Saturday, June 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 20



নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০৮(ক)

0

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (শেষ পর্ব-১)
নুসরাত জাহান লিজা

রিহানের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল অসীম ক্ষোভ, কোনোকিছুতেই আগ্রহ পাচ্ছিল না। সেটা স্প্যানিশ লীগের এল ক্লাসিকো হোক, নেটফ্লিক্সের নেইল বাইটিং যত নতুন থ্রিলার সিরিজই হোক, কিংবা হৃদি.. কোনোকিছুর প্রতিই ওর আগ্রহ আসছিল না। যাবতীয় প্রিয় জিনিসে যেন হঠাৎই রাজ্যের অরুচি এসে জমা হয়েছে।

এলার্ম দিয়ে ঘুমায়, কিন্তু এলার্মের কর্কশ শব্দে ঘুম ভাঙার পরেও কোনো একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকে! আজ যদি কাঙ্ক্ষিত কলটা আসে!

ক্লাসে কখনো দু’জন মুখোমুখি হয়ে গেলে ইউটার্ন নিয়ে চলে যায়। তবে পুরো ক্লাসে ঠিকই আড়চোখে নৈঋতা কী করছে তীক্ষ্ণ খেয়াল রাখে।

দুই সপ্তাহ পরে রিহান কেআরে দাঁড়িয়ে ছিল, নৈঋতা এসে বলল, “নে, তোর এসাইনমেন্ট।”

রিহানের ক্ষোভের আগুনে যেন ঘি পড়ল, “তুই কেন করেছিস? করুণা করতে? তুই দায়িত্ব নিতে বলেছিস। আমি নিজেই করে নেব। সিমপ্যাথি দেখিয়ে এসাইনমেন্ট দিতে হবে না।”

“জেনে ভালো লাগল যে তুই নিজে সিরিয়াস হচ্ছিস। এবার তো কষ্ট করেই ফেলেছি, অভ্যাস হয়ে গেছে। এরপর থেকে নাহয় তুই করে নিস। রেখে গেলাম।”

কথাটা বলে ওর হাতে এসাইনমেন্টটা ধরিয়ে দিয়ে হলে চলে গেল নৈঋতা। রিহানের ইচ্ছে হলো এটা পুড়িয়ে ফেলতে। কিন্তু পারল না! ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখল। নৈঋতার দেয়া কিছু সে নষ্ট করতে পারবে না।

সায়নের রুমে বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিচ্ছিল। ওই রুমে মাস্টার্সের বড় ভাই আজ নেই। সবাই সেখানে আড্ডা জমিয়েছে। রিহান আর মৃদুল গিটার বাজায়। ওদের সাথে গিটার আছে।

আড্ডা চলছিল উদ্দেশ্যেহীন, লতাপাতা, শাখা-প্রশাখায় বিস্তার হয়ে বিষয়বস্তুর শিকড় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না৷ কোন প্রসঙ্গ থেকে কোন প্রসঙ্গে যাচ্ছে তারাও কোনো তাল মিল নেই।

আড্ডা তখন তুমুলে, এরমধ্যে সহসা মৃদুল রিহানকে প্রশ্ন করল, “দোস্ত, তোদের কী হয়েছে রে?”

“কাদের?”

“তোর আর নীরুর?”

“কী হবে? কিছুই না।”

এবার রেদোয়ান বলল, “কিছু না বললেই হলো? আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে তোদের দুইটাকে একসাথে দেখতে দেখতে। মামা, এইভাবে এড়ায়ে গেলে হবে? সবারই চোখে লাগছে এটা!”

“তো এর জন্য আমি কী করব?”

“কী হয়েছে বললেই তো হয়।”

“অন্য কথা থাকলে বল, নইলে চুপ থাক৷ আজাইরা কথা অসহ্য লাগছে।”

“আচ্ছা। থাক।”

কিন্তু থাক বললেই সব থামে না, একজন বলল, “নীরু মেয়েটার কিন্তু খুব ধৈর্য। আমরা নিজেরটাই করে কূল পাই না, বেচারি এসাইনমেন্ট, কিছু কিছু প্র‍্যাকটিক্যাল খাতা পর্যন্তও তো করে দেয়।”

রিহান হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, “থামবি তুই? বললাম না এই টপিক বাদ। তাও খোঁচাচ্ছিস কেন?”

“তুই রেগে যাচ্ছিস কেন? এটা খোঁচা কীভাবে হলো?”

রিহানের সামনে এসট্রে ছিল, সেটাকে ছুঁড়ে ফেলল প্রবল রাগে, এরপর বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। সে সিগারেট সবসময় খায় না৷ কখনো সখনো এমন আড্ডায় দুই টান দেয়।

বন্ধুরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল কেবল, কিছুই বুঝতে পারছে না।

রিহান নিজের ঘরে এসে পড়ার টেবিলে বসল, রাগ কমানোর জন্য সামনে খাতা কলম পেয়ে, খাতায় প্রবল রাগে কলম দিয়ে ঘষাঘষি করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে টেবিলে দুই হাত রেখে খাতার মধ্যে মাথা গুঁজল। অস্ফুটস্বরে বলল,

“এমন করলি কেন নীরু? আমি কি খুব বেশি খারাপ? আমার সাথে বন্ধুত্ব রাখা যায় না!”

***
মাসখানেকের মধ্যে রিহানের ক্ষোভ, রাগ সমস্তই থিতিয়ে এলো, এই অনুভূতি প্রতিস্থাপিত হলো হাহাকারে!

নৈঋতা ওর কাছে ভীষণ স্পেশাল মানুষ। তবে ওর সামান্য একটু দূরত্ব যে এতটা অসহনীয় হবে, সে কোনোদিন ভাবতে পারেনি।

এত দূরে যাবার এই যে চেষ্টা, তবুও ওর জন্য ভাবছে মেয়েটা। কখন কোন শিটপত্র লাগবে, কখন কোন এসাইনমেন্ট সাবমিট করতে হবে সব মনে করিয়ে দিয়েছে।

ইউনিভার্সিটি লাইফের এই সেমিস্টারটা এত বিশ্রী কাটল! শুধু ইউনিভার্সিটি লাইফের কেন, রিহানের পুরো জীবনে এমন অসময় কী কখনো এসেছিল!

দেখতে দেখতে শেষ সেমিস্টারের পরীক্ষার ডেট দিয়ে দিল। ফরম ফিলআপের আগেরদিন নৈঋতা নিজের এগিয়ে এলো। হাতে একগাদা ফটোকপি করা শিট।

“কেমন আছিস রিহান?”

“ভালো।” অভিমানে ইচ্ছে থাকলেও জিজ্ঞেস করা হলো না নীরু কেমন আছে।

“এগুলো নে।”

“কী হবে এগুলো দিয়ে?”

“পড়বি। পরীক্ষা চলে এসেছে না?”

“তোর এত চিন্তা করতে হবে না।”

“ঢং করিস না, রিহান। লাস্ট সেমিস্টারে ক্যারি খেলে চল্লিশ দিনে পড়ে যাবি৷ এমএসে জে-জে সেমিস্টার ধরতে পারবি না।”

“না পারলে নাই।”

“কেন জেদ করছিস এভাবে? নিজের ভালো বুঝবি তো!”

“তুই বুঝেছিস? তুই যে এমএসই করবি না বললি।”

“করব।”

এতদিনের সকল তিক্ততা ভুলে রিহান ভীষণ আনন্দিত হয়ে বলল, “সত্যি?”

“হ্যাঁ। শেরে বাংলায় ভর্তি হবো।”

হাসিমুখ আবার ম্লান হয়ে গেল, “এখানে কী সমস্যা?”

“শাফায়াতের ফ্যামেলি ঢাকাতেই থাকে।”

“শাফায়াত? মানে ওই ছোটলোকটা? ওকেই বিয়ে করবি?”

“এভাবে বলবি না রিহান। হ্যাঁ। উনি আমার কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চেয়েছেন কয়েকবার। আমার পরীক্ষাটা শেষ হলেই বিয়ে হবে।”

“ভালোই।”

বলে রিহান চলে যাচ্ছিল, নৈঋতা পেছন থেকে ডাকল ওকে,

“রিহান, একটু দাঁড়া!”

এই ডাকে কী যেন ছিল সে উপেক্ষা করতে পারল না।

“রিহান, আমাদের কত চমৎকার সময় কেটেছে ক্যাম্পাসে। আমার লাইফের বেস্ট মোমেন্টগুলো আমি তোর সাথে কাটিয়েছে। আমাদের একসাথে সময়টা আর অল্প কিছুদিন। তারপর যে যায় পথে চলে যাব। তুই তোর লাইফে, আমি আমার লাইফ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাব। মাঝেমধ্যে হয়তো খোঁজখবর নেয়া হবে! কিন্তু এভাবে এই মুহূর্তগুলো আর কোনোদিন ফিরবে না। শেষটা এভাবে তিক্ততায় শেষ করবি? বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে একটা জিনিস তোর কাছে চাইছি রিহান, এই কয়টা দিন আমাদের মতো করে, আগের মতো করে কাটাই আমরা?”

বলতে বলতে কখন যে নৈঋতার চোখে পানি চলে এসেছে সে বুঝতেও পারেনি, রিহানের চোখও ঝাপসা। চোখ ভরা জল নিয়ে রিহান বলল,

“তুই খুব খারাপ নীরু! কষ্ট যখন হচ্ছে, তাহলে কেন চলে যাচ্ছিস? তুই এত নিষ্ঠুর কেন?”

নৈঋতা চোখ মুছে হাসার চেষ্টা করে বলল, “বন্ধুত্ব এমনই রিহান। স্টুডেন্ট লাইফ শেষ হলে কোনোদিন আর আগের মতো হয় না কিছু। এটাই রিয়্যালিটি।”

“কেন হয় না?”

“জানি না। এবার নে এগুলো।”

রিহান ঘুরে সন্তর্পণে চোখ মুছল।

“হৃদির কী খবর?”

“জানি না।”

“জানিস না মানে?”

“ওর সাথে কন্টিনিউ করছি না।”

“কেন?”

“ম্যাচ করছে না৷ ওর মধ্যে সন্দেহ বাতিক আছে। জিনিসটা আমার ভালো লাগে না। ভালো হয়েছে প্রপোজ করিনি আগে।”

প্রায় তিন মাস পরে ওরা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলল। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। রিহানের মনে হলো নৈঋতা পরীক্ষার জন্য ওর সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। যা চলছিল, সেভাবে চললে রিহান কিছুতেই নৈঋতার খাতা দেখে লিখত না জেদ করে। সেজন্যই এটা করেছে। নইলে ওকে তো মুছেই দিয়েছিল। পরীক্ষা শেষ করে ওর সাথে বেশিক্ষণ কথা না বলেই নইলে হুট করে চলে গেল কেন!

রিহান মায়ের সাথে নৈঋতার বিয়ের কথাটা সে শেয়ার করেছে৷ মা জিজ্ঞেস করলেন,

“তুই এত কষ্ট পাচ্ছিস কেন?”

“পাওয়ার কথা না?”

“তোর রাগ ছিল নীরু পড়াশোনা বাদ দেবে বলে। কিন্তু ওর তো সেটা করছে না। তাহলে তোর রাগের জায়গাটা কোথায়?”

রিহান মায়ের কথায় হঠাৎ থমকে গেল। ওর সহসা মনে হলো, সে নীরুকে হারাতে পারবে না।

“তোর সমস্যাটা মনে হয় আমি বুঝতে পেরেছি।”

“কী?”

“ছোট বাচ্চারা কী করে জানিস? খুব প্রিয় কোনো জিনিস নিয়ে খেলে, এরপর একসময় সেটা স্বাভাবিক মনে হয়। এরপর হয়তো জিনিসটা কোনো সুরক্ষিত জায়গায় রেখে দেয়। অনেকদিন পরে হয়তো জিনিসটার কথা ভুলেই যায়! বাবা অথবা মা হয়তো সন্তানের আগ্রহ হারিয়ে গেছে বলে কাউকে দিয়ে দিল। তখন হঠাৎ তার মনে পড়ল জিনিসটা ওর কত প্রিয় ছিল! সেই হারিয়ে ফেলা প্রিয় জিনিসের জন্য সে অস্থির হয়ে উঠে। তোর সাথে এটা পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক নয়। তবুও নীরু তোর মনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে এটা তুই আগে বুঝিসনি৷ যখন ও সরে গেছে, তখন অনুভব করেছিস। দূরত্ব মানতে পারছিস না।”

“মা, আমি…”

“নীরুকে আমার ভীষণ পছন্দ ছিল। ভেবেছিলাম আমার এলোমেলো ছেলেটার জন্য ওই মেয়েটা পারফেক্ট। কিন্তু আমার ছেলেটা শুধু এলোমেলো না, বোকাও। নিজেকে চিনতেই বড্ড দেরি করে ফেলল!”

রিহান বিস্মিত হয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, বলল, “আমি নীরুর বাড়িতে যেতে চাই মা। একবার শেষ চেষ্টা করতে। অন্তত নিজের কথা জানাতে চাই৷ এরপর ওর সিদ্ধান্ত।”

রিহান সেদিন রাতেই রওনা দিল নৈঋতাদের বাড়িতে। শুধু মনে মনে দোয়া করল, যেন খুব বেশি দেরি না হয়ে যায়! ফাজিল মেয়ে কল ধরছে না কেন!
………
শেষ পর্বের বাকি অংশ এক-দেড় ঘণ্টা পরে আসছে ইনশাআল্লাহ। আজকে স্কুলের ইউনিয়ন পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা ছিল, সেখান থেকে বাসায় এসে ক্লান্ত ছিলাম, রেস্ট নেবার জন্য শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। একটু আগে উঠলাম। পোস্ট করার আগে পড়তে গিয়ে মনে হলো বাকি অংশে আরও খানিকটা এডিট লাগবে নতুন করে। এটুকু সময় নিচ্ছি, কিছুক্ষণ পরেই আসবে ইনশাআল্লাহ।

নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০৭

0

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ৭)
নুসরাত জাহান লিজা

কথা কাটাকাটির পরে কেউ কাউকে কল করেনি। রিহান ভেবেছে নৈঋতা কল দেবে। রাত দশটা পর্যন্ত মুঠোফোন হাতে নিয়ে বসেছিল, কিন্তু কোনো কল আসেনি। সে অনেকবার কল করতে চেয়েও করেনি। ভীষণ অভিমান হয়েছে ওর। মেয়েটার কত্ত সম্ভাবণা, সব পায়ে দলে এমন একটা সিদ্ধান্ত কেন নিতে চাইছে! কোনো মানে হয়!

নৈঋতা ওর সাথে নিজের স্বপ্নের কথা শেয়ার করত। ছোটবেলা থেকে মেয়েটা ভীষণ একা। বাবার সাথে অসীম দূরত্ব। নিজের ইচ্ছেগুলো কখনো কারোর কাছে প্রকাশ করেনি। ওর সাথে করেছিল। পরিবারে অসুখী হবার জন্যই বোধহয় নৈঋতা ইন্ডিপেন্ডেন্ট হতে চেয়েছিল। কারোর উপরে নির্ভর করা পছন্দ করে না। সেই লক্ষ্য সামনে রেখে পরিশ্রম করে গেছে। এখন যখন অল্প কিছুটা পথ বাকি, তখন এসে কেন হাল ছেড়ে দিতে চাইছে, এটাই রিহানের বোধগম্য হচ্ছে না। সে ভাবল, এখন কল না দিলেও সকালে ওর ঘুম ভাঙানোর জন্য অবশ্যই কল করবে। গত তিন বছরে এমন বহুবার ওদের ঝগড়াঝাটি হয়েছে, ঝগড়ায় যার ইন্ধন ছিল, সেই কল করে অপরপক্ষের অভিমান ভাঙিয়েছে৷ এবারের ভুলটা তো ওর নয়, সে কেন আগেভাগে কল করবে!

সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গেল। কিন্তু আড্ডাবাজ রিহানের আড্ডায় আজ কেন যেন অরুচি হচ্ছিল। কিছুক্ষণ থেকে রুমে চলে এলো। হৃদি কল দিলেও কথা বলল না, সেভাবে। কিছুক্ষণ হ্যাঁ হু করে কল কেটে দিল।

ঘুমানোর চেষ্টা করল, কিন্তু কিছুতেই ঘুম এলো না। এপাশ-ওপাশ করে একটা রাত কাটিয়ে দিল কাঙ্খিত ফোনকলের অপেক্ষায়।

***
নৈঋতা অভ্যাসবশত পড়তে বসল, কিন্তু একটা অক্ষরও পড়তে পারল না। ফোনটা দূরে রেখে দিয়েছে অস্থির মনকে পথভ্রষ্ট করার জন্য। কিন্তু অবাধ্য মন ঘুরেফিরে সে-ই চোরাগলিতেই পাঁক খেতে লাগল।

রিহানকে কথাগুলো বলার আগেই সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। বাবাকেও নিজের সম্মতির কথা জানিয়ে দিয়েছে। আগামীকাল বিকেলে ছেলে দেখতে আসবে ওকে। সারিন্দায় দেখা হবে।

রিহান যদি ওর অনুভূতির খবর কোনোভাবে পেয়ে যায়, ওর কাছে অসহ্য হয়ে উঠবে নৈঋতা। এটা সে মানতে পারবে না। কোনো কারণ না দেখিয়ে রিহানের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করাও অসম্ভব। যোগাযোগ চলতে থাকলে একদিন ঠিকই ধরা পড়ে যাবে সে। আবার এমনি এমনি সরে গেলেও রিহান ঠিকই ওর সমস্ত হৃদয়ে থেকে যাবে। বিয়ে করে ফেললে নতুন সংসারের ব্যস্ততায় নৈঋতা হয়তো একসময় ভুলে যাবে, অন্তত চেষ্টা তো করতে পারবে! বিয়েটা ওর কাছে একটা কারণ দূরে যাবার, ভুলে যাবার চেষ্টা করবার! দ্রুততম সময়ে এরচাইতে সহজ সমাধান আর ওর মাথায় আসেনি। এতে হয়তো রিহানের রাগ হবে, অভিমান করবে, কিন্তু ওকে ভুল বুঝবে না!

রিহান যদি হৃদির সাথে ভালো থাকে, সে মাঝে আসবে না কখনো। হৃদি কী ভীষণ সুন্দর! পুতুলের মতো লাগে দেখতে। আর সে! বড্ড সাধারণ চেহারা ওর, দশজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে কখনোই ওকে আলাদা করে চোখে পড়ে না! রিহানের মতো ভীষণ সুদর্শন একজন ছেলের পাশে হৃদির মতো কাউকেই মানায়, সে ভীষণ বেমানান!

সবকিছু ভেবেই এই সিদ্ধান্ত ওর। কিন্তু এখন অসহ্য এক অস্থিরতা বারবার ওকে গ্রাস করছে। মনের সাথে যুদ্ধ করে এই সিদ্ধান্ত তো নিয়েছে, কিন্তু সে মানতে পারছে কই! রিহানকে কি সে কোনোদিন ভুলতে পারবে, নিজের অস্তিত্বের একটা অংশকে চাইলেও কি ভুলে যাওয়া যায়!

***
রিহানের আজ নির্ঘুম রাত কেটেছে৷ সময় দেখল আটটা ষোলো, এই সময় প্রতিদিন নৈঋতা কল করে ওকে৷ কিন্তু মিনিট দশেক শুয়ে থাকার পরেও কল এলো না। ছেলেমানুষি রোখ চেপে গেল রিহানের। সে শুয়ে রইল জেদ করে, উঠবে না সে। নৈঋতা ক্লাসে গিয়ে যখন ওকে পাবে না, তখন ওকে ক্লাসে নিয়ে যাবার জন্য অবশ্যই কল দেবে। কিন্তু ওর অপেক্ষা নিস্ফল হলো। সাড়ে দশটার দিকে উঠে ক্যান্টিনে গিয়ে নাস্তা করল। আবার রুমে চলে এলো। সে জানে না আজ নৈঋতা নিজেই ক্লাসে যায়নি।

বিকেলে সে বেরিয়ে নৈঋতার হলের সামনে এসে দাঁড়াল। কল করতেই যাচ্ছিল, কিন্তু হলের গেটে নৈঋতাকে দেখে এগিয়ে গেল।

ওকে আজ কিছুটা অন্যরকম দেখাচ্ছে৷ সেজেগুজে বেরিয়েছে। রিহান জিজ্ঞেস করল, “কই যাস?”

নৈঋতা কিছুটা অপ্রস্তুত, তবে সামলে নিল দ্রুত, “আজ ছেলে দেখতে আসবে। শহরের দিকে যাচ্ছি।”

রিহানের মুখে মেঘের ছায়া গাঢ় হলো, “তার মানে তুই বিয়ে করবিই?”

“বললাম তো কাল।”

“যে আসছে, তাকে তুই আগে থেকে চিনিস?”

“নাহ্! বাবা চেনে।”

“অপরিচিত লোকের সাথে একা একা দেখা করতে চলে যাচ্ছিস?”

“সাথে নিয়ে যাব এমন কেউ নেই।”

“আমি যাই তোর সাথে?”

নৈঋতা থমকাল, স্বাভাবিক সখ্যতা ওর কয়েকজনের সাথে আছে বটে। তবে বিয়ের আলোচনা হবে, সেখানে সাথে নিয়ে যাবার মতো গভীর সখ্যতা কারোর সাথে নেই রিহান ছাড়া। আবার রিহানকে এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়াটাও কতটা শোভন হতে পারে সে বুঝতে পারছে না। শাফায়াতকেও সে চেনে না, অপরিচিত মানুষের সাথে একা একা যাবার রিস্ক নেয়াটাও ঠিক হবে না৷ অগত্যা রাজি হলো নৈঋতা,

“ঠিক আছে, কোনো ঝামেলা করার মতলব না থাকলে চল।”

“আমি শুধু ঝামেলা করি?”

নৈঋতা উত্তর দিল না, একটা রিকশায় উঠে পড়ল।

সত্যি বলতে রিহান সাথে যাচ্ছে বলে ওর ভেতরের অস্বস্তি অনেকটা হালকা হয়ে গেল।

***
ওরা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসার কিছুক্ষণ পরে শাফায়াত এলো। প্রাণপণ চেষ্টা করে মৃদু একটা হাসি ঝুলিয়ে তাকে স্বাগত জানলো নৈঋতা।

“ইনি কে?” রিহানকে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল শাফায়াত।

“ও রিহান। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

“ও, আমি ভাবলাম বয়ফ্রেন্ড বুঝি। অবশ্য আক্ষরিক অর্থ তো ছেলেবন্ধুই। তাই না?” বলেই হো হো করে দেঁতো হাসি হাসল শাফায়াত৷ ভাবখানা এমন যেন বিশাল মজার কোনো কৌতুক করেছে।

প্রথম দেখাতেই একে রিহানের বিরক্ত লাগল।

“সব জায়গায় সব ধরনের বন্ধুদের নিয়ে যেতে নেই, এটুকু কমনসেন্স তোমার কাছ থেকে আশা করতেই পারি। তাই না নৈঋতা? নামটা ঠিক বললাম তো?”

নৈঋতা কিছু বলতেই যাচ্ছিল, তার আগেই রিহান বলল, “আমি যতদূর জানি আজই আপনারা ফার্স্ট মিট কিরলেন। প্রথম দেখাতেই আপনি একজন মেয়েকে তুমি করে বলছেন, আবার এমন ভাবে কথা বলছেন, যেন আপনাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। আপনারও দেখছি কমনসেন্সের খানিকটা কমতি আছে।”

দপ করে জ্বলে উঠল শাফায়াত, “আমি সম্মানিত মানুষ নৈঋতা। তোমার বিয়েতে আপত্তি ছিল সেটা আগে বললেই পারতে। ডেকে এনে বয়ফ্রেন্ড দিয়ে এভাবে অপমান করলে কেন?”

এবারও নৈঋতা কিছু বলার সুযোগ পেল না, রিহান বলল, “দেখুন, শুরুটা আপনি করেছেন। একটা স্বাভাবিক বন্ধুত্বকে নিয়ে খুব বিশ্রী রসিকতা করেছেন।”

নৈঋতা উঠে বেরিয়ে এলো, ভীষণ বিরক্ত লাগছে ওর। আশেপাশে না তাকিয়ে একমনে হাঁটছিল, রিহান প্রায় দৌড়ে ওর কাছাকাছি চলে এলো।

“নীরু, শোন, তুই আমার উপরে রেগে গেছিস? দেখ, ওই ছোটলোক তোকে ডিজার্ভ করে না। তুই অনেক ভালো কাউকে ডিজার্ভ করিস।”

“যেমন?”

“যে তোকে বুঝবে, সম্মান করবে এমন কেউ।”

“সেটা তুই এক মিনিটে বুঝে ফেললি?”

“তুই ওর কথা শুনেছিস না? ওকে ডিফেন্ড করছিস!” একরাশ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করল রিহান।

“রিহান, উনি যেই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, এমন পরিস্থিতিতে একশোতে নিরাব্বই জন লোকই সেম রিয়েকশন দেবে। এটাই স্বাভাবিক।”

“স্বাভাবিক কীভাবে?”

“কোনো মানুষই তার হবু বউয়ের পাশে অন্য লোককে সহ্য করে না।”

“আমি অন্য লোক?”

“আমার কাছে না হলেও অন্যদের কাছে তো অবশ্যই।”

রিহান নিজের উদগত রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে বলল, “তবুও, ওই লোক তোর জন্য না। বিয়েটা করিস না।”

“আমি যাকেই বিয়ে করি এটা হবেই। কেউই আমাদের বন্ধুত্বকে হাসিমুখে এক্সেপ্ট করবে না।”

“তাহলে বিয়ে করিস না।”

এবার নৈঋতা আর নিজের মেজাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না, “ফ্যান্টাসি ওয়ার্ল্ড থেকে বেরিয়ে রিয়্যালিটিতে আয় রিহান। তুই কী বলছিস তুই বুঝতে পারছিস? এটা হয় কখনো? কেন করব না বিয়ে?”

“তুই আজ সকালে আমার ঘুম ভাঙাসনি কেন?”

অপ্রাসঙ্গিক কথায় রাগের মাত্রা আরও বাড়ল ওর, “আমি কয়দিন পরে অন্য কারো ওয়াইফ হবো রিহান। হাজব্যান্ড যেই হোক, যত ভালো মানুষই হোক, অন্য লোকের ঘুম ভাঙাচ্ছে এটা কেউই মানবে না। তুইও বিয়ে করবি কাউকে। সে-ও মানবে না। এটা সম্ভব নয়।”

“আমাদের ফ্রেন্ডশিপ এখন অন্য লোকের ইচ্ছের উপরে ডিপেন্ড করবে? তোর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা নেই?”

“এটাই সমাজের নিয়ম রিহান।”

“আমি মানি না।”

“আমি মানি।”

রিহান যদি বলত “অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে না, চল আমরা বিয়ে করি।”

তাহলেও সে ভেবে দেখত। কিন্তু এখন, বাস্তবতা বিবর্জিত কথাগুলো অসহ্য লাগল নৈঋতার।

নিজেকে শক্ত করল নৈঋতা, ওদের বন্ধুত্বের জন্য, রিহানের ভালোর জন্য, রিহানের চোখে নিজের জন্য অর্জিত সম্মানের জন্য, কড়া গলায় বলল,

“না মানলে নাই৷ যা খুশি কর।”

বলে এগিয়ে যাচ্ছিল, পেছনে ফিরে সে আবার বলল, “নিজের দায়িত্ব নিতে শেখ রিহান৷ এলার্ম সেট করে ঘুমাবি, আমার ডাকার অপেক্ষা করিস না।”

বলেই রিকশা ঠিক করে উঠে পড়ল। রিহান তখনও স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল। ওর হঠাৎ মনে হলো এক পৃথিবী শূন্যতা ওকে ঘিরে ধরল৷ নৈঋতা যেন ওর সমস্ত ভালো লাগা সাথে করে নিয়ে চলে যাচ্ছে! এমন অনুভূতি আগে কোনোদিন হয়নি ওর। আজ কেন এমন লাগছে!

নৈঋতার বন্ধুত্ব তো শুধু বন্ধুত্ব নয়! কবে সে এতটা নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে মেয়েটার প্রতি! জীবন কোনোদিন কোনোকিছুর পরোয়া করেনি রিহান, মা’য়ের পরে নৈঋতা একমাত্র নারী, যাকে সে নিজের বলে ভেবেছে, ওর একমাত্র প্রাণের বন্ধু। যার প্রতি পরম বিশ্বাসে নির্ভর করা যায়!

এটা এমন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, যে পথ আলাদা হয়ে গেলে ওর জীবন কোথাও থমকে যাবে!
………
(আগামীকাল শেষ পর্ব আসবে ইনশাআল্লাহ, দুই পর্ব একসাথে এডিট করে পোস্ট করেছি এটা। বানান ভুল থাকলে কমেন্টে জানেবেন, আমি একটু বিশ্রাম নেই এবার। কিছুক্ষণ পরে এসে ঠিক করে দেব ইনশাআল্লাহ।)

ছবি কৃতজ্ঞতাঃ প্রিয়া রহমান আপু।

নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০৬

0

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ৬)
নুসরাত জাহান লিজা

মানুষের জীবন স্থবির হোক বা চলমান, ঋতু ঠিকই পরিবর্তন হয়, পাল্টে যায় প্রকৃতির রঙ। প্রত্যেক ঋতুর নিজস্ব রঙে ঢঙে সেজে উঠে প্রকৃতি। এই বহমান সময়েও কোথাও যেন নিশ্চল হয়ে আছে নৈঋতার জীবন। অথচ সমস্তই স্বাভাবিক নিয়মে, নিত্যকার মতোই ঘটে চলেছে, তবুও কোথাও একটা জায়গা যেন একই ঘূর্ণাবর্তে পাক খাচ্ছে। ঋতু পরিবর্তনের ছোঁয়া সেখানে লাগে না, মনের সেই কোণ যেন শীতঘুমে মগ্ন। সেই মগ্নতায় একটাই অস্তিত্ব বিরাজ করছে কেবল, রিহান৷ এই ঘূর্ণাবর্ত থেকে যেন নৈঋতার মুক্তি নেই। মন কেন মস্তিষ্কের কথা শোনে না, বারণ মানে না!

নতুন সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়েছে মাস দুয়েক। রিহান আগের মতোই আছে। ওদের নিত্য খুঁনসুটিও চলে। তবে কথা বলতে বলতে আচমকা থেমে যায় সে, রিহানের কথা শুনতে কোথাও যেন হারিয়ে যায়! ভেতরে একটা অসহ্য অস্থিরতা ওকে ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলছে।

“নীরু, এই নীরু…”

রিহানের ডাকে সম্বিত ফিরতেই নিজেকে ধাতস্থ করে নিল নৈঋতা, “হুম, বল। শুনছিস।”

“ঘোড়ার ডিম শুনছিস। তোর সমস্যাটা কী বলবি? এইবার বাড়ি থেকে আসার পর থেকেই দেখছি, তুই কেমন অন্যরকম বিহেভ করছিস। দুই মাস ধরে তোকে একটা প্রশ্নই করছি৷ কোনো উত্তরই দিচ্ছিস না।”

রিহানের গলায় রাগের ছাপ স্পষ্ট, “রিহান, কোনো সমস্যা নেই। সব ঠিকঠাক। আচ্ছা, গিটার যেহেতু এনেছিস, একটা গান শোনা।”

“মুড নেই।” বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল রিহান।

“নামী সিঙ্গারদের মতো এক্সকিউজ দিচ্ছিস কেন?”

“তোর কথাবার্তায় মেজাজ খারাপ হচ্ছে।”

নৈঋতার একবার মনে হয় অব্যক্ত কথা যা ওকে সারাক্ষণ জ্বালাতন করছে, তা প্রকাশ করে ফেলে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে নিরস্ত করে। রিহানের কাছে সে অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা, এভাবে নিজেকে প্রকাশ করে ওর চোখে নিতান্ত সাধারণ হতে সে কোনোদিনও পারবে না।

“আমি তো কথাবার্তা কমিয়ে দিয়েছি, তাও আমার কথায় তোর মেজাজ খারাপ হচ্ছে?” অবশেষে বলার মতো একটা কথা খুঁজে পেল নৈঋতা।

“তোর এমন গা-ছাড়া হাবভাবটাই বিরক্ত লাগছে।”

রিহান রাগলে নাকের পাঁটা ফুলে যায়, শিশুরা যখন খেলনা পছন্দ হলে কিনে দেবার জন্য জেদ করে সাড়া পায়না, তখন যেমন দেখায় ওকেও তেমন দেখাচ্ছে। নৈঋতা রিহানের চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

“হয়েছে, হয়েছে। আর মেজাজ খারাপ করতে হবে না। গান শোনাবি নাকি চলে যাব?”

রিহান চুলগুলো পরিপাটি করে আবারও একই ভঙ্গিতে বসে রইল। এই ছেলে মারাত্মক জেদি, তবে জেদ নৈঋতারও কম নয়। সে উঠে দাঁড়ালো, দুই কদম এগুতেই গিটারের টুংটাং শোনা গেল। নৈঋতা মৃদু হেসে ঘুরে দাঁড়ালো, যাক মেঘ কেটেছে তবে!

“তুমি আমার পাশে বন্ধু হে, বসিয়া থাকো।
একটু বসিয়া থাকো..
আমি মেঘের দলে আছি, আমি ঘাসের দলে আছি।
তুমিও থাকো বন্ধু হে..!
বসিয়া থাকো.. একটু বসিয়া থাকো..

রোদের মধ্যে রোদ হয়ে যাই, জলের মধ্যে জল;
বুকের মধ্যে বন্ধু একটা নিঃশূন্য অঞ্চল।।

আমি পাতার দলে আছি, আমি ডানার দলে আছি।
তুমিও থাকো বন্ধু হে..!
মেঘের মধ্যে মেঘ হয়ে যাই, ঘাসের মধ্যে ঘাস;
বুকের মধ্যে হলুদ একটা পাতার দীর্ঘশ্বাস।।
তুমি আমার পাশে বন্ধু হে, বসিয়া থাকো।
একটু বসিয়া থাকো…

নৈঋতা তন্ময় হয়ে রিহানের গান শুনছিল, ওদের দুজনেরই ভীষণ প্রিয় গানটা। সে একটু একটু করে দূরত্ব তৈরি করতে চাইছে, এটা রিহান কিছুটা উপলব্ধি করতে পেরেছে, কিন্তু কারণটা জানে না, তাই এভাবে রাগারাগি করে কারণ খুঁজতে চাইছে, বুঝতে পারছে নৈঋতা।

***
এর সপ্তাহখানেক পরে ক্যান্টিনে সকালের নাস্তা করে নৈঋতা সিঁড়িতে উঠছিল, হঠাৎ হৃদির সাথে দেখা হয়ে গেল। ওকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন আছ?”

সেও হেসে উত্তর দিল, “ভালো। তুমি কেমন আছ?”

“ভালো। নৈঋতা, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল, ভীষণ জরুরি। একটু সময় দিতে পারবে? পাঁচ মিনিট?”

ক্লাসের তখনও আধাঘন্টা বাকি আছে।

“ঠিক আছে। বলো।”

“চলো, ওইদিকে বসি।”

ওরা হলের ওয়েটিং রুমে এসে বসল।

“কীভাবে জিজ্ঞেস করি বুঝতে পারছি না। কথাটা পার্সোনাল। কিছু মনে করবে না প্লিজ।”

নৈঋতা বুঝতে পারছে বিষয়টা রিহানকে নিয়ে। কথার এসব ভণিতা ওর ভীষণ বিরক্ত লাগে! কথা না শুনে সে কীভাবে বুঝবে মনে করবে কিনা!

“বলো, প্লিজ। আসলে ক্লাসের সময় হয়ে যাচ্ছে।”

“আচ্ছা, বলি। রিহানের সাথে তোমার সম্পর্কটা কি শুধুই বন্ধুত্ব?”

নৈঋতার ভীষণ ইচ্ছে করছিল সুযোগ নিতে, বলতে যে ওর সাথে রিহানের গভীর প্রেম৷ তাহলেই ওর সমস্যার সমধান হয়ে যাবে। ওর মনের একটা সত্তা ওকে প্ররোচিত করছিল, “বল, বলে দে। একটা কথাই তো! কী এমন হবে!”

কিন্তু পারল না, ওর চির সংস্করাচ্ছান্ন মন, ওকে বাঁধা দিল। রিহান যদি সত্যিই হৃদিকে চায়, সে কেন মাঝখানে তৃতীয় পক্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে! সে পারল না, শান্ত স্বরে বলল,

“কথাটা রিহানকে জিজ্ঞেস করা উচিত ছিল তোমার।”

“করেছিলাম। ও বলেছে তুমি ওর বেস্ট ফ্রেন্ড। কিন্তু অনেকেই বলাবলি করছিল যে…”

“যেহেতু তুমি ওর সাথে একটা সম্পর্ক শুরু করতে চাইছ, ওকে বিশ্বাস করা উচিত ছিল তোমার। অল দ্যা বেস্ট, হৃদি৷ ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।”

বলে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো নৈঋতা। ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একটা জগদ্দল পাথর যেন ওর বুকে চেপে বসছে, একটা দলা পাকানো কষ্ট বুক বেয়ে উপরে উঠতে চাইছে।

***
সমান্তরাল রেললাইনের দুই পাশে রিহান আর নৈঋতা মুখোমুখি বসে আছে।

“তোর রেজাল্টে আমি এত্ত খুশি হয়েছি নীরু। একটা আফসোস, ফিশারিজ টেকনোলজিতে আমার এমএসের পয়েন্ট হবে না মনে হয়। তুই তো এটাতেই এমএস করবি!”

নৈঋতা রিহানের পেছনে গাছের সাড়িতে বসা একটা স্যাঁতসেঁতে সবুজ রঙের পাখির দিকে চোখ রেখে বলল,

“আমি এমএস করব না।”

“কেন?” আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করল রিহান।

“ভাবছি বিয়ে করব।”

এবার রিহান হেসে ফেলল, “হ্যাহ্! জোক মারিস না।”

“আমি সিরিয়াস রিহান৷ এবার বাসায় গেলে বাবা বিয়ের ব্যাপারে বলেছিল, রাজি হয়ে যাব ডিসিশন নিয়েছি।”

রিহান হাসি থামিয়ে নৈঋতাকে পর্যবেক্ষণ করল, নৈঋতার মুখাবয়বে কৌতুকের কোনো আভাস নেই।

“নীরু, এসব কী বলছিস? বিয়ে করবি? এখনি তোর বিয়ের এত তাড়া কীসের? আর বিয়ে করবি ভালো কথা, কর। কিন্তু এমএস কেন করবি না?”

নৈঋতার উত্তরের জন্য অপেক্ষা করে না পেয়ে বলল, “নীরু, তোর কত স্বপ্নের কথা তুই আমার সাথে শেয়ার করেছিস! তোর এত্ত ভালো সিজিপিএ, এমএস করে ইজিলি লেকচারারের জন্য শর্টলিস্টে সিলেক্টেড হয়ে যাবি৷ পিএইচডি করতে দেশের বাইরে যাবি। এটায় না হলেও অন্য কোনো সেক্টরে তুই চোখ বন্ধ করে টিকে যাবি। এত কষ্ট করে, পরিশ্রম করে পড়াশোনা করিস। সবকিছু এভাবে ছেড়ে দিবি? আমি নাহয় খামখেয়ালি, তুই তো এমন না। হঠাৎ এসব পাগলামির মানে কী?”

“মানুষের ইচ্ছে পরিবর্তন হয় না? আমারও হয়েছে। আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি।”

“এবসার্ড নীরু। আমি মানব না তোর ডিসিশন।”

“লাইফটা আমার রিহান, ডিসিশনটাও আমার।”

রিহানের মুখে একইসাথে বিস্ময় আর বিষাদ খেলে গেল, “হ্যাঁ, তোর লাইফ। স্যরি রে, তোর লাইফে ইন্টারফেয়ার করার জন্য। আমি ভুলে গিয়েছিলাম বন্ধুর জন্য ভালো কিছু চাওয়াটা অন্যায়৷ মাফ করে দিস।”

বলেই উঠে হনহনিয়ে চলে যাচ্ছে রিহান, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে নৈঋতার। ওদের অগুণতিবার ঝগড়া হয়েছে, মান-অভিমান হয়েছে। কিন্তু কখনো আজকের মতো অবস্থায় পৌঁছেনি। চমৎকার সাজানো একটা জিনিস যেন নিজের হাতে শেষ করে দিল নৈঋতা! কখন চোখের কোল বেয়ে জল গড়াতে শুরু করেছে, সে বুঝতেই পারেনি। কতক্ষণ ঠায় বসে রইল সে।
………..
(ক্রমশ)

নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০৫

0

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ৫)
নুসরাত জাহান লিজা

সামনেই যেহেতু পরীক্ষা, নৈঋতা নিজেকে ব্যস্ত রাখার একটা সুযোগ পেল। রিহানের কোনোকিছুই গোছানো নেই।

সে বলল, “আমি শিট ফটোকপি করার সময় দুই কপি করে করেছিলাম। তুই বললি পরীক্ষার আগে নিবি। নে এগুলো।”

শিটগুলো নেড়েচেড়ে রিহান প্রশ্ন করল “এগুলো পড়া কমপ্লিট তোর?”

“আমি দিনের পড়া দিনেই শেষ করে ফেলি রিহান। তোর মতো একরাতে পড়ার জন্য জমাই না।”

“কষ্ট করলে একবারই করব, পুরো সেমিস্টার ধরে করতে পারব না। এত চাপ নাই।”

রিহান ক্লাসেও লেকচার নোট করে না, নৈঋতা ওর ক্লাস খাতারও ফটোকপি করে দিয়েছে।

রিহান সেটা দেখে বলল, “তুই তো আছিসই দোস্ত। তোর মতো ব্রিলিয়ান্ট দোস্ত থাকলে এত কষ্ট করার কী দরকার!”

নৈঋতা অবচেতনেই বলে ফেলল, “আমি তো আর সবসময় থাকব না।”

“মানে?”

“এই যে অনার্সের আর একটা সেমিস্টার বাকি, প্রায় তো শেষই হয়ে আসছে। তাই বললাম।”

“এমএস আছে না?”

“হুম, তা আছে।”

প্রতিবার পরীক্ষার সময় রিহান রাত জেগে পড়তে চায়। রাত জাগায় সে অভ্যস্ত, রীতিমতো নিশাচর, কিন্তু পরীক্ষার সময় কোত্থেকে রাজ্যের ঘুম এসে চোখে জমা হয় কে জানে। নৈঋতাই ওকে কিছুক্ষণ পরপর কল দিয়ে জাগিয়ে দেয়। নিজে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেটা কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না, ঘুমঘুম গলায় বলল,

“আমি পড়ছি তো নীরু।”

নৈঋতা কড়া স্বরে বলে, “এক্ষুণি চোখে পানি দিয়ে আয়, এরপর কফি খা। তারপর বোস।”

কিছুক্ষণ পরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। এটা সব পরীক্ষায় ওদের নৈমিত্তিক রুটিন। পরে পরীক্ষার দিন এটা নিয়ে কথা শোনালে বলে,

“পরেরবার তোর মতো হয়ে যাব নীরু। দেখিস, পাক্কা। শুরু থেকেই পড়ব।”

কিন্তু পরেরবার আবার একই অবস্থা। নেড়া বেলতলায় একবার যায় প্রবাদবাক্যকে ভুল প্রমাণ করে এই ছেলে বারবার বেলতলায় গিয়ে মাথায় বেল পড়ার জন্য অপেক্ষা করে।

ওরা হাঁটছিল, রিহান হঠাৎ বলল, “হৃদি আমাকে ওর সাথে রেস্টুরেন্টে দেখা করতে বলেছে।”

“ডেট?”

“সেরকম না, ওর বার্থডে সেলিব্রেট করবে। ওর বন্ধুরাও থাকবে।”

“ও, ভালো।” নৈঋতার গলা নিষ্প্রভ শোনায়৷

রিহান থেমে হঠাৎ বলল, “তুই যাবি?”

“কোথায়?”

“হৃদির…”

পুরোটা শেষ করতে না দিয়েই নৈঋতা আশ্চর্য হয়ে বলে, “তুই পাগল রিহান! সেখানে আমি কীভাবে যাব?”

“সমস্যা কী গেলে?”

“তোর সমস্যা না থাকতে পারে, কিন্তু আমি অযাচিতভাবে কোথাও যেতে চাই না৷”

নৈঋতার বলতে ইচ্ছে করল, “তুই একটা মহা গবেট রিহান, কোনো মেয়েই তার ভালোলাগার মানুষের সাথে কোনো মেয়েকে দেখে খুশি হয় না, সে যতই প্রাণের বন্ধু হোক।”

এই ছেলে কেন বোঝে না! কিন্তু বলল না কথাটা। জিজ্ঞেস করল,

“গিফট কিনেছিস?”

“নাহ্!”

“একটা গিফট কিনিস।”

“সেটা তো কিনবই।”

“আচ্ছা।”

“কিন্তু আমি মেয়েদের জন্য কিছু কিনতে পারি না৷ মা’র জন্য তো তুই পছন্দ করে দিস।”

রিহান টাকা জমিয়ে মায়ের জন্য মাঝেমধ্যে এটা-সেটা কেনে। একবার টিউশন শুরু করেছিল, সেটার টাকা দিয়ে মায়ের জন্য শাড়ি কিনেছিল, নৈঋতা পছন্দ করে দিয়েছিল।

দুই মাস পড়ে পড়ানো ছেড়ে দেয়, ওর ভালো লাগে না, স্টুডেন্টের মা না-কি একদিন কী বলেছে, ওর ভীষণ গায়ে লেগেছিল কথাটা৷ সেজন্য আর যায়নি৷ পরের মাসের টাকাটাও নিতে যায়নি আর। এরপর আর কখনো ওই পথে যায়নি।

“ওর পছন্দের পারফিউম দিতে পারিস, বই পছন্দ করলে দিতে পারিস। এগুলো তোর বাজেটের মধ্যে হয়ে যাবে, সাথে ফুল।”

“ভালো লাগে না আমার।”

“কী ভালো লাগে না?”

“এই যে এত ভাবনাচিন্তা করে গিফট কেনা৷ তার উপর ওর পছন্দও আমি তেমন একটা জানি না। কাউকে গিফট দেবার পরে সেটার জাজমেন্ট হবে, এটাই আমার ভালো লাগে না।”

নৈঋতা জানে সেটা, ওর এই কথাবার্তা ভালো লাগছে না।

“জেনে নিস। আমার পড়তে হবে। যাই রে, তুই পড়তে বসিস। এখন এটা নিয়ে এত চিন্তাভাবনা করতে হবে না।”

“এসব নিয়ে কেন চিন্তা করতে যাব। ধূর।”

নৈঋতা নিজের রুমে ফিরে এলো। পড়ার কথা বলে এসেছে৷ কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করল না এখন। মাথা ব্যথা করছে। সে আসার সময় বাইরে থেকে খাবার নিয়ে এসেছিল, খেতেও ইচ্ছে করল না। জামা বদলে শুয়ে পড়ল, কিছুক্ষণ ঘুমালে শরীর আর মনের দুই যন্ত্রণাই কমবে ভেবে৷ কিন্তু ঘুম এলো না। শুয়ে এপাশ-ওপাশ করতে থাকল।

***
দেখতে দেখতে ওদের পরীক্ষা শেষ এলো। আজই শেষ পরীক্ষা। ভাইভা শেষ করে বেরিয়ে হেঁটে জব্বারের মোড়ের দিকে যাচ্ছিল ওরা। আজকের ভাইভা ততটা ভালো হয়নি কারোরই। সেজন্য মনটা তেতো হয়ে আছে নৈঋতার।

“মন খারাপ করে আছিস কেন? একটা ভাইভাই তো! এত সিরিয়াস হবার কী আছে? চিল নীরু।”

“গায়ে বাতাস লাগিয়ে এক্সাম দিলে তোর মতো চিল চিল বলাই যায়। কষ্ট করে পরীক্ষা দিলে এসব চিল টিল আসে না।”

আজ মেঘলা দিন। আকাশ থমথমে, কিন্তু বৃষ্টির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

রিহান হৃদির জন্মদিনে গিয়েছিল, সেখান থেকে ফেরার আগে আগে হৃদির এক বন্ধু নাকি ওকে বলেছে, সবাই ভেবেছিল সেদিন সে হয়তো হৃদিকে প্রপোজ করবে। ফিরে এসে নৈঋতাকে এটা বলেছিল রিহান৷ সে নাকি এখনো প্রপোজ করার কথা ভাবেনি।

শুনে নৈঋতা রিহানকে বলেছিল, “প্রপোজ করে ফেললেই পারিস। একটা কমিটমেন্ট ছাড়া মেয়েটা ঝুলে থাকবে নাকি!”

“তুই এটা বলছিস নীরু? কমিটমেন্টে যাবার জন্য আমি এখনো প্রস্তুত নই। আমি এটা হৃদিকে আগেই বলেছিলাম৷ সব জেনে যদি ও এক্সপেক্টেশন রাখে সেটা আমার দোষ? আমার যে ওকে খারাপ লাগে তা না, ভালোই লাগে, সেজন্যই কন্টিনিউ করছি কথাবার্তা। কিন্তু ওরও তো আমাকে বুঝতে হবে নাকি!”

“এই যে বললি ভালো লাগে, এটা যথেষ্ট না?”

“না। আমার সময় লাগবে জিনিসটার সাথে মানিয়ে নিতে। আমি অভ্যস্ত নই।”

“কাল বাসায় যাবি?”

রিহানের প্রশ্নে সম্বিতে ফিরে উত্তরে নৈঋতা বলল, “হুম। তুই গিয়ে রেডি হ। তোর ট্রেন কয়টায়?”

“আমি আজ যাচ্ছি না। কালই যাব।”

“তুই না বললি আজ যাবি?”

“তোকে বাসে তুলে দিয়ে তারপর যাব।”

নৈঋতা বুঝল ওর জন্যই রিহান নিজের যাওয়া একদিন পিছিয়েছে। কিন্তু কিছু বলল না। ভালো লাগল, সে কি স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছে! ওর হয়তো উচিত ছিল, রিহানকে বলা, সে একা বাসে উঠতে পারবে, ওর আজই যাওয়া উচিত। কিন্তু বলতে পারল না। মনে হলো, রিহান সাথে থাকলে ওর ভালো লাগবে। এই ভালোলাগাটুকু সে হারাতে চাইল না।

“আর একটা সেমিস্টার। দেখতে দেখতে কেমন করে সময়গুলো চলে গেল।” ভাবালুতা খেলে গেল নৈঋতার গলায়।

“আসলেই, সাড়ে তিন বছর। আমাদের তিন বছরের ফ্রেন্ডশিপ, তোর মনে আছে, আগে যা ভাব নিতি আমার সাথে?” রিহানকেও নস্টালজিয়া গ্রাস করেছে।

“ভাব দেখাইনি। তখন তোকে আমার খুব ইরিটেটিং ক্যারেক্টার মনে হতো।”

“তখন আমি যেমন ছিলাম, এখনো তাই আছি। তাহলে চেঞ্জটা কোথায় হলো?” রিহানের মুখে হাসি।

“চেনায়। তখন তোকে কাছ থেকে চিনতাম না, যখন চিনলাম, তোকে পড়লাম, তখন তোকে নিয়ে আমার পারসেপশন চেঞ্জ হলো। আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম।”

রেহান হেসে বলল, “প্রাণের বন্ধু।”

নৈঋতা মনে মনে বলল, “তুই জানিস না রিহান, এই জঞ্জালে ভরা ধূলোর পৃথিবীতে তুই আমার একমাত্র শান্তি।”

কিন্তু মুখে বলতে পারল না কথাটা, যদি রিহান ওকে ভুল বোঝে! যদি বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যায়! এই বন্ধুত্বটা ওর কাছে অক্সিজেন, সঞ্জীবনী শক্তি। একটু ভুলে সেটাকে হারাতে পারবে না নৈঋতা! তাহলে শ্বাস নেবে কী করে!

সহসাই কোনো আগমনী বার্তা ছাড়াই উন্মত্ত বাতাস উঠল প্রকৃতিতে, ধূলো, ময়লা, উড়ছে, নৈঋতা চোখ বন্ধ করল শক্ত করে। গাছপালা ভয়াবহ ভাবে দুলছে। প্রকৃতি হঠাৎ যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে। সে থমকে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়।

রিহান ওর হাত ধরে টেনে দৌড়াতে দৌড়াতে বলল, “নীরু, দ্রুত পা চালা না। ওদিকে যেতে হবে।”

একটা নিরাপদ আশ্রয়ে এসে থামল। এই মধ্য জুনে যেন কালবৈশাখীর হানা! নৈঋতার মনেও একইরকম উন্মাতাল ঝড়!

ওদের পাশে আরও অনেকেই এসে দাঁড়াচ্ছে, পাগুলে প্রকৃতি একটু শান্ত হলেই যার যার গন্তব্যে ছুটবে। নৈঋতার একারই যেন কোনো গন্তব্য নেই। কোথাও যাবার তাড়া নেই।
…………
(ক্রমশ)
আর তিন-চার পর্ব বাকি ইনশাআল্লাহ। আবার এক-দুই পর্ব কম-বেশি হতে পারে। ডিটেইলিং করতে গিয়ে কিছুটা বড় হচ্ছে।

নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০৪

0

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ৪)
নুসরাত জাহান লিজা

নৈঋতা হলে এসেই রিহানের মাকে কল দিল। তিনি ওর জন্য এত যত্ন করে ওর প্রিয় খাবার রান্না করে পাঠিয়েছেন, ওর অবশ্যই তাকে একবার কৃতজ্ঞতা জানানো উচিত বলে মনে হলো।

“নীরু, কেমন আছো, মা?”

“ভালো আন্টি। আপনার শরীর এখন কেমন? রিহানের কাছে শুনলাম।”

“এখন ঠিক আছি, মা।”

“আন্টি, আপনি এই শরীর নিয়ে এত কষ্ট করে রান্না করেছেন…”

ওকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “আমার রান্না করতে ভালো লাগে। না করলেই মনে হয় বুড়ো হয়ে গেছি।”

“আপনার রান্না ভীষণ মজা আন্টি। আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।”

ওই প্রান্তে মৃদু হাসির আভাস পেল নৈঋতা, “এই যে তুমি খুশি হয়েছে, এতেই আমি খুশি মা।”

“দোয়া করবেন আন্টি।”

“অবশ্যই। তুমি আমার পাগল ছেলেটার যেভাবে খেয়াল রাখো, তুমি আছো বলে আমি কিছুটা নিশ্চিন্ত থাকি। নইলে ওকে নিয়ে আমার চিন্তার শেষ নেই।”

“আপনি একদম চিন্তা করবেন না আন্টি। ও খুব ভালো ছেলে।”

“কিন্তু অত্যন্ত গা ছাড়া। নিজের খেয়াল রাখে না। জীবন নিয়ে সিরিয়াস না। এগুলোই চিন্তার। ভালো থেকো মা”

রিহানের মায়ের সাথে কথা বলে নৈঋতার ভালো লাগল। কেমন মা মা একটা গন্ধ। রিহানের সাথে ওর বন্ধুত্বের পরে পরে রিহান বাড়িতে গিয়ে ওকে নিয়ে গল্প করেছিল মায়ের কাছে। পরে যেদিন তিনি শুনেছেন সেদিনই কল দিয়েছিলেন নৈঋতাকে। ভীষণ আন্তরিক গলায় ওকে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। এরপর মাঝেমধ্যে কথা হয়। ভদ্রমহিলা ওকে স্নেহ করেন।

বিকেলের কথা মনে পড়ল ওর। রিহান হৃদির সাথে কথা বলছিল৷ কী বলছিল, কিছুই ওর কানে ঢোকেনি যেন। মুহূর্তটা সে মুছে ফেলতে চায় মন থেকে।

***
ওরা একটা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সাথে যুক্ত। দেশের বিভিন্ন দুর্যোগের সময় তারা ডোনেশন কালেক্ট করে।

এবার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রিহান, নৈঋতারা ক্যাম্পাস ঘুরে ঘুরে ডোনেশন কালেক্ট করছে। ভীষণ ক্লান্তিকর কাজ, তবুও যখন মনে হয় মাধ্যমে কারো সাহায্য হচ্ছে, সেই ক্লান্তিটা মিলিয়ে যায়, বরং আলাদা একটা উদ্যম কাজ করে।

এরমধ্যে ওদের ফরম ফিলআপের ডেট দিয়ে দিল লেভেল ফোর সেমিস্টার ওয়ানের ফাইনাল পরীক্ষার। এটা একটা মহাযুদ্ধ মনে হয় নৈঋতার কাছে। এত দৌড়াদৌড়ি করে ফরম নিয়ে, পূরণ করে আবার হল প্রভোস্ট, প্রক্টরের সাইন নেয়াটা মহা ঝক্কির কাজ। তার মধ্যে গরমটা পড়েছে অতিরিক্ত।

রিহান ওর হাত খরচের টাকা থেকে বেশিরভাগ টাকাই সেই ফান্ডে দিয়ে দিয়েছিল৷ হুট করে এভাবে ডেট পড়ে যাবে বুঝতে পারেনি।

নৈঋতার বাবা যে টাকা পাঠান, সেটা থেকে প্রতিবারই কিছু টাকা বেঁচে যায়। সেসব সে জমিয়ে রাখে৷ রিহানকে বলল,

“আমার কাছ থেকে ধার নে।”

“তুইও তো দিলি।”

“আমার জমানো আরও কিছু টাকা আছে৷”

আসলে বাবা যা পাঠান, সে খুব হিসেব করে খরচ করে বাকিটা জমিয়ে রাখে নিজের একাউন্টে। কখন কোন দরকার পড়ে, তখন নিজে থেকে হাত পেতে চাইতে ওর ভালো লাগে না বলেই জমায়।

“আচ্ছা, তবে আমি আজই গিয়ে লিখে রাখব। একদম নেব না নেব না, করবি না।”

“আচ্ছা, করব না।”

প্রক্টর অফিসে ফরম জমা দিয়ে বেরিয়ে আসছিল ওরা, রিহান বলল, “এত প্যারা যে কেন দেয় এরা! এই যুগে এসে সিস্টেমটা ডিজিটাল করতে পারে না!”

“সেটাই৷ বেহুদা দৌড়াদৌড়ি।”

“তোকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। চল ওদিকে বসি।”

নৈঋতার সত্যিই ভীষণ ক্লান্ত লাগছিল। ছেলেটা ওকে এত বোঝে কীভাবে! ওরা পাশেই ইউনিভার্সিটির টিএসসি লেক ভিউতে এসে বসল। জায়গাটা সুন্দর। অসংখ্য গাছা গাছালি এখানে। মন ভালো হয়ে যায়।

রিহান ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ওকে দিল, “এতে স্যালাইন গুলে নিয়েছিলাম বের হবার আগে। খা, ভালো লাগবে।”

“স্যালাইন খেলে কার ভালো লাগে?”

“আমার লাগে।”

“এ্যাহ্!”

“আমি বললাম তোর লাইনে দাঁড়িয়ে কাজ নেই৷ তাও শুনলি না।”

এরমধ্যে হৃদির কল এলো, কথা শেষ করে রিহান আবার ওর পাশে এসে বসে বলল,

“আমাকে ডাকছে, বলল ওর সাথে থাকব কিনা, ফরম নেয়ার সময়।”

নৈঋতা ভেতরের বিষাদ চেপে বলল, “যা তাহলে।”

“আমি না করে দিয়েছি।”

নৈঋতা বলল,

“কেন? তোর হৃদির সাথে থাকা উচিত ছিল।”

“কেন?”

“তাহলে বেশি করে ইমপ্রেস করতে পারতি।”

“ও আমার প্রতি এমনিতেই ইমপ্রেস হয়ে আছে। ওই বরং আমাকে ইমপ্রেস করতে চাইছে। ওকে যদি আমি বলতাম, বরং আমার অনেক কাজ ও করে দিত।”

“তো তুই না ওর প্রতি ইন্টারেস্টেড, এভাবে বলছিস কেন? বরং ওকে হেল্প করা উচিত।”

“এত পুতুপুতু আমার পোষায় না।”

নৈঋতা অবচেতনেই প্রশ্ন করল, “তাহলে আমার জন্য করতে চাইলি কেন?”

রিহান একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলল, “তুই আর হৃদি এক হলি? তোর সাথে ওকে মেলাচ্ছিস কেন?”

“এটা উত্তর হলো?”

“যেমন প্রশ্ন তেমন উত্তর।”

“মেলে না কেন?”

“কারণ তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।”

বলে খানিকটা থেমে রিহান হঠাৎ বলল, “তুই কি জানিস, তুই এ পৃথিবীর সবচাইতে ভালো মেয়ে?”

কথাটা নৈঋতার হৃদয়ের কোথায় গিয়ে যে লাগল! মনে মনে আওড়ালো, “তবুও তুই আমাকে একটু অন্য চোখে কেন দেখলি না? কেন একটু অন্যরকমভাবে ভালোবাসলি না?”

কথাগুলো হয়তো কোনোদিনই সে রিহানকে বলতে পারবে না। ছেলেটা ওকে এত ভালো বুঝতে পারে সবকিছুতে, শুধু যা এখন নৈঋতার কাছে একান্ত আরাধ্য, সেটাই বুঝতে পারে না!
……….
আজকের পর্বটা তাড়াহুড়োয় এডিট করা। এই পর্বের কমতিটুকু আগামী পর্বে পুষিয়ে দেব ইনশাআল্লাহ।

নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০৩

0

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ৩)
নুসরাত জাহান লিজা

ক্লাস শেষে নৈঋতা আর প্রতিদিনের মতো এসে বসেছে জব্বারের মোড়ের রেললাইন ঘেঁষে যে চায়ের দোকানটা আছে সেখানে। এখানকার মালাই চা রিহানের ভীষণ পছন্দের। নৈঋতার যদিও ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু হুট করে দূরত্ব তৈরি করলে অনেকগুলো প্রশ্ন চিহ্ন দাঁড়িয়ে যাবে। তাছাড়া মানুষটা রিহান, যার সাথে ওর অসম্ভব হৃদ্যতা। সেটা কি চাইলেও এক লহমায় মুছে ফেলা যায়!

“তুই মুড অফ করে আছিস কেন নীরু?”

“আমি তোর এসাইনমেন্ট করে দিলাম, খেলা ছিল পৌনে দুটোয়। এর আগে তুই কী কী করলি? যার জন্য কষ্ট করে আমাকে করে দিতে হলো?”

“কী আর করব! সাদির রুমে আড্ডা মেরেছি। এরপর হৃদি কল দিল। কথা বললাম। মাঝে একবার তুই কল দিলি। আমি পরে কলব্যাক করলাম, তুই ধরলি না। তারপর তো ম্যাচ দেখলাম। এই তো।”

কৈফিয়ত দিয়েই চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রিহান বলে উঠল, “হঠাৎ এভাবে জেরা করছিস কেন?”

“এমনি। হৃদির সাথে কতদূর এগুলো? ভালোই তো কথাবার্তা চলছে।” না চাইতেই হৃদির ব্যাপারে প্রশ্ন করে ফেলল। মন যেন নেতিবাচক কথা শুনতে উৎসুক হয়ে আছে।

“খুব বেশি না। নর্মাল জানাশোনার ফেজে আছে এখনো। মেয়েটা ইন্টারেস্টেড আবার লাজুক কিছুটা। তবে আমার প্রতি এখন পর্যন্ত যারা ইন্টারেস্টেড ছিল, তাদের মধ্যে ও সবচেয়ে ভালো। এটুকু বুঝলাম।”

“কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত।” বলার সময় গলাটা ধরে আসছিল নৈঋতার।

“কীসের জন্য?”

“ফাইনালি কারো প্রতি তুই আগ্রহী হচ্ছিস। রিলেশনশিপে যাবি।”

“ধূর! কেবল কথাবার্তা চলছে। এখনি এত শিপ টিপ কীসের! পরে দেখা যাবে।”

কিছুক্ষণ নৈঋতা আর কোনো কথা বলল না। রিহান নিজের মনে বকবক করছিল। হঠাৎ ট্রেনের হুইসেলে আচমকা সে খানিকটা কেঁপে উঠল। অনেকেই রেললাইনে বসে ছিল, তাদের মধ্যে উঠার তাড়া দেখা গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারপাশে গর্জন তুলে বিশালদেহী ট্রেনটা ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

“চল উঠি।”

ওরা রাস্তা ধরে পাঁচতালার সামনের বারান্দা ধরে হেঁটে লাইব্রেরির সামনের রাস্তায় চলে এলো। আজকের বাতাসটা অন্যরকম। রোদ সহনীয় বলে বাতাসটা আরামদায়ক লাগছে।

আনমনে হাঁটছিল নৈঋতা, পাশে রিহান কী বলছে কিছুই যেন ওর কানে যাচ্ছে না। সহসা একটা ছোট্ট ভাঙা ইটের টুকরায় হোঁচট খেয়ে পা বেঁকে পড়ে গেল সে।

রিহান হহন্তদন্ত হয়ে বলল, “এভাবে উজবুকের মতো হাঁটছিলি কেন? দেখে চলতে পারিস না।”

হাত ধরে নৈঋতাকে তুলল সে, বলল, “তুই আমাকে কেয়ারলেস বলিস, আমাকে এভাবে উস্টা খেয়ে পড়তে দেখেছিস কখনো? কী যে করিস না তুই? হাঁটতে পারবি না তো, দাঁড়া রিকশা ডাকি। হাসপাতালে যেতে হবে, এক্সরে করতে হবে।”

সে সত্যিই ভীষণ ব্যথা পেয়েছে, পা ভেঙে গেলেও যেতে পারে। তাই আর আপত্তি করল না। ইউনিভার্সিটি থেকে চরপারা পর্যন্ত যেতে যেতে রিহান ওকে বকাবকি করেছে। অন্য সময় হলে সে ছাড় দিত না মোটেও। কিন্তু আজ সে কেবল দেখল এসবের আড়ালে ওর জন্য রিহানের উৎকণ্ঠা। হাসপাতালের সামনে রিকশা থেকে নামার আগে আগে কেবল বলল,

“এত চিন্তা করছিস কেন আমাকে নিয়ে?”

“চিন্তা হবে না? আমি ছাড়া আর কেউ আছে তোকে নিয়ে চিন্তা করার?”

নৈঋতা নিজের ভেতরের তোলপাড় আরেকবার উপলব্ধি করল।

“নীরু, তুই আমার সবচাইতে কাছের বন্ধু। তুই আমাকে যতটা বুঝিস, আর কেউ এতটা বোঝে না। তুই কষ্ট পেলে আমার চিন্তা হবে না? এটা হয়?”

নৈঋতা জানে রিহান কেবলই ওকে বন্ধু বলে ভাবে, প্রাণের বন্ধু। যেই বন্ধুত্বে ছেলে-মেয়ে বিভেদ হয় না। ওর কাছে মনের আগল খুলে দেয় কিঞ্চিৎ পাগলাটে ছেলেটা। বন্ধুত্বের বাইরে অন্য কোনো অনুভূতি সেখানে নেই। কিন্তু ও কেন পারল না একইভাবে রিহানকে শুধু বন্ধু ভাবতে! বন্ধুত্বের সীমা ছাড়িয়ে কেন অন্য অনুভূতি ওর মধ্যে জন্মালো!

পায়ে কোনো ফ্র‍্যাকচার নেই, তবে মচকে গেছে ভালোমতো। ওকে বসিয়ে রেখে রিহান সমস্ত ওষুধ কিনে এনে ওর হাতে ধরিয়ে দিল। ওর হলের সামনে এসে রিকশা থেকে নেমে বলল, “কাউকে ডাক। একা একা যেতে পারবি না দোতলায়। পায়ে বাড়তি প্রেসার পড়বে।”

“আমি পারব রিহান।”

“এত প্যাকপ্যাক না করে কল দে তো৷ তুই সুপারওইম্যান না। রক্তমাংসের মানুষ।”

“দরকার নেই বললাম তো।”

“তোর রুমমেটদের নম্বর আমার কাছে নেই। হৃদিকে কল দেই, তোকে হেল্প করুক।”

“আমি সুমি আপুকে কল করছি।” হৃদির কথা শুনে নৈঋতা নিজেই কল দিতে রাজি হলো।

“এই তো ভালো মেয়ের মতো কাজ করলি।”

“ফাজলামো করবি না রিহান। গাট্টা খাবি মাথায়।”

সারাদিনে এই প্রথম নৈঋতা নিজের চেনা ফরমে ফিরল।

“এটা মিস করছিলাম। তোর বাজখাঁই গলার থ্রেট।”

ভাগ্যিস ওর পায়ে তীব্র ব্যথা, তাই আজকের মতো বেঁচে গেল রিহান।

***
এই বৃহস্পতিবার রিহান বাড়িতে গিয়েছিল। দুদিন থেকে আজ ফিরেছে। দুই সপ্তাহে নৈঋতার পা পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেছে।

রিহানের কল পেয়ে রিসিভ করল নৈঋতা।

“কেআরে আয় তো নীরু।”

“কেন?”

“দরকার আছে।”

“তুই কখন এলি বাসা থেকে?”

“হলে ব্যাগ রেখেই বেরিয়েছি।”

“আচ্ছা, আসছি।”

নৈঋতা গায়ের পোশাক পাল্টে বেরিয়ে এলো। রিহানের হাতে একটা টিফিন বক্স। ওরা হাঁটতে হাঁটতে নদীর পারে চলে এলো। ওর দিকে বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল,

“মা দিয়েছে, তোর জন্য।”

“কী?”

“আমি জানি না। বলল, নীরুকে দিস।”

নৈঋতা খুলে দেখল একটায় পায়েস, অন্যটায় কিছু পিঠা।

“তুই নাকি একদিন মাকে বলেছিলি, তোর পায়েস খুব পছন্দ। তাই বানিয়ে দিলো।”

নৈঋতা যত কষ্টই পাক কখনো কাঁদে না৷ আজ কেন যেন চোখে পানি চলে আসছিল। ওর তো মা নেই, মায়ের হাতের পিঠা পায়েস ওর কখনো খাওয়া হয়নি। এই খাবারে যেন মা মা গন্ধ লেগে আছে! ভীষণ প্রশান্তিদায়ক গন্ধটা!

“ভীষণ মজা হয়েছে। আন্টিকে আমার পক্ষ থেকে ধন্যবাদ দিয়ে দিস।”

“তুই নিজেই দিস, আমি খাবারটা তোকে ডেলিভারি করে দিয়েছি। এখন কথাও ডেলিভারি করতে হবে?”

“তুই একটা মহা ফাজিল ছেলে।”

“আন্টির শরীর এখন কেমন? অসুস্থ শরীর নিয়ে উনি এতকিছু করেছেন।”

“এখন ভালো। আসলে বাড়িতে শুধু মা আর বাবা-ই তো থাকেন এখন। সময় কাটে না। ভাইয়া ভাবি তো ঢাকায় থাকেন কর্মসূত্রে। আমি এখানে। দুইজন বসে বসে শুধু টেনশন করে আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য। টেনশনের কী আছে তাই বুঝি না।”

“স্বাভাবিক। তুই তাদের জায়গায় থাকলে বুঝতি।”

“তুই যেন কয়টা বাচ্চা কাচ্চা পয়দা করেছিস!”

নৈঋতা পানির বোতল রিহানে পিঠে ঝপাঝপ নামিয়ে আনল কয়েকবার।

“নীরু, আরে, নীরু, তুই আমাকে এত মারিস কেন? এত বিধ্বংসী কেন তুই? আল্লাহ…”

এরকম কত অসংখ্য মুহূর্ত ওদের আছে! খুঁনসুটিতে ভরা।

হঠাৎ রিহানের মুঠোফোন বেজে উঠল। রিহান রিসিভ করে বলল, “হ্যালো হৃদি…”

সোনারঙা বিকেলটা নিমিষেই তামাটে বর্ণ ধারণ করল যেন! নদীতে ভেসে বেড়ানো অনেকগুলো নৌকা, ঘাটে বাঁধা আরও কয়েকটা। তবুও ওর চোখ চলে গেল অনতিদূরের একলা একটা পরিত্যাক্ত নৌকার দিকে। কী ভীষণ একা, সেই নৌকাটার যদি প্রাণ থাকত, তবে সেটাও বোধহয় ওর মতো কষ্ট পেত। ভাগ্যিস ওটা জড় পদার্থ, একজন মানুষ হয়ে জন্মানোর জন্যও দুঃখ হলো ওর।
……..
(ক্রমশ)
কেমন লাগছে গল্পটা?

নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০২

0

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ২)
নুসরাত জাহান লিজা

নৈঋতার আজ একেবারেই ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু সোবহান স্যারের খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা লেকচার আছে। মিস করা যাবে না। অগত্যা সে তৈরি হলো। প্রতিদিন বেরুবার আগে রিহানকে কল করে সে, কিন্তু আজ কেন যেন নিজেকে বিরত রাখল।

প্রচণ্ড রোদ আজ বাইরে, ছাতা নেয়া হয়নি। দুই মিনিট হাঁটলেই কেয়ার মার্কেট, তার পাশে পশু পালন অনুষদ ধরে নিজের ফ্যাকাল্টিতে গেল সে। রিহান তখনও আসেনি, বোরহান স্যারের ক্লাস চলছিল। সে কল না দিলে রিহানের ঘুম ভাঙবে না। এর পরেই সোবহান স্যারের ক্লাস। অগত্যা কল করল। দুইবারের সময় রিসিভ করে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,

“বল, নীরু।”

রিহানের ঘুম জড়ানো ভরাট গলায় কথাটা শুনতে ওর কেন যেন ভীষণ ভালো লাগে। সে ফিসফিসিয়ে বলল,

“কয়টা বাজে আগে দেখ।”

“কয়টা বাজে?”

“তোর চোখ নেই? সময় চিনিস না?”

“তা, তুই বললে কী হয়?”

স্যারের নজর বাঁচিয়ে কল করেছে, কানে এয়ারফোন দিয়ে। ধরা পড়া যাবে না, তাই এই মুহূর্তে বচসায় গেল না।

“নয়টা তেইশ।”

“তুই না আমাকে সোয়া আটটার দিকে কল দিস। আজ দেসনি কেন?”

“তুই এলার্ম সেট করে রাখতে পারিস না? আমাকেই কেন প্রতিদিন জাগিয়ে দিতে হবে?”

“তুই আমার এলার্ম ঘড়ি রে। তুই কত সুন্দর করে গালি দিয়ে আমাকে জাগিয়ে দিস। এলার্ম তোর চাইতে কর্কশ গলায় ডাকতে পারবে না, আর আমার ঘুমও ভাঙবে না।”

“তুই মর, ফাজিল।”

বলে কল কেটে দিল, রিহান সবসময় এভাবেই কথা বলে। তবুও আজ কেন যে কথাটা এত খারাপ লাগল!

স্যার হঠাৎ করে ওকে বললেন, “তুমি কী করছিলে?”

সে অপ্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “কিছু না স্যার।”

“বলো তো, এতক্ষণ কী বলছিলাম?”

পাশ থেকে শৈলী ফিসফিসিয়ে টপিকটা বলে দিল বলে এযাত্রায় বেঁচে গেল সে। রিহানের জন্য আরেকটু হলেই ঝাড়ি খেতে হতো। নৈঋতা অত্যন্ত মনোযোগী থাকে ক্লাসে। কিছু ক্লাস থাকে বিরক্তিকর। তখন খাতায় লিখে লিখে রিহানের সাথে গল্প করে।

গতবার একটা ক্লাসে রিহান এমন হাস্যকর ফাজলামো করছিল স্যারকে নিয়ে, যে সে প্রায় উচ্চস্বরে হেসে ফেলেছিল। ভাগ্যিস সামলে নিতে পেরেছিল।

আজ সে ক্লাসে একেবারেই মনোযোগ দিতে পারছে না। ওর বছর দেড়েক আগের একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। তখন লেভেল টু, সেমিস্টার টু চলছিল। ওদের ডিপার্টমেন্টেরই সিনিয়র বড় ভাই নাহিদ ওকে প্রপোজ করেছিল। সে সাথে সাথে রিজেক্ট করে দিয়েছিল। কিন্তু নাহিদ ভাই কিছুদিন বেশ বিরক্ত করেছে ওকে।

রিহানকে কথাটা জানাতেই ভীষণ রেগে গিয়েছিল সে, “নাহিদ ভাই? ওইটা তো পাক্কা প্লে বয়। ও তোর পেছনে ঘুরবে কেন? ওর তো খবর আছে!”

“মাথা গরম করে ঝামেলায় জড়াস না রিহান। আমি হ্যান্ডেল করতে পারব বিষয়টা।”

“তোকে কিছু করতে হবে না। আমি ঝামেলা করব না। তুই চিন্তা করিস না। আমি ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলব।”

রিহান নাহিদকে কী বলেছে নৈঋতা জানে না, কিন্তু এরপর আর নাহিদ ভাই বিরক্ত করেনি ওকে। রিহান আর নৈঋতা সবসময় একসাথে থাকে বলে, ওদের ফ্যাকাল্টির বেশিরভাগই মনে করে ওরা প্রেম করছে। ওরা চেষ্টা করেছে ভুল ভাঙাতে, কিন্তু কেউই বিশ্বাস করেনি।

রিহান ওর সকল বিষয়ে ভীষণ প্রটেক্টিভ। রিহান যেমন চোখ বন্ধ করে ওকে ভরসা করে, সে-ও রিহানকে নিজের সমস্তটা দিয়ে বিশ্বাস করে। সে সাথে থাকলে নিরাপদ অনুভব করে। রোল কলের সময় শৈলী ওকে ধাক্কা না দিলে, খেয়ালই করত না।

স্যার বেরিয়ে গেলে শৈলীকে বলল,
“থ্যাংকস রে।”

“আজ তোর কী হয়েছে বলবি?”

“কিছু না তো। শরীরটা একটু খারাপ।”

“রিহান আসবে না?”

“আসবে।”

বলতে বলতেই দেখল নবাবজাদা বীরদর্পে ক্লাসরুমে প্রবেশ করছে।

চোখ দুটো কিঞ্চিৎ ফোলা, “রাতে ঘুমাসনি?”

“হৃদির সাথে কথা বলেছি সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত। তারপর… নেটফ্লিক্সে একটা জোস সিরিজ এসেছে। ভাবলাম একটা এপিসোড দেখেই ঘুমাব। এমন টুইস্ট আর থ্রিল, মাথা নষ্ট। পুরো আটটা এপিসোড শেষ করে ঘুমিয়েছি।”

“মহান কাজ করেছিস।”

“তোর মাথা ব্যথা কমেছে।”

“হুম।”

“তুই আজ আগে কল করিসনি কেন?”

“ব্যালেন্স ছিল না।” মিথ্যা কথা বলল নৈঋতা। সত্য কথা বললে অনেক প্রশ্ন আসবে।

“তুই না কালকেই রিজার্জ করলি। ফোনে তো আমার সাথে ছাড়া কারোর সাথে কথাও বলিস না তেমন। বাসায় হয়তো এক দুই মিনিট। তাও আঙ্কেলই কল দেন৷”

“আজাইরা প্যাঁচাচ্ছিস কেন, রিহান? আগে বলিনি বলে বলতে পারব না?”

“তোর কী হয়েছে রে নীরু? তাকা তো আমার দিকে।”

নৈঋতা রাগী গলায় কিছু বলতেই যাচ্ছিল, এরমধ্যে সোবহান স্যার ক্লাসে চলে এলেন। রিহান তখন বিস্মিত দৃষ্টিতে নৈঋতার দিকে তাকিয়ে ছিল। সে বলল,

“জায়গায় গিয়ে বোস। ক্লাসে মন দে।”

***
বাবার সাথে কথা বলতে গেলেই নৈঋতার প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ হয়। ওকে বাড়ি যেতে বলছেন৷ সে দুই ঈদের ছুটি আর সেমিস্টার ব্রেকের সময় ছাড়া বাড়ি যায় না। তখন পুরো হল ফাঁকা হয়ে যায় বলে বাধ্য হয়ে যেতে হয়। নইলে তাও যেত না।

আফজাল স্যারের প্রেজেন্টেশন রেডি করছিল। চারজন করে একটা টিম। ওর টিমে রিহানও আছে আইডি নম্বর পাশাপাশি হবার সুবাদে। ওইদিনই এসাইনমেন্টও জমা নেবেন তিনি৷ টিম এক হলেও তিনি সবাইকে আলাদা আলাদাভাবে সাবমিট করতে বলেছেন৷

রিহানের কল এলো, “কী করছিস নিরু?”

“ঘাস কাটছি।”

“খাওয়ার জন্য?”

“তোকে খাওয়ানোর জন্য। গরু কোথাকার। আফজাল স্যারের এসাইনমেন্ট করেছিস?”

“ওহ্! মনেই ছিল না। ডেডলাইন কবে যেন?”

“পরশু৷ তোর কোনটা মনে থাকে? খালি মেয়েদের বায়োডাটা মনে থাকে?”

“কোন মেয়ের বায়োডাটা মনে রেখেছি?”

“সেটা তুই জানিস। প্যারা দিস না। আমাকে কাজ করতে দে, তুইও এখন এসাইনমেন্ট করতে বস।”

“শোন না নিরু, তুই না আমার একমাত্র বেস্ট দোস্ত, আমারটাও একটু করে দিস কেমন?”

“একদম না রিহান। মিষ্টি কথায় চিড়ে ভিজবে না। নিজের কাজ নিজে কর এবার।”

“আরে আজকে লা লিগার হাই ভোল্টেজ ম্যাচ আছে, এল ক্লাসিকো। নইলে আজ আর তোকে প্যারা দিতাম না। একটু হেল্পই তো চাইছি।”

“ম্যাচ তো পৌনে দুইটায়৷ এখন বাজে আটটা এগারো। এরমধ্যে শেষ হয়ে যাবে৷ সিরিয়াস হ।”

“আজকে আমি পারব না রে। আচ্ছা যা, বিনিময়ে তোর সাথে শপিংয়ে গিয়ে ব্যাগ টেনে দিব। তাও করে দে প্লিজ। আফজাল স্যার কাঁচা চিবিয়ে খাবে নাইলে। আমাকে কেন যেন সহ্যই করতে পারে না ব্যাটা। ক্যারি দিয়ে দেবে নির্ঘাৎ। তুই কি তাই চাস?”

“তুই ভালো করে জানিস আমি শপিংয়ে খুব একটা যাই না। এইজন্য এটা বললি। এমন বিনিময় চাই না।”

“আচ্ছা যা, কেয়ারে শফিক মামার দোকানের নান আর চিকেন চাপ খাওয়াব তোকে, পাক্কা প্রমিজ।”

নৈঋতার মনে পড়ল একবার এরকম একটার বিনিময়ে রিহান ওকে ট্রিট দিতে নিয়ে গিয়েছিল। খাবার শেষে ওকে বলেছিল, “দোস্ত, বিলটা দে তো।”

“তুই না ট্রিট দিলি!”

“আমার দেয়া আর তোর দেয়ার মধ্যে পার্থক্য আছে! একই তো!”

সেবার স্টিলের স্কেল ওর পিঠে পড়েছিল, পরে অবশ্য নৈঋতাও ওকে ফাঁসিয়ে দিয়ে দ্বিগুণ বিল রিহানের কাছ থেকে আদায় করে নিয়েছিল। কত খুঁনসুটিতে মাখা মিষ্টি মধুর স্মৃতি সব।

“এসব ভুজুংভাজুং এ কাজ হবে না। তুই যে ট্রিট দেয়ার বান্দা না, সেটা আমি জানি।”

“আমার জন্য এটুকু করতে পারবি না? সবসময় করে করে এখন এভাবে অথৈ সমুদ্রে ভাসিয়ে দিবি আমাকে?” নাটুকেপনায় এই ছেলে ওস্তাদ।

“পারব না।”

“থ্যাংক ইউ প্রাণের দোস্ত।”

“পারব না বলেছি, করে দেব বলিনি।”,

“আমি একটা ক্যারি খাই এটা তুই চাইবিই না। আমি জানি৷ গুড নাইট। তোকে আজ আর বিরক্ত করব না দোস্ত। গুড নাইট। মন দিয়ে এসাইনমেন্ট কর।”

“শয়তান একটা।” কল কাটার পরে বলল নৈঋতা৷ রিহানের এসাইনমেন্ট শেষ পর্যন্ত ওকেই করতে হবে এটা সে আগে থেকেই জানত। তাই ওরটাই আগে করে রেখেছিল। এই বান্দা এসব করার মানুষ নয়!

কিছুক্ষণ পরে সে নিচে গিয়েছিল পানি আনতে৷ দেখল হৃদি ফোনে কথা বলছে। সে নিজের রুমে এসে কৌতূহল বশত রিহানকে কল দিল, ওয়েটিং।

কেন জানে না একটা দম বন্ধ করা কষ্ট ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলল। সবকিছু হঠাৎ অসহ্য হয়ে উঠল। ল্যাপটপ বন্ধ করে কাঁথায় মাথা মুড়িয়ে শুয়ে পড়ল।
(ক্রমশ)
রিচ ফিরিয়ে আনতে সবাই বেশি বেশি কমেন্ট করে সাহায্য করবেন, এই অনুরোধ রইল।

নব ফাল্গুনের দিনে পর্ব-০১

0

#নব_ফাল্গুনের_দিনে (পর্ব ১)
নুসরাত জাহান লিজা

নৈঋতা রিহানের জন্য অপেক্ষা করছে একরাশ বিরক্তি নিয়ে। এই ছেলের কোনো সময়জ্ঞান নেই। একটা মেয়ে এতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে, ওদিকে নবাবজাদার ঘুমই এখনো ভাঙেনি। নৈঋতা কল করতেই ঘুমঘুম গলায় বলল,

“এত ভোরবেলা কল দিয়েছিস কেন?”

“তুই ঘড়িটা একবার দেখ। এরপর কথা বল।”

কিছুক্ষণ নীরবতা ওই প্রান্তে। এরপর আরেকবার গলাটা ভেসে এলো, “আরে, মাত্র তো দশটা তেইশ বাজে।”

“রিহান, এগারোটায় হাদী স্যারের ক্লাস। তোর এ্যাসাইনমেন্ট করে এনেছিলাম। এগারোটার পাঁচ মিনিট আগে তুই এসে না পৌঁছালে এটাকে আমি দেশলাই দিয়ে জ্বালিয়ে দেব।”

“তুই সিগারেট ধরেছিস নাকি?”

“উদ্ভট কথা কেন বলছিস?”

“দেশলাই সাথে রাখছিস, তাই ভাবলাম…”

“আমি জব্বারে আছি, করিম মামার দোকানের সামনে। দেশলাই পাওয়া আমার জন্য কোনো সমস্যা না। আমি পেট্রোলও জোগাড় করতে পারব। তোর এসাইনমেন্টের সাথে সাথে সেটা তোর মাথায়ও ঢেলে একটা কাঠি জ্বালব।”

রিহান জানে এই মেয়ের মাথায় কিঞ্চিৎ ছিট আছে। ওর মাথায় পেট্রোল না ঢাললেও এসাইনমেন্ট যে রক্ষা পাবে না দেরি হলে, এই ব্যাপারে ওর কোনো সন্দেহ নেই।
এবার ওই প্রান্তে রিহানের ব্যস্ততার আভাস পাওয়া গেল,
“এই না, নীরু, আমি আসছি তো। এক্ষুণি বেরুচ্ছি তো।”

“দশটা পঞ্চান্ন, মনে রাখিস।’’

“আরে, আমি রেডি হব তো।”

“ছেলেদের রেডি হতে আধাঘণ্টা লাগে না-কি।”

“আরে, কত মেয়েরা তাকায়, বল? একটু মাঞ্জা না মারলে হয়!”

নৈঋতা কল কেটে দিয়েছে। এই ছেলে শোধরাবে না। একফোঁটা সিরিয়াসনেস নেই রিহানের মধ্যে। দেখতে সুদর্শন, আড্ডা জমাতে ওস্তাদ, চমৎকার গানের গলা, গিটার বাজায়, শুধু পড়াশোনাটাই করতে ইচ্ছা করে না নাকি। ওর সবচাইতে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে ছেলাটার হাসি। ভীষণ সুন্দর করে হাসে রিহান। এসব কারণেই সে বেশ ভালোই পরিচিত, আবার কিছু মেয়ের কাছে আরাধ্য। তবে রিলেশনশিপ নিয়ে রিহান কখনো খুব একটা সিরিয়াস নয়।

মেয়েদের সাথে কথা যতক্ষণ হয়, খুব মধুমুখ করে কথা বলে, তবে যখনই বুঝতে পারে মেয়েটা বেশি জড়িয়ে যাচ্ছে, রিহান সরে আসতে থাকে। তবে মেয়েদের নজর নিজের উপরে পড়ুক, সেই ব্যাপারে আবার সে খুব সচেতন। ওর ভালো লাগে এটেনশন পেতে।

ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত দম আটকে সে পড়াশোনা করেছে, ভালো রেজাল্ট ছিল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চান্স হবার পর প্রথম সে গণ্ডির বাইরে আসে। মাকে দেখানোর জন্য যেটুকুও বা পড়াশোনা করত, নৈঋতার সাথে বন্ধুত্ব হবার পর থেকে সেটুকুও ছেড়ে দিয়েছে।

রিহানের ভরসার জায়গা নৈঋতা। দু’জনের আইডি নাম্বার পাশাপাশি। লেভেল ওয়ানের প্রথম সেমিস্টারে ওদের কোনো আলাপ হয়নি। কেবল নামে আর চেহারায় চিনত একে অপরকে। প্রথম সেমিস্টার ফাইনালের প্রথম পরীক্ষার দিন কথা হয় ওদের। নৈঋতা নিজের জীবন আর লক্ষ্য নিয়ে অত্যন্ত সচেতন। তাই ক্লাসে রিহানের কথাবার্তা খুব বিরক্ত লাগত ওর।

ফিশারিজ জ্যুলজি পরীক্ষা খুব একটা ভালো হয়নি একজনেরও। সেদিন খাতা জমা দেবার আগে আগে রিহান ওকে ডেকে বলেছিল,

“তোমার ফোন নাম্বারটা দিও তো। একসাথেই যেহেতু এক্সাম দিতে হবে, পড়াশোনাটাও একসাথেই করা যাবে।”

নৈঋতা রাজি হয়েছিল। গ্রুপ স্টাডি করলে ভালোই হয়। টপিকগুলো মাথায় থাকে। সেই থেকে টুকিটাকি কথাবার্তা শুরু। আগে ক্লাসে ওকে বিরক্ত লাগত, ধীরে ধীরে সে বুঝতে পারে, এই রিহান ছেলেটা আসলে এমনই। চলছে, চলুক টাইপ। অগোছালো, ফুর্তিবাজ, কোনো লক্ষ্য, উদ্দেশ্যহীন নৌকার মতো। এসবের কিছুই নৈঋতার পছন্দ নয়, সে অত্যন্ত সিরিয়াস নিজের লক্ষ্যে। তবুও বন্ধুত্ব যে জমেছে, তা রিহানের আকর্ষণীয় চেহারা আর এপিয়ারেন্সের জন্য নয়, রিহানের ভেতরে একটা ছোট্ট শিশু বাস করে, তার জন্য। এই ছেলের সহস্র ফাঁকিবাজি, ছেলেমানুষি আবদার নৈঋতা মেনে নেয়।

ভাবনায় ছেদ পড়ল নৈঋতার। রিহান চলে এসেছে।

“যাক, এখনো অক্ষত আছে, জ্বালাসনি!”

নৈঋতা ঘড়ি দেখল, তিন মিনিট আগেই এসেছে রিহান। তবে সেজেগুজে আসতে ভুলেনি।

“দে আমার এসাইনমেন্ট, তোর উপরে ভরসা নেই।”

নৈঋতা হাতের ফাইল ফোল্ডার দিয়ে রিহানের পিঠে দুই-তিন ঘা বসিয়ে দিয়ে বলল,
“শয়তান, এগুলো তোর জন্য আমি কত কষ্ট করে করেছি, আর তুই…”

রিহান নিজের পিঠ বাঁচাতে বাঁচাতে বসল, “তোর হাতে এত জোর ক্যান! কী খাস তুই?”

নেঋতা রিহানের এসাইনমেন্ট বের করে ওর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “আজকের পর আমার আশেপাশে আসবি না।”

কোনোরকমে এসাইনমেন্টটা ধরে রিহান ছুটল নৈঋতার পিছে। অবস্থা বেগতিক। আজ বোধহয় ফাজলামোটা একটু বেশি হয়ে গেল কি-না।

“নীরু, আরে দাঁড়া না, তুই তো জানিস আমি এরকম। কেন রেগে যাস তবুও। এ্যাই…”

***
রেললাইন ধরে হাঁটছিল নৈঋতা আর রিহান। আজ বেশ রোদ্রতপ্ত দিন। আকাশ ঝলমলে, গেল কিছুদিন টানা বৃষ্টি ছিল। তাই এই রোদটা খারাপ লাগছে না। সহনীয় মনে হচ্ছে।

“তোকে রাতে কল দিয়েছিলাম। নাম্বার বিজি ছিল।”

“কখন?”

“কখন, এই তো নয়টার দিকে হবে হয়তো।”

রিহান বলল, “ও, হৃদি ফোন দিয়েছিল। কথা বলছিলাম ওর সাথে।”

“কোন হৃদি?”

“আরে, ওই যে ডিভিএম এর মেয়েটা। চশমা পরে, চিনিস তো। তোর হলেই থাকে।”

“আচ্ছা, কোন হলে থাকে, তাও মুখস্ত? কয় তালায় থাকে? রুম নম্বর জানিস?”

“তিনশো কত যেন বলল। ভুলে গেছি। চিনছিস তো, তাই না?”

“হ্যাঁ। তা কী আলাপ হলো?”

“ওই আর কী। আমার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। মেয়েটাকে একটু অন্যরকম মনে হলো।’’

“তা নিজেকে জানালি?” সূক্ষ্ম একটা ঈর্ষার কাঁটা নৈঋতাকে খোঁচাতে লাগল কেন যেন। রিহান তো সবসময়ই এমন, তবুও আজ হঠাৎ ওর এমন লাগছে কেন! হয়তো কিঞ্চিৎ মুগ্ধতার আভাস পেয়েছে বলে।

কোনোমতে বলল, “এবার তুই সিরিয়াস রিহান?”

“কথা বলি আগে, জানাশোনা আরও হোক। যদি মনে হয় ঠিকঠাক, তারপর সিরিয়াস কিনা বলা যাবে। চলুক আপাতত।”

নৈঋতার কিছুই ভালো লাগছে না। সে বলল, “আমি হলে যাই আজ। মাথাটা ব্যথা করছে।”

“সে কী, মাথা ব্যথা, চল, আগে চা খাবি৷ এরপর হেলথ্ সেন্টারে গিয়ে ডক্টর দেখাবি আগে, ওষুধ নিয়ে এরপর হলে যাবি।”

“এসবের দরকার নেই। আমি যাই।”

“যাই বললেই হলো নাকি! তুই নিজের দিকে খেয়াল রাখবি না? চল, চল।”

নৈঋতার আপত্তি ধোপে টিকল না, অগত্যা রিহান সাথে থেকে সমস্ত প্রসিডিওর শেষ করে ওকে হলের সামনে দিয়ে গেল।

নৈঋতা হলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইল, রিহানের যাওয়া দেখল। ছেলেটা ওর প্রতি সবসময়ই এমন কেয়ারিং। ওর প্রতি এত যত্নশীল আগে কোনোদিন কেউ ছিল না। ওর তিন বছর বয়সে মা মারা গেছেন। ওর বাবা এরপর আরেকটা বিয়ে করেছেন। টাকা দিয়ে তিনি দায়িত্ব পালন করেন, অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখান, কিন্তু ভালোবেসে দুটো কথা, পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়া এসব স্নেহ কখনো পায়নি সে।

রিহানকে সে বোধহয় ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু ছেলেটা সম্পর্কের ব্যাপারে একেবারেই সিরিয়াস নয়। কোনো কিছুর প্রতিই নয়। একটা ভুল মানুষের জন্য এমন প্রগাঢ় অনুভূতি কেন জমছে ওর! এর কী আদৌ কোনো পরিণতি আছে! জেনে শুনে বিষ পান করেছে সে! নাহ্, নিজেকে সামলে নিতে হবে!

চলবে।

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-২৫

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২৫
নয়না বাসায় এসে টেনেটুনে হিজাব খুলে সোফায় ছুড়ে মারলো। ইচ্ছে করছে জিয়ানের মাথা চিবিয়ে খেতে, তাহলে হয়ত মেজাজ একটু ঠান্ডা হতো৷ ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানির বোতল বের করে ঢকঢক করে গিলছে৷
“জাহানার বেগম হাত থেকে ঠান্ডা পানির বোতল কেড়ে নিয়ে বলে,বাপ চাচাদের মত মাথায় ক্যাড়া উঠেছে? এতো রাগ জেদ ভালো না নয়না৷ কি হয়েছে সেটা আগে বল।”
নয়না জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলে,”আম্মু আমার জন্য ছেলে দেখো আমি বিয়ে করবো।”
“এমন অলুক্ষণে কথা কখনো মুখেও আনবি না!মেয়ে মানুষ হলো সাদা চাদরের মত একটু কিছু হলেই সহজে দাগ লেগে যায়। তাছাড়া রেজা ছেলেটা ভালো সুখেই থাকবি তুই। রুমে যেয়ে ফ্রেশ হ আমি তোর জন্য শরবত করে নিয়ে আসছি।”
“নয়না যেতে যেতে উচ্চ আওয়াজে বলে,বিয়ে কিন্তু আমি করবোই ওই ড্রাইভারের সাথে আমি কিছুতেই থাকবো না৷ শা’লা একটা হিটলার।”
“জাহানারা বেগম মনে মনে বলে,এই মেয়ের কবে বুদ্ধি হবে! পাইলট ছেলেটাকে ড্রাইভার বানিয়ে দিয়েছে!”

“নয়না রুমে এসে পায়চারি করতে লাগলো। নাহহ কিছুতেই সে স্থীর হতে পারছেনা। এভাবে কেউ মিথ্যে বলে? এরজন্যই নীলাঞ্জনা আপি পালিয়ে গেছে। সে পালিয়ে বেঁচে গেছে আমাকে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে। মোবাইল হাতে উঠিয়ে নিয়ে কল করলো জিয়ানকে। পরপর পরপর কয়েকবার কল করেই যাচ্ছে। ওপাশ থেকে একি কথা বলছে নাম্বার আনরিচেবল! রাগে মোবাইল বেডে ছুড়ে মারলো। ড্রেস নিয়ে সোজা চলে গেলে ওয়াশরুমে। বাথটবে হালকা উষ্ণ পানিতে নিজেকে ডুবিয়ে রাখলো। একটু পর পর মাথা বের করে শ্বাস নিচ্ছে।কিছুক্ষণ পর পুরো মাথা বাহিরে বের করে জোড়ে নিশ্বাস নিলো৷ রাগ কিছুটা কমছে। ড্রেস চেঞ্জ করে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। কোমর ছাড়িয়ে হাঁটু ছুঁই ছুঁই চুলগুলো৷ এখন তার বিরক্ত লাগছে চুলগুলোকে। ড্রায়ার থেকে কাঁ’চি বের করলো আজ সে তার সখের চুলগুলো কেটে ফেলবে৷
“জাহানারা বেগম দ্রুত এসে নয়নার হাত থেকে কাঁ’চি নিয়ে বলে,কি হয়েছে তোর?”
“জানিনা আম্মু আমার কিছুই ভালো লাগছে না।”
“এটা শেষ করে রেডি হ। চল আজ তোর জন্য কিছু কেনাকাটা করবো।”
” নাহহ আম্মু আমার ইচ্ছে নেই।”
“তবে বিরিয়ানি রান্না করি।”
“নাহহ আমার খাওয়ার মুড নেই।”
“কি হয়েছে আমার প্রিন্সেসের?”
“নয়না জাহানারা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,আম্মু আমরা কি পরীক্ষার পর ভ্রমণে যেতে পারি না?”
“অবশ্যই পারি। দশটা না পাঁচটা না আমার একটা মাত্র এই সব কিছুই তো তোর জন্য।”
” আচ্ছা কথা দিচ্ছো কিন্তু।”
“দিলাম কথা৷ এবার তুই রেস্ট নে আমি বিরিয়ানির জন্য গোশত নামিয়ে ভিজিয়ে রাখি৷”
“নয়না চুপচাপ বসলো না, পায়চারি করছে আর জিয়ানকে কল করেই যাচ্ছে। সাথে মনে মনে অগণিত গালি তো দিচ্ছেই।”
🌿

নীলঞ্জনা গেটের বাহিরে এসে বলে,আপনাকে ধন্যবাদ আমাকে নতুন করে পথ দেখানোর জন্য।
“জীবন অনেক মূল্যবান সে জীবনকে নিজের হাতে হত্যা করলে দ্বিতীয়বার আর ফিরে পাওয়া যায় না৷ আমরা চাইলেই জীবনের ভুলগুলোকে শুধরে নিয়ে জীবনটাকে সাজিয়ে নিতে পারি। যদিও তা সহজ নয় তবে কঠিনও না।”
“জীবনের কিছু ভুল এমন থাকে যা কখনো শুধরে নেয়া যায় না। সেই একটা ভুল সারাজীবন আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়। জীবনটা আসলে আমরা নিজেরাই নষ্ট করি। ছাড়ুন এসব এটা বলুন আপনার নাম কি?”
“আমার নাম আহিয়ান হাসান অন্তর৷”
“নীলাঞ্জনা।”
” কিছু মনে না করলে আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসতে পারি?”
“মন্দ হয়না৷”
অন্তর ড্রাইভ করছে নীলাঞ্জনা পাশের সিটে বসা৷ অন্তর হঠাৎ বলল, জানিনা কেনো কিন্তু আপনাকে পরিচিত মনে হচ্ছে!
“একই শহরের মানুষ হয়তো কোন রাস্তার মোড়ে আমাদের রাস্তা বদলের সময় দেখা হয়েছিলো।”
“আপনি সুইসাইড কেনো করতে যাচ্ছিলেন?”
“যার জন্য সব ছেড়েছি সে আমাকে না আমার দেহটাকে ভালোবেসেছে। আচ্ছা ছেলে মানুষ কেনো বোঝেনা নারীর মন পেলে তার জন্য সে নারী দুনিয়ায় সর্গ সাজিয়ে দিতে পারে৷ অথচ পুরুষের কেবল নারীর দেহের প্রতি মোহ!”
“সব পুরুষ এক না৷ ভালোবাসা এই যুগে বাগান বিলাস ফুলের মত। সবাই তার সৌন্দর্য আটকে গভীর ভাবে এরপর ধীরে ধীরে তা ঝড়ে পরতে থাকে৷ মোহ আর ভালোবাসার মধ্যে মানুষ মোহকেই ভালোবাসা মনে করে সামনে এগিয়ে যায়।”
“এখানেই থামুন আমার বাসা চলে এসেছে৷”
” তালুকদার ম্যানশনের সমানে এসে থামকে দাঁড়ালো নীলাঞ্জনা৷ কোন মুখে দাঁড়াবে সে? তাকে কি ঠাই দিবে পরিবার নাকি দুর দুর করে তাড়িয়ে দিবে?”
“অন্তর পেছন থেকে বলে,সামনের পথ কঠিন হলেও এগিয়ে যাওয়ার পথে পিছু ফেরতে নেই৷ সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়।”

“নীলাঞ্জনা বাসায় এসে কলিং বেল দিলো৷”
“জাহানারা বেগম তখন বিরিয়ানি দমে দিচ্ছিলেন৷ কলিংবেলের আওয়াজ শুনে বলে,এই সময় কে আসলো?”
“সার্ভেন্ট দরজা খুলে দিয়েই চিৎকার করে বলে,বড় আম্মা দেহেন কেডা আইছে?”
“জাহানারা বেগম ছুটে আসলেন ড্রয়িং রুমে। নীলাঞ্জনাকে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।
“নীলাঞ্জনা জাহানার বেগমের পায়ের কাছে বসে বলে,বড় আম্মু আমাকে ফিরিয়ে দিও না৷ আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি৷ আমাকে একটু ঠাঁই দেও বড় আম্মু।”
🌿
দীর্ঘ তেরো ঘন্টা জার্নির পরে জিয়ান নিজের রেস্ট রুমে ঢুকে ড্রেস খুলে থ্রি-কোয়াটার পরে শুয়ে পরলো৷ কখন চোখ দুটো লেগে গেছে তার ইয়াত্তা নেই। যখন চোখ খুললো তখন উঠে দেখে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। নিজের মোবাইল ওপেন করতেই চমকে উঠলো জিয়ান। নয়’শ মিসডকল! সাথে শ’খানেক টেক্সট।
“শয়তান ড্রাইভার, লুচ্চা ড্রাইভার, ডেভিল ড্রাইভার, হিটলার ড্রাইভার, মেয়েবাজ ড্রাইভার, আরো কত আজে বাজে টেক্সট। এসব দেখে হাসবে নাকি কাঁদবে বুঝতে পারছে না৷সাত পাঁচ না ভেবে কল ব্যাক করলো৷”
” নয়না সাথে সাথে কল রিসিভ করলো। মুখ ফুলিয়ে রেখে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।”
“জিয়ান কাশি দিয়ে বলে,আমি কি দেখতে এতোই খারাপ? আমার দিকে তাকানে যায় না?”
“নাহহ যায় না৷ আগে জামা কাপড় পরেন তারপর তাকাতে বলেন, বডি বানিয়েছেন আর ভাবছেন সব মেয়ে আপনার বডি দেখে প্রেমে পরে যাবে!”
“জিয়ান কম্ফোর্টার টেনে গলা অব্দি টেনে তুললো৷ এবার বলো তো বাংলাদেশের নামকরা প্লেবয় কেন বানিয়েছো আমাকে?”
“সোজা কথার সোজা উত্তর দিবেন একটুও বাঁকা উত্তর দিলে আপনার তেরোটা বাজিয়ে ফেলবো৷”
“আচ্ছা একদম বরাবর উত্তর দেবো।”
” আপনি সিগারেট খান?”
“অভ্যাস নেই তবে মাঝে মাঝে খাই৷ আরেহহহ জানো না সিগারেট খেলে বুদ্ধি বাড়ে।”
“বাজে কথা রেখে এটা বলুন সামনের বাটন খোলা রেখে শার্ট পরেন?”
“মাঝে মাঝে দেশে থাকলে পরি গরমের সময়।”
“কচি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করেন?”
“জিয়ান এক চোখ টিপে বলে,আগে তো করতাম না এখন করি।”
“জিয়ানের দুষ্টুমি মাখা কথায় আরেকজনে ভুল বুঝে রেগে বোম হয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে বেচারা বেখবর। আর কিছু জানতে চান প্রিন্সেস সুনয়না?”
“নয়নার চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। রাগলে নয়নার চোখে অশ্রু টলমল করে, রাগী কন্ঠে বলে,”আমার ইচ্ছে করছে, আপনাকে থেঁতো করে স্যুপ রান্না করে খেতে৷ তবেই যদি আমার মাথা একটু ঠান্ডা হয়।”
“বাহহহ মাস্টার শেফ সুনয়না চৌধুরী মানুষের স্যুপ বানাবে?”
“মানুষের না আপনার স্যুপ বানাবো।”
“তো আমি কি?”
“আপনি ড্রাইভার। বলেই খট করে কল কেটে দিয়ে মোবাইল সুইচড অফ করে দিলো৷ রাগে কি করবে বুঝতে পারছে না৷ কি অসভ্য লোক কচি মেয়েদের ইভটিজিং করে তা আবার বুক ফুলিয়ে বলছে!নির্লজ্জ লোক।”
“জিয়ান ফোনের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,এই পাগলি মেয়ের আবার কি হলো? এই নিব্বা বৌকে নিয়ে যদি সংসার করতে হয় আমার অবস্থা বেহাল হয়ে যাবে৷”
জিয়ান উঠে বসলো৷ টেলিফোন কল করে খাবার অর্ডার করলো। নিজে উঠে ওয়াশরুমে চলে গেলো৷
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে, এক তালাক, দুই তালাক,একশ তালাক৷ টেক্সট দেখে জিয়ান উচ্চ স্বরে হেসে ফেললো!
🌿
মান্নাত ক্লাস শেষ করে একটা হাওয়াই মিঠা কিনে সেটা খেতে খেতে আসছিলো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা গায়ে জানালার পর্দার মত একটা ড্রেস।মান্নাতের চোখ আটকে গেলে এক বাসার দোতলার বারান্দায়। মান্নাত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে বারান্দায় দাঁড়িয়ে গিটার বাজানো ছেলেটার দিকে।
“জাহিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে টুংটাং করে গিটারের সুর তুলছিলো। সেদিন দেখা হয়েছিলো আজও পারিনি কিছুই বলতে যে তোমায়…হঠাৎ রাস্তায় চোখ যেতেই ভ্রু কুঁচকে নিজের রুমে চলে গেলো।
“মান্নাত নিজের দিকে তাকিয়ে বলে,হিটলার বাপের জন্য এজন্মে প্রেম হবে না। নিশ্চিত আমাকে পাগল ভেবে চলে গেছে!”
“জাহিন রুমে ঢুকে দেখে, সায়না দাঁড়িয়ে আছে।”
“তোর কি সমস্যা? তুই জানিস না প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলের রুমে হুট করে চলে আসা ব্যাড ম্যানারস?”
“জাহিন আই লাভ ইউ।”
“আই লাভ ইউ টু ডিয়ার বনু।”
“এটা ঠিক না জাহিন আমি তোকে ছ্যাইয়ার নজরে দেখি।”
“আমি তোকে বোনের নজরে দেখি। যা সর এখন রুম থেকে বের হ আমি আমার গার্লফ্রেন্ডকে কল করবো৷”
#চলবে

চন্দ্রমলিন সন্ধ্যায় পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0

#চন্দ্রমলিন_সন্ধ্যায় (শেষ পর্ব)
#কারিমা_দিলশাদ

তাকে প্রথম দেখলাম বাসর রাতে। বেশি রাত হয়ে যাওয়ায় তাকে সে রাতটা আমাদের বাড়িতেই রাখা হলো। আকস্মিক বিয়ে শুধু মনের উপর দিয়ে না, শরীরের উপর দিয়েও ধকল গেছে। শরীরের ধকল বেশি না মনের ধকল বেশি বলতে পারবো না। কিছুই বলতে পারবো না। আমার ইন্দ্রিয়গুলো যেনো অচল হয়ে গেছে। ধকল সইতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। যখন ঘুম ভাঙলো ডিমলাইটের আলোয়, মুখের সামনে অচেনা এক পুরুষের মুখ দেখে আমার দেহ থেকে আত্মা বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভয়ে চোখ নিশ্চয়ই তার নির্দিষ্ট সাইজের থেকেও বড়ো আকার ধারণ করেছে। চিৎকার দেওয়ার কথা মাথায় আসে নি।
আমার এমন বিহ্বল প্রতিক্রিয়া দেখেই বোধহয় মানুষটা তার স্টকে থাকা সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা দিলো। পুরুষ মানুষের হাসি এতো আকর্ষণীয় হয় আমার জানা ছিলো না। আমার সাথে কি হচ্ছে জানা নেই। আমি বিমোহিত হয়ে সেই হাসি দেখলাম। এই লোক তো প্রলয়ঙ্কর! এই হাসি দিয়েই সে শত শত রমণীর হৃদয় নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে। কিন্তু আমাকে পারলো না। কারণ আমার হৃদয়কে আগেই কেউ বিভৎসভাবে হত্যা করে ফেলেছে। তবুও কিছু একটা আমাকে চুম্বকের মতো টানলো।

-ভয় পেলে?

পাবো না! মাঝরাতে মুখের সামনে অচেনা একটা পুরুষকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখলে ভয় পাবো না? গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোলো না। আকস্মিক শকটা কাটিয়ে উঠতে পারি নি তখনও। এরমধ্যেই আমার সমস্ত ইন্দ্রিয়কে সচল করে দিলো সেই সুবাস। সারা তনু মন ছেঁয়ে গেলো সুবাসে। লোকটা কি মাখে গায়ে!

-এতো সুন্দর করে ঘুমাচ্ছিলে যে চোখ ফেরাতে পারি নি।

পারবেন কিভাবে লজ্জা আছে আপনার? নেই তো। লজ্জা থাকলে মেয়ে দেখতে এসেই নিশ্চয়ই বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে যেতেন না৷

-ভীষণ ঘুমকাতুরে তুমি! নামের মান রক্ষা করেছো। বরের অপেক্ষা না করেই ঘুমিয়ে পড়লে। বর পছন্দ হয় নি?

– অবশ্য…তুমি তো আমায় দেখোই নি। এতো এতো বাঁধা পেরিয়ে তোমার সামনে এলাম। নিজেকে দেখার সুযোগ করে দিলাম। আর তুমি একটু মাথা উঁচু করে দেখলেও না। এতো অবজ্ঞা! জানো কতো মেয়ে আমার পিছন পিছন ঘুরে?

ঘুরবে না। চেহারা ছবি তো মাশাল্লাহ। মেয়েরা পিছু পিছু তো ঘুরবেই। এতো পিছু পিছু ঘুরা মেয়ে থাকতে আমাকেই লোকটার চোখে পড়লো! আমি তো তাকে কিছুই দিতে পারবো না। নারীর প্রথম ভালোবাসা নাকি তার আত্মার প্রথম স্পর্শ। আর স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক সেই আত্মার। আমি যে আমার আত্মার প্রথম স্পর্শ তাকে দিতে পারবো না। অপাত্রে দান করে সেই আত্মা নষ্ট করে ফেলেছি যে।
আমার ভাবনার মাঝেই সে লাইট জ্বালিয়ে দুপা ভাজ করে আমার ঠিক সামনে বসে পড়ে। সাথে সেই প্রলয়ঙ্কারী হাসি৷

-যাক বিয়ের আগে যখন বর দেখোনি। এখন দেখো।
দেখতো বরটা চলনসই নাকি। চলনসই না হলেও এখন কিছু করার নেই। তোমাকে একবার সুযোগ দেওয়া হয়েছিলো। তুমি সেই সুযোগ হাতছাড়া করেছো। এখন আর সুযোগ নেই। আমাকেই আজীবনের জন্য বয়ে বেড়াতে হবে। আমার আবার দয়ার শরীর৷ তাই তোমাকে একটা সাজেশন দেই। এই বোঝাটা অন্তর দিয়ে টেনো। আই প্রমিস লোকসান হবে না।

সেই শুরু। নাহ লোকসান হয় নি। বলা যায় আমি জীবনে জিতে গেছি। খুব জেতা জিতেছি। মানুষটা আমায় আমূল বদলে দিয়েছে। এতো যত্ন, আগলে রাখায় আমি বিগড়ে গেছি। কতো যে বাজে অভ্যাস গড়িয়েছে আমার। এই যেমন গোছালো আমিটা এখন অগোছালো হয়ে গেছি। কোনো কাজ এখন গুছিয়ে করতে পারি না। আসলে করতেই চাই না। মানুষটা এতো গোছানো; আমার থেকেও গোছানো। তার কোনোকিছু আমার গুছিয়ে দিতে হয় না। উল্টো আমাকেই সে গুছিয়ে দেয়। আমিও জেনেবুঝে অগোছালো থাকি৷ সে খুব যত্নে আমায় গুছিয়ে নেয়। তার এই যত্নে মাখা ভালোবাসাটার জন্য আমি সারাজীবন অগোছালো থাকতে রাজি। ভাবা যায় একটা সময় আমি অগোছালো কারো জন্য মরিয়া ছিলাম। এখন মনে হয় কি জানেন? কাউকে যত্নে ভালোবাসার থেকে, কারো যত্নের ভালোবাসা নিতেই বেশি ভালো লাগা কাজ করে।

লোকটার উপর আমি পুরোপুরি নির্ভর হয়ে গেছি জানেন। তাকে ছাড়া কিচ্ছু করতে পারি না। দরকারই বা কি বলুন? যার নিজস্ব একজন পারফেকশনিস্ট আছে তার অন্যকিছুর দরকার নেই। লোকে বলে-কারো উপর নির্ভরশীল হওয়া উচিত নয়, এতে করে তোমার অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে। সে লোকে যা বলার বলুক। লোকে তো কতকিছুই বলে। এই মানুষটা আমার অস্তিত্বকে হারিয়ে যেতে দেয় নি। উল্টো যখন আমি আমার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিলাম; তখন আমার সেই হারানো অস্তিত্বকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি জীবনে এমন একটা মানুষকে পেয়েছি যার উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়। যার উপর দুনিয়ার সব ঝামেলা চাপিয়ে আমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারি। যতো খারাপ পরিস্থিতিই আসুক; আমি জানি মানুষটা আমার উপর সেসবের কোনো আঁচ লাগতে দিবে না। এমন মানুষকে মনে জায়গা না দিয়ে উপায় আছে বলুন?
আমি নিজেকে পুরোটাই তার কাছে সঁপে দিয়েছি। আমি এখন নিশ্চিন্ত। আমার কতো কতো ইচ্ছে ছিলো। সব ইচ্ছের দায় এখন তার। এই যেমন হুট করে কোনো বৃষ্টিমুখোর দিনে ফিরতি পথে ফোন দিয়ে বলবে- তন্দ্রা আমি বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি৷ তুমি একটা শাড়ি পরে জলদি নিচে আসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।

আমি পড়িমরি করে গায়ে শাড়ি জড়িয়ে তার ডাকে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি এক শুদ্ধতম সুদর্শন পুরুষ একরাশ শুদ্ধতা নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর আরকি। ঝুম বৃষ্টিতে পিচঢালা রাস্তায় তার হাত ধরে পথ পারি দেওয়া।
আমার সব মন খারাপের দিনে আমার পাশে থাকা। যতক্ষণ না আমার মন ভলো হবে আমার কাছ থেকে সরবে না। মন ভালো করতে একটার পর একটা, কিছু না কিছু করতেই থাকবে। হয় হাতে হাত রেখে গল্প করবে, নাহয় গান গাইবে, নাহয় নিজের হাতে রান্না করে আমাকে খাইয়ে দিবে। গমগমে কন্ঠস্বরে যখন গান গায় শুনতে এত্তো ভালো লাগে। অভিমান করলে হাজার উপায়ে অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করবে।
আমার সব ইচ্ছে সে পূরণ করছে। আমি কখনো মুখ ফুটে বলি নি। মুখ ফুটে বলার ক্ষমতা যে আমার নেই, জানেনই তো। তার কাছে মুখ ফুটে কিছু বলার প্রয়োজনই পড়ে না। আমার না বলা কথাগুলো কিভাবে কিভাবে যেনো সে বুঝে যায়।

কবে, কখন, কিভাবে জানি না। আমি তার প্রেমে পড়েছি। এই প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারগুলো বোধহয় এমনই। কখন, কিভাবে কার ছায়া মনে জাগে; বলা মুশকিল। শুধু জানি এই মানুষটাকে ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। কিচ্ছু ভালো লাগে না তাকে ছাড়া। মানুষটার দূরত্বে আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। তার গমগমে কন্ঠস্বর না শুনলে আমার বড্ডো একা একা লাগে। আর তার সেই অদ্ভুত সুবাস! তার গায়ের সেই অদ্ভুত সুবাস ছাড়া আমার ঘুম আসে না। কেউ যে এতো যত্নের সাথে ভালোবাসতে পারে আমার জানা ছিলো না। এতো যত্নের ভালোবাসাও আমার কপালে ছিলো! আর আমি কিনা শূন্য নীড়ের জন্য হা-হুতাশ করতাম। এখন আর মুনতাজির ভাইকে সেভাবে মনে পড়ে না। পড়ার সুযোগটা কোথায়। মনে যে এখন অন্যকেউ গেড়ে বসে আছে।

“কিন্তু”। তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়। একজন বলেছিলেন না- নারীর হৃদয়ে প্রথম প্রেম সেই দীপশিখা, যা সময়ের ধাক্কাতেও সহজে নিভে না। আমি তার ব্যতিক্রম নাকি! এতো যত্নের মাঝেও মাঝে মাঝে তাকে মনে হয়।

কেউ যদি আমায় এখন প্রশ্ন করে- জীবন নিয়ে তোমার কোনো আফসোস আছে?
আমি বলবো- হ্যা৷ আফসোস আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে শুদ্ধ মানুষকে আমার শুদ্ধতম ভালোবাসাটা না দিতে পারার আফসোস আছে। আমার প্রথম প্রেমের মালাটা তাকে না দিতে পারার আফসোস আছে। আমার প্রথম অনুভূতিটুকু তার নামে না দিতে পারার আফসোস আছে। আমার এই আফসোস কোনোদিন যাবে না।

***

বহু বছর পর দেশে এলাম। বিয়ের পর পরই বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছিলাম উনার সাথে। মাসখানেক হলো দেশে ফিরেছি। এতদিন শশুর বাড়িতে ছিলাম। আমার শাশুড়ী মারা যাওয়ার পর, শশুর মশাই একা হয়ে গেছেন। সাথে আমার বিধবা ননাশ থাকেন, বাচ্চাকে নিয়ে। অনেক জোর করা হয়েছে উনাদের আমাদের কাছে নেওয়ার জন্য। কিন্তু আমার শশুরের এক কথা। যে কটাদিন বেঁচে আছি এখানেই থাকবো। নিজের বাড়িতে, নিজের দেশেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবো। আমার বাবা-মায়েরও বয়স হয়েছে। খুব চিন্তা হয় তাদের নিয়ে। শশুরকে দেখার জন্য লোক থাকলেও তাদের দেখার জন্য কেউ নেই। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। এবার ঠিক করেছি তাদেরও সঙ্গে নিয়ে যা। সবঠিক হয়ে গেছে। প্রসেসিং-এ যেটুকু সময় বাকি।

সময় বহমান। সময়ের স্রোতে অনেক কিছুই বদলে গেছে। দেখতে দেখতে আমার বাবা-মা বৃদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমিও কি আগের মতো আছি? নেই তো। আমি এখন পরিপূর্ণ নারী। কারো বিবাহিতা স্ত্রী। দুই সন্তানের মা। যার দিনরাত যায় স্বামী, সংসার আর দুটো বাচ্চার পিছনে ছুটতে ছুটতে।

বহুদিন পর আজ পুরনো মানুষদের কাছাকাছি এসে পুরনো স্মৃতি নাড়া দিচ্ছে। জিনিয়া, নিভাপু আসায় আজকে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। নিভাপুর মাঝে বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে। চুলে পাঁক ধরেছে। আমার চিক্কু বেস্টফ্রেন্ড এখন আর চিক্কু নেই। স্বাস্থ্য বেড়ে গেছে। আগের মতো চঞ্চলতার ছিটেফোঁটাও নেই তার মাঝে। কেমন জানি অসহায়ত্ব তার চোখেমুখে। আঙ্কেল মারা গেছেন, আন্টিও বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়েছে। এদের মাঝে আমার বড়ো হওয়া। এক থালায় খাওয়া। কতো কতো স্মৃতি এদের সাথে জড়িয়ে। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে গেছে।

সব বদলে গেলেও উনার প্রতি আমার ভালোবাসা আর আমার প্রতি উনার ভালোবাসা বদলায় নি। আমি আজও উনার যত্ন ভালোবাসার জন্য মুখিয়ে থাকি। বিয়ের পর নাকি ভালোবাসা বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের ভালোবাসা বিলীন হয় নি। বরং সময়ের সাথে সাথে নতুন রুপ নিয়েছে। আমার ভালোবাসার দুটি ফুল আমাদের দুই ছেলে মেয়ে। আগে যেই অনুভূতিগুলোতে সিক্ত থাকতাম। এখন সেসব বিলীন প্রায়।

বহু বছর পর মুনতাজির ভাইকেও দেখলাম। নিজেকে মেইনটেইন করেছে ভালো। চোখে চশমা উঠেছে। এখনও বিয়ে করেন নি। কেনো করেন নি। জানি না। জিনিয়াকে জিগ্যেস করেছিলাম। কিন্তু কোনো জবাব পাই নি। আমিও আর ওকে ঘাটি নি। স্বভাব চরিত্র বোধহয় এখনও বদলায় নি। কিছুই যে বদলায় নি তেমন না। এখন আর উচ্চ শব্দে জ্যাজ সং শোনা যায় না৷ তার পরিবর্তে মৃদু আওয়াজের রবীন্দ্র সংগীত ভেসে এসেছে।

এক বিকেলে তার সাথে কথাও হয়ে গেলো টুকটাক। সবাই উপস্থিত ছিলাম। বাচ্চারা ছুটাছুটি করছিলো। তখন তারসাথে দেখা। জানতাম নিজে থেকে এসে কখনো কথা বলবে না। কথা বললে আমাকেই বলতে হবে। সৌজন্যতার খাতিরে। সবার সামনে আসলে কথা না বললে কেমন দেখাবে না? অথচ আমাকে অবাক করে দিয়ে নিজেই আসলো কথা বলতে।

-কেমন আছো তন্দ্রা?
-মুনতাজির ভাই! ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?
বিনিময়ে মলিন হাসি দিয়ে নরম স্বরে খুব সংক্ষেপে জানালো- ভালো।
-বাচ্চা দুটোর বয়স কতো?
– মেয়ের তিন বছর আর ছেলের এক।
-নাম কি?
– সায়রী আর তিহান।
তিহানকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করলো। সায়রীকেও আদর করলো। বেশ অবাক হলাম। বেশ বদলে গেছে। মুনতাজির ভাই আর এতো নম্রতা,ভদ্রতা। বিশ্বাস করা যায়! এই কি সেই দাম্ভিক, বেয়াদব, বাউণ্ডুলে মানুষটা! অবশ্য এখন তো আর আগের বয়স নেই। বেলা তো অনেক গড়ালো। পরিবর্তন আসাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু একটা কথা সারাক্ষণ আমার মাঝে খচখচ করে, বিয়ে কেনো করেন নি তিনি৷ হয়তো কোনো খেয়ালিপনা থেকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

***

আজকে জিনিয়া চলে যাচ্ছে। দুদিন পর আমিও চলে যাবো। সব গোছগাছ করা শেষ। বাবা মা’ও সঙ্গে যাচ্ছে। এবার আর কোনো চিন্তা থাকবে না। জিনিয়া যাওয়ার আগে আমাকে একটা ডায়েরি দিয়ে গেছে। খুব অনুরোধ করেছে যেনো পড়ে দেখি।

-তন্দ্রা প্লিজ ডায়েরিটা পড়িস। আমি জানি এটা করা আমার উচিত হচ্ছে না। কিন্তু কথাগুলো তোর জানা উচিত। একটু সময় করে পড়িস। আমাদের ভুল বুঝিস না প্লিজ।

সেই ডায়েরিটা নিয়ে অনেক্ক্ষণ ধরে বসে আছি। জানি না ডায়েরিটা কার, কি আছে এতে। তবে অবচেতন মন কিছু সংকেত দিচ্ছে। মনের সাথে মনের যুদ্ধ চলছে। এক মন বলছে খুলিস না, আরেক মন বলছে খুলেই দেখ না। শেষে খুলেই দেখলাম। আমার অনেক ছবি। ছোটবেলার; বড়বেলার। বিভিন্ন ছোট ছোট চিরকুট, চিঠি, ডায়েরির পাতায় পাতায় লেখা অসংখ্য বাক্য। সব আমায় নিয়ে। হাত কাঁপছে। বুক কাঁপছে। গলা শুকিয়ে আসছে। চোখ থেকে অনবরত পানি ঝড়ছে।

আমার প্রাণপাখি,
অনেক অভিমান আমার প্রতি তোর তাই না। মনে মনে কি আমায় বকাঝকা করিস। কর। যতো ইচ্ছা কর। কি করবি বল। মানুষটা যে আমি খুব খারাপ। আর তোর জন্য আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। খুব কষ্ট পেয়েছিস বুঝি? আমারও কষ্ট লাগে। তোকে কষ্ট দিতে আমারও কষ্ট লাগে। তার থেকে বেশি কষ্ট লাগে তোকে অন্যকেউ দেখলে। সহ্য করতে পারি না। ইচ্ছে করে দুনিয়ার সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেই। অন্যকেউ তোকে কেনো দেখবে বল। তুই শুধু আমার। তোকে দেখার অধিকার শুধু আমার। অবশ্য তোর দোষেই তুই কষ্ট পাস। নিজের চুলগুলো অন্যকে কেনো দেখাতে হবে বল? খুব শখ না অন্যকে চুল দেখানোর? তোর সবকিছুতে শুধু আমার অধিকার। অন্যকেউ তোকে দেখবে না। ঠিক করেছি আমি। একদম ঠিক করেছি।

আরেক পৃষ্ঠাতে লেখা-

পরাণপাখি,

আজকে সজীবকে মেরেছি। খুব মেরেছি। কতোবড় সাহস বলতো। বলে কিনা তোকে পছন্দ করে। তোর সাথে যেনো স্যাটিং করে দেই। আমার ভিতরে কি হচ্ছিল বুঝতে পারিস?

এমন অসংখ্য কথা লেখা ডায়েরির পাতায় পাতায়। দমবন্ধ হয়ে আসছে। একটা চিঠিও আছে।

তন্দ্রা,

জানি এই চিঠির আজ কোনো মূল্য নেই। তুই পড়বি কিনা জানি না। তবে একটাবার অনুরোধ করবো পড়ার জন্য। নিজের ভিতরের অস্থিরতা, অপরাধবোধ এমন পর্যায় পৌঁছেছে যেখান থেকে আমি কোনোদিন বের হতে পারবো না।

আমি জানি তোর সঙ্গে অন্যায় করেছি। শুধু তোর সঙ্গে নয়। নিজের সঙ্গেও অন্যায় করেছি। নিজের খামখেয়ালিপনা, নিজের চিন্তাধারায় এতো মগ্ন ছিলাম যে; ঠিক সময়ে তোর মূল্যায়ন করতে পারি নি। তোকে বলতে পারি নি তোকে কতোটা ভালোবাসি।

আর পড়ার ধৈর্য্য হলো না। ভালোবাসতো? মুনতাজির ভাই আমাকে ভালোবাসতো! এখনও বাসে? আমার জন্যই তিনি আজ অবধি বিয়ে করে নি। আমাকে ভালোবাসলে এতো কষ্ট, অবহেলা, অপমান কেনো? যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনো অপমান করা যায়? প্রতিটা পাতায় আমার প্রতি তার পাগলামো আবেগের কথা।

শীতের সন্ধ্যা। মফস্বলি এলাকা হওয়ায় শীত জেঁকে বসেছে। এই প্রচন্ড শীতেও আমি কুলকুল করে ঘেমে চলছি। কোনো অজানা আবেগে নাকি রাগে আমার জানা নেই। রাগ হ্যা রাগ।
মাঠে কিছু বাচ্চারা আগুন জ্বালিয়েছিল। ডায়েরিটা সেই আগুনে জ্বালিয়ে দিলাম। বৃথা৷ এসব মিথ্যা, দমবন্ধকর আবেগের এখন কোনো দাম নেই। আমার প্রতি তার এসব আবেগের এখন কোনো দামই নেই। একসময় উপযুক্ত সময় ছিলো, তখন তিনি সবটা হেলাফেলায় নষ্ট করেছে। সে যাই বলুক, তার কাজের পিছনে তিনি হয়তো হাজারটা যুক্তি দাঁড় করাতে পারবে। কিন্তু সত্যি তো এটাই; কোনো যুক্তিই আমাকে অপমান করার অধিকার তাকে দেয় না। আমার কিশোরী বয়সের প্রথম অনুভূতিকে গলা টিপে হত্যা করার অধিকার তার ছিলো না। সে তো সবই বুঝতো। জানতো। আমিই বোকা। ভেবেছিলাম তিনি হয়তো কিছুই বুঝতেন না। অথচ তিনি আমার সমস্ত অনুভূতি জানা সত্যেও প্রতি পদে পদে আমাকে অপমান করে গেছে। এ কেমন ভালোবাসা! কেউ চুলের প্রশংসা করেছে বলে, চুল কেটে দেওয়া। কেউ পছন্দ করেছে বলে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করা; কেমন ভালোবাসা!

আর যাইহোক। সত্যিকারের ভালোবাসার মানুষকে কখনো কষ্ট দেওয়া যায় না। অপমান করা যায় না। আমার ভালোবাসা পাওয়ার কোনো যোগ্যতাই তার নেই। তবুও তাকে ভালোবেসেছি। ভালোবাসতে কোনো কারণ লাগে না। আমি ভালোবাসতে জানি তাই তারমতো মানুষকেও খুব যত্ন করে ভালোবেসেছিলাম। তাকে ভালোবাসতে পারাটা আমারই কৃতিত্ব ছিলো। মন থেকে ভালোবেসেছিলাম তাকে আর তিনি তা বড়ো নির্মমভাবে পায়ে ঠেলেছেন। ভালোবাসলে সেই মানুষটাকে সম্মান করতে হয়, আগলে রাখতে হয়, কদর করতে হয়। অপমান, অবহেলা, কষ্ট দেওয়ার মাঝে কোনো ভালোবাসা হতে পারে না। তাই এখন এসবের কোনো মূল্যই আমার কাছে নেই। আমি নিজের জীবনে সুখী। প্রকৃতপক্ষেই সুখী। একটা শুদ্ধতম মানুষ পেয়েছি আমি। যে আমাকে সম্মান করে, মূল্যায়ন করে, আগলে রাখে।

জানি না জীবনে এমন কি পূণ্য করেছি যার জন্য আল্লাহ তায়ালা আমাকে এমন বিষাক্ত একটা সম্পর্কে জড়ানো থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছেন। বিষাক্ত সম্পর্ক থেকে বাঁচিয়ে পবিত্র একটা পুরুষকে জীবনে এনে, আমার জীবনটা সুখ, শান্তি, সমৃদ্ধিতে ভরিয়ে দিয়েছেন। একসময় কাউকে খুব যত্নে ভালোবেসেছিলাম আল্লাহ তায়ালা আমার থেকেও যত্নে ভালোবাসতে পারা মানুষটাকে আমার জন্য পাঠিয়েছে। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। ব্যস। আর কিচ্ছু জানতে চাই না আমি। কিচ্ছু না। আমাকে ফিরতে হবে। প্রকৃত এক প্রেমিক পুরুষ অপেক্ষা করছে আমার জন্য। যার সাথে বৃদ্ধ হওয়ার ইচ্ছে। তার বুকে মাথা রেখে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার ইচ্ছে আমার।

***

-তন্দ্রা এই তন্দ্রা..
– উমম..
-ঘুমাচ্ছ?
– কি অদ্ভুত কথা সায়র! ঘুমন্ত মানুষকে জাগিয়ে বলছো ঘুমচ্ছি কিনা। এই রাতের বেলা মানুষ আর কি করবে।
মুচকি হেসে মাথা চুলকে বলে,
– ছাঁদে এসো। আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।

অগত্যা কি আর করার। মশাইয়ের আদেশে চলে গেলাম ছাঁদে। শীতের রাত। ধোঁয়া উঠা দুটো কাপ নিয়ে হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় দাঁড়িয়ে আছে।

-মাঝে মাঝে যে তোমায় কি ভূতে ধরে। এই মাঝরাত্রিরে কনকনে ঠান্ডায় কেউ ছাঁদে আসে?
-আমি আসি।
বলে এককাপ কফি আমার দিকে দিলো। খুব সন্তপর্ণে নিজের চাদরের মাঝে আমায় ঢেকে নিলো। শুধু কি চাদর। এভাবেই লোকটা তার ভালোবাসার মায়ায় আমাকে ঢেকে নিয়েছে।
– কদিন পর চলে যাবো। ভাবলাম আজকের রাতটা একটু অন্যভাবে কাটায়। আপনার সমস্যা আছে রাণীসাহেবা?
-সমস্যা তো নেই। কিন্তু মাঝরাতে তোমার হুটহাট প্ল্যানিং এ আমার হার্ট অ্যাটাক না হলেই হয়।

সায়র জোরে হেসে উঠে। কি সুন্দর হাসি! এই হাসি এমনই অম্লান থাকুক। অম্লান থাকুক আমাদের ভালোবাসাও।

পুনশ্চ: অন্ধকার ছাঁদের ঠান্ডায় হিম ধরা ফ্লোরে পা মেলে বসে আছে কেউ। বুক্ষুভের মতো সিগারেট টানছে আর হাওয়ায় বিষাক্ত ধোঁয়া ছাড়ছে। শীতের কুয়াশার মাঝে মিশে যাচ্ছে তা। গাশে পাতলা একটা শার্ট ছাড়া কিছু নেই। এই ঠান্ডায় শরীর জমে হিম হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু তার ভিতরের ঝড় থামছে না। দৃষ্টি তার সামনের ছাঁদে দাঁড়ানো কপোত-কপোতীর দিকে। তাদের নজর এদিকে পড়ে নি। তারা তো নিজেদের ভালোবাসায় ডুবে আছে। শুধু তারই প্রতিটা রাত এভাবে কাটে। আফসোস আর অনুতাপের সাগরে।
এই আফসোস ভালোবাসার মানুষটাকে না পাওয়ার। এই আফসোস, ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসি বলতে না পারার। শুধু কি আফসোস? তার থেকেও অনুতাপে জর্জরিত সে৷ ভালোবাসার মানুষটাকে বুঝতে না পারার অনুতাপ। ভালোবাসার মানুষটাকে কষ্ট দেওয়ার অনুতাপ। ভালোবাসার মানুষটাকে মূল্যায়ন না করার অনুতাপ। বাবা-মায়ের কথায় ঠিকঠাক প্রতিবাদ না করার অনুতাপ। জীবনে কতোই তো বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়েছে। আরও একটাবার অবাধ্য হলে ওই নারীটা আজ তার একান্ত ব্যক্তিগত হতো। সময়কে হেলাফেলা করার অনুতাপ। এতো এতো অনুতাপ আর আফসোসেই দিন কাটে তার। একবুক হাহাকার নিয়ে কাটে প্রতিটা রাত। সময় থাকতে সঠিক সময় এবং সঠিক মানুষের কদর করতে জানতে হয়।

সময় গেলে সাধন হবে না
দিন থাকতে দ্বীনের সাধন কেন জানলে না
তুমি কেন জানলে না
সময় গেলে সাধন হবে না….

সমাপ্ত.