ে দিয়েন।

বলেই ছোঁয়া এক দৌড়ে চলে যায়। সাদি ছোঁয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।

__

ছোঁয়া সেলিমকে পার্লারে যাওয়ার কথা বলতেই তিনি না করে দেয়। কিন্তু তার এই না বেশিখন টিকে থাকে না। ছোঁয়ার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করা তার মনটা গলিয়ে দেয়। অনুমতি দিয়ে দেয় পার্লারে যাওয়ার।
ছোঁয়ার সাথে পার্লারে যাচ্ছে সাদির মামাতো বোন সুইটি।
সিমিকেও যেতে বলেছিলো কিন্তু সিমি যাবে না। সে বাড়িতেই সেজে নিবে।
তাকে সাজাবে সিফাত।
এদের ভালোবাসা দেখে ছোঁয়া বরাবরই মুগ্ধ হয়। ছোঁয়ার থেকে নয় বছরের বড় সিমি। ছোঁয়া ছোট থেকেই দেখছে তাদের ভালোবাসা। এই দুটো মানুষকে কখনোই ঝগড়া করতে দেখে নি ছোঁয়া। একটু কথা কাটাকাটি ও হয় নি। মাঝেমধ্যে সিমি রেগে গেলে সিফাত চুপচাপ অভিযোগ শোনে আর সিফাত রেগে গেলে সিমি চুপচাপ শুনে। রাগ পড়ে গেলে আবার সরি বলে দেয়।
ছোঁয়া প্রাণ ভরে দোয়া করে বোনের জন্য। সারাজীবন তারা এইভাবেই থাকুক।

__

ছোঁয়ার সাজা হয়ে গেছে বেশ কিছুখন আগে। এখন সুইটি সাজছে। ছোট্ট পার্লার। নতুন নতুন দিয়েছে। এখানে সাজানোর লোক একজনই। তাই আগে পড়ে সাজতে হচ্ছে।
ছোঁয়া বাইরে একটু উঁকি দিয়ে দেখে সামির দাঁড়িয়ে আছে।

” সুইটি আপু তুমি সাজো আমি একটু আসছি।

সুইটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ছোঁয়া বেরিয়ে যায়। সামির বাইক নিয়ে এসেছিলো। সামিরের বাইকে বসে মুহুর্তেই হাওয়া হয়ে যায়।

কাজি অফিসের সামনে বাইক থামে। ছোঁয়া বাইক থেকে নেমেই এক দৌড়ে ভেতরে ঢুকে যায়। সেখানে আশিক শিপন আর দুটো মেয়ে। এদেরও চেনে ছোঁয়া। সাদির বন্ধু। রিমি এবং আফরা।
সাদি বাড়িতে পড়ার টিশার্ট আর টাউজার পড়েই এসেছে। ছোঁয়া গিয়ে রিমির পাশে দাঁড়ায়।

“আপু আমাকে কিউট লাগছে না?

ঘুরে ঘুরে রিমিকে দেখাতে থাকে।

রিমি কিছু বলতে যাবে তার আগেই সাদি ধমক দিয়ে বলে ওঠে
” চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক ইডিয়েট

ছোঁয়া মুখ বাঁকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। এখনই বিয়ে করবে তবুও ধমক দিতে হবে। বজ্জাত লোক একটা।
একটু পরেই কাজি চলে যায়। নিয়ম মেনে দুজনের বিয়ে পড়িয়ে দেয়। ছোঁয়ার ঠোঁটের কোণা থেকে হাসি সরছেই না। সে আজকে ভীষণ খুশি। এতোদিনের কান্নার ফল বুঝি আজকে পেয়ে গেলো?

সাদি আর ছোঁয়া পাশাপাশি বসানো হয়েছে।
ছোঁয়া সাদির দিকে একটু চেপে বসে ফিসফিস করে বলে
“দেখলেন আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো? বলেছিলাম না আপনাকে আমিই পাবো? পেলাম তো?

সাদি জবাব দেয় না। তাকিয়ে থাকে সদ্য বিয়ে করা বালিকা বধুর দিকে।

চলবে

হৃদয়হরণী পর্ব-১০+১১

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:১০
#তানিশা সুলতানা

সাদির বিয়ের দিন ঘনিয়ে এসেছে। আজ বাদে কাল গায়ে হলুদ। সাবিনা সবার জন্য জামাকাপড় কিনেছে। কিনেছে সাদির জন্যও। সামির সাদিকে ধরে বেঁধে দুইবার শপিং এ নিয়ে গেছে। কিন্তু বেচারা সাদি কিছুই কেনে নি৷ জোর করেও তাকে একটা জিনিস কেনাতে পারে নি। শেষে বাধ্য হয়ে সামির নিজের পছন্দে সাদির জন্য কয়েকটা পাঞ্জাবী কিনে আনে। বিয়েতে শেরওয়ানি পড়তে হয় বেচারা সাদি ভুলেই গিয়েছিলো।
এক চোট বকা খেয়েছে সে সাবিনা বেগমের কাছ থেকে।
সাবিনা ছোঁয়ার জন্য কলাপাতা রংয়ের শাড়ি কিনেছে। তার মধ্যে হলুদ রংয়ের ফুল। শাড়িটা বেশ সুন্দর।
সবাই মিলে কেনাকাটা দেখছে। সাদির একমাত্র ফুপি সুমি এবং তার দুই ছেলে ইমন আর রিমন তারাও এসেছে।
ইমন অনার্স পড়ছে আর রিমন ছোঁয়ার সমবয়সী। ওদের তিনজনের খুব ভাব। মনের কথা একে অপরের সাথে খুব ভালো ভাবেই শেয়ার করতে পারে।

সাদি এক পাশে পরিকে কোলে নিয়ে বসে আছে। এসব কেনাকাটাতে তার মন নেই ইন্টারেস্টি ও নেই।
ছোঁয়া আড়চোখে বারবার সাদিকে দেখছে। আজ বাদে কাল লোকটা অন্য কারো হয়ে যাবে। তার পাশে অন্য কেউ থাকবে।
মস্তিষ্কে এসব ঘুরপাক খেলেও মন বলছে অন্য কথা। মন বারবার বলছে “সাদি তোর ছোঁয়া। সে অন্য কাউকে বিয়ে করবে না। তুই দেখে নিস”

ইমন ছোঁয়ার মাথায় গাট্টা মেরে বলে
“কিরে ছ্যাঁকা খাইছিস না কি?

ছোঁয়া সাদির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে
” বিচ্ছেদ তো তাদের হয় যারা সম্পর্কে জড়ায়। আমি তো মায়ায় জড়িয়েছি। আর তিনি আমাকে অবহেলায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে। প্রাণ থাকতে আমাদের বিচ্ছেদ হবে না”

ছোঁয়ার ভাড়ি কথা বোঝে না ইমন। সে বুঝতে চায়ও না। তার মতে ছোঁয়া সারাক্ষণ ভুলভাল বকে।
“তা ভাবি ছেলের বউ কেমন?
সুমির কথা শুনে সাবিনা মুচকি হাসে
” আলহামদুলিল্লাহ ছোট আপা। বউ আমার মাশাআল্লাহ।

সাদি পরিকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
“যতটা ভালো হলে হবু শাশুড়ীকে ঝাঁড়ি দিয়ে কথা বলতে পারে।

বলেই সাদি চলে যায়। সাবিনার হাসি মুখটা চুপসে থাকে। থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সিমি এগিয়ে এসে বলে
” মা কি বলছে এসব? তোমাকে ঝাঁড়ি দিয়েছে?
সাবিনা জবাব দিতে পারে না। চুপ হয়ে য়ায়। সুমি রেগে বলে
“এই মেয়েকে তুমি বাড়ির বউ করতে চাইছো? মাথা ঠিক আছে তোমার?

সাবিনা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
” এতে যদি আমার সাদু ভালো থাকে আমি হাজারটা ঝাঁড়ি খেতেও প্রস্তুত। মেয়েটার কি দোষ বলো? সাদু কথা বলে না। ফোন তুলে না। তাই একটু কড়াভাবে বলেছে।

“হ্যাঁ হ্যাঁ তাই তো। মেয়েটার তো দোষ নেই।
ছোঁয়া তাল মিলিয়ে বলে।
সিমি চোখ পাকিয়ে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়া মুখ বাঁকায়। ছোঁয়া আসলে এই কথা বলতো না কিন্তু সিঁড়ির দিকে সাদিকে দেখেছে তাই বললো।

সাদির বন্ধু বান্ধবরা আজকেই চলে এসেছে। আসলে তারা হাতে হাতো সব কাজ করে দেবে। ছোঁয়া পার্লারে গিয়েছিলো। ফেইস আর চুল গুলো একটু পরিপাটি করে এসেছে।
এখন সে দুই হাতে মেহেদী পড়ে সাড়াবাড়ি ঘুরঘুর করছে। সকলেই কাজে ব্যস্ত। কাল গায়ে হলুদ হাজারটা কাজ পড়ে আছে৷ একমাত্র ফ্রী হচ্ছে ছোঁয়া এবং পরি। পরি তবুও খেলছে। ছোঁয়া সোফায় বসে আছে।
ভীষন পানি পিপাসা পেয়েছে ছোঁয়ার।
সে পরিকে বলে
” মাম্মাম একটু পানি খাইয়ে দাও।

পরি শোনেই না ছোঁয়ার কথা। ছোঁয়া হতাশ হয়। ফোঁস করে শ্বাড টেনে বলে
“আমি কি এবার পানি বীনা মারা যাবো?
তখনই কেউ ছোঁয়ার মুখের সামনে পানির গ্লাস ধরে। ছোঁয়া কথাবার্তা ছাড়া আগে পানি খেয়ে নেয়। তারপর তাকায় পানি দেওয়া ব্যক্তিটার দিকে।
কিন্তু সাদিকে দেখবে কল্পনাও করে নি ছোঁয়া। ছোঁয়ার মুখে পানি ছিলো তা ফোঁস করে ফেলে দেয়। সাদির ওপর পড়ে পানি। দু পা পিছিয়ে যায় সাদি।
দাঁতে দাঁত চেপে বলে
” ইডিয়েট
ছোঁয়া চোখ দুটো একবার বন্ধ করে আবার খুলে বলে
“আপনি এখন কেনো? বিয়ে না করবেন। যান নাচেন গিয়ে। কি গানে নাচবেন ভেবে পাচ্ছেন না? আমি সিলেক্ট করে দিচ্ছি
“বয়স আমার ৫০ পেরিয়েছে ও সজনী গো তোমার গলায় এই বুড়ো মালা দিবে”
দারুণ না গানটা? এই গানেই ডান্স করেন গিয়ে।

সাদি বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। এই মেয়ে এতো ফালতু কথা বলে কি করে?
“কি গান পছন্দ হয় নি? কাপল গানে ডান্স করতে চান? বুড়ো বয়সে কোমর ভাঙ্গবেন আপনি। তখন আপনার সুন্দরী বউ দৌড়ে পালিয়ে যাবে।

সাদি দুই হাতে নিজের চুল টানে। কেনো এসেছিলো সে পানি খাওয়াতে? এর মেয়ের প্রতি একটুও মায়া দেখানো সম্ভব না। আস্ত একটা বেয়াদব মেয়েটা।

সাদি যেতে নেয় ছোঁয়া বলে ওঠে
” বাড়ি তাহলে করছেন ই?
সাদি থেমে যায়। তাকায় ছোঁয়ার দিকে। মেয়েটাকে একটু অন্য রকম লাগছে। চেহারায় অন্য রকম একটা ভাব এসেছে। চুল গুলো একটু বেশিই সোজা লাগছে৷
সাদি চোখ নামিয়ে নেয়
“তোমার বয়স কম। পার্লারে আর যাবে না। মনে থাকে যেনো

বলেই চলে যায় সাদি। ছোঁয়া ফোঁস করে শ্বাস টানে। মানুষটা এমন কেনো? বোঝে না? না কি বুঝতে চায় না?
ভাগ্য কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে? ছোঁয়ার মনের কথাটা কি ঠিক হবে? শখের পুরুষটাকে পেয়ে যাবে ছোঁয়া? জীবনটা সুন্দর হয়ে উঠবে? না কি অন্ধকারে ছেয়ে যাবে?

মাঝরাতে সাদির ফোন বেজে ওঠে। সবেই চোখ দুটো লেগে গিয়েছিলো সাদির। এমন সময় ফোন বাজাতে ভীষণ বিরক্ত হয়। আরও বিরক্ত হয় ফোনের স্কিনের নাম্বার দেখে। মায়া নামের মেয়েটি। বেহায়া মেয়ে বলতে বাধ্য হয় সাদি।
ফোন কেটে আবারও ঘুমানোর চেষ্টা করে সাদি। তখনই ফোনে মেসেজ আসে। কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে মেসেজ অপেন করে।
মায়া নামের মেয়েটি মেহেদী পড়েছে। দুই হাত ভর্তি করে। তার পিক দেওয়া।
তার নিচের একটা পিক দেখে সাথে সাথে সাদি স্কিনশর্ট মারে। আর সাথে সাথেই পিকটা আনসেন্ড হয়ে যায়। সাদি আগেই বুঝেছিলো এমন হবে।
এবার ফোনটা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে সাদি।

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:১১
#তানিশা সুলতানা

শাড়িতেই নারী। শাড়ি পড়লে নারীদের সৌন্দর্য বেরে যায় আসলেই কি তাই?
হয়ত তাই। ছোঁয়া আয়নার সামনে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখছে। তাকে অন্য রকম লাগছে। চোখ মুখ চুল সবটাই তো ঠিক আছে তবুও কেনো অন্য রকম লাগছে?
নাজমা বেগম পেছন থেকে আঁচল ঠিক করে দিচ্ছে। পুরো শাড়িটাই নাজমা বেগম পড়িয়ে দিয়েছে তাকে।
“মা আমাকে কি সুন্দর লাগছে?
ছোঁয়া প্রশ্নটা করেই ফেলে। নাজম বেগন মুচকি হাসে। পিন দিয়ে শাড়ি আটকে মেয়েকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে থুতনিতে হাত দিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখতে থাকে।
“মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ আমার মেয়েটাকে পরির মতো লাগছে।
ছোঁয়া একটুখানি লজ্জা পেয়ে যায়।
পরি কোমরে হাত দিয়ে বলে
” মামনিকে আমার মতো লাগছে?
নাজমা বেগম নিচু হয়ে পরির সামনে বসে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে
“হ্যাঁ
আমার নানুভাইয়ের মতো সুন্দর লাগছে।

বাকি সাজটুকু নিজে নিজেই সেজে নেয় ছোঁয়া। পুরোপুরি রেডি হয়ে আয়নার সামনে দুটো নাচের স্টেপ প্যাক্টিজ করে বেরিয়ে যায়।
মেহমান গিজগিজ করছে। যত আত্নীয় ছিলো সবাই চলে এসেছে। পুরো বাড়িটা সাজানো শেষ। দারুণ লাগছে। চার পাশে চারটা সাউন্ড বক্স বাজছে। তাতে হলুদের গান চালানো। কিছু মেয়েরা চান প্যাক্টিজ করছে।
ছোঁয়ার ভীষণ খুশি খুশি লাগছে। ইসসস কতোদিন পরে এতো সুন্দর একটা বিয়ের আয়োজন৷ কয়েক মুহুর্তের জন্য ভুলেই গিয়েছিলো বিয়েটা তারই হৃদপিন্ডের হচ্ছে। কলিজাটা অন্য কারো হয়ে যাচ্ছে।

সাদি নিজের রুম থেকে বের হবে না। এটাই তার শেষ কথা। সাবিনা অনেক কান্নাকাটি করেও ছেলেকে রাজি করাতে পারছেন না। বিয়ে করতে রাজি হয়েছে বলে এসব করতে হবে এটা মেনে নিবে না সাদি। এরকম হৈ-হুল্লোড় তার কোনো কালেই পছন্দ ছিলে না।
সাবিনা নাছোড়বান্দা। সে সাদির খাটে বসে অনবরত কান্না করেই যাচ্ছে। সাদি সাবিনাকে বোঝাচ্ছেও না। সে টানটান হয়ে শুয়ে আছে। যেনো মায়ের কান্নায় তার কিছু এসে যায় না। সাবিনা তাতে বিরক্ত হয়। আর কতো কান্না করবে?
সাদি চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। মানে সে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে
ছোঁয়া তখন এক দৌড়ে ঢুকে পড়ে সাদির রুমে। সাবিনা বেগমের সামনে এসে গোল গোল করে ঘুরতে থাকে
” আমাকে কেমন লাগছে বড় মা?
সাবিনা মুগ্ধ হয়ে দেখে। মাশাআল্লাহ মেয়েটাকে অনেক সুন্দর লাগছে।
সাদিও চোখ খুলে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। তবে এক পলক তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নেয়।

“আমার বাচ্চাটাকে অনেক সুন্দর লাগছে।

বড় মায়ের থেকে এমন প্রশংসা শুনে খুশিতে লাফিয়ে ওঠে ছোঁয়া। সাবিনা আতঙ্কে ওঠে। দুই হাতে ছোঁয়া ধরে
” আল্লাহ সোনা পড়ে যাবি।
ছোঁয়া মুচকি হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ায়।
” বড় মা চলো
আমরা হলুদ দিতে যাবো তো। সবাইকে দেখাবো না সেজেছি। এখানে বসো থাকলে হবে? তোমাকেও তো সাজাবো আমি।
“সাদু যেতে চাইছে না।
বলতে বলতে আবারও তার চোখ ভিজে ওঠে।
ছোঁয়া মুখ বাঁকিয়ে সাদির দিকে এক পলক তাকায়। তারপর কোমরে হাত দিয়ে বলতে থাকে

” উনি যাবে কি করে? উনি তো যেতে পারবে না। কন্ট্রোল বলে একটা বেপার আছে না? সেটা তো ওনার মধ্যে নেই। বাইরে কি সুন্দর ডিজে গান বাজছে যদি উনি নেচে ওঠে? বুড়ো খাটাশ হয়ে সুন্দরী মেয়ে বিয়ে করতে পারছে। পরাণে কুল নেই তো ওনার। খুশিতে যখন তখন নেচে উঠবে। সকলে হাসবে না? তাই উনি যেতে চাচ্ছে না।
তাই না সাদু বেবি?

সাদি চোখ পাকিয়ে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। তাতে মোটেও ছোঁয়া ভয় পায় না। কে উনি? কেনো ভয় পাবে? হুহহহহহ
সাবিনা মুখ গোমড়া করে ফেলে। মনে মনে একবার চিন্তা করে “বাই এনি চান্স যদি এই মেয়ের সাথে তার ছেলের বিয়ে হয়। তাহলে তো সারাক্ষণ বুড়ো বুড়ো করেই মেরে ফেলবে”
শুকনো ঢোক গিলে সাবিনা। না না এমন অলুক্ষণে কথা চিন্তাও করা যাবে না।

তিনি সাদিকে বলে
“শেষ বার বলছি যাবি না?
সাদি জবাব দেয় না। মানে সে যাবে না। দুনিয়া উল্টে লেগেও সে যাবে না।
ছোঁয়া সাবিনার কানে কানে বলে
” বড় মা টেনশন নিও না। আমি টুপ করে ধুকে টাপ করে ওনাকে হলুদ মাখিয়ে শো করে চলে যাবো। তোমার বুড়ো ছেলে বুঝতেও পারবে না।।

সাবিনা একটু ভরসা পায়। হেসে বেরিয়ে যায়। ছোঁয়া দরজা ওবদি গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়। পেছন ঘুরে তাকায় সাদির দিকে।

“হেই করলার বংশধর লুক এট মি

সাদি তাকায় ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়া নিজের হাতে থাকা চমশা চোখে লাগিয়ে বলে
” ভালোবাসা হারানোর ভয়ে দেবদাস আমি হবো না। আপনাকে জন্মের বিয়ে করাবো আমি। বিয়ের সাধ একদম মিটিয়ে দিবো। জাস্ট ওয়েট এন্ড সী

ছোঁয়া চলে যায়। সাদি নিজের ফোনটা হাতো নেয়। যাক তার প্লানিং সাকসেসফুল হলো তাহলে। বাকিটা ইডিয়টটাই করে দিবে।

বর ছাড়া হলুদের প্রোগ্রাম থেমে নেই। ছোঁয়া একাই মাতিয়ে রেখেছে। ক্যামেরা ম্যান কড়া গলায় বলেছে তার ফোকাস থাকবে ছোঁয়ার দিকে। বাকিদের পিক তোলা বাদ। শুধু ছোঁয়ার পিক তুলতে হবে। এ নিয়ে এক চোট ঝগড়া করেছে সাদির মামাতো বোন সাইফার সাথে।
তখন ছোঁয়ার বাবা সেলিম এসে ঝগড়া থামিয়েছে। ছোঁয়ার হাত ধরে নিয়ে গেছে তাকে খাওয়াতে। আর বাকিদের ইশারা করেছে পিক তুলতে।

সাদির বন্ধুরাও সাদিকে এক চোট টানাটানি করে গেছে। কিন্তু সে যাবেই না। সকলেই হতাশ।
ছোঁয়া এই ফাঁকে দুই হাতে হলুদ নিয়ে সাদির রুমের দিকে হাঁটতে থাকে। আজকে ব্যাডাকে এমন হলুদ মাখাবে যে বিয়ের ভুত মাথা থেকে নেমে যাবে। চোখেও হলুদ ঢুকিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে ফেলে।
শয়তান বেডা ছোঁয়াকে কষ্ট দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবে? এবার অন্ধ হয়ে পড়ে থাকবি ঘরে।

সাদি লাইট বন্ধ করে শুয়ে আছে। ছোঁয়া পা টিপে টিপে রুমে ঢুকে পড়ে। বেশ অন্ধকার রুমটা। ঠিকঠাক ভাবে দেখা যাচ্ছে না কিছুই। লোকটা ঘুমিয়ে আছে কি না জেগে আছে সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। আন্দাজে বিছানার কাছে আসে। হালকা বোঝা যাচ্ছে সাদি শুয়ে আছে।
ছোঁয়া আন্দাজে হাত দুটো এগিয়ে নেয়। সাথে সাথে সাদি ছোঁয়ার হাত দুটো ধরে ফেলে। এক টানে ছোঁয়াকে বিছানায় ফেলে দেয়। এক হাতে ছোঁয়ার দুই হাত মাথার ওপরে নিয়ে শক্ত করে ধরে। ছোঁয়া কিছু বলার জন্য হা করে। কিন্তু সাদির কান্ডকারখানা দেখে শব্দ করতেও ভুলে গিয়েছে।
ছোঁয়ার হাত থেকে হলুদ নিয়ে সাদি ছোঁয়ার সারা মুখে মেখে দেয়। মুখেও ঢুকে যায় হলুদ। ছোঁয়া ছুটাছুটি শুরু করে দেয়। শক্তি প্রয়োগ করে উঠতে যায়। তখনই একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যায়। সাদির হলুদ মাখানো হাতটা ছোঁয়ার পেটের ওপর পড়ে। কেঁপে ওঠে দুজনই। সাদি ছোঁয়াকে ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। সাদি ঘনঘন শ্বাস টানছে। এরকম লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে সে কখনোই পড়ে নি।
ছোঁয়াও বসে পড়ে। মুখ থেকে হলুদ বের করে।

রাগে গজগজ করতে করতে তাকায় সাদির দিকে
“কি করলেন এটা আপনি? এই হলুদ উঠবে এখন? আমার এতো সুন্দর মুখটা।

সাদি কপাল চুলকে জবাব দেয়
” শাড়ি সামলাতে না পারলে পড়বে না। এখান থেকে যাও

চলবে

হৃদয়হরণী পর্ব-৮+৯

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৮
#তানিশা সুলতানা

মায়া নামের মেয়েটি একের পর এক কল করে যাচ্ছে। এভাবে ফোনে কথা বলার অভ্যাস সাদির নেই। সে কথা বলতে চায় না। কল কেটে দিচ্ছে বারবার তবুও কল করে যাচ্ছে।
সাদির বিরক্ত আকাশ ছুঁই ছুঁই। মেয়ে মানুষ এতোটা নিলজ্জ কি করে হয়?
বিয়ে ঠিক হয়েছে ভালো কথা। বিয়ে তো হয়ে যায় নি তাই না? এভাবে কল করার মানে কি? অপর পাশের মানুষটা বিরক্ত হতে পারে এদিকে কি বিন্দু মাত্র খেয়াল নেই?

ছোঁয়াকে ডেকেছিলো মায়ার সাথে কথা বলানোর জন্য। মায়াকে বলার জন্য যে সাদি এটা পছন্দ করে না। কিন্তু ইডিয়েট টা আসলোই না। উল্টো হাতে কামড়ে দিলো।
দাঁতে চওড়া দাগ বসে গেছে হাতে। ফর্সা হাতটা লালচে হয়ে গেছে।
সাদি হাতের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা চর মারতে।
তখনই সাজ্জাদ রুমে ঢুকে হাতে ল্যাপটপের প্যাকের এবং ফোনের প্যাকেট নিয়ে।

“আব্বা কি করছো?

সাদি জবাব দেয় না। বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে।
সাজ্জাদ জিনিস গুলো খাটের ওপর নামায়।
” দেখো তো বাবা পছন্দ হয় কি না? শো রুমে গিয়ে তো বলেছিলাম সব থেকে বেস্টটা দিতে।

সাদি সাজ্জাদের পাশে বসে। প্যাকেট খুলে দেখতে থাকে। নাহহ খুব ভালো হয়েছে। এগুলোই কিনতে চাইছিলো সে। মনে মনে খুশি হলেও প্রকাশ করে না। মুখটা গম্ভীর করেই থাকে।
“ধন্যবাদ

সাজ্জাদ হাসে
” চাকরির পরিক্ষা দিচ্ছো?
“জ্বী। মাল্টিনেশনাল কোম্পানিতে চাকরি পেয়ে গেছি। ১ তারিখ জয়েন করবো।
” বাড়িতেই থাকবে তো?
“নাহহ সামনে সপ্তাহেই চলে যাবো। বাসা দেখে ফেলেছি।

সাজ্জা আর বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। ইচ্ছে করছে বলতে থেকে যাও না এখনে। অফিস তো কাছেই। কিন্তু বলতে পারে না। তার ছেলে থাকবে না যে।
” ওই মেয়েটিকে বলে দিবেন আমাকে যেনো কল না করে।
সাজ্জাদ চট করে ধরে ফেলে কার কথা বলছে।
“কিন্তু বাবা সে তো দুইদিন পরে তোমার বউ হবে।
” তো?
সাজ্জাদ আরকি বলবে?
“ঠিক আছে বলে দিবো।

ততখনে সাদি ছোঁয়ার ফোন থেকে নিজের সিম খুলতে শুরু করে দিয়েছে। সিম খুলে ছোঁয়ার সিম লাগিয়ে সাজ্জাদের হাতে দেয়।
” এটা ওকে দিয়ে দিবেন।

সাজ্জাদ ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে যায়। মাথায় তার হাজারটা চিন্তা। ছেলেকে তো বিয়ে করাচ্ছে সংসার কি করবে? মেয়েটা ভালো থাকবে তো? সাদি কি মেনে নিবে মেয়েটাকে?

সাদি ল্যাপটপ দেখছে তখনই সামির হুরমুরিয়ে ঢুকে পড়ে। সাদির পাশে এসে ধাপ করে বসে পড়ে।
সাদি ভ্রু কুচকে তাকায় সাদির দিকে। এই সময় তো ওর এখানে আসার কথা না?
সাদির তাকানো দেখে সামির দাঁত কেলায়
“আসলে হয়েছে কি বল তো? তোকে নিতে এলাম

সাদি জবাব দেয় না। চুপচাপ কাজ করতে থাকে
সাদির এটেনশন না পেয়ে সামির সাদির সামনে থাকা ল্যাপটপ বন্ধ করে দেয়।
” আরে ইয়াররর আমার কথা শোন।
সাদি বিরক্ততে চোখ মুখ কুঁচকে বলে
“ডোন্ট ডিস্টার্ব সামির। কাজ করছি।
“কাজ বাদ দে ভাই। বিয়ে নিয়ে ভাব আগে। দেখ ভাই বিয়ে কিন্তু জীবনে এক বারই করবি৷

” ইডিয়েটটা পাগলামি না করলে বিয়ে করতামই না। জাস্ট ওকে থামানোর জন্য বিয়ে।

সামির গালে হাত দিয়ে বসে। সাদির কথার মিনিং সে বুঝতে পারে নি। কাকে থামানোর জন্য বিয়ে করছে সে? তবে জিজ্ঞেস করলে সাদি জবাব দেবে না। তাই বলে
“আচ্ছা বুঝলাম। এবার আমাকে থামানোর জন্য শপিং এ চল। শিপন রনি আসিফ ওরাও আসবে। জমিয়ে আড্ডা দিবো।

সাদি না করে না। সারাক্ষণ রুমে বন্ধ থাকতে তারও ভালো লাগছে না। একটু মাইন্ড ফ্রেশ করানো দরকার।
তাই আর কথা না বাড়িয়ে রেডি হয়ে নেয়। সামির তো ভীষণ খুশি।

ছোঁয়া বেরিয়েছে একটু। সারাক্ষণ রুমে বসে থাকতে ভালো লাগছে না তার। আশেপাশে একটুখানি ঘুড়ে দেখার জন্য বেরিয়েছে। কিছু কেনাকাটাও করবে।
বাড়ি থেকে বের হতেই দেখতে পায় ফুসকা মামা। ছোঁয়াকে আর পায় কে? এক দৌড়ে চলে যায় ফুসকা খেতে। বেশি করে ঝাল দিয়ে দুই প্লেট ফুসকা অর্ডার করে।
বেশ আয়েশ করে বসে পড়ে চেয়ারে। আরেকটা চেয়ার সামনে রেখেছে। সেটায় ফুসকা প্লেট নামিয়ে খাবে।
খুব তাড়াতাড়ি ফুসকা চলে আসে। আর ছোঁয়া খেতে শুরু করে দেয়। আহহহা কি ইয়াম্মি। দুই আঙুলে ফুসকা তুলে তা টক পানিতে চুবিয়ে মুখে পুরে নেয়। তারপর চোখ দুটো বন্ধ করে চিঁবতে থাকে ফুসকা।

ফুসকা খাওয়ার মাঝেই ছোঁয়া খেয়াল করে একটা ছেলে তাকে দেখছে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত স্ক্যান করছে। শেষ ফুসকাটা মুখে পুরে উঠে দাঁড়ায় ছোঁয়া। সোজা গিয়ে দাঁড়ায় ওই ছেলের সামনে।
ছেলেটা হকচকিয়ে যায়।
” চেহারায় মধু মিশিয়েছি? না কি বিশ্ব সুন্দরী নায়িকা আমি?

ছেলেটা কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। আমতাআমতা করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।

“কি জবাব দিন। আপনার জন্য ভালো করে খেতে পারি নি আমি জানেন? দেখছেন খাচ্ছি। তাও ডিস্টার্ব করতে হবে? মানুষ না আপনি? বাড়িতে খেতে পারছি না এক জ্বালায় এখানে এসে খেতে পারলাম না আপনার জ্বালায়।

ছেলেটা ছোঁয়ার প্লেটের দিকে তাকায়। একটু টক পানিও বেঁচে নেই। তবুও খেতে পারলো না?

” শুনুন মিস্টার। আমি ছোঁয়া চৌধুরী। আমার দিকে এক বার তাকিয়েছেন ভালো কথা দ্বিতীয় বার তাকানোর সাহস করবেন না। চোখ গেলে দিবো একদম। এতো মেয়ে দেখতে ইচ্ছে হলে বিয়ে করে বউকে সামনে বসিয়ে রাখবেন। অন্যের বউয়ের দিকে নজর দিলে একদম চোখ তুলে হাতে ধরিয়ে দিবো। চিনে রাখবেন আমায়।
যতসব

বলেই ছোঁয়া গটগট করে চলে যায়।
সাদি সামির আসিফ একটুখানি দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিলো। সামির তাকিয়ে আছে সাদির দিকে।
শিপন শুকনো ঢোক গিলে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“এটা মেয়ে না ভাঙা রেডিও?
সামির এক গাল হেসে বলে
” সাদির বোন বলে কথা। এমন হবে না?
“কিহহহ সাদির বোন?
আসিফ খানিকটা জোরে বলে ওঠে

” কাজিন

বলেই সাদি হাঁটতে শুরু করে। এসেছিলো শপিং করতে। কিন্তু এখানে থামতে হয়েছে শিপনের জন্য। তার আসতে লেট হচ্ছিলো।

ছোঁয়ার কাছে ভাংটি টাকা নেই। হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দিয়েছে ফুসকা ওয়ালাকে। ফুসকা মামা বলছে তারও ভাংটি নেই। ছোঁয়ার মেজাজ এমনিতেই খারাপ। এখন ভাংটি নেই বলে মেজাজ আরও বিগড়ে যায়
“মামা ভাংটি না থাকলে ফুসকা বিক্রি করতে আসেন কেনো? আপনার মনে রাখা উচিত আমার মতো বড়লোক মানুষও ফুসকা খেতে আসে। এক হাজার কেনো লাখ টাকার ভাংটি রাখা উচিত আপনার। এভাবে খেয়ে দেয়ে ঝগড়া করার মানে হয়?

ফুসকা মামা তাকিয়ে আছে।
” এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। যান এটা ভাংটি করে নিয়ে আসুন। ততখনে আমি দোকান দেখছি।

“আমি কেনো ভাংটি আনবো? আপনি আনবেন।

” আমি কেনো আনবো? টাকা নিবেন আপনি। আমার তো ভাংটি দরকার নেই। আপনি টাকা না নিলে আমারই ভালো।

সাদি এগিয়ে আসে। পকেট থেকে একশত টাকার নোট বের করে দেয়। ছোঁয়া সাদির দিকে তাকায়
“এক্সকিউজ মি অচেনা বেডা
আপনি কেনো আমার টাকাটা দিয়ে দিচ্ছেন? আপনার টাকার ফুসকা আমি খাবো না। দরকার পড়লে বমি করে বের করে দিবো।

সাদি ফুসকা মামার থেকে একশত টাকা নিয়ে নেয়। তারপর ছোঁয়ার থেকে হাজার টাকা নিয়ে একশত টাকার ১০ টা নোট ধরিয়ে দিয়ে চলে যায়। ছোঁয়া মুখ বাঁকিয়ে টাকা দেয়।

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৯
#তানিশা সুলতানা

পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ আছে যারা একা একাই মজা করতে জানে, ঘুরতে জানে। যাদের বন্ধুর প্রয়োজন পড়ে না। সেই সমস্ত মানুষের তালিকায় ছোঁয়াও পড়ে। তার তেমন কোনো ভালো বন্ধু নেই৷ হ্যাঁ কলেজে কয়েকজন ছিলো। যাদের সাথে হাই হ্যালো পর্যন্তই সম্পর্ক।
বন্ধু নেই বলে কিন্তু ছোঁয়া পিছিয়ে নেই। সে একা একাই মজা করতে জানে।
এই আজকে ঘুরতে বেরিয়েছে। পুরো শহরটা একা একাই চক্কর দিয়েছে। সেই বিকেলে ফুসকা খেয়েছিলো এখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। খিধেও পেয়েছে। রাস্তার পাশে সুন্দর একটা রেস্টুরেন্ট। বাইরে থেকেই কি সুন্দর দেখাচ্ছে।
ছোঁয়া টুপ করে ঢুকে পড়ে। মোমো আর কোল্ড কফি অর্ডার করে চুপচাপ বসে থাকে। ফোনটাও সাথে নেই যে একটু দেখবে। কেমন এতিম এতিম লাগছে। সবাই কি সুন্দর পার্টনার নিয়ে এসেছে। ছোঁয়া মনে মনে ভেবে ফেলে এবার একটা পার্টনার বানাতেই হবে।
আর একা একা নাহহ

“আরেহহহ তুমি ছোঁয়া না?

মাথা তুলে তাকায়। মেয়েটাকে একবার দেখাতেই চিনে৷ ফেলে। এটাই তো সাদির হবু বউ মায়া। ছোঁয়া জবাব দেয় না। মায়া ছোঁয়া পাশে বসে। তারপর একটা ছেলেকে বলে
” ভাইয়া আমার হবু ননদ।

ছেলেটা এক গাল হেসে ছোঁয়ার সামনাসামনি বসে
“হাই আমি নিবর
ছোঁয়া মাথা নিচু করে ছোট্ট করে বলে
” আমি ছোঁয়া।
“বাহহহ খুব সুন্দর নাম। তা একা কেনো?
” আমি একা ঘুরতেই পছন্দ করি।
ছোঁয়ার জবাবে ছেলেটা অসন্তুষ্ট হয়। মনে হচ্ছে জোর করে কথা বলছে।
“ছোঁয়া তোমার ভাইয়া কোথায়? কখন থেকে ওয়েট করছি আসছেই না।
” জানি না।
ছোঁয়ার চোখ দুটো টলমল করছে। ওহহ তাহলে এখন এরা এখানে দেখা করবে?।যতই নিজেকে বোঝাক না কেনো অবুঝ মনটা বোঝে না৷ এই সব বিষয় গুলো মানতে কষ্ট হয়।
সালার কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি। যার থেকে বাঁচার জন্য একটুখানি শান্তি খুঁজতে বাইরে এলো পদে পদে তার সামনেই পড়তে হচ্ছে।

“তোমার ভাই টা এমন কেন বলো তো? কতোবার কল করলাম নো রেসপন্স। কতো টেক্সট করলাম। কথাই বলতে চায় না। আরেহহ বাবা আমি তার হবু বউ না? আমার সাথে একটু কথা বলবে না?

মায়ার কথায় ছোঁয়া কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ওয়েটার তার খাবার দিয়ে যায়। সে চুপচাপ খেতে শুরু কর।
নিরব ছোঁয়াকে দেখছে। বেশ মনে ধরেছে তার।
মায়া বিরক্ত। মেনার্স জানে না মেয়েটা। হবু ভাবিকে সামনে বসিয়ে গান্ডেপিন্ডে গিলে যাচ্ছে। ভাইয়ের সামনে খানিকটা অপমানিত বোধ করে সে।
কোনো কথা না বলে উঠে যায়। ছোঁয়া তবুও কিছু বলো না।

রাত আটটার দিকে বাসায় ফেরে ছোঁয়া। সিমিকে বলে বেরিয়েছিলো তাই আর কেউ কিছু বলে না। নিজের রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই সাদি ঢুকে পড়ে ছোঁয়ার রুমে। ছোঁয়া হুরমুরিয়ে উঠে বসে।
মায়ার সাথে ভালো ভাবে কথা বলে নি বলে হয়ত সাদি তাকে কথা শোনাতো এসেছে। এটাই ভেবে নেয় ছোঁয়া।
লম্বা দম নিয়ে বলতে শুরু করে
” আপনার বউয়ের ভাইকে যে দু ঘা দেই নি এটাই আপনার ভাগ্য। আমি সবার সাথে কথা বলতে পারি না। মানুষ চিনে কথা বলি। আপনার বউয়ের ভাইয়ের নজর খারাপ। আপনার বউকেও আমার ভালো লাগে না। তাই কথা বলি নি৷ আপনার বউ বলে তাকে মাথায় উঠিয়ে নাচতে আমি পারবো না।

এক দমে কথাগুলো বলে থামে ছোঁয়া। সাদি ভ্রু কুচকে ছোঁয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বেলকনিতে চলে যায়। ছোঁয়াও পেছন পেছন যায়।
সাদির বেলকনি থেকে একটা কলম ছোঁয়ার বেলকনিতে এসে পড়েছে সেটাই নিতে এসেছে সাদি।
ছোঁয়া ভেংচি কাটে।
সাদি কলম উঠিয়ে ছোঁয়া দিকে তাকায়

“ফাস্টলি আমার বিয়ে হয় নি। সেকেন্ডলি বউয়ের ভাই হোক বা অন্য কেউ বাজে নজরে তাকালে চোখ তুলে ফেলবে। বাকিটা আমি দেখে নিবো।

বলেই সাদি চলে যায়। ছোঁয়া আবার বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। প্রতিবাদ করা শিখিয়ে গেলো? ছোঁয়ার হাসি পায়। লোকটা একটু বেশিই আদুরে লাগে। এই এখন ধূসর রংয়েট টিশার্ট এলোমেলো চুলো কতো ভালো লাগছিলো। অধিকার থাকলে আলতো হাতে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দেওয়ার ইচ্ছে জেগেছিলো মনের মধ্যে।
ছোঁয়া বিরবির করে বলে
” যদি ভাগ্যক্রমে আপনাকে পেয়ে যাই। ভালোবাসায় আপনার জীবনটাকে রাঙিয়ে দিবো। আপনার ওই গম্ভীর মুখ খানায় হাসি ফুটাবো।
আই প্রমিজ

প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। তারপর টেবিলে খেয়াল করে তার ফোনটা রাখা। ভীষণ খুশি হয়ে ফোনটা হাতে নেয়। আহহহা এবার শান্তি লাগছে। সব পারা যায় কিন্তু ফোন ছাড়া থাকা যায় না।
বাবাকে ভিডিও কল করে ছোঁয়া। আজকে তাদের আসার কথা ছিলো। কেনো আসলো না?

বাবার সাথে কথা বলা শেষ হতেই সাবিনা চলে আসে ছোঁয়াকে ডাকতে। সবাই খেতে বসবে। সাবিনার মুখটা কালো। এমন তাকে কখনো দেখে নি। আজকে কি হলো? কোনো বিষয় নিয়ে মন খারাপ?
ছোঁয়া সাবিনাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দেয়। সাবিনার কোলে মাথা রেখে আহ্লাদী সুরে জিজ্ঞেস করে
” কি হয়েছে মাম্মা?
সাবিনা ছোঁয়ার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে
“আমার ছেলেটাকে মানুষ করবো কিভাবে? মায়ার সাথে কথা বলে না সে। আজকে রেস্টুরেন্টে অপেক্ষা করেছে সাদি যায় নি। দুদিন পরে বিয়ে হবে। মেয়েটার মনের অবস্থা কেমন হয়েছে ভেবে দেখ? আমাকে কল করে প্রচন্ড কান্নাকাটি করেছে মেয়েটা। আমার এসব ভালো লাগছে না।

ছোঁয়া নিজেও সাদির ভাবনায় বিভোর হয়ে যায়। মানুষটা তো মায়াকে ভালোবেসে বিয়ে করছে না। বা মায়ার প্রতিও তার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। তাহলে মায়ার জায়গায় পাত্রী ছোঁয়া হলে খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো? ভালোবাসা চায় না তার থেকে। সুখের সময়ও তার পাশে থাকতে চায় না ছোঁয়া। সুখটা সে একাই উপভোগ করুক।
শুধুমাত্র দুঃখে, মন খারাপ, একাকিত্বে ছোঁয়াকে সাথি বানালে তাতেই সন্তুষ্ট থাকতো ছোঁয়া।
তাকে সারাজীবন দেখার একটা সুযোগ চেয়েছিলো শুধুমাত্র। এর তো বেশি কিছু না।

সাবিনা আবার বলে ওঠে
” আমি কি ভুল করছি ছোঁয়া?

ছোঁয়া সাবিনার হাতে চুমু খায়।
“তুমি কোনো ভুল করছো না। বিয়েটা তিনি করতে চেয়েছে। এখানে তোমার দোষ নেই। তাছাড়া বিয়ে হয়ে গেলে সবটা ঠিক হয়ে যাবে। তুমি চিন্তা করো না।

ছোঁয়ার কথায় সাবিনার মনটা অনেকখানি হালকা হয়। একটু আশার আলো দেখতে পায় সে।

” খাবি চল
সবাই বসে আছে তোর জন্য।

যদিও পেট ভরা তবুও ছোঁয়া যায়। একটুখানি আড্ডা তো দেওয়া যাবে।
সবাই বসে আছে। গল্প করছে। কিন্তু সাদি সে খেয়ে যাচ্ছে। করলা সিদ্ধ করলা ভাজি আর করলা দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল।
তাও আবার চামচ দিয়ে সাহেবি পদ্ধতিতে খাচ্ছে। ছোঁয়া বড়বড় চোখ করে সাদির প্লেটের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কাটা চামচ দিয়ে করলা ধরে ছুড়ি দিয়ে কেটে মুখে পুরে তারপর অল্প ভাতে ভাজি মিশিয়ে মুখে দিচ্ছে। খুব তৃপ্তি নিয়ে চিবচ্ছে। ছোঁয়ার ভীষণ ইচ্ছে করছে সাদিকে একটুখানি জ্বালাতে।

ছোঁয়া সাদির সামনাসামনি বসে
“বড় মা তোমার বুড়ো ছেলেকে বলবা মিষ্টি খেতে। সে যে করলার বংশধর। তা যেনো নতুন ভাবির সামনে প্রুফ না করে। এমনিতেই বুড়ো হয়েছে। ভাগ্য ক্রমে নাক বোচা একটা বউ পাচ্ছে। সেই বউ যদি চলে যায় তাহলে সারাজীবন কিন্তু দেবদাস হয়ে কাটাতে হবে।

ছোঁয়ার কথায় সকলে মুখ টিপে হাসে। সাদি শব্দ করে প্লেটে চামচ রেখে তাকায় ছোঁয়ার দিকে।
” ইডিয়েট

“বড় মা তোমার বুড়ো ছেলে স্কুল কলেজ থেকে একটাই ইংলিশ শিখেছে এটা আমরা জানি। তাই তাকে কথায় কথায় ইডিয়েট বলতে না করে দিও। আমরা সবাই জানি। তিনি ইংলিশে কাঁচা৷
জিজু ঠিক বলেছি?

সিফাত আমতা আমতা করে। কি বলবে সে? শালির দিকে টানলে ভাই ক্ষেপে যাবে।
সাদি আর ছোঁয়ার দিকে নজর দেয় না। চুপচাপ খেতে থাকে। ছোঁয়া মনে মনে কয়েকবার বলে ” পাষান পাষন পাষান

খেতে খেতে ছোঁয়া আবার বলে ওঠে
“চাচ্চু ভাবছি বিয়

বাকিটা শেষ করার আগেই সাদি ধমক দিয়ে বলে ওঠে
” আরেকবার বিয়ে শব্দটা উচ্চারণ করলে থাপ্পড়ে গাল লাল করে দিবো। ইডিয়েট
বয়স কতো তোমার?
যখন যেটা মন চাইবে সেটাই না?

সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সাদির দিকে।

চলবে

হৃদয়হরণী পর্ব-৬+৭

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৬
#তানিশা সুলতানা

ছোঁয়া ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে ছিলো। তার মন খারাপ। মনটা কখনো ভালোই হয় না। লোকটার মায়া তাকে এমন ভাবে বস করে রেখেছে য়ে ছোঁয়া আস্তে আস্তে ভালো থাকতেই ভূলে যাচ্ছে। বেহায়া হয়ে গেছে। তার বিয়ের কথা যতবার মাথায় আসছে ততবারই হাত পায়ের কাঁপন বেড়ে যাচ্ছে। কোথাও লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে তাকে।
ছোঁয়া কি করে সয্য করবে? বিকেলে মেয়ে দেখতে যাওয়া হবে। মেয়ে সবার পছন্দ হবে সেটা ছোঁয়ার জানা।
তারপর?
সাদির বিয়ে হয়ে যাবে। মেয়েটা সাদিকে টাচ করবে। সাদির সাথে থাকবে। গম্ভীর মানবটার হৃদয়েও মেয়েটা এক সময় জায়গা করে নিবে। হয়ে উঠবে মেয়েটার হৃদয়হরণী। আর ছোঁয়া সারাজীবন হতাশা নিয়ে বেঁচে থাকবে?

কান্না পায় ছোঁয়ার। ভীষণ কান্না পাচ্ছে। ভীষণ অসহায় লাগছে। কি করবে? কোথায় গেলে সাদিকে পাবে? কার কাছে বলবে? কে সাহায্য করবে?

চোখের পানি মুছে নেয় ছোঁয়া। কেউ দেখলে কি জবাব দেবে?
মন ভালো করতে বাসা থেকে বের হয়। বাড়ির সামনে বিশাল বড় বাগান। এই বাগানটা তুষার চৌধুরী বানিয়েছে। সব ধরণের গাছ আছে এই বাগানে। খুব সুন্দর বাগানটা।

“আরেহহহ তুমি ছোঁয়া না?

ছোঁয়া চমকে পেছনে তাকায়। সাদির সাথে একটা ছেলে। বাইরে থেকে আসলো মনে হচ্ছে। এই ছেলেকে চেনে ছোঁয়া। ছোট বেলায় দেখতো সাদির সাথে। সাদির একমাত্র বন্ধু সে।
” আরেহহ আপনি সামির ভাই না?
ছোট বেলায় সারাক্ষণ আপনার নাকে সর্দি লেগে থাকতো?

সামিরের হাসি মুখটা চুপসে যায়। সাদির সামনে লজ্জায় পড়ে যায় সে।
ছোঁয়া আসলে কথাটা বলতে চায় নি। মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।
” তোমার তো সর্দিতে গাল দুটোও টইটুম্ব হয়ে থাকতো।
এভাবে পাল্টা ছোঁয়াকে ফাঁসানো হবে ছোঁয়া বুঝতেও পারে নি। সাদির সামনে অপমান। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে
“কোথায় গিয়েছিলেন ভাইয়া?
” বন্ধু আমার বউ দেখতে যাবে। তাই পার্লারে নিয়ে গিয়েছিলাম।

মশকরা করে বলে সামির। সত্যিই সেলুনে গিয়েছিলো। ঘন চাপ দাঁড়ি গুলো পরিপাটি করে কেটেছে। চুল গুলোও অনেকটা ছোট করেছে। মেজাজ বিগড়ে যায় ছোঁয়া। সাদির দিকে এক পলক তাকিয়ে চলে যায়।

বেছে বেছে সব থেকে বড় আম গাছটাই উঠে পড়ে ছোঁয়া। ছোট থেকেই গাছে ওঠাতে পটু ছোঁয়া।
জৈষ্ঠ্যমাস। গাছে পাকা পাকা আমগুলো ছোঁয়ার দিকেই যেনো তাকিয়ে আছে। ছোঁয়া আম খেতে থাকে। আর কাঁদতে থাকে।
মনে মনে সাদিকে হাজারখানা গালি দেয়।
সাদি নিজের রুম থেকে ছোঁয়াকে দেখতে পায়। বিরক্তিতে কপালে তিনটে ভাজ পড়ে তার। একটা মানুষ কতোটা ইডিয়েট হলে এতো বড় গাছে উঠতে পারে?

সাদি বেলকনিতে আসে।
“ওইখান থেকে নামো ইডিয়েট

হঠাৎ সাদির ধমকে চমকে ওঠে ছোঁয়া। আমের আঁটি পুরোটা মুখে ঢুকিয়ে ফেলেছিলো। ফেলে দেয়। গাল ফুলিয়ে বলে
” নামবো না আপনার কি?
“আমি আসলে চাপকে চাপকে নামাবো স্টুপিট।

সাদির ঠান্ডা ধমকে মুখ বাঁকিয়ে নেমে পড়ে ছোঁয়া। লোকটা পাষাণ। ভীষণ পাষান।

বিকেলে সবাই মিলে বের হয়। সাদি যেতে চায় নি। মায়ের জোরাজোরিতে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
গাড়িতে সাদির পাশেই ছোঁয়া বসেছে। অবশ্যই ইচ্ছে করে বসে নি। পরিস্থিতির চাপে বসতে হয়েছে।
সিফাত ড্রাইভ করছে তার পাশে সিমি বসেছে পরিকে কোলে নিয়ে।

“জিজু আমি বিয়ে করবো।

” হ্যাঁ করবে তো। রাজপুত্র এনে দিবো তোমার জন্য।
“আমার এখুনি বিয়ে করতে মন চাচ্ছে।

সিফাত সিমির দিকে এক পলক তাকায়। সিমি দাঁতে দাঁত চেপে বলে ওঠে
“বাবাকে বলবে?
” অবশ্যই বলবা। এখনি কল করো। আমি বিয়ে করবো তো করবোই।

সাদি এতখন চুপচাপ থাকলেও এখন আর পারছে না। মেয়েটা অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করে। সব কিছুতেই তার বাড়াবাড়ি। ইচ্ছে করছে আরেকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। কিন্তু বেপারটা খারাপ দেখায় তাই পারছে না।

“বয়স কতো তোমার?

গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে সাদি।
ছোঁয়া ভেংচি কেটে বলে
” সতেরো বছর দুই মাস পাঁচ দিন বয়স আমার। বিয়ের জন্য পারফেক্ট বয়স। আমার একটা বন্ধুর বিয়ে হয়েছে চোদ্দ বছরে। তার একটা মেয়ে হয়েছে। সেই হিসেবে আমার বিয়ের বয়স পার হয়ে গেছে। এখুনি বিয়ে না করলে পিছিয়ে পড়বো আমি। আমাকে বিয়ে করতে হবে।

সাদি ফোঁস করে শ্বাস টানে। সিফাত শুকনো ঢোক গিলে। পরিও এতোখন ছোঁয়ার কথা শুনছিলো। সে বলে ওঠে
“মাম্মা আমিও বিয়ে করবো।

সিমি হতাশ হয়। সিফাত হেসে ফেলে মেয়ের কথা শুনে।
সাদি পকেট থেকে হেডফোন বের করতে করতে বিরবির করে বলে
” ইডিয়েট

ছোঁয়া আবার বলে ওঠে
“হয় আমাকে বিয়ে দাও। নাহলে বাবার কাছে দিয়ে আসো। আমি এখানে থাকতো চাই না। এসেছিলাম শান্তি পেতে। অশান্তি পেছন পেছন হাজির। আমি না জাস্ট পাগল হয়ে যাচ্ছি।

সাদি ফোনে গান চালিয়ে হেডফোন ছোঁয়ার কানে গুঁজে দিয়ে ফোনটা ছোঁয়ার কোলের ওপর রাখে।
ছোঁয়া বড়বড় চোখ করো সাদির দিকে তাকায়। সাদি চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা ঠেকিয়ে আছে।
সিমি মুচকি হাস। ঠিক করেছে।
রাগে দুঃখে অভিমানে ছোঁয়ার চোখে পানি চলে আসে। কেউ কেনো তাকে বুজছে না?
কেনো?

সাবিনা বেগমের ঠোঁটের কোণা থেকে হাসি সরছেই না। তুষারও বেশ খুশি। মেয়ে তারা আগেও দেখেছে। মাশাআল্লাহ অনেক ভালো মেয়ে। আজকেই আংটি পড়াবে বলে ঠিক করে ফেলেছে।

ড্রয়িং রুমে বসেছে সবাই। ছোঁয়ার ভীষণ বিরক্ত লাগছে। তারা খোশ গল্প শুরু করে দিয়েছে। যেটা ভালো লাগছে না ছোঁয়ার। সাদি নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
একটু পরে মেয়েকে নিয়ে আসা হয়। সাবিনা বেগম আর মমতা বেগমের মাঝখানে মেয়েকে বসানো হয়। কথার এক পর্যায়ে সাদিকে বলা হয় তাকে আংটি পড়িয়ে দিতে।
“মা তুমিই পড়িয়ে দাও।
ছেলের কথায় খুশিতে গদগদ হয়ে সাবিনা আংটি পড়িয়ে দেয় মায়াকে।
বিয়ের কথা ফাইনাল করেই খাবার মুখে তুলবে ওনারা। তাই তাড়াতাড়ি ঠিক করে ফেলা হয়। সামনে শুক্রবারেই বিয়ে।

এবার সাদি এবং মায়াকে আলাদা কথা বলতে পাঠানো হয়।
ছোঁয়ার ভীষণ অস্থির লাগছে। সকালে একটু খেয়েছিলো সারাদিন একটা আম ছাড়া আর পেটে কিছুই পড়ে নি। ছোঁয়া বেশ বুঝতে পারছে যে কোনো মুহুর্তে সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। এখানে সে সিনক্রিয়েট করতে চাই না।

তাই কাউকে কিছু না বলে আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায় এই বাড়ি থেকে। কেউ তাকে খেয়ালই করে না।

গাড়ির কাছাকাছি যেতেই মাথা ঘুরে আসে। চোখ দুটো অন্ধকার হয়ে আসে। গাড়ির চাবি আনে নি সে। ভেবেছিলো গাড়িতে বসে থাকবে। কিন্তু এবার?
এতো কিছু ভাবার সময় ছোঁয়ার হয় না। আস্তে আস্তে ঢলে পড়ে সে। মাটিতে পড়ার আগেই কেউ একজন খুব যত্ন করে ধরে ফেলে ছোঁয়াকে। নরম তুলতুলে দেহ খানা বুকের মধ্যে চেপে ধরে।

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৭
#তানিশা সুলতানা

ছোঁয়াকে গাড়িতে বসিয়ে ফোঁস করে শ্বাস টানে সাদি। ওয়ালেট ফেলে গিয়েছিলো সে। সেটাই নিতে এসেছিলো। ছোঁয়াকে পড়ে যেতে দেখে না ধরে পারে নি।
চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে ছোঁয়া। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। অস্থির লাগছে তার। স্পষ্ট বুঝতে পারছে পাশে সাদি বসেছে কিন্তু কিছু বলতে পারছে না।
ইচ্ছে করছে চিৎকার করে বলতে “আপনি বিয়েটা করবেন না সাদি। প্লিজ বিয়েটা করিয়েন না। আপনাকে অন্য কারো সাথে সয্য করতে পারবো না আমি। কিন্তু গলা দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না।

” আর ইউ ওকে?

সাদি জিজ্ঞেস করে। ছোঁয়া জবাব দেয় না। সাদি ছোঁয়ার দিকে তাকাতেই দেখতে পায় মেয়েটার শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। হাঁসফাঁস করছে মেয়েটা।
সাদি কাঁচ বন্ধ করে এসি চালিয়ে দেয়। ছোঁয়ার গলার সাথে পেঁচানো ওড়নাটা খুলে দেয়। পিঠের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো এলোমেলো ভাবেই ঝুঁটি করে দেয়। পানির বোতলের সিপি খুলে ছোঁয়ার মুখের সামনে ধরে। হা করে পানি খেয়ে নেয় ছোঁয়া।
এবার একটু ভালো লাগছে।
ছোঁয়া ঘাড় বাঁকিয়ে সাদির দিকে তাকায়। কিছু একটা ছিলো ছোঁয়ার চোখে যা সাদিকে অস্থির করে তুলছে।

সাদি নিজের কপালে হাত বুলায়। বলার মতো অনেক কথা থাকলেও সে বলতে পারছে না।
“থাকো আসছি আমি

সাদি নেমে যায়।
ছোঁয়া তাকিয়ে থাকে। মানুষটা চলে গেলো। হারিয়ে যাচ্ছে ছোঁয়ার থেকে৷ অনেক দূরে চলে যাচ্ছে। এখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মায়া ছাঁদের রেলিং ঘেসে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি সাদির দিকেই।
মায়ার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। সাদমান চৌধুরীকে জিতে নিচ্ছে যে। খুশি হবে না? ছোঁয়ার কান্না পায়। কিন্তু এখন আর কাঁদে না।
মনে মনে বিরবির করে বলে
” আমার অনুভূতি যদি মিথ্যে হয় তবে তিনি অন্যের হোক। কিন্তু আমার মনে যদি তার প্রতি অসীম ভালোবাসা থেকে থাকে। সে আমারই হবে। আমার আল্লাহ আমাকে হতাশ করবেন না। আমি তাকে পাবোই পাবো।

ছোঁয়ার খারাপ লাগছে জেনে সিমি চলে আসে। পরিকে রেখে দিয়েছে সাবিনা। সিমি ড্রাইভ করতে জানে। সে ছোঁয়াকে কোনো প্রকার প্রশ্ন না করে ড্রাইভ করে বাড়ি চলে আসে।

পরের সকালটা হয় একদম অন্য রকম। আড়মোড়া ভেঙে চোখ খুলতেই ছোঁয়া একটু হাসে। সারা রাত ভেবেছে। একটা ছেলের জন্য আর যাই হোক এভাবে ভেঙে পড়া ঠিক না। বাবা অনেকবার কল করেছে। ছোঁয়া হাসি মুখে কথা বলতে পারি নি। ছোঁয়া বুঝতে পারে তার জন্য তার বাবারও মন খারাপ। আজকে তিনি আসছে বাড়িতে। আর যাই হোক বাবার সামনে মন খারাপ করে থাকলে বাবা কষ্ট পাবে।

সে বিয়ে করছে করুক। এরকম কান্না কাটি করে তো আর বিয়ে আটকানো যাবে না। কপালে থাকলে এমনিতেই বিয়ে আটকে যাবে। সবটাই ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেকে ফ্রেশ রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে নেয় ছোঁয়া। হাতের ব্যাথা অনেকটাই কমে গেছে। ঘা শুকিয়ে গেছে।
গলায় ওড়না পেঁচিয়ে এক দৌড় দেয় ছোঁয়া। সাদি সিঁড়ি বেয়ে নামছিলো। ছোঁয়া তাকে খেয়ালই করে নি। দৌড়ে নামতে গিয়ে সাদির সাথে ধাক্কা লেগে যায়। সাদি বসে পড়ে। ছোঁয়া গিয়ে সোজা ফ্লোরে পড়ে যায়।
খুব একটা ব্যাথা পায় নি সে। সাদির দিকে এক পলক তাকিয়ে মুখ বাঁকিয়ে উঠে পড়ে ছোঁয়া।
“চোখে দেখেন না? না কি বিয়ের খুশিতে চোখ খেয়ে ফেলছেন? আজাইরা

সাদি দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে যায়। ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকিয়ে সোফায় গিয়ে বসে। বেশ অবাক হয়েছে সে ছোঁয়াকে দেখে। আবার ভালোও লাগছে যাক মেয়েটা তাহলে স্বাভাবিক হয়েছে।

ছোঁয়া রান্না ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে
” বড় মা খেতে দাও। কাল থেকে যে আমি না খাওয়া একবারও তো খোঁজ নিলে না? আমার আপন আপি আপন দাদি আপন বড়বাবা কেউ ই খোঁজ নিলো না আমার।
আমি কি বোঝা হয়ে গেছি? না কি একদিন খাই নি বলে তোমাদের চাল বেচে গেছে কোনটা?

সাবিনা মুচকি হাসে। ছেলের বিয়ের চিন্তায় মেয়েটার কথা ভুলেই গিয়েছিলো তিনি।
সিমি পরোটা নিয়ে ছোঁয়ার সামনে আসে। ছিঁড়ে তাতে ডিম পুরে মুখের সামনে ধরে
“এভাবে খাবো না আমি। আমাকে কি তোমার বাচ্চা মনে হয় না কি? টেবিলে বসে পানি নিয়ে আরামসে খাবো আমি। বাচ্চাদের মতো ঘুরে ঘুরে খাওয়ার স্বভাব আমার নেই।

বলেই টেবিলে গিয়ে বসে ছোঁয়া। সাদি পেপারে চোখ বুলাচ্ছে। ভাঙা রেডিওর জন্য পড়তে পারছে না।
সিমি মুচকি হেসে ছোঁয়ার পেছন পেছন এসে তাকে খাইয়ে দিতে খাবে। খাওয়া শেষে সিমি চলে যায়।
ছোঁয়া টিস্যু দিয়ে মুখ মুছে বলে
” বড় মা আমার জন্য সুন্দর ছেলে দেখবা। ত্রিশ বত্রিশ বছরের খুনখুনে বুড়ো খ্যাটখ্যাটে স্বভাবের ছেলে আমার পছন্দ না
আমি একটা সুন্দরী মেয়ে। আমি সুন্দর স্মার্ট হ*ট ছেলে ডিজার্ভ করি আমি। সেরকম একটা ছেলে জলদি খুঁজে আনো।

সাদি ছোঁয়ার দিকে তাকায়। নিজেকে বুড়ো বলাতে বেশ গায়ে লেগেছে তার। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে তুলে ছাঁদ থেকে ফেলে দিতে। বা দুই চারটা কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু এটা তার স্বভাবের সাথে যায় না।
তাই সরু চোখে তাকিয়েই থাকে। ছোঁয়া ভুলেও সাদির দিকে তাকায় নি।

সাবিনা টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বলে
“ঠিক আছে ঠিক আছে। তুই যা বলবি তাই হবে

” ইডিয়েট

বলেই সাদি চলে যায়। সে এসেছিলো খেতে। কিন্তু তার খাওয়ার মুড চলে গেছে। ছোঁয়া সাদির চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভেংচি কাটে।
সাজ্জাদ এসে ছোঁয়ার পাশে বসে
“মামনি চলো তোমাকে আজকে ভর্তি করিয়ে দিয়ে আসি।
ছোঁয়া চেয়ার টেনে সাজ্জাদের একদম কাছাকাছি বসে
” বড় বাবা তোমার ছেলের ফোন ভেঙে ফেলেছি আমি। ল্যাপটপও ভেঙেছি। সে এখন আমার ফোন চালাচ্ছে। তাকে টাকা দিও বা কিনে দিও। সে তো জীবনেও চাইবে না।

সাজ্জাদ খুশি হয়। তখনই বেরিয়ে পড়ে। তার ছেলের অসুবিধা হচ্ছে নিশ্চয়। জীবনেও সাদি তাকে বাবা বলে ডাকে নি। কখনো কোনো আবদার করে নি। বাবার হাত ধরে স্কুলে যায় নি। ছেলের আবদার পূরণের জন্য অপেক্ষা করে সাজ্জাদ।
তার ছেলেটা এমন স্বভাবের কেনে হলো বুঝতে পারে না তিনি।

ছোঁয়া নিজের রুমে যাচ্ছিলো। প্রথমে সাদির রুম তার পরেই ছোঁয়ার রুম।
সাদি গম্ভীর গলায় বলে
“তোমার সাথে কথা আছে এখানে এসো

ছোঁয়া যেনো কথাটা শুনতেই পায় নি। তেমন ভাব করে চলে যেতে নেয়।
সাদি ছোঁয়ার হাত ধরে
” ইডিয়েট বলছি না কথা আছে।

ছোঁয়া সাদির দিকে তাকায়
“সরি ভাইয়া। আমি দেশের প্রেসিডেন্ট না যে আমার সাথে আপনার কথা থাকবে। আপনার সাথে কথা বলার এতোটুকুও ইন্টারেস্ট নেই আমার। আর আপনার রুমে তো আরও যাবো না। ছোঁয়া চৌধুরী যার তার রুমে যায় না।

বলেই সাদির হাত ছাড়িয়ে নিতে চায়। পারে না। সাদি শক্ত করে ধরে রেখেছে। ছোঁয়া গোল গোল চোখে তাকায় সাদির দিকে
” হাত ছাড়ুন ভাইয়া।

“ড্রামা বাদ দিয়ে এসো
সাদির গম্ভীর গলা
” যাবো না।
বলেই ছোঁয়া সাদির হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। সাদি কোনো শব্দ না করে ছোঁয়ার হাত ছেড়ে দেয়।

চলবে

হৃদয়হরণী পর্ব-৪+৫

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৪
#তানিশা সুলতানা

ছোঁয়া এখনো সেই দৃশ্যটা ভুলতে পারছে না। হাত পায়ের কাঁপন একটুও কমে নি। বুকটা এখনো টিপটিপ করে যাচ্ছে।
লোকটা ভীষণ খারাপ। বাজে একটা লোক। এই লোকটাকে দেখবে না বলে বাবা মাকে ছেড়ে এতো দূরে পাড়ি জমালো। পরিচিত কলেজ পরিচিত বন্ধু বান্ধব সবাইকে ছেড়ে চলে আসলো।
কিন্তু তাতে কি হলো?
লোকটা তো চোখের সামনেই থাকবে। ছোঁয়ার কাছাকাছি। এই লোকটাকে ভুলবে কি করে ছোঁয়া? অনুভূতি থেকে বেরিয়ে আসবে কি করে?
প্রথম অনুভূতি কি এতো সহজে ভোলা যায়?

লোকটাকে ছোঁয়ার ভালো লাগে সেই বাচ্চাসুলভ বয়স থেকে। সবার থেকে আলাদা সে। কথা বলে না হট্টগোল পছন্দ করে না। সারাক্ষণ একা একা থাকে।
মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসলে ঈদ বা কোনো অনুষ্ঠানে তখন দেখতো তাকে।

সেই ভালো লাগাটা পাগলামিতে রূপ নিলো যখন সাদি ছোঁয়ার কলেজে চাকরি পেলো। এবং তাদের ওপর তালায় থাকতো। দূর থেকে দেখতো আর সবাইকে বলে বেড়াতো তার অনুভূতির কথা।

সাদির পাশের রুমটা ছোঁয়ার। সে আপাতত বিছানায় সটান হয়ে বসে আছে। একা একা জামা পাল্টাতে পারবে না সে। তাছাড়া সাদির লোমশ যুক্ত খালি বুকটাকে ভুলতে পারছে না।

আচ্ছা লোকটা যদি ছোঁয়াকে ভালোবাসতো তাহলে কি কাছে টানতো? বিয়ে করে নিতো? তখন?
ছোঁয়া লোকটার হাত ধরতে পারতো। খালি বুকে মাথা গুঁজতে পারতো।

নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয় ছোঁয়া। কয়েকটা গালি দেয় নিজেকে। ছিহহহ
দিন দিন মনটা বেহায়া হয়ে যাচ্ছে।
এই লোকটাকে নিয়ে ভাবা যাবে না। তাকে ইনগোর করতে হবে।
লোকটা তোর জন্য না ছোঁয়া।

সিমি ছোঁয়ার রুমে আসে লাগেজ হাতে। সেখান থেকে জামা বের করতে করতে ছোঁয়াকে বলে
“কেনো আসলি? তুই তো বাবাকে ছাড়া একটা দিনও থাকতে পারিস না। তাহলে?

ছোঁয়া সিমির থেকে কখনো কিছুই লুকাই না। তাই আজকেও লুকালো না৷ বলেই ফেলে
” আমি বন্ধুদের বলেছিলাম সাদু বেবিকে ভালো লাগে। তারা একে একে পুরো কলেজ জানিয়ে দিয়েছে। তার জন্য সাদু আমাকে ক্লাসের সবার সামনে থাপ্পড় মেরেছে এবং বের করে দিয়েছে।

সিমি ফোঁস করে শ্বাস টানে।
“ছোঁয়া তুই বড় হবি কবে বল তো? মানুষকে কেনো জানিয়েছিস? নিশ্চয় তোর জন্য সে টিচারদের সামনেও অপমানিত হয়েছে। সবার হাসির পাত্র হয়েছে। সাদি ভাইয়া একটু অন্য রকম মানুষ।
তুই এটা ঠিক করিস নি।

ছোঁয়া নিজের ভুলটা বুঝতে পারে। সত্যিই তো। ক্লাসের সবাই সাদিকে দেখে হাসতো। ছোঁয়া নিজে কানে শুনেছে একজন স্যার সাদিকে বলেছে ” কি বেপার সাদি? শেষমেশ স্টুডেন্টের সাথে রিলেশন? ইটস নট ফেয়ার ”

সাদি অপমানিত হয়েছে।

শুকনো ঢোক গিলে ছোঁয়া। মনে মনে বলে
“ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলে বেড়ানোটা একদম ঠিক হয় নি। আমার জন্য উনি অপমানিত হলো। ইসসস ছোঁয়া তুই মাথামোটা।

সিমি ছোঁয়াকে জামা পাল্টে বিছানা ঠিক করে দিয়ে চলে যায়।

সকাল সকাল ঘুম ভেঙে যায় ছোঁয়ার। সে আড়মোড়া ভেঙে বাবাকে কল করে। কিছুখন কথা বলে ফ্রেশ হতে গিয়ে খেয়াল করে একা একা পারবে না। নিজের ওপর চরম বিরক্ত ছোঁয়া। ঢং দেখিয়ে কেনো হাত পুড়াতে গেলো?
অসয্য

এতো সকালে সিমি উঠবে না। তাই ছোঁয়া ছাঁদে চলে যায়। ইসসস এতেই যেনো ছোঁয়ার চোখ দুটো চিকচিক করে ওঠে।
সাদি পুশআপ দিচ্ছে। লোকটা রোজ সকালে উঠে এক্সারসাইজ করে। ছোঁয়া চুরি করে দেখতো।
আজকেও তার ব্যতিক্রম নয়। পানি ট্যাঙ্কির পেছনে লুকিয়ে সাদিকে দেখতে থাকে।

হাতা কাটা গেঞ্জি। দুই হাতের পেশি ফুলে উঠেছে। ঘামে সারাশরীর ভিজে জুবুথুবু হয়ে আছে। থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়েছে। ফর্সা পায়ের কালো লোমগুলো যেনো ছোঁয়ার দিকেই তাকিয়ে আছে।
নাক বেয়ে ঘাম পড়ে যাচ্ছে।

ছোঁয়া গালে হাত দিয়ে দেখতে থাকে। নেশা লেগে যাচ্ছে। সাদির নেশা। এই নেশা বোধহয় এই জীবনে আর কাটবে না।
ছোঁয়া দৃষ্টি ফেরাতে গিয়েও পারে না।
চোখ দুটো যে বড্ড বেহায়া।
” ছোঁয়া তোর এই সাদু বেবি যদি দেখে না তুই তাকে চোখ দ্বারা ধ*র্ষ*ণ করছিস। তোকে উল্টো করে গাছে ঝুলিয়ে রাখবে।
নিজেকেই নিজে হুমকি দেয় ছোঁয়া। তবুও কাজ হয় না। তার হুমকিতে মন ভয় পায় না।

সাবিনা বেগম এক মগ কফি নিয়ে ছাঁদে আসে। ছেলের পাশে বসে পড়ে। সাদি টাওয়াল দিয়ে শরীর মুছতে মুছতে কফির মগটা হাতে নেয়। তাতে এক চুমুক বসিয়ে মায়ের দিকে তাকায়
সাবিনা সাদিকে দেখছে। মাশাআল্লাহ ছেলে তার। দেখলেই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

“আব্বা আমার একটা কথা শুনবি?

সাদি জবাব দেয় না। সে কফিতে আরেকটা চুমুক বসিয়ে খানিকটা জোরে বলে
” হেই ইডিয়েট
সামনে আয়

ছোঁয়া মুচকি হেসে আরাম করে বসে সাদিকে দেখতে ছিলো। বড় মা কি বলে শুনতে চায় সে কিন্তু হঠাৎ সাদির ডাকে সে শুকনো ঢোক গিলে নরেচরে বসে। বুঝলো কি করে গোমড়ামুখোটা?

সাবিনা আশেপাশে তাকিয়ে বলে
“কাউকেই তো দেখছি না।

সাদি মন দিয়ে কফি খাচ্ছে। ছোঁয়া দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। লোকটা আর কথা বলবে না জানা আছে তার। একটা কথা যে গলা দিয়ে বেরিয়েছে এতেই ধন্য ছোঁয়া।

সে এক লাফে ট্যাঙ্কির পেছন থেকে বেরিয়ে এসে এক গাল হেসে বলে
” ওহহহ বড় মা তুমি এখানে? আমি তোমাকে সারা বাড়ি খুঁজে শেষ মেষ এখানে চলে আসলাম।

তারপর সাদিকে ভালো করে দেখে বলে
“এ বাবা সাদু স্যার থুক্কু বেবি না না থুক্কু ভাইয়া আপনি এরকম অর্ধেক পোষাক পড়ে আছেন কেনো? ছিহ ছিহ আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছি।

লজ্জা পাওয়ার ভান করে বলে ছোঁয়া। সাদি সরু চোখে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। ছোঁয়া জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। লোকটা কি সুন্দর করে তাকাতে জানে না? আরেহহ ভাই ছেলে মানুষের চোখের দৃষ্টি থাকবে নরম, কোমল। দেখলেই নেশা ধরে যাবে। কিন্তু এনার চোখের দৃষ্টি আগুনের মতো। তাকালেই হাঁটু কাঁপতে শুরু করে।

ছোঁয়া শুকনো ঢোক গিলে বলে
” ববড় মা চলো তো। তোমার সাথে কথা আছে আমার।

সাবিনা সাদির চুলে হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর ছোঁয়াকে বলে
“সাদির সাথে একটু কথা আছে আমার।

ছোঁয়া ফট করে সাবিনার পাশে বসে পড়ে।
” বলো বলো
আমিও শুনতে চাই।

সাবিনা মুচকি হাসে। ছোঁয়াকে এক হাতে টেনে নিজের কাছে নেয়। তারপর বলে
“আব্বা আমি চাইছিলাম তুই বিয়ে কর। তোর একটা সংসার হলে আমি নিশ্চিত মনে মরতে পারবো।

ছোঁয়া বলে
” হ্যাঁ হ্যাঁ আমিও তাই বলি। কতোদিন বিয়ে খাই না। আহহা পেট পুরে খাবো। বলছি কি বড়মা। এতো মেয়ে দেখার কি আছে। হাতের কাছে কতো ভালো ভালো মেয়ে আছে। এই যে আমাকেই দেখো না। কতো সুন্দর কিউট। আমার মতোই একটা মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দাও।

সাবিনা ছোঁয়ার কথায় হাসে। তিনিও চায় ছোঁয়াকে ছেলের বউ বানাতে। কেনো জানি মনে হয় এই মেয়েটাই পারবে তার এই গোমড়ামুখো ছেলেটাকে ভালো রাখতে।
তখনই ছোঁয়া ভাবনায় ডুব দেয়। ওনার সাথে বিয়ে হলে সংসার করবে কি করে? উনি যে নিরামিষ। কথাই বলে না। দেখা গেলো ছোঁয়াকে টুপ করে বারান্দা দিয়ে ফেলে দিলো। বা হাত পা বেঁধে খাটের তলায় রেখে দিলো। তখন? রোমাঞ্চ যে ওনার দ্বারা হবে না এটা ছোঁয়া জানে।

সাদি উঠে পড়ে। ছোঁয়ার ভাবনায় ব্যঘাত ঘটে। নাহলে আরও একটু কল্পনার করতো সে।
“ঠিক আছে মেয়ে দেখো। তবে এর মতো আধপাগল যেনো না হয়।

বলেই সে চলে যায়। ছোঁয়া দাঁত কটমট করে তাকিয়ে থাকে সাদির যাওয়ার দিকে। তাকে আধপাগল বলে গেলো?
সাবিনা হতাশ হয়। বুঝে যায় তার ছেলের ছোঁয়াকে পছন্দ না।
” বড় মা আমি আধপাগল?
“আমার সাদু যখন বলেছে তখন তুই আধপাগলই।

ছোঁয়া অবাক হয়ে যায়। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে ফেলে
” এই আধপাগলের জন্যই একদিন আপনি ফুল পাগল হবেন৷ বলে রাখলাম।।

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৫
#তানিশা সুলতানা

কথায় থাকে না “শখের পুরুষকে দেখে শখ মেটে না”
ছোঁয়ার বেপারটাও তেমন৷ শখের পুরুষ এতো আকর্ষণীয় কেনো হয়? এতো লোভ কেনো জন্মায় তার প্রতি?
এই যে ছোঁয়া মানুষটাকে এতো দেখে তবুও তো মন ভরে না। আরও দেখতে ইচ্ছে করে।
সে খাচ্ছে। কোনো দিকে না তাকিয়ে খেয়ে যাচ্ছে। ছোঁয়া নিজের খাওয়া রেখে তাকেই দেখতে ব্যস্ত। এই ছেলেটা মারুক কাটুক অপমান করুক। তবুও ছোঁয়ার এই ছেলেটাকে চায়।
“তুমি সুখ না হয়ে দুঃখ হও। তবুও অন্যের না হয়ে আমার হও”
মনে মনে কয়েকবার কথাটা বলে ছোঁয়া।

“ছোঁয়া এখানকার কলেজে ভর্তি হবে না কি আবার ফিরে যাবে?

সিফাতের কথায় সাদির থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় ছোঁয়া। সত্যিই তো কি করবে?
এখানকার কলেজে ভর্তি হবে? কিন্তু কিছুদিন পরে সাদি নতুন জব পেলে তো আবার চলে যাবে দূরে কোথাও। তখন কি করবে? কি করে দেখবে সাদিকে?

ছোঁয়ার চোখে পানি চলে আসে। মমতা বেগম তার গালে রুটি পুরে দিয়েছে। সে কোনোরকমে রুটি গিলে বলে
” আমাকে বিয়ে দিয়ে দাও জিজু৷ আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। বিয়ে হয়ে গেলে নিশ্চয় তাকে এতোটা মনে পড়বে না।

সকলে অবাক হয়ে তাকায় ছোঁয়ার দিকে। সিমি বুঝতে পারে ছোঁয়ার কথার মানে। সাবিনা বেগম হাত বুলিয়ে দেয় মাথায়।ছোঁয়া যে মজা করে বলছে না সেটা তার চোখের পানি দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
সাদি বিরক্ত হয়। রুটির মধ্যে করলা ভাজি দিয়ে তা মুখে পুরে এক পলক তাকায় ছোঁয়ার দিকে।
ছোঁয়া তাকিয়েই ছিলো তাই চোখাচোখি হয়ে যায়।
সাদি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে নিজের খাওয়াতে মন দেয়।

সাবিনা বেগম ছোঁয়ার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে
“সোনা মা কান্না করে না। সাদুর বিয়েটা দিয়েই তোমাকে বিয়ে দিয়ে দেবো।

ছোঁয়ার কান্না থামে না। সাদির বিয়ে হয়ে যাবে? বুকটা অসম্ভব ভাবে পুরতে থাকে। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারে না।
” আমি বিয়েটা করতে দিবো না। আমার ফিলিংস কি এতো সস্তা না কি? ভালোবেসেছি মানে আমারই হতে হবে। বিয়ে করতে যাবে? খু*ন করে ফেলবো আমি।

নিজেকে শান্ত করার জন্য মনে মনে বলে ছোঁয়া।

“আব্বা আমি মেয়ে পেয়ে গিয়েছি। তোর ছোট ফুপির ভাসুরের মেয়ে। মেয়েটা মাশাআল্লাহ। অনর্স শেষ করেছে।
আজকেই দেখতে যাবো ভাবছি। তুই কি বলিস?

সাদি জবাব দেয় না। সিফাত ভ্রু কুচকে তাকায়। তার গম্ভীর ভাই বিয়ে করবে? তবে সে খুশি। বিয়ে করলে হয়ত এই গম্ভীর ভাবটা চলে যাবে।
সিমি বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কখনোই চায় না ছোঁয়ার সাথে সাদির কোনো সম্পর্ক হোক। ছোঁয়া উড়ন্ত একটা পাখি। সাদির মতো লোহার খাঁচা তার জন্য না।

মমতা বেগম এক গাল হেসে বলে
” আজকেই যামু বউ৷ দেরি করমু কেন? পছন্দ হইলে আজকেই আংটি পড়িয়ে দিমু। আর এই সপ্তাহের মধ্যেই বিয়ে ফাইনাল করমু।
তোমার আব্বার তো আবার মাথা গরম। চাকরি হইলেই বাড়ি থেকে চলে যাইবো। আমরা বাইচা আছি কি না মইরা গেছি খবর টাও তো নিবো না।
সাথে বউ পাঠিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিত হওয়া যাবে। সে অন্তত একটু খবর টবর দিবে।

মমতা সঠিক কথা বলেছেন। তার সিদ্ধান্তকে সবাই সায় জানায়। ছোঁয়ার আর খাওয়া হয় না। সে উঠে চলে যায়। পেছন থেকে মমতা বেগম ডাকে কিন্তু সে পেছন ফিরে তাকায় না।
ছোঁয়ার দিকে মন না দিয়ে সবাই মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা বলতে থাকে।

___

সাদি রুমে ঢুকতেই দেখতে পায় ছোঁয়া তার বিছানায় বসে আছে। এবং তারই টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু নিয়ে নাক মুছছে।
সাদি চুপচাপ রুমে ঢুকে টেবিলের ওপর থেকে ফোন নিয়ে সোফায় বসে পড়ে।
ছোঁয়া তাকিয়ে আছে। সাদি কিছু বলবে তার অপেক্ষায়। কিন্তু গোমড়ামুখো জলহস্তী কিছুই বলছে না। একটা মানুষ এমন কি করে হতে পারে?

সাদি কিছু বলবে না বুঝতে পেরে ছোঁয়া বিছানায় টিস্যু ফেলে সাদির সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
“আপনি কেনো বিয়ে করবেন?
সাদি ফোনের স্কিনে চোখ রেখেই জবাব দেয়
” আরেকটা থা*প্প*ড় খেতে না চাইলে বেরিয়ে যাও।
ছোঁয়া সাদির পাশে বসে পড়ে।
“যাবো না৷ আপনার বাড়ি না কি এটা? মালিকের মতো ধমকাচ্ছেন। এটা আমার দাদার বাড়ি। এই বাড়ির আনাচে-কানাচে আমার অধিকার রয়েছে। আমি যেখানে খুশি বসতে পারি। যেখানে খুশি যেতে পারি। আপনি বলার কে? হু আর ইউ?

সাদি জবাব দেয় না। সে ফোনে ইন্টারেস্টিং কিছু দেখছে। ছোঁয়ার কথা তার কানে ঢুকেছে কি না বোঝা মুশকিল।
ছোঁয়া বিরক্ত হয়। এই পাথরকে কি করে বোঝাবে সে?

” আপনি কেনো বুঝতে পারছেন না?

খানিকটা চেঁচিয়ে বলে ছোঁয়া। সাদি ফোন রেখে চোখ বন্ধ করে শ্বাস টানে
“সাট আপ ইডিয়েট। যাও এখান থেকে। আদারওয়াইজ থা*প্প*ড়ে গাল লাল করে দিবো।

ছোঁয়া দুই হাতে চুপ টেনে কিছুখন মাথা নিচু করে বসে থাকে। তারপর হাতের সামনে থাকা সাদির ল্যাপটপ ফ্লোরে ফেলে দেয়। সাদি কিছুই বলে না। সে ফোন দেখছে। ছোঁয়া সাদির ফোনটা নিয়ে দেয়ালে ছুঁড়ে মারে।
সাদি অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় তাকায়। ছোঁয়া দাঁতে দাঁত চেপে সাদির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চোখে চোখ রেখে বলে
” বিয়ে আপনার আমাকেই করতে হবে। চ্যালেন্জ করলাম আপনাকে। আপনার রুমে আপনার খাটে আপনার পাশে আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের এতটুকু ছায়াও আসতে দিবো না আমি।
আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে টাচ করার কথা ভুলে যান।
চাপকে তো আমি গাল লাল করতে পারবো না। তবে আপনার চুল টেনে ছিঁড়তে পারবো।
শয়তান বেডা

বলেই ছোঁয়া হনহনিয়ে চলে যায়। সাদি ছোঁয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।
ল্যাপটপ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। এটা ভাঙাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ফোন?
প্রথম মাসের বেতন দিয়ে অল্প দামে ফোনটা কিনেছিলো সাদি। চাকরি নেই। হাতে টাকা নেই। এখন ফোনটাও গেলো।
বিরক্ততে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে সাদি। আবার সেই বাবার কাছে হাত পাততে হবে?

__

ছোঁয়া খুশি হয়েছে ফোনটা ভাঙতে পেরে। কথায় কথায় রাগ দেখানো না? এবার থেকে এভাবেই প্রতিশোধ নিতে হবে।

ছোঁয়া নিজের ফোনে একটা গান চালিয়ে ওড়না ফেলে উরাধুরা নাচতে থাকে। ফোন আর ল্যাপটপ ভেঙে তার মনে হচ্ছে সে বিশ্ব জয় করে ফেলেছে।
কিন্তু ছোঁয়ার নাচ বেশিখন টিকতে পারে না। সাদি হনহনিয়ে ছোঁয়ার রুমে ঢুকে পড়ে। বিছানা থেকে ফোনটা নিতে যেতেই ছোঁয়া খপ করে নিজের ফোনটা ধরে ফেলে।
“আমার ফোন ভাঙবেন না। কয়দিন আগে বাবা এক বস্তা টাকা দিয়ে কিনে দিয়েছে।

সাদি ছোঁয়ার হাতের দিকে তাকায়। পোরা হাত দিয়ে শক্ত করে ধরেছে।
” সিনক্রিয়েট করো না। ফোনটা দাও। আমার ইমপটেন্ট কল আসবে।

ছোঁয়া বুঝতে পারে। তার ফোনটা এখন লাটসাহেব নিয়ে যাবে।
“ফোনটা দিলে বিয়ে করবেন বলেন।

সাদি ছোঁয়ার কথা কানে নেয় না। আস্তে করে ছোঁয়ার হাতটা ধরে। প্রথমবার সাদির ছোঁয়া পেলো ছোঁয়া। অদ্ভুত ভাবে শরীরটা কেঁপে ওঠে। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে।
সাদি বা হাতটা ধরে ডান হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নেয়।
” আপনার ছোঁয়ায় মধু মেশানো আছে গোমড়ামুখো। সেই মধু আমার হৃদয়হরণ করে নিচ্ছে।

সাদি ছেড়ে দিতে চায় ছোঁয়ার হাত কিন্তু তখনই ছোঁয়া একটা অদ্ভুত কাজ করে ফেলে

চলবে

হৃদয়হরণী পর্ব-২+৩

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:২
#তানিশা সুলতানা

জ্বলন্ত আগুন সব কিছুই পুরিয়ে ফেলছে। সাদির ছবিটার সব টুকুই প্রায় পুরে গেছে শুধু চোখ দুটো পুরে নি। ওই ওবদি আগুন এখনো পৌঁছায় নি৷ ছোঁয়া সেই চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মায়ারাজার চোখ দুটো। এই ছবিটা আঁকড়ে বেঁচে আছে সে। প্রতিদিন ছবিটা দেখতে থাকতো। ছবিতে কতো শত চুমু খেয়েছে। বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছে।
আর আজকে চোখের সামনেই ছবিটা ছাই হয়ে যাচ্ছে।
কলিজা কাঁপছে ছোঁয়ার। সাদির শার্টটা পুরে ছাই হয়ে গেছে। চকলেট বক্সে এখনো আগুন জ্বলছে।

সাদির চোখে যখন আগুন পৌঁছায় ছোঁয়া চিৎকার করে ওঠে। দুই হাতে চেপে ধরে জ্বলন্ত আগুনে।
গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে ছোঁয়া। নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। কলিজা ফেঁটে যাচ্ছে তার।
জীবন এতো কঠিন কেনো? ভালোবাসলে এতো কষ্ট পেতে হয় কেনো?

ছোঁয়ার চিৎকারে নাজমা বেগমের কলিজ কেঁপে ওঠে। তিনি ছোঁয়ার রুমের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। মেয়েটা তার ভীষণ নাজুক স্বভাবের। একটু বেশিই চঞ্চল। কিন্তু আজকে কি হলো তার আদরের বাচ্চার? এরকম তো আগে কখনো হয় নি। আগে তো এমন করে নি৷ আজকে কি হলো?

তিনি কল করে তার স্বামী সেলিমকে। সেলিম অফিসের কাজে ব্যস্ত। ফোন ধরতে পারে না। তাই কল করে সাদিকে। সাদি তার বড় ভাসুরের ছেলে। একই বিল্ডিংয়ে ওপর নিচে থাকে তারা। সাদিকে অনেক করে রিকোয়েস্ট করার পরেও তাদের সাথে থাকে না। ৫ তালায় সাদি থাকে আর চার তালায় ছোঁয়ারা।
সেলিমের কাজের সূত্রে বই বাচ্চা নিয়ে ঢাকাতে থাকে তিন বছর হলো।
আর কাকতালীয় ভাবে সাদির ছোঁয়ার কলেজেই চাকরি হয়ে যায়।

সাদি কলেজ থেকে বের হয়ে কলেজের পাশের কফিশপে ঢুকে কফি খাচ্ছিলো। একটু ফাঁক পেলেই সে এখানে কফি খেতে চলে আসে। এই শপের কফি দারুণ লাগে তার।
সবেই কফির মগে ঠোঁট ছোঁয়াবে তখনই ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্কিনে কাকিমা নামটা দেখে কপালে তিনটে ভাজ পড়ে সাদির। বিরক্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসে। ছোঁয়া যে সব বলে দিয়েছে বুঝে যায় সে।

এবার কাকিমাকে কিছু কড়া কথা শোনানোর প্রস্তুতি নেয় সাদি। চোখ মুখ শক্ত করে কল রিসিভ করে। কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে তখনই ভেসে আসে নাজমার কান্নার শব্দ
“আব্বা কোথায় তুমি? আমার ছোঁয়া কেমন করছে। তোমার চাচাকে ফোনে পাচ্ছি না।

এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায় সাদি। কি হয়েছে ছোঁয়ার জিজ্ঞেস করতে গিয়েও গলায় কথা আটকে যায়। ফোনটা কেটে ওয়ালেট থেকে হাজার টাকার নোট বের করে কফির মগের নিচে রেখে তারাহুরো করে বেরিয়ে যায় কফিশপ থেকে।

ছোঁয়ার চিৎকার থেকে গেছে। স্থির হয়ে ফ্লোরে পড়ে গেছে সে।
সাদি আসতেই নাজমা বেগমের কান্নার আওয়াজ বেরে যায়।
” রিলাক্স কিচ্ছু হয় নি। আমি দেখছি

নাজমাকে শান্তনা দিয়ে বলে সাদি। তারপর পকেট থেকে এক্সট্রা চাবি বের করে দরজার লক খুলে।

নাজমা বেগম মেয়ের অবস্থা দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মেয়ের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেয়। দুই হাতে ফোসকা পড়ে গেছে। চোখের পানি শুকিয়ে গেছে। সাদা কলেজ ড্রেসে ছাই লেগে আছে। কোমর সমান লম্বা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে।

সাদি মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার অর্ধেক পুরে যাওয়া চোখ দুটো দেখে চিনতে খুব বেশি সময় লাগে নি। চকলেট বক্স পুরোপুরি পুরে নি৷ এটা দেখেও সে চিনতে পেরেছে। কয়েকবছর আগে দিয়েছিলো ছোঁয়াকে। তখন তারা এক সাথে থাকতো।

পাগলামির মাত্রা এতোটা ছাড়িয়ে গেছে? এতোটা আশা করে নি সাদি। এই মেয়েটা তার জন্য এতো পাগল কবে হলো?
কই কখনো তো তাকে বিরক্ত করে নি। শুধু আশেপাশের মানুষদের থেকেই শুনে এসেছে সাদি।
বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে সাদির। এই শহরে আর নয়।

নাজমা বেগম সাদির সাহায্যে ছোঁয়াকে বিছানায় তোলে। সাদি শুধু একটু হাতটা ধরেছিলো।
ছোঁয়ার হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় সাদি।
ডাক্তারকে কল করে বেরিয়ে যায় এই বাড়ি থেকে।

মাগরিবের আজানের সময় চোখ মেলে তাকায় ছোঁয়া। মাথার ওপরে সাদা দেয়ালটার দিকে বেশ কিছুখন তাকিয়ে থাকে। অনুভব করতে পারে তার মাথায় কারে হাতের অস্তিত্ব। ঘাড় বাঁকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখতে পায় বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে ছোঁয়ার।
হাত উঁচু করে বাবার হাতটা ধরতে যেতেই বুঝতে পারে তার হাতে ব্যান্ডেজ করা।

ছোঁয়াকে নরতে দেখে সেলিম মুচকি হেসে মেয়ের কপালে চুমু খায়।
“ভালো লাগছে মামনি?
” আমি এখনি এই শহর ছাড়তে চাই বাবা। এখানে থাকবো না আমি।
কারণ জানতে চায় না সেলিম। কারণ তিনি জানে হাজার বার জিজ্ঞেস করলেও তার মেয়ে কারণ বলবে না।
“মা পনেরো দিন পরে তো আমরা এমনিতেই যাবো।
” আমি এখুনি যাবো বাবা। এই মুহুর্তে যাবো। আর একটা ঘন্টাও এখানে থাকবো না আমি।

চিৎকার করে বলে ওঠে ছোঁয়া। চোখে পানি চলে এসেছে তার। সেলিম মেয়ের ব্যবহারে অবাক হয়।
গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস পায় না তার মেয়ে। আর আজকে বাবার সামনে চিৎকার করছে?
ভয় করছে তার মেয়েকে দেখে। তবুও শান্ত গলায় বলে।
“ঠিক আছে। এখুনি যাবে তুমি।
আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

ছোঁয়া চোখ বন্ধ করে ফেলে। সেলিম চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
নাজমা খাবার নিয়ে চলে আসে।
সেলিম খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে বলে ওঠে
” খাবারটা শেষ করো। তারপর যাবো আমরা।

ছোঁয়া উঠে বসতে যায়। কিন্তু পারে না। নাজমা বেগম ধরে বসিয়ে দেয়।
সেলিম খাইয়ে দিতে থাকে।
আর তখনই ফোন করে সিফাতকে।

সিফাতের আসতে বেশি সময় লাগে না। নিজেদের গাড়ি থাকাতে দুই ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছে যায়।
বাবা মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে ছোঁয়া গাড়িতে বসে পড়ে। হাত দিয়ে কিছুই ধরতে পারছে না সে।

সিফাতও ওনাদের থেকে বিদেয় নিয়ে রওনা হয়।

ছোঁয়া ব্যস্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎ সিফাত গাড়ি থামিয়ে ফেলে। ছোঁয়া বিরক্ত হয়ে তাকায় সিফাতের দিকে
“কি হলো জিজু? থামলে কেনো?

সিফাত গাড়ির কাঁচ নামিয়ে ভালো করে দেখে বলে
” ওইটা সাদি না?

ছোঁয়া চমকে তাকায়। সত্যিই তো সাদি। ব্যাগ হাতে বাস স্ট্যান্ডে বসে আছে। বুক কেঁপে ওঠে ছোঁয়ার। এই লোকটার মুখোমুখি হবে না বলে প্রিয় শহর ছাড়ছে তবুও লোকটাকে দেখতে হলো?
“বোনু দুই মিনিট বস। আমি জাস্ট যাবো আর আসবো

বলেই সিফাত চলে যায়।
সাদির সামনে দাঁড়িয়ে বলে
” তুই এখানে?
সাদি সিফাতকে দেখে খুশি হলেও প্রকাশ করে না। ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে যায়
“বাড়ি ফিরছি। তোর গাড়ি কোথায়?

বলতে বলতে গাড়ির দিকে চলে আসে। সিফাত সাদির পেছন পেছন আসে। আর প্রশ্ন করে লাভ হবে না। কারণ সাদি জবাব দেবে না। তাই চুপচাপ থাকে।
সাদি গাড়ির পেছনের দরজা খুলে বসে পড়ে। ছোঁয়াকে সে খেয়াল করে নি।

চলবে

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:৩
#তানিশা সুলতানা

সাদি এক মনে ফোন দেখে যাচ্ছে। পাশে উসখুস করতে থাকা ছোঁয়াকে সে এখন পর্যন্ত খেয়াল করে নি। এদিকে ছোঁয়া অস্বস্তিতে ভুগছে। সাদির মুখোমুখি হবে না বলে শহর ছাড়ছে। তবুও মুখোমুখি হতে হলো?
বাই এনি চান্স তারা কি এক বাড়িতেই যাচ্ছে?
ছোঁয়ার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে থাকে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। গায়ের ওড়নাটাও শত্রুতা করলো। ফট করে কাঁধ থেকে পড়ে গেলো। মাথা চুলকাচ্ছে পিঠ চুলকাচ্ছে মুখে চুল উঁড়ে এসে বিরবির করছে।
হাত অকেজো হলে যা হয় আর কি।
হাত দিয়ে ওড়নাটাও ওঠাতে পারছে না। পিঠের চুলকামি বেরেই চলেছে। নিজের ওপর বিরক্ত হয় ছোঁয়া। বিরবির করে নিজেকে কয়েকটা গালি দেয়।
কিন্তু গালিতে কি আর চুলকানি কমে?
ছোঁয়ার নরাচরা দেখে সাদি বুঝতে পারে তার পাশে কেউ আছে। সে ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে গাড়ির ভেতরকার লাইট জ্বালিয়ে দেয়। ছোঁয়া চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলে। সাদি অবাক হয়েছে বেশ। তবে প্রকাশ করলো না চোখ ফিরিয়ে নিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আবারও ফোন হাতে নেয়। তার চতুর মস্তিষ্ক এটুকু বুঝতে পেরেছে যে ছোঁয়া তার জন্য শহর ছেড়েছে।

ছোঁয়া পিটপিট করে চোখ খুলে দেখে সাদি আবারও ফোনে মগ্ন হয়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ছোঁয়া। বুকের ভেতর থেকে টিপটিপ শব্দ বেরিয়ে আসছে। ঢোক চিপতে গিয়ে মনে পড়ে তার গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
সে জোরে জোরে শ্বাস টানতে থাকে।
সিফাত ঘাড় বাঁকিয়ে ছোঁয়ার দিকে এক পলক তাকানোর চেষ্টা করে বলে
“আর ইউ ওকে বোনু?
” পানি খাবো। পিঠ চুলকাচ্ছে। মাথা চুলকাচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে। ভালো লাগছে না। কখনো পৌঁছাবো?
ছোঁয়ার কন্ঠ অস্বস্তি এবং বিরক্তিতে ভরপুর।

সিফাত পানির বোতল নিয়ে সাদির কোলের মধ্যে ফেলে। ভ্রু কুচকে সাদি তাকায় সিফাতের দিকে।
“সিপি খুলে খাইয়ে দে একটু। হাত পুরেছে ওর।

সাদি বিরক্ত হয়। চোখ মুখ কুঁচকে ছোঁয়ার দিকে এগিয়ে বসে। ফোন রাখে পাশের সিটে।
ছোঁয়ার হাত পা মৃদু কাঁপতে থাকে। লোকটার গা থেকে কড়া পারফিউমের গন্ধ আসছে। না তাকিয়েও বুঝতে পারে লোকটা তার খুব কাছে।

গলা কাঁপছে ছোঁয়ার। ” পানি খাবো না” বলার সাহসটুকুও পাচ্ছে না। জীবনে প্রথমবার লোকটার ঘ্রাণ কাছ থেকে নিতে পারলো। এতোটা কাছাকাছি প্রথমবার আসলো। লোকটা তো ছোঁয়ার কাছে আকাশের চাঁদ। যাকে সারাজীবন দূর থেকেই দেখে গেছে। সামনে থেকে কখনো তাকানোর সাহস হয়ে ওঠে নি৷

হঠাৎ ছোঁয়া অনুভব করো তার পড়ে যাওয়া ওড়নাটা আস্তে আস্তে তার শরীর থেকে চলে যাচ্ছে। চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে ছোঁয়া। হাত পায়ের কাঁপন বাড়তে থাকে। যখন তখন বেহুশ হয়ে যাবে ছোঁয়া।

সাদি ছোঁয়ার গলায় পেঁচিয়ে দেয় ওড়নাটা। একটুও টাচ করে নি ছোঁয়ার শরীরে। শুধুমাত্র দুই আগুল দিয়ে ঝুঁটি বাঁধা চুলগুলো তুলে চুলের নিচ দিয়ে ওড়না দিয়েছে৷ যাতে আবার না পড়ে যায়।

ছোঁয়া এবার আস্তে আস্তে চোখ খুলে। সাদি সিপি খুলে ছোঁয়ার মুখের সামনে ধরে।
ছোঁয়া মাথা উঁচু করে হা করে। সাদি একটু পানি ঢেলে দেয়। আশ্চর্য একদম ছোঁয়ার মুখের মাপে পানি ঢেলেছে। একটুও কম না বেশিও না।
তিন চার ঢোক খেয়ে ছোঁয়া আর হা করে না। এতে সাদি বুঝে যায় সে আর পানি খাবে না। তাই সিপি আটকে বোতল রেখে আবারও ফোন হাতে নেয়। সরে বসে না।
ছোঁয়া একদম দরজার সাথে লেগে বসে থাকে। তার কাঁপন এখনো কমে নি। স্বাভাবিক হতে পারছে না সে। নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয় ছোঁয়া। আশ্চর্য এতো কাঁপা-কাঁপির কি আছে?
কে উনি?
ওনাকে দেখে কেনো কাঁপবো?

ছোঁয়ার চোখ দুটো ঘুরেফিরে পাশে তাকাতে চাচ্ছে। এতো কাছ থেকে লোকটা দেখতে কেমন হবে?
প্রশ্নটা মনের মধ্যে উঁকি দিয়ে ওঠে। বেসামাল মনটাকে শান্ত করতে ব্যস্ত ছোঁয়া। এই লোকটা মরিচীকা। তার প্রতি মায়া বাড়ালে দুঃখ অপমান আর অবহেলা ছাড়া কিছুই পাওয়া যাবে না।
চোখ বন্ধ করতেই থাপ্পড়ের কথা মনে পড়ে ছোঁয়ার। চোখ মুখ শক্ত করতে গিয়ে পারে না। কারণ ছোঁয়ার চোখ পড়ে সাদির হাতের দিকে। লোমে আবৃত শক্তপোক্ত পুরুষালি ফর্সা হাত। হাতের নখগুলো ধবধবে সাদা।
লোকটার হাতে এতো ঘন লোম। নিশ্চয় বুকের এরকম আকর্ষণীয় লোম আছে।

নিজের ভাবনাতে নিজেই লজ্জা পায় ছোঁয়া। গাল গুলো লালা হয়ে ওঠে। বুকটা অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে।
হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে হাতে ব্যাথা পায়। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে গিয়েও পারে না। আহহ শব্দ করে ওঠে।
সাদি পাশে তাকায়।
ছোঁয়ার কান্ডে বিরক্ত হয়ে তার মুখ থেকে এতোখনে একটা বুলি বের হয়
“ইডিয়েট

মধুপুর পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ১১ টা বেজে যায়। জার্নিতে ছোঁয়ার ঘুম পায়। কিন্তু আশ্চর্য আজকে ঘুম পায় নি। পাবে কি করে? পাশেই যে ঘুম উড়ানোর মেশিন বসে আছে।

গাড়ি থামতেই সাদি নিজের ব্যাগ হাতে নেমে যায়।
এবং বাড়িতে ঢুকে যায়।

খাওয়া শেষে বাড়ির সবাই টিভি দেখতে বসেছে। এটা প্রতিদিনকার স্বভাব। খাওয়া শেষে সবাই এক সাথে একটুখানি আড্ডা দিবে টিভি দেখবে তারপর ঘুমাতে যাবে।

সাদি সদর দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই সবার চোখ পড়ে সাদির দিকে। সাবিনা খুশিতে কেঁদে ফেলে। দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে
“আব্বা হঠাৎ চলে আসলি যে?

সাদি মায়ের চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।
মমতা বেগম হাত পান খাওয়া লাল দাঁত গুলো বের করে একটু হেসে বলে
“দাদাভাই কাছে আয়। কতোদিন দেহি না তোরে।

তিনি ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারে না। নাহলে নিজেই যেতো।
তুষার চৌধুরী ছেলের দিকে তাকিয়েই আছে। কথা বের হচ্ছে না মুখ থেকে। ছেলেটা বাড়ি থেকে যাওয়ার পরে একটা কল পর্যন্ত করে নি৷ কারো ফোন তোলে নি।
পরি এক দৌড়ে সাদির কাছে যায়। সাদি কোলে তুলে নেয় পরিকে এবং নিজের রুমে চলে যায়।
সকলেই হতাশ হয়।
সিমি সকলের থমথমে মুখ দেখে বলে ওঠে
” আমি ভাবছি ভাইয়াকে বিয়ে করিয়ে দাও। দুষ্টু মিষ্টি একটা বউ চলে আসলে সে ঠিক বদলে যাবে৷

সিমির কথায় হেসে ওঠে তুষার।
“এই না হলো আমার মা। একদম ঠিক বলেছিস। কাল থেকেই মেয়ে দেখা শুরু করে দিবো।

তখনই এক দৌড়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে ছোঁয়া। দৌড়ে এসে সাবিনাকে জাপ্টে ধরে
” বড় মা আমি চলে এসেছি।

সাবিনা ছোঁয়াকে ছাড়িয়ে ছোঁয়ার হাতে দুটো টেনে দেখতে থাকে।
আহারে সুন্দর নরম তুলতুলে হাতটার কি অবস্থা।

সিমি বোনের কাছে আসে। মুহুর্তেই বাড়ির পরিবেশ হাসিখুশি হয়ে যায়। ছোঁয়া মানেই অন্য রকম প্রশান্তি। সে তার কথায় সবাইকে হাসিয়ে ছেড়েছে। এটাই তার স্বভাব।

সকলের সাথে গল্প করার পরে ছোঁয়া চলে যায় নিজের রুমের দিকে।
তার একটা রুম বরাদ্দ করা আছে। সেই রুমেই চলে যায় সে।
রুমে ঢুকে পা দিয়ে দরজা বন্ধ করে পেছন ফিরতেই ছোঁয়া চিৎকার করে ওঠে।
কারণ সাদি টাওয়াল পড়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে মাত্র।
শরীরে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। গাড়িতেই ভাবছিলো বুকের লোমের কথা। আর এখনই তা দেখে ফেললো।
ছোঁয়া চোখ মুখ খিঁচে দাঁড়িয়ে আছে৷ রুম থেকে বের হওয়ার কথা ভুলে গেছে সে।

চলবে

হৃদয়হরণী পর্ব-০১

0

#হৃদয়হরণী
#পর্ব:১
#তানিশা সুলতানা

ভরা ক্লাস রুমে ছোঁয়ার গালে স-জোরে থা*প্প*ড় মারে সাদি। স্তব্ধ হয়ে যায় পুরো ক্লাস রুম। ছোঁয়া তাল সামলাতে না পেরে বেঞ্চের ওপরে পড়ে যায়। ঠোঁট খানিকটা কেটে যায়। কপালে আঘাত পায়। “আহহ শব্দ করে ওঠে ছোঁয়া। মাথা ঘুরছে তার। চারদিক অন্ধকার দেখছে। সেভাবেই চোখ বন্ধ করে খানিকক্ষণ পড়ে থাকে ছোঁয়া। ওঠার শক্তি তার নেই মধ্যে । পুরো ক্লাস রুমে সিলিং ফ্যানের খটকট আওয়াজ ব্যতিত আর কোনো শব্দ নেই।

ছোঁয়ার পাশে বসে থাকা তিথি ছোঁয়াকে তুলে বেঞ্চে বসায়।
ঠোঁট আর কপাল থেকে বেয়েঁ র*ক্ত পড়ছে।
দু-চোখ বেয়ে পানি পড়ছে অনবরত। কিছুতেই কান্না আটকাতে পারছে না।

সাদি ছোঁয়ার ইংলিশ বইটা ছুঁয়ে ক্লাসের বাইরে ফেলে দেয়। বেঞ্চে সজোরে আঘাত করে চিৎকার করে বলে ওঠে
“এসব কি? সাহস হয় কি করে এসব লেখার? বয়স কতো তোমার? স্যারকে প্রেমপত্র লেখা হচ্ছে? এসব শিক্ষা পেয়েছো পরিবার থেকে? স্টুপিট.
ছোঁয়া কেঁপে ওঠে। জরোসরো হয়ে বসে তিথির সাথে চিপকে। নিস্তব্ধ পরিবেশে সাদির চিৎকার ভীষণ ভয়ংকর। তার চোখের সাদা অংশ টুকুতে লাল আভা ফুটে উঠেছে। কপালের রগ গুলো জেগে উঠেছে। অতিরিক্ত রাগে জোরে জোরে শ্বাস টানছে।

পেছন থেকে একটা মেয়ে বলে ওঠে
” স্যার ও সবাইকে বলে বেড়ায়। আপনাকে নিয়ে না কি হানিমুনে যাবে।

পেছনের কয়েকজন হেসে ওঠে। সাদি তাকাতেই আবার থেমে যায়।
আরেকজন বলে
“এই মেয়ে প্রচন্ড বাড়াবাড়ি করে স্যার। পুরো কলেজে রটিয়েছে সে আপনাকে ভালোবাসে। অন্য মেয়েদের সাথে ঝগড়া করে আপনাকে নিয়ে। বদমাইশ মেয়ে একটা।

এই খবর সাদির অজানা নয়। সে জেনেছে। তবুও চুপ ছিলো। তবে আজকে সমস্ত সীমা অতিক্রম করেছে। এমনটা আরও কিছু মেয়ে করে। তাদের সবাইকে শিক্ষা দিতে চায় সাদি ছোঁয়ার মাধ্যমে। যাতে দ্বিতীয় বার কেনো স্টুডেন্ট টিচারকে প্রেমপত্র লেখার আগে দ্বিতীয় বার চিন্তা করে।

” লজ্জা লাগছে না তোমার? নিলর্জ্জ মেয়ে। নিজের সাথে সাথে আমার মানসম্মান ডুবাচ্ছো? ভালোবাসার তুমি কি বুঝো? ঢাক ঢোল পিটিঁয়ে ভালোবাসা রটাচ্ছো? বাবা মা জানে সে খবর?
ফের ধমকিয়ে বলে সাদি।
ছোঁয়া মাথা নিচু করে কাঁদছে শুধু। তার কিছুই বলার নেই। সত্যিই সে অপরাধী। ভীষণ অপরাধ করেছে সে।
ছোঁয়াকে চুপ থাকতে দেখে সাদি দাঁতে দাঁত চেপে প্রচন্ড চিৎকার করে বলে
“চুপ করে আছো কেনো? জবাব দাও?
কোনো জবাব নেই তোমার কাছে?
বেরিয়ে যাও আমার ক্লাস থেকে। আমার ক্লাসে তোমার থাকার কোনো অধিকার নেই। আর হ্যাঁ নেক্সট টাইম যেনো আমার ক্লাসে তোমায় না দেখি।

সাদির চিৎকারে ক্লাসের প্রতিটা স্টুডেন্ট জড়োসড়ো হয়ে যায়। ছোঁয়া ভয়ে কাঁপতে থাকে। নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে তার। কান্নায় গলা আটকে আসছে।
ছোঁয়াকে একই ভাবে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাদির রাগ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। সে ছোঁয়ার হাত ধরে টেনে দরজা ওবদি এনে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়।
পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নেয় ছোঁয়া। পেছন ঘুরে এক পলক তাকায় সাদির দিকে। নিষ্ঠুর মানুষ।
ছোঁয়ার ব্যাগটাও ক্লাসের বাইরে ফেলে দেয় সাদি। কলম বই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে।
ছোঁয়া কাঁদতে কাঁদতে বই কুড়িয়ে নেয়। ব্যাগে পুরে ব্যাগটা কাঁধে চেপে আবারও এক পলক তাকায় ক্লাসের দিকে। সবাই তাকিয়ে আছে ছোঁয়ার দিকে। মুখ টিপে হাসছে অনেকেই। সাদি বই দেখছে।

অন্য ক্লাসের স্টুডেন্টরাও এই খবর জেনে যায়। টিচাররাও জেনে যায়। এই টুকুনি সময়ে পুরো কলেজে ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়ে। সবাই ছোঁয়াকে দেখে হাসতে থাকে।
ছোঁয়া মাথা নিচু করে কলেজ থেকে বেরিয়ে আসে। সবার হাসির পাত্র হয়ে গেলো ছোঁয়া।
কলেজের বাইরে আসতেই আর আটকাতে পারে না নিজেকে। ঘাসের ওপর বসে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে।

প্রথম সিটে বসেছিলো ছোঁয়া। তাই সাদি পড়ানোর জন্য ছোঁয়ার বইটাই নিয়েছিলো। বই খুলে তাতে বড়বড় অক্ষরে লেখা দেখতে পায়

সাদু বেবি
আপনি এতো কিউট কেনো? দেখলেই ইচ্ছে করে টুপ করে আপনার গালে চুমু খেয়ে ফেলি। আপনার হাতে আর বুকের লোম গুলো আমাকে চুম্বকের মতো টানে। আপনার বিলাই চোখ দুটো আমাকে প্রেমের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। নাকের ওপরের ছোট তিল উফফফফফ
সেটার কথা কি বলবো।
চাপ দাঁড়িতে আপনাকে আস্ত একটা মায়ারাজ মনে হয়।
ইচ্ছে করে আপনার বুকে মাথা রেখে আপনার হৃৎস্পন্দন শুনি। আপনার হৃদয়স্পর্শী হতে চাই আমি।
কেন আই ফিল মি?

ইতি
আপনার প্রেমে পাগল ছোঁয়া

চিঠির কথা গুলো পড়তেই সাদির মাথা গরম হয়ে যায়। এই মেয়ের সাহস কতো বড়? সে একজন টিচারকে চিঠি লিখে।

কলেজের এই দিকে মানুষ নেই। কাঠ বাগান বলে এটাকে। এখানে বিকেল হলে মানুষের সোরগোল বাড়ে।
মানুষ না থাকায় ছোঁয়ার কান্না কেউ শুনতে পায় না। নিজের শরীরে নিজে আঘাত করতে থাকে ছোঁয়া। হাতে গলায় মাথায় খামচি দিতে থাকে। চুলগুলে টানতে থাকে।
তার এই মুহুর্তে ম*রে যেতে ইচ্ছে করছে। সে সহ্য করতে পারছে না।

__

কাঁদতে কাঁদতে চোখ মুখ ফুলে গেছে ছোঁয়ার। দুপুরের কড়া রোদের মধ্যে পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরে। বিধস্ত দেখাচ্ছে ছোঁয়াকে। কপালের রক্ত শুকিয়ে গেছে। ঠোঁটের পাশের রক্ত শুকিয়ে গেছে। ডান গালে পাঁচ আঙুলের দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

নাজমা বেগম টিভি দেখছিলো। এভাবে বিধস্ত ছোঁয়াকে বাড়ি ফিরতে দেখে তিনি ভরকে যায়। রিমোট রেখে দাঁড়িয়ে যায়। ছোঁয়া মাথা নিচু করে ফেলেছে। চোখে মুখের পানি মুছে নিয়েছে খানিকক্ষণ আগেই

নাজমা ছোঁয়ার কাছে গিয়ে বলে
“কি হয়েছে তোর? কপাল কাটলো কি করে? চোখে মুখের এমন অবস্থা কেনো তোর? কি হয়েছে?

ছোঁয়া জবাব দেয় না। মাকে এড়িয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। নাজমা দরজা ধাক্কা দিতে দিতে ছোঁয়াকে ডাকতে থাকে। কিন্তু ছোঁয়া শুনে না।

আলমারি খুলে সেখান থেকে সাদির ছবি বের করে। বেশ কয়েকটা ফটোফ্রেম বানিয়েছিলো সে। সাদি কিছু চকলেট দিয়েছিলো ছোঁয়াকে৷ সেই চকলেট গুলো এখনো খায় নি৷ দিয়েছিলো গত ঈদে।

সাদির একটা শার্ট চুরি করে এনেছিলো। নিজের কাছে রাখবে বলে। সেই শার্টটাও বের করে।
খুব যত্নে একখানা ডাইরি লিখেছিলো সাদির নামে। সমস্ত অনুভূতি, ভালোবাসা মিশিয়ে লিখেছিলো ডাইরিখানা।

সব কিছু এক জায়গায় করে। ডেসলাই দিয়ে জিনিস দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয় ছোঁয়া। পুড়তে থাকে ছোঁয়ার কিশোরী মনে জন্ম নেওয়া ভালোবাসা। ছাই হতে থাকে অতি’প্রিয় জিনিস গুলো।

চলবে।

ভুল থেকে ফুল পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0

#ভুল_থেকে_ফুল
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_৩(শেষ)

ঘড়ির কাটায় রাত বাজে এগারো টা। আগামীকাল চলে যাব তাই গুছিয়ে নিচ্ছি সব। আয়ান ঘরে ফিরলো। তার সাথে একটা মেয়েকে দেখে চমকে উঠলাম। অবাক লাগলেও ভাবলাম হয়তো তার কোন আত্মীয় হবে। শাশুড়ির রুমে ডুকলো মেয়েটাকে নিয়ে। আয়ানকে বলতে শুনলাম, মা এই সে!

আমি ছেলেকে কোলে নিয়ে শাশুড়ির রুমের দরজায় দাড়ালাম। জিজ্ঞেস করলাম, কে ও?
মা ছেলে চোখ চাওয়াচাওয়ি করল। মেয়েটা আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে দাড়িয়ে রইল। আমার সন্দেহ বাড়ছে। জোর গলায় বললাম, “কে ও, বলছো না কেন?”

আয়ান কাঠ কন্ঠে বলল, “ওকে বিয়ে করেছি আমি।”

কথাটা শুনামাত্র আমার চারপাশ ঘুরতে লাগলো। শরীর থরথর করে কাঁপছে। ছেলেকে নামিয়ে রেখে দরজা শক্ত করে ধরলাম। শত চেষ্টা করেও কান্না আটকাতে পারলাম না। বাচ্চাদের মতো কেঁদে ফেললাম। প্রচন্ড রাগে এগিয়ে গেলাম আয়ানের কাছে। তার শার্টের কলার ধরে হেঁচকা টান দিলাম, “তোমার সাহস কি করে হয়, একটা বউ থাকা স্বত্বেও আরেকটা বিয়ে করার? উত্তর দাও?”

আয়ান কিছু না বলে হাত ছাড়িয়ে নিলো। বাচ্চা কান্না করছে, গিয়ে বাচ্চাকে কোলে তুলে নিলো। মেয়েটাকে কষিয়ে কয়েকটা থা*প্প*ড় দিলাম পরপর। বাজেভাবে বললাম, তুই কেমন মেয়ে? জানতিস না ওর বউ আছে, বাচ্চা আছে। তারপরেও পালিয়ে এসেছিস? দুনিয়ায় কি আর ছেলে ছিলো না বিয়ের জন্য? ফের আবার মারতে গেলে আয়ান এসে সজোরে আমাকে থা*প্প*ড় দিলো এলোপাতাড়ি।

শাশুড়ী বললেন, এসব হচ্ছে কি? ছেলেরা বিয়ে করতেই পারে সমস্যা কি তাতে? তোমাকে তো আর ফেলে দেবে বলেনি।

আমি কি করব কি বলব কিছুই বুঝতে পারলাম না। দাড়িয়ে হাঁপাচ্ছি শুধু। ততক্ষণে আশেপাশের অনেকে জড়ো হয়ে গেছে। কেউ কেউ লুকিয়ে আমাকে বলছে, পুলিশে যাও। এই করো ওই করো। কিন্তু আমি ওসব কিছুই ভাবছি না। আমি চাচ্ছি এই মুহুর্তে এই নরক থেকে পালিয়ে যেতে।

সবাই ওদিকে ব্যস্ত। আমি ছেলে কোলে নিয়ে পেছন দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম, সাথে কোন ফোন ও নিয়ে আসিনি। আগে আমার বাড়ি যেতে হবে। নয়তো দম আটকে আমি মরেই যাব। এত কিছু সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব না।

তাড়াতাড়ি ভ্যান এ উঠলাম। ভ্যান থেকে নামিয়ে দিলো বাস স্টেশনে। রাত বাড়ছে। মানুষজনের সংখ্যা কম স্টেশনে।খানিক ভয় ভয় ও লাগছে। হঠাৎ কেউ আমার নামে ডাকলো ‘এই রুহি’ বলে। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ফুয়াদ।

সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জিজ্ঞেস করল, “এত রাতে তুমি এখানে কেন? আর এ কি অবস্থা তোমার? হয়েছে টা কি?”

কিছু বলার মতো অবস্থা না আমার। চোখ দিয়ে অনর্গল পানি পড়ছে।

“এ কি তুমি কাঁদছো কেন? প্লিজ বলো রুহি, হয়েছে কি? এদিকে এসো বসো এক জায়গায়।”

আমি নড়লাম না। সে হাত ধরতেই চিৎকার করে উঠলাম। “হাত ছাড়ো বলছি।”

“আরে চিৎকার করছো কেন? মানুষ ভাববে কি! ছেলেটা কাঁদছে। আমার কাছে দাও।”

“না। আমার ছেলেকে নিবে না। কাঁদুক। ”

“আরে পাগল তোমার ছেলেকে নিয়ে যাচ্ছি না।” এই বলে সে ছেলেকে কোলে নিলো। দোকান থেকে পানি এনে দিয়ে বলল, “পানি খাও। মুখ ধুয়ে নাও। ভালো লাগবে। আর আমাকে বলো কোথায় যাবে?”

বিস্তারিত তাকে বলে বললাম, আমি এখন আমার বাড়ি যাব।

সব শুনে ফুয়াদ বলল, “তোমার এভাবে আসা উচিত হয়নি। ওখানে থেকে তোমার পরিবারকে খবর দেওয়া উচিত ছিলো।”

“তোমার কাছে পরামর্শ চাইতে আসিনি।। ছেলেকে দাও। আমাকে যেতে হবে।”

“চলো আমি নিয়ে দিচ্ছি।”

আগুন চোখে তাকালাম তার দিকে, “আমি একা যেতে পারব।”

“এত রাতে একা যাওয়া সেফ না। আমি তোমার বাড়ি যাব না। শুধু সাথে যাব। তুমি পৌঁছালেই চলে আসব। অযথা তর্ক করো না। বাচ্চাটার কষ্ট হচ্ছে। ”

কিছু না বলে বাসে উঠলাম।

বাড়ি গিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়লাম। আমার অবস্থা দেখে সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেন। খানিক সময় পার হলে সব বললাম। মা-বাবা ভাইসহ সবার একই কথা, শেষ দেখে ছাড়বে আয়ানের। আমিও প্রতিজ্ঞা করলাম, শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আয়ানকে জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।

বাবা, ভাই তাই করলেন। টাকা পয়সা সব ঢেলেও আয়ান রেহাই পায়নি। জেল খাটছে কয়দিন। পরে আমারই দয়া হলো, যত হোক সে আমার ছেলের বাবা। বাবাকে মিনতি করে তাকে ছাড়ালাম।

তারপরে শুরু হলো আমার উপর জবরদস্তি। আমাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় নামলেন মা-বাবা। কিন্তু আমি কোনমতে রাজি না। তার কারণ আমার ছেলে। তাকে কখনও একা ছাড়ব না আমি। বিয়েতে রাজি না হওয়ায় অনেক কথা ও শুনতে হয়েছে পরিবারের সবার। চুপচাপ শুনতাম। কিছু বলতাম না। কান্না পেলে কাঁদতাম। ভাবলাম আর বিয়েই করব না। ছেলেকে নিয়ে এই ছোট্ট জীবন কাটিয়ে দিতে পারব অনায়াসে।

সুখে দুঃখে কেটে গেছে দুই থেকে তিন বছর। এর মধ্যে আমি প্রাইমারিতে জব ও পেয়ে গেলাম। মানসিক অবস্থা ও আগের থেকে ভালো। হুট করে এক সন্ধ্যায় ফুয়াদের আগমন। তাকে দেখে বেশ চমকালাম। এতবছরে তার সাথে আমার কোন যোগাযোগ ছিলো না। সে কেন, কোনও ছেলের সাথে আর সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। নিজের ইচ্ছে ছিলো না।

ফুয়াদের সাথে দেখি আরও মানুষ। জানতে পারি তার মা ভাই উনারা। আমার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছে আমার পরিবারে। বুঝতে পারলাম না। এত বছর পর সে আবার কেন ফিরলো। তাও বিয়ের জন্য। আমি তাকে আড়ালে ডাকি। নাকোচ করি প্রস্তাব।
জানাই বিয়ে করব না আমি। আর তোমাকে তো কখনই না।

সে বলে, “কেন।”
আমি বলি, “নতুন করে কাউকে বিশ্বাস করতে পারব না। তাই করব না।”

সে বুঝায়, “সবাইকে এক পাল্লায় মেপো না। আজ তিন চারটে বছর থেকে তোমার পিছনে পড়ে আছি, তুমি কথা না বলা স্বত্বেও। এই যুগে ক’জন এমন করে একবার ভাবো? তারপরেও আমাকে বিশ্বাস করছো না। একবার বিশ্বাস করে দেখতে পারো আমায়। কখনও ভাঙবে না।

জানো রুহি? যেদিন তোমায় প্রথম লাইব্রেরি তে দেখি, এক আকাশ পরিমাণ মুগ্ধতা নিয়ে তোমাকে দেখেছিলাম। এখনও দেখি। জীবনের শেষ অব্দি ও দেখতে চাই। প্লিজ এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করো না আমায়।”

“আমার ছেলেকে রেখে আমি কোথাও যেতে পারব না। বাবাহারা সে, মা হারাও করতে চাই না। দরকার হয় আমার সুখ বিসর্জন দেবো।”

সে হাসলো খানিক। বলল, “তুমি সত্যিই পা*গ*ল৷ আমাকে বুঝতে পারো নি। ছেলেটা তোমার সবচেয়ে বড় সম্পদ। তোমাকে আপন করতে চাই মানে, তোমার আপন সবকিছু আমার ও আপন। আমি যেমন ভালো স্বামী হব তেমনি একজন ভালো বাবা হয়েও দেখাবো। তোমার আমার দুজনের সাথে ছেলে থাকবে।”

“এতদিন কোথায় ছিলে? কোন মেয়ে আসেনি জীবনে?”

“সত্যি বলতে মেয়ে এসেছে। কিন্তু মন বসাতে পারিনি কোথাও। ওভাবে সম্পর্ক ও গড়ে উঠেনি কারও সাথে। মনের ঠিকানা একমাত্র তোমার মাঝে।
আর এতদিন আমি বাহিরে ছিলাম। তোমাকে তো নক করলেই ব্ল*ক করতে তাই আর করিনি। সব খবরাখবর নিতাম তোমার বান্ধবীর থেকে। বলো না বিয়ে করবে আমায়?”

“জানি না। আমার মন সায় দিচ্ছে না।” বলে আমি চলে আসলাম।

আমি দু টানার মধ্যে থাকলেও পরিবারের সবাই রাজি হওয়াতে আমিও হলাম। মা তো বলেই দিয়েছেন, এ বিয়েতে রাজি না হলে আমার আর মুখ দেখবি না। দুদিন পর আমরা মরে গেলে কে তোকে দেখবে। ভাগ্যের লিখন হয়তো তাই ছিলো। আমাদের বিয়ে হলো। এত এত ভালোবাসা, কেয়ারিং দেখে আমি মাঝেমধ্যে অবাক হই। একটা মানুষ এত ভালো হয় কি করে। মন বলে, এইতো মনের মতো কাউকে পেয়েছি।

দেখতে দেখতে বিয়ের সাত বছর হয়ে গেলো। সপরিবারে আমরা লন্ডনে থাকি। ভালোবাসা এক বিন্দু ও কমেনি ফুয়াদের। ছেলের সাথে বন্ডিং ভালো ফুয়াদের। ফুয়াদকে বাবা বলেই ডাকে সে। তাদের যখন একসাথে আড্ডা দিতে দেখি তখন আমার একটা কথাই মনে হয়, মাঝেমাঝে রক্তের সম্পর্ক থেকেও আত্মার সম্পর্ক অনেক গভীর হয়। ফুয়াদ তার বিশ্বাসের মর্যাদা দিয়েছে।

আয়ান তার মা বোন কদিন পরপর কল দেন ছেলের সাথে কথা বলার জন্য। ফুয়াদ নিজে থেকে কথা বলিয়ে দেয়। শুনেছি সেই মেয়েটা আয়ানের সাথে নেই। ডিভোর্স হয়েছে। আর বিয়ে করেনি কাউকে।

মাঝেমধ্যে বুক খানিক হু হু করে উঠে আয়ানের জন্য। প্রথম ভালোবাসা সে। পরমুহূর্তে যখন আবার মনে পড়ে আমার সাথে করা তার অ*ত্যা*চা*র। তখনি ঘৃ*ণা জেগে উঠে।

[সমাপ্ত ]

ভুল থেকে ফুল পর্ব-০২

0

#ভুল_থেকে_ফুল
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_২

সব ঠিকঠাক চলতে লাগল। আয়ান যে আমার অজান্তেই তার পরিবারকে এ বিষয় জানিয়েছে, সেটা আমি জানতাম না। তার মা-বাবা সবার পরামর্শেই সে সালিশ বসিয়েছে। নিজের স্ত্রীকে সবার সামনে এভাবে সালিশ ডেকে অপমান করার বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারছি না। না চাইতেও তার প্রতি খারাপ লাগা আসছে। আমার জন্য আমার মা-বাবার বা সম্মান কোথায়! সে আমার পরিবারের দিকটা ভেবে দেখলে পারতো। এত মিনতি করার পরেও সে কেন এমন কাজ করল! কেন অন্যদের কথা শুনতে গেলো! তার নিজের বিবেক নেই!

উপস্থিত সবার সামনে আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, “তুমি কি সংসার করতে চাও?”

কোন কথা না বলে আমি হ্যাঁ সূচকভাবে মাথা নাড়ালাম।

“যদি করতে চাও তাহলে আজ থেকে ওই ছেলের সাথে কখনও কোনও কথা বলবা না।”

বাধ্য মেয়ের মতো আবারও হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চলে আসলাম নিজের রুমে। জোরে কান্না পাচ্ছে আমার কাঁদতে লাগলাম। মা এসে বললেন, এমনভাবে তোর জন্য আমাদের ছোট হতে হবে কখনও ভাবিনি।

মাকে পুরো বিষয় বিশ্লেষণ করার ইচ্ছে হলো না আমার। থাকার জন্য ও বললাম না। ফুপিয়ে কাঁদছি। আয়ান হেসে ঘরে ডুকলো। জড়িয়ে ধরলো আমায়।এই প্রথমবার তার জড়িয়ে ধরায় গা গিরগির করতে লাগল। সে বলল, সব ঠিক হয়ে গেছে, আর কোনও ঝামেলা নেই। আমিও তোমায় ক্ষমা করে দিলাম।

একবার বলতে ইচ্ছে হলো, আমি তোমার বউ হই।আমার ভুলগুলো একান্ত তুমি শুধরাবে। তুমি কেন দু’পরিবারে সেটা জানাবে। এতে আমি আর আমার পরিবার অপমানিত হয়েছি। তোমার প্রতিও ঘৃ*ণা আসছে। কিন্তু কিছুই বললাম না। সে বুঝার হলে আগেই বুঝতো।

কয়েকদিন এই বিষয় নিয়ে আমার মন খারাপ থাকলেও ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে গেল। হাসি আনন্দে দিন কাটছে আয়ানের সাথে। ওদিকে ফুয়াদ বিভিন্ন নাম্বার থেকে, বিভিন্ন ফেসবুক আইডি থেকে, হোয়াটসঅ্যাপ এ নক করে, আমি সাথে সাথে ব্ল*ক দেই। আমি চাই না আবার আমার সংসারে অশান্তি লাগুক।

আমি প্রে*গ*ন্যা*ন্ট হই। মা হতে চলেছি, এই অনুভূতি বলে বুঝানের মতো না। আয়ান আর আমি ভীষণ খুশি। ডেলিভারি হওয়ার দুমাস আগে বাপের বাড়ি চলে যাই। আয়ান প্রথমে রেগুলার খোজ খবর নিলেও আস্তে আস্তে তার মাত্রা কমে আসলো। এমনিতে শরীর ভীষণ খারাপ তার উপর তার এই পরিবর্তন আমাকে গভীর ভাবাচ্ছে। আমি কোনমতে শান্তি পাচ্ছি না। দুই দিনে, তিনদিনে একবার সে আমায় কল করে তাও তিন চার মিনিট কথা বলে শেষ। অভিমান করে আমিও আর কল দেইনা। এই মানসিক অশান্তি ভোগ করতে করতে চলে আসলো আমার ডেলিভারি ডেট। সে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে চাইলেই আমার দুঃসময়ে পাশে থাকতে পারতো কিন্তু নেয় নি। শুধু এক দুইবার খোজ নিয়েছে, ব্যাস। আমার ছেলে বাবু হয়েছে। গভীর রাতে বাবুকে বুকে জড়িয়ে ইচ্ছেমতো কাঁদলাম। সে কেনো আসলো না এইজন্য।

একটা সংসার তো আর সহজে ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমি দ্রুত তার কাছে ফিরলাম। মানুষটার হয়েছে টা কি তা দেখার জন্য। নজরুলের মতো লম্বা চুল আর উদাস উদাস ভাব দেখে আমার সন্দেহ হলো বেশ। কিন্তু প্রকাশ করিনি কিছু। আমার সাথে ভালোই ব্যবহার করছে। বাবুকে যত্ন করছে। মেয়ে তো আমি, তাই সে শত আঘাত দেওয়ার পরেও একবার ভালো করে কথা বললে সব ভূলে যাই।

সপ্তাহ যেতে না যেতে একদিন তার ফোনের ওয়ালে একটা মেসেজ আসলো হোয়াটসঅ্যাপ এর। স্বাভাবিক মেসেজ না, প্রেমের কথা। আমার দম বন্ধ লাগছিলো এটা দেখে। কিন্তু আয়ানকে বুঝতে দেইনি। তার ফোনের পাসওয়ার্ড চেন্জ ছিলো তাই কৌশলে আগে সেটা জানলাম। সারাদিন অশান্তিতে থেকেছি, রাতে অনেক আগে শুয়ে পড়লেও ঘুমাইনি। ঘুমের ভান করে শুয়ে আছি। সে যখন ঘুমিয়ে পড়লো তখন রাত তিনটা। তার ফোনটা হাতে নিয়ে চুপিচুপি বারান্দায় গেলাম। ফোন কল, মেসেজ, মেসেন্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমু সবকিছুতে একই মেয়ে। ভালোবাসার, প্রেমের, রোমান্টিক আর অ*শ্লী*ল*তার মেসেজে ভরপুর সব বক্স।এসব দেখে বসে পড়লাম আমি। অদ্ভুত কাঁপুনি হচ্ছে পুরো দেহে। কান্নারা দলা বেধে গলায় এসে জড়ো হলো। মুখে কাপড় গুজে চিৎকার করলাম। কবে থেকে এসব শুরু তা খুজতে লাগলাম। সব দেখে বুঝলাম, আমি বাড়ি যাওয়ার কয়েকদিন পর থেকেই সে রিলেশনে জড়িয়েছে। নিজেকে নিজের কাছে খুব ছোট মনে হলো আমার। আমি এতো আকর্ষণীয় হয়েও তাকে আমাতে আসক্ত করতে পারলাম না।

আয়ান টের পেয়ে উঠে আসলো। কেড়ে নিলো ফোন। কেঁদে কেঁদে বললাম, “এটা কি করলে? আমাদের বাচ্চা আছে এখন! এখন কি এসবের সময়?”
সে ঝটপট উত্তর দিলো, “তুমি প্রেম করতে পারছো, আমি পারব না কেন?”
আমি শকড খেলাম তার কথায়। বললাম, “আমি জাস্ট ক’দিন কথা বলেছি। এত ভালোবাসার আর নোংরামি মেসেজ করিনি। আমি জড়ানোর আগেই ফিরে এসেছি। অনুতপ্ত হয়েছি। মাফ চেয়েছি। আর তুমি! মেসেজ দেখে মনে হচ্ছে, মেয়েটা তোমার বউয়ের থেকেও বেশি ঘনিষ্ঠ। ”

আয়ান কোন উত্তর দেয় নি। সে অনুতপ্ত ও নয়। আমার মন বলছিলো, এই বোধহয় বলবে, আর এমন হবে না রুহি। মাফ করে দাও। কিন্তু সে বলেনি এমনটা। ব্যাপারটা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছে আমার। সারারাত কেঁদে কেঁদে কাটালাম। কাউকে বলার ও সাহস নেই। বললে নিজেরই লজ্জা লাগবে। যদি কেউ করুণা করে বলে উঠে, বউ এত সুন্দর হওয়া স্বত্বেও বর আরেক মেয়ের সাথে কথা কয়, ইশ বেচারী!
এই যে এই কথাগুলো আমি মেনে নিতে পারব না। নিজেরে বড্ড ছোট লাগবে।

পরের দিন রাত ১২টায় সে টেক্সট করছে ওই মেয়ের সাথে। আমি গিয়ে পাশে বসি। না চাইতেও চোখের পানি পড়ছে। সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ ও নাই। রাগে, জেদে, কষ্টে রুমে এসে ব্লে*ড নিয়ে নিজের হাত কাটতে গেলাম। কেটে কেটে একদম রক্তের নদী বসিয়ে ফেলব, এমনটা মনোভাব। হুট করে তখন মাথায় আসলো একটা কথা, আমি পাশে বসে কান্না করা স্বত্বেও যে ফিরে তাকায়নি একবার। আমার পুরো শরীর কেটে ফেললেও তার কিছু যাবে আসবে না। আমি উঠে দাড়ালাম। নতুন করে শক্তি পেলাম। ওযু করে তাহাজ্জুদ পড়লাম। কেঁদে কেঁদে দোয়া করলাম। দীর্ঘ সময় মোনাজাত করার পর ভেতরে শান্তি অনুভব করলাম।

তারপর থেকে আমাকে কেমন যেন অন্যচোখে দেখে সে। অল্পস্বল্প ভুল হলে শাশুড়িকে, এমনকি আশেপাশের সবাইকেও বলে। তারা আবার আয়ানকে ফিরতি বলে, বউকে এতছাড় দিতে হয় না। শাষন করতে হয়। আমি এসব শুনি আর আড়ালে গিয়ে চোখের পানি ফেলি। আয়ানকে অনেক বুঝাই। কিন্তু সে ঠিক হয় না। আমি হিসেব খুজি, কি করে একটা মানুষ এভাবে রাতারাতি পরিবর্তন হয় হুট করে। আমার হিসেব মেলে না।

আমার প্রতি তার অবহেলা চরম পর্যায়ে পৌছাচ্ছে। অযথা খুত খুজে। বকে। অপমান করে। বহুদিন অপেক্ষা করেছি, সে ভালো হওয়ার। একটা বাচ্চা আছে এজন্য সব ছাড় দিয়েও থাকতে চেয়েছি। কিন্তু আর সহ্য হচ্ছে না। অপারগ হয়ে ভাবলাম, আমার বাচ্চার জন্য আমি একাই যথেষ্ট। তখন মা-বাবাকে পুরো বিষয়টা জানালাম। বললাম, আমি আর পারছি না। পাগল হয়ে যাব এভাবে থাকলে। আমি আসছি বাড়ি।

সপ্তাহের ভেতর চলে গেলাম বাপের বাড়ি। কিছুদিন যেতেই আয়ান যায়, মিনতি করে নিয়ে আসে। বলে আর করবে না এসব। এভাবে কয়েকবার চলল, আমি যাই আর সে ‘করব না’ বলে নিয়ে আসে। কিছুদিন ভালো যায় তারপর আবার শুরু হয় অশান্তি। খারাপ ব্যবহার করে। আমার সত্যিই খুব ঘৃ*ণা চলে আসল আয়ানের প্রতি। ঠিক করলাম, তার কথায় আর ভুলব না। হাজার মিনতি করলেও ফিরব না। সে আমাকে জ্বালাবে, আবার ছাড়বে ও না। অন্য জায়গায় ফ*ষ্টি*ন*ষ্টি করে বেড়াবে। এবার তাকে চিরতরে মুক্তি দেবো।

চলমান…..!

ভুল থেকে ফুল পর্ব-০১

0

#ভুল_থেকে_ফুল
#শারমিন_প্রিয়া
#পর্ব_১

শশুরবাড়িতে আজ আমার বিচারের আয়োজন করা হয়েছে। পুরো ড্রয়িংরুম ভর্তি মানুষজন। দুই পক্ষের লোক উপস্থিত। সালিশ ডেকেছে আমার স্বামী আর তার মা-বাবা। আমার স্বামী আয়ান বসে আছে সোফার উপর। তার মুখে শয়তানি হাসি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আমার কাছে হাসিটা পৈশাচিক হাসি লাগছে। অনেকক্ষণ কি সব কথাবার্তা হওয়ার পর আমাকে খানিক আগে ডাকা হয়েছে। আমি এক কোণায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। আমার বিশ্বাস করতে এখনও কষ্ট হচ্ছে যে, আমার জন্য এ সালিশ বসেছে আর সেটাও আমার স্বামী করেছে। লজ্জায় ঘৃণায় এখনি আমার মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে। মন বলছে, এখনি ফ্লোর দু’ভাগ হয়ে যাক আর আমি গর্তের মধ্যে ডুকে পড়ি।

আজ থেকে প্রায় তিনবছর আগে আয়ানের সাথে আমার বিয়ে হয় পারিবারিক ভাবে। ঠিকঠাক চলছিলো সব কিন্তু বাধা আর মনোমালিন্য তখনি তৈরি হলো, যখন আমি অন্য একজনের সাথে প্রেমে জড়িয়ে যাই। অপর মানুষটির সাথে প্রায় এক মাস কথা বলার পর আয়ান বুঝে যায় ব্যাপারটা আর আজ সেজন্য আমার এই অবস্থা। আমি স্বামী রেখে অন্য একজনের প্রেমে পড়েছি ঠিক। কিন্তু ভুলটা আমার হলেও আমার স্বামী এতে বেশি দোষী। তার কারণেই আমি আবার প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছি।

আমি রুহি। দেখতে বেশ সুন্দর, আকর্ষণীয়, মায়াবী আর আবেদনময়ী। বেশিরভাগ ছেলে প্রথম দেখায় আমার প্রেমে পড়তে বাধ্য। ছোট থেকে আমি আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে আসছি। কিন্তু, ‘তুমি দেখতে বেশ মায়াবী, চোখ ফেরানো দায়’ এই কথাটা হাজারজনের থেকে শুনেও আমার মন ভরতো না, ভালো লাগতো না। মন চাইতো, বিশেষ একজনের থেকে এই কথাটা শুনতে। তারপর হুট করে বিয়ে হলো। আয়ান আসলো আমার লাইফে। আমাদের মধ্যে প্রেম হলো। ভালোবাসা হলো। কিন্তু বিয়ের তিন বছর হতে গেলো, প্রথম প্রথম এক দুইবার সে আমার প্রশংসা করলেও আর করেনি। চোখের দিকে তাকিয়ে কখনও বলেনি, জানো রুহি? তোমার চোখজোড়া অদ্ভুত সুন্দর! অন্তরঙ্গ মুহুর্ত ছাড়া সে কখনও রোমান্টিক আলাপ ও করেনি। চাঁদনী রাতে হাতে হাত ধরে চাঁদ দেখে গল্প করার কথা থাকলেও আমাদের এমন মুহুর্ত আসেনি। আমি আমার ইচ্ছের কথা বললেও সে নীরব থাকতো। কোনকিছুতে তার ইন্টারেস্ট নেই। যা লাগবে সে তা ঠিক টাইমে এনে দেবে, তার ভালোবাসা এইটুকুতে সীমাবদ্ধ। কেয়ারিং এর বিষয়ে সে জিরো। আমার মন চাইতো, কেউ আমায় ভীষণ যত্নে রাখুক। চোখে হারাক। মন খারাপের দিনগুলোতে আমার পাশে বসুক। আমার মন ভালো করার দায়িত্ব নিক। কিন্তু এমনটা কখনও হয়নি।

আমি তাকে খুব ভালোবাসি। আমার থেকেও বোধহয় বেশি বাসি। কিন্তু তবু হৃদয়ে অশান্তি লাগতো। সে থাকা স্বত্বেও ভেতর বাড়িতে অদ্ভুত শূন্যতা বিরাজ করতো। বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো। খালি মনে হতো, আমি এখনও পরিপূর্ণ না। আমার মনের মতো কাউকে পাইনি।

লেখাপড়া ছাড়া নিজেকে অচল লাগে। তাই বিয়ের পরেও লেখাপড়া কন্টিনিউ চলছে। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আমি। কলেজে অনেকের সাথে পরিচয় হয়। কেউ কেউ যেচে এসে কথা বলে। বিবাহিত শুনার পর মন্তব্য করে, যে আপনাকে পেয়েছে সে খুবই ভাগ্যবান। তাদের থেকে এ কথা শুনলেই আমার মন ভেঙে যায়। মনে হয়, সবাই বলে আমারে যে পাইছে সে ভাগ্যবান কিন্তু আজ অব্দি একবারও সে বলল না, তোমাকে পেয়ে আমি ভাগ্যবান। অচেনা অভিমান আর মন খারাপি ভর করে তখন আমার উপর।

এক বৃষ্টিস্নাত দিনে লাইব্রেরী বসে আছি।হুদাই বইয়ের পাতা উলটপালট করছি। বান্ধবী চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল, সামনে তাকিয়ে দেখ লাল টি-শার্ট পরা একটা ছেলে তোকে বারবার দেখছে। আমি আড় চোখে তাকালাম। সত্যিই তো, ছেলেটা একবার বইয়ের পাতায় চোখ বোলায় আর একবার আমার দিকে তাকায়। বেশ বুঝলাম, বইটই পড়ছে না। হুদাই আমাকে দেখার জন্য এই বাহানা করছে।

সেদিনের পর থেকে লাল টি-শার্ট ওয়ালা ছেলেটা কখনও সামনে থেকে আবার কখনও দূর থেকে আমাকে দেখতো। একদিন তো সোজা সামনে এসে গোলাপ নিয়ে বসে পড়লো হাটু গুজে। আমিসহ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ছেলেমেয়ে অতি বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি। সে সেসব দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বলল, “তোমাকে আমার খুব ভালো লাগে। খালি দেখতে ইচ্ছে করে। না দেখলে মনের উঠান বিষাদে ভরপুর হয়। তুমি কি তোমাকে দেখার সারাজীবন সুযোগ দেবে আমায়? বিনিময়ে আমি ভালোবাসা দেবো। আগলে রাখব। যত্নে রাখব।”

কোন অস্বস্তি ছাড়া স্ট্রংলি ছেলেটা এক নাগাড়ে বলে ফেলল এত কথা। আমি কি বলব না বলব বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু এতটুকুই বলতে পারলাম, “উঠুন আপনি।”

আমার বান্ধবী তাকে বলল, “আপনি ভুল করছেন। হয়তো জানেন না। রুহি বিবাহিত। ”

সে চোখজোড়া বন্ধ করে আবার খুলল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে সহজ গলায় বলল, “ভালো লাগার সময় তার কোথাও লেখা ছিলো না যে, সে বিবাহিত। রাতের পর রাত, দিনের পর দিন যখন তাকে নিয়ে বিভাের থাকতাম, তখনও আমার অনুভূতিরা একবারের জন্য ও জানান দেয়নি যে, মেয়েটা বিবাহিত। ভালো লাগা যখন ভালোবাসায় রুপান্তর হলো, তখনও এই শহরের একটি কাকপক্ষী ও বলেনি সে বিবাহিতা। সবশেষে এখন জানলাম সে বিবাহিতা। এখন তাকে ভুলে যাওয়া, এড়িয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব না।”

তারপর সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি ফুয়াদ। ইংরেজি ফাইনাল ইয়ারে আছি। এখন তুমিই ডিসিশন নাও আমায় গ্রহন করবে কি না।”

আমি তো স্পেচল্যাস।এক পলক শুধু তাকালাম তার দিকে। তাকাতেই বুক ধুক করে উঠলো। অদ্ভুত সুন্দর ঘন পাপড়িওয়ালা বিশিষ্ট টানাটানা তার চোখ দুটো। মায়ায় কাড়া শ্যামলা বর্ণের চেহারা। বিস্তৃত কপালের উপরে কাটাকাটা করে চুল খাড়া করে রাখা। মনে হচ্ছে কেউ চুলগুলো সোজা করে ধরে রেখেছে উপরে। আমি দ্রুত চোখ সরিয়ে ফেললাম। অন্য দিকে মাথা ঘুরিয়ে বললাম, “আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“আমি অপেক্ষায় থাকব।” এই বলে সে দ্রুত পায়ে চলে গেলো।
আমার মন খচখচ করতে লাগলো। মস্তিস্কে বারবার উঁকি দিচ্ছিলো তার সুন্দর কথাগুলো।

ফিরিয়ে দেবার পরেও ফুয়াদ আমাকে দেখতো। আড়াল থেকে আবার সামনে থেকেও। অপলকভাবে তাকিয়ে থাকতো। তেমনি আরেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঝুমবৃষ্টির দিনে আমি ভিজে জবুতবু হয়ে কলেজ ডুকছিলাম। সে কোথা থেকে এসে হেঁচকা টান দিয়ে ছাতার ভেতর ডুকিয়ে রাগ ঝাড়লো, “কোথাও দাড়াতে পারতে! জ্বর আসবে তো!”
আমি কোন উত্তর না দিয়ে বাংলা ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় উঠলাম।
দাড়াও আমি আসছি বলে দশ মিনিটের ভেতর একটা ওয়ান পিস, ওড়না আর টাইলস এনে দিয়ে বলল, “চেন্জ করে এসো তাড়াতাড়ি।”
আমি সত্যি তার এসব আচরণে অভিভূত হয়ে যাচ্ছি।

এইভাবে চলতে চলতে তার ভালোবাসা, কেয়ার দেখে আমিও তার প্রেমে পড়ে গেলাম। লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলতাম। কলেজে এড়িয়ে চলতাম। তার কারণ কম বেশ অনেকে জানে আমি মেরিড।

একদিন সারাবেলা অফলাইন থাকায় সে সিমে মেসেজ করছিলো, “কোথায় তুমি? তুমি জানো না, তুমি ছাড়া সবকিছু আমার বিষাদ লাগে।”
সেই মেসেজটা আায়ান দেখে ফেলে। কথায় আছে না, কোনকিছু লুকিয়ে রাখা যায় না। আমার বেলায় ও তাই হলো। আয়ান এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে আমি কাঁপতে লাগলাম। চারপাশ অন্ধকার লাগতে শুরু করলো। আমি কিছু না ভেবে তার পায়ে পড়ে কান্না শুরু করে দিলাম। মিনতি করে বললাম, আমি ভুল করে ফেলেছি। আমার ভুল হয়েছে। আমায় ক্ষমা করে দাও। কখনও আর কারও সাথে কথা বলব না। মনে ভয় লাগতে শুরু হলো, যদি এই কারণে আয়ান আমাকে ছেড়ে দেয়, আমি মানতে পারব না। আমি আমার স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসি। তার জন্য আমি হাজারও ফুয়াদকে ছেড়ে দিতে পারব। আয়ানকে সারারাত দিন মিনতি করলাম। কাউকে বলো না প্লিজ। আমি ভুল পথে চলে গিয়েছিলাম আর তার কারণ এই এইগুলো। তুমি হয় এমন হও, আমাকে কেয়ার করো, আর না পারো করো না। ছোট্ট একটা জীবন, অত কিছ লাগব না আমার। তোমার সাথে থেকেই কাটিয়ে দেবো পুরো জীবন। আয়ানকে স্বাভাবিক দেখালো। বলল, মাফ করলাম। আমি নিশ্চিন্ত হলাম। তার প্রতি ভালবাসাটাও আরও বাড়ল।

ওদিকে ফুয়াদ ফোন কল মেসেজ দিয়ে পাগল করে দিচ্ছে। সময় করে তার সাথে কথা বললাম। বুজিয়ে বললাম, “তুমি জানো আমি বিবাহিতা আর তা জেনেই আমাকে ভালোবেসেছো। কিন্তু আমি বোধহয় তোমাকে ভালোবাসিনি। বড়জোর প্রেমে পড়েছি বলতে পারো। তোমার কথার প্রেমে পড়েছি। তুমি খুব সুন্দর আর গুছিয়ে কথা বলো! হয়তো এজন্য! ”

“তাহলে আমার সব অনুভূতি কি তোমার কাছে শুধু কথার খেলা ছিল? আমি তোমাকে ভালোবেসে নিজেকে হারিয়েছি, আর তুমি সেটা শুধু কথার মোহ বলে উড়িয়ে দিচ্ছো?”

“দেখো ফুয়াদ, তোমার জন্য আমার সংসার ভাঙ্গুক এটা কখনও চাইব না। আমায় আর খুজো না প্লিজ। ভুলে যেও। কখনও কথা বলার চেষ্টা করো না।”

“তোমার জন্য যদি আমার সঙ্গে কথা বলা কঠিন হয়, তাহলে চুপ থাকো। কিন্তু মনে রেখো, আমার মন থেকে তোমার জায়গাটা কখনো মুছবে না।”

“তোমার মন থেকে মুছে যাবে কি যাবে না, সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি স্পষ্ট বলতে চাই—তোমার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখার ইচ্ছা আমার নেই।”

ফুয়াদকে ফিরতি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সবকিছু থেকে ব্লক করে দিলাম। তাকে দেখলে হয়তো আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এজন্য কলেজ যাওয়া ও সাময়িক অফ করলাম।

আমি খুব ভালো করে বুঝতে পারলাম যে, আল্লাহ পর্দা কেন ফরজ করেছেন। যতই বিবাহিত আর অবিবাহিত হোক না কেন, বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ থাকে। এসে যায়।

চলমান…..!