Wednesday, July 9, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2431



কৃষ্ণকলি পর্ব- ১০

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ১০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

সংযত হয়ে কথা বলুন মিস নুসরাত।
নুসরাতের উদ্ভট আচরণে রাগান্বিত হয়ে কথাটা বলে বাঁধন। নুসরাতের রাগ উত্তরোত্তর বেড়েই চলছে। সেই রাগের বশবর্তী হয়েই নুসরাত বলে ফেলে-
” তুই আমার কলিজায় হাত দিয়েছিস। তোর সাথে আমি কিভাবে ভালো ভাবে কথা বলব তুই’ই বলে দে।”
অকস্মাৎ নুসরাতে এ হেন আচরণে অবাক হয় বাঁধন। আর তাইতো নুসরাতের কোনো কথার জবাব না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে বাঁধন। এদিকে নুসরাত বিরামহীন ভাবে বলেই চলছে_
” মায়া আমার বান্ধবী। ও আমার এমন একজন বান্ধবী যার জন্য আমি আমার কলিজাটাও কেটে দিয়ে দিতে রাজি। আর তুই কি না সেই মেয়েকেই ফালতু বললি। তোর সাহস তো কম নয়।”

নুসরাতের কথার মাঝখানে নুসরাতকে থামিয়ে দেয় বাঁধন। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে- ওহ!
পরাণের বান্ধবী….!!!
তাইতো বলি নিজের খেয়ে বনের মোষ কেন তাড়াচ্ছে?!
নুসরাত বাঁধনকে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই ওদের সামনে গিয়ে উপস্থিত হলাম আমি। আমায় দেখে বাঁধন কিছুটা স্থির হলো। আর নুসরাতের সব রাগ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বাঁধনের সামনে গিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে দাঁড়ালাম আমি।
” স্যরি, বাঁধন ভাইয়া। আমার বান্ধবীর কৃতকর্মের জন্য আমি সত্যি’ই লজ্জিত। আসলে ও উন্মাদ হয়ে গেছে। ভালোবাসার মানুষটি থেকে ধোঁকা খেয়ে বড্ড উন্মাদ হয়ে গেছে। সেই থেকে ও কোনো পুরুষ মানুষের মুখে ভালোবাসি কথাটা সহ্য করতে পারে না। ওর চোখের সামনে কোনো পুরুষ কোনো নারীকে নিয়ে কটুক্তি করলেই হলো, ব্যাস! ও লেগে যায় কোমর বেঁধে তার বিপক্ষে।”
আমার কথা শুনে বাঁধন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলে-
ওহ, তাই বলুন! আমি তো ভাবলাম ওনি সত্যি সত্যি মায়ার কোনো কালের বান্ধবী।

আরে না, না!
ওহ, হ্যাঁ যে কথাটি বলতে এসেছিলাম—
আন্টি আপনাদের ডাকতেছে। বলল কি জানি কথা আছে! কথাটা বলেই রুমের দিকে পা বাড়ালাম। বাঁধন নুসরাত আমার পিছু পিছু চলল বাসার দিকে।
বাসায় প্রবেশ করেই নুসরাত রাগে হনহন করে উপরে চলে যায়, আর বাঁধন মায়ের পাশে গিয়ে বসল। এদিকে নুসরাতের রাগ ভাঙ্গাতে ওর পিছু পিছু চললাম আমি।
কিন্তু রাগ আর ভাঙ্গাতে পারলাম না। যে মিথ্যেটা কখনো সহ্য করতে পারে না নুসরাত, সেই মিথ্যেটাই বললাম। তাও আবার ওকে জড়িয়ে। পাগলী ভীষণ ক্ষেপেছে বুঝতে পারলাম। নুসরাতের রাগ ভাঙ্গানোর বৃথা চেষ্টা করে মিনিট পাঁচেক পর ড্রয়িংরুমের দিকে পা বাড়ালাম।
বাঁধনের মায়ের একটা কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। দাঁড়িয়ে পরলাম দেয়ালে হেলান দিয়ে পর্দার আড়ালে।
বাঁধনের মা বাঁধনের জীবন সঙ্গীনি হিসেবে নুসরাতকে পছন্দ করেছে। আর সেই পক্ষে সবার মতামত জানতে চাইছে। বাঁধনের দাদাই প্রথম মুখ খুলে। ওনি ওনার মতামত পেশ করেন এভাবে__
” বউমা! আমি তো ভাবছিলাম তুমি বাঁধনের জন্য মিষ্টি(মায়া)কে পছন্দ করেছ। কিন্তু তুমি যে তার বান্ধবীকে পছন্দ করবে সেটা বুঝতে পারিনি। আসলে বাঁধনের জীবনসঙ্গীনি হিসেবে নুসরাত নয়, ঐ মেয়েকেই আমার উপযুক্ত মনে হয়েছিল। চলায়, বলায়, আচার- আচরণে অনন্য ঐ মেয়েটি। যদিও একটু কালো কিন্তু কালো’টা কোনো ফ্যাক্ট না।”
বাঁধনের দাদার মুখ থেকে কথা ছুঁ মেরে কেড়ে নেয় বাঁধনের বড় কাকা। বাপের কথার প্রতিউত্তরে ওনি বলেন-
” কি বলছেন আপনি আব্বা? ঐ কালো মেয়েকে বিয়ে করবে আমাদের বাঁধন? শেষমেষ নাতির জীবনটা শেষ করে দিয়ে যাবেন? বাঁধন মুখ দেখাবে কিভাবে মানুষকে? ঐ কালো মেয়েকে নিয়ে ও কি পারবে বন্ধুদের সামনে যেতে? পারবে কোনো প্রোগ্রামে যেতে? আমাদের স্ট্যাটাস আর ওর স্ট্যাটাস মিলবে???”
বাঁধনের বড় কাকার মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় ওর বড় কাকি। রাগে গজগজ করে বলে_
” কেন? কালোরা কি মানুষ না? ওরা কি আল্লাহর সৃষ্টি না? ওদের শরীরে কি অন্য রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে নাকি? আর স্ট্যাটাসের কথা কেন বলছেন? যারা নিঃস্ব ওদের কি বিয়ে হচ্ছে না? গরীব’দের বড় পরিবারে বিয়ে হচ্ছে না?”
বাঁধনের ছোট কাকা বলে উঠে_
” ভাবি তো ঠিক’ই বলেছে। আর ঐ মেয়ের কি নেই? শিক্ষায় দীক্ষায় আচার আচরণে সব দিক দিয়ে অনন্য।”
বাঁধনের ছোট কাকিও বলে উঠে__
” হ্যাঁ, ঐ মেয়েকে আমারও পছন্দ হয়েছে।
থাক কালো। কালোতে কি আসে যায়?”

মিষ্টিকে আমি মেয়ে মানি। আর বউ হিসেবে আমার নুসরাতকেই ভালো লেগেছে। তাই বলে ভাববেন না ওর কথা ভুলে যাব। ওকে আমরা ধূমধামের সাথে অনেক বড় ঘরে ভালো পরিবারে বিয়ে দিব। তাই ওর জন্য আপনারা এত চিন্তা না করে শুধু এটুকু বলুন, নুসরাত বউ হিসেবে যোগ্য কি না?
বাঁধনের মায়ের কথা শুনে বাঁধনের দাদা বলে, তাহলে তো হলো’ই। আমি বিয়েতে রাজি। বাঁধনের দাদার কথা শুনে আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে সবাই একসাথে বলে উঠে—
আলহামদুলিল্লাহ!!!!

আমার পুরো শরীর কাঁপছিল।
আমি কি পড়ে যাব? বাঁধন কি সত্যি’ই নুসরাতের হয়ে যাবে? হতে পারে না। আমার ভালোবাসা অন্য কারো হতে পারে না। ঝরঝর করে চোখ থেকে পানি পরছিল আমার। পর্দার আড়াল থেকেই বাঁধন- নুসরাতের বিয়ের ব্যপারে হাজারো কথা শুনছিলাম আমি। বুঝতে পারছিলাম না কি করব? বাঁধনের মাকে বলতেই পারব না। যিনি আমাকে এতটা ভালোবাসেন, বিশ্বাস করেন এ সত্য মেনে নেওয়ার ক্ষমতা তিনি রাখেন না।
অনেক ভেবে দেখলাম, ওনার স্নেহের ঋন, ওনার ভালোবাসা আর আমাকে আগলে রাখারা আপ্রাণ চেষ্টা আমাকে স্বার্থপর হতে শেখায়নি।
মনে মনে বললাম, তুমি এবার বিয়েটা করে নিও বাঁধন। বিয়েটা করে নিও। আমার মত কালো মেয়ের আশা নাইবা হলো পূরণ। কিন্তু তোমার মায়ের ইচ্ছে’টা পূর্ণ করো তুমি।
ভীষণ কষ্ট হচ্ছে বাঁধন। খুব ভয় লাগছে। ভীষণ ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে কি যেন হারিয়ে ফেলছি। যখন তুমি আমায় ছেড়ে চলে গেলে, তখন মন শঙ্কায় ছিল। তোমায় ফিরে পাবো কি পাবো না। সে দিনগুলোতেও এতটা অসহায় লাগেনি, যতটা আজ লাগছে। আজ ততটা ভয় লাগছে। পার্থিব এই পৃথিবীতে তোমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় আজ পাচ্ছি বাঁধন।
আমার সব আশা যেন বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে। অদৃশ্য এক আয়নায় দেখতে পাচ্ছিলাম সাজানো একটা বাগানের সুন্দর ফুলগাছগুলো উপড়ে পড়ে আছে। কেউ যেন প্রচন্ড আক্রোশে গাছগুলো উপড়ে ফেলেছিল।
ওদের দেখার আগেই পর্দার আড়াল থেকে সরে গেলাম। ছুটে গেলাম রুমের দিকে। দরজা বন্ধ করে, বালিশে মুখ গুজে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদেছি। পরদিন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বিয়ের ব্যাপারে নুসরাতকে অলরেডি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। নুসরাত তাই শুধু আমায় খুঁজছে। একান্তে কথা বলার জন্য নুসরাত আমাকে একটাবারেরও জন্যও একা পায়নি। পাইনি বললে ভুল হবে। আমি’ই ওর থেকে দুরে দুরে থাকি। গাড়িতেও ওর সাথে বসিনি। নুসরাত যে গাড়িতে উঠেছে সে গাড়িতে না উঠে অন্য গাড়িতে উঠলাম। বাঁধনের দাদার পাশের সিটে চুপটি করে বসে আছি। গাড়ির গ্লাস দিয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। বাসায় গিয়ে খুব বিজি হয়ে গেলাম আমি। দিনে কলেজ+টিউশন+কোচিং।
সন্ধ্যায় নামাজ+কুরআন তেলওয়াত। এরপর বাঁধনের মায়ের সাথে সাথে এটা ওটা করা, আর রাতের খাবারের শেষে দরজা বন্ধ করে কলেজের কাজের অজুহাতে মুখ লুকিয়ে কাঁদা।
আমাকে আর পাই কে???

সেদিন ছিল শুক্রবার। শুক্রবার ছুটির দিন।
তবুও মিথ্যে অজুহাত দেখিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। উদ্দেশ্য একটাই। নুসরাতের থেকে দুরে থাকা। কিন্তু চালাক নুসরাত হসপিটালে যাওয়ার কথা বলে বাসায় লুকিয়ে থাকে। আমি বাসা থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে আমার পিছু নেয়। বেশি দুর যেতে পারিনি, তার আগেই ধরে ফেলে। পথ আগলে দাঁড়ালো নুসরাত।
মুখে ব্যস্তভাব এনে বললাম, প্লিজ আমায় যেতে দে সোনাপাখি। আমার কলেজে কোচিং আছে। রাগান্বিত ভঙ্গিতে নুসরাত বলে উঠে-
” একটা থাপ্পর দিমু আরেক বার যদি মিথ্যে কথা শুনি।”
আমি আবারো বললাম প্লিজ আমায় যেতে দে, আমার কলেজে ইমারজেন্সি মিটিং আছে। কথাটা বলতে দেরি, থাপ্পর দিতে দেরি না। আমি কলেজ কর্তৃপক্ষ থেকে জেনেছি আজ কলেজে কিচ্ছু নেই। মিটিং ফিটিং কিচ্ছু নেই। নুসরাত আমার হাত ধরে টেনে আমায় নিয়ে হাজির হয় একটা পার্কের সামনে।
এই মুহূর্তে মাথা নিচু করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি ওর সামনে। চোখ থেকে অঝোরে অশ্রু ঝরছে। ও আমার থুতনি ধরে আমার মাথাটা উচু করে। চোখে চোখ রেখে বলে এখনো সময় আছে, বাঁধনের কাছে ধরা দে। ও বেচারা ওর হারিয়ে যাওয়া মায়াকে আজও ভালোবাসে। হয়ত মুখে উল্টাপাল্টা কথা বলে কিন্তু ভিতরটা ঠিকই কাঁদে। আমি অশ্রুভেঁজা নয়নে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে আছি। নুসরাত অনবরত বলেই যাচ্ছে-
” যা মায়া! যা…..
তুই যা তোর বাঁধনের কাছে।”
নুসরাতের থেকে চোখটা ফিরিয়ে নিলাম। আমি পারব না বলতে। তুই বিয়েটা করে নে।
আবারো এক থাপ্পর।
নুসরাত আমার হাতে একটা মোবাইল দিয়ে বলে তোর বলতে হবে না। শফিক সাহেবের নাম্বারটা তোল। আমি সবকিছু ওনাকে খুলে বলব। ওনি সব শুনে বিদেশ বসে থাকতে পারবেন না। ওনি ঠিক ছুটে আসবেন দেশে ওনার মায়া বন্ধুকে হেল্প করতে। শফিক সাহেবের নাম্বার দিতে অস্বীকার করলে নুসরাত হুমকি দেয় আমায়-
যানবাহন চালিত রাস্তা দিয়ে দৌঁড় দিবে, ওর প্রাণটা দিয়ে দিবে।
নাম্বার’টা বাধ্য হয়ে দিতে হলো। ও দুর থেকে ফোনে কি কথা বলল নিজেও জানি না। তারপর আমার কাছে এসে বলল,
চল! বাসায় চল…..

দেখতে দেখতে একসপ্তাহ চলে গেল।
সেদিনও ছিল শুক্রবার।
প্রচন্ড জ্বরে শয্যাশায়ী হয়ে শুয়ে আছি গত ৩,৪টা দিন ধরে। বাঁধনের পরিবারে সাজসাজ রব। কিসের জন্য এত সাজসাজ রব সেটা আমি জানি না। আর জানবার কথাও নয়। কারন- অসুস্থ হওয়ার পর থেকে প্রত্যহ বাঁধনের মা এসে আমায় খাইয়ে দিয়ে যেত। সেদিন আর বাঁধনের মা আসেনি। এসেছিল নুসরাত। নুসরাতকে দেখে শুয়া থেকে উঠার চেষ্টা করলাম। নুসরাত আমায় খাটে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিল। ক্লান্তচোখে দিকে তাকিয়ে বললাম-
” নিচে এত হৈহুল্লুর কিসের’রে? তোর বিয়ে উপলক্ষ্যে আমন্ত্রিত অতিথীরা আসা শুরু হইছে নাকি?”
নুসরাত আমার দিকে হাসি হাসি মুড নিয়ে বলে- আরে না!
বাঁধনের বাবা আসতেছে। মানে তোর হারিয়ে যাওয়া শ্বশুর। ওনার আগমনেই বাসায় এত খুশির জোয়ার। ওরা সবাই যাচ্ছে তোর শ্বশুরকে আনতে। নুসরাতের পোষাকের দিকে তাকিয়ে বললাম-
তুইও যাচ্ছিস নাকি?
” আরে না! আমার একজন বিগ ফ্রেন্ড ইয়ারপোর্ট দাঁড়িয়ে আছেন আমার জন্য। ওনাকেই আনতে যাচ্ছি। তোকে খাইয়ে দিয়ে যাচ্ছি। লক্ষ্মী মেয়ের মত চুপটি করে বিছানায় শুয়ে থাক, কেমন?”
নুসরাত আমায় খাইয়ে দিয়ে কপালে আলতু চুমু দিয়ে তাড়াহুড়ো করে রুম থেকে বের হয়ে গেল। নুসরাতসহ বাসার সবাই যখন এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই তখন কাঁপা কাঁপা শরীরে নিজ রুম থেকে বাঁধনের মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ালাম। মাথাটা বড্ড ব্যথা করছে, দেখি কিছু পায় কি না।
হেলেদুলে বাঁধনের মায়ের রুমে গিয়ে হাজির হলাম। রুমটা বেশ পরিপাটি। আজ আরো সুন্দর করে সাজানো হয়ছে। যা, ভালো লাগছে না….
মাথা ব্যথার জন্য ট্যাবলেট কিংবা মলমের কৌটা কোনোটাই খুঁজে পাইনি। টেবিলের উপর ঢেকে রাখা পানিভর্তি গ্লাসটা হাতে নিলাম। ধকধক করে পানি খেলাম। গ্লাসটা যথা স্থানে রাখতে যাওয়ার সময় সদ্য দেওয়ালে টানানোর ছবিটার দিকে নজর যায়। অল্পবয়সী বাঁধনের মায়ের পাশে একজন সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে। দেখতে বাঁধনের মতই কিন্তু বাঁধন নয়। ডাক দিলাম কাজের মেয়েকে। জিজ্ঞেস করলাম আন্টির পাশে দাঁড়ানো লোকটা কে?
মেয়েটি হাসি মুখে জবাব দেয়, ইনি শফিক আংকেল। বাঁধন ভাইজানের বাপ। আঠারো বছর পর ওনি বিদেশ থেকে দেশে ফিরছেন।
মেয়েটি চলে গেল।
শফিক?!!!
মানে এই শফিক ঐ শফিক নইতো?
গ্লাস হাতে নিয়েই ছুটে গেলাম রুমের দিকে। রুম থেকে মোবাইলটা নিয়ে এসে গ্যালারীতে বন্ধু শফিকের ছবির সাথে দেয়ালে টানানো ছবিটা মিলালাম।
তার মানে ওনিই বাঁধনের…..(……..)….???
হাত থেকে গ্লাসটা পরে টুকরোটুকরো হয়ে গেল। আজ নুসরাত এবং এ বাসার সবাই একই ব্যক্তিকে রিসিভ করতে গেছেন এয়ারপোর্ট।
ইয়া মাবুদ!!!
বন্ধু শফিক মানে বাঁধনের বাবার মুখ থেকে বাঁধনের পরিবার যখন কথাগুলো শুনবেন তখন ওদের কিরকম রিয়েক্টশন হবে আল্লাহ’ই জানে? না, না।
আমি এ বাড়ির বউ হতে চাই না। আমি চাই না মায়ের মত মহিলার মনে কষ্ট দিতে।
আমি চলে যাব। এখনি চলে যাব।
বাঁধনের ভালোবাসা পেতে গিয়ে আমি আমার একমায়ের মনে কষ্ট দিতে পারব না। আমি চলেই যাব।

মায়া চলে গেল।
মাঝে মাঝে বৃহত্তর স্বার্থের জন্য ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয়। বন্ধু শফিকের সেই কথাটায় বার বার ওর কানে বাজছিল। মায়া তাই চলেই গেল। সবার থেকে নিজেকে দুরে সরিয়ে নিল। অনেক অনেক দুরে……

চলবে…..

কৃষ্ণকলি পর্ব:- ০৯

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ০৯
Writer:- Anamika Islam Antora

বহুদিন পর সমধুর কন্ঠে প্রিয় রবীন্দ্র সংগীত!
আহ্, প্রাণটা জুড়িয়ে গেল!
আপু তুমি! তুমি এত্ত সুন্দর করে গাইতে পারো?
উফ্, অসাধারণ এক পারফরমেন্স দেখলাম। সত্যি আপনার কোনো তুলনায় হয় না মিস কৃষ্ণকলি ম্যাম!
উপস্থিত দর্শকের বিভিন্ন মন্তব্যে আপ্লুত আমি। আজ কেন জানি মনে হচ্ছে, সত্যি’ই আমি বোধ হয় ভালো গাইতে পারি!
গান+চা+আড্ডা। বেশ ভালো’ই জমছিল সেদিনের আড্ডার আসর। দীর্ঘ আড্ডাবাজির পর রাত্রি ঠিক ১০টায় সবাই হাতে ১টা করে চেয়ার নিয়ে রুমে চলে গেলাম। রাত্রি সাড়ে ১০টায় খাবারের জন্য ডাক পরল। রুমটার চারিপাশটা এত সুন্দর কারুকাজ দ্বারা খচিত ছিল যে আমি মন্ত্র মুগ্ধের মত এপাশ থেকে ওপাশে তাকাচ্ছিলাম।
কিগো নতুন গিন্নী?!!! শুধু কি রুম জুড়ে ঘুরঘুর করবে নাকি কিছু মুখেও দিবে?

বাঁধনের দাদার কথায় হুশ হয়। দেয়াল থেকে মুখ ফিরিয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট হাসি দিয়ে চেয়ার টেনে নুসরাতের পাশে বসলাম। খাবার সামনে নিয়েও বারবার বাঁধনের দিকে তাকাতে লাগলাম। আজ বাঁধনকে উদাসীন লাগছে। কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে খাবার হাত রেখে বসে আছে বাঁধন! আচ্ছা, তবে কি ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা মায়ার কথা মনে পরছে? আচ্ছা, ও কি আজকে আমার নাম্বারে কল দিবে?
কিন্তু আমার নাম্বার তো বন্ধ! ও কি আমার নাম্বার বন্ধ পেয়ে সেই চিরচেনা মায়া আইডিতে নক করবে?
ও কি আমায় বলবে__
মায়া ভুল হয়ে গেছে। আমি তোমাকে শুধু শুধু কষ্ট দিয়ে ফেললাম।
চলো না মায়া আমরা আবার নতুন করে সব শুরু করি….!!!
অবুঝ মন এরকম হাজারো প্রশ্ন করে যাচ্ছে নিজে নিজেকেই।

রাত্রি ২.৪৫মিনিট_
সবাই হয়তো দিনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে নিদ্রাজগতে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু আমি?
আমার চোখে ঘুম নেই। মেসেঞ্জার ওপেন করে ফিল্টার মেসেজের দিকে তাকিয়ে চাতকের মত বসে আছি। অচেনা আইডি থেকে আসা প্রতিটা মেসেজ রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করছি। মাঝে মধ্যে হাই, হ্যালোও করছি। কিন্তু চাতকের মত আশায় চেয়ে থাকা এই আমার আশা পূরণ হয়নি। কোনো আইডি থেকেই বাঁধন আমায় নক করে নি।
পরদিন লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে যায় নুসরাত বাঁধনকে। জিজ্ঞেস করে ওর হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসা মায়ার ব্যাপারে। কিছুক্ষণের জন্য বাঁধন স্তব্ধ হয়ে যায়। এক পা দু’পা করে নুসরাতের থেকে সামনে এগিয়ে যায়। দীঘির কাছাকাছি পলাশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নির্বাক দৃষ্টিতে দুর অজানায় তাকিয়ে আছে। কিছু বলতে গিয়েও চুপসে যায় নুসরাত। ভয়ে বাঁধনের সামনে থেকে কেটে পরার সিদ্ধান্ত নেয়। বাঁধন ঠিক তখন’ই পিছন থেকে ডাক দেয়। নুসরাত থমকে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা দৃষ্টি নিয়ে বাঁধনের দিকে ফিরে তাকায় নুসরাত।
– কি হয় মায়া আপনার?
বাঁধনের প্রশ্ন শুনে মাথা তুলে সামনের দিকে তাকালো নুসরাত। এদিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাঁধন। নুসরাত ঠান্ডা মাথায় ভাবছে, আচ্ছা! আগে তাহলে ওনার মনের কথাটা জেনে নেই। জেনে নেওয়া যাক ওনি এখনো মায়াকে ভালোবাসেন কি না?!!! তারপর’ই না হয় সত্যের মোড়ক উন্মোচন করা যাবে। আর সেজন্য কথা ঘুরিয়ে
নুসরাত জবাব দেয়-
আপনার পূর্বের একটা আইডির ফ্রেন্ড ছিলাম আমি। ঐখানে মায়াকে নিয়ে আপনার অসংখ্য স্ট্যাটাস দেখেছিলাম। তাই আর কি জানতে চাইছিলাম কি খবর আপনার সেই মায়ার?

– Okey, আমি আমি আপনার কৌতূহল মিটিয়ে দিচ্ছি মিস নুসরাত। আপনি শুধু নিরব শ্রোতার মত মন দিয়ে শুনে যান। বাঁধন বলা শুরু করে_
মায়া আমার জীবনের এক দুঃসর্হ অতীতের নাম। মায়া এরকম এক মেয়ে ছিল যার কাছে আমার চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্য ছিল না। ও আমায় অনেক কাঁদিয়েছে। শুধু কাঁদিয়েই শান্ত হয়নি নিজ হাতে আমার ভালোবাসাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। প্রথম প্রথম ওর জন্য কাঁদতাম। কিন্তু এখন আর কাঁদি না। কেন কাঁদব? আর কার জন্য কাঁদব? যার জন্য কাঁদব সেতো আমায় কখনো’ই ভালোবাসেনি।
বাঁধনের কথা শুনে আর চুপ থাকতে পারল না নুসরাত। কথার মাঝখানে বাঁধনকে থামিয়ে দিল সে।
” ১মিনিট বাঁধন সাহেব। জাস্ট ১মিনিট।”

জি, বলুন…..(বাঁধন)

আপনার কেন মায়ার প্রতি এমন বিরুপ ধারনার জন্ম হলো? ও কি বলছে কখনো আপনাকে ভালোবাসে না???
নুসরাতের এরূপ প্রশ্নের জবাবে মুখ খুলে বাঁধন। বলা শুরু করে, সব কথা মুখে বলতে হয় না মিস নুসরাত। কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। আমিও বুঝে নিয়েছি। মায়া ওর কর্মকান্ড দ্বারা আমায় বুঝিয়ে দিয়েছে ও আমায় ভালোবাসে না। ভালোবাসলে আমি যেদিন সুদূর ঢাকা থেকে ওর কাছে ছুটে গিয়েছিলাম, সেদিন ঠিক আমার সামনে আসত। আমায় এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রাখত না অচেনা জায়গায়। ও আমায় ভালোই বাসে নি…..

Wow!
মেয়েটি আপনার সামনে আসেনি আর আপনি ওমনি ভেবে নিয়েছেন ও আপনাকে ভালোবাসে না? ও আপনাকে ছবি দিতে অনিহা প্রকাশ করেছে আর এতেই আপনার মনে হলো ও আপনাকে ভালোবাসে না?
মিস্টার বাঁধন সাহেব!
আপনি কি কখনো ওকে জিজ্ঞেস করেছেন ও কেন আপনাকে ছবি দিতে চাই না, আপনার কাছে আসতে চাই তো না? ভালোবাসার দোহাই দিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলেন কি কখনো কেন বলত ও আপনাকে দূর থেকেই ভালোবেসে যাবে?!!!

নুসরাতের প্রশ্নের জবাবে বাঁধন বলে উঠে__
ভালোবাসার দোহাই কেন দিব? আমি তো বুঝেই গিয়েছি ও আমার সাথে Time pass করেছে। Just time pass…..

চুপ, একদম চুপ! আর একটা কথাও শুনতে চাই না আমি মায়া সম্পর্কে। বাঁধনের করা মন্তব্যে রাগান্বিত হয়ে কথাটা বলে উঠে নুসরাত। বাঁধনও উত্তেজিত হয়ে বলে—
” আমার ঠ্যাকা পরেছে ফালতু মেয়েকে নিয়ে কথা বলতে….”!!!!

অত্যাধিক মাত্রায় রেগে যায় নুসরাত।
বাঁধনের পথ আগলে দাঁড়ায় সে।
” ঐ ব্যাটা?!!! আমার স্ট্যাটাসে হুটহাট মন্তব্য করে চলে যাচ্ছিস কোথায়? মন্তব্যের রিপ্লাই নিয়ে যাবি না?????”???

চলবে……

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৮

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বহুকাল পর অচেনা কারো কন্ঠে সেই চিরচেনা নাম. . . . . . .
বাঁধন চমকে গেল।
থমকে গিয়ে পিছু ফিরে তাকালো বাঁধন।
“কি বললেন?”
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল নুসরাতকে।অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার সময় এসেছে সত্যিটা বলার। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে মুখ খুলে নুসরাত।
“মানে বুঝতে পারেননি?আপনার…….. (……)…..?
কথার মধ্যিখানে থেমে যায় নুসরাত। বাঁধন বার বার জিজ্ঞেস করছে, কি হলো? বলুন….
কিন্তু নুসরাত যেন কোনো কথায় বলতে পারছে না। কারন- কথার মাঝখানে ফুলস্টপ’টা টেনে দিলাম আমি মায়া। ঐ মুহূর্তে আমি সামনে গিয়ে না দাঁড়ালে নুসরাতের হয়ত মনেই থাকত না আমার সাথে করার প্রতিজ্ঞার কথা।

সেদিন বাঁধনের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য ছুটে যাচ্ছিল নুসরাত। কিন্তু আমার কসমের কাছে হার মেনে যায় সে। থমকে যায় পথিমধ্যে। বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে ওকে সেদিন বলেছিলাম কখনো যদি আমার ব্যাপারে বাঁধনের সাথে কোনো কথা বলে তাহলে সেদিন বড়’ই অনর্থ ঘটে যাবে। ওকে বলেছিলাম, বাঁধন যাতে কখনো ওর গত হয়ে যাওয়া ভালোবাসার কথা জানতে না পারে………
আমি এসব ভাবতে ভাবতে বাঁধন নুসরাতকে হাজারটা প্রশ্ন করে ফেলেছে। নুসরাত বোকার মত চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে বাঁধনের প্রশ্নের সঠিক জবাব দেওয়ার ক্ষমতা নুসরাতের নেই। আর একটা কিছু বলে যে বিষয়টা ধামাচাপা দিবে সেটাও মাথায় আসছে না।
এদিকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাঁধন।
“গত রাত্রে ফেসবুকের একটা পেইজে মায়ার বাঁধন নামে একটা গল্প পড়ছিলাম আমরা। মন ছুঁয়ে যাওয়া গল্পটা পড়ে’ই নুসরাত আপনাকে মায়ার বাঁধন বলে সম্বোধন করল জনাব।”
পিছন থেকে কথাটা বলে উঠলাম আমি।
“ওহ্, তাই বলেন…”
বলেই বাসার দিকে পা বাড়ালো বাঁধন।

উফফ্, বাঁচালে খোদা!
আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কথাটা বলল নুসরাত।
আজ ভয়ংকর কিছু ঘটে যেত……
অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে নুসরাতের দিকে তাকিয়ে কথাটা বলে বাসার ভিতরে চলে গেলাম আমি।

দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে যায়। একটু একটু করে যে বাঁধনকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, সেই বাঁধনের জন্য’ই বুকের ভেতরে অল্প অল্প করে ভালোবাসার জন্ম হতে লাগল। ধীরে ধীরে বাঁধনের মায়ায় গভীর ভাবে জড়িয়ে যেতে লাগলাম। ওর কথা বলা, ওর খাওয়া, ওর চলা সব…..
সবকিছুর প্রেমে পরে যায় নতুন করে। সেদিন ছিল পহেলা বৈশাখ___
বাঁধন ও তার পরিবার প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ’টা ওদের গ্রামের বাড়িতেই উৎযাপন করেন। আর সে জন্য যথারীতি এবারো ওরা পহেলা বৈশাখের আগের দিন বিকেলে রওয়ানা দেয় গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। ওদের পরিবারের সঙ্গে এবার আমরা দু’বান্ধবিও ছিলাম।
রাত্রি ৮টা…..
আমরা বাঁধনের গ্রামের স্টেশনে গিয়ে পৌঁছলাম। স্টেশনে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল স্বয়ং বাঁধনের দাদা। বাঁধনের কাছাকাছি পৌঁছেই বাঁধনের মা সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। সুইটি দাদাভাই, দাদাভাই করে জড়িয়ে ধরে দাদাকে। সুইটির কপালে চুমু খেয়ে বাঁধনের দাদা আমার দিকে এগিয়ে আসেন।
” এই তাহলে আমার আরেকটা গিন্নি”
কথাটা বলে বাঁধনের বাবা আমার গাল টেনে দিলেন। নুসরাতের সাথেও পরিচিত হলেন।
বাঁধন যখন আনমনে ফোন টিপাটিপিতে ব্যস্ত ঠিক তখন’ই ওর তলপেটে ব্যাথা অনুভূত হয়। ওহ্, বলে সামনে তাকাতেই দেখে ওর দাদা এখনো ঘুষি দিয়ে হাত ওভাবেই রেখেছে। দাদা তুমি…..???
কথাটা বলে’ই বাসার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে বাঁধন। পিছন দিয়ে বাকি সবাই যাচ্ছে।

বাড়িটা খুব পুরনো,
তবে ছিমছামও গুছানো।
চারদিকে শ্যাওলা পরা প্রাচীর দিয়ে ঘেরা বাড়িটির ভিতরের বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে সুন্দর বাগান। বাগানটিতে নানারকম জানা অজানা ফুল ফুটে রয়েছে। ফুলের গন্ধে চারদিক মুখরিত।
বাগানটির ঠিক পাশেই রয়েছে বিশাল বড় দীঘি। যা বাড়ির সৌন্দর্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। দীঘিটিতে উঠা-নামার জন্য সিড়িও রয়েছে। ঐ সিড়ি বেয়েই মহিলারা দীঘির জলে গোসল করত। বাগানের ক্ষাণিকদুরে আরেকটি জিনিস লক্ষ করলাম।
ছোট্ট করে একটা ছাউনির মত কি যেন একটা। সুইটির থেকে জানতে পারলাম এটা আসলে চা’য়ের জন্য নির্মিত।
গ্রীষ্মের পড়ন্ত বিকেলে কিংবা সন্ধ্যাবেলায় বাঁধনের দাদা সবাইকে নিয়ে এখানে বসেই চা আড্ডা দেয়।
বাঁধনের মায়ের থেকে জানতে পারলাম বাঁধনের দাদা পরদাদারা ছিলেন পুরনো ধনী। সমস্ত গ্রামের মধ্যে ওনারাই ছিলেন অধিকতর সম্পত্তির মালিক। আর সে হিসেবে ওনার এই এলাকায় রয়েছে যথেষ্ট দাপট। আর গ্রামের লোকের এ পরিবারের লোকদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা এবং সম্মান করে। কোনো সমস্যা হলে এখানেই সবাই ছুটে আসে……

গ্রামে লোডশেডিং খুব কমন একটা ব্যাপার।
সেদিনও লোডশেডিং হয়েছিল।
বাঁধনের দাদা কাজের ছেলেকে চা বানাতে বলে সবাইকে বললেন হাতে একটা করে চেয়ার নিতে। আমরা সবাই হাতে একটা করে চেয়ার নিয়ে বাঁধনের দাদাকে অনুসরন করে হাজির হলাম দীঘির পাড়ে। দীঘি থেকে ক্ষাণিকটা দুরেই আমাদের অবস্থান। সেখানে সবাই যে যার মত চেয়ার পেতে বসে পরলাম।
প্রকৃতির শান্ত স্নিগ্ধ পরিবেশ,
মৃদু বাতাস,
দুরের পাখিদের বাসা ফেরার আয়োজন।
মাঝে মাঝে দু’য়েকটা পাখির কিচিরমিচির শব্দ।
সবমিলিয়ে ভালো’ই লাগছে……..

ইস!
এই সময় বাঁধন যদি কাছে থাকত,
ওর হাতটা ধরে যদি বসে থাকতে পারতাম
কিংবা ওর কাধে মাথা রেখে!
তাহলে মন্দ লাগত না।
আচ্ছা….
ওর কি আমার কথা একটুও মনে নেই?
ও কি আমাকে একটুও আর ভালোবাসে না?
আমার কথা কি ওর একটুও মনে হয় না?
মনে হয় না সেই স্বপ্নগুলোর কথা,
যা একসময় আমরা দু’জন দেখতাম?
বাঁধনকে নিয়ে যখন ভাবনার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখন’ই আমার ভাবনাচ্ছেদ ঘটে।
” কি বড় গিন্নী? আমাকে রেখে’ই হারিয়ে গেলা কল্পনাতে?”
ছি! দাদাভাই….
কি যে বলো না…..বলেই লজ্জায় মুখ লুকালাম আমি।
-তো গাচ্ছেন না কেন গান???
বাঁধনের কথা শুনে ওর দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকালাম। কিসের গান?!!!
আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম ওদেরকে।
দাদাভাই আমার সখি এখন ওর কল্পরাজ্যের রাজকুমারকে নিয়ে ভাবনার অতলে ডুবে আছে, ওর মন কি আর এখানে আছে???
নুসরাত কথাটা বলতেই ফিক করে হেসে দিল সবাই। আমি মুখ ভার করে বসে আছি।
তো যায় হোক!
হাসি পরে হবে। আগে রবীঠাকুরের কাব্যের নায়িকা কৃষ্ণকলি ম্যামের কন্ঠে একটা রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনে নেই, কি বলো সবাই???
ইতিমধ্যে বাঁধনের মা এবং ওনার দুই জা ও তাদের ছেলেমেয়েরা এসে যোগ দিল।
সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার কন্ঠে গান শুনার প্রতিক্ষায়। অন্যদিন হলে ঠিক বাঁধনের মুখের উপর বলে দিতাম এখন কোনো গান শুনাবো না তোমায়, গান যা শুনানোর ফুলশয্যার রাতেই শুনাবো। দুজন মিলে একসাথে আমাদের প্রিয় রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনব……
আজ তো তা বলতে পারব না।
কারন- ওর সাথে আমার মত কালো মেয়ের মিল তো কখনোই হবার নয়।
” কি হলো শুনান….!!!”
বাঁধনের কথা শুনে সম্ভিত ফিরল। ওর দিকে তাকিয়ে একটা শুকনো হাসি দিয়ে গান শুরু করলাম-

আমি এলেম, তারই দ্বারে….
আমি এলেম।
ডাক দিলেম অন্ধকারে,
হা রে……….
আমি এলেম, তারই দ্বারে……..
আমি এলেম।
আগল ধরে দিলেম নাড়া………
প্রহর গেল, পাইনি সাড়া;
দেখতে পেলেম না’যে তারে,
হা রে………..
আমি এলেম, তারই দ্বারে…….
আমি এলেম।
তবে যাবার আগে এখান থেকে,
এই লিখনখানি__
যাব রেখে………
তবে যাবার আগে এখান থেকে….!
দেখা তোমার পাইবা না পাই…..
দেখতে এলেম__
যেনগো তাই ফিরে যায় সুদূরের পাড়ে……
হা রে……
আমি এলেম, দ্বার’ই দ্বারে…..
আমি এলেম।
তবে যাবার আগে এখান থেকে,
এই লিখনখানি_
যাব রেখে…..
তবে যাবার আগে এখান থেকে….!
দেখা তোমার পাইবা না পাই…….
দেখডে এলেম___
যেনগো তাই ফিরে যায় সুদূরের পাড়ে……
হা রে……
আমি এলেম, তারই দ্বারে…….
আমি এলেম।
ডাক দিলেম অন্ধকারে…….
হা রে…….
আমি এলেম, আমি এলেম……!!!

চলবে……

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৭

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মাঝরাত্রে রিংটনের আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে যায় বাঁধনের মায়ের। ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে ফোন রিসিভ করে চমকে উঠেন ওনি। অজানা বিপদের আশংকায় ভিতরটা মুচড় দিয়ে ওঠে ওনার।
“গেইটের সামনে মানে….?”
কাঁপা স্বরে ওনি জিজ্ঞেস করেন।

হ্যাঁ, ঠিক’ই শুনেছেন আপনারা!
এই মুহূর্তে আমি বাঁধনের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সাথে আছে বান্ধবী নুসরাত। হাজার অনুনয়-বিণয় করেও ওকে ওর কথা থেকে টলাতে পারিনি। গেইটের সামনে এসে ফোন করলাম বাঁধনের মাকে।
” আন্টি! গেইট’টা খুলেন। আমি গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।”
ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে কথাটা বাঁধনের মাকে বললাম। এত রাত্রে এ ধরনের কথা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। ঘাবড়ে যান ওনি। তাড়াতাড়ি বাঁধনকে ডেকে তুলে গেইটের সামনে গেলেন ওনি। গেইটের বাইরে থেকেই লক্ষ্য করলাম মা-ছেলে দু’জনের চোখে মুখেই আতঙ্কের ছাঁপ। নুসরাতের কথায় এত রাত্রে এভাবে ছুটে আসা মোটেও উচিৎ হয়নি আমার। মনে মনে নুসরাতকে হাজারটা গালি দিলাম। তারপর মাথা নিচু করে গেইট অতিক্রম করে বাসার ভেতর ঢুকলাম।

এই মুহূর্তে আমাদের অবস্থান ড্রয়িংরুমে। সোফায় মাথা নিচু করে বসে আছি আমি। আর আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কয়েক জোড়া চোখ। যে চোখগুলোতে রয়েছে হাজারো প্রশ্ন, হাজারো কথা। মিনিট দুয়েক নিরবতার পর মুখ খুলেন বাঁধনের মা।
“এত রাত্রে তুই চলে আসছিস? কি হয়েছে তোর? তুই ঠিক আছিস তো? তোর কোনো সমস্যা হয়নি তো?”

একনিশ্বাসে করা একগাদা নাগরিক প্রশ্ন।

“আসলে আন্টি ও খুব বাজে স্বপ্ন দেখেছে। আর সেটা দেখেই চিৎকার দিয়ে উঠল ঘুম থেকে। তারপর থেকে অদ্ভুত সব পাগলামী করতে থাকে। আমি বাসায় যাব, বাসায় যাব, আন্টির কাছে যাব। তাই বাধ্য হয়ে নিয়ে আসতে হলো।”
বাঁধনের মাকে দ্বিত্বীয় বার প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ না দিয়ে কথাগুলো বলে নুসরাত। বাঁধনের মা দৌঁড়ে আমার কাছে আসলেন। জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। নুসরাতের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালাম। কারন- আমার পক্ষে ঐসকল প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। আবার মিথ্যেটাও বলতে পারতাম না। কারন- ওনার মাঝে আমি আমার মাকে খুঁজে পায়!!!

চলে গেল আরো কয়েক মাস….
এর’ই মাঝে আমার সাথে সাথে নুসরাতও পরিচিত হয়ে গেল এ বাসার প্রত্যেকটি সদস্যের কাছে। এখন আর আমাকে নুসরাতের বাসায় যেতে হয় না। কাজের ফাঁকে ফাঁকে, কখনো বা পেলে নুসরাত’ই ছুটে আসে তার পরাণের বান্ধবীকে দেখার জন্য। সেদিনও নুসরাত এ বাসায় এসেছিল।
” কিরে মা?তুই এত শুকাচ্ছিস কেন? তুই কি খাস না নাকি?”
রাত্রে খাবার টেবিলে সবাই যখন খাবার নিয়ে ব্যস্ত তখন আচমকা’ই প্রশ্নটি করে বাঁধনের মা নুসরাতকে।
“হসপিটালে সারাক্ষণ রোগী নিয়ে ব্যস্ত থাকি। তারউপর বাসায় গিয়ে রান্না, গোসল, খাওয়া। ঘুমানোর আর সময় হয়ে উঠে না আন্টি।”
মাথা উচু করে গম্ভীর হয়ে কথাগুলো বলে নুসরাত।

রান্নার জন্য বুয়া রেখে নাও। আর গ্রামের বাড়িতে কেউ নেই? মানে আপনজন!!!ওখান থেকে একজনকে নিয়ে আসো। যে কিনা অলস সময়ে তোমাকে সঙ্গ দিতে পারবে।
“আমার আবার আপনজন!
ঐ যে সামনে যে মেয়েটি বসে আছে না?!!! যাকে আপনি আপনার মেয়ের স্থান দিয়ে এ বাসায় স্থান দিয়েছেন তার কপাল আর কপাল একই। আমরা একসাথে একই স্কুল+কলেজে পড়েছি। আমরা পাশাপাশি গ্রামের মেয়ে ছিলাম। আমাদের দুজনের মা’ই মারা গেছেন সেই ছোট্ট কালে। দু’জনের বাবা’ই পরবর্তীতে বিয়ে করেছেন। ওর সৎ মা অবশ্য মারা গেছেন কিন্তু আমার সৎ মা??? বেঁচে ছিলেন। ২য় মা মারা যাওয়ার পর আমার বাবা আরেকটা বিয়ে করেন। প্রথমজন যাও একটু মারার পাশাপাশি আদর করত, পড়াশুনার ব্যাপারে সাপোর্ট করত। কিন্তু এখন যেজন আছেন ওনি? ওনার কথার আঘাতে প্রতিনিয়ত আমায় জর্জরিত হতে হয়।খুব বাজে বাজে কথা বলে আমাকে নিয়ে আমার বাবার সাথে। যা একজন মেয়ে হিসেবে আমার জন্য ভিষণ লজ্জাকর ছিল। বহু সংগ্রাম করে মেডিকেল কোর্সটা কমপ্লিট করলাম। তারপর সেই যে বাড়ি ছাড়লাম আর যায়নি। কিসের জন্য যাব বলেন? ওখানে গেলে যে আমি মানসিক শান্তির পরিবর্তে মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে যায় আরো।
একটা শুকনো হাসি দিয়ে কথাগুলো বলে চুপ করল নুসরাত।

বাঁধনসহ ওর মা, বোন আর বুয়ার চোখে জল চিকচিক করছে নুসরাতের কথা শুনে। খাবার টেবিলে এই মুহূর্তে থমথমে ভাব বিরাজ করছে। কিছুটা সময় নিরবতা, তারপর আচমকা বাঁধনের মা বলে উঠল__
” কে বলছে তোর কেউ নেই? তোর জন্য আমি আছি, এ পরিবারের সবাই আছে। আজ থেকে তুই এ বাসায় থাকবে। আর এখান থেকেই হসপিটালে যাবি। বাঁধন রোজ তোকে দিয়ে আসবে। আর বাঁধন?!!!
তুই কালকে একবার নুসরাতকে নিয়ে ওর বাসায় যাবি। ওখান থেকে ওর সব জিনিসপত্র নিয়ে আসবি। কি মনে থাকবে তো?!!!”

– আচ্ছা….. (বাঁধন)

নুসরাতের সাথে আমার চোখ দুটোও জলে ছলছল করে উঠল।

পরদিন সকাল বেলা_
” এই, উঠবি নাকি পানি ঢালব???”(মা)
– উফ্, মা! আরেকটু ঘুমাই না।(বাঁধন)
– ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছিস কয়টা বাজে? বেলা ১১টা বাজে। নুসরাতের জিনিসপত্র গিয়ে কখন আনবি?(মা)

ধরমরিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে বাঁধন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে বলে ১১টা? মা, তুমি আগে ডাক দিবা না? বাঁধন দৌঁড়ে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করে গাড়িতে করে নুসরাতকে নিয়ে পৌঁছে গেল কাঙ্খিত স্থানে। নুসরাত ওর যাবতীয় জিনিসপত্র গুছাতে গুছাতেই কাটিয়ে দেয় ৩ঘন্টা। দুপুর ০২টা নাগাদ ওখানকার সমস্ত ঝামেলা শেষ হলো। আধঘন্টার মধ্যে বাসায় পৌঁছল ওরা। গাড়ি থেকে নেমে বাঁধন একটা একটা করে জিনিস দাঁড়োয়ান চাচার হাতে এগিয়ে দিতে লাগল আর দাড়োয়ান সেগুলো বাসার ভিতর নিয়ে রেখে আসতে লাগল। সবশেষে ড্রাইভারকে গাড়ি ভেতরে নিতে বলে বাঁধন যেই না গেইটের ভিতরের দিকে পা বাড়ালো ওমনি পেছন থেকে ডেকে উঠে নুসরাত।
এই যে মায়ার বাঁধন শুনোন?!!!

থমকে যায় বাঁধন।
দীর্ঘ অনেকগুলো বছর পর সেই প্রিয় নাম!
চমকে উঠে পেছনে তাকালো বাঁধন…..

চলবে…….

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৬

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

“কেমন আছে এখন মায়ার বাঁধন?”

বেশ ভালো!
ছোট্ট করে বলে থেমে গেলাম আমি। কিছু সময় নিরবতা তারপর জনাব শফিক সাহেবের প্রশ্ন- কতজনের নানা হলাম?
শফিক সাহেবের এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তাইতো চনকে উঠে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, মানে?
মানে হলো আমার মায়া বন্ধুর কোল আলো করে এ পর্যন্ত কয়জন এলো? আমি কতজন ছেলে মেয়ের নানা হতে পেরেছি?

বন্ধু শফিকের কথা শুনে কন্ঠ’টা স্তব্ধ হয়ে আসে। উত্তর দিতে গিয়েও দিতে পারিনি। কেন জানি মনে হচ্ছিল কথারা সব বুকের ভেতর প্রকান্ড এক পাথর রুপ ধারন করেছে। প্রচন্ড এক যন্ত্রণায় ভেতরটা ছটফট করে উঠল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম আমি।
পৃথিবীর সবচেয়ে আপন মানুষটিকে এত সহজে হারিয়ে ফেলার বেদনায় জমে থাকা নীল কষ্টের তুষারগুলো গলে গলে পড়তে শুরু করল অশ্রু হয়ে।
এই মুহূর্তে বাঁধনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া পেছনের স্মৃতিগুলোই আমাকে পীড়া দিচ্ছে। বাঁধনের স্মৃতিগুলো বার বার হৃদয়ের ক্যানভাসে ভেসে উঠছে। হুশ হয় বন্ধু শফিকের কথায়।
এই মেয়ে! কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে তোর?

চোখের অশ্রু মুছে হাসিমুখে উত্তর দিলাম, কই? কিছু না তো!!!

ভুলে গেলি? আজকে রাত পোহালে শুক্রবার। আজকের দিনেও তুই মিথ্যে বলবি?

উফ্! বন্ধু শফিকের কথায় মনে পরল আজকের দিনটা একটা সময় আমার আর বাঁধনের জন্য কতটা স্পেশাল দিন ছিল। ২০১০ সালের এই দিনে দু”জন দু’জনকে ভালোবাসার কথাটা বলছিলাম।
ইস! কতই না সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো….
কখনো যদি বাঁধনের সাথে ঝগড়া হতো, আর সেটা যদি হতো শুক্রবার দিন, তাহলে বাঁধনের মুখ থেকে এই একটা কথায় শুনতাম-
” মায়া! আজ না শুক্রবার?!!! আজকের দিনেও তুমি ঝগড়া করবে? রাগ করে থাকবে?”

বাঁধনের এই একটি কথায় থেমে যেত সব ঝগড়া, উড়ে যেত সব রাগ।
বাঁধনকে বলতাম- এই দেখো! চুপ করলাম।
আর ঝগড়া করব না। এবার হলো তো???
আর রাগ? সেটা কি আদৌ গেছে?(বাঁধন)
– হ্যাঁ, গেছে। আমি আর রেগে নেই।
আমার কথা শুনে বাঁধন গম্ভীর গলায় প্রমান চাইত। আমি যে রেগে নেই তার প্রমাণ হিসেবে একটা হাসি দিতে বলত। জোর করে হলেও হাসি দিতাম এভাবে-
” হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি হি”
হাসি হাসি মুখে বাঁধন বলত, এইতো আমার পেত্নী হাসছে।
প্রেমিকরা ওদের প্রেমিকাদের হাসির বর্ণনা কত সুন্দর, কত নিঁখুত ভাবে গল্প-উপন্যাসে তুলে ধরেন। আর বাঁধন?!!!
আমার হাসিকে পেত্নীমার্কা হাসির সাথে তুলনা করত।
রাগান্ধিত স্বরে বলতাম- আমি পেত্নী, নাহ?
সিরিয়াস ভঙ্গিতে বাঁধন বলত- হ্যাঁ, তুমি পেত্নী।

আচ্ছা, আচ্ছা। রাখি।
রাগ দেখিয়ে ফোনটা কেটে দিতে যাব, তখনই ও বলে উঠত-
শুনো! তুমি শুধু আমার পেত্নী। আর কারো না। এ পেত্নীটা শুধুই আমার।
বাঁধনের এই একটা কথায় আমার সমস্ত রাগ দুরে সরে যেত। ভিতরের আনন্দটা চেপে বলতাম- শয়তান!
বাঁধনও আমার সাথে সাথে লম্বা করে বলত- শয়তান!
তারপর আবার সেই হাসি।
পেত্নী মার্কা হাসি।

Oh, hlw mem!
কিছু’তো বলুন। সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। শফিক সাহেবের কথায় সম্ভিত ফিরে। একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেদিন বাঁধনের সাথে দেখা করতে যাওয়ার পর থেকে ওনার বাসায় আশ্রয় নেওয়া পর্যন্ত সবটা খুলে বললাম। আমার কথা শুনে জনাব শফিক সাহেব চুপসে গেলেন। শুধু চুপসে নয়, কিছুক্ষণের জন্য ওনি হয়তো নির্বাকও হয়ে গেছেন। যার কারনে ওনি কোনো কথা বলতেছেন না। টানা ৫,৬মিনিট নিরবতা চলল। ওনার কথা বলার কোনো আভাস’ই পাচ্ছি না।

নিরবতা ভেঙ্গে মুখ খুললাম আমি। বন্ধু শুনতে পাচ্ছেন?
হ্যাঁলো, হ্যাঁলো বলতে বলতে পিছনে ঘুরে তাকালাম। নুসরাত অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে এভাবে দেখে চমকে উঠলাম আমি।

ফোন’টা কান থেকে নামিয়ে, তু তু তু তু….ইই……????

হ্যাঁ, আমি। মায়ার বাঁধনের বর্তমান অবস্থান জানার জন্য’ই ঘুম থেকে জেগে উঠা। আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে নুসরাতের জবাব।

ই ইয়ে মানে আসলে নুসরাত আমি তোকে…..

সম্পূর্ণ কথাটা বলতে পারিনি। তার আগেই আমার মুখ থেকে কথাটা কেড়ে নিয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে জোর গলায় বলতে থাকে নুসরাত, তুই কিভাবে এমনটা করলি?
কিভাবে তুই আমার থেকে এত বড় সত্যি’টা লুকাইলি? আমি কি কখনো’ই কোনো ভালো বন্ধু ছিলাম না???

নুসরাত কথা’টা তো শুন।
চুপ!
একদম চুপ। তুই কোনো কথা বলবি না।রাগান্বিত স্বরে নুসরাতের জবাব। আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না। চুপ করে আছি। নুসরাত ১ঘন্টার আলাপকে সাড়ে ৩ঘন্টা বানালে প্যাঁচাল পেরে। প্যাঁচাল শেষে যখন হাফিয়ে উঠে আমার দিকে তাকালো। আমি তখন সোফায় বসে ঝিমুচ্ছি। নুসরাত আমার কাছে দৌঁড়ে গিয়ে আমার দু’বাহু ঝাকিয়ে বলে-
এই ঘুমোবে না একদম!
তুই এখন এই মুহূর্তে আমার সাথে চলবি।

আধো ঘুম আধো জাগরিত অবস্থায় আমি নুসরাতকে বললাম-
” কোথায় যাব?”
নুসরাত আমার কানের কাছে এসে জোরে জোরে বলতেছে-
” কোথায় আবার? বাঁধনের বাসায়। আমায় তুই বাঁধনের বাসায় নিয়ে চলবি। ঐ হারামজাদাকে আমি দেখতে চাই। দেখতে চাই কেমন বেকুব যে গার্লফ্রেন্ডের কন্ঠ শুনেও গার্লফ্রেন্ডকে চিনে না।”

কি?!!!
চমকে উঠে চোখ মেলে তাকালাম।
এই মুহূর্তে আমার চোখ থেকে নিদ্রাদেবী প্রস্থান করেছে।

কি, কি করিস না;
আমি বাঁধনের বাসায় যেতে চাচ্ছি। ওর সাথে আমার কথা আছে। নিয়ে চল আমায় সেখানে……

চলবে……….

কৃষ্ণকলি পর্ব:- ০৫

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

এফএমে লাখো মানুষের শ্রোতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলা’টা তো খুব ভাগ্যের ব্যাপার। তাহলে আংকেলকে সবাই কেন এমন করত? আমি আজ’ই আন্টির কাছে যাব। আন্টির কাছের কাছে গিয়ে আংকেলের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে বলব। কারন- আংকেল অবশ্যই একবার হলেও ফোন দিয়েছিল আন্টিকে।

-খবরদার!
যা বলছো এখানেই। এই কথা’টা যাতে মায়ের সামনে না বলা হয়।
তাহলে কিন্তু…… (……)……???
আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ার্ত চোখে কথাটা বলল বাঁধন। কেন? ওনি কি এফএমকে ভালোবাসেন না? প্রশ্ন করলাম বাঁধনকে।
তাচ্ছিল্যের স্বরে বাঁধনের জবাব,
” ভালোবাসা?!!!
হা, হা। ঘৃণা করে মা। শুধু ঘৃণা না, ভয়ংকর ঘৃণা। এই নামটাই ওনি সহ্য করতে পারেন না আমার মা। এফএমের “ফ”টাও সহ্য করতে পারেন না।

বাঁধনের কথা শুনে আর কোনো কথা বলতে পারলাম না। বলতে পারলাম না, বাঁধন!
আমিও তো এফএমে প্রোগ্রাম করতাম একসময়। প্রতি বৃহস্পতি’বার দিন আমায় সেখানে যেতে হতো প্রোগ্রাম করার জন্য। অবশ্য মধ্যিখানে অনেকটা দুরে সরে গিয়েছিলাম রেডিও থেকে। কিন্তু আজ এতবছর পর লাখো শ্রোতার ভালোবাসায় আপ্লুত হয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আবার প্রোগ্রাম’টা শুরু করব, তখন…..(……)…..???
যাক!
এখন কথা না বলাটাই শ্রেয়।
আর তাই আমিও কোনো কথা বললাম না।
চুপ করে বাঁধন গাড়ি চালালো।
বাকি রাস্তা একটা কথাও হলো না আর।

সেদিন বান্ধবী ডাঃ নুসরাত কল দিয়ে বলল, ও ঢাকায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছে। আমাকে দেখতে ওর ভিষণ ইচ্ছে হচ্ছে। আমি যেন ওর বাসায় যায়। কলিজার টুকরা বান্ধবীর ইচ্ছে বলে কথা। ফেলতে পারিনি। বাঁধনের মায়ের থেকে অনুমতি নিয়ে ছুঁটে চললাম নুসরাতের বাসার উদ্দেশ্যে। ১ঘন্টার মধ্যে’ই নুসরাতের ওখানে গিয়ে পৌঁছলাম। ওকে দেখে বুঝতে পারলাম এতক্ষণ ধরে আমার’ই অপেক্ষায় গেইটের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে সেকি খুশি! ওর কাছে যাওয়ার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরল আমায়। অনেক দিনের দুঃখ কষ্ট জমে পাহাড়ের মত হয়ে গিয়েছিল আমার ভিতর। সেই দুঃখ-কষ্টের একটু একটু ওকে বলতে লাগলাম। ঘন্টা দু’য়ের মধ্যে’ই মনে হলো আমার ভিতর যে বরফগলা পাহাড় ছিল,
সেটি একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে।
সন্ধ্যায় হালকা নাস্তা করা শেষে দু’বান্ধবীর মধ্যে কিছু কথা হয়। কথোপকথনগুলো এমন ছিল__

নুসরাত:- তারপর?
তোর প্রোগ্রামের কি খবর? এখনো
করিস প্রোগ্রাম’টা?
আমি:- না। তবে কথা দিয়েছিলাম শুরু করব। কিন্তু আমি মনে হয় ওদের কাছে দেওয়া কথাটা রাখতে পারব না। শুরু করতে
পারব না প্রোগ্রাম’টা?
নুসরাত:- কেন? কেন???
আমি:- বাড়িওয়ালাী এফএম নামটা সহ্য
করতে পারে না, ঘৃণা করে।
নুসরাত:- মানে?!!! মানে কি মায়া???

নুসরাতের সাথে বাঁধনের বলা কথাগুলো’ই পুনারবৃত্তি করলাম। আমার কথা শুনে নুসরাত চিন্তিত মনে বাহির পানে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ ওর চোখে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল। লাফ দিয়ে আমার কাছে এসে বলল, আইডিয়া!
– কি idea?
তোর তো প্রতি বৃহস্পতিবার রাত্রে প্রোগ্রাম, তাই না?
– হুম।
আর সেই বৃহস্পতিবার দিন কলেজ থেকে এসে আন্টিকে আমার বাসায় থাকার কথা বলে তুই যদি আমার এখানে চলে আসিস, তারপর রাত্রে আমি তোকে রেডিও অফিসে দিয়ে আসি। তাহলে কেমন হয় ব্যাপার’টা?
– Yes.

খুশিতে নুসরাতকে জড়িয়ে ধরলাম।
কিন্তু পরক্ষণে মুখটা নিকষ কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। নুসরাতের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বারান্দায় চলে গেলাম। বারান্দায় গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাত পিছন থেকে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে। নুসরাতের দিকে একবার তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নিলাম। আমার দৃষ্টি তখন বারান্দার রেলিংয়ের ভিতর দিয়ে দুর অজানায় চলে গেছে। বান্ধবী নুসরাত চুপটি করে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট পাঁচেক পর মুখ খুলে নুসরাত।
তোকে খুব ভালোবাসেন ভদ্রমহিলা, তাইনা?

নুসরাতের দিকে না তাকিয়েই বললাম-
হ্যাঁ। বড্ড বেশীই ভালোবাসেন ওনি আমাকে। এরকম ভালোবাসা আমি আমার জীবনে পূর্বে একজনের কাছ থেকেই পেয়েছিলাম। তিনি ছিলেন- আমার মা। মা মারা যাওয়ার এই যে এত বছর পর আমি একটু তৃপ্তির হাসি দিতে পারি, সে ঐ মহিলার জন্য। যিনি আমার মা সমতুল্য। ওনি এমন একজন মানুষ যার মাঝে আমি মায়ের ছায়া খুঁজে পায়। খুঁজে পায় মায়ের সেই স্নেহমাখা ভালোবাসা, আদর-সোহাগ এবং শাসন। ওনার সাথে আমার পরিচয় তিনদিনের। অথচ দ্যাখ….
ওনি যেন আমার শিরায়-উপশিরায় মিশে আছেন।

– তো! কি করবি?(নুসরাত)

আমি করব না প্রোগ্রাম। আমি চাই না ঐ প্রোগ্রাম করতে যেটা করতে গিয়ে মায়ের সাথে দিনের পর দিন মিথ্যা কথা বলতে হবে। মাকে ঠকানো হবে। আমি আমার মায়ের সাথে এরকমটা করতে পারব না। ওনার স্নেহের মূল্য আমি এভাবে দিতে চাই না। এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে গেলাম।

নুসরাত আমার কাছে এসে বলল, তুই তাহলে রেডিওর জগত থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে চাচ্ছিস, এই তো?!!!

হ্যাঁ, ঠিক তাই।
আমি এ জগত থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছি। তুই প্লিজ আমায় জোর করিস না।
নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে কথাটা বলছিলাম।

তোর যা ভালো মনে হয়।
নুসরাত রুমে চলে গেল। নুসরাতের পিছু পিছু আমিও রুমে গেলাম।

রাতের রান্নাটা দু’বান্ধবি মিলে করলাম।
অনেক দিন পর দু’বান্ধবী একসাথে খাবার খেলাম।
বুঝলি মায়া! একেই বলে সত্যিকারের বন্ধুত্ব। এই যে দুজন দুজনকে ছেড়ে এতটা দিন এতটা দুরে ছিলাম, অথচ সম্পর্কে একটুও ফাটল ধরে নি। সেই আগের মতই হাসি, আনন্দ, খুনসুটিতে ভরপুর আমাদের সম্পর্ক। খাওয়া শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে কথাটা বলল নুসরাত।
মনের টান’টাই আসল নুসরাত। আর দূরত্ব কখনো কোনো সম্পর্কের অন্তরায় হতে পারে না, যদি সেখানে একে অপরের প্রতি টান, ভালোবাসা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা থাকে। তা যে কোনো সম্পর্ক’ই হোক না কেন। নুসরাতের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে জবাব দিলাম।

একদম ঠিক কথা বলছেন ম্যাম। এখানে মনের টান’টাই মূখ্য। (নুসরাত)

ডাক্তার সাহেবা! রাত’তো অনেক হয়েছে। তাই দয়া করে ঘুমান। কালকে সকালে তো আপনাকে আবার হসপিটালে যেতে হবে, তাই না? (আমি)

Okey, good night…..(Nusrat)
Good night….(Myself)

ঘন্টা দেড়েক হয়ে গেছে শুয়ে আছি। নুসরাত মনে হয় এতক্ষণে ঘুমিয়ে গেছে। বিছানা থেকে উঠে বসলাম। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে ধীর পায়ে জানালার দিকে এগিয়ে গেলাম। ফেসবুক লগইন করলাম। দীর্ঘ ৬বছর পর চিরচেনা সেই “মায়া” আইডিতে ঢুকলাম। শত শত মেসেজ। মেসেজ পাঠিয়েছে মায়ার পাগল ভক্তরা। হ্যাঁ, ওরা আমার সেই পাঠক যারা একটা সময় আমার লেখা গল্প,কবিতা না পেলে পাগল হয়ে যেত। মেসেজের পর মেসেজ দিত। কখনো গল্প, কবিতা দিতে দেরি হলে আমার প্রতি ওদের অভিযোগের অন্ত ছিল না। আজ এই যে এতদিন এফবিতে ঢুকলাম মনে হচ্ছে ওরা এতটা দিন আমার নামের পাশে সবুজ বাতিটা জ্বলার অপেক্ষায়’ই ছিল। আজ যখন সবুজ বাতিটা জ্বলে উঠল তখন ওরা ঝাপিয়ে পরে ইনবক্সের উপর। শত শত পাঠকের শত শত মেসেজ। তন্মধ্যে একটা মেসেজের মধ্যে চোখটা আটকে গেল। যেখানে লেখা ছিল-
Very bad, Maya.
Very bad.
সখাকে পেয়ে বন্ধুকেই ভুলে গেলে?!!!
সবার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে উত্তর দিলাম ঐ মেসেজকৃত আইডিতে। যে আইডির লোকটি সাথে ফেসবুকে প্রথম পরিচয় আমার। লোকটি প্রবাসী। নাম “শফিক”।
বয়স আনুমানিক পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। চোখে সানগ্লাস। পরনের ধূসর কালো গেঞ্জিটা ধূসর বর্ণের চাদরে আবৃত। মুখের মিষ্টি হাসিটা যেন সবসময় লেগে থাকে।
লোকটার ছবি দেখলে কেমন যেন এক ভালো লাগা কাজ করে। বাঁধনের চেহারার সাথে লোকটার চেহারার অদ্ভুত মিল রয়েছে।
বাঁধনের সাথে পরিচয়ের শুরু থেকে শেষ অবধি এই লোকটার জানা।
ওনার সাথে শেষ কথা হয় সেদিন, যেদিন বাঁধন শেষ বার আমার এলাকায় গিয়েছিল। বাঁধনের সাথে দেখা করার আগ মুহূর্ত শফিক সাহেবকে ফোন দিলাম আমি। বুকটা তখন ধুরু ধূরু করে কাঁপছে। সেদিন বন্ধু শফিকের কাছে কাঁপা গলায় দোয়া চেয়েছিলাম। বলেছিলাম-
“দোয়া করবেন বন্ধু। দেখা করতে চাচ্ছি।”
সেদিন সেই কথাগুলোই ছিল বন্ধু শফিকের সাথে আমার শেষ কথা।
তারপর আর কথা হয়নি ওনার সাথে। ফেসবুক আইডি, সিম কোনোটাই আর ইউজ করা হয়নি বাঁধনের কাছে প্রত্যাখিত হওয়ার পর থেকে।

মেসেঞ্জারটা ওপেন করার সাথে সাথে বন্ধু শফিকের কল। কোনো দ্বিধা না করে কলটা রিসিভ করে ফেললাম।
ওপাশ থেকে এক মধ্য বয়স্ক লোকের কন্ঠে ভেসে উঠে__
” কেমন আছে এখন মায়ার বাঁধন?”

চলবে……

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৪

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

জি, আপনার বোধ হয় আর কোনো কষ্ট করতে হবে না। সুইটি এখন থেকে আমার সাথে’ই যেতে পারবে। বাঁধনের দিকে তাকিয়ে কথা’টা বলছিলাম আমি।
– সেই জন্য’ই তো বললাম ভালো’ই হলো।
মৃদু হেসে বাঁধনের জবাব।
“আচ্ছা, আসি আন্টি। আসসালামু আলাইকুম।”
বাঁধনের মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিলাম। একমিনিট দাঁড়ান, আমিও অফিসে যাব। কথাটা বলে আমায় থামালো বাঁধন। বাঁধন ওর মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
বাঁধনের পাশের সিটে চুপচাপ বসে আছি এই আমি। গাড়ি চলছে। কিন্তু গাড়ি মুখে’ই কোনো কথা নেই। দুজনে’ই নিরব।
-তারপর???
কলেজ থেকে ফিরবেন কখন? নিরবতা ভেঙে বাঁধনের প্রশ্ন।
– ফিরব কখন সেটা তো জানি না। তবে ৩টা ২০পর্যন্ত কলেজ টাইম। সামনের দিকে তাকিয়ে বাঁধনের প্রশ্নের জবাব দিলাম আমি। বাঁধন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-
” তাহলে তো মনে হয় আমার সাথে ফিরতে পারবেন। আমিও অফিস থেকে চলে আসব ৪টার দিকে। ততক্ষণে আপনার নিশ্চয় অফিশিয়াল কাজ সব শেষ হয়ে যাবে???
-হুম, শেষ হয়ে যাবে। প্রতিউত্তরে আমার জবাব।

তারপর বাকি রাস্তা আর কোনো কথায় হয়নি। বাঁধন আমাকে কোনো প্রশ্ন করেনি আর আমিও কোনো কথা বলার সুযোগ পায়নি।

গাড়ি থেকে নামার সময়_
” এই! সাবধানে, সাবধানে!!!
গাড়ি আসছে….”
বাঁধনের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট হাসি দিয়ে বললাম-
আসি তাহলে….
বাঁধন আমার দিকে তাকিয়ে বলল-
” অপেক্ষা করব ৪টার সময় এখানে।”

বাঁধনের থেকে বিদায় নিয়ে কলেজ গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।
আমার প্রথম ক্লাস ইন্টার প্রথম বর্ষের ছাত্রীদের ফিজিক্স সকাল ১০টায়, দ্বিতীয় ক্লাস ২য় বর্ষের ছাত্রীদের ফিজিক্স দুপুর ১২টা ৪০মিনিটে। ১টা ২০মিনিটে আমার ক্লাস শেষ। তারপর আমার পুরো অবসর। অফিসিয়াল কাজ সেরেও ২টা কিংবা আড়াইটার ভিতর কলেজ থেকে বের হওয়া যাবে, আর ছাত্রীদের প্রাইভেট কিংবা কোচিং করালে তাহলে সেটা অন্য কথা। সেদিন ক্লাস+অফিসিয়াললি কাজ সেরেও দেখলাম ঘড়িতে মাত্র ২টা বেজে ২০মিনিট।

অন্য কোনো কাজ না থাকায় বের হয়ে গেলাম কলেজ থেকে। কলেজ গেইটে গিয়ে অটোতে উঠব কি না সেই দ্বিধাদ্বন্ধে পরে গেলাম। বাঁধন তো বলেছিল ৪টায় বাসায় ফিরবে, ততক্ষণ কি আমি অপেক্ষা করব?
মাত্র তো আড়াইটা বাজে।
না, থাক।
আমি বরং বাসায় চলে যায়।
এই বলে বাসায় চলে যাচ্ছিলাম।পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে আমার সামনে থামল। গাড়ির কাছাকাছি যেতে’ই দেখলাম বাঁধন বসে।।
আপনি? এ সময়?
আপনার না ৪টার আসার কথা? অবাক হয়ে বাঁধনকে প্রশ্ন করলাম।
~ আমারও তো একই প্রশ্ন মিস কৃষ্ণকলি!
আপনি এ সময় এখানে???

বাঁধনের প্রশ্নোত্তরে বললাম,
আমার দুইটা ক্লাস। সেটা ১টা ২০পর্যন্ত’ই। অফিসিয়াল কাজও তেমন ছিল না। তাই টিফিন করে সোজা চলে আসলাম।

আমার অফিসে এখন লাঞ্চটাইম চলে। অসুস্থ্যতার অজুহাত দেখিয়ে বস মামার থেকে ছুটি নিয়ে চলে আসলাম। হেসে হেসে বাঁধনের জবাব।
– বস মামা? সেটা আবার কেমন ডাক? আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম বাঁধনকে।

বস মামা মানে বস আমার মামা হয়। আপন মামা। বাবার অনুপস্থিতিতে ঐ মামায় বাবার কোম্পানির দেখাশুনার দায়িত্বে আছেন।
– আংকেল? আংকেল কোথায়??? বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বাঁধনকে প্রশ্নটা করলাম।

বাঁধন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল__
বাবা?!!!
বাবা হারিয়ে গেছে।
আমাদের রেখে দুর অজানায় পালিয়ে গেছে।
বাঁধনের কথা শুনে হচ্ছিল আমার ভিতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে, ভেঙে চূরমার হয়ে যাচ্ছে। কোনো কথা না বলে বাঁধনের পাশের সিটে গিয়ে বসলাম, ছোট্ট করে বললাম “স্যরি”।
বাঁধন মনে হয় আমার এই স্যরি’টা আশা করে নি। তাই তো আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল-
” Sorry?!!! But Why?”
আমি জানতাম না আংকেল নেই। জানলে এভাবে আপনাকে কষ্ট’টা মনে করিয়ে দিতাম না। আমি আবারও বলছি স্যরি…..
আর আল্লাহ ওনাকে শান্তিতে রাখুক সেই দোয়ায় করি। ভেজা গলায় কথাগুলো বললাম।
এদিকে বাঁধনের অবাক হওয়ার মাত্রা’টা যেন বেড়ে’ই চলছে উত্তরোত্তর। বাঁধন অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেল। আর তাই তো আমার দিকে তাকিয়ে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করল-
” নেই মানে? What do you mean?”
চোখের জলটুকু মুছলাম। করুণ চোখে বাঁধনের দিকে তাকালাম। তারপর_
” আমি সত্যি’ই দুঃখিত। আমি জানতাম না আংকেল আর এ পৃথিবীতে নেই। আর যখন জানতে পারলাম তখন মনে হলো আংকেলের মৃত্যুর কথা মনে করিয়ে দিয়ে আমি আপনাকে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। এই জন্য I am sorry….”
আচমকা বাঁধন stopped, stopped বলে চেঁচিয়ে উঠল। আমি ভয়ে কেঁপে উঠলাম। কিন্তু এভাবে চেঁচানোর মানে’টা বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর বলল, আমার বাবা হারিয়ে গেছে দুর অজানায়,তার মানে এই নয় আমার বাবা আর বেঁচে নেই। আমার বাবা বেঁচে আছে। ওনাকে বেঁচে থাকতে’ই হবে। আমাদের ভালোবাসার টানে ওনাকে একদিন ফিরে আসতেই হবে। তা পৃথিবীর যে প্রান্তে’ই হোক না কেন। এটুকু বলে বাঁধন চুপ হয়ে গেল। আমিও কোনো কথা বাড়ালাম না। তাই আমিও চুপ করে আছি। কিন্তু কৌতূহলী মনকে কিছুতেই শান্তনা দিতে পারছি না। পারছিলাম না একটা হিসেব মিলাতে। হিসেবটা মিলানোর জন্য আমার বাঁধনের হেল্প দরকার। কিন্তু এই মুহূর্তে ওকে এ সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস না করাই ভালো। আর তাই চুপ করে আছি।

মিনিট দশেক এভাবে একই স্থানে গাড়ির ভেতর ২জন চুপ করে বসে ছিলাম। নিরবতা ভাঙে বাঁধন। সামনের দিকে তাকিয়েই বলতে থাকে_
” বাবা ছিলেন ভিষন ছটফটে এবং দুরন্ত স্বভাবের। সারাক্ষণ কাঁধে গিটার নিয়ে ঘুরে বেড়ানো’ই ছিল ওনার স্বভাব। দুরন্ত এবং চঞ্চল বাবা ছিলেন স্বাধীনচেতা আর মুক্তমননের অধিকারী। কোনো ধরাবাধা নিয়ম ওনি পছন্দ করতেন না। আর তাইতো লেখাপড়া শেষ করে দাদার ব্যবসায়ে যোগ না দিয়ে একটা এফএমে আর.জে হিসেবে জয়েন করলেন। সেই রেডিওর পোগ্রামের মাধ্যমে’ই আমার বাবা অসংখ্য দুঃখী মানুষের দুঃখ দুর করে দিয়েছেন। অল্প কয়েক বছরের ব্যবধানে আমার বাবা হয়ে গেলেন সকলের প্রিয় একজন ব্যক্তিত্ব। দিনে কাঁধে গিটার নিয়ে বন্ধুদের সাথে এদিক-সেদিক ঘুরে বেড়ানো আর রাত্রে রেডিওতে মানুষের লাইফ সাপোর্ট দেওয়া। এটুকুই ছিল বাবার কাজ। বাবার জীবন যেন এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু না!!!
বাবার জীবন এটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিল না।
বাবার জীবনে আরো একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল। সেটা ছিল ‘সংসার’। কিন্তু বাবার হাবভাব দেখে মনে হতো সংসারের প্রতি যেন ওনার কোনো দায়িত্ব’ই নেই। বাবা মাকে একদম’ই সময় দিত না। দিত না বললে ভুল হবে, আসলে বাবার সময় হতো না। মা সব দেখেও চুপ করে ছিল। ভাবত পরে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সুইটি জন্ম নেওয়ার পরেও যখন বাবার চালচলনে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না, তখন আমার মা মুখ খুলে। বাবাকে এই নিয়ে কথা বলে। দাদাও বাবাকে বকাঝকা করত। মায়ের বকবকানি, দাদার বকাঝকা আমার বাবার ব্যক্তিত্বে বোধ হয় আঘাত হানে। তাই তো একদিন ভোরে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বাবা বাসা থেকে চলে যায়। বাবা চলে যান বলে গেছেন। কিন্তু কোথায় চলে গেছে সেটা বলে যান’নি। আমার মা আজও বিশ্বাস করে বাবা আসবে। ওনাকে আসতে’ই হবে।

চলবে…..

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০৩

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব- ০৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত গন্তব্যে। আমার স্বপ্নের সুখের নীড়ে।
যে নীড়কে নিয়ে একটা সময় রাতভর স্বপ্ন দেখতাম;
স্বপ্ন দেখতাম আমার থাকবে একটা সাজানো ছোট্ট সংসার।
যেখানে মা সমতুল্য শাশুড়ি , বন্ধু ভাবাপণ্ন শ্বশুর আর বোনের মত একটা ছোট্ট ননদ থাকবে। ওদেরকে নিয়ে হৈহুল্লুর করে কেটে যাবে আমার দিন, আমার রাত।
আমার স্বপ্নগুলো আজ যেন স্বপ্ন হয়ে’ই রয়ে গেল। পূরণ আর হলো না….

মিষ্টি মা!
আমাদের বাড়িটা কি পছন্দ হয়েছে?
~মিষ্টি???(আমি)
হুম, মিষ্টি। এত মিষ্টি দেখতে যে তাকে মিষ্টি বলব না তো কি বলব, হুহ্?
আজ থেকে তোর নাম মিষ্টি। তুই আমার মিষ্টি মা। আগে পরে কি নাম ছিল সেসব ভুলে যা। মনে করবি,
তুই সদা বর্তমানে ছিলি, আছিস, থাকবি।
কি!!!
মনে থাকবে আমার কথা?
– হুম।

সুইটি একটু এদিকে আয়’তো!
বাঁধনের মায়ের ডাকে বাঁধনের ছোট বোন সুইটি ছুঁটে আসল। মিষ্টি করে সালাম দিয়ে আমাকে ওর রুমে নিয়ে গেল।
ফ্রেস হয়ে রেস্ট নেবার জন্য বলল। ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যাগ থেকে কাপড়-চোপড় বের করছিলাম, এর’ই মাঝে মিস সুইটি ওর রুমের প্রতিটি কোণায়-কানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আসবাবপত্রের বর্ণনা দিতে লাগল। এমনভাবে সব কিছুর বিশ্লেষণ করছে মনে হচ্ছে ও যেন কোনো দোকানের মালিক। আর আমি সেখানকার একমাত্র ক্রেতা।
যায় হোক!
আধঘন্টা এভাবে অনর্থক পেঁচাল পারল।
তারপর মনে হয় হাফিয়ে গিয়েছিল।
আপু তুমি বসে রেস্ট নাও, আমি আসছি বলে চলে গেল সুইটি
উফ!!!
পারেও বটে।
কিছু সময়ের ব্যবধানে’ই বুঝে গেলাম মেয়েটা ভিষণ ছটফটে আর চঞ্চল। সারাক্ষণ ছুটোছুটো করাটাই যার স্বভাব। সুইটি যাওয়ার পর বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিয়েছিলাম, ঠিক তখন’ই রুমে বাঁধনের আগমন। একবাটি নুডলস হাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে। অনুমতি নিয়ে’ই তবে রুমে প্রবেশ করে।
নুডলস খান বলে আমার দিকে নুডলসের বাটি”টা বাড়িয়ে দেই বাঁধন।
আমি নুডলস খাই.. না এটুকু শুধু বলছিলাম, তখন’ই ও বলে উঠে-
নিজ হাতে বানিয়েছি।
গ্রহণ করলে ভালো লাগত।
এবার আর ফিরিয়ে দিতে পারিনি। বাঁধনের হাত থেকে নুডলসের বাটিটা নিয়ে ডকডক করে গিলতে লাগলাম, যদিও নুডলস আমার ভিষণ অপছন্দের খাবারের তালিকায় পরে।
জীবনের প্রথম অপছন্দের কোনো খাবার খেলাম।
নাহ, পূর্বের ন্যায় কোনো বমি কিংবা অস্বস্তি লাগে নি। কেন যেন মনে হচ্ছে,
অপছন্দের কোনো খাবার নয়, আমি যেন কোনো অমৃত খাচ্ছি।
এমন অনুভূতির কারণ’টা কি সত্যি’ই ওর রান্নার জন্য নাকি প্রিয় কারো হাতের খাবারের জন্য সেটা জানা নেই আমার….
খাওয়া শেষ করতে’ই জিজ্ঞেস করে বাঁধন, কেমন হলো জানাবেন না???
বাঁধনের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম।
ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়ে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করলাম-
” আপনি রান্না পারেন আগে কখনো বলেন নি তো?!!!”

বাঁধন আমার দিকে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞাসো দৃষ্টি নিয়ে তাকালো। মনে মনে নিজের বোকামির জন্য নিজেকে’ই গালি দিচ্ছিলাম। প্রশ্ন করে বাঁধন__
” আগে বলব মানে?”
– স্যরি, মজা করলাম। তবে যায় হোক!
আপনার নুডলস রান্না’টা কিন্তু বেশ হয়েছে।
আমার দিকে তাকিয়ে একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে_
” শুনে ধন্য হলাম…..”

বাঁধন রুমে চলে যায়।
রাত্রে খাওয়া-দাওয়া শেষে অনেক কথা-বার্তা হলো সবার সাথে।
এতে এটুকু বুঝলাম যে_
” আমার ধারণা’টা মনে হয় একটু ভুল। বাঁধন শান্ত নয়, এখনো আগের মত’ই অশান্ত ভাবটা ওর মধ্যে আছে।”

মাঝরাত্রে খুব ভেঙ্গে যায়।
স্মৃতি’রা এসে মনের জানালায় কড়া নাড়ে। ভিতরে অস্থিরতার সৃষ্টি হয়।
অস্থিরতা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে নামাজকে’ই উত্তম মনে হলো।
ওযু করে বসে গেলাম নামাজের বিছানায়।
আদায় করে নিলাম তাহাজ্জদ।
নামাজ শেষে কুরআন নিয়ে বসে পরলাম।
কুরআন পাঠে এতটাই মগ্ন ছিলাম যে মনে’ই ছিল না এখন রাত্রী গভীর।
এদিকে গভীর রজনীতে তেলাওয়াতের আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় বাঁধনের মায়ের। বিছানা থেকে নেমে ঘড়ির দিকে তাকান ওনি। রাত্রী তখন ৩টা।
এত রাত্রে কুরআন তেলাওয়াত???
বাঁধনের মা নামাজ কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো। রুমে দরজা আটকানো। কিন্তু এ রুম থেকে’ই তেলাওয়াতের আওয়াজ’টা আসছে সেটা ওনি বুঝতে পারলেন। জানালার পর্দা আংশিক ফাঁক করে রুমের ভিতর তাকালেন ওনি।
ওনার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠল।
– এত সুন্দর সুরেলা কন্ঠে তেলাওয়াত তাহলে এই মেয়ে’ই করছে। মিষ্টি হেসে রুমে চলে গেলেন বাঁধনের মা….

পরদিন সকালবেলা ব্রেকফাস্ট করে আন্টিকে(বাঁধনের মা) বলতে গেলাম যে, বাইরে যাচ্ছি। গিয়ে দেখলাম ওনি আধ শুয়া হয়ে হাদিসের বই পড়ছেন। আমাকে দেখে সোজা হয়ে বসলেন ওনি। জিজ্ঞেস করলেন-
কোথাও যাবি মা?
– জি, আন্টি। কলেজে যাচ্ছি।
~ কলেজে? কেন কোনো দরকার মা???(আন্টি)

আন্টি কলেজে আমার চাকুরী হয়েছে…..
– আলহামদুলিল্লাহ! শুনে খুশি হলাম। তা কোন কলেজে চাকুরী হয়েছে তোমার মা?
~ গার্লস স্কুলের সাথে যে কলেজ’টা আছে সে কলেজ’টাই আন্টি।
– কিহ? তুমি মহিলা কলেজের কথা বলছ?
আশ্চর্য হয়ে বাঁধনের মা প্রশ্ন করে আমায়। ওনার প্রশ্নের জবাবে ছোট্ট করে বললাম__
জি আন্টি….

বাঁধনের মা মিষ্টি হেসে বলল__
সেখানে তো সুইটিও পড়ে মা….

ভালো’ই তো হলো।
ও তাহলে এখন থেকে আমার সাথে’ই যেতে পারবে।
‘ হুম, একহিসেবে ভালো’ই হয়েছে আমার মাথার বোজা কমল, ভিষণ থেকে বলে উঠল বাঁধন………’

চলবে…….

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০২

0

কৃষ্ণকলি পর্ব- ০২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বাঁধন চলে গেলে সেদিনের মত বাসায় ফিরে গেলাম। সারা রাত বাঁধনকে ভেবে ছটফট যন্ত্রণায় কাটল। ভোরে বাসা থেকে বের হয়ে ঐ স্থানে গিয়ে দাঁড়ালাম যেখানে বাঁধন উন্মাদের মত হাঁটছিল গতকাল। সকাল থেকে দুপুর বাসা খুঁজার অজুহাতে ঘুরঘুর করেছি সে স্থান ও তার আশেপাশে। কিন্তু বাঁধনের দেখা আর মেলেনি।
একদিন, দু’দিন করে চলে যায় এক সপ্তাহ। বান্ধবী অর্পিতাকেও যে বিশাল বড় ঝামেলায় ফেলে দিয়েছি সেটা ও মুখে না বললেও কাজে ঠিক টের পেতাম। বেশকিছুদিন আগে একটা প্রতিষ্ঠানে চাকরীর জন্য এপ্লাই করেছিলাম। রিটেনে ভালো’ই করেছিলাম। আল্লাহ, আল্লাহ করে যদি ভাইবাতে ভালো করতে পারি তাহলে চাকুরীটা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ!
আর সে জন্য’ই অর্পিতার এখানে উঠেছিলাম। কিন্তু অর্পিতা বোধ হয় এই কয়দিনে’ই হাফিয়ে উঠেছে। আর তাই সেদিন ভাইবা দিয়ে এসে অর্পিতাকে বললাম,
আর একটা দিন অর্পি!
একটা দিন পর আমি বাসা পাই বা না পাই এখান থেকে চলে যাব। অর্পিতা করুণ স্বরে বলেছিল,
মায়া! আমি তোকে এভাবে যেতে দিতাম না। কিন্তু কিন্তু কি করব বল? আমার এত অল্প ইনকামে পরিবার চালিয়ে নিজেও চলা খুব কষ্টকর হয়ে যায়!!!
অর্পিতাকে আমার খরচ বাবদ কিছু টাকা দিয়ে পরদিন সকালে ওর বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। সেদিন সারাদিন হন্যে হয়ে খুঁজেও কোথাও ভালো বাসার সন্ধান করতে পারিনি। ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে পড়ন্ত বিকেলে বাসস্টপের ছোট্ট বেঞ্চে বসে যখন জীবন অংকের হিসাব মিলাচ্ছিলাম তখন’ই পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠে,
” শুনছেন___”

পিছনে ফিরে তাকালাম। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। এ যে স্বয়ং বাঁধন দাঁড়িয়ে। চোখের জল লুকিয়ে বললাম, আপনি?!!!
কেমন আছেন?
এই তো আলহামদুলিল্লাহ! আপনি এখানে এভাবে!!!
— বাসা খু্ঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভেবেছিলাম আজকে যেভাবে’ই হোক একটা বাসা ঠিক পেয়ে যাব, তাই বান্ধবীর বাসা থেকে একেবারে চলে আসছিলাম। কিন্তু____
পেলেন না’তো বাসা???

আমার নিরবতা দেখে বাঁধন বুঝে নিল বাসা খুঁজে পাওয়া যায় নি।
এদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছিল দেখে বাঁধন বলল, চলেন। বাঁধনের দিকে তাকিয়ে চোখ’টা ফিরিয়ে নিলাম।

আমার পক্ষে আর ও বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়।

কি করবেন তাহলে? এভাবে এখানে অসহায়ের মত বসে থাকবেন?(বাঁধন)
— থাকব।(আমি)
মিস ম্যাম! চারপাশ’টা দেখেছেন? সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আর আপনি দিনের শহর দেখেছেন, এখনো অবধি হয়ত রাতের শহর দেখেননি। তাই এ কথা নির্দ্বিধায় বলে ফেললেন। সন্ধ্যা পর থেকে’ই এখানে বখাটেদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। আমি কি বুঝাতে চেয়েছি আশা করি আপনি বুঝতে পেরেছেন!(বাঁধন)

বাঁধনের কথা শুনেও আমার কোনো প্রতিক্রিয়া ছিল না দেখে বাঁধন বোধ হয় মনে মনে অবাক হয়েছিল। অবাক হওয়ার’ই কথা। আমি নির্বিকারচিত্তে সামনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছি,
আমি জানি বাঁধন! তুমি এই মুহূর্তে ঠিক ভাবছ? তুমি ভাবছ আমার কোনো ভয়-ডর নেই নাকি!
ভয় আমার ঠিক’ই আছে বাঁধন। কিন্তু তুমি পাশে থাকায় সেটা এখনো অবধি ভালো ভাবে ঝেকে বসতে পারেনি।

আমার দৃঢ়চিত্তে বসে থাকা দেখে বাঁধন আমায় কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল ঠিক তখনি ওর ফোন’টা বেজে উঠে। বাঁধন ওর ফোন রিসিভ করে।
এই তো মা রাস্তায়। ওকে, ওকে আসছি।
ফোন’টা রেখে বাঁধন আমার দিকে তাকালো।
কৃষ্ণকলি!!!
আমায় এখন যেতে হবে। বোন কোচিংয়ে। সেখান থেকে ওকে আনতে হবে। আপনি বরং আপনার বান্ধবীর বাসায় ফিরে যান।

বাঁধন মায়াকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে’ই ফোন কানে আসছি, আসছি বলে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। মায়া দু’টানায় পরে যায়। কি করবে বুঝতে পারছিল না। বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়াতে’ই ওর ফোন’টা বেজে উঠে।
ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ থাকল মায়া। তারপরে’ই মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে ওর। অবশেষে মায়ার চাকুরী’টা হয়ে গেছে। আর হাসি’টা সেই বিজয়ের’ই হাসি।

খুশিতে আত্মহারা হয়ে যখন আমি দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম তখন মনে হলো ওপাশ থেকে এক দোকানদার ডাক দিয়েছে আমায়। আশেপাশে কেউ ছিল না দেখে নিশ্চিত হলাম ওনি বোধ হয় আমায়’ই ডাক দিয়েছেন। আর তাই আমি টং দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানদার আমায় বেঞ্চে বসতে বলে আমার দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিলেন। আমি চা খাই না বলে চুপচাপ বেঞ্চে বসে পরলাম। চায়ের কাপ পাশে রেখে দোকানদার আমার পাশে এসে বসলেন। তারপর বলতে লাগলেন__
” তুই বোধ হয় এই এলাকায় নতুন! তোর বোধ হয় এই এলাকা সম্পর্কে কোনো ধারনায় নেই। তাই এভাবে নির্ভয়ে এখানে হাঁটতে পারতেছিস।”

– দোকানদারের কথা শুনে এবার সত্যি সত্যি ভয় পাচ্ছি।

_ তোর বাড়ি কোথায়রে মা?
দোকানদারের আবেগী গলার কথা শুনে মনটা গলে গেল। সবটা খুলে বললাম ওনাকে। দোকানদার আমায় নির্ভয় দিয়ে বললেন, “তুই একদম চিন্তা করিস না মা। একদম কাঁদবি না। তুই শুধু এখানে ৫টা মিনিট বস। আমি তোকে বাসা খুঁজে দিব।”

কোনো কথা না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলাম আমি। কিছুক্ষণ পর দোকানদার কাকে যেন বলল__
” আরে ভাবিসাব যে!
আসসালামু আলাইকুম।”
না তাকিয়েও বুঝে গেলাম কোনো মহিলা আসছে বোধ হয় সওদা করতে। মহিলাটি আমার পাশে এসে বসল বুঝতে পারলাম।
আমার চোখ দিয়ে তখনও অঝরে অশ্রু গড়িয়ে পরছিল বিপদের কথা ভেবে। আতংকে কলিজা শুকিয়ে আসছিল। মহিলাটি আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল কিছুক্ষণ। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাচ্ছিল, তারপর কি মনে করে যেন ফিরে আসল।
মহিলাটি আমার পাশে এসে পুনরায় বসল।
আমায় মাথায় হাত রেখে বলল__
” কোন মায়ের নাড়িছেঁড়া ধনরে তুই এখানে এভাবে অনাথের মত বসে কাঁদছিস। বাসা কোথায় তোর মা?”

বহুদিন পর নারী কন্ঠে ‘মা’ ডাক শুনে চোখ দুটো জলে ছলছল করে উঠল। অশ্রুভেঁজা নয়নে সামনের দিকে তাকালাম। এক অতিকায় সুন্দরী মধ্যবয়স্কা নারী আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে চশমা, গায়ে চাদর। আমি ভদ্রমহিলার দিকে ঢ্যাব ঢ্যাব করে তাকিয়ে আছি। কিছু বলতে যাব তখন’ই দেখি বাঁধন। বাইকে করে একটা মেয়েকে নিয়ে এদিকেই এগিয়ে আসছে। বাঁধনকে দেখে আমার মুখে শুকনো হাসি ফুটে উঠল…….

দোকানের সামনে এসে বাঁধন বাইক রাখে। বাইকের পিছনে বসা মেয়েটি আচমকা ভদ্রমহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে।
নালিশ করে বাঁধনের নামে। মহিলা ব্যস্তভাব নিয়ে বললেন,
পাজিটার বিচার বাসায় গিয়ে করব।
আগে দেখি তো আমার আরেক মা কেন কাঁদছে? কথা বলতে বলতে ভদ্রমহিলা আমার দিকে এগিয়ে আসেন।
গম্ভীর ভাব নিয়ে প্রশ্ন করলেন,
বললে না তো মা তুই এখানে এভাবে বসে কাঁদছিস কেন???

আ…..মি…..
মুখ খুলতে যাওয়ার আগেই দোকানদার আমার মুখ থেকে কথা নেয়। ওনি বলা শুরু করেন,
” ভাবিসাব! এ আমার এক মা!
গ্রাম থেকে এসেছে চাকরীর খুঁজে।
চাকুরী ঠিক পেয়ে গেলেও কোনো বাসার সন্ধান পাইনি ও। আমি’ই ওকে এখানে বসিয়ে রেখেছি। ভেবেছিলাম দোকানপাট বন্ধ করে আপনার কাছে নিয়ে যাব ওকে। কিন্তু তার আগে’ই আপনি এসে গেছেন। এখন আপনি যদি আমার এই মা’টার জন্য কিছু করেন তাহলে বড় উপকার হতো। আপনি তো ভাড়াও দেন বাসা। যদি ওকে একটা রুম দিতেন.. ..?!!!”

দোকানি থেমে গেল এটুকু বলে।

মহিলাটি মিষ্টি হেসে বলল__
এভাবে বলবেন না ভাইজান! আপনার মা তো আমারও মা। আর ও ভাড়া কেন থাকবে? কোনো মেয়ে কি তার মা’কে নিজ বাসায় ভাড়া রাখবে???
ও আজ থেকে আমার এখানে’ই থাকবে। আমরা যা খায় তাই ও খাবে।
কি পারবি মা?
যাবি এই মায়ের সাথে???

কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম আমি। অজস্র জলরাশি চোখ থেকে গড়িয়ে পরছিল।
নাহ, এ জল বেদনার নয়!
এ জল আনন্দের।
এ আনন্দের জল। বহুদিন পর অচেনা কারো মাঝে মায়ের ছায়া দেখতে পাচ্ছি। তাই চোখ থেকে অজান্তেই সুখের দু’ফোঁটা আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পরছে……

কি হলো মা? যাবি না এ মায়ের সাথে?
মহিলাটির কথা শুনে চোখের অশ্রু মুছে নিলাম। মৃদু হাসি দিয়ে বললাম__
” যাব আন্টি….”

হুম, এবার তাহলে চল। রাত’তো অনেক হয়েছে। (ভদ্র মহিলা)
দোকানদারের থেকে বিদায় নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম।
এই হতচ্ছারা! এখানে দাঁড়িয়ে ফোন টিপবি নাকি বাসায় যাবি???(মহিলা)
ওহ, মা! লাগছে বলে পিছনে ফিরে তাকালো বাঁধন। আমায় দেখে চোখ বড় বড় করে বলল, আপনি???(বাঁধন)
জি, ও আজ থেকে আমাদের সাথে আমাদের বাসায় থাকবে। কেন? তুই চিনিস নাকি ওকে???(মহিলা)

না’তো…
আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলল বাঁধন। পিছন থেকে ওকে অনুসরন করে অচেনা মা-মেয়ের সাথে এক অচেনা গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলাম আমি।

চলবে……..

কৃষ্ণকলি পর্ব:- ০১

0

কৃষ্ণকলি
পর্ব:- ০১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ছয় বছর পর বাঁধনের সাথে দেখা। ভাবতেই পারিনি, ওর সঙ্গে এভাবে দেখা হবে।
এই ছয় বছরে অনেক বদলে গেছে বাঁধন। সেই চঞ্চল বাঁধন আর এখনকার শান্ত, সভ্য বাঁধনের মধ্যে অনেক তফাত।
আমি এই বিরতিতে বাঁধনকে প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেদিন পড়ন্ত বেলায় ওর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর জীবনের হিসাব কেমন যেন পাল্টে গেল।
মাথা নিচু করে রাস্তায় হাটছিলাম। হঠাৎ উপরের দিকে তাকাতেই বাঁধনকে দেখলাম।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম! কোনো দ্বিধা না করে বলে ফেললাম, কেমন আছেন?
ভালো। ছোট করে বলেই থেমে গেল বাঁধন। আমার মুখে তখন আর কোনো ভাষা ছিল না। কিছু সময় নিরবতা, তারপর আচমকা বাঁধনের মুখ থেকে বেরিয়ে আসল, আপনি? আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারিনি!!
স্মিতহাস্যে বললাম, কৃষ্ণকলি। “কৃষ্ণকলি”
আমার নাম।

অতীতে ফিরে গেলাম আমি। ২০১০সালে বাঁধনের সঙ্গে প্রথম পরিচয় আমার। পরিচয়টা ফেসবুকে’ই। তারপর ঘনিষ্ঠতা, ঘনিষ্ঠতা থেকে আন্তরিকতা। মনের অজান্তে’ই ওকে নিয়ে ভালোবাসার বীজ বপন করে ফেলেছিলাম। খুব বেশী ভালোবেসেছিলাম ওকে। এতটাই ভালো যা লিখে বুঝানোর মত নয়। সেও যে আমাকে ভালোবাসে নি, তাও কিন্তু নয়। বাঁধনও আমায় ভালোবাসত, কিন্তু কখনো বুঝতে দিত না। বুঝতে না দিলেও আমি ওর মনের না বলা কথাগুলো ঠিক বুঝে নিয়েছিলাম। রিলেশনের দু’বছরের মাথায় বাঁধন আমার কাছে একটা জিনিস চাই। আমার ছবি চাই। আমার কাছে বাঁধনের প্রথম আবদার, পূরণ করা’ই যেত। কিন্তু করিনি। বাঁধনকে ছবি দিতে অস্বীকার করলাম। প্রচন্ড অভিমানে বাঁধন আমার সাথে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেয়। তারপর অতিবাহিত হয়ে যায় দীর্ঘ একটা বছর।
সেদিন হসপিটালের বিছানায় আধাশোয়া অবস্থায় তন্ময় হয়ে মান্না দের গান শুনছিলাম। বাঁধনকে হারিয়ে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম আমি। অসুস্থ হয়ে পুরো একবছর মনোরোগ বিভাগে থাকতে হয়েছিল আমাকে। কয়েকদিন ধরে শরীরের অবস্থাও বেশী ভালো যাচ্ছিল না। বান্ধবীর জোরাজুরিতে একরকম বাধ্য হয়ে’ই তাই দু’দিন ধরে হসপিটালে আছি। গান শুনার ফাকে একসময় পাশের কেবিনের এক রোগীর সঙ্গে কথা বলছিলাম। হঠাৎ’ই ফোন’টা বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতে’ই মনে হলো চোখে কিরকম সরষে ফুল দেখছি। ফোন’টা চোখের কাছ থেকে আরো কাছে নিয়ে আসলাম।
চমকে উঠলাম। এ যে বাঁধন!
এতবছর পর কি মনে করে? কানে নিয়ে কথাটা বলতে’ই ও জবাব দেয়, তোমাকে দেখব। দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। তোমাদের এলাকার পরিত্যক্ত সেই জমিদারী আমলের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি, যেখানকার কথা তুমি প্রায়’ই বলতে। ৩০ মিনিটের ভেতর তুমি এখানে আসো, আমি তোমায় সামনাসামনি দেখতে চাই।

ফোনটা কান থেকে নামিয়ে ফেললাম। বান্ধবী ডাঃ নুসরাতকে বলেই ছুটে চললাম এলাকার দিকে। মিনিট দশেকের ভেতর পৌঁছে গেলাম কাঙ্খিত স্থানে। সি.এন.জি থেকে নামতেই দেখলাম একটা অচেনা যুবক গিটার হাতে দাঁড়িয়ে আছে অন্যমনস্ক হয়ে। বাঁধনকে চিনে নিতে আমার ভুল হয়নি, বুঝতে অসুবিধে হয়নি এই আমার বাঁধন! এক’পা দু’পা করে এগিয়েও পিছু হটলাম।
সেদিন বাঁধনের সামনে যেতে পারিনি। বাঁধন ছিল আমার কল্পরাজ্যের রাজকুমারের চেয়েও অনেক অনেক সুন্দর। এত সুন্দর-সুদর্শন যুবকের পাশে আমি যে বড্ড বেমানান। কারণ- আমি কালো। শুধু কালো নয়, অনেক বেশী’ই কালো। মনে ভয় ছিল এমন কালো চেহেরা নিয়ে ওর সামনে গেলে যদি ও ফিরিয়ে দেয়? যদি হারিয়ে যায় ভালোবাসার এই তীব্রতা’টুকু? তার চেয়ে ভালো ওর কাছে অপ্রকাশিত’ই থাকা। বাঁধন ফিরে গিয়েছিল সেদিন। এরপর হাজার চেষ্টা করেও ওর সাথে কথা বলতে পারিনি। পারিনি কোনো প্রকার যোগাযোগ করতে। আর করব’ই বা কিভাবে?
ও যে যোগাযোগের সব মাধ্যম’ই ছিন্ন করে দিয়েছিল। বন্ধ করে দিয়েছিল ফোন নাম্বার। ফেসবুকে ব্লক করে দিয়েছিল। অন্য আইডি খুলে নক করেছিলাম। যার কারনে আইডি’টাই ডিএক্টিবেট করে দেয়। এভাবেই আমার সব স্বপ্নের ইতি ঘটল। সাজানো স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণায় আবারো ছটফট করে উঠলাম।
~ কি হলো? বললেন না যে কে আপনি?
বাঁধনের কথায় ভাবনাচ্ছেদ হলো। ফিরে এলাম সুদূর অতীত থেকে আজকের এই নির্মম বর্তমানে। বাঁধনের দিকে তাকি বললাম, কৃষ্ণকলি।
বাঁধন বিরক্তিভাব নিয়ে বলল, কৃষ্ণকলি!
সে’তো গল্প-উপন্যাসে’ই মানায়। আপনি তো কোনো গল্প নন, তাই না? আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি কোনো গল্প বা উপন্যাসের কথা বলছি না। আর এটাও বলছি না আমি গল্পের নায়িকা।
আমার কথা শুনে বাঁধন বলল,
তবে আমি নিশ্চিত আপনি রবীন্দ্রনাথের সেই কৃষ্ণকলি….
বাঁধনের কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ ছিলাম।
বাঁধন নিরবতা ভেঙে বলল_
“তবে যায় হোক।
আমি মনে হয় ভুল কিছু বলিনি। আপনি’ই সেই কৃষ্ণকলি, যার রূপের বর্ণনা রবীন্দ্রনাথ ওনার কবিতায় চমৎকার ও সুচারুভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।”
বাঁধনের কথার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ওর তুড়ির আওয়াজে দিশা হয়। সামনের দিকে তাকালাম।
– এ এলাকায় নতুন?
বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বললাম, জি!
আজ’ই এসেছি এখানে।
– ওহ! কোথায় উঠেছেন?
জবাব দিলাম, আপাতত বান্ধবীর বাসায় আছি। বাসা খুঁজে পেলে’ই ওখান থেকে চলে যাব। আপনি?
আপনিও এখানকার…..(……)…..???
আমার কথা শুনে মৃদ্যু হেসে বাঁধন বলল, নাহ! আমি ভাড়াটে নয়। এ এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা আমি। ঐ যে সামনে যে বাসাটি দেখছেন সেটাই আমাদের বাসা। কোনো প্রয়োজন হলে জানাবেন। যথাসাধ্য চেষ্টা করব সাহায্য করার। এখন আসি।
আল্লাহ হাফেজ।

বাঁধন চলে যাচ্ছে।
একটু একটু করে দুরে চলে যাচ্ছে।
আমি নির্বাক দৃষ্টিতে ওর সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি….

চলবে…..