Monday, August 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 20



হেমন্তের নীড় পর্ব-০৯

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৯
১৪.
স্নেহার জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমরা চারজন বাইরে খেতে এসেছি। স্নেহা গিফটের জন্য আমার কান দুটো ঝালাপালা করে দিলেও আমি নিরুত্তর মুখে মেন্যুতে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি। যদিও চোখ বুলিয়ে লাভ নেই। দেখা গেলো আমি খেতে চাইছি আম আমাকে জোর করে খাওয়ানো হবে জাম। এই জোরাজুরির যাতাকলে পিষ্ট হতে হতে আমি ক্লান্ত। এহেন পরাধীনতা আমি ঘৃণা করি।

ধ্রুব ভাই বসেছেন আমার পাশে। শুভ্রভাই আমার মুখোমুখি। দুজনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি যে ক্ষণে ক্ষণে উল্টেপাল্টে আমার মুখের উপর স্থির হচ্ছে তা আমি মাথা নিচু করেও বলতে পারি। কিন্তু আমি পণ করেছি কোনোমতেই নিজপছন্দে খাবার অর্ডার দিতে চেয়ে আজ আর অসম্মানিত হবো না। এমনিতেও আমার মন’টা পরে আছে চিলেকোঠার ঘরে। শুদ্ধকে একবার চোখের দেখাও দেখিনি। তারউপর এদের চাহনি আমাকে বিরক্ত করে তুলছে। যেকোনো মূহুর্তে আমি ব্যাগপত্র কাধে তুলে হনহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে পারি। তারপর যা হবে তা গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত নই বলেই আমি উঠে চলে যেতে পারছি না। অবশ্য প্রস্তুত থাকলে আমি তো আসতামই না। শুভ্র ভাই কেশে জিজ্ঞেস করলেন,

‘অর্ডার দিচ্ছিস না কেনো?’

‘খিদে নেই।’

শুভ্র ভাই আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। ধ্রুব ভাই নিশ্চুপ ফোনের দিকে চেয়ে আছে। তার ব্যাপারটাই হচ্ছে এমন, আমার উত্তরই তার উত্তর। আমি নিশ্চিত এই মূহুর্তে আমি যা খেতে চাইতাম সে একটু ভঙ্গি করে মেন্যু উল্টেপাল্টে দেখে আয়েশি ভঙ্গিমায় সেটাই অর্ডার দিতে বলতেন। কিন্তু বাধ সাধতো শুভ্র ভাই। ওই যে সবার উপর নিজের খবরদারি করার অভ্যাস। সবার মতামত উপেক্ষা করে সে নিজ মন মতো অর্ডার করবে। আমার কেমন অসহ্য লাগছে। শরীর চিড়বিড় করে উঠছে। অযথা আমার এই রাগের কারণ আমি বুঝতে পারছি না। শেষে কুলাতে না পেরে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললাম,

‘খাবার পার্সেল করে নিয়ে চলো। বাসায় গিয়ে খাবো।’

শুভ্র ভাই সেকেন্ড কয়েক আমার দিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে থাকলেন। আমি ধরেই নিলাম একটা রাম ধমক খেতে চলেছি এবং হলোও তাই। ধমকে উঠলেন তিনি,

‘পার্সেলই করার হলে এখানে এলাম কেনো?’

ধমকের পৃষ্ঠে আমি আর টু শব্দ করলাম না। চোখ খিচে বন্ধ করে রইলাম। ধ্রুব ভাই তখনো ফোনে চোখ গুজে রয়েছে। শুভ্র ভাই ওয়েটার ডেকে খাবার গুলো পার্সেল করে দিতে বললেন এরপর জায়গা থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে বললেন,

‘এদিকে আয়।’

আমি চমকে উঠলাম। হাত ধরায় অস্বস্তি হলো। এই অস্বস্তির সূত্রপাত শুদ্ধ আমার জীবনে আসার পর। শুভ্র ভাই আলতো হাতে আমাকে বাইরে নিয়ে এলেন। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, ধ্রুব ভাই এতোক্ষণে ফোন থেকে চোখ সরিয়েছেন।

‘তিনবার জোরে জোরে নিঃশ্বাস নে তো।’

‘কেনো?’

‘এমনি। আমার মনে হচ্ছে তোর ফুসফুস ঠিকমতো কাজ করছে না যেকোনো সময় মরে টরে যেতে পারিস তুই। নে নে শ্বাস নে।’

শুভ্র ভাইয়ের কথা আমার মানতে ইচ্ছে করলো না। তখন পড়ন্ত বিকেল পেরিয়েছে। সন্ধ্যা ছুই ছুই! আমি আকাশের দিকে তাকালাম। মিনিট কতক নিশ্চুপ মুহূর্ত গড়িয়ে যাওয়ার পর বিমর্ষ কণ্ঠে বললাম,

‘দেখো! কেমন করে মেঘগুলো চলে যায় প্রকাশ্যে তবু সবার বেখেয়ালে।’

শুভ্র ভাই মুখ তুলে আকাশের দিকে তাকালেন। আমি পেছনে ঘুরে কাচ গলিয়ে দেখলাম ধ্রুব ভাই স্নেহার সাথে কথা বলছে এরপর আবার শুভ্র ভাইয়ের দিকে তাকালাম। পরপর দুবার দুজনের মুখচ্ছবি, গাম্ভীর্যতা পর্যবেক্ষণ করে আমার মনে হলো আদতে এরা একসাথে বড় হয়েছে, সমবয়সী, যা করে সব একসাথে কিন্তু কোথায় যেনো সম্পর্কের টান পরেছে। কোথায় গিয়ে যেনো শান্ত দ্বন্ধ! ওদের মধ্যে সব মিল কিন্তু খুব অমিল!

আমার ভাবনার মাঝে পার্সেল নিয়ে স্নেহা ধ্রুব ভাই বাইরে বেরিয়ে এলেন। ওদের দুজনের মুখের দিকে আমাকে বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব ভাই চোখ নাচালেন। সবসময়ের মতো গম্ভীর মুখে প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘কি হয়েছে তোর?’

‘কিছু না।’

আমাদের যাওয়ার মাঝেই বাধা হয়ে শুভ্র শুভ্র বলে চিৎকার করে দৌড়ে এলেন এক ঝাঁক রমনী। শুভ্র ভাই হেসে হেসে রমনীদের সাথে কুশল বিনিময় করলেন। বললেন,

‘কিরে মাছের বাজার! এখনো একসাথেই ঘুরিস তোরা?’

কথাবার্তায় বুঝলাম তারা খুব ভালো বন্ধু। খুব সম্ভবত তারা তাদের মোমেন্ট ক্যাপচারড করতে বেরিয়েছেন। পাঁচজনের গায়ে একই শাড়ি, একই গয়না, একই সাজ। পেছনে একজন ফটোগ্রাফার গোছের লোক। কথা বলার এক পর্যায়ে রমনীগণ হেসে কুটি কুটি হয়ে শুভ্র ভাই কে ইশারায় কি যেনো বললো। শুভ্র ভাই শুধু মাথা নাড়িয়ে মুচকি হাসলেন। আমার তখন বিরক্তি তুঙ্গে। রমনীগণ আমার মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হতাশ শ্বাস ফেললেন। তাদের এই শ্বাস ফেলে দেখে ধ্রুব ভাইয়ের ভ্রু জোড়াও কুচকে গেলো। আমি তাদের এই হাসিহাসি মুখভঙ্গি থেকে বিশ্রী মুখভঙ্গি হয়ে যাওয়ার কারণ ঠাওর করতে পারলাম না।

বিদায় নিয়ে চলে আসার বেলায় ধ্রুব স্পষ্ট শুনতে পেলো তাদের ফিসফিসানি স্বর,

‘শুভ্রদের ভালোবাসাও উপেক্ষা করা যায়? ও মেয়ে না কংক্রিট?’

১৫.

এখন ডিসেম্বর মাস! শুদ্ধকে দেখার ছুতোয় পড়ন্ত বিকেলে ভারী কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে ফুল গাছ দেখার অযুহাতে ছাদে এসে আমি ভয়াবহ ছ্যাকা খেলাম। শুদ্ধ নেই। তবে ছ্যাকাটি আর ছ্যাকা রইলো না। মিনিট বিশেক পরেই ঘটলো শুদ্ধর আগমন। আমি তার ঘরের সামনে পথ আগলে দাড়ালাম। বুকের মাঝে হাত দুটো ভাঁজ করে গম্ভীর ভান করে বললাম,

‘কোথায় গিয়েছিলেন?’

ভাবটা এই যেনো আমি তার বউ। এই ভেবেই আমার মন রাঙা হলো। শুদ্ধ তার সকল গন্ডি পেরিয়ে আমাকে অবাকতার সাগরে ফেলে মুচকি হাসলেন। বললেন,

‘ছাদের বেঞ্চেতে বসো, তরু। আমি তোমার জন্য চা বানিয়ে নিয়ে আসি।’

আশ্চর্যের চরম শিখরে পৌঁছে গেলাম এই মূহুর্তে আমি। মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে রইলো। সে চা বানিয়ে নিয়ে এসে আপনাআপনি বললো,

‘বাসা খুঁজতে গিয়েছিলাম।’

এই তবে তার ভালো ব্যবহারের কারন! আমি স্তব্ধ নয়নে বললাম,

‘আপনি এখনো ওখানটায় পরে আছেন? আমি ভেবেছিলাম আপনি ভুলে গেছেন।’

‘ভুলে যাওয়ার জন্য তো তোমার দাদুকে বলিনি আমি।’

এই পর্যায়ে আমার চোখ ছাপিয়ে জল এলো। ধরা গলায় বললাম,

‘বাসা পেয়েছেন?’

তিনি মিনিট দুয়েক আমার টলমলে চোখের দিকে চেয়ে কি জেনো খুঁজলেন। এরপর ধীরগতিতে মাথা নাড়িয়ে বললেন,

‘না।’

আমার চোখের জল চোখেতেই গায়েব হলো। আমি ভেবে ফেললাম, সে এক পাও নড়তে পারবে না। তার যাওয়া আমি অবশ্যই ঠেকাবো। আমি তাকে এ পর্যন্ত একবারো জিজ্ঞেস করিনি কেনো তিনি চলে যেতে চান। কারণ উত্তরটা আমার জানা। সে নিশ্চয়ই উত্তর দিবে ‘তোমার জন্য’। আমি পা দুলিয়ে দুলিয়ে বললাম,

‘চা’য়ের টেস্ট ভালো। ধ্রুব ভাইয়াও ভালো চা বানাতে পারে। শুভ্র ভাইয়া আবার ওতো ভালো পারে না।’

বললাম ঠিক টেস্ট ভালো কিন্তু আদতে আমি চা মোটেও পছন্দ করি না। তারউপর সেটা যদি হয় রং চা..! শুদ্ধ মুখে কুলুপ এটে শূন্যে দৃষ্টি রেখে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আমি কি বলবো কি বলবো খুঁজে না পেয়ে শুভ্রভাই, ধ্রুব ভাইয়ের গল্প টেনে বসলাম আচম্বিতে।

‘জানেন, ওরা সবসময় একসাথে চলে, উঠে, বসে, খায়, একসাথে সব করে। কিন্তু… এতো কাছে থেকেও ওরা যেনো যোজন যোজন দূরের। ওদের মধ্যকার আচরণ ঠান্ডা। ওদের এরকম অদ্ভুত ব্যবহারের কারণ আমি বুঝতে পারি না। নাকি পিঠাপিঠি ভাইদের সম্পর্ক এরকমই থাকে?’

শুদ্ধ কোনো উত্তর দিলো না। একটা চাপা শ্বাস বাতাসে মেলে ধরে পকেটে হাত গুজলো। তরুকে বলতে ইচ্ছে করলো না, ‘ওদের সম্পর্কের এই দূরত্বের কারণ একমাত্র তুমি, তরু।’

শুদ্ধর থেকে উত্তর না পেয়ে আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। কেমন বিমর্ষ! কি এতো ভাবে সারাদিন? তারপর হুট করে প্রশ্ন করে বসলাম,

‘আপনার সেলারি কত?’

বাস্তবিক যে কাউকে হুট করে বেতন জিজ্ঞেস করলে সে অপ্রস্তুত হয়। কিন্তু শুদ্ধ অপ্রস্তুত হলো না বরং আয়েস করে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে চা’টা দেয়ালের উপর রেখে বললো,

‘৩০ হাজার টাকা।’

‘ওওও…।’

‘হুম। এই স্যালারিতে তোমার ফ্যামিলি আমার কাছে মেয়ে বিয়ে দিবে না, তরু। বৃথা স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা উচিত তোমার।’

‘আমি স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি। আপনি আমাকে নিবেন কিনা সেটা বলুন। আমার এই স্যালারিতে দিব্যি জীবন কেটে যাবে।’

বলতে বলতেই আমি তার আর আমার চায়ের কাপ উলোটপালোট করলাম। শুদ্ধ কয়েক সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের কাপটা আবার উলটে নিজের কাপ নিয়ে এক চুমুকে চা শেষ করলেন। আমি আশ্চর্য হলাম। মনে মনে গালিও দিলাম কিন্তু লজ্জা বোধ করলাম না। কারণ তার বেলায় আমি মহা নির্লজ্জ! অতঃপর তিনি আমাকে অতীব গভীর কণ্ঠে শুধালেন,

‘চুমুকে চুমুকে বিষ পাণ করার এতো প্রচেষ্টা কেনো তোমার?’

আমি মুচকি হাসলাম। উঁচু স্বরে ফিসফিসিয়ে উত্তর দিলাম,

‘কারণ আমার বেহায়া হৃদয় খারাপ প্রেমিকের বিষপান নামক অমৃতসুধা পানে চরম তৃষ্ণার্ত!’

‘মেয়ে, আমার কাছে এলে পরে অযত্নলব্ধ হয়ে রবে।’

‘প্রিয় যত্নের পুরুষের কাছে অযত্নের পাত্রী হতে আমি সহস্রবার রাজি।’

‘মনে রেখো, আমি তোমার বাবার চোখে চিলেকোঠার সেই বেয়ারা ছেলে।’

‘তাতে কি? আমার চোখে তো ‘স্বপ্নের পুরুষ!’

শুদ্ধ আর কোনো টু শব্দ না করে চলে গেলেন। চারিদিকে তখন সন্ধ্যে সন্ধ্যে ভাব। আমি ক্ষণে ক্ষণে নিঃশব্দে হেসে উঠছি। বহুদিন! বহুদিন পর মনে হচ্ছে আমরা বৈঠকে বসেছিলাম। যে বৈঠক শুদ্ধর প্রতিকূলে আর আমার অনুকূলে। আমি বুক ভরে শ্বাস নিলাম। নাহ! এই লোকটা কি কোনোদিনও আমার প্রেমে পরবে না?
আমি এই এখনকার সময়টাতে এসেও বুঝতে পারিনা তবে ওকথা তিনি আমাকে কেনো বলেছিলেন? কেনো বলেছিলেন আমি তার কাছে হেমন্তের মতো প্রিয়? সেই বাক্য বলার পরেই না আমার কিশোরী মন তার প্রতি ডুবে মরলো? দোষ কি তার নয়? আগ কি সে বাড়ায়নি? এখন কী সুন্দর আমাকে দোষী সাব্যস্ত করে সম্পূর্ণ’টা এড়িয়ে চলে যান! অসভ্য লোক!

চলবে

হেমন্তের নীড় পর্ব-৭+৮

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৭
১১.
শুভ্র ভাই হলেন লাউড এবং রুড। তার কোনো রাখঢাক নেই। তার মুখে যেটা আসবে সেটাই বলবেন। হাই ভোল্টেজের মেজাজের অধিকারী হওয়ায় বাড়ির বড়-ছোট সবাই একরকম তাকে কুর্নিশ করে চলে। তিনি খুবই পরিবারমুখী। তিনি চান তার পরিবার’টাকে সবসময় আগলে রাখতে। পারেন কি পারেন না সেই হিসেবে আমরা যাচ্ছি না। কিন্তু চেষ্টা তো করেন! যাই হোক আমার সমস্যা’টা এখানে না। আমার সমস্যা হলো আমার ব্যাপারে অন্য কারো যেকোনো হস্তক্ষেপ আমার একদম পছন্দ নয়। আমি আবার তার থেকে এক কদম লাউড বেশি কি না! এ সম্পর্কে বাড়িতে কড়া নোটিশ জারি করা রয়েছে তবুও শুভ্র ভাইয়ের এক ডিগ্রি বেশি মাতাব্বরি না করলে পেটের ভাত হজম হবে না।

আজ ড্রয়িংরুমেই আমি রাত ১০ টার দিকে শুভ্র ভাইকে পাকড়াও করে মেজাজ দেখিয়ে বললাম,

‘তোমার সমস্যা কি, শুভ্র ভাই?’

শুভ্র ভাই মাত্র কাজ থেকে ফিরলেন। তিনি তার সমস্যার কথা তো আমাকে অবগত করলেনই না বরং দিগুণ মেজাজে বললেন,

‘হু গেভ ইউ দ্য ডেয়ার? তুই কোন সাহসে আমার উপর মেজাজ দেখাস? এক থাপ্পরে সব দাঁত ফেলে দিবো।’

আমি থতমত খেয়ে বসলাম। বুঝতে পারলাম না কি করলাম। শুভ্র ভাইয়ার প্রশ্নে কি আর বলবো উল্টে আমার মন খারাপ হয়ে গেলো। বস্তুত, শুভ্র ভাই, ধ্রুব ভাই রুড হলেও কখনো কঠিন অভিব্যক্তি নিয়ে আমাকে বকেনি। শুভ্র ভাইয়ের চিৎকারে বড় জেঠি এসে আমায় আগলিয়ে নিলেন। ওই যে আমি এ বাড়ির খুব আদরে বাদর হয়ে যাওয়া মেয়ে! শুভ্র ভাই আর কোনো কথা না বলে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আকস্মিক ধমকে আমার কেবল একটু মন খারাপ, বেশি কিছু নয়। দাদুভাই লাঠিতে ঠুকঠুক আওয়াজ তুলে পাশের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসে আমার থুতনি ধরে নিচু মাথা উপর দিকে তুলতেই আমি ফিক করে হেসে দিলাম। দাদুভাই তবুও মুখ ভার করে জিজ্ঞাস করলেন,

‘মন খারাপ হয়েছে, দাদুভাই?’

আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম,

‘না দাদুভাই। দেখছো না আমি হাসছি। ওরা তো সবসময় বকে।’

‘না না। সব বকা এক হয় না। ওই বেটা কোথায় লুকালো? কোন সাহসে আমার দাদুভাইয়ের সাথে এমন আচরণ করলো?’

তৎক্ষণাৎ ঘর থেকে শুভ্র ভাই চিল্লিয়ে উত্তর দিলো,

‘শুভ্র লুকায় না। একজনকে স্যরি বলে দিয়ো, দাদুভাই। আর আমার কাছে এসেও যেনো তার বেয়াদবির জন্য এপোলোজাইস করে যায়।’

আমিও এখান থেকে উচ্চস্বরে গলা ফাটিয়ে বললাম,

‘মরে গেলেও না। দাদুভাই, বলে দাও আমার এই ব্যবহারের যথেষ্ট কারণ ছিলো। তার ওই দুর্ব্যবহারের যথাপোযুক্ত কারন দেখাতে না পারলে স্যরি ইজ নট এক্সেপ্টেবল।’

‘কি হয়েছে, বল?’

এখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটা। শুভ্র ভাইয়া নিশ্চয়ই মাথাটা ঠান্ডা করে এসেছেন। কিন্তু এই ভ্যাপসা গরমে আমার মাথা যথেষ্ট গরম আছে। আমি বারান্দার বেতের চেয়ারে দুই পা উঠিয়ে ফোনের নোটপ্যাডে শুদ্ধ’র ছবি এড করে তার আজকের সমস্ত কীর্তিকালাপ লিখছিলাম। প্রত্যেকদিনই করি। শুভ্র ভাই এলেন। বসলেন। আমি লেখা শেষ করে তারপর তার দিকে তাকালাম। তিনি ভ্রু কুচকে আমাকে বললেন,

‘তোর টাইপিং বেশি ইম্পোর্টেন্ড?’

‘হ্যাঁ।’

আমার বেপরোয়া উত্তরে শুভ্র ভাই কোনো উত্তর দিলো না। বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বারান্দার ফুল গাছ গুলো থেকে একটা অপরাজিতা ফুল ছিড়ে আরেকটা বেতের চেয়ারের উপর রাখলেন। আমি নাকের পাটাতন ফুলিয়ে চাইলাম,

‘ফুল ছিড়লে কেনো? কাল আমাকে তিন’টা ফুলের গাছ কিনে এনে দিবে।’

শুভ্র ভাই মৃদু হেসে মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা।’

এবার আমি আসল কথা পাতলাম, ‘তুমি এতো রুড কেনো, শুভ্র ভাই?’

শুভ্র ভাই ভ্রু নাচালেন। বললেন, ‘তোকে ডিস্টার্ব করেছে রুড না হয়ে উপায় আছে।’

শুভ্র ভাইয়ের কথায় আমি বিন্দুমাত্র অবাক হলাম না। এ আমার ধারণাতে ছিলো যে, শুভ্র ভাই এই দেড় ঘন্টা ঘরে বসে ইনভেস্টিগেশন করে বের করে ফেলেছে আমার রাগের কারন। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে উত্তর করলাম

‘মোটেও না। আমাকে সে ভালোবাসে, ডিস্টার্ব কখনোই করেনি। আমি তোমার কাছে এসে কখনো বিচার দেই নি।’

‘তুই না বললেই কি আমি জানবো না?’

‘তুমি ওর দুই গালে দুইটা করে চারটা থাপ্পড় মেরেছো। তোমার যে দানবের মতো হাত আর ওর ফর্সা গাল দুটোর আকর্ষণ ঘটে আমার উপর ব্লাস্ট হয়েছে।’

‘কেনো? ছেলেটা কি তোকে কিছু বলেছে?’

আমি চু শব্দ করে উঠলাম,

‘আহা! ছেলেটা হলো অতিভদ্র, আলাভোলা। এই বলদ চর খেয়ে আবার আমাকে জেরা করবে এই বুকের পাটা থাকলে তো পাল্টা চর একটা তুমিও খেয়ে আসতে। এমন একটা পেবা মার্কা ছেলেকে তুমি কি করে চারটে থাপ্পড় মারলে সেটাই ভাববার বিষয়। তোমার একটুও মায়া কাজ করলো না?’

‘না করলো না।’

‘ওর মা এসে আমাকে কত অপমান করেছে জানো?’

এই পর্যায়ে এসে শুভ্র ভাই সুর করে শিষ বাজিয়ে বিদ্রুপ করে বললো,

‘মাম্মা’স বয়! কীভাবে অপমান করলো তোকে?’

‘স্টপ বিহেভিং লাইক দ্যাট। যতটা না অপমানিত হয়েছি তার থেকে ছেলেটার জন্য আমার বেশি খারাপ লেগেছে। চর খেয়ে ছেলেটার ভয়ানক জ্বর!’

‘তাই নাকি? আমার হাতে তো ভালো জোর রে, তরু! আয়, একটা খেয়ে দেখ তো কত ডিগ্রি।’

আমি মুখ ভেঙিয়ে বললাম,

‘দানব একটা! ছেলেটার মা আমাকে বলেছে আমি নাকি ভাড়া করে গুন্ডা নিয়ে গিয়ে তার ছেলেকে পিটিয়ে গালের ছাল তুলে ফেলেছি। সে কর্তৃপক্ষকে বিচার দিবে। থানায় যাবে।’

শুভ্র ভাই পাত্তা না দিয়ে প্রাউড ফিল করে বললেন,

‘মরুক গিয়ে! বলিসনি ‘বেশ করেছি?’ তার ছেলে ওতো নাদান হলে আবার মেয়েদের প্রেমপত্র দেয় কীভাবে? আবার লিখে ‘প্রিয়তমা তরু, তুমি আমার প্রেমে না পরলে আমি রাস্তায় শুয়ে থাকবো। নাওয়া, খাওয়া, বাথরুম সব বাদ দিয়ে বসে থাকবো।’ মদনে বাথরুম পর্যন্ত লিখেছে। হোয়াট রাবিশ!’

আমি নিচুস্বরে বললাম,

‘ঠিকই তো লিখেছে। বাথরুমও মানুষের জীবনে আবশ্যক একটা বিষয়। তুমি বাথরুমে যাওয়া ছাড়া কয়দিন বাঁচবে?’

পরমুহূর্তেই আমি চেঁচিয়ে উঠলাম,

‘ওয়েট, হোয়াট? আমি না থাকলে তুমি আমার রুম সার্চ করো, শুভ্র ভাই?’

শুভ্র ভাই দু’কানে দু’হাত চেপে ধরে বললেন,

‘না জেনে আরেকবার চিল্লালে তোর চাপায় আর একটা দাঁতও খুঁজে পাওয়া যাবে না। চিঠি’টাকে আমি খুঁজিনি চিঠিটাই আমাকে খুঁজে নিয়েছে।’

আমাকে আর বলে দিতে হলো না চিঠিটা কীভাবে শুভ্র ভাইকে খুঁজে পেলো। চিঠির তো আর হাত পা নেই তাই না! শুভ্র ভাইয়ার ওয়ার্নিং কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে আমি একচোটে উঠে দাঁড়িয়ে আবারো চিল্লিয়ে উঠলাম,

‘স্নেহার বাচ্চা…..!’

স্নেহা আর আমি এক ঘরেই থাকি। কাজেই আমার ডাকে সে মাথা নিচু কিরে বারান্দায় এসে দাড়ালো। শুভ্র ভাই দাঁতে দাঁত চেপে আমার চুল টেনে ধরলো,

‘এই, তোকে আমি বলেছি স্নেহার নাম?’

আমি ব্যথা পেয়ে আরো জোরে চিল্লিয়ে উঠলাম,

‘আমাকে এসব বলে দিতে হয় না। আমি মুখ দেখলেই সব বুঝতে পারি।’

‘ওরে বাপরে! তা একটা টিয়া পাখি কিনে মাজারের সামনে বসে যা না! দুই চার টাকাও ইনকাম করতে পারবি।’

আমি মুখ টানা মেরে বললাম,

‘হুহ! আমার ক্লাস এতোটাও নিচু নয়। আমাকে একটা উটপাখি কিনে দাও। আমি উটপাখি নিয়ে বসবো।’

স্নেহা বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,

‘হিহিহি। তার থেকে শুভ্র ভাইয়া আর ধ্রুব ভাইয়া কে নিয়ে বসে যাও। একদিনে দুই চার লাখও কামাতে পারবে। যা ড্যাশিং আমার ভাইয়ারা।’

স্নেহার কথায় আমি বমির ভান করলাম সাথে হাত বাড়িয়ে ওর গালে একটা থাপ্পড় দিলাম। বললাম,

‘ডোন্ট শো ইউর ডার্টি টিথ। ক্লোজ ইউর মাউথ।’

স্নেহা থাপ্পড় খেয়ে ঠোঁট ফুলালো। ফলস্বরূপ শুভ্র ভাই আরো জোরে আমার চুল টেনে ধরলেন,

‘তুই আমার বোনের গালে চর মারলি কোন সাহসে?’

আমি ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে বলে উঠলাম,

‘যেই সাহসে তুমি আমার চুল টেনে ধরেছো। আমিও তো তোমার বোন। ওর বেলায় ভালোবাসা আর আমার বেলায় নো নাথিং? শুধু ধমক আর মাইর?’

‘না। তুই আমার বোন নস।’

এই বলে শুভ্র ভাই তার হাত হালকা করলেন। ছাড়া পেয়ে আমি একটানে চুল ছাড়িয়ে হাতখোপা করলাম। ছোট ছোট চুল ললাটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেপ্টে গেলো। শুভ্র ভাই খুব মনোযোগ নিয়ে আমার হাতখোপা করা দেখলেন। আমিও তার দিকে আগুন গরম চোখে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে আছি। তারপর কেবল-ই প্রশ্ন করতে যাবো, ‘তবে আমি তোমার কি?’ তার আগেই শুভ্র ভাই বলে উঠলেন,

‘তুই একটা শাকচুন্নি।’

আমি নাকের পাটাতন ফুলিয়ে ফেললাম,

‘আমি কারোর শাক চুরি করিনি।’

স্নেহা আবার পেত্নী মতো হিহিহি করে দাঁত কেলিয়ে উঠলো। আমি ওর দিকে কড়া চোখে তাকালাম। শুভ্র ভাই চলে যেতে যেতে বললেন,

‘এই চুন্নির কাজ শুধু মানুষের হৃদয় চুরি করা। নইলে ওমন আলাভোলা ছেলেটাও তোর প্রেমে মগ্ন হয়? দুনিয়াতে মেয়ের অভাব পরলো নাকি!’

চলবে

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৮
১২.
রৌদ্রময় সকাল! আমি বাবার সাথে দাঁড়িয়ে আছি বাড়ির বড় গেটে। আমার দাদুভাই এর মান্দাতা আমলের গাড়ি’টি হেচকি তুলতে তুলতে এগিয়ে আসছে। আমি খুব কষ্টে দাঁতে দাঁত চেপে বাবার পাশে লক্ষী বাচ্চার মতো দাঁড়িয়ে আছি। হেচকি তুলতে তুলতে আসা গাড়িটির নাম হলো ‘বুলেট’। আমার দাদুর বাবার জীবনদ্দশার গাড়ি এটি। বাপের স্মৃতি মনের বেদনার বেড়ায় ধরে রাখতে চাওয়ায় আর দাদুর একগুঁয়ে স্বভাব এবং ত্যাড়ামির জন্য বাড়ির কেউ আর নতুন গাড়ির নাম মুখ থেকে উচ্চারণ করতে পারলো না। গলা পর্যন্ত এসে তা মৃত হয়ে সবাই ক্লান্তচিত্তে যে যার মতো বাইক কিনে চলাফেরা শুরু করলো। এ নিয়ে আমার দাদুর কোনো আফসোস নেই। তিনি নিত্যদিন সাবান থেকে শুরু করে নিজের থুতু পর্যন্ত দিয়ে গাড়ি ঝকঝকে তকতকে করতে করতে সবাইকে মূর্খের দল বলে গালিগালাজ করেন।

মঈনুল আংকেল খুবই আন্তরিকতার সহিত বললেন,

‘আবদুল, মামনিকে নিয়ে উঠো।’

মঈনুল আংকেল এ বাড়ির কেয়ারটেকার, ড্রাইভার, মালি, দারোয়ান। এক কথায় একের ভেতর সব। বাবা সহ আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। কিন্তু দেখা গেলো আমাদের গলধঃকরন করতে না পেরে বুলেট দুই তিনবার হেচকি দিয়ে বন্ধ হয়ে গেলো। আমি এবার রাগে হন্য হয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম,

‘আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে, বাবা। এই নকশা’র সাথে তুমি অফিস যাও। আমি রিক্সা করে চলে গেলাম।’

মঈনুল আংকেল আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার সহিত বললেন,

‘মামনি রাগ করো না। গাড়িটা একটু ধাক্কা দিলেই দেখবে ঘোড়ার মতো দৌড়াচ্ছে।’

আমার রাগের পারদ আরো বেড়ে গেলো। বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম,

‘এখন কি আমি গিয়ে ধাক্কা দেবো?’

মঈনুল আংকেল আমাদের পরিবারের একজন। আমার বাপ-চাচার মতোই। তিনি অত্যধিক স্নেহের স্বরে কিছু বলার আগেই সেই স্থানে শুদ্ধ’র দেখা মিললো। ঠোঁট গোল করে শিস বাজাতে বাজাতে হাতে চাবির রিং ঘুরাতে ঘুরাতে তিনি চলছেন। আমি উনাকে দেখেই কি কারণে কে জানে একদম শান্ত হয়ে বসলাম। তখন কারণ না জানলেও এখন এসে বুঝতে পারছি আসলে শুদ্ধ’কে দেখে নয়, বাবা যে শুদ্ধকে একদম পছন্দ করতো না তাই আমি তাকে দেখে কেমন শান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার শান্ত হওয়ার মাঝেই বাবা শুদ্ধ’কে অদ্ভুত সম্বোধন করে বললেন,

‘এই, চিলেকোঠার বেয়ারা ছেলে। কাম হেয়ার।’

শুদ্ধ এগিয়ে এলেন। বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বললেন,

‘আসসালামু আলাইকুম, আংকেল। নিড এনি হেল্প? ধাক্কা দেবো?’

শুদ্ধর কথা আমার বাবার সম্ভবত পছন্দ হলো না। আরো পছন্দ হলো না ওর দাঁত কেলিয়ে হাসি’টা। আরে বেটা সালাম পর্যন্ত ঠিক আছে আগ বাড়িয়ে খুচিয়ে তোর এতো কথা বলতে হবে কেনো? এরজন্যই তোকে আমার বাপ দেখতে পারে না তুই বুঝিস না? তরুর মন উত্তর দিলো, ‘আরে এই বেটা তো এইসব ইচ্ছেকরে করে। মহাপাজি লোক।’ বাবা কপালে ভাঁজ ফেলে চুপচাপ নিজ স্থানে বসে রইলেন। আমি গরমে হাঁসফাস করে উঠলাম। মঈনুল আংকেল অতি আন্তরিকতার সহিত বললেন,

‘শুদ্ধ বাবা। একটু সাহায্য করো। তরু মামনির দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

আমার দেরি হচ্ছে কি হচ্ছে না তাতে শুদ্ধ’র যে কোনো মাথা ব্যথা নেই তা আমার শিরা উপশিরা পর্যন্ত জানে। কিন্তু বিধিবাম! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম এই ছেলে বুলেটের চেয়েও নকশাবাজ। সে চুইংগাম চিবোতে চিবোতে আমার বাবাকে আবারো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো,

‘আংকেল, হেল্প লাগবে? আসলেই লাগবে?’

কথার ভাষ্য দেখো! মনে হচ্ছে ইহজগৎ এ ওর সাহায্য ছাড়া সবাই থমকে থাকবে। আমার বাবা নাক ফুলালেন। আমি তা দেখে সিটের সাথে খিচে বসে রইলাম। আজ যে কি হবে তা আল্লাহ জানেন! বাবার উত্তর দেওয়া না দেখে শুদ্ধ আমার দিকে তাকিয়ে একদিকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন,

‘আংকেল আপনি এক থেকে পাঁচ গুণুন আর এই চিলেকোঠার বেয়ারা ছেলের শক্তি দেখুন। কীভাবে আপনাকে আর আপনার মেয়েকে নাড়িয়ে দেয়!’

বলেই নিজের মাসেল দেখিয়ে শুদ্ধ পেছনে চলে গেলো। আমার বাবার নাক ফুলে আগের চেয়ে তিনগুণ হলো। যেকোনো সময় ব্লাস্ট হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সত্যি সত্যি পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় গাড়ি স্টার্ট নিলো। মঈনুল আংকেল উইন্ডো দিয়ে মাথা বের করে শুদ্ধকে দুই আঙ্গুল দিয়ে হ্যাটস অফ দেখিয়ে গাড়ি টানলেন।

১৩.
আমার ক্লাস শেষ হলো সাড়ে বারোটায়। বের হয়ে এসে দেখি শুদ্ধ দাঁড়িয়ে। আমি অবাকতার শীর্ষে চলে গেলাম। বোয়াল মাছের মতো মুখটা হা হয়ে গেলো। চোয়াল ঝুলে পরার যোগাড়। শুদ্ধ আমাকে নিতে আমার ভার্সিটি এসেছে? দু’চোখ আমাকে এই দিনও দেখালো? আমি থমথম পায়ে আশ্চর্য নিয়ে তার চোখের সামনে হাজির হয়ে তাকেও আশ্চর্য করে দিয়ে বললাম,

‘ওহ মাই গড! আমি কি দেখছি এসব?’

শুদ্ধ ভ্রু কুচকালো। পাত্তাহীন গলায় বললো,

‘কি দেখছো?’

‘আপনি আমাকে নিতে এসেছেন?’

আমার কথা শুনে শুদ্ধ যেনো আমার থেকে আরো চারগুণ বিস্মিত হলো। দুই গালে হাত রেখে অবাকতার ভঙ্গি করে বললো,

‘ওহ মাই গড! ওহ মাই গড! এভাবে তো ভেবে দেখিনি।’

পরক্ষণেই ধমক দিয়ে বললো,

‘তোমার কি মনে হয় আমার আর কাজ নেই? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরি? রোদ মাথায় নিয়ে এখানে তোমাকে নিতে এসেছি?’

অপমানে আর মন চুরমারের শব্দে আমার মুখটা চুপসে গেলো। আমি ঠোঁট উল্টে বললাম, ‘তাহলে কেনো এসেছেন?’

‘তোমাকে বলতে হবে?’

‘না বললে বুঝবো আমাকে নিতেই এসেছেন। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আই ডোন্ট মাইন্ড! আমার আবার একটু লজ্জা সরম কম।’

এই বলেই আমি তার বাইকের পেছনে চরে বসে তার কাধে হাত রাখলাম। সে সেকেন্ড দশেক সময় নিলো বিষয়টা বুঝতে। এরপর তার কাধ থেকে আমার হাত ঝারি দিয়ে ফেলে ধমকে ধমকে আমার কানের বারোটা বাজিয়ে দিলো,

‘এই ফাজিল মেয়ে। নামো তাড়াতাড়ি। তোমার বাবা নিজের মেয়ে রেখে আমাকে বেয়ারা ছেলে ডাকে কোন আক্কেলে? আজই গিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করবে। আর বলবে এখন থেকে যেনো তোমাকে নির্লজ্জ ডাকে।’

আমি কানের ভেতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে দুই সেকেন্ড খুচানোর ভান করে হাসিমুখে বললাম,

‘বাবার হয়ে আপনি ডাকুন। আমি কিছুই মনে করবো না।’

উনি দিলেন আমাকে আরেক রাম ধমক,

‘এই মূহুর্তে নামবে তুমি। জলদি। নাহলে একটা আছাড় দেবো। আমি এক থেকে তিন গুনবো। এক……. দুই……….

‘নামছি নামছি। অভদ্র মানুষ একটা!’

‘আমি অভদ্র? নাকি বলা নেই কয়া নেই হুট করে অন্যের বাইক চেপে বসা তুমি অভদ্র?’

‘অন্যের বাইকে তো বসিনি। আমি আপনার বাইকে বসেছি।’

আমার কথার মাঝেই একজন এসে শুদ্ধকে প্রায় হাজার পনেরো টাকা দিয়ে গেলো। টাকা গুণে মানিব্যাগে রেখে শুদ্ধ বললো,

‘একজনের কাছে ধার পাই। সেই টাকা নিতে এসেছিলাম। মাসের এক তারিখ হতে না হতেই তো তোমার দাদু আবার ভাড়া ভাড়া করে আমার মগজ চিবিয়ে খাবে। আজব এক বাড়িতে উঠেছি। রাতদিন বুড়ো থেকে ছুরি সবাই আমার মগজ চিবিয়ে খাচ্ছে। আমার মগজের যে কতই টেস্ট…! উফফ!’

উনার কথায় আমি মুখ টানা মারলাম। শুদ্ধকে পছন্দ করে না বলেই তো দাদু মাসের এক তারিখ হতে না হতেই ভাড়া নিয়ে ক্যাচাল শুরু করে। পাঁচ তারিখে মধ্যে ভাড়া দেওয়া শুদ্ধর জন্য ফরজ। আমি মুখ ফুলিয়ে বললাম,

‘যেই কাজেই আসুন। তাই বলে আপনি এই রাস্তায় আমাকে ধমকে আপনার বাইক থেকে নামিয়ে দেবেন? আমি বসলে কি আপনার গাড়িতে ফোসকা পরবে?’

‘অবশ্যই।’

‘আমি আজ বুঝতে পারছি কেনো আমার বাবা আপনাকে পছন্দ করে না। আপনার কথার ধরনের যে ছিরি!’

‘শুনো মেয়ে, তোমার বাবার পছন্দে অপছন্দে আমার কোনো যায় আসে না।’

‘কিন্তু আমার আসে।’

শুদ্ধ সেকেন্ড কতক থামলো। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কয়েকবার ব্যর্থ শ্বাস ফেলে মলিন স্থির কণ্ঠে বললো,

‘সুরম্য মসৃণ মেঠোপথের ক্ষেত্রপতি তুমি। দূর্গম কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দেওয়ায় কেনো এতো পক্ষপাত তোমার?’

আমি তার প্রশ্নের উত্তর দেবো তার আগেই হাওয়ায় ভেসে এলো ধ্রুব ভাইয়ের কণ্ঠস্বর,

‘তরু…। এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস?’

বলে ধ্রুব ভাই নিজের বাইক ছেড়ে নেমে আমার পাশে এসে দাড়ালো। জোরপূর্বক হেসে শুদ্ধর সাথে হ্যান্ডশেক করে বললো,

‘ভাইয়ের এখানে কি কাজ?’

‘এইতো তেমন কিছুনা। একজনের থেকে টাকা পেতাম সেটাই নিতে এসেছিলাম।’

‘ওহ আচ্ছা।’

ধ্রুব ভাই আড়চোখে একবার আমার দিকে তাকিয়ে খপ করে আমার হাতটা ধরলো। আমি চমকে উঠলাম। ধ্রুব ভাইয়ের বোধ হয় এই একটাই কাজ। হাত মুচড়ে ছাড়াতে গেলেই ধ্রুব ভাই ব্যস্ততার সহিত বললেন,

‘আসি তাহলে।’

বলে আমাকে টানতে টানতে বাইকে উঠালেন। অদূরে শুদ্ধ মৃদু হাসলো। বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বিরবির করলো,

‘তোমার অপেক্ষায় তারা অথচ তুমি চেয়ে দেখো না। কাঠবেলী, আমার পেছন ঘুরো না।’

চলবে

হেমন্তের নীড় পর্ব-০৬

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-০৬
৯.
শুদ্ধ বেশিরভাগ সময় বাইরে পাঞ্জাবি পরে। তার মুখে ঘন একটু বড় বড় দাড়ি। আমার দাদু এবং বাবা কেউই তার এই গেট আপ পছন্দ করেন না। বাবা তাকে দেখলেই রাগে জ্বলে উঠেন এবং বলেন, ‘দেখো, মুখে কেমন জংলীদের মতো দাড়ি রেখেছে। কোনো ছাটাই বাছাই নেই।’ অথচ ওদের কে বোঝাবে এই গেট আপেই তাদের মেয়ে ওই জংলীর প্রেমে পরেছে। ওই দাড়িতে তাকে জংলী নয়…. বরং ভীষণ আলাদা রকমের সুদর্শন এবং আকর্ষনীয় দেখায়। তার সৌন্দর্যতার অনুপাত যেকোনো তুর্কি, তামিল নায়কদের হারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু আমার মূর্খ বাপ-দাদা তা বোঝে না। যাইহোক সেই দুঃখের কালো স্রোতের প্রতিমুখে আরো একটি স্রোতের ধারা রয়েছে। যার রং একদমই কালো নয় বরং সাদা। আমার জন্মদাত্রী শুদ্ধ’কে বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ করেন।

শুদ্ধকে পছন্দ-অপন্দের উল্লেখিত ব্যাক্তিবর্গ ছাড়া বাড়ির বাকি সদস্য নিউট্রাল। তারা শুদ্ধকে অপছন্দও করেন না আবার অতিভক্তিও করেন না। দেখা হলে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করেন। সে বাদ যাক আমার মায়ের শুদ্ধ’কে পছন্দ করার অন্যতম একটি কারণ হলো শুদ্ধ তাকে সবসময় সালাম দেন। দিনে যদি ৬০ বার শুদ্ধ’র সাথে দেখা হয় তিনি সালাম দিবেন। একবার কথার শুরুতে, আরেকবার কথার শেষে৷ এছাড়াও আরো কারণ রয়েছে যা আমার জানা নেই।হয়তো মায়ায়! শুদ্ধর চেহারাটাই তো একটা মায়ার গোডাউন। সে যাই হোক বলতে গেলে, আমার মা শুদ্ধের প্রতি অন্ধভক্ত। প্রতিদিন একবার শুদ্ধের খোঁজ-খবর নেওয়া তার জন্য বাঞ্ছনীয়।

আমার মাতৃদেবীর কাছে আমার আরাম আবার বড্ড অপ্রিয়। তো যথারীতি শ্রাবণের এই মাঝ দুপুরে আমার আরামকে হারাম করে মাতা মহোদয় আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি গড়িমসি করে আড়মোড়া ভেঙে যেতে যেতে ১০ মিনিট লেট করলাম। মায়ের পেছনে যাওয়ার সাথে সাথে তিনি ঘুরে আমার দিকে এমন একটা লুক দিলেন যেনো আমি তার খাবারে লবণ বেশি দিয়েছি।

‘বলো?’

‘বাটি’টা শুদ্ধর কাছে দিয়ে আয়। শুদ্ধর গলা ব্যাথা। ঠান্ডা লেগেছে। কোনো কিছুই নাকি খেতে ইচ্ছে করছে না তাই রান্না করেনি।’

আমি বাটির ঢাকনা তুলে দেখলাম ভেতরে শুটকি ভর্তা, আলু ভর্তা আর পেয়াজ, রসুন, শুকনা মরিচ মিশিয়ে একটা ভর্তা। লেবু দিয়ে চটকে খেতে কি যে মজা লাগবে! আমি ঠোঁট উল্টে জননীকে বললাম,

‘ভর্তা খাবে শুধু? ভাত দিয়েছো কই?’

‘ও কেমন জানিস না? এই ভর্তাই গ্রহণ করবে কি না দেখ!’

আমি রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এক ছুটে ছাদে চলে এলাম। ইশশ… খুব দেরি করে ফেলেছি। এরজন্যই বলে মায়ের এক ডাকে ছুটে আসতে। মায়ের ডাককে অবজ্ঞা করে ১০ মিনিট দেরি না করলে তো আরো দশ মিনিট আগে শুদ্ধকে দেখতে পারতাম। চিলেকোঠার ঘরে টোকা দেওয়ার ৫-৭ মিনিট পর শুদ্ধ বেরিয়ে এলেন নাক মুছতে মুছতে। আমি ভ্রু কুচকে শুধালাম,

‘আপনি কি নক করার সাথে সাথে দরজা খুলতে পারেন না?’

শুদ্ধর গলায় মাফলার প্যাঁচানো। ভারী এবং ভাঙা স্বরে তিনি জবাব দিলেন, ‘না, পারি না।’

‘হ্যাঁ, আপনি তো আবার কিছুই পারেন না। ধরুন।’

‘কি?’

‘খাবার। আম্মু পাঠালো।’

শুদ্ধ ভ্রু কুটি করে আমার দিকে মিনিট পাঁচেক তাকিয়ে থেকে যে উত্তর করলেন তা শুনলে আমার দুঃখে পাঠকদের মরে যেতে ইচ্ছে করবে।

‘তুমি কি যাবে নাকি আমি তোমার মুখের উপর দরজা বন্ধ করবো, তরু?’

যথাক্রমে আমারও হাসিহাসি মুখটা ফাঁটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো।

‘এমন করেন কেনো? আম্মু কত শখ করে পাঠালো!আমি কত শখ করে এই ছাদে বয়ে আনলাম। আর আপনার কি ব্যবহার! আপনার ব্যবহার দেখলে আমার বমি আসে।’

‘তো করো কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে। আমার ঘরের সামনে করলে তোমাকে দিয়েই পরিষ্কার করাবো।’

‘আপনি এতো পাষাণ কেনো?’

‘আর তুমি এতো বোকা কেনো?’

‘সে তো আমি জন্ম থেকেই।’

অসুস্থ শুদ্ধ অল্পতেই আজ হতাশ হলেন। ক্লান্ত শ্বাস ফেলে বললেন,

‘আমার ঘরে চাল, ডাল, মশলা সব আছে। পারলে রান্না করে দিয়ে যাও।’

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়লাম। চোয়াল আমার ঝুলে পরলো। অবাক নয়নে মিনিট দশেক শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে থেকে তাকে হতভম্ব করে দিয়ে আমি এক দৌড়ে নিচে চলে আসলাম। আমি নিশ্চিত সে মনে মনে আমাকে ‘তারছিড়া বলদ’ ডাকলো। তাতে আমার কিছু যায় আসে না। এসব শুনে আমি অভ্যস্ত। মায়ের কাছে বাটি’টা ধরিয়ে আমি আমার রুমে আসলাম। মুখে পাউডার মাখলাম, ঠোঁটে হালকা করে লিপস্টিক দিলাম। কি ভেবে যেনো একটা হলুদ শাড়িও পড়লাম। এতো রং রেখে হলুদ শাড়ি পরার অর্থ কি বলুন তো?আমি জানি পাঠকগণ বলতে পারবেন না। ওই যে বলেছিলাম, শুদ্ধ সবসময় সাদা লুঙ্গি, সাদা গেঞ্জি পরে হলুদের বর সেজে বসে থাকে তাই আমিও আজ একটু হলুদের কনে সাজলাম।

আমি আবার শাড়ি পড়তে এক্সপার্ট। এক মিনিটে শাড়ি পরে দু মিনিটে ফুল রেডি হয়ে উৎফুল্ল মনে চিলেকোঠায় গেলাম, দরজা খোলা ছিলো বিধায় ঢুকে পরলাম। শুদ্ধ তখন গোসলে ঢুকেছে। এই মূহুর্তে এসে আমি লজ্জায় লাল-নীল হয়ে মুখের উপর হাত দিলাম। ইশশ.. শুদ্ধ যখন এসে দেখবে তার জন্য আমি শাড়ি পরেছি তখন কি ভাববে? আমার লজ্জার মাঝেই শুদ্ধ বেরিয়ে এলো। কিন্তু সে আজ লুঙ্গি পরেনি। পরেছে একটা সাদা টাউজার আর কালো রঙের গেঞ্জি। তাকে দেখেই আমার ঠোঁট’টা আপনা আপনি উলটে গেলো। এটা কি হলো? তার জন্য আমি গায়ে হলুদের কনে সাজলাম আর সে আজ বর সাজলো না? আল্লাহর ৩৬৫ দিন সে বর সেজে বসে থাকে। আর আজ তার এই গেটাপ কি মানা যায়?

শুদ্ধ আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন মিনিট খানিক। আমি লজ্জায় আরো কুকরে গেলাম। যখন লজ্জার, সরমের সর্বোচ্চ সীমানায় তখন এক বাজখাঁই ধমকে আমার কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়।

‘এই মেয়ে, শাড়ি পড়ে এসেছো কেনো? তোমার বিয়ে হচ্ছে এখানে? এক্ষুণি যাও চেঞ্জ করে এসো। শাড়ি পরে তুমি আমার বাসায় রান্না করতে পারবে না। নো। নেভার।’

তার সাফ সাফ বক্তব্য। আমার মন’টা ভেঙে খানখান করে দিলো একবারে। আমি জানি পৃথিবী উল্টে গেলেও এই বক্তব্যের কোনো পরিবর্তন হবে না।

আমি ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কষ্টের সাগরে সাতার কাটতে কাটতে নিজঘরে এলাম। আয়নার সামনে দাড়ালাম। বাহ! কী সুন্দর লাগছে আমাকে। যে মেয়েকে ঠোঁটে সামান্য লিপস্টিক দিলেই পরীর মতো লাগে, সে-ই তো অপ্সরা। কিন্তু এতো সুন্দর হয়েই বা কি লাভ? অপরপক্ষের মন তো একটা পাথর। আমি রাগে দুঃখে ঠোঁটের লিপস্টিক এক ঘষায় মুছে ফেললাম। এরপর আয়নার সাথে হেলান দিয়ে জানালা গলিয়ে আকাশের দিকে চাইলাম। চেয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম,

‘আরে, ও তো একটু ওরকমই। ওর কথা গায়ে মেখেছি কবে আমি?’

আমি আবার স্ট্রং হয়ে দাড়ালাম। ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া মনটাকে ফেবিকল দিয়ে জোড়া লাগিয়ে আমি শাড়ি খুলে নাচতে নাচতে অনেক খুঁজে একটা হলুদ রঙের জামা পরলাম। তবুও আমি গায়ে হলুদের কনে সেজেই ছাড়লাম। আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে আবার ঠোঁটে লিপস্টিক মাখলাম৷ ঠোঁট চোখা করে নিজেকে পরপর দুটো চুমু দিলাম। নিজের মনের সাথে আলাপ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম,

‘আরে, পাছে লোক এ কিছু বলে। কিন্তু শুদ্ধ তো আমার পাছে লোক নয়। উনি তো আমার হৃদয়ের লোক। হৃদয়ের লোকের জন্য তো আরো সাত খুন মাফ।’

আমার উড়নার এক কোণা নাড়িয়ে নাচতে নাচতে আসার পথে বাধ সাধলেন আম্মু। আমি ব্রেক কষলাম। আম্মু বললেন,

‘কোথায় যাচ্ছেন? আপনার ব্রাঞ্চ’টা কখন করবেন একটু শুনি?’

‘তোমার শুদ্ধ তো খাবার নিলো না। উল্টে আমাকে বললো পারলে রান্না করে দিয়ে যেতে। তাই যাচ্ছিলাম আর কি!’

‘ওহ।’

আম্মুর কপালে হালকা ভাঁজ। আমি চোরা গলায় বললাম,

‘নাকি তুমি যাবে রান্না করে দিতে?’

আম্মু কপালে ভাঁজ বজায় রেখে কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন,

‘না, তুই যা। তোর আব্বু এসে পরবে। আমার এদিকে কাজ পরে আছে। আর আমি গেলে শুদ্ধ লজ্জা পাবে। আমাকে রান্না করতে দিবে না।’

আমি খুশি হয়ে উঠলাম। বড় করে শ্বাস নিয়ে বললাম,

‘ঠিকাছে, আমি যাই দেরি হয়ে যাচ্ছে।’

‘যা। আচ্ছা শোন।’

আম্মুর ডাকে পেছন ফিরলাম, ‘হ্যাঁ, বলো।’

‘স্নেহাকে নিয়ে যা।’

এ হলো আরেক মুসিবত! কি দরকার ছিলো? আমার হাসি-হাসি মুখটা বিলীন হয়ে গেলো। আমি ঠোঁট ফুলিয়ে তাকালাম। আমাকে থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আম্মুই স্নেহাকে ডেকে বললো,

‘স্নেহা…. এই স্নেহা বই খাতা নিয়ে শুদ্ধর কাছে পড়তে যা।’

স্নেহা যাবে না বলে গড়িমসি করলেও আম্মুর ধমকের তোপে তা আর কুলালো না। অগ্যতা যেতেই হলো।

১০.
শুদ্ধ আমাকে দরজায় দাড় করিয়ে রেখেছে। আমি বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে বললাম,

‘সমস্যা কি আপনার? স্নেহাকে ডুকতে দিলেন আমাকে ডুকতে দিচ্ছেন না কেনো?’

শুদ্ধ গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা থেকে সরে দাড়ালেন। আস্তে আস্তে বললেন,

‘আমার মাথায় কোনো মামদো ভূত চেপেছিলো বলেই আমি তোমাকে রান্না করতে বলেছিলাম।’

‘বেশি কথা না বলে লবন গরম পানি দিয়ে গার্গল করুন।’

কথাটা বলেই আমি রান্না ঘর দেখে এসে হাত খোপা করতে করতে বললাম,

‘কি খাবেন?’

‘আমার মাথা।’

‘এটা আমি বানাতে পারি না। অন্য কিছু বলুন।’

‘শুটকি ভর্তা করো।’

‘সাথে আলু ভর্তা করে দেই?’

‘করো।’

‘বেগুন ভাজি খাবেন? আর একটু ডাল?’

এই পর্যায়ে এসে শুদ্ধ নাক ফুলিয়ে আমার দিকে তাকালেন। গর্জে উঠে বললেন,

‘তোমাকে এক ঘন্টা সময় দিলাম। এর মধ্যে যা রান্না করবে আমি তাই খাবো। পুরো দুনিয়া রান্না করলে আমি দুনিয়াই খাবো।’

‘যাহ! আমি তো ওতো রান্না পারি না। পুরো দুনিয়ায় কত রকম রান্না আছে আপনি জানেন? ইটালিয়ান, ইন্ডিয়ান, চাইনিজ, জাপানিজ, মেক্সিকো, কোরিয়ান…

বাকিটুকু আর বলতে পারলাম না তার আগেই শুদ্ধর ঘরের মেঝে’টা যেনো কেঁপে উঠলো ওর গর্জনে,

‘আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করবে, তরু?’

আমি চুপ করলাম। ওতো সুন্দর করে তরু বলে ডাকলো। চুপ না করে আর উপায় কি। রান্নাঘরে গিয়ে ক্রস করে উড়না নিয়ে গিট্টু দিয়ে নিজের কাজ শুরু করলাম। আগে চুলায় ভাত বসালাম। আরেক চুলায় আলু সিদ্ধ দিয়ে পেঁয়াজ, মরিচ কাটতে বসলাম। হঠাৎ পেছনে তাকিয়ে দেখি শুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে। আমি গায়ের উড়না ঠিক করে বললাম,

‘কি হয়েছে?’

শুদ্ধ তখনো এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। একটু পর ধীর পায়ে আমার কাছে আসলেন। আমি পেছন দিকে ঝুঁকে গেলাম। তিনি ধীর কণ্ঠে বললেন,

‘তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে জানো, তরু?’

কপালে পরে থাকা এলো চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে শুধালাম, ‘কেমন?’

‘অলকানন্দার মতোন।’

তার ওইটুকুন প্রশংসা’তে মনে হলো আমার দম বন্ধ হয়ে আসবে। আমি শ্বাসটুকু নিতে ভুলে গেলাম। প্রিয়র প্রশংসা এতো স্পর্শনীয় কেনো? শুদ্ধ তার গলার স্বর আরো নিচুতে নামিয়ে আমার কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,

‘শুনো কাঠবেলী, আমার প্রেমে পরা বারন তোমার।’

আমি তার কথায় চোখ তুলে তাকালাম। মিষ্টি করে হেসে তার মতো ফিসফিস করে উত্তর দিলাম,

‘নিষিদ্ধতে আমার প্রবল ঝোঁক।’

‘আমি প্রেমিক হিসেবে মানুষ’টা বড্ড খারাপ।’

‘আপনি নামক এই খারাপ প্রেমিক মানুষ’টা আমার বড্ড প্রিয়!’

‘এতো প্রিয় ভালো নয় মেয়ে, আমাকে পাওয়ার আশা করলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই জুটবে না কপালে।’

বলেই শুদ্ধ আমার পেছনে হাত বাড়িয়ে পানির বোতলটা নিয়ে চলে গেলো সাথে সত্যি সত্যি আমাকে দিয়ে গেলো এক বুক দীর্ঘশ্বাস। তার বুকে আমি মাথা পাতিনি। তার গায়ের সাথে আমার গা স্পর্শ করেনি। তবুও তার ওই একটুখানি কাছে আসাতে মনে হলো আমার সারা গায়ে তার সুবাস। রন্ধ্রে রন্ধ্রে বরফ শীতল স্রোতের ধারা বয়ে গেলো। কিন্তু আমার বুকের ভেতর’টা এমন করছে কেনো? কেনো বাজছে ওমন করুণ সুর? কেনো আমার চিৎকার করে কান্না পাচ্ছে? কেনো মনে হচ্ছে আকাশে ঘন কালো মেঘ আর আমার হৃদয়ে রাক্ষুসে বিদ্যুৎ এর ঝিলিক? হৃদপিণ্ড’টা খামচে ধরছে যেনো। আমি আমার বুকের বা’পাশে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে বার কয়েক জোরে করে শ্বাস নিজের মাঝে টেনে নিলাম। তবুও মনে হলো নিঃশ্বাসের সাথে প্রেমোদক নয় বরং প্রেমবিষ পান করলাম।

চলবে

হেমন্তের নীড় পর্ব-৪+৫

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-০৪
৭.
তাবদাহের তীব্রতায় ২০২৪ সালের জুলাইয়ের এক জ্যোৎস্নার রাতে তরু বিমর্ষ ভঙ্গিমায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো। সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল-কলেজ বন্ধ ঘোষণা। ‘ছাত্রদের নিরাপত্তার জন্য এই কর্মসূচির উদ্যোগ’ এ বাণী সরকার জানালেও আসলে যে কীসের উদ্যোগ তা আমরা ভালোভাবেই বুঝতে পারি। দেশে নেট কানেকশন অফ আটদিন যাবৎ। শুনেছি, নিহতের সংখ্যা ছাড়াবে হাজারের ঘর। আহত প্রায় চল্লিশ হাজারের উপরে।

আমার মনে তখন নব্য প্রেমের ক্ষুধা। তাকে বারবার দেখতে চাওয়ার তৃষ্ণা। আমি তখনো বুঝিনি তাকে আমি ভালোবাসি। বুঝলাম সেদিনই,

ছাদে গিয়ে দেখে এলাম রাত ১১ টা বাজে তবুও তিনি তার চিলেকোঠায় ফিরেননি। অথচ রাত ৯ টার মধ্যে বাড়ি ফেরা তার অভ্যাস। দেশের এমন পরিস্থিতিতে তার এতো রাত পর্যন্ত বাইরে থাকা মোটেও ভালো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। আগেও বলেছি আমি খুব শান্ত মেয়ে। সব ঘটনা আমি প্রতিক্রিয়াহীন হ্যান্ডেল করতে পারি। কোনোকিছুর নেগেটিভিটি সহজে আমার মনে স্থান দেই না। কাজেই আমি স্থির হয়ে বারান্দায় বসে গেটের দিকে তাকিয়ে তার আসার অপেক্ষায় রইলাম।

রাত ২ টার দিকে সে ফিরলো। আমি অন্ধকারে দেখলাম দুই তিন জন ছেলে তাকে ধরে নামিয়ে দিয়ে গেলো। ভ্রু কুচকে সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বোঝার চেষ্টা করলাম। যেই দেখলাম সে ধীর-স্থির পায়ে পিঠ বাঁকিয়ে খুব কষ্টে হেটে আসছে অমনি দৌড়ে নিচে চলে আসলাম। আমার বড় জেঠু আজমল রহিম অর্থাৎ শুভ্র ভাইয়ার বাবা খুব রাত করে হাসপাতাল থেকে ফিরেন। তিনি ঘুমোতে যানও দেরি করেই। সেদিন ভাগ্য সহায় ছিলো, রাত দুইটার সময়ও জেঠু জেগে ছিলেন। সোফায় বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলেন। আমি গিয়ে ধীর কণ্ঠে বললাম,

‘বড় জেঠু। একটু চিলেকোঠায় চলো।’

বলে রাখা ভালো আমার জেঠুর খুব পছন্দের ছেলে হলেন শুদ্ধ এবং এতো পছন্দের কারনটাও বলছি। জেঠু আমার দিকে ভ্রু কুচকে বললেন,

‘এতো রাতে ওই ছেলের কাছে কি?’

‘উঠো আগে, এতো কথা না বলে।’

জেঠু উঠলেন। জেঠুকে ম্যানেজ করে বাইরে নিয়ে এসে দেখি বাইরের সিড়ির সামনে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছেন শুদ্ধ। রক্তাক্ত শার্ট। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করা। জেঠু হালকা চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,

‘ওহ মাই গড। ইউ আর ব্লিডিং।’

শুদ্ধ চমকে গেলেন না। অসহ্য ব্যথায় তার দিন দুনিয়ার কোনো হুশ ছিলো না। তবে এই অসময়ে আমাদের উপস্থিতি যে তিনি আশা করেননি তা তার চোখ মুখ দেখে বোঝা গেলো। জেঠু গিয়ে শুদ্ধর এক হাত কাধে তুলে নিলেন আর গলার স্বরের উচ্চতার সতর্কতা বজায় রেখে বললেন,

‘ধর ধর তরু। ছেলেটা শরীরের ভর ছেড়ে দিচ্ছে। পরে যাবে।’

আমি তৎক্ষণাৎ ধরলাম। সিড়ি বেয়ে চিলেকোঠায় নিয়ে গিয়ে তার গায়ের শার্ট খুলে জেঠু তৎক্ষণাৎ আবার নিচে নেমে এলেন তার ডাক্তারি জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য। আমাকে বলে গেলেন একটা ভেজা কাপড় দিয়ে শরীরের ক্ষত স্থান ব্যতীত লেগে থাকা রক্ত গুলো মুছিয়ে দিতে। আমি বাইরে নিজেকে দেখাচ্ছি নদীর মতো শান্ত কিন্তু আমার হাত পায়ে অবিরাম কাঁপন। শুদ্ধ বললেন,

‘তুমি বারান্দায় বসেছিলে, তরু?’

আমি উত্তর দিলাম না। তার পিঠ মুছে দিতে গিয়ে দেখলাম পিঠের অবস্থা বেহাল। মারের দাগে একটুখানি জায়গা ফাঁকা নেই। তা দেখে এতোক্ষণে আমার চোখ টলমল হয়ে এলো। সেভলন দিয়ে মারের চোটে ফেটে যাওয়া জায়গাগুলো পরিষ্কার করে দিতে লাগলাম। শুদ্ধ বুঝে আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন,

‘ভয় পেয়ো না। একটুখানি পিটানি খেয়েছি। ব্যথা পাইনি। রক্ত কিন্তু আমার না রক্ত আমার এক বন্ধুর। জানো, আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার বন্ধু গুলি খেয়েছে। মনে হয় বাঁচবে না, তরু।’

তার তরু বলে ডাকটা এতো করুন শোনা গেলো আমার কানে যা আমি বলে বোঝাতে পারছি না। কাজেই নিজের করুণতা ঢাকতে আমি মাথা নিচু করে কাজ করে গেলাম। এটা নাকি একটুখানি? তার নাকি ব্যথা লাগেনি! সে অনবরত আরো কিছু কপট মিথ্যা বলে গেলো অথচ আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি তার কাধের ক্ষত থেকে রক্ত ঝরছে। ওই ক্ষত বিক্ষত শরীরটা দেখে আমার শক্ত করে ধরে রাখা হৃদয়ের শেষ রক্ষা আর হলো না। চোখ থেকে পানি নিঃশব্দে টুপ করে তার পিঠের উপর পরলো। শুদ্ধ টের পেলেন না। আমি নিজেকে সামলে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,

‘আন্দোলনে গিয়েছিলেন, না?’

‘হ্যাঁ। কুকুরদের অতর্কিত হামলায় পরলাম, বুঝলে? এ কয়েকদিন তক্কেতক্কে থেকে আজ ঝোপ বুঝে কোপ মারলো আমার উপর। তারউপর কাল ওদের এক লিডারকে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছি কি না! হলগুলোর সামনে ককটেল ফেলছে, গুলি করছে। প্রশাসন তাকিয়ে দেখছে।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুধালাম,

‘আপনি কি একটু শুবেন?’

বলতে বলতেই জেঠু চলে এলেন। ড্রেসিং করতে করতে তিনি প্রশ্ন করলেন,

‘বাংলার বাঘ তোমরাই। চালিয়ে যাও বাংলার রণসূর্য’রা।’

শুদ্ধ মাথা দুলিয়ে বললো,

‘চালাতে আর পারছি কই। নেট কানেকশন সব অফ। 4g কানেকশন অফ। কারফিউ জারি। সাধারণ জনগণের চরম ভোগান্তি।’

‘এই গোটা একটা দেশের সাধারণ জনগণের ছেলে-পেলেদের জন্যই তোমরা মার খাচ্ছো, প্রাণ দিচ্ছো। প্রাউড ফিল কর গিল্টি নয়। মানুষ তোমাদের পাশে আছে। তোমার বাবা -মা জানে তোমার এই অবস্থা?’

‘জি না। শুধু আন্দোলনে যাই এটুকুই জানে।’

‘পিছু হটতে বলে না?’

‘কখনো না। বললেও পিছু হটবো কেনো? বাঁচলে সিংহের মতো বাঁচবো। আমি মাকে বললাম, ভয় পাও কেনো? আমি মরলে তুমি হবে শহিদের মা। তুমি হবে গর্বিত মা। বাবা বললেন, ভয় পাবা না। বাংলার দামাল ছেলে তো তোমরাই। ক্যাম্পাস উড়ে যাক, হল উড়ে যাক, বৃহদাংশ দেহ মাটিতে লুটিয়ে যাক। তবু গুটি কয়েক একজোট হয়েই লড়ে যাও।’

শুদ্ধ আরো বলে গেলেন, ‘ওই যে একদম ছোট বেলায় কাজী নজরুল ইসলাম এর লেখা ‘আমি হব’ কবিতায় পড়েছিলাম না, আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে? তোমার ছেলে উঠলে গো মা রাত পোহাবে তবে।’

জেঠু শুদ্ধর বাহুতে চাপর মেরে বললেন,

‘বাঘের বাচ্চা। বাংলার মূল চালিকা শক্তি তো ছাত্ররাই। কোটা প্রথা নিপাত যাক। মেধাবীরা মুক্তি পাক।’

পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমি আর্তনাদ করে বললাম, ‘আস্তে জেঠু। মেরো না।’

‘আরে বেটি, সাহস দিচ্ছি।’

‘তুমি তার পিঠের অবস্থা দেখো। শুধু তো হাতই দেখছো।’

জেঠু ক্ষত স্থানগুলো ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তার ক্ষতের একেকটা জ্বলন্তির অস্ফুট আর্তনাদ আমার মন দগ্ধ করলো। কাজ শেষ করে জেঠু, আমি ফিরে আসতে গেলে শুদ্ধ আমাকে ডেকে বললেন টেবিল থেকে পানির জগটা তার মাথার কাছে দিয়ে যেতে। জেঠু চলে গেলো। আমি জগ তার মাথার কাছে দিয়ে চলে আসতে নিলেই তিনি মেঘমন্দ্র স্বরে বললেন,

‘তরু, যখন তখন এই চিলেকোঠার দরজায় এসো না তুমি।’

আমি স্তব্ধ দাঁড়িয়ে থেকে তার কথা মর্মার্থ টা বুঝলাম। তারপর ধীর হাতে লাইট টা অফ করে দরজা চাপিয়ে এসে পরলাম। সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম আমি তাকে বস্তুত ভীষণভাবেই ভালোবেসে ফেলেছি এবং আমার এই ভালোবাসার প্রথম দিনেই তার কাছে বাজে ভাবে ধরা খেয়ে গিয়েছি। তখন না বুঝলেও এখন বুঝতে পারছি আমার চোখের পানির উষ্ণতা তিনি অনুভব করেছেন এবং সেই সাথে আমাকে অনুভব করিয়েছেন একপাক্ষিক ব্যর্থ ভালোবাসার অধ্যায়ের সূচনা। সেই থেকেই মূলত আমার খুকি ডাকের নিপাত হয়েছিলো। এতো বিশ্রীভাবে তার মুখের ‘তরু’ হতে তো আমি চাইনি।

চলবে

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-০৫
৮.
ধ্রুব ভাই হলেন শান্ত। কথা কম, তার কাজ বেশি। নিজে যেটা ঠিক মনে করবেন সেটাই করে ছাড়বেন। এর কোনো হেরফের হবে না। তিনি সারাদিনে ১০ কথাও বলেন না। তার গ্যাঞ্জাম করার স্বভাব নেই। এই এক ভালো দিক তার। কথা কাটাকাটি, তোষামোদি, আহ্লাদি, ঝগড়া এসব তার ধাতে নেই। সে চুপচাপ নিজের কাজটুকু শেষ করে উঠে চলে যাবেন। এতে কারো কোনো অসুবিধা হলো কি হলো না সেটা তার দেখার বিষয় নয়।

এই যেমন ধরুন সেদিন তিনি তার কর্মস্থলে যাননি। আমি নিজঘরে আধশোয়া হয়ে ফোন টিপছি। তিনি আমার ঘরে এসে ঘরটাকে তছনছ করে কি যেনো খুঁজে চলেছেন। প্রথম দিকে আমি বিশেষ পাত্তা দিলাম না। কিন্তু শেষমেশ পাত্তা না দিয়ে কোনো উপায়ও খুঁজে পেলাম না। যতই হোক রুমটা তো আমার। বিরক্তিতে কপাল কুচকে শুধালাম,

‘কি খুঁজছো?’

‘তোর কাছে আমার একটা সিম আছে না?’

সিমের কথা শুনে আমি উঠে বসলাম। ফোনটা হাত থেকে রেখে ঢোক গিললাম পরপর দুইবার। এই সিম দিয়ে আমি অপরিচিত সেজে শুদ্ধকে রাতে ফোন দিয়ে, মেসেজ দিয়ে জ্বালাতন করি। শুদ্ধ বিরক্ত হয়ে রাগে ফোন দেওয়া শুরু করলেই সিম বন্ধ করে রেখে দেই। সিম’টা আমার ফোনের কাভারের ভেতরে। আমি ধীরে সুস্থে কাভার থেকে সিমটা বের করে ফুলদানির নিচে রাখলাম। ধ্রুব ভাইকে কপট রাগ দেখিয়ে বললাম,

‘সিম লাগবে আমাকে বললেই তো পারো৷ এভাবে ঘর তছনছ করার কি মানে?’

‘কথা কম বলে বের করে দে।’

আমি অনেকক্ষণ খোঁজার নাটক করে হয়রান হয়ে বললাম,

‘আজ ক্লান্ত হয়ে গেছি কাল আবার খুঁজবো।’

‘এক থাপ্পড় দিলেই ক্লান্তি ছুটে তরতরা সোজা হয়ে যাবি। সিমে আমার ইম্পোর্টেন্ড একজনের নাম্বার সেভ করা।’

ধ্রুব ভাইয়ের ধমক খেয়ে আমি সত্যি সত্যি সোজা হয়ে গেছি। বিছানায় বসতে গিয়েও সটান দাঁড়িয়ে পরেছি। আমি ধ্রুব ভাইয়ার দিকে ঠোঁট উল্টে অসহায় চোখে তাকালাম। ধ্রুব ভাইয়ের মন গললো। উনি বিছানায় বসলেন সাথে হাত ধরে টেনে আমাকেও বসিয়ে দিয়ে বললেন,

‘তোকে একটা গল্প বলি শোন।’

আমি আগ্রহ নিয়ে তাকালাম। কারোর মুখ থেকে গল্প শোনা আমার এক ধরনের প্রবৃত্তি। আমি শুনতে খুব পছন্দ করি।

‘ওকে, প্রথমে গল্পের খাতিরে আমরা ধরে নেই ছেলেটার নাম অমুক আর মেয়েটার নাম তমুক ।’

‘এটা কোনো নাম হলো? তোমার এই অমুক তমুকের গল্প শুনার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। সরি।’

‘ওকে ঠিকাছে। ধর, আরাফ আর তুবা। তো, তুবা আরাফকে খুব ভালোবাসে। আরাফ তুবাকে একদম পাত্তা দেয় না। বেহায়া তুবা আরাফের পেছন পেছন ছুটে, লুকিয়ে দেখে, প্রত্যাখ্যান পেয়েও বারংবার ভালোবাসার প্রস্তাব নিয়ে ছুটে যায়। আরাফ তবুও তুবাকে ভালোবাসে না। একদিন আরাফকে গিয়ে বলে, ‘এই শেষবার তোমার কাছে এসেছি। আজ প্রত্যাখ্যান করলে কিন্তু আমি আর আসবো না। আরাফ পাত্তা দেয় না। রাগে, অভিমানে চোখ খিচে চলে আসার পথে তুবার একটা বাইকের সাথে এক্সিডেন্ট হয়। মেজর এক্সিডেন্ট নয় এই ছোটখাটো। তবে তুবার কাপড় ছিড়ে হাটুতে, কনুইয়ে আর কপালে গভীর ক্ষত হয়। রক্তে জামা কাপড় ভাসতে দেখে আর সারাদিন না খাওয়া তুবা সেখানেই অজ্ঞান হয়ে যায়। আরাফ তাড়াতাড়ি ওকে হসপিটালে নিয়ে যায়। এরপর মায়া জন্মায় তারপর আস্তে আস্তে জন্মায় ভালোবাসা। একদিন তুবা ওর বাবার কাছে ধরা খেলো। বাবার কাছে বেধড়ক মার খেয়েও ছুটেছুটে আরাফের কাছে যেতে চাইতো। পাগলপ্রায় মেয়েকে সামলাতে না পেরে বাবা মেনে নিলেন। মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন আরাফের সাথে। মেয়েটার আরাফের সাথে সংসার করার খুব সাধ ছিলো। কিন্তু বিয়ের প্রায় এক মাস আগে তুবার ধরা পরে ক্যান্সার। সে আর বড়জোর তিন মাস বাঁচবে। এদিকে ক্যান্সারের কথা শুনে আরাফের মা বিয়েতে বেঁকে বসলেন।’

এটুকু বলে থামলেন ধ্রুব ভাই। প্রথমদিকে ঘটনার প্রেক্ষাপটে আমি যেনো শুদ্ধ আর আমাকে দেখতে পেয়ে একটা ঘোরের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম। ধ্রুব ভাই থামতেই আমি চমকে বাস্তবে স্থির হলাম। কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

‘তারপর? তুবার সাথে কি আরাফের সংসার টা হয়েছিলো? তুবা মারা গিয়েছিলো নাকি বেঁচে ছিলো?’

ধ্রুব ভাই খুব আয়েস করে মাথার পেছনে দু’হাত দিয়ে বসলেন। আর বললেন,

‘আজ আর বলার মুড হচ্ছে না রে।’

আমি হতবিহ্বল চোখে তাকালাম। ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই নাক ফুলিয়ে ফুসে উঠে ধ্রুব ভাইকে লাগালাম এক কিল। ধ্রুব ভাই হাসতে হাসতে উঠলেন। আমার নাক টেনে বললেন,

‘আমার সিম হারিয়েছিস। এটা তোর শাস্তি।’

‘তুমি খুবই অসভ্য ধ্রুব ভাই। তোমার কথায় নাচা আমার ভুল হয়েছে।’

আমি আরো দু চার কিল ঘুষি লাগাতে লাগাতে উনাকে দরজার কাছে নিয়ে গিয়ে থামলাম। এরপর আরেকবার মারতেই উনি আমার হাত চেপে ধরে ফেললেন। আমি স্থির হলাম। উনি আমার মুখের উপর ঝুকে পরে বললেন,

‘গল্পের ‘কী লাইন’ কি জানিস?’

‘না এবং জানতেও চাই না।’

‘আরাফ আর তুবা কাজিন ছিলো।’

আমি হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আবারও চেঁতে উঠলাম,

‘তোমাকে আমি বলতে বলেছি? অসহ্য! গল্পের এন্ডিং দেও। কুইক।’

ধ্রুব ভাই গল্পটা তো শেষ করলেন-ই না। উল্টো তার হাত আমার চোখের সামনে ধরলেন। আমি সেদিকে তাকিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। উনার হাতে সিম। সেকেন্ড কয়েক পর চোরা গলায় জিজ্ঞেস করলাম,

‘কোথায় পেলে?’

ধ্রুব ভাই নাটকীয় ভঙ্গিতে উত্তর করলো,

‘ম্যাজিক।’

বলেই চুপচাপ আমার গায়ে আগুনটা ধরিয়ে দিয়ে উনি ঠিকই চলে গেলেন।। ইনি হলেন একজন ঠান্ডা মাথার খুনী। পাঠকগন আমি অতি মাত্রায় দুঃখিত আমি বলেছিলাম এ এক ভালো দিক তার। আদতে ওদের কোনো ভালো স্বভাব নেই। যা আছে সব আমাকে বাঁশ দেওয়ার স্বভাব।

চলবে

হেমন্তের নীড় পর্ব-০৩

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-০৩
৫.
সময় গড়ালো তার সাথে আমার ভাব আরো জমলো। এরপর আমার ঠিক মনে নেই তবে আনুমানিক আমি তখন ভার্সিটি উঠেছি। কোনো এক গোধূলি লগ্নে বৃষ্টি শেষে ঠান্ডা বাতাসের কনে দেখা কমলা রঙের আলোয় আমি শুদ্ধকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,

‘আপনার বর্ষাকাল কেমন লাগে?’

‘বিশ্রী৷ সাপ-পোকামাকড়, কাদা, রাস্তার ধারে ধারে জমে থাকা পানি, মশা। বিচ্ছিরি একটা অবস্থা।’

‘বসন্ত?’

‘চৈত্রের গরম চেনো?’

‘গ্রীষ্ম?’

‘আই হেইট কাঠাঁল এন্ড ইট’স স্মেল।’

‘আম ভালো লাগে?’

‘না।’

‘তো কি ভালো লাগে?’

‘নিজেকে।’

‘আচ্ছা, শীতকাল কেমন লাগে?’

‘আসলে তীব্র গরম, শীত কোনোটাই আমার পছন্দ নয়।’

‘হেমন্ত?’

‘ভালো বলেছো। হেমন্ত আমার প্রিয়। একটি আরাম আরাম ঋতু।’

‘শরৎ ভালোলাগে না কেনো?’

‘কারন কাশফুল আমার একদম পছন্দ নয়। ওটা একটা ফুল হলো?’

‘তবে আমি কি আপনাকে হেমন্ত প্রেমিক বলে ডাকবো?’

‘হ্যাঁ, ডাকতে পারো তো। ভালো লাগবে শুনতে।’

এই বলে আমি-তিনি দুজনেই থামলাম। কয়েক মিনিট চোখ বন্ধ করে পার করার পর এক বাক্যের একটি কথা আমাকে এক মুহূর্তের মধ্যে রাত-দিন তাকে নিয়ে ভাবতে তার বাধ্য করেছিলো সেদিন। তিনি যেনো খুব আবেগ নিয়ে বলেছিলেন,

‘শুনো, তরু। তুমি আমার কাছে হেমন্তের মতো।’

সেই শুরু! সেই এক বাক্যের লাইন সেই সন্ধ্যায় আমার শরীরে বিদ্যুৎ এর ঝিলিক বইয়ে দিলো। আমি তার গভীর প্রেমে পরলাম ধীরে ধীরে কিন্তু তার সেই আবেগ বাণীর প্রেমে পড়লাম তৎক্ষণাৎ। আমি মনে করেছিলাম সে মন থেকে বলেছে কিন্তু এই বয়সটাই এসে বুঝতে পারছি সেই বাক্য কেবল একটা সুন্দর বন্ধনের খাতিরে ছিলো। এর বেশি আর কিচ্ছু নয়। আমার চোখ ছাপিয়ে জল আসতে চাইছে। আমি কেনো সেই বাক্যটা শুনলাম? সেই সময় কোনো শব্দে আমার কানে তালা লেগে গেলো না কেনো? সেই এক বাক্য আমার জীবনে কাল হয়ে দাড়ালো। আমি কলম চালালাম খাতায়। লেখলাম আর ফিসফিসিয়ে বললাম,

‘তাই তো আমি আপনার কাছে হেমন্তের নীড় খুঁজতে এসেছি।’

তারপর? তারপর তার খুকি ডাক ঘুচে গেলো। তার সাথে আমার পরামর্শের পাট চুকে গেলো। যে বিরক্তি একসময় আমাকে ঘিরে ধরতো তা এখন তাকে ঘিরলো।

চলবে

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩ (এর অংশবিশেষ)
৬.
আমি তার প্রতি কেমন কন্সার্ন পাঠকদের তার একটা উদাহরণ দেই। আমি ভার্সিটি গিয়ে তথাকথিত আমার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খোলা মাঠে আড্ডা দিচ্ছি। এরমধ্যে স্নেহা আমাকে ফোন দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি বিরক্তিতে দিলাম এক ধমক। ধমক খেয়ে ও শুধু কান্নার মাঝে বলতে পারলো শুদ্ধ ভাইয়া। ব্যস! এতোটুকুতেই! তারপরের সেই লজ্জার বিষয়টুকু বলতে গেলে আমার নিজের প্রতি এখনো চরম ক্রোধ আসে। বস্তুত, আমি ওর কান্নারত গলায় ‘শুদ্ধ ভাইয়া’ এটুকু শুনে ধরেই নিয়েছিলাম শুদ্ধ হয় এক্সিডেন্ট করেছে, নাহলে মরে টরে গিয়েছে কিংবা অসুস্থ হয়েছে। আমি নেহাত’ই একজন ধীর-স্থির মেয়ে। নেগেটিভিটি মনে স্থান দেই না। কিন্তু তা শুদ্ধর বেলায় অন্য হিসাব। সেই মূহুর্তে আমার মাথায় সব নেগেটিভিটির স্তূপ এসে ভিড়লো। আমি ফোন কেটে শান্ত চিত্তে বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে দৌড়ে বাড়ি এসে দেখি……….

পাঠকরা আমাকে গাধা ভেবে ভুল করবেন না। ওরকম সিচুয়েশনে পরলে আমি হলফ করে বলতে পারি আপনি আমার থেকেও গাধার মতোন কাজ করতেন। দেখা গেলো অতিরিক্ত প্যানিক থেকে নিজেই অসুস্থ হয়ে গেলেন কিংবা রাস্তায় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজেই একটা অঘটন ঘটিয়ে বসলেন। সে যাই হোক, বাড়ি এসে আমি কি দেখলাম সেটা শুনুন,

আমি বাড়ি এসে দেখলাম শুদ্ধ স্নেহা’র নরম তুলতুলে ফর্সা সুন্দর গাল’টাকে চেরি ফলের মতো লাল বানিয়ে দিয়েছে। কারন’টা হলো সেদিন বাসায় শুভ্র ভাই আর ধ্রুব ভাই অনুপস্থিত। স্নেহা অংক বই খাতা নিয়ে গিয়েছে শুদ্ধর কাছে। শুদ্ধ’র আবার বিরাট ধৈর্য্য আর আমাদের স্নেহা বিরাট মেধাবী কী না! তিন চারবার এক অংক বুঝাতেই স্নেহা যখন এক অক্ষরও বুঝলো না তখন একটা সপাট চর এসে লাগলো ওর কপোলে। লিটরেলি মেয়েটা যোগ পর্যন্ত ঠিকমতো করতে পারছিলো না। অথচ কাল ওর ম্যাথ টিউটোরিয়াল পরীক্ষা আছে। হাহ! থাপ্পড় খেয়ে আহ্লাদী বাচ্চা আহ্লাদিত হয়ে এরজন্যই আমাকে কেঁদে কেঁদে ফোন দিয়েছে। ওর মেলোড্রামা আমি জন্মের মতোই আজ ঘুচিয়ে দিলাম। সব শুনে ওর আরেক গালকে বিটরুটের মতোন লাল বানিয়ে দিলাম। ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কতক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বাসা মাথায় তুলে কেঁদে গেলো জেঠির কাছে বিচার দিতে। আমি নিশ্চিত ওর ভ্যাবানো দেখে জেঠি নিশ্চয়ই আরেকটা চপেটাঘাত লাগাবে।

স্নেহার কান্না থামলো না। বাড়িসুদ্ধ সবাইকে কান্নার কারণ বলে বলে বেড়ালেও শুভ্র কিংবা ধ্রুব ভাইকে বললো না। এদিক থেকে স্নেহা একটা সুইটেস্ট পার্সন। ওর মতো কিউট মেয়ে আমি দুনিয়াতে দেখিনি। বস্তুত, আমার মনে থাকা শুদ্ধর প্রতি বছরের প্রথম বৃষ্টির ঝমঝমানোর ন্যায় অনুভূতির স্নেহা সবটুকুই জানে। আমি ওকে পইপই করে সব বলেও দেই কখন কি হয় না হয়। কিন্তু এই সফট হার্টের মেয়েটা কাউকে কক্ষনো কিছু বলেনি। সে জানে শুভ্র আর ধ্রুব ভাই শুদ্ধকে পছন্দ করে না তাই ওদের সামনে শুদ্ধর পার্টটুকু এড়িয়ে বাকিটুকু বললো। কোনো এক কারনে শুদ্ধর মুখোমুখি ওরা হয় না। ওদের মুখোমুখিও শুদ্ধ হয় না। শুভ্র ভাই এসে আদরের বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে আহ্লাদ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘এতো কাদে না, সোনা? আইসক্রিম খাবে?’

ন্যাকামো! কেউ কাদলেই আদর উপচিয়ে পরে। আর তখন ‘তুমি ডাক’ আদরের মাত্রা’টাকে পুরা আহ্লাদের চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। এসব আহ্লাদ আমার একদম পছন্দ হয় না। স্নেহা হেচকি তুলতে তুলতে বললো,

”তরু আপু, আমার গালে কেনো মারলো?’

বলেই আবার জোরেসোরে কান্না। আমি বিরক্তিতে কপাল কুচকে বললাম,

‘একটাই তো মেরেছি। এতো নাটক করছিস কেনো? নাকি আরেকটা খেতে চাস? কান্না থামা, ভ্যাবানি।’

শুভ্র ভাই আমার দিকে কড়া চোখে তাকালেন। আমি বিশেষ পাত্তা না দিয়ে উপর দিকে চোখ নিক্ষেপ করে শীষ বাজালাম। ধ্রুব ভাইয়ের আপন বোন স্নেহা। কিন্তু ওর প্রতি শুভ্র ভাইয়ের আদরের পাল্লাটুকু বেশি ভারী। যদিও ধ্রুব ভাই যথেষ্ট আদর করেন নিজের বোনকে। তবুও মায়ের থেকে বরাবর মাসির দরদ একটু বেশিই থাকে। ধ্রুব ভাই এবার বিরক্তে এক রাম ধমক দিলেন,

‘এই, এটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসো তো। কি শুরু করেছে? একটা সিম্পল অংক পারে না। মাথা ভর্তি গোবর। মেরেছে বেশ করেছে।’

শুভ্র ভাই বললেন, ‘কি করলে কান্না থামবে, বাবু?’

স্নেহা কাদতে কাদতে উত্তর দিলো, ‘শপিং এ গেলে।’

সাথে সাথে আমি ফট করে বলে উঠলাম,

‘এ্যাহ! জাতে মাতাল তালে ঠিক। একটা চর খেয়ে সারাদিন নাটক বুঝি এরজন্য করছিলি?’

শুভ্র ভাই আমাকে আবার চোখ রাঙানি দিয়ে বললেন,

‘যা, রেডি হয়ে আয়। শপিং এ যাবো আমরা।’

‘আমি কোথাও যাচ্ছি না।’

আমি মুখে না করলাম ঠিকই কিন্তু আমি জানি আমাকে যেতেই হবে কারণ শুভ্র ভাই আমাকে বাড়িতে ফেলে কিছুতেই শপিং এ যাবেন না। ধ্রুব ভাই কিছু বললেন না। উনার ভাবমূর্তি দেখে মনে হলো উনি যাবেন না। কিন্তু আমি লিখে দিতে পারি এখন যদি আমি বলি আমি যাবো তাহলে ধ্রুব ভাইও পেছন পেছন লেজ নাড়তে নাড়তে যাবেন। এরা দুজন কি আমার বডিগার্ড নাকি? একজন বাড়িতে একা ছেড়ে দিয়ে যেতে রাজি নন আরেকজন একা বাইরে ছাড়তে রাজি নন। যতক্ষণ বাড়িতে দুজন থাকবে আমার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকবে। অসহ্য যন্ত্রণা! অগ্যতা আমি রেডি হতে গেলাম। কারণ লাভ নেই তো! কথায় শুধু কথা বাড়বে। শেষে গিয়ে দেখা যাবে দাদুভাইয়ের কাছে দুজন নালিশ ঠুকে এক মাসের বিচার একবারে বসাবে।

চলবে

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-৩ (এর অংশবিশেষ)
৬.
আমি তার প্রতি কেমন কন্সার্ন পাঠকদের তার একটা উদাহরণ দেই। আমি ভার্সিটি গিয়ে তথাকথিত আমার বন্ধু-বান্ধবদের সাথে খোলা মাঠে আড্ডা দিচ্ছি। এরমধ্যে স্নেহা আমাকে ফোন দিয়ে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। আমি বিরক্তিতে দিলাম এক ধমক। ধমক খেয়ে ও শুধু কান্নার মাঝে বলতে পারলো শুদ্ধ ভাইয়া। ব্যস! এতোটুকুতেই! তারপরের সেই লজ্জার বিষয়টুকু বলতে গেলে আমার নিজের প্রতি এখনো চরম ক্রোধ আসে। বস্তুত, আমি ওর কান্নারত গলায় ‘শুদ্ধ ভাইয়া’ এটুকু শুনে ধরেই নিয়েছিলাম শুদ্ধ হয় এক্সিডেন্ট করেছে, নাহলে মরে টরে গিয়েছে কিংবা অসুস্থ হয়েছে। আমি নেহাত’ই একজন ধীর-স্থির মেয়ে। নেগেটিভিটি মনে স্থান দেই না। কিন্তু তা শুদ্ধর বেলায় অন্য হিসাব। সেই মূহুর্তে আমার মাথায় সব নেগেটিভিটির স্তূপ এসে ভিড়লো। আমি ফোন কেটে শান্ত চিত্তে বন্ধুদের থেকে বিদায় নিয়ে দৌড়ে বাড়ি এসে দেখি……….

পাঠকরা আমাকে গাধা ভেবে ভুল করবেন না। ওরকম সিচুয়েশনে পরলে আমি হলফ করে বলতে পারি আপনি আমার থেকেও গাধার মতোন কাজ করতেন। দেখা গেলো অতিরিক্ত প্যানিক থেকে নিজেই অসুস্থ হয়ে গেলেন কিংবা রাস্তায় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে নিজেই একটা অঘটন ঘটিয়ে বসলেন। সে যাই হোক, বাড়ি এসে আমি কি দেখলাম সেটা শুনুন,

আমি বাড়ি এসে দেখলাম শুদ্ধ স্নেহা’র নরম তুলতুলে ফর্সা সুন্দর গাল’টাকে চেরি ফলের মতো লাল বানিয়ে দিয়েছে। কারন’টা হলো সেদিন বাসায় শুভ্র ভাই আর ধ্রুব ভাই অনুপস্থিত। স্নেহা অংক বই খাতা নিয়ে গিয়েছে শুদ্ধর কাছে। শুদ্ধ’র আবার বিরাট ধৈর্য্য আর আমাদের স্নেহা বিরাট মেধাবী কী না! তিন চারবার এক অংক বুঝাতেই স্নেহা যখন এক অক্ষরও বুঝলো না তখন একটা সপাট চর এসে লাগলো ওর কপোলে। লিটরেলি মেয়েটা যোগ পর্যন্ত ঠিকমতো করতে পারছিলো না। অথচ কাল ওর ম্যাথ টিউটোরিয়াল পরীক্ষা আছে। হাহ! থাপ্পড় খেয়ে আহ্লাদী বাচ্চা আহ্লাদিত হয়ে এরজন্যই আমাকে কেঁদে কেঁদে ফোন দিয়েছে। ওর মেলোড্রামা আমি জন্মের মতোই আজ ঘুচিয়ে দিলাম। সব শুনে ওর আরেক গালকে বিটরুটের মতোন লাল বানিয়ে দিলাম। ও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কতক্ষণ আমার দিকে চেয়ে থেকে বাসা মাথায় তুলে কেঁদে গেলো জেঠির কাছে বিচার দিতে। আমি নিশ্চিত ওর ভ্যাবানো দেখে জেঠি নিশ্চয়ই আরেকটা চপেটাঘাত লাগাবে।

স্নেহার কান্না থামলো না। বাড়িসুদ্ধ সবাইকে কান্নার কারণ বলে বলে বেড়ালেও শুভ্র কিংবা ধ্রুব ভাইকে বললো না। এদিক থেকে স্নেহা একটা সুইটেস্ট পার্সন। ওর মতো কিউট মেয়ে আমি দুনিয়াতে দেখিনি। বস্তুত, আমার মনে থাকা শুদ্ধর প্রতি বছরের প্রথম বৃষ্টির ঝমঝমানোর ন্যায় অনুভূতির স্নেহা সবটুকুই জানে। আমি ওকে পইপই করে সব বলেও দেই কখন কি হয় না হয়। কিন্তু এই সফট হার্টের মেয়েটা কাউকে কক্ষনো কিছু বলেনি। সে জানে শুভ্র আর ধ্রুব ভাই শুদ্ধকে পছন্দ করে না তাই ওদের সামনে শুদ্ধর পার্টটুকু এড়িয়ে বাকিটুকু বললো। কোনো এক কারনে শুদ্ধর মুখোমুখি ওরা হয় না। ওদের মুখোমুখিও শুদ্ধ হয় না। শুভ্র ভাই এসে আদরের বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে আহ্লাদ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘এতো কাদে না, সোনা? আইসক্রিম খাবে?’

ন্যাকামো! কেউ কাদলেই আদর উপচিয়ে পরে। আর তখন ‘তুমি ডাক’ আদরের মাত্রা’টাকে পুরা আহ্লাদের চরম পর্যায়ে নিয়ে যায়। এসব আহ্লাদ আমার একদম পছন্দ হয় না। স্নেহা হেচকি তুলতে তুলতে বললো,

”তরু আপু, আমার গালে কেনো মারলো?’

বলেই আবার জোরেসোরে কান্না। আমি বিরক্তিতে কপাল কুচকে বললাম,

‘একটাই তো মেরেছি। এতো নাটক করছিস কেনো? নাকি আরেকটা খেতে চাস? কান্না থামা, ভ্যাবানি।’

শুভ্র ভাই আমার দিকে কড়া চোখে তাকালেন। আমি বিশেষ পাত্তা না দিয়ে উপর দিকে চোখ নিক্ষেপ করে শীষ বাজালাম। ধ্রুব ভাইয়ের আপন বোন স্নেহা। কিন্তু ওর প্রতি শুভ্র ভাইয়ের আদরের পাল্লাটুকু বেশি ভারী। যদিও ধ্রুব ভাই যথেষ্ট আদর করেন নিজের বোনকে। তবুও মায়ের থেকে বরাবর মাসির দরদ একটু বেশিই থাকে। ধ্রুব ভাই এবার বিরক্তে এক রাম ধমক দিলেন,

‘এই, এটাকে বাইরে ফেলে দিয়ে আসো তো। কি শুরু করেছে? একটা সিম্পল অংক পারে না। মাথা ভর্তি গোবর। মেরেছে বেশ করেছে।’

শুভ্র ভাই বললেন, ‘কি করলে কান্না থামবে, বাবু?’

স্নেহা কাদতে কাদতে উত্তর দিলো, ‘শপিং এ গেলে।’

সাথে সাথে আমি ফট করে বলে উঠলাম,

‘এ্যাহ! জাতে মাতাল তালে ঠিক। একটা চর খেয়ে সারাদিন নাটক বুঝি এরজন্য করছিলি?’

শুভ্র ভাই আমাকে আবার চোখ রাঙানি দিয়ে বললেন,

‘যা, রেডি হয়ে আয়। শপিং এ যাবো আমরা।’

‘আমি কোথাও যাচ্ছি না।’

আমি মুখে না করলাম ঠিকই কিন্তু আমি জানি আমাকে যেতেই হবে কারণ শুভ্র ভাই আমাকে বাড়িতে ফেলে কিছুতেই শপিং এ যাবেন না। ধ্রুব ভাই কিছু বললেন না। উনার ভাবমূর্তি দেখে মনে হলো উনি যাবেন না। কিন্তু আমি লিখে দিতে পারি এখন যদি আমি বলি আমি যাবো তাহলে ধ্রুব ভাইও পেছন পেছন লেজ নাড়তে নাড়তে যাবেন। এরা দুজন কি আমার বডিগার্ড নাকি? একজন বাড়িতে একা ছেড়ে দিয়ে যেতে রাজি নন আরেকজন একা বাইরে ছাড়তে রাজি নন। যতক্ষণ বাড়িতে দুজন থাকবে আমার পেছনে আঠার মতো লেগে থাকবে। অসহ্য যন্ত্রণা! অগ্যতা আমি রেডি হতে গেলাম। কারণ লাভ নেই তো! কথায় শুধু কথা বাড়বে। শেষে গিয়ে দেখা যাবে দাদুভাইয়ের কাছে দুজন নালিশ ঠুকে এক মাসের বিচার একবারে বসাবে।

চলবে

হেমন্তের নীড় পর্ব-০২

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-০২.
৩.
আমার এক আশ্চর্য সমস্যা রয়েছে। বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকলেই আমার চাপা ব্যাথা করে। বর্তমানে আমার ভীষণ চাপা ব্যাথা করছে। কারন বিগত বারো ঘন্টা আমি কারোর সাথে কথা বলিনি। এরমধ্যে অবশ্য নয় ঘন্টা ঘুমিয়েছি। এখন চুপচাপ বসে বসে মুখের এক্সারসাইজ করছি। এই যে বাড়িতে একজন জলজ্যান্ত পরির মতো মেয়ে না খেয়ে, মন খারাপ করে কারোর সাথে কথা না বলার অনশন করেছে এতে কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কেউ তার সাথে আগ বাড়িয়ে এসে কথা বলছে না। একটু আহ্লাদ দিয়ে তোষামোদ করছে না। খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে এগিয়ে আসছে না। ব্যাপারটা নিয়ে খুবই ব্যথিত আমি। আমার জন্মদাত্রী অবশ্য একবার এসে আমাকে আগাগোড়া পর্যবেক্ষণ করে গেলেন তবে বিশেষ পাত্তা দিলেন না। এখন অপেক্ষার প্রহর গুনছি কখন বাবা বাড়ি আসে। তবে আমার ভাবনার মাঝেই বাবার বদলে এলেন শুদ্ধ। তিনি এসে ডাইনিং টেবিলে বসে পত্রিকা পড়া আমার দাদুভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

‘আসসালামু আলাইকুম, দাদুভাই। কেমন আছেন?’

আমি চোখ টিভির দিকে রেখে কান সজাগ করে রইলাম। উফফ.. শুদ্ধ’কে দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। পাঠকরা ভাবতে পারেন এ আমার কিশোরী মনের আবেগ অথবা উঠতি যুবতী একচ্ছত্র ভালোলাগা। তবে তাদের বোঝার সুবিধার্থে আমি বলে দিতে চাই যে কিশোরী বয়স এবং উঠতি যুবতী বয়স দুটোই আমি পেরিয়ে এসেছি। এ আমার প্রেম! ভালোবাসা!

আমার দাদুভাই যে শুদ্ধ’কে একদম পছন্দ করেন না সেটা তিনি তার চেহারার অভিব্যাক্তিতেই বুঝিয়ে দেন। তিনি সালামের উত্তর নিলেন মনে মনে বিরবির করে। কিন্তু উত্তর নেওয়া উচিত ছিলো জোরে শব্দ করে। আমি শিখিয়ে দিলাম না। নেহাত আমার থেকে তার জ্ঞান-বুদ্ধি কিছু কম নয়। আর তাছাড়া আমার কারোর সাথে কথা না বলার অনশন চলছে। শুদ্ধ বললেন,

”আমি এ মাসের ডিসেম্বরে বাসা’টা ছেড়ে দিচ্ছি, দাদুভাই।’

আমি চোখ বড় বড় তাকালাম। সটান সোফা থেকে যন্ত্রমানবের ন্যায় দাঁড়িয়ে পরে মুখ ফসকে বলে ফেললাম,

‘কিহ? আপনি না কাল বললেন জানুয়ারিতে ছাড়বেন?’

শুদ্ধ উদ্দেশ্যহীন তাকালো। যেন আমার অবাকতা তাকে বিন্দুমাত্র প্রভাবিত করেনি এমন ন্যায় মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,

‘কেমন আছো, তরু?’

আমি উত্তর দিলাম না। চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে তার অভিনয় দেখে গেলাম,

‘কাল তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো? কি জানি মনে করতে পারছি না। জানুয়ারিতে ছাড়বো বলেছিলাম? তাহলে বোধহয় ভুল বলেছি।’

আমি অবাকতার শীর্ষে চলে গেলাম। কি বলছে এই লোক? আমার সাথে দেখা হয়েছে কি না সেটাও তার মনে নেই। নাকের পাটাতন ফুলিয়ে বললাম,

‘কেনো? আপনি কি ডিমেনশিয়ার রোগী?’

এরমাঝে ধ্রুব ভাই এসে গম্ভীর স্বরে ডাকলেন,

‘তরু, এদিকে আয়। জেঠু ডাকছে।’

বলে ধ্রুব ভাই নিজেই এসে খপ করে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। আমি কিচ্ছু বললাম না। অন্যসময় হলে এইমুহূর্তে আমি নিশ্চিত বিরক্ত হয়ে বলে উঠতাম, ‘আমার সময় হলে যাবো। একদম জোর-জবরদস্তি করবে না।’ কিন্তু এখন এইক্ষণে এসে আমার আর সেই কথাটুকু বলতে ইচ্ছে করলো না। অপমানের জ্বালা চারিদিক থেকে আমাকে ঘিরে ধরলো। যার জন্য আমি পুরো পৃথিবী ছাড়তে প্রস্তুত সে আমাকে কেয়ারই করে না। আমাকে সে বিন্দুমাত্র গ্রাহ্য করে না। আমার চোখ ছাপিয়ে জল এলো। শুদ্ধ তা দেখলোও। কিন্তু তার চোখে আমি কোনো অনুতাপ, কিংবা মায়া দেখলাম না। সেসব তো দূর করুণার ছায়াটুকু পর্যন্ত ছিলো না।

দাদুভাই বললেন,

‘সকালের নাস্তা করে যেয়ো, শুদ্ধ। পরোটা আর আলু ভাজি। তুমি চাইলে একটা ডিম পোজ করে দিতে বলি?’

দাদাভাই যে শুদ্ধর এককথায় রাজি হয়েছেন তা আর ভেঙে ভেঙে হলফ করে বলতে হবে না। তার চোখে মুখের ঝিলিকেই বোঝা যাচ্ছে, তিনি শুদ্ধর এই ডিসিশনে অতিমাত্রায় খুশি। শুদ্ধ মাথা দুলিয়ে হেসে তার ঝাঁকড়া চুলগুলো পেছনে ঠেলে দিয়ে বললো,

‘আমার সব জায়গায় খেতে বসে পরার অভ্যাস নেই।’

শুদ্ধর কথাটা শোনা গেলো, আমার অন্যের ঘরে নোটিশ বহীন যখন তখন খেয়ে বেড়ানোর অভ্যাস নেই। সে অতি ভদ্র ভাষায় বলেছে বলেই ভদ্র লোকগণ প্রথম দেখায় এই ত্যাড়া লোককে খুবই ভদ্র বলে দাবি করবেন। তবে মুরব্বিরা সাধারণত এই ধরনের কাট কাট কথাবার্তা বলা ছেলে পেলেদের পছন্দ করেন না। যথারীতি দাদুভাইয়ের কাছেও শুদ্ধ বড়োই অপছন্দনীয়। তার কাছে শুদ্ধ’কে খুবই ঠান্ডা মাথার বেয়াদব কিছিমের লোক এবং অত্যাধিক ধূর্ত বলে মনে হয়। এ ধরনের ধূর্ত ছেলেরা সাধারণত সংসার পাতে বোকা কিছিমের মেয়েদের সাথে। ধূর্ততার সাথে না পেরে বোকার অভিমান জমতে জমতে একসময় তলানি পরে আর উপরটুকু থাকে পরিষ্কার, পাতলা, ট্যালটেলে। সেই পাতলা তরলটুকুর নাম সম্পর্ক।

আমাকে যে ইনটেনশনালি শুদ্ধর সামনে থেকে সরিয়ে আনা হলো তা আমি ভালোভাবেই বুঝতে পারছি। এ অবশ্য নতুন নয়। দাদুভাইয়ের মতো শুভ্রভাই এবং ধ্রুবভাইও শুদ্ধ’কে পছন্দ করেন না। আরো বেশি পছন্দ করে না আমাকে শুদ্ধর আশেপাশে দেখা। কোনো এক দৈবিক কারনে আমার বাবাও শুদ্ধকে পছন্দ করে না। আমার এখন শোকের প্রতীক কালো পোশাক পরে রাজকীয় গম্ভীর ভঙ্গিতে বলতে ইচ্ছে করছে,
‘আমি যাকে ভালোবাসি তাকে আমি ছাড়া আর কেউ ভালোবাসে না, তবুও সে আমায় ভালোবাসলো না। ‘

এবং এরসাথে আমার মন চাইছে শুদ্ধও নাটকীয় ভঙ্গিতে তা স্বীকার করে বলুক, ‘তরু ছাড়া এই এক জনমে আমাকে আর কেউ ভালোবাসেনি। আমার এ জীবন তরুর তরে সমর্পিত।’

০৪.
শুদ্ধ এ বাড়িতে আছেন আড়াই বছর ধরে। প্রথম দিকে তার ব্যবহার আমার মোটেও পছন্দ ছিলো না। আমি তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। এক, দুই মাস একটু পুরাতন হতেই দেখা গেলো তার সাথে সাক্ষাৎ হলেই ‘খুকি খুকি’ করে কান ঝালাপালা করে দিচ্ছেন। উঠতি বয়সের মেয়েরা নিজেদের বড় ভাবতে পছন্দ করে। কাজেই আমিও তার এই খুকি ডাক কোনোমতেই গ্রহণ করতে পারলাম না। সাত-আট মাস পর্যন্ত তাকে দেখলেই বিরক্তিতে আমার নাকের পাটাতন ফুলে উঠতো। তারপর কোন জেনো এক অজানা লগ্নে তার সাথে আমার ভাব বিনিময় হলো। আমি জানতে পারলাম লোকটা ভারী চমৎকার। তার ভাবনা গুলো ভীষণ সুন্দর। সে আমার সাথে পরামর্শর আয়োজন করতো,

‘তোমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে, খুঁকি?’

বলে রাখা ভালো আমি তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছি। আমি তার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বললাম,

‘তরু বলুন। নাহলে উঠে চলে যাবো।’

তিনি গ্রাহ্যই করলেন না। বললেন,

‘বলোতো খুকি, সাতকাহন কার উপন্যাস?’

আমি হতাশ নিঃশ্বাস ছাড়লাম কিন্তু তার খুকি ডাক ছাড়াতে পারলাম না। তবু আগ্রহ নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে বললাম,

‘শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।’

তিনি অকপটে ঘোষণা জানালেন ‘আমি একজন বিশিষ্ট লেভেলের মাথামোটা। আমাকে ইন্টার থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে ফেলে থালাবাসন মাজতে বসিয়ে দেওয়া উচিত। আমার মস্তিষ্ক পুরোদস্তুর অপরিপক্ক। মুরগির গু দিয়ে ভরপুর। সুতরাং, আমার জন্য খুকি নামটাই পার্ফেক্ট।’

আমি ঠোঁট উল্টে বললাম,

‘কে লিখেছে?’

‘সমরেশ মজুমদার।’

আমি মুখ টানা মেরে বললান, ‘আমি জানি সমরেশ মজুমদার। দেখলাম আপনি জানেন কিনা!’

শুদ্ধ আমার কথা বিশ্বাস করলেন। কারণ আমি টুকটাক বই পড়ি। এবং মাঝেমধ্যেই ইচ্ছাকৃত উল্টাপাল্টা লেখকের নাম বলি।

‘তোমার মতে কোন লেখক আন্ডাররেটেড? আর কোন লেখক ওভাররেটেড?’

‘সমসাময়িক?’

‘যেকোনো।’

‘আমার জ্ঞান খুবই অল্প। তাই লেখক জাজ করা আমার একদমই উচিত হবে না। তবে আমার অপছন্দের লেখক …. ।’

আমি নিচু আওয়াজে বললাম নামটি, পাছে যদি আবার পাঠকগণ তাদের প্রিয় লেখকের হয়ে আমাকে ধুয়েমুছে সাফ করে দিতে আসে? শুদ্ধকে প্রশ্ন করলাম,

‘আপনার অপছন্দের লেখক কে, শুদ্ধ ভাই?’

বলে রাখা ভালো সেসময় আমি তাকে ‘ভাই’ বলেই সম্বোধন করতাম। আমার প্রশ্ন শুনে উনি উত্তর করলেন,

‘আমি নিজেই।’

‘কেনো আপনি কি লেখালেখি করেন?’

‘লিখি না বলেই তো আমি নিজেই নিজের অপছন্দের লেখক। কত লেখার ট্রাই করেছি তোমার বয়সী থাকতে।’

উনার কথা শুনে আমরা একসাথে অল্প বিস্তর হাসলাম। আহা! সে কি মধুর সময়। যদি আগে জানতাম তার প্রেমে এভাবে পা পিছলে পরবো আমি!তবে কক্ষনো তার সাথে বৈঠকে বসতাম না। সেই স্মৃতি গুলো আজ এই সময়টায় এসে খুব পীড়াদায়ক। আমি বলেছিলাম সেদিন গর্বে বুক ফুলিয়ে,

‘আমিও লেখার চেষ্টা করবো।’

‘লেখা এতো সহজ নয়। আগে এইচএসসি শেষ করো, খুকি।’

উনার বিদ্রুপ শুনে আমি মুখ ভার করলাম। উনি কি বোঝাতে চাইছেন, আমি গর্দভ স্টুডেন্ট বলে কি ইন্টার পাশও করতে পারবো না? আশ্চর্য! আমি এতোটাও গবেট নই। আমি গাল ফুলিয়ে জবাব দিলাম,

‘পাশ করার মতো ব্রেইন আছে আমার। হুহ!’

শুদ্ধ আমার কথায় অযথাই বিকট হাসিতে ফেটে পরে বললেন,

‘খুকি, তোমাকে মুখ ভার করলে তো খুব সুন্দর দেখায়।’

তার প্রতি লাইনে খুকি খুকি যেনো আমাকে বুঝিয়ে দেয় আমি কতটা গরু জাতের। আমার মুখ আরো ভার হয়ে আসতো। সত্যি বলতে আমি আগে কিছুটা বলদ জাতেরই ছিলাম। বর্তমানে নিজের কাছে নিজেকে বড় জাহির করার জন্য বুদ্ধিমতী বলে দাবি করলেও আমি আসলে সেই বলদ-ই রয়ে গেছি। নচেৎ ওমন নস্যাৎ লোকের পেছনে কে ঘুরে?

চলবে

হেমন্তের নীড় পর্ব-০১

0

#হেমন্তের_নীড়
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
পর্ব-০১

১.
‘এই মূহুর্তে ঠোঁটের আলকাতরা গুলো মুছবি। চোখের উপর কি সঙ দিয়েছিস? তুলে ফেল এক্ষুণি। শাড়ি পড়েছিস কোন সাহসে?’

‘আশ্চর্য! আমার কি একটু শাড়ি পড়ার সাধীনতাও নেই?’

‘তোকে মার্জিত পোশাক পরে যেতে বলেছিলাম।’

‘শাড়ি অবশ্যই একটি মার্জিত পোশাক।’

‘তর্ক করছিস কোন সাহসে? কথা কানে যায় না? শাড়ি পরে রংঢং করবি তারপর ছেলেরা দেখে পছন্দ করবে। পেছন পেছন ঘুরবে এসব খুব এঞ্জয়েবল লাগে?’

শুভ্র ভাইয়ের কথায় কান’টা আমার ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। আমি বিরক্ত চোখে চাইলাম। চু শব্দ করে চলে আসতেই সামনে এসে দাড়ালেন আরেক দানব। ধ্রুব ভাই! তিনি আরো দ্বিগুন গরম মেজাজে গলা চড়িয়ে বললেন,

‘আজকের অনুষ্ঠানে একটা ছেলে তোর ছবি তুলেছে তুই আবার হাসিমুখে পোজ দিয়েছিস? যার তার ফোনে ছবি রাখার এতো শখ?’

‘ও আমার থেকে ছোটো।’

‘তো?’

‘এবার কিন্তু অসহ্য লাগছে আমার!’

‘থাপ্পড় খাবি, বেয়াদব?’

আমার রাগের উপর এদের ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখে আমার রাগের পারদ চিড়বিড় করে বাড়লো। বিগত দুই ঘন্টা থেকে ঘুরেফিরে তারা দুজন একই ঘটনা ভিন্ন ভিন্নভাবে মশলা মাখিয়ে আমাকে ঝাড়ির উপরে রেখেছে। নেহাৎ আমি ভদ্র মেয়ে। তাই ভদ্রতার খাতিরে কোনো প্রত্যুত্তর করছি না। এক কান দিয়ে ডুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করছি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এদের যন্ত্রণায় যেকোনো সময় ঠুসঠাস করে মাথা’টা ফেটে যেতে পারে। তাই চেঁচিয়ে ডেকে উঠলাম,

‘দাদুভাই, দাদু…ভাই।’

দাদাভাই এলেন লাঠিতে ভর করে ঠুকঠুক আওয়াজ করতে করতে। এসেই তিনি বিরক্ত হয়ে আরো এক কাঠি উপরে গরম মেজাজ দেখিয়ে বললেন,

‘এতো বড় মেয়ে ষাড়ের গলায় চিল্লাচ্ছিস কেনো? এলাকার লোক সব সজাগ হয়ে যাবে।’

অতঃপর আমি বুঝে ফেললাম এ বাড়িতে আদতে আমার বিন্দুমাত্র দাম নেই। এদের অত্যাচারে একদিন ঠিক ঠিক আমাকে বনবাসে চলে যেতে হবে। দীর্ঘ এক আর্তনাদের নিঃশ্বাস নিজের বুকের ভেতর চেপে বললাম,

‘অবশ্যই চেঁচাবো। এরা কি আমাকে জোকার পেয়েছে? দুইজন একসাথে শুরু করে দিয়েছে এই রাত বিরেতে। মায়ের বকা, তোমার বকা, এদের দুজনের বকা। আমি এইটুকুন একটা মাসুম বাচ্চা! এতো বকাবকি হজম করতে পারি?’

শুভ্র ভাই বোধ হয় তার ধৈর্য্য আর ধরে রাখতে পারলেন না। চোখের সাদা অংশ লাল করে বললেন,

‘মারবো টেনে এক চর। তোমাকে ভালো কিছুই বলা যাবে না? কিছুই শেখানো যাবে না? তুমি একাই একশ? যা করতে চাও তা করতে দিলেই খুব খুশি, না?’

আমার মুখ’টা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেলো। শুভ্র ভাই দাদুভাইয়ের দিকে তাকিয়ে এবার বললেন,

‘দাদুভাই, আপনি কি জানেন? আপনার এই নাতনি বাড়ির বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই হয়ে যায় জন্মের বেহায়া। ছেলেদের সাথে মুখে মধু নিয়ে হেসে হেসে কথা না বললে তো তার পেটের ভাত’ই হজম হয় না। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে কেউ বিয়েবাড়ির সাজ দিয়ে যায়? গাঁইয়া কোথাকার!’

গাঁইয়া! বেহায়া! আমাকে এইভাবে অপমান? আজ যদি দাদাভাই এর বিচার না করেন তবে আমি বিষ খাবো। কিন্তু আমার এই পণ বহাল রাখা তো দূরের কথা আমি মুখ দিয়ে উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারলাম না কারণ দেখা গেলো আমার মুখ থেকে বের হওয়ার আগেই আমার দুই হারামি ভাই এবং দাদাভাই তিনজন তিন কৌটা নেংটি ইঁদুর মারার বিষ এনে দিয়েছেন। আমার ইঁদুরের বিষ খেয়ে মরার ইচ্ছা আপাতত নেই। সুতরাং আমি চুপ থাকলাম এবং আমার এই সরলতার সুযোগ নিয়ে ওইদিকে আরেক টেপ রেকর্ডার বাজলো। ধ্রুব ভাই বললেন,

‘শুধু কি তাই? চেনা নেই জানা নেই অচেনা কোন বখাটে ছেলেপেলেদের ফোনে ছবি তুলেছে আপনার নাতনি। ভাবুন কতটা গোঁয়ার!’

ইয়া মাবুদ! আমাকে গোঁয়ার ডেকেছে? আমি তোমার কাছে বিচার দিলাম। তুমি এর বিচার করো। আমি দাঁতে দাঁত পিষে মেঝের দিক তাকিয়ে রইলাম আলাভোলা মুখ করে। ধ্রুব ভাইকে আমার কুত্তা দৌড়ানি খাওয়াতে ইচ্ছে করলো কিন্তু এবারও আমার ইচ্ছেগুলো মাটিচাপা দিয়ে আমি আব্বুর আসার অপেক্ষা করলাম। কারন এই ইহজগৎ এ ওই এক বাপ ছাড়া আমার পাশে দাঁড়ানোর আর কেহই নেই। আমার টিম মেম্বার এবং শুভাকাঙ্ক্ষী বলতে শুধুমাত্র, কেবলই, একমাত্র আমার বাবা। দাদুভাই রায় দিলেন,

‘এটা খুব বাজে কাজ হয়েছে। এই জঘন্য অপরাধের জন্য আমি তরু’র কাল দুপুর পর্যন্ত খাবার বন্ধ করলাম। তরু খেতে পারবে কাল রাত ৯ টা বেজে ১ মিনিটে।’

শুভ্র ভাই এবং ধ্রুব ভাই এই রায়ে একদমই খুশি হলেন না এবং তা তাদের চোখ দেখেই বোঝা গেলো। তারা খুশি হতেন যদি আমাকে দুই মাস ঘরবন্দীর রায় দেওয়া হতো। আমি রাগে দুঃখে বাংলার চলচ্চিত্রের শাবানার মতো দুই হাত দুই কানে দিয়ে বলে উঠলাম, ‘নায়ায়ায়ায়া….।’ কিন্তু আমার না বোধহয় কারোর কানে ঢুকলো না। যে যার মতো চলে গেলো। আমি সিনেমার মধ্যে মশলা এড করার জন্য স্লো মোশনে দৌড়ে আমার ঘরের দিকে রৌনা হলাম। আর মনের মুখে বলে গেলাম,

‘অসম্ভব! আমি খাদ্য প্রেমী মানুষ। একদিন না খেয়ে থাকলে আমি তো মরেই যাবো। নিকুচি করেছে ওদের ঘোষণার। ওদের ঘোষণা আমি থোরাই কেয়ার করি? এদের যন্ত্রণায় আমার জীবন’টা একদম শ্যাষ!’

২.

শুভ্র এবং ধ্রুব ভাই আমার দুই জেঠার ছেলে। হুমায়ুন আহমেদ এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় উভয়ের দুটি বিখ্যাত চরিত্র আমার ঘরেই অবস্থান করে। যদিও বিখ্যাত চরিত্রদের সাথে আমাদের ঘরে অবস্থানরত দুই চরিত্রের কোনোদিক থেকেই কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমার সরল, হাবা, স্লো মেশিনের অধিকারী মস্তিষ্কের ভাবনার অনুপাতে, কোনো এক অতিব গোপন কারণে আমার দুই জেঠির মাঝে বিশেষ নিশ্চুপ দ্বন্ধ অর্থাৎ জেদাজেদি চলে। বিষয়টা অতিব গোপন না আবার প্রকাশ্যও না। জায়ে জায়ে খোঁচা মারা, ঠেস দেওয়া, জেদাজেদি চলবে এটাই স্বাভাবিক। তাদের এই শীতল, অকথ্য, চোখেচোখে শান্ত যুদ্ধ আমার নিরেট মস্তিষ্ক বোধ হয় এতকাল হালকার উপর ঝাপসা একটু বুঝতে পেরেছে কিন্তু এই বুদ্ধিহীন মস্তিষ্ক তার কারণ উদঘাটন করতে পারছে না। কারণ একইসাথে আমার মায়ের সাথে তাদের দুজনের সম্পর্ক পাল্লাপাল্লি পর্যায়ে অতিব সুন্দর এবং নম্র। ধ্রুব এবং শুভ্র এই দুটি বিখ্যাত নাম হওয়ার পেছনের কারণও বুঝি তাদের ওই নিরব দ্বন্ধ। এও বহু ঘাটাঘাটি এবং বহুল গবেষণার পরে নিজের সকল অকর্মণ্যতার বুদ্ধি ঢেলে একটু একটু আন্দাজ করেছে আমার মান্দাতার আমলের, দ্যা গ্রেট স্লো মস্তিষ্ক।

এই মূহুর্তে আমি স্লো মোশনে দৌড়ে আমার ঘরে গেলাম না। অটোমেটিক ভাবে পা দুটো পথ পাল্টে চলে এলো চিলেকোঠার ঘরে। আমি দরজায় হালকা টোকা দিলাম। সেটা আমার নিজের কানেই তেমন শোনা গেলো বলে মনে হলো না। অথচ ভেতর থেকে গম্ভীর গলার পুরুষ’টির স্বর ভেসে এলো,

‘কিছু বলবে?’

‘জি।’

‘বলো।’

‘এতো অভদ্র কেনো আপনি? ভেতরে আসতে না বলেন, এটলিস্ট দরজা তো খুলে কথা বলতে পারেন।’

তিনি দরজা খুললেন না। অবশ্য এটা আজ নতুন নয়। এক বছর থেকে হয়ে আসছে। ভেতর থেকে তিনি বললেন,

‘অভদ্র মানুষকে দরজা খুলতে বললে অভদ্র কাজ করে ফেলতে পারে। তখন?’

আমি মাথা নিচু করে বিরবির করে বললাম,

‘হক না! পারলে বিয়ে করে নিন। মুখ দিয়ে তিনবার কবুল আর হাত দিয়ে একটা সই করে দিলে কার কি এমন ক্ষতি হয়ে যাবে?’

তিনি বোধহয় শুনলেন। নাহলে ভেতর থেকে এই উত্তর কি করে এলো? কিন্তু শুনলেন কীভাবে? হাতির কান নাকি?

‘পাগলামো না করে যাও এখান থেকে। তোমার জন্য আমি ঘর ছাড়া হই তা নিশ্চয়ই চাও না?’

আমি কিছু বলার মতো খুঁজে পেলাম না। মিনিট কয়েক নিরব গড়ার পর আমার গলা কেমন ধরে এলো।

‘একটু খুলুন না। কথা দিচ্ছি এক নজর দেখেই দৌড় দিবো আর একটা কথাও বলবো না।’

পাষানের মন গললো না। তিনি দরজা খুললেন না মিনিট দশেক গড়িয়ে গেলেও আমি দীর্ঘশ্বাস বুকে বোঝাই করে চলে আসতেই খট করে দরজা খোলার শব্দ হলো৷ অতঃপর আমার অতি কাঙ্ক্ষিত পুরুষ’টি বের হয়ে এসে আমার চক্ষুদ্বয় শীতল করলেন। আমি মুগ্ধতায় খেই হারালাম। পাঁচদিন পর তার মুখটা দেখে আমার মনে হলো আদতে এই আশ্চর্য সুন্দর বদনখানি আমি পাঁচযুগ পর দেখলাম। আমার ঠোঁটে তখন বিশ্বজয়ের হাসি অথচ তিনি বললেন,

‘তোমার দাদুভাইকে বলো জানুয়ারিতে আমি বাসা ছেড়ে দিচ্ছি।’

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। চোখ যেনো কোটর থেকে বেরিয়ে আসবে। চোয়াল আমার ঝুলে গেলো। এহেন সব অবাকতার সাথে নিজেকে নিজেই শুধালাম,

‘মানে? আজকে অক্টোবরের ২০ তারিখ। নভেম্বর, ডিসেম্বর। দুই মাস? আমি কি কানে ভুল শুনলাম?’

আমার প্রিয় পুরুষটি বললেন,

‘নহে বালিকা! যা শুনিয়াছো ঠিকই শুনিয়াছো। তোমার অত্যাচার তো আর কুলানো যাচ্ছে না।’

আদতে তিনি এমন কিছুই বলেননি। সবই আমার কল্পনা। তিনি আমার কথার কোনো ধারই ধারেন নি। আমার চোখে পানি এলো না। কারন আমি জানি তার যাওয়া আমি অবশ্যই ঠেকাতে পারবো। কিন্তু আমার শখের পুরুষের শখের নারীটি কেনো আমি নই? এই ভেবে আমার বুক ক্রমশ ভারী হচ্ছে। আমি বুক ভরা মন খারাপ নিয়ে কেমন নিস্তেজ গলায় প্রশ্ন করেছিলাম সেদিন,

‘আচ্ছা, আমাকে আপনার দেখতে ইচ্ছে হয় না? আমি কি যথেষ্ট সুন্দরী নই?’

আমার শখের পুরুষ আচমকা তখন আমার দিকে ঝুঁকে এলো। তার পোড়া কালচে খয়েরি ঠোঁট এবং আমার মোলায়েম নুড লিপস্টিক লাগানো ঠোঁটের পার্থক্য কেবল তখন তিন ইঞ্জির। আমার পড়নে তখনো শাড়ি এবং তার গায়ে স্বভাবতো-ই নতুন জামাইয়ের মতো সাদা লুঙ্গি আর সাদা সেন্টো গেঞ্জি। আশেপাশে বাতাসের হই হুল্লোড়। রাস্তার হলদে নিয়ন বাতির আলো এসে তার উপর পরতেই তাকে দেখাচ্ছে বিয়ের বরের মতো। মনে হচ্ছে আজ তার গায়ে হলুদ। গলায় একটা গামছা আর গালে একটু হলুদের ছোঁয়া থাকলেই একদম পারফেক্ট হতো। অল্প বয়স্ক ছেলেদের লুঙ্গি পড়লে আমার কাছে বিদঘুটে লাগে। তবে আমার শখের পুরুষটিকে লাগে স্নিগ্ধ। আমি তার দিকে তাকিয়েই থাকি। ওই তামাটে বর্ণ, কালি পড়া গভীর দুটি নয়ন, সিল্কী এলোমেলো চুল, গোলগাল মুখ, এক গোছা দাড়ি। কি দেখে যে এতো পাগল হলাম আমি নিজেই জানি না। তবুও পাগল হলাম। অজান্তেই! আমি তখনও তাকে পর্যবেক্ষণ করছি ঘোর লাগা দৃষ্টিতে আর তিনি কন্ঠ খাদে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে আমাকে বলছেন,

‘ওভাবে চেয়ে দেখো না অঙ্গনা, তুমি ছারখার হবে!’

চলবে

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-২৯

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২৯
সূচনা কোমড়ে দু’হাত গুঁজে বলে,”এই তুই এখানে কি করিস? আবার গিটারও বাজাতে পারিস!”
“জাহিন বেশ অবাক হলো!এইটুকু পুঁচকে মেয়ে তাকে তুই করে কথা বলছে! এই যে দাদি আম্মা সাহস তো ভালোই এইটুকু ছানাপোনা হয়ে জিরাফের মত ছেলেকে তুই সম্বোধন!”
“এই একদম আমাকে দাদি আম্মা বলবি না বলে দিলাম৷ আমি সূচনা তালুকদার। বড় আম্মুকে বলে দিলে তোকে পিট্টি দেবে।”
“দারোয়ান এসে সূচনাকে ডেকে নিয়ে গেলো৷”
“সূচনাকে নিতে গাড়ি চলে এসেছে। বাসায় ফিরে দৌড়ে নয়নার রুমে গেলো৷ কিরে ময়না তুই সারাদিন পড়ার টেবিলে পরে থাকিস আর এদিকে তোর বর কি কি করে খবর রাখিস না?”
“নয়না ভ্রূ কুঁচকে তাকালো সূচনার দিকে৷ এই তুই স্কুল থেকে এসেই আমার রুমে কেন এসেছিস?”
“তোর বর স্কুলে গান গাইছিল সাথে গিটারও বাজাচ্ছিল৷”
“তোর ফাউল কথা রেখে যা তো। আমাকে পড়তে দে পরশু আমার কেমিস্ট্রি এক্সাম৷”
“এই কেমিস্ট্রি আবার কোনটারে টয়না? আমারে কেন পড়ায় না?”
“তুই যাবি?”
“তুই আমার সাথে যাবি? বিকেলে স্কুলে অনুষ্ঠান, তোর বর গান গাইবে শুনবি?”
“নয়না কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,ঠিক আছে তোর সাথে যাবো। কিন্তু এই কথাটা কাউকে বলবি না৷”
“বিকেলে নয়না ব্ল্যাক কালার আর সোনালি পারের জামদানি পড়লো, লম্বা চুল গুলো হিজাবের আড়ালে লুকিয়ে ফেললো৷ চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। সূচনাকে সাথে নিয়ে গাড়িতে বসলো৷ নয়নাদের আসতে আসতে একটু দেরি হয়ে গেছে স্কুলের গেট পার হয়ে কিছুদূর আসতেই কানে আসলো….
“আমি তোমাকে আরো কাছে থেকে
তুমি আমাকে আরো কাছে থেকে
আমি তোমাকে আরো কাছে থেকে
তুমি আমাকে আরো কাছে থেকে
যদি জানতে চাও, তবে
ভালোবাসা দাও ভালোবাসা নাও
ভালোবাসা দাও ভালোবাসা নাও
নদী কেন যায় সাগরের ডাকে?
চাতক কেন বৃষ্টির আশায় থাকে?
যদি বুঝতে চাও
আমি তোমার ওই চোখে চোখ রেখে
তুমি আমার এই চোখ চোখ রেখে
স্বপ্ন দেখে যাও, তবে
ভালোবাসা দাও ভালোবাসা নাও
ভালোবাসা দাও ভালোবাসা নাও
কাছে এলে যাও দূরে সরে
কত দিন রাখবে আর একা করে
মনে টেনে নেও
আমি তোমার ওই হাতে হাত রেখে
তুমি আমার এই হাতে হাত রেখে
আমি তোমার ওই হাতে হাত রেখে
তুমি আমার এই হাতে হাত রেখে
এসো এগিয়ে যাই।।”

নয়না সূচনার হাত ধরে এক প্রকার দৌড়ে স্টেজের সামনে চলে আসে, অশ্রু টলমল নয়নে সামনে তাকিয়ে থাকে অভিমান, অভিযোগের দৃষ্টিতে৷ এই মানুষটাকে কি নয়না ভালোবেসে ফেলেছে! নয়তো তাকে দেখে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে কেনো ইচ্ছে করছে! কেনো ইচ্ছে করছে শার্টের কলার শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করতে আপনি আমাকে কষ্ট কেনো দিচ্ছেন!
“জাহিনের দৃষ্টি নয়নার দৃষ্টিতে স্থির হলো, কয়েক সেকেন্ডের জন্য জাহিন থামলো। এরপর আবার গাইতে শুরু করলো৷ গান শেষ হওয়ার আগেই অভিমানে নয়না বাহিরের দিকে চলে যাচ্ছিলো৷
জাহিন গান শেষ করেই দ্রুত পায়ে নয়নার পিছুপিছু আসে। সূচনাকে গাড়িতে বসিয়ে নয়না উঠতে যাবে তখনই নয়নার হাতে টান পড়ে ৷ নয়না পিছু ফিরে রাগী কণ্ঠে বলে ডোন্ট টাচ।
“আচ্ছা ছেড়ে দিচ্ছি বলে তো যাও এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলে কেনো?”
“নয়না অবাক দৃষ্টিতে সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলেশহীন ভাবে বলে,আপনি সুদর্শন তাই আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম৷ দ্রুত গাড়িতে বসে ড্রাইভারকে বলে,চলুন দ্রুত৷”
“জাহিন অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! কি হলো? মেয়েটা বারবার তার সাথে এমন অদ্ভুত বিহেভিয়ার কেন করে? চেহারাটা নিষ্পাপ মনে হয় শত বছরের মায়া জমা হয়ে আছে৷”
“অন্তর এসে বলে,তুই এই মেয়ের প্রেমে একদিন মরবি।”
“শা’লা প্রেম কই পেলি!”
“তুই আমারে আর কোনোদিন শা’লা কইলে তোর ভবিষ্যৎ বৌ আমার।”
“হ আমার ভবিষ্যতে বৌ তোর বোন।”
” তাহলে সমুন্দী বল।”
“সুমুন্দির ছেলে কথা কম ক এবার এই মাইয়ার খোঁজ নে৷ এটার কাহিনি বের কর৷”
🌿
নয়না বাসায় এসে রুমের দরজা বন্ধ করে হাঁটুতে মুখ গুঁজে কান্না করতে লাগলো৷ হাতের উল্টো পিঠে চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে আলমারি থেকে নিজের ফোন বের করে সুইচড অন করলো৷ সামনাসামনি কিছু বলতে পারেনি কিন্তু এবার ফোনে ইচ্ছেমতো বকে দেয়ার ইচ্ছে নিয়ে ভিডিও কল করল।
“ওপাশ থেকে কোন রেসপন্স নেই৷ তৃতীয়বার কল রিসিভ হতেই নয়না চিৎকার করে বলে,আপনার কি হয়েছে! আপনাকে মাত্রই সুস্থ দেখে আসলাম।কোন হসপিটালে আছেন আমাকে বলুন৷”
“জিয়ান কোন কথা না বলে, নয়নার দিকে তাকিয়ে আছে। কোন এক অদ্ভুত কারণে সে নয়নাকে দেখলে তার সব কষ্ট উবে যায় সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।”
” কি হলো কথা বলুন..”
“স্যরি”
“নয়নার চোখ টলমল করছে৷ একটা সপ্তাহ পর লোকটাকে দেখলো কিন্তু একি মানুষ একি সময় দু’দিকে কীভাবে সম্ভব।”
“আপনি কোথায়?”
” জিয়ান ফোন ঘুরিয়ে দেখালো৷ কানাডার একটা হসপিটালে।”
“নয়না কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলো৷”
“এই শুনছো আমার রাঙা বৌ আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এজন্মে আর তোমাকে ছাড়বো না।”
“নয়না কান্না করছে৷”
“প্লিজ কান্না করো না৷ আমি এতোদিন পর তোমার চোখের অশ্রু দেখতে চাইনা৷ স্যরি আর কোনোদিন তোমাকে হার্ট করবো না৷”
“আপনি অসুস্থ হলেন কি করে?”
” এক ষোড়শী বালিকার হৃদয় ভাঙার অনুশোচনা আমাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে৷ তুমি কি জানো আমি তোমার সরলতার মায়ায় আবদ্ধ হয়ে গেছি। আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে নাতো?”
‘নয়না ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো৷ কান্না করতে করতে ঘুমিয়ে পরেছিলো হঠাৎ এমন স্বপ্নে নয়নার ঘুম ভেঙে যায়। উঠে চোখে মুখে পানি দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত দশটা বাজে।
আলমারি খুলে ফোন হাতে নেয়।
🌿
মান্নাত ওয়াশরুমের ফলসছাদে অন্ধকারে মুখ চেপে রেখে কান্না করছে। কিছুক্ষণ আগেই কিছু মানুষ এসে তার বাবা,মাকে তুলে নিয়ে গেছে। এখনো তারা তন্য তন্য করে পুরো বাসা তালাশ করছে। মান্নাতের কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে,ইঁদুর এসে একটু পর পর পায়ে আঁচড় কাটছে৷ এ কেমন অমানিশা গ্রাস করছে মান্নাতের সুন্দর জীবনকে? তার বাবা মাকেই বা কোথায় নিয়ে গেছে? মান্নাতের ভেতর থেকে চিৎকার আসছে। অথচ সে নিরুপায়। মান্নাতের মন বলছো, এই শহরের মানুষগুলো বড্ড নিষ্ঠুর ইট পাথরের মতই৷ পাশ ঘেঁষে এতো বাসা অথচ কেউ এগিয়ে আসলো তাদের সাহায্যে! হয়ত আমাকেও কোনো শকুন গিলে খাবে দিবালোকে কেউ ফিরেও তাকাবে না৷
🌿
জিয়ান এই এক সপ্তাহে দুইবার ফ্লাই করেছে এই ব্যতীত রুম থেকে বের হয়নি৷ হঠাৎ তার নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে।বারবার নয়নার নিষ্পাপ মুখশ্রী তার চোখের সামনে ভেসে উঠেছে৷ চোখ বন্ধ করলেই কানের সামনে নয়নার দুষ্ট মিষ্টি কথাগুলো বাজতে থাকে। জিয়ান চেয়েও নয়নাকে নিজের মন মস্তিষ্ক থেকে বের করতে পারছে না! অবশেষে আজ সে ছুটির জন্য অ্যাপ্লিকেশন করে বসেছে।তার মন এখন নয়নার উষ্ণতা ছাড়া শান্ত হবে না। তার চোখের তৃষ্ণা মিটবে না নয়নার দর্শন ব্যতীত৷ কত শতবার কল করেছে টেক্সট করেছে অথচ সেসব কিছুই পৌঁছায়নি৷ মনের কাছে পরাজিত হয়ে সে ছুটে যাচ্ছে তার প্রেয়সীর দাঁড়ে।
🌿
নাজিম চৌধুরী পায়ের উপর পা তুলে,চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলেন,তোমার ছোট ছেলেকে বোঝাও। আমার পক্ষে একা একা এত বড় বিজনেস সামলানো এখন আর সম্ভব না। আর ওই বাড়িতে খবর নিয়েছো মেয়েটা এখন কেমন আছে? এক্সাম শেষ হলে যত দ্রুত সম্ভব আমার বৌ আমি নিয়ে আসবো৷
“মিতা বেগম বললেন,জাহিন কি আমার কথা শুনবে? তুমি একবার বলে দেখো। আর সুনয়নাকে দেখতে আবার যাবো কাল৷ তুমিও আমার সাথে যাবে?”
“নাজিম চৌধুরী চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বলে,ভেবে দেখছি৷”
🌿
রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ নয়নার চোখে ঘুম নেই বই নিয়ে পরে আছে। হঠাৎ জাহানারা বেগম রুমে এসে বলে,তুই কি অর্ডার করেছিস নয়না? এত রাতে ডেলিভারি ম্যান এসে বিরক্ত করছে?
“নয়না অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,আমি কিছু অর্ডার করিনি৷”
“আয় দেখে যা গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে ডেলিভারি বয়। তোর হাতে ছাড়া দেবে না।”
“নয়না ভ্রূ কুঁচকে উঠে আসলো৷ দরজা খুলতেই লোকটা বলল, আপনি সুনয়না চৌধুরী?”
“নাহহ আমি সুনয়না তালুকদার।”
“চৌধুরী বাড়ির বড় বৌ না আপনি?”
” জাহানারা বেগম বলেন হ্যাঁ আমার মেয়ে চৌধুরী বাড়ির বৌ।”
“হাতে থাকা দুইটা বুকে নয়নার দিকে বাড়িয়ে দিলো,একটাতে ফুল আরেক টাতে চকোলেট। আরেকটা বেশ বড়সড় বক্স দিয়ে বলে,ম্যাম এগুলো আপনার জন্য।”
“নয়না কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই লোকটা চলে গেলো৷”
“রুমে এসে সব কিছু নিয়ে চুপচাপ বসে আছে৷ এতোগুলা চকোলেট, ফুল কে তাকে একসাথে পাঠাবে! এই বক্সেই বা কি আছে?”
‘নীলাঞ্জনা হেসে বলে,তোর বর তোকে বড্ড ভালোবাসে মনে হচ্ছে। দেখ কত কিছু পাঠিয়েছে। আমাকেও কম কিছু বলেই চুপ করে গেলো৷
“নয়নার ইচ্ছে করছে নীলাঞ্জনার চুল ছিড়ে ফেলতে৷ এইগুলোও যদি প্লেন ড্রাইভার আপনার কাজ হয় তবে আপনার একদিন তো আমার যতদিন লাগে প্লেন ড্রাইভার বাচ্চা।
#চলবে
আসসালামু আলাইকুম প্রিয় পাঠক/পাঠিকা সবাইকে পবিত্র মাহে রমজান শুভেচ্ছা ❤️

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-২৮

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২৮
চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করলো নয়না৷ তার পায়ের কাছেই বসে আছে জাহানারা বেগম।
“নয়নার জ্ঞান ফিরেছে এটা দেখেই দ্রুত সামনে এগিয়ে এসে নয়নার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,এখন কেমন লাগছে মা?”
“নয়নার চোখে অশ্রু টলমল করছে। ইচ্ছে করছে তার মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে।”
“নার্স এসে বলল,একটু সময় দিন এখন কেউ রোগীকে ডিস্টার্ব করবেননা৷”
“নয়না পাশ ফিরতেই চোখ পরলো মিতা বেগমের দিকে৷
“এগিয়ে এসে নয়নার চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুটুকু মুছে দিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলেন, দ্রুত সুস্থ হয়ে যাও।”
“নয়নার কেনো যে ইচ্ছে করছে না কারো কথার উত্তর দিতে!
রাতেই নয়নাকে বাসায় আনা হয়েছে। নয়না জাহানারা বেগমের রুমে। একবারের জন্য ও নিজের মোবাইলটার খোঁজ করেনি। বালিশে হেলান দিয়ে বসে আছে চোখভর্তি অশ্রু মস্তিষ্ক ভর্তি টেনশন।
” হঠাৎ মাহবুব তালুকদার একগাদা লাল শাক নিয়ে রুমে ডুকলেন৷ ফিল্মি স্টাইলে হাঁটু মুড়ে জাহানারা বেগমের সামনে শাকগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলে হ্যাপি হাগ ডে।
“জাহানারা বেগম ভ্রু কুঁচকে বলে,বুড়া বয়সে ভীমরতিতে ধরছে!
“নয়না হাসছে।
“মাহবুব তালুকদারের হৃদয় ও যেনো হাসছে। পৃথিবীতে এই একটা নারী যার চোখের কোনে অশ্রু তার সহ্য হয়না। কিভাবে তার মুখে হাসি ফিরিয়ে আনবে পৃথিবীর সব সুখ তার পায়ে এনে রাখবে সেটাই যেনো তার প্রধান কাজ।”
“নয়না হাসিমুখে বলে,আম্মা বাবা তোমাকে এখনো কত ভালোবাসে দেখছো! হাগ ডে’তে শাক নিয়ে এসেছে।”
“নয়নাকে দুইপাশ থেকে দুজন জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু দিয়ে বলে,এভাবে হাসবি, তুই হাসলেই আমাদের পৃথিবী হাসে। তোর মন খারাপে আমাদের পৃথিবীতে ভুমিকম্প শুরু হয়।”
” নয়না শুধু এই মানুষ দুটোর জন্য সেদিন বিয়েতে অমত করতে পারেনি। এদের ভালোবাসার কাছে তার সব কষ্ট সব ত্যাগ তুচ্ছ।”

“জানালার গ্রীল আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে জিয়ান। মোবাইলটা ভেঙে ফেলেছে। চোখ দুটো বন্ধ করলেই ভেসে উঠছো এক অসহায় নিস্পাপ মুখশ্রী। জিয়ানের এখন সিগারেট প্রয়োজন কিন্তু সিগারেট তার হাতের নাগালে নেই।
জিয়ান বেডের উপর বসলো। চোখ বন্ধ করে বলে,স্যরি পাখি আমি না চাইতেও বারবার তোমার কোমল হৃদয়ে আঘাত করছি। আমি তোমার মায়ায় জড়িয়েছি খুব অল্প সময়ে। মায়াবতী তোমার মায়া কাটবে কিনা জানি না৷ তবে আমি তোমার ভালোর জন্য আমাকে তোমার থেকে সরিয়ে নেবো৷ আমি তোমার কষ্টের কারন হতে চাইনা। তবুও আমিই অপরাধী তোমার ছোট হৃদয়টাকে ক্ষতবিক্ষত করার অপরাধে। তোমাার মত নিষ্পাপ এক ফুলকে কলুষিত করেছি আমি আমাকর ক্ষমা করে দিও মায়াবতী।

🌿
সায়নার পাশে অনিকেত চুপচাপ বসে আছে। একি রিকশায়। অনিকেত বাস্তবতা বোঝে সে জানে পৃথিবী কতটা কঠিন৷ বাবা, মা না থাকলে তার দুনিয়া কত নির্মম।
” এই যে হার্টের ডাক্তার আপনি হার্টের ডাক্তার হয়ে আমার হার্টের চিকিৎসা কেন করবেননা?”
“তুমি না জাহিনকে ভালোবাসো।”
” ভালো আমি এজন্মে কাউকে এখনো বাসিনি৷ তবে জিয়ান আর জাহিন ভাইয়া আমার চাইল্ডহুড ক্রাশ৷ জিয়ান ভাইয়া রাগী গম্ভীর সব সময় পড়ালেখা আর পড়ালেখায় ডুবে থাকতো। তাই আমার পছন্দ ছিলো জাহিন৷ ছোট থেকে ও কোন বিষয়ে বেশী সিরিয়াস হয় না৷ সব সময় নিজের মন মর্জি মত চলতো। তাই ভেবেছিলাম এরে বিয়ে করে আমিও মনমতো ঘুরতে পারবো। লাইফে সুদর্শন ছেলে আর টাকা দুটো একসাথে পেলে কেউ হাত ছাড়া করতে চায়?”
“আমার তো দুটোর একটাও নেই?”
” আপনার আছে সুদ্ধ মন পবিত্র দেহ। আপনি ওইদিন বলেছিলেন আপনার শরীর টাচ করতে না। কারন এটা আপনার ভবিষ্যত বৌয়ের আমানত ব্যাস আমি আপনার উপর ফিদা। বিয়ে করলে আপনাকেই করবো৷ আর হ্যা যথেষ্ট সুদর্শন আপনি আর ডাক্তাররা আবার গরীব ও হয়! আমাকে বোকা মনে হয় আপনার?”
“অনিকেত শান্ত কন্ঠে বলে,আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবো না আমি নিজেও জানিনা আমার বাবা মা কে? এমন পিতৃ পরিচয়হীন ছেলের কাছে কোন পরিবার নিজের মেয়ে দেবে?”
“পরিবারের দিতে হবে কেন? মেয়ে নিজেই আপনার কাছে চলে আসবে৷”
“দূরত্ব ঠিক রেখে কথা বলুন।”
” সায়না হুট করে এক অকাজ করে বসলো। হঠাৎ অনিকেতর হাতদুটো ধরেই ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো অনিকেতের ঠোঁটে। প্রথমবার কোন নারীর স্পর্শে অনিকেতের শরীরে যেনো বিদ্যুৎ বয়ে গেলো।”

🌿

লাবিব বাসায় আসতেই তার বাবা তাকে বকাঝকা করলো এরপর ঠান্ডা মাথায় ব্রেইন ওয়াশ করলো৷
“লাবিব বসে আছে একটা হোটেল রুমের সোফায়। তার নতুন গার্লফ্রেন্ড সোনিয়াকে নিয়ে এসেছে৷ সোনিয়া নিজেই তাকে এখানে আসার অফার করেছে৷ লাবিব মনে মনে ভাবলো এই মেয়ে বড়লোক হলে তো আর নীলাঞ্জনা বেবিকে ফিরিয়ে আনবো না। লাবিব সোনিয়ার হাতের উপর হাত রেখে বলে,বেবি ইউ আর সো বিউটিফুল। এই ড্রেসটা পরে আসো বেব।”
” সোনিয়া এক চোখ টিপে বলে,ড্রেসের কি দরকার সোনা৷বলেই দুজন কাছাকাছি আসলো। হঠাৎ সোনিয়া একটা ছু’ড়ি বের করে লাবিবের গলায় ধরে বলে,শা’লা যা আছে বের কর নয়ত এখানে তোর লাশ ফেলে রাখবো। একদম শক্তি দেখানোর চেষ্টা করবি না এখানে সব আমার লোক।”
🌿

গোটা একটা সপ্তাহ কেটে গেছে এরমধ্যে জিয়ান নয়নার কোন যোগাযোগ হয়নি৷
“হসপিটাল থেকে ফিরে নয়না পড়ালেখায় ব্যস্ত হয়ে পরেছে৷ সে যেনো তার মনের সাথে যুদ্ধ করেই এইভাবে কাউকে ভুলে থাকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দুটো পরিক্ষা শেষ। মোবাইল বন্ধ করে আলমারির ড্রয়ারে রাখা সেটা একবারের জন্য ও ধরেনি নয়না৷ এখন সূর্য অস্ত যাওয়ার সময়। নয়না বারান্দায় এসে দোলনায় বসলো, মাঝে এখানে বসে সে আনমনে কবিতা আবৃত্তি করে,সূর্য ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামছে নয়নার চোখের কোন ভিজে উঠেছে অজানা কারনে৷ তার কেন মন খারাপ লাগছে! কেনো না চাইতেও চোখদুটো ভিজে উঠছে! মানুষ কি এতো সহজে কারো মায়ায় আটকে যেতে পারে? কোন মানুষকে কি এতো সহজেই হৃদয়ে জায়গা দেয়া যায়? আচ্ছা আমরা কি নিজের ইচ্ছেতে কারো মায়ায় আবদ্ধ হতে পারি? অথবা ভালোবাসতে পারি? হৃদয় তো মস্তিষ্কের মত না যে এসব ভেবেচিন্তে করা যায়! সেতো নিজের মত চলে মন আর মস্তিষ্কের দ্বন্দ্বে আমাদের কাকে প্রধান্য দেয়া উচিৎ? মন আর মস্তিষ্ক কেনো আলাদা চলে? এসব প্রশ্ন যেনো নয়নাকে ঘীরে ধরেছে অথচ উত্তর মেলাতে সে ব্যর্থ! সূর্যের রক্তিম ভাবা টুকুও বিলুপ্ত হওয়ার পথে, নয়না উঠে দাঁড়িয়ে আনমনে বলছে,
“আমি চাইনা তুমি আমাকে সূর্যের মত ভালোবাসো যার প্রখরতা বিলুপ্ত হয়ে যায় আঁধারে,
আমি চাইনা তুমি আমায় চাঁদের মত ভালোবাসো,
যার সৌন্দর্য হারিয়ে যায় দিনের আলোয়।
আমি চাই তুমি আমায় আকাশের মত ভালোবাসো,যে ক্ষনে ক্ষনে বদলাবে তবুও ছেড়ে যাবে না৷ সব সময় স্থীর থাকবে আমার পাশে।”
“নীলাঞ্জনা পাশ থেকে বলে,বাহহ সুন্দর বলেছিস তো। তা খুব ভালোবাসিস বুঝি?”
“নয়না কোন উত্তর না দিয়ে রুমে চলে আসলো, জায়নামাজ নিয়ে ফ্লোরে পেতে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো৷ আর কোন সময় নামাজ পড়ুক আর না পড়ুক পরিক্ষার সময় নয়নার নামাজ যেনো মিস হয় না৷
” নীলাঞ্জনা হাসছে। ছোট বেলা থেকেই নয়না এক্সামের নামাজি। নীলাঞ্জনা একসপ্তাহ ধরে এবাসায় কেউ তার খোঁজ নেয়নি৷ সে খাচ্ছে ঘুমাচ্ছে। কেউ তাকে কিছুই জিজ্ঞেস করছে না। কাছে ডাকছে না! সবার এই নিরবতা নীলাঞ্জনাকে যেনো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
🌿
“নয়না চিৎকার করে বলে,আপনার দুঃখ, আপনার কষ্ট, আপনার সেক্রিফাইস, আপনার হৃদয়ের ক্ষত। সব দিকে আপনি আর আপনি! স্বার্থপর মানুষ আপনি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দেখতে পাননা!আপনার এতো কিছুর মধ্যে আমি কোথায়? আমার ক্ষত বিক্ষত হৃদয় একবারও আপনার দৃষ্টিতে পরেনি? একবারও আপনার মন বলেনি আপনি অন্যায় করছেন আমার সাথে?আপনার এতোকিছুর ভীড়ে ভিক্টিম কার্ড প্লে করছি আমি!” জিয়ান ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। বেড সাইড ল্যাম্প জ্বালিয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিলো৷ তারমানে এসব স্বপ্ন ছিলো।মোবাইল হাতে নিলো । নতুন মোবাইল কিনেছে৷ মোবাইলের স্কিনে তারিখ দেখে বলে,আজ একটা সপ্তাহ আমাদের কথা হয় না৷ রোজ আমার তোমার কথা মনে পরে তোমার কি আমার কথা মনে পরে না ষোড়শী? তোমার এক্সাম কেমন হচ্ছে জানা হলো না৷আমি তোমাকে আমার করতে পারবো না৷ আমি তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। তবুও চাই তুমি ভালো থাকো। আমি তোমার অপরাধী তুমি কখনো আমার অপরাধ ক্ষমা করে আমাকে আপন করতে পারবে না৷ আমি বারবার তোমাকে হার্ড করেছি বারবার তোমার কোমল হৃদয়ে গভীর আঘাতে জর্জরিত করেছি। ক্ষমা যাওয়ার ভাষা টুকুও আমার কাছে নেই৷ আমি জানি তুমি ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো আমার মত অপরাধীকে না৷ মোবাইলের স্ক্রীনের আলো নিভে যাচ্ছে জিয়ান আবার জ্বালাচ্ছে। সেখানে জ্বলজ্বল করছে তার ষোড়শী রমনীর হাসোজ্জল মুখশ্রী।
#চলবে৷

অর্ধাঙ্গিনী পর্ব-২৭

0

#অর্ধাঙ্গিনী
#নুসাইবা_ইভানা
#পর্ব -২৭
নয়না আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরুন করছে আর মিটি মিটি হাসছে, বারবার যেনো তার কানে রাঙা বৌ শব্দটা বাড়ি খাচ্ছে! ষোড়শী হৃদয়ের প্রেম ভয়ংকর তা কেবল প্রেম না প্রথম অনূভুতি হৃদয়ের দরজা খুলে কারো উপস্থিতি।
লম্মা চুলগুলো সম্পূর্ণ না আঁচড়ে বেডে এসে বসলো তার এখন ইচ্ছে করছে নাচতে। গান খুঁজতে লাগলো মনমত গান না পেলে নাচ জমে না৷ নাচটা তো ভেতর থেকে আসতে হবে৷
নয়না উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে নাহহ নীলাঞ্জনাকে কোথাও দেখতে পেলো না৷ দরজা বন্ধ করে সাউন্ড বক্সে গান ছেড়ে নাচ শুরু করতেই৷ নয়নার ফোনটা স্ব শব্দে বেজে উঠলো, বিরক্ত নিয়ে মোবাইল হাতে তুলে বলে,এই সময় আবার কার ডিস্টার্ব করতে হলো? স্কিনে তাকাতেই নয়নার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। সাথে সাথে রিসিভ করেই বলে,কে যেনো বলেছিলো প্রথম এক্সামের পর কথা হবে!
“কারো অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখার পর মনটা আঁকুপাঁকু করছিলো তাই মনটাকে বোঝাতে অক্ষম হয়ে কল দিলাম।জিয়ান নয়নার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে! মনে মনে বলে,মেয়েদের মন বোঝা নয়রে নয় সোজা। হটাৎ আমাবস্যা হঠাৎ জোছনা।
” এভাবে তাকিয়ে কি দেখছেন?
“একটু আগেই না কাঁদছিলে ফুলটুসি আর এখন যেনো দাঁত দিয়ে মুক্ত ঝড়ছে!
” আপনার জন্য কি সারাক্ষণ কান্না করব!
“সারাক্ষণ তো দূরের কথা আমার জন্য কখনো কান্না করবে না। চোখের পানি আমার সহ্য হয় না৷
” কিন্তু আমি তো কোন কারনে কান্না শুরু করলে পাক্কা দেড় দু’ঘন্টা কান্না করি। তারপর আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখি কান্না করে আমাকে কেমন লাগছে।
“জিয়ান অট্টহাসি দিয়ে বলে,আগে তোমাকে পাগল ভাবতাম আজ কনফার্ম হলাম।
” ফোন রাখুন তো এখন আমি নাচবো।
“জিয়ান চোখ বড় বড় করে বলে,তুমি নাচতে পারো!
“জিয়ানের কথায় ভ্রু কুঁচকে নয়না বলে,
নাচতে পারি মানে!আমার নাচ দেখলে আপনি নোরা ফাতেহির নাচ ভুলে যাবেন৷
‘নাহহহ এ আমি বিশ্বাস করি না৷
‘নয়না রাগে নাচা শুরু করলো৷
“এক পাগলি কে রাগিয়ে দিয়ে মোবাইলের অপর পাশের ব্যাক্তিটি মুগ্ধ নয়নে নাচ দেখতে ব্যস্ত।
” নয়নার হঠাৎ চোখ আটকালো জিয়ানের উপর। সাথে সাথে থেমে গেলো।
“জিয়ান এখনো যেনো আটকে আছে তার রাঙ বৌয়ের নৃত্যে।
” এই যে মিস্টার প্লেন ড্রাইভার এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে নজর দিচ্ছেন কেন হু?
“আমার জিনিস আমার নজর আমি দেবো না তো কে দেবে?
” আপনার জিনিস মানে?
“জিয়ান বুঝতে পারলো হুঁশ হারিয়ে ভুল বলে ফেলেছে।আমারই তো। মোবাইলটা কে কিনে দিয়েছে হু।
” কিনে দিলেও কি এটার মালিক এখন আমি।
” তোমার মালিক তো আমি।
“ইশশ শখ কত!
” বহুত শখ সুইটহার্ট। এই মূহুর্তে শখ হচ্ছে তোমার গলার নিচের কালো তিলটাকে আমার ঠোঁটের উষ্ণ ছোয়া দেয়ার।
“নয়না ওড়না টেনে তিলটা ঢেকে বলে,মুখে কিছু আটকায় না?
” কে বললো আটকায় না! কত কিছুই তো আটকে রাখি৷ তুমি ষোল বছরের পুটিমাছ বলে।
“শুনেন মিস্টার জিয়ান রেজা চৌধুরী আমি সুনয়না তালুকদার বয়স আমার সবে ষোল তবে বিয়ে হলে আমার একটা বাচ্চাও থাকতো৷
” নিজেই এক বাচ্চা আবার আসছে বাচ্চা থাকতো৷ এই তোমার এতো ডার্টি মাইন্ড জানা ছিলো না তো!
“সরেন আপনার সাথে কথাই বলবো না৷
” রাঙা বৌ তোমার জন্য একদম পার্ফেক্ট শব্দ।
“আমি সিঙ্গেল এসব বৌ টৌ আমাকে কইবেন না কইয়া দিলাম।
” আইছে আমার সিঙ্গেল ছেমড়ি!অর্ধেক বাসর সেরে সে আবার সিঙ্গেল।
“নয়না দাঁত কিড়মিড় দিয়ে বলে,আপনাকে কিন্তু কামড় দিবো।
” কাম অন বেবি কোথায় কোথায় কামড় দিবে দাও। আমি রেডি তোমার কামড় খেতে। ইশশ এতো কিউট বৌয়ের কামড় খাবো ভাবতেই কেমন কেমন ফিল হচ্ছে।
“অসভ্য ড্রাইভার একদম চুপ করুন নয়ত ছ্যাপ দিয়ে দৌঁড় দিবো।
” জিয়ান চোখ টিপে বলে,বুড়া বয়সে আমার কুয়াড়ার কৌটা তুমি ছ্যাপ দিলে আমি তোমার আঁচলে মুছে নেবো৷
“নীলাঞ্জনা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বলে, নয়ন কইরে? আমাকে একটা তোয়ালে দে তো।
” জিয়ান নীলাঞ্জনার কন্ঠ শুনেই চিনে ফেললো,এতোদিন পর সেই চিরচেনা কন্ঠ ধ্বনি কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই জিয়ানের চোয়াল শুক্ত হয়ে গেলো। হাস্যজ্বল চেহারা রক্তিম বর্ণ ধারন করল, চোখ থেকে যেনো অগ্নি ঝড়বে!
“নয়না কিছু বলার আগেই জিয়ান বলে,তোর রুমে এই মেয়ে কি করে! কেন জায়গায় দিয়েছিস ওকে? তোদের বাসায় রুমের অভাব!
” আজকেই তুই আমার বাসায় চলে যাবি এর আগে তোর সাথে আমার কোন কথা নেই।
“জিয়ান নয়নাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নিজের ফোনটা ছুড়ে মারলো ফ্লোরে৷ সাথে সাথে ফোনটা ভেঙে ফ্লোরে পরে রইলো৷
” নয়না কান্না করছে৷ নয়নার শরীর কাঁপছে৷ ঠিক এই রুপটা সে আরো একবার দেখেছে। নয়না চিৎকার করতে চাইছে কিন্তু তার মুখ থেকে শব্দ আসছে না৷ প্যানিক আ্যাটাক করেছে নয়নার৷
“নীলাঞ্জনা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখে, নয়নার হাত পা কাঁপছে চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝড়ছে।
নীলাঞ্জনা নয়নাকে জড়িয়ে ধরে বলে,নয়ন তোর কি হয়েছে! বল আমাকে বোন আমার৷ নয়না কিছু বলতে পারছে না নীলাঞ্জনা আঁকড়ে ধরে আছে৷ সেদিন রাতের দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভাসতে লাগলো। ধীরে ধীরে নয়নার চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেলো৷
🌿অনিকেত আজ খুব বিরক্ত। এই হসপিটালের পর চেম্বারে বসাটা তার কাছে মহা বিরক্তের কাজ৷ কিন্তু টাকার তো দরকার আছে জীবনে৷ একটা রোগি দেখলে সাতশ টাকা ভিজিট৷ এই ইনকাম তো কোন ডাক্তার মিস করতে চাইবে না৷
হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এগারোটা ছুঁই ছুঁই ইচ্ছে করছে সব রুগে রেখে পালাতে! এটাই শেষ রোগি আজকের। ৫০ নাম্বার সিরিয়াল।
” রোগি এসে বসে আছে।
‘অনিকেত এতোক্ষণ চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো৷ মাত্র চোখ খুলে বলে আপনি?
“ডাক্তার আমার হৃদয়ে ব্যথা আপনি তো কার্ডিওলজি ডাক্তার আমার হার্টের রোগ ঠিক করে দিন।
” সায়নার কথা শুনে অনিকেত বলে,আপনার কাছে কি এসব কৌতুক মনে হচ্ছে! সকাল আটটায় বের হয়েছি এখন পর্যন্ত ঠিকমতো শ্বাস নিতে পারিনি৷ আর আপনি এই তিন ঘন্টা ধরে এই আজাইরা আলাপ করার জন্য বসে ছিলেন!
“আপনার মত রসিক মানুষ রাগও করতে পারে?
” অনিকেত কোর্ট গায়ে পরতে পরতে বলে,আমি এখন বের হবো।
“সায়না অনিকেতের পেছন পেছন বের হয়ে বলে,আপনার বৌ নেই আমার বর নেই। আমাদের মধ্যে কত মিল তাই না?
” মিল নেই। আপনার বাবা মা সব আছে আমার তিন কূলে কেউ নেই এক হলো কি করে!
“বিয়ে করবেন আমায়?
” অনিকেত থমকে দাঁড়ালো৷ রিকশা ডেকে সায়নাকে উঠতে ইশারা করলো। সায়না উঠে বসতেই অনিকেত রিকশা ওয়ালা মামাকে বলে,মামা এনাকে বাসায় পৌঁছে দিবেন।
“সয়না দ্রুত নেমে অনিকেতের হাত ধরে বলে,এই রাতে একা কি করে যাবো! দয়ামায়া নেই নাকি?
” হাত ছাড়ুন আমার শরীর আমার বৌয়ের জন্য সংরক্ষিত, এখানে টাচ করা অন্য নারীর জন্য অবৈধ।
🌿মান্নাত চোখ বন্ধ করে বলে,আই লাভ ইউ।
“জাহিন অবাক হলো না৷ মেয়ে মানুষ নার্ভাস হয়ে গেলে ভুলভাল কাজ করে বসে। জাহিন একটা পানির বোতল এগিয়ে দিয়ে বলে,আপনার মাথায় পানি ঢেলে মাথা ঠান্ডা করুন নয়ত পাগল ভেবে মানুষ আপনাকে মারবে।
” মান্নাত চোখ খুললো,আবার বলল,আমার আপনাকে ভাল্লাগছে। ম্যারি মি?
“জাহিন মান্নাতের দিকে তাকিয়ে বলে,বয়স কত তোমার! সর্বোচ্চ সতেরো কিংবা আঠারো।
” এরমধ্যেই মান্নাতের মা এসে বলে,এখানে কি হচ্ছে?
“জাহিন প্রস্থান করতে করতে বলে,আপনার মেয়ের মাথায় সমস্যা রাস্তাঘাটে তাকে একা ছাড়বেন না আন্টি।
” মান্নাত ভয়ে চুপসে গেলো। এইরে এবার আর রক্ষে নেই! মিন মিন করে বলে,আসলে আম্মু হয়েছে কি জানো?
“আমি কিছু জানতে চাই না। বাসায় চল আজ বোঝাবো কত ধানে কত চাল।
” আমি তো বুঝি আম্মু, যতটুকু ধান চাল তো ততটুকুই হবে। মান্নাত জিহ্বায় কামড় বসালো ভুল টাইমে ভুল কথা বলে ফেলেছে। আজ বাসায় গেলে তুলকালাম হবে।

“জাহিন ফিরে আসতেই অন্তর বলে,তুই আবার কবে থেকে মেয়েদের চেক আউট করছিস! সেদিন স্কুলে আজ আবার রাস্তায়!
“চুপ কর শা’লা জাহিন চৌধুরী মেয়েদের চেক আউট করে না। মেয়েরা জাহিন চৌধুরীকে চেক আউট করে।
” কতবার বলেছি শা ‘লা না সুমুন্দি বলবি।
“ঘাড়ের নিচে না খেতে চাইলে চল এখান থেকে।
” ছিহহহ আমি মেয়ে না তুই লেস.. কবে হলি।
“শা ‘লা এবার তোর রক্ষা নেই।
‘অন্তর দৌড় দিয়ে বলে,তুই সুযোগ পেলেই আমারে হেনস্তা করিস আজ দেখ কেমন লাগে।
” তোরে একবার পাই তোরে ঠিক জায়গায় কিক মেরে তোর পরবর্তী প্রজন্ম অন্ধকার করে দেবো।
#চলবে