Friday, August 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2005



তিলেত্তমা পর্ব ১০

0

তিলোত্তমা
পর্বঃ ১০

দিবস বোধহয় তখনো তার সেই ভাইয়ের কথাই বলে যাচ্ছিলেন, আমার কানে ঢোকেনি সেসব। বুকের ভেতর সব ভেঙেচুরে যাক, এই পাবলিক প্লেস-এ, এত এত মানুষের মাঝখানে সেটা প্রকাশ করার তো আর কোনো মানে হয়না! টেবিলে রাখা টিস্যুতে চোখজোড়া মুছে নিয়ে তাই মনোযোগ দিয়ে সামনে তাকিয়ে থাকার ভান করি। অভিনয়টা বোধহয় আজও রপ্ত করতে পারিনি, কয়েক মুহূর্ত বাদেই ধরা পড়ে যেতে হয়।

-‘কী হলো? are you feeling sick, রাত্রি?’- দিবসের প্রশ্নাকুল চোখজোড়া আমার মুখের ওপর স্থির নিবদ্ধ হয়ে আছে।

-‘ন…না, না! ডিউটি শেষে এলাম তো, তাই…’

-‘ওহ! আচ্ছা দিব্য আসতে আসতে আমরা কোল্ড ড্রিংকস অর্ডার করি তাহলে? ফোনটাও তুলছে না, কখন আসবে তাও জানার উপায় নেই!’

আমি ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাতে দুটো কোল্ড ড্রিংকসের অর্ডার করেন দিবস। তারপর নিতান্ত সহজ গলাতেই প্রশ্ন করেন-

-‘আচ্ছা, সেদিন নিশার কথার তোড়ে তো আর আপনাকে সব খুলে বলাই হয়নি! আমরা দুই ভাই, এক বোন। দিনা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছে। আর, দিব্য আমার বছর দুয়েকের ছোট… পেশায় আইনজীবি। উম..ম দেখতে টেখতে এই আমারই মত হবে ধরুন। আমি তো ছবি দিয়েছিলাম আন্টিকে, দেখেছেন নিশ্চয়ই?’

মনে মনে আরেকজনের ছবি এঁকে রেখেছি বলে সে ছবি আর দেখা হয়ে ওঠেনি। মুখ ফুটে এই কথাটুকু বলতেও বাঁধছে। তাই ঘাড় নেড়ে মিথ্যে সম্মতি জানালাম কেবল।

-‘ওহ, তাহলে তো দেখেছেন ই! আপনার কথা ওকে গতকাল ই বলেছি কেবল, বুঝলেন? ছোটবেলায় খুবই দুষ্টু ছিলো ছেলেটা, বড় হয়ে কেমন নিজের ভেতর গুটিয়ে গেছে! একলা একলাই থাকে, কারো সাথে খুব একটা মেশে-টেশে না। তবে আমায় খুব মানে! আসলে বাবা মারা যাবার পর খুব কষ্ট করে ওদের পড়ালেখাটা চালাতে হয়েছে আমাকে… তখন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। টিউশন আর পার্টটাইম জব করে কোনোমতে সংসারটা চালাতে হয়েছে, এর মধ্যেও ওদের পড়ালেখার ওপর এতটুকু আঁচ লাগতে দিইনি আমি আর মা। সেই তখন থেকেই দিব্যটা আমার খুব ভক্ত, বুঝলেন! আমার কোনো কথা কোনোদিন অমান্য করে না ছেলেটা…’

একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখজোড়া জ্বালা করছিলো আমার। বুকের ভেতর মরুভূমির হাহাকার, চোখ জুড়ে অনল দহন আর মন গহীনে ‘মিছিমিছি’র ক্রমাগত তাড়না- ‘বলে দে রাত্রি! এখন না বলিস তো সব ঘেঁটে যাবে… বলে দে সব!’ আমায় আর স্থির থাকতে দিলো না। দিবসের কথা শেষ না হতেই ফস করে বলে বসলাম-

-‘সেজন্যেই বুঝি আপনার ভাইয়ের ঘাড়ে আমায় গছিয়ে দিচ্ছেন? আপনার কথা ফেলতে পারবেনা, তাই না চাইলেও বাধ্য হয়েই আমায় ঘাড়ে করে নিয়ে ঘুরতে হবে!’

হঠাৎ ব্রেক কষা একটা গাড়ির মত থেমে গেলেন দিবস। চশমার আড়াল থেকে পিটপিটিয়ে চেয়ে রইলেন খানিক, বোধহয় কিছু ভাবলেন। তারপর ধীর গলায় বললেন-

-‘গছিয়ে দিচ্ছি মানে? রাত্রি, আপনি কোনো জড়বস্তু নন যে আপনাকে যার ঘাড়ে খুশি গছিয়ে দেয়া যাবে!’

-‘তাই? এ কথাও আপনারা জানেন? অথচ একেকসময় নিজেকে একটা লাথি খাওয়া ফুটবল বলে মনে হয় আমার, বুঝলেন! ৯০ মিনিট জুড়ে বেচারি বলটা কেমন পায়ে পায়ে ঘুরতে থাকে, কেউই ওটাকে নিজের কাছে একদণ্ড রাখতে চায়না। ঠিক আমার মতন। যত দ্রুত সম্ভব আমায় হাত বদল করতে পারলে মা শান্তি পান, তাই কোত্থেকে ধরেপেড়ে ঐ কাউসারালীকে নিয়ে এলেন! আবার নিশার জন্যে করছি বলে সে ঋণ মেটাতে এবারে আপনি নিজের ভাইটাকে বলির পাঁঠা করলেন! আমায় চেনেনা-জানেনা অথচ আপনার একটা কথাতেই আপনার বাধ্যগত ভাইটি দিব্যি আমায় বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলেন! স্বেচ্ছায় নয়, কেবল আপনার কথায়। না সে আমায় চেনে না আমি তাকে চিনি-জানি, ঐ বেচারার গলায় কেনো আমাকে ঝুলিয়ে দেবার মতলব করছেন বলুন তো? যেনো মাঠে ফেলে রাখা একটা ফুটবল আমি, যে যেভাবে পারছে, যাকে পারছে ball pass করছে… অথচ মা চাইলেই আমায় দুদণ্ড শান্তি দিতে পারতেন! আর আপনিও হয়তো…’

কথা আর কী বলব ছাই, নাকের জল চোখের জলে মাখামাখি হয়ে বসে আছি! দিবস সম্ভবত হতবাক হয়ে আমার দিকে দেখছেন, এক-দু’বার চোখ পড়েছিলো ওঁর দিকে। নাহ, শুধু শুধু এভাবে সিন ক্রিয়েট করার মানে নেই। ওড়না চেপে মুখটা মুছে উঠে দাঁড়ালাম-

-‘যাই হোক! আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, আমার একটা গতি করতে চাইবার জন্যে। কিন্তু, এই বিয়েটায় আমার মত নেই… কিছু মনে করবেন না। অকারণে একজনের ঘাড়ের বোঝা হয়ে থাকবার চেয়ে এই এখনই বেশ ভালো আছি! আসছি…’

বাসায় ফেরার আর কণামাত্র ইচ্ছে অবশিষ্ট ছিলোনা। বাসা ভর্তি মানুষজন গিজগিজ করছে। এই বিয়েটা ভেঙে গেছে শুনলে বড়খালা, ফুপু আর মা মিলে আরেক গজব নামিয়ে আনবে। এই বিদ্ধস্ত মনটা এসব আর সহ্য করতে পারছে না! জন্ম জন্মান্তর ধরে কেবল সয়েই যাচ্ছি… আর কতো?

নিশিতাকে ফোন দিয়ে ওর হোস্টেলে যেয়ে উঠলাম ক’দিনের জন্যে। মেডিকেলে আমার ঠিক পরের রোলটাই ছিলো নিশিতার, সেই সূত্রে মোটামোটি একটা ভাল বন্ধুত্ব রয়েছে আমাদের। মা’কে ফোন দিয়ে জানিয়ে দিলাম কাজের প্রচণ্ড চাপের কারণে সপ্তাহখানেকের মত বাসায় যেতে পারবোনা, বিয়ের আলাপটা ততদিন পিছিয়ে থাকুক। ফোনেই ব্যাপক হম্বিতম্বি করছিলেন মা, পারেন তো তখনি দিবসকে ফোন দিয়ে বসেন! পরে বাবাকে দিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মা’কে থামানো গেছে। সপ্তাহখানেকের মধ্যে বড়খালা আর ফুপু চলে গেলে পরে সবটা খুলে বলতে হবে বাসায়, তার আগ পর্যন্ত এই হাতেগোনা পাঁচ-ছয়টা দিন কেবল আমার একলার, একটু নিশ্চন্তে নিঃশ্বাস ফেলবার!

ছোটোখাটো আঘাত আজকাল মনটাকে কাবু করেনা আর, সইতে সইতে সয়ে গেছে সেসব। কিন্তু, আজকে ভীষণ মন খারাপের মেঘ জমেছে বুকের ভেতর। একটু একলা থাকা খুব জরুরি… দু’দিনের জন্যে ছুটি নিয়ে নিলাম হসপিটাল থেকে। এই দু’দিন কেবল মন ভালো করার দিন। যা ইচ্ছে, যা খুশি করবার দিন!

-‘রাত্রি! অ্যাই রাত্রি! ওঠ… দেখতো কে এসেছে! নিচ থেকে সিকিউরিটি ইন্টারকমে কল করেছে, কে এসেছে তোর কাছে!’- গুনে গুনে দুইটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে মরার মত ঘুমিয়ে গেছিলাম গতকাল রাতে। যা খুশি করার দুই দিনের মধ্যে একদিন পার হয়ে গেছে কেবল কী করবো কী করবো ভাবতে ভাবতেই। মন খারাপ ভাবটা কাটবে কী উল্টে আরও বেড়েছে! সারাদিন বেকার বসে থেকে রাতে একদমই ঘুম আসছিলো না, তাই ঘুমের ঔষধ খেয়েছিলাম। এই প্রথমবার খেলাম বলেই কিনা কে জানে, একেবারে অজ্ঞানের মত ঘুমিয়ে ছিলাম গোটা রাত এমনকি পরের দিনের সকালটাও। বেলা বারোটায় নিশিতার ডাকে কোনোমতে চোখ মেলে তাকাই, এখানে আবার আমার খোঁজে কে আসবে!

-‘কে এসেছে নিশি? চলে যেতে বল গিয়ে যা… বল আমি ঘুমাবো এখন!’

-‘ধুর ছাই! আমি চিনি নাকি তোর কে এসেছে… রাইয়্যান না কি জানি নাম বললো…’

এক মুহুর্তে ঘুমটুম সব উধাও হয়ে যায় চোখ থেকে। লাফিয়ে উঠে ইন্টারকমের হ্যান্ডসেটটা কানে লাগাই-

-‘দিবস রাইয়্যান কী আফনের লোক?’- সিকিউরিটি গার্ডের কাটাকাটা কণ্ঠটা ভেসে আসে তার বেয়ে।

-‘হ্যাঁ! দিবস রাইয়্যান আমার… আমার লোক! দাঁড়াতে বলুন, আসছি আমি!’

ধুপধাপ করে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে, গায়ে কোনোমতে একটা ওড়না জড়িয়েই সিঁড়ি বেয়ে দৌড় লাগালাম। টের পেলাম- বুকের ভেতরের দ্রিমদ্রিম বেজে চলা ঢাকের ডাকটার সাথে সাথে মনটাও তাল দিয়ে নাচতে চাইছে!

মন কি তবে এই আশাতেই বসে ছিলো? একজনের আগমনে বৃষ্টি ঝরাবে বলে সেই অপেক্ষাতেই মেঘ জমিয়ে রেখেছিলো নিজের ভেতর?

-‘নিশা বারবার আপনার খোঁজ করছিলো…’

নিচে নামতেই দিবসের দেখা পাই, গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে। পাশে যেয়ে দাঁড়াতেই চমকে তাকিয়ে একটা সরলরৈখিক হাসি দিয়ে চট করে মাথাটা নামিয়ে নিলেন। এরপর থেকে কেবল হেঁঁটে চলেছি নির্বিকার দু’জনে। কারো মুখে কোনো কথা নেই! বেশ অনেকদূর আসবার পর এই মহামূল্যবান বাক্যখানার বিচ্ছুরণ হলো দিবসের কণ্ঠনালী বেয়ে।

ওহ! তবে এই কথা! নিশা খোঁজ করছে বলে নিশার বাবার আজ এখানে আগমন! আর কিছু নয়… কিচ্ছুনা!

-‘বেশ তো! সে তো ফোনে বললেই পারতেন…’

-‘ফোন তুলছিলেন না আপনি, বেশ ক’বার রিং হবার পর আপনার বান্ধবী ফোনটা তোলেন। উনার থেকেই ঠিকানাটা পেলাম…’

-‘ওহ! ঘুমিয়ে ছিলাম আসলে। আচ্ছা, এবারে তো জানলাম, কাল আসবো বলে দিয়েন নিশাকে।’

এরপর আবার নিস্তব্ধতা। যেন দু’জন অচেনা মানুষ হেঁটে চলেছে কেবল, কারো কিছু বলবার নেই। প্রবল আশায় মনটা জেগে উঠলেও টের পাচ্ছি শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি এখনো সজাগ হয়ে ওঠেনি পুরোপুরি। আরো খানিকটা ঘুমের প্রয়োজন। নীরবতা ভাঙার দায়িত্বটা অবশেষে তাই আমি ই নিলাম-

-‘আমার ঘুম পুরো হয়নি বুঝলেন! আরেকটু বোধহয় ঘুমানো দরকার… আসছি তবে?’

হাঁটতে হাঁটতে একটা পার্কের মত জায়গায় এসে থেমেছি। লাল লাল ফুলে ছেয়ে যাওয়া একটা কৃষ্ণচূড়া গাছের ঠিক তলাটায় দাঁড়িয়েছেন দিবস। ফ্রেমলেস চশমাটা হাতে নিয়ে অকারণেই শার্টের কোনা দিয়ে ঘষাঘষি করে ওটার ছাল-চামড়া একেবারে তুলে ফেলছেন। চিরাচরিত চশমার আবরণহীন চোখজোড়া দিয়ে সরাসরি আমার চোখ বরাবর তাকিয়ে আবৃত্তির মত সুরে প্রশ্ন করলেন-

-‘দুইটা মিনিট সময় হবে? Just two minutes?’

আমার বোধহয় ঘুমের তোড়ে মাথার ভেতর সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নেশাগ্রস্থের মত ঐ চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম-

‘তোমার জন্যে অনন্তকাল সময় হবে আমার’
অ-ন-ন্তকাল… বোঝো?’

এতকাল এরকম কতশত কথা মনে মনে বলে গেছি একা একা! কোনোদিন মুখ ফুটে বলবার সাহস হয়নি। আজকে নিশ্চিত কোথাও কিছু একটা ওলট-পালট হয়ে গেছে!

দিবস সেকথা শুনতে পেলেন কী না কে জানে! একদিকে সর্বশক্তি দিয়ে মনটা জেগে থাকার তোড়জোর করছে অন্যদিকে প্রচণ্ড ঘুমে আমার চোখ জড়িয়ে আসছে বারবার। দুইয়ের মাঝামাঝি কিছু একটা বেছে নিতে হবে তাই ধপ করে গাছের নিচে বসে পরলাম। দিবসও উপায়ন্তর না দেখে পাশে এসে বসলেন। তারপর ধীর গলার মেঘ গমগম কণ্ঠটা ভেসে এলো কানে-

-‘না জেনে-বুঝে অযথাই আপনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি, রাত্রি! আপনি যেরকম ভাবছেন ব্যপারটা আসলে সেরকম না, তবুও কোনোভাবেই আপনাকে না জানিয়ে দিব্যর সাথে আপনার বিয়ের বিষয়টা নিয়ে কথা বলা আমার একদমই উচিত হয়নি। আমার নাহয় ছোট ভাই, কিন্তু আপনার কাছে তো দিব্য একেবারে অচেনা- এটা আমার বোঝা দরকার ছিলো! আমি জানিনা আমার এখন এই কথাটা বলাও উচিত হচ্ছে কি না…’

দিবস আবৃত্তির সুরে বলেই যাচ্ছিলেন। দিবসের কথার মাঝামাঝি কোনো এক জায়গায় এসে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বেঘোরে ঘুমিয়ে পরি আমি। ঘন্টা পাঁচেক বাদে ঘুম ভেঙে নিশিতার ঘরে আবিষ্কার করি নিজেকে, ততক্ষণে প্রায় সন্ধ্যে হয়ে গেছে। এরপর অনেকবার চেষ্টা করেও মনে করতে পারিনি ঠিক কী কী বলছিলেন সেসময় দিবস। কেবল স্বপ্ন দেখার মত করে কিছু শব্দ এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতর, পুরো কথাটা কিছুতেই মনে করতে পারছিনা! উচিত-অনুচিত, চেনা-অচেনা, দিব্য-দিবস… ধুর ছাই! কীজানি কী বলছিলেন কে জানে! সে নাহয় নাই মনে পরলো, আমি নিজেও কীসব ছাতামাথা যেনো বলেছিলাম- সেগুলোর এক বর্ণও মনে পরছে না একদম! ঘুমের ঘোরে কী যে বলেছি, আর সেসবের কতখানিই যে দিবসের কানে গেছে খোদা জানেন! সেদিন রাতে ঘুমটা পুরোপুরি কেটে গেলে প্রায় গোটা রাতটাই মাথার ভেতর হাতড়ে হাতড়ে মরেছি, কোনোকিছুই পুরোপুরি মনে পরেনি।

আজকে দুপুরে নিশার চোখের অপারেশনটা করা হবে। সকাল থেকেই মেয়েটার পাশে বসে আছি, সে শুধু নিশা আমাকে ওর মাম্মাম ভেবে ভুল করছে বলে নয়। সত্যি বলতে এই ক’দিনে মাতৃহীন বাচ্চাটার প্রতি আমার নিজেরই কেমন একটা অদ্ভুত মায়া পরে গেছে! তাছাড়া, আর দু-একদিন বাদে তো চলেই যাবে মেয়েটা, আর হয়তো দেখা ই হবে না! পৃথিবী যতই গোল হোক, এই ছোট্ট একটা জীবনে একবার হারিয়ে ফেলা মানুষেরা আর দেখা দেয়না।

আজকেই নিশার দাদীর সাথে পরিচয় হয়েছে আমার। ভদ্রমহিলা খুবই অমায়িক এবং উনিই হচ্ছেন এই বাপ-বেটির হিজল চোখের আসল উৎস! অর্থাৎ, উনার DNA থেকে এই চোখ পেয়েছেন দিবস এবং তার থেকে পেয়েছে নিশা! কিছু কিছু মানুষ হয়না? একেবারে সরল-সোজা, একদিনের মধ্যেই যারা অন্যকে একেবারে আপন করে নেয়? উনি ঠিক ঐরকম! নিশা যখন বারবার মাম্মাম বলে ডাকছিলো আমাকে, একবার তো উনি ভুলে বলেই বসলেন- ‘তোমার সন্ধান যদি আগে পাইতাম মা, তাইলে নিশার এই ডাকটা আজকা সত্যিই হইতো!’

আমার কি তখন খানিক হৃদকম্প হয়েছিলো? মনে মনে আমি কি উত্তর করেছিলাম- ‘এখনো সময় ফুরোয়নি! এইতো সন্ধান পেলেন, এবারে সত্যি করে দিন না!’

হয়তো বলেছিলাম, নয়তো না! ইদানিং অনেক কিছু কেমন যেন ভুলে ভুলে যাই আমি। মনটা সারাদিন এত এত কিছু কল্পনা করে, এত এত কিছু ভাবে যে সত্যি মিথ্যা, বাস্তব–কল্পনা সব কেমন গুলিয়ে যায় আমার!

দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই নিশার অপারেশনটা ভালয় ভালয় শেষ হয়। ঠিক তিন দিন পর, অবজারভেশন শেষে ওর চোখের ব্যান্ডেজটা খোলা হবে।

সবার কথাই তো বলছি, দিবস বাদ যাবে কেন? সেই যে সেদিন কৃষ্ণচূড়ার নিচে টুপ করে ঘুমিয়ে গেলাম, সেদিনের পরে আমি একরকম এড়িয়েই চলেছি লোকটাকে। যে সুতো ছিঁড়ে গেছে শুধু শুধু তাকে বুনে চলার তো আর মানে হয়না! নিশার অপারেশনের দিনে তো টেনশনেই সবার হ-য-ব-র-ল অবস্থা, সেদিনটা এভাবে ওভাবেই কেটে গিয়েছিলো। এরপর এই দুইদিনও একটা চাপা টেনশন কাজ করেছে সবার ভেতর, সব ঠিকঠাক থাকবে তো? ব্যান্ডেজ খোলা হলে নিশা ঠিকঠাক দেখতে পারবে তো? এর মধ্যেও যে দুই-চারবার দেখা হয়েছে দিবসের সাথে, মাথা নিচু করে ওঁকে এড়িয়ে অন্য কোথাও চলে গেছি আমি।

আজকে সকাল থেকে একটা চিন্তার পাথর চাপ দিয়ে বসে ছিলো বুকের ভেতরটায়। বিকেলে ব্যান্ডেজ খোলা হলে যখন প্রথমবারের মত স্পষ্টভাবে দুনিয়াটা দেখতে পেলো মেয়েটা, টুপ করে কোথাও হারিয়ে গেলো চিন্তাপাথরটা! কোনোদিকে না তাকিয়ে ‘মাম্মাম’ বলে সোজা আমার কোলে ঝাঁপিয়ে পরলো মেয়েটা। চোখভর্তি পানি নিয়ে আমি আবিষ্কার করলাম আমার কোলজুড়ে আলো করা একটা ছোট্ট মেয়ে! কী ভীষণ সুন্দর একটা অনুভূতি!

মাতৃত্বের অনুভূতি বুঝি একেই বলে?

কিন্তু তীব্র আনন্দের সাথে কি একটুখানি আফসোস আর একটুখানি অপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা মিশে নেই আমার ঐ চোখভর্তি জলে? আর তো মাত্র কয়েকটা ঘন্টা, তারপরেই নিশাকে রিলিজ দিয়ে দেবে হসপিটাল থেকে। একেবারে চিরতরে হারিয়ে যাবে এরা আমার এই ক্ষুদ্র, তুচ্ছ জীবনটা থেকে! বড় সাদাকালো এই জীবনে একমুঠো আবির ছড়িয়ে দিয়েছিলো যে মানুষগুলি, তাদের ধরে রাখবার ক্ষমতাটুকুও বুঝি বিধাতা আমায় দেন নি? হায় খোদা! কী ভীষণ নিস্তরঙ্গ, একাকী একটা জীবনগল্প লিখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এই দুনিয়াটার বুকে আছড়ে ফেললে তুমি আমায়! মনে মনে একশোবার অন্তরীক্ষে আবেদন করি- এ গল্পের মোড় কি ঘুরবে কোনোদিন নাকি এই প্রচণ্ড একলা জীবনটাকে বয়ে নিয়ে শেষমেশ একদিন অসীমে বিলীন হয়ে যেতে হবে আমায়- অন্তত সেটুকু তো জানিয়ে দাও! তাহলে আর মিছে আশা করে করে বারবার ঠকতে হবে না।

আমার সে আবেদনের কোনো জবাব আসে না। বুকের ভেতরে সঞ্চিত সবটুকু রঙ শুষে নিয়ে পরদিন তাই নিশা চলে যায় ওর বাপির হাত ধরে। আমার জন্যে পরে রয় হাসপাতালের রঙচটা দেয়াল, বুকভর্তি কৃষ্ণচূড়ার মত থোকা থোকা স্মৃতি আর ঘুণে খাওয়া একলা জীবন।

তিলেত্তমা পর্ব ৯

0

তিলোত্তমা
পর্বঃ ৯

নিশার অপারেশনের ডেট ফিক্সড হয়ে গেছে, আগামী মঙ্গলবার সকালে। আজ শুক্রবার… মাঝে কেবল তিনটা দিন বাকি! প্রতি শুক্রবার নাকি নিশাকে নিয়ে বেড়াতে যাবার অলখিত নিয়ম রয়েছে বাপ-বেটির চুক্তিতে, পাকেচক্রে এবারে আমিও ওদের মাঝে ঢুকে গেছি! গতকালই নিশা বারবার বলেছে মাম্মামকে ছাড়া এবার বেড়াতে যাবেনা সে, দিবস অনেকবার চেষ্টা করেও মেয়ের মন গলাতে পারেননি! হাঁদারামটা যদি বুঝতো ওদের সাথে দুটো মুহূর্ত বেশি কাটাবার জন্য ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছি আমি! এই রুটিন করা একঘেয়ে জীবনটা একটা সমতল রাস্তার মতো চলছে বহুদিন, বহু বছর ধরে… এক টুকরো পাহাড়ি ঢাল হয়ে এসেছে এই দু’জন, কাঙাল মনটা তাই দুটো মুহূর্ত হলেও বেশি থাকতে চায় এদের সাথে। জন্ম জন্মান্তর ধরে আমি যে একটুখানি ভালবাসার, একটুখানি মানবসঙ্গের বড় কাঙাল!

সে যাইহোক, শেষমেশ আজ বেরিয়েছি তিনজনে মিলে। গন্তব্য শিশুপার্ক, আমাদের হসপিটালের একেবারে কাছাকাছিই জায়গাটা। বেছে বেছে নিরাপদ রাইডগুলিতেই উঠানো হলে নিশাকে, বাধ্য মেয়ের মত শক্ত করে রাইড ধরে বসে ছিলো প্রতিবারই সে। ধীরগতির টয় ট্রেনে নিশাকে বসিয়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, দিবস হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন-

-‘ আচ্ছা,আমায় তো আর আপডেট জানালেন না! আপনার সেই কাউসারালীর পরে কী হলো?’

-‘ওহ! আমার ঘাড় থেকে সে ভূত তো আপনি নামিয়ে দিলেন! কিন্তু মা’র ঘাড় থেকে এখনো নামেনি, উলটে আরো দুচার’জন সঙ্গী জুটিয়ে নিয়েছেন মা! সবাই মিলে মাথার পোকা নাড়িয়ে দিচ্ছে এখন!’

-‘অদ্ভুত সমস্যা! এই ছেলের মধ্যে আপনার মা ঠিক কী খুঁজে পেলেন…’

-‘সমস্যাটা আসলে অন্য জায়গায়। মা’র মূল চিন্তাটা হচ্ছে তার কালো মেয়েকে যেভাবেই হোক পাত্রস্থ করা। অনেক খোঁজাখুঁজির পর এই একজন পাওয়া গেছে… তাকেও হেলায় হাতছাড়া করলে হয়তো আজীবন আইবুড়ো থাকতে হবে আমার। এই ভয়েই…’

-‘বিয়ে করতেই হবে, এমন দিব্যিই বা কে দিয়েছে? নাইবা করলেন বিয়ে!’

-‘সে গিয়ে আমার মা’কে বুঝিয়ে আসুনগে যান! আর সত্যি বলতে…’

দিবসের প্রশ্নাকুল চোখজোড়ায় এক ঝলক তাকাই। পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে মাটির দিকে নিয়ে যাই। নাহ! বেশি সময় ঐ চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলে বরবাদ হয়ে যেতে হবে!

-‘সত্যি বলতে, একটা ছোট্ট, সুন্দর, একেবারে নিজের একটা পরিবারের শখ তো সব মেয়েরই থাকে। এই প্রকাণ্ড পৃথিবীটার বুকে একেবারে নিজের একটা ঘর, নিজের কয়েকটা আপনজন থাকবে- প্রাণী মাত্রই এইটুকু চাওয়া, এই প্রবৃত্তি- এটা তো প্রকৃতির ই নিয়ম। এবারে, কারো কোষে কোষে মেলানিন বেশি কি কম, তা দেখে তো আর এই প্রকৃতি তার নিয়ম বদলাবে না…’

আমি টের পাই ঐ চোখজোড়া কিছুটা চমকে গেছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকার আপ্রাণ ইচ্ছেটাকে গলাটিপে ধরে দাঁড়িয়ে রই।

-‘যদি কিছু মনে না করেন, একটা প্রশ্ন করতে পারি?’

-‘হ্যাঁ! অবশ্যই!’

-‘আপনার নিজস্ব কোনো পছন্দ-অপছন্দ আছে? মানে, ঐ প্রেম-ট্রেম আরকি…’

-‘হাসবো না কাঁদবো বলেন দেখি! জীবনে সর্বসাকুল্যে এসেছে দু’জন- একজন তো সেই সাত বছর আগে দু’দিনের জন্য এসে জন্মের মত শিক্ষা দিয়ে গেছিলো… আরেক নমুনাকে তো নিজের চোখেই দেখলেন সেদিন। প্রেম নামক ডেজার্টটার সবচেয়ে crucial ingredient কী বলেন দেখি?- মেলানিন! আপনার গায়ের ভেতর এই ingredient যত কম, আপনার প্রেম হবার সম্ভাবনা তত বেশি!’

দিবস খানিকক্ষণ মাথা নিচু করে কী একটা ভাবেন। আড়চোখে তাকিয়েও ঐ চোখজোড়া দেখা যাচ্ছেনা আর…

-‘যদি কিছু মনে না করেন তো, আমি আপনার মায়ের সাথে কথা বলতে চাই এই ব্যাপারটা নিয়ে… মানে অবশ্যই আপনার পারমিশন নিয়ে!’

-‘হাজার বোঝালেও মা বুঝবেন না! মায়ের চোখে কাউসারালী যোগ্য সুপাত্র…’

-‘যদি তারচেয়েও যোগ্য, সুপাত্রের সন্ধান পান আপনার মা, তখন?’

হৃদপিণ্ডটা ধপাস করে আধাহাত লাফিয়ে গলার কাছে চলে আসে। ঢোঁক গিলে সেটাকে জায়গামতো বসিয়ে নিয়ে বললাম-

-‘বেশতো… কিন্তু আপনি কেন শুধু শুধু এত খাটনি করতে যাবেন?’- ততক্ষণে নিশা নেমে এসেছিলো। ওকে নিয়ে হালকা গতিতে হাঁটছিলাম।

-‘আপনি যেজন্যে নিশার জন্য “শুধুশুধু খাটনি” করে যাচ্ছেন সেজন্যে! আর, তাছাড়া এতে আমারো কিছু লাভ আছে বলেই…’

-‘বাপি, আইস্ক্রিম খাবো!’- নিশার আবদারে বাকি কথাটুকু চাপা পড়ে যায়।

আচ্ছা? যে অবিশ্বাস্য সম্ভাবনার কথা মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছে, তাও কি কখনো সম্ভব?

‘হতেও তো পারে!’- মিছিমিছি ফিসফিস করে বলে।

-‘না মিছিমিছি! একদমই না! অনেক দিন আগে একবার ইট, বালু, সিমেন্টের যোগাড় না করেই খেলাঘর বানাতে বসেছিলাম, মনে নেই কী হলো সেবার? আর না! কপালে যা আছে তাইই হবে এবার! সে যদি কাউসারালী হয়, তবে তাই! তবু একলা একলা নিজের মনে খেলাঘর পেতে বসবোনা আর, এই বিষয়টা নিয়ে আর একটা শব্দও ভাববোনা…’

কিন্তু মনের ওপর বুঝি কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে? দুরন্ত, অবাধ্য মনটা যখন খুশি যেখানে খুশি উড়ে বসে যা খুশি তাই কল্পনা জুড়ে দেয়… তারে বাঁধবার মতো খাঁচার সন্ধান তো আমার জানা নাই!

তবু মনটাকে চেপেচুপে বেঁধে রাখবার মিছে চেষ্টা করে করে দিনটা কাটিয়ে দিলাম। আজকের দিনটা বড় ভালো কাটলো আমার! জীবন মাঝে মাঝে এক-দু’মুঠো সুখের কণা মনের ভুলে আমার দিকেও ছুঁড়ে দেয় তবে!

-‘এ তো খুবই ভাল প্রস্তাব! ছেলে ব্যারিস্টার! চেহারাও মাশাআল্লাহ ভালো… তা এমন রাজপুত্র আছে বইলাই বুঝি ঐ কাউসাররে পছন্দ হয়নাই তোর মেয়ের!’- বাসায় ঢুকতেই বড়খালার গলা কানে এলো আমার।

হৃদযন্ত্রটা গুনে গুনে দুই সেকেণ্ডের জন্যে থেমে গেলো। এর মধ্যেই খুশিখুশি চেহারায় মা’কে এগিয়ে আসতে দেখলাম।

-‘হ্যাঁ রে রাত্রি! এত ভাল একটা প্রস্তাব আসবে জানলে আমিই কি ছাই ঐ কাউসারালীর জন্যে মাথার পোকা নাড়িয়ে দিতাম নাকি তোর! তা বেশ, আমাদের এদিক থেকে তো সব আলহামদুলিল্লাহ, তোর বাবাও মত দিয়েছেন। এবারে শুধু ফরমাল দেখা সাক্ষাতটাই বাকি। আমি বলি কী শুভ কাজে আর করতে নেই, কে কখন কোনদিক দিয়ে চোখ নাচানি, কান ভাঙানি দেয়! দিবসকে বলে দিয়েছি কালকেই আমরা দেখাসাক্ষাৎ পর্বটা শেষ করে ফেলতে চাই। কিন্তু, তা ছেলের ফ্যামিলি নাকি ঢাকার বাইরে থাকে, তাদের আসতে আসতে আগামী সপ্তাহ হয়ে যাবে… পরে ঠিক হলো কালকে কেবল তোরা-তোরা দেখা করে আয় গিয়ে, এরপর আমরা নাহয় আগামী সপ্তাতেই কথাবার্তাটা এগিয়ে নেবোখন…’

মা নির্ঘাত ভয় পাচ্ছেন কখন আবার ছেলেরা বিগড়ে বসে কিংবা অন্য কেউ তাদের সুন্দরী কন্যাটিকে সাজিয়েগুজিয়ে নিয়ে এসে মায়ের কালো মেয়েটার বিয়ে ভেঙে দেয়! তাই এর তাড়াহুড়ো করে একেবারে কালকেই তারিখ ঠিকঠাক করতে বসে যেতে চাচ্ছেন। ভালো প্রস্তাব পাওয়া গেছে এবারে যত দ্রুত সম্ভব আপদ বিদেয় করা আরকি!

-‘বড় মাছ জালে আটকাইছে, এখন কি আর কাউসার রে ভাল্লাগবে সোহেলী? তা একসময় আবার ঐ কাউসারই শেষ ভরসা ছিলো… যাকগা যা হইসে হইসেই। ভাল খবর, খুশির খবর শুনে খুশিই হইলাম। তা বলি কি যত তাড়াতাড়ি পারো জাল টেনে ডাঙায় তুইলা নেও, নায়তো পরে মাছে জাল কেটে বেরোয়ে গ্যালে তো আবার সেই গুঁড়াচিংড়ি কাউসারালীরেই সাধাসাধি কর‍তে হবে!’- ফুপুর ঠেস দেয়া কথাগুলিও আজ বড় মধুর শোনাচ্ছে! মা বোধহয় সেজন্যেই হেসে হেসে উত্তর করলেন-

‘হ্যাঁ শায়লাপা, রূপ না থাকলেও মেয়ের আমার কপাল আছে ভালো বলতে হবে! তা বড় মাছ ধরতে জালখানাও বড় হতে হয়, গুঁড়াচিংড়ির জাল তো আর আমার মেয়ে নয়! ডাবল গোল্ডেন পাওয়া, ডাক্তারি পাশ করা…’

মা তার মেয়ের গুনগান গেয়ে চলেন। আমি মনে মনে হাসি। এই মা-ই দু’দিন আগে কাউসারালীর জন্যে জানপ্রাণ দিয়ে দিচ্ছিলেন, কেবল একটা ডাক্তারি ডিগ্রির জন্যে আমার এত দেমাগ কেনো তাই বসে বসে ভাবছিলেন। আর আজ! সত্যি, মানুষ বড় অদ্ভুত! সময় আর পরিস্থিতি মানুষকে কতটা বদলে দেয়!

আচ্ছা, এভাবে একদিন দিবসও কী বদলে যাবে? মনে মনে মনকে প্রশ্ন করি।

ভেতর থেকে মিছিমিছি জোর গতিতে মাথা নাড়ায়।

-‘উহু! দিবস সেরকম নয়। চিরন্তন সত্যের মত কিছু চিরন্তন মানুষ থাকে জানিস তো? জীবনে পোড় খেতে খেতে সেরকম একেকজন মানুষ তৈরি হয়, দিবস সেরকমই একজন…’

-‘কিন্তু কাল যদি নিশার মা ফিরে আসে, তখন? ঐ তিষমা তিলোত্তমাকে ফেলে কে এই রাত্রিকে নিয়ে পড়ে থাকতে চাইবে?’

-‘সুন্দরের আগুনে ঝাঁপ দিয়ে যে পতঙ্গের ডানা পুড়েছে, সে ই তো জানবে অন্ধকারের কদর কী। দ্বিতীয়বার ভুল করে কেউ কি আগুনে ঝাঁপ দেয়?’

ভালো যুক্তি! এরপর আর কী সংশয়ই বা অবশিষ্ট থাকে? তবুও মনের খচখচানিটা যায়না আমার… ঘরপোড়া গরু তো, সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভয় করে!

হঠাৎ করে সবকিছু একদম ঠিকঠাক হয়ে গেলো যেনো! মা আর সেই আগের মত নেই। সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষফোঁড়াটা নেমেছে তাই বেশ নির্ভার ঘুরে বেড়াচ্ছেন আজকাল। বড়খালা এরমধ্যেই সাগুফতাকে ফোনে জানিয়ে দিয়েছেন- ভাল ঘর ভাল বর দুটোই জুটেছে রাত্রির কপালে। চোখ কপালে তুলে সাগুফতা দেশে আসার সমস্ত যোগাড়যন্ত্র করে ফেলেছে, এই বিয়ের পেছনে গূঢ় রহস্যটা জানার জন্যেই বোধহয়! ওদিকে বড়ফুপু বেশ তেতে আছেন, কিন্তু আঁচটা লোকসম্মুখে প্রকাশও করতে পারছেন না। কেবল মেঘ থমথম মুখে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর বাবা তো সেদিন রাতে এসে বলেই গেলেন- ‘এমন যোগ্য পাত্রের জন্যেই এতদিন অপেক্ষা করে ছিলাম মা, এবার আর অমত করিস না যেনো!’ মা’কে নাকি মেসেঞ্জারে ছেলের ছবি পাঠিয়েছে তার বড়ভাই, তাই দেখে একেকজনের চক্ষু চড়কগাছ! তা অবশ্য হবারই কথা। কালীর সাথে কার্তিক কিংবা দাসীর সাথে রাজপুত্রের মিল হবে- এ তো সাতজন্মেও ভাবেনি কেউ!

সবার কথাই তো বললাম, আর আমি? আমার যতটা না খুশি লাগছে তারচেয়ে বেশি লাগছে নিশ্চিন্ত আর তারচেয়েও বেশি লাগছে ভয়! নিশ্চিন্ত লাগছে কারণ মায়ের এই সারাক্ষণ বিয়ে বিয়ে করে তৈরি করা বিষম যন্ত্রণার হাত থেকে সারাজীবনের জন্য মুক্তি পেতে যাচ্ছি বোধহয় এবার। আর ভয় হচ্ছে কেনো? একশো একখানা প্রশ্ন মনের ভেতর ঘুরেফিরে উঁকি দিচ্ছে বারবার- আদৌ কি সব ঠিকঠাক মত সমাধা হবে? আর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন- মাত্র এক সপ্তাহের পরিচয়ে কেউ আমাকে কেনো বিয়ে করতে চাইবে? আমার জায়গায় সাগুফতা হতো তো মেনে নেওয়া যেতো! আমার মধ্যে যদি ভাল কিছু থেকে থাকে তো হয়তো সে আমার মন, তার খোঁজ পেতে তো কয়েক বছর সময় লাগার কথা! রুপে ভুলবার জন্যে এক সপ্তাহ কিংবা একদিনই যথেষ্ট, কিন্তু সে জিনিসে তো আমি ঠনঠন! তাহলে? আমার মধ্যে ঠিক কোন বস্তুর সন্ধান পেলেন দিবস?

নাহ! এই প্রশ্নগুলির ঠিকঠাক জবাব আগামীকাল ই চাইতে হবে।

নাতনির অপারেশনের খবর শুনে নিশার দাদী এসেছেন গ্রাম থেকে। আরও আগেই আসতেন, সব গোছগাছ করতে সময় চলে গেছে বলেই নাকি আসতে পারেননি। উনার কাছে নিশার দায়িত্ব দিয়ে আবার অফিস শুরু করেছেন দিবস। এদিকে আমারও ইদানিং বেশ কাজের চাপ যাচ্ছে হসপিটালে। তাই আজকে বিকেলে ডিউটি শেষে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে বসবো বলে ঠিক হয়েছে। সেই কবে কোন বিকেলে একবার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের মাঠে জবরজং সেজে গিয়ে অপমানের চূড়ান্ত হয়েছিলাম, আজ কেবল সেই দিনটার কথা মনে পরছে বারবার! শোভন বলে সেই ছেলেটা- ওর খবরও তো আর জানিনা! সিফুর সাথে তো আর হলোনা কিছু, কেবল লাটিমের মত ঘুরেই গেলো পেছন পেছন। এরপর আর কিছু জানিনা…

আজকে অবশ্য আর সেদিনের মত উত্তেজনা কিংবা মানসিক টেনশন কাজ করছে না। এই মাঝবয়সে এসে সেই কৈশরের হরমোনগুলিই বা কই পাবো…সেই টানটান সুতোর মত মুহূর্তগুলিই বা কীভাবে তৈরী হবে!

তাই আজকে আর আলাদা করে কিছু করিনা কিংবা বলা ভালো- করা হয়ে ওঠেনা! ডিউটি শেষে এপ্রনটা খুলে কেবল হাতেমুখে পানি ছিটিয়ে আর চুলগুলি সামান্য আঁচড়ে নিয়েই বেরিয়ে যাই। খুব একটা দেরি হয়নি আমার, ভেতরে ঢুকতেই দিবসের টকটকে মুখটা চোখে পরে। ফ্রেমলেস একটা চশমা পরে এদিক-ওদিক কাউকে খুঁজছে, বামহাতটা বারবার ঘাড়ের পেছনে নিয়ে যাচ্ছে আবার সামনে এনে রাখছে- বোধহয় নিজের অজান্তেই।

-‘দেরি করে ফেললাম? নাকি আপনি আগে এসেছেন?’- ওর সামনের চেয়ারটা টেনে বসতে বসতে প্রশ্ন করলাম।

-‘আরে নাহ, কই দেরি করলেন! সাড়ে পাঁচটায় আসার কথা এখন বাজে পয়ঁত্রিশ। পাঁচ-দশ মিনিট তো এদিক ওদিক হতেই পারে।’- একটা ভদ্রতাসূচক হাসিসমেত বললেন দিবস। এখনো ইতিউতি এদিক-ওদিক তাকিয়ে যেন কাউকে খুঁজছেন। অথচ আমি তো এসে গেছি!

-‘কাউকে খুঁজছেন মনে হচ্ছে!’

-‘হ্যাঁ! দেখুন তো দিব্যটার সেই কখন চলে আসবার কথা এখনোও কোনো খবর পাত্তা নেই। ফোনটাও তুলছে না!’

দিব্য! এ আবার কে!

-‘কে… দিব্য?’

-‘আমার ভাই! দিব্য রাইয়্যান… ওর সাথেই তো আপনার বিয়ের কথা হচ্ছে!’

বোধহয় এই খটখটে রোদভরা বিকেলে ছাদটাদ ফুঁড়ে রেস্টুরেন্টটার মাঝামাঝি একটা বজ্রপাত হয়ে গেলেও এতটা অবাক হতাম না আমি! ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইলাম কেবল সামনে বসা মানুষটার দিকে, বিয়ের পাত্র আসছে না বলে টেনশনে ছটফট করছেন। কয়েকটা মুহূর্ত মাত্র, সামনে বসা অবয়বটা অস্পষ্ট হয়ে আসে ক্রমশ… টের পাই কোত্থেকে হুড়মুড়িয়ে একগাদা জল এসে ভরে গেছে চোখজোড়া।

(চলবে

তিলেত্তমা পর্ব ৮

0

তিলোত্তমা
পর্বঃ ৮

মা আজ ভীষণ তেতে আছেন। একে তো সকালে বাবার কারণে তার প্রিয়পাত্র, সুদর্শন উজবুক কাউসার আলীর ঢোল পেটাতে পারেননি, তার ওপর খানিকক্ষণ আগে কাউসার নাকি তাকে ফোন করে জানিয়েছে এই বিয়েটা আর করতে পারবেনা সে। মা বারংবার জিজ্ঞেস করলেও কোনো কারণ নাকি বলেনি সে, কেবল বলেছে -‘আপনার মেয়েকেই সেকথা জিজ্ঞাসা করে নেবেন!’

মনে মনে কাউসার আলীর গলায় কথাগুলি শুনতে পাই আমি- ‘আপ্নার মিয়েকেই সে কুসচেন করে দেখুন!’ দৃশ্যটা ভাবতেই ধপ করে হেসে ফেলি।

-‘তোর হাসি পাচ্ছে রাত্রি? কী এমন অযোগ্যতা আছে এই ছেলের? অনার্সে পড়ছে, পাশ করলেও তো তোর সমান ডিগ্রি হয়ে যাবে! দেখতে শুনতে কত ভালো… কী এমন রুপনগরের রাজকন্যা তুই যে রাজার ছেলের জন্যে বসে বসে আইবুড়ো হচ্ছিস? সিফুটার অমন সুন্দর চেহারা, তাও তো জামাই জুটেছে একটা কালো-কুলো, বেঁটে-ছোটো! একদিক পেতে হলে আরেকদিক ছাড় দিতেই হবে! আর আমাদের কাউসারের যেমন রুপ তেমনি হাইট! নাহয় তোর মত ডাক্তার নয় ছেলেটা, তাই বলে এত দেমাগ তোর?…’

এতদিন মায়ের এই কথাগুলি এক কানে শুনে আরেক কানে বের করে দিয়েছি, কোনোরকম লাগেনি। কিন্তু আজকে ঐ বাপ-বেটিকে দেখবার পর থেকে আমারো যে বড় শখ হয়েছে একটা পরিবারের…. একটা দুষ্টু-মিষ্টি, তুলতুলে ছোট্ট বাচ্চা আর বাচ্চার বাবার! গায়ের রং যেমনই হোক, ঘন পল্লব ঘেরা হিজল বনের মত চোখ থাকবে বাচ্চাটার- বাবার DNA থেকে ধার করা! একেবারে বাবার কার্বন কপি হবে বাচ্চাটা… ভ্যাবাচ্যাকা খেলে সেও চোখ পিটপিট করে তাকাবে, তর্জনীতে চুলকে নেবে ঘাড়ের পেছন…

হায় খোদা! কী যা তা ভাবছি আমি! ছিছিছি, একদিনের একবেলার পরিচয়ে এতদূর ভেবে ফেলা, তাও আবার কার না কার বিয়ে করা জামাই নিয়ে! ছিহ! নিজেকেই নিজে ধিক্কার দিই আমি, কিন্তু কী অদ্ভুত! ভেতর থেকে নড়েচড়ে ওঠে মিছিমিছি। ফিসফিসিয়ে বলে-

-‘এত ছিছি করার কিছু নেই মেয়ে! বিপরীত লিঙ্গের কাউকে ভালো লাগবে- এ প্রকৃতিরই নিয়ম!’

-‘তাই বলে বিয়ে করা, বাচ্চার বাপকে? না মিছিমিছি, তুই এবারে আবোলতাবোল বকছিস!’

-‘ছাই জানো তুমি রাত্রি! নিশার মা তো নেই, সে কোথায় চলে গেছে কে জানে… ‘

-‘বলেছে তোকে! অমন স্বামী-সন্তান ফেলে কোন পাষাণ চলে যায় রে?’

-‘আচ্ছা, যদি থেকেও থাকে তাতেই বা দোষ কোথায়? তুমি তো আর দিবসকেই চাচ্ছোনা, কেবল ওদের দু’জনকে দেখে অমন একটা ছোট্ট, সুন্দর পরিবার পাওয়ার বাসনা অনুভব করেছো! এ তো প্রকৃতিরই নিয়ম…এতে তো দোষ নেই রাত্রি! দিবস না হোক, দিবসের মতন কেউ? নিশা না হোক, নিশার মতন কোনো বাচ্চা তোমার জীবনে আসুক- এ চাওয়া তো দোষের নয়!’

-‘তাহলে আমি এসব ছাইপাশ ভাবছি কেনো? নিজের জন্য কাউকে কল্পনা করতে গেলে বারবার ঐ একই চোখ, ঐ অঙ্গভঙ্গি মনে আসছে কেনো?’

-‘সে তোমার ক্ষণিকের আবেগ, মুহূর্তের ভালোলাগা রাত্রি! সে কেটে যাবে দেখো! শুধু মনে রেখো, সেই সাত বছর আগে শোভনের মত অপদার্থের জন্যেও তুমি ছিলেনা, আর এখন এই কাউসারের মত উজবুকের জন্যে তুমি নও… তাতেই হবে!’

মা তখনো কীসব গজগজ করে চলছেন, সেসব আর আমার কানে ঢুকছে না! আমি ডুবে গেছি মিছিমিছির সাথে গভীর আলোচনায়।

-‘বাহ! বেশ ভালো দেখা যাচ্ছে তো তোমাকে আজ মামনি! আগামী সপ্তাহেই অপারেশনটা করা যাবে আশা করি!’- নিশার রিপোর্টটা বেশ সন্তোষজনক লাগছে দেখে। ওটা হাতে নিয়ে মেয়েটার দুইগালে হালকা টিপে দিয়ে বললাম আমি।

-‘তারপর আমি তোমাকে আর বাবাকে দেখতে পাবো, মাম্মাম?’

নিশার বাবা পাশেই বসে ছিলেন, মেয়ের প্রশ্নে চমকে তাকান। আমি কী বলব বুঝতে না পেরে বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকি। দিবসই শেষে উত্তর দেন-

-‘হ্যাঁ নিশা! তারপর তুমি সবকিছুই দেখতে পাবে। তোমার টেডিবিয়ার পিংকুকেও!’

-‘আমার খালি তোমাকে আর মাম্মামকে দেখলেও চলবে… যদি চোখ বেশি ঠিক না হয় তাহলে অতটুকুই ঠিক করে দিও! শুধু তোমাদের দুইজনকে যাতে দেখতে পাওয়া যায়…’

বাচ্চারা যে কী অদ্ভুত কথা বলে একেকসময়! কী ভীষণ নিজেদের মত করেই না ওরা দুনিয়াটাকে দেখে! মেয়েটার কথাগুলি শুনে মনটা হঠাৎ খারাপ লাগে আমার, অজান্তেই চোখের কোণে দু ফোঁটা জল চলে আসে। চোখজোড়া আঙুলে মুছে নিশাকে কোলে নিয়ে বলি-

-‘একেবারে পুরোপুরিই ঠিক হয়ে যাবে তোমার চোখ মামনি! আর মাত্র কয়েকটা দিন…’

রাউণ্ড ডিউটি শেষে নিজের ডেস্কে এসে বসে ছিলাম, পরিচিত কণ্ঠটা কানে আসে ঠিক তখনই।

-‘আসতে পারি?’

দিবস!

-‘জ্বি অবশ্যই! হঠাত এখানে… নিশা ভালো আছে তো?’

-‘আরে না না, ওসব কিছু নয়! আমার মনে হলো আপনি আমার কাছে কিছু explanation পাবেন, সেগুলো জানাতেই…’

-‘মানে?’- দিবসের কথা শুনে অবাক লাগে আমার।

-‘উম…ম, মানে নিশার মাম্মামের ব্যাপারটা আরকি!’

-‘ওহ! সে তো আপনি বলেইছেন- ওর মায়ের সাথে আমার কণ্ঠটা মিলে যায় বলে আমাকে মাম্মাম ভেবে ভুল করছে নিশা…’

-‘না ওটা নয়! আসলে…এইযে ও হচ্ছে নিশার মাম্মাম, মিহির!’- পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে আমার দিকে এগিয়ে ধরেন দিবস। ছবি রাখবার জায়গাটাতে একটা স্ট্যাম্প সাইজের ছোট্ট ছবি, হাস্যোজ্জ্বল একটা মুখ। বড্ড সুন্দর… কিন্তু এই মুখটা তো আমার চেনা! কোথায় দেখেছি একে…

-‘চিনতে পেরেছেন?’

-‘দেখেছি বলে মনে পরছে কিন্তু ঠিক ক্লিয়ারলি মনে আসছে না… ‘

-‘তিষমা তিলোত্তমা? এবার চিনেছেন?’

-‘ওহ! হ্যাঁ তাইতো! এটা তো তিষমা তিলোত্তমার ছবি… মডেলিং এ ইদানিং খুব নামডাক হয়েছে মেয়েটার। এটা… এটা নিশার মায়ের ছবি! মানে… মানে…’- প্রচণ্ড বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেলেছি বোধহয় আমি।

-‘ওর আসল নাম মিহির, আতিয়া মিহির হোসেন! ভালবেসে বিয়ে করেছিলাম আমরা, বছর চারেক আগে। বিয়ের আগে থেকেই টুকটাক মডেলিং করতো সে শখের বশে, আমার পূর্ণ সমর্থন ছিলো তাতে। বিয়ের পরপর আবিষ্কার করলাম দুজনেই এতকাল বাপ-মায়ের ঘাড়ে বড় হয়েছি, বাস্তববুদ্ধি প্রায় শূন্য দু’জনেরই। বিয়ের পর সংসারের দায়িত্ব, রোজ তিনবেলা খাবারের আয়োজন এসবের চক্করে মিহিরের শখে ভাটা পড়ে… ওদিকে আমিও ব্যস্ত হয়ে পরি অফিসের কাজে ভীষণভাবে। জুনিয়র এমপ্লয়ি ছিলাম বলে বিভিন্ন বৈদেশিক ট্যুরগুলিতে আমাকেই যেতে হতো, মিহিরকে কখনো নিতে পারতাম কখনো পারতাম না। নিজের শখটাকে দূরে সরে যেতে দেখে মিহিরও আস্তে আস্তে কেমন হয়ে পরছিলো, আমিই ঠেলেঠুলে ওকে একটা এক্টিং স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিই। এরমধ্যেই নিশা চলে এলো। দিন দিন সংসারের ব্যস্ততা যত বাড়তে থাকলো, মিহির যেনো ততই বিরক্ত হতে লাগলো… কোত্থেকে কী করে কী হলো জানিনা- হঠাত একদিন ওদের মডেলিং স্টুডিওতে আমাকে ডেকে নিয়ে মিহির বললো- ‘এত ঝামেলা আর ভাল্লাগে না, আমি ডিভোর্স চাই!’ ওদিকে তখন কেবল আমরা জানতে পেরেছি নিশার চোখের অসুস্থতা সম্পর্কে, আর এদিকে মিহির এই কান্ড করে বসেছে। কতবার যে ওকে বোঝালাম, কতভাবে চেষ্টা করলাম! বারেবারে এক কথাই বলছিলো সে- এই গাধার বোঝা টেনে টেনে নিজের সব শখ, আহ্লাদ বিসর্জন দিতে পারবেনা ও! তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে বলে বসলো- ‘এই প্রতিবন্ধী, কানা মেয়েকে পালতে পালতে আমি নিজের জীবন আর নিজের ক্যারিয়ার এভাবে ক্ষয় করতে পারবোনা!’।

নিজেকে খুব ভদ্রলোক দাবি করছিনা, তবে অন্তত মেয়েদের সম্মান করবার মতো পারিবারিক শিক্ষাটুকু আমার ছিলো। কিন্তু সেদিন আমিও নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি, আমায় যা বলছিলো বলছিলোই। নিশাকে নিয়ে যখন আবোলতাবোল বলতে শুরু করলো মিহির, আচমকাই চড় বসিয়ে দিয়েছিলাম ওর গালে!

ব্যস, আর যায় কোথায়! স্টুডিওতে থাকা বাকি লোকজন সবাই মিলে আমার ওপর চড়াও হলো… তারপর তো সেই পুরনো ঘটনা। আমাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনকারী হিসেবে প্রমাণ করে আদালতে ডিভোর্স চাইলো মিহির, সাক্ষী দিলো ওর বন্ধুবান্ধবেরা, এমনকি আমার শাশুড়িও! তার অমন সোনার বরণ মেয়ে আমার সংসারে কলুর বলদের মত খেটে খেটে কালি হয়ে যাবে- এ তার প্রাণে সইছিলো না।

এরপরের ঘটনা তো দেখছেন ই! আমি পড়ে রইলাম নিশাকে নিয়ে, নানা জায়গায় চেষ্টা করতে লাগলাম ওর চিকিৎসার জন্যে, শেষে আপনাদের হসপিটালে এলাম। আর আমার মিহির নাম পাল্টে হয়ে গেল তিষমা তিলোত্তমা! রাস্তায় বেরুলেই তিষমাকে দেখা যেতে লাগলো বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপনগুলোতে…’

শেষের দিকে দিবসের গলাটা বড় ভারী শোনায়। কী বলবো বা কী করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না… আমি ভেবেছিলাম ছোটোখাট রাগ অভিমানের ব্যাপার হবে হয়তো! নিশা সুস্থ হতে হতেই ওর মাম্মাম ফেরত চলে আসবেন, বেচারি মেয়েটার অপেক্ষাও ফুরোবে। কিন্তু এখন তো দেখছি তার আর আসবার কোনো সম্ভাবনাই নেই!

বেশ অনেকটা সময় এভাবে চুপচাপই কেটে যায়।

-‘আচ্ছা, আপনার অনেকটুকু সময় নষ্ট করলাম! আসি তবে আমি…’- শেষমেশ দিবসই নিরবতা ভাঙ্গেন।

-‘আমার আবার সময়, তার আবার নষ্ট হওয়া! হাসালেন…শুনুন!’

প্রায় দরজা অব্দি পৌঁছে গিয়েছিলেন দিবস, পেছন ফিরে তাকালেন।

-‘নিশাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না একদম, সব ঠিকঠাক থাকলে ও একদম সুস্থ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ! ততদিন নাহয় আমিই ওর মাম্মাম হয়ে থাকলাম!’

দিবসের মুখভঙ্গির পরিবর্তনটা চোখে পরে আমার। প্রথমে খানিকটা অবাক হয় চোখজোড়া, তারপর মিষ্টি একটা সরলরেখা হাসির সাথে সাথে কৃতজ্ঞতা মেশানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঐ হিজল বনঘেরা চোখের তারাদুটো।

কারুর চোখ বুঝি এতটাও expressive হয়?

আচ্ছা, এই ঘরটার প্রত্যেকটা ইট-পাথর কি ঐ দৃষ্টিতে ঘায়েল হয়ে গেলো না?

বেয়াদব মিছিমিছিটা নড়েচড়ে বসে, বুকের ভেতর থেকে ফিসফিসিয়ে বলে-

-‘ইট-পাথরের জীবন নেই বোকা মেয়ে, ওরা ঘায়েল হতে জানেনা! শুধু শুধু ওদেরকে নিজের সাথে জড়াচ্ছিস কেনো রে?’

এই বেয়াদব মেয়েটা সত্যবাদী যুধিষ্ঠির হয়ে সেই-ই কবে থেকে বুকের ভেতর আসন গেড়ে বসে আছে! ধুর! এর জ্বালায় একটু নিজের মনে কথাও বলা যায়না!

বাড়ি ফেরার পথে নিশা মেয়েটার মায়াভরা মুখটা বারবার মনের ভেতর উঁকি দিচ্ছিলো। আহারে বেচারি! বড্ড আশা করে বসে আছে মাম্মামকে দেখবে বলে, চোখজোড়া হয়তো ভালো হয়ে যাবে অপারেশনের পর, কিন্তু তারপর? মিথ্যে বলবোনা, শুধু নিশার কথাই ভেবেছি সেটাও নয়। হাজার চেষ্টা করেও একজনের হিজলচোখ থেকে একচুলও নড়াতে পারিনি নিজের মনকে। সবকিছু ভুলে যেতে চেয়ে যতবার নিজের চোখ বুঁজেছি, আরেকজনের আরেকজোড়া চোখ এসে হানা দিয়ে গেছে ততবার!

একরাশ ভাবনা দিয়ে মাথাটা জ্যাম হয়ে ছিলো বলে কিনা কে জানে, আশেপাশে একদমই খেয়াল ছিলোনা আমার। বাসায় ঢুকে সোজা নিজের ঘরে যেয়ে চুপচাপ শুয়ে ছিলাম অনেক্ষণ। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘোর কাটে আমার।

-‘ওমা রাত্রি! এখনো গোসল করিসনি? শরীর খারাপ লাগছে নাকি…’- বড়খালামনি এসেছেন!

-‘বড়খালামনি, তুমি? কখন এলে?’- উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলাম।

-‘এইতো ঘন্টা দুয়েক। তুই এভাবে পড়ে আছিস কেনো?’

-‘হু, যাবো! গোসলে যাবো এখনই। তারপর বলো তোমাদের ওদিকের কী খবর? সিফু কেমন আছে?’

-‘সে তো ঐ দেশে ভালই আছে, আরামে-আয়েশে। জানিস ই তো জামাইয়ের বড় চাকরি, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেই রেখেছে বউকে। সে তো আবার বউ বলে অজ্ঞান…আচ্ছা, তুই ফ্রেশ ট্রেশ হয়ে তোর মায়ের ঘরে আয়, কথা আছে!’

নির্ঘাত ঐ কাউসারালীর ব্যাপারে মা বড়খালামনিকে ডেকে এনেছেন! উফ, এখন আবার এই নিয়ে কথা শুনতে হবে কিছুক্ষণ! হিজল বনে ডুবে থাকা মনটাকে টেনেটুনে বাস্তবে ফিরিয়ে নিয়ে এলাম, তারপর জামাকাপড় হাতে করে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে ঠিক করলাম- ‘আর চুপচাপ সহ্য করে যাবোনা মা’র এসব কর্মকাণ্ড। দরকার হলে সত্যি সত্যি ঘরবাড়ি ছেড়ে হোস্টেলে যেয়ে উঠবো…’

মায়ের ঘরে যেয়ে রীতিমত চক্ষু চড়কগাছ আমার… কেবল বড়খালাই না সাথে ফুপুকেও ডেকে এনেছেন মা! এই ফুপুই তো উজবুকটার সাথে বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলো…

-‘দেখো মা, তুমি আমাদের বংশের গর্ব। ডাক্তার মেয়ে.. বংশে আর দ্বিতীয়টা নাই আমাদের! কিন্তু তাই বইলা এইভাবে বিয়েথা না কইরা একা একা তো আর জীবন কাটানো যায়না!’- প্রথম কোপটা তবে ফুপুই দিলেন! আমি কেবল চুপচাপ শুনে যাচ্ছি… দেখি কতক্ষণ ধৈর্য ধরে রাখা যায়!

-‘অত কথায় তো কাজ নাই শায়লাপা, ওরে জিজ্ঞেস করেন কাউসাররে ঠিক কী বইলা আর কেন সে ফিরায়ে দিসে ঐদিন। পোলাটা এত্ত কষ্ট কইরা সেই হসপিটাল পর্যন্ত গেসে…’

-‘আহ সোহেলী! আমারে বলতে দেও! তোমার মাথামুথা গরম, তুমি আর এর মধ্যে আইসো না তো…দেখো মা আমি বুঝতেসি সমস্যাটা কোনখানে! কাউসার পোলাডা ভালো, গ্রামের মধ্যে খুব ভালো ছাত্র! সবাই একডাকে অরে চিনে… হয়তো তুমার মতো অত মেধাবী না, হয়ত ডাক্তার না। কিন্তু সেও কিন্তু অনার্সে পড়তেসে! সেশন জট না কি কয়- সেইটায় আটকায়া যাওয়াতে এখনো পাশ করে বাইর হইতে পারেনি। এই এক্টুকুই খুঁত- এর বাইরে আর সবদিকে কিন্তু ছেলেটা ভালো… দেখতে শুনতে যেমন, আদব কায়দা, কথা-বার্তা সবকিছুই অতি উত্তম! কিছু দেনা-পাওনার বিষয়-আশয় আছে সে আমি জানি, কিন্তু ঐটুকু ত ছাড় দিতেই হবে মা!’

অন্য সময় হলে হয়ত যুক্তি দিয়ে ফুপুকে ঘায়েল করার চেষ্টা করতাম, কিন্তু আজকে কেনো জানি এসব কথার পিঠে আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছেনা! ফুপুর শেষ কথাগুলি শুনে চকিতেই একটা বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়! কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে, ঠিক ঐ উজবুকটার উজবুকীয় ভাষায় সুর করে করে বলতে শুরু করলাম-

-‘অবশ্যই! কাউছারালী খুবোই ভালো পাত্রো ফুফু! যেমোন ওঁচা-লম্বা, তেমোন গায়ের রং! কাউছারালীকে পাওয়া তো আমার সৌভাগ্যো… আমিই ওর যোগ্য নই কেবল সেকথাটাই ওঁকে বলেচি! তারপর উনার কিছু কুসচেন ছিলো সেগুলুর আঞ্চার দিয়েচি…’

-‘এই সোহেলী! তোর মেয়ে এমন করে কথা বলছে কেনো? কী হয়েছে এর!’- বড়খালার বিস্মিত কণ্ঠ কানে এলো।

ফুপু আর মায়ের মুখ তখন থমথম করছে। উজবুকটার ‘অতি উত্তম’ কথাবার্তার নমুনা তো তাদের জানাই আছে, ঠিকঠিক ধরে ফেলেছেন কী বোঝাতে চাইছি আমি!

‘গয়লা যেমন ভালোবাসে, ডাস্টবিনের ঐ ময়লারে…
আমি তেমন ভালোবাসি, প্রাণ বন্ধুয়া তোমারে এ এ এ’- গুনগুন করতে করতে মায়ের ঘর ছাড়লাম। বড়খালা তখনো প্রশ্ন করে যাচ্ছেন- ‘ও সোহেলী! তোর মেয়ের কী হয়েছে? অ্যাঁ! কী বলে গেলো মেয়ে? অ্যাঁ!!’

মা যে অত সহজে হাল ছাড়বার পাত্র নন সে আমি জানি! ফুপু আর বড়খালামনিকে যখন ডেকে এনেছেন তখন বিয়ের ব্যাপারে একটা না একটা হেস্তনেস্ত এবার করে তবে ছাড়বেন। আমার পরিচিত যে মেয়েরা মেডিকেলের আশেপাশের আবাসিক হোস্টেলে আছে তাদের ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নিয়ে রাখলাম, বাড়িতে বেশি যন্ত্রণা দেখলে টুপ করে সেখানে উঠে যাবো! এখনো ধৈর্যের বাঁধ ভাঙেনি আমার, দেখা যাক কতদিন পারা যায়…

তিলেত্তমা পর্ব ৭

0

তিলোত্তমা
পর্বঃ ৭

কাউসার আলী একবার আমার দিকে আরেকবার নিশার দিকে তাকাচ্ছে, এখনো বোধহয় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারেনি বেচারা! কিছুক্ষণ এমন রামগড়ুরের ছানার মত এদিক-ওদিক তাকিয়ে তারপর কিছু একটা বিড়বিড় করতে করতে হেঁটে বেরিয়ে ভিজিটর্স রুমের দিকে চলে গেলো।

-‘মামনি! তুমি এখানে বসো, আমি দেখছি তোমার চোখে কী হয়েছে।’- নিশাকে বললাম আমি।

মেয়েটা ভীষণ বাধ্য। লক্ষ্ণী মেয়ের মত সেখানে বসে পরলো। আগামী সপ্তায় একটা মাইনর অপারেশন করা লাগবে ওর চোখে, সেজন্যেই আজকে চোখের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে রিপোর্ট তৈরি করা জরুরি। ভালোমতো ওর অবস্থাটা কাগজে টুকে নিয়ে বোর্ডে পিন আপ করে রেখে মেয়েটার দিকে তাকালাম। কী মিষ্টি একটা বাচ্চা! চোখ দুটো এত্ত অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর! ইশ, এই চোখজোড়ায় কিনা খোদা আলো দেননি!

-‘তুমি এবারে শুয়ে শুয়ে গান শুনতে পারো মামনি।আমি আসছি, কেমন?’

নিশা ছটফট করে ওঠে।

-‘না মাম্মাম! তুমি গেলে আর আসবেনা আমি জানি! কত্ত খুঁজেছি তোমাকে আমি, আবার গেলে আবার খুঁজতে হবে! সে অনে-ক কষ্টের কাজ মাম্মাম!’- নিশা ঠোঁট উল্টায়।

কী অদ্ভুত কথা বলছে এ মেয়ে! কই গেছে ওর মা? ইতিউতি এদিক-ওদিক খুঁজেও কাউকে পেলাম না। বেশ অনেকটা সময় নিয়ে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিশাকে শান্ত করা গেলো। ভীষণ মায়াকাড়া চেহারা মেয়েটার, গোলগাল, নাদুস-নুদুস, টকটকে গায়ের রঙ আর সবচেয়ে নজরকাড়া ওর চোখজোড়া… ঘন আঁখিপল্লবে ঘেরা একফালি হিজলের বনের মতো!

কিন্তু আমার তো আবার রাজকপাল! এই আদরের ডিব্বা বাচ্চাটাকে ছেড়ে এখন নাকি ঐ কাউছারালীকে বোঝাতে যেতে হবে! উফফ, আমার মা এত যন্ত্রণা তৈরি করতে পারে!

-‘দেখুন কাউসার সাহেব, আপনার সাথে তো আমার আগে কথাটথা তেমন হয়নি। আপনার কথা হয়েছে মা’র সাথে, আর আমার এই ব্যাপারটা মা জানেননা। সেজন্যে আপনিও জানেন না…’

-‘মানি? কি ব্যাপাড়ের কথা বলচো তুমি?’

-‘জ্বি বলছি, আপনি জাস্ট কোনো কোশ্চেন না করে শুনুন প্লিজ…’

-‘কুসচেন কড়বোনা মানি কি? আমার অনেক কুসচেন আচে, সেগুলুর আঞ্চার না পেলে তো এই বিয়ের ব্যাপাড়টা এগুবে না…’

ধ্যাত্তেরি ব্যাটা উল্লুক! কথা কী বলি সেইটা শোন আগে তারপর তোর ‘কুসচেন-আঞ্চার’ খেলিস যত খুশি!

মনের কথা মনেই চাপা দিয়ে হাসিমুখ করে বললাম-

-‘জ্বি অবশ্যই ‘কুসচেন’ করবেন, আগে আমাকে সব বলতে দিন। এরপর আপনার সব ‘কুসচেন’-এর ‘আঞ্চার’ আমি দেবো!’- মনে মনে একটা বিশাল বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিয়ে মিথ্যে কথাগুলি আরেক দফা গুছিয়ে নিই। তারপর হড়বড় করে বলতে আরম্ভ করি-

-‘দেখুন এই নিশা মেয়েটা আসলে আমারই মেয়ে! বেশ ক’বছর আগেই ওর বাবা, মানে দিবস রাইয়্যানের সাথে আমার পরিচয় হয়। দিবসের একটু তাড়া ছিলো বলে আমরা কোর্ট ম্যারেজ করে নিই কিন্তু তখনো পড়ালেখা করছিলাম বলে কাউকে জানাইনি। প্রায় তিন বছর মা-বাবাকে হোস্টেলে থাকবার কথা বলে দিবসের সাথে ছিলাম আমি, সেসময়েই নিশার জন্ম হয়। তারপর আমার পড়ালেখাটাও শেষ হলো আমাকেও মা-বাবার সাথে যেয়ে আবার থাকতে হলো! এখন নিশার দেখাশোনা দিবসই করছে, নিশা সুস্থ হলেই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ও যাবে আমাদের বাসায়… আশা করি এর মধ্যিখানে আপনি ঢুকে পরে গণ্ডগোল বাঁধাবেন না!’- বুদ্ধি করে নিশার ফাইল ঘেঁটে ওর বাবার নামটা দেখে নিয়েছিলাম। কথাগুলি বলতে বলতে লক্ষ্য করলাম কাউসার আলীর ফর্সা গালদুটো ধীরে ধীরে লাল বর্ণ ধারণ করছে…

-‘কিন্তু নিশাকে দ্যাখলে ত তুমার মেয়ে বইলা মনে হয় না!’

ওরে খোদা! লাল্টু মিয়ার দেখি আসল বুলি বেরিয়ে গেছে! তবু আধা শুদ্ধ আধা অশুদ্ধ জগাখিচুড়ি ভাষার চেয়ে এ অনেক ভালো! কিন্তু, এই উজবুকটা এখন প্রমাণ দাবি করবে নাকি? উফ, মহা ছ্যাচ্চড় তো!

-‘দেখেন আপনি তো ওর বাবাকে দেখেন নাই… নিশার মতই সুন্দর দেখতে। আমি যেমন রাত্রি, সে তেমন দিবস- বুঝসেন?’

তবুও কাউসার আলীর চোখেমুখে অবিশ্বাসের ভাবটা কাটেনি, বরং বিচিত্র ক্রোধে চেহারা আরো লালবর্ণ ধারণ করেছে। উপার্জনক্ষম মেয়ে, ঢাকায় ফ্ল্যাটের আশা সব এমনভাবে হাতছাড়া হতে দেখলে অবশ্য এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক!

-‘দেখুন বিশ্বাস করা না করা আপনার ব্যাপার! শুধু শুধু আপনাকে মিথ্যে বলে আমার কী লাভ, বলুন? আপনার মত এমন সুদর্শন, হ্যাণ্ডসাম পাত্র কেউ যেচে পরে হাতছাড়া করে?”- উফ! এই গাধাটাকে কী করে যে সরাই! তেল দিয়ে পিছল করে দেখি কাজ হয় কীনা!

কাউসার আলী আর কোনো বাদ-প্রতিবাদ করেনা। ধপ করে ভিজিটর্স চেয়ারে বসে কিছু একটা ভাবতে থাকে বোধহয়। করুকগে যা খুশি, আমার ঘাড় থেকে আপদ নামলেই বাঁচি! সিন্দাবাদের ভূত একটা ঝুলিয়ে দিয়েছেন মা!

গোঁয়ারগোবিন্দটাকে সেখানেই ফেলে রেখে চিলড্রেনস ওয়ার্ডে ফেরত যাই আমি। নিশাকে কথা দিয়ে এসেছিলাম যে একটু পরেই ফিরে আসবো, বেচারি মেয়েটা বোধহয় অপেক্ষা করে আছে!

-‘নিশা মামনি! এইযে আমি এসে গেছি… বলেছিলাম না চলে আসবো?’- একটা টেডি বিয়ার জড়িয়ে ধরে খাটে শুয়ে ছিলো মেয়েটা, আমার গলা শুনেই লাফ দিয়ে উঠে বসে। আমার দিকে পেছন ফিরে নিশার বেডসাইড টেবিলে ফলমূল আর শুকনো খাবার গুছিয়ে রাখছিলো কেউ একজন, অতর্কিতে পেছন ফিরে লোকটা। পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াবার আগেই অস্ফুটে একটা বাক্য বেরিয়ে আসে তার মুখ দিয়ে -‘মিহির! তুমি আসবে আমি জানতাম!’

ঝুঁকে পরে নিশাকে আদর করছিলাম আমি, মাথা উঁচু করতেই লোকটার চোখে চোখ পড়ে আমার। চেহারাটা একনজর দেখলেই বোঝা যায়- ইনিই নিশার বাবা! মেয়ে একদম বাপের চেহারা পেয়েছে…নিশার ঐ হিজল বনের মত পল্লবঘেরা চোখজোড়াও এই লোকের DNA থেকেই ধার করা! প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন উনি, চোখে চোখ পরতেই খানিকটা সংকুচিত ভঙ্গিতে চোখ নামিয়ে নিয়ে বললেন-

-‘Sorry! আমি ভেবেছিলাম মিহির… মানে নিশার মা এসেছে! আপনার কণ্ঠস্বর একেবারে মিহিরের মতো!’

ওহ! তবে এই ব্যাপার! নিশা মেয়েটা চোখে প্রায় একদমই দেখতে পায়না, কণ্ঠস্বর শুনেই বেচারিকে মানুষে মানুষে তফাত করতে হয়। এজন্যেই একটু আগে আমাকে ওর মাম্মাম বলে ভুল করেছে মেয়েটা।

-‘বাপি! এটাই মাম্মাম! তুমি চশমা পরে দেখো তো ভালোমতোন! মাম্মাম, বাপিকে চশমাটা দাও তো… ‘- নিশার জোর প্রতিবাদী কণ্ঠ বেজে ওঠে ঝনঝন করে। নিশার মা কই, এদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আদতে কী হয়েছে কে জানে! পাকেচক্রে আমি কেমন কেমন করে এখানে এসে গিট্টু পাকিয়ে গেলাম!

-‘এক্সকুজ মি! আপনিই কী দিবোস সাহেব?’

কণ্ঠটা কানে আসতেই পিলে চমকে যায় আমার!

কাউসার আলী!

ব্যস, এটুকুই বাকি ছিলো! উজবুক উল্লুকটা কিনা লাফাতে লাফাতে আবার এখানে এসে হাজির হয়ে গেছে! ইয়া মাবুদ, এবারে কী হবে! বানিয়ে বানিয়ে যেসব আকাশ-কুসুম শুনিয়েছি উল্লুকটাকে, কাকতালীয়ভাবে সব ই মিলে গেছে! এই দিবস বলে লোকটা আসলেও দেখতে নিশার মতই সুন্দর… কিন্তু এবারে কাউসার আলী যদি সব ফাঁস করে দেয়, তখন?

-‘জ্বি আ…আমিই দিবস রাইয়্যান! কিন্তু আপনাকে ঠিক…’

-‘আই এম কাউছার, কাউছারালী- ফ্রম মুহিপুর সদর! আপনি কি জানেন আপ্নার ‘ইস্ত্রি’ মানে উয়াইফ রাতরির সাথে আমার মেইরিজ প্রায় ঠিকঠাক হয়ে গিয়েচে…’- হায় খোদা! উল্লুকটা সব ঘেঁটেঘুঁটে হালুয়া পাকিয়ে দিলো! এবারে?

নিশার বাবা চোখ পিটপিট করে একবার কাউসার আলীর দিকে আরেকবার আমার দিকে তাকান। এই বেচারা না চেনেন উজবুক কাউসারালীকে না চেনেন তার ‘ইস্ত্রি ওরফে উয়াইফ রাতরি’-কে! মেয়ের চিকিৎসা করাতে এসে রেডিমেড একখানা ‘উয়াইফ’ জুটে যাওয়াতে তাকে খুব একটা আনন্দিত মনে হচ্ছেনা, না হওয়াটাই স্বাভাবিক! দু’পা পিছিয়ে কাউসারালীর পেছনে যেয়ে দাঁড়াই আমি, তারপর হাতজোড় করে অনুরোধের ভঙ্গিতে ইশারা করি দিবসকে উদ্দেশ্য করে। লোকটাকে দেখে সরল-সোজা, নিপাট ভালমানুষ বলেই মনে হচ্ছে আমার, অন্তত কাউছারালীর তুলনায় নিঃসন্দেহে বেটার অপশন! কাউছারালীর ভূতটাকে ঘাড় থেকে নামানোর জন্য এবারে আমাকেই বোধহয় সিন্দাবাদের ভূত হয়ে এই দিবস রাইয়্যানের ঘাড়ে ঝুলে পড়তে হবে! কী আর করার আছে… তবু যদি এযাত্রায় বাঁচা যায়!

দিবস সাহেব কী বুঝলেন কে জানে, সেই একইভাবে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে চেয়ে রইলেন। আমি তখনো ইশারায় অনুরোধ করে যাচ্ছি, আঙুল দিয়ে কাউসার আলীকে দেখিয়ে মাথা নাড়িয়ে যেভাবেই হোক কিছু একটা বোঝাতে চাইছি…

-‘আ..উমম! আমি আসলে মানে আমি বুঝিনি ব্যাপারটা এখনো! ঠিক কী বলছেন আপনি?’- অবশেষে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় দিবসের।

-‘এইযে রাতরি, সে কি আসলেও আপ্নার উয়াইফ? ফেমিলি থেকে আমাদের মেইরিজটা ঠিকঠাক হয়েচে কিন্তু রাতরি এখন বলচে যে বাসায় না জানালেও ওর বিয়ে হয়ে গেসে আরো আগেই আপ্নার সাথে… আর আপ্নার মেয়েও রাতরিকে মাম্মাম বলে ডেকেসে… ‘

দিবস সাহেবকে তর্জনী দিয়ে ঘাড়ের পেছনে চুলকাতে দেখা যায়। চোখ থেকে চশমাটা খুলে শার্টের কোণায় পরিষ্কার করে আবার চোখে লাগান, তারপর ছোট্ট দুটো কাশি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলেন-

-‘জ্বি কথা সত্য! ‘রাতরি’ আর আমার ‘মেইরিজ’টা হয়েছিলো…আশা করি আপনি আপনার ‘ফেমিলি’কে বুঝিয়ে বলবেন ব্যাপারটা! আর রাতরির বাসায় কাউকে জানাবেন না প্লিজ…’

আর কথা বাড়ায় না কাউসার আলী, কটমট করে একবার আমার দিকে তাকায়। তারপর গটগটিয়ে হেঁটে বাইরে বেরিয়ে যায়। বুকে চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা নাকে-মুখে বের করে দিয়ে ধপ করে নিশার পাশেই বসে গেলাম আমি। বোধহয় উজবুকটার হাত থেকে নিষ্কৃতি মিললো অবশেষে!

-‘I think you owe me some explanations!’- দিবস সাহেবের কণ্ঠটা কানে আসে আমার।

-‘অবশ্যই অবশ্যই!’- কোনোমতে ঢোঁক গিলে বলি আমি। some explanations তো কমই বলেছেন এই লোক, বিশাল এক্সপ্লানেশন পাওয়ার অধিকার আছে উনার!

-‘আসলে হয়েছে কী… এই উজবু..মানে এই কাউসার আলীর সাথে মা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। কিন্তু দেখতেই তো পেলেন কী রামছাগ..মানে কী অদ্ভুত এই লোকটা। আজকে কথা নেই বার্তা নেই সে এখানে এসে হাজির হয়েছে…ওদিকে নিশাটাও ঠিক তখনি জানিনা কেনো ওর আমাকে ওর মাম্মাম বলে ভুল করলো। শেষমেশ আর উপায় না পেয়ে…’

-‘তাই এই সিন্দাবাদের ভূত ঘাড় থেকে নামাতে মিথ্যে গল্প আঁটলেন- তাইতো?’

ইশ! এই লোকটা কি একেবারে মনের ভেতরের কথা পড়তে পারে নাকি? আমি যে মনেমনে কাউসার আলীকে সিন্দাবাদের ভূত নাম দিয়েছি সেটাও জেনে গেছে!

-‘মানে.. I’m extremely sorry… তৎক্ষণাৎ এই বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিলো, আমি আসলে কীভাবে কি করবো…’

-‘It’s okay! No need to panic! আমি বুঝেছি ব্যাপারটা, আর সত্যি বলতে ঐ উজবুকটার সাথে আপনাকে মানায় ও না! ঠিক কী দেখে আন্টি মানে আপনার মা একে আপনার জন্য পছন্দ করলেন…’

নিশার বামপাশের বেডের বাচ্চাটার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম আমি, মুখ না তুলেই উত্তর করলাম-

-‘নিশা যে বললো আপনাকে চশমাটা পরে নিতে… ঠিকঠাক পাওয়ারের চশমা পরেছেন তো? অমন লম্বা, সুদর্শন, টকটককে ফর্সা পাত্র পাওয়া তো আমার মত মেয়েদের জন্য সৌভাগ্য…’

-‘ওহ! এই ব্যাপার! বুঝেছি…’- দিবসের গলায় ইতস্তত ভাবটা প্রকট হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি বেশি অস্বাভাবিক হয়ে উঠবার আগেই লোকটাকে ধন্যবাদ দিয়ে দেয়া দরকার, অচেনা-অজানা একটা মেয়ের অসম্পূর্ণ অনুরোধে যেভাবে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়েছেন উনি- অভাবনীয়!

-‘যাকগে আমার কথা ছাড়ুন! আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ! না চিনে না জেনে যেভাবে রিস্ক নিয়ে সাহায্য করলেন…’

-‘ওয়েলকাম! চোখের সামনে কাউকে নদীতে পরে যেতে দেখলে যে কেউই সাহায্য করবে… তারজন্য চেনাজানা থাকা লাগেনা!’

বাপরে বাপ! এ দেখি ফটাফট উত্তর দিতে এক্সপার্ট! যেনো উত্তরখানা মুখে তৈরি করাই ছিলো!

-‘ভালো উপমা দিয়েছেন! এরপর আর কিছু বলার পাচ্ছি না। একনজর দেখেই মানুষ সম্পর্কে অনেক কিছু আইডিয়া করে ফেলেন দেখছি আপনি! কাউসার আলীর ব্যাপারটা একেবারে ঠিকঠাকই ধরেছেন!’

দিবস সাহেব অল্প হাসেন। এরমধ্যেই নিশাকে কোলে নিয়ে একটা কমলালেবু ছিলে ছিলে খাওয়াতে বসে গেছেন। ডানদিকের ফাঁকা বেডটায় বসেছি আমি, আপাতত হাতে তেমন কাজ নেই। আর তাছাড়া এই বাপ-বেটিকে দেখতে ভালই লাগছে, কেমন শান্তি শান্তি দৃশ্য!

-‘আপনার ঐ কাউসার আলীকে দেখে আমাদের গ্রামের একজনের কথা মনে পরে গেলো, বুঝলেন? ভালো ছাত্র বলে বেশ নামডাক ছিলো তার গ্রামের মধ্যে, সেই দাপটে ধারেকাছে ঘেঁষা যেতো না। ঐ থাকেনা কিছু? নন্দকুমার টাইপের? ঐরকম আরকি। ছোটোবেলা থেকে গ্রাম্য ভাষা শিখেছে আর একটু বড় হতেই নিজেকে বিশাল কেউকেটা ভাবা শুরু করেছে। তো ফলাফলে যা হলো- এই কাউসারের মত একইরকম ভাবে জগাখিচুড়ি করে কথা বলতে আরম্ভ করে দিলো সে ছেলে! তো একবার হয়েছে কি- এক পিচ্চি মেয়ে, এই ধরুন নিশার থেকে একটু বড় হবে, একা একা স্কুলের মাঠে ঘুরছিলো। হাঁটতে হাঁটতে পেছনের জংলামত জায়গাটার দিকে চলে যাচ্ছিলো বাচ্চাটা, তা আবার আমাদের হিরোর চোখে পরলো- সাথে সাথে সে মাঠের অপর প্রান্ত থেকে চেঁচিয়ে বলতে আরম্ভ করলো- ‘অ্যাঁই মেয়ে, অ্যাঁই মেয়ে! ওকানে যেওনা, ওটা জঙ্গল! ওকানে যেও না…’- ঠিক এই পর্যায়ে এসে বাবার সাথে নিশাও গলা মেলালো! বাপ-বেটির যুগ্ম কণ্ঠ কানে এলো আমার-

-‘ওকানে হাপ আছে!’- টেনে টেনে সুর করে একইভাবে কোরাসের মত বেজে উঠলো গলা দুটো! কী সুন্দর! কী অপার্থিব সুন্দর! নিশা মেয়েটা হাত নেড়ে নেড়ে সাপের ছোবলের মত ভঙ্গি করে দেখাচ্ছিলো বলার সময়, ওর অঙ্গভঙ্গি দেখে অজান্তেই খলখল করে হেসে উঠলাম।

-‘নিশার দেখি মুখস্থ কাহিনী! এই গল্প কতবার করেছেন মেয়ের কাছে?’- হাসতে হাসতেই জিজ্ঞেস করলাম।

-‘অনেকবার! এমনকি নিশাকে কোনোকিছুতে বারণ করতে হলে শুধু বলবেন- ‘নিশা! ওকানে হাপ আছে, খবরদার যেওনা!’- ব্যস তাতেই হবে!’- কমলালেবুটা খাওয়া হতে নিশার মুখটা ভেজা রুমালে মুছে দিতে দিতে বললেন দিবস। বাপ-বেটিকে দেখে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো, এরকম সুন্দর, মিষ্টি একটা পরিবার কি আদৌ কখনোও হবে আমার? নাকি ঐ কাউসার আলীই শেষমেশ জুটবে কপালে…

(চলবে)

তিলেত্তমা পর্ব ৬

0

তিলোত্তমা

পর্বঃ ৬

–‘রাত্রিরে নিয়ে তো চিন্তা নাই, এই সুন্দুরীরে নিয়ে হইসে যত চিন্তা! কলেজে-কোচিং এ যাওয়া আসা, শহর এলাকা, নিরাপত্তার কোনো হাল-হদিস নাই! ঝিনাইদাতে যেমনে ছিলো ছিলোই, এইখানে সিফুর বোরকা-নিকাব পইরা চলাফেরা করাই ভালো!’- মায়ের কথায় বড়খালাও সায় দেন। সিফু মানে সাগুফতা বরাবরই মা-খালাদের লক্ষ্ণী মেয়ে, বাধ্য মেয়ে- তাই সে মেনেও নেয়। একত্রেই কলেজে আর কোচিং গুলিতে যাতায়াত করি আমরা এখন। প্রায় মাস দু’য়েক হয়ে গেছে আমরা কলেজে ভর্তি হয়েছি। এই দু’মাসের মধ্যেই পাড়ার একপাল ছেলে সিফুর পেছনে হত্যে দিয়ে পরেছে! কী অদ্ভুত, এই পাড়ায় এতো ছেলেপেলে ছিলো আমাদের বয়েসী? দিব্যি একলা চলে ফিরে বেড়িয়েছি, কই এদের তো দেখিনি এতদিন! এই প্রথমবারের মত আমি আবিষ্কার করলাম দেখতে অসুন্দর হওয়ার ও তবে কিছু সুবিধা আছে বৈকি! এইযে দিব্যি নিরাপদে, একেবারে আর দশটা ছেলের মত ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছি- এ তো এক মস্ত সুবিধে! চেনা নেই জানা নেই, রাস্তার ছেলে ছোকরারা প্রতিনিয়ত যন্ত্রণা করলে কতদিন আর ভালোলাগে? মোড়ের মুদি দোকানী থেকে আরম্ভ করে ওপরতলার ব্যাচেলর ছোকরারা রাস্তা দিয়ে আসতে যেতে আমাদের বারান্দার দিকে চোখ ফেলে ফেলে যাচ্ছে আজকাল! আচ্ছা, সাগুফতার কি বিরক্ত লাগেনা এসব? নাকি আপামর জনসাধারণের এই অতি-সমাদর ওর ভেতরে আত্নতৃপ্তির বোধ জাগায়? কিজানি! আমি কেমন করে জানবো? আমি ত সাগুফতা নই। আমি তো রাত্রি।

আমি তাই হেসে মা’কে বলি- ‘হ্যাঁ মা, আমাকে নিয়ে চিন্তা নাই! আমার চেহারাটাই ত বোরকার কাজ করে, একবার দেখলে কেউ আর দ্বিতীয়বার তাকায়না! সিফুর জন্য বরং বোরকা বানাতে দিও।’

তো তাই-ই হলো অবশেষে। রাস্তা দিয়ে একজোড়া কালো মেয়ে আসা যাওয়া করে আজকাল- একজন কালো বোরকায় আপাদমস্তক ঢাকা বলে কালো আরেকজনের তো প্রতি কোষের DNA র ভাঁজে ভাঁজেই কালিমাখা! সিফুকে ঢেকেঢুকে নিয়ে মা খালারা তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, কিন্তু বাস্তবে তাতে ছাই লাভ হয়! এই দু’মাসে ওর রুপের খ্যাতি আনাচে কানাচে ছড়িয়ে গেছে, তাই ঐ কৃষ্ণকালো চারগজ কাপড়ের ভেতরে যে ধ্রুবতারা জ্বলজ্বল করছে তা জানতে দু’দিনও সময় লাগেনা পাড়াসুদ্ধ ছেলেপেলের! তাই তারা সব হত্যে দিয়ে পরে থাকে সিফুর পেছনে,অতি সাহসী কেউ কেউ প্রেম কিংবা বন্ধুত্বের প্রস্তাব ও পাঠায়। সিফুর তাকে ভালো লাগলে বন্ধু হয় নয়ত ফুঃ দিয়ে উড়িয়ে দেয়….

এভাবেই চলছে আজকাল। একই সাথে একই কলেজে যাওয়া আসা করছি আমরা রোজ। রাস্তায় বের হয়েই সাগুফতা কানে হেডফোন গুঁজে দিয়ে গুজগুজ গুজগুজ করতে আরম্ভ করে দেয় আর আমি বাসে কিংবা রিকশায় বসে বসে ভাবতে থাকি গতকাল ফিজিক্সের যে অঙ্কটা করলাম, ওটা বোধহয় অন্যভাবেও করা যেতো! হয়তো একটা জটিল অঙ্কের সমাধান ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গেছি, গভীর রাতে সিফুর ফিসফিসানির শব্দে হঠাৎ হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে আচমকাই তার উত্তর মাথায় এসেছে! আমি উত্তেজনায় ছটফট করছি কখন সকাল হবে কখন সমাধানটা মিলিয়ে দেখবো, সকাল হওয়া পর্যন্ত আদৌ মাথায় থাকবে তো সমাধানটা? ওদিকে সিফুও হয়তো ফোনখানা কানে ধরে ছটফট করছে, এড্রেনালিন রাশের উত্তেজনায়! দিনে দিনে সিফুটা যত নরম, পেলব সিনেমার নায়িকাদের মত হতে থাকলো, আমি কেমন টমবয় টাইপ হতে শুরু করলাম! কোনো ছেলে ছোকরা সিফুকে ফোনে জ্বালাচ্ছে? ডাকো রাত্রিকে! কাউকে আচ্ছামত ঝাড়তে হবে? ডাকো রাত্রিকে! মোড়ের ফ্লেক্সিলোডের দোকানদার একবার সিফুর নাম্বারটা নিয়ে খুব যন্ত্রণা আরম্ভ করেছিলো, নিজেকে কিনা ইঞ্জিনিয়ার বলে পরিচয় দিচ্ছিলো সে ছোকরা! সিফুটা তো ইঞ্জিনিয়ার শুনেই সেই নরম গলায় ‘কে আপনি? কেনো ফোন দিচ্ছেন? বন্ধু হতে পারি তবে আর কিছু নয়’ করছিলো! আমার সন্দেহ হতে একটু খোঁজ নিতেই ছেলের আসল পরিচয় বেরুলো, তারপর তো সেই- ডাকো রাত্রিকে! এক দুপুরে দোকানে যেয়ে আচ্ছারকম তুলোধুনো করে এলাম ছোকরাকে, দ্বিতীয়বার যন্ত্রণা করলে বাবাকে বলে দেবো বলতেই ছেলে রীতিমত মাফমুক্তি চেয়ে কানে ধরলো।

যাহোক, সিফু আসবে শুনে যতটা অখুশি হয়েছিলাম আদতে ততটা অসুবিধে হয়নি আমার। মা যদিও কিছুটা তুলনা করছেন, সেসব আমি আর গায়ে মাখছিনা আজকাল! আর সেই শোভনের ঘটনাটার কারণে ইদানিং মনেমনে সিফুকে ধন্যবাদ ই বরং জানাই আমি! সেই ধাক্কাটুকু পাওয়া খুব জরুরি ছিলো আমার জন্যে, সেবার তো অল্পের ওপর দিয়েই গেছে! চেতন মনে না জানলেও অবচেতনে কী ভীষণভাবে মুখিয়ে ছিলাম আমি একটা প্রেম-প্রেম সম্পর্কের জন্য! দু’দিনের দু’খানা কথাতেই একেবারে শাড়িটাড়ি জড়িয়ে, রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গান আওড়াতে আওড়াতে দেখা করতে চলে গিয়েছিলাম! এদিকে সবাইকে জ্ঞান বিতরণ করে শেষকালে নিজেই কীনা মোহের জালে আটকা পরতে গেছিলাম- ছিছিছি! ভালই হয়েছে সেবার ওরকম একটা শিক্ষা পেয়ে আমার, একেবারে সোজা পথে চলে এসেছি! আজকাল তাই আমিও সিফুর সাথে হাসতে হাসতেই গলা মেলাই-

‘কেউ কোনোদিন আমারে তো, কথা দিলো না…’

সিফু আজকাল পড়তে বসার খুব একটা সময় পায়না। বড় খালামনির ভয়ে এতদিন রুটিনমাফিক রোজ রোজ সকালে পড়তে বসতে হতো ওকে, ঘুম ঘুম চোখে ঘাড় দুলিয়ে বুঝে না বুঝে গাদাগাদা জিনিস মুখস্থ করতে হতো। আজকাল সেই ভয়টাও নেই! ক্লাস পরীক্ষাগুলিতে আমার পাশে বসে উতরে যায় আর টার্ম এক্সামগুলির আগে ইম্পর্ট্যান্ট টপিকগুলি মাসখানেক ধুমিয়ে গিলে নিয়ে পরীক্ষার খাতায় বমি করে দিয়ে আসে। এভাবে চলতে চলতে একদিন এইচএসসি পরীক্ষাও দিয়ে ফেললাম দু’জনে। মাঝের দুই বছরে তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেনি। কেবল সুজনকে সিফুর কাছে গাঁইয়া গাঁইয়া লাগছিলো বলে ওর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে সিফুর, ঢাকারই বড়লোক ‘এক বাপের এক পুত্র’ জিহানের সাথে নতুনভাবে ‘স্পেশাল ফ্রেন্ডশিপ’ গড়ে উঠেছে ওর। আমি ভাল রেজাল্টের কারণে কলেজ থেকে দুটো স্কলারশিপ পেয়েছি- প্রায় বিনা বেতনেই পড়ছি আজকাল। আমার ছোট ভাইটা ক্লাস সিক্স থেকে সেভেনে উঠেছে এবছর… এইতো!

সেই গোবেচারা রাত্রি মেয়েটা কীভাবে এইচএসসিতেও বৃত্তি পেলো, কেমন কেমন করে ঢাকার সেরা মেডিকেল কলেজটাতে চান্স পেলো আর কীভাবে কীভাবে এই কালো মেয়েটার হাসিমুখের ছবিই ঢাকার অলিতে গলিতে, আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পরলো- ‘অনিতা তাবাসসুম রাত্রি, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা- ২য় স্থান।’- সেকথা লিখতে গেলে ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে যাবে বোধকরি! আবার সিফু আর আমি দু’জনে দু’দিকে ছিটকে পরলাম। কোথাও চান্স না পাওয়ায় ওকে ঝিনাইদহ নিয়ে গেলেন বড় খালামনি, ফোন-টোন সব কেড়ে নিয়ে পাত্র দেখতে শুরু করে দিলেন ওর জন্যে। এদিকে ঢাকাতেও বিশাল গন্ডগোল করে রেখে গেছে মেয়ে! দু’দিন পরপর একেকজন এসে রীতিমত হুমকি ধামকি দিয়ে যাচ্ছে আমাদের- সিফুর সাথে ‘বন্ধুত্ব’ ছিলো তাদের, ওর খোঁজ জানতে চায় এখন! নাহলে শান্তিতে থাকতে দেবেনা আমাদেরকে। উপায়ন্তর না পেয়ে সেই বাসাটা ছেড়ে অন্য এলাকায় চলে যেতে হলো আমাদের, আমার মেডিকেলের কাছাকাছিই পলাশীতে একটা বিশাল বড়, পুরনো আমলের বাসা ভাড়া করলেন আব্বু। মা যদিও একেবারেই পছন্দ করেননি এই বাসাটা, আমার কিন্তু বেশ মনে ধরেছিলো! সেই ১৯৫৫ সালে বানানো হয়েছিলো এই তিনতলা বাসাটা! পুরনো হওয়াতে বিশাল বড় বড় সব রুম, টানা বারান্দা, শ্যাওলা ধরা সিঁড়ি, নোনাপানি মাখা ছাদ, ঘরের দেয়াল… ইশ! কী সুন্দর! কী ভয়ঙ্কর সুন্দর!

এভাবেই সবকিছু ছেড়েছুড়ে মাঝজীবনে এসে একেবারে নতুন একটা জীবন শুরু হলো আমাদের!

তখনও কি আমি জানতাম, কী ভীষণ চমক সাজিয়ে রেখেছে এই নতুন জীবনটা আমার জন্য?

নতুন জীবনে প্রায় বছর পাঁচেক কেটে গেছে! আমার পড়ালেখা আপাতত কিছুদিনের জন্যে থেমেছে, ইন্টার্নশিপ করছি এখন। সিফুটাকে বড়খালামনি ধরেবেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন এক প্রবাসী ছেলের সাথে। বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ওকে মালয়েশিয়ায় নিয়ে গেছে সেই ছেলে, যতদূর জানি সেখানে ভালই আছে টোনাটুনি মিলে! মা’র কাছে শুনেছি সিফুর নাকি বাবু হবে, দু’মাস হলো খবর পেয়েছে। ভালোই চলছিলো সব ঠিকঠাক, কিন্তু ইদানিং এক যন্ত্রণা আরম্ভ হয়েছে- ঝামেলায় পড়েছি মা’কে নিয়ে! হাজার পড়ালেখা, হাজার ক্যারিয়ার হলেও নারীজন্ম নাকি সার্থক হবেনা বিয়েশাদী আর বাচ্চাকাচ্চা না হলে! যখন তখন, যেখানে সেখানে যাকে পাচ্ছেন তাকেই ধরে বসছেন মা- ‘রাত্রিটার জন্য একটা ছেলেটেলে খুঁজে দিন না! মোটামুটি ভালো বংশের হলেই চলবে, চাকরি বাকরি না থাকে তো আমরাই ব্যবস্থা করে দেবো- কেবল পাত্র চাই!’ মা’র ধারণা মেয়েরা নাকি কুড়িতেই বুড়ি, আর এদিকে তার মেয়ের তো ছাব্বিশ চলে! একে তো মেয়ের চেহারার এই হাল, তাতে বয়সের নেই গাছপাথর… ব্যস চিন্তায় চিন্তায় মা’র চুলে পাক ধরছে। কানা খোঁড়া, সকার-বেকার যেমন যা হোক, কেবল একটি পাত্র চাই! অশেষ খোঁজাখুঁজির পর গত মাসে এক ‘সুপাত্রের’ সন্ধান নিয়ে এলেন আমার ফুপু। ছেলের নাম কাউসার আলী, ঢাকারই একটা মেসে থাকে, তিন বছর ধরে চাকরির চেষ্টা করছে কিন্তু হচ্ছেনা। হবেই বা কী করে? পড়ালেখা করেছে কেবল ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত! ফুপুর সেই সুপাত্র অনার্সে ভর্তি হয়ে বসে আছেন কোথাও একজায়গায়, কবে পাশ করবেন তারও ঠিক নেই! ছেলে নাকি আমার ছবি দেখেছে এবং অনেক ভেবেচিন্তে নিমরাজি হয়ে বলেছে- ‘একটা ভালো চাকরি আর সাথে ঢাকায় একখানা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করে দিলে তবে এই মেয়েকে বিবাহের প্রস্তাব ভেবেচিন্তে দেখা যাবে!’ সাথে আরেকখানা শর্ত ছিলো- যেহেতু মেয়ে ডাক্তার এবং আয়-উপার্জন ভালই বলা চলে, তাই পাত্রের পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব বউকেই নিতে হবে! বলা বাহুল্য, এই বিয়েতে কোনোমতেই রাজি ছিলাম না আমি। ওদিকে মা পারলে তখনই কাজী ডেকে এনে আমায় তিন কবুল বলিয়ে দেন! পাত্র সুদর্শন, লম্বায় ছ’ফুট, মধ্যবিত্ত পরিবারের হলেও ভাল বংশের… কালো মেয়েকে বিয়ে করছে এটুকু দাবি তো থাকবেই! তবু ডাক্তারি ডিগ্রীখানা ছিলো বলে আজ মেয়েকে পার করা যাচ্ছে, নাহয় কী যে হতো!

মা’কে পইপই করে বলে দিয়েছিলাম মরে গেলেও এই কুলাঙ্গাররটাকে আমি বিয়ে করবোনা! বাবাও একবাক্যে মানা করে দিয়েছেন, অথচ মা সেই গুনগুন গুনগুন করেই যাচ্ছেন! আজকে সকালে নাস্তার টেবিলেও সেই এক আলাপ-

‘রাত্রির বাবা, তোমার তো কোনো হেলদোল নাই! মেয়ে যে দিনদিন আইবুড়ো হচ্ছে সে খেয়াল আছে? ওর বয়সে আমি এক বাচ্চার মা ছিলাম, আর আমার কথা কী বলি? সিফুটাকে দেখো তো! দিব্যি বিয়েথা করে নিয়ে বাচ্চা হতে চললো!…’

-‘আহ সোহেলী! থামো তো! সিফুর সাথে আমার মেয়ের তুলনা যায়? সময় হলে সব ই হবে, আর না হলেই বা কি? রাত্রি আমার যোগ্য মেয়ে, যেন তেন গোবিন্দলাল ধরে এনে, যার তার হাতে তো ওকে তুলে দিতে পারিনা আমি! এ আমার মেয়ে নয়, এ আমার ছেলে! যদি কোনোদিন বিয়ে না ই করে রাত্রি, তবে তাই-ই সই, তবু এমন অপ্রস্তাব- কুপ্রস্তাবে আমি রাজি নই!’

ব্যস! আর যায় কোথায়! চিৎকার চেঁচামেচি করে, খাবার-টাবার ফেলে রেখে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলেন মা। এই এক বিষয় নিয়ে বারবার আলোচনা একদমই ভাল লাগছিলোনা আমার, কোনোমতে নাকে-মুখে একটু কিছু গুঁজে বাসা থেকে পালিয়ে বাঁচলাম! আজকে চিলড্রেনস ওয়ার্ডে ডিউটি আছে আমার। গোলগাল নাদুসনুদুস বাচ্চাগুলিকে দেখলেই মনটা শান্তিতে ভরে ওঠে আমার! আবার অসুস্থ হয়ে ভর্তি হওয়া বাচ্চাগুলির কষ্ট দেখলে বুকের ভেতরটায় উথাল-পাতাল করে ওঠে…

–‘এক্সকুজ মি? তুমি কি রাতরি না?’- প্রচণ্ড স্মার্টনেসের ঠ্যালায় শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে যেয়ে ঠিকঠাক বলতে না পারলে যেমন শোনা যায়, ঠিক সেই জগাখিচুড়ি ভাষাটা একেবারে কানে এসে লাগলো আমার। রোজকারের মত রাউণ্ড ডিউটিতে এসেছিলাম, আড়াই বছরের নিশা নামের বাচ্চাটার চেক-আপ করছিলাম ঠিক তখনই এই ঘটনা। ঘাড় ঘুরাতেই জগাখিচুড়ি ভাষার উৎসটা চোখে পরলো-

লম্বাচওড়া, সুঠামদেহী এক ‘সুপুরুষ’ দাঁড়িয়ে আছে সামনে! এই ভরদুপুরেও চোখে কালো সানগ্লাস লাগানো… কে এই উজবুক? চিনিনা, জানিনা প্রথম দেখাতেই আমায় ‘তুমি তুমি’ করে সম্বোধন করছে!

–‘জ্বি! আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না…’

–‘আই এম কাউছার! কাউছারালী…’

ইয়ামাবুদ! এই কাউ-সার কিনা শেষমেশ গরু খোঁজার মত আমায় খুঁজতে খুঁজতে এখানে পর্যন্ত এসে হাজির হয়েছে!

–‘আপনি! আপনি এখানে কেমন করে,কোত্থেকে…’

–‘তুমার আম্মু আমাকে এই এড্রেছ দিয়েচে! বলেচে এখানে দেখা কোড়তে…’

ইহ! কথার কী ছিরিরে বাবা! ওহ আচ্ছা! এইজন্যেই কি মা আজ সকালে এই প্রসঙ্গটা তুলেছিলো?

ভালো বিপদ হলো তো! এই উজবুকটাকে এবারে কী করে পাশ কাটাই?

–‘দেখুন কাউসার সাহেব! এটা তো একটা হসপিটাল, এখানে পারসোনাল বিষয়ে আলাপ আলোচনা না করাই বেটার! আমার মনেহয় আপনি…’

আমার কথা শেষ না হতেই একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে! নিশা নামের যে বাচ্চাটাকে আসা অব্দি ঘুমন্ত অবস্থায় দেখছিলাম, সে কখন জেগে গেছে কে জানে… আচমকাই লাফ দিয়ে আমার কোল বরাবর ছুটে আসে! যতদূর শুনেছিলাম জন্মগত একটা চোখের ত্রুটিতে ভুগছে বাচ্চাটা। প্রথম দিকে ওর বাবা-মা একদম ই টের পায়নি ওর সমস্যার কথা, তখন ঝাপসাভাবে কিছুটা দেখতেও পেতো সে। আস্তে আস্তে সমস্যা প্রকট হলে সেটা ধরা পড়ে এবং নানা জায়গায় নানারকম চেষ্টার পর গত সপ্তায় আমাদের হসপিটালে এনে ভর্তি করেছে। প্রায় পরে যাবার দশা হয়েছিল বাচ্চাটার, কোনোমতে জাপটে ধরি ওকে।

–‘মাম্মাম! তুমি এসেছো? কোথায় চলে গেছিলে, আমি কত্ত খুঁজলাম!’- দু’হাতে আমার গলা আঁকড়ে ধরে বলে নিশা।

এ আবার কেমন হলো! কীসব আজগুবি কাণ্ড ঘটছে আজ?

-‘অ্যাঁই মেয়ে? কে তুমি? কে তোমার মাম্মাম?’- কাউসার আলীর বিস্মিত কণ্ঠ কানে আসে আমার। সাথে সাথে বিদ্যুৎ এর মত একটা বুদ্ধি খেলে যায় মাথায়! যেন মাথার ভেতরের কথাগুলি পড়তে পারছে নিশা, একেবারে যুৎসই জবাব দেয় মেয়েটা!

-‘এটাই আমার মাম্মাম! চলে গেছিলো কোথায় জানি, আজকে এসেছে আবার! তুমি কে?’

উজবুকটার চেহারাটা হয়েছে দেখবার মতো!

নিশাকে কোলে জাপটে ধরেই ফিসফিসিয়ে কাউসার আলীর উদ্দেশ্যে বললাম আমি-

‘আপনি বাইরে ভিজিটরস রুমে যেয়ে বসুন, আসছি আমি!’

(চলবে)

তিলেত্তমা পর্ব ৫

0

তিলোত্তমা
পর্বঃ ৫

একটা খুবই অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে! আজকে আমাদের এসএসসির রেজাল্ট দিয়েছে এবং সবাইকে রীতিমত অবাক করে দিয়ে আমি সাগুফতার থেকে ভালো রেজাল্ট করে বসে আছি! সবার কথা বাদ দিই, আমি নিজেই তো অবাক হয়ে বসে আছি খবর শুনে। বাবা কেজি পাঁচেক মিষ্টি এনে আশেপাশে বিলোচ্ছেন, মা জনে জনে ফোন করে খবর দিচ্ছেন- মেয়ে গোল্ডেন এ+ পেয়েছে। আত্নীয় স্বজনরা সকলেই জানে ছেলেবেলা থেকে রাত্রি-সিফু একসাথে বড় হয়েছে তাই স্বাভাবিকভাবেই সিফুর রেজাল্টের খবরটাও জানতে চাচ্ছে সবাই-ই। মা’কে বিমর্ষ গলায় বলতে শোনা যাচ্ছে- ‘ ইংরেজী আর রসায়নে ছুটে গেছে সিফুটার, নিশ্চয়ই কোনো গোলমাল হয়েছে। বড়পা বোর্ডে যোগাযোগ করছে, re check এর এপ্লিকেশন নিয়ে!’

তবে আমরা যতটা অবাক হয়েছি, আমার স্কুলের স্যারেরা কিন্তু অতটা অবাক হননি। আমার সেই অংকের স্যার তো বাবাকে বলেই বসলেন- ‘এ মেয়ে ভালো করবে সে তো জানাই ছিলো। এবার মিষ্টি আনুন দেখি বেশি করে!’

কথা মিথ্যে নয়, ক্লাস টেন এর টেস্ট পরীক্ষায় আড়াইশো মেয়ের মধ্যে আমার পজিশন ছিলো এগারো! সেই মধ্যবিত্ত রেজাল্টের মেয়েটা রাতারাতি কী করে উচ্চবিত্ত হয়ে গেলো সেটা এক রহস্য বটে! কিন্তু, খুব ভালো করে ভেবে দেখলে এর কারণটা পরিষ্কার বোঝা যায়। পড়ালেখা করা ছাড়া আমার আসলে আর কোনো ‘অপশন’ ছিলোনা! উদাহরণ দিই- সিফুর কথাই যদি বলি, কত্তকিছু করবার ছিলো ওর! ছিলো বলছি কেনো, এখনো আছে! সুজনের সাথে একটা পাকাপাকি সম্পর্ক ছাড়াও ওর জীবনে এসেছিলো আরো অনেকে- আশিক, সোহাগ, হৃদয় কিংবা সেই শোভন! সাগুফতা না চাইতেই এরা বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল ওর দিকে, সাগুফতাও তাতে অসম্মতি প্রকাশ করেনি। একদিন সুজনের সাথে ঝগড়া হয়েছে তো আশিক এসে সিফুর মন ভালো করার জন্য দিনকে রাত, রাতকে দিন করে ফেলেছে! আজ ভালোবাসা দিবসে পুরোটা সুজনের সাথে ঘুরেছে তো কাল বন্ধু দিবসে বন্ধুদের নিয়ে ‘হ্যাং আউটে’ গেছে।

শুধু কি সিফু? একই ঘটনা তো আমার স্কুলের কত্ত মেয়ের সাথেই হয়ে গেলো এই ক’বছরে! হোসেন স্যারের অসম্ভব সুন্দর অঙ্ক বোঝানোর দক্ষতায় ক্লাস নাইন পেরোতে না পেরোতেই গণিত বিষয়টায় বেশ দখল চলে এসেছিলো আমার… সেই সুবাদে দু’চারজন বান্ধবীও জুটে গিয়েছিলো! এদের একজন তার বাসার টিচারের সাথে প্রেম জুড়ে দিলো, আরেকজন তাদের বাড়িওয়ালার বড় ছেলের গলায় ঝুলে গেলো! একজনের হলো পড়তে পড়তে প্রেমে পরা, আরেকজন সিঁড়ি বেয়ে আসতে যেতে দোতলার সুদর্শনের ঘাড়ে ঝুলে পরা! তৃতীয় যে বান্ধবী, সেও কিছুদিন পর খবর নিয়ে এলো- ‘ওরে! আমারো যে হয়ে গ্যাছে! বাপির বন্ধুর ছেলে…’

ব্যস! চারজনের দলে সেই রাত্রি একলা বাকি পরে রইলো। প্রায়ই স্কুল ফাঁকি দিয়ে ওরা ঘুরতে চলে যেতো, একেকদিন একেক জায়গায়। আমার তো কেউ নেই, কোথাও যাবার নেই, কিচ্ছুটি করবার নেই। আমার জন্য পড়ে রইল কেবল কিছু বই। বেশ, তাই-ই সই!

একদিকে যেমন বেড়ে গেলো আমার গল্পের বই পড়ার হার, অন্যদিকে তেমন তরতর করে বাড়তে আরম্ভ করল অঙ্কের নাম্বার! দু’চারটা পরীক্ষাতে ভাল করার পরে টের পেলাম অনেকেই কেমন সমীহের নজরে দেখছে আমায়! ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দর, পুতুল পুতুল মেয়েটা, দিশা- যার দিকে তাকালে প্রচণ্ড আফসোসে স্রষ্টাকে মনেমনে জিজ্ঞেস করতাম- ‘একই হাতে ওকে আর আমাকে গড়লে কেমন করে গো?’- একদিন গণিতের ক্লাস টেস্টের সময় সে নিজে যেচে আমার পাশে বসে বললো যেন ওকে দেখাই আমি, গতকাল ভ্যালেন্টাইন্স ডে থাকার কারণে প্রিপারেশন নিতে পারেনি সে।

আচ্ছা, এই মেয়েটার কথা কি বলেছি আগে? বুকের ভেতর খুব গোপনে লালন করা কতগুলি কষ্টের ভেতর একটা কষ্টের সাথে এই মেয়েটা জড়িয়ে আছে!

সে প্রায় বছর ছয়েক আগের ঘটনা!ক্লাস থ্রি কিংবা ফোর এ পড়তাম, তখন একেবারে বোকার হদ্দ ছিলাম আমি। নিজের মত চুপচাপ থাকতাম বলে কোনো বন্ধুবান্ধব ও জোটেনি, অথচ সেই বয়সেই বেশ কয়েকটা ‘ফ্রেন্ডগ্রুপ’ তৈরি করে ফেলেছিলো বাকি মেয়েরা! এরমধ্যে সবচেয়ে দাপুটে গ্রুপটা ছিলো দিশা-দের। দিশা, অন্তরা, রাওনাফ আরো দু’চারটে মেয়ে মিলে ডাঁকসাইটে ‘ক্যাপ্টেন গ্রুপ’ বানিয়েছিলো! প্রতিবছর এদের দলটা থেকেই কাউকে না কাউকে ক্লাস ক্যাপ্টেন বানানো হতো। এরা প্রত্যেকেই ভালো ছাত্রী হওয়াতে টিচারদের বেশ প্রিয় ছিলো। তারওপর এদের প্রত্যেকের বাবামায়েদের ই আর্থিক অবস্থা বেশ ভালো ছিলো, ক্লাস ওয়ান থেকেই টিচারদের বাসায় বাসায় যেয়ে কোচিং করতো এরা সকলে। এমনকি বাংলা, ধর্ম কিংবা সমাজের মত সহজ বিষয়গুলিও ওরা দলবেঁধে ক্লাস টিচারদের বাড়িতে যেয়ে আলাদাভাবে কোচিং করতো, আর তাই স্বাভাবিকভাবেই টিচারদের প্রিয়মুখ ও ছিলো এই মেয়েগুলি। তো যাইহোক, তখন আমার বয়স কম, এতশত তো বুঝতাম না! মা’কে যেয়ে বললাম- ‘ওদের সাথে আমিও বন্ধু হতে চাই, তুমি ওদের বলে দাও আমায় যাতে ওদের দলে নেয়!’ ওহ, বলে রাখি- আমরা কিন্তু অত বড়লোক নই! একটা ছোটখাটো সরকারি চাকরি করতেন বাবা। মা বললেন এভাবে বলেকয়ে নাকি বন্ধুত্ব হয়না, ওদের সাথে মিশতে মিশতেই একদিন ওরা আমার বন্ধু হয়ে যাবে। বেশ কথা! পরদিন বেশ ভেবেচিন্তে, বুকের ভেতর সাহসের বেলুন ফুলিয়ে ওদের দখলকৃত বেঞ্চগুলির একটার এককোণে যেয়ে বসলাম! ক্লাসের একদম সেরা জায়গায় সবচেয়ে ভালো তিনখানা বেঞ্চ বসিয়ে নিয়েছিলো ওরা নিজেদের জন্যে, রোজ সেখানেই বসতো। সবমিলিয়ে আটজনের দল ছিলো ওরা, আর তিনজন করে এক বেঞ্চে বসতে হতো আমাদের। তো তিন বেঞ্চে ওরা বসে যাবার পরও রোজ একজনের জায়গা খালি থেকে যেতো, ওখানে আর কেউ বসতো না। মনে মনে কতদিন যে নিজেকে ঐ জায়গাটাতে বসিয়েছি! ক্লাসের মাঝে ওরা যখন একে অন্যের কানেকানে ফিসফাস করে কিছু একটা বলে মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসতো কিংবা স্যারের চোখ ফাঁকি দিয়ে নিজেদের ভেতর চিরকুট চালাচালি করতো- খুব লোভ হতো আমার! ঐ ছোটছোট, অবান্তর কথাগুলি শোনার জন্য, ঐ হাতে হাতে চলে অবশেষে ছেঁড়া অবস্থায় মেঝেতে পরে থাকা চিরকুটগুলি পড়ার জন্য- আমার ছোট্ট মনটা ছটফট করতো! অবশেষে সেদিন সাহস করে সশরীরেই বসে গেলাম ঐ জায়গাটাতে… তৃতীয় সারির বেঞ্চটার কোণায়।

–‘তুমি এখানে বসেছ যে? জানোনা এটা আমাদের জায়গা?’- খানিক বাদেই অন্তরা এসে প্রশ্ন করলো।

–‘আমি… আমি! বসোনা এখানটায়, একজনের জায়গা তো ফাঁকাই পরে থাকবে…’- ঢোঁক গিলে নিয়ে থেমে থেমে বললাম আমি। মা বলে দিয়েছে- মিশতে হবে ওদের সাথে! তবেই না বন্ধু হবে ওরা আমার! উহু, ভয় পেলে চলবেনা!

–‘কীইইইহ!’- নাক টেনে একটা শব্দ করে অন্তরা। তারপর চোখ কুঁচকে আমার দিকে তাকায়, যেন অস্পৃশ্য কোনো জন্তুকে দেখছে। না না, তখনো সেই দৃষ্টিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করার বয়েস হয়নি আমার! বহুদিন পর চোখ বুঁজে সেদিনের কথা ভাবতে গিয়ে টের পেয়েছি- বোধহয় হাঁটাচলার পথে একটা তেলাপোকা পরে থাকলেও এভাবেই তাকাতো অন্তরা!

বিড়বিড় করতে করতে একদম সামনের বেঞ্চটায় যেয়ে বসে অন্তরা, মাঝের বেঞ্চটা ফাঁকা রেখে। এক এক করে ওদের দলের বাকি মেয়েগুলি আসতে থাকে, সেই একই রকম দৃষ্টি আমার দিকে নিক্ষেপ করে যার যার মত বসে যায় ওরা বাকি বেঞ্চ দুটোতে… টের পাই একে অন্যকে ফিসফাস করে কিছু বলছে ওরা আর বারবার ঘুরে তাকাচ্ছে আমার দিকে। তবু সাহসের শেষবিন্দুটুকু আঁকড়ে ধরে আমি বসে থাকি একা, তিনজনের বেঞ্চটার পুরোটা দখল করে!

একে একে আটজন ই চলে এসেছে ওরা, সামনের দুই বেঞ্চে গাদাগাদি করে আটজন বসেছে, তবু আমার পাশে কেউ বসেনি! নিরীহগোছের, গোবেচারা রোল ৫৬র এহেন অদ্ভুত আচরণে ক্লাসের বাকি মেয়েরাও কানাকানি শুরু করে দিয়েছে। নিজেকে ক্যামন বোকা বোকা লাগছে এখন আমার, আমার পাশে বসলে কি জাত চলে যায় অন্যদের? যে ই ক্লাসরুমে ঢুকছে সে-ই অবাক হয়ে এদিকে তাকাচ্ছে আর তারপর দৌড়ে যেয়ে নিজের বন্ধুদের সাথে ফিসফাস করছে… কী ভীষণ বিব্রতকর একটা অবস্থা! ‘মিছিমিছি’ আমায় গাল দিচ্ছিলো তখন ভীষণ, এখনও মনে আছে সেকথা!

ক্যাপ্টেন গ্রুপ বেশিক্ষণ এভাবে চিপকে থাকতে পারলো না, প্রথম ক্লাসেই ম্যাডাম এসে তিনজন করে বসতে বলে ওদের উঠিয়ে দিলেন। কেউই আমার পাশে বসতে চায়না, এ-ওকে সে-তাকে গুঁতোচ্ছে! অবশেষে ম্যাডামের ভয়ে নিতান্ত বাধ্য হয়ে দু’জন এলো আমার পাশে- দিশা আর অন্তরা! আমি কি খুশি হয়েছিলাম তখন? একটু আশার আলো দেখে? নাকি প্রচণ্ড লজ্জা আর অপমানে কুঁকড়ে ছিলাম? – নাহ! মনে নেই!

এটুকু মনে আছে, তখনো হাল ছাড়িনি। কী ভীষণ জেদি একটা জোঁকের মত লেগে ছিলাম ওদের বন্ধু হতে চেয়ে, এখন সেকথা ভাবলেও লজ্জায় গা গুলোয়! ক্লাসের গ্যাপ গুলোতে আমি যাতে শুনে না ফেলি, সেজন্যে মুখে হাত দিয়ে নিজেরদের মধ্যে কথা বলছিলো ওরা। কিন্তু মা যে বলে দিলো মিশতে হবে ওদের সাথে? এরকম করলে আমি মিশব কী করে? কথাই তো বলছেনা ওরা আমার সাথে! আচ্ছা, আমিই বলি নাহয়…

–‘তোমরা এত কী বলাবলি করো? আমি কাউকে বলবোনা, আমাকে বলোনা!’

দিশা আমার পাশে বসে ছিলো, আচমকা লাফ দিয়ে অন্তরার একেবারে কোলের কাছে ঘেঁষে গেলো ও- যেনো কালো একটা কিলবিলে জোঁক দেখেছে এইমাত্র!

ব্যস! ওদের কথা বলাবলিও বন্ধ হয়ে গেলো! এবারে নিজেদের মধ্যে চিরকুট চালাচালি করতে আরম্ভ করলো ওরা।

আমি বোধহয় ছ্যাঁচোড় ছিলাম ছোটকালে, নয়ত বিশ্ববোকা! নাহয় এরপরেও সরে না গিয়ে কীভাবে বলে বসলাম-

–‘ওটা ছিঁড়ে ফেলোনা! আমাকে দেখিও প্লিইজ!’

যেন শুনতেই পায়নি এমন ভঙ্গিতে কাগজটা ছিঁড়ে ফেললো রাওনাফ! সামনে উবু হয়ে ওদের কানেকানে কি একটা বললো দিশা, আমি কেবল দেখলাম সকলের মুখে হাসি ফুটেছে! খাতার পেছনের পৃষ্ঠাটা ছিঁড়ে নিয়ে খসখস করে তাতে কিছু লিখলো দিশা, তারপর সবাইকে দেখালো। বাকিরাও কিছু কিছু লিখা যোগ করলো, তারপর দিশার হাতে ফেরত দিলো।

কী অবাক কাণ্ড! আমার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়েছে দিশা! মা তবে ঠিকই বলেছিলো… মিশতে হবে, তবেই বন্ধুত্ব হবে!

খুশিতে ডগমগ হয়ে কাগজটা লুফে নিলাম।

–‘থ্যাংকু!’- দু’পাটি দাঁত বের করে কাগজটার ভাঁজ খুলতেই লেখাগুলি চোখে পরলো-

‘ময়ূরের পুচ্ছ লাগালেই কাক কি ময়ূর হয়? সেই কাক ও ময়ূরের গল্পটা পড়োনি? বাংলা সহপাঠ বইতে আছে, ১৫ নং পৃষ্ঠায়- পড়ে নিও।’

নিচে একটা ছবি, তাড়াহুড়োয় পেন্সিল দিয়ে আঁকা। আটটা ডানাসহ পরী একসাথে দাঁড়িয়ে আছে, আর তাদের পায়ের কাছে কিলবিল করছে একটা মোটাসোটা চীনেজোঁক…

এখনো মনে আছে টপটপ পানিতে ভিজে গিয়েছিলো কাগজটার একপ্রান্ত। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে বাথরুমে যেয়ে দরজা লাগিয়েছিলাম, মুঠোর ভেতর তখনো কাগজটা ধরে রাখা… চীনেজোঁক আর সারাদিনে বেরোয়নি সে বাথরুম ছেড়ে! ছুটির ঘন্টা বাজলে সবাই যখন হুড়মুড় করে নেমে গেছিলো, তারপর ফাঁকা হয়ে যাওয়া ক্লাসরুমটায় যেয়ে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে নিয়ে নেমেছিলো সে।

তারপর থেকে প্রতিদিন পেছনের বেঞ্চটায় বসে ক্লাস করে গেছে চীনেজোঁক, আর কোনো ডানাকাটা পরীর সাথে কখনো মিশতে যায়নি… মনের ভুলেও না!

সাগুফতার রেজাল্ট আর বদল হয়নি, recheck করেও একই ফলাফল এসেছে। অনেক ভেবেচিন্তে মামারা বলেছেন, বড়খালামনি ঐ স্কুলের টিচার বলে এতদিন সিফু হয়ত প্রাপ্যের চাইতে বেশি বেশি সুবিধা পেয়ে এসেছে, শেষমেশ বোর্ড এক্সামে যেয়ে রেজাল্টটা খারাপ হলো! তাই অনেক কথাবার্তার পরে ওকে ঢাকায় এনে আমার সাথে একই কলেজে ভর্তি করানো হয়েছে।

ডায়েরিটা, কেবল আমার ডায়েরিটাই জানে- সিফু আসাতে আমার খুব মন খারাপ হয়েছে! এমনিতে মা আমায় যেমনই আদর করুন, সিফু এলে মায়ের কী জানি হয়! সারাক্ষণ ওর সাথে আমার তুলনা দেন মা, আর মন ভার করে বসে থাকেন। ‘সিফুর পায়ের পাতাটা দেখ, কী সুন্দর, কী সুন্দর! তোর ত হয়েছে বাপের মত থ্যাবড়া পা!’

‘দেখতো সিফু কি সুন্দর সেজেগুজে বেরোয়, এই অকালকুষ্মাণ্ড নিয়ে আমার হয়েছে গেরো! কার ঘরে যে পার করবো এই মেয়ে আমি! ‘

কিংবা, ‘হ্যাঁ রে সিফু, ওই লকেটটা কী সুন্দর মানায় রে তোকে! রাত্রির জন্য বানিয়েছিলাম পুরো ছয় আনা স্বর্ণ দিয়ে, তা মেয়ের গায়ে সোনা ফুটলে তো! তুইই নিয়ে নে এটা, ধর!’- ব্যস আমার সাধের গোলাপি পাথর বসানো লকেটখানা হাতছাড়া।

আচ্ছা, মা যেমন বলে আমি কি আসলেও অমন হিংসুটে?

আমি বুঝি মা কেন এমন করেন! মায়েদের তিনবোনের মধ্যে আমার মা সবচেয়ে সুন্দরী ছিলেন! পাড়ায় খানবাড়ির তিন মেয়ের মধ্যে মেজোমেয়ে সোহেলীকে সকলে একডাকে চিনতো! ওদিকে বড়খালা ছিলেন এক্কেবারে উলটো, নানাভাইয়ের মত পুরুষালি চেহারার ধাঁচ পেয়েছিলেন। অথচ কপাল দেখো দুই বোনের? নানাভাইয়ের কারণেই কীনা মায়ের বিয়ে হলো আমার কালোকুলো বাবার সাথে আর বড়খালার বিয়ে হলো সুদর্শন বড়খালুর সাথে! বড়খালুদের অবস্থা বেশ গরিব ছিলো, কালো মেয়েটাকে তার হাতে গছিয়ে বিনিময়ে তার চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন নানাভাই। আর, ওদিকে আমার বাবা আমার মতই কালো-কুলো হলেও একখানা সরকারি চাকরি ছিলো তার… নানাভাইয়ের সুন্দরী মেয়েটাকে বিয়ে করতে বেশি বেগ পেতে হয়নি বাবাকে তাই!

ছেলেবেলা থেকেই সবার কাছে একটু বাড়তি সমাদর পেয়ে পেয়ে বড় হয়েছেন আমার মা। এ তো জানা কথাই- ‘আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী!’ তাই নিজের অসুন্দর মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে মায়ের বড় চিন্তা হয়, সাগুফতাকে চোখের সামনে দেখলে মায়ের সে চিন্তার পালে হাওয়া লাগে। সাগুফতা নামক জ্বলজ্বলে তারাটার পাশে নিজের গর্ভের মেয়েটাকে বড় মলিন লাগে। মা তাই এখানে সেখানে যার কাছে যত প্রসাধনীর সন্ধান পান সব এনে হাজির করেন। আমার ড্রয়ার ভরে উঠতে শুরু করে ফেয়ার এণ্ড লাভলি, হরেক রকম আয়ুর্বেদিক সাবান আর ফেয়ারটোন পাউডারের কৌটো দিয়ে…

সাগুফতার এখানে আসবার খবর শুনে তাই আমার ভীষণ মন খারাপ হয়! ভীষণ!

কত কিছু বকবক করে গেলাম, আসল কথাটিই তো বলিনি! সেই শোভনের ঘটনার পরে কী হলো? বিদ্ধস্ত, অপমানিত মেয়েটার জন্য ধরণী সেদিন দ্বিধা হয়নি, বাড়ি ফিরে যাবার পর সকলের কাছে বেশ খানিকটা বকা শুনতে হয়েছিলো বরং, দেরি করে ফিরবার কারণে! যে বোনের প্রতিশোধের বলি হলো মেয়েটা, তাকে কিচ্ছুটি বলেনি সে! বলা ভালো, লজ্জায় বলতে পারেনি কিছুই। কেবল সারারাত কেঁদে কেঁদে অন্তরীক্ষের কাউকে বলেছিলো- ‘যদি আমি অপরাধ করে থাকি তো আমায় শাস্তি দিও! তা না হয় তো যে আমার সাথে এতবড় অবিচারটুকু করলো তাকে তুমি ছেড়োনা…’

বুকের ভেতর থেকে ‘মিছিমিছি’ কেবল সান্ত্বনাবাক্য বলে যাচ্ছিলো তখন। পাশে শুয়ে শুয়ে সাগুফতা সহাস্যে সুজনকে গান শোনাচ্ছিলো-

‘কেউ কোনোদিন আমারে তো, কথা দিলো না…
কথা দিলো না।
বিনি সুতোর মালাখানি গাঁথা হইলো না…
গাঁথা হইলো না!’

স্কুলের ছুটি আরো কিছুদিন বাকি ছিলো, আমি পরদিনই ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ছোটমামার সাথে ঢাকায় রওনা করি। মামার কাজ ছিলো সেদিন ঢাকাতে, আমিও ঝুলে পড়ি ওর গলায়। সাগুফতা রয়ে যায় নানুবাড়িতেই, ওর ছুটির আমেজ তখনও ফুরোয়নি….

তিলেত্তমা পর্ব ৪

0

তিলোত্তমা
পর্বঃ ৪

বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলো একভাবেই। সাগুফতাটা তো দিব্যি ফোনে মজে আছে! ধুরো, বইটই কিছু নিয়ে আসা দরকার ছিলো সাথে করে, সেই কখন থেকে হ্যাবলার মত বসে আছি! আদৌ কি সে ছেলে আসবে? নাকি না?- ভাবতে ভাবতেই ‘হোহো’ হাসির শব্দে চমক ভাঙে আমার।

‘জয় মা কালীইইইইই!’- কতগুলো ছেলের কণ্ঠ সমস্বরে বেজে ওঠে, কোরাসের মত! চমকে গিয়ে উঠে দাঁড়াই, ঘাড় ঘোরাতেই চোখে পরে সেদিনের দেখা সেই ছেলেগুলোকেই, বাইসাইকেলে করে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে ছিলো যারা! তিনজনের দলটা আমাদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলো। কিন্তু কই, শোভন তো নেই ওদের সাথে! আর কী বলছিলো ওরা… হিন্দু ধর্মের নাকি ওরা সবাই?

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সাগুফতার দিকে তাকাতেই দেখি মিটিমিটি হাসছে ও।

–‘কী হলো রে এটা সিফু?’- প্রশ্ন করলাম।

–‘কিইজানি! এরা এখানে কী করে? কই, তোর নায়ক কই?’

অদ্ভুত তো!

স্কুলের মাঠে দু’একজন বাচ্চা ছেলেমেয়ে খেলছিলো। শোভনের ঐ বন্ধুরা কিছুদূর যাবার পরই বাচ্চাগুলির একজনকে ডেকে নিয়ে কিছু একটা বলে… আমরা তখনো দাঁড়িয়ে দেখছি ওদেরকে। আগামাথা কিছুই তো বোঝা যাচ্ছেনা ছাই!

একটু বাদেই বাচ্চাটা দৌড়ে আমাদের দিকে আসে, তারপর ডানহাতে ধরা সাদা কাগজটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়-

-‘ন্যান! এইডা আফনের!’

–‘আর এই দুইডা আফনের! তাত্তাড়ি ফুন নাম্বারডা লেইখা ফিরুত দ্যান, খেলতাসি আমরা।’ – সাগুফতার দিকে একটা গোলাপী রঙের কাগজ আর বলপেন এগিয়ে দেয় বাচ্চাটা।

নিজের হাতের কাগজটা পড়ব কি, আমি বোকার মত সাগুফতার দিকে চেয়ে রইলাম! হচ্ছে কী এসব?

বাচ্চাটার হাত থেকে কাগজটা নিয়ে দ্রুতহাতে খসখস করে কিছু একটা লিখে আবার ফেরত দেয় সাগুফতা। জিনিসদুটো নিয়েই একদৌড়ে চলে যায় ছেলেটা।

মাথাটা পুরো এলোমেলো লাগছে আমার! যন্ত্রের মত হাতে ধরা কাগজটায় চোখ বুলাই-

-‘Sorry, আমাকে মুক্তি দিলে ভালো হয়।
……….- শোভন’

ব্যস! কেবল এতটুকুই লিখা। এপিঠ-ওপিঠ উলটে দেখলাম, আর কিচ্ছু নেই!

মানে কী! কে কাকে আটকালো আর কে ই বা কার থেকে কীসের মুক্তি চাচ্ছে? আমি তো যেচে পড়ে শোভনের সাথে কথা বলিনি একবারও! ও-ই তো সেদিন…

আলগোছে চিরকুটটা ধরা ছিলো আমার হাতে, ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে সেটা পড়ে নেয় সাগুফতা। তারপর ‘ফুঃ’ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে-

-‘হায়রে গল্পনেশী! ছাইপাশ নোভেল গিলে গিলে মাথাটা যে পোকার বাসা বানিয়েছিস এবার বুঝলি তো? কে কবে এলো কি এলোনা, দুটো কথা বললো কি বললো না- ওমনি প্রেমে হাবুডুবু খেতে খেতে খাতাপত্তর জুড়ে তার নাম লেখে ভরানো! এত সস্তায় প্রেম হয়না, বুঝলিই? আশা করি কোনটা মোহ কোনটা প্রেম আর কোনটা ভালোবাসা- আমাকে এসব শেখাতে আসবি না আর!’

সাগুফতার টেনে টেনে বলা কথার সুরে ভাবনায় ছেদ পরে আমার। কী বলছে ও এসব আবোলতাবোল?

-‘কী বলছিস সিফু, আমি এখনো কিছুই বুঝিনি বিশ্বাস কর…’

-‘সে তুই বুঝবিওনা জানি! থাকিস তো সারাদিন কুনোব্যাঙ-এর মত এক কোণায় বসে, দু’খানা বই হাতে নিয়ে! কুয়োর ব্যাঙ সমুদ্রে পরলে যা হয় আরকি!’- ঠোঁট বাঁকায় ও।

-‘তুই কি কিছু জানিস, সিফু? কে এই শোভন, কোত্থেকে এসে এভাবে উদয় হলো আর কেনইবা এখন…’

-‘সে তোর শোভনকে যেয়ে জিজ্ঞেস করগে যা!’

সাগুফতা ঘাড় দোলায়, তারপর বাড়ির দিকে হাঁটতে আরম্ভ করে। ওর পেছন পেছন যেতেও ভুলে যাই আমি, ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি স্কুল মাঠটায়। আমি কি এখনোও অপেক্ষা করছি কারো আশায়? যে আসবে বলে কথা দিয়েছিলো গতকাল, যার জন্য এত আয়োজন…

যে বন্দি না হতেই মুক্তির আবেদন নিয়ে এসেছে- তার আশায়?

কতক্ষণ পার হয়েছে জানিনা, সন্ধ্যে হবে হবে অবস্থা। মাঠের কোণার দিকে একটা কাঁঠাল গাছের গুঁড়ির ওপর বসে আছি এখনও। প্রচণ্ড তৃষ্ণা পেয়েছে, অথচ বাড়ি ফেরারও কোনো তাগিদ পাচ্ছি না। চলে যাবো এভাবে? ঘন্টা তিনেক আগেও কত কী ভাবছিলাম! দুরুদুরু বুকটাকে শাড়ির আঁচলে আগলে, একবুক প্রত্যাশা নিয়ে যে সাদা কাগজে নতুন কোনো গল্প লিখবো ভেবে এলাম, একটা কালির আঁচড়ও পরবেনা তাতে?

হায় খোদা! যদি শূন্যই করে দেবে তবে পূর্ণ করেছিলে কেনো? বেশ তো ছিলাম আমি একলা একলা! নিজের জগতে, নিজের মতো করে…

-‘এক্সকিউজমি আপু!’- কেউ একজন পাশে এসে দাঁড়ায়। ধ্বক করে ওঠে হৃদপিণ্ডটা, সে নয় তো?

নাহ! সে নয়! অন্য কেউ… তবে মুখটা চেনা, কোথাও দেখেছি একে!

-‘আমার নাম নিবিড়, আমি শোভনের বন্ধু। সেরকম বন্ধু নই, কেবল পাড়া-প্রতিবেশী ধরণের বন্ধুত্ব আরকি। শোভন আপনার সাথে যেটা করেছে একদমই ঠিক হয়নি সেটা… আমি বারবার না করেছিলাম ওকে কিন্তু..’

শোভন যে ঠিক কী করেছে আমার সাথে সেটাই আমি এখনো জানিনা! সে তো আর আমার সামনেই এলোনা। আমি তো দিব্যি আমার মত ছিলাম, শোভন কেনইবা যেচে আমার জীবনে আসতে চাইলো, কখনইবা আমি ওকে বন্দি করলাম যে এখন আবার মুক্তি চাচ্ছে, আর এমনটাই যখন করবে তখন কেনো অযথা আমায় টেনে এখানে নিয়ে এলো! এইতো গতকালও ফোনে কীসব বলছিলো, আর আজ কী হলো? সে যদি চলেই যাবে তবে এলোই বা কেনো, আর এলোই যদি তবে দু’দিন বাদেই চলে যেতে চায় কেনো? ঐ এক বাক্যের একটা চিরকুট, যে বাক্যটার কীনা কোনো আগামাথাই নেই- তাই দিয়ে কি এত প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়? যদি শোভন নিজে এসে আমায় স্পষ্টাস্পষ্টি প্রত্যাখ্যান করে যেতো, তো আমি গটগট করে হেঁটে এতক্ষণে বাড়ি ফিরে যেতাম ঠিকঠিক! কেননা, আমি তো আর সেধে সেধে ওর কাছে যাইনি, আর তাই আমাকে প্রত্যাখ্যানের অধিকার ও ওর নেই। ও কিছু বলবে বলেছিলো, তাই শুনতেই তো আমি এসেছি! কাউকে ডেকে এনে এবারে ‘আমি তোমার থেকে মুক্তি চাই’- এই কথা বলার কোনো মানে হয়?

কিন্তু তা তো সে করেনি! এই একবাক্যের একটা চিরকুট, একটা পৃষ্ঠার চারভাগের একভাগ- এই দিয়ে কী বুঝবো আমি?

সেদিনের বহুবছর পর অনেকবার ভেবে দেখেছি, বোধহয় সেজন্যেই অতক্ষণ ওখানে একা একা বসে ছিলাম আমি- একটা স্পষ্ট উত্তরের আশায়! ভাল-মন্দ, সুখ-দুঃখ সে যাই-ই হোক, অন্তত একটা উত্তরের আশায়…

-‘আপু, শোভন আসলে আপনার ঐ বোনকে পছন্দ করতো, নদীর পাড়ে একদিন ওকে দেখেই শোভন আমাদেরকে সেকথা জানায়। কিন্তু আপনার বোন শোভনকে বলে আপাতত কোনোরকম সম্পর্কে জড়াতে চায়না সে, তবে একটা শর্তে কেবল বন্ধুত্ব করতে রাজি আছে শোভনের সাথে। যদি শোভন আপনাকে পটাতে পারে তবে…’

ও! তবে এই কথা! সাগুফতাকে ছোটোবেলা থেকেই জানি আমি, নিজের মতের বিরুদ্ধে একটা শব্দও সহ্য হয়না ওর। সেদিন যে বলেছিলাম সুজনের সাথে ওর প্রেমটা হয়তো প্রেম নয়- তার জন্যে এতবড় শাস্তি আমার?

-‘আপু, আমি অনেকবার নিষেধ করেছিলাম শোভনকে, এমনকি সেদিন তেরাস্তার মোড়ে ওরা যখন আপনাদের পথ আটকে দাঁড়ালো আমাকে তখনো মিথ্যে বলেছিলো ওরা… আমি জানতাম যে আপনার বোনের সাথে কথা বলার জন্যেই ওরা সেদিন গিয়েছিলো! যেহেতু শোভন ওকে পছন্দ করে বলেছে, তাই আমিও ছিলাম সেদিন সেখানে… ‘

ব্যস! সমস্ত উত্তর পেয়ে গেছি এবারে! ঠিক যা ভেবেছিলাম তাই-ই! সাগুফতাকেই চেয়ছিলো শোভন, আমাকে নয়।

নাহ! দুনিয়া এখনো ওল্টায়নি! সাগুফতাকে ফেলে রাত্রিকে কেউ কোনোদিন পছন্দ করেনি- সবকিছু যেমন ছিলো তেমনই আছে।

কী ভীষণ বোকা আমি! এতশত বই পড়া জ্ঞান(!) আমার, তবু এটুকু মনে এলোনা- গল্পের নায়িকারা কখনোও কালো হয়না, অসুন্দরী হয়না।

সাগুফতাদের দুনিয়াতে রাত্রিরা কোনোদিনই গল্পের কেন্দ্রে থাকেনা! কোনোদিন না!

-‘অনেক ধন্যবাদ! আপনাকে আজীবন মনে থাকবে…’- এইতো কী স্বাভাবিকভাবে ছেলেটার সাথে কথা বলছি আমি! কোনো আক্ষেপ নেই, রাগ-দুঃখ কিংবা ক্ষোভ- কিচ্ছু নেই! আচ্ছা, মনের খুব গোপনে কি কেউ জানতো যে এমনটাই হবার ছিলো?

জানতো ই তো! আমার সেই বন্ধু- মিছিমিছি! কতবার বারণ করেছিলো সে আমায়! শুনিনি সেসব, অসম্ভবের পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছি বদলে। হলো তো তার শাস্তি এবার!

সন্ধ্যা ফুরিয়ে এসেছে প্রায়, রাত নামছে চারদিকে। অন্ধকার এখনো পুরোপুরি জাঁকিয়ে বসেনি। এই সন্ধ্যার হালকা আঁধারের ভেতরেও দিনের যতটুকু আলো অবশিষ্ট আছে- সেও আমার চেয়ে ফর্সা! আর, এই কালো- কুচ্ছিত মেয়েই কীনা ভেবে বসে আছে কোনো একজনের তাকে দেখে ভালো লেগে গেছে! আকাশ কুসুম বুঝি একেই বলে!

শাড়িটা এলোমেলো হয়ে গেছে, অভ্যেস নেই যে একদমই শাড়ি পরবার! রাজবাড়ির দাসী কিনা রাজপুত্রের আশায় শাড়ি জড়িয়ে, সেজেগুজে বিবাহমণ্ডপে হাজির হয়েছে! ছিঃ ছিঃ, কী দুর্বিষহ লজ্জা, কী ভয়ংকর অপমান! শরীরের কোষগুলোতে ‘মেলানিন’ বেশি- এই অপরাধের অপরাধী করে আর কাওকে পাঠিয়ো না খোদা এখানে, দেখলে তো প্রতি পদে পদে কেমন লাঞ্চনা সইতে হয়? আর যদি তবুও পাঠাও, তবে অন্তত দু’হাতে দুখানা খড়্গ দিয়ে পাঠিও- যেন ‘জয় মা কালী’ হর্ষধ্বনি শোনার সাথে সাথে দু’চারটা অসুর ও বধ করতে পারি।

অন্ধকারের বুক চিড়ে আরো অন্ধকার একটা অবয়ব ধীরপায়ে হেঁটে স্কুলমাঠ ছাড়ে। তারপর জনারণ্য পৃথিবীর বুকে নিঃসঙ্গ অবয়বটাকে দেখা যায়- স্কুলমাঠ, পোস্ট অফিস, বাঁশঝাড় আর সবশেষে উত্তরের দীঘি পেরিয়ে যেতে…তার চোখ বেয়ে কি অশ্রুধারা নেমেছে? কে জানে! লাঞ্ছনা আর অপমানের বোঝা মাথায় করে হেঁটে যাওয়া মেয়েটা বোধহয় মনেমনে আওড়ায়- ‘ হে ধরণী দ্বিধা হও!’- তাই-ই বা কে শোনে! ধরণী সেই কবে কোন সত্যযুগে অপমানিত, লাঞ্চিত সীতার লজ্জায় দ্বিধা হয়েছিলো… কলিযুগে তা আর হবার নয় বুঝি!

এর অনে..ক-অনেকদিন পর যেয়ে ঐ সরল, বোকাহাবা, অভিমানী মেয়েটার কথা ভেবে আমার বড় কষ্ট হবে। অনেক বছর পর, লোকারণ্য কোনো লাইব্রেরির কোণায় বসে আমি ভাববো- ‘আহ! যদি পারতাম ঐ সতের বছরের মেয়েটার কানেকানে ফিসফিস করে বলে আসতাম- ”অভিমান করোনা মেয়ে! বিশ্বাস করো, শোভনের মত কোনো অপদার্থের জন্য তুমি জন্মাওনি! বিশ্বাস করো!”

কিন্তু সেটা হয়না! বাইশ বছরের রাত্রি পৌঁছতে পারেনা সেই সতের বছরের রাত্রির কাছে।

সতের বছরের মেয়েটা তাই পুরো বিশ্বসংসারের ওপর অভিমান করে বসে। পণ করে বসে- এই এক জীবনে আর কাউকে বিশ্বাস করে ঠকবে না সে!

তিলেত্তমা পর্ব ৩

0

তিলোত্তমা
পর্বঃ ৩

-‘রাত্রি! চুপচাপ দৌড় দে! খবরদার, এর সাথে কথা বাড়াস না’- আমি টের পাই বুকের ভেতরের গহীন কুঠুরিতে বসে বসে আমার সেই বন্ধু ‘মিছিমিছি’ আমাকে বলছে।

কিন্তু পা দুটো যেনো আটকে গেছে মাটির সাথে, ঠায় দাঁড়িয়ে আছি কেবল মূর্তির মত!

-‘যাকগে! তুমি বোধহয় ভয় পাচ্ছো। আমি বাঘ-ভাল্লুক নই, রাত্রি! কাল এখানে থেকো- কথা আছে!’- এই বাক্যটুকু বলেই শোভন নামের অদ্ভুত ছেলেটা পেছন ফিরে চলে গেলো! কতক্ষণ একভাবে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা, ঘোর ভাঙে সাগুফতার ডাকে।

-‘কী রে! বন্ধ বই হাতে নিয়ে এমন পুতুল সেজে দাঁড়িয়ে আছিস ক্যানো?’

-‘হু! ও তুই! না কিছুনা, চল যাই!’

তারপরের পুরো দিনটা যে কীভাবে গেলো আমি জানিনা! ঘোরগ্রস্তের মত কেবল হেঁটে-চলে বেরিয়েছি বোধহয়। মনের ভেতর থেকে ‘মিছিমিছি’ বারবার বলছিলো- ‘যাসনে রাত্রি! যাসনে!’ অথচ ঠিকই পরদিন বিকেল হতে না হতেই বুকের ভেতরে একশো প্রজাপতি ডানা মেলে ওড়াওড়ি শুরু করে দিলো! অজান্তেই টুকটাক সাজগোজ ও করে ফেললাম। ছিছি! সেকথা ভাবলে এখনো লজ্জায় গা রি রি করে ওঠে! মায়ের আগ্রহে বহু প্রসাধনী মাখামাখির পর মুখটাকে কিছুদিন শান্তি দিয়েছিলাম নানুবাড়ি এসে, সেই আমিই সাগুফতার থেকে চেয়ে নিয়ে মুখে ফাউণ্ডেশন মাখলাম, পাউডার লাগালাম, ঠোঁটে লিপস্টিক, কানে চকমকে পাথর বসানো দুল- রীতিমত সঙ সাজা বলে যাকে! কী অদ্ভুত! এতটা কমবয়েস ও তো ছিলোনা আমার! কতশত বই পড়া আমি, কতজনের কতরকম প্রেমের অভিজ্ঞতার ঘটনা শুনে কান পাকানো আমি কী না এই একজনের, একদিনের, দুটো বাক্য শুনেই কেবল এভাবে গলে পানি হয়ে গেলাম?

কী অদ্ভুত! কী অদ্ভুত!

বই একটা নিয়ে গেছিলাম হাতে করে, সে কেবল শো-পিস! মুখের সামনে কেবল ধরে বসে ছিলাম, সাদা কাগজের কালো অক্ষরগুলি আদৌ মস্তিষ্কে ঢোকেনি একটাও। বুকের ভেতর ধ্বকধ্বক বাদ্য বাজছিলো অনবরত… কে এই ছেলে? আমায় চেনে কীভাবে?

-‘রাত্রি!’- অচেনা কণ্ঠে দুই অক্ষরের চেনা শব্দটা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাই।

এসেছে!

-‘জি! আপনি… মানে আপনি আমার নাম জানলেন কী করে?’- পুরো একটা দিন ধরে সাহস সঞ্চয় করে, মনে মনে একশোবার এই সময়টার মহড়া দিয়ে, রীতিমত ‘স্ক্রিপ্ট তৈরী করে নিয়ে এসেও শেষে কিনা তোতলাচ্ছি!

-‘যা জানা দরকার তা মানুষ যে করেই হোক জেনে নেয়, রাত্রি! ঐযে বলেনা- পথ পথিকের সৃষ্টি করেনা বরং পথিকই পথের সৃষ্টি করে নেয়?’

ও বাবা! এ দেখি বাংলা ব্যাকরণ বই থেকে quote করছে! এমন ভারী ভারী কথার কী জবাব আমি দেবো?

-‘যাকগে, তুমি বোধহয় ফ্রি হতে পারছো না, ভেবেছিলাম এমনই হবে! নাও এটা ধরো- সুবিধামত যোগাযোগ করো!’- ছোট্ট আধাপাতার একটা চিরকুট বাড়িয়ে ধরলো সে। প্রচণ্ড ভয়ে আমার নিজেকে বিবশ লাগছিলো, আচ্ছা মামা বা মামার কোনো বন্ধু যদি এখন আমাদের দেখে ফেলে তখন? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পলক ফেলছিলাম কেবল, হাত বাড়িয়ে চিরকুটটা নেবার মত শক্তি কিংবা বুদ্ধি কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অবশেষে…

অবশেষে বাম হাতখানা বাড়িয়ে আমার ডানহাতে ধরে চিরকুটটা মুঠোয় পুরে দিয়ে খানিক হাসে শোভন, কী মিষ্টি ওর হাসিটা! তারপর ‘আসছি! অপেক্ষায় থাকবো বলে দিলাম!’- বলেই চলে যায়।

মুঠোর ভেতর জ্বলন্ত অঙ্গার নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রই শতবর্ষী বটগাছটার মত!

সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা ছিলো, দু’য়েক মুহূর্ত বাদেই টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো।

যেন বহুকাল পরে সাগুফতা ফিরে এলো। হাতের চিরকুটটা দেখে একেবারে হইহুল্লোড় শুরু করে দিলো সে! একটা ফোন নাম্বার শুধু লিখা ওতে, আর কিছুনা। সাগুফতা পারলে তক্ষুণি ফোন দেয় ঐ নাম্বারে, আমি অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওকে থামালাম। দু’জনে বাড়ির পথে যাচ্ছি। আমার হাতে তখনো গল্পের বইটা ধরা, বইয়ের ভেতরে চিরকুটটা স্থির হয়ে বসে আছে। জ্যান্ত বিড়ালছানার মত লাফাচ্ছে কেবল আমার বুকের ভেতরটা!

-‘কে রে এই ছেলে? আমায় দেখাস তো এরপরেরবার এলে! ক্যামন রে দেখতে? হাইট কতো? নাম কী?…’

নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলাম আমরা, সাগুফতা একাধারে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছিলো। একটু এগোতেই একটা তেরাস্তার মোড়, মোড় থেকে সোজা হেঁটে খানিকদূর গেলেই নানুদের বাড়িটা। চাইলে ডানদিকের রাস্তাটা ধরেও যাওয়া যায়, একটু ঘুরপথে। মোড়ে যেতে না যেতেই সাঁই করে একটা বাইসাইকেল একেবারে আমার পাশ কাটিয়ে সজোরে সামনে যেয়ে থামলো। চমকে সেদিকে তাকালাম- শোভন! কোথা থেকে ডানদিকের রাস্তাটা দিয়ে এসে পাশ কাটিয়ে একেবারে আমাদের সামনাসামনি এসে থেমেছে! সাগুফতা আর আমার- দু’জনেরই গতিরোধ হলো, চমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম আমরা।

এরই মধ্যে ঐ একই পথ ধরে আরো তিন-চারজন একই বয়সী ছেলে বাইসাইকেল করে এসে মোড়টায় জমায়েত হয়েছে, ডানদিকে যাবার রাস্তাটা ব্লক করে দিয়ে। বৃষ্টির বেগ এরমধ্যেই খানিকটা বেড়ে গেছে, নানুবাড়ির এত কাছে এসে এইভাবে এই অবস্থায় যদি কেউ আমাদের দেখে ফেলে? ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যাচ্ছে আমার, এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব পালাতে পারলে বাঁচি! কিন্তু বাড়ি যাবার দু’দিকের রাস্তাই আটকে রেখেছে ছেলেদের দলটা। ভোম্বলের মত কেবল শোভনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মেরুন রঙের একটা ফুলহাতা শার্ট পরনে, হাতা দুটো নিপাট ভাঁজ করে কনুইয়ের কাছটাতে গুঁজে রাখা। সেই অদ্ভুত হাসিটা ঠোঁটে ঝোলানো তার! বাইসাইকেলের কিকস্ট্যাণ্ডটা বৃষ্টিভেজা মাটিতে গেঁথে এলোমেলো চুলগুলি বামহাতে পেছনে সরিয়ে একেবারে চোখের ভেতর দিয়ে অন্তরের গভীরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল!

-‘উফফ! মা..রডালা!’- সাগুফতা আমার দিকে ঝুঁকে বিড়বিড় করে বললো।

আমার পাথর হয়ে যাওয়া চোখজোড়া কেবল দেখতে পেলো পায়ে পায়ে এদিকেই আসছে শোভন। চোখ থেকে খবর গেলো মস্তিষ্কে, আর সেখান থেকে সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে, সমস্ত শিরা-উপশিরায়!

ভীতুর ডিম পা জোড়া দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য হয়ে বামদিকের রাস্তায় দৌড় লাগালো!

একটু বাদে টের পেলাম উপায়ন্তর না পেয়ে সাগুফতাও আমার পেছন পেছন দৌড় লাগিয়েছে!

-‘কী ভীতুর ডিম রে তুই রাত্রি? ছেলেগুলি সব হাঁ হয়ে তাকিয়ে ছিলো! এভাবে দৌড় দিলি ক্যানোও?’- হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করে সাগুফতা। বামদিকের রাস্তা ধরর হেঁটে প্রাইমারি স্কুলের মাঠের কাছাকাছি এসে পড়েছি প্রায়, খানিকক্ষণ এখানে অপেক্ষা করে আবার তেরাস্তার মোড় হয়েই বাড়ি ফিরতে হবে!

-‘কেউ দেখে ফেললে? তখন?’

-‘আরে! ও তো শোভন! ছোটমামার বন্ধু রাজীবমামার ভাইয়ের ছেলে! ওর সাথে কথা বলতে দেখলেই বা কী হতো?’

-‘তুই চিনিস ওকে!’

-‘হ্যাঁ! রাজীবমামাকে তো তুইও চিনিস, তারই তো ভাস্তে! যাকগে, যাহোক।শেষমেশ তোর ও কপাল খুললো, বল? আচ্ছা, এবার এই নে ধর, ফোন কর!’- হাতের মোবাইল ফোনটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় ও।

-‘ধুর! আমি অতসবে নেই! কোথাকার কে না কে…’

মুখে বললেও মন জানে- এর সব মিথ্যে! আগাগোড়া সব জানার জন্য বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে আমার। কে এই শোভন? আমার নাম জানলো কী করে? আর কেনইবা আমার সাথে কথা বলতে চায়? আচ্ছা, আমায় যখন দেখেছে তখন নিশ্চয়ই সাগুফতাকেও চোখে পড়েছে ওর! ওকে ফেলে আমাকে পছন্দ করেছে কেউ-এমনটাও কি সম্ভব? আচ্ছা, এমন তো নয়- যে সাগুফতার কাছে যাবার জন্যে আমাকে সহজ সিঁড়ি ভেবে নিয়ে কথা বলতে চাইছে শোভন বলে ছেলেটা? চকিতে এমন একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় খেলে যায় আমার, সত্যিই তো! হলে এটাই হবে!

-‘সিফু, আমার মনেহয় ঐ ছেলের তোকে ভালো লেগেছে। তোর কাছে যাবার সাহস না পেয়ে আমায় এসে ধরেছে…’

সাগুফতা সরু চোখে তাকায়।

-‘তোর মাথায় এতসব বুদ্ধি-কুবুদ্ধি ঘোরে রে রাত্রি! ছাইপাশ নোভেল-উপন্যাস পড়ে পড়ে এসব হয়েছে বুঝলি!’- নাক টেনে টেনে বলে সাগুফতা।

সাগুফতার হাজার জোরাজোরি সত্ত্বেও সেদিন আর কিছুতেই ঐ চিরকুটের নাম্বার ফোন দিতে সাহস হয়নি আমার। মনের ভেতর থেকে ‘মিছিমিছি’ বারবার বারণ করছে যে!

পরদিন একটু বেলা হতেই আবার ধরে বসে সাগুফতা। এদিকে এতগুলো ঘন্টা আমার সাথে মারামারি করে ‘মিছিমিছি’ও ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে- ‘মরগে যা! পরে আমার কাছে কাঁদতে আসিসনে যেনো!’- বলে!

-‘এই রাখলাম ফোন! বিশ মিনিট সময়, আমি গোসল সেরে আসার মধ্যে যদি call করিস তো করবি নয়তো সুযোগ শেষ! এরপর সারাদিনের জন্য আমার দখলে চলে যাবে ফোন- বলে দিলাম!’- দু আঙুলে আমার নাকে চেপে ধরে মাথাটাকে ডানে-বামে ঘুরিয়ে চলে যায় সাগুফতা।

ফোনটা যেন দুর্বোধ্য যান্ত্রিক কোনো ভাষায় ডাকছে আমাকে! জানিনা কী ভেবে সবে হাতে তুলে নিয়েছি, সাথে সাথে ভেতর থেকে ‘মিছিমিছি’ আবার বলে উঠলো-

‘ছি রাত্রি! কী ছেঁচড়া রে তুই!’

-‘চুপ মিছিমিছি! একদম চুপ! তুই কী জানিস এসবের?’

তবু মিছিমিছি চুপ করেনা, গজগজ করতে থাকে।

আর আমি?

আমি ঘোরগ্রস্তের মত বাটন চাপি- ০১৬৩….

-‘হ্যালো!’- অপর প্রান্তের কণ্ঠটা বুকের ভেতর মাদল বাজিয়ে দেয় যেন!

-‘জি! হ্যালো?’

-‘রাত্রি!’- যেন বিস্ময়ের একটা অস্ফুট শব্দ কানে এলো আমার।

-‘ফোন করলে তবে অবশেষে! কেমন আছ?’

-‘জি, ভালো! আপনি কেন অযথা এমন করছেন বলুন তো!’

-‘অযথা!!’- প্রায় চিৎকার করে ওঠে শোভন।

‘তোমার কাছে অযথা মনে হতে পারে রাত্রি,কিন্তু আমার কাছে তো নয়!

এপ্রান্তে আমি নিশ্চুপ! ফোন ধরা ডান হাতটা কাঁপছে অনবরত, তাল মিলিয়ে মাথাটাও কেমন দুলছে। আচ্ছা, অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে যাবনা তো আবার?

-‘কথা বলবেনা তো? আচ্ছা বেশ, দরকারটা যখন আমার তখন আমিই নাহয় বলছি! রাত্রি! গত পাঁচটা দিন ধরে কেবল তোমাকে একনজর দেখবার জন্য নদীর পাড়ে ঘুরেছি! শেষে সেদিন সাহস করে কাছে গেলাম… আমার তোমাকে ভালোলাগে রাত্রি! প্রথম যেদিন বিকেলের আলোয় তোমাকে দেখলাম- থমকে দাঁড়িয়ে গেছিলাম জানো? কী ভয়াবহ রকমের শান্ত, সুন্দর একটা মেয়ে!…’

-‘বানিয়ে ছানিয়ে ক্যানো এসব বলছেন? সুন্দর শব্দটা আমার সাথে যায়না সে আমিও জানি। শুধু শুধু…’

আমার কথা শেষ না হতেই ওপাশ থেকে মৃদু একটা গুঞ্জন কানে আসে আমার। ভালমত কিছু বোঝার আগেই ফোনটা কেটে যায়। খানিক বাদে আবার রিং হয়, শোভন কল ব্যাক করেছে!

-‘হ্যালো!’

-‘তোমার কথাগুলো একেবারেই অবান্তর রাত্রি! ফোনে আর কত কী বলবো, কাল বরং প্রাইমারি স্কুলের মাঠটায় চলে এসো বিকেলের দিকে? ওদিকটা নির্জন আছে একটু, কারো দেখে ফেলার ভয় থাকবেনা!’

ফোন রেখে দিলো শোভন।

না, জ্ঞান হারাইনি এখনোও! নিজের হাতে চিমটি কেটে দেখলাম- কল্পনা কিংবা স্বপ্ন নয়, বাস্তবেই ঘটছে এসব!

মানুষ কত অদ্ভুত, না? এই আমি সুজনের কথা শুনে সেদিন সাগুফতাকে বোঝাতে যেয়ে কত বড়বড় শেখা বুলি কপচিয়ে গেলাম, অথচ সেই আমিই এখন একজনের সাথে সবে দু’দিনের পরিচয়ে মনে মনে তাকে নিয়ে খেলাঘর পেতে বসেছি!

কোথাও সাদা কাগজ দেখেছি? তো সেই চিরকুটটার কথা মনে পরছে!
বাইসাইকেলের বেল-এর ক্রিংক্রিং আওয়াজ কানে এসেছে? তো এক ঝলকে সেদিনের কথা মাথার ভেতর উঁকি দিচ্ছে! ইশ! কী হতো আরেকটুখন ঐ তেরাস্তার মোড়ে দাঁড়ালে?

ফোন নাম্বারটা ঠোঁটস্থ, মুখস্থ, কণ্ঠস্থ করে ফেলেছি একেবারে! দিনের মধ্যে একশো একবার করে কেবল ওটাই আওড়ে যাচ্ছি!

আচ্ছা, একেই কি সবাই প্রেম বলে?

-‘বাপরে বাপ রাত্রি! তলে তলে এত্ত?’- সাগুফতার কথার সুরে চমকে তাকাই। কী হলো আবার?

ঠোঁট টিপে হাসছে সাগুফতা। ওর চোখের ইশারামত সামনে তাকাতেই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরে বুকের ভেতরটায় আমার…যদি ফর্সা হতাম তো এতক্ষণে বোধহয় গাল-টাল সব লাল হয়ে যেতো। ঐ গল্প-উপন্যাসের সুন্দরী নায়িকাগুলোর মত!

ছোটমামার টেবিলে বসে, ওর ই একটা খাতার মলাটে কলম চালিয়ে কেবল একজনের একটা নাম ই লিখে গেছি এই এতক্ষণ ধরে! বসে বসে তো আকাশ পাতাল ভাবছিলাম আর এদিকে অজান্তেই খাতার মলাট ভরিয়ে ফেলেছি ‘শোভন’, ‘শোভন’ লিখে!

কী লজ্জা! কী লজ্জা!

-‘তাড়াতাড়ি খাতাটা লুকিয়ে ফ্যাল! মামা দেখলে না! খবর হয়ে যাবে কিন্তু, হুউ!’

কী বিপদ! দ্রুত খাতাটা খুলে দেখলাম ভেতরে ছোটমামার গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে কিনা। নাহ! ভাগ্য ভালো বলতে হবে! কেবল দুই-একটা বাজারের লিস্ট ছাড়া আর তেমন কিছু নেই। তড়িঘড়ি খাতাটা নিয়ে ব্যাগে বন্দি করে ফেললাম।

হয়ে গেছে যা হবার! আটকে গেছি জালে!

-‘তো নায়িকা আপা? দিবস রজনী আপনি যে কার আশায় আশায় থাকেন- সে জানে এসব?’- সাগুফতা চোখ মটকায়।

-‘ধুর! সিফু! যা ভাগ!’- ওর হাত থেকে গামছাটা কেড়ে নিয়ে দৌড়ে গোসলঘরের দিকে যাই আমি। মাথার ভেতর ততক্ষণে বেজে চলেছে-

‘দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।
তাই চমকিত মন, চকিত শ্রবণ, তৃষিত আকুল আঁখি॥’

পুতুলনাচের পুতুলের মত ঠিকঠিক পরদিন বিকেল হতেই প্রাইমারি স্কুলের মাঠে হাজির হয়ে গেলাম! সাগুফতাও ছিলো সাথে। বাসা থেকে সব পুরান-ধুরান জামাকাপড় নিয়ে এসেছিলাম নানুবাড়িতে, গ্রামে এলে তো এমনিতেই কাপড়চোপড় ময়লা হয় বেশি। তাই ভাল জামাগুলো ইচ্ছে করেই আনিনি। সাগুফতাই বুদ্ধি দেয় ছোটোখালামনির শাড়ি পরে আসার! প্রথমে তো একদমই রাজি ছিলাম না আমি, তারপর সাগুফতা বললো এমনিতেও ও আজকে শাড়িই পরবে, সুজন নাকি ওর কাছে ছবি চেয়েছে শাড়ি পরা অবস্থায়! ছোটমামার একটা ডিজিটাল ক্যামেরা আছে, দু’জনে মিলে ওতে শাড়ি পরা ছবিও তোলা হয়ে যাবে এই ফাঁকে!

বেশ, শেষে পরলাম শাড়িই দু’জনে মিলে! সাগুফতাকে একেবারে পরীর মত লাগছিলো! মিথ্যা বলবনা, ওর পাশে নিজেকে দেখে একটু… না না, একটু না, বেশ অনেকখানিই মন খারাপ লাগছিলো আমার। কী বেমানান লাগছে ওর পাশে আমায়! একই পোশাক, একইরকম ভাবে পরেছে দুজন মানুষ, অথচ দেখো- একজনকে লাগছে আকাশের পরীর মত আর আরেকজনকে লাগছে বাঁশঝাড়ের পেত্নীর মত!
ধুর!

টপাটপ দু’চারটা ছবি তুলেই তড়িঘড়ি বেরিয়ে স্কুলমাঠে এসেছি দু’জনে মিলে। সাগুফতা সুজনকে MMS করে ছবি পাঠাচ্ছে, আমি ওর পাশেই গালে হাত দিয়ে বসে আছি।

সে আসেনি এখনোও…

তিলেত্তমা পর্ব ২

0

গল্পঃ তিলোত্তমা
পর্ব: ২

সেই ক্লাস ফাইভের রাত্রি, সাড়ে তিনফুটের জেদী মেয়েটা আচমকা একদিন টের পেলো পৃথিবীর বুকে যে গল্পটা হাতে নিয়ে সে এসছে, সেটা তার বড় একলার, বড় নিজস্ব। আর কেউ এই গল্পের ভাগীদার হতে চায়নি কোনোদিনই, কেবল প্রকৃতির নিয়মে বাধ্য হয়ে জড়িয়ে গেছে! সেই রাতে আমি অনেক্ষণ কেঁদেছিলাম, অনেক্ষণ। ছোট্ট বুকটার ভেতর কী প্রচন্ড রকমের কষ্ট হচ্ছিলো সেদিন আমার! এখনো চোখ বুজে সেদিনের কথা ভাবলে টের পাই বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। এগারো বছরের সেই রাত্রি বুকের ভেতর একটা কুঠুরী বানাতে শুরু করলো সেদিন থেকে। খুব গোপন, অন্ধকার একটা কুঠুরী- তার বাইরের রঙটার থেকেও গভীর কালো! চারপাশ থেকে আসা সমস্ত আঘাত, হাস্যছলে বলা সমস্ত অপমানগুলো এক একটা দুঃখবই বানিয়ে করে সেখানে জমাতে থাকলো সে। বয়েস বাড়ে, সাথে জমতে থাকা দুঃখবইও! মনেমনে নিজের একজন খুব কাছের বন্ধু বানিয়ে নিলাম তারপর, নাম দিলাম- ‘মিছিমিছি’! মন খারাপ হলেই সেই মিছিমিছি নামের মেয়েটার সাথে মনেমনে কথা বলতাম আমি, দু’জনে মিলে গান গাইতাম, আমি প্রশ্ন করতাম সে উত্তর দিতো আবার পালটা প্রশ্নও করতো আমায়! আর তারও অনেক পরে এই ডায়েরিটাকেও আমাদের দু’জনের বন্ধু বানিয়ে নিলাম- এখন তিনজনে মিলে ভালই আছি!

বোধহয় আমার মত একলা গল্প নিয়ে আসা মানুষগুলির জন্যেই সৃষ্টিকর্তা এই ‘মন’ বলে জিনিসটা বানিয়ে দিয়েছেন! নয়তো এই এত এত মানুষভরা পৃথিবীতে এরা একলা একলা বাঁচতো কী করে?

আমাদের স্কুলে একজন নতুন অঙ্কের স্যার এসেছেন, খুব সুন্দর করে ধীরে ধীরে বুঝিয়ে পড়ান। সপ্তাহখানেক তাঁর ক্লাস করেই টের পেলাম ধীরে ধীরে গণিত বিষয়টা ভালো লাগছে আমার। কী মনে করে কে জানে, মা’কে যেয়ে বললাম আগের অঙ্ক স্যারের বদলে ওনার কাছেই কোচিং করতে চাই আমি। মায়ের অবাধ্য মেয়ে আমি, আরো আগে থেকেই নিজের ইচ্ছেমত টিচার অদলবদল করি- মাও তাই বিনা বাক্য ব্যায়ে রাজি হয়ে গেলেন। অন্তরীক্ষে কেউ একজন বোধহয় একটা প্রশ্রয়ের মুচকি হাসি হাসলেন। বহুবছর পর জেনেছি- জীবনের সবচেয়ে সঠিক আর সবচেয়ে সুন্দর সিদ্ধান্তটা আমি সেদিন নিয়েছিলাম।

আর সবচেয়ে বিচ্ছিরি আর ভুল সিদ্ধান্তটা? পেছন ফিরে তাকালে যে দিনটার কথা ভেবে আমার সবচেয়ে বেশি আফসোস হয়, ঐ বোকা রাত্রি নামের একরত্তি মেয়েটার জন্য বড় করুণায় বুকের ভেতরে হাহাকার করে ওঠে- সেই দিনটা?

সবে এস.এস.সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে আমাদের। আমার দুই মামা, ছোটোখালা আর নানা-নানী সকলে মিলে রাজবাড়ীর একটা গ্রামে থাকেন, বড় বন্ধ পেয়ে আমি আর সাগুফতা দু’জনেই নানুবাড়ি বেড়াতে চলে এসেছি। নানুদের বিশাল বাড়িটা একেবারে পুরনো আমলের জমিদারবাড়ির মতন দেখতে- চারদিকে বড় বড় ঘর তোলা, মাঝে ছড়ানো উঠান, বাড়ির প্রবেশদ্বারে জোড়ায় জোড়ায় সারি সারি নারকেল গাছ, উঠানে ঢুকতেই নানীর হাতে গড়া টুকরো বাগান আর উত্তরে, বাড়ির একেবারে পেছনে একটা দীঘি।

আমার নিজের কোনো মোবাইল বা কম্পিউটার নেই। নেশা বলতে এক গল্পের বই আর দুই গান শোনা! সাগুফতাকে অবশ্য বড়খালা একটা ফিচার ফোন কিনে দিয়েছিলেন গতবছর, বৃত্তি পেয়েছিলো বলে উপহার হিসেবে চেয়ে নিয়েছিলো ও-ই। স্কুলের লাইব্রেরি থেকে বেশ ক’টা বই বাগিয়ে নিয়ে নানুবাড়ি যেয়ে অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম সেই ফোনে-ফোনে কীভাবে কীভাবে একটা ছেলের সাথে নাকি প্রেম হয়ে গেছে সাগুফতার! স্কুলের অনেক মেয়েরাই আরো আগে থেকেই এ ধরণের সম্পর্কে জড়িয়ে গিয়েছিলো সে আমি জানতাম। কিন্তু তাই বলে সাগুফতা! বড়খালার বাধ্য মেয়ে, মায়ের চাঁদপানা মুখের মেয়ে, বড়মামার আদরের মেয়ে- সাগুফতা!

-‘সুজন আমাদের সাথে একই কোচিং এ পড়ে, সেখান থেকেই পরিচয় হয়েছে আমাদের।’- সাগুফতা চোখ মটকে বলে।

-‘তারপর?’- আমি বোকার মত জিজ্ঞেস করি।

-‘তার আবার পর কী? তুই তো জানিসই ছেলেরা ক্যামন ঘোরে আমার পিছপিছ! সেরকমই… সুজনটা হ্যাংলার মত পেছন পরে রইল, শেষমেশ আমিও গলে গ্যালাম!’- সাগুফতা হাত নাড়ায়, যেন মাছি তাড়াচ্ছে। আমি গোগ্রাসে গিলতে থাকি ওর কথা।

-‘এই-ই! ওরকম তো কতজনেই তোর পেছন পেছন ঘোরে! এর বেলায়ে হঠাৎ গলে গেলি যে?’

-‘তুই তো দেখসনি সুজনকে! সেইই হ্যাণ্ডসাম! আর, ঝিনাইদায় ওদের বিশা-ল বাংলোর মত বাড়ি…’

আমি প্রচন্ড অবাক হয়ে সাগুফতার দিকে চেয়ে রই। এভাবে বুঝি ভালবাসা হয়? এই বয়সে হাজারখানেক বই পড়া শেষ আমার, মাথার ভেতর চকিতে খেলে যায় সবগুলো প্রেমকাহিনী। নাহ! এরকমভাবে যে সম্পর্কের শুরু সেটা কখনোই সত্যিকারের সম্পর্ক হতে পারেনা! সেই কথাটাই সাগুফতাকে বলি-

-‘টাকা পয়সা আর হ্যাণ্ডসামনেস দেখে কি ভালোবাসা হয়?

-‘তো? কী দেখে হয় তাহলে?’- সাগুফতা ঘাড় নাচায়।

-‘আমি কত বইতে পড়েছি, এভাবে মোহ তৈরি হয়। কিন্তু… কিন্তু তা দিয়ে পুরো একটা জীবন কাটানো যায়না…’

সাগুফতা আগুন চোখে আমার দিকে তাকায়।

-‘তুই এসবের কী জানিস? কেউ কোনোদিন করেছে তোকে প্রোপোজ? তুই জানিস, সুজন যেদিন আমাকে প্রোপোজ করেছিলো সবচেয়ে দামী চাইনিজ রেস্টুরেন্টটার টপ ফ্লোর পুরোটা সারাদিনের জন্য book করে নিয়েছিলো! শোন, অন্তত তোর কাছ থেকে প্রেম-ভালোবাসার জ্ঞান নিতে হবেনা আমাকে!’

সত্যিই, বড় বেশি বলে ফেলেছি। তাইতো! এসবের আমি কী জানি? আমাদের স্কুলের প্রায় সবারই দু’একবার উড়োচিঠি পাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে এরমধ্যেই! আয়েশা, সুমি, রুমানা- এদের একনজর দেখার জন্য তো স্কুলের গেটের সামনে ছেলেদের লাইন পড়ে যেতো! পরে প্রিন্সিপাল ম্যাডামের হস্তক্ষেপে সেসব এখন কমেছে। আর আমি? গত দুই বছর ধরে তো একলা একলাই যাতায়াত করছি। না কেউ কোনোদিন ভুলেও একটা চিঠি দিলো, আর না কেউ কোনোদিন একবারের বেশি দু’বার ফিরে তাকালো!

আমি তাই চুপ হয়ে যাই, ঘাড় গুঁজে দেই বইএর ভেতর। বোধহয় দু ফোঁটা নোনাজল বেয়ে পরে বইএর পাতায়, কে জানে তার খবর? সাগুফতা তখন SMS bundle কিনে নিয়ে সুজনের সাথে টেক্সটিং এ ব্যস্ত…

এর আগে ডিসেম্বরে স্কুল ছুটি হলেই আমরা দৌড়ে নানুবাড়ি চলে আসতাম। খুব মজা হতো সেসময়, এখানে আমাদের সমবয়সী মেয়েদের সাথে কতরকম খেলা যে খেলতাম! ছি-বুড়ি, কানামাছি, বউছি, বরফ-পানি, কুমির ডাঙা, ডাক ডাক বেলী… কত্তকিছু! একবার তো ব্যাট আর বল যোগাড় করে ক্রিকেট ও খেলেছিলাম।

কিন্তু এবার সব কেমন ওলট-পালট হচ্ছে! গ্রাম এলাকা বলে আমাদের সমবয়সী অনেক মেয়েদেরই এরমধ্যেই বিয়ে-থা হয়ে গেছে, আর যারাওবা বাকি আছে এরা এখন আর এসব খেলে-টেলে না! কেমন বড় মানুষের মত মুখ করে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়, গ্রামের মেয়েরা বোধহয় দ্রুত বড় হয়ে যায়! ওদিকে সাগুফতাটাও ফোনে মজে আছে, এবার বেশিরভাগ সময়টাই দীঘির পাড়ে বসে বই পড়ে পড়েই কাটাচ্ছি তাই। বাড়িতে মামারা থাকেন বলে সাগুফতা প্রায়ই আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে বলে নদীর পাড়ের দিকে চলে যায়, তারপর আমাকে পাহারায় বসিয়ে দিয়ে সুজনের সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত হয়ে পড়ে! প্রায়ই এমন হতো, আমি নদীর এক ধারে বসে ঘাড় গুঁজে বই পড়ে চলেছি- কখনো জাফর ইকবাল, কখনো হুমায়ূন আহমেদ অথবা কখনো নিতান্তই কোনো ছোটদের ভূতের গল্পের বই- যেটা কিনা ছোটখালা আমাকে পাশের বাড়ি থেকে ধার করে এনে দিয়েছেন! সত্যি বলতে ঐ সময়টায় আর কোনো কিছু খেয়াল থাকতো না আমার। একমনে ডুবে যেতাম বইয়ের ভেতর, কীসের পাহারা দেয়া কীসের কী! সাগুফতা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতো ফোনে, কখনো কখনো বেশ দূরেই চলে যেতো। ওদের কথা বলা শেষ হলে পরে আবার আমায় নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতো। এভাবেই চলছিল দিনগুলি। এই বড় অনিয়মের নিয়ম করা দিনগুলিতে হঠাৎ একদিন… এক রবিবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটলো!

প্রতিদিনকার মতই সাগুফতা ব্যস্ত ছিলো ফোনে আর ঘাড় গুঁজে বই পড়ছিলাম আমি নদীর ধারে বসে বসে, হঠাৎ-ই কোত্থেকে কেউ একজন এসে ধপাস করে বসে পরলো আমার পাশে।

-‘ওমা! কথা শেষ আজকে এত তাড়াতাড়ি? বাড়ি যাবি নাকি…’

ভেবেছিলাম সাগুফতা এসেছে বোধহয়। কথা বলতে বলতেই বইটা বন্ধ করে ঘাড় ঘুরাই। প্রচণ্ড বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখি সাগুফতা নয়, সম্পূর্ণ অচেনা একজন এসে বসে আছে আমার পাশে।

একটা ছেলে! আমাদেরই বয়সী!

তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াই আমি, সাথে সাথে সে-ও উঠে দাঁড়ায়! মিষ্টি একটা হাসি ঝুলিয়ে বলে-

-‘হাই! আমি শোভন! ঢাকায় থাকি, এখানে দাদুর বাসায় বেড়াতে এসেছি।’

আমি থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম কেবল। এপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে খানিক বাদে আবার ছেলেটা বলে উঠে-

‘আচ্ছা তোমাকে মানে আপনাকে বলতে হবেনা কিছু! আমি জানি আপনার নাম রাত্রি!’

কী ভয়ঙ্কর! কে এই ছেলে? কোত্থেকে এভাবে উদয় হলো! নিজেকে একেবারে বোবা লাগছে আমার…

(চলবে)

(কপি বা শেয়ার না করবার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে)
পরের পর্ব

তিলেত্তমা পর্ব ১

0

গল্পঃ তিলোত্তমা
পর্বঃ ১

-‘হিহি! ভাগ্য ভালো আল্ট্রাসোনোগ্রাফি করার সময় বাচ্চার গায়ের রঙ জানা যায়না, নাইলে খালামনি বোধহয় তোকে এবর্ট-ই করে ফেলতো!’- হাসতে হাসতে বলল সাগুফতা। আমি গরুর মত বড়বড় চোখজোড়া মেলে কেবল নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলাম ওর হাস্যোজ্জ্বল, সুন্দর, দুধসাদা মুখটার দিকে। আচ্ছা, মানুষের গায়ের রঙ আর মনের রঙ এক হয়না কেন?

অবশ্য সাগুফতারই কী দোষ দেয়া যায়? সাগুফতার খালামনি, মানে আমার নিজের মা-ই যে বীজ বুনে গেছেন, সেই চারাগাছে সার-পানি দিচ্ছে বলে সাগুফতাকে আর কতটুকুইবা দায়ী করা যায়! বড়খালু, বড়খালা আর তাদের একমাত্র মেয়ে সাগুফতা সবে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছে কি ঢোকেনি, মায়ের সেই পুরনো রেকর্ডারটা বাজতে আরম্ভ করেছে-

‘ওমা সিফু! কী সুন্দর হচ্ছিস রে দিন দিন! এই এত রাস্তা জার্নি করে এসেও মেয়ে যেন ঝলকাচ্ছে! হ্যাঁ রে আপা, এমন একটা চাঁদপানা মেয়ে দেবে বলেই কিনা বিয়ের পর আট বচ্ছরেও খোদা কোল ভরায়নি তোর? আর আমারজনকে দেখ! বিয়ের বছর ঘুরতে না ঘুরতেই কোল আলো করে এলেন, আলো না ছাই অন্ধকার!’- শেষ অংশটুকু বিড়বিড় করতে করতে সাগুফতাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে গেলেন মা। বড়খালার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে আমিও ওদের পেছন পেছন যাচ্ছি ঠিক তখনই মুখে হাতচাপা দিয়ে উদগত হাসিটাকে ফুলের পাপড়ির মত মেলে দিয়ে আমাকে কথাটা বললো সাগুফতা- আগেভাগে জানলে নাকি মা আমাকে পৃথিবীতে আসতেই দিতেন না! সাগুফতা মোটেও আস্তে বলেনি এসব।
আমি নিশ্চিত জানি পাশে থাকা মা’র কানেও এই কথাগুলো গেছে, অথচ কী নির্বিকারভাবে হাঁটছিলেন মা- যেন শুনতেই পাননি কিছু! ঘরে ঢুকে সাগুফতার পানপাতার মত ছোট্ট মুখটাকে আঙুলে ছুঁইয়ে দিয়ে মা বললেন- ‘চাঁদপানা মেয়ে আমার! থাকবি তো মা কিছুদিন এবার খালামনির বাসায়?’

আমার এখন প্রচণ্ড মনখারাপ! আর যেহেতু আমার তেমন কোনো বন্ধুও নেই, তাই মনখারাপ করলে আমি নিজের ঘরে বসে বসে ডায়েরি লিখি। আগে গান গাইতাম একলা একলা, তারপর একদিন খুব মনখারাপের সময় খেয়াল করলাম আনমনেই টেবিলে বসে খাতার ওপর আঁকিবুকি করছি, ভালো লাগছে করতে! এরপর থেকে মন ভালো না থাকলে ডায়েরিটা নিয়ে বসে যাই, হাবিজাবি লিখে ভরাই। ওহহো! এতকিছুর মধ্যে আমার নামটাই তো বলা হলোনা! আমি রাত্রি। যদিও মা দাবি করেন বাবার নামের সাথে মিলিয়ে এই নাম রাখা হয়েছে আমার কিন্তু আমি বেশ টের পাই গায়ের রঙ মিলিয়ে ঝিলিয়েই নামটা রেখেছিলেন মা আমার! সেই ছেলেবেলা থেকেই যে-ই আমার নাম শুনেছে সেই এই একই ইঙ্গিত দিয়েছে-

-‘বাহ! সুন্দর নাম, একেবারে তোমার মত!’

কিংবা,

-‘ওমা! এত মিলিয়ে নাম পেলো কইগো! কে রেখেছে এই নাম, তোমার মা না বাবা?’

কিংবা,

-‘রাত্রি? বাহ! তোমার সাথে বেশ যায় তো নামটা!’

প্রকাশভঙ্গি আলাদা, কিন্তু কথা ঐ একই! ছোটবেলায় এতকিছু বুঝতাম না, ভাবতাম হয়ত আসলেই আমার নামটা খুব সুন্দর আর আমিও! একটু বড় হবার পর যখন আয়নার ভেতর দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে শিখলাম, আর জানলাম রাত্রি শব্দের মানে রাত- সেই প্রথম বুঝলাম কী ভীষণ বোকা ছিলাম এতকাল!

যাকগে, আমার কথা থাকুক! এবারের পহেলা বৈশাখের বন্ধটা পরেছে বৃহস্পতিবার। টানা তিনদিন ছুটি কাটাতে বুধবার রাতেই বড়খালারা আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছেন। বড়খালার একটাই মাত্র মেয়ে এই সাগুফতা, আমার বয়েসী। আমি এবার ক্লাস নাইনে উঠেছি, সাগুফতাও তাই। আমরা থাকি ঢাকায় আর ওরা ঝিনাইদহে। ঐখানের যে স্কুলে সাগুফতা পড়ে সেখানের ই টিচার বড়খালা, আর সাগুফতার রেজাল্ট ও অনেক ভালো- ওদের ক্লাসে সবসময় প্রথম তিনজনের ভেতর থাকে ও। আমি ঢাকারই একটা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ি, রেজাল্ট মোটামুটি! ক্লাস এইটে আমার রোল ছিলো ৩৩, এবারে একটু এগিয়েছে।

সাগুফতা দেখতে সুন্দর, শুধু সুন্দর না- অস্বাভাবিক রকমের সুন্দর! একবার তো বাসের মধ্যে এক মহিলা ওকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন- ‘মা, তোমাদের দেশ কি ইন্ডিয়ার ওদিকে?’ সাগুফতা অবাক হয়ে মাথা নাড়তেই তিনি আবার বলে উঠেছিলেন- ‘ওহ! আসলে তোমাকে দেখতে একদম সোনাক্ষী সিনহা বলে যে নায়িকাটা, ওর মত! তাই ভাবলাম ওর আত্নীয় টাত্নীয় হও কি না!’। আর কত্তবার যে রাস্তাঘাটে ওকে দেখে বড়খালার কাছে ওর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে মানুষজন, তার তো গোনা গুনতিও নেই!

তো যা বলছিলাম, সাগুফতা সুন্দর আর আমি কুৎসিত!

সাগুফতাকে ঝিনাইদহের ওর এলাকার লোকজন একনামে চেনে, আমাকে তো আমার স্কুলের মেয়েরাও চেনেনা ঠিকঠাক!

সাগুফতা বরাবর ভাল রেজাল্ট করে, আর আমার- মধ্যবিত্ত, যৎসামান্য রেজাল্ট!

সাগুফতাকে বড়খালা রোজ ভোরে উঠিয়ে পড়তে বসান, নিয়ম করে রোজ নিজের বাছাই করে দেয়া টিউশনে পাঠান- সে বাধ্য মেয়ের মত মায়ের কথা শোনে, বরাবর ভাল রেজাল্ট করে। আর আমি সুযোগ পেলেই বেলা পর্যন্ত ঘুমাই, নিজের পছন্দমত স্যারের বাসায় পড়তে যাই আর বরাবর মাঝামাঝি, না ভালো না খারাপ -একটা রেজাল্ট গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়াই।

তাই সাগুফতাকে সবাই আদর করে আর আমাকে দূরছাই! ভাবছেন বাড়িয়ে বলছি? আচ্ছা, তবে কেবল একটা ঘটনাই শুনুন!

আমরা, মানে আমি আর সাগুফতা দু’জনেই তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। সাগুফতাদের গ্রীষ্মের ছুটি শুরু হয়ে গেলেও আমাদের স্কুল তখনোও খোলা। বন্ধ পেয়ে আমাদের বাসায় বেড়াতে চলে এসেছে ও। খবর পেয়ে বড়মামাও চলে এসেছে, ঢাকাতেই একটা মেসে থাকতো মামা। তখন সাগুফতা আর আমার, আমাদের দু’জনের বেশ মিল ছিলো, সাদা-কালো-ফর্সা-শ্যামলা অতশত তখনোও বুঝতাম না কিনা! সাগুফতা এসেছে, কিছুদিনের জন্য খেলার সাথী পেয়েছি। একপ্রকার নাচতে নাচতেই সেদিন রোজকারের মত কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলে গেলাম, সেদিনই শেষ ক্লাস ছিলো আমাদের। বন্ধে দু’জনে মিলে কতকিছু করব তার ছকটক সব কষতে কষতে বাড়ি এলাম। ওমা! সাগুফতা নেই! বড়মামা ওকে নিয়ে বৈশাখের মেলায় গেছেন ঘুরতে! অথচ… অথচ আমিও তো একই বাসায় ছিলাম! আজই তো আমার শেষ স্কুল ছিলো, ওরা কি কালকে আমাকে সহ মেলায় যেতে পারতো না?

এই এখনকার আমি হলে তখন ঠিকঠিক সব মনের ভেতর কবর দিয়ে রেখে দিতাম, হয়ত ডায়েরিটাতে এক-দু’পাতা লেখা যোগ হতো। কিন্তু কী ভীষণ ছেলেমানুষ ছিলাম তখন আমি! কান্নাকাটি করে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিলাম, কেন আমাকে ছাড়া ওরা মেলায় গেলো বলে! মেলা থেকে ওরা ফিরে এলো, সাগুফতার হাত ভর্তি খেলনাপাতি আর আমার জন্য কেবল দুটো তেঁতুলের চকলেট এনেছে বড়মামা! সাগুফতা উচ্ছ্বল গলায় বর্ণনা করছিলো মামার বন্ধুর বাইকে করে পুরো মেলা ঘুরেছে, মেলায় কত কী খেয়েছে ও, নাগরদোলায় চড়েছে, গ্যাস বেলুন উড়িয়েছে… আরও কতশত গল্প! তখন আমি ছেলেমানুষ, এতশত শুনে জেদ করে বসলাম আমাকেও মেলায় নিয়ে যেতে হবে! বাধ্য হয়ে পরদিন বড়মামা আমায় নিয়ে ফের মেলায় গেলেন ঠিকই, কিন্তু শেষমেশ যে চূড়ান্ত অবহেলা আর অনাদরে সেই দিনটুকু কেটেছিলো আমার… এইতো এখনো লিখতে যেয়ে টপটপ করে কাঁদছি! না মামার বন্ধুর বাইক-টাইকে নয়, লোকাল বাসে চড়ে মেলায় গিয়েছিলাম সেদিন। কীসের নাগরদোলা কীসের কী? হিড়হিড় করে টেনে বাস থেকে নামিয়ে ঘাড় ধরে মেলায় নিয়ে সেদিন বড়মামা আমায় বলেছিলো-

‘এই নে তোর মেলা! মেলায় যাব, মেলায় যাব! মাথার পোকা নাড়িয়ে দিলো একদম!’

সাড়ে তিনফুটের ছোট্ট আমি তখন বোকার মত তাকিয়ে ছিলাম কেবল ছয়ফুট তিন ইঞ্চির বড়মামার দিকে! কী ভীষণ রাগী দেখাচ্ছিলো ওঁকে সেদিন!

সেই প্রথম, সেই শেষ! এরপর আর বড়মামার কাছে কিছু চাইনি কোনোদিন। সেদিন ই প্রথম টের পেয়েছিলাম, কোথাও একটা পার্থক্য আছে রাত্রি আর সাগুফতায়! হয়ত বড়মামা আমায় সাগুফতার মত করে ভালোবাসেন না, সে কথা বুঝতে পেরে একটা জড়বস্তুর মত কুঁকড়ে ছিলাম সারাদিন। মেলায় যেয়ে সাগুফতা সেদিন বার্গার খেয়েছে বলেছিলো, আমি অত দামী খাবার কোনোদিন খাইনি! খাবারের দোকানগুলির পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় বারবার চোখ আটকে যাচ্ছিলো কাঁচঘেরা গোল গোল বার্গারগুলোর দিকে। নাহ! সেদিন আর মেলায় কিছু খাওয়া হয়নি আমার, ঘন্টা চারেক বাদে বাড়ি ফিরে বুভুক্ষের মত একথালা ভাত নিয়ে বসেছিলাম।

তবু কাঁদিনি সেদিন একফোঁটাও! একটা অদ্ভুত কষ্ট দলা পাকিয়ে গলায় জমে ছিলো সারাদিন। তীক্ষ্ণ, তীব্র একটা অপমানবোধ সমস্ত মনটাকে তিতে করে রেখেছিলো। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে মায়ের কাছে যেয়ে বলেছিলাম-

‘জানো মা, বড়মামা না একদমই সাগুফতার মত আদর করেনা আমায়…’

আমার কথা শেষ না হতেই মা খেঁকিয়ে উঠেছিলেন-

‘সাগুফতার সাথে সারাদিন অত হিংসে কীসের রে তোর পোড়ারমুখী! হয়ে দেখা না আগে ওর মত, তারপর এসব কান ভাঙাতে আসিস!’

মুখের কথা আমার মুখেই রইল। মনে বুঝলাম, বড় বেশি পার্থক্য আছে রাত্রি আর সাগুফতার মধ্যে।

বড্ড বেশি!