Friday, July 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 135



বিয়ে থা পর্ব-৩৭+৩৮

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব- ৩৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

বড়পর্ব-১

শিলিগুড়ির একটি হোটেলে উঠেছে তারা। ধ্রুব একহাতে ট্রলি ও অন্য হাতে নিনীকার এক হাত চেপে ধরে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। ট্রলি সাইডে রেখে ঠাস করে বন্ধ করে দিলো দরজা। নিনীকার ধরে রাখা হাত টেনে নিজের কাঁধে রাখলো। কোমড়ে হাতের শক্ত বাঁধন স্থাপন করে অপলক তাকিয়ে রইলো।

‘ আমি কিন্তু এসেছি, তুমি কি এবারও বলবে না মিসেস? ‘

নিনীকা জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। দুজনের দৈহিক স্পর্শ গাঢ় হচ্ছে। ধ্রুব চোখে অন্ধকার দেখলো। টেনে নিয়ে ফেললো নরম বিছানায়।

এর আগে নিনীকা এমন এগ্রেসিভ হয়েছে কি না বুঝতে পারছে না ধ্রুব। আজকের সবটুকুতে নিনীকা ভীষণ শক্ত ছিল। ধ্রুব দূর্বল হলেও টেনে আবার ঠিক করে নিয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছে বার-বার। ধ্রুব আজ যেনো এক নতুন নিনীকাকে দেখেছে। কেমন অস্বাভাবিক আচরণ! স্বাভাবিক মানুষের দৈহিক চাহিদা কখনো এরূপ হয়না। দূরত্বের পর কাছাকাছি এলেও না! ধ্রুব মুখ তুলে নিনীকার ক্লান্ত মুখশ্রীর দিকে তাকালো। বন্ধ চোখজোড়া, গালে শুকিয়ে যাওয়া জলের চিহ্ন। মোমের মতো শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে যেনো। ধ্রুব তো এমন চায়নি! তবে কেন নিনীকা ইচ্ছে করে নিজেকে এতোটা তুলে ধরলো। ওর কি কোনো প্রব্লেম আছে!

ধ্রুব মাথা চেপে ধরলো। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে সব। নিজের শরীরের অবস্থাও ভালো না। নিনীকা নিজেকে ছিন্নভিন্ন করার পথ তৈরি করার সাথে সাথে ধ্রুবকেও ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে।

এতো ডার্ক বিষয় নিয়ে ধ্রুব কখনো ভাবেনি। তবে আজ ভাবতে হচ্ছে। নিনীকার বড়ো হওয়া স্বাভাবিক নয়। চিন্তা ভাবনাও স্বাভাবিক নয়। কিন্তু ধ্রুব ওকে যখন হলে রেখে গেছে তখন স্বাভাবিক ছিল। এতো উত্তেজিত, চেহারার এই হাল কিছুই আগে ছিল না।

নিনীকা ফোনে স্বীকার করেছিল রাত জাগে। কেন! ধ্রুবর জন্য? কিন্তু ধ্রুব তো প্রতিদিন ফোন করে খুঁজ নিতো। দৈহিক ভাবে দূরত্ব থাকলেও মন তো সবসময়ই দুজনের কাছে দুজনের পড়ে থাকতো। নিনীকার এই হালের জন্য দায়ী কি শুধু দৈহিক দূরত্ব? নাকি সাথে আরও কিছু একটা রয়েছে যা ধ্রুব ধরতে পারছে না।

ধ্রুব অসহায় চোখে তাকালো। কি এমন কারণ থাকতে পারে। কি হতে পারে। যা সে মিস করে যাচ্ছে। তার মিসেসের গুরুতর কোনো প্রব্লেম হয়েছে, নাহলে এমন অস্বাভাবিক আচরণ কেন করবে!

ধ্রুব শরীরে প্যান্ট চাপিয়ে ওয়াশরুমে ছুটলো। একেবারে গোসল করে বের হয়ে নিনীকাকে ওই অবস্থাতেই কোলে নিয়ে শাওয়ারের নিচে ছেড়ে দিয়ে আসলো। নিনীকা নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইলো। ধ্রুব একটু শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ চুপচাপ গোসল করে বের হও। আমি ড্রেস বের করে দিচ্ছি। ‘

নিনীকা বের হলো কাঁপতে কাঁপতে। ধ্রুব বিছানা ঠিকঠাক করে ফেলেছে। নিনীকাকেও কাঁথার তলে ঢুকিয়ে দিলো। নিজে আধশোয়া হয়ে থাকলো। মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে লাগলো।

‘ ঘুমাতে চেষ্টা করো। ‘

নিনীকা মুখ বের করে তাকালো।

‘ অনেক কষ্ট হচ্ছে। ‘

ধ্রুব অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ এতো এগ্রেসিভ হলে কেন? নিজেও ডুবলে আমাকেও ডুবালে। একটু সহ্য করো, আমি বের হয়ে খাবার ও ঔষধ নিয়ে আসছি। খবরদার এই অবস্থায় বের হয়ে যেও না। ‘

ধ্রুব উঠে দরজা পর্যন্ত যেতেই নিনীকা ডেকে উঠলো।

‘ ওয়ালেট তো নিয়ে যাও। ‘

ধ্রুব বের হতে গিয়ে ও ফিরে এলো। কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে হেসে ওয়ালেট নিয়ে বের হয়ে গেলো।

নিনীকার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগলো। নিজের উপর ঘৃণা হতে লাগলো প্রচন্ড ভাবে। এটা তার কি হলো!

নিনীকার বুক খা খা করছে। এতো একাকিত্বে সে কখনো ভুগেনি। বিগত কয়েকদিন যাবত সে মারাত্মক ডিপ্রেশনে কাটিয়েছে। আজকের এসব যদি ডিপ্রেশনের প্রভাবে হয় তো তাকে এমন ভয়ংকর ডিপ্রেশন থেকে বের হতে হবে। ধ্রুবকে বলতে হবে।

নিনীকার কন্ঠরোধ হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাস অস্বাভাবিক। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। দু’হাতে মাথার চুল খামচে ধরলো। তার নিজেকে কোনো মানসিক রোগী মনে হচ্ছে!

ধ্রুব ফিরে যখন রুমে ঢুকলো তখন হাতের খাবার গুলো নিচে পড়ে গেলো। নিনীকা দরজা খোলার শব্দে চমকে হাত থেকে ছু*রি ফেলে দিলো। ধ্রুবের চোখে অবিশ্বাস। দৌড়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরেছে। নিনীকা চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। ধ্রুবর গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো জল।

দীর্ঘ এক ঘন্টা ওভাবেই বসে ছিল তারা। নিনীকা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ধ্রুব দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শূন্যে তাকিয়ে আছে। চোখমুখ শক্ত করে রাখার কারণে ব্যথা অনুভব করছে।

দীর্ঘক্ষণ পর চোখ ফিরিয়ে নিনীকার দিকে তাকালো। তাকিয়ে থাকলো অপলক। এক মিনিট দু মিনিট করে দশ মিনিট অতিক্রম হলো। আস্তে করে নিনীকার মাথা রাখলো বালিশে। উপরে নিজের দীর্ঘকায় শরীরের ভর ছেড়ে দিয়ে বুকে মুখ গুঁজে পড়ে রইলো। সে টের পেলো তার বুক অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে।

ধ্রুব নিজেকে শান্ত করলো সময় নিয়ে। ঘুমন্ত নিনীকাকে টেনে তুললো। শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ তোমার থেকে এরকম কিছু আমি আশা করিনি মিসেস। এরকম একটা পথ বেছে নেওয়ার আগে আমার কথা মনে পড়েনি? ‘

নিনীকা মাথা নিচু করে রইলো। ধ্রুব ফের বলল,

‘ তুমি আমাকে ভালোবাসোনি কখনো, বাসলে আজ এমন করতে পারতে না। তুমি খুব ভালো করেই জানতে আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি। তুমি অবুঝ নও, তুমি এতোদিনে বুঝোনি? তুমি না থাকলে কারো জীবন থেমে যেতে পারে! ‘

‘ জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না মেজর। ‘

কি শক্ত কন্ঠ! ধ্রুব অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ এটা দিয়ে তুমি কি বুঝালে? ‘

নিনীকা ঠোঁট আলাদা করে হাসতে চেষ্টা করলো।

‘ এটাই কঠিন বাস্তবতা। আজ যদি আমি না থাকি তুমি একদিন দুদিন কাঁদবে, কিন্তু একসময় ঠিকই আবারও নতুন করে সব শুরু করবে। তখন হয়তো আমার জায়গায় অন্য কেউ থাকবে। কিন্তু জীবন থামবে না, সে চলে যাবে যেভাবে চলে যায় পৃথিবী থেকে মানুষ! ‘

‘ নিনীকা! পৃথিবীর ৯৯% মানুষের জীবন কাহিনি এটা। বাকি ১% এর টা বললে না যে? ‘

নিনীকা অবাক হয়ে শুধালো,

‘ ১% এর জীবন কাহিনি টা কি মেজর? ‘

ধ্রুব মাথা টেনে বুকে চেপে ধরলো,

‘ পৃথিবীর ১% মানুষ প্রিয়জনের শোকে সারাজীবনের জন্য থমকে যায়। উঁহু তারা আবেগি নয়, তারা আমার মতো শক্ত কঠিন হৃদয়ের বলেই তাদের থমকে যেতে হয়। এই ১% মানুষেরা দ্বিতীয়বার কাউকে নিয়ে ভাবতে পারে না। তুমি ঠিকই বলেছো নিনীকা, জীবন থেমে থাকে না। বয়স বাড়বে, আয়ু কমবে। ওই ১% মানুষেরাও সময়ের স্রোতে ভেসে বুকে কারো জন্য বুক ব্যথা নিয়ে মা*রা যাবে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় কি জানো? ‘

নিনীকার কন্ঠে কৌতুহল,

‘ কি? ‘

‘ সেই ১% মানুষেরা নিয়ম মেনে সব কাজ করবে। চাকরি টা ঠিকঠাক করবে। স্বাভাবিক থাকবে সব। কিন্তু হঠাৎ সে যান্ত্রিক জগতের যান্ত্রিক কাজকর্ম থামিয়ে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে। তার তখন বিষন্ন লাগবে। কেউ ছেড়ে চলে গেছিলো বা কেউ তার হয়নি কিংবা কেউ তার মা*রা গেছিলো আবার কাউকে ধরে রাখতে পারেনি বলে তখন তার সবকিছু থমকে যাবে। নিনীকা তুমি কি সেই ১% মানুষদের ব্যাপারে জানো? ‘

নিনীকা মুখে হাত চেপে মাথা নিচু করে কেঁদে উঠলো। ধ্রুব ঠোঁট চেপে হাসলো,

‘ তুমি কাঁদছো কেন নিনীকা? ‘

নিনীকা বুকে আঘাত করতে লাগলো,

‘ বাজে লোক, বাজে লোক, বাজে লোক আপনি। ‘

ধ্রুব আটকালো না। বরং ঠোঁট প্রসারিত হলো তার।

‘ প্রিয় নিনীকা, আমার মতো বাজে লোকের জন্যে হলেও থেকে যেও। তুমি সবসময়ই মনে রেখো, পৃথিবীর ওই ১% মানুষের মধ্যে কেউ না কেউ তোমার জন্যে থেমে যাবে! ‘

নিনীকার চোখমুখে অপরাধী ভাব।

‘ আমি কখনোই এমন করতে চাইনি, জানিনা হঠাৎ কি হয়েছিল। ছু*রি দেখে হঠাৎ মাথা ঘুরে গেলো। কি থেকে কি করতে চেয়েছি নিজেও বুঝিনি। আমায় ক্ষমা করো। আর করবো না, সত্যি। ‘

ধ্রুব নির্নিমেষ চাহনিতে তাকিয়ে।

‘ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে। ‘

নিনীকা নিজের দিকে তাকালো। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। ধ্রুব হেসে বলল,

‘ অনেকক্ষণ আগে কেউ একজন আমার সাথে নিজ থেকে অস্বাভাবিক অনেককিছু করেছে। তুমি কি থাকে চেনো? ‘

নিনীকা বালিশে মুখ গুঁজে ফেললো। ধ্রুব বলল,

‘ তোমাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবো। রেডি হয়ে নাও। বাহিরে গিয়ে একেবারে খাবো না-হয়। ‘

নিনীকা মুখ তুলে বলল,

‘ কিসের ডক্টর? ‘

‘ সাইকিয়াট্রিস্ট। ‘

নিনীকা চুপ করে তাকিয়ে রইলো। ধ্রুব গালে হাত রাখলো,

‘ একদম নিজেকে দোষ দিবে না। নিজেকে খারাপ ভাবারও দরকার নেই। তুমি যা করেছো তোমার হাসবেন্ডের সাথে। আর হাসবেন্ডের সাথে সবকিছু করা যায়। এরকম এগ্রেসিভ মাঝে মধ্যে হলে কোনো ক্ষতি হয় না, তবে যদি প্রত্যেক দিনের রুটিন হয়ে যায় তবে দুজনেরই পরবর্তীতে নানা সমস্যা দেখা দিবে। হাসবেন্ড ওয়াইফের নরমাল যে দৈহিক মিলন একসময় সেটার আগ্রহ ও কমে যেতে পারে। আমি কি তোমাকে বুঝাতে পেরেছি মিসেস? ‘

‘ আমি! আসলে হঠাৎ করেই প্রচন্ড ডিপ্রেশন! ‘

‘ হুসস, তোমাকে কিছু বলতে হবে না এখন। আগে ডক্টরের কাছে যাবো আমরা। ‘

নিনীকা নিজেকে প্যাকেট করে নিলো একেবারে। ধ্রুব মিটমিট করে হাসলো,

‘ মুখটা তো বের করে রাখো, শ্বাস নিতে না পারলে আমার বউ মা*রা যাবে যে। ‘

নিনীকা নাক-মুখ কুঁচকে তাকালো,

‘ তোমার খুব হাসি পাচ্ছে? ‘

ধ্রুব হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। বলল,

‘ একদম না, আমি এখন ভীষণ সিরিয়াস। ‘

*
ইন্ডিয়ার একজন বড়ো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে এসেছে তারা। সাইকিয়াট্রিস্ট মহিলা। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। চশমা ঠেলে দিয়ে বললেন,

‘ কেমন আছো নিনীকা মা? ‘

নিনীকা অবাক হলো। তাদের আজ প্রথম সাক্ষাৎ, অথচ ভদ্রমহিলা যেভাবে কথা বলছেন মনে হচ্ছে কতো বছরের চেনা। আবারও বললেন,

‘ আমাদের আজ প্রথম সাক্ষাৎ। আমাকে ডক্টর না ভেবে নিজের বন্ধু ভাববে। এবং নিজের সমস্যাটা বলবে। কি বলবে তো? ‘

নিনীকা মাথা নাড়ালো। ধ্রুব কথা বলল,

‘ ও সহজে কারো সাথে মিশতে পারে না, একটু চাপা স্বভাবের। ‘

তিনি হাসলেন,

‘ ব্যাপার না, এইতো সে এখন আমার সাথে মিশতে পারবে। কি পারবে তো মা? ‘

নিনীকা ঠোঁট উল্টে ধ্রুব ও ডক্টরের দিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাচ্ছে। ধ্রুব এক হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরলো,

‘ কোনো রকম অস্বস্তি বোধ করার দরকার নেই মিসেস। বি ইজি। ইনি অনেক ভালো একজন ডক্টর, তুমি যদি ইজি না হও তো তোমার সমস্যা টা সমাধান হবে কিভাবে? ‘

নিনীকা কথা বললো এবার,

‘ বলুন কি বলতে হবে। ‘

‘ তোমার ডিপ্রেশনের কারণ কি মা? এখন তো উড়ে বেড়ানোর বয়স। মন খারাপ হলে পাহাড়ে সমুদ্রে ঘুরবে, তা না ডিপ্রেশনে চলে গেছো। এই জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা অনেক বুঝদার। তারা সহজে ডিপ্রেশনে যায় না। তুমিও তার ব্যতিক্রম নও। আ’ম রাইট নিনীকা? ‘

‘ আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার বড়ো হওয়াটা সহজ নয়। ছোটবেলা থেকেই নানান কিছুর সম্মুখীন হয়েছি৷ তবে কখনো তেমন ডিপ্রেশনে যাইনি। এক কথায় সহ্য করতে করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। আমার মস্তিষ্ক ও মেনে নিয়েছিলো। সেজন্য ডিপ্রেশন টাচ করতে পারতো না। একাকিত্ব আমার প্রিয় হয়ে গেছিলো। কিন্তু যখন ধ্রুবর সাথে সংসার করতে শুরু করি তখন আমি একাকিত্ব ভুলে যাই। আমাদের একমাসের সংসারে ও কখনো আমাকে একা ছাড়েনি। আমি এটাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। তারপর ও যখন একমাস পর ওর জবে চলে যায় আর আমি ইন্ডিয়াতে চলে আসি পরীক্ষা দিতে। প্রথম দু একদিন তেমন প্রব্লেম হয়নি। কিন্তু তারপর থেকেই আমাকে আবারও একাকিত্ব ঘিরে ধরলো। এক সময় যেটাকে আমি পছন্দ করতাম, এখন সেটাই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দিচ্ছিল। আমার ভালো লাগতো না।সবসময়ই বিষন্ন লাগতো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেছিলো। সাথে আমি ভীষণ করে একজন সঙ্গীর অভাববোধ করছিলাম। আমার ধ্রুবকে লাগবে মনে হতো৷ কিন্তু ও তো কাজে, কিভাবে আসবে। ওকে বলতেও পারতাম না। মনের দিক থেকে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিলাম। ওর অভাববোধ এতোই অনুভব হয়েছিল যে আমি!

ধ্রুবর শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠ,

‘ তুমি কি মিসেস? ‘

নিনীকা চোখ বন্ধ করে বলল,

‘ আমি ফিঙ্গার ব্যবহার করতে গেছিলাম! ‘

ডক্টর বললেন,

‘ ব্যবহার করতে গেছিলে, তার মানে ব্যবহার করোনি। রাইট মাই চাইল্ড? ‘

‘ হু, আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে চেষ্টা করেছি। কেউ ছিল না যাকে কিছু বলতে পারবো। রুমমেটদের সাথে ততোটা ক্লোজ ছিলাম না। সুমিত্রার বাড়িতে বিয়ের তোড়জোড় চলছে, ও বিজি সেজন্য ওর সাথেও তেমন ভাবে যোগাযোগ হতো না। আমি ধ্রুবকে কিছু বলতে পারতাম না, মনে হতো ওর কাজে আমি বাঁধা হয়ে দাড়াচ্ছি না তো! ‘

‘ মিস্টার ধ্রুব, আপনার এই বিষয়ে কি ধারণা? ‘

‘ আজ ও অস্বাভাবিক আচরণ করেছে। আমার মনে হয়েছিল এটা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মাঝে মধ্যে হয়ে থাকে, বাট প্রতিদিন যদি এরকম অস্বাভাবিক ভাবে দৈহিক কিছু হয় তবে দুজনেরই সমস্যা হতে পারে। তাছাড়া মনে আরও অনেক সন্দেহ এসেছিলো। আর সে ছু*রি হাতে নিয়েছিলো শেষপর্যন্ত। আমার মনে হলো ওকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। ‘

ভদ্রমহিলা হাসলেন,

‘ আপনি অনেক দায়িত্বশীল মানুষ। আপনার স্ত্রীর ভাগ্য ভালো যে তাকে আপনি প্রথম দিনই আমার কাছে নিয়ে এসেছেন। তবে চিন্তার কোনো কারণ নেই। এটা আপনি স্বাভাবিক ভাবে নিন। কারণ চাকরির জন্যে আপনি দূরে থাকায় কয়েকদিন আপনাদের মধ্যে দৈহিক কিছু হয়নি। আপনি কাজে ডুবে ছিলেন। সে একাকিত্বে ভুগছিলো। ক্ষিদে ফেলে আমরা যদি খাবার না পাই, যদি দুদিন না খেয়ে থাকতে হয় তখন হঠাৎ করে কেউ সামনে খাবার রাখলে এগ্রেসিভ আচরণ এমনিতেই চলে আসবে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে চেষ্টা করবেন। ঘুরাঘুরি করবেন। সে এখন আর আগের মতো একাকিত্বে অভ্যস্ত নয়। সে আর আগের মতো নেই। সে পরিবর্তন হয়েছে। আগের নিনীকা একাকিত্ব ভালোবাসতো, এখন যে আছে সে আপনার স্ত্রী যে একাকিত্ব ভুলে আপনাকে বেছে নিয়েছে। আমি কি আপনাকে বুঝাতে পেরেছি মিস্টার ধ্রুব? ‘

ধ্রুব দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছাড়লো। তার বুক থেকে ভারী কিছু একটা নেমে গেলো।

‘ আমি বুঝতে পেরেছি ডক্টর। আমি অবশ্যই ওর খেয়াল রাখবো। তাছাড়া আমি সবকিছুর ব্যবস্থা করেও রেখেছিলাম, যাতে ওকে আমার থেকে দূরে না থাকতে হয়। কিন্তু সবকিছুরই একটি পর্যাপ্ত সময় প্রয়োজন। তাকে কয়েকমাস পর এমনই নিজে যেখানে যেতাম সেখানে নিয়ে যেতাম, সেটা নাহয় এখন থেকেই করলাম। ‘

‘দ্যাটস গুড। আপনি অনেক সাপোর্টিভ এবং বুদ্ধিমান। আপনার ওয়াইফ লাকি। এরকম কিছু কোনো পুরুষ সহজে বুঝতে পারে না। আমার মনে হয় আপনার জায়গায় অন্য কোনো পুরুষ থাকলে দৈহিক চাহিদা পূরণের মজা নিতো, তার মাথাতে এটা আসতো না যে এটা অস্বাভাবিক কিছু, স্বাভাবিক নয়৷ নিজের স্ত্রীর খেয়াল রাখবেন। যত্ন করবেন। ঠিক হয়ে যাবে।

তারপর নিনীকার দিকে তাকালেন,

‘ এসব নিয়ে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই মা। তোমার কোনো সমস্যা নেই, তুমি ফিট। স্বামীকে সবকিছু বলতে চেষ্টা করবে। তুমি মনে রাখবে তোমার একজন পার্সোনাল সাইকিয়াট্রিস্ট আছে, সে হলো তোমার স্বামী। তোমার এরকম সাধারণ প্রব্লেম সে নিজেই সমাধান করতে পারবে। ‘

নিনীকা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। ধ্রুব কিছু সময় পর বের হয়ে এলো নিনীকাকে নিয়ে।

রাস্তায় রোদের তাপে তাকানো যায় না। ধ্রুব কোমড় টেনে নিজের সাথে জড়িয়ে রেখে হাঁটতে লাগলো। আচমকা ওড়নার উপর দিয়ে নিনীকার কাঁধে চুমু খেলো। নেশালো কন্ঠে বলল,

‘ আমার পুতুল, আমার সুন্দরী মিসেস, নিনীকা! ‘

নিনীকা ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আমার ভাগ্যটা হয়তো অনেক ভালো, নাহলে পালিয়ে আসা মেয়ের কপালে কি এমন স্বামী জুটে বলো? যার সাথে সংসার করবো না বলে পালিয়ে এসেছিলাম আজ সে-ই আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। আজ আমি নিজেই তাকে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করি। তুমি এতো ভালো কেন গো? ‘

ধ্রুব চোখে চোখ রেখে হাসলো,

‘ যার বউ এতো রোমান্টিক তার কি খারাপ হওয়া মানায়? ‘

‘তুমি সবমসময়ই আমাকে লজ্জা দাও, অসভ্য মেজর।’

ধ্রুব জীপে টেনে তুললো।

‘ ডক্টর বলেছে বউকে সবসময়ই কাছাকাছি রাখতে। তার মানে কি বুঝতে পারছো তো? তুমি সবসময়ই আমার সাথে লেপ্টে থাকবে ওকে? ‘

নিনীকা চোখ রাঙানোর অভিনয় করলো,

‘ একদম না, কাছাকাছি বলতে বুঝিয়েছে আমার খেয়াল রাখতে। তুমি সবমসময়ই উল্টো পাল্টা বেশি বুঝো। ‘

‘ আচ্ছা ম্যাম, আপনি যদি এখন দয়া করে বুকের উপর থেকে সরে যান তবে আমি গাড়ি চালাতে পারি।

নিনীকা দেখলো সে সত্যিই ধ্রুবর বুকের উপর ঝুঁকে আছে। নাক ফুলিয়ে সরে গেলো।

‘ তুমি নিজেই আমাকে গাড়িতে টেনে তুলতে গিয়ে নিজের উপর ফেলে দিয়েছো। ইনোসেন্ট সাজার চেষ্টা করবে না একদম। বাজে লোক। ‘

*
খেয়ে ঘুরেফিরে তারা হোটেল রুমে ফিরলো সন্ধ্যার আগে। ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দিতেই চোখে ঘুম দেখা দিলো। ধ্রুব বুকে টেনে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে লাগলো।

‘ সারাদিন অনেক জ্বালিয়েছো, এবার ঘুমাও। ‘

নিনীকা বাধ্য মেয়ের মতো ঠোঁট উল্টে ঘুমিয়ে পড়লো। ধ্রুব এক হাতে মোবাইল নিয়ে ফোন করলো নিরবকে। রিসিভ হতেই বললো,

‘ ক্যাপ্টেন, চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে আগামীকাল রওনা হবো। ওদিকটা সামলে নিও। ‘

নিরব বলল,

‘ চিন্তা করবেন না আমি সামলে নিবো। ‘

‘ আমাদের সেনানিবাসের আশেপাশে ভালো কটেজ বুক করে রেখো। সাথে তোমার ম্যামও আসবে। আমি ঢাকা ট্রান্সফার না হওয়া পর্যন্ত সে আমার সাথে কটেজেই থাকবে। ‘

‘ ব্যবস্থা হয়ে যাবে মেজর। আপনি ম্যামকে নিয়ে সাবধানে আসবেন। ‘

ধ্রুব কান থেকে মোবাইল নামিয়ে ফারিনকে ফোন দিলো। রিসিভ হতেই বলল,

‘ তোর ভাবীকে আমার কাছে নিয়ে যাবো বনু, বাবাকে ইন্ডিয়ায় আসতে হবে না বলে দিস। ‘

ফারিন প্রায় চিৎকার করে বলল,

‘ তুমি কি এখন ভাবীর কাছে আছো? সত্যি তোমার কাছে নিয়ে চলে যাবে? ‘

‘ হ্যাঁ সত্যি নিয়ে যাবো। চট্টগ্রামে কটেজে থাকবে আমার সাথে৷ আপাতত পরীক্ষার পর প্রতিষ্ঠান বন্ধ ওর। মাকে চিন্তা করতে মানা করিস। আমি ওর খেয়াল রাখবো। আর আমি ডিউটিতে থাকলেও ও কটেজেই থাকবে। ওর মোবাইল সবসময়ই অন থাকবে। ফোন দিয়ে কথা বলবি প্রতিদিন। নিজের কি অবস্থা করেছে।’

ফারিন চমকে গেলো,

‘ কি হয়েছে ভাবীর? ‘

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,

‘ চোখের নিচে দাগ পড়ে গেছে, শুকিয়ে গেছে। ওকে একা ছাড়াটা রিস্ক। একাকিত্বের অভ্যাস এখন ওর নেই। আমি ডিউটিতে থাকলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবি ফোনে কথা বলে হাসানোর। বুঝেছিস?’

ফারিনের কন্ঠ ভেজা শুনালো,

‘ সব দোষ তোমার ওই চাকরির। আমার মোমের মতো ভাবিটা শুকিয়ে গেছে! তোমাকে আমি ছাড়বো না, একবার আসো বাসায় শুধু। পাপাকে বিচার দিবো দাঁড়াও। ‘

ধ্রুব হাসলো,

‘ দিস, আপাতত ফোন রাখ। ‘

ফারিন রাগ দেখিয়ে ফোন রেখে দিলো। ধ্রুব ঘুমন্ত বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আচমকা চুমু খেলো ঠোঁটে। হাত দিয়ে ছুয়ে দেখলো চোখের নিচের কালো দাগগুলো। তার অনুভব হলো তখনকার রাগ করে বলা ‘তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসোনি কথাটা মিথ্যা! মিসেস নিনীকা শেখ শুধু তাকে ভালোই বাসে না, বরং এমন ভাবে ডুবে গেছে আজ যদি ধ্রুবর কিছু হয়ে যায় তবে তার মিসেসের স্থান হয়তো পাগলাগারদে হতে সময় নিবে না! ভেবে ধ্রুব আশ্চর্য হয়ে গেলো। মেয়েটা কবে তাকে এতো ভালোবেসে ফেললো!

ধ্রুব কপালে আদর দিলো। সামনে আসা চুল গুছিয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ লাগিয়ে বলল,

‘ মেজর ধ্রুব মাহবুব ও তার পাগল মিসেসকে অসম্ভব ভালোবাসে মেয়ে!

(চলবে)

#বিয়ে_থা
#পর্ব- ৩৮
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

বড়পর্ব-২

সন্ধেবেলা ঘুমানোর কারণে ভোরে ঘুম ভেঙে গেলো নিনীকার। হাত দিয়ে বিছানা হাতড়ে কিছু একটা খোজলো, পেলো না। নিজের উপর ভারী কোনো কিছু অনুভব ও হলো না। তবে মানুষটা কোথায়?

নিনীকা ফট করে চোখ মেলে তাকালো। দৃষ্টি ঘরের চারিদিকে ঘুরাতেই আটকালো খাটের ঠিক পাশের মেঝেতে।

পড়োনে শুভ্র রঙের একটি শার্ট। মাথায় একটি শুভ্র টুপি। মেঝেতে নিনীকার একটি পরিষ্কার শুভ্র রঙের সুতির ওড়না বিছানো। মানুষটা সিজদাহ্ দিচ্ছে। নিনীকার মনে অদ্ভুত সুখ সুখ অনুভূতি হলো। বিছানা থেকে ঝটপট নেমে ওয়াশরুমে ঢুকলো। বের হয়ে এলো দ্রুত। ধ্রুবর একটু পেছনে আরেকটা ওড়না বিছিয়ে নামাজে দাড়িয়ে গেলো। সে যখন সবে দাড়িয়েছে, তখনই ধ্রুব সালাম ফিরিয়ে তার দিকে তাকিয়েছে।

ধ্রুবর চোখেমুখে স্বর্গীয় কোনো সুখী ভাব। নিনীকার সালাম ফেরানো পর্যন্ত বসে রইলো। তারপর দুজন একসাথে মোনাজাত ধরলো।

দোয়া শেষ করে ধ্রুব প্রথম স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুম্বন করলো। নিজের কপালেও অনুভব করলো একটি পবিত্র স্পর্শ।

ধ্রুব জড়িয়ে ধরে বিছানায় বসালো। গালে হাত রেখে স্ত্রীর মুখশ্রীতে চোখ ভুলিয়ে নিলো। চোখের নিচের কালো দাগ অনেকটাই উধাও হয়ে গেছে। চোখেমুখে আগের মতো আর দুঃখী ছাপ নেই। ধ্রুব আনন্দের সাথে বলল,

‘ সুন্দর সকালের শুভেচ্ছা মিসেস। কেমন অনুভব করছো আজ? মন ভালো? ‘

নিনীকার সুখে চোখ ভরে গেলো। সে কখনো শুনেনি, কখনো দেখেনি কোনো স্বামী তার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছে ‘মন ভালো? ‘

ধ্রুব চোখের পানি মুছে দিলো।

‘ আমি কি তোমাকে কষ্ট দিলাম? ‘

নিনীকা আছড়ে পড়লো,

‘ না গো, আমার তো সুখে কান্না পাচ্ছে। তুমি এতো ভালো কেন? ‘

ধ্রুব মাথায় হাত ভুলিয়ে দিলো,

‘ কোথাও একটা পড়েছিলাম তুমি যেমন তোমার জীবনসঙ্গী ও তেমনই হবে। ধরে নাও তুমি ভালো বলেই আমি-ও ভালো। ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানেরা-ও ভালোই হবে। ইনশাআল্লাহ। ‘

নিনীকা খোলা বারান্দার দিকে দেখিয়ে বলল,

‘ কাপড় কে ধুয়েছে, তুমি? ‘

‘ হ্যাঁ কেন? ‘

‘ কষ্ট করতে গেলে কেন? আমিই ধুয়ে দিতাম ঘুম থেকে উঠে। ‘

‘কষ্ট হবে কেন? মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেছিল। তাই ভাবলাম কাজ কিছু টা এগিয়ে রাখি। এতোক্ষণে হয়তো কাপড়গুলো শুকিয়ে গেছে কিছু টা। ব্যাগপত্র ও গুছানো আছে। আমরা বের হয়ে যাবো একেবারে একটু পর। পথে নাস্তা ও করে নিবো। একটু রেস্ট নিয়ে নাও। ‘

নিনীকা গালে হাত রাখলো,

‘ তুমি রেস্ট করো একটু। ‘

ধ্রুব বালিশে মাথা রেখে হাত বাড়ালো,

‘ এসো ঘুমাবো। ‘

চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সামনের একটি কটেজের গেইটের পাশে থামলো জীপ গাড়িটি। ধ্রুব নেমে ব্যাগপত্র হাতে নিলো। চারিদিকে অন্ধকার, আলগোছে চেপে ধরলো নিনীকার একটি হাত।

আজ তাদের দুজন একসাথে ট্রেনে করে এসেছে। ধ্রুব জীপগাড়িটি বাংলাদেশ টু ভারত কিভাবে নিয়ে গেছে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেছে সেটা সেই জানে।

গেইটের সামনে দাড়ানো অবয়বটা স্পষ্ট হলো। নিরব এগিয়ে এসে দাড়ালো।

‘ আসুন মেজর, আসতে কোনো অসুবিধা হয়নি তো? ‘

‘ না তেমর অসুবিধা হয়নি, জীপগাড়িটা আনতে সময় লেগেছে সেজন্য লেট হয়ে গেলো। তোমার ম্যাম ক্লান্ত, রুম ক্লিন করা তো? রেস্ট নিবে সে। ‘

‘ সব ক্লিন এবং ঠিকঠাক করা আছে। ম্যামের কোনো অসুবিধা হবে না। ‘

ধ্রুব নিনীকার হাত টেনে নিয়ে যেতে লাগলো।

‘ আর কোনো দরকার হলে আমি ফোন করবো, তোমাকে ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন। ‘

নিরব চাবি দিয়ে চলে গেলো। ঘুমের ঘোরে নিনীকা তেমন কিছু শুনতে পাচ্ছে না। ধ্রুব ব্যাগপত্র নিচে রেখে নিনীকাকে কোলে তুলে নিলো। তার মিসেস ঠিকঠাক দাঁড়াতেই পারছে না।

শুভ্র বিছানায় আরামে ঘুমাচ্ছে নিনীকা। ধ্রুব ব্যাগপত্র রেখে দরজা বন্ধ করে পড়োনের শার্ট খুলে ছুঁড়ে ফেললো। ঘেমে গোসল হয়ে গেছে তার। ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে তবেই বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। উত্তপ্ত পরিবেশে এক টুকরো শান্তি কুড়াতে নিনীকা বেছে নিলো ধ্রুবর ঠান্ডা বুক।

পরদিন ভোরে উঠতে দেখা গেলো ধ্রুবকে। যথা নিয়মে সে নামাজ আদায় করলো। নিনীকা যখন চোখ মেললো তখন ধ্রুব মেঝেতে বুক ডাউন দিচ্ছে। উদাম শরীর বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে। নিনীকার পড়োনে ঢিলেঢালা একটি সাদা রঙের সিল্কের প্লাজু ও পেট পর্যন্ত ছোট কাপড়। নিজের পোশাকের অবস্থা দেখে সে অবাক হলো না, ধ্রুবই পাল্টে দিয়েছে।

নিজের পাশে আরেকটি মানুষের অস্তিত্ব অনুভব করলো ধ্রুব। থেমে চোখ তুলে পাশে তাকালো। ছোটখাটো একটি পিঁপড়ে তার সাথে তাল মিলিয়ে বুক ডাউন দিতে চেষ্টা করছে। এক পর্যায়ে পিঁপড়ে টা হাত ফসকে ধপাস করে মেঝেতে পড়ে গেলো। বুকে ব্যথায় ঠোঁট উল্টে ওভাবেই শুয়ে তাকালো ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে কাছে টানলো। চেক করে বলল,

‘ বেশি ব্যথা পেয়েছো? ‘

নিনীকা কাধে মাথা রেখে গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে গেলো।

‘ আমার মধ্যের বুঝদার স্বভাব কোথাও হারিয়ে যাচ্ছে মেজর, আমি অতিরিক্ত আহ্লাদী ঢংগি হয়ে যাচ্ছি। ‘

ধ্রুবর মুখ হা হয়ে গেলো।

‘ তোমার আহ্লাদ করার মানুষ আছে আহ্লাদী হতে ক্ষতি কি? ‘

নিনীকা পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো। ধ্রুব মেঝেতে বসে টেনে দু’পায়ের ফাঁকে বসালো। অগোছালো চুলে হাত দিয়ে বলল,

‘ কতো দিন তেল ছোয়াও নি বলো তো? মাথা কি আর এমনি এমনি পাগল হয়? হেয়ার ওয়েল আছে না? নিয়ে এসো। ‘

নিনীকা উঠে হেয়ার ওয়েল নিয়ে এলো। আবারও বসে পড়লো আগের জায়গায়।

ধ্রুব যত্ন করে চুলে তেল দিয়ে দিলো। আরামে নিনীকা কবে যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না। যখন ঘুম ভাঙলো তখন ধ্রুব রুমে নেই। একটি চিরকুট রেখে গেছে।

‘ কাছেই আছি মিসেস। ঘুম থেকে উঠে গোসল দিবে। তারপর আমাকে একটা ফোন করবে। ‘

নিনীকা গোসল করে বের হয়েই ফোন করলো। ধ্রুব রিসিভ করতেই বলল,

‘ আপনি কোথায় চলে গেলেন আমাকে রেখে? ‘

‘ ডিউটিতে মিসেস, কিছুক্ষণের মধ্যে রুমে নাস্তা পৌঁছে যাবে। খেয়ে রেস্ট নিবে। আমি তাড়াতাড়ি ফিরবো, সেনানিবাসে আছি। ‘

নিনীকা কিছু বললো না। ধ্রুব ফোন রেখে দিয়েছে। ফিরলো সন্ধ্যার আগ মুহুর্তে৷ আর্মি ইউনিফর্ম পড়োনে বুটের শব্দ তুলে রুমে ঢুকলো। নিনীকা একবার দেখে চোখ ফিরিয়ে নিলো। ধ্রুবর ভ্রু কুঁচকে গেলো।

‘ তার বউয়ের কি হলো আবার? ‘

ফ্রেশ হয়ে এসে পাশে বসতেই নিনীকা একটু দূরে সরে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। ধ্রুব টেনে নিজের উপর বসালো।

‘ গাল ফুলিয়ে রেখেছো যে? ‘

‘ ও….মিসেস? ‘

নিনীকা ফট করে তাকালো।

‘ এভাবে ডাকবে না একদম। তোমাকে আমি ভালোবাসি না। ‘

‘ ঠিক আছে বাসতে হবে না, আমার একার টাই যথেষ্ট। ‘

ধ্রুবর বুকে কিল-ঘুষি পড়লো।

‘ তুমি আমাকে মর্নিং আদর না দিয়ে চলে গেছিলে কেন? ‘

ধ্রুব দু’হাতে মুখ আগলে ধরলো।

‘ আমি দিয়েই গেছি মিসেস, তুমি ঘুমে ছিলে বলে টের পাওনি। ‘

‘ আমাকে একা রেখে গেছিলে, যদি কেউ ঘুমের সুযোগ নিয়ে কিছু করে ফেলতো? ‘

‘ ঘরে ক্যামেরা লাগানো আছে ম্যাডাম, আমি আপনাকে চোখেচোখেই রেখেছি। ‘

নিনীকা চমকে গেলো,

‘ আমি ঘরে কাপড় চেঞ্জ করেছি, তুমি সেটাও দেখেছো? বাজে লোক কোথাকার। ‘

‘ নতুন করে কিছু তো দেখিনি, সবমসময়ই দেখি। ‘

এমন ঠোঁটকাটা উত্তরে নিনীকা চুপ করে রইলো। ধ্রুব অভিমান ভাঙাতে চেষ্টা করলো।

‘ শাড়ি পড়বে? ‘

নিনীকা বিনাবাক্যে শাড়ি বের করে পড়তে শুরু করলো। ধ্রুব কুঁচি ঠিক করে দিলো। নিজেকে ফিটফাট করে বের হলো বউকে নিয়ে কটেজ থেকে।

ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাঁটতে তেমন মন্দ লাগছিল না নিনীকার। অভিমান অনেক আগেই না-ই হয়ে গেছে। দুজন একটি ছোট্ট চায়ের দোকানে বসলো। পাশাপাশি বসে চা খাওয়া হলো। তারপর ফিরে এলো কটেজে।

ঘরে খাবার দিয়ে যেতেই নিনীকা নাক ফুলিয়ে বলল,

‘ হোটেলের খাবার খেতে ভালো লাগে না। বাজার করে আনবে, সাথে কিছু রান্না করার আসবাবপত্র। আমি রান্না করবো। ‘

ধ্রুব বিনাবাক্যে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো। পরদিন ফেরার সময় সে নিরবকে সাথে নিয়ে সবকিছু কিনে নিয়ে এসেছে। কিছু অনলাইনে ও অর্ডার করেছে। ধ্রুব সব ঘরে সেট করে একটি শর্ত দিলো।

‘ সিলিন্ডার গ্যাস, রিস্ক আছে। আমি ঘরে থাকলেই তুমি রান্না করতে পারবে। যদি আমি দেখি আমার অবর্তমানে তুমি এটায় হাত দিয়েছো তবে তখনই তোমার রান্না বন্ধ হয়ে যাবে। মনে থাকবে? ‘

নিনীকা মাথা নাড়ালো। ধ্রুব বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ প্রতিদিন আসতে বাজার নিয়ে আসবো, ফ্রিজ অর্ডার করেছি এনে দিবে দু এক দিনের ভেতরে। তখন না-হয় একসাথে বেশি করে বাজার করে ফেলবো। হু? ‘

‘ আমিও বাজারে যাবো। ‘

‘ যাবে, সমস্যা কি? ‘

নিনীকা শাক ও ভাত রান্না করলো। প্লেটে তুলে ধ্রুবর হাতে দিলো। ধ্রুব রান্নার সময়টায় এক সেকেন্ড ও এদিক সেদিক তাকায় নি। পাছে কখন তেল ছিটকে আসে আর তার মিসেসের কোনো ক্ষতি হয়ে যায়। প্লেট হাতে নিয়ে ভাত মাখিয়ে প্রথম লোকমাটা নিনীকার মুখে তুলে দিলো। নিনীকা ইশারা করে বলল,

‘ তুমি খাও তো। ‘

ধ্রুব খেলো। সে ভেবেছিল তেমন ভালো হবে না। নিনীকা তেমন রান্না ও করেনি কখনো। কিন্তু ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো। পারফেক্ট হয়েছে সব।

‘ ভালো হয়নি গো? ‘

ধ্রুব আরেক লোকমা মুখে তুলে দিয়ে হাসলো।

‘ পারফেক্ট, আমি তো ভেবেছি তুমি রান্না তেমন জানো না। ‘

‘ মায়ের থেকে অনেক রান্না শিখেছি। হোস্টেলে থাকতে রান্না করতে হতো। তোমার কি ভালো লাগছে? ‘

‘ অনেক, বাড়িতে না গেলে আমার সবসময়ই বাহিরের খাবার খেয়ে থাকতে হয়। বিয়ে করে বউ সাথে নিয়ে এসে ভালো করেছি, এখন ভালো মন্দ খেতে পারবো। ‘

নিনীকা হেসে ফেললো,

‘ এবার আমাকে কিছু দাও। ‘

‘ কি নিবে? ‘

‘ এইযে রান্না করে খাওয়াচ্ছি, তার বিনিময়ে যা ইচ্ছে দাও। ‘

ধ্রুব টেবিলের উপর থেকে নিজের ওয়ালেট এনে নিনীকার হাতে তুলে দিলো।

‘ সবই আপনার ম্যাম। ‘

নিনীকা ওয়ালেট খুললো। বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন তুলা তাদের পারিবারিক ছবি এক সাইটে যত্ন করে রাখা। ছবিতে ধ্রুব ও নিনীকা হাত ধরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। তাদের দুজনের একসাইটে ফাহিম মাহবুব ও ধারা, আরেক সাইটে ফারিন ভাবীর কাঁধ জড়িয়ে রীতিমতো ঝুলে আছে।

‘ ছবিটা কবে ওয়ালেটে রাখলে? ‘

ধ্রুব যাওয়ার ফাঁকে বলল,

‘ ডিউটিতে আসার আগের দিন। ‘

নিনীকা ছবিটা বের করতে গিয়ে দেখলো এটার নিচে আরেকটা ছবি। খুবই ঘনিষ্ঠ একটি ছবি। ধ্রুব নিনীকাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কপালের এক সাইটে ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে। এটা বৌভাতের। নিনীকার মুখে হাসি ফুটলো। ধ্রুবর গালে চুমু দিলো ফটাফট কয়েকটা। ধ্রুব হাসতে গিয়ে বিষম খেলো।

নিনীকা পানি খাইয়ে শান্ত করলো।

‘ ঠিক আছো? ‘

ধ্রুব কিছু না বলে খাওয়া শেষ করলো। নিনীকা ধরে নিলো তার হাসবেন্ড রাগ করেছে। কিন্তু হলো তার উল্টো৷ ধ্রুব খাওয়া শেষ করে বউকে কোলে তুলে নিয়ে নরম বিছানায় ফেলেছে।

রাতের শেষপ্রহরে ঘুমে ডুবে যেতে যেতে সে বিরবির করে বলেছে,

‘ আমার বৌ, আমার বৌ…আমার মিসেস। ‘

নিনীকা কানে ফিসফিস করে উত্তর দিলো,

‘ মেজর ধ্রুবর মিসেস। ‘


আর্মি ইউনিফর্মের শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিলো নিনীকা। প্যান্টের বেল্ট ঠিকঠাক করে দিলো। হাতে ক্যাপ নিয়ে সামনে দাড়াতেই ধ্রুব উঁচু করে উপরে তুললো। মাথায় ক্যাপ পড়িয়ে দিয়ে কপালে গাঢ় করে চুম্বন করে কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো সে। ধ্রুব এক হাতে পকেটে ওয়ালেট ঢুকালো। পায়ে আগেই বুট জোতা পড়ে নেওয়ায় ঝামেলা পোহাতে হলো না।

‘ তাকাও মিসেস। ‘

নিনীকা মাথা তুললো।

‘ মন খারাপ করছো কেন? ‘

‘ তাড়াতাড়ি ফিরবে, একা রুমে ভালো লাগে না। ‘

ধ্রুব পুরো মুখশ্রীতে ঠোঁটের স্পর্শ স্থাপন করলো। লাল টুকটুকে হয়ে গেছে মুখ। একটু বেশি চাপ লাগলেই এমন হয়। স্পর্শকাতর স্থানেও বাদ রাখলো না। এতো এতো আদর পেয়ে নিনীকার এবার ধ্রুবকে ছাড়তেই ইচ্ছে করলো না। কিন্তু ছাড়তে হলো। ধ্রুব মুখে মুখ লাগিয়ে রাখলো।

‘ আমার মোমের পুতুল, তোমাকে আদর করতেও ভয় লাগে। যদি মোমের মতো শরীরে দাগ পড়ে যায়। ‘

নিনীকার বলতে ইচ্ছে করলো ‘ আজ যেও না’ কিন্তু বলতে পারলো না। ধ্রুব চলে গেলো। সবসময়ের মতো নিনীকা ফারিন না-হয় ধারার সাথে কথা বললো, কখনো বা নিজের কাছে থাকা পড়ে ফেলা একটা দুটো উপন্যাসের বই আবারও পড়তে লাগলো। ধ্রুব একটু তাড়াতাড়ি ফিরলো আজ।

তখন গোধুলি বিকেল। উপন্যাসে ডুবে যাওয়া নিনীকার কানে এলো একটি আহ্বান।

‘ নিনীকা মেজর হেয়ার..’

নিনীকা সব ফেলে ছুটে বের হলো। সিঁড়ি থেকে এক প্রকার লাফ দিয়ে পড়লো ধ্রুবর উপর। ধ্রুব নিজের উচ্চতার থেকেও উঁচু করে তুলে ধরেছে। নিনীকা মেজরের ক্যাপটা নিজের মাথায় পড়ে নিলো। দু-হাত প্রসারিত হতেই ধ্রুব ঘুরাতে শুরু করলো।

চারিদিকে সবুজের সমারোহ। উপরে নীল রাঙা আকাশ। নিচে আর্মি ইউনিফর্ম পরিহিত একটি যুবক, শুভ্র রঙের গাউন পরিহিত নিজের স্ত্রীকে উপরে তুলে ঘুরছে। আর্মির ক্যাপ পরিহিত স্ত্রীটির খিলখিল হাসিতে মুখরিত হচ্ছে চারিদিক।

তখনই আগমন ঘটে নিরবের। মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো তার। আড়ালে দাড়িয়ে দৃশ্যটি মোবাইলে ক্যামেরা বন্দি করে নিশ্চুপে প্রস্থান করলো। সে খুঁজ খবর নিতে এসেছিলো, ফাহিম মাহবুবের আদেশে।

নিনীকা হাসি থামাতে পারছে না। এতো খুশি, এতো আনন্দ শুধুমাত্র এই একটি মানুষই তাকে দিতে পারে। ধ্রুব একসময় ঘুরানো থামালো। বুটজুতোর শব্দ তুলে বউকে কাঁধে তুলে নিয়ে চললো রুমে। নিনীকার তেলে ডুবানো চুলগুলো মাটির দিকে হেলে রয়েছে। যদি লম্বা হতো তাহলে হয়তো মাটি ছুঁয়ে ফেলতো। রাতে তাকে এভাবে কেউ দেখলে পেত্নী ও ভাবতো।

আজ ধ্রুব রান্না করবে। নিনীকা তার এসিস্ট্যান্ট। মুরগী ভালোই রান্না করতে পারে সে। নিনীকা স্পাইসি করে মাংস খাবে বললো। ধ্রুব ঝালঝাল করে রান্না করলো। খেয়ে চোখের জল নাকের জল এক করলো দুজন। পানি খেয়েও যখন স্বস্তি মিললো না তখন সমাধান হিসেবে আঁকড়ে ধরলো দুজন দুজনকে। কে কার ভেতরে ঝাল গুলো ঢেলে দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা চললো।

*
নিরব ছবিটা ফারিনের মোবাইলে সেন্ড করেছে। ফারিন ছবিটা দেখেই কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো। তারপর চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। ফাহিম ও ধারা বের হয়ে মেয়েকে লাফাতে দেখে অবাক হলেন না। সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলেন কবে লাফানো বন্ধ করে ঘটনা খুলে বলবে। ফারিন লাফানো বন্ধ করে মোবাইল এগিয়ে দিলো। ধারার পাশে বসে বলল,

‘ দেখো মাম্মা, ভালো করে দেখো। সাদা গাউনে ভাবিকে প্রিন্সেসের থেকে কম লাগছে না। মাথায় আবার ভাইয়ার আর্মির ক্যাপ পড়েছে। ছবিটা কতো ওয়া-ও। কতো রোমান্টিক। মাম্মা মাম্মা আ’ম সো হ্যাপি। ‘

ফারিন এবার ফাহিম মাহবুবের পাশে গিয়ে বসলো। গলা জড়িয়ে ঝুলে পড়লো।

‘ থ্যাংক ইউ সো মাচ পাপা, তোমার পছন্দ আসলেই সুপার। ইশ কতো সুন্দর সে। একদম পুতুল। ‘

ফাহিম মাহবুব অসহায় কন্ঠে বললেন,

‘ একবার তো ভাইয়ের প্রশংসা ও করতে পারতে মা আমার। ‘

ফারিন পিটপিট করে তাকালো মোবাইল স্কিনে। আর্মির ইউনিফর্ম পড়া ধ্রুব তাকিয়ে আছে নিনীকার দিকে। নিনীকা দুহাত প্রসারিত করে চোখ বন্ধ করে হাসছে। কতো অপূর্ব দৃশ্য। ধ্রুব আছে বলেই ছবিটা এতো সুন্দর হতে পেরেছে।

‘ যাও করলাম প্রশংসা। ব্রো ছবিতে আছে বলেই ছবিটা পূর্ণতা পেয়েছে। তবে তোমার দজ্জাল ছেলেকে বলবে আমার পুতুল কে যেনো একা না ছাড়ে। হুহ! ‘

ফাহিম মাহবুব হাসলেন। ধারা এতোক্ষণে বললেন,

‘ ছবিটা সত্যিই সুন্দর৷ কে তুলেছে? আর তুমিই বা কোথায় পেলে? ‘

ফারিন নাক-মুখ কুঁচকে বলল,

‘ কে দিবে আবার, ভাইয়ার ওই ক্যাপ্টেন সেন্ড করেছে।’

‘ আমি খেয়াল করেছি তাকে নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করা হলে তুমি বিরক্ত হও। সে কি তোমার সাথে বিরক্তিকর কিছু করেছে মাই প্রিন্সেস? ‘

‘ অফকোর্স! মাঝে মধ্যে ফোন দিয়ে বলবে ‘ মিস ফারিন আপনি কি মেজরকে একটু বলবেন তার সাথে জরুরি প্রয়োজন, মোবাইল টা অন করতে? ‘ যদি আমি বিরক্ত হয়ে বলি আমাকে কেন ফোন করেছেন? বাড়িতে কি আর কেউ নেই? তখন ন্যাকা সুরে বলে ‘ আমি দুঃখীত মিস ফারিন। ‘

ধারা হেসে ফেললেন। ফাহিম মাহবুব মেয়ের গাল টেনে দিলেন।

‘ আমার অফিসার কিন্তু ভালো মা, রিটায়ার্ড নেওয়ার পরেও সে এখনো আমি কোনো অর্ডার দিলে তা পালন করে। ‘

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-৩৫+৩৬

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ )

বিয়ের অনুষ্ঠানের পর ছোট করে একটি বৌভাতের অনুষ্ঠান করা হলো। রমজান শেখ ও মিথিলা আসলেন না। ডাক্টারের কাছে যেতে হবে তাদের। তারপরই সব আত্মীয় স্বজন বিধায় নিলেন। ধারার ভাইয়েরাও বিদেশে চলে গেলেন। সুমিত্রাও ফিরে গেছে ইন্ডিয়ায়।

সময় দ্রুত গতিতে চলে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে নিনীকার। তার পরীক্ষার রুটিন প্রকাশ হয়েছে। আগামীকাল তাকে ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে। এদিকে ধ্রুবর ও ছুটি শেষ। ফারিনের এসএসসি পরীক্ষা চলছে।

সময়টা রাত দশটা। খেয়ে ধ্রুব একটু বেরিয়ে গেছে। ঘরে নিনীকা একা। এই কয়েকটা দিন তার স্বপ্নের মতো কেটেছে। ধ্রুবের হাতে হাত রেখে কতো জায়গায় ঘুরেছে। রাতের আঁধারে নির্জন রাস্তায় হেঁটেছে। লং ড্রাইভে গিয়েছে। দিনশেষে একে অপরের উষ্ণতায় ডুবে থেকেছে।

এবার তাদের সাময়িক সময়ের জন্যে আলাদা হতে হবে। নিনীকা ভাবলো, সে না-হয় কয়েকদিন পর পরীক্ষার পাঠ চুকিয়ে নেবে, কিন্তু ধ্রুব! তার যে চাকরিটাই এমন, সারাজীবনই কি সে পরিবার ছেড়ে ওখানে এখানে ঘুরবে?

ধ্রুব ফিরলো এগারোটা নাগাদ। হাতে প্যাকেট করে আনা ফুচকা। ছোট্ট টেবিলে রেখে বউকে জড়িয়ে ধরলো।

‘ ফুচকা এনেছি। ‘

নিনীকা নিজেকে ছাড়িয়ে নিচে চলে গেলো। প্লেট নিয়ে আসার সময় ডেকে এলো ফারিনকে। ফারিন এলো। চোখের নিচে কালো দাগ। বেচারি রাত জেগে পড়ে। নিনীকা টেনে বিছানায় বসালো। ফুচকা সামনে দিয়ে বলল,

‘ খেতে শুরু করো। কি অবস্থা করেছো নিজের বলো তো? সুস্থ না থাকলে কিভাবে হবে? ‘

ফারিন হেসে খেতে শুরু করলো। ধ্রুব গালে হাত দিয়ে বউ ও বোনকে দেখছে। নিনীকা ঠেসে একটি ফুচকা ঢুকিয়ে দিয়েছে তার মুখে। বহু কষ্টে সে সেটা গিললো। বলল,

‘ অনেক টক। ‘

ফারিন চোখ বন্ধ করে গপাগপ খাচ্ছে।

‘ তুমি এর স্বাদ কি বুঝবে? মেয়েদের ইমোশন এটা। ‘

‘ খেয়ে বের হো। ‘

ফারিন ঠোঁট বাকালো,

‘ যাবো না, ভাবি আমার বই খাতা নিয়ে আসো তো। এখানেই পড়বো আজ। এখানেই ঘুমাবো। তোমার হাসবেন্ডকে বলো আমার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়তে। ‘

ধ্রুবর মুখ গম্ভীর হয়ে গেলো। নিনীকা সত্যি সত্যি উঠে দাড়িয়েছে। ধ্রুব টেনে ধরলো হাত।

‘ খাওয়া শেষ করো তাড়াতাড়ি, তারপর এই শয়তানকে বের করো রুম থেকে। ‘

ফারিন নিনীকার আরেক হাত টেনে ধরলো।

‘ ভাবি তুমি প্লিজ বই খাতাগুলো নিয়ে এসো। ‘

ধ্রুব ফারিনের হাত থেকে বউকে ছাড়িয়ে প্রায় জড়িয়েই ধরেছে।

‘ আমার বৌ থেকে দূরে থাক। খেয়ে বিদেয় হো, তোর না পরীক্ষা? ‘

‘ তো? আগামীকাল ভাবি চলে যাবে, তার সাথে সেজন্য আজ আমি থাকতে চাই। ‘

ধ্রুবের মুখ দেখার মতো হলো। বোনের সামনে এর বেশি নির্লজ্জ হওয়া সম্ভব না। এখন শেষ ভরসা নিনীকা। যাকে সে শক্ত করে ধরে রেখেছে। একদম বের হতে দিবে না।

ফারিন ঠোঁট চিপে হাসছে,

‘ তুমি ভাবিকে ছাড়ছো না কেন? ‘

নিনীকা এই দুজনের টানাটানিতে বিরক্ত হলো। নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ধ্রুব আরও শক্ত করলো বন্ধন। নিনীকা আস্তে করে বলল,

‘ বোনের সামনে এমন নির্লজ্জ আচরণ করছেন কেন? কি ভাববে সে? ‘

ধ্রুব ও আস্তে করে উত্তর দিলো,

‘ বউয়ের সাথে এবারের মতো আজই আমার শেষরাত, তোমার বোঝা উচিত মিসেস। ‘

নিনীকা শরীরে অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করলো। কয়েকদিন তার মেয়েলি প্রব্লেমের কারণে ধ্রুব তার কাছাকাছি আসেনি। বুকে জড়িয়ে রেখে ঘুমাতো আর বলতো,

‘ তোমার এই প্রব্লেমটা আসার আর সময় পায়নি? ‘

নিনীকা হেসে ফেলতো। মানুষটা এতো পাগল।

ফারিন ফুচকা খেয়ে শেষ করে বলল,

‘ যা-ও এইবার চলে যাচ্ছি, নেক্সট টাইম থেকে আর ছাড়বো না ভাবিকে। ‘

ধ্রুব শব্দ করে দরজা বন্ধ করেছে। নিনীকা মুখে হাত রেখে হাসছে। ধ্রুব ঠেলে ছুঁড়ে ফেললো বিছানায়। নিজের সমস্ত ভর ছেড়ে দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলো গাল,

‘ খুব মজা নেওয়া হচ্ছিল? ‘

নিনীকা ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়িয়ে না করলো। ধ্রুব কাত হয়ে সরে গেলো। মিছিমিছি চোখ বন্ধ করে ঘুমের অভিনয় করছে। নিনীকা বুঝতে পেরে ঠেলে সোজা করলো। বুকে কনুই ঠেকিয়ে রেখে বলল,

‘ ওতো রাগ করছো কেন? আমি তো জানতাম ও মজা করছে। ‘

ধ্রুব সাড়া দিলো না। নিনীকা আবার বলল,

‘ তুমি কতোদিনের জন্য চলে যাচ্ছো বলো তো, আমি থাকবো কিভাবে? ‘

‘ কথা বলবে না? আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে? ‘

ধ্রুব ফট করে চোখ মেলে তাকালো। তাদের সংসারের একমাস পূর্ণ হয়েছে। একমাস! আগামীকাল নিনীকাকেও হোস্টেলে দিয়ে তাকে রওনা হতে হবে কাজে। তবে সে অনেক কিছু গুছিয়ে নিয়েছে। নিনীকাকেও বলা হয়নি।

‘ এর পরের বার থেকে ঢাকাতেই সব হবে। পোস্টিং যেখানেই হোক তুমি সাথে যাবে। ‘

নিনীকার মুখ উজ্জ্বল হলো। ফট করে চুমু খেলো ঠোঁটে।

‘ আগে বলো-নি কেন গো? ‘

ধ্রুবের মুখ থেকে অভিমানের চাপ সরে গেলো। হাতের বন্ধন শক্ত করলো।

‘ তুমি কাছে থাকলে আমার এতকিছু মনে থাকে না। ‘

নিনীকা গাল টেনে দিলো,

‘ অভিমান ও করতে জানেন আপনি? ‘

ধ্রুব হাসছে,

‘ কেন ওটা কি শুধু মেয়েরা করে নাকি? ছেলেরা করতে পারে না? ‘

নিনীকা উন্মুক্ত বক্ষে ঠোঁট ছুইয়ে মুখ গুঁজলো।

‘ আমার অভিমান করা ধ্রুব, মেয়েদের অভিমানী বলা হয়। তোমাকে কি বলবো? অভিমানা? ‘

*
পরদিন সকালে নাস্তা করেই রেডি হতে হয় তাদের। নিনীকা সবার থেকে বিদায় নিলো। ধারা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলেন কিছুক্ষণ। একসময় যে মেয়েটির সাথে ঝগড়া করার জন্যে ছেলের বউয়ের অভাববোধ করছিলেন সেই মেয়েটিই তার ছেলের বউ আজ। এবং আজ তিনি মেয়েটিকে ভালোও বাসেন।

নিনীকা আহ্লাদী কন্ঠে ডাকলো,

‘ মা…’

ধারা কপালে আদর দিলেন,

‘ ভালো করে পরীক্ষা দিও, পরীক্ষা শেষ হলে তোমার তো কিছুদিন বন্ধ থাকবে তাই না? তোমার শ্বশুর মশাইকে পাঠিয়ে দিবো নিয়ে আসবে না-হয়। বাড়িটা ফাঁকা ফাকা লাগবে এখন। কেন এসেছিলে মায়া বাড়াতে? ‘

নিনীকার চোখ ছলছল করলো। সবাই এতো ভালো কেন?

ফাহিম মাহবুব তার দজ্জাল চেহারার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ আমার পুত্রবধূকে সহিসালামতে পৌঁছে দিবে। তার যেনো কোনো অসুবিধা না হয়। ‘

ধ্রুব মাথা নাড়ালো। ধারা ছেলেকে নিচু হতে বললেন। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে মাথা নিচু করলো। কপালে ভেজা একটি আদর টের পেলো। বহুদিন পর মায়ের আদর পেয়ে তার মুখে হাসি ফুটলো। চাকরির পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মাকে তেমন সময়ই দিতে পারেনি সে। কোথায় যে এই আদর গুলো চাপা পড়ে গেছিল কে জানে। ধ্রুব মাকে জড়িয়ে ধরেছে।

‘ এইবার সবকিছু চুকিয়ে আসবো বুঝলে। তোমাকে আর ছেলের প্রতিক্ষায় দিন গুনতে হবে না। ‘

ধারা আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিলেন।

‘ মিশনে গেলে সাবধানে থেকো বাবা, দেশের কাজ করার জন্যে অনেক মেজর আসবে যাবে। কিন্তু তোমার মায়ের একমাত্র ছেলে হারিয়ে গেলে আর ফিরে আসবে না। ‘

ধ্রুব অভয় দিলো।

‘ আমি সাবধানে থাকবো মা, চিন্তা করো না। ‘

ফারিনের পড়োনে স্কুল ড্রেস। ভাই ভাবিকে বিদায় দিয়ে বাবাকে নিয়ে পরীক্ষার হলের উদ্দেশ্যে বের হবে সে।

নিনীকা ফারিনকে জড়িয়ে ধরলো,

‘ ভালো করে পরীক্ষা দিও। নিজের ও মা বাবার খেয়াল রেখো। ‘

সবশেষে ফাহিম মাহবুবের থেকে বিদায় নিয়ে দুজন জিপ গাড়িতে উঠে বসলো। নিনীকা ধ্রুবর চোখ থেকে গগলস নিয়ে নিজের চোখে পড়ে নিলো। পড়োনে তার সাদা শার্ট, গলায় ছোট্ট স্কার্ফ। লং একটি স্কার্ট ও পড়েছে। ধ্রব আড়চোখে তাকিয়ে বউ কথা কও অতিক্রম করতে করতে বলল,

‘ সেই প্রথম মুখোমুখি হবার দিনের মতোই তোমাকে সুন্দর লাগছে। আজ স্কার্ট উপরে তুলে দৌড় দিবে না? ‘

নিনীকা বাহুতে ঘুষি দিলো,

‘ বদমাইশ মেজর। ‘

(চলবে)

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ )

একটানা সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে এসে কাউন্সিলিং করেছেন রমজান শেখ। আজ শেষ দিন। মিথিলা ও রমজান শেখ ডাক্তারের চেম্বারে বসে আছেন। সাইকিয়াট্রিস্টের নাম রুহুল আমিন। চোখের চশমা ঠিক করে রমজান শেখের দিকে তাকালেন। কিঞ্চিৎ হাসি ফুটিয়ে বললেন,

‘ কেমন আছো ইয়াং ম্যান? ‘

রমজান শেখ এই একমাস যাবত অনেক বার মধ্যবয়সী এই লোকের ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি মানতে নারাজ হয়তো। সেজন্য বার-বার ইয়াং ম্যান বলেই ডাকেন। রমজানের মুখে হাসি। তার ভেতর এখন পানির মতো সহজ সরল। বললেন,

‘ আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? ‘

রুহুল আমিন উত্তর দিলেন। তারপর ঔষধ পত্র নাড়াচাড়া করলেন কিছুক্ষণ। ফের প্রশ্ন করলেন,

‘ আজকাল কেমন ফিল করো? ‘

‘ ভালো, আমি নিজের মধ্যে সেই পুরনো আমিকে খুঁজে পাই। ‘

‘ ভেরি গুড। আজকের পর থেকে তোমাকে আর আসতে হবে না। এবং এসব ঔষধপত্র ও খেতে হবে না।শুধু কয়েকটা ঔষধের নাম বলে দিবো। ওগুলো মস্তিষ্ক ঠান্ডা রাখবে তোমার। আর তোমার ডায়বেটিসের ঔষধ গুলো তো আর সারাজীবনই খেতে হবে। হা হা। ‘

রমজান শেখ মাথা নাড়ালেন। ডক্টর আবার বললেন,

‘ তুমি অনেক জটিল পেশেন্ট ছিলে। বাট আ’ম সাকসেস না-ও। একটু বাহিরে অপেক্ষা করবে? তোমার স্ত্রীর সাথে আমি একটু কথা বলবো। ‘

রমজান শেখ বের হয়ে গেলেন। মিথিলা হেসে বললেন,

‘ বলুন ডক্টর, কি বলবেন? ‘

‘দেখুন মিসেস শেখ আমি আপনাকে পার্সোনাল কিছু প্রশ্ন করবো। আপনার হাসবেন্ড স্বামী স্ত্রীর বিশেষ মুহুর্তে কি আগের মতো হিংস্রতা প্রকাশ করেন? বা আগের মতো কোনো কর্মকাণ্ড করেন? যেটা করলে আপনার মনে হতো সে নিজের রাগ মেটাচ্ছে। ‘

‘ না। সে আর এরকম করে না। আমাকে ছুলেও এমন ভাবে ছুয় যেনো আমি একটি নরম পুতুল, সে একটু জুড়ে চাপ দিয়ে ধরলেই ব্যথা পেয়ে কেঁদে ফেলবো। মানুষটার অনেক উন্নতি হয়েছে। অনেকবার কেঁদে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। নিজের মেয়ের কথা আজকাল বেশি বলে। মেয়েকে অনেক কষ্ট দিয়েছে। মেয়ের কাছে ক্ষমা চাইবে। ‘

‘ দ্যাটস গুড। হি ইজ ফুল ফিট। বাট রিমেম্বার, সে যেনো এরকম আঘাত আর কখনো না পায়। সামান্যতম মনকষ্ট হলে তার ব্রেনে ইফেক্ট পড়বে মারাত্মক ভাবে। তাকে সর্বদা হাসিখুশি রাখতে চেষ্টা করবেন। তার সাথে কেউ যাতে কখনো রেগে বা আঘাত দিয়ে কথা না বলে সেটার খেয়াল রাখবেন। তাকে কোনোভাবেই উত্তেজিত যাতে করা না হয়। সবাইকে বলবেন তার সাথে সফট ও নরম স্বরে কথা বলতে। ‘

মিথিলা হাসিমুখে বেরিয়ে গেলেন। রমজান শেখ হাত ধরে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,

‘ কি বললো? ‘

‘ শেখ বাবু ফুল ফিট। ‘

‘ সত্যি? ‘

মিথিলা বাহুতে মাথা রাখলেন,

‘ সত্যি গো, তুমি সুস্থ পুরোপুরি। ‘

*

বন্ধ চোখজোড়ায় জানালার ফাঁক গলিয়ে অল্প আলো পড়তেই নিনীকা পিটপিট করে তাকালো। চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট। মাথা ভারী হয়ে আছে। মুখে দুঃখের চাপ। নিনীকা দূর্বল শরীর টেনে উঠে বসলো। গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে তার। রুমমেট দুজন গতকালই বাড়ি চলে গেছে।

নিনীকা মোবাইল হাতে নিলো। ধ্রুবর দুটো মিসকলড। কল দিতেই রিসিভ করলো। উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,

‘ ঘুম ভেঙেছে তোমার মিসেস? ‘

ধ্রুব ভোর থেকে সকাল দশটা পর্যন্ত পার্সোনাল মোবাইল অন করে রাখে। এ সময়ের মধ্যেই নিনীকা ও বাড়িতে কথা বলে নেয়। নিনীকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘ হু..। ‘

‘ তোমার কি মন খারাপ? ‘

‘ না ‘

ধ্রুবর চিন্তিত স্বর,

‘ তবে মুখ শুকনো যে? ‘

‘ অডিও কলে কিভাবে দেখলে?

‘ আমি গলার স্বর শুনে বুঝতে পারি। তাছাড়া তুমি কয়েকদিন ধরে ভিডিও কলে কথা বলতে রাজি হচ্ছো না, বললেও এড়িয়ে যাচ্ছো। কেন বলো তো? আমার কি তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করে না? ‘

‘ স্যরি। ‘

‘ তোমার কি হয়েছে বলবে? আমার দ্বারা কি কোনো ভুল হয়েছে? ‘

‘ না গো। ‘

‘ নিনীকা! প্লিজ বলো কি হয়েছে তোমার? ‘

নিনীকা ভেজা কন্ঠে বলল,

‘ তুমি কি আসবে? আমার তোমাকে প্রয়োজন। ‘

ওপাশ থেকে কিছু সময় ধ্রুব কোনো কথা বললো না। সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত? বা এমন কিছু যা মনে লুকিয়ে রেখেছো? ‘

নিনীকা ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকালো,

‘ আমি..আমি তোমাকে ফোনে বলতে পারবো না। তুমি এসো, একবার এসো প্লিজ। ‘

নিনীকার কন্ঠে অসহায়ত্ব। ধ্রুবর বুক চিনচিন করে উঠলো। কি হয়েছে তার মিসেসের?

‘ আমি চেষ্টা করবো মিসেস। তুমি কেঁদো না তো, প্লিজ ভিডিও কলে আসবে? ‘

নিনীকা কল কেটে ভিডিও কল করলো। স্কিনে ভেসে উঠলো আর্মির ইউনিফর্ম পড়া ধ্রুবর মুখ। ক্লিন শেভ করা মুখটায় চিন্তিত ভাব। নিনীকাকে গভীর চোখে দেখলো ধ্রুব। কিছু মুহুর্ত পর বললো,

‘ চোখের নিচে কালো দাগ, চোখমুখ শুকনো। তুমি তো নিজের প্রতি যত্নবান মিসেস। তবে এগুলো কি? রাত জাগো? কিন্তু কেন? ‘

‘ওই পরীক্ষা ছিলো…’

‘ মিথ্যা বলো না, সত্যিটাই শুনতে চাই। ‘

নিনীকা মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললো।

‘ তুমি এসো প্লিজ, আমি পারছি না। ‘

ধ্রুবর চোখ টলমল করছে। আশ্চর্য সে কেঁদে ফেলবে নাকি? এমন তো আগে ছিল না, এতো নরম হলো কবে সে! শুধু বললো,

‘ অপেক্ষা করো মিসেস। ‘

ধ্রুব এরপর দু’দিন কোনো যোগাযোগ করলো না। নিনীকা ফোন দিয়ে ও বন্ধ পেলো। তার নিজের উপর রাগ হলো। মানুষটা অতদূরে নিশ্চয়ই তার হেয়ালিতে রেগে গেছিলো সেদিন।

নিনীকার ভাবনা মিথ্যা করে দিয়ে তিনদিনের মাথায় হোস্টেলের সামনে এসে থামলো একটি জিপ গাড়ি। ধ্রুব চোখের গগলস খুলে দারোয়ানকে বলল,

‘ নিনীকা নামে একজন ছাত্রী আছে, তাকে বলবেন ব্যাগপত্র গুছিয়ে একেবারে নিচে নেমে আসতে। যদি বলে কেন, তবে বলবেন কেউ তাকে নিতে এসেছে। ‘

দারোয়ান মাথা নাড়িয়ে চলে গেলেন। নিনীকাকে কথাটা বলতেই সে চমকে গেলো। তাকে কে নিতে আসতে পারে আন্দাজ করতে পারলো না। তবে ধারা বলেছিলেন তাকে নেওয়ার জন্যে ফাহিম মাহবুবকে পাঠাবেন। অভিমানে নিনীকার ঠোঁট বেঁকে গেলো। ফুপাতে ফুপাতে ব্যাগপত্র গুছালো। গায়ে চাপালো একটি ফতোয়া ও জিন্স। চুলগুলো কোনোরকমে জুটি করে বেঁধে ট্রলি নিয়ে ছুটলো নিচে।

নিচে এসে যখন আশেপাশে ফাহিম মাহবুব কে খুঁজলো তখন চোখের সামনে দেখা দিলো চিরপরিচিত জীপগাড়ি। নিনীকার মুখ থেকে ধীরে ধীরে অভিমান সরে গেলো। ধীর পায়ে এড়িয়ে এসে বসলো জীপে। পেছনে ব্যাগপত্র রাখলো। ধ্রুব এতোক্ষণ নিরবে তাকেই পর্যবেক্ষণ করেছে। নিনীকা কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চেষ্টা করলো। ধ্রুব তার আগেই টেনে নিলো। বুকে জড়িয়ে মুখ গুঁজলো নরম অঙ্গে। নিনীকার শরীর কেঁপে উঠছে মাঝে মধ্যে। ধ্রুব পিঠে হাত ভোলাচ্ছে।

‘ এতো কান্না কিসের? এসেছি তো। ‘

নিনীকা অনেক পর থামলো। মুখ তুলে তাকালো পিটপিট করে। ধ্রুব দু’হাতের ভাজে মুখ নিয়ে ঠোঁটে দীর্ঘ চুম্বন করলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে হাসলো।

‘ আমাকে পাগল করে দিবে তুমি। ‘

নিনীকা ধ্রুবকে অবাক করে দিয়ে গলায় মুখ গুঁজে নিজের কাজে ব্যস্ত হলো। ধ্রুব অবাক হতে গিয়ে হেসে ফেললো। হাতের বন্ধন শক্ত করে বলল,

‘ আমরা রাস্তায় মিসেস। একটু দূরে হোটেল বুক করেছি। বেশি সময় লাগবে না, চলো যাই? ‘

নিনীকা শুনলো। অভাবেই পড়ে রইলো ধ্রুবের কোলে বসে কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে। হাত দু’খানা গলা জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ধ্রুব ওভাবেই জীপ টান দিলো। যেতে যেতে বউকে দেখতে গিয়ে মনের মধ্যে চিন্তারা বাসা বাঁধলো। তার মিসেসের কিছু তো একটা হয়েছেই!

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-৩৩+৩৪

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ )

বাগানে তৈরি করা বসার জায়গার পেছনে বড়বড় করে লেখা ‘ ধ্রুব ও নিনীকার হলুদ সন্ধ্যা।’ পাশাপাশি বসে আছে ধ্রুব ও নিনীকা। নিনীকার পড়োনে হলুদের মধ্যে সুন্দর কাজ করা লেহেঙ্গা। ফুলের গহনা পড়ানো হয়েছে। ধ্রুবর পড়োনে হলুদ পাঞ্জাবি। ধ্রুব সবাইকে দেখিয়েই বউয়ের হাত ধরে বসে আছে।

সর্বপ্রথম হলুদ ছুঁইয়ে দিলেন ধারা ও ফাহিম। তারপর একে-একে সমস্ত আত্নীয়রা। নিনীকার দু-চোখ কাউকে খুঁজছিলো।

সবার শেষে একটি মমতাময়ী হাত ছুঁয়ে দিলো নিনীকার গাল। মিথিলা একা নন পাশে রমজান শেখ দাড়িয়ে আছেন। সবার নজর এদিকেই। আত্নীয়দের মধ্যে একজন বলেই ফেললেন,

‘ কতো ইয়াং শ্বশুর শ্বাশুড়ি ধ্রুবর। ‘

রমজান শেখ হাতে হলুদ নিলেন, সবার আগে ধ্রুবর গালে ছুয়ালেন। তারপর নিনীকার গালে লাগিয়ে দিয়ে হাসলেন। নিনীকা শক্ত হয়ে বসে রইলো। বিস্ময়ে সে কথা বলতে পারছে না।

রমজান শেখ হাতের গিফটটা ধ্রুবর দিকে এগিয়ে দিলেন। ধ্রুব হাসিমুখে সেটা গ্রহণ করলো। ফটোশুট হলো। খাওয়া দাওয়া হলো। সবশেষে দুজনকে বাগানে ব্যবস্থা করা জায়গায় বসিয়ে গোসল করানো হলো। ধ্রুব বউকে কোলে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। ধারার আদেশে নিনীকাকে ফারিনের রুমের ওয়াশরুমে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো।

তারপর এলো মেহেদী লাগানোর পর্ব। ডোয়িং রুমে ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিনীকা ও ধ্রুবের পড়োনে সবুজ রঙের কারুকাজ করা পোশাক। নিনীকার হাতে প্রথম মেহেদী ধ্রুব নিজেই লাগিয়ে দিলো। বড়বড় করে লিখলো ‘ধ্রুব’ নামটি। বউয়ের মেহেদী দেওয়া শেষে ধ্রুবর হাতে মেহেদী লাগানো হলো। হাতের নখে মেহেদী দিয়ে মাঝে বউয়ের নামটাই লিখতে দিলো শুধু।

মেহেদীর ফটোশুট শেষ হতে হতে রাত্রীর বারোটা বেজে গেছে। নিনীকার দু-চোখ সেই দুজন ব্যক্তিকে খুঁজছে মনে মনে। ফারিনের থেকে জানতে পেরেছে তারা হলুদের অনুষ্ঠানের পরপরই চলে গেছেন, ধারা জোর করলেও থাকেন নি।

পুরো দু’তলা আত্নীয় স্বজনে ভর্তি। ধ্রুবর রুমে তার মামাতো দু’টো ভাইও থাকবে। খাওয়া দাওয়া করে সবাই একটু বিশ্রাম নিতে ঘরে চলে গেলো। ভোরের আগে উঠে আবার বিয়ের আয়োজন করতে হবে। যদিও ধারা কমিউনিটি সেন্টারে করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু ফাহিম মাহবুব তাতে নারাজ। তাদের বংশের কারো বিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে হয়নি। বউ কথা কও এই হয়েছে৷

বিয়ের দিন। ভোরে উঠতে হয়েছে সবাইকে। বাদ যায়নি ধ্রুব ও। নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে তাকেও কাজ করতে হচ্ছে। বাবুর্চি ইতিমধ্যে বাগানে রান্না করার জন্যে আগুন ধরিয়ে ফেলেছে। সবাই কিছু না কিছু করতে ব্যস্ত। ধারা কিচেনে গিয়ে নাস্তা বানিয়ে নিলেন। কম হলেও চল্লিশ জনের মতো হবে। অনুষ্ঠানে তো আরও মানুষ আসবেন, সবমিলিয়ে দুশোরও উপরে মেহমান। বিশাল আয়োজন হচ্ছে।

খাওয়ার ব্যবস্থা’টা বিশাল ডোয়িং রুমেই করা হয়েছে। কোণায় কনে ও বরের বসার জন্যে দুটি কারুকাজ করা চেয়ার।

দুপুর দুটো। ধারা নিনীকাকে নিচে নিয়ে আসতে বললেন। ফারিন, সুমিত্রা ও সাথে দুটো মেয়ে মাথার উপর দোপাট্টা ধরে আছে। লেহেঙ্গার দুটো সাইড উঁচু করে ধীরে ধীরে নেমে আসছে মেজর ধ্রুব মাহবুবের অর্ধাঙ্গিনী নিনীকা শেখ।

সিঁড়ির কাছে দাঁড়ানো ধ্রুব মুগ্ধ চোখে দেখলো। এর আগে নিনীকাকে বিয়ের সাজে দেখা হয়নি তার। শেষ সিড়িতে পা রাখতেই ধ্রুব নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো। নিনীকা সেটায় হাত রেখে তাদের জন্য ব্যবস্থা করা স্থানে চলে গেলো। সবার মধ্যমনি দুজন।

স্যুট বুট পড়া ফাহিম মাহবুব স্ত্রীর দিকে এগিয়ে এলেন। ধারা নীল জামদানী পড়েছেন। ফারিন পড়েছে সাদা গাউন। সুমিত্রা শাড়ি পড়েছে৷

‘লিপস্টিক ছড়িয়ে গেছে মুছে ঠিক করে নাও। ‘

ফাহিম মাহবুব রুমাল এগিয়ে দিলেন। তারপর ফোনের ক্যামেরা বের করে ধরলেন। ধারা সেদিকে তাকিয়ে রুমাল দিয়ে নিজের লিপস্টিক ঠিক করে নিলেন। ভালোবাসা নিয়ে ধরলেন স্বামীর হাত। এগিয়ে চললেন ছেলে ও পুত্রবধুর দিকে।

নিনীকা ও ধ্রুবকে সামনাসামনি দাড় করানো হয়েছে। আংটিবদল হবে। ধ্রুব জ্বলজ্বল করা হীরের আংটি তার অর্ধাঙ্গিনীর হাতে পড়িয়ে দিলো। নিনীকাকে সোনার আংটি দেওয়া হলো ধ্রুবকে পড়ানোর জন্যে। আংটিটা হাতে নিয়ে সে কিছু মুহুর্ত থমকে রইলো। সে যদি আজ চাকরি করতো তবে নিজের হাসবেন্ডকে নিজেই আংটি কিনে পড়িয়ে দিতে পারতো।

সদর দরজা দিয়ে অত্যন্ত সুদর্শন ও সুন্দরী দেখতে একটি জুটির আগমন ঘটেছে। রমজান শেখ মৃদু জোরে বললেন,

‘ মেয়ের জামাইকে তো আমাদের পক্ষ থেকে আংটি দেওয়ার কথা। ‘

নিনীকা চমকে তাকালো। মিথিলার মুখে স্নিগ্ধ হাসি। তিনি একটি আংটির বক্স এগিয়ে দিলেন। ধারা আগেরটা নিনীকার থেকে নিয়ে নিলেন। মিথিলা বললেন,

‘ কিছু মনে করবেন না আপা, এটা তো নিয়ম বলুন। ‘

ধারন হাসলেন,

‘ কিছু মনে করিনি। ‘

নিনীকার ঠোঁটের কোণে হাসি। সোনালী রঙের ঝলমলে আংটিটা পড়িয়ে দিলো ধ্রুবর আঙ্গুলে।

দুজনকে পাশাপাশি চেয়ারে বসানো হলো। একে একে মানুষজন আসছে, উপহার দিয়ে যাচ্ছে। ফটোশুট হচ্ছে। ধ্রুব ফিসফিস করে বলল,

‘ লাল রঙে রাঙানো রক্তজবা আমার, আমি তোমাতে মুগ্ধ হই বার-বার। ‘

নিনীকা মাথা নিচু করে হাসলো। আলগোছে টেনে ধরলো ধ্রুবের বাহু। মাথা এলিয়ে দিয়ে বলল,

‘ লাল শেরওয়ানিতে আমার সুদর্শন জামাই। ‘

অনেক মেহমান খেয়ে চলে গেছে। ধ্রুব ও নিনীকাকে খাওয়ানোর জন্যে টেবিলে বসানো হয়েছে। ধ্রুব নিজ হাতে বউকে খাইয়ে দিলো।

সবার খাওয়া শেষ হতে হতে গোধুলী পেরিয়ে গেলো। জ্বলজ্বল করে উঠলো চারিদিক। ডোয়িং রুমে রঙবেরঙের লাইট অন করা। মালা বদল করা হলো। পৃথিবীতে যখন অন্ধকার নেমে আসবে ঠিক সেই মুহুর্তে দুজনের মাথায় দোপাট্টা ধরা হলো। সামনে ধরা হলো কারুকার্যময় আয়না।

সুমিত্রা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করলো,

‘ আয়নাতে কি দেখা যায় জিজু মশাই? ‘

ধ্রুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। লাল রক্তজবার মতো ঠোঁট, নাকে নোলক, বন্ধ চোখ জোড়ায় সৌন্দর্যের আলপনা আঁকা। সিঁথিতে শোভা পাচ্ছে ছোট্ট একটি টিকলি। তার নজর আটকালো থুতনির ওই কালো কুচকুচে তিলে।

সুমিত্রা পুনরায় তাড়া দিলো,

‘ কি দেখা যায় জিজু? বলছেন না কেন? ‘

বন্ধ চোখজোড়া খুলে গেলো। ধ্রুব সেই কাজল কালো চোখে তাকিয়ে সম্মোহনী গলায় শুধালো,

‘ আমার মিসেস। ‘

নিরব এই প্রথম সম্বোধন করলো,

‘ আয়নায় কি দেখতে পাচ্ছেন ভাবি? ‘

নিনীকা কারুকার্যময় আয়নায় তাকালো। এ কয়েকদিনে চাপদাড়ি হয়ে গেছে, থুতনির নিচে, কপালে কাটা দাগ। হলদে ফর্সা মুখ, নিচের ঠোঁট চেপে ধরে রেখেছে। পড়োনে শোভা পাচ্ছে লাল শেরওয়ানি। গলায় মালা, পর্যবেক্ষণের এই মুহুর্তে তার ঠোঁট প্রসারিত হচ্ছে। নিনীকা মুগ্ধ চোখ সেই হাসিতে আটকে গেলো। শুধালো,

‘ মেজর ধ্রুব মাহবুবের মিসেস এর ভালোবাসাময় পুরুষ। ‘

চারিদিকে হৈহৈ পড়ে গেলো। সবার মুখে হাসি। ধ্রুব বউকে কোলে করে রুমে রওনা হলো। দরজা খুলতেই চোখেমুখে মুগ্ধতা ধরা দিলো। ফুলের বাগান করে ফেলেছে রুমটা। ফুলে সজ্জিত বিছানায় নিনীকাকে বসিয়ে দিলো। ফারিন তড়িৎ গতিতে নিনীকার পাশে বসলো।

‘ মাম্মা বলেছে নিচে যেতে। ‘

ধ্রুব অসহায় চোখে তাকিয়ে চলে গেলো। সুমিত্রা ফারিনের মাথায় চাপড় মারলো।

‘ শয়তান মেয়ে আমার জিজুটাকে ভালো করে বউকেও দেখতে দিচ্ছে না। ‘

ফারিন কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,

‘ আমার কি দোষ? মাম্মা বলেছে সে না বলা পর্যন্ত এদের একা না ছাড়তে। ‘

নিনীকা গভীর মনোযোগ দিয়ে কিছু ভাবছে। সুমিত্রা ধাক্কা দিলো,

‘ কি ভাবছিস? ‘

নিনীকা নিজের মোবাইল খুঁজলো। মনে পড়লো মোবাইলটা ধ্রুবর কাছে। সুমিত্রাকে বলল ধ্রুবকে ডেকে দিতে। সুমিত্রা বিনাবাক্যে ডাকতে চলে গেলো। ধ্রুব এসে বউয়ের কাছে বসলো।

‘ ডেকেছিলে? ‘

‘ মোবাইল দাও। ‘

ধ্রুব মোবাইল বের করে দিলো।

‘ আমি ভেবেছি তোমার আমাকে প্রয়োজন। ‘

সুমিত্রা দরজার পাশে লুকিয়ে ছিল। শব্দ করে হেসে ফেললো। ধ্রুব উঠে দাড়ালো। নিনীকা ফোনে আঙ্গুল চালাতে চালাতে বলল,

‘ মা চলে গেছে কি না জানতে হবে। ‘

নিনীকা ডায়াল করতেই মিথিলা রিসিভ করলেন। নিনীকাকে কিছু বলার সুযোগ দিলেন না।

‘ নিনীকা আমরা বাড়িতে যাচ্ছি, তোমার বাবাকে একটু পর ডক্টরের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তোমার নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা আমার মা। ‘

নিনীকার রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। কোনো প্রতুত্তর না করে মোবাইল কান থেকে নামিয়ে রাখলো।

ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি হয়েছে? ‘

সুমিত্রা এগিয়ে এলো,

‘ আপনি তাড়াতাড়ি যান জিজু, আন্টি এখন আপনাদের দুজনকে একসাথে দেখলে রেগে যাবেন। ‘

ধ্রুব চলে গেলো। নিচে অনেক কাজ আছে। ধারার বাবার বাড়ির ও ধ্রুবদের বংশের আত্নীয়রা কিছু রয়ে গেছেন। তারা একেবারে আগামীকাল বৌভাতের পর যাবেন।

ধ্রুবকে ঘরে পাঠানো হলো নয়টার পর। দরজা বন্ধ করে সে যখন বিছানার দিকে এগিয়ে গেলো তখন দেখতে পেলো তার বউ ঘুমিয়ে পড়েছে। বিয়ের সাজ এখনো রয়ে গেছে। গালে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর চিহ্ন। ধ্রুবর বুক ধক করে উঠলো। আলগোছে নিনীকার মাথা তুলে বুকে জড়িয়ে ধরলো। হাত দিয়ে সামনে আসা চুলগুলো কানে গুঁজে দিলো। গালে হাত ঠেকিয়ে মৃদু স্বরে ডাকলো,

‘ মিসেস? ‘

নিনীকা ফট করে চোখ মেলে তাকালো। ধ্রুব প্রশ্ন করলো,

‘ কেঁদেছ কেন? ‘

নিনীকা ঝাপটে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। ধ্রুবের চোখ টলমল করছে, ঠোঁট বেঁকে যেতে চাইছে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। নিনীকা এক সময় শান্ত হলো। ধ্রুব শক্ত কন্ঠে বলল,

‘ আজ হয় সব বলবে নয়তো আর কখনোই বলার দরকার নেই। ‘

(চলবে)

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

সময় গড়িয়েছে। রাত দশটা। দুজন কাপড় চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়েছে। একটু আগে ফারিন দুজনের খাবার দিয়ে গেছে উপরে। নিনীকা শক্ত হয়ে বিছানায় বসে। ধ্রুব নিজেই ভাত মাখিয়ে মুখে তুলে দিলো। নিনীকা বাধ্য মেয়ের মতো খেয়ে নিলো। ধ্রুব খেতে খেতে বলল,

‘ কেন এতো অবাধ্য হচ্ছো মিসেস? আমাকে কি এতোদিনে একটুও বিশ্বাস করতে পারোনি? তবে কেন বলেছিলে ভালোবাসো? ‘

নিনীকা টলমল চোখে তাকালো,

‘ আপনাকে আমি ভালোবাসি এবং সবচেয়ে বেশি বিশ্বাসও করি। কিন্তু আপনি বুঝতে পারছেন না, ব্যাপার টা আমার মা বাবার বিষয়ে। তিনি যতোই খারাপ হোন তাকে আর কারো কাছে খারাপ প্রমাণ করতে আমি চাই না। আপনাকে কি করে আমি সব বলি! ‘

ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাওয়া শেষ করলো। ডিম লাইট অন করে এসে শুয়ে পড়লো ফুলে সজ্জিত বিছানায়। নিনীকা বুকে আছড়ে পড়লো। ধ্রুবের পড়োনের টি-শার্ট টেনে খুলে রাগে ছুঁড়ে ফেললো রুমের এক কোণে। উন্মুক্ত বুকে দাঁত দিয়ে দংশন করে নিজের রাগ, চাপা অভিমান কমাতে চেষ্টা করলো। ধ্রুব মাথায় হাত ভুলিয়ে শান্ত করতে চাইলো।

‘ শান্ত হও, বলতে হবে না কিছু। ‘

নিনীকা ঠোঁট ফুলিয়ে মুখ তুলে তাকিয়ে কেঁদে ফেললো। ধ্রুব চোখের পানি মুছে দিলো।

‘ হুস কাঁদে না। ‘

‘ আপনাকে আমি বলবো, তবে কখনো তারা যাতে জানতে না পারে আপনি সব জানেন। ‘

ধ্রুব বউয়ের পড়োনের শার্ট ঘরের আরেক কোণে ছুড়ে ফেললো। নিজের উপর সমস্ত ভর নিয়ে হাতের বন্ধন শক্ত করে বলল,

‘ কেউ জানবে না। ‘

নিনীকা মাথা এলিয়ে দিলো।

‘ আমার আগমনী বার্তা শুনে বাবা খুশি হননি। কেন হননি জানি না। মা বলেছেন তাদের লাভ ম্যারেজ। বাবা ও তিনি একই ক্লাসে ছিলেন। সমবয়সী তারা। প্রথমে বন্ধুত্বের মতো সম্পর্ক গড়ে উঠে, তারপর প্রেম। আবেগের বয়স থেকে তাদের প্রেম বাবার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ পর্যন্ত চললো। তারপর পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হলো। বাবার বাবা মানে আমার দাদার অঢেল সম্পত্তি ছিলো। বাবা স্টুডেন্ট হলেও বেকারত্ব গুছিয়ে ফেলতে চেষ্টা করেছেন দাদার ব্যবসায় ঢুকে। ভালো বংশ, ছেলে ভালো। তার উপর কতো বছরের সম্পর্ক তাদের। সবাই রাজি হবেন স্বাভাবিক। আর আমার নানা মশাই তেমন রাগী মানুষ ও ছিলেন না। আগের যুগ হলেও মেয়ের মতামতের গুরুত্ব ছিল তার কাছে। ব্যস মা বাবার বিয়ে হয়ে যায়। বাবা নাকি মাকে অনেক ভালোবাসতেন। চিঠিপ্রেম ও বাদ যায়নি। তাদের যখন প্রতিষ্ঠান আলাদা হয় প্রেম চলাকালীন তখন নাকি বাবা শহরে বেশিদিন থাকতে পারতেন না। ছুটে গ্রামে এসে লুকিয়ে মায়ের সাথে দেখা করতেন। বিয়ের পরও বাবার সেই প্রেম এক চিমটিও কমেনি। কিন্তু বিয়ের পাঁচ মাস পর বাবা বদলে যান।

তিনি হোস্টেলে ছিলেন। মাকে ফোন করেছিলেন পরীক্ষা শেষ তিনি ফিরবেন। মা আমার আগমনের সংবাদ ফোনে দিলেন না। বাবাকে বলেছিলেন সারপ্রাইজ দিবেন। বাবা কথা রাখেন নি। পরের দিন বাড়ি ফিরেন নি। তার চার পাঁচ দিন পর বাড়ি ফিরেন। তখন তিনি মায়ের সেই প্রেমিক ছিলেন না, ছিলেন হিংস্র কোনো পশু। সেই যে বাবা বদলে গেলেন। মায়ের উপর তার হিংস্রতা ছিল মাত্রাধিক। আমার আসার খবর শুনে তিনি নাকি মাকে চড় মেরেছিলেন। অথচ এই তিনিই বাসর রাতে স্ত্রীর সাথে কথা বলেছিলেন, তার প্রথম সন্তানের নাম হবে নিনীকা শেখ।

আমার যখন জন্ম হলো তখন নাকি বাবা কোলে নেন নি। আমার এখনো মনে আছে, তখন কতোই বা বয়স হবে চার কি পাঁচ। বাবার কোলে উঠার বায়না করতাম। বাবা নিতেন না। মাঝে মধ্যে যখন আমি ঘরে একা থাকতাম তখন নিতেন। আবার নির্দয় ভাবে ছুঁড়েও ফেলতেন। আমি ব্যথায় ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতাম। তুমি ‘পচা বাবা’ বলে অভিযোগ করতাম।

একটু একটু করে বড়ো হচ্ছিলাম। আমার কাছে একজন ঘৃন্য লোক হলেন আমার বাবা। আমারই সামনে তিনি আমার মাকে অমানুষিক অত্যাচার করতেন। বন্ধ দরজার ভেতর থেকে আমার কানে ভেসে আসতো মায়ের চিৎকার। আট বছর বয়সেই আমাকে আলাদা ঘরে দেওয়া হলো। রাতের আঁধারে আমি মা মা বলে চিৎকার করে কাঁদতাম। কিন্তু মা আসতে চাইলেও বাবা আটকে রাখতেন।

আমার সাথে কেউ মিশতো না। স্কুলে যেতাম গাড়ি করে, আসতামও গাড়ি করে। কারো সাথে কথা বলতাম না। সবার বাবা তাদের স্কুলে নিয়ে যেতো। আমার বাবা যেতো না। সে কখনো আমার জন্যে চকলেট নিয়ে আসতো না। আমার পছন্দের চিপস খাওয়া বন্ধ করে দিতে হয় তার জন্য। আমার যা পছন্দ হতো, তা তিনি আমার থেকে কেঁড়ে নিতেন। পছন্দের পুতুল, পছন্দের খেলনা। আমি যখন ক্লাস এইটে তখন আমার একটি ছেলের সাথে বন্ধুত্ব হয়। আমাদের বাড়ির পাশের বিল্ডিংয়ের একটি ফ্ল্যাটে ওরা নতুন এসেছিলো। আমি ওর সাথে মাঠে খেলতে যেতাম। বাবা অফিসে গেলে বের হতাম, ফিরে আসতাম তার আসার আগে। মাঝে মধ্যে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ওর সাথে খেলতে চলে যেতাম। মা বারণ করতেন। বাবা জানলে রক্ষে থাকবে না। কিন্তু বাবা কিভাবে যেনো জেনে গেলেন। ওই ছেলেটাকে আমার সামনে প্রচন্ড মারলেন। ক্ষমতার জোরে ওদের শহর ছাড়া করে ছাড়লেন। আমাকে টেনেহিঁচড়ে ঘরে এনে ছুঁড়ে ফেললেন। বললেন, ‘ ছেলেদের থেকে যেনো দূরে থাকি। কোনো পুরুষ যেনো আমার আশেপাশে ও না আসে। ‘

আমি ভাবলাম হয়তো বাবা অন্য কিছু আন্দাজ করে এটা বলেছেন। বুঝাতে চেষ্টা করে বললাম, ‘ও শুধু আমার বন্ধু হয় বাবা, আমরা একসাথে প্রতিদিন মাঠে আরও ছেলেমেয়েদের সাথে খেলাধুলা করি। ‘

বাবা আমাকে দুদিন ঘরবন্দী করে রেখেছিলেন। মাকেও আসতে দিতেন না। দু’দিন পর আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। আমি ভয়ে ভয়ে থাকতাম। কোনো ছেলে আমাকে প্রপোজ করলে আমি ভয়ে কাউকে বলতাম না। বাবার কানে গেলে ওই ছেলেগুলোর অবস্থা খারাপ করে দিতো। আমি পাবলিকে চান্স পেলাম। হোস্টেলেই থাকতাম বেশিরভাগ। অনেক ছেলে মেয়েই বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছে। আমি পাত্তা দিতাম না।

টিউশনি করাতে শুরু করলাম। নিজের হাত খরচটা জুটে যেতো। ফাইনাল ইয়ার শেষ করে বাড়িতে তখন। আচমকা বাবা বিয়ে ঠিক করেন। আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করলাম। পারলাম না। মাকে ইমোশনাল ব্লেকমইল করলাম। সে আমাকে পাসপোর্ট এনে দিলো। ঠিক করলাম রমজান শেখের মান ইজ্জত ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে চলে যাবো।

বিয়ের দিন আমাকে পালাতে সাহায্য মা-ই করেছেন। বেলকনি দিয়ে বাগানে, বাগান থেকে লুকিয়ে বের হয়ে সিএনজি ধরে নিজের পরবর্তী গন্তব্যে।

বাবার পছন্দের প্রতি কখনোই আমার ভরসা ছিল না। আমার ধীরে ধীরে একটা ফোবিয়া তৈরি হয়ে গেছিলো। আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারতাম না। ছেলেদের তো নয়ই। প্রত্যেক মেয়ের জীবনে বাবা হয় প্রথম পুরুষ। তার থেকেই পুরুষদের ব্যাপারে ধারণাটা প্রথম পাওয়া যায়। আমার ধারণা পাওয়াটা তেমন ভালো ছিল না। আমি দেখেছি কিভাবে একজন পুরুষ স্বামী নামক ট্যাগ শরীরে লাগিয়ে দিনের পর দিন নিজের স্ত্রীর উপর জঘন্য সব নির্যাতন করে। আমি দেখেছি একজন পাষণ্ড বাবাকে।

সুমিত্রার সাথে পরিচয়টা অনলাইনে হয়। টুকটাক কথা হতো। একসময় সম্পর্ক গাঢ় হয়। আমার জীবনে একজন বন্ধু হয়। ওকে আমি সব শেয়ার করি বিশ্বাস করে। আমি সেদিন ভেবেছিলাম ও হয়তো আপনাকে সব বলে দিয়েছে। সেজন্য ওভাবে রেগে গেছিলাম। আপনার মায়ের সাথে ঝগড়া শুরু করেছিলাম ঠিক, তবে সর্বোচ্চ রাগ তখন হয় যখন তিনি মা বাবা নিয়ে কথা বলেন।

দীর্ঘ কথা বলে থামলো নিনীকা। তার চোখেমুখে কষ্টের চাপ। ছলছল চোখে ধ্রুবর দিকে মুখ তুলে তাকালো।

‘ আমাকে কখনো ছেড়ে যাবেন না, বদলে যাবেন না। কথা দিন। ‘

ধ্রুব দু’হাতে মুখ তুলে কাছাকাছি আনলো। কপালে গভীর ভালোবাসা নিয়ে চুম্বন করলো।

‘ তোমাকে ছেড়ে যাওয়ার আগে আমার হৃদপিণ্ড ছিঁড়ে যাক, পৃথিবী থেকে ধ্রুব নামটি মুছে যাক। ‘

নিনীকা কিছু একটা ভেবে বলল,

‘ আমি আপনার মা বাবাকে দেখে, আপনার আমার প্রতি ভালোবাসা, দায়িত্ব দেখে এতোটুকু বুঝেছি এক জনমের অর্ধেক সময় অবহেলায় কাটলেও বাকি সময়টা ভালোবাসাতেই কেটে যাবে। আমার এই ধারণাটা যেনো কখনো বদলে না যায়। এটার দায়িত্ব আমি আপনাকে দিলাম। ‘

‘ দায়িত্ব নিলাম তবে। ‘

নিনীকা তলপেটে চাপ অনুভব করলো। ধ্রুব নেশালো কন্ঠে শুধালো,

‘ পৃথিবীর সবকিছু ভেসে যাক, সবাই ছেড়ে চলে যাক। বদলে যাক সবকিছু। আমি মেজর ধ্রুব মাহবুব কথা দিচ্ছি সারাজীবন মিসেসের দেওয়া দায়িত্ব পালন করে যাবো ভালোবেসে। ‘

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-৩১+৩২

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩১
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

(কপি নিষিদ্ধ)

দীর্ঘ এক রাত এক দিন জ্বরে ভুগতে হয়েছে রমজান শেখ কে। এখন কিছু টা সুস্থ তিনি। কিন্তু শরীর প্রচন্ড দূর্বল। চেহারাটা যতোই অল্প বয়সী পুরুষদের মতো হোক, শরীর তো বয়সের সাথে সাথে ক্ষয়ে যেতে চাইবেই। রমজান শেখ নিজের শরীরের তেমন যত্ন নিতেন না। নিজের প্রতি ঘৃণা থেকে উপরে উপরে নিজেকে ভালো করেই রেখেছিলেন শুধু। যাতে সবাই ভাবে তিনি অলটাইম ফিট। ডক্টর বাসায় এসে দেখে গেছেন। শরীরের ডায়বেটিস কন্ট্রোলে নেই। শীগ্রই তাকে একজন ডায়াবেটিস ডক্টরের শরণাপন্ন হতে বলেছেন। যেহেতু জ্বর কমে গেছে সেজন্য এই সন্ধ্যা বেলাতেই মিথিলা রমজান শেখ কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলেন। কিন্তু বাঁধা দিলেন রমজান, তার সত্যিই আজ বিছানা থেকে উঠে বাহিরে পা রাখতে ইচ্ছে করছে না। মিথিলা মেনে নিলেন। গরম স্যুপ এনে খাইয়ে দিতে লাগলেন। স্যুপটা একটু টক, রমজান শেখ টক খেতে চেয়েছেন।

বউ কথা কও এ বিস্তর আলোচনা হচ্ছে। ধারা ছেলের আনুষ্ঠানিক বিয়ের প্রসঙ্গ তুলেছেন। ফাহিম মাহবুব চিন্তিত স্বরে বললেন,

‘ বউমার মা বাবাকে তো জানাতে হবে আগে। ‘

‘ তো জানাবো। দুই পরিবারের আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ‘

নিনীকা ফারিনের পাশে বসেছিল। এবার সে মুখ তুলে তাকিয়েছে। ধারা আগ্রহ দেখিয়ে বললেন,

‘ নিনীকা তোমার মা বাবার নাম্বার দাও তো। আমি কথা বলবো। ‘

ফাহিম মাহবুব নিজের মোবাইল থেকে রমজান শেখের নাম্বার বের করে দিলেন। ধারা সেই নম্বর টাতেই ডায়াল করলেন।

রমজান শেখের মোবাইল বিকট আওয়াজে বেজে উঠলো। রিসিভ করলেন মিথিলা। রমজান শেখ ইশারায় জিজ্ঞেস করলেন কে?

মিথিলা লাউঞ্জে দিয়ে দিলেন। ভেসে এলো ধারার গলা।

‘ আসসালামু আলাইকুম, আমি ধারা আহমেদ বলছি। ধ্রুবর মা। ‘

রমজান শেখ তৎক্ষনাৎ মোবাইল কেড়ে নিলেন। বললেন,

‘ আমি রমজান শেখ বলছি। ‘

ভেসে এলো ফাহিম মাহবুব এর গলা,

‘ রমজান শুনছিস? নিনীকা মা ও ধ্রুবর আনুষ্ঠানিক বিয়ের আয়োজন করবো ভাবছি। তুই কি ভাবিকে নিয়ে একবার বাড়িতে আসতে পারবি? ‘

রমজান শেখ আড়চোখে মিথিলার দিকে তাকালেন। মিথিলা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলতে বলছেন। রমজান শেখ উত্তর দিলেন,

‘ আমি তো অসুস্থ মিথিকে পাঠাবো না-হয়। ‘

ফাহিম মাহবুব ‘ঠিক আছে’ বলে রেখে দিলেন। ‘

মিথিলা ফুসফুস করে বললেন,

‘ সবকিছুতে তোমার বাড়াবাড়ি। কি হতো বললে যে আমরা যাবো? মেয়েটাকে কতোদিন দেখি না, বলতে পারতে ওদের আসার জন্য। ‘

রমজান শেখ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

‘ বলেছি তো তুমি যাবে। আর কি চাও? ‘

মিথিলা কাঁধে হাত রাখলেন,

‘ চলো না তুমিও যাবে। সুস্থ হয়ে যাবে তো। আমি থাকতে তোমার চিন্তা কিসের বলো তো? ‘

‘ মিথিলা, আমার মেয়ে আমার যাওয়াটা পছন্দ করবে না। তার খুশি আমার জন্যে নষ্ট হয়ে যাক তা আমি চাই না। তুমি যেও, ও তোমাকে দেখলে খুশি হবে। ‘

মিথিলা চুপ হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন এ সুযোগে মেয়েকে সব বলে আসবেন। জানিয়ে আসবেন নিজের স্বামীর অসহায়ত্ব, অভিযোগ, অপরাধবোধ, ঘৃণা থেকে করা কাজকর্মের কারণ!

পরদিন সকালে রমজান শেখকে ডক্টরের কাছে নিয়ে গেলেন মিথিলা। দুপুরের খাবার খাওয়ার পর রমজান শেখ ঘুমিয়ে পড়লেন। মিথিলা ড্রাইভারকে দিয়ে মেয়ের শ্বশুর বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেককিছু কিনলেন। তারপর গাড়িতে করে রওনা হলেন নিনীকার শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে।

বাড়ির কেউ এখনো দুপুরের খাবার খায়নি। সবাই সোফায় বসে অপেক্ষা করছে মিথিলার। উদ্দেশ্য একসাথে খাবার খাবে। সবার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে গেইট দিয়ে ঢুকলো একটি কালো গাড়ি। নিনীকা দৌড়ে সদর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেলো। মিথিলা গাড়ি থেকে বের হতেই ঝাপিয়ে পড়লো।

কতো দিন, কতো মাস পর! মা মেয়ের চোখে জল। মিথিলা মেয়ের কপালে আদর দিলেন। গালে হাত রেখে বললেন,

‘ কেমন আছিস নিনীকা? ‘

‘ আমি অনেক ভালো আছি মা, তোমার শরীর ভালো তো? ‘

‘ ভালো আছে। ‘

বাড়ির সবাই সদর দরজায় দাড়িয়ে আছেন। ধ্রুব এগিয়ে এসে সালাম দিলো। মিথিলা মেয়ে জামাইয়ের মাথায় হাত ভুলিয়ে দিলেন। ধারা ও ফাহিম মাহবুবের সাথে কুশল বিনিময় করে প্রথমবারের মতো প্রবেশ করলেন বউ কথা কও এ।

দুপুরের খাবার খেয়ে সোফায় বসে আলোচনা করা হলো। সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো এক সপ্তাহ পর শুক্রবারে অনুষ্ঠান করা হবে ধ্রুবদের বাড়িতে। মিথিলাকে উপরের রুমে রেস্ট করতে বলা হলো। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। ইচ্ছে ছিল মেয়েকে সব বলে দিবেন আজ। কিন্তু এই খুশির সময়ে এসব বলে মেয়ের মন খারাপ করাতে চাইলেন না। মাথায় চলছে স্বামীর চিন্তা। অসুস্থ মানুষ টা কি করছে কে জানে। মিথিলা বিদায় নিলেন। বিয়ের আয়োজন করার জন্যে অনেকবারই আসা যাওয়া হবে তার। মিথিলা যখন সদর দরজা পেরিয়ে গাড়িতে উঠবেন তখন নিনীকা দৌড়ে এলো। নিচু কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

‘ তিনি কি বেশি-ই অসুস্থ? ডাক্তার কি বলেছেন? ‘

মিথিলা না হেসে পারলেন না। বললেন,

‘ তিনি কিছু টা সুস্থ আছেন। ডায়বেটিস বেড়ে গেছে, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলাফেরা করতে হবে। তাহলে আগের মতো কন্ট্রোলে চলে আসবে। ‘

‘ তাকে মিষ্টি খেতে নিষেধ করো। ‘

‘ তুই করে দিস। ‘

নিনীকা মুখ অন্ধকার করে ফেললো,

‘ তোমার বরকে তুমিই বলো। ‘

‘ ওমা আমার বর কি তোর কেউ হয় না? ‘

‘ তোমার বর এতো শান্ত হলো কবে থেকে? আমি সংসার করছি, কিছু দিন পর আনুষ্ঠানিক বিয়ে। তার তো শান্তিতে থাকার কথা নয়। আফটার অল আমি তার পছন্দের পুরুষের সাথে সংসার করবো না বলে পালিয়ে গেছিলাম। আবার ফিরেও এলাম। যাই হোক তাকে আমার পক্ষ থেকে একটা ধন্যবাদ দিয়ে দিও। বাবা হিসেবে তিনি ভালো না হলেও আমার জন্যে ভালো কাউকেই চ্যুজ করেছিলেন। আমি সেজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ। ‘

‘ ধন্যবাদ টা তাকে তুই-ই দিস না-হয়। মানুষ টা খুশি হবে। ‘

‘ ওই জঘন্য ব্যক্তিটার প্রতি তোমার অন্ধ ভালোবাসা দেখলে আমার রাগ হয় মা। ‘

মিথিলা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

‘ ভালো থাকিস মা, মানুষটাকে পারলে ক্ষমা করে দিস।’

কালো গাড়িটি সাই-সাই করে চলে গেলো। নিনীকার চোখে অশ্রু টলমল করছে। যেকোনো সময় গড়িয়ে পড়বে ভাব। সে অশ্রুকণা ঝরতে দিলো না। চোখমুখ শক্ত করে রইলো। ওই মানুষটার জন্যে অশ্রু ঝরানোর কোনো মানে হয়না।

‘ তোমার মন খারাপ কেন মিসেস? ‘

নিনীকা মুখে হাসি ফুটাতে চেষ্টা করলো। ধ্রুব সম্মুখে এসে দাড়িয়েছে।

‘ একদম মিথ্যা হাসি দেখাতে চেষ্টা করবে না। কি হয়েছে বলো আমাকে। ‘

‘ কিছু হয়নি। এমনি মা চলে গেলো বলে খারাপ লাগছে। ‘

‘ শিওর? ‘

‘ হু। ‘

ধ্রুব কাঁধ জড়িয়ে ধরলো।

‘ তুমি ভালো করে মিথ্যাও বলতে পারো না আমার মিসেস। ‘

নিনীকা চুপ করে রইলো। ধ্রুব বউকে নিয়ে রুমে গেলো। কোলে বসিয়ে চেপে ধরলো সত্যি জানার জন্য। নিনীকা কেঁদে ফেললো।

‘ আপনি অনেক খারাপ, আমি ওই লোকটার জন্যে একদম কাঁদতে চাইনি। দিলেন তো কাঁদিয়ে। ‘

ধ্রুব হতভম্ব তার বউ কাঁদছে কেন!

‘ তুমি কার জন্যে কাঁদছো মিসেস? কে তোমাকে কি বলেছে বলো আমায়। ‘

‘ কেউ কিছু বলেনি। ‘

‘ তুমি নিজেই তো এখন বললে তুমি ওই লোকটার জন্যে কাঁদতে চাওনি। কোন লোকটা নিনীকা? ‘

নিনীকা রেগে ধ্রুবের বুকে দাঁত বসিয়ে দিলো।

‘ বলবো না, একদম বলবো না। ‘

(চলবে)

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

বউ কথা কও জ্বলজ্বল করছে। বাড়িকে ঘিরে রেখেছে রঙবেরঙের লাইট। সন্ধ্যার এই সময়টিতে গেইট দিয়ে ঢুকলো ধ্রুবর জিপগাড়িটি। গাড়ি থেকে নেমে দাড়ালো নিরব ও সুমিত্রা। সুমিত্রকাকে রিসিভ করার দায়িত্ব নিরবকে দেওয়া হয়েছিলো। বিয়ে বাড়ির সবাই আপাতত ব্যস্ত। আর মাত্র দুদিন পর বিয়ের অনুষ্ঠান। আগামীকাল গায়ে হলুদেরও আয়োজন করা হবে।

সুমিত্রা দৌড়ে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলো। ‘নিনীকা ইয়ার’ বলে চিৎকার করে উঠলো। উপর থেকে দৌড়ে নেমে এলো নিনীকা। একটি গভীর আলিঙ্গন হলো। উচ্ছাসে দুজনের মুখ দিয়ে খুশির শব্দ বের হচ্ছে। সুমিত্রা খুশিতে চিৎকার করছে।

বাংলাদেশে আবারও পা রাখতে পেরে তার অনেক আনন্দ হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি আনন্দের কারণ নিনীকার বিয়ে। যদিও মা বাবা রাজি ছিলেন না প্রথম। কারণ সুমিত্রার আশির্বাদ হয়ে গেছে। বিয়ে মাসের শেষের দিকে। এ অবস্থায় মেয়েকে ভিন্ন দেশে দিতে নারাজ ছিলেন তারা। অগত্যা ধ্রুবর মা বাবা ফোন করে অনুরোধ করলেন। আশ্বাস দিলেন সুমিত্রাকে সহিসালামতে পৌঁছে দিবেন তারা।

সুমিত্রার সাথে সবার পরিচয় করানো হলো। তারপর নিয়ে যাওয়া হলো রুমে। নিনীকার সময়টা ঘরেই কাটে এখন। বউ বলে তার বের হওয়া বারণ। দুদিন হলো ধ্রুবের থেকে আলাদা হতে হয়েছে তাকে। ধারার হুকুম, বিয়ের আগে আর বউয়ের কাছাকাছি থাকা যাবে না। নিজের মায়ের এহেন অত্যাচারে ধ্রুব মর্মাহত। দু’দিন ধরে বউ তার ধরাছোঁয়ার বাহিরে।

সুমিত্রাকে বলতেই সে খিলখিল করে হেসে উঠলো। আফসোস করে বলল,

‘ আহারে, বেচারা জিজু। দু’দিন ধরে না খেয়ে আছে। ‘

নিনীকা চোখ রাঙালো,

‘ চুপ কর বেয়াদব। কেউ শুনলে কি ভাববে। ‘

‘ ওমা তুই লজ্জা পাচ্ছিস নাকি? আমার ভাবনা কি তবে সঠিক? জিজু আর তোর মধ্যে সব হয়ে গেছে! ‘

নিনীকার মুখ লাল হয়ে গেলো।

‘ তুই চুপ করবি? ‘

সুমিত্রা অবাক হয়ে বলল,

‘ তোর এই রুপটা আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। জিজু কি বেশিই রোমান্টিক? নিতে পারিস তো? আজ সারারাত এই কয়েকদিনের তোর রাত্রি যাপন শুনবো। আ’ম সো এক্সাইটেড ডিয়ার। ‘

নিনীকা ওর কাঁধে চাপড় মারলো,

‘ চুপ কর না, তুই নির্লজ্জ হয়ে গেছিস। ‘

‘ ওমা তুমি করতে পারবে আর আমি বলতে পারবো না? ‘

নিনীকা প্রসঙ্গ পাল্টালো,

‘ যার সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে সে কেমন? ‘

সুমিত্রা সিরিয়াস হলো,

‘ মানুষ হিসেবে যতোটুকু বুঝেছি মন্দ না। ডাক্তারি পাশ করেছে। ফ্যামিলি ও ভালো। নাম অনিরুদ্ধ দাশগুপ্ত। দেখতে সুদর্শন বলা যায়। আমার সাথে মাঝে মধ্যে ফোনে কথা হয় শুধু। সে নিজেই খুঁজ নিতে ফোন করে। ভেবেছিলাম আমার বিয়ের পর তোর বিয়ে হবে, কিন্তু দেখ তোরটা আগে হয়ে যাচ্ছে। সেজন্য জামাই সহ আসতে পারলাম না। কিন্তু তুই জামাই নিয়েই আমার বিয়েতে যাবি। তখন তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো। ‘

নিনীকা জড়িয়ে ধরলো,

‘ অভিনন্দন ডিয়ার। ‘

দুজন ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। ধ্রুবের সাথে এই খাবার টেবিলেই দেখা হয় শুধু। কিন্তু তার বর আজ এখনো টেবিলে উপস্থিত হয়নি। নিনীকা আশপাশে উঁকিঝুঁকি দিলো। সদর দরজা দিয়ে ধ্রুবকে ঢুকতে দেখা গেলো। পড়োনে বাহিরের পোশাক। চেহারায় ক্লান্তি ভাব। উপরে যেতে যেতে নিনীকার দিকে অসহায় চাহনি নিক্ষেপ করলো। সুমিত্রা সেটা দেখে বলল,

‘ ইশ, আমার জিজুটার কতো কষ্ট হচ্ছে। বেচারা! ‘

নিনীকার মন খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটা ক্লান্ত শরীরে ফেরার পর তাকে সবসময়ই জড়িয়ে ধরে। আদর দিয়ে তারপর ফ্রেশ হতে যায়। দুদিন ধরে সেটাও পারছে না। বাড়ি ফিরে বউকে কাছে পাচ্ছে না বলে নিশ্চয়ই তার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তার মানুষটার রোমান্টিসিজম একটু বেশিই। এমন নয় যে নিনীকার সেগুলো বিরক্ত লাগে। তার ভালো লাগে। সব শেষে যখন মানুষটার চোখেমুখে তৃপ্তি দেখতে পায় তখন নিজেকে সুখী সুখী লাগে। নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হয়। নিনীকা সেই সুখানুভূতি মিস করছে। প্রচন্ড ভাবে মিস করছে। ভেতরের উত্তেজিত মন গোপন কিছুর জন্যে হাহাকার করছে। আন্দোলন তুলছে বিশ্রীভাবে।

ধ্রুব ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। চেয়ার টেনে নিনীকার মুখোমুখি বসলো। পাশে ফারিন। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ভাই ভাবীকে দেখে রাখার। টেবিলে তেমন কেউ নেই। ফাহিম মাহবুবের বংশের আত্নীয়রা আগামীকাল আসবেন। আগামীকাল বিদেশ থেকে ধারার ভাইয়েরা আসবেন। অর্থাৎ সবাই আসবেন আগামীকাল। আজ শুধু সুমিত্রা এলো। নিরব তো আর সবমসময় থাকছেই। তার উপর অনেক দায়িত্ব।

ধ্রুবর প্লেটে লেগ পিস পড়লো। সে সেটা তুলে বউয়ের প্লেটে দিয়ে দিলো। ধারা ও ফাহিম নিশ্চুপে হাসলেন। ফারিন ভাইয়ের কানে কানে বলল,

‘ ভাবির দিকে তাকাচ্ছো না কেন তুমি? দেখো ভাবিকে কতো সুন্দর লাগছে। ‘

ধ্রুব তাকালো। এবং তার সর্বনাশটা হয়েই গেলো। এতোক্ষণ মনে মনে বললো তাকাবে না৷ বউ ছাড়া থাকাটা এমনিতেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে তার।

নিনীকার নাকে হীরের ছোট্ট নাক ফুল জ্বলজ্বল করছে। পড়োনে গোলাপি রঙা শাড়ি। ধ্রুব ঢুক গিলে মাথা নিচু করে নিলো।

সুমিত্রা ফিসফিস করে নিনীকাকে বলল,

‘ আমার তো বুকটা ফেটে যাচ্ছে দোস্ত। মুখটা একবার দেখ। ‘

নিনীকা তাকালো, ধ্রুব ও তাকিয়েই ছিল। দুজনের চোখাচোখি হলো। নিনীকা মুচকি হাসলো। ধ্রুব বিনিময়ে চোখের ইশারায় খেতে বলল।

রাত তখন নয়টা। নিনীকাকেও ফারিনের ঘরে থাকতে দেওয়া হয়েছিল। এবার থেকে সুমিত্রাও থাকবে। ফারিন ঘুমে কাত৷ আজ তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়েছে সবাই। তাছাড়া সকাল থেকে সবাইকেই দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। সেজন্য সবাই ক্লান্ত। সুমিত্রা নিনীকাকে আস্তে করে বলল,

‘ আমি ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে নেবো। তুই জিজুর কাছে চলে যা। ‘

নিনীকার মুখশ্রী উজ্জ্বল হলো। সে বের হয়ে যেতেই সুমিত্রা দরজা লাগিয়ে বিছানায় এলো। ফারিন ফট করে চোখ মেলে তাকালো।

‘ মাম্মা জানতে পারলে আমাকে ছাড়বে না। ‘

সুমিত্রা গাল টেনে দিলো,

‘ কেউ জানবে না। তোমার ভাবি সবাই জেগে উঠার আগেই ফিরে আসবে। তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমাও, চিন্তা করার জন্যে আমি আছি। ‘

বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে এক হাত কপালে রেখে চোখ বন্ধ করে ছিল ধ্রুব। দরজা লাগানোর শব্দে উঠে বসলো। লাইট অন করে সম্মুখে তাকাতেই চমকে গেলো।

‘মিসেস। ‘

নিনীকা দৌড়ে এসে ঝাপিয়ে পড়লো। ধ্রুব চিৎ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। নিনীকা আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। ধ্রুব পিঠে হাত রাখলো।

‘ শান্ত হও, আমি আছি তো। ‘

নিনীকা তখনো কাঁপছে। ধ্রুব হাতের সাহায্যে মুখ তুলে ধরলো।

‘ কাঁদছো কেন মিসেস? আমি আছি তো। ‘

‘ মিস ইউ মেজর। ‘

ধ্রুব ঠোঁট চেপে হাসলো,

‘ তোমার মেজরও তোমায় মিস করেছে মিসেস। ‘

নিনীকা ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁধে মুখ গুঁজে দিলো। হাতের সাহায্যে এক এক করে খুলে ফেললো ধ্রুবের পড়োনের শার্টের বোতাম।

মধ্যরাত। ঘুম নেই দুজনের চোখে। ধ্রুবের বুকে মুখ গুঁজে রেখেছে নিনীকা। আরেকটু পর আবারও আলাদা হয়ে যেতে হবে তাদের। ধ্রুব কখনো ঠোঁট ছুঁইয়ে দিচ্ছে কখনো হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে। কখনো সান্তনা দিচ্ছে,

‘ আর মাত্র একদিন, তারপরই আবারও আমরা একসাথে থাকবো। কেঁদো না। আমার তোমাকে কাঁদতে দেখতে ভালো লাগে না। তুমি না স্ট্রং মেয়ে? আমার মিসেস এতো আবেগি হলো কবে থেকে? ‘

নিনীকা রেগে নাকমুখ কোঁচকালো,

‘ আবগেটা আপনার জন্যেই বেড়ে গেছে। ঠিক আছে আর আসবো না। চলে যাচ্ছি। ‘

নিনীকা সত্যি সত্যি উঠে যাচ্ছে। ধ্রুব টেনে জড়িয়ে ধরলো।

‘ তুমি এভাবে কাঁদলে আমি কিন্তু কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলবো মিসেস। দেখা গেলো সকালে দরজার বাহিরে তোমার শ্বাশুড়ি খুন্তি হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছেন। ‘

নিনীকা চোখ ছোটছোট করে তাকালো,

‘ কিছু ঘটাতে বাদ রেখেছেন নাকি? ‘

ধ্রুব হাসলো,

‘ সামান্যতে কি আর মনে ভরে গো? যদি চাও তো আমি শুরু করতে পারি।

ধ্রুব চোখ মারলো। নিনীকা চুল টেনে দিলো।

‘ অসভ্য মেজর। ‘

‘ নিনীকা, আমার রোমান্টিক বউ। ‘

নিনীকা বুকের উপর উঠে বসেছে। ধ্রুব মুখ তুলে চোখ ভুলিয়ে বলল,

‘ আমার আবেদনময়ী মিসেস। ‘

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-৩০

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-৩০
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

খাবার টেবিলে বিশাল আয়োজন। দুপুরের খাবার খেতে বসেছে সবাই। নিরবকে ফাহিম মাহবুব যেতে দেন নি। বলেছেন দুপুরে খেয়ে তারপর যেতে। নিরব মেনে নিলো। তার তেমন কাজ নেই, বর্তমানে ধ্রুবের মতো সেও ছুটিতে আছে। সুতরাং আরও কিছু সময় থাকাই যায়।

নিনীকা ওড়না দিয়ে বারবার শরীর ঢাকতে চেষ্টা করছে। মাঝে মধ্যে রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে ধ্রুবের দিকে। দিনেদুপুরেও এই লোকের রোমান্স পায়। ধ্রুব টেবিলের নিচে নিজের পা দিয়ে নিনীকাকে খুঁচিয়ে মজা নিচ্ছে। একটি হাত রেখেছে নিনীকার হাটুর কাছে। খেতে খেতে মাঝে মধ্যে এটা সেটা বউয়ের প্লেটে তুলে দিচ্ছে। নিনীকার তখন রাগ চলে যায়। এতো যত্নশীল তার বরটা।

সকালে ধ্রুব বউকে নিয়ে সেই যে দরজা দিয়েছে তারপর আর খুলেনি। ধারা ফাহিম মাহবুবকে টেনে নিয়ে গেছেন। ছেলে বিবাহিত তা এই লোকটার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো হয়তো। ছেলেটাও হয়েছে তেমন। যেমন বাপ তার তেমন ছেলে।

ফারিনের সামনাসামনি চেয়ারে বসেছে নিরব। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সে সামনের দিকে তাকাচ্ছে। চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে নিচ্ছে। ফারিন বিরক্ত হচ্ছে প্রচন্ড। এমন ছ্যাচড়া লোক তার পছন্দ নয়। এই বেটা যে তাকে মনে মনে পছন্দ করে সে তা বুঝে গেছে। বুড়ো লোক কোথাকার, হাটুর বয়সী মেয়ের দিকে নজর দেয়! ফারিন বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ আপনি বাব-রার এদিকে তাকিয়ে কি দেখেন মিস্টার ক্যাপ্টেন? ‘

নিরবের গলায় খাবার আটকে গেলো। ধারা পানি এগিয়ে দিলেন। ফাহিম মাহবুব চিন্তিত হয়ে বললেন,

‘ কি দেখো অফিসার? ‘

নিরব অসহায় চোখে তাকালো। এ বাড়ির কেউ তার পরিস্থিতি বুঝতে পারছে না। আমতা আমতা করে বলল,

‘ সামনাসামনি বসেছেন উনি সেজন্য বার-বার নজর সেদিকেই চলে যায়, আ..মানে বলতে চাইছি আমাদের নজর সবমসময়ই সামনের দিকেই যায়। আপনি যদি সামনে বসতেন তবুও যেতো। যেমন আপনার সামনের দিকে মেজর বসে আছেন। আপনার নজর সর্বপ্রথম সেদিকেই যাবে না? ‘

ফাহিম মাহবুব মাথা নাড়ালেন। ফারিন চোখমুখ শক্ত করে নিলো। কি ধান্দাবাজ লোক!

খাওয়া শেষ হলে নিরব কিছুক্ষণ সোফায় বসে এটা সেটা বললো। তারপর বিদায় নিলো। ফারিন হাফ ছেড়ে বাচলো। মনে মনে বিরবির করলো,

‘ আর আসিস না ভাই, নিজের বয়সী কাউকে খুঁজে নে। বাবা মার আহ্লাদী কন্যা নাহলে তোকে কি যে করতাম! ‘

বউ কথা কও এ আড্ডা জমেছে। ফারিন একপর্যায়ে বললো,

‘ চলো সবাই একটা গেম খেলি? ‘

নিনীকা আগ্রহ দেখালো,

‘ কি গেম? ‘

‘পাপা বলবে, পাপা বলো না কি খেলা যায়। ‘

ফাহিম মাহবুব বললেন,

‘ লুডু খেলবো চলো। ‘

‘ কিন্তু আমরা তো পাঁচ জন। ‘

ধ্রুব উঠে দাড়ালো,

‘ তোমরা খেলো, আমি একটু ঘুমাবো। ‘

নিনীকা আড়চোখে তাকাতেই ধ্রুব ইশারা করলো। নিনীকা উঠে ধ্রুবের পেছন পেছন চলে গেলো। যাওয়ার আগে বলে গেলো,

‘ আমি আসছি, ততোক্ষণে তুমি লুডু বের করো ওকে? ‘

ফারিন খুশি হয়ে লুডু বের করে আনতে চলে গেলো।

রুমে এসে ধ্রুব দরজা দিলো। নিনীকাকে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়লো। নিনীকা কিছু বললো না। নিশ্চুপে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে লাগলো। ধ্রুব মাথা তুলে দীর্ঘসময় নিয়ে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিলো। তারপর তলিয়ে গেলো ঘুমের রাজ্যে। নিজের উপর ধ্রুবর গরম নিঃশ্বাস অনুভব করতেই নিনীকা বুঝলো তার বর ঘুমিয়ে পড়েছে। নিজের পরিবর্তে পাশবালিশ রেখে রুম থেকে বের হয়ে গেলো ধীরে ধীরে। ধ্রুবের ঠোঁট কিঞ্চিৎ বেঁকে গেলো। বউয়ের জায়গায় বালিশে মুখ গুঁজলো।

ধ্রুব যখন ঘুম থেকে উঠে নিচে নামলো তখন বিকেল হয়ে গেছে। এখনো খেলা চলছে। সে বউয়ের সাথে ঘেষে বসলো। ফারিন উচ্ছাস নিয়ে বলল,

‘ ব্রো বাবা ও ভাবিকে আমি ও মা দুবার হারিয়েছি। এবারও ওরাই হারবে দেখো। ‘

ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে হেসে নিনীকার দিকে তাকালো। বেচারি অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ আমি তেমন পারি না তো, তবে বাবা পারেন। আপনি আমার হয়ে খেলায় উঠুন না, বাবাকে জিতিয়ে দিন একবার। ‘

ধ্রুব নিজের জায়গায় নিনীকাকে বসিয়ে নিজে নিনীকার জায়গায় বসলো। ফারিন এবার নাক ফুলালো,

‘ তোমার সাথে কি আমি পারবো? এটা চিটিং না? তুমি কেন ভাবির বদলে খেলবে? ‘

ধারা ফাহিম মাহবুবকে কটাক্ষ করলেন,

‘ দুটোই গাধা, দেখছিস না দু’বার হেরে গেছে। তা বাবা আমার তুমি এবার দেখো এদের জেতাতে পারো কি না।’

ফাহিম মাহবুবের মুখে কোনো কথা নেই। চেহারার অবস্থা থমথমে। নিনীকা এই নিয়ে দশবার শ্বশুরকে স্যরি বলেছে। পরের সময়টা দুর্দান্ত খেললো ধ্রুব। এবং এবার জিতেও গেলো। নিনীকা খুশিতে ধ্রুবকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। ফারিন কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,

‘ আমি মানি না, ব্রো তুমি ওদের জিতিয়ে দিলে। ‘

ধারা ঘরের দিকে উঠে যেতে যেতে বললেন,

‘ সবকটা চিটিংবাজ, চলে আয় মা এদের সাথে আর খেলিস না। ‘

ফাহিম মাহবুব মেয়ের মাথায় হাত ভুলিয়ে দিলেন,

‘ বাবা হেরেছি তো মা, তুমিই তো জিতলে। তিন ম্যাচের মধ্যে দু’ম্যাচ তুমি জিতেছো। তার মানে তো উইন তুমি। বুঝেছো? ‘

এবার ফারিন খুশি হয়ে গেলো। ধারা সিঁড়ি পেরিয়ে যেতে যেতে হাসলেন। এ লোক সর্বদা মেয়ের মন রাখতে চেষ্টা করে।

ফাহিম মাহবুব উঠে ঘরে চলে গেলেন। ফারিন পড়তে বসতে হবে বলে চলে গেলো। রইলো ধ্রুব ও নিনীকা। ধ্রুব হাই তুলতে তুলতে বউকে টেনে নিজের কোলে বসালো।

‘ তুমি আমাকে ঘুমে রেখে চলে এসেছো, এতবড় সাহস।’

নিনীকা ঠোঁটে চুমু খেলো।

‘ ফারিন বলেছিল তো, না এলে মন খারাপ করতো না বলুন? ‘

ধ্রুব হাত টেনে পেটে রাখলো,

‘ অনেক ক্ষিধে পেয়েছে। ‘

নিনীকা উঠে কিচেনে চলে গেলো। ফিরে এলো দশ মিনিট পর। ধ্রুবের সামনের ছোট টেবিলে ভাত ও গরম তরকারি রাখলো। ধ্রুব এতোক্ষণ ধরে চালানো ফোনটা নিনীকার কাছে দিয়ে প্লেট হাতে নিলো। নিনীকা স্কিনে তাকালো। ফেসবুক লগইন করা। সে ধ্রুবের আইডি ঘুরতে লাগলো। মাঝে মধ্যে হা করে ধ্রুবর হাতে খেতে লাগলো।

প্রোফাইলে বাগানে তুলা সেই ফটো দেওয়া। নিনীকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘ এটা কখন দিলেন? ‘

‘ মাত্রই। ‘

ধ্রুবর লিস্টে ফারিন ও ধারা ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই। তার উপর প্রোফাইল লক করা। হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ শুধু। রিলেশনশিপ দেওয়া নেই। নিজের আইডি খুঁজে রিকুয়েস্ট পাঠালো। নিনীকা নিজের ফোন খুঁজলো। ধ্রুব পকেট থেকে বউয়ের ফোন বের করে এক হাতে নিজেই অন করলো। নিজেই নিজেকে এক্সেপ্ট করে নিলো। নিজের আইডির সাথে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস ম্যারিড দিয়ে তবেই থামলো। নিনীকা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে। ধ্রুব দাঁত বের করে হাসছে।

‘ তোমার আইডির সব ছেলে আনফ্রেন্ড করে দিয়েছি। ‘

‘ আমার আইডিতে ছেলে বলতে তেমন কেউ ছিলো ও না, কিছু ক্লাসমেইট ছিল হয়তো। ‘

ধ্রুব মুখে ভাত ঢুকিয়ে দিলো।

‘ যে-ই হোক, আনফ্রেন্ড করে দিলাম। ‘

নিনীকা ভাত গিলে বলল,

‘ আপনি তো অনেক হিংসুটে। ‘

‘ তোমার মতো। ‘

‘ আমি কি করেছি? ‘

‘ এইযে দেখছো তোমার বরের লিস্টে কোন মেয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে কি না ‘

নিনীকা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ অনেক মেয়ে ঝুলে আছে, এতো এতো ফলোয়ারস আপনার। বেছে বেছে কয়েকজনকে এড করে দেই? ‘

ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে হাসলো,

‘ দরকার নেই, আমার মিসেস আছে। ‘

‘ তাতে কি? ‘

‘বউ থাকতে অন্য মেয়ে লিস্টে নিয়ে আইডি অপবিত্র করবো কেন? তাছাড়া আমি প্রচুর বউ পাগল, বউকে অনেক ভালোবাসি। আমার বউয়ের এতোটুকু খারাপ লাগাও আমার সহ্য হবে না। দরকার হলে ফেসবুক আইডিই রাখবো না। তবুও সে যাতে মন খারাপ না করে। ‘

নিনীকা ঠোঁট ফুলিয়ে বুকে ঝাপিয়ে পড়লো। ধ্রুব সাবধানে হাতের প্লেটটি নিচে রাখলো। হাত দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে চুলের ভাজে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

‘ তোমাকে আমি অনেক ভালোবাসি মিসেস। ‘

নিনীকার কান্নারত স্বর,

‘ মিসেসও আপনাকে অনেক ভালোবাসে ধ্রুব। ‘

‘একটা কথা রাখবে? ‘

‘কি? ‘

‘তুমি করে বলা যায় না? আপনি বলে ডাকাটা এখনের যুগের জন্য ঠিকঠাক যদিও। বাট আমার ওই পুরনো ব্যাকডেটেড তুমি ডাক-টাই শুনতে ইচ্ছে করে। ‘

‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি ধ্রুব। ‘

ধ্রুবের ঠোঁট প্রসারিত হলো।

‘ মেজর ধ্রুব মাহবুবের মিসেস হওয়ার জন্যে, আমাকে এভাবে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্যে, তোমাকে আমার হওয়ার জন্যে ধন্যবাদ মেজরের বউ। ‘

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-২৯

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৯
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

‘ভালোবাসার মিথিলা বেগম,

‘ পত্রে সবার আগে আমার সালাম নিও। বাবাকে আমি তোমার কথা জানিয়েছি অনেক আগে। তিনি শীগগির তোমাদের বাড়িতে প্রস্তাব রাখতে যাবেন। তুমি মনে কোনো চিন্তা রেখো না। হোস্টেল থেকে ফিরলেই আমি তোমাকে দেখা দেবো। ততোদিন একটু মনোকষ্ট সহ্য করে নাও। শহর থেকে পরিচিত একজন ভাই গ্রামে যাচ্ছেন। তাহার কাছে তোমার জন্যে নিজের প্রথম ইনকাম দিয়ে কেনা কিছু উপহার পাঠিয়েছি। দেখা করার সময়ে তোমাকে আমি সেগুলোতে দু-চোখ ভরে দেখতে চাই। প্রাণের মিথিলা বেগম তুমি অপেক্ষায় থেকো। ‘

ইতি
তোমারই শেখ বাবু

‘ পুরনো চিঠিটা পড়ে মিথিলার বুকে ঢেউ বইতে লাগলো। তাদের প্রেমের সময়কার এরকম কতশত চিঠি আছে। দুজন দুজনকে চিঠি লিখতেন মাঝে মধ্যে। রমজান শেখের বাড়িতে বা হোস্টেলে টেলিফোন থাকলেও মিথিলাদের বাড়িতে ছিল সবে একটা। তাও বাবার ঘরে। মিথিলা চুপিচুপি সেটা দিয়ে কথা বলতেন। মনে চলতো ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। অথচ তার বাবা কন্যার এহেন প্রেমের বিষয়ে আগেই অবগত ছিলেন। অগোচরে খোঁজ খবর নিয়ে যখন জেনেছেন ছেলে ভালো পরিবারের তখনই চুপ হয়ে গেছেন। অপেক্ষা করেছেন সঠিক সময়ের। সেই সঠিক সময় আসে। রমজান শেখের বাড়ি থেকে প্রস্তাব রাখা হয়। তারই পরিপেক্ষিতে আজ মিথিলা তার জীবনের একমাত্র প্রেমিকের বউ। দুজন বয়সে প্রায় সমবয়সী। গ্রাম থেকে শহরে বাড়ি করেছেন রমজান শেখ। গ্রামের বাড়িটা এখনো পড়ে আছে। নিনীকা হওয়ার পরই এখানে একেবারে চলে আসতে হয় তাকে। নিনীকার দাদাবাড়ি বা নানাবাড়ির তেমন কারো সাথে যোগাযোগ নেই। রমজান শেখ বাবার একমাত্র পুত্র। এদিকে মিথিলার বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইদের সাথে দূরত্ব বেড়ে যায়। সারাজীবন এই বাড়িতেই কাটিয়েছেন, কখনো সেভাবে কোথাও আর যাওয়া হয়নি।

পুরনো স্মৃতিচারণ বন্ধ করে মিথিলা বিছানার দিকে অগ্রসর হলেন। রমজান শেখের চোখজোড়া বন্ধ। কপাল তীব্র গরম। মিথিলা ওয়াশরুম থেকে পানি নিয়ে এলেন। কপালে জলপট্টি দিতে দিতে আচমকা কিভাবে ঘুমিয়ে গেলেন বুঝতেও পারলেন না।

চারিদিকে সবুজে ঘেরা। বাড়িটির বাগানের ঘাসগুলোতে ফুটেছে পুর্তলিকা। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ফারিন ও নিনীকা বাগানে এসেছে। দুজনে হাত বাড়িয়ে ফুল ছিঁড়ে কানে গুঁজেছে। কথা বলতে বলতে কখনো একে অপরের উপর হেসে হেলে পড়ছে। ধারা বারান্দায় দাড়িয়ে কফি খেতে খেতে সে-ই দৃশ্য মনোযোগ সহকারে দেখছেন। ফারিনের চোখ বারান্দায় পড়তেই চকচক করে উঠলো মুখ।

‘ মাম্মা তুমিও এসো। ‘

ধারা বারান্দা পেরিয়ে সিঁড়ি, সিঁড়ি পেরিয়ে সদর দরজা পেরোলেন। নেমে এলেন বাগানে। নিনীকা রক্তের মতো টুকটুকে জবা ফুল ছিঁড়ে তার কানে গুঁজে দিলো। ধারার পড়োনে ফাহিম মাহবুবের গতকাল কিনে আনা খয়েরী রঙের জামদানী শাড়ি। ব্রাউন ও কালো রঙের মিশ্রিত চুলগুলোতে ছোট্ট একটি বেনী করা। ঠোঁটে হালকা লিপবাম। ফাহিম মাহবুব বাগানে উপস্থিত হলেন। স্ত্রীর এহেন রুপ মুগ্ধ চোখে দেখলেন। ফারিন হেসে বলল,

‘তুমিও কি কানে ফুল গুঁজবে পাপা? ‘

‘ না আমার মা, ফুল ফুলদেরই মানায়। ‘

‘ আমাদের কেমন লাগছে পাপা? মাম্মাকে দেখো কতো বিউটিফুল লাগছে না? ‘

ফাহিম মাহবুব হাসলেন,

‘ তোমার মাম্মাকে সবসময়ই সুন্দর লাগে। ‘

ধারা গম্ভীর হতে চেষ্টা করলেন। পারলেন না। তার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠেছে। ছেলেমেয়েদের সামনে স্বামীর প্রশংসনীয় মন্তব্যে তার লজ্জাও লাগছে। ফাহিম মাহবুব সুযোগ নিলেন। বললেন,

‘ দেখো তোমার মা কিভাবে লজ্জা পাচ্ছে। ‘

ফারিন তাকালো,

‘ তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো মাম্মা? ‘

ধারা চুপ করে রইলেন। নিনীকা হাতের ফোনে ক্যামেরা অন করে বলল,

‘ আপনাদের একসাথে একটা ছবি তুলি বাবা? ‘

ফাহিম মাহবুব খুশি হলেন,

‘ অবশ্যই, অবশ্যই। ‘

ধারাকে টেনে নিয়ে ফারিন জবা ফুলের গাছের সামনে দাড় করালো। ফাহিম মাহবুব স্ত্রীর কাঁধে এক হাত জড়িয়ে দাড়িয়ে রইলেন। দুজনের মুখে হাসি। নিনীকা দৃশ্যটি ক্যামেরায় বন্দি করলো। ফারিন মা বাবার মাঝে গিয়ে দাড়ালো। তার কানে পুর্তলিকা ফুল। মা বাবার মধ্যে তাকে একটি পরীর মতো লাগলো। ছোট্ট পরী।

নিরবকে রাতে থেকে যেতে হয়েছিল। ধ্রুবের সাথে কথা বলতে বলতে পায়ে পা মিলিয়ে হেঁটে বাগানে এলো। অংশ নিলো আনন্দের এই মুহুর্তে। ফারিন একটি ফুল বাড়িয়ে দিলো,

‘ আপনি কি কানে ফুল গুঁজবেন? ‘

নিরবের কন্ঠ থমথমে,

‘ জি না। ‘

নিনীকা ধ্রুবর কানে বড়ো একটি সাদা পুষ্প গুঁজে দিলো। টেনে মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে ক্যামেরায় দুজনকে বন্দি করলো। ধ্রুব ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

‘ এসব কি? আমার কানে ফুল কেন? ‘

‘ কোথায় লিখা আছে ছেলেরা ফুল কানে দিতে পারবে না? আপনাকে ফুলবাবু লাগছে মোবাইলে দেখুন। ‘

ফারিন হাসছে,

‘ তোমাকে সুন্দর লাগছে ভাইয়া। ‘

ফাহিম মাহবুব ছেলেকে দেখলেন।

‘ ফুল কানে দেওয়াতে তোমার দজ্জাল চেহারা কিছু টা নমনীয় লাগছে বেটা। ‘

ধারা চোখমুখ কুঁচকে তাকালেন,

‘ একদম আমার ছেলেকে দজ্জাল বলবে না। নিজে কি ছিলে? চাকরি করতে হলে সবাইকেই ওরকম হতে হয়। সে তো আমি দরদি তোমাকে মায়া করে বিয়ে করেছি, নাহলে বিয়ের জন্য মেয়েই পেতে না। ‘

ফাহিম মাহবুব হাসলেন,

‘ ভাগ্যিস তুমি বিয়ে করেছিলে, নাহলে যে কি হতো! সেটা কল্পনা করেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। চেক করে দেখো। ‘

ধারা মুখ শক্ত করে চুপ করে রইলেন। ফারিন খিলখিল করে হেসে পেছন থেকে ভাইয়ের গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলছে। ধ্রুব বোনকে পিঠে তুলে নিয়েছে।

‘ তুই বড় হচ্ছিস না কেন রে? তোকে বিদায় করতে হবে তাড়াতাড়ি। ‘

ফারিন এক হাত ছাড়িয়ে ধ্রুবের চুল টানতে চেষ্টা করলো। ধ্রুব নামিয়ে দিলো তৎক্ষনাৎ।

ধারা মেয়েকে টেনে ধরেছেন। ফারিন ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদছে,

‘ তোমাকে বিদেয় করবো, তোমাকে বিয়ে দেবো। ‘

ধ্রুব শব্দ করে হাসছে,

‘ আমি তো বিয়ে করে নিয়েছি। ‘

নিনীকাকে দেখিয়ে বলল,

‘ এই দেখ আমার বউ। ‘

‘ তোমার বউকে রেখে তোমাকে বিদেয় করবো। ভাবীকে লুকিয়ে রাখবো। দেখে নিও। ‘

ধ্রুব মিথ্যা ভয় পাওয়ার অভিনয় করলো,

‘ তাই নাকি? আমার ভুল হয়ে গেছে ক্ষমা করে দিন রাজকুমারী। ‘

ফাহিম মাহবুব ছেলেকে মৃদু জোরে ধমক দিলেন।

‘ চুপ করো বাজে ছেলে, আমার মেয়েকে একদম বাজে কথা বলবে না। তুমি ও তোমার মা বিদেয় হবে। আমি আমার মেয়েকে নিয়ে একা থাকবো এই প্রাসাদে। তাই না আম্মা? ‘

ফারিন তখন বাবাকে জড়িয়ে ধরে ধ্রুবের দিকে রাগী চাহনি নিক্ষেপ করে রেখেছে। ধ্রুব ঠোঁট চেপে হাসছে। নিনীকা আচমকা বলল,

‘ আমিও আপনাদের পক্ষে বাবা। আমিও থাকবো। ‘

ফারিন তৎক্ষনাৎ নিনীকার হাত টেনে নিজের দিকে নিলো। ধ্রুব অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ এ কেমন অবিচার? জাতি এমন অপরাধ মেনে নিবে না। আমার মতো সহজ সরল ছেলের প্রতি তুমি এভাবে অন্যায় করতে পারো না মিসেস। এসো, ফিরে এসো বলছি। ‘

ধারা গম্ভীর স্বরে বললেন,

‘ ছেলের বউ শ্বশুরের পক্ষ নিচ্ছে। একটা মেয়ে জামাই থাকলে নিশ্চয়ই আমাদের পক্ষ নিতো ধ্রুব। ‘

নিরব নিজের নিরবতা ভাঙলো। তৎক্ষনাৎ এসে দাড়ালো ধারার পাশে।

‘ মেয়ে জামাই নেই তো কি হয়েছে, আপাতত আমি আছি আন্টি। এই নিন আমিও আপনাদের পক্ষে। ‘

ফাহিম মাহবুব অসন্তোষ গলায় বললেন,

‘ সারাজীবন আমাকে স্যার বলে মুখে ফ্যানা তুলে এখন মীরজাফরি করলে অফিসার। তোমার ওই দু’দিনের মেজরের পক্ষ নিলে। দেখবো কতোদিন এমন পক্ষ পক্ষ খেলা চলে। ‘

নিরবের চেহারায় অসহায়ত্ব।

‘ তবে আমি আপনার দলে আসছি স্যার। ‘

ধারা হাত টেনে ধরলেন।

‘ একদম না। তুমি আমাদের পক্ষের। ‘

ওপর পাশ থেকে ফাহিম মাহবুব হাত টেনে ধরলেন।

‘ ছাড়ো ওকে সে আমাদের পক্ষে আসবে বলেছে।

‘ ধ্রুব আমাকে পেছন থেকে টানতে থাক। দেখবো এই লোক কিভাবে তার এই অফিসারকে নিজের পক্ষে নেয়। ‘

ফাহিম মাহবুব পেছনে দাড়ানো কন্যা ও পুত্রবধূকে ইশারা করলেন। ফারিন ও নিনীকা তৎক্ষনাৎ পেছন থেকে তাকে টেনে ধরলো।

সবার মাঝখানে টানাটানিতে নিরবের হাত খুলে যাওয়ার অবস্থা। বেচারা অসহায় কন্ঠে চিৎকার করলো,

‘ মেজর প্লিজ রক্ষা করুন। ‘

ধ্রুব তৎক্ষনাৎ ছেড়ে দিলো ধারাকে। পেছন থেকে দৌড়ে গিয়ে নিনীকাকে টেনে কাঁধে তুলে নিলো। দৌড় দিয়ে চললো বাগান পেরিয়ে। ধারার পুরো ভর ছিল ধ্রুবের উপর। ফারিনের পুরো ভর ছিল নিনীকার উপর। ফাহিম মাহবুব ছিলেন নিরবের দিকে ঝুঁকে। আচমকা ধ্রুবের এহেন কান্ডে একে একে সবাই ধপাস করে নিচে পড়েন। ফাহিম মাহবুব তৎক্ষনাৎ চিৎকার দিলেন,

‘ আরে ধ্রুবকে ধরো, ও আমার পুত্রবধূ নিয়ে পালাচ্ছে। ‘

ধারা ও ফাহিম মাহবুব উঠে ছুট লাগালেন সেদিকে। ফারিন নিরবের হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।

‘ আপনি আমাদের পক্ষেরই হবেন, একদম ছুটতে চেষ্টা করবেন না। ‘

নিরব অসহায় চোখে তাকিয়ে মাথা নাড়ালো। দুজন দৃষ্টি ফেললো সদর দরজার দিকে। ধ্রুব ইতিমধ্যে বউ নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে। পেছনে ধারা ও ফাহিম দৌড়াচ্ছেন। নিরবের মুখ দিয়ে বের হয়ে এলো,

‘ ও মাই গড, ও মাই গড! ‘

তাদের কানে ভেসে এলো ফাহিম মাহবুবের চিৎকার,

‘ অসভ্য ছেলে থামো বলছি, ছেড়ে দাও আমার বউমাকে। ‘

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-২৮

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৮
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

রাত সাড়ে দশটা। বাহিরে প্রকৃতির তান্ডব চলছে। টেবিলে ধারা গরম খাবার এনে রাখছেন। ফাহিম মাহবুব চেয়ার টেনে বসলেন।

‘ ছেলেমেয়েরা কোথায়? ‘

‘ আমি এসে গেছি পাপা। ‘

সিঁড়ি দিয়ে নামলো ফারিন। পড়োনে বারবি ফ্রক। সেটা দুলাতে দুলাতে আসছে সে। বাবার পাশে বসে গলা জড়িয়ে ঝুলতে লাগলো। ফাহিম মাহবুব শব্দ করে হাসলেন। মেয়ের কপালে আদর দিয়ে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বললেন,

‘ দেখেছো আমার মা কতো খুশি হয়েছে? তোমাকে যখন ভিডিও কলে দেখাচ্ছিলাম ড্রেসটা তখন তুমি বলেছিলে ওর পছন্দ হবে না। অথচ এখন সে খুশিতে লাফাচ্ছে। ‘

ধারা আড়চোখে বাপ মেয়েকে দেখে নিলেন।

‘ তোমার মেয়ের কখন কোনটা ভালো লেগে যায় আমি কিভাবে বলবো? আজ এটা কাল ওটা। নির্দিষ্ট কোনো পছন্দ নেই তার। ‘

ফারিন আদুরে বাচ্চাদের মতো ঠোট চোকা করলো,

‘ আমাকে প্রিন্সেস লাগছে না মাম্মা? ‘

ধারা এবার হাসলেন, এগিয়ে এসে দাড়ালেন ফাহিম মাহবুবের পেছনে। দুজনের গাল টেনে দিয়ে বললেন,

‘ বাপ মেয়ে দুজনকেই সুন্দর লাগছে। ‘

‘ তুমি পড়োনি কেন? পাপা তো সবার জন্যে এনেছে। ‘

‘ এখন কেন পড়বো? পরে কখনো পড়ে দেখবো। ‘

‘ কিন্তু এখন পড়লে পাপা তো খুশি হতো, তাই না পাপা? ‘

ফাহিম মাহবুব নতুন কেনা পাঞ্জাবির কলার টেনে বললেন,

‘ সে তো হতামই। তবে তোমার মাম্মামের বোধহয় আমার কেনা শাড়ি পছন্দ হয়নি। ‘

ধারা পাঞ্জাবির কলার ঠিক করে দিলেন,

‘ তোমাকে বলেছি আমার পছন্দ হয়নি? আচ্ছা যাও খেয়ে পড়বো। পড়ে ঘুমাবো ভালো হবে? ‘

‘ দৌড়াতেও পারো সমস্যা নেই। ‘

ফারিন খিলখিল করে হাসলো। ধারা চোখ গরম করে তাকালেন। তন্মধ্যে শীতে কাঁপতে কাঁপতে নিচে নামলো নিনীকা। পেছনে ধ্রুব। দুজনেই সদ্য গোসল করেছে। চুল শুকিয়ে তবেই নিচে নেমেছে। নিনীকাকেও কাঁপতে দেখে ফারিন হেসে বলল,

‘ বৃষ্টির দিনে ঠান্ডা লাগে অনেক তোমার? ‘

নিনীকা থমথমে কন্ঠে উত্তর দিলো,

‘ তেমন না, তবে আজ বেশিই ঠান্ডা। ‘

ধ্রুব মিটমিট করে হাসছে। নিনীকা ফুসফুস করতে করতে চেয়ার টেনে বসলো। আজ তার মাথায় মস্ত বড় একটি ওড়না জড়ানো, ফাহিম মাহবুবের দেওয়া থ্রিপিসের জর্জেট ওড়না। যা শরীর পুরোটাই ঢেকে রেখেছে। ধারা চিন্তিত হয়ে কপালে হাত রাখলেন।

‘ তোমার কি বেশিই ঠান্ডা লাগছে? এসিটা অফ করে দেই তবে। যেভাবে কাপছো খেতে পারবে তো নিজ হাতে? ‘

নিনীকা কাঁপা হাতের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো। ধারা নিজেই আবার বললেন,

‘ সমস্যা নেই, আমি আছি, ফাহিম আছে, তোমার বর আছে, তাছাড়া ফারিনও আছে। বলো কার হাতে খাবে?’

নিনীকার চোখে বিস্ময়। আর কতো অবাক হবে সে? ধ্রুব কিঞ্চিৎ কাশলো,

‘ বলো মিসেস কার হাতে খেতে চাও? ‘

ফারিন ফুড়োন কাটলো,

‘ ওতো খুশি হওয়ার দরকার নেই, ভাবী নিশ্চয়ই তোমার হাতে খাবে না। হুহ! ‘

ধ্রুব বোনের মাথায় গাট্টা মারলো। নিনীকা ঠোঁট চেপে হাসছে। তার হুট করেই কান্না পাচ্ছে। ফাহিম মাহবুব বললেন,

‘ আমি খাইয়ে দেই মা? এখনো মাঝে মধ্যে এ বাড়ির সদস্যদের একসাথে বসে খাইয়ে দেই মাঝে মধ্যে। তুমি তো সবে এলে, চলো এখন থেকে তোমাকেও খাইয়ে দিবো। ‘

ফারিন বাবার গলা ছেড়ে চেয়ার থেকে নামলো। দ্রুত গতিতে হাতে তুলে নিলো প্লেট।সেটাতে ভাত ও রোস্ট নিয়ে মাখাতে মাখাতে বলল,

‘ একদম না, আমি খাওয়াবো তাকে। ‘

টেবিলের সবাই হাসছে। ধারা ফারিনের হাত থেকে প্লেট টেনে নিতে চাইলেন। সে দিলো না। ছোট হাতে ভাত তুলে ধরলো নিনীকার মুখের সামনে। নিনীকা খেয়ে নিলো। ধ্রুব বলল,

‘ ভাইকে তো কখনো খাইয়ে দিলি না, একদিনের ভাবির জন্যে এতো দরদ। দে আমার বউকে আমি খাইয়ে দিবো, তুই তোরটা খা। ‘

ফারিন দিলো না। ধারা নিজেই টেনে নিলেন। ফারিন দামী বারবি ড্রেসের মায়া ত্যাগ করে নিচে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়লো। ফাহিম মাহবুব হায়হায় করে উঠলেন। মেয়েকে টেনে এক প্রকার কোলেই নিলেন। ধারাকে মিছে রাগ দেখালেন,

‘ তোমার এতো বড় সাহস, তুমি আমার প্রিন্সেসকে দুঃখ দাও। ধারা! ‘

ফারিনকে বুঝ দিলেন,

‘ চলো আজ বাবা সবাইকে খাইয়ে দিবো। তোমার মা বা ধ্রুব কেউ তোমার ভাবীকে খাওয়াবে না। তুমি তো খাইয়েছো তাই না? এবার বাবা সবাইকে খাইয়ে দেই? ‘

ফারিনের কাঁধ পর্যন্ত চুল কাটা। গোলগাল মুখশ্রী। বয়স এবার ষোলো হবে। ফেইস রিয়াকশন দেখে যে কেউ বলবে মেয়েটি ইমম্যাচিউর। অথচ পরিবার ছাড়া সবখানেই মেয়েটি বড়োদের মতো দাপিয়ে বেড়ায়। ফারিন চোখ ঘুরিয়ে সবাইকে দেখে নিলো। বলল,

‘ ঠিক আছে। ‘

ধারা মেঝেতে শীতলপাটি বিছিয়ে দিলেন। নিনীকা একে-একে সব খাবার সেখানে রাখলো। সবাই গোল হয়ে বসলেন। নিনীকার একপাশে ধ্রুব। তার এক হাত সবার অগোচরে বউয়ের কাঁধে। আরেক পাশে ফারিন। তারপর মাঝে ফাহিম মাহবুব। ধ্রুব ও ফাহিম মাহবুবের মাঝখানে ধারা বসলেন। ফাহিম মাহবুবের সামনে একটি প্লেট। যেটাতে তিনি ভাত মাখাচ্ছেন। তারপর একে একে স্ত্রী, কন্যা, পুত্র এবং পুত্রবধূকে খাইয়ে দিচ্ছেন। মাঝে মধ্যে স্ত্রী, কন্যা, পুত্র ও পুত্রবধূ তার মুখেও ঠেলে দিচ্ছে খাবার।

বাহিরে প্রকৃতির তান্ডব বেড়েছে। ডোয়িং রুমের কাঁচের জানালাগুলো খোলা। বাতাসে পর্দাগুলো উড়ছে। বউ পাগল পরিবারটির নাম বউ কথা কও। বাড়িটা যেনো মায়ায় ঘেরা। মায়ায়ঘেরা বাড়িটার মানুষ গুলোও প্রচন্ড মায়াময়। কি নেই এখানে। চারিদিকে সারাক্ষণই এক ধরনের সুখ বিরাজ করে। আকাশ গর্জন করছে। মাঝে মধ্যে সাদা হয়ে আলোকিত করে তুলছে ডোয়িং রুমের দৃশ্যটি। সুখী একটি মুহুর্ত।

সুখি এই দৃশ্যে একজন উধাও। বাড়িটার বর্তমান প্রজন্মের কন্যা ফারিনের বর। কে হবে সে? ওই যে দেখা যাচ্ছে ফাহিম মাহবুবের পাশে আরেকটু জায়গা ফাঁক রয়ে গেছে। ওখানে কে করে নিবে জায়গা?’

চারিদিকে নিস্তব্ধতা। কারেন্ট চলে গেছে বলে জেনারেটর চালু করা হয়েছে। মাঝে মধ্যে সুখি পরিবারের মানুষদের কথাবার্তা শুনা যাচ্ছে। নিস্তব্ধ পরিবেশে আচমকা শুনা গেলো বিকট একটি শব্দ। ফাহিম মাহবুব তখন সবে ধ্রুবের মুখের সামনে খাবার তুলে ধরেছেন। ধ্রুব মুখে নিতে গিয়ে থেমে গেলো। ভ্রু কুঁচকে তাকালো সদর দরজার দিকে।

ধারা জানলা দিয়ে বাহির দেখলেন। চিন্তিত স্বরে স্বামীকে বললেন,

‘ এ অসময়ে কে আসতে পারে গো? ‘

ফাহিম মাহবুব ধ্রুবের মুখে ঠেলে ভাত ঢুকিয়ে দিলেন। আবারও বেজে উঠলো সেই শব্দ। ধ্রুব উঠে দাড়ালো।

‘ আমি দেখছি। ‘

ফাহিম মাহবুব ছেলেকে মানা করলেন।

‘ একদম না বাবা, আগে জানা প্রয়োজন বাহিরে কে বা কারা আছে। আমাদের চাকরিসূত্রে কিন্তু শত্রুর অভাব নেই ধ্রুব। ‘

ধ্রুব দমে গেলো। বসে পড়লো আগের জায়গায়। ফাহিম মাহবুব ধারাকে চোখের ইশারা করলেন। তিনি উঠে গিয়ে দরজার ফাঁক গলিয়ে বাহিরে তাকালেন। ধারা কিছু টা চমকে গেলেন। ফাহিম মাহবুব ইশারায় জানতে চাইলেন, ‘কে?’

ধারা এসে পাশে বসলেন। হা করে মুখে ভাত ঢুকিয়ে চিবাতে চিবাতে বললেন,

‘ ফারিন বেটা আমার দরজাটা খুলে দিয়ে এসো। ‘

ফারিন বারবি গ্রাউনটা দুদিকে তুলে দুলতে দুলতে দরজা খুলতে গেলো। সবার নজর দরজার দিকে। সদর দরজা খুলে গেলো। কাক ভেজা পুরুষটি কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে ঢুকে ফারিনকে দেখেই থমকে গেলো। সাথে সাথে নিজেকে সামলে নিয়ে এগিয়ে গেলো ধ্রুবদের দিকে। ফারিন দরজা বন্ধ করে পুনরায় নিজের জায়গায় এসে বসেছে। ফাহিম মাহবুব চিন্তিত স্বরে বললেন,

‘ কি হে অফিসার তোমার এই অবস্থা কেন? ‘

নিরব অসহায় কন্ঠে বলল,

‘ একটা কাজে বের হয়েছিলাম স্যার, হঠাৎ প্রচন্ড বৃষ্টি শুরু হলো। মাঝরাস্তায় গাছ ভেঙে পড়ে আছে। গাড়ি টেনে আনা সম্ভব না। কাছেই আপনাদের বাড়ি, সেজন্য চলে এলাম। ‘

বলেই চারিদিকে চোখ ভুলিয়ে পুনরায় বলল,

‘ আমি মনে হয় ডিস্টার্ব করলাম এসে। বৃষ্টি কমলেই রওনা দিবো। গাড়ি পেয়ে যাবো আশা করি। ‘

ফাহিম মাহবুব প্লেটে ভাত মাখাচ্ছেন।

‘ তুমি আগে কাপড় চেঞ্জ করো। তারপর বাকি কথা হবে। ‘

ধ্রুব উঠে দাড়ালো,

‘ এসো ক্যাপ্টেন৷ ‘

নিরব ধ্রুবের দেওয়া টিশার্ট ও টাউজার পড়ে নিচে নামলো। ফাহিম মাহবুব নিজের পাশের ফাঁকা জায়গাটি দেখিয়ে বললেন,

‘ এখানে বসে পড়ো। এসেই পড়েছো যখন আমাদের পরিবারের এই মুহুর্তের খাওয়াপিনায় অংশগ্রহণ করো।’

নিরব বসলো। তার একপাশে ফাহিম মাহবুব আরেক পাশে ফারিন। ফাহিম মাহবুব যখন তার দিকে ভাতের লোকমা ধরলেন তখন সে অবাক হলো না। এই বাড়ির সবকিছুই তার জানা। যদিও এর আগে এরকম মুহুর্তের সাক্ষী হওয়া হয়নি। আজ হয়ে গেলো। তার বড়োই ভালো লাগলো। নিজেকে মনে হলো এই পরিবারেরই একজন!

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-২৭

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ )
সন্ধ্যা বেলা প্রকৃতির রুপ বদল হলো। ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি নামলো ধরনীতে। কালো গাড়িটা এসে থামলো মেডিক্যালে। গাড়ির দরজা খুলে ছাতা মাথায় নিয়ে বের হলেন রমজান শেখ। বিপরীতে গিয়ে দরজা খুলে বের করে আনলেন মিথিলাকে। স্থান দিলেন ছাতার নিচে। বুকের সাথে পিঠে ঠেকিয়ে শক্ত করে ধরে এগিয়ে চললেন চেম্বারের দিকে।

ডাক্তার দেখিয়ে তারা যখন বের হলেন তখন বাহিরে বৃষ্টি নেই। রমজান শেখ মিথিলার হাত শক্ত করে মুঠোয় নিলেন।

‘ চলো আজ ঘুরি। ‘

মিথিলা আজ অনেক খুশি। সাথে তার আনন্দ বাড়িয়ে দিলো রমজান শেখের প্রস্তাব। মানুষ টা পুরনো শেখ বাবু হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মিথিলা মাথা নাড়িয়ে সায় জানালেন। গাড়ি লক করে শেখ বাবুর হাত ধরে হেঁটে চললেন রাস্তা দিয়ে।

দশমিনিট হাঁটার পর বৃষ্টি নামলো। গাড়ি লক করার আগে ছাতা গাড়িতেই রেখে এসেছেন বৃষ্টি ছিল না বলে। মিথিলার শাড়ি ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। তারা যে রাস্তায় দাড়িয়ে আছেন সেখান প্রচন্ড নির্জন। মিথিলার বৃষ্টিময় রুপ রমজান শেখকে গায়েল করলো। হাত ছেড়ে কোমড়ে স্পর্শ করলেন। নিজের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে হাঁটতে ছুঁয়ে দিতে লাগলেন মিথিলাকে। বৃষ্টি বাড়ছে। বৃষ্টিময় সেই রাস্তায় বৃষ্টিময় গাঢ় চুম্বন হলো। হলো আরও অনেক কিছু। রমজান শেখ নিজের কোর্ট খুলে মিথিলাকে পড়িয়ে দিলেন। বৃষ্টি কিছু টা কমে যেতেই ফিরে এলেন গাড়ির কাছে। গাড়িতে বসে হাঁচি দিতে দিতে দুজনের দমবন্ধ হওয়ার অবস্থা। মিথিলা রেগে বললেন,

‘ তোমার জন্যে হলো, বলেছিলাম ছাউনির নিচে যাই। শুনো নি। ‘

রমজান শেখ হাসলেন,

‘ ছাউনির নিচে গেলে কি রোমান্স করতে দিতে? ওখানে আলো ছিল তো। ‘

মিথিলা নাকমুখ কোঁচকান,

‘ একদম বাজে কথা বলবে না, বৃষ্টির মধ্যেও রাস্তায় তার রোমান্স করতে হয়। বেয়াদব লোক। ‘

‘ তোমারই তো। ‘

‘ হ্যাঁ আমারই, সেজন্য এখন দুজন মিলে ঠান্ডা লাগিয়ে বসে আছি। এসেছিলাম ডাক্তার দেখাতে। এক রোগের ডাক্তার দেখাতে এসে আরেক রোগ বেঁধে ফেললাম। ঠান্ডার জন্যে কয়দিন ভুগতে হবে কে জানে। আমার না-হয় সহজে কমে যাবে, তোমার কমবে? সবসময়ই বেশি বেশি। ‘

রমজান শেখ গাড়ি ড্রাইভ করা শুরু করেছেন।

‘ কমে যাবে কয়েকদিন রেস্ট নিলে, চিন্তা করো না। জ্বর তো আসেনি। ‘

মিথিলা তেতে উঠলেন,

‘ আসেনি, মানে আসবে না নাকি? ‘

রমজান শেখ চুপ রইলেন। এক হাতে স্ত্রীর কাঁধ জড়িয়ে ধরে ড্রাইভ করতে মনোযোগ দিলেন। চুপচাপ থাকাটা মিথিলার সহ্য হলো না। ঘুষি বসালেন রমজানের বাহুতে। ব্যথায় উহ শব্দ বের করলো।

‘ মারছো কেন? তুমি তো দেখি আমাকে সুস্থ করতে এসে নিজেই সাইকো হয়ে যাচ্ছো। স্বামী নির্যাতন করবে নাকি এবার? ‘

‘ প্রয়োজন হলে তাই করবো। ‘

রমজান হাসলেন,

‘ ঠিক আছে করো, পারলে আমার মতো যখন তখন আদর টাদর করে অজ্ঞান ও করে দিতে পারো। আমি একদম মাইন্ড করবো না। ‘

মিথিলার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নিলেন। রমজান শেখ শব্দ করে হাসলেন। গাল টেনে দিলেন।

‘ তুমি এখনো অনেক আদুরে প্রিয়তমা। ‘

*
সন্ধ্যায় বারান্দায় বসে ফারিনের সাথে কফি খেতে খেতে আড্ডা দিতে বসেছিলো নিনীকা। ধ্রুব রুমে ঢুকতেই দুজনের আড্ডার সমাপ্তি হলো। ফারিন কফির কাপ গুলো নিয়ে চলে গেলো। ধ্রুব ক্লান্ত শরীর বউয়ের কাঁধে এলিয়ে দিলো। বেচারা সেই যে নাস্তা করে বের হয়েছিল নিরবের জরুরি ফোনকলে, এখন ফিরলো। নিনীকা মাথাটা সযত্নে নিজের কোলে রাখলো। চুলের ভাজে হাত ডুবিয়ে চুম্বন করলো কপালে।

‘ মাথা কি বেশি-ই ব্যাথা করছে? ‘

ধ্রুব বন্ধ চোখজোড়া খুললো,

‘ বুঝলে কিভাবে? ‘

নিনীকা হাসলো,

‘ বুঝে ফেললাম। ‘

ধ্রুবের ঠোঁটে হাসি ফুটলো। হাত দিয়ে টেনে কাছে আনলো নিনীকার মুখশ্রী। ওষ্ঠে ফটাফট চুমু বসিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো।

‘ এখন ভালো লাগছে। ‘

নিনীকা চুলের ভাজে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।

‘ ঘুমাবেন পরে আগে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন। তারপর রিলাক্সে একটা ঘুম দিবেন সব ঠিক হয়ে যাবে। ‘

‘ তুমি দুপুরে খেয়েছিলে তো? ‘

নিনীকা মুখ কালো করে ফেললো,

‘ আমি ক্ষিদে সহ্য করতে পারি না, সেজন্য আপনার সাথে খাবো বলে ভাত খাইনি। তবে…চিপস, কফি সব খেয়েছি। আপনি কি রাগ করলেন? ‘

ধ্রুব ঘর কাপিয়ে হাসলো। হাসতে হাসতে নিনীকার কোমড়ে নাক ঘষলো।

‘ তুমি কেন অপেক্ষা করে ভাত খাওনি মিসেস? চিপস কফিতে কি পেট ভরে? যাও এক্ষুনি খাবার নিয়ে এসো। ততোক্ষণে আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। পাগলি মিসেস টা! কি করে এসব। এভাবে কেউ না খেয়ে থাকে? ‘

নিনীকা চোখ ছোট ছোট করে ফেললো,

‘ আমি যদি না খেয়ে অপেক্ষা না করি তো কে করবে? ‘

ধ্রুব উঠে বসলো,

‘ টিপিকাল বউদের মতো কথা, বাহ্! একদিনের সংসারে এতো পরিবর্তন। আ’ম ইমপ্রেস। ‘

নিনীকা ঠেলে দিলো,

‘ যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। ‘

ধ্রুব ওয়াশরুমের দরজা পর্যন্ত গিয়ে ‘মিসেস’ বলে চিৎকার করে দ্রুত গতিতে নিনীকার সামনে এসে দাড়ালো। নিনীকা চমকে তাকালো।

‘ কি হয়েছে? ‘

ধ্রুব বুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে। নিজের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে বলল,

‘ তোমাকে জড়িয়ে ধরিনি বলে বুকটা কেমন যেন করছিলো। ‘

নিনীকা হতভম্ব। এই লোক তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলো।

‘ এভাবে কেউ চিৎকার করে? ‘

‘ নিনীকা হুস, চুপ থাকো। ফিল মি। ‘

আবারও উচ্ছাস নিয়ে বললো,

‘ নিনীকা তুমি এতো নরম কেন? এতো তুলতুলে কেন? আমি তো তোমাকে তুলো ভেবে খেয়ে ফেলবো হঠাৎ। ‘

নিনীকা পিঠে হাত দিয়ে মৃদু জোরে ঘুষি দিলো,

‘ আস্তে বলুন, কি করছেন পাগল মেজর। ‘

‘ নিনীকা আমি যদি দরজা খোলে সবকিছু করেও ফেলি তবুও শব্দ বাহিরে যাবে’না, রুম সাউন্ড প্রুফ। ‘

নিনীকা লজ্জায় ওভাবেই পড়ে রইলো। ধ্রুব ছাড়লো অনেক পরে। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলছে,

‘ নিনীকা আমি তোমাকে এতো এতো ভালোবাসি। ‘

নিনীকার মাথা ঘুরছে। এলোমেলো চুলগুলো হাত কোপা করে নিলো। পড়োনের লং শার্টের বোতামগুলো আটকে দিয়ে স্কার্ফ পড়ে নিলো। ধ্রুবকে বকতে বকতে নিচে গেলো খাবার আনতে।

ধ্রুব টাওয়াল পড়ে দুষ্টু হাসি মুখে ঝুলিয়ে নিনীকার অপেক্ষায় খাটে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে। নিনীকা এলো আরও তিন মিনিট পর। রুমে ঢুকতেই তার গলা শুকিয়ে গেছে। হাঁটুর উপর পর্যন্ত টাওয়াল পড়ে পায়ে পা তুলে বসে আছে ধ্রুব। উন্মুক্ত শরীর দেখিয়ে নিনীকাকে দূর্বল করতে চাইছে সে। নিনীকা চোখমুখ শক্ত করে রইলো। খাবার রাখতেই ধ্রুব আবদার করলো,

‘ তুমি খাইয়ে দাও। ‘

নিনীকা চোখ নিচের দিকে রেখেই প্লেটে ভাত মাখাচ্ছে। ধ্রুব টেনে নিজের কোলে বসিয়েছে। থরথর করে কাঁপছে নিনীকার হাত। ধ্রুব ঘাড়ে থুতনি ঠেকালো।

‘ এভাবে কাপছো কেন মিসেস? এনিথিং রং? ‘

নিনীকার ইচ্ছে হলো হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে। কাঁপা কাঁপা হাতে লোকমা তুলে দিলো ধ্রুবর মুখে। ধ্রুব খেতে খেতে বলল,

‘ তুমিও খাও। ‘

বহু পরিশ্রম করে নিনীকা খাওয়া শেষ করলো। প্লেট রেখে দরজা বন্ধ করে পেছনে ঘুরতেই দেখে ধ্রুবর পড়োনের টাওয়াল মেঝেতে লুটোপুটি খাচ্ছে। নিনীকার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। ধ্রুব অবুঝ স্বরে বলল,

‘ অনেক গরম লাগছে মিসেস, বাতাস করবে একটু? ‘

নিনীকা ঘেমে একাকার। ধ্রুব তাকে কাছে টেনে নিয়েছে। ফিসফিস করে বলল,

‘ কে যেনো বলেছিল পুরুষেরা শুধু অধিকার দেখিয়ে বিছানায় নিয়ে যেতে পারে। আমি তো তোমাকে বিছানায় নিয়েছি নিনীকা। তোমার খারাপ লাগছে না? ‘

নিনীকা গলার স্কার্ফ ছুড়ে ফেললো।

‘ আপনি নিয়েছেন, এবার আমি নিবো। শোধবোধ। ‘

ধ্রুব চোখ বন্ধ করতে করতে বলল,

‘ মাথা ব্যথা কমানোর আরেকটা পদ্ধতি আছে মিসেস। জানো সেটা কি? বিজ্ঞানের ভাষায় অন্যকিছু বললেও আমি বলি বউয়ের আদর। ‘

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-২৬

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

রৌদ্রজ্বল সকাল। বারান্দায় রোদ চিকচিক করছে। সেথায় একটি চেয়ারে পা তুলে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়ছে ফারিন। সামনে এসএসসি পরীক্ষা তার। পড়াশোনায় তাদের বংশের এপর্যন্ত সবাই মোটামুটি ভালোই মেধাবী ছিলেন। ফারিনও তার ব্যতিক্রম নয়। তাকে কখনো জোর করে পড়তে বসাতে হয়না। তার উপর সে যেমন মা বাবা ভাইয়ের কাছে আহ্লাদী, বাহিরের সবার কাছে ঠিক ততোটাই বুঝদার ম্যাচিউর একটি মেয়ে। তার আহ্লাদীপনা সবকিছু শুধুমাত্র আপনজনদের জন্য। নিজের এই গন্ডি গুলো তাকে কেউ বুঝিয়ে দেয়নি। সে নিজ থেকেই বুঝেছে। এই যেমন তার বয়সী ছেলেমেয়েরা প্রেম করে বেড়ায়, কিন্তু সে এসব থেকে চল্লিশ হাত দূরত্ব বজায় রাখে। তার মতে এগুলো সময় নষ্ট। ফ্যান্টাসি অবশ্যই থাকে, কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। আরাম আয়েশে জীবনযাপন করলেও তার মা বাবা তাদের দু’ভাই বোনকে বাস্তবতা মানতে শিখিয়েছেন। একবার তো ফারিন সারাজীবনের মতো শিক্ষা পেয়েছিলো। ফারিনের তখন কতোই বা বয়স হবে এগারো। সে তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। তার ক্লাসের একটি মেয়ের সাথে সে খারাপ ব্যবহার করে। কারণ টা ছিলো এই, ‘মেয়েটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছিলো। সাথে মেয়েটার মা তাদের বাড়িতে কাজও করতেন। সুতরাং ফারিন মেয়েটিকে তুই করেই ডাকতো। মেয়েটি মেধাবী ছিলো। ফারিনের সাথে তার টক্কর চলতো, কে ফাস্ট হবে। একদা মেয়েটি রেগে ফারিনকে বলেছিলো, ‘তুমি স্কুলে আমাকে তুই বলবে না, এখানে আমি তোমার ক্লাসমেইট হই। ‘

ফারিনের সেদিন রাগ হয়েছিলো। সে তো সবসময় ডেকে অভ্যাস বলে ডাকতো। তাছাড়া তারা ছিল ক্লাসমেইট। এক ক্লাসে সবাই তুই বলেই বেশি ডাকে। গায়ে লাগায় ফারিন খুঁচিয়ে বলেছে,

‘ পড়িস তো আমাদের দেওয়া জামাকাপড়, আবার আমাকেই কথা শুনাচ্ছিস। আমার বাবা যদি বেতন না দেয় তোর মা তোর বেতন দিতে পারবে? ‘

ছোট্ট সেই মেয়েটি ফারিনের মতোই নিষ্পাপ পুষ্প। কোমল মনে আঘাত লাগে তার। সেদিন দৌড়ে গেছিল ‘বউ কথা কও’ এ। মাকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে বলেছিল,

‘ এখানে আর কাজ করলে আমি পড়বো না মা। একদম পড়বো না। ‘

বিচক্ষণ ধারার কানে সব গেলো। কাজের মহিলাটি কেঁদে ফেললেন। ধারা নিজের সন্তানের এহেন কর্মকাণ্ডে কষ্ট পেলেন। সেই ছোট্ট ফারিনকে একমাস হেঁটে হেঁটে স্কুলে যেতে হয়েছিলো। আর সেই মেয়েটিকে ধারা গাড়ি দিয়ে পাঠাতেন। টিফিনে আবদার’কৃত খাবার দেওয়া বন্ধ করে শুকনো রুটি তুলে দিতেন। ফারিন বুঝতে পেরেছিল! সেই মেয়েটির কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। জীবনের ওই শিক্ষাটা তার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো। তারপর থেকে তারা দুজনেই একসাথে স্কুলে গেছে। আজ তাদের মধ্যে একটি সম্পর্কও আছে। মেয়েটি ফারিনের বেস্টফ্রেন্ড! চমৎকার না? সেই মেয়েটা! রোজা। ‘

রোজা ফারিনের সাথেই পড়ে। তার মা এখন আর কাজ করেন না। ঘর সামলান। ধারা রোজার বাবাকে নিজেদের গাড়ির ড্রাইভার করে নেন। মাঝে মধ্যে শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে অনেক কিছু করেন ও। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো রোজাকেই ধারা ধ্রুবের জন্যে মনে মনে পছন্দ করতেন। কিন্তু বয়সের গ্যাপ বেশি হওয়ায় কখনো মুখ ফুটে বলতে পারেননি। ফারিন সেটা বুঝতে পেরেছিল। সে জানে তার মা জনদরদী। সুতরাং নিজের ছেলের জন্যে রোজাকে পছন্দ করবেন সেরকম টা না ভাবার কোনো কারণ নেই।

ফারিনের মোবাইলে শব্দ হলো। রোজার মেসেজ-

‘ এই প্রশ্নটার উত্তর কি হবে জানিস? ‘

ফারিন বই বন্ধ করলো। রোজার সাথে মেসেজে কথা বলতে লাগলো। তন্মোধ্যে এলো একটি ফোনকল। নাম্বারটি তার চেনা। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো নিরবের চিন্তিত কন্ঠোস্বর।

‘ হ্যালো ফারিন বলছেন? ধ্রুব স্যারের ফোন অফ কেন? কাইন্ডলি তাকে একটু বলে দিবেন? জরুরি প্রয়োজন। ‘

ফারিনের চোখমুখ কুঁচকে গেলো। এই লোকটা দরকার হলেই তাকে ফোন দিবে। কেন রে বেটা? আর কেউ নেই?

‘ মাকে কল করতে পারতেন। ‘

নিরব কাশলো,

‘ আসলে আন্টির নাম্বার নেই। ‘

‘ এ কেমন কথা? বাড়ির সবার নাম্বার আছে অথচ মায়ের নাম্বার নেই। ‘

নিরব মিনমিন করে বলল,

‘ আমি রাখছি, আপনাকে কল করার জন্যে দুঃখীত। ‘

ফারিন কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখলো। চোখেমুখে প্রচন্ড বিরক্তি। পড়ার সময় ডিস্টার্ব তার পছন্দ হয়না। একে তো রোজার মেসেজে তার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটলো, সাথে নিরবের কল! আড়চোখে একবার মোবাইল স্কিনে তাকালো। বেলা গড়িয়েছে অনেক। সাড়ে নয়টা ছুঁইছুঁই। সকালে তার ঘরে গ্রিন্টি এসেছে। বাবা মা হাটাহাটি করেছেন যথা নিয়মে। এখন নাস্তা করার সময়। ধ্রুব বা নিনীকাকে দেখা যায়নি। ধারার আদেশ তাদের যেনো ডিস্টার্ব না করা হয়। জার্নি করে ঘুমিয়েছে যখন ইচ্ছে উঠুক। সেজন্য ফারিন ডাকেনি। এবার ডাকতেই হচ্ছে।


দরজার টুকা পড়লো। উষ্ণতায় মুড়িয়ে ঘুমানো ধ্রুবের ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেলো। দরজার শব্দ আরেকটু বিকট হলো। এবার সে ফট করে চোখ মেলে তাকালো। ভারী মাথাটা তুলতেই সম্মুখে নিনীকার মোমের মতো মুখখানি নজরে এলো। ধ্রুবের পিঠে দু-হাত জড়িয়ে কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সে। ধ্রুব মাথাটা পুনরায় আগের স্থানেই রাখলো। চোখ বন্ধ করতেই আবারও কানে এলো শব্দ টা। সাথে ফারিনের কন্ঠ,

‘ ব্রো উঠো, দশটা বেজে যাচ্ছে যে। তোমার ক্যাপ্টেন ফোন করেছে জরুরি প্রয়োজন। ‘

ধ্রুবের গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সে গলার স্বর উঁচু করার চেষ্টা করলো,

‘ দেখছি। ‘

ফারিনের কন্ঠোস্বর আর পাওয়া গেলো না। ধ্রুব গভীর চোখে নিনীকাকে দেখতে ব্যস্ত হলো। মোমের মতো শরীরে কিছু দাগ স্পষ্ট। ধ্রুবের হতে গিয়ে মোমের মতো শরীরে দাগ পড়ে গেছে। ধ্রুব হাত দিয়ে, ঠোঁট দিয়ে ছুয়ে দিচ্ছে সেগুলো। নিনীকা ঘুমের মধ্যে কেঁপে উঠছে বার-বার। একসময় তার ঘুম ছুটে গেলো। ততোক্ষণে ধ্রুবের আলিঙ্গন গভীর হয়েছে। নিনীকার বুঝতে একটু সময় লাগলো বটে।

বিছানা ছাড়তে দেরি হলো। ধ্রুব যখন বউ কোলে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে তখন ঘড়ির কাটা দশটা পেরিয়েছে। ভেজা শরীরে বের হয়ে সে প্রথম মোবাইল অন করে চার্জে দিয়েছে। তারপর বউকে নিয়ে ফিটফাট হয়ে নিচে নেমেছে। খাবার টেবিলে চারজন। নিনীকার লজ্জায় মাথা নিচু করা ছিল। ধারা গম্ভীর মুখে নাস্তা তুলে দিয়েছেন। বুঝদার ফারিন অনেক কিছুই বুঝে নিয়েছে। খেতে খেতে বললো,

‘ তোমাদের জন্য অপেক্ষা করে খাওয়া হয়নি। ‘

নিনীকা যেনো আরও লজ্জা পেলো। ধ্রুবের কাছে শুনেছিল ফারিন ডেকে গেছে। বেচারি এক ঘন্টা আগে ডেকেছে অথচ তারা নেমেছে এক ঘন্টা পর।

‘ বিয়ের পর মেয়েদের আলাদা সুন্দর লাগে। তোমাকে এই মুহুর্তে সদ্য বিবাহিত বউ মনে হচ্ছে। সাথে আমার বেটাকেও নতুন বর নতুন বর লাগছে। তাই না ফারিন? ‘

ধারার কথায় ফারিন গাল ভরে হাসলো।

‘ হ্যা তোমাদের দুজনের মুখটা আজ অন্যান্য দিনের থেকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। বিয়ে করার ইফেক্ট। ‘

নিনীকার পড়োনে লং স্কার্ট ও টিশার্ট। গলায় ছোট্ট একটি স্কার্ফ ঝুলানো। ফারিন মুচকি হেসে বলল,

‘ তোমার সাদা ভালো লাগে তাই না? আমি কি তোমাকে ভাবী বলে ডাকতে পারি? ‘

কি নিষ্পাপ আবদার। নিনীকা হেসে সম্মতি জানালো। ফারিন মুগ্ধ হয়ে বলল,

‘ তোমার সবকিছুই সুন্দর ভাবী। তোমার বরটাও সুন্দর। তোমার ননদও সুন্দর। তোমার শ্বশুর বাড়ির সবাই সুন্দর। ‘

ধ্রুব ফোড়ন কাটলো,

‘ বরটা তেমন সুন্দর না। মুখে অজস্র কাটা দাগ। ‘

ফারিন গরম চোখে তাকালো,

‘ সেই কাটা দাগই তোমার সৌন্দর্য। তুমি যে মেজর সেটার পরিচয় এই কাটা দাগ গুলো দেখলেই মানুষ ঝুঝতে পারবে। বুঝলে? ‘

ধ্রুব ঠোঁট উল্টে মাথা নাড়ালো। অগোচরে হাত রাখলো নিনীকার স্পর্শকাতর স্থানে। নিনীকা শরবত খাচ্ছিল। নাকেমুখে উঠে গেলো সব। কাশতে কাশতে বেচারির চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো। ধ্রুব আফসোসে ভেসে বউয়ের কাশি কমাতে ব্যস্ত হলো। কি বউ তার আদর করলেও কেশে উঠে। খোদা!

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-২৫

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-২৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

শাড়ি সামলাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে নিনীকাকে। অথচ যেদিন পালিয়ে গেছিল সেদিন শাড়ি পড়েই কত পথ অতিক্রম করতে হয়েছিল তাকে। মায়ের পরিয়ে দেওয়া শাড়ি ছিল সেটা। সময়ের উপর সব চলে। নিনীকার আগের পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি ভিন্ন। সেদিন সে না চাইতেও শাড়ি সামলিয়েছে, আজ সে না চাইলেও বর ও ননদ দুজন তার শাড়ি সামলাতে ব্যস্ত হচ্ছে। অবশ্য নিনীকা মনে মনে খুশিই হচ্ছে। এইযে চেয়ারে বসার সময় ধ্রুব যত্ন করে তার আঁচল কোলে তুলে দিলো। ফারিন পাশের চেয়ারে সবার সময় কাঁধের দিকে টেনে দিলো। এইযে তার শ্বশুর মশাই খাওয়ার ফাঁকে বলছেন এটা দিবো মা? ওটা দিবো মা? রোস্ট টা আরেকটু নাও মা! এতোসব কিছু তার ভাগ্যে ছিল৷ তার সুখ। তার সংসারের মানুষগুলো! অথচ সেদিন কি না এসবের থেকে দূরে পালিয়ে গেছিল! পৃথিবীর সবাই একরকম হয় না। তার বরের বাড়ির সবাই চমৎকার। উঁহু তারই বাড়ি। এটা তো তারই, তার পরিবার। নিনীকার ভাবনার মধ্যে ধারা প্লেটে এক চামচ বিরিয়ানি তুলে দিলেন। খেতে ইশারা করে বললেন,

‘ ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করো না নাকি? গাল গুলো ভেঙে ভেতরে চলে গেছে। এখন থেকে ঠিকমতো খাবে। একটু স্বাস্থ্য হলে আরও ভালো লাগবে। ‘

নিনীকার চোখ ছলছল করছে। ধ্রুব নিজের প্লেট দেখিয়ে বলল,

‘ আমার প্লেটেও কিছু দাও, তোমার বউমাকে তো আমি বলিনি না খেয়ে স্লিম হতে। আমার বউ মোটা হোক চিকন হোক আমারই বউ। তুমি যেভাবে আমাকে না খাইয়ে রাখতে চাইছো মনে হচ্ছে আমি বলেছি তাকে না খেয়ে থেকে স্লিম হতে। ‘

ফারিন মুখ টিপে হাসলো। ফাহিম মাহবুব গলা কাঁকড়ি দিলেন। ধ্রুব মূলত নিজের মায়ের সাথে বউয়ের সম্পর্ক সহজ করতে একটু বেশিই বলে ফেলেছে। বেচারা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গড়গড় করে যা-ই বলে তা-ই এলোমেলো। কোনোটার আগামাথা নেই।

ধারা ছেলের প্লেটে রোস্ট ও বিরিয়ানি দিলেন।

‘ খাও, আর তোমার বউকেও খেতে বলো। এ বাড়ির সবাই গুলোমোলো, তোমার বউকেও গুলোমোলো হতে হবে বলে দিও। ‘

ধ্রুব মাথা নাড়িয়ে খাচ্ছে। নিনীকা চোখ বন্ধ করে রোস্ট চিবুচ্ছে। মুখ দিয়ে তৃপ্তিময় শব্দ বের করে বলল,

‘ আপনার রান্না অসম্ভব সুস্বাদু আঙ্কেল। ‘

ফাহিম মাহবুব হাসলেন। আরও রোস্ট প্লেটে তুলে দিলেন। ধারা গম্ভীর স্বরে বললেন,

‘ সব শ্বাশুড়ির মতো আমি বলবো না মা বলে ডাকো। যদি কখনো মা মনে হয় তখনই না-হয় ডেকো। নয়তো ডাকার দরকার নেই। আর ফাহিমের ইচ্ছে তার ছেলের বউ তাকে বাবা বলেই যেনো ডাকে। ‘

ফাহিম মাহবুব এবারও হাসলেন,

‘ হ্যাঁ মা তুমি আমাকে বাবা বলেই ডাকবে, আমার আরেক মেয়ে হয়েই থাকবে। বাবা হিসেবে আমি অতোটা ও খারাপ নই। তোমার দু’পাশে বসা দুজনকে জিজ্ঞেস করে দেখো। ‘

নিনীকা কিছু বললো না। বাবা শব্দটির মানে তার কাছে অন্যকিছু। যদিও পৃথিবীর সব বাবা এক নন। তবুও তার সময় লাগবে। সুতরাং ব্যাপারটা এড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয় মনে করলো।

তাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলো সাড়ে দশটার দিকে। সবাই যে খেয়ে তৃপ্তি পেয়েছে তা সবার চোখে-মুখেই স্পষ্ট। যা দেখে ফাহিম মাহবুবের অসম্ভব ভালো লাগছে। মাঝে মধ্যে স্ত্রীর কানে কানে বলছেন,

‘ দেখেছো? আমিও তোমার মতো রান্না শিখে গেছি। সময় করে আরেকটা আইটেম শিখিয়ে দিও। ‘

ধারা ইশারায় হ্যাঁ জানিয়েছেন। রিটায়ার্ড মানুষটাকে মাঝে মধ্যে রান্না ঘরে ঢুকান তিনি। সে-ই সুবাদেই কিছুটা রান্না আয়ত্ত করেছে তার বর।

সোফায় কিছুসময় বসে থাকা হলো। এগারোটার পর সবাই যার যার ঘরে চলে গেলো। ধ্রুব খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে বলল,

‘ আজ যেনো আমাদের কততম বাসর মিসেস? দার্জিলিংয়ে কয়রাত ছিলাম যেনো? ‘

নিনীকা কিছু বললো না। নিজেও শরীর এলিয়ে দিলো পাশে। ধ্রুব টেনে নিলো বুকে। ফিসফিস করে শুধালো,

‘ তুমি কি আজও ইন্টারেস্টেড নও? ‘

নিনীকা বুকে মাথা রাখলো। আবেগ নিয়ে কপালে দীর্ঘ চুম্বন করলো। রাতের আঁধারে মিলে গেলো দুটি সত্তা। রাত্রির শেষ প্রহরে ধ্রুব ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে বিরবির করলো,

‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি আমার মিসেস। ‘

নিনীকার চোখে ঘুম নেই। এক হাত ধ্রুবের চুলের ভাজে রাখা। নিজেও বিরবির করলো,

‘ আপনার মিসেসও আপনাকে ভালোবাসে ধ্রুব। ‘

চারিদিকে ভোরের আলো ছড়াচ্ছে ধীরেধীরে। নিনীকা তখনো তাকিয়ে। মাঝে মধ্যে ওষ্ঠ দিয়ে ছুয়ে দিচ্ছে ধ্রুবের কপাল, গাল, ঠোঁট। ধ্রুব নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে যাচ্ছে। তাকে দেখতে আদুরে লাগছে। ঠোঁট উল্টে ঘুমাচ্ছে বেচারা। মুখের ক্লান্তি জানান দিচ্ছে তার পরিশ্রম।

নিনীকা ঠেলে দিলো না। বরং আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে নিজেও চোখ বন্ধ করলো। তাকে ঘুমাতে হবে। দিনের বেলা তার সহজে ঘুম আসে না। তার উপর না ঘুমালে মাথা ব্যথা তো আছেই।

*
আজ ভোরে উঠেছেন রমজান শেখ। সাথে টেনে তুলেছেন মিথিলাকেও। দুজনে নামাজ আদায় করেছেন। রমজান শেখ এর পড়োনে শুভ্র পাঞ্জাবি। মিথিলা মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন। শুভ্র সুদর্শন পুরুষটির মুঠোয় তার হাত। সুদর্শন পুরুষটি তাকে নিয়ে বাগানে হাঁটাহাঁটি করছে। মাঝে মধ্যে ঠোঁট আলগা করে কথা বলছে। মিথিলা বহুদিন পর মুগ্ধ হয়ে নিজের পুরুষকে দেখলেন। আলগোছে কাঁধে মাথা রাখলেন।

‘ আজ তোমাকে দুই যুগ আগের সেই প্রেমিক পুরুষই মনে হচ্ছে শেখ বাবু। আমার জন্ম সার্থক হলো তোমার এই রুপ দেখে। ছেলে হয়ে তুমি এতো রূপবান কেন হলে বলো তো? ‘

রমজান শেখের চোখে সাদা ফ্রেমের চশমা। সেটা খুলে হাতে নিলেন। মিথিলার পড়োনের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে নিলেন সযত্নে। হাতের মুঠোয় হাত নিলেন আবারও।

‘ সবই আল্লাহর সৃষ্টি। তুমি আমাকে ভালোবাসো বলেই আমি তোমার চোখে সুন্দর। ‘

মিথিলা মানতে নারাজ,

‘ তাহলে কেন হাঁটুর বয়সী মেয়েরা তোমাকে আহ্বান করে? ‘

রমজান শেখের ঠোঁটে স্নিগ্ধ হাসি।

‘ কারণ তারা আমাকে ভালোবাসে না, বাসলে আহ্বান করতো না। তারা সাময়িক ভাবে আকৃষ্ট হয়। কিন্তু তুমি অন্যরকম। কতকিছু করেছি ছেড়ে তো গেলেই না উল্টো এতোকিছুর পরও আমাকে আঁকড়ে ধরেছো। আমি কি এসবের যোগ্য মিথি? ‘

মিথিলা হাতের মুঠো শক্ত করলেন,

‘ তুমি অবশ্যই যোগ্য। আমি পুরনো সবকিছু ভুলে যেতে চাই। আমি তুমি মিলে একটা সাধারণ জীবনযাপন করতে চাই। যেখানে শুধু ভালোবাসা থাকবে। সাথে থাকবে আমাদের ছোট্ট মেয়ে নিনীকা। ‘

রমজান শেখ দাঁত বের করে হাসছেন।

‘ তোমার ছোট্ট মেয়েটি বড় হয়ে গেছে মিথি। তার সংসার আছে। তাছাড়া সে তার বাবাকে কখনো ক্ষমা করবে না। ওর জায়গায় আমি থাকলেও করতাম না। আমার মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে বুঝলে। ‘

‘ সব জানলে সে তোমাকে ক্ষমা না করে থাকতে পারবে না। আমার মেয়ে সে, মায়ের মতো ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতা তার আছে। বুঝেছো? ‘

‘ সে তো আমারও রক্ত তার শরীরে। বাপের মতো একটি ক্ষত নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিতেও তার দ্বিধা হবে না। দেখা গেলো সবশুনে সে আমাকে আরও ঘৃণা করবে। ‘

মিথিলা নাকমুখ কোঁচকান,

‘ তুমি বেশি বেশি বলছো। তোমাদের বাপ মেয়েকে আমি সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাবো শীগ্রই। আগে তোমাকে ঠিক করি। সন্ধ্যায় আমাদের যেতে হবে। মনে থাকে যেনো। ‘

রমজান শেখ মাথা নাড়ালেন।

‘ আপনার কথাই শেষ কথা আমার বেগম। ‘

মিথিলা কিশোরীদের মতো লজ্জা পেলেন। মুখ লুকালেন সুদর্শন পুরুষটির বুকে।

(চলবে)