বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1214



ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ১১

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

আমি কি এখন রুমে যাব? ভাবির সামনে গিয়ে দাঁড়াব? আমি কি রুমে গিয়েই ভাবির হাত থেকে শাঁড়িটা কেড়ে নিব? আমি কি সত্যি সত্যি শাঁড়িটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসব? না, না! এ আমি পারব না। এ আমার দ্বারা সম্ভব না। আপন মনেই কথাগুলো বলে দরজার সামনে থেকে সরে যায় শিশির। তারপর চোখের জল মুছে দরজা থেকে ক্ষাণিকটা দুরে সরে গিয়ে ডাক দিল শিশির-
” ভাবি! কোথায় তুমি? আম্মু ডাকছে তোমায়। খেতে আসো।”
আগেভাগেই কারো আগমনী বার্তার সংকেত পেয়ে সাবধান হয়ে যায় লাবণ্য। ফ্লোর থেকে উঠে চটজলদি শাঁড়িটা লুকিয়ে ননদের কথার স্বাভাবিক জবাব দেয়-
” আসছি শিশির! তুমি যাও…..”

আমি তো যাব’ই। তার আগে আমার যে একটা কাজ আছে ভাবি। ঐ কাজটা করে তবেই যে আমি নিচে নামব। মনে মনে কথাটা বলে শিশির ওর রুমের আলমারি থেকে একটা পুরনো কাপড় বের করে নেয়। মোড়কে আবৃত কাপড়টা নিয়ে শিশির যখন সিড়ি বেয়ে নিচে নামছিল তখন সবাই শিশিরের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। নিচে নেমে কাউকে কিছু না বলে সরাসরি দরজার সামনে চলে যায় শিশির। দরজার কাছে গিয়ে পিছু ফিরে তাকায় শিশির। কতগুলো চোখ তখনো ওর দিকে কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সবার কৌতূহল মেটানোর জন্য শিশির জবাব দেয়-
” মোড়কে আবৃত জিনিসটা আর কিছু নয় শুভ্র ভাইয়ার কেনা ঐ শাঁড়িটা ছাড়া। তুমি বলছিলা না এটা কালকে ডাস্টবিনে ফেলে দিবে? তাই আমি এখন আমি এটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসতেছি।”
শুভ্রর মা গম্ভীর গলায় বলেন, হ্যাঁ, যা! ফেলে দিয়ে আয়। শিশির যাচ্ছি বলে বাইরে চলে যায়। খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে পরে শুভ্র। জল ছলছল চোখ আর মনে ব্যথা নিয়ে কিছু পেটে না দিয়েই সে স্থান পরিত্যাগ করে শুভ্র। শাশুড়ির বারংবার ডাকে ক্ষাণিক বাদেই খেতে আসে লাবণ্য। টেবিলে বসে মলিন মুখে লাবণ্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চাতকের ন্যায় ঐ দুটি আঁখি যেন কাউকে খুঁজছে! কিন্তু মুখ খুলতে পারছে না।অনেকক্ষণ এদিক ওদিক তাকানোর পর লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই ফেলে লাবণ্য-
” শুভ্র ভাইয়া কে যে দেখছি না! ওনি কি খাবে না?!”

ভাইয়া!!!
খাবার মুখে তুলে হাসতে হাসতে কাশি উঠে যায় শিশিরের। লাবণ্যর শাশুড়ি একধমকে শিশিরের হাসি থামিয়ে হাতে একটা পানির গ্লাস ধরিয়ে দেয়। তারপর লাবণ্যর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে জবাব দেন-
” খাবার টেবিলে বসছিস, খেয়ে চলে যা। এসব শুভ্র টুভ্রর খাবার নিয়ে চিন্তা তোকে করতে হবে না। যার ইচ্ছে হবে নিজে নিয়েই খেতে পারবে। আর ইচ্ছে না হলে না খাবে। এই নে! তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠ।”
লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যর দিকে একটা প্লেট এগিয়ে দিয়ে নিজেও বসে পরে খেতে। জলে টলমল চোখ নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ারে বসে থাকে লাবণ্য। তারপর যখন বুঝতে পারে দু’চোখে অন্ধকার দেখছে, তখন কাউকে কিছু না বলে ড্রয়িংরুম থেকে দৌঁড়ে চলে যায় লাবণ্য। লাবণ্যর চলে যাওয়ার পর শিশির উত্তেজিত গলায় বলে উঠে-
” হলো তো এবার?
মা! আর কত? আর কত কষ্ট দিবা ভাইয়াকে? তোমার নিজ পেটের ছেলে। একটুও কষ্ট হয় না ওর জন্য? একটা বছর ধরে ওকে এভাবে দিনের পর দিন ব্যথার তীরে জর্জরিত করে আসতেছ। আর কত জর্জরিত করবা ওকে? এবার তো ক্ষতটা শুকাতে দাও…”
মেয়ের কথা শুনে রেগে গেলেও কিছুই বললেন না রোকসানা বেগম। তবে মুখ খুলেন বাবা। রাগান্বিত স্বরে ধমক দিয়ে বলেন-
” চুপ! একদম চুপ! ছোট হয়ে বড়দের ব্যাপারে কথা বলার সাহস তোকে কে দিয়েছে?”
“বাবা তুমিও?”
অবাক বিস্ময়ে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে খাবার প্লেটে পানি ঢেলে হনহনিয়ে রুমে চলে যায় শিশির।

রাত্রি সাড়ে বারো’টার মত বাজে। সবাই আরো একটাদিন সেহরী খাওয়ার অপেক্ষায় নিদ্রাজগতে পাড়ি জমিয়েছে। কিন্তু সবাই ঘুমিয়ে গেলেও ঘুম নেই শুভ্র লাবণ্যর চোখে। একজন মেয়েদের মত হাউমাউ করে ফ্লোরে বসে কান্না করতেছে, আরেকজন বালিশে মুখ গুজে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদতেছে। একজন কাঁদতেছে ওর কৃতকর্মের জন্য, ওর করা ভুলের জন্য।
আরেকজন কাঁদতেছে অনর্থক।
হ্যাঁ, অনর্থক’ই বটে।
না হলে এভাবে কাঁদবে কেন?
কি মানে আছে এই কান্নার? আর কেন’ই বা কাঁদবে? কিসের জন্য কাঁদবে? কার জন্য কাঁদবে?
সব প্রশ্নের একটাই উত্তর, আর সেটা হলো ভালোবাসা। আপনার আমার কাছে যেটা অনর্থক, ওর কাছে সেটা ভালোবাসার কান্না।
আমরা মানুষগুলোই এরকম। প্রচন্ড রকম দুঃখবিলাসী। না হলে যার থেকে সবচেয়ে বেশী কষ্ট পায় কেন তার কাছে এভাবে ফিরে ফিরে যায়?

সেদিন সেহরীর সময় শুভ্র কিংবা লাবণ্য কেউ ঘুম থেকে উঠেনি।
শুভ্রর মা এবং শিশির দুজনের রুমের দরজায় অনেকক্ষণ নক করেছে, কিন্তু কেউ দরজা খুলেনি। ফজরের নামাজের আজান ধ্বণি ভেসে আসতে লাগল দুরের সব মসজিদ থেকে। কিন্তু ওরা? তখনো ঘুমুচ্ছে।
সকাল ৯টা। শুভ্র বাসা থেকে এই সময়ই বের হয়ে যায়, কিন্তু আজ? সে ঘুমুচ্ছে। সকাল ১০টা। লাবণ্য কলেজে প্রাইভেট পড়তে যায়। অথচ আজ? ও ঘুমুচ্ছে। বেলা ১২টা। এখনো এরা ঘুমুচ্ছে। দুপুর ১টা বেজে ৩৫মিনিট। এখনো এরা ঘুমুচ্ছে।

শিশির:- মা….
আর কত ওয়েট করবা? এবার তো দরজা দুইটা ভাঙো।
মা:- আর একটু ওয়েট কর। তোর বাবা আসতেছে।
কাজের মেয়ে:- ঐ তো আংকেল এসে গেছে।
,
দুইটা সুঠামদেহী যুবক নিয়ে শুভ্রর বাবার আগমন হলো ২য় তলায় রুমের সামনে।
,
,
শিশির:- বাবা! দেখো না ওরা দরজা খুলতেছে না।
শুভ্রর মা:- এসেছ তুমি? এবার তাড়াতাড়ি দরজা ভাঙো।
শুভ্রর বাবা:- সরো তোমরা। আমি ডেকে দেখি।

শুভ্রর বাবা শুভ্র এবং লাবণ্য দু’জনের দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ল কিছুক্ষণ। তারপর জোর গলায় বলতে শুরু করল-
” শুভ্র দরজা খুল। বাইরে সবাই দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য। ”
” লাবণ্য মা! দরজা খুলো। অনেক বেলা হয়েছে। এবার তো উঠো।”
” কি হলো শুভ্র? দরজা কেন খুলতেছিস না?”
” লাবণ্য! তুমি কি শুনতে পাচ্ছ? দুপুর আড়াইটা বাজে। নামাজ পড়বা কখন? দরজা খুলো তাড়াতাড়ি।”
” শুভ্র! এবার কিন্তু আমার রাগ উঠে যাবে। দরজা খুল বলছি।”
” লাবণ্য মা! দরজাটা খুলো।”

নাহ!
কোনো কাজ হলো না। এবার মনে হচ্ছে দরজাটা ভাঙতেই হচ্ছে। কামাল, কাশেম!
তোমরা দরজা ভাঙার জন্য প্রস্তুত হউ। প্রচন্ড রাগে ফুসছে শুভ্রর বাবা। এভাবে লোক হাসানোর কোনো মানেই হয় না। আজ দরজাটা ভাঙোক, তারপর দুটোকেই বাড়ি থেকে বের করে দিব। এ বাড়িতে থেকে কোনো নাটক চলবে না। ???

আগে তো দরজা ভাঙোক……???

চলবে……..

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ১০

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মায়ের প্রশ্নের পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে থেমে যায় শুভ্র। কারণ ওর মায়ের মুখ থেকে বখাটে কথাটা শুনার পর থেকে লাবণ্যর খুব হাসি পাচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে উচ্চস্বরে হাসতে কিন্তু সেটা না পেরে মুখে হাত চেপে লাবণ্য হাসতেছে। আর শুভ্র তন্ময় হয়ে সেই হাসি হাসি মুখপানে তাকিয়ে আছে।
আহ্, কি মিষ্টি!
হ্যাঁ, খুব মিষ্টি করে লাবণ্য হাসতে পারে। গালের দুইপাশের টোল যেন সেই হাসির সৌন্দর্য্যকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। মুগ্ধ শুভ্র লাবণ্যর হাসিতে বিভোর। ঘোর কাটে মায়ের ডাকে। “পাগল হয়ে গেছিস? মাথাটা কি একেবারে গেছে? এভাবে একা একা হাসছিস কেন? কি হয়ছে তোর?”
একগাদা প্রশ্ন ছুঁড়ে যায় শুভ্রর দিকে ওর মা। ইয়ে না মানে আসলে আমার একটু কাজ আছে। আমি আসি বলে শুভ্র প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই কোনোরকম কেটে পরে।

রমজানের মাঝামাঝি সময়। সন্ধ্যায় হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরে শুভ্র। বাসায় ঢুকে দেখে ওর পুরো ফ্যামিলি আলোচনাসভায় বসছে।
আলোচ্য বিষয়- “ঈদ কেনাকাটা”……
শুভ্রর টনক নড়ে। ওহ্, নো! আমি তো ভুলেই গেছিলাম সামনে ঈদ। আচ্ছা, ঈদ উপলক্ষ্যে আমি যদি লাবণ্যকে কিছু দেই, তবে কি সে এটা গ্রহন করবে? নাকি আমার মতই আমার দেওয়া গিফ্টও ছুঁড়ে ফেলে দিবে? না, না ছুঁড়ে কেন ফেলে দিবে? আজ না বাসুক কোনো একসময় তো ও আমায় ভালোবাসতো। শত অবহেলার পরও ভালোবাসতো। তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস ও আমার ভালোবাসার দান গ্রহন না করে পারবে না। ও ঠিক গ্রহন করবে। শুভ্র বাসায় এসেও সাথে সাথে বাসা থেকে বের হয়ে চলে যায়। ড্রয়িংরুমে আলোচনাসভায় বসা প্রত্যেকেই অবাক বিস্ময়ে শুভ্রর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আর বলতেছে, এর আবার কি হলো? বাসায় আসতে না আসতেই বের হয়ে গেল?
এদিকে শুভ্র মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে মার্কেটে পৌঁছে যায়। মার্কেটে গিয়ে শুভ্রর মাথা বিগড়ে গেছে প্রায়। হায়রে! এ আমি কোথায় এলাম শপিং করতে? এখানে তো সব কাপড় নজর কাড়া, আমি কোনটা রেখে কোনটা নিব? শুভ্র মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এমন হয় পিছন থেকে কেউ একজন বলে উঠে- Any problem, sir?
শুভ্র মাথা তুলে তাকিয়ে দেখতে পায় ওর পাশে একজন অতিকায় সুন্দরী রমনী দাঁড়িয়ে। শুভ্র স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে বলল, না, না! তেমন কিছু না। রমনী মিষ্টি হেসে বলল, আপনি না বললেও আমি কিন্তু বুঝতে পেরে গেছি প্রবলেমটা কি? আপনি সঠিক কাপড় নির্বাচনে দ্বিধা-দ্বন্ধে ভুগছেন? সঠিকটা চোজ করতে পারতেছেন না, তাই তো?!!! মৃদ্যু হেসে মাথা নাড়ে শুভ্র। রমনী আবারো একটা মিষ্টি হাসি দেয়। তারপর শুভ্রর পাশের একটা চেয়ার টেনে বসে কর্মচারীকে বলে, এই যে ভাইয়া! এই ডিজাইনের মধ্যে কিছু শাড়ি নামান তো! জি, মেডাম নামাচ্ছি বলে অনেকগুলো সুন্দর নিউ ডিজাইনের শাড়ি নামিয়ে দেয়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে রমনী দুইটা শাড়ি শুভ্রর সামনে রাখে। ” আমার মনে হয় এই ডিজাইনের মধ্যে যেকোনো একটা নিলে ভালো হবে। এমনিতে নতুন ডিজাইন, তারপর মিষ্টি একটা কালার। মেডামকে খুব মানাবে। শুভ্র শাড়ির দুইটার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে। সত্যিই তো! অনেক সুন্দর! চোখ যেন ফেরানোই যাচ্ছে না। শুভ্র রমনীটির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে বলে, আমি আর কি বাছাই করব? আমার দুটোই পছন্দ হয়েছে। তবে আমার মনে হয় মিষ্টি কালারটা খুব বেশী মানাবে ওকে। শুভ্র লাবণ্যর জন্য মিষ্টি কালারটা বাছাই করে ঐ রমনীটিকে ধন্যবাদ দিয়ে বাসায় ফিরে।

বাসায় ফিরতে ফিরতে ফিরতে রাত্রি সাড়ে ৯টা বেজে গেছে। শুভ্রর বাবা মসজিদে তারাবীহ নামাজ আদায় করতে চলে গেছে। আর বাকিরা যে যার রুমে চলে গেছে। এই সুযোগ শাড়িটা লাবণ্যর হাতে পৌঁছে দেওয়ার। শুভ্র বাসায় ঢুকে সরাসরি লাবণ্যর রুমে চলে যায়। লাবণ্য তখন মোনাজাত করছিল। শুভ্র তাই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পরল। মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজটা তুলে ডানে তাকাতেই চমকে যায় লাবণ্য। আপনি? ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? শুভ্র তখনই রুমে প্রবেশ করে। ব্যাগ থেকে শাড়িটা বের করে মেলে ধরে লাবণ্যর সামনে। মুগ্ধ নয়নে শাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে লাবণ্য।। এই মুহূর্তে কোনো কথা’ই যেন ওর মুখ থেকে সরছে না। শুভ্র লাবণ্যর এমন নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে থাকা দেখে বলল,
” নাও! এটা তোমার জন্য…… ”
লাবণ্য তখনও স্টেচুর মতো দাঁড়িয়ে ছিল। এটা দেখে শুভ্র’ই লাবণ্যর হাত দুটো উঁচু করে সেই হাতে শাড়িটা তুলে দেয়। শাড়ি হাতে পেয়েও লাবণ্যর কোনো রিয়েক্ট নেই। ওভাবে স্টেচুর মত হাত দুটো উঁচু করে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে শুভ্রর মা?!!!
লাবণ্যকে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতে ডাকতে লাবণ্যর রুমেই পৌঁছে যায়। আচমকা শাশুড়ির রুমে প্রবেশে কিছুটা হকচকিয়ে যায় লাবণ্য। হাতে রাখা শাড়িটা লুকোনোর আগেই দেখে ফেলেন ওনি। শুভ্রর দিকে একবার তাকিয়ে লাবণ্যর হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে নেন ওনি।
” এটা? এটা কোথায় থেকে পেয়েছিস?”
নিশ্চুপ লাবণ্য শাশুড়ির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শাশুড়ি জোর গলায় বলেন, কি হলো? চুপ করে আছিস যে?
” মা! এটা আমি এনেছিলাম। লাবণ্যর জন্য।” পিছন থেকে ভয়ে ভয়ে কথাটা বলে উঠে শুভ্র। শুভ্রর মা অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে শুভ্রর দিকে তাকান। তারপর হাত থেকে শাড়িটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলে উঠে,
” কে বলেছে তোকে শাড়ি দিতে? কে বলেছে? তোর সাহস হলো কিভাবে ওর হাতে শাড়ি তুলে দেওয়ার? আর কখনো যাতে তোকে এ কাজ করতে না দেখি।”
আর লাবণ্য! তোর সাহস হলো কিভাবে একে এ রুমে জায়গা দেওয়ার? লাবণ্য চুপসে গেছে শাশুড়ির রাগী গলার আওয়াজ শুনে। এদিকে শুভ্র?! ওর ইচ্ছে হচ্ছিল মায়ের প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব দিতে। বলতে যে, ” আমার বউকে আমি যা ইচ্ছে তা দিব। তার জন্য সাহসের কি দরকার? আর তুমিই বা এমন কেন করতেছ?”
কিন্তু কি মনে করে যেন শুভ্র বলল না।
শুভ্রর মা এবার চেঁচিয়ে উঠল, কি হলো? এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুম ত্যাগ করে শুভ্র। লাবণ্যকে খাবার টেবিলে আসতে বলে শাশুড়ি রোকসানা বেগম নিচে চলে যায়। নিচে গিয়ে মনে হলো শাড়িটা তো ঐ রুমেই ফেলে রেখে এসেছি। ওটা ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসা দরকার ছিল। মেয়ে শিশির খাবার পরিবেশন করছিল। রোকসানা বেগম মেয়েকে বলেন,
” সর! আমি খাবার দিচ্ছি তোর বাবাকে। তুই গিয়ে একটা কাজ করে আয়! লাবণ্যর রুমে যে শাড়িটা পরে আছে, ঐটা আপাতত ময়লা ফেলার ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে আয়। সকাল হলে না হয় ডাস্টবিনে ফেলে দিয়ে আসবি।”
জি, আচ্ছা বলে শিশির লাবণ্যর রুমের দিকে পা বাড়ায়। দরজার সামনে গিয়ে থমকে যায় শিশির। দেখতে পায় কিছুক্ষণ আগে যে শাড়িটা ওর মা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে গিয়েছিল, সেই শাড়িটা’ই লাবণ্য বুকে জড়িয়ে ফ্লোরে হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছে।
এতকিছুর পরও এত ভালোবাসা মনের ভেতর পুষে রেখেছে? অজান্তেই শিশিরের চোখ থেকে দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরে।

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ০৯

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ০৯
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় শুভ্রর বাবা ও মা। শুভ্র তখনো লাবণ্যর দিকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে ছিল। পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যকে বলে উঠে—
” কাল তোর পরীক্ষা! সে খেয়াল আছে?” শাশুড়ির কথা শুনে মাথা তুলে লাবণ্য।
— কি হলো? এখনো দাঁড়িয়ে আছিস যে? পড়তে হবে না?
” যাচ্ছি মা……..”
লাবণ্য ওর রুমে চলে যায়। শুভ্র তখনো প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে।
—- তুই আবার এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা নিচে টেবিলে গিয়ে খা।
মায়ের কথায় শুভ্র নিচে চলে গেল। সাথে শুভ্রর বাবা এবং বোন। খাবার টেবিলে খাবারে হাত দিয়ে চুপসে বসে আছে শুভ্র। এখন পর্যন্ত একমুঠো খাবারও পেটে যায়নি ওর। যাওয়ার কথাও নয়। মন যেখানে ভরপুর, খাবারের সেখানে পেটে না যাওয়ারই কথা। বাবা, বোন খাওয়া শেষে চলে যাওয়ার পর, ভরা প্লেটে পানি ঢেলে শুভ্রও রুমে চলে যায়। রুমে গিয়ে একবার বিছানায় তো আরেক বার সোফায়, একবার দাঁড়িয়ে তো আরেকবার বসে লাবণ্যর কথা ভাবছে। শুভ্রর কোনো কিছুতেই শান্তি লাগছে না। ছন্নছাড়ার মত এখান থেকে সেখানে যাচ্ছে। কোনো কিছুতেই ওর ভালো লাগছে না। এদিকে লাবণ্য?!!!
বই হাতে একের পর এক পৃষ্টা উল্টাচ্ছে। পৃষ্টা উল্টিয়ে যখনই পড়বে বলে স্থির করে তখনই শুভ্রর মুখখানা হৃদয়ের ক্যানভাসে ভেসে উঠে। লাবণ্য বইয়ের পাতায় কোনো লেখা দেখতে পাচ্ছে না। সব পাতা জোড়েই শুধু শুভ্র, শুভ্র, শুভ্র_____
উফফ! এসব কি হচ্ছে আজকে?
ভ্রু কুচকে পড়ার টেবিল থেকে উঠে পরে লাবণ্য। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পরে।
কিন্তু একি?!!!
শুয়ে থেকেও লাবণ্যর ভালো লাগছে না। কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। ছটফট করছে ভিতরটা। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ লাবণ্য। কিছুক্ষণ বিছানার এপাশ ওপাশ করে শুয়া থেকে উঠে বসে। অন্ধকারে হাঁটুতে ভর দিয়ে চুপটি করে মাথা নিচু করে বসে থাকে। এমন সময় রুমে আগমন ঘটে ওর শাশুড়ির। আলোটা জ্বেলে ওনি লাবণ্যর মাথায় হাত রাখেন। লাবণ্য মাথা তুলল তাকায়।
” অনেক রাত হয়েছে, ঘুমিয়ে পর।”
শাশুড়ির কথায় হুম বলে শুয়ে পরে লাবণ্য।
ডিমলাইট’টা জ্বালিয়ে আলো নিভিয়ে রুম ত্যাগ করেন লাবণ্যর শাশুড়ি।
নির্ঘুম শুভ্র ধীরপায়ে লাবণ্যর দোয়ারে এসে দাঁড়ায়। জানালার পর্দাটা আংশিক ফাঁক করে ভেতরের দিকে তাকায় শুভ্র। ডিমলাইটের মৃদু আলোয় শুভ্র দেখতে পায় ওর লাবণ্য পরম নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। ঘুমন্ত লাবণ্যর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজ রুমের দিকে পা বাড়ায় শুভ্র।

পরদিন পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরছিল লাবণ্য। কলেজ গেইটের কাছাকাছি আসতেই দেখতে পায় শুভ্র দাঁড়িয়ে। শুভ্রকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পিছু হটে লাবণ্য। শুভ্র অবাক বিস্ময়ে লাবণ্যের দিকে তাকিয়ে ভাবছে-
” এভাবে চলে গেল কেন ও?”
ক্ষাণিক বাদেই ফিরে আসে লাবণ্য। কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় শুভ্র। কারণ, এই মুহূর্তে ওর পিছনে ওর মা স্বয়ং দাঁড়িয়ে। লাবণ্যর পিছু হটার কারণ বুঝতে পারে শুভ্র। বুঝতে পারে ওকে দেখে লাবণ্যই ফোন করে মাকে এনেছে। লাবণ্যকে নিয়ে বাসায় যাওয়ার আগমুহূর্তে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে রোকসানা বেগম ছেলে শুভ্রকে__
” তুই? তুই এখানে কি করছিস?”
আমতা আমতা করে শুভ্রর জবাব, কাজ! একটু কাজ ছিল মা……………

লাবণ্যর পরীক্ষা চলাকালীন সময়ে প্রতিদিন শুভ্র কলেজ গেইটে দাঁড়িয়ে থাকত। অধির আগ্রহে অপেক্ষা করত লাবণ্যর ফিরে আসার, লাবণ্যর সাথে কথা বলার জন্য। কিন্তু লাবণ্য?!!!
যতবারই শুভ্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখত, ততবারই শাশুড়িকে ফোন করে আনত। ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে প্রতিদিন’ই শুভ্র বাসায় ফিরে যেত। সেদিন ছিল লাবণ্যর পরীক্ষার শেষ দিন। প্রতিদিনকার মত শুভ্রও সেদিন গিয়েছিল লাবণ্যর সাথে কথা বলার প্রত্যাশায়। তবে সেদিন আর শুভ্র কলেজ গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল না। শুভ্র লুকিয়ে ছিল কলেজ গেইট থেকে ক্ষাণিকটা দুরে, আড়ালে। লাবণ্য যখন দেখল শুভ্র নেই, তখন নিশ্চিন্তে সামনের দিকে এগুচ্ছিল। গেইট পেরিয়ে একটু সামনে আসতেই চলার সেই গতি থেমে যায় ওর। মাথা নিচু করে একজায়গায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্য। আর শুভ্র?!!!
শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্যর ঠিক সামনেই পথ আটকে।

— লাবণ্য!
তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। প্লিজ এখান থেকে একটু চলো। লাবণ্য পূর্বের ন্যায় মাথা নিচু করে আছে।

— লাবণ্য! এটা পাব্লিক প্লেস। আর পাবলিক প্লেসে আমি কোনো বাড়াবাড়ি করতে চাচ্ছি না। তাই প্লিজ, লাবণ্য! তুমি আমার সাথে চলো।
লাবণ্য মাথা নিচু করে আছে, তবে ওর মুখ থেমে নেয় আর। মাথা নিচু করে লাবণ্য অনর্গল বলা শুরু করে-
” আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমার এখন বাসায় যেতে হবে। না হলে মা টেনশন করবে।”

– লাবণ্য প্লিজ তুমি আমার সাথে চলো। আমাকে তোমার বেশীক্ষণ সময় দিতে হবে না। শুধু ৩০মিনিট। ৩০মিনিট সময় দান করো তুমি আমায়।
” Impossible….
৩০মিনিট কেন? ৩০সেকেন্ড সময়ও আমি কাউকে দিতে পারব না। প্লিজ, রাস্তা ছাড়ুন।”

— লাবণ্য! প্লিজ এমন করে না। আমার কথাটা শুনো একটু….(….)….???
” রাস্তা ছাড়ুন বলছি….”

—- না, আমি এখন রাস্তা ছাড়ব না।
” আমি কিন্তু এবার চিল্লিয়ে মানুষ জড়ো করব। ”

— যদি পারো, তবে তাই করো। আমিও শুনতে চাই তোমার গলার জোর কতটুকু?
লাবণ্য কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাজির শুভ্রর মা। দুর থেকে শাশুড়ি দেখেই হেসে উঠে লাবণ্য। বলে উঠে— ” মা তুমি?”

হ্যাঁ, আমি। তোর আর মানুষ জড়ো করতে হবে না। চল, সামনে রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে।
কথাটা পিছন থেকে শুভ্রর মা বলে উঠে। শুভ্র লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। লাবণ্যর মা সেদিকে তাকিয়ে বলে-
” আর আপনি? আপনি কি ডাক্তারি পেশা ছেড়ে অন্য কোনো পেশা গ্রহন করেছেন?”

মাথা তুলে তাকায় শুভ্র।
– মা! তুমি আমাকে বলছো???
শুভ্রর মা গম্ভীর কন্ঠে বলেন, জি! আমি আপনাকেই বলছি। এই পেশা গ্রহন করেছেন কবে?
শুভ্র অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে মাকে, কিসের পেশা?!!!

এই যে প্রতিদিন মহিলা কলেজের গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েদের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকিস সেই পেশা।

অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যায় শুভ্র। অবাক বিস্ময়ে বলে উঠে-
” মানে???”
শুভ্রর মা শান্ত গলায় বলেন-
মানে ডাক্তারি পেশা ছেড়ে বখাটে পেশায় কবে থেকে নাম লিখিয়েছিস???

শুভ্র:- কি???
মা:- জি…………

চলবে…….

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ০৮

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ০৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

শুভ্র পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে বের হয়ে পরল লাবণ্যর খুঁজে। এখানে সেখানে, অলিতে গলিতে, পথে-ঘাটে, পার্ক, ক্যাফে-রেস্তোরায় সব, সব জায়গায় শুভ্র লাবণ্যর খুঁজ করেছে। কিন্তু কোথাও লাবণ্যকে খুঁজে পায়নি। লাবণ্যর বন্ধুমহলের কেউ লাবণ্যর সন্ধান দিতে পারে নি। সেদিন মনমরা হয়ে চেম্বার থেকে ফিরছিল শুভ্র। পথে দেখা হয় লাবণ্যর বন্ধু সুমনের সাথে। দুর থেকে দেখেই চিনে ফেলে শুভ্র। এ তো সেই ছেলে যাকে আমি ছবিতে লাবণ্যর পাশে দেখেছিলাম। থমকে যায় শুভ্র। পিছন থেকে ডাক দেয় সুমনকে- এই যে শুনছেন?
পিছু ফিরে সুমন। প্রাণের বান্ধবী লাবণ্যর বরের ছবি সুমন আগেও অনেক বার দেখেছে। তাই শুভ্রকে চিনে নিতে কষ্ট হয়নি।
হাসি হাসি মুখে বলে উঠে সুমন-
” শুভ্র ভাইয়া যে! কি অবস্থা আপনার? লাবণ্য কেমন আছে?”
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে শুভ্র, “আপনি? আপনি আমাকে চিনেন?”
শুভ্রর কথা শুনে হা, হা করে হেসে উঠে সুমন- ” কি যে বলেন না! আপনি হচ্ছেন সেই মেয়ের হাজবেন্ড যে আমাদের কলেজের সেরা রূপবতী ছিল। আর তাছাড়া আপনি হচ্ছেন আমার বেস্টফ্রেন্ডের কলিজা, যার কথা উঠতে বসতে শুনতে হতো আমায়। আপনাকে না চিনে উপায় আছে কি? শুভ্র বলে উঠে-
” আপনি আর লাবণ্য একই কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করছেন?”
সুমন জবাব দেয়, হ্যাঁ! আমরা একই কলেজের স্টুডেন্ট ছিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুভ্র বলে, কথা হয় না লাবণ্যর সাথে?
সুমন বলে, হয়! তবে আগের মত আর হয় না। লাবণ্য আগের থেকে কেমন যেন বদলে গেছে। গম্ভীর হয়ে গেছে। আগে ও এমন ছিল না। ঐতো সেদিন! আন্টির সাথে শপিংয়ে গিয়েছিল ও। কাকতালীয়ভাবে আমিও আমার বউকে নিয়ে সেখানে হাজির। ওকে সেদিন কত যে প্রশ্ন করলাম, ও শুধু হ্যাঁ, না জবাব দিল। নিজ থেকে একটা প্রশ্নও করেনি আমাদের।

ওহ! আপনি বিয়ে করেছেন?
স্মিতহাস্যে সুমনের জবাব, হ্যাঁ! ২বছর ৬মাস হলো বিয়ে করলাম।
___” Late Congratulation…..”
সুমন অট্টহাসি দিয়ে বলে, tnx… সুমনের থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছিল শুভ্র, আচমকা মনে হলো সুমনের বলা সেই কথাটি, ” ঐতো সেদিন আন্টির সাথে ও শপিংয়ে গিয়েছিল….”
পিছু ফিরে তাকাই শুভ্র। প্রশ্ন করে সুমনকে। কি যেন বলছিলেন, লাবণ্য আন্টি মানে আমার মায়ের সাথে শপিংয়ে গিয়েছিল?”
সুমন ভ্রু কুচকে বলে, হ্যাঁ! আপনার মা’ই তো ছিল। কেন বলুন তো?! হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?
শুভ্র কথা ঘুরিয়ে বলল, সে কিছু না। আচ্ছা আসি তাহলে। আল্লাহ হাফেজ।

রাত্রি ১১টা ৩৫মিনিট__
শুভ্র ওদের নতুন বাসার গেইটের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দাড়োয়ান গেইট খুলে দেয়। বাসার দরজায় কড়া নাড়ে শুভ্র। দু’তিনবার কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে শুভ্রর বোন। এত রাত্রে ভাইকে এভাবে দেখে চমকে উঠে শিশির। প্রশ্ন করে ভাইকে। ” ভাইয়া! তুই ঠিক আছিস তো?”
ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিল শুভ্রর বাবা মা। ওখান থেকে উচু গলায় শুভ্রর মায়ের প্রশ্ন- কে এসেছেরে শিশির? শিশিরের জবাব, তুমি দেখে যাও কে এসেছে? শুভ্রর মা দরজার সামনে এসে মুখ কালো করে ফেললেন। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
” তুই? তোকে না বলে দিয়েছি লাবণ্য এ বাসায় নেই? তো আবারো কেন এসেছিস?”

গম্ভীর গলায় শুভ্রর জবাব, ” লাবণ্য থাকে না বলে আমি কি এ বাসায় আসতে পারব না? নাকি এ বাসায় আসা আমার বারণ? ”
ড্রয়িংরুম থেকে শুভ্রর বাবা প্রশ্ন করেন, কে এসেছে শুভ্রর মা? কার সাথে কথা বলছ? শুভ্রর মা কোনো কথা না বলে কিচেনের দিকে চলে যান। শুভ্র রুমে প্রবেশ করে বাবাকে সালাম দেয়। মাথা উঁচু করে শুভ্রকে দেখে মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় করে সালামের জবাব দেন। শুভ্র ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কেমন আছে কিন্তু জবাব পায়নি। তাই চুপ করে রুমে চলে গেছে। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরে শুভ্র।
রাতটা কোনোমতে পোহাক। তারপর চিৎকার কান্নাকাটি করে হলেও ওদের থেকে লাবণ্যর ব্যাপারে জানতে হবে। কপালে হাত দিয়ে কথাগুলো ভাবছিল শুভ্র। তখনই রুমে প্রবেশ করে শিশির। “ভাইয়া চল! খাবি…”
আমি খাব না বলে বিদায় করে দেয় শুভ্র তার বোনকে। একটু পর রুমে প্রবেশ করে শুভ্রর বাবা। ” কি হলো? তোর মা খাবার নিয়ে বসে আছে। যাচ্ছিস না কেন?”
গম্ভীর গলায় শুভ্রর জবাব, খিদে নেই আমার। তোমরা খেয়ে নাও। শুভ্রর বাবা কথা না বাড়িয়ে চলে যায়।

পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে শুভ্র ওর বাবা মাকে লাবণ্যর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে ওরা ওকে উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়ে দেয়। রাগে কষ্টে ব্রেকফাস্ট না করেই রুমে যায় শুভ্র। দুপুর ১২টার দিকে শুভ্রর বাবা শুভ্রর রুমে প্রবেশ করে। শুভ্র তখন জানালার গ্রিল ধরে চুপটি করে বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। শুভ্রর বাবা এসে জিজ্ঞেস করে, “কিরে? হসপিটালে যাবি না?” শুভ্র স্থির গলায় জবাব দেয়, না।
বাবা বুঝতে পারল ছেলের মনের অবস্থা ভালো নই, তাই আর কোনো কথা না বলে রুমে থেকে বের হয়ে গেলেন ওনি। পরদিন শুভ্র আর বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। পড়তে পারেনি ফজরের নামাজ। পড়বে কিভাবে? না খেতে পেয়ে শরীর যে একদম দুর্বল হয়ে গেছে।

সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। সারাদিনের ভেতর ছেলেকে একবারও রুমের বাইরে না দেখে ভয় পেয়ে যান রোকসানা বেগম। শুভ্র বিছানায় শুয়ে খিদের অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছিল। একমাত্র ছেলের এমন করুণ অবস্থা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল মায়ের। শিশিরের সহযোগীতায় ওনি শুভ্রকে জোর করে খাবার টেবিলে নিয়ে যায়। তারপর একদম জোর করেই খাইয়ে দেয়। রাত্রে শুভ্রকে আর ডাকতে হয়নি। শুভ্র নিজেই যাচ্ছিল ডিনার করতে। সিড়ি বেয়ে নিচে নামার সময় দেখা হয় শিশিরের সাথে। হাতে ভাতের প্লেট আর তরকারীর বাটি নিয়ে উপরের রুমের দিকে যাচ্ছে। অবাক শুভ্র প্রশ্ন করে, ” কিরে? খাবার নিয়ে উপরে কোথায় যাচ্ছিস?”
প্রশ্ন শুনে আঁতকে উঠে শুভ্র। আমতা আমতা করে বলতে শুরু করে-
” ইয়েমানেনামানেআমি_ আসলে……”
শুভ্র চোখ বড় বড় করে বলে, কাঁপতেছিস কেন? আমি কি বাঘ না ভাল্লুক? শিশির ঢোক গিলে বলে, আমি___ খাব, খাব এগুলো….
বিস্ময়ে হতবাক শুভ্র প্রশ্ন করে, তুই খাবি? তো নিচে কি হয়ছে? শিশির বার বার আটকে যাচ্ছিল তবুও কাঁপা গলায় বলল, আমার রুমে খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। তাই…..
শিশিরের জবাব শুভ্রর কাছে সুবিধার মনে হলো না। তবুও বলল, যা তাহলে…..
শুভ্র নিচে চলে গেল।
শিশির যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। দু’লাফে রুমে গিয়ে হাত থেকে প্লেট আর বাটি রেখে ছিটকিনি এটে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে শিশির। লাবণ্য চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে শিশিরকে। ” কি হয়েছে শিশির?”
শিশির ঢোক গিলে বলে, কিছু না ভাবি। তুমি খাও তো….

৭দিন পর_
প্রতিদিনকার মত সেদিনও হসপিটাল থেকে সোজা এ বাসায় চলে আসে শুভ্র। এসেই ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে বসে সে। রোকসানা বেগম প্লেটে খাবার দেওয়া মাত্রই প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে পরে শুভ্র। এভাবে প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলি যে? বাবার প্রশ্নের জবাবে ছেলের উত্তর, আজকে শিশিরের সাথে রুমে খাব। শুভ্র সামনের দিকে পা বাড়ায়। পিছন থেকে বাবা মায়ের কারো কথা কানে না নিয়ে শুভ্র এক পা দু’পা করে সিড়ির ধাপ অতিক্রম করছে। উপরে শিশিরের রুমের সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ায় শিশির। ডাক দিতে গিয়েও ডাক দেয়নি বোনকে। কারন, ইতিমধ্যে শুভ্র বুঝে গেছে এ রুমে শিশির ছাড়াও আরো একজন আছে।
আজ শুভ্র ঐ ২য় জনের সাথে পরিচিত হবে। তাই খাবার হাতে নিশ্চুপ শুভ্র দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মিনিট দশেক পর দরজা খুলে শিশির। দরজার সামনে শুভ্রকে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না সে। শিশির চমকে উঠে। কাঁপা গলায় আমতা আমতা করে বলে উঠে-
” তু…..তু……..তু……তুই……?”

কি হয়েছে শিশির? কার সাথে কথা বলছ? বলেই এগিয়ে আসছিল লাবণ্য। শুভ্রকে এখানে এভাবে দেখে চমকে যায় লাবণ্য। শুভ্রর চোখ এতক্ষণে শিশিরের থেকে লাবণ্যর দিকে চলে যায়। লাবণ্য শুভ্রর থেকে চোখ সরিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে।

চলবে…….

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ০৭

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ০৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মানে আবার কি হবে? তুই তো বললি ভাবি ওনার বাবা মায়ের সাথে ২বছর ধরে আছে। তার মানে এটা দাঁড়ায় না যে তুই ভাবিকে ওনাদের সাথে কবরে শুইয়ে দিয়ে আসছিস!
বোনের কথা শুনে চেঁচিয়ে উঠে শুভ্র। কি উদ্ভট কথা বার্তা বলছিস তুই? কবরে কেন শুয়ে থাকবে? ওদের বাবা মা আছে না? ওদের সাথে বাসায় থাকবে।

এখানেই ভুল করছেন আপনি ডা: শুভ্র। লাবণ্যর বাবা মা তো তখনই মারা যায় যখন ও অনার্স ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা দিচ্ছিল। তাহলে ওরা কিভাবে কবর ছেড়ে বাসায় থাকবে? পিছন থেকে বলে উঠে লাবণ্যের কাজিন সোহেল।
চমকে উঠে পিছনে তাকালো শুভ্র। আপনি?
ডাঃ সোহেল জবাব দেন, হ্যাঁ আমি। লাবণ্যের কাজিন। পেশায় একজন ডাক্তার। সেদিন লাবণ্যের শরীরে অনেক জ্বর ছিল, ও হাঁটতে পারছিল না। তাই আমি ওকে শক্ত করে ধরে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলাম। আর আপনি সেটা দেখেই ভুল বুঝলেন।
ভুল না বুঝে উপায় আছে? ও হঠাৎ করে যোগাযোগ কেন বন্ধ করে দিল? ওর বাবা মা মারা গেছে সেটা তো আমায় বলতে পারত। নিজে না পারুক, তুষারকে দিয়ে তো বলতে পারত। জানাতে পারত সমস্যার কথা।
মানুষটা স্বাভাবিক জীবনে থাকলে তো এতকিছু ভাবতো। আর কার কথা যেন বলছিস? তুষার?!!!!
হা, হা, দুঃখের মাঝেও হাসি পেল।
তুষার বেঁচে থাকলে তো খবর নিয়ে যাবে!
শিশিরের কথা শুনে আঁতকে উঠে শুভ্র। কাঁপা গলায় বলে, মানে? তু তু তু……..ষা…..র নেই?
সোহেল জবাব দেয়, না নেই। সেদিন কার এক্সিডেন্টে শুধু লাবণ্যর বাবা মা মারা যায়নি, তুষারও মারা গিয়েছিল।
ওদের কথা শুনে শুভ্রর পুরো পৃথিবী ঘুরছে। মনে হচ্ছে, এখনি যেন মাথা ঘুরে পরে যাবে। শুভ্র মনে মনে বলছে, হায় আল্লাহ! একি শুনালে আমায়?
” শুধু ওরাই মারা যায়নি। মারা যাওয়ার সাথে সাথে নিয়ে গেছে একটা মেয়ের মুখের হাসি। বেঁচে থাকার স্বপ্ন। নিয়ে গেছে একটা মেয়ের সুস্থ স্বাভাবিক জীবন। সেদিন চোখের সামনে পরিবারের এতগুলো মানুষের মৃত্যু মেনে নিতে পারে নি মেয়েটি। তাই তো সে সব হারিয়ে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে যায়।”
শিশির থেমে গেল। সোহেল বলতে শুরু করল, মেয়েটি ঢাকায় যে বাসায় থাকত সে বাসার বাড়িওয়ালা ও আশেপাশের বাসার লোকজনেরা ওকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখে। কারন, ওকে কন্ট্রোল করা যাচ্ছিল না। খবর পেয়ে ছুটে আসে মেয়েটির গ্রামের বাড়ির আত্মীয় এবং সেই সাথে মেয়েটির মায়ের বান্ধবী। মানসিক হসপিটালে ভর্তির পরও অবস্থার কোনো উন্নতি হচ্ছে না দেখে মেয়ের মায়ের সেই বান্ধবী ও ওনার হাজবেন্ড মেয়েটিকে দেশের বাহিরে নিয়ে যান।
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে শুভ্র, মা?!!!

সোহেল জবাব দেয়, হ্যাঁ। আপনার মা’ই ছিল লাবণ্যর মায়ের একমাত্র কাছের বান্ধবী। লাবণ্যকে আপনার মা অনেক আগে থেকেই আপনার জন্য পছন্দ করে রেখেছিল।

ভাইয়া, এই ভাইয়া! দাঁড়া….. কোথায় যাচ্ছিস এভাবে?
সোহেলের পুরো কথা না শুনে শুভ্র ছুঁটতে থাকে। শিশির বার বার ডেকেও থামাতে পারল না ভাইকে।
শুভ্র ছুটছে তো ছুটছে’ই……………

শিশির! ওকে পিছু ডেকো না। যেতে দাও ওকে। ওকে ওর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে দাও। ওর প্রায়শ্চিত্তের সময় এসে গেছে শিশির। পিছু ফিরে তাকাই শিশির। প্রশ্ন করে সোহেলকে, কিন্তু সেই প্রায়শ্চিত করার সুযোগ আদৌ কি ও পাবে? ভাবি কি এখনো আপনাদের বাড়িতে আছে?
লাবণ্যকে ওখানে রেখে আসার পরদিন’ই তোমার বাবা মা ওকে ঢাকায় তোমাদের নতুন বাসায় নিয়ে গেছে। ও ওখানেই আছে এখন। অনার্স ২য় বর্ষে পড়ে। ও এখন বেশ ভালোই আছে।
শিশির কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞেস করল, মানে? ভাবি এখন আমাদের বাসায় আব্বু আম্মুর সাথে আছে? সোহেল স্মিতহাস্যে জবাব দেয়, হ্যাঁ। ও তোমাদের বাসায়’ই আছে। এইতো আমি তো তোমাদের বাসা থেকেই আসলাম ওকে দেখে।
শিশির আনন্দে লাফিয়ে উঠে শুভ্রর নাম্বার ডায়াল করে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে, ভাইয়াকে তাহলে খবরটা দিতে হয়!

সোহেল হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নেয়। শিশির চোখ বড় বড় করে সোহেলের দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকায়। সোহেল গম্ভীর কন্ঠে বলে, লাবণ্যর কথা এখন শুভ্রকে বলা যাবে না।
শিশির অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, কেন বলা যাবে না? মুচকি হেসে সোহেল বলে, খুঁজোক না! খুঁজোক আর একটু একটু করে পুঁড়তে থাকুক বিরহের অনলে। তবেই না ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হবে।
শিশির মন খারাপ করে বলে, কিন্তু ভাইয়া তো কষ্ট পাবে?!!!
প্রশ্নোত্তরে সোহেলের জবাব, আরে বোকা মেয়ে! কষ্টের পরই তো ভালোবাসার অধ্যায় শুরু হবে। একটু তো ধৈর্য্য ধরো!!!
শিশির সোহেলের কথামতো শুভ্রকে আর কল দিল না।

এদিকে শুভ্র?!!!
লাবণ্যর জন্য পাগলপ্রায়। এখানে ওখানে করে অসংখ্য জায়গায় লাবণ্যর খুঁজ করেছে, কিন্তু কোথাও ওকে পায়নি। লাবণ্যর গ্রামের লোকজন ভিষণ অপমানজনক ও কটু কথা বললো শুভ্রকে। কিন্তু শুভ্র একটুও অপমানিত হয়নি।
কারণ- ও জানে এ হবে, এ হওয়ার কথা ছিল। রাত্রি ১২টা বাজে।
শুভ্রর চোখে ঘুম নেই।
সারাটা দিন লাবণ্যকে খুঁজে ক্লান্ত শুভ্র বাসায় ফিরে যায়। ফ্রেমে বন্দি লাবণ্যর ছবিটা লাবণ্যর খাটের নিচে অযত্নে অবহেলায় পরে ছিল, আজ শুভ্র সেই ময়লায় ঢাকা ছবি বুকে নিয়ে কাঁদতেছে আর ছবির গায়ে চুমুর পর চুমু দিচ্ছে।
এমন সময় দুরের কোনো এক দোকান থেকে ভেসে আসছে-

” তোর কাছে আমার
অনেক কথা বলার ছিল,
তোর সাথে আমার
স্বপ্ন দেখার আলাপ ছিল!!
তুই শুধু দুরে যাস, দুরে যাস
পাবি না আমাকে!!
.
তোর কাছে আমার
অনেক কথা বলার ছিল,
তোর সাথে আমার
স্বপ্ন দেখার আলাপ ছিল।

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ০৬

0

ভুল এবং ভালোবাসা

পর্ব- ০৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

একপা দু’পা করে লাবণ্য পৌঁছে যায় কবরস্থানে। কবরস্থানে ক্লান্ত লাবণ্য ঐ জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায় যে জায়গায় ওর বাবা- মা আর স্নেহের একমাত্র ছোট্ট ভাইটি চিরনিদ্রায় শায়িত হয়ে আছেন।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। লাবণ্য তখনো নির্জন জায়গায় বাবা মায়ের কবরের পাশে চুপটি করে বসে ছিল। দু’দিনের অভুক্ত শরীর নিয়ে লাবণ্য বেশীক্ষণ কবরস্থানে বসে থাকতে পারে নি। একটা সময় লাবণ্য জ্ঞান হারায়। সেদিন মাগরিবের নামাজ শেষে মাদ্রাসার কিছু ছাত্র নিয়ে লাবণ্যর চাচা কি কারনে যেন কবরস্থানে গিয়েছিলেন। কবরস্থানে ভাই ভাবির কবরের পাশে একমাত্র ভাতিজিকে নিথর হয়ে পরে থাকতে আঁতকে উঠেন। একটা বিকট চিৎকার দিয়ে ওনি বসে পরেন। রাস্তার আশেপাশের বাড়ির মানুষজন ওনার চিৎকার শুনে ছুটে আসেন। ছুটে আসেন লাবণ্যর চাচি ও চাচাতো ভাই বোনেরা। লাবণ্যকে ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। পাশেই একটা হসপিটালে রোগী দেখতে বসত লাবণ্যের কাজিন। খবর পেয়ে ছুটে আসে ওর কাজিন। লাবণ্যর পালস চেক করে জানায়, নাহ! কিচ্ছু হয়নি। শুধু জ্ঞান হারিয়েছে। জ্ঞান ফিরার পর লাবণ্যকে সবাই প্রশ্ন করে, কি হয়েছে? লাবণ্য বিছানা থেকে গর্জে উঠে। ও কিছুতেই বিছানায় শুয়ে থাকতে চায় না। লাবণ্য কবরস্থানে বাবা মায়ের সাথে থাকবে বলে স্থির করে। জোর করে ধরেও ওকে কেউ খাওয়াতে পারছে না। অস্থির লাবণ্য হাত পা ছুড়াছুড়ি করা শুরু করে কবরস্থানে যাওয়ার জন্য। অবস্থা বেগতিক দেখে লাবণ্যর চাচা চাচি ফোন করে ঢাকায় লাবণ্যর শ্বশুর বাড়িতে। খবর পেয়ে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি ছুটে আসেন। রাত্রি তখন আড়াইটা। পুরো এলাকা ঘুমিয়ে গেলেও এ বাড়ির কেউ দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। ওরা ভেবে নিয়েছে লাবণ্য বুঝি পূর্বের ন্যায় পাগল হয়ে গেছে। তাই লাবণ্যর হাতে পায়ে শিকল পরিয়ে রেখেছে। লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি এসে দেখে অসহায় লাবণ্য শিকল পায়ে ছটফট করছে। লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যর কাছে ছুটে যান। মাথায় হাত রাখেন। উপরের দিকে মুখ তুলে তাকায় লাবণ্য। শ্বশুর শাশুড়িকে দেখে চোখের জল ছেড়ে দেয় লাবণ্য। শাশুড়ি লাবণ্যকে বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। সকলের নিষেধ অগ্রাহ্য করে লাবণ্যর হাত পায়ের শিকল খুলে দেন ওনি। শিকলবিহীন লাবণ্যকে শাশুড়ি একটি আলাদা রুমে নিয়ে একরকম জোর করে খাবার খাইয়ে দাইয়ে ঔষধ খাইয়ে দেন। ছোট্ট বাচ্চাদের মত খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পরে লাবণ্য। সকালে ঘুম থেকে উঠলে আবার সেই পাগলামী শুরু হয়- আমি বাবা মায়ের সাথে থাকব, আমি কবরস্থানে থাকব। এলাকার লোকজন কানাঘুষা শুরু করে এবারো বুঝি মাথাটা গেল। লাবণ্যর শ্বশুর সবাইকে ধমক দিয়ে থামায়। তারপর লাবণ্যর কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে, মা! কি হয়ছে তোমার? কে তোমায় কি বলছে? তুমি আমাদের বলো। আমরা ওর বিচার করব। লাবণ্য অনর্গল বলতে শুরু করে বিয়ের পর থেকে গতকালের ঘটে যাওয়া কাহিনী পর্যন্ত সব, সব বলে লাবণ্য। পুরো কথা শুনে রেগে যায় লাবণ্যের চাচা চাচিসহ এলাকাবাসী। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় লাবণ্যর শাশুড়ির। লাবণ্যর শ্বশুর বলে উঠে, শুভ্র ভুল করেছে। শুধু ভুল না, ভয়ংকর ভুল। ওর সেই ভুলের প্রায়শ্চিত্ত ওকে করতে হবে। এখন আমাদের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে দে মা। আমরা নিজ হাতে তোমার জীবনটা শেষ করে দিয়েছি। আমরা অনেক বড় ভুল করছি। এখন সেই ভুলের প্রায়শ্চিত করতে চাচ্ছি। মা তুমি আমাদের সাথে চলো। লাবণ্যর চাচা চাচি এমনকি এলাকার কেউ লাবণ্যকে শ্বশুর শাশুড়ির সাথে দিতে চায় না। পরিস্থিতি প্রতিকূলে দেখে শাশুড়ি ছুটে যায় লাবণ্যর কাজিন ডাক্তার সোহেলের কাছে। মায়ের সমতুল্য মহিলার অনুরোধ ফেলতে পারেনি ডাক্তার সোহেল। বাবা মাকে অনেক চেষ্টা করে বুঝিয়ে লাবণ্যকে ওর শ্বশুর শাশুড়ির হাতে তুলে দেওয়া হয়। শর্ত একটাই- যে ছেলের কারনে ওনাদের মেয়ের এই অবস্থা হয়েছে সেই ছেলের ছায়াও যাতে ওনাদের মেয়েকে স্পর্শ না করে। শর্ত মেনে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি লাবণ্যকে নিয়ে ঢাকায় ওদের বাসায় চলে যায়।

কেটে যায় ২বছরেরও অধিক সময়। সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা লাবণ্য এরই মধ্যে লাবণ্য পুনরায় পড়াশুনা শুরু করেছে। অনার্স ২য় বর্ষের ছাত্রী এখন লাবণ্য। পড়াশুনার পাশাপাশি একটা ছোট্ট কিন্ডারগার্টেনে বাচ্চাদের পড়া’ই ও। বাকিটা সময় শ্বশুর শাশুড়ির সাথে গল্পে আর আড্ডাবাজিতে কেটে যায়।
সবমিলিয়ে গল্পের নায়িকা লাবণ্য বেশ ভালো ভাবেই ওর দিন কাটাচ্ছে।
এদিকে গল্পের নায়ক শুভ্র…!!!
ওর কি খবর? ও কি আদৌ ভালো আছে????
এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে আমাদের যেতে হবে শুভ্রর কাছে। তো চলুন বন্ধুরা ঘুরে আসা যাক শুভ্রর বাড়ির আঙ্গিনা থেকে।
শুভ্র——————
লাবণ্যকে গ্রামের বাড়িতে দিয়ে আসার পর থেকেই শুভ্র কিরকম উদাসীন হয়ে গেছে। অজানা এক শূন্যতায় শুভ্রর ভিতরটা সবসময় হাহাকার করে। একটা অজানা অপরাধবোধ শুভ্রর ভিতরটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেত। সারাদিন হসপিটালে থাকত শুভ্র। দিনশেষে হসপিটালের চেম্বার থেকে যখন বাসায় ফিরত তখন কেমন যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব করত শুভ্র। বুকটা কেমন খাঁ খাঁ করে উঠত ওর। যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য প্রতিরাত্রে শুভ্র স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমাতো। কিন্তু কাজ হতো না। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে যেত শুভ্রর। স্মৃতিরা এসে মনের জানালায় কড়া নাড়ত। শুভ্রর মনে হতো শূন্য রুমে কেউ যেন গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে। শুধু কাঁদছে না, মাঝে মাঝে অস্ফুট স্বরে কেউ যেন বলছে- আমার খুব কষ্ট হচ্ছে শুভ্র। আমায় একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে।
শুভ্র রুম জুড়ে খু্ঁজে বেড়াতো। কিন্তু কাউকে দেখতে পেত না ও।
ঠিক সে সময় বুকের বামপাশে চিনচিনে এক ব্যথা অনুভূত হতো।

সেদিন উন্মাদের মত রাস্তায় হাঁটছিল শুভ্র। পিছন থেকে কেউ একজন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় ওকে। রাস্তা থেকে উঠে ডানে তাকাতেই দেখে লাগেজ হাতে শিশির দাঁড়িয়ে। কিছু বলার আগেই শিশির বলে উঠে- ” সারপ্রাইজ দিতে এসেছিলাম। আর সেজন্য বাবা-মা-ভাই-ভাবি কাউকে জানাইনি দেশে ফিরতেছি। কিন্তু এখন তো দেখি সারপ্রাইজ দিতে এসে আমি নিজেই ভয়ংকর রকম সারপ্রাইজ পেয়ে গেলাম।”
ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসিরর রেখা টেনে শুভ্র জিজ্ঞেস করে- কেমন আছিস?
প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন করে শিশির। আমার’টা না হয় পরেই বলি। আগে বল তুই কেমন আছিস? আর দেবদাসমার্কা চেহারা নিয়ে এভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন?
– – – – – – – – – – – – –
কি হলো ভাইয়া? চুপ করে আছিস কেন?
– – – – – – – – – – – – –
আচ্ছা, বাদ দে! ভাবি কেমন আছে সেটা বল……
কি হলো? চুপ করে আছিস কেন?

নিচু কন্ঠে শুভ্রর জবাব, জানি না…….

জোর গলায় শিশির বলে উঠে, কিহ? জানিস না মানে? শুভ্র আবারো বলে, ও আমার কাছে নেই দু’বছর ধরে। তাই বলতে পারব না ও কেমন আছে? ভাইয়ার মুখ থেকে এমন সব কথা শুনে চুপ থাকতে পারে নি শিশির। ও এবার চেঁচিয়ে উঠে- ” ভাইয়া! কি বলছিস এসব? দু’বছর ধরে ভাবি তোর কাছে নেই? তাহলে ভাবি কোথায় আছে?
শান্ত গলায় শুভ্রর জবাব, বাবা মায়ের কাছে রেখে আসছি। খুব সম্ভবত ও বাবা মায়ের সাথেই আছে দু’বছর ধরে।

শিশির এবার আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠে।
” What? তুই কি ভাবিকে কবরে ওনার বাবা মায়ের সাথে শুইয়ে দিইয়ে আসছিস?”

শুভ্র:- মানে????

চলবে………..

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ০৫

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। শুভ্র আর বাসায় ফিরছে না। টেনশনে অস্থির লাবণ্য ফোন হাতে নাম্বার তুলেও কল দেওয়ার সাহস পায়নি। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। শুভ্রর তখনো ফেরার নাম নেই। অস্থির লাবণ্য বারান্দা থেকে রুম, রুম থেকে গেইটের সামনে, গেইটের সামনে থেকে বারান্দায় এভাবেই ঘুরঘুর করছে আর অধির আগ্রহে রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে। কিন্তু শুভ্রর ফেরার কোনো নাম নেই। নিরুপায় লাবণ্য সাহস করে এবার শুভ্রর নাম্বারে কল দিয়েই ফেলল। এদিকে বারবার কল দেওয়ার পরও শুভ্র কল রিসিভ করছে না। টেনশনে উদ্ভিগ্ন লাবণ্য একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। একটা সময় ওপাশ থেকে সুরেলা কন্ঠে ভেসে উঠে, “আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, একটু পর আবার চেষ্টা করুন।” ফোন বন্ধ থাকা সত্ত্বেও লাবণ্য একের পর এক কল দিয়েই যাচ্ছে। বার বার ওপাশ থেকে একই কন্ঠ ভেসে আসছে। বাধ্য হয়ে লাবণ্য হসপিটালে কল দেয়। জানা যায়, শুভ্র সারাদিনে একবারও হসপিটালে যায় নি। হসপিটালে যায়নি, এদিকে ফোনও বন্ধ। শুভ্রর কিছু হয়নি তো? অজানা আশঙ্কায় লাবণ্যর ভিতরটা শিউরে উঠে। নিরুপায় লাবণ্য শুভ্রর খুঁজে বের হয়ে পরে বাসা থেকে। বাসার সামনের টঙ দোকান, চেনা জানা অলিগলি, ক্যাফে, রেস্তোরা কোথাও, কোথাও বাদ পরেনি খুঁজতে। কিন্তু শুভ্রর সন্ধান আর মিলাতে পারেনি লাবণ্য। রাত্রি তখন দশটা। সারাদিনের অভুক্ত লাবণ্য অসুস্থ্য শরীরে যখন হেলেদুলে রাস্তা হাঁটছিল তখন পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষরূপী জানোয়ারগুলো ওর দিকে বিভিন্ন বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছিল। কাকতালীয় ভাবে সে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল লাবণ্যর কলেজ ফ্রেন্ড সুমন। ছেলেদের বাজে মন্তব্যের প্রতিবাদ করতে এসে বুঝতে পারে এ আর কেউ নয় তারই প্রাণের বান্ধবী লাবণ্য ছাড়া। সুমন দৌঁড়ে যায় লাবণ্যর কাছে। জিজ্ঞেস করে, কিরে কি অবস্থা দোস্ত? এত রাত্রে তুই এখানে যে? লাবণ্য কথা ঘুরিয়ে জবাব দেয়, রাতের শহর দেখতে এসেছিলাম। তুই? তুই এখানে কি করছিস? স্মিতহাস্যে সুমনের জবাব, বান্ধবীদের সাথে রাত্রিবেলা শপিং করার শখ জাগছে। একটা বউ বলে কথা। ফেলতে পারিনি আবদার। নিয়ে এলাম শপিংয়ে। মেয়েদের শপিং। বুঝতেই তো পারছিস সময়ের ব্যাপার… তাই বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসির রেখা টেনে লাবণ্যর জবাব, ওহ, আচ্ছা! বুঝতে পারছি। আজ তাহলে আমি আসিরে। অন্য আরেকদিন কথা হবে। ভালো থাকিস। লাবণ্য রাস্তা পার হচ্ছিল, পিছন থেকে লাবণ্যর হাত ধরে হ্যাচকা টানে সুমন লাবণ্যকে ওর কাছে নিয়ে যায়। লাবণ্য চোখ বড় বড় করে সুমনের দিকে তাকিয়ে আছে। সুমন গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে, আরেকটু হলে তো উপারে চলে যাইতি। চল, তোকে রাস্তা পাড় করিয়ে দিচ্ছি।

রাত্রি সাড়ে ১০টা।
শুভ্র বাসায় পায়চারি করছে আর বার বার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। অস্থির শুভ্র ফোন করে বন্ধু আতিক’কে। “আতিক! তোর ভাবি তো এখনো ফিরেনি। তুই কি বাসা থেকে বের হইবি একটু?” সিরিয়াস কন্ঠে আতিকের জবাব, আর দেখতে হবে না দোস্ত। যা দেখার দেখে নিয়েছি। শুভ্র! আজ সত্যি বুঝতে পারছি তুই আসলেই সত্যি কথা বলতি। আর আমি ব্যাটা ভাবছি তুই’ই ভুল। শুভ্র অস্থির ভঙ্গিতে প্রশ্ন করে আতিককে, কি? কি বলছিস তুই? কার কথা বলছিস? আতিক সাথে সাথে একটা এমএমএস পাঠায় শুভ্রর ফোনে। এমএমএসটা ওপেন করে শুভ্রর চোখ কপালে। একটা অচেনা ছেলের সাথে ওর বউ হাত ধরাধরি অবস্থায় হাঁটতেছে। ভুলের পাহাড় ছোট্ট থেকে মুহূর্তেই বিকট আকার ধারণ করে। সত্যি’টা অনুধাবন না করেই লাবণ্যর প্রতি একরাশ ঘৃণা পুষে ফেলে শুভ্র। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে শুভ্র যখন সোফায় বসেছিল তখন ভীরু পায়ে রুমে লাবণ্যর আগমন। শুভ্রকে বাসায় দেখে লাবণ্যর মুখে হাসি ফুটে উঠে। শুকনো হাসি মুখে এনে বলে, “এসেছেন?”
সোফায় হেলান দেওয়া থেকে সোজা হয়ে বসে শুভ্র। তারপর লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলে, ” আমি না এলেই তো হ্যাপি থাকতি, তাই না?” অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে লাবণ্য, এসব কি বলছেন আপনি? সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় শুভ্র। চটজলদি লাবণ্যর চুলের গোছা ধরে ফেলে। মুঠোভর্তি চুলের গোছা ধরে বলে উঠে শুভ্র, ” বুঝতে পারছিস না? সত্যি কি তুই বুঝতে পারছিস না?” আচমকা শুভ্রর এধরনের আচরণে অবাক লাবণ্য বলে উঠে, ” আমি কি কোনো অন্যায় করেছি শুভ্র?” চুলের মুঠি আরো শক্ত করে ধরে শুভ্র। তারপর লাবণ্যর চোখে চোখ রেখে বলে, খবরদার! তোর ঐ পাপ মুখে আর কখনো আমার নাম নিবি না। লাবণ্য অবাক বিস্ময়ে আবারো প্রশ্ন করে, ” আমার অন্যায়টা কি সেটাতো বলুন আপনি!” রাগে আগুন শুভ্র লাবণ্যর চোখের সামনে আতিকের দেওয়া সেই এমএমএসটা মেলে ধরল। একপলক তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসির রেখা টেনে বলে উঠে লাবণ্য, এটা? উচ্চস্বরে শুভ্রর জবাব, অবাক হয়েছিস যে কিভাবে এটা আমি পেলাম? আরে সত্য কখনো চাপা থাকে না, সত্যকে হাজার চেষ্টা করেও ঢেকে রাখা যায় না। তুই ধরা পড়ে গেছিস। সময় হয়ে গেছে তোর মুখ ও মুখোশ উন্মোচনের।
দেখুন আপনি আমায় ভুল বুঝছেন। এই ছেলে আমার…..(…..)….???
চুপ, একদম চুপ! কোনো কথা বলবি না। অনেক সয়েছি, আর না……….

লাবণ্য সেদিন অনেক চেষ্টা করছে সত্যিটা বলার, কিন্তু শুভ্র তা শুনতে নারাজ। অসহায় লাবণ্য সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করে শেষরাত্রে যখন ঘুমানোর জন্য চোখ বুজল তখন হ্যাচকা টানে শুভ্র ওকে বিছানা থেকে তুলে বসায়। অনেক ঘুমিয়েছিস, আর না! এবার চল আমার সাথে। শুভ্র লাবণ্যকে একরকম টানতে টানতে গেইটের সামনে ওর গাড়ির কাছে দাঁড় করায়। প্রশ্ন করে লাবণ্য, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? রাগে আগুন শুভ্রর জবাব, তোর বাপ-মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি। আজ থেকে ওদের কাছে থাকবি। কিন্তু আমার বাবা- মা তো…….. (…..)….??? কোনো কিন্তু নেই। তুই ওদের কাছে থাকবি, এটাই ফাইনাল। লাবণ্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ওর গ্রামের বাড়ির রাস্তায় চলে আসে। আসবার কালে অসহায় লাবণ্য জল ছলছল চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়েছিল। পিছু ফিরে শুভ্র যখন তাকিয়ে ছিল তখনো অবধি লাবণ্যর বিশ্বাস ছিল শুভ্র মনে হয় মজা করছে। এখন দৌঁড়ে এসে আমার কাছে এসে বলবে স্যরি, আমি আসলে মজা করছি তোমার সাথে। নাহ! শুভ্র এসব কিছুই বলেনি। বলেছিল শুধু- মনে আছে তো আমি কি বলছি? কাঁদো কাঁদো গলায় লাবণ্যর জবাব, হুম! আজ থেকে আমি আমার বাবা মায়ের সাথে থাকব। জোর গলায় শুভ্রর জবাব,
Good…মনে থাকে যেন…..

দেখতে দেখতে শুভ্রর গাড়ি দুরে, বহুদুরে মিলিয়ে যায়। ক্লান্ত লাবণ্য একটু একটু ওর বাবা মায়ের কবরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে……..

চলবে………………

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ০৪

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

৩দিন পর_
যেহেতু লাবণ্য এখন কিছুটা সুস্থ্য তাই লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি বাসায় ফেরার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। ওরা বাসায় চলে যাবেন তবে লাবণ্যকে একা রেখে নন। যদিও শুভ্র বাসায় আসে তবুও ওরা কেন জানি ভরসা পাচ্ছে না। রেডি হওয়ার আগ মুহূর্ত লাবণ্যর শাশুড়ি আবারো লাবণ্যর কাছে যায়- কিরে? এখনো রেডি হসনি? তোকে না সেই কখন বললাম রেডি হতে? তাড়াতাড়ি রেডি হো! আমি শাড়িটা চেঞ্জ করে আসি। এসে যাতে দেখি তুই রেডি। লাবণ্যর শাশুড়ি রেডি হয়ে এসে দেখে লাবণ্য তখনো চুপটি করে বারান্দার গ্রিল ধরে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে। দেখো তো মেয়ের কান্ড! এখনো দাঁড়িয়ে আছে। আয়, তোকে আমি নিজেই রেডি করিয়ে করিয়ে দিচ্ছি। লাবণ্যর হাত ধরে টানতে টানতে ওর শাশুড়ি যখন ওকে বেডরুমে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন লাবণ্য বলে উঠে, “আমি যাব না মা….”
লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যর হাতটা ছেড়ে দেয়। লাবণ্যর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে, যাবি না মানে? লাবণ্য মাথা নিচু করে বলে,
” আমি আমার সংসার ছেড়ে কোথাও যাব না মা।” কিন্তু লাবণ্য ও তো তোকে…(….)….???
পুরো কথা বলতে পারে নি রোকসানা বেগম, তার আগেই লাবণ্য ওনার মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নেয়। লাবণ্য অকপটে বলে উঠে, দিক কষ্ট। তুমি দেখো মা, কষ্ট দিতে দিতে ও যেদিন ক্লান্ত হয়ে যাবে, সেদিন ও আমার কাছে ফিরে আসবে। ওর সব ভুলের পরিসমাপ্তি সেদিন ঘটবে। সেদিন ও আমায় ঠিক বুঝবে! আমি না হয় একটু কষ্ট করে সেদিনটির অপেক্ষায় থাকব।
লাবণ্যর মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, তোর যা ভালো মনে হয়। তবে হ্যাঁ, জীবনের সাথে লড়াই করতে করতে কখনো যদি ক্লান্ত হয়ে পরিস, তাহলে চলে আসিস! চলে আসিস এই মায়ের কাছে। পৃথিবীর আর কোথাও তোর জায়গা না হলেও এই মায়ের আঁচলের ছায়াতলে ঠিক তোর জায়গা হবে। ভালো থাকিস। আমরা আসি।

লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি চলে যায়। যাওয়ার আগে লাবণ্য ওর শ্বশুর শাশুড়ির পা ছুঁয়ে সালাম করে। লাবণ্যর শ্বশুর লাবণ্যর মাথায় হাত রেখে বলে, দোয়া করি! জয়ী বেশে ফিরে আসুক আমার মা’টা….
লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি চলে যায়। সেদিন লাবণ্যর সাথে ওর বাবা মায়ের কথোপকথনের সবটা আড়াল থেকে শুনে নেয় শুভ্র। সব শুনে একটা বিকট হাসি দেয় শুভ্র। জয়ের মুকুট তোর জন্য নয়রে মেয়ে। এ খেলায় তোর পরাজয়। তুই হেরে যাবি এ খেলায়। শোচনীয়ভাবে তোর পরাজয় ঘটবে। এমন পরাজয় যে লজ্জায় মুখ লুকানোর স্থান পাবি না। আমি তোর মুখ ও মুখোশ তুলে ধরব সবার সামনে। সেদিন কোথাও মুখ লুকানোর স্থান পাবি না তুই। কোথাও না।

সেদিন শুভ্রর মন খারাপ ছিল। কেন জানি ভালো লাগছিল না কিছুই।
তাই হসপিটালে যায়নি। শুভ্র ওর রুমে শুয়ে আছে চুপটি করে। অজানা কারনে ওর মনটা খারাপ ছিল। বেডে শুয়ে গভীরভাবে শুভ্র যখন ওর মন খারাপের রহস্য বের করতে ব্যস্ত তখন লাবণ্য চুপটি করে এসে শুভ্রর পাশে বসে। কপালের উপর হাত দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন শুভ্রর চোখ মুখ দেখে লাবণ্য বুঝতে পারে শুভ্রর মনটা বোধ হয় খুব খারাপ। লাবণ্যর মনে পড়ে যায় শুভ্রর বলা সেই কথাগুলো, লাবণ্য জানো? আমার যখন মন খারাপের সময় তুমি যখন আমার মাথায় হাত রাখ, তখন আমার সব চিন্তা দুর হয়ে যায়। বছর পাঁচেক আগের কথা লাবণ্যর আজ হঠাৎ মনে পড়ে গেল। আর তাই কোনো সংকোচ না করে লাবণ্য শুভ্রর মাথায় হাত রাখে। আস্তে আস্তে ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকে। কিছুক্ষণের জন্য শুভ্র ওর মনের সব যন্ত্রণা ভুলে গিয়েছিল। পরক্ষণে যখন মনে হলো এ তো তারই ছোঁয়া, যাকে আমি মনে প্রাণে ঘৃণা করি। এ তো সেই ছলনাময়ীর ছোঁয়া, যে ছলনাময়ী একদিন অন্য একটা ছেলের জন্য আমায় ভুলে গিয়েছিল। শুভ্র লাফিয়ে উঠে বিছানা থেকে। অগ্নিচোখে লাবণ্যর দিকে তাকাই। লাবণ্য রীতিমত কাঁপছিল শুভ্রর ঐরকম লাল আগুনের মত চোখ দেখে। আচমকা লাবণ্যর কিছু বুঝে উঠার আগেই শুভ্র লাবণ্যর হাতটা ধরে ফেলে। লাবণ্য স্থির দৃষ্টিতে শুভ্রর মুঠোর দিকে তাকিয়ে আছে। কেননা, বিয়ের পর এই প্রথম শুভ্র লাবণ্যর হাত স্পর্শ করল।

” সমস্যা কি তোমার? এভাবে কেন আমার পিছু লেগে আছ? কেন আমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছ না? কেন একমুহূর্তও তোমার জন্য আমি শান্তিতে থাকতে থাকতে পাচ্ছি না? কেন? কেন? কেন?”

একনিশ্বাসে করা একরাশ প্রশ্ন শুভ্রর। ভীরু কন্ঠে লাবণ্যর জবাব, আপনি খুব চিন্তিত ছিলেন মনে হয়। তাই আপনার…(….)…????
পুরো কথা বলার আগেই শুভ্র চেঁচিয়ে বলে উঠে, আমি তোমাকে ঘৃণা করি লাবণ্য, ঘৃণা করি। সেখানে তুমি ভাবলে কিভাবে তোমার ছোঁয়াতে আমি শান্তি খুঁজে পাবো?
লাবণ্য শুভ্রর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল, আমি জানি এসব আপনার অভিমান থেকে বলছেন। আপনি কখনো আমাকে ঘৃণা করতে পারেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আসল সত্যিটা শুনলে আপনার সব ভুল ভেঙ্গে যাবে। আমি আপনাকে আজ সব বলব। আপনি আমায় একটু সহ্য করেন। ধৈর্য্য নিয়ে আমার কথাগুলো শুনেন….

শুভ্র একলাফে খাট থেকে উঠে পরে। তারপর শার্ট গায়ে দিয়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। লাবণ্য শুভ্রর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। শুভ্র রাগী গলায় বলে, আমার ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে দিও না লাবণ্য। তাতে কিন্তু তোমার’ই খারাপ হবে। আমি একটু শান্তিতে থাকতে চাই। আর তার জন্য আমি একটু একা থাকতে চাচ্ছি। দয়া করে আমায় একটু শান্তিতে থাকতে দাও।
লাবণ্য শুভ্রর পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। শুভ্র বাসা থেকে বের হয়ে যায়। বেলকুনিতে দাঁড়িয়ে অশ্রুভেঁজা দৃষ্টিতে লাবণ্য শুভ্রর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

চলবে…..

ভুল ও ভালোবাসা পর্ব- ০৩

0

ভুল ও ভালোবাসা
পর্ব- ০৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মা, আমার জরুরী কাজ আছে। তাই আমায় হসপিটালে যেতে হচ্ছে। দয়া করে আমায় পিছু ডেকো না।
পিছু ডাকবে না মানে? বউটা অসুস্থ্য। আর ওকে ফেলে তুই হসপিটালে চলে যাচ্ছিস? তুই কিরে? তোর ভিতর কি মায়া দয়া বলতে কিচ্ছু নেই? একটুও মানবতা নেই?
” বাবা, শুনো! আমাকে তোমরা মানবতা শিখাতে এসো না। কারন, মানবতা শেখার আমার কোনো প্রয়োজন নেই। তোমাদের আদরের বউ মা অসুস্থ্য। সমস্যা কি? তোমরা তো আছ মানবতাবোধ সম্পূর্ণ ব্যক্তি। তো আর দেরী কেন? এখনি লেগে পরো কাজে। আমার এত মানবতা দেখানোর টাইম নাই। আমি গেলাম।”
বাবার কথার মুখে মুখে জবাব দিয়ে চলে যায় শুভ্র। জনাব শফিকুল ইসলাম মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পরেন। রোকসানা বেগমও রীতিমত অবাক ছেলের এমন আচরণে। জনাব শফিকুল ইসলাম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেতেছে, আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম রোকসানা। আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম। একটা সময় যেই ছেলেকে নিয়ে গর্ববোধ করতাম, আজ সেই ছেলে আমায় ব্যর্থ করে দিয়েছে। আমি একজন ব্যর্থ বাবা হয়ে গেলাম। আমি পারলাম না আমার ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে। আমার সারাজীবনের পরিশ্রম আজ ব্যর্থ হয়ে গেল। হু, হু করে কেঁদে উঠল শুভ্রর বাবা। এই মুহূর্তে কিছু সান্ত্বনার বানী বলা দরকার বুঝতে পারছিল শুভ্রর মা। কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছিল না ওনার। অনেক চেষ্টা করে রোকসানা বেগম কাঁপা গলায় শুধু এটুকু বলল, শান্ত হও!
সেদিন রাত্রে বাসায় ফিরে কারো সাথে কথা বলেনি শুভ্র। লাবণ্যের সাথে কথা নাইবা বলল, নিজের বাবা মায়ের সাথে তো কথা বলতে পারত। কিন্তু তাও বলেনি। একটা বারের জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন বোধ করেনি, খেয়েছ তোমরা? যেহেতু সেদিন শুভ্রর বাবা মা এসেছিল তাই তাদেরকে লাবণ্যর ঘরটা ছেড়ে দিতে দিয়ে শুভ্রর রুমে থাকতে হলো। লাবণ্য রুমে প্রবেশ করা মাত্রই খাট থেকে একটা বালিক নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেয় শুভ্র। লাবণ্য বুঝতে পারে ওর জায়গা খাটে নয়, ফ্লোরে। সে শুয়ে পরে ফ্লোরে। একে তো অসুস্থ্য শরীর, তারউপর ঠান্ডা ফ্লোর। রাত্রে আবারো হাড় কাঁপিয়ে জ্বর আসে লাবণ্যর। উপয়ান্তর না পেয়ে বালিশ নিয়ে উপরে উঠে সে। শুভ্রর পিছনে বালিশ পেতে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পরে লাবণ্য। ঘুমিয়ে পরে সে। জ্বরের ঘোরে কাঁপতে কাঁপতে কখন যে শুভ্রর চাদরের নিচে চলে যায় কিছুই টের পায় না লাবণ্য। খেয়াল হয় যখন হ্যাঁচকা টানে কেউ একজন ওকে খাট থেকে ফেলে দেয়। শুভ্রর রক্তবর্ণ চোখ দেখে ভড়কে যায় লাবণ্য। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, “আসলে খুব শীত…(…)….???
পুরো কথা বলতে পারে নি লাবণ্য। তার আগেই শুভ্র হনহনিয়ে রুম থেকে বের হয়ে ছাদে চলে যায়। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের কোণে জড়ো হওয়া জলটুকু মুছে নেয় লাবণ্য।

সকালে হসপিটালে যাবার প্রাক্কালে শুভ্রর পথ আগলে দাঁড়ায় ওর মা। রাত্রের পুরো ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ওনি। দরজার আড়াল থেকে সব, সবটা শুনেছেন ওনি। আজ তাই কিছু প্রশ্ন নিয়ে ছেলের সম্মুখীন হলেন। আজ ওনি ওনার সব প্রশ্নের উত্তর শুনে তবেই একটা সিদ্ধান্তে আসতে চান। প্রশ্ন করেন ছেলেকে, লাবণ্যর প্রতি তোর কেন এত বিতৃষ্ণা? কেন এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস অসহায় মেয়েটাকে? মায়ের প্রশ্নের জবাবে চিৎকার করল বলে উঠে শুভ্র, আমার ওকে ভালো লাগে না কথাটা শুনা সত্ত্বেও কেন আমায় জোর করে বিয়ে করালে? কেন? কেন? দুনিয়াতে কি এই মেয়ে ছাড়া আর কোনো মেয়ে তোমাদের চোখে পরেনি? এই মেয়ের মধ্যে কি পেয়েছ তোমরা? এই মেয়ে কি জাদু করেছে তোমাদের যে এই মেয়ের জন্য তোমরা আমায় ব্ল্যাকমেইল করেছ???

রোকসানা বেগম ছেলের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালেন,কি বললি ব্ল্যাকমেইল করেছি আমরা তোকে?
শুভ্র উঁচু গলায় জবাব দেয়, তা নয়তো কি? বাবার ইচ্ছে এই মেয়েকে পুত্রবধূ করার। এখন ওকে বিয়ে না করলে বাবা মনে কষ্ট পাবে। স্ট্রোক করবে…..
উত্তেজিত হয়ে শুভ্রর মা বলেন, চুপ কর শুভ্র। শুভ্র ব্যঙ্গাত্বক স্বরে বলে, এই মেয়ের সম্পর্কে আমারও কোনো কথা বলতে ভালো লাগে না মা। তুমি প্রশ্ন করছ তাই জিজ্ঞেস করলাম, কি জাদু করেছ ও তোমাদের?
শুভ্রর মা শান্ত গলায় বলেন, শুভ্র! এই মেয়ে আমাদের কোনো জাদু করেনি। ওর মা আমার বান্ধবী। আমার খুব ভালো একটা বান্ধবী ছিল লুবনা মানে লাবণ্যর মা। কয়েকবছর আগে লাবণ্যর বাবা, মা, ভাই একটা…..(…..)…..???
Enough! অনেক হয়েছে মা। এবার বন্ধ করো তোমার সিনেমাটিক ডায়লগ। আমার সময় বয়ে যাচ্ছে। আমি গেলাম। আল্লাহ হাফেজ। শুভ্র ওর মায়ের পুরো কথা না শুনে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

পর্দার আড়াল থেকে মা ছেলের কথোপকথনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুনে নিয়েছে একজন।

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ০২

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ০২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

একে তো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে, তারউপর সারাদিনের অভুক্ত। শরীরটা একদম নেতিয়ে পরছিল। কোনো রকমে খাবারগুলো ফ্রিজে তুলে রেখে শুয়ে পরে লাবণ্য। অন্যদিন বিছানায় গা এলিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে ঘুম চলে আসলেও আজ কেন জানি হাজার চেষ্টার পরেও ঘুম চোখে আসছে না। লাবণ্য পারছে না ঘুমোতে। সারারাত বিছানায় এপাশ ওপাশ করল লাবণ্য। মাঝরাত্রে হাড়কাঁপিয়ে জ্বর আসে ওর। ছটফট লাবণ্য বিছানা থেকে উঠে শুভ্রর রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। নক করে শুভ্রর রুমের দরজায়। একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঘুম চোখে দরজা খুলে শুভ্র। দরজা খুলে লাবণ্যকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মেজাজ চরমে উঠে যায় ওর। ভ্রু বাকিয়ে রাগী স্বরে বলে উঠে সে, ” রাত বিরাতে কি শুরু করছ এসব? আমায় কি শান্তিতে একটু ঘুমুতেও দিবে না?”
কাঁপা গলায় লাবণ্যর জবাব, ” সকাল থেকে আমার খুব জ্বর, ঔষধও আনতে পারিনি। আপনার কাছে কি জ্বরের ট্যাবলেট হবে?”
গলার আওয়াজ কিছুটা নিচু হয় কথাটা শুনে কিন্তু রাগটা কমেনি। রাগান্বিত স্বরে শুভ্রর পাল্টা জবাব, ” তো আমি কি ঔষধের ফার্মেসী খুলে বসেছি যে আমার কাছে ঔষধের জন্য এসেছ?!!! যত্তসব”
না, মানে আপনার কাছে ঔষধ থাকে তো তাই…..(……)…..????
পুরো কথা বলতে পারেনি লাবণ্য। তার আগেই মুখের উপর দরজাটা লাগিয়ে দেয় শুভ্র। জ্বরে কাতর লাবণ্য অশ্রুভেঁজা চোখে ফিরে যায় রুমে। পরনের ওড়নার একপাশ পানিতে ভিঁজিয়ে নিজে নিজেই কপালে দিয়ে রাখে একটু ভালো লাগার আশায়। অসুস্থ্য শরীরেরও নামাজটা মিস করেনি। কাঁপা কাঁপা শরীরে উঠে দাঁড়ায় লাবণ্য। শুভ্রর রুমের সামনে গিয়ে কড়া নাড়ে। শুভ্রকে নামাজের জন্য জাগিয়ে দিয়ে নিজেও নামাজটা আদায় করে নেয়। অন্যান্য দিনের মতো কুরআন তেলওয়াতটা আর করা হয়ে উঠেনি। একে তো জ্বর, তারউপর শরীরটা একদম নেতিয়ে পরেছিল। নামাজের বিছানায়’ই শুয়ে পরে লাবণ্য। এদিকে নামাজ পড়ে একটু শুয়েছিল শুভ্র। অন্যান্য দিনের মত সেদিন আর লাবণ্য ডাকতে পারেনি শুভ্রকে। যার কারনে শুভ্রর ঘুমটাও ভাঙেনি। যখন ঘুম ভাঙে তখন সকাল সাড়ে ১০টা। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে হুড়মুড়িয়ে বাসা থেকল বের হয় শুভ্র। একবারও জানার প্রয়োজন মনে করল না, পাশের রুমে এত বেলা অবধি কি করছে মেয়েটা? কেন জাগিয়ে দেয়নি ওকে?

অসুস্থ্য লাবণ্য ছটফট যন্ত্রণায় সারাটা দিন বিছানায় ছটফট করেছে আর আল্লাহ, আল্লাহ করেছে। আল্লাহর অশেষ রহমত ছিল লাবণ্যর উপর। সেদিন সন্ধ্যায় কাকতালীয় ভাবে বাসায় আগমন ঘটে শুভ্রর বাবা-মায়ের। সন্ধ্যা হয়ে গেছে, অথচ বাসায় কোনো আলো নেই, নেই কোনো সাড়া শব্দ। তবে কি বাড়িতে কেউ নেই নাকি? শুভ্রর বাবার প্রশ্নের জবাবে ওর মা বলে উঠে, তা কি করে হয়? বাসার মেইন দরজায় যে খুলা। চলো তো একটু ভিতরে গিয়ে দেখি! দরজা ঠেলে লাবণ্য, লাবণ্য করতে করতে শুভ্রর রুমে প্রবেশ করে ওর বাবা- মা। পুরো রুম জুড়ে ময়লা আর বিছানাটাও কেমন অগোছালো। লাবণ্য কি আজকে ঘরদোয়ার পরিষ্কার করো নি? বলতে বলতে পাশের রুমে প্রবেশ করে শুভ্রর মা। রুমে প্রবেশ করতেই শুভ্রর মায়ের একটা চিৎকার ভেসে উঠে। চিৎকার শুনে শুভ্রর বাবার ছুটে যান। স্ত্রীর মতো তিনিও আঁতকে উঠে একমাত্র আদরের বউমাকে বিছানায় নিথর হয়ে পরে থাকতে দেখে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই লাবণ্যর পাশে বসে লাবণ্যকে ডাকতেছে আর বলতেছে-
” মা! কি হয়ছে তোমার? মা চোখ খুলো। মা, ও মা? কি হয়ছে তোমার? জ্বরে যে গাঁ পুড়ে যায় শুভ্রর বাপ! এখন কি করব?”
লাবণ্য একটু একটু করে চোখ মেলে তাকায়। শ্বশুর শাশুড়ি দু’জনের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ছেড়ে দেয়। শুভ্রর বাবা মা লাবণ্যকে বিছানায় উঠিয়ে শুইয়ে দেই। লাবণ্য আলতো করে ওর শ্বাশুড়ির হাতটা চেঁপে ধরে আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে, ” আমায় কিছু খেতে দাও। খুব ক্ষিদে পেয়েছে মা”…..
বহু চেষ্টা করে লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি বুঝতে পারল লাবণ্য খেতে চাচ্ছে। বাসা থেকে রান্না করে আনা খাবারগুলোই মুখে তুলে খাইয়ে দেয় লাবণ্যকে। তারপর সাথে থাকা জ্বরের ট্যাবলেট থেকে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়। খাওয়া-দাওয়া শেষে লাবণ্য নিথর হয়ে শুয়ে থাকে বিছানায়। ওর শ্বশুর ছুটে যায় হসপিটালে। কান ধরে টেনে আনে ছেলেকে।
বাসায় আসার পর শুভ্রর কি মেজাজ!
বাবা! আজকে রোগীর অনেক ভীড়। আমায় হসপিটালে যেতে হবে। দয়া করে আমায় যেতে দাও।

” হসপিটালে আজ আর যেতে হবে না। তোর আসল রোগী বিছানায় শুয়ে আছে, ওর কাছে যা। ওর চিকিৎসা কর।”
পিছন থেকে কথাটা বলে উঠে শুভ্রর মা।

মায়ের কথা শুনে থমকে দাঁড়ায় শুভ্র;

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ০১

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ০১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

অসহ্য! তোমাকে আর কতবার বলব? এভাবে আমার অনুমতি ছাড়া হুটহাট আমার রুমে প্রবেশ করবে না। আমার ভালো লাগে না। সহ্য করতে পারি না তোমাকে। তোমার কাজকে। তবুও কেন এমন কর? কেন শান্তিতে থাকতে দিচ্ছ না আমাকে? একরাশ বিরক্তির স্বরে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলে শুভ্র। লাবণ্য কোনো কথা না বাড়িয়ে নিশ্চুপ হয়ে শুভ্রর রুম ত্যাগ করে।
শুভ্র এবং লাবণ্য স্বামী স্ত্রী। ১বছর হলো ওদের বিয়ে হয়েছে। অথচ তাদের মধ্যে স্বামী স্ত্রীর যে সম্পর্ক সেটা এখনো গড়ে উঠেনি। আর উঠবেই বা কি করে? শুভ্র যে লাবণ্যকে মনে প্রাণে ঘৃণা করে। বিয়েটা অবশ্য করেছে কিন্তু সেটা নিজ ইচ্ছের বিরুদ্ধে, বাবা-মার ইচ্ছের প্রাধান্য দিতে। কিন্তু মন থেকে শুভ্র লাবণ্যকে মেনে নিতে পারে নি। লাবণ্য এবং শুভ্রর বৈবাহিক জীবন ১বছরের হলেও ওদের পরিচয়টা হয় তারও অধিক সময় আগে। আজ থেকে ৫বছর আগে ওয়ার্ডে রোগী দেখতে গিয়ে লাবণ্যর সাথে দেখা হয় শুভ্রর। শুভ্র ছিল মেডিকেলের স্টুডেন্ট আর লাবণ্য ছিল এইচএসসি পরীক্ষার্থী। ওয়ার্ডে সেদিন লাবণ্যও উপস্থিত ছিল ওর অসুস্থ্য মাকে নিয়ে। লাবণ্য এবং শুভ্রর পরিচয়টা সেদিন’ই হয়। প্রথমেই পরিচয়, তারপর ঘনিষ্ঠতা।
ঘনিষ্ঠতা থেকে সেটা আন্তরিকতায় রূপ নেয় ১বছরের ব্যবধানে। ভালোবেসে ফেলে একে অপরকে। অসহায় লাবণ্যের মুখে হাসি ফুটে উঠে শুভ্রর মত ছেলের ভালোবাসা পেয়ে। লাবণ্য এখন আর মন খারাপ করে থাকে না। শুভ্রর আদর-যত্ন-শাসন-ভালোবাসায় লাবণ্যর জীবন যেন কানায় কানায় পূর্ণ। লাবণ্যকে দেখে মনে হতো, ওর মত সুখী এখন পৃথিবীতে কেউ নেই। কিন্তু সেই সুখ লাবণ্যর কপালে বেশীদিন সইনি। রিলেশনের দু’বছরের মাথায় লাবণ্যর মা, বাবা ও একমাত্র ছোট্ট ভাইটি রোড এক্সিডেন্টে পরপারে পাড়ি জমায়। চোখের সামনে পরিবারের এতগুলো প্রিয়জনের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি সে। ব্যাপারটা লাবণ্যর ব্রেনে আঘাত করে। লাবণ্য মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যায়। সামনে থাকা জিনিসপত্র একে একে ভাঙ্গতে থাকে। সামনে যাই পেত, লাবণ্য সেটাই ভাঙ্গত। কাঁচের প্লেট, গ্লাস, ফুলের টব সব, সব ভাঙতে থাকে লাবণ্য। চোখের সামনে পরিবারের সবার মৃত্যু তে লাবণ্য যে উন্মাদ হয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারে বাড়ির মালিক ও আশেপাশের ভাড়াটিয়ারা। তারা লাবণ্যকে শিকল দিয়ে বেঁধে লাবণ্যর গ্রামে খবর দেয়। খবর শুনে ছুটে আসে লাবণ্যর মায়ের বান্ধবী এবং ওনার হাজবেন্ড।
ওনারা ওনাদের হেফাজতে রাখার জন্য লাবণ্যকে নিয়ে যায়। ভর্তি করে মানসিক হসপিটালে। ১বছর চিকিৎসাধীন থাকার পর কোনো উন্নতি হয়নি লাবণ্যর। এটা দেখে ওরা লাবণ্যকে বিদেশে নিয়ে যায়। সেখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে ২বছর পর দেশে ফিরেন ওনারা। লাবণ্য তখনো পুরোপুরিভাবে সুস্থ হয়নি। সেদিন লাবণ্যকে নিয়ে ওর কাজিন হসপিটাল থেকে ফিরছিল। লাবণ্যর গায়ে প্রচন্ড জ্বর থাকার কারনে হাঁটতে পারছিল না। ওর কাজিন তাই ওকে পিছন থেকে ধরে বাসার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। দূর থেকে লাবণ্যকে দেখে শুভ্র। থমকে যায় ওর গতিপথ। হঠাৎ করে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া, আজ একটা অচেনা ছেলের সঙ্গে জড়াজড়ি অবস্থায় হেঁটে যাওয়া দেখে শুভ্রর মধ্যে বিরূপ ধারণার জন্ম নেয়। মনে মনে বলে উঠে, ওহ! তাহলে নতুন নাগর পেয়ে আমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল? আর আমি গাঁধা কত বাজে দুশ্চিন্তা’ই না করছি!
একরাশ ঘৃণা বুকে, মনের মধ্যে একটা বৃহৎ ভুল ধারনা পুষে সে স্থান ত্যাগ করে শুভ্র।
সুপ্রিয় পাঠক/পাঠিকবৃন্দ চলুন তাহলে শুনে আসি কিভাবে সেই বিশাল ভুলের পরিসমাপ্তি এবং ভালোবাসার শুভ সূচনা হয়।

রাত্রে লাবণ্য চা হাতে শুভ্রর রুমে প্রবেশ করে। শুভ্র তখন সবেমাত্র চেম্বার থেকে ফিরছিল। লাবণ্যকে রুমে দেখা মাত্র’ই রাগ উঠে যায় শুভ্রর। কোনো কথা না বলে চুপচাপ লাবণ্য চা’য়ের কাঁপটা রেখে দাঁড়িয়ে ছিল, আচমকা শুভ্র চা’য়ের কাপটা হাত দিয়ে ঠেলে লাবণ্যর পায়ের নিচে ফেলে দেয়।
” তোমাকে বলছি না তুমি আমার সামনে আসবা না? আমি তোমার ছায়া পর্যন্ত সহ্য করতে পারি না। তারপরও কেন তুমি আমার সামনে আসো? কেন? কেন? কেন?”

শুভ্রর রাগী গলার কথা মোটেও ভয় পায়নি লাবণ্য। আর তাই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পায়ের নিচ থেকে ভাঙা কাপের টুকরোগুলো একজায়গায় জড়ো করে বাইরে চলে যায় সে। শুভ্রর রাগী গলার কথা, ধমক, চোখ রাঙ্গানো দেখেও একটুও ভয় পাই না লাবণ্য। সে এতে ভালোই এনজয় করে। কারণ, লাবণ্য জানে শুভ্র ওর সাথে এমন ব্যবহার কখনো মন থেকে করতে পারে না। ওর বিশ্বাস ওর শুভ্র ওর জন্য সব, সব করতে পারে। আর এটাও জানে, শুভ্র যেদিন জানতে পারবে আমি আসলে ইচ্ছে করে নয়, মানসিক ভাবে পাগল হয়ে ওর থেকে দুরে ছিলাম সেদিন সে আর আমায় ভুল বুঝে দুরে সরিয়ে দিতে পারবে না, ও ঠিক সেদিন আমায় কাছে টেনে নিবে। আমায় ভালোবাসবে। আমি না হয় সেদিনের জন্য’ই অপেক্ষায় থাকি।
প্রচন্ড জ্বর গায়ে, কাঁপা কাঁপা শরীরে বিছানা থেকে উঠে লাবণ্য। ওযু করে কাঁপা কাঁপা শরীরে রান্না করে সে। যদিও জানে এ রান্না শুভ্র খাবে না। তবুও রান্না করল। রান্না শেষে কাঁপা কাঁপা শরীরে শুভ্রকে ডাকে। তাড়াহুড়ো করে ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে চায় শুভ্র। পিছন থেকে ডাক দেয় লাবণ্য।
পিছু ফিরে তাকায় শুভ্র। ব্রেকফাস্ট রেডি, ব্রেকফাস্ট’টা করে যান প্লিজ।
ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে শুভ্রর জবাব, তোমাকে আর কতবার বলব? আমার জন্য রান্না করো না। আমি বাইরে থেকে খেয়ে নিব। লাবণ্য আর একটা কথাও বলেনি। চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। শুভ্র হনহনিয়ে বের হয়ে যায় রুম থেকে। রাত্রে চেম্বার থেকে বাসায় ফেরার সাথে সাথে প্রতিদিনের মত সেদিনও চা নিয়ে রুমে ঢুকে লাবণ্য। প্রতিদিনের মত সেদিনও শুভ্রর চোখে মুখে একরাশ বিরক্তির ছাপ ছিল। নিশ্চুপ লাবণ্য চা’য়ের কাঁপটা শুভ্রর সামনে রাখতে রাখতে বলে, ” টেবিলে খাবার দিচ্ছি, খেতে আসেন।”
মিনিট পাঁচেক পর চা’য়ের কাপ হাতে নিয়ে কিচেনে হাজির হয় শুভ্র। লাবণ্য তখন তরকারি গরম করছিল। লাবণ্য, তোমাকে আমি আগেও বলেছিলাম,এখনও বলছি। দয়া করে তুমি আমার জন্য এত ব্যস্ততা দেখিও না। আমি প্রতিদিন বাইরে থেকে খেয়ে আসি, খেয়ে আসব। আমার চা-টা দরকার পরলে আমি নিজেই করে খেতে পারব। দয়া করে, আমার কথাগুলো কানে ঢুকাও। এই কথাগুলো যাতে সেকেন্ড টাইম আর বলতে না হয়। কথাগুলো বলেই চা’য়ের কাঁপটা রেখে রুমে চলে যায় শুভ্র।
আর লাবণ্য?!!!
আঁচল দিয়ে চোখের কোণে জমে থাকা জলগুলো মুছে নেয়।

চলবে…..

স্বার্থ 

0
স্বার্থ
সে প্রায় বলতো – তুমি আমার অভ্যাস হয়ে গেছো জানো?
কথাটা বলে আমি কান্না থামাতে পারলাম না। একজন সাইক্রিয়াট্রিস্টেরর চেম্বারে বসেই কাঁদতে শুরু করলাম।
সাইক্রিয়াটিস্ট একজন ২৫-২৬ বছর বয়সী মেয়ে। আমার এভাবে হুট করে কেঁদে ফেলাতে সে বেশ অসস্তিতে পরে গেলো। আমি দ্রুত কান্না থামিয়ে বললাম
– ম্যাম, আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।
ম্যাম মুচকি হাসার চেষ্টা করে বললেন
– না না সমস্যা নেই। আপনি শুরু থেকে বললে আমার সুবিধা হতো।
– আপনার অনেক সময় নষ্ট করে ফেললাম।
– আপনি আমার কাছে সমস্যার সমাধানের জন্য এসেছেন। সময় যতই লাগুক লাগতে দিন। আপনি শুধু সম্পূর্ণ গল্পটা বলবেন। বুঝতেই পারছেন গল্পটা জানা খুব দরকার তাছাড়া আপনার কোনো হেল্প আমি করতে পারবোনা।
– আমার নাম অদ্রি।একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছি। ওর সাথে আমার প্রথম পরিচয় ফেসবুকে। আমার ফ্রেন্ডলিস্টে অনেক ছেলে আছে। তার মধ্যে কম বেশি সবার সাথে টুকটাক কথা হয়। তার সাথেও সেরকমই কথা হয় প্রথমে।যেহেতু আমি তাকে বাস্তব জীবনে চিনি না তাই কথা বলার কোনো আগ্রহ ছিলোনা।সে নিজেই ম্যাসেজ দিতো। আমার যেহেতু ওইসময় অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের এক্সাম চলে তাই পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম।
আমার এক্সাম কেমন হচ্ছে? এটা করছি নাকি? ওটা করছি নাকি? এরকম অনেক প্রশ্ন সে আমায় করতো। আমি প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতাম আর ভাবতাম এভাবে সবকিছু কেনো জানতে চায়?
আমাকে কখনোই কেউ এইভাবে বুঝতে চায়নি, জানতে চায়নি আমার ভেতরটায় কী চলে!
 সে আমার জমে থাকা কথা গুলো জানার জন্য মরিয়া হয়ে পড়তো।
একদিন জানতে পারলাম তার ১ মাস হলো ব্রেকাপ হয়েছে।
ম্যাম, আমি ভাবলাম – আমার তো সময় আছেই। ম্যাসেঞ্জারে তো পরেই থাকি। তাহলে তার সাথে একটু কথা বললে যদি তার খারাপ লাগাটা কমে তাহলে বলি না। এমন না যে আমার খুব ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।
একজন মানুষকে যদি আমি একটু সাহায্য করি তাতে আমার কিছুই যায় আসবেনা।
আমার ব্যক্তিগত জীবনে এতোটা কেয়ার কোনো ছেলের কাছ থেকে পাইনি।
আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারছিনা।
– সমস্যা নেই বলুন। আমার কোনো কিছু জানার প্রয়োজন হলে আপনাকে প্রশ্ন করবো।
– আমি আগ বাড়িয়ে ঘনিষ্টতা বাড়ায়নি।সেই আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। আমার ইচ্ছা ছিলোনা কিন্তু নাও বলতে পারছিলাম না। দেখা করার পর বুঝতে পারলাম সে ঠিক আমার সাথে কথা বলতে পারছেনা। আমি কথা বলেও যাচ্ছি কিন্তু তার মুখে হুম, হ্যাঁ ছাড়া কোনো শব্দ বের হচ্ছেনা। সেদিন বাসায় এসে অনেক ভাবলাম কিন্তু এর কারণ আমি খুজে পাচ্ছিলাম না।
আমি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম – আচ্ছা ম্যাসেঞ্জারে তো ম্যাসেজ একটার পর একটা দিতেই থাকিস, সামনাসামনি তো হুম হ্যাঁ ছাড়া কোনো শব্দই বের হলোনা।
ও বলল – আমি বাস্তবে কথা একটু কম বলি।
তারপর স্বাভাবিকভাবেই চলছিলো।
 একটা সময় আমি এতোটা আসক্ত হয়ে পড়লাম যে রাত জেগেও ম্যাসেঞ্জারে পড়ে থাকতাম।
সে প্রায়ই বলতো
– জানো অদ্রি, তুমি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছো। এতো সময় আমি প্রথম তোমার সাথে ব্যয় করেছি।তোমাকে আমার ভালোলাগা, খারাপ লাগা সব বলি। না বললে না শান্তি পাইনা।
কথাগুলো আমাকে ভাবাতে শুরু করলো। অবসর সময়ে এই কথাগুলোই আমার বারবার মনে পড়তো।
একদিন কথায় কথায় আমি বলে ফেললাম
– আমাদের মধ্যে কিন্তু অটল বিশ্বাস আছে। আর একে অপরের অভ্যাস আমরা। আমাদের মধ্যে এখন আর সেই ফ্রেন্ডশিপ টা নেই। এটা এখন অন্য কোনো সম্পর্কে পা বাড়িয়েছে।
সে বলল
– দেখো বিশ্বাস আছে কিন্তু তোমাকে আমি কখনো কল্পনায় আনতে পারিনা। অভ্যাস তুমি কিন্তু তোমাকে ফিল করতে পারিনা। এভাবে কোনো সম্পর্কে জড়ায় না। যদি ফিল না করতে পারি তাহলে সেটা কোনোভাবেই সম্পর্ক হয়না।
তার কথাগুলো বাস্তবতা ছিলো। আমি মেনে নিলাম। আর কোনো প্রকার যোগাযোগ না রাখার সিদ্ধান্ত নিলাম। সে তার জায়গায় ঠিক।
আমি চাচ্ছিলাম কিন্তু
আর কথা বলতে পারছিনা। মনে হচ্ছে গলার কাছে কিছু একটা আটকে গেছে।
ম্যাম বলল
– সে আপনাকে আসতে দেয়নি। তাইতো?
– হুম।
– ঠিক ফ্রেন্ডশিপের কতদিনের মাথায় এই ঘটনাটা ঘটেছে?
– ১ বছরের মাথায়।
– আপনার উচিৎ ছিলো তখনই ছেড়ে দেয়া। তারপর কী ঘটলো?
– আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে ফেসবুক থেকে দূরে থাকতাম। যাতে আমি দূরে সরে যেতে পারি কিন্তু তার সাথে আর একটু কথা বলার লোভ আমি ছাড়তে পারিনি। শুধু মনে হতো আর একটু কথাই তো। যতো বেশি কথা হবে তার আমার প্রতি তত বেশি মায়া বাড়বে। তখন হয়তোবা আমাকে ছাড়তে পারবেনা।ফেসবুক থেকে দূরে থাকলেও সে আমাকে ফোনে ম্যাসেজ বা কল দিতো। আমিও চাচ্ছিলাম না পুরোপুরি ভাবে তাকে ছাড়তে।
মাঝেমধ্যে আমার আবদার যখন খুব বেড়ে যেতো তখন সে আমাকে বলতো
– তুমি ভারচুয়াল জগতের ফ্রেন্ড। তোমার অস্তিত্ব ফেসবুকেই সীমাবদ্ধ। এটা মনে রাখবা।
আমি চুপচাপ শুনতাম।
তাকে প্রায়ই কথাগুলো আমি মনে করিয়ে দিতাম। প্রতি উত্তরে বলতো
– কোন সময় রেগে কী না কী বলেছি তাই ধরে বসে আছো। তোমাকে ছাড়া আমার সময় কাটেনা আর তুমি আছো এসব নিয়ে।
এভাবেই রাগ অভিমানে কাটছিলো। আমি ভাবতাম একদিন হয়তোবা আমার অস্তিত্ব স্বীকার করবে।
আজ থেকে প্রায় ছয় মাস আগে আমাকে হঠাৎ ফোন করে বলল একটু দেখা যাবে। খুব দরকার।
দেখা করতে গেলাম।
একটা ছোটো রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম।প্রায় ২ বছর পর দেখা। আমার ভেতরটা ওকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছিলো।
সেই প্রথমে কথা বলল
– জানো আমার না মায়া দয়া কম। তোমার মায়া দেখে অবাক হই।
– অবাক হওয়ার কিছুই নাই।
– তুমি খুব ইমোশনাল টাইপের মানুষ। তাই তোমার সাথে আমার দেখা করতে ভালো লাগেনা।আমার আবেগ বলতে কিছুই নাই। আছে টাইম সিকনেস ব্যাপারটা। কারো সাথে বেশি সময় কাটালে তার প্রতি ভালোলাগা জন্মায় কিন্তু ভালোলাগাটা কাটাতেও পারি। এই তিনবছরে যতটুকু বুঝলাম তোমাকে আমার এখনি ছেড়ে দেয়া উচিৎ। তা না হলে তুমি বিপদে পড়বে। তোমার প্রতি আমার কোনো ফিলিংস আসেনা। যা আছে তাও ভারচুয়াল। এতদিন যা যা বলেছি,করেছি সেটাকে ফ্রেন্ড হিসেবে মেনে নাও। এতেই ভালো হবে।
আমার বলা শেষ। তোমার কিছু বলার আছে?
– না।
– কফি খাও। তোমার তো পছন্দের।
– না। আমি এখন আসি।
ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললাম। আমার পক্ষে এর চেয়ে বেশি বলা হবেনা। আমার ফেসবুক আইডির ইমেইল আর পাসওয়ার্ড আপনাকে দিচ্ছি। একটু পরলেই বুঝতে পারবেন।
– আপনার সামনেই আপনার মোবাইলে পড়ি? আমাকে না দিলেও হবেন।
– আপনি আমাকে হেল্প করবেন তাই আপনাকে আমার বিশ্বাস করতে হবে।
– এখনো কি যোগাযোগ আছে?
– সে যোগাযোগ রাখবেনা বলেও আমাকে মোবাইলে ম্যাসেজ দেয়। আমি কখনো রিপ্লাই দেই কখনো দেইনা।
– হুম। আচ্ছা আপনি ইমেইল পাসওয়ার্ড দিয়ে যান। আর আগামীকাল সকালে আসুন। ১০ টায় আসলেই হবে।
বিছানার উপর পরে থাকা মোবাইলে এখন আর তার আসা ম্যাসেজের নোটিফিকেশন আসেনা। বিছানার পাশে ফ্লোরে বসে চাপাস্বরে কাঁদছি। খুব ইচ্ছে করে চিৎকার করে কাঁদতে। তাতে হয়তোবা কষ্টটা কম হতো। আমি চাইনি তার সাথে জড়াতে সেই বারবার আমাকে জড়িয়েছে। আমি চেয়েছি তাকে দূরে রাখতে সে দেয়নি। কিন্তু এখন সে ঠিকই দূরে সরে গেলো। ভাবলো না তার অভ্যাসের সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষটা কেমন আছে? এখন আর জিজ্ঞেস করতে আসেনা – সারাদিন কই ছিলে? খুব ব্যস্ত ছিলা?
সকাল ১০ টার একটু পরে চেম্বারে ঢুকলাম। আমাকে দেখে ম্যাম মুচকি হেসে বলল
– আপনার অপেক্ষায় ছিলাম। বসুন।
তার টেবিলের সামনের চেয়ারটাতে বসলাম।
ম্যাম বললেন
– আপনি গতকাল পুরোপুরি গল্পটা বলতে পারেননি। ম্যাসেঞ্জারের ম্যাসেজ গুলো পড়াতে আমার বেশ সুবিধা হয়েছে। আপনাদের কনভারসেশনে কয়েকটা বিষয় বুঝতে পারলাম।
১. আপনাদের মাঝে বেনামী সম্পর্কের জন্ম হয়েছিলো। আর সেই সম্পর্ক টা আপনার প্রিয় মানুষ টি তৈরি করেছিলো।যার কেন্দ্রে আপনাকে রেখেছিলো।
২. তার বলা কথাগুলো যেকোনো মেয়ের মধ্যেই ভালোবাসার অনুভূতি তৈরি করবেই। ব্যাপারটা ঠিক এরকম যে তার প্রয়োজনে আপনাকে পুরোপুরি ব্যবহার করেছে। আপনার মন খারাপের সময় আপনাকে সম্পর্কের প্রথম দিকে খুব সময় দিতো কিন্তু পরে তাকে আপনি খারাপ সময় পাননি। এটা সে ইচ্ছা করে করতো।
৩. আপনার কথায় সে বুঝতে পেরেছিলো আপনি তার প্রতি খুব দূর্বল। আপনি সবসময় আগ বাড়িয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করতেন যে, আপনাদের মাঝে বেনামী সম্পর্ক আছে।
৪. সে আপনাকে ছেড়ে দেয়ার কারণ হিসেবে সামনাসামনি যেটা বলেছে সেটা পুরোপুরি সত্য না। সত্যটা হচ্ছে সে আপনাকে গ্রহণ করতে পারবেনা। আর কারণ গুলো সে আপনাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছে। আপনি নিজ থেকেই বলবেন না আমি বলবো?
– আপনি বলুন।
– আপনারা সেম এজ এবং আপনি অতোটা সুন্দর না। মানে মোটামুটি। সে অনেক সুন্দরী আর অল্পবয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চায়। এর কারণ সেক্সুয়াল জীবন দীর্ঘ হবে। ঠিক কিনা?
– হ্যাঁ।
– আরেকটা কারণ হচ্ছে, সে আপনাকে কখনোই ভালোবাসতে পারেনি। আপনার অস্তিত্বই সে স্বীকার করতে চায়না। তার জীবনে আপনার কোনো মূল্যই নেই। লাস্টের দিকের কনভারসেশন গুলোতে তাই বুঝলাম। প্রথম দিকে আর মাঝের দিকে আপনার সাথে ওভাবে কথা বলেছে যাতে তার এক্সকে ভুলে থাকতে পারে।
এক ঢিলে দুই পাখি সে মেরেছে।
আপনি কী চান এমন মানুষের সাথে লেগে থাকতে যে আপনাকে প্রয়োজনে শুধুই ব্যবহার করেছে?
– নাহ, আমি মুক্তি চাই।
– তাহলে তার সাথে যব যোগাযোগ এর পথ বন্ধ করে দিন।আপনার মা আর পরিবারের সাথে কোথাও ঘুরে আসুন। ১-২ সপ্তাহের ছুটিতে। তারপর আমার সাথে আবার দেখা করতে আসবেন। আর একটা কথা সে আপনার কাছে আবার ফিরে আসতে চাইবে।
 – না ম্যাম আসবেনা।
ম্যাম মুচকি হেসে বললেন
– সে ফিরে আসবে। এরকম প্রেমের সম্পর্কে না জড়িয়ে প্রেমিকা পেতে কেইবা চাইবেনা বলুন? আসবে সে। তখন ভাববেন,  একবার স্বার্থের জন্য আপনাকে যে ছেড়ে দিয়েছে সে যে দ্বিতীয় বার আপনাকে ছেড়ে দিবেনা তার গ্যারান্টি নেই।
মনে থাকবে তো?
– হুম।
– আর এই ১- ২ সপ্তাহ তার কাছ থেকে দূরে থাকবেন। সব যোগাযোগ বন্ধ। যদি পারেন তাহলে আবার আসবেন। আর তা না হলে এই নীলুফার ত্রিদেবী আপনাকে কোনো প্রকার হেল্প করতে পারবেনা।ভুল  একবার করেছেন আর এখনি শুধরে নিতে হবে। তা না হলে একসময় আপনি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হবেন। আপনার আগের ছবি আর এখনকার ছবির সাথে একটু মেলাবেন। কতো রাত ঘুমান না তার হিসেব নেই। চোখের নিচে কালো দাগ তো পড়েছেই আর নিজের যত্ন তো ভুলেই গেছেন। নিজেকে ভালোবাসুন।
চেম্বার থেকে বের হয়ে এসে জোরে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে বললাম
– সে তার স্বার্থের জন্য আমাকে ব্যবহার করেছে কখনো ভালোবাসেনি।
তার নামটা আমি আর কখনো উচ্চারণও করবোনা।
ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি ওর কল এসেছে। কল কেটে দিয়ে ওর নাম্বার ব্লক লিস্টে দিয়ে দিলাম।
© Maria Kabir

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ১৮

14

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

কলটা কেটে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় হিয়া। বড়সড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে এদিকওদিক তাকায়। দু’হাতে বেশ শক্ত করে চেপে ধরে মাথা।
বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় বাকি সবাই। হৃদয় স্ত্রী হিয়ার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে। মাথা থেকে দু’হাত সরিয়ে পিছু তাকায় হিয়া। চোখের কোণে জমে থাকা জলগুলো অশ্রুবিন্দু হয়ে ঝরে পরে নিচে।
‘আমি এখন কি করব? কি জবাব দেবো আমি এখন?’ শব্দ করে কেঁদে উঠে হিয়া।
বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় শুভ। কন্ঠকে স্বাভাবিক করার বৃথা চেষ্টা করে।’ ফুপ্পি! আমার মনে হয় নীলিমা আন্টিকে তোমার সবটা খুলে বলা উচিৎ।’
শুভ’র সাথে তাল মিলিয়ে হৃদয়ও জানায়, হ্যাঁ! আমার মনে হয় শুভ ঠিক’ই বলেছে। তোমার এখন’ই ওনাদের সবটা জানানো উচিৎ।
এরকম’ই সাতপাঁচ নানান কথা ভাবছিল ওরা। তার’ই মধ্যে নীলিমার ৬,৭টা কল এসে আপনাআপনি কেটে যায়।
তারপর অতিবাহিত হয়ে যায় দু’মিনিটেরও অধিক সময়। আর কোন কল আসেনি। এদিকে এরই মাঝে বুকে অদম্য সাহস সঞ্চয় করে ফেলেছে হিয়া। আর সেই সাহসিকতার জোরে’ই কল করে প্রাণপ্রিয় বান্ধবী নীলিমা’কে।
তারপরের কথোপকথনঃ-

– হ্যাঁলো…(হিয়া)
– হ্যাঁ, শুনছি! কোথায় আদিরা?(নীলিমা)
– আমি আসলে নিচে’ই এখন দাঁড়ি….
– আপনি উপরে নাকি নিচে সেটা তো আমি
জানতে চাইনি মিসেস হিয়া। আমি যেটা
জানতে চাচ্ছি সেটা হলো- কোথায়
আমার মেয়ে আদিরা?
– নীলিমা তুই আমার সাথে এভাবে কেন
কথা বলছিস?
– মিসেস হিয়া! আমি আপনাকে কল
করিনি কথা বলার আদব কায়দা
শিখার জন্য। আমি কল করেছি
আমার মেয়ের সাথে কথা বলার জন্য।
– নীলিমা প্লিজ আমার কথা’টা তো শুন…
– মিসেস হিয়া, আমি স্পষ্ট বাংলা’য়
জানতে চাচ্ছি কোথায় আমার মেয়ে?
– নীলিমা তুই আমার ক….
– আমি কোন কথা শুনতে চাচ্ছি না মিসেস
হিয়া। আপনি শুধু এটা বলেন যে,
কোথায় আমার মেয়ে?
– নীলিমা ও’তো…
– হ্যাঁ, বলুন! ও কি…?
– ঘুমিয়ে আছে।
– কিহ?
– ও আসলে ঘুমিয়ে আছে…
– ঘুমিয়ে আছে?
– হ্যাঁ, ও ঘুমিয়ে আছে। আসলে আজকে
কলেজে তেমন ক্লাস হয়নি তো তাই
বেশীক্ষণ পড়তে হয়নি। ডিনার করে
একটু তাড়াতাড়ি’ই ঘুমিয়ে পরেছে।
– ওহ, আচ্ছা! তাই নাকি…?
– হ্যাঁ…
– হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে নীলিমা। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় হিয়া। ফোন কানে চুপসে দাঁড়িয়ে থাকে। ওপাশে নীলিমা’র হাসি থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। চেষ্টা করছে আবির। কিন্তু কিছু’তেই নীলিমা’র হাসি থামছে না। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নীলিমা’র গালে জোরে একটা থাপ্পর মারে আবির। নীলিমা ছিটকে পড়ে যায়। সেই সাথে ফোনটাও। হিয়া তখনো লাইনে’ই ছিল। ফোনের লাউডস্পিকার জানান দিচ্ছিল ওপাশে ঠিক কি হচ্ছে…!
ফোন হাতে আবির দেখতে পায় লাইন’টা এখনো কাটেনি। আর তাই ফোনটা কানে ধরে। তারপর কোন রকম সালাম কুশল বিনিময় ছাড়া’ই একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় হিয়া’র উদ্দেশ্যে- ‘ বড্ড ভরসা করে মেয়ে’টাকে তোমার কাছে রেখেছিলাম। বিনিময়ে এই তার প্রতিদান দিলে তুমি…?’
ঢোক গিলে হিয়া। প্রশ্নের জবাবে কিছু একটা বলতে চায়। তার আগেই ফোন কেটে দেয় আবির। বন্ধ করে দেয় ফোন।
পরে অনেক বার ট্রাই করেছে কিন্তু প্রতিবার’ই ফোনটা বন্ধ দেখিয়েছে….!
উত্তেজিত আঁখি কোন কথা ছাড়া’ই মায়ের থেকে ফোনটা এনে নিলয়ের নাম্বারে কল দেয়।
তারপরের কথোপকথনঃ-

– হ্যাহ্যাহ্যাঁলো…(আঁখি)
– জ্বি, কে বলছেন?(নীলয়)
– নীলয় আমি আঁখি। চিনতে পারছো?
– ওহ, আঁখি আপু!!!
– হ্যাঁ, তোমার আপু কেমন আছে?
– এতক্ষণে আপুর কথা মনে হলো?
– নীলয় বাদ দাও না! কোথায় নুহা?
– হসপিটালে…
– কিহ?
– হ্যাঁ, হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে আপু।
– কিকিকি হয়েছিল ওর?
– কি হয়েছিল, নাহ?
– হ্যাঁ, বলো নীলয়। কি হয়েছিল?
– কি হয়েছিল সেটা তো আমি জানি না।
কারণ আমি কলেজে ছিলাম। কলেজ
থেকে যখন ফিরি তখন পুরো বাড়ি জুড়ে
মানুষের উপস্থিতি ছিল দেখার মতো।
আব্বু আম্মু বিদেশ থেকে ফিরছে
এজন্য যতটা না মানুষ এসেছিল তার
থেকেও বেশী মানুষ এসেছিল এটা শুনে,
বাবা মা’য়ের সাথে মেয়ের লাশও
এসেছে।
– মানে কি নীলয়?
– তোমাদের বাসার অদূরে’ই আপুর
এক্সিডেন্ট হয়েছিল। বাবা যখন
এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি তোমাদের
বাসায় যাচ্ছিল সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য
আপু তখন রাস্তার পাশে মুমূর্ষু অবস্থায়
পরে ছিল। কাকতালীয় ভাবে আব্বু
আম্মু সেখানে’ই পৌঁছে এবং তখন’ই
আপুকে নিকটস্থ হসপিটালে নিয়ে যায়।
আপুর অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয় ছিল।
ওরা আপুকে ফিরিয়ে দেয়। তারপর
আপুকে প্রাইভেটে নিয়ে গেলে
সেখানকার ডাক্তার জানায় আপু মারা
গেছে। সাথে সাথে আপুকে বাড়িতে নিয়ে
আসার ব্যবস্থা করা হয়। বাড়িতে কান্নার
রুল পড়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ তো
কবর খুঁড়ার কাজও শুরু করে
দিয়েছিল। গোসল করাতে নিয়ে যাওয়া
হয় আপুকে। ছোট্ট দেহের প্রাণটা তার
অস্তিত্ব জানান দেয়ার জন্য হয়তো বা
ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে। নড়ে উঠে আপু।
আপুর হৃদস্পন্দন একটু একটু করে
উঠানামা করতে থাকে। আপুকে তখন’ই
নিকটস্থ হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়…

পুরো ঘটনা শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে আঁখি। ওর মুখ দিয়ে কোন কথা’য় সরছে না। চোখ দিয়ে অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পরছে। কাছে যায় শুভ। আঁখির হাত থেকে ছুঁ মারা’র ন্যায় ফোন’টা নিয়ে নিজ কানে ধরে। ওপাশে ক্লান্ত গলায় নীলয় তখনো বলে’ই চলছে- “শুনেছি কিছুক্ষণ আগে জ্ঞান ফিরেছে আপু’র। তবে মা আমাদের কাউকে আপুর কেবিনে যেতে দেয়নি। আপুর এ অবস্থার জন্য নাকি দাদীমা, আমি, ফুপ্পি, আদিত্য ভাইয়া, সবাই, সবাই দায়ী। তাই মা আব্বু ছাড়া আমাদের কাউকে ঢুকতে দেয়নি ভিতরে। দেখতে দেয়নি আপুকে। আপু এখন আমাদের গ্রামের হসপিটালে’ই আছে। দোয়া করো। রাখছি….!”
ফোনটা কান থেকে নামিয়ে সোফায় বসে পড়ে শুভ। চোখ মুখ শক্ত করে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
পাশে এসে বসে হিয়া। ‘শুভ! বাবা কি হয়েছে? কোথায় নুহা? জানতে পেরেছিস কিছু?
কিচ্ছু জবাব দেয়নি শুভ। হিয়া এবং হৃদয় দু’জনে’ই ছুটে যায় মেয়ে আঁখির কাছে। আঁখি ওর বাবা মা’কে সবটা জানালে তবে’ই ওরা আশস্ত হয়।
তবে টেনশন দুর হয়নি। হিয়া কিংবা তার পরিবার কেহ’ই জানে না নুহার বর্তমান অবস্থা…

সেই রাতে’ই হিয়া রওয়ানা দেয় নুহার গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সাথে আছে শুভ, আঁখি এবং হৃদয়। বাসা থেকে বেশ ক্ষাণিকটা দুরে গিয়ে হৃদয়ের মনে পড়ে অত্যাধিক তাড়াহুড়ায় বাড়ির মেইন গেইট’টাই বন্ধ করতে ভুলে গেছে। মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে হৃদয় শুভকে পাঠায়। মেইন গেইট’টা বন্ধ করে চাবিটা সাথে নিয়ে আসার জন্য।
শুভ চটজলদি বাসায় গিয়ে হাজির হয়। হিয়া’র রুম থেকে চাবি আনার এক পর্যায়ে কি মনে করে যেন উঁকি দেয় নিজের রুমের দিকে। তারপর যা দেখলো তাতে শুভ’র চক্ষু ছানাবড়া হয়ে গেল। প্রচন্ড রাগে গর্জে উঠে শুভ।
” ছোট্ট আদনান খাটে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ফারহানা এবং তার মা। দুজনে’ই আদনানের হাত থেকে কিছু একটা খুলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে।”
প্রচন্ড রাগে দু’হাত মুঠো করে করে দরজা’র সামনে দাঁড়িয়ে থাকা শুভর মনে পড়ে নুহা’র বলা সেই কথা- ‘রাগ আসে শয়তানের থেকে! রাগ’কে প্রশ্রয় দিতে নেই….!’

শান্ত হয়ে যায় শুভ। অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠে পিছনে তাকায় মা-মেয়ে। শুভ’র চোখে মুখে তখনো তাচ্ছিল্যের হাসি ছিল।
” হা, হা! শেষে কি না তুমি নিজের ছেলের হাতের আংটি চুরি করলে….!”

চলবে…

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ১৭

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ফারহানাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে অফিস পানে ছুটে যায় শুভ। অফিসে গিয়ে ক্লান্ত দেহটাকে চেয়ারে এলিয়ে দেয়। মাথাটা প্রচন্ড ব্যথা করছিল শুভর। হাতের কাছেই ড্রয়ার ছিল। যার ভিতরে রাখা প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য কিছু ঔষধ পত্র। সেখান থেকে ব্যথার একটা ট্যাবলেট খেয়ে নেয় শুভ।
মিনিট ত্রিশেক অতিক্রম হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ব্যথাটা সেরে গেছে পুরোদমে। কিন্তু ভিতরে কেন এরকম লাগছে? বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় শুভ।
পায়চারী করতে থাকে রুম জুড়ে। আজ তো একটা দু’মুখো সাপের বিষ দাঁত ভেঙে ঘুরিয়ে দিয়েছি। আর কখনো ছোবল বসাতে পারবে না আমার পরিবারের কারো উপর। আজ তো আমার সুখের দিন। সুখ সাগরে ভেসে যাওয়ার দিন। কিন্তু এরকম লাগছে কেন আমার? সুখে আত্মহারা হওয়ার বদৌলতে ভিতরে অস্থিরতা কেন বিরাজ করছে? আমার জীবনে তো আজ সব, সব আছে। তারপরও কিসের এত শূন্যতা? উফফ, এমন কেন লাগছে আমার?
অজানা এক যন্ত্রণায় চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে শুভ। রুমে ঢুকে ম্যানেজার। জানতে চায় উদাসীনতার কারণ। জবাবে শুভ জানায়- শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে, চাচা! আমি আর থাকতে পারছি না এখানে। বাসায় যেতে হবে আমার। আপনি কি এদিকটা একটু সামলাতে পারবেন?
ম্যানেজার শুভকে নির্ভয় দিয়ে বাসায় গিয়ে রেস্ট নিতে বলেন। শুভও পরম নিশ্চিন্তে বাসার উদ্দেশ্যে গাড়িতে করে রওয়ানা দেয়।

হন্যে হয়ে গাড়ি চালাচ্ছে শুভ। মাঝ রাস্তায় কি মনে করে যেন গাড়িটি নিয়ে ডানে মোড় নেয়। নুহাদের কলেজ গেইটের সামনে এসে গাড়ি থামায় শুভ। গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়।
ইতস্তত শুভ কলেজ গেইটের সামনে পায়চারী করছে। যদিও এটা নুহার কলেজ তথাপি আজই প্রথম এসেছে এখানে। কিভাবে, কি কারণে নুহার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে সেটাই বুঝতে পারছে না শুভ। এদিকে পূর্ব পরিচিত কেউ নেইও এই কলেজে, যাকে দিয়ে নুহাকে খবর পাঠাবে।
ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে ফিরে আসছিল শুভ। পিছন থেকে একটা মেয়েলি কন্ঠ ভেসে আসে। “আসসালামু আলাইকুম, স্যার….”
থমকে দাঁড়ায় শুভ। সালামের সঠিক জবাব দিয়ে পিছু ফিরে তাকায়….
– তুমি?
— জ্বি, স্যার! কেমন আছেন?
– এইতো আলহামদুলিল্লাহ!
— স্যার এখানে কি জন্য এসেছেন?
– আমার একটা হেল্প করবা?
— জ্বি, স্যার বলুন…
– তুমি তো এই কলেজেই পড়ো, না?
— জ্বি, স্যার!
– কিসে পড়ো জানি?
— ম্যাথে অনার্স করতেছি। ২য় বর্ষ স্যার।
– গুড।
— স্যার কি হেল্প বললেন না তো…
– আসলে তোমাদের কলেজে ১ম বর্ষে এবার একটা মেয়ে ভর্তি হয়েছে। নুহা নাম তার। ও আমাদের রিলেটিভ। তুমি যদি একটু ওকে ডেকে দিতে…
— স্যার, কিসের পড়ে ও? ইন্টারে?
– হ্যাঁ, হ্যাঁ! সাইন্সের স্টুডেন্ট। নাম নুহা….
— আচ্ছা, স্যার। আমি এখনি ডেকে দিচ্ছি।
– ঠিক আছে।

কথা হচ্ছিল শুভর সাথে ওর স্টুডেন্ট তানহার। একটা সময় তানহা এবং তার বান্ধবীরা শুভর কাছে উচ্চতর গনিত প্রাইভেট পড়তো। পরিচয়টা সেখান থেকেই।
মিনিট সাতেক পর ফিরে আসে তানহা। তানহাকে দেখে প্রশ্ন করে শুভ, কই? পেয়েছ?
মুখে মলিন হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে তানহার জবাব, স্যার! নুহা বলে কোন মেয়ে সাইন্সের গ্রুপে নেই। তবে আদিরা মাহমুদ ‘নুহা’ নামের একজন আছে।

– আদিরা? হ্যাঁ, হ্যাঁ! নুহা’ই আদিরা। কোথায় ও?
— স্যার ও আসেনি আজকে?
– আসেনি???
— ওর সহপাঠীরা তো সেটাই বলল।
– আচ্ছা, ঠিক আছে। তুমি এখন আসতে পারো।
— ঠিক আছে, স্যার! আসসালামু আলাইকুম।
– ওয়ালাইকুম আসসালাম।

কলেজ গেইট দিয়ে ভেতরে চলে যায় তানহা। প্রচন্ড এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়িতে উঠে বসে শুভ। আশেপাশে আরো একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে স্টার্ট দেয় গাড়ি।
আঁখির কলেজের সামনে দিয়েই যাচ্ছিল। চোখ আটকে যায় অদুরে দাঁড়িয়ে থাকা আঁখির দিকে। যার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে একদল বখাটে। রাগে দিগ্বিদিক শূন্য শুভ গাড়ি থেকে নেমেই এলোপাথাড়ি ভাবে কয়েকটা কিল ঘুসি বসিয়ে দেয় এক বখাটের পেটে, বুকে। ‘ এইরে! আশিক স্যার’ বলেই দৌঁড়ে পালিয়ে যায় বাকি বখাটেরা। মাইর খেয়েছে যে বখাটে সবশেষে সে বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে আঁখি এবং একসময়কার স্যারের কাছে মাফ চেয়ে সে স্থান পরিত্যাগ করে।
আঁখির দিকে ফিরে তাকায় শুভ। উঁচু গলায় বলে উঠে, দাঁড়িয়ে কেন আছিস? আর কিসের শুটিং দেখানোর বাকি আছে?
নিশ্চুপ আঁখি দ্রুত গাড়িতে গিয়ে বসে। শুভর ভয়ানক চেহারা দেখে ভয়ে রীতিমত কাঁপছে সে। ভিতরে প্রচন্ড রাগ পুষে রেখে গাড়ি স্টার্ট দেয় শুভ। গাড়ি চলছে। প্রচন্ড দ্রুতগতিতে গাড়ি চলছে সম্মুখপানে। না জানি এক্সিডেন্ট হয়ে যায় সেই ভয়ে উচ্চস্বরে চিৎকার শুরু করে আঁখি। বিলাপ করে বলতে থাকে- ‘ভাইয়া! প্লিজ আস্তে চালা গাড়ি। প্লিজ ভাইয়া, প্লিজ…’
নিরাপদ স্থানে গিয়ে জোরেশোরে ব্রেক কষে শুভ। রাগান্বিত দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় আঁখির দিকে।
ভয়ে ঢোক গিলে আঁখি। আমতাআমতা স্বরে প্রশ্ন করে শুভকে- ‘কি হলো? এভাবে বড় বড় চোখে আমার দিকে কেন তাকিয়ে আছিস?’

– বোরকা ছাড়া তোকে বাসা থেকে বের হওয়ার পারমিশন কে দিয়েছে?
— কে মানে? কি বলছিস তুই এসব?
– বোর…কা ছা…ড়া তু…ইইই কেন এসে….ছিস?
— ক্ষেপে যাচ্ছ কেন?
– প্রশ্নের বদলে প্রশ্ন নয়, উত্তর দে…
— ভাইয়া! পরীক্ষা চলছে। কলেজ ড্রেস না পরে আসলে গেইটের ভেতর ঢুকতে দেয় না।
– কিসে পড়িস তুই?
— অনার্স ২য় বর্ষে।
– অনার্স ২য় বর্ষ পড়ুয়া এক ছাত্রীকে বোরকা পরার অপরাধে পরীক্ষার হল থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এরকম রেকর্ড কখনো হয়েছে?
— নাহ…কিন্তু….
– একদম কিন্তু কিন্তু করবি না। কাল থেকে বোরকা পরে আসবি।
— তোর কি মনে হয়? বখাটেদের বাজে মন্তব্যের জন্য এটাই দায়ী?
– সেটা নয়।
— তবে?
– নুহাকে অনুসরন কর।
— মানে কি?
– নুহা তথা ইসলামিক জীবনাদর্শ অনুসরন কর। এতে শুধু ইহজাগতিক কল্যান নিশ্চিত হবে না। অর্জন করতে পারবি তুই মৃত্যুর পরের জগতের জন্য পাথেয়।
— ভাইয়া, তুই অনেক বদলে গেছিস।
– হু, নুহাও বলে।
— কিহ?
– কিছু না। চল…
— হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ
– কি হলো? হাসছিস কেন?
–কই হাসছি না তো। দেখে গাড়ি চালা…

বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ বাসায় আসে ওরা। প্রতিদিনের মতো সেদিন আর ড্রয়িংরুমে কেউ বসে ছিল না। নিস্তব্ধতা। পুরো বাসা জুড়ে কি রকন অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল।
“আদনান! আদনান! আদনান…”
উচ্চস্বরে ডাকতে থাকে আঁখি। উপরতলা থেকে ছুটে আসে দাদীমা। দাদীমাকে দেখে প্রশ্ন করে আঁখি-
‘ দাদীমা! আদনান কোথায়? আর আম্মু আসেনি?’
– অনেক কষ্টে ঘুম পাড়ালাম। তোর মা এখনো আসেনি।
— আর নুহা? নুহা কোথায়? ওকে দেখছি না যে!
– সকালে এসে তো আমি ওকে দেখিনি। কেন? কোথায় গেছে ও?
— কোথায় আর যাবে! মনে হয় কলেজে…
– আচ্ছা, যা! ফ্রেশ হয়ে শুভ আর ফারহানাকে নিয়ে নিচে আয়।
— আচ্ছা…

সেই তখন থেকে মনে মনে নুহাকে খুঁজছে শুভর দুটি চোখ। কিন্তু কোথাও খুঁজে পায়নি কাঙ্খিত মানুষটিকে। দিশেহারা শুভ নুহাকে খুঁজতে খুঁজতে নিচে চলে আসে। খাবার টেবিলের সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় শুভ। না চাইতেও ধীর গলায় গলায় বলে উঠে- ‘নুহা কোথায়?’
মুখে ইষৎ হাসি ফুটে উঠে দাদীমার মুখে। ‘এসেছিস দাদাভাই? বস। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।’
জবাবে কিচ্ছু বলেনি নুহা। শুকনো মুখে ফিরে তাকায় আঁখির দিকে।
বিস্মিত আঁখি প্রশ্ন করে শুভকে, কি হলো? টেবিলে না বসে এভাবে আমার দিকে কেন তাকিয়ে আছিস?
– নুহা কোথায়?
— কলেজে।
– ও কলেজে নেই…
— নেই?
– না নেই…
— তাহলে হয়তো কোথাও গিয়েছে।
– কোথায় যাবে ও?
— কত জায়গায়’ই তো যেতে পারে।
– এই শহরে ওর আপন বলতে হিয়া ফুপ্পি ছাড়া আর কেউ নেই।
— তাহলে হিয়া ফুপ্পির কাছেই গেছে।?
– মেজাজ খারাপ করিস না।
— ওরে বাবা! রেগে যাচ্ছিস কেন?
– দে! আমাকে ফুপ্পির ফোন নাম্বারটা দে।
— আশ্চর্য! তুই সামান্য বিষয়কে এত বড় করে কেন দেখছিস?
– কথা বাড়াবি না। রাগ উঠাবি না একদম…
— ওকে, ওকে। তুল নাম্বার…
– হু,
— 01737…….63….
– দাদীমা! তোমরা খেয়ে নাও। আমি আসি একটু।

ফোন কানে নিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে যায় শুভ। ফোন করে সবটা জানায় হিয়াকে। হসপিটাল থেকে ফিরছিল হিয়া। খবর পেয়ে চিন্তিত হিয়া মাঝ রাস্তা থেকেই ছুটে যায় নুহার কলেজের দিকে। কলেজ ততক্ষণে ছুটি হয়ে গেছে। অফিসটা তখনো খোলা ছিল। হিয়া অফিসে স্যারদের সাথে দেখা করে নুহার বিষয়ে জানতে চায়। ওরা খাতা ঘেটে জানায়- “স্যরি, ম্যাম! আদিরা মাহমুদ ‘নুহা’ অনুপস্থিত। ও আসেনি আজকে।”
মলিন মুখে অফিস থেকে বেরিয়ে যায় হিয়া। কল করে হৃদয়কে। খবর পেয়ে সমস্ত কাজকর্ম ফেলে ছুটে আসে হৃদয়ও।
আশেপাশের সকল অলিতে-গলিতে নুহার খুঁজ করা হয়েছে। কোথাও নুহাকে দেখতে পাওয়া যায়নি।
হন্যে হয়ে শুভ খুঁজ করে আশপাশের হসপিটাল গুলোতে। সেখানেও খুঁজে পাওয়া যায়নি নুহাকে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়। নুহার সন্ধান আর মেলেনি। বাধ্য হিয়া স্বামীকে সাথে করে বেরিয়ে পরে রাস্তায়। এক এক করে সবার কাছে নুহার বর্ণনা দিয়ে জানতে চায় দেখেছে কি না। সবার একই উত্তর, নাহ! দেখিনি এমন কাউকে…

রাত্রি আনুমানিক ১০টা কি সাড়ে ১০টা বাজে। চিন্তিত মনে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে আছে সবাই। ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কাঁদছে হিয়া।
” ওর নানুর বাড়িতে খুঁজ নিয়েছি। এমনকি পুরো শহর তন্নতন্ন করে খুঁজেছি। কোথাও পাইনি। কোথায় গেছে মেয়েটা?”
কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়ছিল হিয়া।
পাশ থেকে হৃদয়ের প্রশ্ন- একমিনিট, একমিনিট! কান্না থামাও হিয়া। আমরা তো ওর দাদীর বাড়িতে ফোন করিনি। ওতো দাদীর বাড়িতেও যেতে পারে।
হৃদয়ের কথায় কান্না থামিয়ে দেয় হিয়া। হ্যাঁ, হ্যাঁ! আমায় ফোনটা দাও।
হৃদয় স্ত্রী হিয়ার দিকে ফোনটা বাড়িয়ে দেয়। কাঁপা কাঁপা হাতে হিয়া একটা একটা করে ডিজিট তুলতে থাকে। শেষ ২ডিজিট বাকি ছিল। তুলতে পারেনি। তার আগেই ফোনের স্ক্রিনে ভেসে উঠে একটা অচেনা নাম্বার।
উত্তেজিত হিয়া ফোন রিসিভ করতে গিয়ে ভুলে কেটে দেয়। তারপর কানে নিয়ে হ্যালো, হ্যালো করতে থাকে। কানে থাকা অবস্থায় রিং বেজে উঠে আবারো।
হিয়ার হাত থেকে ফোন নিয়ে যায় আঁখি। দ্রুত ফোন রিসিভ করে পরিচয় জানতে চায়।
পরিচয় শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় আঁখি। ওপাশের মানুষটি নাকে মুখে কথা বলে যাচ্ছে। কিন্তু আঁখি একদম নিশ্চুপ। মুখ দিয়ে কোন কথা’য় বের হচ্ছে না ওর। যেন সে কথা বলার শক্তি হারিয়েছে।
” কি হলো? কে ফোন করেছে?”
শুভর ডাকে ঘোর কাটে আঁখির। দ্রুত ফোনটা কেটে বন্ধ করে দিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে ফিরে তাকায়। তারপর অনেকটা কাঁপা গলায় বলে- আম্মু! নীলিমা আন্টি…..
চমকে উঠে হিয়া। ‘কিহ? নীলিমা?’
– হ্যাঁ, আম্মু! নীলিমা আন্টি কল দিয়েছে। তোমার সাথে কথা বলতে চাচ্ছে।
— নীলিমা সুস্থ হয়ে গেছে?(হৃদয়)
– কথা শুনে তো সেটাই মনে হলো বাবা।
— কিন্তু আমি এখন কি করবো’রে মা? কিভাবে কথাটা ওকে জানাবো…(হিয়া)
– আহ, হিয়া! কান্না থামাও তো। তুমি আগে নীলিমার সাথে কথা বলে দেখো।
— ঠিক আছে। আঁখি তোর আবির আংকেলের নাম্বারে কল দিয়ে দে…
– দিচ্ছি….
— …….
– ……………
— ……………..
– আম্মু! নাম্বার তো বন্ধ।
— স্যার টু লিখা দ্যাখ আরেকটা নাম্বার। ঐটায় দে…
– ঠিক আছে।
— ………..
– আম্মু এটাও বন্ধ…
— কি বলছিস কি?
– হ্যাঁ, আম্মু। বন্ধ’ই তো দেখাচ্ছে।
— এই! তখন কোন নাম্বারে ফোন দিয়েছে? (শুভ)
– এই যে…
— এটা তো বাংলাদেশী নাম্বার।(শুভ)
– কিহ?(হিয়া)
— হ্যাঁ, ফুপ্পি! এটা বাংলাদেশী নাম্বার।
– আচ্ছা, কল দে তো মা…(হৃদয়)

যেই আঁখি কল দিতে যাবে অমনি ঠিক একই নাম্বার থেকে আবারো কল আসে। উত্তেজিত আঁখি ফোন রিসিভ করে স্পিকার বাড়িয়ে দিয়ে মায়ের মুখের কাছে ধরে।
– আসসালামু আলাইকুম। কে বলছেন?
— আবির।
– স্যার, নীলিমা সত্যিই..(….)….???
— সুস্থ হয়ে গেছে।
– কখন? কোনদিন স্যার? দেশে আসছেন কবে?
— আমরা দেশে’ই আছি।
– কিহ? কবে এসেছেন স্যার?
— আজ’ই।
– কেমন যেন অবিশ্বাস্য…(…)…???
— নীলিমা কথা বলবে তোমার সাথে। নাও।
– হ্যালো, নীলি…..মা কেমন আছিস?
— যেমন রেখেছেন…
– মানে?
— কিছু না। আদিরা কোথায়? ওর কাছে ফোনটা দেন একটু। কথা আছে।
– আআআদিরা…???
— হ্যাঁ, আদিরা। ফোনটা ওকে একটু দেন…
– তোর কন্ঠ এমন শুনাচ্ছে কেন? তুই কি অসুস্থ্য?
–মিসেস হিয়া! আপনার কথা শুনতে আমি একদম প্রস্তুত নয়। তাই প্লিজ ফোনটা কাইন্ডলি আমার মেয়ের হাতে দেন।
– হিয়া বলছিলাম কি তুই আজ কখন এসেছিস?
— মিসেস হিয়া! আমি আবারো বলছি, আপনার সাথে কথা বলার মতো সময় এবং মন মানসিকতা এই মুহূর্তে কোনোটাই আমার নেই।
– কিসব কথা বার্তা বলছিস তুই নীলি? তুই কি সত্যিই সুস্থ হয়ে এসেছিস? না মানে…(….)….???
–মিসেস হিয়া! আমাকে নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে। আমি একদম সুস্থ আছি। এখন আপনি দয়া করে ফোনটা আমার মেয়ের কাছে দিন।
– নীলি তুই এভাবে কেন….(….)…???
— যেটুকু বলেছি সেটা আপনার জন্য অনেক বেশী হয়ে গেছে মিসেস হিয়া…
– নীলি তুই আমাকে এভাবে???
— হ্যাঁ, আমি এভাবেই বললাম। কারণ আপনার সাথে কথা বলতে আমার এখন রুচিতে বাঁধছে…
– কিন্তু আমি কি করেছি নীলি?
— কেন? আপনি জানেন না? জানেন না আপনি কি করেছেন?
– নীলি! প্লিজ এভাবে বলিস না।
— হ্যাঁ, বলবো না। আমি আপনাকে এভাবে আর কখনো বলবো না। আপনি শুধু এই মুহূর্তে আমার মেয়ের সাথে একবার কথা বলিয়ে দিন….

চলবে…

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ১৬

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে শুভ এদিক ওদিক করতে থাকে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে যেন কাউকে খুঁজছে। সেটা দেখে হিয়ার প্রশ্ন-
” কিরে! কাউকে খুঁজছিস?”
আমতাআমতা করে শুভর জবাব, ইয়ে ফুপ্পি! আর সবাই কোথায়?
চারিদিকে চোখ বুলিয়ে হিয়ার স্বামী হৃদয়ের জবাব, ‘কই! সবাই তো এখানে উপস্থিত আছে…’
শুভ পুনরায় এদিক ওদিক তাকাতে থাকে। তারপর অনেকটা নিচু গলায় জবাব দেয়- ইয়ে মানে! ফারহানাকে যে দেখছি না…?
শুভর মুখে ফারহানার নাম শুনে চমকে উঠে সবাই। হিয়া’তো ভাত মুখে দিতে গিয়ে রীতিমত বিষম খায়।
হৃদয় পানির গ্লাসটা স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিতে অনেক বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করে-
‘শুভ? তুই সত্যি সত্যি ফারহানাকে খুঁজছিস তো?’
ভ্রু-কুচকে শুভর জবাব, হ্যাঁ, আমি ফারহানাকে খুঁজছি। কেন? কোন সমস্যা?
ক্ষাণিক কেশে হিয়ার জবাব, আরে না, না! সমস্যা কেন হবে? আসলে জানতে চাচ্ছিলাম হঠাৎ
করে এভাবে ফারহানাকে কেন খুঁজছিস?
স্বাভাবিক গলায় শুভর জবাব, শপিংয়ে যাবো…

আনন্দে পারলে লাফ দিতে পারছে না ফারহানার মা। এতক্ষণ টেবিলে বসে থেকে সবার সব কথা নিরবে শুনে গেলেও আর চুপ থাকতে পারছে না।
আর এত বড় একটা সু-সংবাদ শুনার পর চুপ থাকতে পারার কথা’ও নয়। তাই অনেকটা জোর গলায় বলে উঠে-
— বাবা! ও তো ঘরেই আছে। ভালো করছো বাবা। ও অনেকদিন ধরে বাহিরে যায় না।
— হু, সেই জন্য’ই তো এ সিদ্ধান্ত।
— এখানে কি খায়, না খায় সেটাও জানি না। তুমি তো ওকে এখানে আসতে মানা করেছ। বলছিলাম কি ফেরার পথে ওকে নিয়ে কোন ভালো রেস্টুরেন্ট থেকে লাঞ্চটা করে এসো।
— জনমের লাঞ্চ করাবো আজকে…(বিড়বিড় করে)
— কিছু বললে বাবা?
— বলছিলাম কি- আমার ব্রেকফাস্ট করা শেষ। ওকে একটু ডাকুন। আমার এখনি বেরোতে হবে।
— ঠিক আছে বাবা! আমি এখনি ডাকছি…
“ফারহানা মা, কইরে….”
ফারহানাকে ডাকতে ডাকতে ওর মা উপরের দিকে চলে যায়।

টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় নুহা। পাশ থেকে দাদীমার প্রশ্ন- ‘সে কি! তুইও উঠছিস যে?”
নীচু গলায় নুহার জবাব, আমার জরুরী কাজ আছে দাদীমা!
এবার হিয়ার প্রশ্ন- ব্রেকফাস্ট’টাতো করে যা…
— না, আন্টি! আমার এখনি যেতে হবে।
— দাঁড়া, তোর আংকেল তোকে পৌঁছে দিবে।
— না, আমার এখনি বের হতে হবে।
— আচ্ছা, যা ভালো মনে হয়…

নুহা দ্রুত হেঁটে উপরতলায় চলে যায়। চটজলদি বোরকা পরে রেডি হয়ে নেয়। হিয়া’রা তখনো টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করছে। বিনীত ভঙ্গিতে নুহা সবাইকে জানায়- “আমি তাহলে আসি। আসসালামু আলাইকুম…”
সালাম দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায় নুহা। ডেকে আনে রাস্তার ওপাশ থেকে এক সিএনজিওয়ালাকে।

তারপরের কথোপকথনঃ-
” কোথাও যাবেন, আপা?”
— হু…
— কোথায়?
— একটু দাঁড়ান আপনি…
— দাঁড়িয়ে তো আছি’ই। কোথায় যাবেন আপনি সেটা তো বললেন না।
— ২মিনিট পর বলছি…(এদিক ওদিক তাকিয়ে)
— আপা কি সত্যিই কোথাও যাবেন, নাকি মস্করা করার জন্য ডেকে এনেছেন?
— চলেন…
— কোথায় যাবো?
— ঐযে সামনের ঐ গাড়িটাকে ফলো করেন।
— ওহ, আচ্ছা!
— হু, দ্রুত চলেন…

শুভ চলছে ফারহানাকে সাথে করে সামনের দিকে। তাদের ফলো করে পিছন দিয়ে যাচ্ছে নুহা। যদিও রাতে হোস্টেলে চলে যাবার ব্যাপারে ফাইনাল কথাবার্তা হয়ে গিয়েছিল হিয়ার সাথে। কিন্তু ভোরে কি মনে করে যেন নুহা হিয়াকে না করে দেয়। বলে দেয়- ‘আপাতত হোস্টেলে যাবে না। গেলেও ঈদের পর যাবে…’

যায় হোক! যে কথাটি বলছিলাম। শুভর গাড়ির পিছু নিয়ে একসময় নুহা কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে যায়। সিনএনজি ওয়ালা ধীর গলায় জানায়-
‘ ঐতো, তারা শপিংমলের সামনে নামলো…’
‘ঠিক আছে। আমার গন্তব্যও তাহলে এটাই।’ নুহা সিএনজি থেকে নেমে সিএনজিওয়ালাকে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে একটা বিল্ডিংয়ের আড়ালে দাঁড়ায়।

এদিকে শুভ গাড়ি থেকে নেমে অনেকটা অস্বস্তির সাথে, ভেতরে বিরক্তি পুষে নিয়ে ফারহানাকে কোলে করে বাহিরে বের করে হুইলচেয়ারে বসিয়ে দেয়।তারপর হাসোজ্জল মুখে হুইলচেয়ার ঠেলে, ফারহানাকে সাথে করে ভিতরে ঢুকে শুভ।
চোখের জল মুছতে মুছতে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে নুহা। এ দৃশ্য দেখার পর সামনে এগিয়ে যাওয়ার সমস্ত শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে। তারপরও বহুকষ্টে, ভারাক্রান্ত মনে পিছু নেয় শুভদের।

শপিংমলের দোকানে দোকানে শুভ ফারহানাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর কেনাকাটা করছে। কখনো কখনো হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে।
ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে নুহার। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। কিন্তু পারছে না। ছোট্ট বাচ্চাদের ন্যায় ঠোঁটজোড়া কেবল মৃদু কাঁপছে ওর। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণের ভেতর কান্না চলে আসবে। না, না! আমি আর পারছি না এভাবে কান্না লুকাতে।
দৌঁড়ে শপিংমল থেকে বেরিয়ে যায় নুহা।উত্তেজিত নুহা কান্না করতে করতে কখন যে রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে টের পায়নি। যখন টের পায়, তখন খুব কাছ থেকে একটা গাড়ির হর্ণের আওয়াজ ভেসে আসে। ভয়ে দৌঁড় দেয় নুহা। গাড়িটি তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে নুহাকে একটা ধাক্কা দেয়।
মাথায় প্রচন্ড ব্যথা অনুভূত হয় নুহার। মনে হচ্ছে কেউ যেন কোন ভারী পাথর দিয়ে মাথায় আঘাত করেছে। আশেপাশে অনেক মানুষের শোরগোলের আওয়াজ ভেসে আসছে।
এটুকুই… এর বেশী কিছু শুনতে পায়নি নুহা। তার আগেই জ্ঞান হারায়।

শপিংমল থেকে বের হয় শুভ’রা। রাস্তার পাশেই রক্তের স্তুপ জমে আছে। চেঁচিয়ে উঠে ফারহানা। একরাশ বিরক্তি নিয়ে শুভ ফারহানার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়- ” কি? সমস্যা কি?”
ফারহানা ওর আঙ্গুল দিয়ে রক্তের দিকে ইঙ্গিত করে। শুভ ডানে ফিরে তাকায়। রক্ত দেখে শুভ নিজেও ভড়কে যায়। এত রক্ত? কোন মানুষের শরীর থেকে বের হয়েছে? না জানি কতটা আঘাত পেয়েছে মানুষটা…!
পাশ থেকে ফারহানার জবাব, দেখছ! গরু জবাই করার মতই রক্ত। একদম তরতাজা। মনে হয় এই মাত্র এক্সিডেন্ট হয়েছে। বাঁচবে না মনে হয়।
চেঁচিয়ে উঠে শুভ, চুপ করো। আর ফালতু, অলক্ষুণে কথা বলা থেকে বিরত থাকো।

কথা বাড়ায় না ফারহানা। হুইলচেয়ারে করে শুভর সাথে করে ওপাশে যায়। অতঃপর শুভর কোলে উঠে গাড়ির ভেতরে পৌঁছে।
গাড়ি স্টার্ট দেয় শুভ। বাসার ঠিক বিপরীত দিকে গাড়ি চলছে। আনন্দে আত্মহারা ফারহানা প্রশ্ন করে শুভকে- ” আচ্ছা, আমরা কোন রেস্টুরেন্টে যাচ্ছি?”
ব্যাঙ্গাত্বক গলায় শুভর জবাব, আহা, রেস্টুরেন্ট!
রেস্টুরেন্টে যাবে। শুভর কোলে চড়ে রেস্টুরেন্টে যাবে মহারানী। শখ কতো…
কিছুটা ভয় পেয়ে যায় ফারহানা। প্রশ্ন করে শুভকে, তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন শুভ?

— হারামজাদী! কথা কম বল…
— শুভ! কোথায় যাচ্ছি আমরা? কিছু তো বলো?
— কোর্টে…
— কো…কো…কোর্টে মানে?
— অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার জন্য…
— মানে?
— ঝুলিয়ে রাখা সম্পর্ককে চিরতরে শেষ করে দেয়ার জন্য…
— না, শুভ। এটা হয় না। তুমি এটা করতে পারো না।
— সবই হবে। হতে বাধ্য।
— গাড়ি থামাও শুভ।
— চুপ করে বসে থাক।
— শুভ প্লিজ গাড়ি থামাও।
— ……..
— আমি কিন্তু গাড়ি থেকে লাফ দিচ্ছি।

কোর্টের সামনে এসে প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে শুভ গাড়িটা থামায়। দম নেয়ার টাইম পায়নি শুভ। তারআগেই গাড়ির দরজা খুলে বাহিরে বের হয়ে যায় ফারহানা। হা করে তাকিয়ে আছে শুভ। এ যে এক সুস্থ, স্বাভাবিক ফারহানা। রাগে রীতিমত ফুসছে সে। গাড়ি থেকে বের হয়ে আসে শুভ।
— How Funny! ফারহানা তুমি ভালো হয়ে গেছ?
— হ্যাঁ, ভালো হয়ে গেছি।
— সিনেমায় দেখতাম স্মৃতিহারা মানুষের গাড়ি কোন কিছুর সাথে ধাক্কা খেলে মানুষটা স্মৃতি ফিরে পায়।
এখন তো দেখছি পা হারা মানুষও তাদের পা ফিরে…
— বন্ধ করো তোমার জোকস বলা।
— ইটস ওকে! এই দ্যাখো! একদম চুপ হয়ে গেছি। এখন চলো তো…
— আমি ভিতরে যাবো না।

শুভ কাছে যাওয়ার আগেই রাস্তা বরাবর দৌঁড় দেয় ফারহানা। একটা গাড়ি বিকট শব্দে ফারহানার পাশে এসে থামে। ভয়ে থমকে দাঁড়ায় ফারহানা। কানে হাত দিয়ে রাস্তার মধ্যিখানেই দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে বাসের ড্রাইভার ফারহানাকে যাচ্ছে তাই বকে যাচ্ছে। একটা শয়তানি হাসি দিয়ে শুভ ফারহানাকে রাস্তার পাশে নিয়ে আসে। ফারহানা তখনো দু’হাত দিয়ে কান ঢেকে রেখেছে।
— ভয় পাওয়ার কিছু নেই আর। চলো…
— না, আমি যাবো না।

কোন কথা ছাড়া’ই শুভ ফারহানাকে টানতে টানতে ভেতরে নিয়ে যায়। পরিচিত লোকগুলোর সামনে গিয়ে হাজির হয়। পূর্বেই শুভ- ফারহানার ডিভোর্সের প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র প্রস্তুত ছিল। বাধ্য ফারহানা একসময় নিজের হার মেনে নেয়। তারপর সবার উপস্থিতিতে ডিভোর্সের সমস্ত কার্যক্রম সম্পূর্ণ হয়। আলাদা হয়ে যায় শুভ-ফারহানার পথ চলা।

কোর্টের সমস্ত কার্যক্রম শেষ করে ফারহানাকে বাসার সামনে পৌঁছে দিয়ে অফিসের দিকে চলে যায় শুভ। যাওয়ার আগে অবশ্য ফারহানাকে বলে গেছে- “আজ রাতটাই! তারপর সকালে যাতে কোন কথা ছাড়া’ই এ বাসা খালি পাই…”

চলবে…

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ১৫

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

রুমে ঢুকে নুহা। খাটের একপাশে হিয়া আন্টিকে বসে থাকতে দেখে চমকে যায় সে। কিছুটা তোতলাতে তোতলাতে প্রশ্ন করে- ‘আআআনটি আপনি? ককখন আসলেন?
স্বাভাবিক গলায় হিয়ার জ্ববাব, অনেকক্ষণ’ই হলো। দেখলাম শুভর সাথে কথা বলছিস। তাই ডাকিনি। ভাবলাম রুমে এসে বসি….
আমতাআমতা করতে থাকে নুহা। “শুভভাইয়াহ্যাঁআসলেইয়েমানেআমি।”

– সমস্যা কি তোর? এভাবে ঘামছিছ কেন?
— ইয়ে, না মানে….
– আমার পাশে বসতো।
— …………
– এবার বল কি হয়েছে তোর?
— আন্টি। আমি এমনি। কিছু হয়নি।
– কিছু হয়নি তবে হোস্টেলে কেন থাকবি?
— ওহ, বাবা তোমাকে বলেছে?
– হ্যাঁ! আমাকে ফোন করে জানিয়েছেন…
— আসলে আন্টি হোস্টেলে থাকলে…(….)….???
– হ্যাঁ, বল। আমিও শুনতে চাচ্ছি।
— আসলে আন্টি ঐখানে থাকলে ঠিকঠাক মতো পড়াশুনা করতে পারব আর আমার রেজাল্টও ভালো হবে।
– এখানে করতে মানা করছে কে?
— কেউ না।
– তবে? তোকে আমরা রান্নাবান্নার সকল দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছি, তাইতো?
— এসব কি বলছেন আন্টি?
– এসব আমি নয়, তুই বলছিস। আমাকে দিয়ে বলাচ্ছিস।
— আন্টি রেগে কেন যাচ্ছেন?
– রাগিনি। রাগবোও না। তুই শুধু একটা কথা সত্যি করে বল, আমার অবর্তমানে এ বাড়ির কেউ তোকে কষ্ট দিয়েছে কি?
— না, আন্টি। এরকম কিছু হয়নি।
– তবে?
— হয়েছে একটা জিনিস…
– কি হয়েছে সেটাই তো জানতে চাচ্ছি।
— না, না! বলা যাবে না সে কথা…
– তুই কি আমার সাথে রসিকতা করছিস?
— ছি, ছি! এসব কি বলছেন?
– মনে তো হচ্ছে সেটাই।
— আসলে আন্টি কথাটা আপনাকে বলা যাবে না।
– কি এমন কথা যা আমাকে বলা যাবে না?
— বাদ দেন না।
– তোর কি শারীরিক কোনো সমস্যা হয়েছে?
— না, না আন্টি। সেরকম কোন সমস্যা নেই।
– তবে?
— সমস্যাটা মানসিক।
– আমাকে বলবি? নাকি আঁখিকে পাঠাবো?
— না আন্টি।
– তাহলে বর্ণিতা না করে বলে ফেল…
— আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না আন্টি। ওরা আদনানকে আমার কাছে দেয় না।
– ওহ, গড! এই কথা?
— রাত্রে ঘুম হয় না। খুব কষ্ট হয়।
– আর তাই সেই কষ্ট নিরসনের জন্য হোস্টেলে চলে যেতে চাচ্ছিস, তাই তো?
— কষ্ট নিরসনের জন্য নয় আন্টি। আমার এমনিতেও ভালো লাগছে না। পড়াশুনায় মন টিকছে না। মনে হচ্ছে হোস্টেলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে। সবার দেখাদেখি আমিও কিছু পড়তে পারবো।
– ঠিক আছে। আর মাত্র পনেরো দিন আছে। তারপরেই তো রোজা শুরু। তুই বরং ঈদের পর যা…
— না, আন্টি। আমার আর একমিনিট সময়ও নষ্ট করতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আমি কালকেই যেতে চাচ্ছি।
– ঠিক আছে। আমি তবে হোস্টেল সুপারকে ফোন দিয়ে জেনে নেই খরচের ব্যাপারে।
— আচ্ছা।
– ঘুমা তাহলে। সকালে উঠে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিস। আসি…
— আল্লাহ হাফেজ।

হিয়া চলে যায়। বালিশ কোলে নিয়ে, খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে নুহা। বড্ড কান্না পাচ্ছে ওর। এ বাড়ি থেকে চলে যাবে ভাবতেই চোখ জলে ভরে গেছে। কিন্তু ফারহানা এ বাড়ি থেকে যাচ্ছে না। শুভও হাত পা গুটিয়ে বসে আছে। আদনানকে আগের মতো আপন করে কাছে পাবে না। এ ব্যাপারটা’য় নুহাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার ইন্দ্রন জুগিয়েছে।
অনেক রাত হয়েছে। ভোরে উঠতে হবে আবার। কালবিলম্ব না করে তাই বিছানায় গা এলিয়ে দেয় নুহা।
চোখটা প্রায় লেগে এসেছিল। তখনি দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। বিছানায় উঠে বসে নুহা। এতরাত্রে কে এসেছে? ভাবতেই আবারো কড়া নাড়ার আওয়াজ পায়।
নুহা নেমে যায় বিছানা থেকে। ওড়নাটা সুন্দর করে নববধূদের ন্যায় মাথায় এবং শরীরে জড়িয়ে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
দরজার একদম কাছে গিয়ে কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে, কে?
বাহির থেকে ভেসে আসে, ‘আমি…’
শুভর কন্ঠ শুনে চমকে যায় নুহা। ভাবতে থাকে- এত রাতে ওনি আবার কি মনে করে? দরজায় আবারো কড়া নাড়ার শব্দ হয়। ভাবনা জগত থেকে ফিরে আসে নুহা। দরজাটা খুলে দেয়।

– ডিস্টার্ব করলাম মনে হয়। স্যরি…
— না, না। ইটস ওকে।
– এটা কি তোমার? (হাতে একটা কানের দুল)
— হ্যাঁ, কোথায় থেকে পেয়েছেন এটা?(কানে হাত দিয়ে অবাক হয়ে)
– আমার শার্টের বোতামের মধ্যে আটকে ছিল।
— ওহ…(লজ্জায় নিচু হয়ে যায়)

নুহার লজ্জানত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে শুভ। লজ্জায় মুখমন্ডল কিরকম লাল হয়ে গেছে। বোধ হয় তখনকার কথা ভেবে লজ্জা পাচ্ছে।
‘ওহ, হ্যাঁলো! শুনতে পাচ্ছেন?’
ডাক দেয় নুহাকে। নড়ে উঠে নুহা। শুভর দিকে না তাকিয়েই হাত বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে।
কিচ্ছু বলেনি শুভ। নুহার হাতে দুলটা রেখে নিঃশব্দে নিজ রুমে চলে যায়।
দরজা বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে ধপাস করে বসে পড়ে নুহা। এই মানুষটাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে, ভাবতেই নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর। চোখজোড়া বোজে ঘন ঘন নিশ্বাস নিচ্ছে নুহা। একটা অচেনা কষ্ট ওর ভিতরটা কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।
‘ওনার জন্য আমার এরকম লাগছে কেন? ওনি আমার কে? ভালোবাসা? কখনো তো মুখে বলেনি! আচ্ছা, ওনি তো বলেছেন আমাকে নাকি বিশ্বাস করেন। তবে কি ওনি আমাকে ভালোবাসেন? ধূর! কিসব ভাবছি। বিশ্বাস আর ভালোবাসা তো এক জিনিস হতে পারে না…’
এরকম হাজারো প্রশ্ন আনমনে নুহা নিজে নিজেকে করে। কোন প্রশ্নের সঠিক কূল কিনারা সে পায়নি। ভাবতে ভাবতে একসময় ক্লান্ত নুহা তলিয়ে যায় গভীর ঘুমে।

সকালে দরজায় কড়াঘাতের আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে। বাহির থেকে হৃদয় আঙ্কেল ডাকছেন। ‘কই নুহা মা! আজান দিয়েছে। নামাজ পড়বে না? উঠো…’
চটজলদি বিছানায় উঠে বসে নুহা। জ্বি, আঙ্কেল। উঠছি। আপনিও এখন যান। নামাজ পড়ে আসেন।
হৃদয় চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায়, আঁখি এবং হিয়াকেও ডেকে উঠানোর জন্য।
দরজা খুলে নুহা। শরীর টানা দিতে দিতে আঁখির রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজায় নক করবে তখনি পাশের অই কিচেন থেকে ভেসে আসে কারো গলা।
“আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছো না কেনো
তবেই না নষ্ট হওয়াতে আনন্দ…”

আঁখি আপু না? থমকে দাঁড়ায় নুহা। ভিতরটা শিউরে উঠে ওর। তবে কি আমার ধারনায় ঠিক? আঁখি আপু সত্যিই কোন মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে আছে। কিন্তু কে দিচ্ছে এই যন্ত্রণা? আর কাকেই বা বলছে এ কথা? নিষিদ্ধ কোন সম্পর্কে জড়িয়ে গেলো না’তো?
কিচেন থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ ভেসে আসে। ভাবনাচ্ছেদ ঘটে নুহার। দ্রুত কিচেনের দিকে এগিয়ে যায়। ফোন হাতে গাল গড়িয়ে পরা জলটুকু মুছছে আর ডায়েরী থেকে একটা একটা পাতা ছিড়ে আগুনে জ্বালিয়ে দিচ্ছে।
কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে নুহা। চোখের কোণে জমে থাকা জলটুকু দ্রুত মুছে নিয়ে পিছু ফিরে তাকায় আঁখি।

– ওহ, নুহা…!
— হু, আমি। কাঁদছো কেন?
– কই কাঁদছি না তো।
— আমি স্পষ্ট দেখছি তুমি কাঁদছ আর…
– রুমে যা নুহা। ভালো লাগছে না আমার।
— ভালো লাগানোর জন্যই তো এলাম।
– মানে?
— নামাজ পড়বে, আসো…
– তুই যা। আমি একটু পর….(…..)….???
— একটু পর না। এখন আসো।
– উফফ! একটু শান্তিতে থাকতে দে।
— নামাজ মানুষের মনে শান্তি আনয়ন করে, জানো কি?
– ঠিক আছে, চল…

হিয়া আন্টিকে জাগিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে পড়ে নুহা। পাশেই দাঁড়ায় আঁখি। নুহার নামাজ শেষ সাথে সাথেই। কিন্তু আঁখি সেই কখন থেকে মোনাজাতের ভঙ্গিতে বসে আছে। মোনাজাত শেষ হওয়ার নাম নেই।
নুহা গভীর দৃষ্টিতে আঁখির দিকে তাকায়। আঁখির চোখের জলে গাল ভিঁজে একাকার হয়ে গেছে। চোখ মুখ ফুলে গেছে। ভিষণ অদ্ভত রকম দেখাচ্ছে তাকে। না জানি মানুষটার ভিতর দিয়ে কতবড় ঝড় বয়ে যাচ্ছে।
‘ কিরে? এভাবে কি দেখছিস?’ ভাবনাচ্ছেদ ঘটে নুহার। ফিরে তাকায় আঁখির দিকে। ওহ, আপু। তোমার হলো?

– হু…
— মনটা কি খুব খারাপ?
– না।
— খুব বেশী খারাপ থাকলে কোরআন তেলওয়াত করো কিছুক্ষণ যেহেতু অজুটা আছে…
– না, এখন অনেকটাই ভালো লাগছে।
— আরো ভালো লাগবে, এক দুই পাতা কুরআন তেলওয়াত করে নাও।
– আমার ভালো লাগছে নুহা।
— এটা আমি তোমার খারাপের জন্য বলছি না আপু। পড়লে তোমার’ই উপকার।
– আসলে নুহা আজ আমি কুরআন তেলওয়াত করতে পারবো না।
— ঠিক আছে। তুমি তাহলে আমার পাশে বসো। আমি কুরআন তেলওয়াত করবো, তুমি সেটা শুনো।
– আচ্ছা…

নুহা কুরআন তেলওয়াত করছে আর আঁখি গভীর মনোযোগের সহীত সেটা শুনছে। মিনিট দশেক পর রুমে ঢুকে আদনান। দৌঁড়ে এসে দু’জনের মাঝখানে বসে।
কুরআনটা বন্ধ করে নুহা ফিরে তাকায় আদনানের দিকে। আদনান বিনীত ভঙ্গিতে নুহাকে সালাম দেয়-
” আসসালামু আলাইকুম, আম্মু…”
চমকে যায় আঁখি। ফিরে তাকায় নুহার দিকে। নুহাও যে অবাক হয়নি, তাও কিন্তু নয়।
” ওয়ালাইকুম আসসালাম, বাবা…”
কুরআন মাজিদে চুমু খেয়ে যথাস্থানে রেখে দিয়ে ছোট্ট আদনানকে কোলে তুলে নেয় নুহা। তারপর আদনানের কপালে একটা চুমু খায়।
পাশ থেকে আঁখির প্রশ্ন-
” আদনান বাবা! তোমাকে আসসালামু আলাইকুম বলা কে শিখিয়েছে?”
আদনানের ছোট্ট জবাব, আম্মু…
আঁখি ফিরে তাকায় নুহার দিকে। স্মিতহাস্য নুহার জবাব, আসলে সেদিন সকালে হিয়া আন্টিকে যখন সালাম দিয়েছিলাম তখন ও সাথেই ছিল। তারপর যা বললো- “আম্মু তুমি আসসালাম কও ক্যা?”
– কি?
— ইতটু আগে নানুরে কি কইছ? আব্বুরেও একদিন কইছিলা…
– কইছিলা নয় বলছিলা, বাবা…
— তুমি আসসালাম কও ক্যা?
– ওহ, আচ্ছা! এটাকে সালাম বলে বাবা। সালাম দিলে আল্লাহ খুশি হয়।
— আমিও আসসালাম বলবো আম্মু।
– ঠিক আছে বাবা। আগে শিখে নাও। তারপর…

আঁখি একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে। নুহা জানায়-
” তারপর থেকে ওকে সালামটা শিখাতে থাকি। ঠিকঠাক উচ্চারণ করতে পারতো না কখনো। কিন্তু আজ এ কেমন কারিশমা দেখালো…?”

চলবে…

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব-১৪

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব-১৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

কাঁদতে থাকে আদনান। ওকে যে করেই হোক বিষ দিতেই হবে। সবার শত নিষেধ, শত কথার পরও ও কিছুতেই কারো বুঝ মানছে না।
চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল নুহা। কাছে আসে আদনানের। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দু’গাল স্পর্শ করে। ‘বাবা! এসব খেতে নেই। এইসব পঁচা খাবার। খেলে অসুখ হয়…।’
– আব্বু কেন বলল তখন?
— কি বলছে?
– বিষ খেতে।
— তোমার আব্বুর ভুল হয়ে গেছে।
– খিদে লাগছে। ভাত খাবো।
— আসো। চেয়ারে আসো….

বাড়ি ভর্তি মানুষের কারো কথা শুনেনি। অথচ নুহার দু’কথায় শান্ত হয়ে যায় ছোট্ট আদনান। তারপর আর কোন কথা বলতে হয়নি। কোন কথা ছাড়াই চুপচাপ খাবার খেয়ে উপরে রুমে চলে যায়।
একে একে সবাই টেবিল ছেড়ে চলে যায় শুভ নুহা ছাড়া। শুভও উঠছিল। পাশ থেকে ধীর গলায় বলে উঠে নুহা। ‘কাজটা আপনি ঠিক করেননি।’

থমকে দাঁড়ায় শুভ। নিচু গলায় জবাব দেয়।
– আসলে মন মেজাজ ভালো ছিল না।
— হুটহাট রাগ করা ভালো না। রাগটা আসার সময় হয়তো টের পাওয়া যায় না। কিন্তু যাওয়ার সময় টের পাওয়া যায় কতটা ক্ষতি হয়েছে।
– জানি।
— জানেন বলেই তো আজ এতবড় একটা ভুল করে ফেলেছেন।
– বিষটা আসলে ওকে নয় ঐ ফাজিল মহিলাকে খাওয়ানো উচিৎ।
— জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে সবই আল্লাহর হাতে। বিধির বিধান লঙ্ঘন করার চেষ্টাও করবেন না কখনো। তওবা করে দ্রুত আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন।
– কিসের ক্ষমা? ঐ মহিলা তো একটা কীট। যে সংসারে যাবে অশান্তি বয়ে যাবে। ওকে মেরে ফেললে আমার সওয়াব হবে।
— হে আল্লাহ রহম করেন আপনার এই বান্দাটার উপর। সদয় হোন আপনি তার প্রতি।
– ভুল কিছু বললাম কি?
— মহাভুল। সংসারের শান্তি আনয়নের জন্য কোথাও মানবহত্যার বিধান নেই। তার জন্য আল্লাহ আছেন। আপনি তার কাছে সাহায্য চান। নিরাশ হবেন না।
– কিন্তু আমার তো একে সহ্য হচ্ছে না একদম।
— একটা কথা বলব?
– জ্বি, বলো…
— ওনি কি সত্যিই ব্যাংক ম্যানেজারের হাত ধরে চলে গিয়েছিলেন?
– কেন? সন্দেহ আছে?
— সেটা নয়। প্রশ্নটা হলো আপনি কিভাবে জানলেন ওনি অন্যের হাত ধরে বাড়ি ছেড়েছে?
– আমার বন্ধু বলেছে।
— আপনি অন্যের কথায়…(…..)….???
– আমার বন্ধুই ওর বর্তমান হাজবেন্ড।
–হায় আল্লাহ! এসব কি বলছেন?
.
– হ্যাঁ। আমরা প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম। খুব ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং ছিল আমাদের মধ্যে। শত ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করে আমি ওকে নিয়ে এখানে ওখানে ঘুরতে যেতাম। এভাবেই কাটছিল আমাদের দিন। হঠাৎ ও অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওকে আমি আমার থেকেও বেশী ভালোবাসতাম। অফিস কামাই করে আমি ওর সেবাযত্ন শুরু করি। একসপ্তাহ পর যখন আমি অফিসে যাই তখন বস আমাকে কাজ থেকে বের করে দেয়।
–মানে কি? আপনি সাতদিনে একবারও ওদের সাথে কথা বলেননি? মানে ফোনে যোগাযোগ করেননি?
– নাহ! এতবেশী চিন্তিত ছিলাম যে ভুলে গেছিলাম আমি ইহজাগতিক সবকিছু।
–তারপর?
– একবছর পর আদনান আসে পৃথিবীতে। তখনো আমার চাকরী হয়নি। চেষ্টা যে করিনি তাও কিন্তু নয়।
–কলেজে জয়েন করলেন কখন?
– তখনি। বন্ধু রুহুলের অনুরোধে গেস্ট টিচার হিসেবে জয়েন করি ওর কলেজে। ফাঁকে ফাঁকে চাকরীর ইন্টারভিউও দিতে থাকি।
— তখন সংসার কিভাবে চলতো?
– আমার বন্ধু যে ব্যাংকে জব করত সে হুট করে হাতেমতাই হয়ে যায়।
— মানে?
– মানে ও আমার দুর্দিনে সুপারম্যানের মতই আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমাকে টাকা দিয়ে হেল্প করে।
— ওরা পালিয়েছে কখন?
– তিনমাস পর।
— ওদের পরিচয়টা কি তিনমাসেরই ছিল?
– জানি না।
— আপনি কিছুই টের পাননি?
– শেষের দিকে কিছুটা টের পেয়েছিলাম।
— কিভাবে?
– ফারহানার ফোনে কথা বলার মাত্রাটা বেড়েই চলছিল।
— মায়ের সাথেও তো কথা বলতে পারে।
– গভীর রাতে? কি এমন দরকার?
— ঘুম থেকে উঠে গিয়ে কথা বলত?
– হু।
— কি সমস্যা জিজ্ঞেস করেননি ওনাকে?
– করেছিলাম। ভুলভাল জবাব দিত।
— যেমনঃ
– ও আমাকে বলে, বিশ্বাস করো। চাকরী সংক্রান্ত বিষয়ে আপনজনদের সাথে কথা বলছি। বলেছিলাম আমি, এ বিশ্বাসের অমর্যাদা করো না। ও আমার গা ছুঁয়ে তারউপর বিশ্বাস রাখতে বলল।
— সত্যিই কি রেখেছিলেন বিশ্বাস?
– ওর উপর বিশ্বাস আমি রেখেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম মোবাইলে কথা বলার সময় সে হাসিখুশি থাকত। কথা বলার শেষ হলে সে বিরক্ত হতো। সময়ে অসময়ে ছোট্ট অবুঝ শিশুকে বিছানায় ছুঁড়ে মারত। তখন থেকে তার প্রতি বিশ্বাস আমার কমতে লাগলো।
— তারপর?
– ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গেলে মানুষের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। আমারও একসময় ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটল। ক্ষুব্ধ
হয়ে তার কাছে জিজ্ঞাসা করলাম, কার সঙ্গে কথা বলো, কি কথা বলো? এতে সে বিরক্ত হলো। এমন ভাব দেখাল, যেন আমাকে বিয়ে করে সে মস্ত বড় ভুল করেছে। বিষয়টা আমার পৌরুষে আঘাত করল। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। তাকে আঘাত করলাম।
— ভালো কোন পরিবর্তন এসেছিল কি?
– না। বরং দিনদিন তার মোবাইল ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল। সেই সঙ্গে বাড়তে থাকল আমার প্রতি অবহেলা।
— তারপর?
– একদিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম, বিছানায় ফারহানা নেই। বাথরুমেও লাইট জ্বলছিল না। বারান্দায় গিয়ে দেখলাম সে মোবাইলে কথা বলছে। মাথায় খুন চেপে গেল। হাত থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে তাকে চড়-থাপ্পড় মারতে লাগলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল।
— এরপর কি হলো?
– এর পরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। ফারহানা আমাকে আর আদনানকে ছেড়ে চলে গেল।

বড়সড় নিশ্বাস ফেলল নুহা। প্রশ্ন করল শুভকে। “এবার আপনার জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি কি কিছু বলতে পারি?”
– অবশ্যই…(শুভ)
— ফারহানা চলে যাওয়ার পর ঘরের মতো মনটাও ফাঁকা হয়ে গেল। সেই ফাঁকা মনে আর কেউ বিশ্বাসের ছোঁয়া ফেলতে পারেনি।(নুহা)
– জীবন কোন গল্প নয় মিসেস নুহা।
— জীবন দিয়েই তো গল্প রচিত হয়।
– তা হয়। কিন্তু আমার অবস্থানে দাঁড়িয়ে বিশ্বাস সংক্রান্ত তুমি যে ডায়লগটা দিলে, সেটা ভুল।
— মানে বিশ্বাসের ছোঁয়া ফেলতে পেরেছে কেউ?
– হ্যাঁ, পেরেছে।
— কে সেই ললনা? নামটা জানতে পারি?
– হায়, আল্লাহ! তোমার ওড়নায় এটা কি? সাপ নাকি বিচ্ছু? কিরকম ঘাপটি মেরে বসে আছে।

শুভর কথায় ভয়ে লাফিয়ে উঠে নুহা। ‘ও মাগো, ও বাবাগো’ বলে ছুঁড়ে ফেলে দিল পরনের ওড়না। জাপটে ধরলো শুভকে। কান্নাজড়িত গলায় বার বার বলতে লাগল- ” পিপিপ্লিজ, ফেলে দিন। পিপিপ্লিজ, ফেলে দিন। আমি ভিষণ ভয় পাই বিচ্ছুকে। পিপিপ্লিজ…”
ঐভাবেই জড়িয়ে রাখে শুভ নুহাকে। তারপর অনেকটা আদুরে গলায় সুর তুলে বলতে শুরু করে
‘তুমি, তুমি, তুমি… তুমি, তুমি, তুমি….’
ভয়টা তখনো রয়েই গেছে নুহার। মাথা তুলে শুভর মুখের দিকে তাকায় সে। তারপর অনেকটা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে, কিসের তুমি?
স্মিতহাস্যে শুভর জবাব। ‘প্রশ্নটা ছিল- ফারহানা চলে যাওয়ার পর কোন ললনা আমার মনে বিশ্বাসের ছোঁয়া ফেলতে পেরেছে? তারই উত্তর বললাম হলো- ‘তুমি’……

শুভর থেকে সরে দাঁড়ায় নুহা। লজ্জায়, সুখে ওর মুখটা অদ্ভুতরকম সুন্দর দেখাচ্ছে। গাল দুটো একদম লাল হয়ে গেছে। শুভর বড্ড ইচ্ছে হচ্ছিল গাল দুটো একবার ছুঁয়ে দিতে। এগুচ্ছিলও সামনে। তারআগেই উপরতলা থেকে ডাক পড়ে হিয়া আন্টির। ‘ কইরে শুভ! কই গেলি….’
‘আসছি ফুপ্পি’ বলেই দুরে পরে থাকা ওড়নাটা যতনে হাতে তুলে নেয় শুভ। এগিয়ে যায় নুহার দিকে। নুহা তখনো নিচের দিকেই তাকিয়ে আছে। কিচ্ছু বলেনি শুভ। শুধু ওড়নাটা সুন্দর করে নুহার মাথায় দিয়ে দেয়। যাওয়ার সময় ছোট্ট করে বলে যায়- ” স্যরি! জানতাম না তুমি বিচ্ছুকে ভয় পাও। জানলে এটা নিয়ে ফান করতাম না….”

দেখতে দেখতে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায় শুভ। সম্ভিত ফিরে নুহার। ডাক দেয় শুভকে। ‘দাঁড়ান….’
থমকে দাঁড়ায় শুভ। সিড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠে নুহা। সামনে গিয়ে দাঁড়ায় শুভর। তারপর অনেকটা ধীর গলায় বলে- ” আল্লাহ মিথ্যেবাদীকে পছন্দ করেন না। মিথ্যে বলা মহাপাপ। আশা করি, এরপর থেকে মিথ্যে বলবেন না। কৌতূক করেও না….”

কথাটা বলেই দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে নুহা।
দীর্ঘশ্বাসের সাথে ঠোঁটের কোণে একটা হাসি ফুটে উঠে শুভর।

চলবে….

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ১৩

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মিনিট তিনেক অতিবাহিত হওয়া মাত্রই নুহা ওর হাতটা দ্রুত ছাড়িয়ে নেয়। কিছুটা অবাক হয়ে শুভ নুহার দিকে তাকায়। জবাবে কিচ্ছু বলেনি নুহা। ব্যাগ থেকে সেফ্টিপিন বের করে চলন্ত রিক্সায়’ই মুখটা ঢেকে নেয়।

হাত ছাড়িয়ে নেয়ার কারণটা এতক্ষণে বুঝতে পারে শুভ। প্রতিদিনকার মতই সেদিনও নুহা বাসা থেকে বের হওয়ার আগেই বোরকাটা পরে নেয়। কিন্তু এভাবে ফারহানার অপ্রত্যাশিত আগমন, আদনানকে কেড়ে নিয়ে যাওয়া, ফারহানা শুভর কাছে আসা এসব নানাবিধ কারণে নুহা বেশ উদাসীন ছিল। যার দরুন মুখ ঢাকতেই ভুলে গেছে।

ভিষণ অনুতপ্ত হয় নুহা। একটু উদাসীনতার জন্য আজ রাস্তার শত, শত মানুষ দেখেছে। হে আল্লাহ! মাফ করো আমায়। আর কখনো এমন হবে না।
আনমনে নুহা নিজেই নিজের সাথে কথা বলছিল। সেটা দেখে পাশ থেকে বলে উঠে শুভ, মানুষ মাত্রই ভুল হয়। আর কাজটা তোমার সম্পূর্ণ ইচ্ছের বিরুদ্ধেই হয়েছে। এত অনুশোচনায় ভুগার কি আছে? সব ঠিক হয়ে যাবে।
জবাবে শুধু ফিরে তাকিয়েছিল নুহা। এর বেশী কিছু করেনি।

দেখতে দেখতে অতিবাহিত হয়ে যায় মিনিট বিশেক। নুহা পৌঁছে যায় কাঙ্খিত গন্তব্য তথা কলেজ গেইটে। নেমে পড়ে রিক্সা থেকে। ভাড়া দিতে গেলে বাঁধা দেয় শুভ। ‘ মামা! ভাড়া আমি দেবো। চলেন সামনে….’
নুহা কিছু বলতে যাবে তার আগেই রিক্সা চলতে শুরু করে। একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে নুহা। তারপর হাঁটতে শুরু করে…

কোর্টে যায় শুভ। পুরু ব্যাপারটা খুলে বলে পরিচিত আংকেল তথা উঁকিল শহিদুল ইসলাম আকাশকে। পরের কথোপকথনঃ-

শুভঃ- আমি তাহলে গ্রামে যাই…!
উঁকিলঃ- হ্যাঁ, তুই গ্রামে যা। ঐ ডিভোর্স লেটার যেটা ফারহানা তোর কাছে পাঠিয়েছিল সেটা নিয়ে আয়।
তারপর ডিভোর্স বলিস আর যায় বলিস, সবই হবে। আপাতত যা বলছি সেটা কর।
শুভঃ- Tnq you, Uncle.
উঁকিলঃ- You are most welcome…

উঁকিলের থেকে বিদায় নিয়ে শুভ রওয়ানা দেয় কুমিল্লার উদ্দেশ্যে। কুমিল্লার চান্দিনা শুভর গ্রামের বাড়ি। শুভকে এখন সেখান থেকে প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র নিয়ে আসতে হবে। ‘কেন যে সেদিন কাজটা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। আপনমনে নিজে নিজেকেই গালি দিচ্ছে শুভ।

বিকেল ৩টা বেজে ৪৫মিনিট। কলেজ থেকে বাসায় ফেরে নুহা। দাদীমা খাবার খাওয়ার জন্য ডাকতেছে। কিন্তু ওর সেদিকে খেয়াল নেই। ওর দু’চোখ খুঁজছে কেবল আঁখিকে। হ্যাঁ, আঁখিকেই। হিয়া আন্টির একমাত্র মেয়ে আঁখি। যাকে বেশ ক’মাস ধরে নুহা বড্ড উদাসীন দেখেছে।পড়াশোনা, খাওয়া-দাওয়া, নামাজ-রোজা কোনো কিছুই ঠিকমতো করছে না। ক’দিন ধরে তো ভার্সিটিতেও যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
মোটকথা, ইহজাগতিক সমস্ত কার্যক্রম থেকে আঁখি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে।
কেন এই নিরবতা? কি হয়েছে তোমার? প্রশ্নটা করেছিল নুহা।
জবাবে কিচ্ছু বলেনি আঁখি। এড়িয়ে যাওয়া ছাড়া…

যায় হোক। অনেক খুঁজার পর নুহা আঁখিকে স্টোররুমে ফ্লোরে বসে কিছু একটা পুড়তে দেখতে পায়। আগুন দেখে ভয় পেয়ে যায় নুহা। দৌঁড়ে যায় আঁখির কাছেঃ-

– আঁখি আপু! কি করছো তুমি এসব?
— ওহ তুই?
– হু, আমি। তোমায় খুঁজতে খুঁজতেই তো হয়রান প্রায়।
— কেন?
– এসব কি?
— আগুন।
– আগুনের ভিতর কি দিয়েছ সেটাই জানতে চাচ্ছি।
— কলিজা।
– কিসব উল্টাপাল্টা কথা বলছো?
— ভুল তো কিছু বলিনি।
– তাই বলে কলিজা?
— হ্যাঁ, কলিজা। অহর্নিশী পুড়ে। ভাগ্যিস সে পুড়ার গন্ধটা কেউ পায় না। তাইতো জানতেও পারে না কেউ ভেতরের খবর।
– আমি কিছুটা টের পাচ্ছি?
— কি?
– অন্তঃদহন…
— যা। ড্রেস চেঞ্জ করে খেয়ে নে।
– সেইজন্যই তো তোমাকে নিতে এসেছি। চলো তো…

নুহার অনেক জোড়াজুড়ির পর আঁখি খাবার খেতে রাজি হয়। নেমে যায় নিচে। খেয়ে নেয় দুপুরের খাবার।

আসরের নামাজ শেষে নুহা আবারো আঁখির রুমে গিয়ে হাজির।
– আপু আসবো?
— হ্যাঁ, আয়।
– কি করছিলে?
— গেইমস খেলছিলাম…
– গেইমসই যদি হয় ফোনটা কেন লুকালে?
— গোয়েন্দাগিরি শুরু করেছিস কবে থেকে?
– গোয়েন্দাগিরি না।
— তবে পিছনে কেন লেগেছিস?
– মনের খবর নেয়ার জন্য।
— কিহ? কিসের খবর???
– বর্ণিতা করো না আপু। মনটা যে তোমার ভালো নেই, এটা আমি অনেক আগেই টের পেয়েছি।
— ………….
– প্লিজ আপু! চুপ করে থেকো না। আমায় বলো। কি হয়েছে তোমার? কেন এই নিরবতা?
— যা, রুমে যা নুহা।
– আপু আমায় বেয়াদব হতে বাধ্য করো না।
— মানে কি?
– আমি আজকে আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এখান থেকে যাবো না।
— নুহা। রাগ উঠাবি না আমার। খুউব খারাপ হয়ে যাবে।
– আপু, সংযত করো নিজেকে। রাগকে প্রশ্রয় দিও না। রাগ আসে শয়তানের থেকে। যায় হোক। আমি আর বিরক্ত করতে চাচ্ছি না। চলে যাচ্ছি।

নুহা রুমে যায়। রাত্রি সাড়ে নয়টার দিকে শুভ আসে। সাথে একজন উঁকিল এবং এলাকার কিছু গন্যমান্য লোক। সবার সম্মুখে শুভ ঘোষনা দেয়,
‘আজ আমার আর ফারহানার সম্পর্কের চির সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে।’
এ ঘোষনায় নড়ে উঠে ফারহানার মা। ‘চির সমাপ্তি মানে? বাবা, তুমি কি বলছ এসব?
ক্ষাণিক হাসে শুভ। জানান দেয়, অবাক হওয়ার তো কিছু বলিনি আমি। আর খুব কঠিন কথা যে বলেছি, তাও কিন্তু নয়। তবুও আপনার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে?
পাশ থেকে ফারহানার জবাব, শুভ তুমি কি শুরু করছ এসব?
এবারো হাসে শুভ। ‘শুরু তো করেছ তুমি, তোমরা। যার শেষটা করব আমি।’

– মানে কিকিকিকি করবা?
— মন থেকে আমি তোমায় সেদিনই বের করে দিয়েছি, যেদিন শুনেছি তুমি ব্যাংক ম্যানেজারের টাকার প্রলোভনে আমাদের ছেড়ে গেছো। আজ আমি তোমাকে সর্বসম্মুখে এ বাড়ি থেকে বের করব।
নদর্মার বিষাক্ত কোন কীটকে আমি এ বাড়িতে স্থান দেবো না। কিছুতেই না।

শুভর দৃঢ় মনোবল দেখে ভয় পেয়ে যায় ফারহানা। জুড়ে দেয় মায়া কান্না। কাজ হচ্ছে না দেখে হুইল চেয়ার থেকে ইচ্ছে করে পড়ে যায়। জাপটে ধরে শুভর পা। একে একে হিয়া, ওর হাজবেন্ড এবং সবশেষে এলাকাবাসীর পা জাপটে ধরে। এ ঘটনায় মুরুব্বীরা বিব্রতকর অবস্থায় পরে যায়। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সবাই। ফারহানা তখনো ফ্লোরে বসে অবিরত কান্না করছে আর তাকে এ বাড়ি থেকে না তাড়ানোর মিনতি জানাচ্ছে।
কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল মুরুব্বীরা। কিন্তু সেটাও পারেনি। তার আগেই জ্ঞান হারায় ফারহানা।

ফারহানার মা এবং হিয়া দু’জনই ফারহানাকে ধরাধরি করে রুমে নিয়ে যায়। মুরুব্বীদের একজন জানায়- “জানি! মেয়েটা অন্যায় করেছে। কিন্তু ও যেহেতু আবারো ফিরে এসেছে এবং এমনভাবে ক্ষমা চাচ্ছে আমার মনে হয় ওকে একটা সুযোগ দেয়ায় যায়। কি বলেন উঁকিল সাহেব?”

উঁকিলঃ- হ্যাঁ, আমারও সেটাই মনে হচ্ছে। ওকে সংশোধনের একটা সুযোগ দেয়ায় যায়।
হৃদয়ঃ- কিন্তু মেয়েটি তো ওকে ডিভোর্স দিয়েছে।
মুরুব্বী-১ঃ- এরকম হয়। মানুষ এরকম ভুল করে।
মুরুব্বী-২ঃ- আবার এর সুন্দর সমাধা আছে।
হৃদয়ঃ- কি সেই সমাধা?
মুরুব্বী-৩ঃ- পুনরায় বিয়ে….
শুভঃ- অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিলাম। আর পারছি না। মাফ করবেন। আমার পক্ষে সেকেন্ড টাইম এই মেয়েকে বিয়ে করা অসম্ভব।
উঁকিলঃ- কিন্তু মেয়েটি তো পাগল…
শুভঃ- আংকেল আপনিও…..(….)….???
উঁকিলঃ- আরে বাবা! উত্তেজিত কেন হচ্ছিস তুই?
শুভঃ- যত যায় হোক। আপনার থেকে এটা আমি প্রত্যাশা করিনি আংকেল।
উঁকিলঃ- শান্ত হো। আজ মেয়েটি অসুস্থ হয়ে পরেছে। সুস্থ হোক। তারপর কালকে যা করার করা যাবে। আমি উঠি এখন।
মুরুব্বীরাঃ- আমরাও উঠি…

সবাই চলে যায়। উত্তেজিত শুভ ডান হাতটা মুঠো করে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পিছন থেকে কাঁধে হাত রাখে হৃদয়। ‘শান্ত হও। যা করার কালই হবে।’

রাত্রি ১১টা বেজে ৩৫মিনিট_
খাটে আধশোয়া অবস্থায় হেলান দিয়ে বসে আছে ফারহানা। তার পাশেই ওর মায়ের অবস্থান। দু’জনের চোখে মুখেই অদৃশ্য আলোর রেখা খেলা করছে…

এ বাসার সবাই নিচে ড্রয়িংরুমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে বিষণ্ন মনে। শুভ বসেছে সোফার ঠিক মাঝখানে। ছোট ছোট পায়ে উপরতলা থেকে ছুটে আসে আদনান। জাপটে ধরে শুভকে।
” বাবা! খিদে পেয়েছে।
আজকে আমি কি দিয়ে খাবো?”
মুহূর্তেই ঠাস করে শব্দ হয়। গালে থাপ্পর মারে শুভ আদনানকে। ‘যা এখান থেকে! বিষ খা গিয়ে…’

কান্না করতে করতে উপরে নুহার রুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় আদনান। শক্ত করে মুখটা চেপে ধরে কান্না করছিল নুহা। দরজার সামনে বাচ্চার কান্না আওয়াজ শুনে নিজেকে সংযত করে নেয়।
‘কে ওখানে?’
ভেতরে প্রবেশ করে আদনান। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে তখনো। সেটা দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারেনি নুহা। জাপটে ধরে আদনানকে। গালে, মুখে, নাকে চুমু দিতে দিতে দিতে বলে- ‘ কি হয়েছে বাবা? আব্বু আজো মেরেছে? বকে দেবো ওনাকে। আচ্ছা করে বকে দেবো।’

কান্না থেমে যায় আদনানের। ততক্ষণে নিচ থেকে খাবারের জন্য ডাক পড়ে। ছোট্ট আদনানকে কোলে নিয়ে ধীর পায়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নামে নুহা। মা মেয়ের খাবারটা উপরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে যেহেতু ওনারা না করেছে খাবেনা। ঐ মুহূর্তে টেবিলে উপস্থিত ছিল- আঁখি, হিয়া, হৃদয়, শুভ, নুহা এবং আদনান।

নিত্যকার নিয়মে সেদিনও নুহা নিজের প্লেট থেকে একমুঠো ভাত নিয়ে আদনানের মুখে এগিয়ে দেয়। আদনান মুখ ফিরিয়ে নেয়। নুহা আবারো আদনানের মুখের দিকে ওর হাতটা নিয়ে যায়। আদনান এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। নুহাও উঠে দাঁড়ায়-
” কি হলো? উঠলে কেন? খাবে না?”
আদনান রাগান্বিত স্বরে জবাব দেয়, আমি এগুলো খাবো না। আমি নতুন মজা খাবো।
আদুরে স্বরে নুহার প্রশ্ন, নতুন মজা? সেটা আবার কি?

” আমি বিষ খাবো…..”
চমকে উঠে সবাই। ফিরে তাকায় আদনানের দিকে। একটু সময়ের ব্যবধানে আদনান কাঁদার সাথে সাথে রাগে লাফাতে থাকে।

“আমার খিদে পেয়েছে। আমায় বিষ দাও। ভাতের সাথে বিষ মাখিয়ে দাও। আমি খাবো…!”

(বিঃদ্রঃ- রহস্য থাকবে এবং তার উন্মোচন হবে। শুধু ফারহানা নয়, পুরো গল্পটায় রহস্যে আবৃত। সকল রহস্যেরই উন্মোচন হবে, একটু একটু করে, ধীরে ধীরে। সেই পর্যন্ত সাথেই থাকুন ধৈর্য্য নিয়ে। ওহ, হ্যাঁ!একটা কথা না বললেই নয়। ৪বছরের ছোট্ট আদনান বিষ খাওয়ার জেদ ধরেছে কারণ, ও ওর জীবনের প্রথম নামটা শুনেছে ওর বাবার মুখ থেকে। তাই ভাবছে এটা না জানি কত মজার জিনিস….]

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ১২

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রুমে চলে যায় নুহা। বন্ধ করে দেয় দরজা। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর। কিন্তু পারছে না। দাঁতে দাঁত চেপে কান্নার শব্দটাকে ভিতরেই আটকে রাখার অদম্য চেষ্টা চলছে। চোখ দুটো বোজে রেখেছে নুহা। অজস্র জলরাশি গাল গড়িয়ে নিচে পরছে। ঠোঁটগুলো ছোট বাচ্চাদের ন্যায় মৃদু কাঁপছে।

দরজা খুলে বাহিরে যায় নুহা। পূর্বের ন্যায় আবারো জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। শুভর বুকে ফারহানা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। বাহির থেকে ওদের ভারী হয়ে যাওয়া নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। ওদের প্রতিটি নিঃশ্বাস নুহাকে ধারালো ছুরির ন্যায় ক্ষত-বিক্ষত করে দিচ্ছে। কান্না আটকাতে মুখ চেপে দ্রুত সে স্থান পরিত্যাগ করে নুহা।

নুহার কাছে মন খারাপের কারণ অজানা থাকলেও মন ভালো করার কারণটা বেশ ভালো করে জানা আছে। নুহা ওর জীবনে কারো কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেনি কেবলমাত্র আল্লাহ ছাড়া। মহান আল্লাহ তায়ালা জাগতিক সকল সমস্যার সমাধানদাতা। তাই যেকোনো প্রতিকূল অবস্থায় নুহা পরম সৃষ্টিকর্তার কাছেই সাহায্যের আবেদন জানান। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মন ভালোর মহৌষধ হিসেবে নুহা নামাজকেই বেছে নেয়। তাইতো অজু করে দ্রুত নামাজ পড়ে নেয়।

সকালে আদনানকে সাথে নিয়ে পড়তে বসছিল নুহা। দুজনেই নিজ নিজ পড়াশুনায় ব্যস্ত ছিল ভিষন। রুমে ঢুকে ফারহানার মা। কিছু না বলেই আদনানকে কোলে তুলে নেন। ‘ছাড়ো, ছাড়ো’ বলে কান্না শুরু করে দেয় আদনান। ফিরে তাকায় নুহা। মহিলাটিকে দেখে ইতস্তত নুহা ওর বই বন্ধ করে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।
” কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আদনানকে?”
– রুমে।
— ও’তো পড়বে এখন।
– সেই জন্য’ই নিয়ে যাচ্ছি।
— ………
– আগে ওর মা ছিল না। তাই তোমাকে পড়াতে হয়েছে। এখন ওর মা চলে আসছে। আশা করি, তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না।
— ……….
– আসো। লক্ষ্মী ভাই আমার। আসো, আসো। মায়ের কাছে পড়বে।

প্রচন্ড কান্না করছিল আদনান। তবুও কোল থেকে নামায়নি ওর নানী। নুহার চোখের সামনে দিয়ে আদনানকে নিয়ে যাওয়া হয় অন্য রুমে। চেয়ারে বসে পড়ে নুহা। শব্দ করে কেঁদে দেয়।

রুমের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল শুভ। চাপা গলায় কারো কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায় সে। ফিরে তাকায় নুহার রুমের দিকে। ‘হ্যাঁ, এ রুম থেকেই তো শব্দটা আসছে। কিন্তু এ রুমে এরকম করুণ স্বরে কে কাঁদছে? নুহা নয়তো?’
কৌতূহল মেটাতে নুহার রুমের দিকে পা বাড়ায় শুভ। দরজার সামনে থেকেই প্রশ্ন করে। ‘কে? কে কাঁদছে?’ রুমে অপ্রত্যাশিত মানুষের আগমনে চুপ হয়ে যায় নুহা। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আবারো প্রশ্ন করে শুভ। ‘কে কাঁদছে?’
চুপ হয়ে আছে নুহা। কান্নারা সব গলায় দলার মতো কুন্ডলি পাকিয়ে আছে।
আরো কাছে চলে আসে শুভ। জোর গলায় প্রশ্ন করে আবারো, ‘কি হলো? কথা বলছো না কেন? শুনতে কি পাচ্ছো আমার কথা?’
‘ আল্লাহ! ওনি তো দেখছি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এখন কি করব? সত্যিটা যে বলা যাবে না। মিথ্যেও যে বলা মানা। আল্লাহ! সাহায্য করো আমাকে….’

নুহার আকুল আবেদন বোধ হয় উপরওয়ালার কাছে সাথে সাথেই পৌঁছে গিয়েছিল। হয়তো সেজন্যই নুহার মাথা থেকে খসে পড়ে ওড়নাটা। আলগা হয়ে যায় খোপার বাধন। শুভর দৃষ্টি চলে যায় টেবিল থেকে সরাসরি মেঘকন্যার দীঘল কালো কেশের দিকে। এলোমেলো অবিন্যস্ত চুলে মেঘকন্যার পুরো মুখ ঢেকে গেছে। তৈরি হয় একটা অদৃশ্য পর্দা। সেই পর্দার আড়ালে গিয়ে মেঘের দেশের মেঘকন্যা দ্রুত তার চোখের জলটুকু মুছে নেয়। শক্ত করে মনকে। স্বাভাবিক হয়ে যায় অনেকটা।
এদিকে শুভ ওর পকেট থেকে ফোনটা বের করে দ্রুত। ভয়ে ভয়ে পিছন থেকে একটা ছবি তুলে নেয়।
ফোনের আলোটা নুহার চোখ এড়াতে পারেনি।পিছু ফিরে তাকায় চটজলদি।
হাবা মার্কা হাসি দিয়ে শুভ ওর হাতের ফোনটা উপরে তুলে নাড়াতে থাকে। জিজ্ঞাসো দৃষ্টি নিয়ে নুহা তখনো শুভর দিকে তাকিয়ে। আড়চোখে সেটা খেয়াল করে শুভ। নুহার প্রশ্ন করতে হয়নি। তার আগেই বোকা শুভর জবাব, ‘ইয়ে! নেট পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই দেখলাম ছবি উঠানো যায় কি না…’

– নেটের জন্য মানুষ ছবি নয় কল দেয়।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটাই।
– কি সেটাই?
— কল, কল…
– কিসের কল?
— নেট আনার জন্য।
– নেট আনার জন্য কল দেয় না মানুষ। যে জায়গায় নেট পাওয়া যায়, সেখানে যায়।।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ….
– কিসের হ্যাঁ, হ্যাঁ?
— দেখছিলাম এখানে নেট পাওয়া যায় কি না…
– নেটের জন্য কোন জায়গা লাগে না। আপনার ফোন নষ্ট হয়ে গেছে।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমার সেটাই মনে হচ্ছে।
– আমার কি মনে হচ্ছে জানুন?
— কি?
– ফোন নয় আপনার ভিতরে যান্ত্রিক কারিগরির কোন সমস্যা হয়েছে।
— Sorry….?
– আপনি অফিসে যাওয়ার আগে একবার হিয়া আন্টির চেম্বার থেকে ঘুরে আসুন, ধন্যবাদ।

লজ্জায় মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে যায় শুভ।
শুভ রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই দাদীমার(বুয়া) ডাক পরে। ‘কইরে নুহা-আঁখি! টেবিলে খাবার দিয়েছি। সবাইরে নিয়ে আয়….’

দাদীমার ডাকে সাড়া দিতে নিচে নেমে আসে নুহা। কারো কোন কথা ছাড়াই চুপচাপ টেবিলে বসে খেতে শুরু করে।
এদিকে আঁখির ডাকে বাকি সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়। খেতে বসে। ছোট্ট আদনান এসে বসলো নুহার পাশেই। প্রতিদিনকার মতো সেদিনও নুহা নিজের প্লেট থেকে একমুঠু ভাত আদনানের মুখে পুরে দেয়। আরেকমুঠু ভাত মুখে পুরে দেয়ার আগেই আদনানকে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে যায় ফারহানা। ‘ ও যথেষ্ট বড় হয়েছে! তাই এখন থেকে প্লেটেই খাবে ও। ওর খাওয়া দাওয়া নিয়ে আর কারো টেনশন করতে হবে না…’
ফারহানার কথার জবাবে কিচ্ছু বলেনি নুহা। চুপচাপ মাথা নিচু করে খেয়ে সে স্থান পরিত্যাগ করে।

ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে হু,হু করে কেঁদে উঠে নুহা। ওর চোখের সামনে দিয়েই একটু একটু করে সব প্রিয়জনরা দুরে সরে যাচ্ছে। অচেনা হয়ে যাচ্ছে চেনামুখ। বড্ড অচেনা। এতকিছু দেখেও সে কিচ্ছুটি করতে পারছে না, নিরবে সয়ে যাওয়া ছাড়া।
দরজায় কে যেন ধাক্কা দিচ্ছে। কান্না থামিয়ে প্রশ্ন করে নুহা, কে? বাহির থেকে শুভর গলা ভেসে আসে। ‘বাসায় এত ওয়াশরুম থাকতে, পুরুষদের ওয়াশরুমেই ঢুকতে হলো?’
নুহার চোখ চলে যায় ওয়াশরুমের চারিদিকে। বুঝতে পারে বড়সড় একটা ভুল করে ফেলেছে। চোখের জলটুকু মুছে দরজা খুলে নুহা। অতঃপর মাথা নিচু করে নিজ রুমে চলে যায়।
‘অদ্ভুত মানুষ’তো! একটা স্যরিও বললো না…’ নুহার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে শুভ।

এদিকে রুমে এসে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে নুহা। যত দ্রুত সম্ভব হোস্টেলে উঠবে সে। কলেজ হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করবে। আঁখির থেকে ফোনটা নিয়ে নুহা কল করে ওর বাবাকে।
ওর বাবা ফোন রিসিভ করে। ও জানায়- ‘পড়াশুনার সুবিধার্থে ওকে কলেজ হোস্টেলে থাকতে হবে।’ প্রতিউত্তরে ওর বাবা জানায়- ‘ ঠিক আছে, মা! আমি এক্ষুনি হিয়ার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলছি। ও আজকে আসার সময় সব ব্যবস্থা করে আসবে।’
তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা বলে তখনকার জন্য বিদায় নেয় বাবার থেকে।

কল কেটে একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে নুহা। রেডি হয়ে নেয় কলেজে যাওয়ার জন্য। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় শুভ।
” কই! হলো..?”
– আআআআপনি?
— বিশেষ দরকারে কোর্টে যাবো। তোমাদের কলেজের পাশ দিয়েই যেতে হবে। চলো। একসাথেই যাওয়া যাক…
– না, আপনি যান। আমি যেতে পারব।
— তুমিও চলো না।
– আমি যেতে পারবো।
— সেটা আমিও জানি। যাবে না। এটা বলে দিলেই হয়….

রাগ দেখিয়ে চলে যায় শুভ। কান্না লুকিয়ে বাসা থেকে বের হয় নুহা। বাসার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শূন্য রিক্সার জন্য। মিনিট দুয়েকের মধ্যে একটা শূন্য রিক্সা আসে। নুহা উঠে বসে। হুট করে কোথায় থেকে যেন শুভ চলে আসে। লাফিয়ে উঠে রিক্সায়। রিক্সা চলা শুরু করে। বিস্মিত নুহা চোখ বড় বড় করে শুভর দিকে ফিরে তাকায়।
” আপনি…?”
– হ্যাঁ, আমি। শুভ আমার নাম। কেন? কোন সন্দেহ আছে?
— সেটা না…
– তো?
— আপনার তো গা….(….)….???
– গাড়ি আছে। তবে রিক্সায় চড়তে আমার বেশী ভালো লাগে। আর তখন তো কোন কথায় নেই যখন পাশে…..
— কি?
– কিছু না।
— ওহ….

তারপর নিরবতা। ঘোর নিরবতা বিরাজ করে দুজনের মাঝে। হঠাৎ রিক্সার প্রচন্ড ঝাঁকুনিতে নুহা শুভর একটা হাত চেপে ধরে। শুভ ফিরে তাকায় নুহার দিকে। চোখাচোখি হয়। ইতস্তত নুহা হাতটা সরিয়ে নিতে চাইল। কিন্তু পারল না।
মিনিট পাঁচেক পর ওদের হাত দুটির ওপর নুহার আরেকটি হাত এসে ভর করল। শুভ ফিরে তাকায় নুহার দিকে।
লক্ষ্য করল, নুহার নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শুভ আরো খেয়াল করল, ওর হাতের মধ্যে রাখা নুহার হাত দুটো মৃদু কাঁপছে।

চলবে….

ফুলশয্যা_সিজন(০৩) পর্ব- ১১

0

ফুলশয্যা_সিজন(০৩)
পর্ব- ১১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

প্রচন্ড রাগে অগ্নিশর্মা শুভ তেড়ে যায় ফারহানার দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠাস করে একটা থাপ্পর মারে ফারহানার গালে।

এ ঘটনায় মোটেও প্রস্তুত ছিল না ফারহানা। চমকে যায় সে। ভেঁজা চোখে মাথা তুলে তাকায় শুভর দিকে। আমতাআমতা স্বরে প্রশ্ন করে-
‘ শুভ! তুমি আমায় মারলে?’
প্রশ্নোত্তরে কিচ্ছু বলতে পারেনি শুভ। তার আগেই রুমে প্রবেশ করে ফারহানার মা। মেয়ের প্রশ্নের জবাবটি মা-ই দিয়ে দেয়।
‘ বেশ করেছে মেরেছে….’

বেশ অবাক হয় ফারহানা। মায়ের দিকে তাকিয়ে অনেকটা অভিমানি স্বরে প্রশ্ন করে-
‘ মা তুমি….(….)….???’
পুরো কথা বলতে পারেনি। মা মেয়েকে থামিয়ে দিয়ে অনেকটা শাসনের স্বরে বলে-
‘ ও তো একটা দিয়েছে! অন্য কেউ হলে এতক্ষণে আরো কয়টা পরতো গালে…!’
জবাবে কিচ্ছু বলেনি ফারহানা। শুধু জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় মায়ের দিকে। মা তার মেয়ের দৃষ্টির ভাষা বুঝে নেয় অতি সহজেই। জবাব দেয়-
‘ তুই যাকে কাজের মেয়ে হিসেবে আখ্যায়িত করেছিস সে কে জানিস? একসময়কার সাড়া জাগানো তরুণী ডাক্তার নীলিমা এবং বিশিষ্ট শিল্পপতির নাতনী আদিরা মাহমুদ নুহা। এই মেয়ের বাবা ঢাকা……(…)….কলেজের একজন সুনামধন্য শিক্ষক ছিলেন। বর্তমানে মেয়েটির মা অসুস্থ তাই তার স্ত্রীকে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে আছেন….!’

এতটুকু বলে থেমে যায় ফারহানার মা। অনেক কিছু বলার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সুযোগ পায়নি শুভ। তাই প্রচন্ড রাগ নিয়ে রুম থেকে বাহির হয়ে যায়।

এতক্ষণে মুখ খুলে ফারহানা। চাপা গলায় প্রশ্ন করে মাকে- ‘সবই তো বুঝলাম মা! কিন্তু ঐ মেয়ে এ বাড়িতে কি করে? মানে ও যেভাবে কাজ করে দৌঁড়াইয়া দৌঁড়াইয়া, দেখে তো মনে হয় না বেড়াতে এসেছে….’
মেয়ের প্রশ্নে মায়ের জবাব, আরে! তোর ফুপু শাশুড়ির পরানের বান্ধবী ছিল ডাক্তার নীলিমা। মায়ের অনুপস্থিতিতে ওনিই মেয়েটিকে মাতৃস্নেহ দিয়ে লালন পালনের দায়িত্ব নিয়েছেন।
বড়সড় নিশ্বাস নেয় ফারহানা। ‘ওহ, তাই বলো। সমস্যা নেই। ওনাদের যা ইচ্ছে করুক গিয়ে। কি বলো, মা?’
শয়তানি হাসি দেয় ফারহানার মা। জবাব দেয়,
‘হ্যাঁ, সেটাই! আমাদের এতকিছু জেনে লাভ নেই। আমাদের কাজ নিয়ে ভাবা যাক আপাতত….’

রাতের খাবারের পর ফারহানা গিয়েছিল পাশের রুমে। আসার পর থেকে ছেলেকে একবারও দেখা হয়নি। যদিও তার ছেলেপিলে তে কোন নেশা নেই। তথাপি লোকদেখানোর জন্য উঁকি দেয় পাশের রুমের পর্দা ধরে।
আদনানকে পড়াচ্ছিল নুহা। আদনানও শান্ত বালকের ন্যায় নুহার কথা মতোই পড়ছিল। দরজার ওখান থেকে বলে উঠে ফারহানা- ‘ আসব…?’

দরজার দিকে তাকায় নুহা। ফারহানার মুখটা দেখে বুকের ভেতর ধুকপুকানি শুরু হয়। মনে হচ্ছে, কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে দুরমুশ পিটাচ্ছে ভেতরে।

নুহার অনুমতি দিতে হয়নি। তার আগেই রুমে ঢুকে পড়ে ফারহানা। আদনানের ঠিক পাশেই হুইল চেয়ারে বসে আছে ফারহানা। প্রশ্ন করেন ছেলেকে- ‘কেমন আছে আমার বাবা’টা?’
মনোযোগী স্টুডেন্ট আদনান বিজ্ঞদের ন্যায় অনেকটা বিরক্তিকর দৃষ্টিতে ফিরে তাকায় ফারহানার দিকে। ফারহানা আবারো প্রশ্ন করেন ছেলেকে, ‘বাবা! কেমন আছো তুমি?’
ফারহানার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আদনান ফিরে তাকায় নুহার দিকে। প্রশ্ন করে নুহাকে, ‘আম্মু! কি হয় ওনি তোমার?’
ঘোর কাটে নুহার। দীর্ঘশ্বাসের সাথে জবাব দেয়, আপু…! ওনি আমার আপু হয় আদনান…
কিছুক্ষণ একমনে কি যেন ভাবলো আদনান। তারপর হঠাৎ করেই প্রশ্ন করে বসে ফারহানাকে, ‘তুমি আমার আন্টি লাগো, তাই না?’

ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় ফারহানা। ভ্রু-কুঁচকে প্রশ্ন করেন ছেলে আদনানকে। ‘মানে? আমি তোমার আন্টি হই মানে? কে বলেছে তোমায় আমি তোমার আন্টি হই?’
হেসে দেয় আদনান। মুরুব্বীদের মতো করে জবাব দেয়, এটা আবার বলে দিতে হবে নাকি? আঁখি আন্টিও তো আমার আম্মুর আপু হয় আর আমার আন্টি হয়। তুমিও তো আম্মুর আপু। আমার তো আন্টি’ই লাগো, ঠিক না?

হো, হো করে হেসে দেয় ফারহানা। কোলে তুলে নেয় ছেলেকে। ‘ওরে পাকনা বাবাটা আমার! ওনি তোমার মা নয়, আমি তোমার মা। আর আমি তোমার আন্টি নয়, ওনি তোমার আন্টি, নুহা আন্টি। কি নুহা? ঠিক বলছি তো?’
দম আটকে আসছে নুহার। বহু কষ্টে জবাব দেয়, হু…

রাগ উঠে যায় আদনানের। ফারহানার বাহু থেকে নিজেকে মুক্ত করে নেয়। নুহার কোলে গিয়ে বসে পড়ে। অতঃপর ছোট্ট বিড়ালের মতো মাথা বের করে ফারহানার দিকে তাকায়। তারপর অনেকটা বিকৃত স্বরে বলে উঠে- ‘এ্যাহে… বললেই হলো। এটা আমার মা। তুমি না। তুমি মিছে কথা বলো….’
বিস্মিত ফারহানা আদনানের দিকে ফিরে তাকায়। প্রথম বার নুহাকে আম্মু ডাকছে এটা শুনেও মনের ভুল ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিল ফারহানা। কিন্তু পরপর
তিনবার একই ডাক। এটা মনের ভুল হতে পারে না। তাই ফারহানা একরকম জোর করে কাছে টেনে নেয় আদনানকে। প্রশ্ন করে- ‘ওনি তোমার কি হয়?’
এবারো আদনান অকপটে জবাব দেয়, নুহা ওর মা হয়।

নুহার দিকে ফিরে তাকায় ফারহানা। ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেছে নুহা। গলাটাও কিরকম শুকিয়ে আসছে। সেই সাথে ভিতরটা হু, হু করে কাঁদছে। অদ্ভুত রকম এক কষ্ট অনুভূত হচ্ছে নুহার। কেন এই কষ্ট? এরকম লাগতেছে কেন আমার? আমাকে তো কেউ কিছু বলেনি….! তাহলে এমন কেন লাগছে আমার? এরকম অসংখ্য প্রশ্ন নুহার মনে। কোনোটার সঠিক জবাব নুহার মন নুহাকে দিতে পারেনি। ফারহানাটাও কিরকম অদ্ভুত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েছিল নুহার দিকে। নুহার তখনকার অবস্থা দেখে ফারহানার মনে বিরূপ ধারনার জন্ম নেয়। তবে কিচ্ছু বলেনি নুহাকে। নিঃশব্দে আদনানকে ছেড়ে দিয়ে রুম ছাড়ে ফারহানা।

বাহিরে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে রাত্রি ১০টার দিকে বাসায় ফিরে শুভ। ড্রয়িংরুমে আদনানকে কোলে নিয়ে বসে কার্টুন দেখছে ফারহানা এবং তার মা। বাবাকে দেখে যেন স্বস্তি ফিরে পেলো ছেলে। দৌঁড়ে গেলো বাবার কাছে। জাপটে ধরলো বাবাকে।
ছেলেকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খায় শুভ।
‘ কি বাবা? কিছু বলবে?’

আদনান সোফার পাশে বসে থাকা মা এবং নানীর দিকে একবার তাকায়।
‘ বাবা আমি তোমাদের সাথে থাকবো আজকে…!’
ছেলের গালের সাথে গাল মেশায় শুভ।
‘ ঠিক আছে বাবা!
এখন বলো সন্ধ্যার পর পড়তে বসছিলা কি না…!’

রাগান্বিত দৃষ্টিতে আদনান ফিরে তাকায় সোফার দিকে। গাল ফুলিয়ে বড়দের ন্যায় জবাব দেয় আদনান, ইনার কারণে তো পড়তেও পারলাম না আজকে… একবার শুধু ফারহানার দিকে ফিরে তাকায় শুভ। তারপর ছেলেকে কোলে নিয়ে উপরে নিজ রুমের দিকে চলে যায়।
পিছু থেকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল ফারহানা। মাথা নেড়ে বাঁধা দেয় পাশে বসা মা…

রাত্রে আদনানকে ঘুম পাড়িয়ে বাহির থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দরজা লক করছিল শুভ। দরজা ঠেলে হুইল চেয়ারে করে রুমে প্রবেশ করে ফারহানা।
– তুমি?
— এতগুলো বছর একা থাকলে। আজও একা থাকবে?
– What do you mean?
— আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি সেটা কি তুমি সত্যিই বুঝতে পারনি?
– এতকিছু বুঝার দরকার নেই আমার। বেরিয়ে যাও তুমি…
— চলে যাওয়ার জন্য তো আসিনি…!
– মানে কি?
— দেখো না, কত নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে আমাদের ছেলেটা।
– আমাদের নয়। এ শুধু আমার ছেলে।
— আচ্ছা, তোমারই। এখন চলো তো…
– মানে কি?
— মানে আজকে আমরা তিনজন একসাথে ঘুমোবো…
– ইম্পসিবল…

কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ফারহানা। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় হিয়া। হিয়া আন্টির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে দরজার কাছে চলে যায় শুভ। প্রশ্ন করে, ‘কিছু বলবে আন্টি….?’
হিয়া শুভকে রুম থেকে বাহির করে নিয়ে যায়।

রাত্রি ১১টা বেজে ৩৮মিনিট_
ছাদে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে হিয়া এবং শুভ। হিয়ার কথা হলো- ‘ এ মেয়ে পাগল হয়ে গেছে শুভ। ব্যাংক ম্যানেজার মনে হয় তাড়িয়ে দিয়েছে কিংবা তার টাকা ফুরিয়েছে। এই জন্য তোর কাছে ছুটে আসছে। সমস্যা নেই। বাপ তুই শুধু আজ রাতটা ঐ রুমে কাটা। তারপর সকালে যা করার করা যাবে…’
কিন্তু আন্টি! ও তো আমায় ডিভোর্স দিয়েছে। ডির্ভোস দিয়েও কোন অধিকারে আমার কাছে আসলো?
শুভর প্রশ্নোত্তরে হিয়ার জবাব, আছে। অধিকার আছে। তুই ডিভোর্স লেটার হাতে পেলেও ও ডিভোর্স লেটার হাতে পায়নি।
চাপা কন্ঠে শুভর জবাব, আমি তো ওকে ডির্ভোস’ই দেইনি আন্টি।
বলে উঠে হিয়া, সেটাই! তুই ওকে ডিভোর্স দিসনি। আর ও সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে।
আচ্ছা, বাদ দে। রুমে যা। আজকের রাতটা আপাতত জেগে বসে কাটা। কালকে হবে…
গর্জে উঠে শুভ। ‘কাল কেন? আজই হবে। আমি ওকে আজই ডিভোর্স দেবো।’
পাগলামি করিস না। আমার কথা শুন। রুমে যা। সকালে যা হওয়ার হবে…

অনেক করে বুঝানোর পর তবেই রাজি হয়েছে শুভ।রুমে গিয়ে আদনানকে মাঝখানে শুইয়ে দিয়ে খাটে হেলান দিয়ে চুপচাপ বসে আছে শুভ। ফারহানাকে ওর মা বিছানার অপর পাশে শুইয়ে দিয়ে গেছে।

ঘড়ির কাটা যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। যেন সে এক রাতের জন্য চলার গতি হারিয়ে ফেলেছে। বসা থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করে আবার গিয়ে খাটে হেলান দেয়। সোফায় শুইতে গেলে চিল্লানো শুরু করে ফারহানা। মানসম্মানের ভয়ে আবারো খাটে এসে হেলান দেয় শুভ।

ঘন্টাখানেক পর ফারহানা ঘুমিয়ে যায়। সেই সুযোগে সোফায় গিয়ে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ে শুভ। মিনিট ত্রিশেকের ভিতর শুভর চোখেও ঘুম চলে আসে।

ঘুমিয়ে পড়ে শুভ। দু’চোখ শুধু এক করতে পারেনি নুহা। ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে ও। অচেনা এক কষ্ট ওর ভেতরটা শেষ করে দিচ্ছে। কাঁথার ভেতর মুখ লুকিয়ে সারারাত কেঁদেছে সে। যদিও কান্নার কারণটা তার অজানা।

শেষ রাত্রে শুভর রুমের জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। হাত দিয়ে জানালার পর্দা সরায়। খাটে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে আদনান। এই মুহূর্তে ছোট্ট আদনানকে জড়িয়ে ধরতে বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে নুহার। মনকে শক্ত করে নুহা। সব ইচ্ছেকে সবসময় প্রশ্রয় দিতে নেই এটা ভেবেই চলে আসছিল। অনিচ্ছাকৃতভাবেই খাট থেকে দৃষ্টি চলে যায় সোফায়। সোফায় শুয়ে আছে শুভ। শুভর বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে ফারহানা। না চাইতেও চোখের কোণে জমে থাকা জলকণাগুলো অশ্রু হয়ে গাল গড়িয়ে ঝরে পরে নিচে…

চলবে….