Thursday, July 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 33



অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-০৪

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৪
লাবিব নীলাঞ্জনার পিঠের চুল সরিয়ে ঘাড়ে আলতো করে চুমু খেলো। কোমড়ে হাত রেখে নিজের বক্ষে জড়িয়ে নিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, ভালোবাসি আমার প্রিয়তমা।
‘নীলাঞ্জনা কিছুটা সরে দাঁড়ালো। লাবিব কতবার বলবো বিয়ের আগে আমার এসব পছন্দ না। আমরা বিয়েটা কবে করছি?
‘ করছি না আমরা বিয়ে। ভালোবাসি আমি তোমাকে কি অদ্ভুত তোমাকে টাচ করলেই তোমার শরীর জ্বলে উঠে! তা তো উঠবেই পাইলট জিয়ান রেজা চৌধুরীকে খুব মিস করছো বুঝি? এতোই যখন রেজার জন্য প্রেম উতলে পরে তাহলে আমার সাথে আসলে কেনো? রেজাকে বিয়ে করে এখন হানিমুন সেরে ফেলতে।
‘নীলাঞ্জনা ঠাসসস করে লাবিবের গালে চড় বসিয়ে দেয়, আমার এখন মনে হচ্ছে আসলেই আমি ভুল মানুষের জন্য সবাইকে ত্যাগ করেছি। তুমি আমাকে সত্যি সত্যি ভালোবাসো তো? আমি তোমাকে কি বলেছি? যাস্ট এতোটুকুই তো শারীরিক সম্পর্কে আমরা বিয়ের পরে জড়াবো পবিত্র ভাবে। যে পুরুষ শরীরের পাগল হয় সে তো কখনো ভালোবাসতে পারে না। তার নেশা শরীর, শরীর পেলে একদিন ঠিক তার নেশা কেটে যায়। আমি আজ এক্ষুনি বাসায় চলে যাবো৷ তোমার সাথে আর একমুহূর্ত ও থাকবো না। আমার পরিবার আর আমার যা মানসম্মান যাওয়ার তাতো ধুলোয় মিশি গেছে। তোমার মত মানুষের সাথে থেকে নিজের আত্মমর্যাদা বিসর্জন দিতে পারবো না।
‘লাবিব নীলাঞ্জনার হাত ধরে বলে প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও আমার ভুল হয়ে গেছে। কি করবো বলো, তোমাকে দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে নিজের মধ্যে তোমাকে মিশিয়ে নিতে। আজই আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না লাবিব। আমার মনে বলছে তোমার আমার প্রতি কোন ফিলিংস নেই৷
‘এভাবে বলছো! বলছি তো ভুল হয়েছে এই কান ধরে স্যরি বলছি প্লিজ এবারের মত স্যরি এক্সপেক্ট করো ময়না পাখি৷।
‘করতে পারি এক শর্তে।
‘কি শর্ত বলো ময়নাপাখি। তোমার জন্য এই অধমের জান ও হাজির।
‘কথা দাও আমাদের মাঝে কখনো তুমি জিয়ানকে টেনে আনবে না। আমি যদি ওকে সত্যি ভালোবাসতাম তাহলে ওরে ছেড়ে তোমার কাছে আসতাম! জিয়ান আমার স্কুল লাইফের ভালোবাসা তখন আমি নেহাৎ বাচ্চা ছিলাম আবেগে ভেসেছি। তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার পর আমি অনুভব করেছি হ্যা এটাই ভালোবাসা৷
‘লাভ ইউ আমার ব্যাক্তিগত ময়না পাখি।
” এবার যাও বিয়ের আয়োজন করো৷
‘তুমি নাস্তা করে রেডি হও আমি কাজি নিয়ে আসছি।
‘অপেক্ষায় রইলাম প্রেমিকা থেকে প্রিয়তমা স্ত্রী হওয়ার৷
🌿
আম্মু আমি সত্যিই দুঃখিত সুনয়নার বয়সটা যে এতো কম আমি বুঝতে পারিনি। যাইহোক আমি আমার ভুল শুধরে নেবো।
‘তোমার কি বিয়েটাকে ছেলেখেলা মনে হয় জিয়ান? বিয়ে হচ্ছে জন্ম জন্মান্তরের বন্ধন। এটা তোমার কিনে আনা কোন শোপিস না। ভালো লাগলো কিনে আনলে ভালো লাগলো না ছুড়ে ফেলে দিলে। তুমি যথেষ্ট ম্যাচিউর তাই নিজের জ্ঞান কাজে লাগাও বোকাদের মত কাজকর্ম করার কোন মানে নেই!
‘নয়না, তুমি বসো আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসি৷
যাওয়ার সময় জিয়ানকে বলে গেলো, আমি যাবো আর আসবো ওর সাথে কোন রকম মিস বিহেভিয়ার করবি না৷
‘নয়না বেডের এককোনায় বসে বসে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রুমটা দেখতে লাগলো। বাপরে রুমের ফার্নিচার থেকে শুরু করে রুমের দেয়ালের রং পর্দা সব সাদা৷ এতো শুভ্রতায় জড়ানো মানুষ এমন খারাপ হয়!
‘এই মেয়ে শোন..
‘প্রথমমত আমার নাম সুনয়না নট এই মেয়ে।
‘তুমি না বাচ্চা?
‘বাচ্চা কাকে বলে জানেন? মন চাইলেই আপনি যার গাল টেনে দিতে পারেন কোলে নিতে পারবেন তাকে৷ আমাকে দেখে কি বাচ্চা মনে হয়! পুরো তেত্রিশ কেজি ওজন আমার আর বয়স ষোল। সো বাচ্চা আর এই মেয়ে দুটোর কোনটাই আমার সাথে যায় না।
‘তারমানে তুমি ইচড়ে পাকা?
‘আপনি যাই বোঝাতে যান আমি বুঝবো না। কারন আপনি জিলাপির প্যাঁচের চেও কঠিন প্যাঁচানো৷ আর ভাববেন না আমি ভীতু! আমার কিন্তু অনেক সাহস জানেন আমার ক্লাসের রাফির নাক ফাটিয়ে দিয়েছিলাম এক ঘুষিতে। আপনি বড়ো তাই কিছু বলিনি৷ কাল রাতে যা করেছেন আপনার নামে মামলা করা উচিৎ।
‘মামলা হইলে পরে দেইখা নেবো থানায়। উপসসসস আমি তো ভিষন ভয় পেয়েছি।
‘আপনার মুখে গান মানায় না আপনার মুখে করলার মত তেতো কথা মানায়। এই আপনাকে আন্টি ছোট বেলায় মুখে মধু দেয়নি?
‘তুমি তো বড্ড বেশি কথা বলো! তোমাকে আজই আমি বাসায় দিয়ে আসবো। বয়সের চেয়ে কথা বেশি শিখেছো পিচ্চি কোথাকার।
‘একদম পিচ্চি বলবেন না৷
‘জিয়ান হুট করে নয়নাকে কোলে তুলে নিলো।
‘এই ছাড়ুন আমি কিন্তু চিৎকার করবো৷
‘নয়নার গালে পরপর দুটো চুমু খেলো এরপর বেডে বসিয়ে দিয়ে বলে,বাচ্চাদের এভাবেই কোলে নিয়ে আদর করতে হয়।
‘মনে মনে নয়না বলে,নেহাৎ ছয়তালা বিল্ডিংয়ের মত দেহ আর লম্বা নয়ত আমি বোঝাতাম আমাকে নিয়ে মজা করার শাস্তি কত কঠিন।
‘জিয়ান নয়নার সামনে বসলো, প্রথমবার নয়নার দিকে নজর দিলো। ভালো ভাবে লক্ষ্য করলো, হলদে ফর্সা গায়ের বরন, পিংকিস পিংকিস একজোড়া ঠোঁট,হরিণের মত টানাটানা একজোড়া চোখ। চেহারা জুড়ে অদ্ভুত সরলতা। হঠাৎ কপালের ডান পাশে চোখ পড়তেই জিয়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। ঠিক নীলাঞ্জনার কপালের ডানপাশে যেখানে তিল নয়নার ও সেম।
‘আপনি রেগে যাচ্ছেন কেনো! আমার ভয় করছে।
‘জিয়ান হুট করে নয়নার চুলগুলো মুঠ করে ধরলো,তোদের মত মেয়েদের আমার চেনা আছে। এই রুপের জালে আমাদের মত ছেলেদের জীবন ধ্বংস করে দিস৷ তোদের এমন অবস্থা করা উচিৎ যাতে আর কোন ছেলের জীবন নষ্ট না হয়। ভালোবাসাকে তোদের কাছে খেলনা মনে হয়!
‘নয়না ব্যথায় কুঁকড়ে উঠলো। চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরতে লাগলো অশ্রুকনা।
‘ব্যথাতুর কন্ঠে অনুনয়ের সুরে বলল,প্লিজ ছাড়ুন আমার লাগছে।
‘মিতা বেগম রুমে এসে এই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে বলে জিয়ান এসব কি হচ্ছে? মানা করেছিলাম তো ওর সাথে মিস বিহেভ করতে! হাতে থাকা খাবারের ট্রেটা টেবিলের উপর রেখে নয়নাকে আগলে নিলেন বুকে৷
‘জিয়ান ততক্ষণে রুম ছেড়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে।
‘দাঁড়াও। মিতা বেগমের কন্ঠ শুনে স্থীর হলো জিয়ানের পা।
‘আম্মু প্লিজ এখন এই মূহুর্তে আমার কোন রকম জ্ঞানের বানী শোনার মন মানসিকতা বা ধৈর্য কোনটাই নেই। আমাকে একটু একা থাকতে দাও।
‘তোমার মেজাজ নিয়ে ডিপ ফ্রিজে রেখে আসো। আজ তুমি যেটা করলে আমার ভাবতেও ঘৃণা হচ্ছে তোমার মত সন্তান আমি গর্ভে ধারন করেছি! এইটুকু একটা মেয়ে তুমি ওর উপর শারীরিক মানসিক টর্চার করেই যাচ্ছো! তোমার প্রেমিকা তোমাকে ধোঁকা দিয়ে আরেক ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে তাতে এই নিষ্পাপ মেয়েটার কি দোষ? আর কোন মেয়ে এমন মেজাজ সহ্য করবে? মেয়েটা ঠিক ডিসিশন নিয়েছে তোমাকে ছাড়ার। আর হ্যা মনে রেখো ও আজ থেকে আমার মেয়ের মত। জীবনে দ্বিতীয়বার ওর গায়ে আঘাত করার কথা চিন্তাও করলে তোমার মত ছেলেকে অস্বীকার করতে আমি দুবার ভাববো না৷
‘জিয়ান বাহিরে এসে সোজা চিলে কোঠায় চলে আসলো। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তার৷ আচ্ছা ছেলে মানুষের হৃদয় ভেঙে গুড়িয়ে গেলেও কি তাদের কান্না করা মানা! আমি কি দোষ করেছিলাম শুধুমাত্র নীলাঞ্জনা কে ভালোবাসতাম। আমি তোমাকে কিভাবে বোঝাবো আম্মু, নীলাঞ্জনাকে আমি খোলসের আড়ালে থাকা মুক্তর মত যত্নে রেখেছিলাম। নিজে শত আঘাত সহ্য করলেও কখনো ওর শারীরে সামান্য আঁচড় ও আসতে দেইনি৷
কেউ কেনো বোঝেনা ছেলেদেরও হৃদয় আছে! তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ কেউ কেন দেখতে পায় না ? তারাও পুড়ে বিরহের অনলে সেই দগ্ধ হৃদয়ের আর্তনাদ কারো হৃদয় স্পর্শ করে না! কেন কেন?
“তুমি ভুল ছিলে না, তুমি ছিলে সদ্য ফোটা সুভাষিত ফুল।
যার ঘ্রানের মাদকতা আমাকে নিঃশ্ব করে দিয়েছে।”

#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-০৩

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -৩
তুই কি আসলেই মেয়টার সাথে ইন্টিমেড হয়েছিস!
‘চুপ কর শা’লা মেজাজ এমনিতেই খারাপ আর খারাপ করিস না। নি*কো*টিনে শেষ টান দিয়ে বলে,করতে পারলাম কই?
‘তাহলে কি করেছিস! এই অবস্থা কি করে হলো?
‘তেমন কিছুই করিনি। টেনে রুমে নিয়ে এসেছি জবরদস্তি করেছি। পুরোটা কম্পিলিট হওয়ার আগেই মেয়ে বেহুশ!
‘তুই এইটুকু মেয়ের সাথে জবরদস্তি করেছিস! মেয়েটা বাচ্চা ব্রো?
‘রাখ তোর বাচ্চা। ছয়মাসের বাচ্চার মা হয়ে যাবে আসছে বাচ্চা! একটা বাচ্চা মেয়েকে কোন বাবা বিয়ে দেয়! আমার আর ওর বয়সের ডিফারেন্স জেনেই বিয়ে দিয়েছে।
‘জায়িন তুই তো আমার বন্ধু জায়িন না। আমি যে জায়িনকে চিনি সে-তো মেয়েদের সম্মান করে, ভদ্র প্রকৃতির একজন আদর্শ পুরুষ।
ভদ্রতা! ভদ্রতাকে আমি দাফন করে দিয়ে এসেছি ও-ই বাড়ির উঠোনে। কি দোষ ছিলো আমার? ভালোবাসে ছিলাম এইটুকুই। সবার বিরুদ্ধে যেয়ে বিয়ে করে নিজের অর্ধাঙ্গিনী বানাতে চেয়েছিলাম এটাই ভুল!
‘এখানে সুনয়নার দোষটা কোথায়?
‘সাপের বংশে মানুষ আসবে কোথা থেকে? ওরা সব ক’টা সাপ। তাই বিষদাঁত আগেই উপড়ে ফেলবো৷ ভাগ্যিস পিরিয়ড শুরু হয়েছে নয়তো আমি ওর এমন হাল করতাম জীবনে অন্য কোন পুরুষের কথা চিন্তায় আনতেও ওপর রুহ কেঁপে উঠতো।
‘তুই যাচ্ছিস কবে? তোর ছুটি শেষ হচ্ছে কবে?
‘সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলে,পাঁচদিনের ছুটির তিনদিন শেষ আর দুদিন বাকি আছে। আচ্ছা লাবিব কই? ওরে তো আমার বিয়ের দিন থেকে দেখছি না৷ মোবাইল ও সুইচড অফ?
‘লাবিব গ্রামে গেছে। লাবিবের কথা ছাড় আমার কথা শোন, মেয়েটাকে একটা বছর সময় দে। এবার এসএসসি দিবে সেটা শেষ করুক। ততদিনে তোর সাথে ওর সম্পর্ক মজবুত হোক। এমন কিছু করিস না মেয়েটার সাথে যাতে তোকে ছেড়ে যেতে ব্যাধ্য হয়।
‘দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে হনহন করে বেরিয়ে আসলো নাহিদের রুম থেকে। সোজা বাসায় এসে নিজের রুমে ঢুকলো।
খাটের উপর তাকিয়ে দেখে খাটের উপর বসে চকোলেট খেতে ব্যস্ত নয়না। শার্টের কলার কাঁধ বেয়ে পরে কাঁধের বেশ খানিকটা স্পষ্ট।
‘ঝাঁঝালো কন্ঠে ডাকলো এই মেয়ে..
‘ভয়ে চকোলেট মুখের পাশে লেপ্টে গেলো। হাত পেছনো নিয়ে চকোলেট লুকিয়ে রাখলো।
‘তোমার সমস্যা কি? সব সময় নিজের শরীর দেখানোর চেষ্টা কেন করো? এসব কি পরেছো? শাড়ি কই তোমার?
‘নয়নার বলতে ইচ্ছে করলো আমার নাম সুনয়না নট এই মেয়ে। চোখ পিটপিট করে তাকাচ্ছে আর মনে মনে এসব ভাবছে।
‘কি হলো উত্তর দাও শাড়ি কোথায় তোমার?
‘নয়না উঠে দাঁড়িয়ে বলে এই তো।
‘পুরো শাড়ি পেঁচিয়ে কোমড়ের গুঁজে রেখেছে। দাঁড়ানো ফলে শার্টের হাতার ভেতরে হাত দুটো হারিয়ে গেছে।
‘জিয়ানের এবার রাগ না হাসি আসছে। সামনের দিকে ভালো করে তাকিয়ে মনে মনে বলে,আসলেই তো বাচ্চা লাগছে দেখতে! মুখে চকোলেট লেপ্টে আছে। শাড়ি এমনভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে দু’ কদম হাঁটলেই উষ্টা খেয়ে পরবে। বুঝলাম না পুরো পরিবার কি আমার সাথে আবার একটা ধোঁকা করলো! বিয়ের দিনতো জলপাই রংয়ের লেহেঙ্গা পরা মেয়েটাকে এতো বাচ্চা লাগেনি।
‘এই মেয়ে এদিকে আসো।
‘নয়না বারবার হাতা দুটো উপরের দিকে উঠানোর চেষ্টা করছে, কয়েকবার চেষ্টা করে মোটামুটি হাতাদুটো কাবু করতে পেরেছে শাড়ি একটু উঁচু করে সামনে এগোতে চাইলেই বেডের উপর থেকে ধপাস করে পরে যেতে নিলে জিয়ান ধরে ফেলে,জিয়ানের গলা জড়িয়ে ধরে ড্যাপড্যাপ করে তাকিয়ে আছে নয়না। মনে মনে বলে হায় আমার রনবীর কাপুর।
‘জিয়ান ঠাসসস করে নিচে ফেলে দেয়, নয়না জোড়ে বাবাগো বলে জোড়ে চিৎকার করে উঠে। আরো চিৎকার দেয়ার আগেই জিয়ান নয়নার মুখ চেপে ধরে।
‘মনে মনে নয়না বলে,তুই একটা ভিলেন। তোকে আমি এমন শিক্ষা দেবো খালি আরেকটু সাহসটা আমার বাড়ুক।

🌿রুমের মধ্যে বসে না থেকে যাও মেয়েটার কাছে যাও খোঁজ নাও মেয়েটার দেখো তোমার ছেলে তার অবস্থা কি করেছে। দরকার পরলে ডাক্তার খবর দেই। ডাক্তার সুলতানা পারভিন কে কল করলেই চলে আসবে। নাজিম সাহেবের কথা শেষ করার আগেই নয়নার গলার স্বর কানে আসলো। মিতা বেগম দ্রুত ছুটে আসলেন রুমে।
‘এসে দেখে নয়না নিচে পরে আছে জিয়ান তার খুব কাছে মুখ চেপে রেখেছে।
‘মিতা বেগম জিয়ান বলে ডাক দিতেই জিয়ান নয়নাকে ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে আসলো। মিতা বেগম দ্রুত এসে নয়নাকে বুকের সাথে চেপে ধরলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, তোমার এ অবস্থা কেন মা?
‘নয়না আড়চোখে জিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে।
‘রুম থেকে বের হ।
‘জিয়ান সাদা শার্ট নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো।
‘মিতা বেগম নয়নাকে ধরে বেডে বসালেন। কোমল স্বরে জিজ্ঞেস করলেন তুমি শাড়ি পরতে পারো না?
‘নয়না মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো।
‘আসো আমি পরিয়ে দেই। বলে নিজের আঁচল দিয়ে নয়নার মুখে লেপ্টে থাকা চকোলেট মুছে দিলেন। সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিলেন। তুমি বসো আমি তোমার জন্য খাবার আনাচ্ছি। আচ্ছা সকালে তোমার কেমন নাস্তা পছন্দ?
‘নয়না মিতা বেগমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।
‘শাড়ি পরানোর সময় মিতা বেগম নয়নার শরীরে বিভিন্ন চিহ্ন দেখেছেন যা তার ছেলের বদৌলতে বাচ্চা মেয়েটার শরীরে স্থান পেয়েছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,কাঁদে না নয়না। শরীর খুব ব্যথা করছে? আমাকে বলো তোমার কি সমস্যা হচ্ছে?
‘আমি আপনার সাথে থাকবো আন্টি।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তবে জানো তো বিয়ের পর মেয়েদের একমাত্র ভরসা যোগ্য আশ্রয়স্থল স্বামী।
‘নয়না মিতা বেগমের আঁচল খামচে ধরলো। গতকাল রাতে তার সাথে যা হয়েছে এরপর এই মানুষটার সাথে স্বাভাবিক হতে পারবে কখনো!
‘মিতা বেগম নয়নার ভয় বুঝতে পেরে নয়নাকে বলল, তোমার স্বামী ততটা খারাপ না যে রুপ তুমি দেখছো সেটা তোমার বোনের উপর রাগ ক্ষোভ থেকে৷ তবে জানো তোমাকে ভালোবাসা দিয়ে ওর এই রাগকে মোচন করতে হবে। তুমি চিন্তা কোরোনা আমি তোমাকে সহযোগিতা করবো আর্দশবান স্ত্রী হয়ে উঠতে। এখন বসো আমি খাবার নিয়ে আসি৷
‘মিতা বেগম চলে যেতেই নয়নার নীলাঞ্জনার কথাটা মাথায় আসলো। আচ্ছা নীলাঞ্জনা আপি তো লাবিব নামের একটা ছেলেকে ভালোবাসতো তাহলে এই তিত করলার সাথে কি সম্পর্ক! নীলাঞ্জনা আপি কি টু টাইমিং করতো? কেনো এমনটা করলে আমার সাথে নীলাঞ্জনা আপি! কেনো করলে?তোমাকে আমি কোনদিন ক্ষমা করবো না। চোখের পানি মুছে ড্রেসিং টেবিলের উপর একটা মোবাইল দেখতে পেলো দ্রুত মোবাইলটা হাতে নিয়ে সাইট বাটনে ক্লিক করতেই মোবাইলের স্কিনে দুজন কপোত-কপোতী হাসোজ্জল পিক ভেসে উঠলো। এটাতো নীলাঞ্জনা আপি আর তিত করলা। দুজনে এতোটা ক্লোজ! তারমানে আমি যা ভাবছি তাই? মোবাইলটা হাত থেকে রাখার আগেই কেউ ছো মেরে নিয়ে নিলো, কর্কশ কন্ঠে বলে,সাধারণ বোদবুদ্ধি নেই! পারমিশন ছাড়া কারো পার্সোনাল জিনিসে হাত দিতে নেই৷
‘আপনি নীলাঞ্জনা আপিকে কতদিন ধরে চেনেন?
‘সে কৈফিয়ত আমি তোমাকে দেবো না। নয়নার দিকে চোখ পরতেই চোখ গেলো গলার দিকে রক্ত জমে জমাট বেঁধে কালো হয়ে থাকা চিহ্নের উপর।
‘মনে একজন রেখে ঘরে কেনো আমাকে আনলেন? মলিন কন্ঠে বললো নয়না।
‘তোমার বয়স কত?
‘পেছন থেকে মিতা বেগম বলেন, ষোল বছর। এখন মনে হলো বৌয়ের বয়স জানতে হয়? বিয়ের আগে জানতে হয় বিয়ের পরে না।
‘স্যরি আম্মু আমার ভুল হয়েছে। আমি আমার ভুল শুধরে নেবো। আজই সুনয়নাকে ওদের বাসায় ফেরত দিয়ে আসবো।

#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-০২

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২

সকালের আলো রুম জুড়ে ছড়িয়ে পরতেই উঠে বসলো জিয়ান, আড়মোড়া ভেঙে তাকাতেই দেখে বেডে রক্ত লেগে আছে। নাক মুখ কুঁচকে উঠো পরলো। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে তে’লাপোকার মত ছুড়ে মারতে। নিজের রাগ সংযত করে ডাকতে লাগলো, এই মেয়ে উঠো? কি হলো উঠছো না কেন?
‘আম্মু আমার পিরিয়ড চলছে ঘুমাতে দাও ডিস্টার্ব করো না।
জিয়ান আর ডাকলো না নয়না কে। ফ্রেশ হয়ে নিচে চলে আসলো৷ বাসার কারো সাথে কোন কথা না বলে বের হয়ে গেলো বাহিরে৷ ফার্মেসীতে এসে চুপচাপ কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। বারবার ঘুরে ঘুরে প্যাডের দিকে তাকাচ্ছে৷ কিন্তু দোকান তো ফাঁকা হচ্ছে না! দূর আজ কি মানসম্মান এভাবেই যাবে?
‘আপনার কিছু লাগবে?
‘জ্বি এক প্যাকেট প্যাড দিন। সবচেয়ে ভালোটা।
‘লোকটা প্যাড প্যাক করে দিতে দিতে বলে,স্যার নতুন বিয়ে করেছেন বুঝি! তাই নতুন নতুন লজ্জা পাচ্ছেন! আরেহহ স্যার এসব তো কমন ব্যাপার৷ এতো লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। এ-র সাথে চকোলেট,আইসক্রিম, ফুল কিনে নিয়ে যাবেন৷ দেখবেন ভাবি আসমানের চাঁদ পাওয়ার মত খুশি হয়ে যাবে।
‘আপনাকে কত টাকা দিবো?
‘একশ বিশ টাকা।
‘টাকা দিয়ে জিয়ান দ্রুত বের হয়ে আসলো। ইচ্ছে করছিলো লোকটার নাক ফাঁটিয়ে দিতে। বাসায় এসে ঢুকতেই মিতা বেগম বলেন, মেয়েটার সাথে ভালো আচরণ করিস। মেয়েটার বয়স কম।
‘বয়স কম! তাহলে বিয়ে দিলে কেন? বাসায় সাজিয়ে রেখে দিতো! যে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে সে মেয়েকে নিয়ে নাটক আমি সহ্য করবো না।
‘বিয়ে যেহেতু হয়েছে বৌ তোমারই থাকবে কেউ নিয়ে যাবে না৷ কয়েকটা দিন সময় দাও। বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি?
‘আমি বুঝতে পারছি তবে দুঃখিত তোমাদের প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে তার বৌয়ের সাথে ফুলসজ্জা সেরে ফেলেছে।
‘কথা শেষ করার আগেই জিয়ানের গালে ঠাসসস করে একটা চড় পরলো। জিয়ান রক্ত চক্ষু নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখে নাজিম সাহেব।
‘তুমি কি মানুষ আছো? মানুষের তো বোধবুদ্ধি থাকে। নিজেকে মানুষ মনে করলে সুনয়নার সাথে মানুষের মত বিহেভিয়ার করবে। কবুল বলে বাসায় যখন নিয়ে এসেছো সারাজীবনের জন্য সে তোমার অর্ধাঙ্গিনী। নিজের অর্ধেক অংশ ও তোমার। তাই সেভাবেই ট্রিট করবে। বাবা মায়ের সামনে কথা বলার ম্যান্যারস টুকুও হারিয়ে ফেলেছো? তোমাকে পড়ালেখা করতে পাঠিয়ে ছিলাম প্রেম করতে না। করেছো প্রেম। হাজার বার মানা করেছি এই মেয়ের সাথে তোমার যায় না। তবুও তোমার জেদের কারনে আমরা নত হয়েছি। কি লাভ হলো! সেই তো তোমার সাধের প্রেমিকা তোমাকে ছেড়ে পালিয়ে গেলো! বললাম ফিরে আসো কিন্তু না তোমার তো বৌ লাগবেই বৌ ছাড়া তুমি ফিরবে কেন? তো বৌ যখন নিয়েই এসেছো তার যত্ন করো। আর হ্যা এরপর কথা বলার সময় সামনের মানুষটা কে সেটা দেখে ভদ্রতা বজায় রেখে উত্তর দিবে।
‘জিয়ান রাগে টগবগ করতে করতে দোতলায় আসলো। দোতলার সিঁড়ির কাছে থাকা ফ্লাওয়ার বসটা পা দিয়ে ফেলে ভেঙে ফেললো। ইচ্ছে করছো সুনয়নাকে শেষ করে ফেলতে।রুমে এসে দেখে নয়না ব্লাউজের ফিতা বাঁধার চেষ্টা করছে।চোখটা ফিরিয়ে নিলো৷ কিন্তু বেহায়া নজর আবার সেদিকে পরলো। ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে, পিঠের বেশ খানিকটা জায়গা উন্মুক্ত। সেখানে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। ফর্সা ঘাড়ের উপরে জোড়া তিল দুটো যেনো জিয়ানকে চুম্মুকের মত টানছে। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো জিয়ান। জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে কর্কশ কন্ঠ বলে উঠে,শরীর দেখিয়ে জিয়ান রেজা চৌধুরী কে ঘায়েল করা সহজ নয়৷ তা বয়স কম হলেও পুরুষকে কিভাবে আকৃষ্ট করতে হয় সেটা ভালোই শিখেছ!
‘হঠাৎ পুরুষালি কন্ঠ শুনে চকমে যায় নয়না। কোনমতে শাড়ি দিয়ে নিজেকে প্যাঁচিয়ে নিয়ে বলে,আপনার মধ্যে কি সাধারণ ম্যানারস টুকুও নেই! রুমে ঢোকার আগে নক করে ঢুকতে হয়। এই টুকু বলেই ঢোক গিললো নয়না। যদিও চঞ্চল নয়না কাউকে ছেড়ে দেয়ার পাত্রী না কিন্তু এই লোককে দেখলেই কেমন ভয় হয়! নিজেকে তখন সিংহের গুহায় অসহায় বেড়াল মনে হয়।
‘হামারা রুম হামারা মার্জি।
‘অসভ্য মানুষের কাছ থেকে সভ্যতা আশা করাও বোকামি মুখ ফস্কে কথাটা বের হয়ে গেলো। সাথে সাথে ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো। মুখের ভেতর কেমন ধুকপুক করছে।
নয়না শাড়ী দুহাতে ধরে কোনমতে হেঁটে ওয়াশরুমের দিকে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আর কিছুক্ষণ এখানে থাকলেই বিপদ কখন যেনো আক্রমণ করে বসে! হুট করে জিয়ান নয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো। নয়না দু’ কদম পিছিয়ে গেলো।জিয়ান দু’কদম এগিয়ে আসলো।
‘ভীত কন্ঠে বললো, সামনে থেকে সরুন কি করছেন?
‘জিয়ান হুট করে শাড়ি ভেদ করে নয়নার উন্মুক্ত কোমড় আকড়ে ধরে নয়নাকে নিজের অনেকটা কাছে নিয়ে আসলো।
‘নয়না চোখ বন্ধ করে নিলো। হার্ট এতো জোড়ে বিট করছে মনে হচ্ছে কেউ তবলা বাজাচ্ছে। ভেঙ্গে ভেঙে বলল প্লিজজ ছাড়ুন ।
‘উঁহু। অসভ্যতা করা এখনো বাকি। বলেই নয়নাকে ঘুরিয়ে নয়নার পিঠ নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নয়নার কাঁধে মাথা রেখে বলে,উফফ বড্ড আদুরে তুমি। বিয়ে যখন হয়েছে বাসরটাও সেরে ফেলি? এতো কিউট টেডিবিয়ারের মত বৌকে আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে হয়। কে জানে এই বিয়ে কয়দিন টিকে?
‘নয়নার বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পরছে।
হুট করে জিয়ান নয়নাকে ছেড়ে দিয়ে বলে,তোর মত মেয়ের দিকে জিয়ান চৌধুরী নজর ত দূর ফিরেও তাকাই না বলেই ধাক্কা দিয়ে বেডে ফেলে দিয়ে বলে,আগামীকাল রিসিপশনের পরে তোমার ছায়া জেনো এই বাড়িতে না পরে।
‘হঠাৎ করে এমন হওয়ায় শাড়ি পুরোটা এলোমেলো হয়ে গেলো৷ জিয়ান এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,টেবিলের উপরে প্যাড রাখা। আমি বের হচ্ছি তাড়াতাড়ি শাড়ি ঠিক করো।
‘জিয়ান রুম থেকে বের হতেই নয়না শাড়ি পেঁচাতে লাগলো৷ নাহ কোন ভাবেই আগামাথা মেলাতে পারছে না৷ ধুর এসব শাড়ি ফারি আমাকে দিয়ে পরা হবে না। কিন্তু আমি পরবো কি! কোন ড্রেসও তো আনা হয়নি। গালে হাত দিয়ে কতক্ষণ ভাবলো তারপর নিজের খুরাফাতি বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে পরার মত ড্রেস বানিয়ে নিলো। প্যাড হাতে নিয়ে বেশ অবাক হলো। প্যাডের সাথে একটা ব্যাগে কিটক্যাট আর ডেইরি মিল্ক। চকোলেট দেখে বেশ অবাক হলো নয়না। মনে মনে বলে,লোকটা কি এই আধবুড়ো বয়সে চকোলেট খায়!এমন রসকষহীন মানুষ চকোলেট কি করে খেতে পারে? চকলেট খাবে সুইট কিউট মিষ্টি হৃদয়ের মানুষ। ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বেডে বসে চকোলেট খাওয়া শুরু করলো।
🌿
জিয়ান চলে যেতেই মিতা বেগম বললেন, এতো বড়ো ছেলের গায়ে কেউ হাত তোলে?
‘একদম চুপ থাকো। এ সব কিছুর জন্য একমাত্র দায়ী তুমি। ছেলের দোষ সারাক্ষণ আঁচলের তলায় লুকিয়ে রেখে রেখে বিগড়ে দিয়েছো ছেলেটাকে। বয়স! বাবা মায়ের সামনে বয়স আবার কি! অন্যায় দেখলেই কানের নিচে ঠাটিয়ে লাগিয়ে দিলে আজ এই পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতো না। আর হ্যা ও-ই বাড়িতে কল করে বলে দাও কাল এখানে রিসিপশন। সো এখানে এসে যেনো কোন নাটক ক্রিয়েট না করে৷ এখানকার কেউ তো জানেনা এক মেয়ে পালিয়ে গিয়েছে বলে আরেক মেয়েকে ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছি৷ চৌধুরী পরিবার হাত ছাড়া তো করা যায় না। ডার্টি গেইম খেলেছে।
‘দোষ তো তোমার ছেলের ও আছে।
‘সেটাও তোমার ফল্ট আমি তখন তোমাকে বললাম আমি দেখে নিচ্ছি রেজাকে। তখন তুমি বললে দয়া করে ভরা আসরে সিন ক্রিয়েট করোনা। যা হচ্ছে হতে দাও।
🌿জিয়ান রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে!
#চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-০১

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#সূচনা পর্ব
#নুসাইবা_ইভানা

বিছানার চাদর গায়ে পেঁচিয়ে গুটিশুটি মেরে বসে আছে এক কিশোরী। চাদরের বিভিন্ন জায়গায় ছোপ, ছোপ রক্তের দাগ।চোখ মুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। অন্ধকার রাত টিমটিম করে জ্ব’লছে মোমবাতিগুলো পাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন সুগন্ধি ফুল৷

বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসে একের পর এক সিগারেটের পোড়াচ্ছে জিয়ান । জিয়ান রেজা চৌধুরী, সদ্য পাইলটে জয়েন করেছে ।বয়স আঠাশের কোটায় হলেও দেখতে পঁচিশ বছরের যুবক। লম্বা চওড়া শরীর,উজ্জ্বল বর্ণের গায়ের রং, ধুসর রাঙা চোখ।
কিছু সময় পর উঠে এসে কিশোরীর সামনে বসলো, সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ধোঁয়া নয়নার চোখে মুখে ছাড়লো। মোবাইলের টর্চ অন করে বলে,বিয়ে হলে স্বামীর আদর সহ্য করতে হয় তা জানো না।
‘নয়না চুপ করে আছে শরীরের অসহ্য ব্যথা চোখ থেকে টুপটুপ করে অশ্রু ঝড়ছে।
‘বয়স কত তোমার? নাম কি?
‘নয়না তবুও চুপ করে আছে। চোখ থেকে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝড়ছে।
‘জিয়ান রেগে বলে, বোবা নাকি কি জিজ্ঞেস করছি উত্তর দাও?
‘নয়না তবুও মুখ থেকে কথা বের করলো না।
জিয়ান নয়নার বাহু ধরে বলে, নাম জিজ্ঞেস করছি তো উত্তর দাও।
‘নয়না কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,সুনয়না।
‘তোমার বোন কোথায়?নীলাঞ্জনা কোথায়?
‘আমি জানিনা।
‘আমাকে বিয়ে কেন করলে? কবুল কেন বললে?তোমাকে শোপিসের মত সাজিয়ে রাখার জন্য বিয়ে করিনি, ভালো না বাসি, আমি প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ আমার শারীরিক চাহিদা আছে সেটা তো বউ হিসেবে তোমাকে পূরণ করতে হবে। কবুল যখন বলেছ তখন তো আর নিস্তার নেই। বলেই নয়নাকে আবার কোলে তুলে নিলো।
‘নয়না কাঁদো, কাঁদো কন্ঠে বলে,প্লিজ আমাকে ছেড়েদিন আমি আর সহ্য করতে পারবো না৷ অনেক ব্লাড আসছে। আমার শরীরও ব্যাথা হচ্ছে প্লিজ ছেড়ে দিন।আর ব্যথা দেবেননা ভাইয়া৷
‘বয়স কত?
‘ছেড়ে দিন আমাকে আমি সত্যি বলছি আমি মরে যাবো।
‘জিয়ান নয়নাকে বেডে রেখে লাইট অন করলো৷
‘নয়না আরো ভালো করে নিজের শরীরে চাদর প্যাচিয়ে নিলো। এলোমেলো চুল,ফর্সা চেহারাটা লাল হয়ে আছে। চোখে লেপ্টে আছে কাজল, ঠোঁট জোড়া ফুলে উঠেছে।
‘মেয়েটাকে দেখে এবার মায়া হচ্ছে জিয়ানের । জেদের বসে এইটুকু মেয়ের সাথে জোর জবরদস্তি করা হওয়া উচিৎ হয়নি৷ জিয়ান নরম স্বরে বললো, এখনো ব্লাড আসছে?
‘নয়না মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
‘ওয়াশরুমে যাও আর চেঞ্জ করে আসো৷
‘নয়না উঠতে যেয়ে হোচট খেয়ে পরলো৷
জিয়ান নয়নাকে কোলে তুলে ওয়াশরুমে নিয়ে আসলো৷
‘নয়নার শরীরে পানি লাগতেই শরীর জ্বলে উঠলো।
জিয়ান নয়নাকে শাওয়ারের নিচে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বাহিরে চলে আসলো।
বেডের পাশে বসে নিজের ফোনের স্কিনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, কি সুন্দর হাসোজ্জল মুখখানা, কে বলবে এই মেয়েটি তাকে চরম ভাবে ঠকিয়েছে!আসলেই কি স্বার্থের দুনিয়ায় ভালোবাসা ঠুনকো?

এরমধ্যেই শীতে কাঁপতে কাঁপতে জিয়ানের একটু দূরে দাঁড়িয়ে নয়না বলে,আমার প্যাড লাগবে?
‘আমি কি তোমার চাকর আমাকে কেন বলছো!
‘নয়না জিয়ানের ভয়ে আরো দু’কদম পিছিয়ে যায়। যার ফলে নয়নার কাঁধ থেকে চাদর সরে যায়। ফর্সা কাঁদে লাল তিলটা জ্বলজ্বল করছে।
‘জিয়ান চোখ রাঙিয়ে বলে,তুমি কি ড্রেসও পরতে পারো না! এখন সেটাও আমাকে পরিয়ে দিতে হবে?
‘নয়না চাদর শক্ত করে ধরে বলে,আমার ড্রেস ত বাসায়।
‘তাহলে তুমি এখানে কেন এসেছো?
‘নয়না কিছু বলবে তার আগেই জিয়ান নয়নার দিকে একটা টিশার্ট আর জিন্স বাড়িয়ে দিয়ে বলে, আজকের মত ম্যানেজ করো কাল এক ব্যবস্থা করবো।
‘কিন্তু প্যাড?
‘প্যাড দিয়ে কি করবে?
‘নয়না পায়ের নখ দিয়ে দেয়ালে আঁচড় কাটছে৷
‘বলো!
‘পিরিয়ড।
‘প্রথমবার ত তাই ব্লাড বের হয়েছে এখন আর বের হবে না। চুপচাপ এগুলো পরে শুয়ে থাকো।

‘নয়না ওয়াশরুমে এসে টিশার্ট পরতেই হাঁটুর নিচ পর্যন্ত ঢেকে গেলো। ছ’ফুট লম্বা চওড়া বডির টিশার্টের ভেতর নয়না ছানা পোনা। জিন্সটাও পরে দু’হাতে ধরে আবার রুমে আসলো।
‘জিয়ান নয়নার দিকে একবার তাকালো, তাকিয়ে কোনমতে নিজের হাসি চেপে রেখে বলে, বা’পাশে শুয়ে পরো।
নয়না চুপচাপ গুটিশুটি মেরে শুয়ে পরলো।

🌿 মাহফুজা বেগম বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদেই চলেছে।
মাহবুব তালুকদার এবার উঠে বসলেন বেড সাইট সুইচ টিপ দিয়ে লাইট অন করলেন ধমকের সুরে বললেন,সেই কখন থেকে মরা কান্না করছো!তা মরেছেটা কে?
‘এই বাচ্চা মেয়েটাকে চোখের সামনে থেকে নিয়ে গেলো,আর তুমি বলছো কে মরেছে!
‘মাহফুজা কতবার বলেছি, মেয়ের জন্মই হয় পরের ঘরের জন্য। আজ না হয় কাল পাঠাতেই হতো।
‘তাই বলে আমার বাচ্চা মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিবে?
‘আমি যা করেছি এই তালুকদার বংশের মান সম্মান আর ভালোর কথা চিন্তা করেই করছি৷ আর তাছাড়া ছেলেও ভালো আর বংশীয়।
‘সব সময় তুমি ভালোই করো, তবে সেটা তোমার ভাইয়ের জন্য নয়ত তার পরিবারের জন্য। কিন্তু সেসবে আমার মেয়েটাকে কেন কুরবানি দিলে?
‘ আমার মেয়ে আর আমার ভাইয়ের মেয়ে আমার কাছে আলাদা না। নীলাঞ্জনা একটা ভুল করেছে তার ভুলের জন্য আমরা শাস্তি দেবো কিন্তু সমাজের মানুষের কাছে নিজের মেয়ের সম্মান নিয়ে কথা উঠুক সেটা ত হতে দিতে পারিনা। নাজিম চৌধুরী যেমন নাম তেমন তার দাপট তার একমাত্র ছেলে জিয়ান রেজা চৌধুরী। যদি তাদের প্রস্তাবে রাজি না হতাম তাহলে সমাজে মুখ দেখানোর মত অবস্থা তারা রাখতো না।
‘বাহহহ নিজের ভাইয়ের মেয়ের সম্মান রক্ষা করার জন্য নিজের মেয়ের জীবন বলি দিয়ে দিলে!
‘বলি কেন বলছো মেয়ে আমার ভালো থাকবে।
‘তাতো থাকবেই এখনো এসএসসি গন্ডি পেরোতে পারলো না সেই মেয়েকে এক প্রাপ্ত বয়স্ক পাইলটের গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে বলছে মেয়ে আমার ভালো থাকবে! তুমি কি সত্যি সুনয়নার নিজের বাবা? এমন বাবা জেনো কোন মেয়ের না হয়।
‘হ্যা আমি পৃথিবীর সবচেয়ে স্বার্থপর বাবা।
‘তুমি মনে রেখো আমার মেয়ের শরীরে একটু আঁচড় লাগলে আমি কাউকে ছেড়ে দিবো না জেলের ভাত খাওয়াবো সবাইকে ভুলে যাবো কার সাথে আমার কি সম্পর্ক!

মাহবুব তালুকদার উঠে এসে বারান্দায় দাঁড়ালেন রাত বাজে একটা পঁচিশ এখন কি কল করা ঠিক হবে? সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে কল করেই বসলেন নাজিম সাহেবকে।
নাজিম সাহেব ভ্রু কুঁচকে কলটা রিসিভ করলেন গম্ভীর কন্ঠে বললেন এখন আর কি বলার বাকি আছে তালুকদার সাহেব?
‘রাগ অভিমান করাটা স্বাভাবিক কিন্তু ভাগ্যের খেলা আমাদের তো বোঝা দায়।
‘যেটা বলার জন্য কল করেছেন সোজা সেই পয়েন্ট আসুন।
‘আমার মেয়েটা নাবালিকা এখনো তার আঠারো বছর হতো দুই বছর বাকি। আপনার ছেলেকে বলবেন আমার মেয়েটার সাথে যাতে কোন রকম খারাপ কিছু না করে।
‘নাবালিকা মেয়েকে বিয়ে দেয়ার সময় মনে ছিলো না? এখন নিজের ছেলেকে এসব আমি কোন মুখে বলবো?
‘ভাই আমার মেয়েটাকে নিজের মেয়ে মনে করে একটু খেয়াল রাইখেন।
নাজিম সাহেব কল কেটে দিয়ে বলে নাইস জোক্স একটা সাতাশ বছরের যুবকের বউ কিনা নাবালিকা!
মিতা বেগম বললেন কি বলো?তাহলে যাও ছেলেকে আটকাও রাগের বশে মেয়েটার সাথে কি না কি করে ফেলবে।
‘তোমার ছেলের রাগ তোমার অবশ্য জানা কতবার বলেছি এই মেয়েকে বিয়ে করতে হবে না, না করবেই করবে! কি হলো রেজাল্ট মেয়ে আরেক ছেলের সাথে পালিয়ে গেলো, শেষে কি হলো তারা আরেকটা মেয়েকে আমাদের ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিলো? এবার যা হওয়ার হোক তুমি চুপচাপ ঘুমাও।
‘এই সবে বাচ্চা মেয়েটার কি দোষ? ওতো ভিক্টিম সবাই ওর উপর চাপিয়ে দিলো সব!

চলবে।

অলৌকিক পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

⛔অলৌকিক(শেষ অংশ)

সাতদিনের মধ্যে মিলির সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। মিলিকে নিয়ে উঠলাম আমার একরুমের ছোট্ট বাসায়।

বাসর রাতে মিলি আমাকে বলল,
আপনি আমাকে বিয়ে করলেন, আপনার ভয় নাই?

কিসের ভয়।

এই যে আমার সাথে জ্বীন থাকে এটা জেনেও বিয়ে করলেন।

এসব জ্বীন ভুত কখনো মানুষের সাথে থাকে না। এসব আমি বিশ্বাস করি না।
হিহি।
হাসছেন কেনো, হাসির কিছু বলিনি।
আমার সাথে কিন্তু আসলেই জ্বীন আছে।

আচ্ছা ডাকুন আপনার জ্বীনকে। উনিও তো আমাদের সাথেই এ বাসাতে থাকবেন আজ থেকে। আমার সাথে আলাপ পরিচয় করিয়ে দেন।

আপনি বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে।

এই পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ। এক একজন একেকরকমের মতে বিশ্বাস রাখে। তাদের বিশ্বাস তো আর আমি বদলাতে পারবো না।

আমার আগের স্বামী কিন্তু বিয়ের পরদিন মারা গেছে।

শুনেছি।

কিভাবে মারা গেছে শুনবেন?

এসব কথা থাক। আপনি এখন ঘুমান। ক্লান্ত দেখাচ্ছে আপনাকে। ঘরটা ভীষণ এলোমেলো। একটাই ঘরতো। রান্না খাওয়া সব এখানে। আপনার কষ্ট হবে এভাবে থাকতে।

আমার কষ্ট হবে না। আমি গুছিয়ে ফেলব।

একটা কথা বলব?

জ্বি বলেন।

আপনি এতো সুন্দর, এতো সুন্দর কোনো মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে কখনো ভাবিনি।

মিলি আমার কাছে সরে এসে বলল,

আপনিও সুন্দর। এখন গলার হারটা খুলে দিনতো। এসব খুব ভারি লাগছে।
মিলি তার মাথায় দেয়া লাল ওড়না সরিয়ে আমার দিকে পেছন ফিরে বসল। আমি কাঁপা হাতে ওর গলারটা খুলতে চাইছি। কিছুতেই খুলছে না। মিলি খিলখিল শব্দে হাসছে। আমি সাহস করে ওর ঘাড়ে আমার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলাম। ও আমার দিকে ফিরে আমাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল।

মিলি আমার ছোট্ট এক রুমে খুব সুন্দর করে সংসার পাতলো। ঘরের একপাশে সুন্দর একটা কাপড় রাখার আলনা রাখল। আরেকপাশে ছোট একটা মিটসেফে রান্নার জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখল। সাইড টেবিলে সুন্দর একটা ঘড়ি রেখেছে। ঘড়িটার নীচের দিকে একটা ছেলে একটা মেয়েকে পেছন থেকে জড়িয়ে আছে। খাটের পাশের টেবিলেটায় বেশ কিছু গল্পের বই রাখল। ওগুলো ও বাড়ি থেকেই নিয়ে এসেছে সাথে করে।

মেয়েটা দারুণ গোছানো। নিজেও পরিপাটি থাকে। ওকে দেখলে মনে হয় না ওর মধ্যে অশুভ কিছুর বাস আছে।

মিলির অস্বাভাবিকতা প্রথম ধরা পড়ল একদিন রাতে। আমি আর মিলি বসে আছি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো। মিলি বলল,

মোমবাতি আছে?

হুম, আমি আনছি,তুমি বসে থাকো।

আমি উঠে গেলাম ম্যাচ আর মোম আনতে। হাতরে হাতরে এগোচ্ছি। হঠাৎ মিলি বলল,

বায়ে সরে যান। দরজা বা দিকে।

আমি একটু বা দিকে সরে এগোলাম। তারপর থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মিলি কিভাবে দেখছে সারা ঘরতো ঘুটঘুটে অন্ধকার।

তুমি আমাকে অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছো ?

হুম,আমি অন্ধকারে দেখতে পাই।

ও মিথ্যা বলেনি। মিলি অন্ধকারে দেখতে পায়,অনায়াসে হাঁটা চলা করতে পারে। এমনকি তরকারি কাটা ,খাবার বাড়া এসব টুকটাক কাজ আলো ছাড়াই করে ফেলে। ও মাঝে মাঝেই অকারণে হিহি করে হাসে। একা একাই কথা বলে। আবার হঠাৎ হঠাৎ মন খারাপ করে থাকে।

যখন ওর মন খারাপ থাকে তখন আমার সাথে তেমন কথা বলে না। ওর চোখ ফোলা থাকে। আমি বুঝি ও লুকিয়ে কান্না করেছে।

যেই আমি এসব জ্বীন, ভুত, জাদুটোনা বিশ্বাস করতাম না সেই এখন মাঝে মাঝে ভাবি সত্যি কি মিলির সাথে খারাপ কিছু আছে?

একদিন কাজ শেষে বাসায় ফিরে দেখি ও অসময়ে শুয়ে আছে। আমি বুঝলাম ওর মন খারাপ। কারণ আমার সাথে কোনো কথা বলেনি। উঠে চুপচাপ খাবার বেড়ে দিয়েছে।

আমি বললাম,

তোমার মনখারাপ?

হুম।

আমাকে কারণটা বলা যায়?

আপনি তো বিশ্বাস করবেন না।

আচ্ছা বলো, বিশ্বাস করব।

মিলি আগ্রহ নিয়ে পা গুছিয়ে আরাম করে বসল। যেন কোনো মজার রুপকথার গল্প বলবে।

আমার না একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আমি মাঝে মাঝে মানুষের অতীতের বিশেষ কোনো ঘটনা বলতে পারি।

কিভাবে পারো। তোমার সাথে থাকা জ্বীন বলে দেয়?

হি হি হি।

হাসো কেন?

আচ্ছা হাসবো না। শোনেন,জাফর লোকটা কিভাবে মারা গেলো বলি।

আমি আজ আর না করলাম না।

আচ্ছা বলো।

মিলি এমনভাবে বলছে যেন খুব স্বাভাবিক কোনো ঘটনা।

লোকটা বাসর রাতে ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে সোজা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। লোকটার মুখ থেকে একটা বাজে গন্ধ আসছে। হয়তো নেশা করেছে। আমার দমবন্ধ লাগতে শুরু করল। বলা নেই, কওয়া নেই এভাবে অচেনা কেউ জড়িয়ে ধরলে কেমন লাগে বলুন?

হুম, খারাপ লাগারই তো কথা।

হঠাৎ আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। আমি গরগর করে বললাম,মানে কেউ একজন বলিয়ে নিলো, জলজ্যান্ত মেয়েটাকে মেরে ফললেন,আর কেউ কিছু জানলো না।

লোকটা ছিটকে সরে গেল। চোখেমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

আমি বলেই গেলাম,

আপনি ওর পরিচিত। ওর সাথে বাজে কাজ করেছেন। ছেড়ে দিলে সবাইকে বলে দিতো তাইনা!

জাফর কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

কিসব উলটা পালটা বকতেছো।

সারারাত অত্যাচার করে তারপর গলা টিপে মেরে বস্তায় করে ভোররাতে সোজা নদীতে। লাশ কোথায় ভেসে চলে গেলো । কেউ কিছু টের পেলো না।

জাফর দাঁড়িয়ে টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে খেলো। তারপর বিস্তারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। এতো বছর আগের ঘটনা আমি কিভাবে হরহর করে বলে দিচ্ছি তাই ভেবে ঘামতে শুরু করল। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,

আজকে আমাদের বাসররাত। আর তুমি ভয় দেখাইতেছো কেন?

আমি হি হি করে হেসে ফেললাম।

ঘটনাতো সত্য। সত্যি কিনা বলেন।

তোমার মাথায় গন্ডগোল আছে।

তারপর বাইরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর বাইরে হৈচৈ কান্নাকাটি। জাফর স্ট্রোক করেছে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।

এসব বলে তুমি কি মজা পাও মিলি। জাফর লোকটার হয়তো প্রেশার হাই ছিল। বিয়ে বাড়ির টেনশন,রিচ ফুড খাওয়া,তার ওপর নেশা করা এসব কারণে স্ট্রোক করেছিল।

মিলি আহত চোখে তাকাল।

আপনি বিশ্বাস করেন নাই তাইতো।

হুম। আমাকে বলছ বলছ,আর কাউকে এসব বলবা না ঠিক আছে?

হুম।

মিলি আর ওসব বলেনি। কিন্তু আমি কিভাবে কিভাবে যেন এই বিষয়টা মাথা থেকে সরাতে পারলাম না। মিলিকে আমার একটু একটু ভয় লাগতে শুরু করল। ও যখন আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কিছু খোঁজে আমার ভয় করে। আমি মনেপ্রাণে বলতে থাকি মিলি যেন আমার অতীত বলতে না পারে। ওকে আমি আর ভয় পেতে চাই না।

বিয়ের ছয়মাসের মাথায় সুখবর পেলাম। মিলি মা হতে চলেছে। খুশিতে আমার চোখে পানি চলে আসল। কেউ না থাকা আমার একজন রক্তের কেউ আসবে। আমার সন্তান। মিলির প্রতি আমার ভীষণ খেয়াল রাখতে হয়। ও খুব অনিয়ম করে। একা একা থাকতে খারাপ লাগে ওর।

একদিন আমার শশুর এসে মিলিকে নিয়ে গেলেন। এ সময় নাকি মেয়েদের মায়ের কাছে থাকতে হয়। নিয়মিত চেক আপ করাও হলো। ডাক্তার বললেন সবকিছু স্বাভাবিক আছে। কিন্তু মিলির ব্যথা উঠলো ডেটের দেড়মাস আগেই। প্রচন্ড ব্যথা হলো সারারাত। কিন্তু নরমাল ডেলিভারি হলো না। কিসব জটিলতা দেখা দিলো। শেষে ডাক্তার সিদ্ধান্ত নিলেন সিজার করার। অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে মিলি আমাকে ডেকে বলল,

আপনার কোনো দোষ নাই। বাচ্চাটা দৌড়ে আপনার বাইকের সামনে চলে আসছিল। আপনি নিজেকে অপরাধী ভাববেন না।

আমি কেঁপে উঠলাম। সেই কলেজ জীবনের ঘটনা। মামার বাইক নিয়ে বাজারে গেছি। মামির একটা ঔষধ গ্রামের ঔষধের দোকানে পাচ্ছিনা। তাই মামা তার বাইক দিয়ে উপজেলায় পাঠালেন। মামা দোকানে ব্যস্ত। ঔষধ নিয়ে ফেরার পথে বকখালির মোড়ে গাড়ি ঘুরিয়েছি মাত্র একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা হুট করে দৌড় দিয়ে এসে পড়ল বাইকের সামনে। তারপর ছিটকে একপাশে পড়ে গেল। আমি ব্রেক কষে দাঁড়ালাম । বাচ্চাটাকে হাসপাতালে নিতে হবে। কিন্তু পেছনে ফিরতেই দেখলাম কিছু মানুষ হৈ করতে করতে ছুটে আসছে।

ধর ধর ধর,শালাকে পুঁতে ফেলব আজ।

খুব ভয় পেয়েছিলাম। জোরে বাইক টেনে চলে এসেছিলাম। পরে খবর পেয়েছি বাচ্চাটা মারা গেছে। আমি চুপ করে থাকলাম। কাউকে কিছু জানাইনি। কিন্তু সেই দহন আজো আমাকে তাড়া করে। কিন্তু এই কথা মিলি কিভাবে জানল!

একজন ইন্টার্ন ডাক্তার এসে জানালো রক্ত রেডি রাখতে। মা আর বাচ্চা দুইজনের কন্ডিশন ক্রিটিকাল।
সব চিন্তা ছেড়ে দিয়ে খোদাকে ডাকলাম।

খোদা আমার মিলির আর বাচ্চাটার যেন কিছু না হয়।

ডাক্তাররা চেষ্টা করল কিন্তু মিলিকে বাঁচাতে পারলো না। আমার কোলে ফুটফুটে এক কন্যা সন্তান আর কিছু অমিমাংসিত প্রশ্ন দিয়ে মিলি চলে গেলো ওপারে।

**

রুজাইফার বয়স এখন দশ চলে। আমাদের বাপ বেটির সংসার বেশ কেটে যাচ্ছে। রুজাইফা দেখতে ঠিক মিলির মতো হয়েছে। আমার মুখে ও ওর মায়ের গল্প শোনে। আমি যখন মিলির কথা বলি ওর চোখেমুখে একটা আলো ছড়িয়ে পড়ে। মাকে যেন ও দেখতে পাচ্ছে।

আমরা এখন নিজেদের বাড়িতে থাকি। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই। রুজাইফাকে বড় করতে গিয়ে চাকরি করা হয়নি। ব্যবসা শুরু করেছিলাম। এখন নিজের দোকান আছে।

রুজাইফাকে ওর নানা নানী নিজেদের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওকে ছাড়া আমি বাঁচব কিভাবে। তাই নিজেই ওকে লালনপালন করছি।

কয়দিন হয় আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে নতুন এক পরিবার উঠেছে। সেখানে প্রায়দিন একটা বাচ্চা ছেলে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে আর বলে,

আমাকে ছেড়ে দাও,আর মেরো না। আর ভুল করবো না।

খোঁজ নিয়ে জানলাম ছেলেটার নিজের মা নেই। চার পাঁচ বছর বয়স হবে। বাবা আবার বিয়ে করেছে। সৎমাটা ছেলেটাকে দুই চোখে দেখতে পারে না।

রোজ রোজ কান্না শুনি। ভীষণ মায়া হয়। একদিন বাইরে লোকটার দেখা পেয়ে বলেই ফেললাম,

এতটুকু একটা ছেলেকে আপনার ওয়াইফ এভাবে পেটায়,এটাতো ঠিক না।

লোকটা চটে উঠল,

আরে মশাই,এটা আমার পারিবারিক বিষয়। আপনি কথা বলার কে? মা ছেলেকে শাসন করে না! সৎ মা বলেই খারাপ লাগছে। নিজের মা হলে কেউ কিছু বলতো না।

আর কি বলব। মনখারাপ হয়ে গেল। আহারে বাচ্চা ছেলেটা।

একদিন বাজার করে ফিরছি। রুজাইফাও আছে। বাসায় ঢুকতে যাব। দেখলাম সিঁড়ির গোড়ায় ছেলেটা মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রুজাইফাকে চকোলেট কিনে দিয়েছিলাম। ও ছেলেটাকে বলল,

চকোলেট খাবে?

উহু।

আরে নাও। কিছু হবে না। আমার ভাই থাকলে ওকেতো চকোলেটের ভাগ দিতাম।

ছেলেটা চকোলেট হাতে নিলো। ওর মুখটায় হাসি ফুটে উঠল। হঠাৎ ওর মা এসে হাত থেকে চকোলেট কেড়ে নিয়ে মারতে শুরু করল।

ফকির কোথাকার। এখন মানুষের থেকে চেয়ে খাওয়া শুরু করছিস। কি দেখাচ্ছিস, তোকে খেতে দেইনা।

আমি হতচকিত হয়ে গেলাম। তাকিয়ে দেখলাম রুজাইফা একপাশে সরে গিয়ে চোখ বড় বড় করে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর মাথার দুপাশের রগ ফুলে উঠেছে। তারপর অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। মহিলা হঠাৎ বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ল। আর্তনাদ করতে থাকল,

উফ! মরে গেলাম। কেউ যেন কলিজাটা খামচে ধরেছে।

কিছু সময় পর রুজাইফার মুখ স্বাভাবিক হলো। ও হাসছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওকে এখন ঠিক মিলির মতো দেখতে লাগছে।

🧿সমাপ্ত

🖊️ইশরাত জাহান দিনা

অলৌকিক পর্ব-০১

0

অলৌকিক (১ম পর্ব)
ইশরাত জাহান দিনা

আমার ওয়াইফ মিলিকে আজকাল আমার একটু ভয় ভয় লাগে। এই ভয় আগে ছিলো না। নতুন হয়েছে। বিয়ের আগেও শুনেছিলাম মিলির ওপর জ্বীনের আছর আছে। সেই জ্বীন চায় না মিলির কারো সাথে বিয়ে হোক। এজন্যই মিলির প্রথম স্বামী বিয়ের পরদিন স্ট্রোক করে মারা যায়। আসলে স্ট্রোক একটা উছিলা, ঐ জ্বীন মিলির বরকে মেরে ফেলেছিলো। নাহলে সুস্থ সবল মানুষ কেনো হঠাৎ বিয়ের রাতে স্ট্রোক করতে যাবে।

অনেকেতো নাকি এটাও বলত যে মিলির সাথে ঐ জ্বীন নিয়মিত শারীরিক সম্পর্ক করে। মিলির পেটে ঐ জ্বীনের বাচ্চাও ছিল। সেটা পরে মিলি নষ্ট করেছে। এসব আমি শুনেছিলাম মিলির সাথে আমার বিয়ের কথা যখন চলছিলো সে সময়।

আমি অবশ্য এসব জ্বীন ভুতে বিশ্বাস করি না। তাইতো এসব কথায় কান না দিয়ে মিলিকে বিয়ে করেছি। তবে এখন মাঝে মাঝে ওকে আমার ভয় লাগে।

আমার পরিচয় দিয়ে নিই। আমি মোকাদ্দেস। গরীব পরিবারের ছেলে। অবশ্য পরিবার বলতে তেমন কেউ নেই আমার। মা বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন লঞ্চ ডুবিতে। আমার দাদা বাড়ি ছিলো বরিশাল। আমরা থাকতাম ঢাকায়। বাবা একটা ছোট চাকরি করতেন। একবার আমার দাদি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। নানিমা সেসময় আমাদের দেখতে ঢাকায় এসেছেন। চার বছরের আমাকে নানির কাছে রেখে মা আর বাবা গেলেন বরিশালের উদ্দেশ্যে। কিন্তু বাড়ি পৌঁছানোর আগেই লঞ্চ ডুবিতে মারা যান দু’জনেই।

সেই থেকে নানির কাছে রয়ে গেলাম। সেই নানিও মারা গেলেন আমার চৌদ্দ বছর বয়সে। আমার মা ছিলেন নানির একমাত্র সন্তান। তাই কাছের বলতে আর কেউ রইলোনা । দাদী অসুস্থ মানুষ,থাকেন চাচাদের সংসারে। আমাকে রাখবেন কিভাবে। নানী মারা যাবার পর দূর সম্পর্কের এক মামার কাছে থেকে এস এস সি পাস করে ঢাকা চলে আসি। এখানে এসে টিউশনি করে, মানুষের দোকানে কাজ করে বি এ পাস করেছি। এখন একটা বিস্কিট কোম্পানির কেরানির পোস্টে চাকরি করছি।

বিয়ে থা করার কথা ভাবতে ভাবতে বয়স ত্রিশ পেরিয়ে গেছে। আসলে আমার জন্য যে মেয়ে দেখবে এমন কাছের কেউ নেই। একরুম আর বারান্দাওয়ালা একটা বাসায় একাই থাকি। নিজেই রান্না করে খাই। কেরোসিনের চুলায় ভাত, আলু সিদ্ধ,ডিমভাজি করে খাই। মাঝে মাঝে বাইরে হোটেলেও খেয়ে নিই যখন রান্না করতে ভালো লাগে না। তো একদিন অফিস থেকে ফিরে ভাত রাঁধতে গিয়ে মার পড়ে হাত পুড়ে গেলো। পরদিন অফিসে গেলে আমার কলিগ রাকিব ভাই বললেন,

এভাবে কি চলে নাকি মিয়া, এবার একটা বিয়েশাদী করে ফেলেনতো।

আমাকে মেয়ে দেবে কে?

কি যে বলেন। এই দেশে মেয়ের অভাব আছে নাকি। আপনি শুধু হ্যা বলেন।

আমি কি বলব । শুধু হাসলাম,যার মানে দেখেন।

খুব সুন্দর একটা মেয়ে আছে। সিনেমার নায়িকাদের মতো দেখতে। বাবার অবস্থাও ভালো। দেখলেই পছন্দ হবে আপনার।

এমন মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দেবে?

কথাতো এইখানেই ভাই। আপনাকে খুলেই বলি তবে। বিয়েশাদীর ব্যাপার। লুকিয়ে রাখা ঠিক হবে না। মেয়েটার আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু সংসার হয়নি একদিনও।

আমি একটু দমে যাই।

ওহ। একদিনো সংসার হয়নি কেনো?

ছেলেটা বিয়ের রাতেই মারা যায়। স্ট্রোক করেছিল।

ইশ! খুব দুঃখজনক ঘটনা।

হুম আরও দুঃখজনক হলো এই ঘটনার পর সবাই ভাবতে শুরু করল মেয়েটার কোনো দোষ আছে। অলক্ষুনে মেয়ে আরকি। ওর জন্য বরটা মারা গেছে।

এমন আবার হয় নাকি এখনও। এসব কুসংস্কার এখন কেউ মানে?

আপনার যা কথা! হয় মানে। অহরহ হচ্ছে। কত বিচিত্র কারণে যে মেয়েদের বিয়ে ভাঙে। এই যে এই মেয়েটার আর বিয়েই হচ্ছে না। পাত্র পক্ষ আসে,দেখে পছন্দ করে কিন্তু এসব কথা শোনার পর বিয়ে ভেঙে দেয়।

এটাতো ঠিক না। জীবন মৃত্যু সব খোদার হাতে। কে কখন মারা যাবে কেউ বলতে পারে না। এই যে আমি আপনার সাথে কথা বলছি, এখুনি আমার মৃত্যু হতে পারে। সেখানে আপনার তো কোনো হাত নেই।

আপনি এভাবে ভাবছেন কিন্তু সবাইতো এমন করে ভাবতে পারে না। আপনাকে একটু হলেও চিনি বলেই এই মেয়ের কথা বললাম। মেয়ের বাড়ির লোকজন মেয়েটাকে নিয়ে ভীষণ টেনশনে আছে। বিবাহযোগ্য মেয়েকে আর কতদিন ঘরে রাখবে। আপনি দেখেন। মেয়ে যদি পছন্দ হয়তো কথা ফাইনাল করব। পছন্দ না হলে আরও মেয়ে আছে।

আমার একটু আগ্রহ হলো। মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। মেয়ে নাকি ভীষণ সুন্দরী। সুন্দরের প্রতি আকর্ষণ সব মানুষেরই কম বেশি আছে। আমিও এর বাইরে না। আর তাছাড়া আমার যেহুতু এসব কুসংস্কার নিয়ে মাথাব্যথা নাই তাই বললাম,

এই মেয়েটাকেই দেখি তাহলে।

আচ্ছা আমি ডেট ঠিক করে জানাব। মেয়ের বাসায় কথা বলে নিই।

পরদিন অফিসে যেতেই রাকিব ভাই বললেন,

ভাই তৈরি থাইকেন। আগামী শুক্রবার মেয়ে দেখতে যাব।

শুক্রবার বিকেলে রাকিব ভাই সহ মিলিদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। দোতলা ছিমছাম একটা বাড়ি। দোতলা পুরোপুরি কমপ্লিট হয়নি। বাড়ির সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। সেখানে একপাশে ছোট একটা ফুলের বাগান। আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়ালের চারপাশ ধরে নানান রকম ফলের গাছ। দোতলা এখনো কমপ্লিট হয়নি। দুটো ঘরের কাঠামো তুলে রাখা হয়েছে।
আসার পথেই মিষ্টি কিনে এনেছি। সেগুলো একটা কমবয়সী মেয়ে এসে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেছে। বসার ঘরে মিলির বাবা আর বড় ভাই আছেন। আমাকে টুকটাক প্রশ্ন করলেন।

তা বাবাজি বাড়ি কোথায় আপনার?

জ্বী বরিশালে।

চাকরি যেন কোথায় করেন।

আমি কোম্পানির নাম বললাম।

এটার অফিস কোথায়?

গাজীপুরে।

বাবাজি যেন কি পাস দিছেন?

বি,এ পাস করেছি।

মাশাআল্লাহ।

বাড়িতে কে কে আছেন?

কাছের বলতে তেমন কেউ নাই। এক দূর সম্পর্কের মামা আছেন। দাদী আর চাচারা আছেন। খুব একটা যোগাযোগ নেই।

আচ্ছা।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে মিলি ঢুকল শরবতের গ্লাস হাতে নিয়ে।

আসসালামুআলাইকুম।

রাকিব ভাই জোরে সালামের উত্তর দিলেন।

ওয়ালাইকুমুস সালাম।

মিলির কন্ঠস্বর ভীষণ মিষ্টি। যেন রিনিঝিনি করে কাঁচের চুড়ির আওয়াজ তুলছে।

আমি মুখ তুলে মিলির দিকে তাকালাম।

বড় করে ঘোমটা টানা। চেহারা দেখা যাচ্ছে না।

মিলির এক ভাবি ঢুকল পেছনে পেছনে। উনি মিলি বসার পর পেছন থেকে ঘোমটা একটু টেনে মুখটা বের করে দিলেন।

রাকিব ভাই বললেন,

মাশাআল্লাহ।

আমি হা হয়ে গেলাম।
এতো সুন্দর দেখতে কোনো মানুষ হয় নাকি!এই মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দেবে এনারা?

ভাবি বললেন,

আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে করতে পারেন।

রাকিব ভাই বললেন,

আপনার পুরো নামটা যেন কি?

মোছাঃ শাহরিন মিলি।

সুন্দর নাম।

রাকিব ভাই আমাকে বললেন,

ভাই কিছু জানতে চাইলে বলেন।

আমি রাকিব ভাইকে বললাম,

আমার তেমন কোনো প্রশ্ন নাই।

মিলি ওর ভাবির কানে কানে কি যেন বলল।

উনি বললেন,

আপনারা বরং নিজেরা একা কথা বলুন।

আমাকে ছাদে নিয়ে যাওয়া হলো। কিছুক্ষণ পরেই মিলি এলো।

আপনি ভালো আছেন?

জ্বি আলহামদুলিল্লাহ। আপনি?

আলহামদুলিল্লাহ।

আমার সম্পর্কে সবকিছু জানেনতো?

জ্বি শুনেছি।

আপনার বিয়েতে আপত্তি নেই?

নাহ। অতীত নিয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। তবে আপনি হয়তো আমার সম্পর্কে সবটা জানেন না। আমি খুব সাধারণ পরিবারের ছেলে। ছোটখাটো একটা চাকরি করি। গাজীপুরে একটা একরুমের বাসায় ভাড়া থাকি। আমার সম্পত্তি বলতে কিছু নাই,মানে জমিজমার কথা বলছি। আপনি বিয়েতে রাজীতো?

আমার আপত্তি নেই।

তাহলে দিনতারিখ ঠিক করে ফেলি?

জ্বি, বাবার সাথে কথা বলুন।

সাতদিনের মধ্যে মিলির সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। মিলিকে নিয়ে উঠলাম আমার একরুমের ছোট্ট বাসায়।

♠️চলবে…..

মেঘ বলেছে যাব যাব পর্ব-২৬ এবং শেষ পর্ব

0
মেঘ বলেছে যাব যাব হুমায়ূন আহমেদ

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (পর্ব :২৬, শেষ পর্ব )🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

তারেক অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে

তারেক অনেকক্ষণ ধরেই বসে আছে। কোনো কথাটথা না। চুপচাপ বসে থাকা।

হাসান চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তার বিছানার চাদরটা ধবধবে সাদা। গায়ে যে চাদরটা আছে তার রঙও সাদা। সে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। বাইরে বেশ গরম। মাথার ওপর ফ্যান ঘুরছে। কিন্তু হাসানের মনে হয় শীত লাগছে।

তারেক বলল, তোর মাথার যন্ত্রণা কি একটু কমেছে?

হাসান নিচু গলায় বলল, হুঁ।

হুঁ বলার ধরন থেকেই বোঝা যায় মাথার যন্ত্রণা আসলে কমেনি। কড়া পেইনকিলার ব্যথাটাকে ভোঁতা করে দিয়েছে।

তুই যে এত বড় অসুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াতি বুঝতেই পারি নি। আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছে।

অসুখ-বিসুখ তো পৃথিবীতে আছেই।

তাও ঠিক।

তারেক আবার চুপ করে গেল। হাসান বলল, শুধু শুধু বসে আছ কেন? চলে যাও।

কোথায় যাব?

তোমার ঘরে যাও। অফিস থেকে এসেছ বিশ্রাম কর।

তোর কি কিছু খেতেটেতে ইচ্ছা করে?

না।

খেতে ইচ্ছে হলে বল। লজ্জা করবি না।

হাসান হাসল। একবার ভাবল বলে, আঙুর খেতে ইচ্ছে করছে। আঙুর নিয়ে এসো। বলা ঠিক হবে না। ভাইজান সত্যি আধকেজি আঙুর নিয়ে আসবে।

হাসান!

জ্বি ভাইজান।

আমার মনটা খুবই খারাপ হয়েছে।

তুমি ঘরে যাও তো। ঘরে গিয়ে বিশ্রাম কর।

আমার যদি ক্ষমতা থাকত–অবশ্যই তোকে বিদেশে নিয়ে চিকিৎসা করতাম। ঘরবাড়ি জমিজমা থাকলে অবশ্যই বিক্রি করতাম। কিছুই নেই। প্রভিডেন্ট ফান্ডে ষোল সতের হাজার টাকা আছে। আমি অবশ্য হাল ছাড়ি নি। দেখি কী করা যায়। লায়লার স্বামীর কাছে টাকা ধার চাইব?

কারো কাছে কিছু চাইতে হবে না।

সে তো বাইরের কেউ না। এখন তো আমাদেরই একজন। টাকা তো আমি মেরেও দিচ্ছি না। মাসে মাসে শোধ দেব। মাসে তিন হাজার টাকা করে শোধ দিলেও বছরে হয়।

ভাইজান আমার আঙুর খেতে ইচ্ছে করছে।

কোনো ব্যাপারই না। এনে দিচ্ছি। কোনটা খাবি–সাদাটা না কালোটা? আচ্ছা! যা দু পদেরই আনিব। ভিটামিন সি ছাড়া আঙুরের অবশ্য ফুটভ্যালু কিছু নেই। তোর যখন খেতে ইচ্ছে করছে খা।

তারেক উঠে দাঁড়াল। হাসান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কেউ একজন পাশে এসে বসলেই তার খারাপ লাগে। পুরোপুরি এক সময়টা কাটাতে পারলে ভালো লাগত। কেউ কাছে আসবে না। চিঠি লিখবো। সেই চিঠিগুলো থাকবে বালিশের নিচে। যখন মাথার যন্ত্রণা একটু কমবে তখন সে চিঠি খুলে পড়বে। মানুষের সঙ্গের চেয়ে তাদের চিঠি পড়াটা এখন বোধহয় আনন্দময় হবে।

লিটনের একটা চিঠি পরশুদিন পেয়েছে। চিঠিটা বালিশের নিচে ছিল। আজ সকালে পড়েছে। কয়েকদিন পর হয়তো আবারো পড়বে। লিটন লিখেছে–

হাসান,
তোকে চিঠি লিখতে অনেক দেরি করে ফেললাম। আসলে কী ব্যস্ততায় যে সময় কাটছে। আমাকে না দেখলে তুই আমার ব্যস্ততা বুঝতে পারবি না। আমি ভোর আটটায় চলে যাই। ফিরি সন্ধ্যার পর। গ্রোসারি করা, ঘর-সংসার দেখা, রান্না করা–সব তোর ভাবির একা করতে হয়। সেই বেচারিরও নিঃশ্বাস ফেলার সময় নেই। আমাদের এপাটমেন্টটা উনত্রিশ তলায়। আর লড্রিঘর হচ্ছে এক তলায়। কাপড় ধুতে হলেও নিচে নামতে হয়। এত উঁচুতে থাকতে শুরুতে খুব অস্বস্তি লাগত। মনে হত জোরে বাতাস এলেই বিল্ডিংটা বুঝি ভেঙে পড়বে। এখন অবশ্য সয়ে গেছে।
শম্পা সারাদিন কী করে জানিস ‘ শুধু ঘর গোছায়। রাজ্যের জিনিস কিনে ঘর ভর্তি করে ফেলেছে। তার যে এমন খরুচে হাত তা জানতাম না। তার শখের জিনিস কী জানিস–স্ট্রফড এনিমেল। ঘরটিকে সে একটা চিড়িয়াখানা বানিয়ে ফেলেছে। আমি একদিন তার ওপর সামান্য রাগই করলাম।—সে কেঁদেকেটে একটা কাণ্ড করেছে। তার অভিমান ভাঙবার জন্যে শেষে আমি নিজেই একটা বিশাল হাতি কিনে দিয়েছি। দাম কত নিয়েছে। শুনলে তুই ভিরমি খেয়ে পড়ে যাবি সাত শ’ সিঙ্গাপুরি ডলার। শম্পার সঙ্গে থেকে থেকে আমারও খরচে হাত হয়ে যাচ্ছে। এক সময় কী যে কষ্ট করেছি। ভাবতেই গায়ে কাঁটা দেয়। আমার খুব ইচ্ছা তোকে এনে কিছু দিন আমাদের সংসারে রাখি। আরেকটু গুছিয়ে বসেই তোর জন্যে টিকিট পাঠাব।
ইতি লিটন
পুনশ্চ : হাসান তুই কি একটা কাজ করবি? খুব সুন্দর কিছু বাংলা নাম পাঠবি? কুড়িটা ছেলের নাম এবং কুড়িটা মেয়ের নাম। কী জন্যে নাম পাঠাতে বলছি বুঝতেই পারছিস। বিদেশে শিশুপালন খুবই যন্ত্রণা হবে। কী আর করা। আমরা খুবই খুশি। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।

হাসানকে রোজই একবার লায়লা দেখতে আসে। এই মেয়েটাকে হাসানের ভালো লাগে। লায়লা ঘরে ঢোকে কাদো কাদো মুখে।

ভাইয়া আজ তোমার অবস্থা কী? বলে বিছানায় বসে। কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার মুখ থেকে কাদো কাদো ভাবটা চলে যায়। সে মনের আনন্দে তার সংসারের গল্প শুরু করে। গল্প করার সময় আনন্দে সে কলমল করতে থাকে। হাসানের সব সময় মনে হয় এই আনন্দের পাশে দীর্ঘ সময় থাকলে তার মাথার অসুখটা কমে যাবে।

ভাইয়া শোন-বাবু কী রকম যে দুষ্ট তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না। ওর বাবার অবশ্য ধারণা আগে এত দুষ্ট ছিল না। আমি নাকি লাই দিয়ে দিয়ে তাকে দুন্টু বানাচ্ছি। এত ছোট একটা বাচ্চা আমি তো আদর করবই। মুখে ভাত তুলে না দিলে সে খায় না। বেচারা ছেলেমানুষ না। ও কী বলে জান? ও বলে রাত্ৰি তুমি বাবুকে যতটা ভালবাস আমাকে তার দশ ভাগের এক ভাগও বাস না। বুঝলে ভাইয়া ও আমাকে লায়লা ডাকে না। লায়লার অর্থ রাত। সেই জন্যে ডাকে রাত্রি। লজার ব্যাপার না? এখন কী করব। বল? আদর করে ডাকে আমি তো না বলতে পারি না। পরশুদিন আবার বলল, চল সিঙ্গাপুর থেকে ঘুরে আসি। ছেলের স্কুল কামাই করে আমি সিঙ্গাপুর যাব। আমার এত শখ নেই। ও তা শুনবে না। ওর স্বভাব হচ্ছে একবার কোনো একটা কথা মুখ দিয়ে বলে ফেললে সেটা করতেই হবে। খুব ভয়ে ভয়ে আছি। এদিকে আমার ড্রাইভার কী করেছে। জান? গত মঙ্গলবারের কথা। আমাকে বলল, চাকা পাংচার হয়েছে ঠিক করতে হবে। আমি একশ টাকা দিলাম। সে আর টাকা ফেরত দেয় না। বৃহস্পতিবার তাকে ডেকে বললাম। চাকা পাংচার সারাই করতে কুড়ি টাকা লাগে। বাকি আশি টাকা কোথায়? সে বলল, ম্যাডাম পকেটমার হয়ে গেছে। ওই আশি টাকা তো গেছেই আমার নিজেরও দু শ টাকা গেছে। এখন সে এডভান্স বেতন চায়। আমার অবস্থা দেখেছ?

তোর তো কঠিন অবস্থা।

কঠিন অবস্থা তো বটেই। কাউকে যে তুমি বিশ্বাস করবে। সে উপায় নেই। সবার দিকে চোখ রাখতে হয়। আমি তো আর মাছি না যে আমার পঞ্চাশ হাজার চোখ আছে। আমি একা কদিক সামলাব?

তা তো ঠিক।

সন্ধ্যা হতেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমোতে পারি না। ওর অভ্যাস হচ্ছে রাতে ছবি দেখা। আমাদের একটা LD প্লেয়ার আছে। LD নিয়ে আসে। রোজ ছবি দেখে। LD কী জানি ভাইয়া?

না।

LD হলো লেজার ডিস্ক। পুরো সিনেমাটা একটা গ্রামোফোন রেকর্ডের মতো রেকর্ডে থাকে। কী সুন্দর ছবি যে আসে না দেখলে তোমার বিশ্বাস হবে না। একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে দেখাব। সরি বাসা বলে ফেলাম। বলা উচিত ছিল বাড়ি। বাসা তো না, আমরা তো আর ভাড়া বাড়িতে থাকি না যে বাসা। তাই না ভাইয়া? তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

না চোখ বন্ধ করে আছি।

ঠিক আছে তুমি রেস্ট নাও। আর শোন ভাইয়া, বেশি চিন্তা করবে না। আমি রোজ এসে দেখে যাব। ও বলছিল হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা করাতে। মাঝে মাঝে হোমিওপ্যাথি মিরাকলের মতো কাজ করে। ওর এক আত্মীয়ের তোমার মতো ব্রেইন টিউমার ধরা পড়েছিল। ডাক্তাররা সব জবাব দিয়ে দিয়েছে। তখন সে হোমিওপ্যাথি শুরু করে আস্তে আস্তে টিউমার মিলিয়ে যায়। যে ডাক্তার ওষুধ দিয়েছিলেন তিনি আবার ইন্ডিয়া চলে গেলেন। আমি ওকে বলেছি–ইন্ডিয়াতেই যাক আর বিলাতেই যাক তুমি সেই ডাক্তারের খোঁজ বের করবে।

দেখ খুঁজে।

ভাইয়া আজ যাই।

আচ্ছা।

হাসানের অসুখের খবর সে কাউকে দেয় নি। তারপরেও কেমন করে জানি সবাই জেনে গেছে। প্রতিদিনই কেউ না কেউ উপস্থিত হচ্ছে। হাসানকে বিস্মিত করে একদিন সুমি এসে উপস্থিত। তার গায়ে ধবধবে সাদা ফ্রক। হাতে অনেকগুলো গোলাপ। কী সুন্দরই না হয়েছে মেয়েটা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে।

স্যার কেমন আছেন?

ভালো।

আপনাকে দেখতে এসেছি।

থ্যাংক য়্যু। খবর পেলে কোথায়?

সুমি মুখ টিপে হেসেছে। খবর কোথায় পেয়েছে সে বলবে না।

এত বড় অসুখ কী করে বাঁধালেন?

বুঝতে পারছি না। সুমি। অসুখের কথা থাক। তুমি কেমন আছ বল?

ভালো আছি।

তুমি তো অনেক বড় হয়ে গেছ?

হুঁ।

তোমার যে ই.এস.পি, ক্ষমতা ছিল এখনো কি আছে? ভবিষ্যৎ বলতে পারতে। এখনো কি পার?

হুঁ।

আচ্ছা বল দেখি আমি আর কত দিন বাঁচব?

সুমি হাতের ফুলগুলো নাড়াচাড়া করছে। কিছু বলছে না। কিন্তু তার মুখ বিষন্ন নয়।

স্যার আপনার জন্যে একটা মজার জিনিস। এনেছি।

মাজার জিনিসটা কী?

এক ধরনের ক্যান্ডি। মুখে দিয়ে রাখবেন–এক সময় মুখের ভেতর পটপট শব্দ হতে থাকবে।

সে কী?

বাবা বাইরে থেকে নিয়ে এসেছেন। মুখে দিয়ে দেখুন।

হাসান ক্যান্ডি মুখে দিয়েছে। এক সময় মুখের ভেতর সত্যি সত্যি পটপট শব্দ হওয়া শুরু করল। হাসান থুঁ করে ক্যান্ডি ফেলে দিল। সুমি হাসছে খিলখিল করে। হাসান মুগ্ধ হয়ে হাসির শব্দ শুনছে।

শীতের মাঝামাঝি সময়ে হাসানের অবস্থা খুব খারাপ হলো। তাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। হাসপাতালটাই হয়ে গেল তার ঘরবাড়ি। কেবিনে স্যাতস্যাতে ঘর। বিবৰ্ণ দেয়াল। ফেনাইলের গন্ধমাখা মেঝেতে তার জীবন আটকে গেল। মানুষের সঙ্গ তার অসহ্য বোধ হতে শুরু করল। কেবিনের জানালা খুলে আকাশ দেখতে তার ভালো লাগে না। তার ভালো লাগে কুণ্ডলী পাকিয়ে নিজেকে ছোট্ট করে শুয়ে থাকতে। নিজের মনে কথা বলতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সে নিজের মনে কথা বলে। একেক সময় একেকজন এসে তার মাথায় উপস্থিত হয়। এদিন যেমন এলেন আম্বিয়া খাতুন।

কী রে হাসান আমার মৃত্যু সংবাদ শুনেও তুই দেখতে এলি না। তুই এত বড় পাষণ্ড! ছিঃ ছিঃ ছিঃ!

দাদিমা আমি অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি।

অসুখ হবে না–রোদের মধ্যে টো টো করে ঘোর। নিয়ম নাই, শৃঙ্খলা নাই। অসুখ হয়েছে ভালো হয়েছে।

আপনি এমন রেগে আছেন কেন দাদিমা?

জোয়ান ছেলে অসুখ বাঁধিয়ে বিছানায় পড়ে আছিস রাগব না? আমি খুবই রাগ করেছি। দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়ে আছিস কেন? মরার আগেই তুই দেখি ঘরটাকে কবর বানিয়ে ফেলেছিস। জানালা খোল।

জানোলা খুলতে ইচ্ছা করে না দাদিমা।

ইচ্ছা না করলেও খুলতে হবে। দাঁড়া আমি খুলে দিচ্ছি।

আম্বিয়া খাতুন অনেক চেষ্টা করলেন। জানালা খুলতে পারলেন না। বৃদ্ধর প্রাণান্ত চেষ্টা দেখে হাসান নিজের মনে খুব হাসল। হাসান যতই হাসছে বৃদ্ধা ততই রাগছেন।

হাসানকে খুব অবাক করে দিয়ে হাসপাতালের কেবিনে উপস্থিত হলো চিত্ৰলেখা। তার উপস্থিতি কল্পনায় নয়, বাস্তবে। চিত্ৰলেখা আগের চেয়ে রোগা হয়েছে। গায়ের রঙও খানিক কমেছে। কিন্তু সে আরো সুন্দর হয়েছে।

চিত্ৰলেখা হাসিমুখে বলল, আপনার অসুখের খবর আমি অনেক আগেই পেয়েছি–আসতে দেরি করলাম।

এই প্রথম হাসান লক্ষ করল কেউ একজন হাসপাতালে তার সঙ্গে দেখা করতে এসে হেসে হেসে কথা বলছে। যেন হাসানের অসুস্থতা কোনো ব্যাপারই না।

দাড়িগোফ গজিয়ে একাকার করে ফেলেছেন। শেভ করেন না কেন?

রোজ করি না। দু-এক দিন পর পর করি।

রোজ শেভ করবেন। সকালবেলা শেভ করে আয়না দিয়ে চুল আঁচড়ে–আয়নার দিকে তাকিয়ে বলবেন, হ্যালো ইয়াংম্যান।

আচ্ছা বলব। আপনি আমাকে দেখতে আসবেন আমি ভাবি নি।

অন্যেরা ভাবতে পারে না–এমন সব কাণ্ডকারখানা আমি প্রায়ই করি। শুনুন হাসান সাহেব, আপনি বোধহয় জানেন যে আমি একজন ডাক্তার।

জ্বি জানি।

আপনার অসুখ সম্পর্কে যা খোঁজখবর নেবার আমি নিয়েছি। ডাক্তারদের ডায়াগনেসিস দেখেছি। ডায়াগনেসিস ভালো করেছেন। মনে হচ্ছে টিউমারটা শেকড় বসিয়ে দিয়েছে।

তার মানে কি এই যে আমার সময় শেষ?

হ্যাঁ, মানে মোটামুটি তাই। তবে শুনুন হাসান সাহেব–অপারেশন এবং রেডিওথেরাপির সুযোগ আছে। অপারেশনটা খুবই জটিল। তবে জনস হবকিন্সে দুজন সার্জন আছে যাঁদের হাত জাদুকরী হাত। তারপরেও রিকোভারির সম্ভাবনা কম। থাটি পার্সেন্ট। তবে থাটি পার্সেন্ট সম্ভাবনাও এক অর্থে অনেক সম্ভাবনা। তাই না।

জ্বি।

আমি সেই সম্ভাবনাটা যাচাই করতে চাই। আপনাকে বাইরে নিয়ে যাওয়া এবং সম্ভাবনাটুকু পরীক্ষা করার আমার ইচ্ছা। আপত্তি আছে?

আপনি এটা করতে চাচ্ছেন কেন?

দুটা কারণ আছে। প্রথমটা আপনাকে বলা যাবে। দ্বিতীয়টা বলা যাবে না। প্রথম কারণ হলো, আমার বাবা আপনাকে খুব পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে বলে গিয়েছিলেন–আপনার কোনো সমস্যা হলে দেখতে।

ও আচ্ছা।

চিত্ৰলেখার দ্বিতীয় কারণটা অনেক জোরালো। হাসান নামের অতি দুর্বল এই মানুষটাকে হিশামুদিন সাহেবের চেয়েও অনেক বেশি পছন্দ তার নিজের। অহঙ্কারী মেয়েরা নিজের পছন্দের কথা সব সময় লুকিয়ে রাখে।

হাসান সাহেব।

জ্বি।

আমি যদি আপনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি আপনার আপত্তি আছে?

জ্বি না।

থ্যাংক য়্যু।

চিত্ৰলেখা হঠাৎ লক্ষ করল তার চোখে পানি চলে আসছে। সে জানালার কাছে সরে গেল। জানালা বন্ধ কেন? জানালা খুলে দি কেমন?

জ্বি আচ্ছা।

চিত্ৰলেখা জানালা খুলে দিয়েছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে বিশাল একটা মেঘের স্তুপ ভেসে ভেসে আসছে। খুব সাবধানে চিত্ৰলেখা তার চোখ মুছল। তার কাছে মনে হলো–মেঘের সঙ্গে মানুষের খুব মিল। মানুষ যেমন কাঁদে মেঘও কাঁদে। বৃষ্টি হচ্ছে মেঘের অশ্রু। চিত্ৰলেখা মুগ্ধ হয়ে মেঘের স্তুপের দিকে তাকিয়ে আছে।

লেখকরা কল্পনা করতে খুব ভালোবাসেন। আমার কল্পনা করতে ভালো লাগছে–হাসপাতালের জানালা থেকে যে মেঘটা দেখা যাচ্ছে সেই মেঘই এক সময় ঢেকে দিয়েছিল তিতলী এবং শওকতকে।

মানুষের কল্পনার সঙ্গে বাস্তবের মিল খুব একটা হয় না। কল্পনা করতে ভালো লাগে। হাসানের অসুখ সেরে গেছে। সে শুরু করেছে আনন্দময় একটা জীবন। বুড়িগঙ্গায় নৌকায় করে ঘুরতে গিয়েছে। নদীতে খুব ঢেউ উঠেছে। চিত্ৰলেখা ভয় পেয়ে বলছে, এ কোথায় নিয়ে এলে? আমি তো সাঁতার জানি না। নৌকা এমন দুলছে কেন? নৌকার মাঝি হাসিমুখে বলছে, টাইট হইয়া বহেন আফা, আমি আছি কোনো চিন্তা নেই।

খুব সহজে কল্পনা করা যায়, তারেক ঘর গোছাতে গিয়ে হঠাৎ ড্রয়ারে খুঁজে পেয়েছে রীনার লেখা চিঠি-চিঠিটা খুব ছোট্ট। রীনা লিখেছে, ‘তুমি কোনোদিন জানবে না, আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি।’ চিঠি পড়েই তারেক বের হলো। যে করেই হোক রাগ ভাঙিয়ে রীনাকে ফিরিয়ে আনতে হবে।

বাস্তব কখনো গল্পের মতো হয় না। বাস্তবের রীনা ফিরে আসে না। বাস্তবের হাসানদের সঙ্গে কখনো বুড়িগঙ্গার জলের ওপর চিত্ৰলেখার দেখা হয় না। তবে বাস্তবেও সুন্দর সুন্দর কিছু ব্যাপার ঘটে। যেমন–লিটনের ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়। লিটন তার বন্ধু হাসানের পাঠানো দুটো নাম থেকে একটি নাম তার মেয়ের জন্যে রাখে। দুটি নামের কোনোটাই তার পছন্দ না–তিতলী, চিত্ৰলেখা। তারপরেও সে মৃত বন্ধুর স্মৃতির প্রতি শ্ৰদ্ধা জানাতে মেয়ের নাম রাখল–চিত্ৰলেখা।

জীবন বয়ে চলবে। আবার এক নতুন গল্প শুরু হবে নতুন চিত্ৰলেখাকে নিয়ে। কোনো এক লেখক লিখবেন নতুন গল্প, আশা ও আনন্দের অপূর্ব কোনো সঙ্গীত।

২৬ পর্ব তথা শেষ পর্বের সমাপ্তি 📌

🔴ধন্যবাদ 🔴👍

মেঘ বলেছে যাব যাব পর্ব-২৫

0
মেঘ বলেছে যাব যাব হুমায়ূন আহমেদ

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (২৫ পর্ব )🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

তিতলী লক্ষ্য করল শওকতের বাঁ গাল খানিকটা ফোলা। সে কিছুক্ষণ পরপর গালে হাত দিচ্ছে। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। বেশি রকম চিন্তিত হলে শওকত মাথার চুল টানে। এখন মাথার চুলও টানছে। চুল এলোমেলো হয়ে আছে। চিন্তিত হাবার মতো কোনো কারণ ঘটেছে? পাসপোর্ট হারিয়ে গেছে। ট্রাভেলার্স চেকভর্তি মানিব্যাগ খোয়া গেছে? তিতলী বসে আছে। কাঠমুণ্ডু এয়ারপোর্টে সে কৌতুহল নিয়ে শওকতকে লক্ষ করছে। সমস্যায় সে যে পড়েছে তা তাকে দেখে বোঝা যায়। মানুষটার একটা বড় গুণ হচ্ছে যত সমস্যাতেই পড়ুক সোধৈৰ্য হারায় না। খুব বেশি হলে মাথার চুল টানে। চুল টানারও কি কোনো বিশেষ ভঙ্গি আছে? টেনশন বেশি হলে মাথার সামনের চুল টানা। টেনশন কম হলে পেছনের চুল টানা জাতীয় কিছু। তিতলী এমনভাবে মানুষটাকে লক্ষ করে নি। প্রয়োজন বোধ করে নি। এখনো প্রয়োজন বোধ করছে না।

শওকত বড় একটা পেপার গ্লাস নিয়ে তিতলীর দিকে আসছে। তার ভুরু কুঁচকে আছে। চিন্তা মনে হয় আরো বেড়েছে।

তিতলী নাও পেপসি খাও।

তিতলী গ্লাস হাতে নিল। তার পেপসি খেতে ইচ্ছে করছে না–মানুষটা এত আগ্ৰহ করে এনেছে, না খেলে ভালো দেখায় না। একবারের জন্য হলেও গ্লাসটা ঠোঁট ছোঁয়ানো দরকার। তারপর হাতে নিয়ে বসে থাকলেই হবে।

তিতলী বলল, কোনো সমস্যা হয়েছে?

না। তেমন কিছু না। আমার সুটকেসটা আসে নি। ওরা বলছে এক ঘণ্টা পর রয়েল নেপাল এয়ারলাইনসের একটা প্লেন আসবে। সুটকেসটা নাকি সেখানে। অপেক্ষা করা ছাড়া পথ দেখছি না। তোমার বোধহয় চুপচাপ বসে থাকতে খারাপ লাগছে।

খারাপ লাগছে না। তোমার গাল ফোলা। কী হয়েছে?

হঠাৎ করে দাঁত ব্যথা শুরু হয়েছে।

বেশি?

হাঁ বেশি। হোটেলে গিয়ে পেইনকিলার টিলার খেতে হবে।

আমার কাছে প্যারাসিটামল আছে।

প্যারাসিটামলের স্টেজ পার হয়ে গেছে। তুমি বস, আমি হোটেলের খোঁজ নিই। গল্পের বইটই কিছু এনেছ? বসে বসে পড়।

গল্পের বই লাগবে না।

শওকত চিন্তিতমুখে হোটেল ইনকোয়োরির দিকে যাচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে তাকে নিয়ে যাবার জন্যে বাংলাদেশ এম্বেসির এক ভদ্রলোকের আসার কথা। হোটেল বুকিং তারই করে রাখার কথা। তিনি আসেন নি। এম্বেসিতে টেলিফোন করেও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। চারটা বাজে। অফিস আওয়ার্স শেষ। হোটেল রিজার্ভেশনের সমস্যা হয়তো হবে না। এখন টুরিস্ট সিজন না। ভরা বর্ষায় কেউ নেপাল বেড়াতে আসে না। হোটেলের চেয়েও বেশি জরুরি–একজন ডাক্তার খুঁজে পাওয়া। দাঁতের ব্যথা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। মাথা দপদপ করছে। নেপাল এয়ারলাইনসে সুটকেস পাওয়া না গেলে রেডিমেড শার্ট-প্যান্ট থেকে শুরু করে টুথপেস্ট, টুথব্রাশ সবই কিনতে হবে।

নেপাল এয়ারলাইনসের ফ্লাইট দু ঘণ্টা দেরি করে এল। সেখানে সুটকেস নেই। শওকতের গাল আরো ফুলেছে। মনে হচ্ছে জ্বর এসে গেছে। বাইরে শুরু হয়েছে বৃষ্টি। মুষলধারে বৃষ্টি। পাহাড়ি অঞ্চল বলেই কি বৃষ্টির ফোঁটা এত বড়?

এম্বেসির ভদ্রলোকের নাম সোবহান। তিনি শেষ পর্যন্ত এসেছেন। ভদ্রলোক বিমানের টাইমিঙে গণ্ডগোল করেছেন। তবে ভদ্রলোক করিতককর্মা। নগরকেটে হোটেল বুকিং নিয়ে রেখেছেন। কাঠমাণ্ডুতে নাকি দেখার কিছু নেই। ভদ্রলোকের মতে হিমালয়ের সঙ্গে প্ৰথম পরিচয় নগরকেটে হওয়া উচিত। ভদ্রলোক এয়ারপোর্ট থেকেই শওকতের সুটকেস খুঁজে বের করলেন। পরের দিন বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটে সুটকেস আসবে এটা নিশ্চিত করলেন। ডেনটিক্টের সঙ্গেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলেন। বিদেশের এম্বেসিতে যারা কাজ করেন তারা ঘুমানো এবং শপিং করা ছাড়া অন্য কিছুই পারেন না বলে যে ধারণা দেশে প্রচলিত তা সম্ভবত সত্যি নয়।

ভদ্রলোক শওকতকে শার্ট-প্যান্ট কিনতে দিলেন না। গষ্ঠীরমুখে বললেন, কাল তো সুটকেস চলেই আসছে–শুধু শুধু ডলার খরচ করবেন কেন? একটা রাতেরই তো কারবার। ভাবির শাড়ি প্যাঁচ দিয়ে লুঙ্গির মতো পরে শুয়ে থাকবেন। দুপুরের মধ্যে আমি সুটকেস পৌঁছে দেব। পরদিন রওনা করবেন পোখরা।

শওকত বলল, কোথায় যাব?

পোখরা। সেখানে খুব সুন্দর তিনটা হ্রদ আছে–ফিওয়া, বেগনাস এবং রুপা। লোকগুলোর উৎস হলো অন্নপূর্ণ রেঞ্জের তুষার গলা পানি। ফিওয়া হ্রদের পাশে লোকভিউ হোটেল। একটা রুমি নিয়ে রেখেছি। এসি রুম, আপনাদের পছন্দ হবে।

যাব। কীভাবে?

বাইরোডে যাবেন। ট্যাক্সি নিয়ে যাবেন। প্লেনেও যাওয়া যায়। ওয়ান ওয়ে টিকিট ফোর্টি নাইন ডলার। প্লেনে যাওয়া অর্থহীন। পোখরা যাবার দুপাশের দৃশ্য না দেখলে মানবজন্ম বৃথা।

কাঠমাণ্ডুতে কিছু দেখার নেই?

মন্দির ফন্দির আছ–চাইলে একদিন দেখিয়ে আনব। ইউরোপ আমেরিকার টুরিস্টরা ক্যামেরা হাতে নিয়ে খুব আগ্রহ করে পটাপট মন্দিরের ছবি তোলে। মন্দির দেখার জন্যে নেপালে আসার দরকার কী? নেপালে এসেছেন। হিমালয় দেখবেন। প্রাণভরে হিমালয় দেখুন। তবে…।

তবে কী?

বর্ষাকাল তো। হিমালয় দেখতে পারবেন কি না, সেটা হলো কথা। আকাশ পরিষ্কার না থাকলে কিছু দেখা যায় না। আপনাদের ভাগ্য ভালো হলে ইনশাল্লাহ দেখবেন।

তারা নগরকেটে পৌঁছল রাত আটটার দিকে। বৃষ্টি তখনো ঝরছে। মুষলধারে না হলেও ঝিরবির করে পড়ছে। আঁকাবাকা পাহাড়ি রাস্তা। রাস্তায় আলো নেই। একপাশে গভীর গিরিখাদ। স্টিয়ারিঙের হতে শক্ত না হলে ভয়াবহ অ্যাকসিডেন্ট ঘটবে। বষ্টিভেজা রাস্তাও খুব পিছল। মাঝে মাঝেই গাড়ি ঝাঁকুনি খেয়ে থেমে যাচ্ছে। অল্পবয়সী ড্রাইভার জয় পশুপতিনাথজী বলে গাড়ি স্টার্ট দিচ্ছে।

শওকত বলল, রাস্তা তো ভয়াবহ। তিতালী তোমার ভয় লাগছে?

তিতলী বলল, না।

তাহলে তোমাকে ‘সাহসী তরুণী’ টাইটেল দেয়া যায়। ভয়ের চোটে আমার দাঁত ব্যথা সাময়িকভাবে চলে গেছে। আমার ধারণা হোটেলে পৌঁছার পর ভয় কেটে যাবে, দাঁত ব্যথা আবার শুরু হবে।

সেক্ষেত্রে হোটেলে না পৌঁছে পথে পথে ঘুরে বেড়ানো ভালো।

শওকত শব্দ করে হাসল। তিতালীর মনে হল–মানুষটার হাসি খুব সুন্দর। হাসান ভাইয়ের হাসিও সুন্দর, তবে হাসান ভাই এত শব্দ করে হাসত না। তিতালীর অস্বস্তি লাগছে। তুলনামূলক চিন্তা সে কেন করছে। এর মধ্যে তুলনার কী আছে?

বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়ি থেমেছে। ড্রাইভার জয় জয় পশুপতিনাথজী বলে দু’হাত একত্র করে স্টিয়ারিংকে নমস্কারের মতো করেছে। তিতালী ভীত গলায় বলল, কী হয়েছে? ড্রাইভার হাসিমুখে বলল, বহেনজি আ গয়া।

এত অন্ধকার কেন ?

নেপালি ড্রাইভার বাংলা বাক্য বুঝল। জবাব দিল ইং – নো ইলেকট্রিসিটি । পাওয়ার ফেইলিউর ।

অন্ধকারে এতক্ষণ চোখে পড়ে নি- এখন দেখা যাচ্ছে- দক্ষিণে বিশাল দোতলা হোটেল। ভূতের বাড়ির মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইলেকট্রিসিটি না থাকলে এত বড় হোটেলে চার্জলাইট জ্বলবে, বাতি জ্বলবে–পুরোপুরি অন্ধকার খাঁখাঁ করছে। বৃষ্টি সূচের মতো গায়ে বিধছে। তিতালীর শরীর কাঁপছে। এত ঠাণ্ডা বৃষ্টি এর আগে তার গায়ে পড়ে নি। পাহাড়ি বৃষ্টি কি এত ঠাণ্ডা হয়? বৃষ্টির এই নমুনা জানলে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয়ই লিখতেন না, এস কর স্নান নবধারা জলে।

তিতালী হোটেলের লবিতে পা দেয়ামাত্র ইলেকট্রিসিটি চলে এল। চারদিক ঝলমল করে উঠল। হোটেল দেখে তিতালী মুগ্ধ। শোবার ঘরগুলো বড় বড়। ঘরে কাঠের পুরনো ধরনের আসবাব। ডেসিং টেবিলের আয়নাটা সুন্দর। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে । হোটেলের আয়না। সচরাচর ভালো হয় না। বাথরুমেও ঝক ঝক করছে ।

তিতলী খুশি খুশি গলায় বলল, হোটেলটা তো খুব সুন্দর।

শওকত বলল, হোটেলটা খুব সুন্দর না। মাঝারি ধরনের। তুমি কখনো ভালো হোটেলে থাক নি বলে তোমার কাছে এত সুন্দর লাগছে। তোমার কি ক্ষিধে লাগছে?

হুঁ।

তাহলে তুমি এক কাজ কর খেয়ে এস। ডাইনিং হলে চলে যাও। রাত বেশি হলে ডিনার পাবে না।

তুমি খাবে না?

আমার দাঁতের যে অবস্থা! পানি ছাড়া কিছু খেতে পারব না। তাছাড়া খেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। আমি চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকব।

আমি একা একা খেতে যাব?

হ্যাঁ যাবে। আমরা যে বিচিত্র জীবন শুরু করেছি। সেখানে দোকার ব্যাপার তো নেই–তাই না? এক কাজ করা–ভালো করে হাতমুখ ধুয়ে নাও কিংবা গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর খেতে যাও। মেনু দেখে দেখে অর্ডার দেবে সমস্যা কিছু নেই। পারবে না?

পারব।

গুড।

শওকত বিছানায় গা এলিয়ে দিল। শরীরটা বেশ খারাপ লাগছে। গা কেমন ঘিনীঘিন করছে। বাসি কাপড় ছাড়া হয় নি। ছাড়ার উপায়ও নেই। একসেট কাপড় হলেও কেনা দরকার ছিল। গরম পানিতে গোসল সেরে হোটেলের গামছা গায়ে জুড়িয়ে শুয়ে থাকলে হয়। ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে একজন তরুণীর সামনে ব্যাপারটা শোভন হবে না। এই তরুণী তার স্ত্রী এটিও খুবই আশ্চর্যজনক ব্যাপার। ভিক্টোরিয়ান যুগের গল্প-উপন্যাসে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কবিহীন স্বামী-স্ত্রী হয়তো থাকে। এ যুগে কি থাকে? তিতলী যা করছে তা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা থেকে করছে। আর সে নিজে যা করছে তাও কি অসুস্থতা নয়? অন্যের অসুখকে প্রশ্রয় দেয়াও তো এক ধরনের অসুখ। সে যা ভেবেছিল তা হচ্ছে না–সময়ের সঙ্গে তিতলী সহজ হচ্ছে না। বরং উল্টোটা হচ্ছেঅস্বাভাবিক সম্পর্কই এখন স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। এক সময় আরো স্বাভাবিক মনে হবে। ভুল হচ্ছে, মস্ত বড় ভুল। ভুলের ছোট্ট চারা রোপণ করা হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই চারা ডালপালা মেলে মহীরুহ হয়ে গেছে। এই মহীরুহ এখন আর খুব সহজে টান দিয়ে উপড়ে ফেলা যাবে না। বড় করাত দিয়ে গাছটা কাটতে হবে। সেই করাত দুজনের করাত। করাতের এক মাথা থাকবে তার হাতে অন্য মাথা থাকবে তিতলীর হাতে। তিতলী কি সেই করাতের একমাথা ধরবে? মনে হয় না।

শওকতের জ্বর বাড়ছে। মনে হচ্ছে এন্টিবায়োটিকগুলো কাজ করছে না। ঠাণ্ডাও বোধহয় লেগেছে–বুকের ভেতর ঘড়ঘড় শব্দ হচ্ছে। সামান্য কাশি। নিউমোনিয়া না তো? বড় ধরনের অসুখ বাঁধিয়ে ফেললে তিতলী সমস্যায় পড়বে। বিদেশে অসুস্থ মানুষ মানে নানান যন্ত্রণা। তিতলী নামের এই মেয়েটিকে এ জাতীয় যন্ত্রণায় ফেলার কোনো অর্থ হয় না। মেয়েটা কে? কেউ না। খুব রূপবতী একটা মেয়ে যে বাস করছে ভয়ঙ্কর এক ঘোরের জগতে। ঘোর কাটছে না। সম্ভবত কাটবেও না।

তিতলী?

হুঁ।

ঠাণ্ডা এক গ্লাস পানি দিতে বল। পানি খাব।

কাকে বলব? রুম সার্ভিসকে বলতে হবে। আচ্ছা টেলিফোনটা আমার কাছে দাও–আমি বলছি। তোমার জ্বর কি বেড়েছে?

তাই মনে হচ্ছে।

মাথায় পানি ঢালতে হবে?

না। তুমি বসে আছ কেন? খেতে যাও।

তিতলী চলে গেল। শওকত ভেবেছিল তিতলী গায়ে হাত দিয়ে জ্বর দেখবে। এই ভদ্রতা সাধারণ ভদ্রতা। তিতলীর কাছ থেকে এই সামান্য ভদ্রতাটুকু কি আশা করা যায় না?

নতুন জায়গায় তিতলীর ঘুম হয় না। নগরকেটের হোটেলে তার খুব ভালো ঘুম হলো। দীর্ঘ ঘুম এবং খুব আরামের ঘুম। ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। হোটেলের ভেতরে তখনো অন্ধকার। শওকত চাদর মুড়ি দিয়ে কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। তার মাথা বালিশ থেকে সরে গেছে। বাচ্চাদের এই অভ্যাস শওকতের আছে। মাথার নিচে বালিশ থাকে না। তিতলীর একবার ইচ্ছা করল শওকতের মাথাটা বালিশে তুলে দেয়। তারপরই মনে হলো থাক।

সে বাথরুমে ঢুকে হাতমুখ ধোল। কলটা ছাড়ল খুব সাবধানে। অসুস্থ মানুষ-ঘুম যেন না ভাঙে।

তিতলী ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় এল। সেখান থেকে চলে এল হোটেলের বাগানে। সে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। যে বিস্ময়কর দৃশ্য তার সামনে ছিল তার জন্যে তার কোনো প্ৰস্তুতি ছিল না। দিগন্তজুড়ে হিমালয় পর্বতমালা। বরফের চাদরে তার গা ঢাকা। প্ৰভাতের প্রথম সূর্যকিরণে সেই চাদরে সোনালি আভা লাগতে শুরু করেছে। এ কী অপরূপ দৃশ্য! তিতলী মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগোচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘন কুয়াশা তাকে ঢেকে ফেলল। বর্ষাকালে এত কুয়াশা এল কোথেকে? হঠাৎ তার মনে হল–এটা মেঘ না তো? জলভরা একখণ্ড মেঘ কি তাকে জড়িয়ে ধরেছে? অবশ্যই তাই। এম্বেসির সোবাহান সাহেব এ জাতীয় কথাই তো বলেছিলেন। নগরকোট এত উঁচুতে যে গায়ের ওপর দিয়ে মেঘ চলে যায়। হাতের মুঠোয় মেঘ ধরা যায়; এই তো সেই মেঘ। আকাশের মেঘ হাত দিয়ে ছোয়া যাচ্ছে! চোখের সামনে হিমালয়ের রঙ বদলে যাচ্ছেপ্রকৃতি এত সুন্দর হয়? তিতলীর রীতিমতো কান্না পেয়ে গেল। এত সুন্দর কখনো একা দেখা যায় না। শওকতকে এনে দেখাতে হবে। ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে আসতে হবে। বাগানে চেয়ার-টেবিল পাতা আছে। হোটেলের গেস্টরা চেয়ারে বসে হিমালয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের সামনে পটভর্তি চা। তিতলীরাও তাই করবে। দুজন বসে চা খাবে তারপর হঠাৎ একসময় বিশাল একখণ্ড মেঘের ভেতর তারা ডুবে যাবে।

তিতলী শওকতের গায়ে হাত রেখে কোমল স্বরে ডাকল–এই ওঠ তো। ওঠ।

শওকত চোখ মেলল। অদ্ভুত একটা দৃশ্য সে দেখছে—তিতলী তার গা ঘেঁসে বসে আছে। তিতলীর একটা হাত তার পিঠে। এটি কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য? না স্বপ্নদৃশ্য নয়। তিতলীর গা থেকে বাসি ফুলের গন্ধ আসছে। স্বপ্নদৃশ্যে গন্ধ থাকে না।

চট করে উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাও।

কেন?

বাইরে যে কী সুন্দর! আমি এতক্ষণ মেঘের ভেতর দাঁড়িয়ে ছিলাম।

সত্যি।

হ্যাঁ সত্যি। এই দেখ তোমার গা ছুঁয়ে বলছি। শুয়ে আছ কেন ওঠ।

শওকত হাত বাড়িয়ে তিতলীর হাত ধরল। তিতলী হাত সরিয়ে নিল না। শওকত তাকে কাছে টানল। তিতলী কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে রইল–তারপর হঠাৎ নিজেকে ছেড়ে দিল। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কী করছ দরজা খোলা! শওকত বলল, থাকুক খোলা।

তিতলী বলল, তোমার গায়ে জ্বর নেই?

না নেই।

তিতলী বলল, আমার ভীষণ লজ্জা লাগছে। তুমি কি এক সেকেন্ডের জন্য আমাকে ছাড়বে?

এক সেকেন্ডে কী করবে?

দরজা লাগিয়ে দেব।

দরজা লাগাতে হবে না।

কী আশ্চর্য বারান্দা দিয়ে বেয়ারারা আসা-যাওয়া করছে।

ওরা হাইলি টেন্ড। হোটেলের খোলা দরজা দিয়ে এরা কখনো ভেতরে তাকাবে না।

আমরা হিমালয় দেখব না?

হিমালয় পালিয়ে যাচ্ছে না।

আমিও তো পালিয়ে যাচ্ছি না। ছিঃ ছিঃ তুমি তো আমাকে নগ্ন করে ফেলছ। আমি কিন্তু এখন ধাক্কা দিয়ে তোমাকে বিছানা থেকে ফেলে দেব।

ফেলে দাও।

ধাক্কা দিতে গিয়ে তিতলী ধাক্কা দিতে পারল না। তার শরীর জেগে উঠেছে। সে গভীর মমতা ও ভালবাসায় শওকতকে জড়িয়ে ধরল। হিমালয় সূর্যকিরণ মেখে তার রঙ বদলাচ্ছে। ফেরারি মেঘমালার দু-একটা ঘুরে বেড়াচ্ছে হোটেলের চারপাশে। তিতলীর চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। তার মনে হচ্ছে কোনো একটা দুষ্ট প্রকৃতির মেঘ বোধহয় খোলা দরজা দিয়ে তাদের ঘরে ঢুকে পড়েছে। তারা ডুবে গেছে মেঘের দিঘিতে।

২৫ পর্ব শেষ 📌

মেঘ বলেছে যাব যাব পর্ব-২২+২৩+২৪

0
মেঘ বলেছে যাব যাব হুমায়ূন আহমেদ

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব(পর্ব :২২)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

রীনা ভালো আছে কি না তা সে এখনো বুঝতে পারছে না। দিনের বেলায় সে বেশ ভালোই তাকে। দিনটা শুরু হয় ব্যস্ততার ভেতর শেষও হয় ব্যস্ততার ভেতর। সন্ধ্যার পর থেকে কিছু করার থাকে না। বুকে হাঁপ ধরার মতো হয়। সে বসে থাকে টিভির সামানে। টিভিতে ক্ৰমাগত হিন্দি গানের নাচ হতে থাকে। নাচের মুদ্রা কুৎসিত। নাচের সঙ্গে যে গান হয়। সেই গানের সুর একই রকম। তারপরেও নাচ ছাড়া আর কিছু দেখার নেই। কারণ গৃহকর্তা মনসুর সাহেব এই অনুষ্ঠানটাই দেখেন। রীনা এ বাড়িতে আছে আশ্ৰিতের মতো। একজন আশ্ৰিতের ইচ্ছা-অনিচ্ছা থাকতে পারে না।

শ্যামলী রিং রোডের এই বাড়ি রানার বান্ধবী আফরোজার। আফরোজা রীনার সঙ্গে এক সঙ্গে স্কুলে পড়েছে। পাস করার পর আর কোনো যোগাযোগ ছিল না। দশ বছর পর আবার যোগাযোগ হয়েছে। কাকতলীয়ভাবেই হয়েছে। আফরোজা স্কুলে থাকতেও হড়বড় করে কথা বলত–এখনো হড়বড় করেই বলে। সে রীনাকে জড়িয়ে ধরে হড়বড় করে যে কথা বলল তা হচ্ছে–তুই পাগলির মতো এইসব কী বলছিস? স্বামীকে ছেড়ে চলে এসেছিস। চাকরি খুঁজছিস। আমি তোর জন্যে চাকরি কোথায় পাব? কাকে আমি চিনি? তবে চাকরি দিতে না পারলেও তোকে থাকতে দিতে পারব। চলে আয় আমার বাড়িতে। রিং রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। চার বেডরুমের ফ্ল্যাট। একটা গেষ্টরুম খালি পড়ে থাকে। ওইখানে থাকবি।

রীনা বলল, তোর হাসবেন্ড কিছু বলবে না?

কিছুই বলবে না। আমার হাসবেন্ড হচ্ছে টবের গাছের মতো। কথাবার্তা কিছুই বলে না। সন্ধ্যাবেলা টিভির সামনে বসে। মাঝখানে একবার ভাত খাওয়ার জন্যে ওঠে। বারটা বাজলে ঘুমোতে যায়।

উনি করেন কী?

ব্যবসা পাতি করে। কী ব্যবসা তাও জানি না। ও কী করে না করে তা নিয়ে ভাবতে হবে না–তুই আয় তো। কথা-বালিশ নিয়ে উঠে আয়।

রীনা রিং রোডে আফরোজার ফ্ল্যাটবাড়িতে গিয়ে উঠল। সুন্দর গোছানো ফ্ল্যাট। দামি হোটেলের মতো সব কিছু ঝকঝকি করছে। যে গেষ্টরুমে রীনাকে থাকতে দেয়া হয়েছে সেখানেও এসি আছে। মেঝেতে দামি কাপেট। আফরোজা বলল, গরম লাগলে এসি ছাড়বি। কোনো রকম কিন্টামি করবি না। নিজের বাড়ি মনে করে থাকবি। পরের বাড়িতে আছিস বলেই যে কিছু কর্ম করবি–চা বানাবি, রান্না করবি তাও না। তিনটা কাজের মানুষ। কাজ না করে করে ওদের হাতে পায়ে জং ধরে গেছে। রীনা বলল, তোর ছেলেপুলে কী?

ছেলেপুলে কিছু নেই। আমার নাকি কী সব সমস্যা আছে। ও বলছিল টেসটিউব বেবি নিতে। শুনেই আমার ঘেন্না লাগল। টেস্টটিউব অদল বদল হয়ে যাবে–কার না কার দিয়ে দেবে। ছিঃ। তারপরও কোলকাতা গিয়ে দু’মাস ছিলাম। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে–ডাক্তাররা খোঁচাখুঁচি করে যন্ত্রণার চূড়ান্ত করেছে। বাচ্চাকাচ্চা ছাড়া আমি ভালোই আছি। পালক নেবার কথা মাঝে মাঝে ভাবি। দেখা যাক। আমার এত গরজ নেই।

আফরোজার স্বামীর নাম নুরউদ্দিন। থলথলে ধরনের শরীর। দেখেই মনে হয় এই মানুষটার জন্ম হয়েছে আরাম করার জন্যে। ফ্ল্যাটে যখন থাকে বেশিরভাগ সময় চেয়ারে পা তুলে বসেই থাকে। হয় খবরের কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকে নয়তো টিভির দিকে তাকিয়ে থাকে। হাঁটা চলা করতে মনে হয় কষ্ট হয়।

আফরোজা রীনাকে তার স্বামীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল-এ হচ্ছে স্কুল জীবনে আমার বেষ্ট ফ্রেন্ড–রীনা। রীনা আমাদের ফ্ল্যাটে কিছুদিন থাকবে। কতদিন এটা বোঝা যাচ্ছে না। মাসখানেকও হতে পারে-আবার বছরখানেকও হতে পারে। বুঝতে পারছি?

নুরুউদ্দিন বলল, হুঁ।

আফরোজা বলল, রানার দিকে তাকিয়ে হুঁ বল। অন্য দিকে তাকিয়ে ই বলছি কেন? আরেকটা কথা শোন–তুমি তোমার পরিচিত সবাইকে বলে দেবে রীনার জন্যে যেন একটা চাকরির খোঁজ করে। ও বি.এ. পাস করেছে। সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছে। অতি সুইট মেয়ে।

আচ্ছা।

বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওর সঙ্গে দুটা কথা বল। ভদ্রতাও তোমাকে শিখিয়ে দিতে হবে? বেচারি মনে করবে কী?

নুরউদ্দিন রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবি দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন।

আফরোজা বিরক্ত গলায় বলল, ভাবি ডাকছ কেন? তুমি নাম ধরে ডাকবে। বয়সে তুমি আমার দশ বছরের বড়। রীনার চেয়েও দশ বছরের বড়। নাম ধরে ডাকবে কোনো অসুবিধা নেই।

আচ্ছা।

ওর নাম কী জান?

না।

ওর নাম রীনা।

ও আচ্ছা রীনা।

তুমি রীনার জন্যে একটা চাকরি যোগাড় করে দেবে।

আচ্ছা।

রীনা লক্ষ করল মানুষটা আসলেই টবের গাছের মতো। ফ্ল্যাটে যখন থাকে বসে বসেই সময় কাটিয়ে দেয়। নিজের কথা বলে না। অন্যের কথা শোনার আগ্রহও তার নেই। মাঝে মাঝে রীনার মনে হয়–আফরোজা যে তাকে ফ্ল্যাটবাড়িতে এনে তুলেছে। সে তার নিজের গরজেই এনে তুলেছে। আফরোজার কথা বলার মানুষ দরকার। মুখ সেলাই করে দুজন মানুষ দিনের পর দিন পাশাপাশি বাস করতে পারে না। রীনার মাঝে মাঝেই মনে হয়-সংসারে ছেলেপুলে থাকাটা যে কত দরকার তা মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে বোঝানোর জন্যে আল্লাহ এই সংসারটা তৈরি করেছেন।

তবে কথা না বললেও রীনার নুরউদ্দিনকে পছন্দ হয়েছে। পুরুষদের স্বভাবই হচ্ছে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে আশপাশের মেয়েদের শরীরেব ওপর চোখ বুলিয়ে নেয়া। এই মানুষটি তা থেকে মুক্ত। তার ভদ্রতাবোধও ভালো। মানুষটা টিভি সেটের সামনে বসে থাকে খালি গায়ে। রটনা ঘরে এলে পাশে খুলে রাখা পাঞ্জাবিটা চট করে গায়ে দেয়। রীনা বলেছে-আপনার যদি খালি গায়ে থাকতে আরাম লাগে আপনি সেইভাবে থাকুন। আমি কিছু মনে করব না। নুরুউদ্দিন খালি গা হয় নি। তাছাড়া রীনাকে সে রীনা নামেও ডাকছে না। ভাবিই ডাকছে। এটিও রীনার পছন্দ হয়েছে। বান্ধবীর স্বামী তাকে নাম ধরে ডাকবে এটা ভাবতে তার ভালো লাগে না।

নুরুউদিনের যে ব্যাপারটা রীনার খারাপ লাগে তা হচ্ছে ভদ্রলোকের মদ্যপানের অভ্যাস আছে। সবদিন না–মাঝে মাঝে। প্রথম দিন মদ্যপানের দৃশ্য দেখে আতঙ্কে রীনার হাতপা নীল হয়ে যাবার উপক্রম হলো। মদ্যপানের ব্যাপােটা বড় বড় হোটেলে হয়, এবং অপরিচিত লোেকরা মদ্যপান করে—এই ছিল তার ধারণা। পরিচিত একজন মানুষ চেয়ারে পা তুলে মদ খাবে এই দৃশ্য রানার কল্পনাতেও ছিল না। আফরোজা এই দৃশ্য দেখেও কিছু বলছে না। এতেই বীনা খুব অবাক হচ্ছে। সে বলেই ফেলল, আফরোজা তুই কিছু বলছিস না?

আফরোজা বলল, কী বলব?

উনি যে ড্রিংক করছেন।

বদ অভ্যাস করে ফেলেছে, বলে কী হবে। শুরুতে বলেছি কাজ হয় নি–এখন আর বলি-টালি না। তাছাড়া কোনো সমস্যা করে না। নিজের মনে খায়। মদে। ওর কিছু হয় না। টাল না হয়ে পুরো এক বোতল ভদকা সে খেতে পারে।

টাল না হয়ে মানে কী?

টাল হলো–মাতাল। মদভর্তি চৌবাচ্চায়। ওকে ডুবিয়ে দে ও চৌবাচ্চার সব মদ খেয়ে বের হয়ে এসে বলবে–ভাত দাও। ক্ষিধে হয়েছে।

কী আছে। এর মধ্যে যে উনি এত আগ্রহ করে খাচ্ছেন?

কিছুই নেই। তিতকুট একটা জিনিস, খেলে মাথা ঘোরে।

তুই খেয়ে দেখেছিস?

হুঁ। একবার রাগ করে খেয়েছিলাম–অতি অতি অতি কুৎসিত। তুই একবার খেয়ে দেখিস।

সর্বনাশ!

সর্বনাশের আবার কী? ছেলেরা খেতে পারলে আমাদের খেতে অসুবিধা কী।

মদ্যপানের পর নুরউদ্দিনের তেমন কোনো পরিবর্তন রীনার চোখে পড়ে নি। শুধু একটা পরিবর্তন হয়–টুকটাক দু-একটা কথা বলে। প্রশ্ন করলে উত্তর দেয়। যেমন একদিন রীনা বলল, আপনি যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাচ দেখেন আপনার ভালো লাগে?

নুরউদ্দিন গ্লাসে হালকা চুমুক দিয়ে বলল, না। মনে হয় একদল ছেলেমেয়ে পিটি করছে।

ভালো লাগে না তো দেখেন কেন?

কিছু করার নেই। এইজন্যে দেখি। দেখিও ঠিক না, তাকিয়ে থাকা আর দেখা এক না।

গল্পের বইটই আপনি পড়েন না?

কলেজ জীবনে দু-একটা পড়েছি। এখন আর পড়ি না।

পড়েন না কেন?

সব বই তো একই রকম–একটা পড়লেই সব পড়া হয়। একটা ছেলে থাকবে, একটা মেয়ে থাকবে। তাদের প্রেম হবে। তারপর হয় তাদের বিয়ে হবে নয়। বিয়ে হবে না। এই তো ব্যাপার।

আপনার বন্ধুবান্ধব খুব কম?

হুঁ। বন্ধু কম, শক্রও কম। যাদের বন্ধু বেশি তাদের শত্ৰুও বেশি! যাদের কোনো বন্ধু নেই, তাদের কোনো শক্ৰও নেই।

রীনার চাকরি নুরউদ্দিনই যোগাড় করে দিল। এক কথায়— মাসে ছ হাজার টাকা বেতনের চাকরি তো সহজ ব্যাপার না। রীনার বিস্ময়ের সীমা রইল না। যে লোকটার প্রধান কাজ সন্ধার পর থেকে টিভির সামনে বসে মদ্যপান করা সে এক কথায় চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে এটা রীনা ভাবে নি। হাসান বছরের পর বছর ঘুরে চাকুরি পায় নি। তার সে দশ দিনের মাথায় চাকরি পেয়ে গেল। থলথলে শরীরে খালি গায়ে মানুষটার ক্ষমতা অবশ্যই আছে।

চাকরি রীনার ভালো লাগছে। সুন্দর ছিমছাম অফিস। ভালো ব্যবসা হচ্ছে। অফিসের লোকজনদের মুখ দেখেই তা বোঝা যায়। সবার ভেতরই ব্যস্ততা। রীনার বসকেও তার পছন্দ হয়েছে। স্মার্ট মানুষ। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়স। টকটকে লাল গেঞ্জি গায়ে দিয়ে একদিন অফিসে এসেছিলেন। তাকে পচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়েসী। যুবকের মতো লাগছিল। ভদ্রলোকের কথাবার্তা মার্জিত। অফিসের বসরা সব সময় গোমড়া মুখে থাকেন। ভদ্রলোকের মুখে গোমড়া না–কথায় কথায় রসিকতা করেন। রসিকতা যখন করেন–এমন গভীর ভঙ্গিতে করেন যে প্রথম কিছুক্ষণ বোঝাই যায় না–রসিকতা।

প্রথম দিন রীনা তার সঙ্গে দেখা করতে গেল। দরজায় পেতলের দুটা অক্ষর A.H. –আজিজুর হকের আদ্যক্ষর। নামের বদলে কেউ শুধু আদ্যক্ষর দরজায় লাগিয়ে রাখতে পারে রীনা ভাবে নি। সে দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকল। ভদ্রলোক বললেন, রীনা কী খবর?

রীনা বলল, জ্বি স্যার ভালো।

কাজ বুঝে নিয়েছেন?

জ্বি।

আপনার কাজটা কী বলুন তো?

রীনা হকচাকিয়ে গেল। তাকে রিসিপশনে বসতে বলা হয়েছে। এর বেশিকিছু বলা হয় নি। ভদ্রলোককে সেটা বলা কি ঠিক হবে? রীনা ইতস্তত করতে লাগল। হক সাহেব বললেন, ওরা আপনাকে কী করতে বলেছে, আমি জানি না। আপনার প্রধান কাজ হচ্ছে রোজ একবার এসে আমার সঙ্গে খানিকক্ষণ হাসিমুখে গল্প করা। অফিসের বেশিরভাগ মানুষ গোমড়া মুখে বসে থাকে। আমার অসহ্য লাগে।

রীনা খানিকটা হকচাকিয়ে গেল। ভদ্রলোকের এ জাতীয় কথা বলার মানে কী? মেয়ে কর্মচারীদের সঙ্গে অফিস বসদের নানান ধরনের গল্প শোনা যায়। এর রকমই কি? উনি কি অন্য কিছু বলার চেষ্টা করছেন?

রীনা।

জ্বি।

আমার কথা শুনে মোটেই ঘাবড়াবেন না। রসিকতা করছি। তবে আমি সত্যি সতি্যু হাসিমুখ দেখতে পছন্দ করি। নকল হাসিতেও আমার আপত্তি নেই। সত্যি কান্নার চেয়েও নকল হাসি আমার কাছে অনেক ভালো। ঠিকমতো কাজ শিখুন। আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি–মেয়েরা যখন অফিসে কাজ করতে আসে তখন তারা হয় দারুণ কাজের হয়, নয়তো নিতান্তই অকাজের হয়। মাঝামাঝি কিছু মেয়েদের মধ্যে দেখা যায় না, শুধু পুরুষদের মধ্যেই দেখা যায়। আমি কর্মী মহিলা চাই। গল্পবাজ মহিলা না যাদের প্রধান কাজ ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে লিপষ্টিক বের করে ঠোঁটে ঘষা। প্রথম দিনে অনেক কথা বলে ফেললাম—আর না।

রীনা প্ৰথম কাজ শুরু করেছিল রিসিপশনে–এখন তাকে দেয়া হয়েছে ফরেন করেসপনডেন্স ডেস্কে। যে বুড়ো ভদ্রলোকের কাছে তাকে কাজ শিখতে হচ্ছে তিনি খিটখিটে এবং বদমেজাজি। কথায় কথায় তিনি রীনাকে ধমক দেন। তবে প্ৰায় প্রতিদিনই বলেন–তোমার মাথা পরিষ্কার। অন্যরা যে কাজ এক বছরে শিখেছে তুমি তা শিখেছ এক মাসে।

এই জাতীয় কথা শুনতে আনন্দ লাগে। বুড়ো ভদ্রলোক রীনাকে শুধু যে আনন্দ দেবার জন্যে এই কথাগুলো বলছেন–তা যে না, রীনা নিজেও তা বুঝতে পারে। কাজ করতে তার ভালো লাগে। হক সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে একদিন বললেন, আপনার কাজের খুব সুনাম শুনি। আপনি স্পোকেন ইংরেজি কেমন জানেন?

রীনা বলল, ভালো জানি না স্যার।

ভিসিআরে বেশি বেশি ইংরেজি ছবি দেখে স্পোকেন ইংলিশ বানিয়ে নিন। আপনাকে আমরা আমাদের লন্ডন অফিসে পাঠিয়ে দেব। দেশের বাইরে যেতে আপত্তি নেই তো?

জ্বি না স্যার।

আপনার পারিবারিক আনফরচুনেট অবস্থার কথা আমাকে বলা হয়েছে। পারিবারিক বিধিনিষেধ নেই তো?

জ্বি না।

ভালো করে ভেবে বলুন। সব ঠিকঠাক করে আপনার বাইরে যাবার ব্যবস্থা হলো হলো–তারপর আপনি বেঁকে বসলেন বা আপনার স্বামী বেঁকে বসলেন। এমন হবে না।

জ্বি না।

হুট করে কিছু বলতে হবে না। আপনি সপ্তাহখানিক ভাবুন। তারপর বলুন।

রীনা এক সপ্তাহ ভেবেছে। কখনো তার কাছে মনে হয়েছে–না সম্ভব না। দেশে সে আছে বলেই অন্তত সপ্তাহে একবার সে টগর-পলাশকে দেখতে পারছে। আবার কখনো মনে হয়েছে–সব ছেড়েছুড়ে দূরে চলে যেতে। একবার মনে হলো তারেক যদি শোনে সে লণ্ডন চলে যাচ্ছে তাহলে সে কী বলবে? টেলিফোনে আলাপ করবে না সরাসরি তার অফিসে চলে যাবে? অফিসে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? তারেক যদি ভাবে সে আসলে এসেছে ঘরে ফিরে যেতে? ভাবলে ভাবুক। যদি সে সত্যি সত্যি লন্ডনে চলে যায়–যাবার আগে একবার দেখা করাও তো উচিত।

বুধবার দুপুরবেলা রীনা তারেকের অফিসে উপস্থিত হলো। তারেক লাঞ্চ সেরে পান চিবোচ্চিল, রীনাকে দেখে বিস্মিত-অবাক কিছুই হলো না। স্বাভাবিক গলায় বলল, রীনা কী খবর?

রীনা বলল, ভালো।

আজ আমার ব্যাডলাক, সকালে এসে দেখ ফ্যান নষ্ট। সকাল থেকে গরমে সিদ্ধ হচ্ছি। মিস্ত্ৰি আনতে লোক গেছে। এগারটার সময় গেছে–এখন দুটা। মিস্ত্রিও নেই, লোকও নেই। নো ম্যাংগো, নো গানিব্যাগ। আমিও নেই ছালাও নেই।

রীনা বলল, তুমি কেমন আছ?

ভালো।

বাসার খবর কী?

বাসার খবরও ভালো। পলাশ গতকাল রেলিঙের ওপর পড়ে একটা দাঁত ভেঙে ফেলেছে। রক্তটক্ত কিছু বের হয় নি। কট করে দাঁতের একটা কণা ভেঙে গেল।

তোমার চাকরি কেমন চলছে?

ভালো।

প্রথম প্ৰথম চাকরি খুব ভালো লাগে। কিছুদিন পর আর ভালো লাগে না। আমার তো রোজ সকালে অফিসে এসে একবার করে ইচ্ছা করে ফাইল টাইল সব জ্বলিয়ে দিয়ে হাঁটা ধরি।

কোন দিকে হাঁটা ধরতে ইচ্ছে করে, চিটাগাঙের দিকে?

হাঁটা ধরতে ইচ্ছে করে এই পর্যন্তই। তুমি চা খাবে?

না।

পান খাবে? মিষ্টিজর্দা দেয়া পান আছে। দুপুরে খাবার পর একটা পান খেতে ভালো লাগে৷ পান হচ্ছে পিত্তনাশক এবং হজম সহায়ক।

রীনা অবাক হয়ে তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছে। কী আশ্চৰ্য–দু’মাস পর দেখা–মানুষটা কত সহজেই না কথা বলছে। যেন কিছু যায় আসে না। রীনা বলল, আমাদের অফিসের একটা ব্ৰাঞ্চ আছে লন্ডনে। আমাকে খুব সম্ভব সেখানে পাঠাবে।

কবে?

জানি না কবে।

বেতন কত দেবে? দেশে যে বেতন দেবে বাইরে সে বেতন দিলে তো হবে না। ফরেন করেন্সিতে বেতন হওয়া উচিত।

উচিত হলে নিশ্চয়ই ফরেন কারেন্সিতে বেতন দেবে। তোমার ওই মেয়ের খবর কী?

লাবণীর কথা বলছ? ভালোই আছে। গত সপ্তাহে চিটাগাং গিয়েছিলাম–ওদের কক্সবাজার ঘুরিয়ে নিয়ে এসেছি। লাবণীর মেয়েটা আগে সমুদ্র দেখে নি। এই প্ৰথম দেখল। খুব খুশি।

তুমি এইভাবে ঘোরাফেরা করছি লোকজনের চোখে লাগছে–তুমি মেয়েটাকে বিয়ে করে ফেল না কেন?

তারেক বিস্মিত হয়ে বলল, এক বউ থাকতে আরেক বউ ঘরে আনব কীভাবে?

আইনে বাধা আছে?

ইসলামি আইনে বাধা নেই–কিন্তু দেশে তো পুরোপুরি ইসলামী আইন নেই—

থাকলে তোমার সুবিধা হতো। তাই না?

তারেক সিগারেট ধরাল। রীনার কান্না পাচ্ছে। এখানে আসা তার উচিত হয় নি। মানুষটার সঙ্গে তার বাসায় চলে যেতে ইচ্ছা করছে। একবার যদি সে বলত–রীনা তুমি চল আমার সঙ্গে–সে নিশ্চয়ই যেত। রীনা ক্লান্ত গলায় বলল, যাই কেমন?

দাঁড়াও পিয়নকে সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি। রিকশা ঠিক করে দেবে। দুপুরবেলায় রিকশা-বেবিট্যাক্সি কিছুই পাওয়া যায় না।

রীনা বলল, রিকশা লাগবে না।

অফিস থেকে বের হয়ে রীনার ইচ্ছা করল আবার তারেকের সঙ্গে দুটা কথা বলতে ওকে খুব রোগ লাগছে। ওর কি ঘুম হচ্ছে না?

পর্ব ২২ শেষ 📌

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (পর্ব ২৩)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

আজ লায়লার বিয়ে।

দায়সারা টাইপ বিয়ে। বর কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে আসবে। কয়েকজন আত্মীয়স্বজন থাকবে। কাজি সঙ্গে করে নিয়ে আসবে। বিয়ে পড়ানো হবে। তারা কনে নিয়ে চলে যাবে। পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহর। এক লাখ উসুল।

এটা কী রকম বিয়ে? গায়ে হলুদ না, কিছু না। লায়লা ঠিক করে ফেলেছে দুপুরে সে পালিয়ে যাবে। কোথায় যাবে এখনো ঠিক করে নি। কল্যাণপুরে তার এক বন্ধবী থাকে। তাদের বাড়িতে ওঠা যায়। সেখানে টেলিফোন আছে। টেলিফোনে অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।

বিয়ের দিনটা অন্যরকম থাকে। অথচ তার বিয়ের দিন অন্য দিনগুলোর চেয়ে মোটেও আলাদা না। সবকিছু আগের মতো শুধু টগর-পলাশ স্কুলে যাচ্ছে না। তারা বারান্দায় মহা উৎসাহে ফুটবল খেলছে।

তারেকও অফিসে যায় নি। সে বারান্দার বেতের চেয়ারে বসে ছেলেদের খেলা দেখছে। তারেক বলল, লায়লা আমাকে চা দে।

লায়লা চা বানাতে গেল। কমলার মা বলল, বিয়ার দিন চুলার ধারে যাইয়েন না আফা। ঘরে গিয়া টাইট হইয়া বইয়া থাকেন। চা আমি বানাইতেছি।

লায়লা তাকে ধমক দিয়েছে–বেশি কথা বলবে না। কমলার মা। এত কথা আমার ভালো লাগে না।

চা বানাতে গিয়ে লায়লার চোখে পানি এসে গেল। তার কত শখ ছিল অল্প বয়েসী, লম্বা পাতলা সুন্দর একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে। যার সঙ্গে সে নানান ধরেনের আহ্লাদী করবে। আহ্লাদী করতে তার খুব ভালো লাগে। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তার সঙ্গে সে আহ্লাদী কী করবে? হেডমাস্টার চেহারার একজন মানুষ। আগে বিয়ে হয়েছে। সেই পক্ষের ছেলে আছে। কে জানে ছেলেও হয়তো বাবার বিয়েতে বরযাত্রী আসবে।

মানুষটার কথাবার্তাও গা জ্বালা ধরনের–শুনুন প্লেইন এন্ড সিম্পল বিয়ে হবে। কোনো অনুষ্ঠান না কিছু না। অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে আমি যেতে চাচ্ছি না।

তুই অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে যাবি কিরে গাধা? তোর একটুও চক্ষুলজ্জা নেই! দুদিন পরে পরে বিয়ে করছিস!

লায়লা তার বিয়ের খবর কাউকে জানায় নি। কোন লজয় জানাবে? সবাই হাসাহসি করবে না! হয়তো বলবে–গাছে না। উঠতেই এক কাদি? বিয়ের আগেই এত বড় ছেলে?

ভাইয়া চা নাও।

তারেক চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বল, মা-বাবা কেউ তো এখনো আসছে। না? মা বোধহয় রাগ করেই বসে আছে। আমাকে গিয়ে রাগ ভাঙিয়ে আনতে হবে। বড়বুবুরই বা ব্যাপারটা কী? সব ঠিকঠাক করে—তারই খোঁজ নেই।

লায়লা জবাব দিল না। তারেক বলল, চা ভালো বানিয়েছিস। একটু কড়া হয়েছেআরেকটু কড়া হলে ভালো হতো।

রকিব কি তোর বিয়ের খবর জানে?

আমি জানি না।

হাসানকে বলেছিলাম খবর দিতে। দিয়েছে হয়তো। লায়লা যা আমার জন্যে আরেক কাপ চা আন।

লায়লা চা আনতে গেল। সেখান থেকেই দেখল হাসান বের হচ্ছে। এই সকালে চা-টা না খেয়ে কোথায় যাচ্ছে। লায়লা রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। হাসানকে ডাকবে না ডাকবে না করেও ডাকল, ভাইয়া শোন। যাচ্ছে কোথায়?

রহমানদের বাড়িতে। তার দাদির অবস্থা নাকি খুব খারাপ। রাতে খবর পাঠিয়েছে। যেতে পারি নি। চট করে দেখে আসি।

চা খাবে?

চা হচ্ছে নাকি? চা হলে দে। তোর মুখ এমন শুকনা লাগছে কেন? রাতে ঘুম হয় নি?

না।

বিয়ে নিয়ে টেনশান করছিস?

তোমরা কেউ টেনশন করছ না, আমি শুধু শুধু টেনশান করব কেন?

রাগ করেছিস নাকি?

আমি রাগ করব কেন? আমার রাগ করার কী আছে? তুমি ভাইয়ার কাছে বোস আমি চা নিয়ে আসছি।

লায়লার চোখে আবার পানি আসছে। হাসানকে সরিয়ে দিতে না পারলে সে তার চোখের পানি দেখে ফেলবে। কী দরকার চোখে পানি দেখানোর।

লায়লা!

হুঁ।

আমি দেরি করব না। যাব আর আসব–যেতে-আসতে যা সময় লাগে। এই ধর দুঘণ্টা। তোর কিছু লাগবে?

না আমার আবার কী লাগবে?

হুট করে বিয়ের দিন ঠিক হয়ে গেল–এইজন্যে আর উৎসব হচ্ছে না। এটা নিয়ে মন খারাপ করবি না। উৎসব বড় ব্যাপার না। যার সঙ্গে সারা জীবন থাকিবি সেই মানুষটা বড় ব্যাপার। ভদ্রলোককে আমার পছন্দ হয়েছে।

ভালো।

এখন তুই খুব রেগে আছিস–তোর পছন্দ হবে সবচেয়ে বেশি। তুই আমাদের সামনেই ওই ভদ্রলোকের সঙ্গে আহ্লাদী করবি–দেখে রাগে আমার গা জ্বলে যাবে।

এই নাও তোমার চা।

লায়লা আজ সকালে কি তুই আয়নায় নিজেকে দেখেছিস?

আয়নায় নিজেকে দেখার কী আছে।

তোকে আজ খুবই সুন্দর লাগছে। যা আয়নায় নিজেকে দেখে আয়।

ভাইয়া প্লিজ আহ্লাদী করবে না। লায়লা তারেকের চায়ের কাপ নিয়ে বের হয়ে গেল। আসলেই আয়নার সমানে আজ দাঁড়ানো হয় নি। হাসান যখন বলেছে তখন একবার নিজেকে দেখতেই হয়। লায়লা নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে, তখন চোখে পড়ল বাসার সামনে ট্যাক্সি থামল। ট্যাক্সি ভর্তি মানুষ। বড়বুবু সবাইকে নিয়ে চলে এসেছেন। পেছনে আরেকটা ট্যাক্সি সেখান থেকে মা-বাবা নামছেন। সবার মুখ হাসি হাসি। এ কী! উৎসব শুরু হয়ে গেল নাকি? লায়লার বুকে সামান্য কঁপন লাগল। ছোটবেলায় ঈদের দিন ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই যেমন মনে হত আজ। ঈদ এবং বুকে কাঁপন লগত তেমন কাঁপন।

টগর এবং পলাশ দাদিমা দাদিমা বলে বিকট চিৎকার করছে। বড়বুবু হাতে অনেকগুলো প্যাকেট নিয়ে নামছেন। কে জানে প্যাকেটগুলাতে কী আছে।

আম্বিয়া খাতুন আবারো একটা ভেলকি দেখিয়েছেন। হাতপা, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। টেনে টেনে শ্বাস নিচ্ছিলেন। এক সময় শ্বাস নেয়া স্তিমিত হয়ে গেল। সেকান্দর আলী ‘ও আমার মারে’ বলে বিকট চিৎকার দিয়ে উঠতেই আম্বিয়া খাতুন ক্ষীণ গলায় বললেনগাধাটা চিল্লায় কেন? আম্বিয়া খাতুনের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গেল। নিয়মিত শ্বাস পড়তে লাগল। তিনি পানি খেতে চাইলেন। আত্মীয়স্বজনরা দল বেঁধে এসেছিলেন তারা চলে যেতে চাচ্ছিলেন, সেকান্দর আলি বললেন— এখন যাবেন না। মৃত্যুর আগে আগে হঠাৎ শরীরটা ভালো হয়ে যায়। তাই হচ্ছে। আপনারা চলে যাবেন, ঘটনা ঘটে যাবে। আপনাদের মনে থাকবে আফসোস–শেষ সময়ে কাছে থাকতে পারলেন না। আত্মীয়স্বজন বেশিরভাগই থেকে গেলেন। সব অপেক্ষই যন্ত্রণাদায়ক, মৃত্যুর অপেক্ষাও তাই।

হাসান যখন পৌঁছলো তখন লোকজনে বাড়ি গমগম করছে। উৎসব উৎসব ভাব। ছোট বাচ্চারা উঠোনে খেলছে। বয়স্করা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গল্প করছেন। ট্রেভর্তি চা এসেছে। চা নেয়া হচ্ছে। সবার মধ্যে ঢিলেঢালা ভাব। শুধু সেকান্দর আলি বিরসমুখে বসে আছেন। রাত্রি জাগরণের কারণে তার শরীর খারাপ করেছে। সামান্য হাঁপানির টানও উঠছে। বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে থাকলে হতো। সেটা ভালো দেখায় না। মারা এখন তখন অবস্থা আর পুত্র এসি ঘরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে! তার যেসব আত্মীয়স্বজন একটু পর পর তাকে বলছে ‘সেকান্দর তুমি যাও শুয়ে একটু রেষ্ট নাও, তোমার দিকে তাকানো যাচ্ছে না’–তারাই তখন নানা কথা ছড়াবে। দরকার কী?

হাসানকে দেখে সেকান্দর আলি বললেন, কী খবর হাসান?

হাসান বলল, জ্বি চাচা ভালো।

মার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তোমাকে দেখতে চাচ্ছিলেন। এসেছ ভালো করেছ। যাও দেখা দিয়ে এস।

রহমান কোথায়?

ওকে টঙ্গী পাঠিয়েছি। একজন কাউকে তো ব্যবসাপতি দেখতে হবে।

জ্বি দেখতে তো হবেই।

শোন হাসান, তোমার জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করেছি। গ্রামের দিকে যেতে হবে। স্কুলমাস্টারি। শিক্ষকতা পেশা হিসাবে খারাপ না। গ্রামে থাকবে ফ্রেশ। আলোবাতাস, ফ্রেশ সবজি। সবাই শহর। শহর করলে গ্রামগুলো চলবে কীভাবে?

জায়গাটা কোথায়?

আমাদের গ্রামের বাড়িতে। আমারই দেয়া আমার মায়ের নামে স্কুল—আম্বিয়া খাতুন গার্লস হাইস্কুল।

ও আচ্ছা।

নদীর পাড়ে স্কুল। অতি মনোরম পরিবেশ। মেয়েদের হোস্টেল আছে। শিক্ষদের থাকার জায়গা আছে। বেতন যা দেয়া হয়। খারাপ না। সরকারি ডিএ তো আছেই। আনম্যারিড কোনো শিক্ষক ওই স্কুলে দেয়া হয় না–তোমার বেলায় নিয়ম শিথিল করা হয়েছে। গ্রামে যাবে?

জ্বি ভেবে দেখি।

হ্যাঁ ভেবে দেখ। আর যদি যাবার সিদ্ধান্ত নাও তাহলে বিয়ে করে ফেল। বউ নিয়ে থাকবে। সুখে থাকবে। তোমরা ঢাকা শহর ঢাকা শহর করা। কী আছে। এই শহরে! পলিউশন। বেবিট্যাক্সির ধোঁয়া খেয়ে মানুষের গড় আয়ু কমেছে পাঁচ বছর। ঠিক না?

জ্বি।

আচ্ছা যাও মার সঙ্গে দেখা করে আস। একটি কথা শোন–মা তোমার জন্যে এত ব্যস্ত কেন?

জানি না চাচা।

বুঝলে হাসান, মাের এই ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝি না। আমি অতি মাতৃভক্ত ছেলে। মা যা বলছে করেছি। স্কুল বানাতে বলেছে, বানিয়েছি। শীতের সময় আসে মা বলে, গ্রামের গরিব-দুঃখীকে শীতের কম্বল দে, পুরনো কম্বল দিবি না।—নতুন কম্বল। দেই নতুন কম্বল। অমুক এতিমখানার ছেলেপুলেদের ঈদের কাপড় দে। এতিমখানায় কি ছেলেপুলে একটা-দুটা থাকে? শত শত ছেলেপুলে। উপায় কী-মাতৃআজ্ঞ; তাদের দেই। কাপড়–অথচ দেখ আমাকে সহ্যই করতে পারেন না। আচ্ছা তুমি যাও দেখা করে আস। চাকরির ব্যাপারে কোনো ডিসিশান নিলে আমাকে জানাবে।

জ্বি আচ্ছা।

হাসান ভেতরের দিকে রওনা হলো।

আম্বিয়া খাতুনকে আধশোয়া করে বসানো হয়েছে। অল্পবয়েসী একটা মেয়ে চামচে করে তাঁকে স্যুপ খাইয়ে দিচ্ছে। মেয়েটি তাকে দেখে খুবই বিরক্ত মুখে তাকাল। আম্বিয়া খাতুন বললেন, কী রে হাসান তোর সময় হলো শেষ পর্যন্ত?

কেমন আছেন দাদিমা?

ভালো আছি। দেখছিস না। সুপ খাচ্ছি। তোর চাকরি-বাকরি কিছু হয়েছে?

জ্বি না।

যার যা ক্ষমতা আল্লাহপাক তাকে তাই দেন। যার ক্ষমতা চোর হবার তাকে তিনি চোর বানান। যার কিছুই করার ক্ষমতা নেই তাকে কিছুই বানান না–সে তোর মতো পথে পথে ঘোরে। বুঝেছিস?

জ্বি।

সেকান্দরকে বলেছি তোর চাকরির জন্যে।

দাদিমা আমার চাকরির জন্যে আপনি ব্যস্ত হবেন না।

ব্যস্ত তোকে কে বলেছে? তোর চাকরি হলেই কী আর না হলেই কী? যা আমার সামনে থেকে। যাবার আগে সেকান্দরের সঙ্গে দেখা করে যাবি।

জ্বি আচ্ছা।

তোকে স্কুলের চাকরি গছিয়ে দিতে চাইবে। খবরদার নিবি না। কোনো মতে একটা চালাঘর তুলে দিয়েছে–না আছে। ছাত্র না আছে কিছু। মাস্টাররা বেতন পায় না। বুঝেছিস?

জ্বি।

বিয়েটিয়ে করবি না?

হাসান চুপ করে রইল।

না করাই ভালো। বউ তো আর তোর মতো বাতাস খেয়ে থাকবে না। তোকে না। চল যেতে বললাম, দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আজকাল কি কানেও শুনতে পাস না?

যে মেয়েটি স্যুপ খাওয়াচ্ছিল সে শুকনো গলায় বলল, আপনি এখন যান। উনাকে আর বিরক্ত করবেন না। স্যুপ খাওয়ানোর চেষ্টা করছি।

হাসান বের হয়ে এল। এই বৃদ্ধার মেহের কোনো কারণ সে জানে না। কোনোদিন জানবেও না। ঘর থেকে বের হবার সময় হঠাৎ তার মনে হলো, এই বৃদ্ধর সঙ্গে আর দেখা হবে না। এ রকম মনে হবার কোনো কারণ নেই। তবু মনে হলো। গুরুতর অসুস্থ যে কোনো মানুষের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় এ রকম অনুভূতি হয়–যার আসলে তেমন গুরুত্বই নেই।

সেকান্দর সাহেব বলেলেন, হাসান চলে যাচ্ছে নাকি?

জ্বি।

মা কী বলল?

তেমন কিছু বলেন নি।

আচ্ছা ঠিক আছে। স্কুলের ব্যাপারে কোনো ডিসিশান নিলে জানাবে। স্কুলের চাকরি খারাপ না। স্যাটিসফেকশান আছে। একটা ভালো কাজ করছ, তার স্যাটিসফেকশন।

জ্বি।

সন্ধ্যার দিকে সময় পেলে একবার এসো। মার জন্যে খতমে শেফা পড়াচ্ছি। বাদ মাগরেব দেয়া হবে।

বাসায় একটা কাজ আছে চাচা।

কাজ থাকলে আসার দরকার নেই।

সেকান্দর আলি বিমর্ষমুখে সিগারেট ধরালেন। সিগারেটে তিনি কোনো স্বাদ পেলেন না।

লায়লার বিয়ে হয়ে গেল।

তার মন খারাপ ভাবটা বিয়ের পর পুরোপুরি কেটে গেল। যতটা দায়সারা বিয়ে হবে বলে সে ভেবেছিল দেখা গেল বিয়েটা সে রকম দায়সারা হয় নি। ওরা বিয়ের শাড়িই এনেছে তিনটা। একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর। এর মধ্যে একটা নীল শাড়ি দেখ লায়লা মোহিত হয়ে গেল। সে ফিসফিস করে বলল, ভাবি নীল শাড়িটা কেমন লাগছে?

বিয়ে উপলক্ষে রীনা এসেছে। সে বেশ স্বাভাবিকভাবেই আছে। টগর-পলাশ মাকে দেখে বেশ স্বাভাবিক আছে। তাদের মধ্যে বাড়তি কোনো আবেগ বা উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে না।

রীনা বলল, শাড়িটা তো খুবই সুন্দর।

এখন বল শাড়ি কোনটা পরব?

সবচে’ সুন্দরটাই পর। নীলটা পর।

কিন্তু ভাবি লাল শাড়ি ছাড়া বিয়ে কেমন কেমন জানি লাগছে।

তাহলে থাক লালটাই পর। বিয়ে পড়ানো হোক–তারপর বদলে নীলটা পরলেই হবে।

গায়ে হলুদ হয় নি বলে। লায়লার মনে যে খুঁতখুঁতনি ছিল সেটা দূর হয়েছে–রীনা দুপুরে এসেই গায় হলুদের ব্যবস্থা করেছে। লায়লা খুবই আপত্তি করছিল, কী ছাতার বিয়ে তার আবার গায়ে হলুদ! ভাবি তুমি বরং কিছু শুকনা মরিচ পিষে গায়ে ডলে দাও। গায়ে মরিচ হয়ে যাক!

রীনা ধমক দিয়েছে–ঝামেলা করবে না তো। এস বলছি। লায়লা আর ঝামেলো করে নি। খুশি মনেই গিয়েছে। বিয়ের শাড়ি পরানোর পর লায়লার খুব ইচ্ছা করতে লাগল কোনো একটা পার্লারে গিয়ে চুল বেঁধে আসতে। ভুরুও প্লাক করা দরকার। তুরু প্লাক সে নিজে নিজে করে। বিউটি পার্লারে ওরা নিশ্চয়ই খুব সুন্দর করে করবে। কিন্তু কথাটা সে বলবে কাকে? বলতে লজ্জাও লাগবে। তার বান্ধীরা কেউ থাকলে বলত। কাউকেই আসতে বলা হয় নি। এখন মনে হচ্ছে আসতে বললে ভালো হতো। নীল শাড়িটা সবাইকে দেখাতে ইচ্ছা করছে।

বরযাত্রীদের কাজি নিয়ে আসার কথা। তারা আনতে ভুলে গেছেন। গাড়ি পাঠানো হয়েছে কাজি আনতে। লায়লা সেজোগুজে অপেক্ষা করছে। মাথার চুল বাধাটা নিয়ে তার মনটা খুঁতখুঁত করছে। আচ্ছা লজ্জার মাথা খেয়ে সে কি ভাবিকে বলে ফেলবে? ভাবি আবার তাকে বেহায়া ভাববে না তো? লায়লা ক্ষীণস্বরে ডাকল, ভাবি।

রীনা বলল, কী ব্যাপার বল? লায়লা তোমাকে কিন্তু খুবই সুন্দর লাগছে। আয়নায় দেখেছি নিজেকে।

চুল বাঁধাটা মনে হয় ঠিক হয় নি ভাবি। কেমন ফুলে ফুলে আছে। রীনা বলল, লায়লা চল একটা কাজ করি। এখনো তো হাতে সময় আছে চল কোনো পার্লারে গিয়ে বেঁধে আসি।

যাব কী করে ভাবি? বেবিট্যাক্সি করে? বিয়ের শাড়ি পরে বেবিট্যাক্সি করে যাওয়া বিশ্ৰী দেখাবে না?

বেবিট্যাক্সি করে যাব কেন? তোমার বরের গাড়ি নিয়ে যাব। তোমার বরের গাড়ি তো তোমারই গাড়ি।

দেখ ভাবি তুমি যা ভালো বোঝ। কী ছাতার বিয়ে–এর জন্যে আবার পার্লারে গিয়ে চুল বাঁধা!

লায়লা তোমার গয়নাগুলো দেখেছি। একটা নীল পাথরের সেটও আছে। তোমার নীল শাড়ির সঙ্গে খুব মানাবে।

ওইসব তুমি দেখ ভাবি, আমার কিছু দেখতে ইচ্ছে করছে না।

দেখতে ইচ্ছা করছে না বললেও লায়লা পাথরের সেটটা আগেই দেখেছে। উফ! এত সুন্দর।

যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সেই মানুষটাকেও সে এক ফাঁকে দেখেছে। বাহ্‌! পায়জামাপাঞ্জাবিতে খুব মানিয়েছে! আর আগে একবার দেখেছিল শার্ট-প্যান্ট পর্যা–তখন এত ভালো লাগে নি। আশ্চর্যের ব্যাপার–লোকটার ছেলের জন্যেও তার মায়া লাগছে। বাচ্চা একটা ছেলে–মারা ভালবাসা পাচ্ছে না। ছেলেটাকে সে অবশ্যই আদর করবে। সে বেচারা তো কোনো দোষ করে নি। তাকে এরা কোথায় একা একা রেখে এসেছে কে জানে। মনে করে নিয়ে এলেই হতো। লোকে কী বলবে? বলুক। লায়লা মানুষের কথার ধার ধারে না।

লায়লার বান্ধবীরাও শেষ পর্যন্ত বিয়েতে এসে যুক্ত হলো। বিউটি পার্লার থেকে লায়লা তাদের টেলিফোন করে দিয়েছিল। দু’জনের বাসায় টেলিফোন ছিল না। লায়লা চিঠি লিখে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। আশ্চর্য এই গাড়িটা তাদের ভাবতেও ভালো লাগছে। সে যখন ড্রাইভারকে ঠিকানা দিয়ে বলল, এই দু’জনকে আমার চিঠি দিয়ে আসতে পারবেন? ড্রাইভার বলেছে, অবশ্যই পারব ম্যাডাম। ড্রাইভারের মুখে ম্যাডাম শব্দ শুনতে এত ভালো লাগল!

বর-কনে চলে যাবার পর মনোয়ারা রীনাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন। গভীর গলায় বললেন, শোন বউমা তুমি যে এসেছ আমি খুব খুশি হয়েছি। আমি দশ রাকাত নফল নামায পড়ে তোমার জন্যে দোয়া করেছি। মা তুমি কি থাকবে না চলে যাবে?

আমি চলে যাব। হাসানকে বলেছি ও পৌঁছে দেবে।

এক কাজ করলে কেমন হয় মা, আমি তারেককে ডাকি ও কানে ধরে তোমার সামনে দশবার উঠবোস করুক।

ছিঃ মা! কী বলছেন এসব!

ভুল বলছি না। ঠিকই বলছি। ও কানে ধরে উঠবোস করলে তোমার রাগটা একটু পড়বে।

মা এইসবের কোনো দরকার নেই।

তারেক যে কাণ্ড করেছে তারপরে তোমাকে আমি থাকতেও বলতে পারি না। বুড়ো মার একটা কথা তুমি রাখি। আজ রাতটা থাক কাল সকালে চলে যেও।

একটা রাত থাকলে কী হবে?

গাধাটার সঙ্গে কথা বল। কথা বলে তোমার যদি মন গলে।

আচ্ছা ঠিক আছে মা আজ রাতটা থেকে যাচ্ছি।

একটু বস আমার সামনে। তোমার সঙ্গে গল্প করি। লায়লাকে কেমন মনে হলো মা–খুশি?

হ্যাঁ, খুব খুশি।

একেবারে গাধা মেয়ে। শাড়ি-গয়না দেখে এলিয়ে পড়েছে। যে যা চায় আল্লাহ তাকে তাই দেন। ও শাড়ি-গয়না চেয়েছিল, আল্লাহ তাকে শাড়ি-গয়না দিয়েছেন। আমার একেকটা ছেলেমেয়ে হয়েছে একেক পদের।

তারেক শুয়ে পড়ছিল। রীনা ঘরে ঢুকতেই উঠে বসে সহজ স্বাভাবিক গলায় বলল, এটা পান দাও তো।

যেন কিছুই হয় নি। সব আগের মতো আছে। রীনা পান এনে দিল। তারেক হাই তুলতে তুলতে বলল, বাতি নিভিয়ে আস। তুমি ছিলে না মশারি তুলে ফেলেছিলাম। মশারি খাটিয়েছি।

ভালো।

মশা অবশ্যি নেই বললেই হয়। কয়েকদিন ঝড় হয়েছে তো বেশিরভাগ মশার পাখা ঝড়ে ছিঁড়ে গেছে। ওরা উড়তে পারে না।

ভালো।

রীনা বিছানায় উঠতে উঠতে বলল, লাবণী কেমন আছে?

ভালো আছে। ওর মেয়েটার নিউমোনিয়ার মতো হয়েছে। খুব টেনশানে আছি। নিউমোনিয়া খারাপ ধরনের অসুখ। চিকিৎসার চেয়ে যত্নটা বেশি লাগে। লাবণী অফিস নিয়ে ব্যস্ত, বাচ্চাটার যত্ন হচ্ছে কি না কে জানে।

ডাক্তার দেখছে না?

দেখেছে। রসিফিন দিচ্ছে। রসিফিন ভালো এন্টিবায়োটিক। নিউ জেনারেশন ড্রাগ। ঠিকমতো ওষুধ পড়ছে কিনা কে জানে।

তুমি চলে যাও। দেখে শুনে ওষুধ দেবে।

যাব। বৃহস্পতিবার নাইটকোচে চলে যাব। শুক্ৰ-শনি ছুটি আছে। নাইট কোচগুলো ভালো করেছে। পাঁচ ঘণ্টা লাগে যেতে। গাড়িতে টয়লেটের ব্যবস্থা আছে।

তারেক মশারির ভেতর থেকে বের হবার উপক্রম করল। রীনা বলল, যাচ্ছ কোথায়?

তারেক চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে। আগুনের ফুলকি উঠছে–নোমছে। রীনা তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। এই মানুষটাকে ছেড়ে সে কাল ভোরে চলে যাবে। কিন্তু তার কী প্ৰচণ্ড ইচ্ছাই না করেছে মানুষটার সঙ্গে থাকতে। একটা জীবন সুখে-দুখে পার করে দিতে।

রীনা চোখের জল সামলাবার চেষ্টা করছে। পারছে না। তার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।

২৩ পর্ব শেষ 📌

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব(পর্ব :২৪)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

নাম হাসান, হাসানুজ্জামান

আপনার নাম?

জ্বি আমার নাম হাসান। হাসানুজ্জামান।

আপনি কী করেন?

কিছু করি না–বেকার বলতে পারেন। সম্প্রতি অবশ্য একটা চাকরি পেয়েছি।

কী চাকরি?

স্কুল টিচারের চাকুরি। ঢাকার বাইরে।

আপনি ধূমপান করেন?

জ্বি।

নিন। একটা সিগারেট খান।

ওসি সাহেব সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিলেন। হাসান সিগারেট নিল। তার অস্বস্তি বাড়ছে। তাকে থানায় ডেকে আনার কারণ স্পষ্ট হচ্ছে না। তারাও ভেঙে কিছু বলছেন না। ওসি সাহেবকে বেশ ভদ্র মনে হচ্ছে। পুলিশের চাকরি না করে এই ভদ্রলোক কোনো কলেজের শিক্ষকতাও করতে পারতেন। খাকি পোশাকে তাকে মানাচ্ছে না।

চা খাবেন?

জ্বি না। আমাকে কেন ডেকেছেন দয়া করে বলবেন?

আপনার ছোট ভাই আছে না–রকিব?

জ্বি।

তার সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ নেই?

যোগাযোগ থাকবে না কেন? আছে তো। মাঝখানে বেশ কিছুদিনের জন্যে ইন্ডিয়া গিয়েছিল।

শেষ কবে তার সঙ্গে দেখা হয়েছে?

শেষ কবে দেখা হয়েছে। হাসান মনে করতে পারল না। লায়লার বিয়েতে আসে নি। এটা মনে আছে। তাকে খবর দেয়া হয়েছিল, সে নিজেই খবর দিয়ে এসেছে।

দিন তারিখ বলতে হবে না। মোটামুটি একটা সময় বললেই হবে।

শেষবার সে এসেছিল খুব সম্ভব দিন পনের আগে। কেন বলুন তো?

এর মধ্যে সে কি কোনো খবর পাঠিয়েছে?

জ্বি না। পাঠালেও আমি জানি না।

সে কি বাসায় আপনাদের কারো কাছে টাকা-পয়সা রাখতে দিয়েছে?

জ্বি না।

এমনকি হতে পারে যে কারো কাছে রাখতে দিয়েছে আপনি তা জানেন না? ব্যাপারটা গোপনে ঘটেছে।

আমি আসলে কিছু বুঝতে পারছি না। এই প্রশ্নগুলো আপনি কেন করছেন জানতে পারলে আমার উত্তর দিতে সুবিধা হতো।

চা দিতে বলি–এক কাপ চা খান। চা খেতে খেতে কথা বলি। দিতে বললো?

বলুন।

ওসি সাহেব চা দিতে বললেন। হাসান খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। রকিব কি কোনো ঝামেলায় পড়েছে? ঝামেলাটা কোন ধরনের? বড় ধরনের ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার কোনো কারণ নই। রকিব রগচটা কিন্তু ভালো ছেলে।

চা নিন হাসান সাহেব।

হাসান চা নিল। ওসি সাহেব বললেন, আমি বেশি কিছুদিন আগে একজন এস.আইকে পাঠিয়েছিলাম। ও আপনার বাবার সঙ্গে রকিব সম্পর্কে কথা বলেছিল। এক ধরনের সাবধানবাণী বলতে পারেন। উনি কি ব্যাপারটা নিয়ে আপনাদের সঙ্গে ডিসকাস করেন নি?

আমাকে কিছু বলেন নি। মনে হয় অন্য কারো সঙ্গে বলেন নি। বাবা কথাবার্তা বিশেষ বলেন না। সমস্যার কথা একেবারেই বলেন না।

আপনার ছোট ভাই রকিব বাজে ধরনের সমস্যায় জড়িত ছিল। তার মধ্যে একটা হচ্ছে মানি এক্সটিরশন?

কী বললেন?

বিত্তবান লোকজন আটকে রেখে টাকা চেয়ে পাঠানো।

কী বলছেন এসব?

তার বিরুদ্ধে একটা হত্যা মামলাও আছে।

আপনাদের নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে।

জ্বি না ভুল হচ্ছে না।

আমার মনে হয় শক্রিতাবশত তার সম্পর্কে এই জাতীয় কথা বলা হচ্ছে। সে ছাত্র রাজনীতি করে—তাকে বিপদে ফেলার জন্য এইসব হয়তো ছড়াচ্ছে। সে খুবই ভালো ছেলে। পড়াশোনায় ভালো। চিকেন পক্স নিয়ে এস.এস.সি. পরীক্ষা দিয়েছিল–তারপরেও চারটা লেটার নিয়ে এস.এস.সি. পাস করেছিল।

বুঝলেন হাসান সাহেব–দেশের পরিবেশ এখন এমন রাতারাতি একজন ভালো মানুষ নষ্টমানুষ হয়ে যায়।

নষ্ট হবার একটা সীমা থাকে। সীমার নিচে নষ্টও হওয়া সম্ভব না। আপনি কী করে বললেন রকিব হত্যা মামলার আসামি?

আপনার চা কি শেষ হয়েছে?

জ্বি।

চলুন আমার সঙ্গে।

কোথায় যাব?

আপনি একটা ডেডবডি আইডেনটিফাই করবেন।

হাসান হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকাল। খাকি পোশাক পরা এই মানুষটা এইসব কী বলছে। সে ডেডবিডি আইডেনটিফাই করবে। কেন? কার ডেডবডি?

হাসান সাহেব!

জ্বি।

বস্তায় ভরে পুকুরে ফেলে দেয়া ডেডবডি। চেনার অবস্থা না পচেগলে গিয়েছে। নিকট আত্মীয়স্বজনরা মাথর চুল দেখে জামাকাপড় দেখে হয়তো আইডেনটিফাই করতে পারবেন। এই জন্যই আপনাকে আনা।

আপনার কী করে ধারণা হলো এটা আমার ভাইয়ের ডেডবডি?

আপনার ভাইয়ের একজন সহযোগীকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। তার স্বীকারোক্তি থেকে জেনেছি। সে বলছে রকিবকে ছুরি দিয়ে জবাই করা হয়–তারপর ডেডবিডি ইটসহ বস্তায় ভরে পানিতে ফেলে দেওয়া হয়।

হাসানের মনে হলো–খাকি পোশাক পরা এই মানুষটা আসলে মানুষ না, পিশাচ। এর হৃদয় বলে কিছু নেই। সে নির্বিকারভাবে কথাগুলো বলছে। তার মন বলে কিছু নেই? তার কি বাসায় ভাইবোন নেই? ছেলেমেয়ে নেই? সে কি স্ত্রীর সঙ্গে বসে টিভিতে নাটক দেখে না? ঘন বর্ষায় কি তার বাড়িতে খিচুড়ি ইলিশ মাছ রান্না হয় না?

হাসান সাহেব!

জ্বি।

নিন আরেকটা সিগারেট নিন।

জ্বি না সিগারেট নেব না।

তাহলে চলুন।

কোথায় যাব?

মেডিকেল কলেজে। ডেডবডি মেডিকেল কলেজের মৰ্গে রাখা হয়েছে। আপনি আইডেনটিফাই করার পর সুরতহাল হবে। যদিও সুরতহাল অর্থহীন। তবুও নিয়ম রক্ষার জন্যে করতে হবে।

আপনি যে ডেডবিডি আমাকে দেখাতে যাচ্ছেন সেটা আমার ভাইয়ের ডেডবডি না। আপনারা মস্তবড় ভুল করছেন।

ভুল হতেও পারে। ভুল হচ্ছে কি না তা জানার জন্যই আপনাকে নিয়ে যাওয়া।

লাশের পাশে একজন ডোম দাঁড়িয়ে। তার নাক গামছা দিয়ে বাঁধা। তার হাতে একটা লাঠি। সে লাঠি দিয়ে উল্টেপাল্টে দেখাচ্ছে।

ওসি সাহেব বললেন, দেখলেন!

হাসান জবাব দিল না।

দাঁতগুলো দেখুন। ওপরের প্রথম দাঁতটা ভাঙা। হাতের রিস্টওয়াচটা দেখুন।

হাসান বলল, এটা আমার ভাইয়ের ডেডবডি না।

ও আচ্ছা ঠিক আছে–চলুন যাই।

ঘর থেকে বের হয়েই হাসান বলল, আমার মাথা ঘুরছে শরীর কেমন যেন করছে। আমি বমি করব।

বারান্দায় গিয়ে বমি করুন। কোনো অসুবিধা নেই। আমি পানি এনে দিচ্ছি।

হাসান মুখ ভর্তি করে বমি করল। তার মনে হচ্ছে শরীরের ভেতরটা পুরোপুরি মুখ দিয়ে বের হয়ে যাবে। সে হয়ে যাবে উল্টো মানুষ। শরীরের বাইরের অংশ চলে যাবে ভেতরে। ভেতরের অংশ চলে আসবে বাইরে।

হাসান সাহেব।

জ্বি।

এখন কি একটু ভালো বোধ করছেন?

জ্বি।

নিন পানি দিয়ে মুখ ধোন। একটা পান খান।

আমি কি চলে যেতে পারি?

জ্বি পারেন। চলুন আমি আপনাকে একটা রিকশা করে দি। পুলিশের গাড়ি করে পাঠাতে পারতাম সেটা ঠিক হবে না। প্রতিবেশীরা নানান কথা বলতে পারে।

আপনাকে রিকশা করে দিতে হবে না। ধন্যবাদ।

ওসি সাহেব বললেন, কুৎসিত একটা দৃশ্য আপনাকে দেখিয়েছি— সামান্য ভদ্রতা আমাকে করতে দিন।

ওসি সাহেব!

জ্বি।

ডেডবডিটা আমার ছোট ভাইয়ের।

আমি জানি।

আমি কাউকে বলতে চাচ্ছি না। কাউকে না। বাবা-মা কাউকে না। তাতে কোনো অসুবিধা আছে?

অসুবিধা নেই।

সবাই জানবে একটা ছেলে ছিল, হারিয়ে গেছে। কত মানুষ তো হারিয়ে যায়।

তা যায়।

আমার ভাইয়ের কি জানাজা হবে? কবর হবে?

হ্যাঁ হবে। আপনি কাঁদবেন না।

ওসি সাহেব আপনার নামটা কি জানতে পারি?

কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে আমার নামও রকিব। হাসান সাহেব কাঁদবেন না প্লিজ। আর ভাই শুনুন–আই অ্যাম সরি।

জ্বরে হাসানের গা পুড়ে যাচ্ছে।

বাড়িতে কেউ নেই। তারেক গিয়েছে চিটাগাং। রীনা এসে টগর-পলাশকে নিয়ে গেছে। লায়লা তার শ্বশুরবাড়িতে। হাসানের মা তার বড় মেয়ের বাড়িতে। শুধু হাসানের বাবা আশরাফুজ্জামান সাহেব আছেন। তবে এই মুহুর্তে তিনি বাড়িতে নেই। চায়ের স্টলে বসে আছেন। গরম গরম জিলাপি ভাজা হচ্ছে। তিনি জিলাপি খাচ্ছেন। রসে তার মুখ মাখামাখি। এত ভালো জিলাপি তিনি অনেক দিন পর খাচ্ছেন। মাখনের মতো মোলায়েম হয়েছে। মুখে দেয়ামাত্র গলে যাচ্ছে।

কমলার মা গোঙানির শব্দ শুনে হাসানের দরজার সামানে এসে দাঁড়িয়েছে। সে ভীত গলায় ডাকল, ভাইজান?

হাসান চোখ মেলল। তার চোখ টকটকে লাল। হাসান ভারি গলায় বলল, কে?

কমলার মা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ভাইজান আমি।

হাসান আবারো বলল, কে?

ভাইজান আমি কমলার মা। আপনের কী হইছে ভাইজান?

মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে কমলার মা।

খুব বেশি?

হ্যাঁ খুব বেশি।

হাসান চোখ বন্ধ করে ফেলল। সে জেগে আছে অথচ সেই বিশ্ৰী স্বপ্নটা আবার শুরু হয়েছে। একদল হাঁস যাচ্ছে। সে হাঁটছে। হাঁসের সঙ্গে। হাঁসিরা শামুক গুগলি জাতীয় খাবার খাচ্ছে। ঝিনুকের খোল খুলতে তার কষ্ট হচ্ছে। একটা হাঁস তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। হাঁসটার চোখ মানুষের চোখের মতো বড় বড়।

জেগে থেকেই সে এই স্বপ্নটা দেখছে কেন? তার কি মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে? এই দুঃস্বপ্নের কথা সে তিতলী ছাড়া আর কাউকে বলে নি।

স্বপ্নের কথা শুনে তিতলী বলেছিল। খিচুড়ি দিয়ে ভূনা হাঁসের মাংস খেলে তোমার হাঁসের স্বপ্ন দেখার এই রোগ সেরে যাবে। শীতকাল আসুক আমি নিজে তোমাকে ভুনা হাঁসের মাংস খাওয়াব। তুমি কি জান আমি খুব ভালো রাধুনি?

না জানি না।

আমার অনেক কিছুই তুমি জান না। একেক করে জানবে। আর মুগ্ধ হবে। এই পৃথিবীতে মটরশুঁটি দিয়ে কই মাছের ঝোল আমার চেয়ে ভালো কেউ রাঁধতে পারে না। শীতকাল আসুক তোমাকে মটরশুঁটি আর কই মাছের ঝোল খাওয়াব।

আচ্ছা।

মাছের ঝোল রান্নার গোপন কৌশল কি তুমি জান?

জানি না।

জানতে চাও?

না।

জানতে না চাইলেও বলব। মাছের ঝোল রান্নার আসল কৌশল হলো–অনেকক্ষণ নাড়াতে নাড়তে হাত ব্যথা হয়ে যাবে। তবু চামচ নাড়ানো বন্ধ করবে না। বুঝেছ?

হুঁ।

শীতকাল আসতে কত দেরি? এখন কোন কাল? বর্ষা শেষ হয়ে গেছে না?

হাসান চোখ মেলল।

কমলার মা বলল, ভাইজান মাথাত পানি ঢালমু?

হাসান বলল, না।

যন্ত্রণা কি আরো বাড়ছে ভাইজান?

হুঁ।

মাথা বিষের বড়ি খাইবেন?

না। তুমি এখন যাও।

হাসান চোখ বন্ধ করছে না। চোখ বন্ধ করলেই হাঁসের পাল চলে আসবে। চুড়ির শব্দ হচ্ছে। কে এসেছে চুড়ি পরে? তিতলী না তো? হাসান জানে কেউ নেই তারপরেও বলল, কে তিতলী! আশ্চর্য ব্যাপার। মাথার ভেতরে তিতলী কথা বলে উঠল।

হুঁ।

কেমন আছ?

ভালো।

তোমাকে অনেক দিন থেকে মনে মনে খুঁজছি।

কেন?

ওই যে একটা গান করেছিলে বুড়িগঙ্গায় ওই গানের লাইনগুলো কী?

আমি তো গান করি নি।

তিতলী শোন!

শুনছি।

আমি খুব একটা অন্যায় করেছি। তোমাকে বলা হয় নি।

বল।

নাদিয়া এত ভালো রেজাল্ট করেছে, ওকে কনগ্রাচুলেশনস জানানো হয় নি। আমি ওর জন্যে একটা গিফট কিনে রেখেছিলাম। সেই গিফটটাও তাকে দেয়া হয় নি।

একদিন বাসায় গিয়ে ওকে দিয়ে এসো।

তুমি রাগ করবে না তো?

আমি রাগ করব কেন?

তিতলী!

বল শুনছি।

হাঁসের স্বপ্নটা আমি এখনো দেখি।

ও আচ্ছা।

স্বপ্নটা দেখার সময় মাথায় খুব যন্ত্রণা হয়।

ও আচ্ছা।

তিতলী আমার মনটা সারাক্ষণ খুব খারাপ থাকে।

ও আচ্ছা।

তুমি কি জান আমি এখানে, মাঝে মাঝে তোমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকি?

ও আচ্ছা।

কয়েকদিন আগে তোমাদের কলেজে গিয়েছিলাম। মনের ভুলে চলে গিয়েছি।

ও আচ্ছা।

এখন আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা হচ্ছে।

ও আচ্ছা।

আশরাফুজ্জামান বাড়িতে ফিরলেন রাত ন’টায়। তিনি ছেলেকে দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন। কী হয়েছে হাসানের? তিনি ভীত গলায় বললেন, তোর কী হয়েছে রে? তোর চোখ এত লাল কেন?

হাসান লাল চোখে তাকিয়ে রইল। জবাব দিল না।

চলবে।

মেঘ বলেছে যাব যাব পর্ব-১৯+২০+২১

0
মেঘ বলেছে যাব যাব হুমায়ূন আহমেদ

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (পর্ব :১৯)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

রীনা খুব শান্ত ভঙ্গিতেই তার সুটকেসে কাপড় ভরল

রীনা খুব শান্ত ভঙ্গিতেই তার সুটকেসে কাপড় ভরল। কয়েকটা ব্যবহারি শাড়ি, ব্লাউজ, পেটিকেট। ব্যাস এই তো। নয় বছরের বিবাহিত জীবনে নেই নেই করেও অনেক কিছু জমে গেছে। সবকিছু সঙ্গে নিয়ে যাওয়া অর্থহীন। পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। থাকুক তার স্মৃতি হিসেবে কিছু জিনিসপত্র। সঙ্গে করে সামান্য হলেও কিছু টাকা-পয়সা নেয়া দরকার। সেটা নিতে ইচ্ছে করছে না। ছোট মামার দেয়া সাত শ ডলারের কিছুই নেই। রীনা ভেবেছিল একটা টাকাও সে খরচ করবে না। সব জমা করে রাখবে। অথচ কত দ্রুতই না সেই টাকাটা খরচ হলো। তারেকের অফিসের কিছু দেনা শোধ করা ছাড়া টাকাটা আর কোনো কাজে লাগে নি। তার হাত আজ পুরোপুরি খালি।

বউ হিসেবে যখন সে বাবার বাড়ি থেকে আসে তখনো খালি হাতে এসেছিল। বাবা কয়েকবার বলেছিলেন, মেয়েটার হাতে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দাও। টুকটাক খরচ আছে। ফন্ট করে স্বামীর কাছে চাইতেও পারবে না লজ্জা লাগবে। বিয়েবাড়ির উত্তেজনায় শেষ পর্যন্ত তার হাতে টাকা দেয়ার ব্যাপারটা মনে রইল না। সে গাড়িতে উঠল। এক্কেবারে খালি হাতে। আজ বাড়ি থেকে বিদায় নেবার সময়ও খালি হাতে বিদায় নেয়া ভালো। যেভাবে এসেছি–সেভাবে যাচ্ছি। না তাও ঠিক না। সে স্বামীর কাছে এভাবে আসে নি। তার দরিদ্র বাবা ধারদেনা করে অনেক গয়নাপাতি দিয়েছিলেন। এই নিয়ে বাড়িতে অনেক অশান্তিও হয়েছে। রীনার মা ঝাঁঝালো গলায় বলেছিলেন–এত যে ঋণ করলে শোধ দিবে কীভাবে? টাকার গাছ পুঁতেছ? রীনার বাবা হাসিমুখে বলেছিলেন, মেয়েটা ঝলমলে গয়না পরে স্বামীর কাছে যাচ্ছে এই দৃশ্য দেখতেও অনেক আনন্দ। তোমার এই মেয়ে সুখের সাগরে ডুবে থাকবে।

সুখের সাগরে ডুবে থাকার এই হলো নমুনা। নয় বছর স্বামীর সঙ্গে থেকে আজ সব ফেলে দিয়ে চলে যেতে হচ্ছে।

রীনা তার গলার হারটা সঙ্গে নিল। বাবার দেয়া গয়না একে একে বিক্রি করে সংসারের ক্ষুধা মেটাতে হয়েছে। হারটা রয়ে গেছে। হার বিক্রি করে নগদ কিছু টাকা হাতে নিতে হবে। মানুষের সবচেয়ে বড় বন্ধু অর্থ! স্বার্থহীন বন্ধু। যে মানুষের চারদিকে শক্ত দেয়াল হয়ে মানুষকে রক্ষা করে। রানার সে রকম বন্ধু নেই। আশ্রয় দেবার মতো আত্মীয়স্বজনও নেই। সে যার কাছেই উঠবে সে-ই ব্যস্ত হয় উঠবে তাকে তাড়িয়ে দিতে। তাকে উঠতে হবে স্কুল জীবনের বান্ধবীর বাসায়। তারা তাকে তাড়িয়ে দেবে না। স্কুলজীবনের বন্ধুত্ব অন্যরকম ব্যাপার। এই বন্ধুত্ব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে। কখনো কমে না। রীনার সঙ্গে তার স্কুলজীবনের বন্ধুদের কোনো যোগ নেই। কে কোথায় আছে সে জানেও না। একজন থাকে বারিধারায়। সুস্মিতা। তার সঙ্গে নিউমার্কেটে হঠাৎ দেখা হয়েছিল। সুস্মিতা ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল। সুস্মিতা বাড়ির নম্বর, টেলিফোন নম্বর সব একটা কাগজে লিখে দিয়েছিল। কাগজটা অনেকদিন ছিল টেবিলের ড্রয়ারে। তারপর উড়ে চলে গেল। সুস্মিতার ঠিকানা জানা থাকলে কাজ হতো।

বিকালের মধ্যে রীনা সব গুছিয়ে ফেলল। বিকেলে বাচ্চারা খাবে তার জন্যে নুডলস। রাতের জন্য পোলাও। দুজনই খুব পোলাও পছন্দ করে। রোজ খেতে বসে বলবে, মা পিলাউ’। টগর সব শব্দ উচ্চারণ করতে পারে শুধু পোলাও বলতে গিয়ে বলে পিলাউ। পোলাও থাকলে তার আর কিছু লাগবে না। তরকারি না হলে চলবে। কপি কাপ করে ‘‘পিলাউ খাবে। সেই খাওয়া দেখার ভেতরও আনন্দ আছে। আজ রীনা এই আনন্দ পাবে না। টগর ‘‘পিলাউ খাবে একা একা। না, একা একা নিশ্চয়ই খাবে না–লায়লা থাকবে।

রীনা এক শ টাকার একটা নোট এবং কিছু ভাংটি টাকা সঙ্গে নিল। যেখানেই যাক রিকশা ভাড়া, বেবিট্যাক্সি ভাড়া তো দিতে হবে।

আলমিরা খুলে টগর এবং পলাশের জুতাজোড়া নিল। জন্মের এক মাস পর এলিফ্যান্ট রোডের এক দোকান থেকে রীনা নিজে এই দু জোড়া জুতা কিনেছিল। লাল ভেলেভেটের জুতা। এখনো ঝলমল করছে। জুতা জোড়া কেনার সময় সে বিস্মিত হয়ে ভাবছিল–জন্মের সময় মানুষের পা এতো ছোট থাকে? রীনার অনেক দিনের শখ টগর এবং পলাশের যেদিন বিয়ে হবে সেদিন কাচের বাক্সে জুতাজোড়া রেখে সেই বাক্সটা মায়ের বিয়ের উপহার হিসেবে সে দেবে। প্ৰতীকী উপহার। চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়া–দেখ একদিন তুমি এ রকম ছোট ছিলে-আজ বড় হয়েছ। তোমার সংসারে এ রকম ছোট একটা শিশু আসবে। চক্ৰ কোনোদিন ভাঙবে না। চলতেই থাকবে।

এই জীবনে রানার কোনো ইচ্ছাই পূর্ণ হয় নি। কে জানে এই ইচ্ছাটাও হয়তো পূর্ণ হবে না। টগর-পলাশের বিয়ে হয়ে যাবে সে খবরও পাবে না। রীনার চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল যেন চোখের পানি চোখেই শুকিয়ে যায়। বাড়ি ছেড়ে যাবার সময় চোখের পানি ফেলতে নেই। চোখের পানি বাড়ির জন্যে ভয়াবহ অমঙ্গল নিয়ে আসে। রীনা চায় না, এই বাড়ির অমঙ্গল হোক। এ বাড়িতে টগর ও পলাশ থাকে। হাসান থাকে, লায়লা থাকে। তার শ্বশুর-শাশুড়ি থাকেন। এদের সবাইকে রীনা অসম্ভব পছন্দ করে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, সবচে’ বেশি পছন্দ করে তার শাশুড়ি মনোয়ারাকে। কেন করে সে নিজেও জানে না।

সব গোছানোর পর রীনা মনোয়ারার ঘরে উঁকি দিল। যাবার আগে একটু দেখা করা। তাকে কিছু বলে যাওয়া যাবে না। সেটা সম্ভব না।

রীনা শাশুড়ির ঘরের দরজা ফাঁক করল। মনোয়ারা বললেন, বউমা তোমার শ্বশুর। কোথায় জান?

জানি না মা।

বারান্দায় গিয়ে উঁকি দাও–তোমার শ্বশুরকে দেখবে রাস্তার ওপাশে যে চায়ের স্টল আছে, বিসমিল্লাহ টি-স্টল, ওইখানে বসে আছে।

খবর দিয়ে আনব মা?

না খবর দিয়ে আনতে হবে না। কয়েকদিন ধরেই আমি ব্যাপারটা লক্ষ করছি। বুড়োর ভীমরতি হয়েছে। ঠিক এই সময় বুড়ো চায়ের স্টলে বসে থাকে কেন জানতে চাও?

কেন?

মেয়েস্কুল ছুটি হয়। মেয়েগুলো শরীর দোলাতে দোলাতে রাস্তা দিয়ে যায়। আর আমাদের বুড়ো এই দৃশ্য চোখ দিয়ে চাটে। বুঝলে কিছু?

রীনা চুপ করে রইল।

একটা বয়সের পর পুরুষ মানুষের এই রোগ হয়। চোখ দিয়ে চাটার রোগ। খুবই ভয়ঙ্কর রোগ। আল্লাহপাক এই বিষয়টা জানেন বলেই এই বয়সে চোখে ছানি ফেলে দেন। আমাদের বুড়োর চোেখ পরিষ্কার, ছানি পড়ে নি। তার খুব সুবিধা হয়েছে। রোজ বিকেলে চা খেতে যাচ্ছে। জীবনে তাকে চা খেতে দেখলাম না, এখন চা খাওয়ার ধুম পড়েছে। ভেবেছে আমি কিছু টের পাই নি। কোনো ভরা বয়সের মেয়ে ঘরে এলে বুড়ো কী করে লক্ষ করেছ? তার মা ডাকার ধুম পড়ে যায়। মা মা বলে আদরের ঘটা। মা ডাকলে মাথায় পিঠে, পাছায় হাত বোলানোর সুযোগ হয়ে যায়-। সুযোগ আমি বার করছি। আজ বাসায় ফিরুক। সাপের পা তো কেউ দেখে নাই। তোমার শ্বশুর আজ সাপের পা দেখবে, শিয়ালের শিং দেখবে।

মা আমি একটু বাইরে যাচ্ছি।

একা যাচ্ছ?

জ্বি।

একা যাবার দরকার নেই, বুড়ো শয়তানকে সাথে নিয়ে যাও। বুড়ো একদিনে অনেক মেয়ে দেখে ফেলেছে আর না দেখলেও চলবে। যাচ্ছে কোথায়?

আমার এক বান্ধবীর বাসায়।

শয়তানটাকে সাথে নিয়ে যাও। তুমি বন্ধুর বাসায় যেও। শয়তানটাকে রিকশায় বসিয়ে রাখবে। সে রিকশাওয়ালার সঙ্গে গল্প করবে। এটাই তার শান্তি। আর শোন মা তুমি দেরি করবে না। সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে ফিরবে। বাড়ির বউ সন্ধ্যার পর বাইরে থাকলে সংসারে অমঙ্গল হয়। বাড়ির বউকে দুটা সময়ে অবশ্যই ঘরে থাকতে হয়। সূৰ্য ওঠার সময় এবং সূর্য ডোবার সময়। এই কথাগুলো মনে রাখঘা মা। তোমার ছেলে দুটাকে যখন বিয়ে দিবে তখন তাদের বউদেরও বলবে।

জ্বি আচ্ছা।

রীনা শাশুড়ির ঘর থেকে বেরোল। টগর-পলাশ বারান্দার দেয়ালে মহানন্দে রঙ পেন্সিল দিয়ে ছবি আঁকছে। দেয়ালে ছবি আঁকা নিষিদ্ধ কর্ম। এই নিষিদ্ধ কর্মের জন্যে দু ভাই অতীতে অনেক শাস্তি পেয়েছে। আজ পেল না। রীনা তাদের সামনে এসে দাঁড়াল। দু। ভাই মাথা নিচু করে বসে আছে। ভয়ে কেউ মাথা তুলছে না। রীনার খুব শখ ছিল যাবার আগে ছেলে দুটির মুখ ভালোমতো দেখে যায়। সেটা বোধহয় সম্ভব হবে না। মাকে দেখে এরা দুজন মাথা আরো নিচু করে ফেলল। দেয়ালে দু মাথাওয়ালা একটা ভূত আঁকা রয়েছে। রীনা ভূতের দিকে তাকিয়ে আছে। রীনা নরম গলায় ডাকল, টগর। টগর মার গলায় বিপদের আভাস পেয়েছে। সে ছুটে দাদিমার ঘরে ডুকে গেল, মুহূর্তের মধ্যেই তাকে অনুসরণ করল পলাশ। মার হাত থেকে মুক্তির এই একটিই উপায়।

ভাবি শোন।

বারান্দায় লায়লা দাঁড়িয়ে আছে। তার গলার স্বর ভারি। মনে হয়। সে এতক্ষণ কাঁদছিল। চোখে কাজল লেপ্টে আছে।

কী ব্যাপার লায়লা?

তুমি একটু আমার ঘরে আস তো ভাবি।

রীনা লায়লার ঘরে ঢুকতেই লায়লা দরজা বন্ধ করে দিল। রীনা বলল, ব্যাপার কী বল তো?

লায়লা কান্না চাপতে চাপতে বলল, ভাবি তুমি বল আমি কি এতই ফেলনা? আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি?

ব্যাপারটা কী?

আমি জানি আমার চেহারা ভালো না। রং ময়লা–তাই বলে আমার জন্যে ডিভোর্সড ছেলে খুঁজতে হবে?

কে খুঁজছে ডিভোর্সড ছেলে?

বড়বুবু একটা ছেলের সন্ধান এনেছেন। ডিভোর্সড। আগের ঘরের একটা ছেলে আছে তিন বছর বয়স। আমার চেহারা খারাপ বলে আমার ভাগ্যে বুঝি সেকেন্ডহ্যান্ড হাসব্যান্ড।

বিয়ে তো এখনো হয়ে যায় নি লায়লা।

না হোক বড়বুবু কেন সেকেন্ডহ্যান্ড হাসবেন্ডের খোঁজ আনবে। ভাবি তুমি তো জান সেকেন্ডহ্যান্ড জিনিসই আমি দু চোখে দেখতে পারি না। নিউমার্কেটে কত সুন্দর সুন্দর সেকেন্ডহ্যান্ড সুয়েটার পাওয়া যায়। আমার বন্ধুরা সবাই কিনেছে। আমি কখনো কিনেছি?

লায়লা চুপ কর তো!

কেন আমি চুপ করব? ভাবি আমি কি মানুষ! আমাকে আগেভাগে কিছু না বলে মেয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমিও হাসিমুখে সেকেন্ডহ্যান্ডটার সাথে কথা বলেছি। গাধাটা আবার যাবার সময় বড়বুবুকে বলেছে মেয়ে পছন্দ হয়েছে। আরো গাধা তোর তো যেকোনো মেয়েই পছন্দ হবে।

লায়লা শোন এখানে তোমার পছন্দটাই জরুরি। তুমি তোমার পছন্দ-অপছন্দটা কড়া করে বলবে। তুমি যে জীবন যাপন করবে সেটা তো তোমার জীবন। অন্যের জীবন তো না।

লায়লাকে শান্ত করে রীনা বের হয়ে এল। ভাগ্য ভালো সুটকেস হাতে বেরোতে তাকে কেউ দেখল না।

রীনা রিকশায় উঠেছে। ঢাকায় তার থাকতে ইচ্ছে করছে না। ঢাকার বাইরে কোথাও চলে যেতে হবে। ময়মনসিংহ চলে গেলে কেমন হয়। রানার বড়মামা ময়মনসিংহ জজকোর্টের পেশকার। কেউটখালিতে বাসা। বাসে ময়মনসিংহ যেতে আড়াই ঘণ্টার মতো লাগে। সে পৌছবে সন্ধ্যার পর পর। তখন কেউটখালিতে গিয়ে বড়ামামাকে খুঁজে বের করতে হবে। বাসার ঠিকানা রীনার জানা নেই। যদি খুঁজে না পাওয়া যায়। যদি মামা এর মধ্যে বাসা বদল করে থাকেন? দুশ্চিন্তা হচ্ছে। রীনা দুশ্চিন্তাকে আমল দিল না। তার সমস্ত শরীর কেমন ঝিমঝিম করছে। মুখ শুকিয়ে পানির পিপাসা হচ্ছে। কোনো একটা দোকানের সামনে রিকশা দাঁড় করিয়ে সে কি এক বোতল পানি কিনে নেবে? কত দাম এক বোতল পানির?

রিকশাওয়ালা বলল, কই যাবেন?

রীনা বলল, কমলাপুর রেলস্টেশন।

বলেই মনে হলো সে ভুল করেছে। সে যাবে মহাখালি বাসস্টেশন। মহাখালি বাসস্টেশন থেকেই ময়মনসিংহের বাস ছাড়ে। শুধু শুধু কমলাপুর রেলস্টেশন বললে কেন? ভুলটাকে ঠিক করতে ইচ্ছা করছে না। যাক কমলাপুরেই যাক। ময়মনসিংহ যাবার কোনো একটা ট্রেন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। আর পাওয়া না গেলে একটা রাত রেলস্টশনে কাটিয়ে দেয়া তেমন কঠিন হবে না। স্টেশনে সারা রাত গাড়ি আসা-যাওয়া করবে। অসুবিধা কী? জনতার মধ্যে আছে নির্জনতা।

১৯ পর্ব শেষ 📌

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (পর্ব :২০)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

যে চেয়ারটায় হিশামুদিন বসতেন সেই চেয়ারে চিত্ৰলেখা বসে আছে। প্রথম দিন অস্বস্তি লেগেছিল–এরপর আর লাগে নি। এমন ব্যস্ততায় তার দিন কাটছে যে অস্বস্তি লাগার সময়ও ছিল না। ব্যস্ত মানুষদের অস্বস্তি বোধ করার সময় থাকে না। চিত্ৰলেখার দিন কাটছে বাবার কর্মপদ্ধতির মূল সূত্রগুলো ধরতে। তাকে কেউ সাহায্য করছে না। যাদের সাহায্য করার কথা তারা এক ধরনের নীরব অসহযোগিতা করছেন। অফিসের প্রধান প্রধান কর্তব্যক্তিরা এগিয়ে আসছেন না। তাদের প্রশ্ন করেও তেমন কিছু জানা যাচ্ছে না। এ রকম কেন হচ্ছে চিত্ৰলেখা বুঝতে পারছে না। তারা কি চান না। সব আগের মতো চলুক?

চিত্ৰলেখার সামনে তিন কর্মকর্তা বসে আছেন, জিএম আবেদ আলি, এজিএম ফতেহ খান এবং প্রোডাকশান ম্যানেজার নুরুল আবসার। তাদের চা দেয়া হয়েছে। তারা বিমর্ষমুখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছেন। আবেদ আলি পকেটে হাত দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট বের করলেন। চিত্ৰলেখা বলল, আপনি সিগারেট ধরাবেন না। সিগারেটের ধোঁয়া আমার পছন্দ না। বন্ধঘরে ধোঁয়া যেতে চায় না। অসহ্য লাগে।

আবেদ আলি সিগারেটের প্যাকেট সরিয়ে রাখলেন। তার মুখ আরো গভীর হয়ে গেল।

চিত্ৰলেখা বলল, আমি যদি কারো চাকরি টাৰ্মিনেট করতে চাই আমাকে কী করতে হবে বলুন তো?

আবেদ আলি কিছু বললেন না, ফতেহ খান বললেন, আপনি যা করবেন কোম্পানি আইন মোতাবেক করবেন। কোম্পানি আইনের বাইরে গিয়ে কিছু করার ক্ষমতা মালিকদের দেয়া হয় নি। মালিক চেয়েছেন বলে চাকরি নেই এই ব্যবস্থা এখন নেই।

প্রাইভেট কোম্পানিতে কোনো একটা ব্যবস্থা তো থাকতেই হবে। সেই ব্যবস্থাটা জানতে চাচ্ছি।

ফতেহ খান বললেন, আপনাকে ল’ইয়ারের পরামর্শ নিতে হবে। কোম্পানির নিজস্ব ল’ইয়ার আছে তার কাছে জেনে নিন।

আপনারা কিছু জানাবেন না?

আমরা তেমন জানি না।

আপনি জানেন না সেটা বলুন। আমরা বলছেন কেন? আবেদ আলি সাহেব হয়তো জানেন, নূরুল আবসার সাহেবও হয়তো জানেন। অন্যদের দায়িত্ব নেয়াটা কি ঠিক হচ্ছে?

নুরুল আবসার বললেন, মিস চিত্ৰলেখা আপনাকে একটা কথা বলি। দয়া করে কিছু মনে করবেন না, আপনি একসঙ্গে সবকিছু বুঝে ফেলতে চেষ্টা করছেন। আমাদের এই কোম্পানি অনেক বড় কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যারা জড়িত তারা দীর্ঘদিন থেকে জড়িত। বছরের পর বছর কাজ করে আমরা যা শিখেছি আপনি এক সপ্তাহে তা শিখে ফেলতে চান, তা কী করে হবে! ধীরে চলার একটা নীতি আছে সেই নীতি মেনে চলাই ভালো।

আমাকে ধীরে চলতে বলছেন?

অবশ্যই ধীরে চলতে বলছি।

আপনাদের ধারণা আমি ধীরে চলছি না?

আমাদের ধারণা। আপনি একসঙ্গে সব জেনে ফেলার জন্যে অস্থির হয়ে আছেন। ছটফট করছেন।

আপনিও বললেন–আমাদের ধারণা। আপনি বলুন আমার ধারণা। নাকি আপনাদের তিন জনের ধ্যান-ধারণা সব এক রকম।

আমরা সব একজিকিউটিভ ডিসিশান মেকিঙে থাকি। আমাদের ধ্যান-ধারণা এক রকম হওয়ারই তো কথা।

গত মাসে কোম্পানি প্ৰায় এক কোটি টাকা লোকসান করেছে। কেন করেছে আবেদ আলি সাহেব। আপনি বলুন?

এক কোটি টাকা না–সত্তর হাজার পাউন্ড। একটা বিশেষ খাতে লোকসান হয়েছে। সেই লোকসান আমরা সামলে উঠব। ব্যবসায় লাভ-লোকসান থাকে। বিজনেস হচ্ছে এক ধরনের গ্যামলিং।

লাভ-লোকসান ব্যবসায় থাকবে তাই বলে ব্যবসা গ্যামলিং হবে কেন? আমরা তো জুয়া খেলতে বসি নি।

আবেদ আলি ভুরু কুঁচকালেন। মনে মনে বললেন–ভালো যন্ত্রণায় পড়া গেল।

চিত্ৰলেখা বলল, আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাই নি–এত বড় একটা লোকসান হলো কেন?

যথাসময়ে এলসি খোলা হয় নি। তারপর আমাদের কিছু ক্রটি ছিল যার জন্যে পেনাল্টি দিতে হয়েছে।

কী ক্রটি?

ম্যাডাম বিষয়টা তো জটিল–চট করে বোঝাতে পারব না। সময় লাগবে।

সময় আপনাকে দিচ্ছি–আপনি বোঝাতে শুরু করুন। কাগজ-কলম লাগবে?

আবেদ আলি বললেন, মিস চিত্ৰলেখা, বসের কন্যাকে প্রাইভেট পড়ানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ছে না। তারপরও আমি আপনাকে বোঝাব। তবে এখন না। এখন আমাকে যেতে হবে। আমার জন্যে লোকজন অপেক্ষা করছে। আপনাকে আরো একটা কথা বলি মিস চিত্ৰলেখা, যখন-তখন আপনি মিটিং ডাকবেন না। এতে সবারই কাজের ক্ষতি হয়। মিটিং যখন ডাকবেন–এজেন্ডা ঠিক করে ডাকবেন। এজেন্ডা জানা থাকলে আমাদের তৈরি হয়ে আসতে সুবিধা হয়।

আবেদ আলি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। অনুমতির অপেক্ষা করলেন না। শুধু ফতেহ খান বললেন, ম্যাডাম তাহলে যাই? চিত্ৰলেখা বলল, আচ্ছা যান। তাকে সূক্ষ্মভাবে অপমান করা হলো তবে সে অপমান গায়ে মাখল না। সে বাবার চেয়ারে কিশোরী মেয়েদের মতো খানিকক্ষণ দোল খেল। তারপরই চাবি দিয়ে ড্রয়ার খুলল।

কিছু মজার মজার ফাইল এই ড্রয়ারে আছে। ফাইলগুলো বাড়িতে ছিল সে নিয়ে এসেছে। প্রতিদিনই সে খুব মন দিয়ে পড়ে। হিশামুদ্দিন সাহেব তার অফিসের প্রতিটা কর্মচারী সম্পর্কে আলাদা আলাদা নোট রেখে গেছেন। পড়তে পড়তে চিত্ৰলেখার প্রায় মনে হয়-বাবা যেন জানতেন একদিন চিত্ৰলেখা এই ফাইল পড়বে। পড়ে পড়ে সিদ্ধান্ত নেবে।

ফাইল তৈরি করা ছাড়াও হিশামুদ্দিন সাহেব আরো একটা কাজ করে গেছেন। কোম্পানি পরিচালনা সম্পর্কে দীর্ঘ নির্দেশ দিয়ে গেছেন। চিঠির মতো করে লেখা এই নির্দেশনামা চিত্ৰলেখা বলতে গেলে প্ৰতিদিনই একবার করে পড়ছে।

মা চিত্ৰলেখা,
তোমার মাথায় বিরাট দায়িত্ব এসে পড়েছে। তোমার কি মনে হচ্ছে তোমার মাথায় তিন মণ ওজনের পাথর চেপে বসেছে? তুমি নিঃশ্বাস নিতে পারছ না?
যদি এ রকম মনে হয় তুমি পাথর ছুড়ে ফেলে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে। আমি একটি কর্মকাণ্ড শুরু করেছি। আমার মৃত্যুর পরেও তা চলতে থাকবে এ জাতীয় চিন্তাভাবনা আমার কোনো কালেই ছিল না। এই পৃথিবীতে সবকিছুই সাময়িক।
অবশ্য পুরো ব্যাপারটা তুমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে দেখতে পার। আমার ধারণা তোমার সেই যোগ্যতা আছে। যদি তুমি চ্যালেঞ্জ হিসেবে নাও তাহলে তোমাকে আমার কিছু উপদেশ দেবার ইচ্ছা।
পুরনো কালে পৃথিবীজুড়ে যুদ্ধবিগ্ৰহ চলত। দু দল যুদ্ধ করছে। সেনাপতিরা যুদ্ধ পরিচালনা করছেন। এই সময় হঠাৎ যদি কোনো কারণে কোনো একদলে সেনাপতি নিহত হয় তখন সেই দল সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়। সৈন্যরা মনোবল হারিয়ে ফেলে। অস্ত্র ফেলে দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করে। এই ব্যাপারটা এখনো আছে৷ এখনো সেনাপতির মৃত্যু মানে যুদ্ধে পরাজয়। সৈন্যরা এখনো যুদ্ধ করে তাদের নিজেদের জন্যে না–যুদ্ধ করে তাদের সেনাপতির জন্যে।
সেনাপতিকে সৈন্যদের আস্থা অর্জন করতে হবে। এই কাজটা সবচে’ কঠিন। তুমি তা পারবে। ভালোভাবেই পারবে।
কোম্পানি পরিচালনা শুরুতে তোমার কাছে জটিল মনে হবে–কাজটা কিন্তু জটিল নয়। ঘোড়ার পিঠে চড়া এবং ঘোড়াটাকে দৌড়ানো শুরু করাটা জটিল, কিন্তু একবার যখন ঘোড়া দৌড়াতে শুরু করে তখন জটিলতা কিছু থাকে না। শুধু দেখতে হয়–পথ ঠিক আছে কি না। পথে কোনো খান্দা-খন্দ পড়ল কি না। অবশ্য আরেকটা জিনিস দেখতে হয় তোমার শেষ সীমাটা কোথায়? গোলটী কী?
তুমি অবশ্যই কোমল হবে। সেই কোমলতার সঙ্গে সঙ্গে এক ধরনের নির্মমতাও তোমার মধ্যে থাকতে হবে। যেখানে নির্মম হওয়া দরকার সেখানে কখনো কোমল হবার চেষ্টা করবে না। দয়া, করুণা এইসব মানবিক গুণাবলি কোম্পানি পরিচালনার কাজে আসে না বরং কাজ শ্লথ করে দেয়। মনে কর কেউ একটা অন্যায়। করল, কিংবা কারো কোনো কাজে কোম্পানি ক্ষতিগ্ৰস্ত হলো। তুমি যদি তার শাস্তি না দাও। তাহলে এই অন্যায়টি সে আবারো করবে। সে ধরে নেবে যে সে ক্ষমা পেয়ে যাবে। শুধু সে না। অন্যরাও তাই ভাববে। You have to be cruel, only to be kind. কাজের পুরষ্কার যেমন থাকবে তেমনি অন্যায়ের শাস্তিও থাকবে।
ক্ষমা অত্যন্ত মহৎ গুণ। কোম্পানি পরিচালনায় ক্ষমা একটা বড় ত্রুটি।
কোম্পানির কার্যপ্ৰণালীর প্রতিটি খুঁটিনাটি তোমাকে জানতে হবে। উদাহরণ দিয়ে বলি:–কোম্পানির অতি তুচ্ছ কাজ যে কজন করে তাদের একজন হলো রশীদ। রশীদ হলো সাইকেল পিয়ন। তার একটা সাইকেল আছে। হাতে হাতে চিঠি পাঠাতে হলে চিঠি এবং ঠিকানা দিয়ে রশীদকে বললেই সে চলে যাবে। তুমি কি জান রশীদ তার এই কাজ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে করে। তাকে তুমি ঠিকানা লিখে চিঠি দেবে এবং তা সে পৌঁছাবে না। এটা কখনো হবে না।
একবার কী হয়েছে শোনা –সে একটী চিঠি নিয়ে গেল। যার চিঠি সে বাসায় ছিল না। রশীদ বাসার সামনে রাত তিনটা পর্যন্ত বসে রইল। কোম্পানি ঠিকমতো তখনই চলবে যখন যার যা কাজ তা ঠিকমতো করা হবে।
তোমাকে দায়িত্ব গ্ৰহণ করার পর একটি অপ্রিয় কাজ করতে হবে–কাজটা হচ্ছে জেনারেল ম্যানেজার পদে নতুন কাউকে আনা। অবশ্যই তোমাকে আবেদ আলিকে অপসারণ করতে হবে। কাজটা আমিই করে যেতাম। তোমার জন্যে রেখে গোলাম। আবেদ আলি অত্যন্ত কর্মঠ। সে নিজের কাজ খুব ভালো জানে। তার সমস্যা হলো সে নিজেকে এখন অপরিহার্য বিবেচনা করছে। যখন এই কাজটা কেউ করে তখন নানান সমস্যা হতে থাকে। সে নিজের স্বার্থটিকে প্ৰাধান্য দেয়। কাজকর্মেও হেলাফেলা ভাব চলে আসে। সে তার প্রতি অনুগত একটা শ্রেণীও তৈরি করে নেয়। আবেদ আলি তাই করেছে।
আবেদ আলির চাকরির টার্মিনেশন লেটার আমি তৈরি করে রেখেছি। আইনগত কিছু জটিলতা আছে বলেই তৈরি করে যাওয়া। তুমি যদি কোম্পানির দায়িত্ব নাও তাহলে এই টার্মিনেশন লেটার সই করে তুমি তাকে দেবে। আর তুমি যদি দায়িত্ব না নাও তাহলে যেমন আছে তেমনি থাকবে। তোমার অনুপস্থিতিতে তার প্রয়োজন আছে…

চিত্ৰলেখা আবেদ আলির চাকরির টাৰ্মিনেশন লেটারে নিজের নাম সই করল। তারিখ বসাল। ইন্টারকমে বলে দিল–সাইকেল পিয়ন রশীদকে যেন পাঠানো হয়।

রশীদ এসে দাঁড়াল মাথা নিচু করে। বেঁটেখাটো মানুষ। মালিক শ্রেণীর কারো দিকে চোখ তুলে তাকানো বোধহয় তার অভ্যাস নেই। সে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে।

কেমন আছ রশীদ?

ভালো।

এই ঠিকানায় একটা চিঠি দিয়ে এসো।

জ্বি আচ্ছা।

তোমার সাইকেলটি ঠিক আছে?

বেল নষ্ট।

বেল ঠিক করার ব্যবস্থা কর।

কোযারটেকার স্যারকে বলেছিলাম।

উনি ব্যবস্থা করেন নি?

রশীদ চুপ করে রইল। সে কখনো তার ওপরওয়ালাদের বিষয়ে কোনো নালিশ করে না।

আচ্ছা আমি বলে দেব।

আমি চলে যাব? চিঠি দিয়ে এসে আপনাকে রিপোর্ট করব?

দরকার নেই। তুমি যাও। চিত্ৰলেখা কেয়ারটেকারকে ডেকে পাঠাল। কেয়ারটেকারের নাম সালাম। সে

ভীতমুখে সামনে এসে দাঁড়াল।

কেমন আছেন সালাম সাহেব?

জ্বি, আপা ভালো। কাজকর্মে মন বসছে না আপা।

মন বসছে না কেন?

স্যার নাই। কী কাজ করব কার জন্য করব?

আমার জন্যে করবেন।

তা তো অবশ্যই। . আমাদের যে সাইকেল পিয়ন রশীদ তার সাইকেলের বেল নষ্ট। বেল ঠিক হচ্ছে না কেন?

আমাকে তো আপা সে কিছু বলে নাই।

সে বলেছে। যেহেতু আপনার কাজকর্মে মন নাই আপনি শুনতে পান নি। বাবার মৃত্যুতে আপনি এতই ব্যথিত যে, কোনো কিছুই আপনি এখন মন দিয়ে শুনছেন না। আচ্ছা। আপনি যান–আমাদের জিএম সাহেবকে একটু আসতে বলে দিন।

জ্বি আচ্ছা। চিত্ৰলেখা ঘড়ি দেখল। তিনটা বাজে। অফিস আরো এক ঘণ্টা চলবে। সে অফিস থেকে ঠিক চারটায় বের হবে। আজ তার পরিকল্পনা হলো রাস্তায় খানিকক্ষণ হাঁটা।

আবেদ আলি বিরক্তমুখে ঢুকলেন।

আমাকে ডেকেছেন?

চিত্ৰলেখা বলল, আবেদ আলি সাহেব বসুন।

মিটিঙের মাঝখান থেকে উঠে এসেছি।

কীসের মিটিং?

এলসি খোলার দেরি এবং ইরেগুলারিটি বিষয়ে একটা তদন্তের ব্যবস্থা করছি।

ও আচ্ছা।

কী জন্যে ডেকেছিলেন?

একটা অপ্রিয় প্রসঙ্গের জন্যে ডেকেছি। দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন, তারপর বলছি।

আবেদ আলি বসলেন। তার ভুরু কুঞ্চিত। চিত্ৰলেখা খুব সহজ এবং স্বাভাবিক গলায় বলল, কোম্পানির বৃহত্তর স্বার্থে আমাকে একটি অপ্রিয় কাজ করতে হচ্ছে। আপনার সার্ভিস আমাদের আর প্রয়োজন নেই। আমাদের কাছে মনে হচ্ছেকোম্পানির স্বাৰ্থ আপনি এখন আর আগের মতো দেখছেন না। সত্তর হাজার পাউন্ডের যে ক্ষতি আমাদের হয়েছে—তার দায়-দায়িত্বও সম্পূর্ণ আপনার।

কী বলছেন?

যা সত্যি তা বলছি।

আমাকে ছাড়া আপনি তো সাত দিনও চলতে পারবেন না। আপনি তো সামান্য মানুষ আপনার বাবারও আমি ডানহাত ছিলাম।

আমার বাবা যেহেতু নেই; আমার বাবার ডানহাতেরও প্রয়োজন নেই তাই না? নিন এটা হচ্ছে আপনার জব টামিনেশন লেটার। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার কী জানেন, এই চিঠি বাবাই লিখে টাইপ করে রেখে গেছেন। আমি শুধু নাম সই করেছি। কিছু কিছু মানুষ মৃত্যুর পরেও তাদের উপস্থিতির ব্যবস্থা রেখে যায়।

আবেদ আলি চিঠি পড়ছেন। তার হাত কাঁপছে। ব্যাপারটা তার কাছে খুবই অপ্ৰত্যাশিত।

আবেদ আলি সাহেব!

জ্বি।

আপনার দায়িত্ব আপনি এজিএম সাহেবকে বুঝিয়ে দেবেন।

ম্যাডাম ব্যাপারটা কি আরেকবার কনসিন্ডার করা যায় না?

জ্বি না, যায় না। পাশার দান ফেলা হয়ে গেছে। আপনি এখন আসুন।

আপনি বিরাট সমস্যায় পড়বেন। হাতেপায়ে ধরে আবার আমাকেই আপনার আনতে হবে।

আনতে হলে আনব। এই মুহুর্তে আপনাকে আমাদের দরকার নেই।

চিত্ৰলেখা আরেক কাপ চায়ের কথা বলল। অফিসে বসার পর থেকে তার খুব ঘনঘন চা খাওয়া হচ্ছে। অভ্যাসটা কমাতে হবে। মাথা ধরেছে। মাথাধরা কমানোর একটা ব্যবস্থা করা দরকার। ওষুধ খেতে ইচ্ছা করছে না। খোলা বাতাসে বসা দরকার। এসি দেয়া বদ্ধঘরে এক সময় দম আটকে আসে। চিত্ৰলেখা এসি বন্ধ করল। জানালার পরদা সরাল। জানালা খুলল। দিনের আলো নিভে আসছে। আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। মেঘ বলেছে যাব যাব? মেঘেরা কোথায় যেতে চায়? হিমালয়ের দিকে না। অন্য কোথাও? মানুষের পাখা থাকলে ভালো হতো। মেঘদের সঙ্গে উড়ে বেড়াত। মেঘদের সঙ্গে বাস করলেই জানা যাবে মেঘেরা কোথায় যেতে চায়।

আসব?

চিত্ৰলেখা জানালা থেকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, আসুন। রশীদ তাহলে আপনাকে খুঁজে পেয়েছে। বসুন।

হাসান বসল। সে হিশামুদ্দিন সাহেবের এই বিশাল অফিসে এই প্রথম এসেছে। তার চোখে বিস্ময়।

চা খাবেন?

জ্বি না।

খেয়ে দেখতে পারেন। এরা চা খুব ভালো বানায়। দার্জিলিঙের চা পাতা এবং বাংলাদেশের চা পাতা সমান সমান নিয়ে একটা মিকচার তৈরি হয়। সেই মিকচার দিয়ে চা বানানো হয়।

তাহলে দিতে বলুন।

আপনাকে ডেকেছি। কী জন্যে জানেন?

জ্বি না।

আপনাকে ডেকেছি। কারণ আজ বিকেলে আপনাকে নিয়ে ঘুরব। গাড়িতে করে না।—হণ্টন।

বৃষ্টি আসছে তো!

আসুক। আমার একটা রেইনকোট আছে–আপনার জন্যে ছাতা আনিয়ে দিচ্ছি। বৃষ্টির সময় রেইনকোট পরে হাঁটা আমার খুব পুরনো অভ্যাস। নোট করছেন তো?

হাসান বিস্মিত হয়ে বলল, কী নোট করব?

কথাবার্তা যা বলছি। এইসব–এই যে একটু আগে বললাম, আমার পুরনো অভ্যাস হচ্ছে বৃষ্টিতে রেইনকোট পরে হাঁটা। আমি তো আগে একবার আপনাকে বলেছিবাবার মতো আমিও আপনাকে ঘণ্টা হিসেবে পে করব। কাজেই আপনি যত বেশি সময় আমার সঙ্গে কাটাবেন ততই আপনার লাভ।

হাসান তাকিয়ে আছে। চিত্ৰলেখাকে কেমন যেন অস্থির লাগছে।

হাসান সাহেব!

জ্বি।

অকারণে আপনাকে ডেকে আনায় আপনি কি বিরক্ত হয়েছেন?

জ্বি না।

বিরক্ত হলেও কিছু করার নেই। আমি মাঝে মাঝে খুব নিঃসঙ্গ বোধ করি। মনে হয় দম বন্ধ হয়ে মরে যাব।

আপনার এরকম অবস্থা যখনই হবে খবর দেবেন–আমি চলে আসব।

বৃষ্টি মনে হয় আসছে—তাই না?

জ্বি।

চিত্ৰলেখা মুগ্ধ হয়ে বৃষ্টি দেখছে।

২০ পর্ব শেষ 📌

🔴মেঘ বলেছে যাব যাব (পর্ব :২১)🔴
– হুমায়ূন আহমেদ

তারেক মাগরেবের নামায শেষ করে

তারেক মাগরেবের নামায শেষ করে বারান্দায় এসে বলল, লায়লা আমাকে চা দে।

চা তৈরিই ছিল। লায়লা চায়ের কাপ এনে সামনে রাখল। তারেক চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, তোর অবস্থা কী?

লায়লা বিস্মিত গলায় বলল, আমার আবার কী অবস্থা?

পড়াশোনার অবস্থা।

পড়াশোনার অবস্থা খুবই খারাপ। এইবার পরীক্ষা দিলে পাস করতে পারব না।

তাহলে এ বছর ড্রপ দিয়ে পরের বছর দে।

ভাইয়া আর কিছু বলবে?

না। সিগারেটের প্যাকেট আর দেয়াশলাই এনে দে।

লায়লা সিগারেটের প্যাকেট এবং দেয়াশলাই এনে দিল। তারেক বলল, টগর আর পলাশকে বই নিয়ে বসতে বল। আমি পড়া দেখিয়ে দেব।

তারেক চুকচুক করে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। নামাযের সময় সে মাথায় টুপি পরেছিল, সেই টুপি এখনো খোলা হয় নি। টুপি মাথায় তাকে শান্ত সমাহিত মনে হচ্ছে। চা খেতে খেতে সে পা নাচাচ্ছে। মনে হচ্ছে সন্ধ্যাকালীন এই চায়ের আসর তার ভালো লাগছে।

একমাসের ওপর হলো রীনা নেই। তার অনুপস্থিতিতে বড় ধরনের যে সমস্যার আশঙ্কা করা গিয়েছিল এখন মনে হচ্ছে সে আশঙ্কা অমূলক। সে না থাকায় বরং কিছু সুবিধা হয়েছে। তারেক ঘুমাচ্ছে একা। বেশ হাতপা ছড়িয়ে ঘুমাতে পারছে। রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে সিগারেট খেতে পারছে। কথা বলার কেউ নেই। টুথপেস্টের মুখ লাগানো হয় নি, ব্রাশটা বেসিনে পড়ে আছে কেন এই নিয়েও বলার কেউ নেই। রীনা মশারি না খাটিয়ে ঘুমাতে পারত না। তারেকের কাছে মশারি ছিল অসহনীয় যন্ত্রণা। এখন মশারি খাটাতে হচ্ছে না। ফুলম্পিডে ফ্যান ছেড়ে শুয়ে থাকলে মশার কাছে ভিড়তে পারে না। মানুষের কাছে ফ্যানের বাতাসটা আরামদায়ক। মশাদের কাছে সেই বাতাস হলো টর্নেডো; প্রচণ্ড টর্নেডোর সময় মানুষ যেমন ডিনার খেতে বসে না, মশারাও তেমনি রক্ত খেতে আসে না। এই সহজ সূত্র সে রীনাকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করেছে–রীনা বুঝতে চায় নি। এখন আর বোঝাবুঝির কিছু নেই।

মনোয়ারা ছেলের ওপর রাগ করে চলে গেছেন। এটা একটা দুঃখের ব্যাপার হয়েছে। তারেক তার মাকে খুবই পছন্দ করে। মার সঙ্গে মাঝে মধ্যে কথা না বললে তার দমবন্ধ লাগে। মা না থাকার একটা ভালো দিকও আছে। মার ঘরটিকে তারেক বর্তমানে নামাযঘর করে ফেলেছে। পাঁচ ওয়াক্তের জায়গায় এখন শুধু দু ওয়াক্ত করে ‘ নামায পড়া হচ্ছে। শুরু হিসেবে এটা খারাপ না।

রানার অভাব লায়লা অনেকটা পূরণ করেছে। রান্নাবান্নার ব্যাপারটা দেখছে। টগরপলাশকে স্কুলে নিয়ে যাওয়া এবং নিয়ে আসার কাজও করছে। কলেজে যাচ্ছে খুব কম। মনে হয় এ বছর বি.এ. পরীক্ষা সে ড্রপই করবে। সংসারের জন্যে এটা ভালো। বি.এ. পরীক্ষার চেয়ে সংসার অনেক বড়।

টগর-পলাশের ব্যাপারটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। মা নেই কেন? কিবে আসবে?’ এ জাতীয় কথা তারা তারেককে এখনো জিজ্ঞেস করে নি। তবে লায়লাকে এবং হাসানকে নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করছে। তারা কী জবাব দিচ্ছে কে জানে। সময় এবং সুযোগমতো একবার জিজ্ঞেস করতে হবে। অবশ্যি জিজ্ঞেস না করলেও হয়। এরা ঝামেলা করছে না। এটাই বড় কথা। এমন কি হতে পারে মা ঘরে না থাকায় তারা আনন্দিত? হতে পারে। খাওয়া নিয়ে তাদের বকাঝকা কেউ করছে না, চড় থাপ্নড় মারছে না। দেয়ালে ছবি আঁকছে। কেউ কিছু বলছে না। প্রায়ই স্কুল কামাই করছে। মা থাকলে সে উপায় ছিল না। স্কুলে যেতেই হতো।

তারেকের আজকাল প্রায়ই মনে হয় মানুষের সংসার না থাকাই ভালো। আর থাকলেও সে সংসার হবে সাময়িক ধরনের সংসার। সেই সংসারে স্ত্রী পুত্ৰ কন্যা সবই থাকবে। মাঝে মাঝে সেখানে বেড়াতে যাওয়া, কয়েকদিন থেকে চলে আসা। সব পুরুষরা থাকবে হোটেলে। সবার জন্যে আলাদা আলাদা ঘর। ঘরে এটাচড বাথ থাকবে, টিভি থাকবে। খাবারের সময় হোটেল থেকে খাবার দিয়ে যাবে। ছেলের জন্মদিন, ম্যারেজ অ্যানিভার্সিরি এইসব উৎসবে সংসারে ফিরে যাওয়া! আবার ফিরে আসা।

রীনা চলে যাবার পর লাবণীর সঙ্গে তারেকের আর তেমন যোগাযোগ হয় নি। লাবণী একটা চিঠি লিখেছিল। কেমন আছেন, ভালো আছেন টাইপ চিঠি। চিঠির জবাব দেয়া হয় নি। তারেক রোজই একবার ভাবে চিঠির জবাব দেবে–শেষে আর দেয়া হয় না। রাতে ঘুম পেয়ে যায়। ইদানীং তার ঘুমাও খুব বেড়েছে। ভাত খাবার পর থেকে হাই উঠতে থাকে।

দুই পুত্রকে নিয়ে তারেক পড়াতে বসল। বাচ্চা দুটি বিছু হয়েছে। যমজ বাচ্চারা বিষ্ণু ধরনের হয় এটি সনাতন সিদ্ধ ব্যাপার। এরা দুজন যমজ না হলেও বিক্ষুর ওপরেও এক ডিগ্রি বিষ্ণু। হোমওয়ার্কের খাতায় ভূতের ছবি আঁকা। মাথা থেকে এইসব দুষ্টামি দূর করতে হবে। কঠিন হওয়া যাবে না। কাঠিন্য যে-কোনো সমস্যার বড় বাধা।

কেমন আছিস রে টগর?

গুড আছি বাবা।

পড়াশোনা কেমন হচ্ছে?

গুড হচ্ছে।

কথায় কথায় গুড বলছিস কেন?

মিস বলেছে বাসায় সব সময় ইংরেজি বলতে হবে।

হোমওয়ার্কের খাতায় এটা কীসের ছবি?

ভূতের ছবি। ভূতের গলা এত লম্বা থাকে নাকি?

এটা সাপভূত তো এজন্যে গলা লম্বা। সাপভূতদের গলা লম্বা হয়।

হোমওয়ার্কের খাতায় ছবি আঁকছিস কেন?

ছবি আঁকার খাতা শেষ হয়ে গেছে এই জন্যে।

মিস রোগ করবে।

মিস খুব এংরি হবে। রাগের ইংরেজি হলো এংরি।

এংরি বানান কী?

বানান জানি না।

পলাশ তুই জানিস?

জানি না।

গুড বানান জানিস?

জানি, কিন্তু বলব না।

বলবি না কেন?

তুমি তো আমাদের মিস না। মিস বানান জিজ্ঞেস করলে বলতে হয়।

আর কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হয় না?

না।

তারেক সিগারেট ধরাল। এদের পড়াশোনা করানো মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার। একজন টিচার রেখে দিতে হবে। বাড়তি খরচ, তাতে অসুবিধা হবে না। সংসারে মানুষ কমে গেছে। লায়লার বিয়ে হলে আরো কমবে। তার বেতনও কিছু বাড়বে। খুব শিগগিরই প্রমোশন হবার কথা। পলাশ বলল, বাবা সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়।

কে বলেছে, মিস?

না, মা বলেছে।

মার প্রসঙ্গ চলে আসায় তারেক একটু শঙ্কিত বোধ করল। এই প্রসঙ্গ আলোচনায় না আসাই বোধহয় মঙ্গলজনক। টগর গম্ভীর গলায় বলল, যে সিগারেট খায় সে মারা যায়। আর সিগারেট খাবার সময় আশেপাশে যারা থাকে তারাও মারা যায়। তুমি সিগারেট খেলে আমরা মারা যাব।

কে বলেছে, তোদের মা না মিস?

মা বলেছে। সিগারেট যেমন খারাপ, চকলেটও খারাপ। চকলেট খেলে দাঁত নষ্ট হয়ে যায়। এক রকম পোকা এসে দাঁত খেয়ে ফেলে। দাঁতের ইংরেজি হলো টুথ।

তারেক সিগারেট ফেলে দিল। মার প্রসঙ্গ চলে এসেছে–এখন কি সেই বিষয়ে দুএকটা কথা বলা ঠিক হবে? না পুরো বিষয়টা নিয়ে চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে?

টুথের বানান কী?

ট-উ-কারে টু, থ—টুথ।

বাংলা বানান না। ইংরেজি?

জানি তোমাকে বলব না।

তারেক ইতস্তত করে বলল, তোর মা যে আসছে না। এ নিয়ে কী করা যায় বল তো?

টগর-পলাশ দুজনই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তারেক বাচ্চাদের দিকে না। তাকিয়ে বলল, তোর মা যে আসছে না, এ জন্যে নিশ্চয়ই তোদের মন খারাপ। তার সঙ্গে দেখা হচ্ছে না।

পলাশ বলল, দেখা হয় তো।

পলাশের এই কথা বলা মনে হয় ঠিক হয় নি। টগর চোখের ইশারায় তাকে চুপ করতে বলেছে। তারেক বিস্মিত হয়ে দুই ছেলের দিকে তাকিয়ে আছে।

মা’র সঙ্গে দেখা হয়?

হুঁ।

বাসায় আসে নাকি?

না। স্কুলে যায়।

স্কুলে যায়?

একদিন মা তার বাসায় নিয়ে গেল।

বাসায় নিয়ে গেল মানে–বাসা ভাড়া করেছে? বাসা কোথায়?

জানি না।

বাসাটা কেমন?

সুন্দর।

সে একাই থাকে না। আরো লোকজন থাকে?

জানি না।

জানিস না মানে কী? বাসায় আর কাউকে দেখিস নি?

উঁহুঁ।

তোদের মা যে তোদের দেখতে আসে, তোরা যে তার বাসায় গিয়েছিলি এটা এ বাড়ির আর কে জানে?

সবাই জানে। শুধু তুমি জান না।

মার বাসায় কীভাবে গিয়েছিল–সে এসে নিয়ে গিয়েছিল?

চাচু নিয়ে গিয়েছে। আবার নিয়ে এসেছে।

হাসান নিয়ে গেছে?

হুঁ।

তারেক অ্যাশট্রেতে ফেলে দেয়া আধা-খাওয়া সিগারেট তুলে নিল। তার দুই পুত্ৰ তার দিকে তাকিয়ে আছে। টগর বলল, ব্যাটম্যান মানে কী, তুমি জানি বাবা?

তারেক অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, না।

ব্যাটম্যান মানে হলো বাদুরমানুষ। ব্যাট মানে বাদুর। ম্যান মানে মানুষ।

ও।

বাদুরমানুষ কিন্তু উড়তে পারে না। শুধু লাফ দিতে পারে। একটা বাড়ির ছাদ থেকে আরেকটা বাড়ির ছাদে যায়। আর ঘোস্ট মানে কী জান?

হুঁ।

ঘোস্ট মানে ভূত। ভূত কিন্তু পৃথিবীতে হয় না। শুধু কার্টুনে হয়। আমাদের মিস বলেছে। অদৃশ্য মানব কাকে বলে তুমি কি জান বাবা?

না।

অদৃশ্য মানবকে চোখে দেখা যায় না। অদৃশ মানব কিন্তু ভূত না। মানুষ।

হুঁ।

অদৃশ মানব চোখে দেখা যায় না, এই জন্যে এদের ছবিও আঁকা যায় না। কিন্তু পলাশ তো বোকা–এই জন্যে সে অদৃশ্য মানবের ছবি এঁকেছে। ছবি দেখবে বাবা?

তারেক ‘হুঁ’ বলল। কিন্তু উঠে চলে গেল। ব্যাপারটা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না-সবাই মিলে কি তাকে বয়কট করেছে? হাসানের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে কথা বলা দরকার; হাসানের সঙ্গে তার দেখা ইদানীং হচ্ছে না। হাসানের ব্যস্ততা খুব বেড়েছে। কোনো একটা কাজটাজ বোধহয় করছে। কী কাজ তা এখনো জিজ্ঞেস করা হয় নি। যে কাজই করুক খুব পরিশ্রমের কাজ নিশ্চয়ই। রোদে পুড়ে চেহারা নষ্ট হয়ে গেছে। সস্তা সিগারেটও মনে হয় প্রচুর খাচ্ছে। হাসান পাশ দিয়ে গেলে মনে হয় তামাকের একটা ফ্যাক্টরি হেঁটে চলে গেল। জর্দা দিয়ে পানও খাচ্ছে–দাঁত লাল–মুখ দিয়ে ভুরিভুরে জর্দার গন্ধ আসে।

হাসান দরজা বন্ধ করে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়েছিল। তারেক ধাক্কা দিতেই উঠে এসে দরজা খুলল।

ঘুমোচ্ছিলি?

না। শুয়েছিলাম।

দশটা বাজতেই শুয়ে পড়লি, শরীর খারাপ?

জ্বর জ্বর লাগছে।

রোদে রোদে ঘুরলে জ্বর তো লাগবেই-ভদ্রে মাসের রোদে তাল পেকে যায়, মানুষ তো পাকবেই। ভদ্র মাসে রাস্তাঘাটে মানুষ ঘোরে তাদের বেশির ভাগই পাকা মানুষ।

সিগারেট লাগবে ভাইয়া?

না সিগারেট লাগবে না। এক প্যাকেট কিনেছিলাম, সাতটা খেয়েছি। এখনো তেরটা বাকি আছে। এলাম তোর সাথে একটু গল্প-গুজব করি, বাতিটা জ্বালা।

হাসান অনিচ্ছার সঙ্গে বাতি জ্বালোল। তার জ্বর এসেছে। ভালো জুর। দুপুরে সে কিছু খায় নি। রাতেও খায় নি। ক্ষিধেয় নাড়ি পাক দিচ্ছে কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে কোনো খাবার সামনে আনলেই বমি হয়ে যাবে।

তারেক বসতে বসতে বলল, তোর ভাবি ঝোঁকের মাথায় ফট করে চলে গেল। এই নিয়ে কারো সঙ্গে কথাও বলা হয় নি।

কথা বলার কী আছে?

সেটাও ঠিক কথা বলার কী আছে? লজ্জাজনক ব্যাপার।

তোমার জন্যে লজ্জাজনক তো বটেই। যা ঘটেছে তোমার জন্যেই ঘটেছে।

তোর ভাবি কোথায় আছে কিছু জানিস?

শ্যামলীতে আছে। তার এক বান্ধবীর বাড়িতে।

ও আচ্ছা।

ঠিকানা চাও?

না ঠিকানা দিয়ে কী করব?

তুমি যদি মনে করা–ভাবির সঙ্গে কথা বলে তাকে ফিরিয়ে আনবে।

সেটা ঠিক না। ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা কোনো কাজের কথা না। আমি তাকে চলে যেতে বলি নি–সে চলে গেছে। আমি যদি তাকে চলে যেতে বলতাম তাহলে তাকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমার ছিল। যদি আসার হয় নিজেই আসবে।

হাসান হাই তুলতে তুলতে বলল, ভাবি কঠিন জিনিস। নিজ থেকে আসবে না।

না এলে কী আর করা। বাচ্চাদের খানিক সমস্যা হবে–এই আর কী? সমস্যা তো পৃথিবীতে থাকেই। সমস্যা নিয়েই আমাদের বাস করতে হয়।

তুমি কি তোমার অফিসের ওই মহিলাকে বিয়ে করবে?

বিয়ের কথা আসছে কেন?

বিয়ে হচ্ছে না?

তারেক সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সহজ গলায় বলল, টগরের কাছে শুনলাম–ওদের মার সঙ্গে দেখা হয়–এটা ভালো। আর্লি ষ্টেজে মার ভালোবাসা দরকার। মায়ের ভালবাসা ভিটামিনের মতো কাজ করে। যাক।—সময়ে-অসময়ে ভিটামিনটা পাচ্ছে।

হুঁ।

ও কি চাকরি-বাকরি কিছু করছে?

জানি না। হয়তো করছে।

চাকরির বাজার খুবই টাইট–তবে মেয়েদের স্কোপ বেশি। বলিস ভালোমতো যোগাযোগ করতে। পত্রিকা দেখে এপ্লিকেশন করলে হবে না। সরাসরি উপস্থিত হতে হবে।

ভাইয়া আমার মাথা ধরেছে। কথা বলতে ভালো লাগছে না।

দে একটা সিগারেট খাই। সিগারেটটা শেষ করে চলে যাব।

নিজের ঘরে গিয়ে খাও।

তোর এখানে খেয়ে যাই।

ভাইয়া তুমি কি ভাবিকে টেলিফোন করতে চাও? ভাবি যে বাড়িতে থাকে সেখানকার টেলিফোন নাম্বার আমার কাছে আছে।

টেলিফোন করে কী করব?

কী করবে তা জানি না। টেলিফোন নাম্বার আছে তুমি চাইলে দিতে পারি।

আচ্ছা দে রেখে দেই। তোর এই অবস্থা কেন? মনে হচ্ছে রোদে পুড়ে কাঠকয়লা হয়ে গেছিস। ব্যাপার কী?

কোনো ব্যাপার না।

রোদে বেশি ঘুরবি না। চামড়া নষ্ট হয়ে যাবে। সূর্যের আলট্রা ভায়োলেট রে খুব খারাপ। ঙ্কিনক্যানসার হয়।

হুঁ। ভাইয়া এই নাও ভাবির টেলিফোন নাম্বার। এখন চলে যাও। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরা–কথা বলতে ভালো লাগছে না।

হালকা ধরনের কথাবার্তা বললে বরং মাথা ধরাটা কমে। লাইট ডিসকাশন ওষুধের মতো কাজ করে।

ভাইয়া আমার বেলায় করে না। তাছাড়া আমাদের ডিসকাশন মোটেই লাইট হচ্ছে न्म।

তারেক উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, তোর সঙ্গে আরেকটা জরুরি কথা ছিলএখন মনে পড়ছে না।

মনে পড়লে বলবে।

যখন মনে পড়বে তখন দেখা যাবে তুই পাশে নেই। আর তোর সঙ্গে যখন দেখা হবে তখন আর জরুরি কথাটা মনে পড়বে না। মানুষের জীবন মানেই এই জাতীয় জটিলতা।

হুঁ।

মানুষের মনে যে বয়সে নানান ধরনের শখ হয় সে বয়সে টাকা-পয়সা থাকে না। বুড়ো বয়সে যখন টাকা-পয়সা হয় তখন আর শখ থাকে না।

তোমার কী শখ?

ব্যাংককে গিয়ে একবার একটা ম্যাসেজ নেয়ার শখ ছিল। এই বিষয়ে অনেক কথা শুনেছি। আমার পরিচিত কয়েকজন ম্যাসেজ নিয়েছে। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার। বিরাট একটা কাচের ঘরের পেছনে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ইয়াং মেয়েরা সেগোগুজে বসে থাকে। প্ৰত্যেকের আলাদা আলাদা নম্বর আছে। তোর একটা মেয়ে পছন্দ হলো–ধর তার নাম্বার তিন শ তের। তুই তিন শতের নাম্বারে একটা কার্ড…।

ভাইয়া চুপ কর। তোমার কাছ থেকে এ সব শুনতে খুবই অস্বস্তি লাগছে। এইসব তুমি কী বলছ?

কী বলছি মানে? খারাপ কী বলছি?

কী বলছি বুঝতে পারছি না? তোমার জীবনের সবচে’ বড় শখ একটা বেশ্যা মেয়ে তোমার গা দলাই মলাই করবে।

বেশ্যা মেয়ে বলছিস কেন? ওরা সব কলেজ-ইউনিভার্সিটির মেয়ে। স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলির মেয়ে। তাছাড়া এটাই যে আমার জীবনের সবচে’ বড় শখ তাও না। অনেকগুলো শখের মধ্যে একটা…।ফ্যামিলি ট্যুর প্যাকেজ

ভাইয়া আমার খুব মাথা ধরেছে, তুমি এখন যাও।

শ্যাস্পেনের এত নামধাম শুনেছি। খেয়ে দেখার শখ ছিল–একটা বোতলের দামই শুনেছি। দু-তিন হাজার টাকা…।

ভাইয়া প্লিজ আমি আরেকদিন তোমার শখের কথাগুলো শুনবো।

তুই এমন রেগে গেলি কেন?

রাগি নি। আমি তো বললাম, আমার খুব মাথা ধরেছে।

কমলার মাকে বল এক বালতি গরম পানি করে দিতে। গরম পানি দিয়ে হট শাওয়ার নিলে শরীরটা হালকা হবে, ভালো ঘুম হবে।

আচ্ছা আমার যা করার করব তুমি যাও।

ফট করে রেগে গেলি। আশ্চর্য!

তারেক নিজের ঘরে ঢুকল। হাসানকে যে জরুরি কথাটা বলার ছিল সে কথাটা তখনি মনে পড়ল। তাকে গিয়ে সেই কথাটা বলা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছে না। অকারণে সে যেমন রেগে গেছে–দরজায় ধাক্কা দিলে সে হয়তো দরজাই খুলবে না। কথাটা হচ্ছে তার অফিসে একটা মেয়ে টেলিফোন করেছে। মেয়েটার নাম চিত্ৰলেখা। সে হাসানকে খুঁজছে। খুব নাকি জরুরি। একবার না, মেয়েটা টেলিফোন করেছে। দু’বার।

ঘুমোতে যাবার আগে তারেক একটা কাগজে বড় বড় করে লিখল–চিত্ৰলেখা। সকালবেলা এই কাগজটা দেখলেই তার মনে পড়বে। হাসানকে খবরটা দেয়া যাবে।

সবচে’ ভালো হতো এখন দিতে পারলে।

রীনাকে টেলিফোন করার কোনো ইচ্ছা তারেকের ছিল না। অফিসে এসে রুমাল বের করার জন্যে পকেটে হাত দিয়ে দেখে রীনার টেলিফোন নাম্বার লেখা কাগজ। টেলিফোন করলে কে ধরবে? রীনার বান্ধবী? নাকি রীনাই ধরবে? তারেক টেলিফোন করবে কী করবে না বুঝতে পারছে না। তারপরেও কী মনে করে করল। দুটা রিঙের ভেতর না ধরলে সে রেখে দেবে।

দুটা রিং বাজতেই রীনা ধরল। গম্ভীর গলায় বলল, হ্যালো কাকে চাচ্ছেন? তারেক বলল, কে রীনা?

হ্যাঁ। কী ব্যাপার?

কোনো ব্যাপার না। কেমন আছ?

ভালো আছি।

ও আচ্ছা এইটা জানার জন্যে। বাসার খবর ভালো–টগর পলাশ দুজনই ভালো আছে।

আচ্ছা।

হাসানের শরীরটা মনে হয় খারাপ। কাল রাতে জ্বরটির মনে হয় এসেছে ভাত খায় নি। রোদে রোদে ঘুরে চেহারাটাও খারাপ হয়ে গেছে। আমি বলেছি রোদে কম ঘুরতে।

ভালো।

লায়লার বিয়ের কথা হচ্ছিল–বিয়েটা হয়ে যাবে মনে হয়। ছেলে ভালো। বয়স সামান্য বেশি। ডিভোর্সড।

ও।

রকিব এসেছিল। ও এর মধ্যে দু’মাসের জন্যে ইন্ডিয়া গিয়েছিল। ঘুরেটুরে এসেছে। দু’মাসের জন্যে ইন্ডিয়া গিয়েছিল। আমি তো জানতামই না। তাজমহল দেখে এসেছে। জয়সলমীরও গিয়েছিল। উটের পিঠে চড়ে ছবি তুলেছে। আমার জন্যে জয়পুরী পাঞ্জাবি এনেছে। তোমার জন্যে একটা শাড়ি এনেছে। আমি হাসানকে বলব তোমাকে দিয়ে আসতে। ও তো তোমার বাসা চেনে।

আর কিছু বলবে?

না।

চিটাগাঙের ওই মেয়ে–লাবণীর সঙ্গে যোগাযোগ আছে?

ও দুটা চিঠি দিয়েছিল। আগে জবাব দেই নি–কাল একটার জবাব দিয়েছি।

এর মধ্যে চিটাগাং যাও নি?

না।

কবে যাবে?–ঘুরে আসছ না কেন? লাবণী আর তার মেয়েকে নিয়ে কক্সবাজার থেকে ঘুরে আসা। সমুদ্র দেখিয়ে আন।

তারেক কিছু বলল না। রীনা বলল, টেলিফোন রেখে দিচ্ছি। তারেক বলল, আচ্ছা! পরে কথা হবে। তুমি ভালো থেকে।

আমি ভালোই থাকব। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হতে হবে না। আচ্ছা শোন, আমি টেলিফোন রেখে দিচ্ছি। আমার অফিসের গাড়ি এসে গেছে। হর্ন দিচ্ছে।

অফিসের গাড়ি এসেছে মানে তুমি কি চাকরি করছ নাকি?

সামান্য চাকরি করছি।

রিসিপশনিস্ট? শোন, রিসিপশনিক্টের কাজে কোনো প্রসপেক্ট নেই–অন্য কোনো লাইনে ঢোকার চেষ্টা কর।

আমি এখন রাখলাম।

তারেকের একটু মন খারাপ লাগছে। অফিসের ব্যাপারটা আর ভালোমতো জানা হলো না। কোন অফিস–কত বেতন কিছুই জানা হলো না। অফিসের টেলিফোন নাম্বারটাও নিয়ে রাখলে হতো।

পর্ব ২১ শেষ 📌