বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1213



এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ১২

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ১২

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বাঁধন কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকল। ওর কাছে মনে হচ্ছিল, ঘটনাটা একটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়।
একসময় বাঁধনও হাত বাড়িয়ে মায়াকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরলো।
ঠিক তখনই মায়া বাঁধনকে ছেড়ে দিয়ে দৌঁড়ে বাহিরে চলে গেল। বাঁধন নির্বাক হয়ে আগের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। মনে মনে ভাবল, আজই ওকে স্যরি বলব। তারপর যা হয় হবে।
এরই মাঝে বৃষ্টি থেমে গেল। ক্ষাণিক বাদেই মায়া ফিরে এলো। বাঁধন মায়ার ভয়ে তাকাতে পারছিল না। না জানি কি শাস্তি জারি করে এভাবে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরা’য়। মায়া সামনে এসে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে বলল, এদিকে তাকান।
বাঁধন অনেক কষ্টে মায়ার দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। মায়ার চোখে মুখে কোনো লজ্জা বা সংকোচ ছিল না। ছিল প্রতিশোধের চিহ্ন। মায়া দ্বিধা- সংকোচ ছাড়াই বলল, আপনি কি আমাকে ভালোবাসতেন?
আচমকা এ ধরনের প্রশ্নে ভড়কে যায় বাঁধন।
আবারো মায়ার তাড়া, চুপ করে রইলেন কেন? জবাব দিন।
মায়ার ঝাঝাল কন্ঠে বাঁধন স্তম্ভিত। তবুও সাহস করে বলল, হ্যাঁ, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি লক্ষ্মী।
ভালোবাসার পূর্বশর্ত বিশ্বাস, সেটা কখনো শুনেননি আপনি? উত্তেজিত হয়ে বলল মায়া।
লক্ষ্মী প্লিজ আমায়, সব কথা শেষ করার আগেই মায়া একটা চিরকুট বের করে বাঁধনের হাতে দিল। বাঁধন চিরকুট’টি হাতে নিয়ে বলল, কি এটা?
ব্রেকআপ লেটার। আপনার সাথে আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। আজ থেকে আমরা কেউ কাউকে চিনি না, জানি না। এমনকি আজকের পর থেকে আমরা একে অপরের সাথে কোনো প্রকার যোগাযোগ রাখব না। প্রমাণ সরূপ জটপট এখানে একটা সাক্ষর করেন তো। আমার আবার হসপিটালে চাকরী হয়েছে। জিনিস পত্র সব গুছিয়ে রাখতে হবে। কাল থেকে ওখানে চলে যাব।
বাঁধনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। হাসবে নাকি কাঁদবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। মুখ দিয়েও কোনো কথা বের হচ্ছিল না। মায়া বলতে লাগল, ঢাকায় আপনি যে হসপিটালে বসেন, সেই হসপিটালেই আমি জয়েন করব। স্যালারী খুব বেশি না, তবে চলে যাবে আমার। কাজ খুব সহজ, ইসিজি করা। যা আমি মাস ছয়েক আগে শিখেছিলাম।
আর হ্যাঁ, আজ যে ঘটনাটা ঘটল সেটা স্মৃতি চিহ্ন হয়ে থাকবে।
বাঁধন অবাক হলো।

এরপর মায়া স্বাভাবিকভাবে বলল, আজ যেটা করেছি, সেটা না করলে আপনি কোনো দিন বুঝতেন না আমি আপনাকে সত্যি’ই ভালোবেসেছিলাম। পরবর্তী জীবনে কতটা অসুখী হবো এখন নিশ্চয় তা বুঝবেন। তাড়াতাড়ি সাক্ষরটা দিয়ে দিন।
বাঁধন হা করে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
কি হলো! কথা কানে যাচ্ছে না? নিন, সাক্ষর’টা করে আমাকে উদ্ধার করেন।
বাঁধন কোনো কথা না বলে, চিরকুটের নিচে ছোট্ট করে লিখল- ভালোবাসি….. তারপর ভাঁজ করে মায়ার হাতে চিরকুটটা ধরিয়ে দিল।
এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকানোর কিছুই হয়নি। আর শুনুন, আজকের পর থেকে যাতে আপনাকে আমার বাড়িতে না দেখি। আপনি আর এ বাড়িতে আসবেন না। এ বাড়িতে আপনার কেউ নেই। এখনই এখান থেকে চলে যান।
হনহনিয়ে মায়া রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
বাঁধন কিছুক্ষণ হাবার মত দাঁড়িয়ে থেকে, মায়ার পিছু নেয়।

শ্বশুরবাড়িতে শ্যালিকা যে রুমে বসে পড়ছে,
সেই রুমে গিয়ে বাস ধপাস করে খাটে শুয়ে পরল বাঁধন। শ্যালিকা চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে, কি হলো ভাইয়া? শরীর খারাপ???
শুভ্র মাথা ঝাকিয়ে জবাব দেয়- শরীর নয়, মন খারাপ, মন। শ্যালিকা হিয়ার পাল্টা প্রশ্ন- আপু কিছু বলেছে? বাঁধন মুখে কিছু না বলে শুধু মাথা ঝাকায়। উত্তর হ্যাঁ বোধক শুনে হিয়াতো চটে গেছে। সেকি! আসতে না আসতে ঝগড়া করে ফেলেছে?
হিয়া প্রশ্ন করে দুলাভাইকে-
ভাইয়া কি করেছে ও???
গম্ভীর কন্ঠে বাঁধনের জবাব, ব্রেকআপ!
—— কিহ???
– জি….!!!
—— মাথাটা বোধ হয় এবার গেছে। হিয়া দৌঁড়ে গেল দুলাভাইয়ার জন্য শরবত বানিয়ে আনতে।
আপু, এক জগ শরবত বানিয়ে দাও তো!
বোনের প্রশ্নে অবাক হয় মায়া। চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে বোনকে, এই! তুই এই বৃষ্টির দিনে শরবত দিয়ে কি করবি? মাথাটা কি একেবারে গেছে?
দাঁতে দাঁত চেপে হিয়ার জবাব, ঠিক ধরেছ। মাথাটা গেছে। তবে সেটা আমার নয়, তোমার ডাক্তারবাবুর।
হিয়ার কথা শুনে কিছুটা রেগে গেল মায়া। রাগান্বিত দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল, খবরদার! উল্টাপাল্টা কথা বলবি না।
উল্টাপালটা কথা আমি নয়, তোমার জামাই বলছে, এখনো বলেই চলেছে। কিসব অদ্ভুত কথা, আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে, আমার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। কি পাগলের সাথে আমি যে দিন কাটাই সেটা ঐ আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না, এখন ওরে বিয়ে দিলাম ডাক্তারের সাথে। ভেবেছিলাম এবার বুঝি মুক্তি পাব। এখন দেখি, মুক্তি?!!!
সে গুড়েবালি। তার সাথে বিয়ে দিয়েছি সে আরো বড় পাগল।
মায়া কিছুটা ঘাবড়ে যায়, তবে আন্দাজ করতে পারছে কি হয়েছে। তাই হিয়াকে ঠেলে পড়তে পাঠিয়ে নিজেই টিউবওয়েল থেকে ঠান্ডা পানি এনে তার সাথে লবন আর লেবুর রস মিশালো। গুড় খুঁজতে গিয়ে না গিয়ে চিনি আবিষ্কার করল। কিন্তু চিনি তো ওনি খায় না। কি আর করার? অগত্যা চিনি ছাড়া শরবত বানিয়ে মায়া হিয়ার পড়ার রুমে যায়।
– নিন! গুড় নেই, চিনিও দেইনি। মিষ্টি ছাড়াই খেয়ে নিন।
—— বাঁধন এক নিঃশ্বাসে গ্লাসের সবটুকু পানি খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বলে, আহ!
মিষ্টি……এমন মিষ্টি জীবনেও খাইনি।
হিয়া পড়া রেখে চোখ বড় বড় করে দুলাভাইয়ের দিকে তাকায়। “আপনি আবার মিষ্টি পেলেন কোথায় থেকে? কে দিয়েছে মিষ্টি?”
বাঁধন মায়ার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে, তোমার আপুর থেকে পেয়েছি, তোমার আপু খাইয়ে দিয়েছে। আহ! কি মিষ্টি…. এখনো স্বাদ লেগে আছে ঠোঁটে।
রাগী চোখে মায়া বাঁধনের দিকে তাকাতেই বাঁধন চোখ মেরে দেই। চতুর হিয়া বোনের লাল হয়ে যাওয়া মুখের অবস্থা দেখেই বুঝে গেছে তার বোনের জামাই কোন সে মিষ্টির কথা বলছে।
তাই সে আর কথা না বাড়িয়ে গোসল করার অজুহাতে ভদ্র বালিকার মতো রুম থেকে বের হয়ে যায়।

অঝোর ধারায় বৃষ্টি পরছিল। বাঁধন তখন চেয়ারে বসে বাহির পানে তাকিয়ে ছিল। অনেকটা আফসোসের স্বরে বাঁধন আনমনেই বলে ফেলল- ইস, থাকলে লুডু খেলাটা জমত বেশ!
রুমে বসা ছিল হিয়াসহ মায়ার ২টা কাজিন। হিয়া আত্মহারা হয়ে বলে, মানা করছে কে? চলেন? শুরু করা যাক। কথাটা বলেই বিছানার নিচ থেকে কাগজে মুড়ানো লুডু বাঁধনের হাতে তুলে দেয়।
লুডু হাতে মুখটা কালো করে বাঁধন বলে উঠে, তোমার বোন থাকলে জমতো বেশ!
কিন্তু আপুতো বৃষ্টির দিনে কাথা নিয়ে, বালিশ জড়িয়ে শুয়ে থাকতে পছন্দ করে। ও কি আসবে?
বাঁধন হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে, গিয়ে বলো আগে। না আসলে দেখা যাবে কি করা যায়।
ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি। তবে মনে হয় না কোনো কাজ হবে।
হিয়া, মায়াকে ডাকতে মায়ার রুমে যায়। মায়া তখন রুমের বাহিরেই বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। হিয়া গিয়ে লুডু খেলার কথা বলতেই একটা ধমক দিয়ে দেয়। ব্যর্থ হিয়া মন খারাপ করে রুমে ফিরে। মুখ গুমড়া করে বাঁধনকে জানায়, এখনো কাথা নিয়ে, বিছানায় যায়নি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তাই খুশি মনে কথাটা বলছিলাম। একটা ধমক দিয়ে কান ফাটিয়ে দিয়েছে। আপনাকে আগেই বলছিলাম কাজ হবে না।
বাঁধন হিয়াকে সান্ত্বনা দিয়ে চুপ করায়। তারপর উচ্চস্বরে বলতে থাকে, আরে হিয়া বুঝো না কেন? মানুষ পারলে তো খেলবে? আমার মতো খেলেয়ারের সাথে খেলা এত সহজ না। এর জন্য সাগস লাগে, সাহস!
কথাটা মায়ার কানে পৌঁছতে দেরি হয়নি। ছুটে আসে রুমে। অগ্নিচোখে বাঁধনের দিকে একবার তাকিয়ে, লুডু নিয়ে বসে পরে। খেলা শুরু হয় বাঁধন-হিয়া বনাম মায়া- হৃদয়। ফ্লোরে বসে এরা পুরোদমে খেলে চলছে, অন্যদিকে মায়ার এক কাজিন চিরকুট হাতে নিয়ে চেয়ারে বসে আছে বিচারকের ভঙ্গিতে। হাতে দুইটা ছোট্ট ছোট্ট কাগজ। একটা বাঁধনের দেয়া, আরেকটা মায়ার। এখন শুধু হার জিত দেখার পালা। যেই হারবে, সে-ই অপরপক্ষের লিডারের দেয়া চিরকুটে উল্লেখিত যেকোনো আবদার পূরণে সচেষ্ট থাকতে হবে।

বহু চড়াই উতরাই পেরিয়ে খেলায় জয়ী হলো। জিতে গেল বাঁধন, হেরে গেল মায়া। লজ্জায়, রাগে, দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে মায়ার। কিন্তু কোনো রাগ দেখাল না। রাগ না দেখিয়ে চুপসে মাথা নিচু করে আগের স্থানেই বসে রইল। ঠিক তখনি মায়ার কাজিনটা বাঁধনের দেয়া চিরকুট’টা মায়ার হাতে ধরিয়ে দেয়। চিরকুট হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে লেখাটা পড়ে বাঁধনের দিকে একবার ভ্রু কুঁচকে তাকায় মায়া। বাঁধনের মুখে বিশ্বজয়ের হাসি। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ায় মায়া। কাউকে কিচ্ছু না বলে রুমে গিয়ে শুয়ে পরে মায়া। মিনিট পাঁচেক পর রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় বাঁধন।

চলবে…..

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ১১(মহাপর্ব)

1

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ১১(মহাপর্ব)
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে ভড়কে যায় মায়া। ঘড়িতে সময় তখন সকাল ০৭টা বেজে ৪৫মিনিট।
ছি, কি লজ্জা!!!
এতক্ষণ ধরে ঘুমাইলাম? তড়িগড়ি করে বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে টের পায় মায়া, ওর চুলগুলো যেন কোথায় আটকে আছে। চুল ছাড়ানোর জন্য ফিরে তাকাতেই দেখতে পায় বাঁধনের শার্টের বোতামে চুলগুলো আটকে।
চুলগুলে বোতামের সাথে এমন ভাবে প্যাঁচিয়ে ছিল যে মায়া তা ছাড়াতে পারেনি। ছাড়াতে না পেরে শরীরের জোর দিয়ে চুল গুলো ধরে টানতে থাকে। এতেও কাজ হচ্ছে না।
ইস! এমনিতেই লেইট তারউপর এমন একটা পরিস্থিতি। আল্লাহ! আমারে বাঁচাও।
মায়ার কথায় বাঁধনের ঘুমের কিছুটা বিঘ্ন ঘটে। নড়েচড়ে উঠে বাঁধন। চুলে টান খেয়ে হুমড়ি খেয়ে বাঁধনের বুকে গিয়ে পরে মায়া। উঠতে গেলে জাপটে ধরে বাঁধন।
ঘুম ঘুম গলায়’ই বলে, উম্মমমমমমমম! কোথায় যাচ্ছ? আরেকটু থাকো না!
মায়া মনে মনে ভাবছে, দাঁড়া! তোর রোমাঞ্চ আমি বের করছি।
মায়া যে পাশে শুয়েছিল, তার ঠিক নিচেই বাঁধন বাজার থেকে ব্লেড কিনে এনে রেখেছিল কাজিনের ছেলের মাথা ন্যাড়া করার জন্য। মায়া সেই ব্লেডটাই কাজে লাগালো। চুল ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা না করে অনেকটা উপর থেকেই চুল’ই কেটে ফেলল।
আহ! মুক্তি….
রুম থেকে বেরিয়ে যায় মায়া। ততক্ষণে রান্না হয়ে গেছে বাসায়। খাবার টেবিলে অনেকে বসে ব্রেকফাস্ট করছে।
ইস! লজ্জায় মাথা কাটা গেল….
ফ্রেশ হয়ে মায়া দোতলায় দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিচে সবার খাওয়া দেখছে। নিচে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না সে।
ব্যাপারটা বাঁধনের বাবার চোখ এড়ায় না। মায়া বলে এক আদুরে ডাক দেন। শ্বশুর মশাইয়ের আদুরে গলার ডাক শুনে লজ্জা ভুলে দৌঁড়ে নিচে নামে মায়া।
নিচে নামতেই শাশুড়ির প্রশ্ন, একা কেন তুই? গন্ডারটা উঠে নি?
আমতা আমতা স্বরে মায়ার উত্তর, ঘুমুচ্ছে গন্ডারের মত।
মায়ার কথায় সবাই ওর দিকে ফিরে তাকায়। মায়াতো নিজের বোকামির জন্য নিজেকেই গালাগাল দিচ্ছে।
ধূর! কি বলতে কি বলতে কি বলে ফেললাম? আমিও গন্ডার ডাকলাম?!।!
শাশুড়ি মুচকি হেসে বলে, বসছিস না কেন? নাকি গন্ডারের সাথেই খাইবি?
লজ্জায় মাথা নিচু করে তাড়াতাড়ি খেতে বসে পরে মায়া। খেতে বসে মায়ার এদিক ওদিক তাকানো দেখে শ্বশুরের প্রশ্ন- মা! কিছু লাগবে তোমার?
নিচু স্বরে মায়ার জবাব, রাকিব ভাই- ভাবি কোথায়? ওদের কে যে দেখছি না!
চলে গেছে ভোরের ট্রেনে, সামনে থেকে ফারজানার জবাব।
একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মায়া।
আহ! যা বাঁচা বেঁচে গেলাম……

সকাল ১০টা বেজে ১২মিনিট__
বাঁধন একবারো রুমের বাইরে আসেনি। এখনো পরে পরে ঘুমুচ্ছে মনে হয়। একটা ডাক দিয়ে আসি।
নাহ! বাঁধন ঘুমুচ্ছে না। খাটে আধশোয়া অবস্থায় হেলান দিয়ে মুখ ভার করে ফোন টিপছে।
সেরেছে রে! ইনি মনে হয় চুল দেখে কষ্ট গেছেন। যে চুল ওনার এত প্রিয়, সেই চুল ছাড়ানোর চেষ্টা না করে কেটে ফেললাম। ওনি বোধ হয় তাই কষ্ট পেয়েছেন।
মায়া ধীর পায়ে বাঁধনের দিকে এগিয়ে যায়। মায়া কাছে যেতেই বাঁধন ফোনটা অফ করে বালিশের নিচে রেখে কপালে হাত দিয়ে শুয়ে পরে।
কাছে গিয়ে মায়া ডাক দেয়, শুনছেন!
বাঁধনের কোনো জবাব নেই দেখে আবারো ডাক দেয়- এই শুনছেন…..!!!
এবারো বাঁধনের কোনো সাড়া নেই। সাড়া না পেয়ে মায়া বাঁধনকে ধাক্কা দিয়ে বলে, এই শুনছেন….!!!
বাঁধন এবার রাগান্বিত দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকায়। ভড়কে যায় মায়া। মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আসে ওর। কিন্তু বাঁধন কিছু বলেনি। কিছু না বলে আবারো পূর্বের ন্যায় কপালে হাত দিয়ে শুয়ে পরে। মায়া আবারো কিছুটা ধাক্কা দিয়ে আদুরে গলায় ডাক দেয়-
এ্যাই…..!!!
বাঁধন এবার সোজা হয়ে বিছানায় উঠে।
মায়ার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করে- কি? সমস্যা কি তোমার? এমন কেন করছ? শান্তিতে কি ঘুমোতেও দিবে না?
অনেকটা ধমকের স্বরে বাঁধন কথাগুলো বলে। ধমক শুনে মুখটা গুমড়া করে ফেলে মায়া। অন্যদিকে তাকিয়ে ভাবছে-
ওহ! কষ্ট পাননি তাহলে, রেগে গেছেন।
তাইলে কোনো সমস্যা নাই। রাগ দেখিয়ে চুপ করে রুমে বসে থাকেন, আমি ততক্ষণে একটা কবিতা লিখে আসি।

রুমে গিয়ে ফোনটা ওপেন করে নোটপ্যাডে লিখতে শুরু করে মায়া__

এতো আয়োজন করে
আমাকে কেউ কোনোদিন চায়নি।
মন খারাপের দিনে
আমার পাশে বসে গল্প শুনায়নি।

পড়ন্ত বিকেলে হাতটা ধরে
হাঁটার জন্য কেউ এতটুকুও
আবদার করেনি,
বৃষ্টিস্নাত বিকেল কিংবা সন্ধ্যায়
একসাথে বৃষ্টিতে ভিঁজার জন্যও
কেউ আমায় পাশে রাখেনি।
কখনো কাছে এসে বলেনি কেউ-
এগিয়ে দাও পা, নূপুর পরিয়ে দেই।

কাজ শেষে ঘরে ফেরার পর
কেউ কোনোদিন আমার কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়নি,
গুজে দেয়নি খোপায় বেলির ফুল।
অভিমানে কেউ আজো আমার নামে
লেখেনি ভালোবাসার নামে অভিযোগ।

আমি চাই কেউ আমায়
খুব করে চেয়ে বসুক,
বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় কিংবা বিকেলে
হাতে হাত ধরে বৃষ্টিতে ভিঁজুক।
আমি চাই আমাকেও কেউ
অনেক কাছে রাখুক,
মন খারাপের গল্প শুনাক।

আমি চাই কেউ আমার কাছে আসুক,
হাতে হাত রেখে দুরের পথে হাটুক।
আমি চাই কেউ বলুক-
লক্ষ্মী পা টা দাও তো, নূপুর পরিয়ে দেই;

আমি চাই ঘরে ফিরে
কেউ আমার কপালে ভালোবাসার
এক উষ্ণ পরশ এঁকে দিক,
খোঁপায় বেলির মালা গুজে দিক।
আমি চাই আমার সাথে কেউ অভিমান করুক,
চোখের জলে মাঝেমধ্যে দু’একটা
অভিযোগ পত্র লিখুক।

কবিতা লিখে আবেগপ্রবণ হয়ে গেল মায়া,
যেটা সবসময় হয়।
দৌঁড়ে গেল বাঁধনের রুমে। বাঁধন আবারো তখন ফোন টিপায় ব্যস্ত। মুখ দেখে মনে হচ্ছে কোনো টেনশনে আসে।
আমি গিয়ে না হয় টেনশনটা দুর করে দেই। ওনাকে কবিতা আবৃত্তি করে শুনাই। আমার কবিতা আবৃত্তি শুনলে তো আবার ওনার মন ভালো হয়ে যায়। আজো কবিতা শুনে আমার সাথে রাগ করে থাকতে পারবে না। যেমন কথা, তেমন কাজ।
মায়া বাঁধনের পাশে চেয়ার টেনে বসে হৃদয়ের সবটুকু অনুভূতি মিশিয়ে দিয়ে আবৃত্তি করতে শুরু করে……..
আবৃত্তি করা শেষ। পুরো আবৃত্তি চলাকালীন সময় বাঁধন একটা কথাও বলেনি। কিন্তু এখন বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছে। মায়া তো আনন্দে আত্মহারা এই ভেবে যে ওর আবৃত্তি কাজে দিয়েছে।
কিন্তু একি?!!! ওনি যে আমার কাছেই আসছেন। কি করতে চাচ্ছেন ওনি? কবিতার আবদার গুলো পূরণ করতে চাচ্ছেন না তো!!!
চেয়ারে বসে ছিল মায়া। বাঁধন মায়ার দু’বাহু ধরে চেয়ার থেকে ওকে দাঁড় করায়।
ইস! এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন মনে তো হচ্ছে ওনি কল্পনায় ডুবে গেছেন। এখন হয়তো কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দিবে। সে জন্যই তো দাঁড় করালো। লজ্জায় চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে মায়া।
চোখ খুলে বাঁধনের ধমক শুনে।
এখনো এখানে দাঁড়িয়ে আছ? বের হয়ে যাও রুম থেকে। মায়া নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। বাঁধন ওর সাথে এভাবে কথা বলবে সেটা যে ও কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। চোখের জল টলটল করছে। আর কিছুই ভাবতে পারছে না। ভাবতে গেলেই কান্না করে দিবে। তাইতো অভিমানে দৌঁড়ে সে স্থান ত্যাগ করে মায়া।

পুরো দিনে একবারও মায়া বাঁধনের সামনে যায়নি, যদিও ওর দুটি চোখ চাতকের ন্যায় আশায় চেয়ে ছিল কখন আসবে বাঁধন, হাতটি ধরে পাশে বসবে। জল ছলছল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলবে,
” ভালোবাসি তো লক্ষ্মী…..”
সব ভুলে মায়া বাঁধনের বাহুডোরে আটকা পরবে। এসব, এসবই ভাবতে ভাবতে মায়ার দিন কেটে গেল। রাত এলো।
চুপচাপ রাতের খাবার খেয়ে এলাকায় বন্ধুদের সাথে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে আসল। তারপর চুপটি করে এসে বিছানায় শুয়ে পরল।
এদিকে অনেকক্ষণ বিছানায় মরার মত শুয়ে থেকেও মায়া যখন দেখল প্রতিদিনের মত বাঁধন আজ আর ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছে না তখন মায়া নিজেই বাঁধনের কাছে যায়। চুপটি করে বাঁধনের বুকে মাথা রাখে।
বাঁধন মায়ার মাথাটা ওর বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে, দিনে তো অনেক করছ। এবার রাত্রেও কি আমায় ঘুমোতে দিবে না?
মায়া প্রায় কেঁদে দিবে দিবে অবস্থা, কিন্তু কাঁদেনি। করুণ দৃষ্টিতে মায়া বাঁধনের দিকে তাকায়, প্রশ্ন করে বাঁধনকে।
” এ্যাই! কি হয়ছে আপনার? এমন কেন করছেন?”
প্রশ্নটা মায়া বাঁধনের গালে হাত রেখে করে। বাঁধন হাতটা সরিয়ে অনেকটা বিরক্তির দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে-
” তুমি কি আমাকে আজকে ঘুমোতে দিবে না বলে স্থির করেছ?”

বাঁধনের এই একটি কথায় নিমিষেই মুখটা কালো হয়ে যায় মায়ার। কন্ঠ’টা কেমন যেন ভারি হয়ে আসে। তবুও প্রশ্ন করে-
” আপনি আমাকে এটা বলতে পারলেন?”
বাঁধন কিছুটা নরম স্বরে বলে, তা নয়তো কি?
জবাবে আর একটা কথাও বলেনি। বাঁধনের থেকে অনেকটা দুরে সরে গিয়ে ওর বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে পরে মায়া।
বাঁধনও ফোনটা রেখে লাইট’টা অফ করে কপালে হাত রেখে শুয়ে পরে।
পুরো রাত্রির ভেতর মায়া একটুও নড়েনি, তাই বাঁধন জানে না সে রাত্রে মায়া ঘুমিয়েছিল কি না। কিন্তু বাঁধন?!!! বাঁধন এক সেকেন্ডের জন্যও চোখের পাতা এক নড়তে পারে নি। একটা অজানা কষ্ট ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল। কুড়ে কুড়ে খাচ্ছিল ভেতরটা।
পরদিন সকালেও বাঁধনের ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরী হয়। ফ্যানটা অফ করে বিছানা গুছাতে গিয়ে মায়া বাঁধনের ফোনটা নিচে পরে থাকতে দেখে। উঠাতে গিয়ে দেখে ফোনের স্ক্রিনে বার বার সবুজ বৃত্ত জ্বলে উঠছে। বোধ হয় কোনো কিছুর নটিফিকেশন আসছে।
লকটা খুলে নটিফিকেশন গুলো রিমোভ করার জন্য হাত বাড়াতেই মায়ার চক্ষু কপালে উঠে যায়। মনে হচ্ছে সবকিছু ঝাপসা দেখছে ও। নিজের চোখকেও কেন জানি বিশ্বাস করতে পারছিল না। আর পারার কথাও নয়।
মায়া বাঁধনের ইমুর চ্যাটলিস্টের প্রথমে ওর সাবেক প্রেমিক আরিফের নাম্বারটা দেখতে পায়। আরিফ!!!! যে একসময় মায়ার প্রাণ ছিল। যাকে ছাড়া মায়া একমুহূর্তও বেঁচে থাকার কল্পনা করতে পারত না। সেই আরিফ, যে মায়ার প্রথম ভালোবাসা ছিল।
ছেলেটা ভিষণ ভাবে কষ্ট দিয়েছে মায়াকে। দিনে দিনে আরিফের কষ্ট দেয়ার মাত্রাটা বেড়েই যাচ্ছিল। শেষের দিকে তো আরিফ ভিষণ ভাবে এড়িয়ে চলেছে মায়াকে। এতেও কাজ হয়নি। মায়া পাগলের মত আরিফকে কল দিত, আরিফের কাছে ছুটে যেত। বাধ্য হয়ে আরিফ সিম চেঞ্জ করে ফেলে। একদিন মায়াকে না জানিয়েই দেশের বাহিরে চলে যায়। চিরতরে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মায়ার সাথে আরিফের। মায়া নামাজে বসে খুব কাঁদত। আরিফকে হারিয়েছে এতে ওর কোনো কষ্ট নেই, ওর শুধু একটাই চাওয়া ওর আরিফ যেন দুর দেশে ভালো থাকে। যে সুখের জন্য আরিফ ওকে এতটা কষ্ট দিয়েছে, এড়িয়ে চলেছে, সে সুখ যেন ওর কাছে ধরা দেয়। মায়ার রোজকার প্রার্থনার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল আরিফের সুখ কামনা।
অভিশাপ মুখে দিতে হয় না। মনে কষ্ট পেলে অভিশাপ এমনিতেই লেগে যায়। আরিফেরও তাই হলো। মায়ার ভালোবাসার অভিশাপে সে সব হারালো। প্রথমে সেই মেয়েকে যার জন্য মায়াকে এতটা এড়িয়ে চলত, তারপর বাবাকে।
সব হারিয়ে নিঃস্ব আরিফ কল দেয় মায়াকে। কিন্তু ততদিনে অনেক বেশী দেরী হয়ে গেছে। ৪বছরে বদলে গেছে অনেক কিছুই। ঠিক যেমন বদলে গেছে মায়ার এলোমেলো জীবন বাঁধনের সান্নিধ্যে এসে।
বাঁধন মায়াকে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখায়। নাহ….
বাঁধন ভালোবাসতে নয়, ভালো রাখতে এসেছিল। এক নিঃসঙ্গ লেখিকার প্রেমের সঙ্গী হতে নয়, মন খারাপের সঙ্গী হতে এসেছিল।
কেউ কাউকে কখনো বলেনি, ভালোবাসি। তবুও ভালোবাসা হয়ে গেল। সেই ভালোবাসা বিয়ে পর্যন্ত গড়ালো। আজ এতদিন পর আরিফের কল।
ভিতরটা অজানা আশঙ্কায় মুচড় দিয়ে উঠে। কলটা কেটে দেয় মায়া। কল কেটে বাঁধনের সাথে হওয়া প্রতিটি কথোপকথন মন দিয়ে পড়তে থাকে মায়া। যতই পড়ছিল, ততই কষ্টে ভিতরটা ফেটে যাচ্ছিল মায়ার।
আরিফ বাঁধনকে মায়ার সম্পর্কে এমন গুছিয়ে বলল যে, এটা দেখে যে কেউ বলে দিবে মায়া আরিফকে বড্ড বেশী ভালোবাসত। বাঁধনও সেটাই ভেবেছে।
আর তাইতো এইভেবে মায়ার আড়ালে কেঁদেছে-
এর অর্ধেকের অর্ধেকও তো আমায় ভালোবাসে না…..

ফোনটা বাঁধনের বালিশের পাশে রেখে রুম থেকে বেরিয়ে যায় মায়া। আজ খুব কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে ওর, কিন্তু পারছে না। কান্না’টা যেন কোথায় আটকে আছে।
সেদিন মায়া আর ইচ্ছে করেই বাঁধনের কাছে যায়নি, বাঁধনকে বিরক্ত করেনি। সারাদিন শুয়ে বসে কাটিয়ে রাত্রে ননদ ফারহানার সাথে ঘুমানোর বন্দোবস্ত করে।
এদিকে রাত্রি ১০টা বাজে, মায়ার রুমে আসতে দেরী থেকে বাঁধন কল করে বোনের ফোনে। জিজ্ঞেস করে-
” কিরে! তোর ভাবি কোথায়?”
ফারহানার জবাব, এইতো! আমার সাথে ঘুমোবে বলল…..
বাঁধন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলটা কেটে দেয়। ঘুমিয়ে পরে বাঁধন।
ঘুম ভাঙে সকাল ৮টায়, বাচ্চা কাচ্চার শোরগোলের আওয়াজে। জানালা খুলে বোনের রুমের দিকে তাকায়। রুমে তো কেউ নেই। গেল কোথায় এরা….
বারান্দায় গিয়ে দাঁড়িয়ে নিচে তাকায় বাঁধন।
কিরে! কি হয়ছে? এত হৈচৈ কিসের?
পিচ্চি বোন আফসানার জবাব, মায়া’পু চলে যাচ্ছে তো, আমরা রাস্তায় এগিয়ে দিয়ে আসছি।
কিহ?! চলে যাচ্ছে মানে???
বাঁধন জলদি ওর রুমের পিছনের জানালা খুলে। ওখান থেকে রাস্তা পুরোটা দেখা যায়।
বাঁধন সেই জানালা দিয়ে দেখতে পায় কেমন জল ছলছল চোখে মায়া জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে। বাঁধন তাকাতেই চোখটা ফিরিয়ে নেয় মায়া। তারপর সি.এন.জিতে উঠে পরে। তার একটু পরেই বাঁধনের বাবা উঠে সি.এন.জিতে। সি.এন.জি চলতে শুরু করে। একটু একটু করে দুরে চলে যায়।

মায়া চলে যাওয়ার ঘন্টা দুয়েক পর কল ফেবুতে নক করে ওর বান্ধবীকে।
বাঁধনকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মেসেজের পর মেসেজ পাঠাতে থাকেন ওনি___
” শেষ পর্যন্ত একটা অচেনা ছেলের জন্য এভাবে দুরে সরিয়ে দিলেন নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে?”
” মায়ার অতীত সম্পর্কে সবকিছুই তো আপনি জানতেন, তারপরও ওকে এতটা কষ্ট দিলেন?”
” একটাবারের জন্যও ভাবলেন না যে কারণটার জন্য আপনি ওকে এড়িয়ে চলছেন, সেটা ও জানতে পারলে কতটা কষ্ট পাবে..”
” এই আপনার ভালোবাসার প্রতি বিশ্বাস?”
” শেষ পর্যন্ত কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা আপনার বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।”
আশ্চর্য কি জানেন?
এই যে এতকিছু করলেন তারপরও মেয়েটির কোনো অভিযোগ নেই। ও বার বার শুধু একটা কথায় বলছিল, আমি মরে যাবো। ঐ ছেলের কারণে যদি আমাদের রিলেশনে ফাটল ধরে তাহলে আমি মরে যাবো।
” দেখে নিয়েন আপনি! সত্যি সত্যি ও একদিন মরে যাবে। যেদিন মরে যাবে, সেদিন বুঝবেন কি ছিল ও আপনার জীবনে….???”

বাঁধন দাঁড়ানো থেকে বসে পরল। চিৎকার করে কাঁদতে পারছে না ও কিন্তু চোখ থেকে ঠিক’ই জল গড়িয়ে পরছে।
এ আমি কি করলাম?! ওকে আমি কষ্ট দিলাম? এটা হওয়ার তো কথা ছিল না! আমি তো ওকে ভালোবাসতে নয়, ভালো রাখতে চেয়েছিলাম। ভালোবাসার সঙ্গী নয়, মন খারাপের সঙ্গী হতে চেয়েছিলাম।
সেই আমি আজ স্বার্থপর হয়ে গেলাম। নিজের কথা চিন্তা করে ওকে এতটা কষ্ট দিয়ে ফেললাম।

সেদিনটা কোনো রকম গেল, পরদিন সকাল সকাল হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পরে বাঁধন। গন্তব্য শ্বশুরবাড়ি।
দুপুর ১টা কি দেড়টা বা’জে তখন। বাঁধন ওর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। শ্বশুর শাশুড়িকে সালাম এবং কুশল বিনিময়ের একপর্যায়ে বাঁধন ওর শ্যালিকা মারফত জানতে পারে বউটা ওর সকাল থেকে ওদের পুরনো বাড়িতে আছে।
বাহিরে বৃষ্টি পরছে। এখন গেলে কাকভেঁজা হয়েই যেতে হবে। কিন্তু না যেয়েও উপায় নেই। শ্যালিকার থেকে একটা ছাতা নিয়ে ও বাড়িতে চলে যায় বাঁধন। মায়াদের পুরনো টিনশেড বাড়ি। নতুন বাড়ি তৈরি করার পর এখান থেকে ওরা চলে গেছে। কিন্তু মায়া মাঝে মাঝে এখানে এসে শুয়ে থাকে।
ঘরের দরজাটা হালকা মিশানো ছিল। ছাতা বন্ধ করে দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করতেই বাঁধনের মাথা ঘুরে যায়। একটা সবুজ পরি সবুজ লেহেঙ্গা পরনে খাটে বাচ্চাদের মত হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমন্ত প্রিয়ার কাছাকাছি যেয়ে মুখ থেকে দৃষ্টি সরাতেই একটা জায়গায় চোখ আটকে যায় বাঁধনের। দু’হাত উপরের দিকে দিয়ে, টানটান হয়ে শুয়ে ছিল মায়া, যার কারণে ফতুয়াটা একটু উঠে পেটের খানিক জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়। বাঁধনের দৃষ্টি ছিল মায়ার নাভির দিকে।
বাঁধনের কেমন যেন নেশা ধরে যায়। ইচ্ছে হচ্ছে ঘুমন্ত পরীটাকে একটু ছুঁয়ে দিতে, আদর করতে। পরমুহূর্তে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বিছানায় পরে থাকা ওড়নাটা মায়ের পেটের উপর রাখে।
নড়ে উঠে মায়া। বাচ্চাদের মত পায়ে পা দিয়ে চুলকাতে থাকে। তারপর আবারো ঘুম।
মায়ার পা থেকে লেহেঙ্গাটা অনেকটা উপরে সরে যায়। বাহিরে বৃষ্টি, ভিতরে প্রিয়তমার এই রূপ, অনেকটা মাতাল হয়ে যায় বাঁধন।
কিন্তু দিশেহারা হয়নি। তাইতো ঘুমন্ত প্রিয়াকে স্পর্শের জন্য হাত বাড়িয়েও হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।

ততক্ষণে জেগে যায় মায়া। ধীর পায়ে বাঁধনের দিকে এগুতে থাকে। বাঁধন বুকটা মৃদু কাঁপতে শুরু করল। কেন যেন ভয় ভয় করছিল। বুঝতে পারছিল না কে এরকম হচ্ছিল।
বাঁধন হঠাৎ মায়ার স্পর্শ পেল। বাঁধন স্থির দাঁড়িয়ে ছিল। মায়া বাঁধনের দুই কাধ খামচে ধরল। বাঁধনকে নিজের কাছে টেনে নিল। বাঁধন তখন ভয়ে কাঁপছিল। ঘটনাটা বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু ঘটছিল। মায়ার নরম ঠোঁট বাঁধনের ঠোঁট দুটিকে তার ভিতরে নিয়ে গেল। হাত দিয়ে মায়া বাঁধন চুলগুলো খামচে ধরল। তারপর সজোরে তার ঠোঁট বাঁধনের ঠোঁটের উপর চেপে ধরল।

চলবে……

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ১০

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ১০
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মায়া বাঁধনের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে আছে।
—– কি হলো? এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?
– যান, আপনি লুঙ্গি চেঞ্জ করে আসুন।
—– লুঙ্গি চেঞ্জ করে তোমার ওড়না পরব?

বাঁধনের কথায় মায়া রাগান্বিত ভঙ্গিতে ওর দিকে তাকালো।
—— দেখো, রাগ করার কোনো কথা বলিনি।
এত রাত্রে আমি পরব’টা কি? লুঙ্গি যে
যে রুমে সে রুমে তো ভাইয়া(কাজিন)
শুয়ে আছে।
– আপনি বসুন, আমি আসছি।
—– এই শুনো, যেও না…. ওরা কিন্তু ভেবে নিবে…..(….)….???

মায়া লাইটটা জ্বালিয়ে ফোনের টর্চ জ্বেলে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল। বাঁধন মাথায় হাত দিয়ে বসে কিছুক্ষণ পর দরজায় হেলান দিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। এদিকে মায়া?!!!
এত রাত্রে ভাবিকে ডাক দিব কি না এটা ভাবতে ভাবতে একটা সময় ডাক দিয়েই ফেলল। মায়ার ডাকে ভিতর থেকে দরজা খুলে বাঁধনের কাজিন রাকিবের বউ। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে বাঁধনের ভাবি জিজ্ঞেস করে-
— কি হয়েছে মায়া?
—— মায়া আমতা আমতা করে বলেই ফেলে, ভাবি প্যান্ট লাগবে।
বাঁধনের ভাবি যেন আঁকাশ থেকে পরল।
ঘুম ঘুম ভাবটা আর ওনার চোখে নেই। মায়া যা বলল তা শুনে চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলল। তারপর প্রশ্ন করল-
” কিসের প্যান্ট? কার প্যান্ট?”
মায়া মাথা নিচু করে বলে,
আসলে ভাবি বাঁধন ভাইয়া আছে না?
ওনার একটা প্যান্ট দরকার।
মায়া মাঝে মাঝে এমন সব কথা বার্তা বলে যে- জীবনে যে কখনো হাসেনি সেও হেসে ফেলে, আর পলি ভাবি’তো হলো হাসির ডিব্বা, এমনিতে আজকে মায়া যা বলেছে তাতে ওনার হাসি থামবে বলে মনে হয় না।
মায়ার কথাটা শুনার পর থেকে পলি ভাবি হাসছে তো হাসছেই। ওনার হাসির আওয়াজে ওনার হাজবেন্ড রাকিব উঠে আসেন। স্ত্রীকে পিছন থেকেই থামিয়ে দেন মুখে হাত চেপে। রাগান্বিত ভঙ্গিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন-
” কি? শুরু করছ’টা কি এই রাত বিরাতে?”
মিসেস পলি কোনো রকম মুখ থেকে হাজবেন্ডের হাতটা সরিয়ে বলেন, আর হাসব না। রুমে যাও মায়ার সাথে একটু কথা বলেই চলে আসছি।
রাকিব রুমে চলে গেলে পলি ভাবি আবারো হাসা শুরু করে, তবে এবার আর উচ্চস্বরে নয়, এবার মুচকি মুচকি।
এদিকে বোকা মায়া জা’য়ের দুষ্টু হাসির কারণ বুঝতে না পেরে অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে বসে, কি হলো ভাবি? আসছ কেন?
পলি বাবা মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলেন, এখনো তো অনেক রাত বাকি মায়া। এখনি গোসল করে নিলে বাকি রাত কেমনে কি???
রাত, গোসল?!!!
কি সব বলছেন ভাবি? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।
পলি ভাবি মায়ার গাল টেনে দিয়ে বলে, ওরে ন্যাকা! যেন ভাঁজা মাছটা উল্টিয়ে খেতেও জানে না। দাঁড়াও, প্যান্ট এনে দিচ্ছি। কথাটা বলেই বাঁধনের ভাবি রুমে চলে যায়।
বোকা মেয়ের টনক নড়ে যখন দেখে পলি ভাবি হাতে প্যান্টের সাথে সাথে ওর জামা কাপড়ও নিয়ে আসছে। পলি ভাবির হাত থেকে প্যান্ট কিংবা থ্রি-পিছ কোনোটা না নিয়েই সে স্থান একরকম দৌঁড়ে ত্যাগ করে মায়া। দরজার সামনে বাঁধনের দাত বের করা হাসি দেখে রাগে জ্বলতে থাকে মায়া, কিন্তু কিচ্ছু বলেনি। চুপচাপ মায়া বিছানায় গিয়ে ধপাস করে বসে চোখ বন্ধ করে ফেলে।
দরজা আটকে সোফায় বসে হো, হো করে হাসতে থাকে বাঁধন।
মায়া রাগে, লজ্জায় শেষ। বাঁধনের প্রতি প্রচন্ড রাগে অভিমানে মায়া লাইট অফ করে বিছানায় শুয়ে পরে মুখ ঢেকে।
সোফা থেকে উঠে দাঁড়ায় বাঁধন। হাসতে হাসতে লাইট’টা জ্বালিয়ে দিয়ে মায়ার মাথার পাশে গিয়ে বসে।
মায়ার মুখের উপর থেকে ওড়নাটা সরিয়ে দিয়ে দুষ্টু হাসির সাথে ঠাট্টাই মেতে উঠে বাঁধন। প্রচন্ড রাগে বিছানা থেকে উঠে বাঁধনের বুকে, পেটে এলোপাথাড়ি কিলঘুসি মারতে থাকে মায়া। বাঁধন তখনো হাসতেই আছে। ক্লান্ত মায়া কিলঘুসি থামিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে শুরু করে।
বাঁধন হাসি থামিয়ে অভিমানীকে বুকে টেনে নেয়।
মিনিট পাঁচেক হয়ে গেল। মায়া তখনো বাচ্চাদের মত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মায়ার কান্নার জলে বাঁধনের বুকের একপাশের শার্ট ভিঁজে গেছে। বাঁধন ওর অভিমানীকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অন্যদিনের মত আজ আর মায়া বাঁধনের পরশে বিরক্ত কিংবা হাত পা ছুঁড়াছুঁড়ি করেনি। বাঁধনের জড়িয়ে ধরার সাথে সাথে সেও বাঁধনকে নিভিড় করে জড়িয়ে ধরে।
মিনিট দশেক কেটে যাওয়ার পর অভিমানীর চোখের জল মুছে দেয়ার জন্য বাঁধন ওকে কাঁধ থেকে সরায়।
কিন্তু একি?!!!
মায়া ঘুমিয়ে গেছে। খুব বেশী কান্না করলে কিংবা কষ্ট পেলে মায়া যে সে অবস্থায় ঘুমিয়ে যায়, সেটা বাঁধন রিলেশন চলাকালীন সময়েই মায়ার বান্ধবীদের থেকে শুনেছিল, আজ তা স্বচক্ষে দেখল।

আস্তে ধীরে বাঁধন মায়াকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মায়ার চোখের নিচে গড়িয়ে পরা জলের দাগ এখনো রয়ে গেছে। পরম আদরে বাঁধন ওর অভিমানীর চোখের জল মুছে, কপালে আলতো করে চুমু পরশ বুলিয়ে দেয়। ফ্যানের স্পিডটা পূর্বের ন্যায় কমিয়ে বাঁধন ওর কাথাটা মায়ার গায়ে ভালো করে টেনে দেয়।
এক হাতে ভর দিয়ে বাঁধন মায়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
না চাইতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে বাঁধনের। মনে মনে ভাবে-
“এতটা বোকা হয় কি করে মানুষ?”

মাঝরাত্রিতে ঘুম ভেঙে যায় মায়ার। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় মায়া দেখতে পায় খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বাঁধন ঘুমিয়ে আছে।
গা থেকে কাথাটা সরিয়ে বাঁধনের উপর দিয়ে, ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে টেবিলের উপর থেকে কম্বলটা এনে গায়ে দিয়ে শুয়ে পরার আগে আরো একবার বাঁধনের দিকে তাকায় মায়া।
ফ্যানটা এতটাই দ্রুতগতিতে চলছিল যে এই গরমেও বাঁধন কেঁপে উঠে। বাঁধনের ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ার মায়া হয় খুব। কম্বলটা গা থেকে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে বসে মায়া। তারপর বাঁধনকে টানতে টানতে বালিশে এনে শুইয়ে দিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত কম্বলের কিছু অংশ দিয়ে বাঁধনের শরীর ঢেকে দেয়।
বাঁধনের এত বড় শরীরটাকে টেনে ঠিক জায়গায় আনতে গিয়ে ঘেমে একাকার মায়া। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই কারেন্ট চলে যায়। মুহূর্তেই পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে যায়।
অন্ধকারে বিছানায় হাঁটতে গিয়ে হোঁচট খায় মায়া। তখনি ধপাস করে পরে যায়।
নাহ! মায়া ফ্লোরে পরেনি।
বাঁধনের পায়ের সাথে হোঁচট খেয়ে বাঁধনের বুকের উপরই পরে মায়া। তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে মায়া টের পাই বাঁধন মায়ার দু’বাহু শক্ত করে ধরে আছে।
—- উফফ, ছাড়ুন।
— নাহ,
—- এমন কেন করছেন?
— কারণ এখনো কারেন্ট আসেনি।
—— তো?!!!
—- পরের বার পরলে কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। ভুলে যেওনা পরনে কিন্তু লুঙ্গি আমার।
—— এত্ত খারাপ ক্যা আপনি?
—- বংশগতি রক্ষার জন্য এতটুকু তো খারাপ হওয়ায় যায়।
—– ওহহোহোহোহোহো….

কারেন্ট চলে আসে। মায়া তখনো বাচ্চাদের মত চোখ বন্ধ করে ঠোঁট বাকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। বাঁধন মুগ্ধ নয়নে মায়ার দিকে তাকিয়ে।
বাঁধনের কোনো আওয়াজ না পেয়ে চোখ খুলে মায়া।
— হাসছেন কেন?
—- কই, হাসলাম?
— খুব এনজয় করেন, নাহ?
—- কিসের কি, মায়া?

বাঁধনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বাঁধনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বাহিরে চলে যায় মায়া, মিনিট পাঁচেক পর ফিরে আসে।
ফিরে এসে কোনো কথা না বলে বাঁধনের গা থেকে কম্বলটা টেনে নিয়ে আসে। তারপর ফ্যানের স্পিড পুরোটা বাড়িয়ে কম্বল দিয়ে নাক মুখ ঢেকে শুয়ে পরে।
একটা নিরব হাসি দিয়ে বাঁধন কাথা নিয়ে শুয়ে পরে।

ঘন্টাখানেক যেতে না যেতেই ঘুম ভেঙে যায় মায়ার। মনে হচ্ছে তেলাপোকারা গিলে খাবে ওকে। কোথা থেকে যেন একের পর এক তেলাপোকা এসে মায়ার নাকে, মুখে, হাতে, পায়ে, মাথা, চুলে ছিটকে পরছে।
বাধ্য মায়া বাঁধনকে পিছন থেকে ধাক্কাতে শুরু করে। বাঁধন ছিল তখন ঘুমে অচেতন, তাই মায়ার ডাকে সাড়া দিতে পারেনি। অসহায় মায়া লাইট জ্বালিয়ে ফ্লোরে গিয়ে দাঁড়ায়। মায়া দেখতে পায় পুরো রুম জুড়ে তেলাপোকারা ছুটোছুটি করছে। ফ্লোরের দিকে তো তাকানোই যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে যেন তেলাপোকার কারখানা। ওড়না হাতে নিয়ে এপাশ ওপাশ দেখতে দেখতেই দুটো তেলাপোকা উড়ে এসে ওড়নায় বসে। ভয়ে ওড়নাটা খাটের পাশে চেয়ারের উপর রেখে রীতিমত লাফাতে থাকে মায়া।
বাঁধন জেগে যায়। ব্যর্থ মায়া তখন চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে।
একটা হাসি দিয়ে বাঁধন মশারীটা টানায়।
তারপর মায়াকে মশারীর ভেতর নিয়ে আসে।
মশারীর ভেতর এসে চুপসে বসে আছে মায়া।
এটা দেখে বাঁধনের প্রশ্ন, কি হলো? ঘুমোবে না???
মায়া করুণ চোখে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে বলে, এমনিতেই অসুস্থ, তারউপর আজ রাত্রিতে একটুও চোখের পাতা এক করতে পারিনি। আবার যদি ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে মাথাটা প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু করবে। আপনি কি একটু আমার পাশে বসবেন? মানে আমি ঘুমালে যাতে তেলাপোকা শরীরে বসতে না পারে, সেই জন্য।
মায়ার প্রশ্নের উত্তর সরূপ বাঁধন শুধু একটা হাসি দেয়, তারপর কিছু না বলেই মায়াকে টেনে বাঁধন ওর বুকে মাথা রেখে শুইয়ে দেয়। মিনিট দশেকের ভিতর পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরে মায়া।
ক্লান্ত বাঁধন তখনো মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর এদিক ওদিক তাকিয়ে তেলাপোকা আসছে নাকি দেখছে।
এ যেন তেলাপোকার হাত থেকে বউকে বাঁচানোর জন্য তেলাপোকা পাহাড়া দেয়া হচ্ছে…..

চলবে……

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০৯

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০৯
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

রাত্রি ৯টার দিকে মায়ার রান্নাবান্না শেষ হলো। ননদকে ড্রাইনিং টেবিলে খাবার পরিবেশন করতে বলে কিছু খাবার নিয়ে মায়া চলে যায় ওর দাদী শাশুড়ির রুমে।
বাঁধনের দাদীমা তখন শুয়ে শুয়ে তসবিহ জপছিল, মায়াকে দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তসবিহ হাত থেকে বিছানার একপাশে রাখলেন।
“ক্যা বউ নাকি? ঐখানে ক্যান, ভিতরে আসো।”
মায়া মিষ্টি হাসি দিয়ে ভিতরে গেল। হাতের ঐ খাবারের প্লেটটা বিছানার পাশের টেবিলটাই রেখে দাদী শাশুড়ির অনেকটা কাছে চলে যায় মায়া। তারপর মুখের কাছে গিয়ে কিছুটা জোর গলায় বলে উঠে, দাদীমা! খাওয়ার আগে ঔষধ আছে?
বাঁধনের দাদীমা কান খাড়া করে বলে, কি কস? বুঝি না তো….!
মায়া কাশি থামিয়ে আবারো জোর গলায় বলে উঠে- বলছি, রাতে খাবার আগে কোনো ঔষধ আছে?
দাদীমা আবারো কান খাড়া করে বলে, কি???
মায়া কিছুক্ষণ কাশি দিয়ে তারপর আবারো বলে উঠে, ঔষধ, ঔষধ খাবেন এখন? হসপিটাল থেকে যে ঔষধ দিয়ে দিয়েছে এবার সেগুলো কখন খাবেন?
বাঁধনের দাদীমা এবার বলে উঠে, আসছি তো একসপ্তাহ হয়ে গেল।
মায়া খুক খুক করে কিছুক্ষণ কাশি দিয়ে তারপর বলে, ওহ! দাদীমা…. আমি হসপিটাল থেকে কখন আসছেন এটা জিজ্ঞেস করিনি। বলছি রাত্রে খাবার আগে ঔষধ খেতে হয় কি না?!!!
উত্তরে বাঁধনের দাদীমার জবাব, না! রাত্রে খায়নি। মায়া এবার কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। কারণ, ইতিমধ্যে দাদীমা তসবিহ হাতে তসবিহ জপা শুরু করে।

নিশ্চুপ মায়া ননদ ফারহানাকে ডেকে আনার জন্য পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখে দরজার সামনে মুচকি হেসে বাঁধন দাঁড়িয়ে।
মায়া কিছু বলার আগেই রুমে আসে বাঁধন। বালিশের নিচ থেকে কি যেন বের করে দাদীর কানে গুজে দেয় সে। তারপর ধীর গলায় বলে, দাদীমা! রাতের ঔষধ কি খেয়েছ?
সহজ গলায় দাদীমার জবাব, খাওয়ার আগেরটা খায়ছি। তোর বাবা এসে খাইয়ে দিয়ে গেছে।
বাঁধন মায়ার দিকে তাকালো। মায়া ঢ্যাবঢ্যাব করে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে।
দাদীমার সাথে কথা বলার ক্ষমতা সবাই রাখে না। আর কথা বলার জন্যও কৌশল জানা চাই। এমন চিল্লানো শুরু করছিলে, কিছুক্ষণের ভিতর তো পুরো বাড়ির লোক জড়ো হয়ে যেত। ভাগ্যিস, আমি এসে গেছি। কথাটা বলেই ফিক করে হেসে দেয় বাঁধন।
দাদীমা তোমার খাবার। খাবার খেয়ে কিছুক্ষণ দেরী করে বাকি ঔষধগুলোও খেয়ে নিও। কথাটা বলেই বাঁধন চলে গেল।
মায়া ধীর পায়ে দাদীমার পাশে গিয়ে বসল। তারপর ওনাকে খাইয়ে দিয়ে নিচে চলে গেল।

রাত্রি ১০টা কি সাড়ে ১০টা বাজে_
চুপচাপ বাঁধন উপরের দিকে তাকিয়ে শুয়ে আছে। লাইটটা অফ করে ফুলস্পিডে ফ্যানটা ছেড়ে বিছানায় হাতড়াতে হাতড়াতে বাঁধনের বিপরীত পাশে যায় মায়া।
দু’জনেই চুপচাপ। কারো মুখেই কোনো কথা নেই।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর কম্বল গায়ে শুয়ে পরে মায়া।
মিনিট খানেক পর বাঁধন ফোনের আলোয় দেখে এরই মধ্যে নাকমুখ ঢেকে শুয়ে পরেছে অভিমানী। এই গরমে কম্বল, কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় বাঁধন।
ড্রিম লাইটের আলো জ্বেলে দিয়ে মায়ার পাশ ফিরে হাতে ভর দিয়ে শুয়ে আছে বাঁধন।
ঘন্টাখানেক পর কি মনে করে যেন কম্বলটা ক্ষাণিকটা ফাঁক করে চোখ দুটো বের করে মায়া। বাঁধন তখনো ঐভাবেই হাতে ভর দিয়ে শুয়ে। ঘাবড়ে যায় মায়া। সেই সাথে কিছুটা লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি মুখটা ভিতরে নিয়ে যায়।
বাঁধন পূর্বের ন্যায় তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
নিশ্চুপ মায়া কম্বলের ভিতর আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে আবারো কম্বলের ভিতর থেকে চোখ দুটো বের করে উঁকি দেয়। পূর্বেকার মতই বাঁধন তখনও হাতে ভর দিয়ে শুয়েছিল। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় মায়া স্পষ্ট দেখতে পায় ওর বাঁধনের চোখের কোণে জমে থাকা জলগুলো কেমন চিকচিক করছে।
এতদিন ধরে করে আসা অন্যায় অবিচারের জন্য মায়া আজ সত্যিই অনুতপ্ত। মায়ার ভিতরটা কেমন অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হচ্ছে।
মায়া স্থির করেছে বাঁধনের সাথে এতদিন ধরে করা প্রতিটি অন্যায় অবিচারের জন্য আজ ক্ষমা চেয়ে নিবে। যে করেই হোক বাঁধনের থেকে ওর ক্ষমা পেতেই হবে। না হলে যে ওর ইহকালটাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। কেননা, যেভাবে আর যে করেই হোক মায়া জানে ও বাঁধনের বিবাহিতা স্ত্রী।

মায়া বাঁধনের দিকে তাকায়। বাঁধন কেবলি তখন বালিশে মাথা রেখে শুয়েছে।
ধীর গলায় মায়া বলে উঠে-
—– স্যরি,
– ঘাড়টা ঘুরিয়ে চোখ মেলে তাকায় বাঁধন, কিসের স্যরি?
—— আমার ভুল হয়ে গেছে।
– কিসের ভুল?
——- আমি এতদিন আপনার সাথে যা করেছি সব ভুল। সত্যি আজ বুঝতে পারছি আপনিই ঠিক, আমি ভুল।
– এতদিন ধরে কি করছ তুমি? আর কোনটা ভুল? আর আমিই বা সঠিক এটা কিসের ভিত্তিতে বলছ?
——– এতকিছুর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আমি করতে পারব না। আমি শুধু জানি আমি আপনার বিয়ে করা বববব…..(….)….???
– হ্যাঁ, বলো। তুমি আমার কী?
(মুচকি হেসে বাঁধন)
——- জানি না……(ঘোর লজ্জা পেয়ে)
– তাহলে কিসের ক্ষমা কিসের কি?
(কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে)
——- বলছি…..?
– জ্বি, বলো…..?
——- আমি মানে বলতে চাচ্ছি আমাদের বিয়ে হয়েছে।
– তো, এখানে আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কি আছে? আর তোমার অন্যায়’ই বা কোথায়?
——- বুঝতে কেন পারছেন না আমি আপনার বি ব ববববব……(…..)….???
– কি সব বি ববববব করছ? স্পষ্ট করে বলতে পারলে বলো, না হলে আমি ঘুমাচ্ছি।
——-……..
– ওকে, ফাইন। আমি ঘুমাইলাম।
—– আপনি আপনার বববববব ব…(…)…????
– বলো……
—— বববববব….. (…..)….???
– বলো, ??
——- মজা করেন? হাসার কথা বলছিলাম আমি আপনাকে???
– কি জ্বালা! হাসলাম কোথায় আমি? তুমি না বললে আমি ক্ষমা করব কিসের ভিত্তিতে? কোন সে অপরাধে?
—– লাগবে না আপনার ক্ষমা….

কথাটা বলেই অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নাক মুখ কম্বলে ঢেকে শুয়ে পরে মায়া। রীতিমত রাগে ফুসছে সে। আজ আমার দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে আমায় নিয়ে হাসাহাসি?!!! হুহ! লাগবে না আমার ক্ষমা। প্রচন্ড অভিমানে কান্নায় নাক মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে মায়ার।
মায়ার খুব ঘুম পাচ্ছে। চোখটা কেমন না চাইতেই লেগে আসছে। ঘুমে ঢুলুঢুলু মায়া টের পায় ওর শরীর থেকে একটু একটু করে কম্বলটা সরে যাচ্ছে। প্রথমে পা, তারপর শরীর কম্বলবিহীন হয়ে যাচ্ছে। পুরো ব্যাপারকে মায়া ঘুমের ঘোর ভেবে উঁড়িয়ে দিয়েছে। হতে পারে ঘুমের ঘোরে এমন ভাবনা হচ্ছে এটা ভেবেই চুপ রইল মায়া। কিন্তু সত্যি’ই কি ঘুমের ঘোর থেকে এমন হচ্ছে?
মনে তো হয়, না। না হলে কম্বলের সাথে ফ্যানের স্পিডটা কমে যাবে কেন? আসলে কি হচ্ছেটা কি? এটা ভেবেই চোখ খুলে তাকায় মায়া।
চোখ খুলে তো হতবাক মায়া!
—– এ আপনি কি করছেন? কম্বলটা টেবিলের উপর রাখছেন কেন?
– এমনি, আমার ঘুমাতে ঝামেলা হচ্ছে, তাই!
—— দেখুন, এবার কিন্তু বেশী বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।
– আমার ক্ষমা পেতে হলে এই বাড়াবাড়ি’টাকেই মেনে নিতে হবে।
——- মানে???
– মানে খুব সহজ। এই কম্বল ওখানেই থাকবে।
——– কিন্তু আমি যে ঘুমাতে পারি না কম্বল ছাড়া।
– সেই জন্যই তো ফ্যানের স্পিডটা কমিয়ে দিয়েছি।
—— তারপরও আমার পাতলা কাথা হলেও লাগে।
– আছে তো…..
—— কোথায়???
– এই যে….
—— এটা তো আপনার গায়ে দেয়া। আমার গায়ে দেয়ার কাথা এখন কোথায় পাব?
– এত কথা না বলে আসো না নিচে।
—— কিহ?!!!
– আমার না কাথার…..???
——- এটাও কি ক্ষমার পূর্বশর্ত?
– বলতে গেলে বলতে পারো সেটাই।
——– আচ্ছা…?
– কি হলো? আচ্ছা বলে থেমে গেলে কেন?
—— আপনি লুঙ্গি পরেছেন???
– হ্যাঁ, পরেছি। কেন বলো তো?
—– এ্যাঁ, না…………
আমায় নতুন করে মাফ করেন। আমি পারব না কাথার নিচে যেতে…….
– হায় আল্লাহ! এখানে আমার লুঙ্গির কি দোষ??????
– ????

চলবে……..

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০৮

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মায়া- বাঁধনের চোখাচোখির মাঝেই সেখানে হাজির হয় হোটেল মালিক শাহিদ মাহমুদ।
‘খাওয়া হয়েছে?’
মায়ার দিকে তাকিয়ে স্মিতহাস্যে প্রশ্ন করেন হোটেল মালিক। ওনার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট হাসি দিয়ে পার্স থেকে টাকা বের করে মেলে ধরে মায়া। বাঁধন মায়ার হাতটা ওর হাত দিয়ে ঠেলে দুরে সরিয়ে বলে উঠে, কাকা!
মায়া…. তোমার ভাতিজার বউ…(মায়ার দিকে তাকিয়ে বাঁধন)।
হোটেল মালিক ওরফে বাঁধনের কাকা অবাক দৃষ্টি নিয়ে মায়ার দিকে তাকাই। এরই মাঝে একবার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে ফেলেছেন ওনি। মায়াও অবাক বিস্ময়ে হোটেল মালিকের দিকে তাকিয়ে আছেন। অনেকগুলো প্রশ্ন ওকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। উত্তর না জানা পর্যন্ত ওর নিস্তার নেই। বাঁধনের দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে উঠে বাঁধন, মায়া! ইনি’ই সেই কাকা, যার কথা তোমাকে বলতাম। মায়ার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে। স্মিতহাস্যে প্রশ্ন করে, মানে ওনি শাহিদ মাহমুদ কাকা? রসিক কাকা?
হায়রে!
রসিক কথাটা এখানে না বললেই নয়? বাঁধন লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। মায়া মিষ্টি হেসে সালাম এবং কুশল বিনিময় করে চাচাশ্বশুরের সাথে। মায়ার খাওয়ার বিল আর দেয়া হয়নি। উল্টো ওর হাতে চকচকে ১হাজার টাকার নোট ধরিয়ে দেয় শাহিদ মাহমুদ মানে বাঁধনের কাকা। বাঁধন মায়াকে নিয়ে চলে যাচ্ছিল, পিছন থেকে ডাক দেয় কাকা। শুন….
বউরে লইয়্যা আইয়্যা পরিস রাত্রিতে, তোর কাকি খুশি অইব্য, আর দু’জোড়া টুনাটুনিতে আড্ডাও বেশ জমবে।
বাঁধন মৃদু হেসে মায়ার দিকে তাকায়। মায়া লজ্জায় মাথা নিচু করে।
হাঁটা শুরু করে বাঁধন।
দু’জন পাশাপাশি হাঁটছে। কিন্তু দু’জনেই বেশ চুপচাপ। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। হাঁটার সময় দুটো হাতের পৃষ্ট একসাথে লেগে মৃদু কাঁপনির সৃষ্টি হচ্ছে। কিছুদুর এগুতেই বাঁধন রিক্সা ডাকে। যদিও মায়ার ইচ্ছে হচ্ছিল বাঁধনের পাশাপাশি একটু হাঁটতে, তবুও রিক্সায় উঠেই গেল। কারণ, সব ইচ্ছেকে সব সময় প্রশ্রয় দিতে নেই। আর তাছাড়া বাঁধনের হাঁটাতে এলার্জি আছে সেটা মায়া রিলেশন চলাকালীন সময়ে বাঁধনের মুখ থেকে একাধিকবার শুনেছে, তাই মায়া নিঃশব্দে রিক্সায় উঠে বসে। রিক্সায় উঠে মায়ার নিজেকে সিনেমার হিরোইনদের মত মনে হচ্ছে, কিন্তু বাঁধন?!!!
ওর মনে হয় মোটেও নিজেকে ঐ হিরোইনের হিরো মনে হচ্ছে না। মনে হলে এতক্ষণে ঠিক ইতস্তত করে হলেও পাশে বসে থাকা হিরোইনের হাতটা আলতো করে চেপে ধরত।
নিশ্চুপ মায়া কিছুক্ষণ করুণ চোখে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। উদাসীন দৃষ্টিতে মায়া অন্য দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে।
বাঁধন হাসি আটকে ওর অভিমানীর দিকে তাকায়। সত্যি বলতে ওরও ইচ্ছে হচ্ছে মায়ার হাতদুটো আলতো করে ছুঁয়ে দিতে কিংবা মাথার ঐ অবাধ্য চুলগুলো যা ওড়নার নিচ থেকে বেরিয়ে ওর চোখে মুখে এসে ছিটকে পরছে, সেগুলো পরম যত্নে কানের পাশে গুজে দিতে কিংবা এতটা কাল ধরে করে আসা কল্পনার মতই রিক্সার হুড ফেলে আচমকা ওর মায়াকে জড়িয়ে ধরতে কিংবা হঠাৎ করে কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে ‘লক্ষ্মী ভালোবাসি তো’ বলতে।
এই এরকম হাজারো কিছু ইচ্ছে হচ্ছে বাঁধনের, কিন্তু এই মুহূর্তে সেই ইচ্ছেগুলোর কোনো প্রাধান্য দিচ্ছে না। কেননা, বাঁধন চাচ্ছে আজ অন্যকিছু হোক। অভিমানী ওর সব অভিমান ঝেড়ে ফেলে ওর কাছে ছুটে আসুক। রিলেশন চলাকালীন সময়ে বাঁধন যে কথাটি শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল, আজও বাঁধন ওর মায়ার মুখ থেকে সেই কথাটি শুনতে চায়। বাঁধন ওর অভিমানীর মুখ থেকে শুনতে চায়-
” কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না।”
মায়ার বলা কথার মধ্যে এই একটি কথা বাঁধনের অদ্ভুত রকম ভালো লাগে। মায়া হয়তো বলে, ভালোবাসি না। কিন্তু বাঁধন মায়ার এই ভালোবাসি না কথার মধ্যে অন্য রকম কিছু খুঁজে পায়। আর সেই অন্যরকম কিছুর স্বাদ আস্বাদনের জন্যই বাঁধনের বার বার একই কথা, ‘ভালোবাসি তো লক্ষ্মী’। আর নিত্যকার নিয়মে মায়ার সেই প্রশ্নের জবাব হিসেবে বলা, কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না।
বাজান, আইয়্যা পরছি!
রিক্সাওয়ালার কথায় হুশ ফিরে বাঁধনের। তাকিয়ে দেখে রিক্সা থেকে নেমে মায়া হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দুরে চলে গেছে। চটজলদি রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে মায়ার দিকে ছুটতে থাকে বাঁধন।
কি হলো? আমি ডাকছি, শুনতে পাচ্ছো না?
বাঁধনের প্রশ্নে চুপসে দাঁড়ায় মায়া। বাঁধন আবারো বলা শুরু করে, আর এদিকে কোথায় যাচ্ছ? এদিকে কি তোমার নতুন শ্বশুরবাড়ি নাকি? মায়া উদাস দৃষ্টি মেলে বাঁধনের দিকে একবার তাকায় তারপর চুপচাপ হাঁটতে থাকে বাঁধনের পিছুপিছু। শ্বশুরবাড়ির ত্রিসীমানায় পা রাখতেই বাঁধন একটা পিচ্চিকে ডাক দেয়–
” ঐ হাসান! এদিকে আয়!”
পিচ্চিটা বাঁধনের ডাক শুনে ছুটে আছে।
” কাকা, কিছু বলবা? তাড়াতাড়ি বলো, আমার নৌকা ডুবে যাচ্ছে।”
পিচ্চিটার দিকে তাকিয়ে থ হয়ে যায় মায়া। এ সেই পিচ্চিটা যার সাথে পুকুরপাড়ে দেখা হয়েছিল। এ তাহলে বাঁধনের কাজিনের ছেলে হাসান মাহমুদ? মায়া এতক্ষণে পিচ্চিটার তখনকার হাসির রহস্য বুঝতে পারে। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটে উঠে ওর।
” এ তোর কাকিমা! সালাম দে…”
বাঁধনের কথায় পিচ্চি হাসান মাহমুদ একবারের জন্য মায়ার দিকে ফিরে তাকায়। তারপর কিছু না বলেই হাসতে হাসতে দৌঁড়ে সে স্থান ত্যাগ করে।
” কত বজ্জাত হয়েছে। লজ্জায় নিজের বউয়ের সামনে নাক কান কাটা গেল। এ মুখ আমি কই লুকাবো।”
বাঁধন কথাগুলো মনে মনে ভাবছিল, মায়া তখনি জোরে হাসা শুরু করল।
বাঁধন মুখ কালো করে বলল, হাসির কি হলো এখানে? এভাবে হাসছ কেন? মায়া হাসিটা কোনোরকম থামিয়ে বলল, এমনি!
এমনি এমনি কেউ পেত্নী মার্কা হাসি দেয়?
বাঁধনের শেষের কথাটায় কষ্ট পেল মায়া।
হাসি থামিয়ে পূর্বেকার মতই মুখটা মলিন করে ফেলল। মনে মনে, আগে যখন হাসতাম তখন মনে হতো হাসিতে মুক্তো ঝরে আর এখন যখন হাসছি তখন মনে হচ্ছে পেত্নী হাসে। অভিমানে গাল ফুলিয়ে বাঁধনের পিছুপিছু বাসায় ঢুকলো অভিমানী মায়া।

একমাত্র পুত্রবধূকে সামনে পেয়েই যেন অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছে বাঁধনের মা। কারো কোনো সাহায্য ছাড়াই হাসতে হাসতে বিছানায় উঠে বসেন ওনি। মায়ার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বাসার সবার খবর নিচ্ছেন।
এদিকে মায়ার আসার খবর শুনে বাড়ির পিচ্চিরা মুহূর্তেই এসে জড়ো হয়ে গেলো। সবার মুখেই হাসি। মায়াকে খুঁজে পেয়ে ওরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। খুশি হওয়ারও একটা কারণ আছে। কারণ, এই বাড়িতে মায়ায় একমাত্র বধূ স্যরি বধূ বললে ভুল হবে, মায়ায় একমাত্র মেয়ে যে আসলে পুরো বাড়ি খুশির আমেজে মেতে উঠে।
ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে মায়ার হাসি, মায়ার কথা পুরনো দেয়ালের চারপাশে প্রতিধ্বণিত হয়ে যখন ফিরে আসে, তখন আশেপাশের মানুষজন বুঝতে পারে এ বাড়িতে মায়া এসেছে। যার মায়ার বাঁধনে দেয়ালগুলোও কেমন আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে আছে। তাইতো মায়ার হাসিতে, কথা বার্তায় এক মোহনীয় সুরের ঝংকার সৃষ্টি করে এ বাড়ির চারপাশের দেয়াল। মায়া এসেছে, এ বাড়ির প্রাণ ফিরে এসেছে সেটাই দেয়ালগুলো জানান দেয়।
শাশুড়ির সাথে কথা বলা শেষে শ্বশুরের রুমে যায় মায়া। মায়ার পিছুপিছু বিচ্ছুরাও গেল বাঁধনের বাবার রুমে। সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করার একপর্যায়ে মায়া দেখতে পায় পিচ্চিরা যে যার মত বাহিরে চলে যাচ্ছে মন খারাপ করে।
মায়া শ্বশুরের রুম থেকে বেরিয়ে নিচতলায় দাদী শাশুড়ির রুমে যায়।

এদিকে ফ্রেশ হয়ে দোতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল বাঁধন। আর তার ঠিক নিচেই বাচ্চারা বলাবলি করছে-
” মায়া’পু বোধ হয় এবার আর আমাদের সাথে খেলবে না।”
আরেকজন বলছে, খেলবে কিভাবে? দেখিস নি ওর কাশি?
ধূর! ভাল্লাগে না……
এই শুন! আমার কাকিমারও এমন কাশি হয়ছিল, কাকিমা তখন তুলশী পাতার রস খায়ছে আর ভালো হয়ে গেছে। আমরা যদি মায়া’পুরে তুলসী পাতা এনে দেই?
আনন্দে একসাথে হুল্লোর দিয়ে সবাই চলে গেল তুলসী পাতার সন্ধানে, উপরে বাঁধন ওদের কথা শুনে আনমনেই হেসে উঠে।

সবার সাথে পরিচয় পর্ব শেষে মায়া যায় ওর ননদ ফারহানার রুমে। খাটে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় তন্ময় হয়ে কানে হ্যাডফোন গুজে কি যেন শুনছে। হতে পারে ওর হিরোইনের কথার রেকর্ড শুনছে।
এটা ছাড়া এই অবেলায় শুয়ে আর কিবা করবে? চুপচাপ মায়া ননদের পাশে গিয়ে বসে। ‘বাব্বাহ্! খুব খুশি মনে হচ্ছে। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আজকে কি এমন করল, হুম?
চটজলদি বিছানা থেকে উঠে বসে বুকে থু, থু দেয় ফারহানা। একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে বলে উঠে, আপু তুমি? যা ভয়টাই না পাইয়ে দিয়েছিলে!
মুচকি হেঁসে মায়ার প্রশ্ন, আবহাওয়া চেঞ্জের পূর্বাভাস পাচ্ছি, ব্যাপার কি?
ফারহানা মাথা চুলকিয়ে বলে, কি যে বলো না আপু-ভাবী?!!!
আপু- ভাবী?!!!
সেটা আবার কেমন?????
আর বলো না। আমি তোমাকে আপু কেন ডাকি, এই নিয়ে বুড়িদের কথার শেষ নেই। বুঝতে পারছি না আমি আমার ভাবিকে আপু ডাকি, ওদের কেন এত জ্বলে?
হা, হা!!!
এভাবে বলতে নেই বোন, ওরা মুরুব্বী তো। বলতেই পারে। তাই বলে ওনাদের কথায় কষ্ট পেলে চলবে???
মায়ার কথায় মাথা ঠান্ডা হয় ওর ননদের। তারপর আড্ডায় মেতে উঠে। সন্ধ্যার পর মাগরিবের নামাজ শেষে বাসায় আসে বাঁধন। ওর আকুল নয়ন দুটি যেন এদিক ওদিক তাকিয়ে মায়াকেই খুঁজছিল কিন্তু কোথাও পায়নি বাঁধন মায়াকে।
রাত্রি তখন ৮টা বাজে। বাঁধন মাকে দেখার বাহানায় মায়াকে খুঁজতে যায়। প্রশ্ন করার আগেই বাঁধনের মা বলে উঠে, সেই সন্ধ্যা থেকে বলছি অসুস্থ শরীরে রান্না করতে হবে না, দাদীর পাশে গিয়ে বস। আমার কথা শুনলো না। গিয়ে দেখে আয় না রান্না কতদূর এগুলো?
মায়ের কথা শুনে বাঁধন হতবাক!
এই অসুস্থ শরীরে মায়া রান্না করতে গেছে? একদিন ওনারা রান্না করতে পারল না???
বাঁধনের প্রশ্নে ওর মায়ের জবাব, যৌথ ফ্যামিলি তো! তাই হয়তো ভাবছে রান্না না করলে যদি কেউ কোনো কথা শুনায় আমাকে, তাই হয়তো গেছে। বাঁধন মায়ের কথার পাল্টা জবাবে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, যৌথ ফ্যামিলি দেখেই তো ওর ছাড় আরো বেশী পাওয়ার কথা। আর ওরা যেমন শহর থেকে তোমার অসুস্থতার খবর শুনে এসেছে তেমনি মায়াও দুর শহর থেকে তোমাকেই দেখতে এসেছে। তো ওরা যদি একেকজন একেক দিকে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে, তাহলে মায়া কেন পারবে না?
বাঁধনের মা আর কোনো কথা বাড়ায়নি।
বাঁধনও রাগে হনহনিয়ে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। দুর থেকেই বাঁধন মায়াকে দেখতে পায়। ওড়না কোমড়ে গুজে দিয়ে পাঁকা গৃহিণী বধূদের মত কোমড়ে হাত দিয়ে মাছ ভাজি উল্টাচ্ছে আর একটু একটু পর কপালের ঘাম মুছছে।
বাঁধনের কল্পনার সংসারে ওর বউ যেভাবে রান্না করত, আজ মায়াকে সেভাবেই রান্না করতে দেখে মুখে একচিলতে হাসি ফুঁটে উঠে বাঁধনের। কেমন যেন ঘোরের মধ্যেই বাঁধন মায়ার অনেকটা কাছে চলে যায়। কাছে গিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনি রাখে।
ঠান্ডায় জমে গেছে মায়ার গলা। ভাঙা গলায়’ই মায়া বলতে থাকে, ছাড়ুন! এখানে আমি একা আসিনি, ফারহানাও এসেছে রান্না করতে। ঘোরের মধ্যেই বাঁধন বলে উঠে, থাকুক ফারহানা।
ততক্ষণে হাতে একটা বাটি নিয়ে ফারহানা এসে হাজির। ই, ই করে লজ্জায় অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় ফারহানা। এর চেয়ে অধিক লজ্জায় মায়াকে ছেড়ে মাথা চুলকাতে চুলকাতে কিচেন ত্যাগ করে বাঁধন।

চলবে……

[

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০৭

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মাগরিবের নামাজ পড়ে সন্ধ্যার পর পরই আবারো কল দেয় মায়া। বাঁধনের ফোন তখনো বন্ধ। অভিমানী মায়া মন খারাপ করে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
গেইট’টা আস্তে করে ফাঁক করে বাসায় ঢুকে সুমি। সুমি মায়ার কাজিন। বয়সে মায়া সুমির থেকে বছর দুয়েক বড় হলেও, তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। বাঁধনের সাথে রিলেশন চলাকালীন সময়ে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর বিষয়গুলোও মায়া বোন সুমির সাথে শেয়ার করত। ওদের মধ্যে কোনো সমস্যা হলে সুমি তা সমাধানের প্রাণপন চেষ্টা করত। কখনো বা রাগী মায়াকে বিভিন্ন কৌশলে সুমি কন্ট্রোল করত, বাঁধনের সাথে কথা বলিয়ে দিত। তাই সুমিকে মায়ার মন খারাপের সাথী বললেও খুব একটা ভুল হবে না।
ওহ, হ্যাঁ! যে কথাটি বলছিলাম___
মন খারাপ করে বারান্দার রেলিং ধরে চুপসে দাঁড়িয়ে ছিল মায়া। পিছন থেকে সুমি হাত রাখে মায়ার কাঁধে। কিছুটা চমকে পিছনে তাকায় মায়া।
” ওহ, সুমি আপু?!!!”
— অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়েছিলাম, মন খারাপ???
” কই?! নাতো!!!”
—— বাহ্! আমার বোনটা তো দেখছি বেশ বড় হয়ে গেছে।
জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে সুমির দিকে একবার তাকালে মায়া। সুমি ঠোঁটের কোণে মলিন হাসির রেখা টেনে বলল, খুব কথা লুকানো শিখে গেছিস, তাই না?
সুমির প্রশ্নে মাথা নিচু করে ফেলে মায়া।
হঠাৎ’ই বৃষ্টি পরা শুরু করে। বাহিরে হাতটা বাড়িয়ে দেয় মায়া। পূর্বেকার মতই বৃষ্টির কয়েক ফোঁটা মায়ার হাতে এসে পরতেই হাঁচি শুরু হয়ে যায় মায়ার। একটানে সুমি মায়াকে রুমে নিয়ে যায়। রুমে খাটে বসিয়ে সুমি ওর ওড়না দিয়ে মায়ার হাতে লেগে থাকা বৃষ্টির পানিগুলো মুছে দিচ্ছে। মায়া ঢ্যাবঢ্যাব চোখে কাজিন সুমির দিকে তাকিয়ে আছে।
—- এভাবে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে থাকলে হবে না। মন খারাপের কারণ জানতে চাই আমি। কি হয়েছে সেটা শুনতে চাই আমি। আমি জানতে চাই, আমার বোনটার চোখে কে অশ্রু জড়িয়েছে?
কাজিনের আহ্লাদমাখা কথা শুনে আহ্লাদী মায়া চোখের পানি ছেড়ে দেয়। এখন শুধু ঠোঁট বাকাতে বাকি।
—– বল, কি হয়েছে?
কাঁদো কাঁদো গলায় মায়ার জবাব, ও আমার সাথে রাগ করে মামার বিয়ে না খেয়েই সকালে চলে গেছে। ও বাড়ির সবাই এজন্য আমায় খুব বকেছে…..
—– কল দিসনি পরে?
— দিয়েছিলাম, কিন্তু ফোন বন্ধ;
—— পাগলী মেয়ে! এইজন্য এত কান্না করা লাগে? হতে পারে ওর ফোনে চার্জ নেই কিংবা ফোন বন্ধ করে ভাইয়া হয়তো নামাজ পরতে গেছে।

সুমির কথা শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হলেও বেশীক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে পারেনি মায়া। ওর ধারণা, বোকা মায়াকে কিছু শান্ত্বনার বাণী দিয়ে সুমি শুধু চুপ করিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বাঁধন ওর সাথে রাগ করেই ফোন বন্ধ করে রেখেছে।
রাত্রি ১১টা বেজে ১৯মিনিট তখন। এরই মধ্যে কয়েকশত বার ট্রাই করে ফেলেছে মায়া। প্রতিবারই ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। আবারো কল দেয় মায়া। এবার আর মন খারাপ করে ফোনটা কান থেকে নামাতে হয়নি। এবার রিং বাজছে। রিং বেজে একবার আপনাআপনি কেটে যায়, কেউ কল রিসিভ করেনি। মায়া আবারো কল দেয়। এবার ওপাশ থেকে ফোনটা রিসিভ হয়। গভীর উৎকন্ঠার সাথে মায়া “হ্যালো” বলে উঠে।
—– কিছু বলবে?

না মানে আপনি আসলে আপনি কি…. (…)…???
এভাবে আমতাআমতা কেন করছ? কিছু বললে তাড়াতাড়ি বলো, আমি ঘুমাবো। অনেকটা বিরক্তিকর স্বরে বাঁধন কথাগুলো বলল। নরম স্বরে মায়ার প্রশ্ন, খুব ঘুম পাচ্ছে?
—– হুম। খুব ক্লান্ত আমি…..
– ঠিক আছে, ঘুমান তাহলে।
—— রাখি….
– এই শুনোন……
——- কি?
– খেয়েছ রাত্রে???
——–……….
– স্যরি, খেয়েছেন?
—– প্রশ্নোত্তর কোনো কথা বলেনি বাঁধন। শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কলটা কেটে দেয়।

সারারাত্রিতে একটাবারের জন্যও চোখের পাতা এক করতে পারেনি মায়া। শেষ রাত্রিতে বাঁধনের ফোনে আবারো কল দেয় মায়া। কলটা রিসিভ করে বাঁধন। কাঁপা কাঁপা গলায় “সালাম” দেয় মায়া। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বাঁধন সালামের জবাব দিয়ে বলে, কিছু বলবে?
——ফজর নামাজের সময় হয়েছে। উঠে পরুন। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আজান দিবে।
– ওকে।
——- আচ্ছা, রাখি তাহলে।
– ওকে।
——- মায়া কলটা কেটে ফোনটা বালিশের নিচে রেখে একটা বালিশকে বুকে জড়িয়ে ধরে ঠোঁট বাকিয়ে কান্না করতে থাকে। তারপর কান্না করতে করতেই ঘুমিয়ে পরে।

সকাল ৮টা কি সাড়ে ৮টা বাজে তখন,
ও বাড়ি থেকে মায়ার মা-ও চলে এসেছে মায়ার পরীক্ষা আছে বলে। রান্না করে মায়ার মা মায়াকে ডাক দেয়। ঘুম জড়ানো কন্ঠে মায়ার জবাব, খুব কাশি পাচ্ছে। একটু পর উঠছি মা। এখন আর ডেকো না। কারণ, কথা বললেই আমার কাশি উঠে, আর কাশি দিলে বুকে ব্যথা পাই।
মায়ার মা চলে গেল। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করে ভেঁজা ভেঁজা চোখে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে মায়া। এতবেলা হয়ে গেল একটা কলও দেয়নি বাঁধন। অথচ আগে তো বাঁধন…..(…..)…??? ভাবতেই জলে ভরে যায় চোখ।
ফেসবুকে গিয়েও বেশীক্ষণ টিকতে পারেনি মায়া, চলে আসে ফেসবুক থেকে। সকাল ১১টার দিকে রওয়ানা দেয় পরীক্ষা কেন্দ্রের দিকে। বিকেলের দিকে বাসায় ফিরেও আবারো চাতকের ন্যায় ফোনের স্ক্রিনের দিকে একটি ফোন কলের আশায় চেয়ে থাকা। বাঁধন আর কল করে না। রাত্রেও বাঁধনের একটা কলের আশায় বসে থাকত মায়া, কিন্তু বাঁধনটা কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল। আগের মত আর মায়াকে কল দিয়ে বিরক্ত করত না। তিনবেলা খাওয়ার আগে কল এসএমএস করে বলত না, লক্ষ্মী! খেয়ে নাও কিংবা খেয়ে বিকেলের দিকে পুকুরপাড়ে ঘুরতে যেও কিংবা গোসল করে একটু ঘুমিও। এখন আর ভরা জোৎস্নাতে বাঁধন মায়াকে বিরক্ত করে না।
ঘুম থেকে জাগিয়ে দিয়ে বলে না-
লক্ষ্মী! বাইরে দেখো কি সুন্দর চাঁদ কিংবা জানালাটা খুলে দাও, চাঁদের আলোয় আলোকিত হয়ে যাবে তোমার ঘর। অনেক রাত ভর ফেসবুকে থাকলে এখন আর কেউ ধমক দিয়ে বলে না, রাত হয়েছে অনেকটা। ঘুমাতে যাও……

বাঁধনবিহীন মায়ার দিনগুলো এভাবেই কাটছিল।

সেদিন ছিল মায়ার পরীক্ষার শেষের দিন। পরীক্ষা হলে যাওয়ার আগ মুহূর্তে মায়ার বাসা থেকে কল আসে। মায়া ওর বোন মারফত জানতে পারে, বাঁধনের মা মানে ওর শাশুড়ি মা খুব অসুস্থ্য। ৪ঘন্টার পরীক্ষা ১ঘন্টায় দিয়ে হল থেকে বেরিয়ে যায় মায়া।
মায়া গাড়িতে উঠে গেছে।
গন্তব্যস্থল- শ্বশুর বাড়ি।
ঘন্টা তিনেকের মধ্যে মায়া বাঁধনের গ্রামে উপস্থিত হয়। কিন্তু সমস্যা একটাই। ওর শ্বশুরবাড়ি যে ঠিক কোনটা মায়া সেটাই বুঝতে পারছে না। বিশাল বড় গ্রামের পুরোটা ঘুরে ফিরে একটা পুকুরপাড় গিয়ে হাজির হয় মায়া। কল করে বাঁধনকে। প্রতিবারের মত এবারো বাঁধনের জবাব,
এই অসুস্থ শরীরে তুমি আমার গ্রামে চলে আসছ, এটা তুমি বলছ আর আমি বিশ্বাস করব, ভাবলে কিভাবে? বহু অনুনয় বিণয়ের পরও মায়া পারেনি বাঁধনকে বিশ্বাস করাতে ও মজা নয়, সত্যিই এসেছে ওদের গ্রামে।
কলটা কেটে দেওয়ার পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনের দিকে তাকায় মায়া। অনেকগুলো পিচ্চি পুকুরে ঝাপ দিচ্ছে আর খেলছে। মায়া ওদেরকেই ডাক দিল। হাসি হাসি মুখে ভেঁজা শরীরে একটা পিচ্চি ছুটে আসল মায়ার দিকে।
” কা…..কী….(…….)….????”
পিচ্চিটার পুরো কথা শুনার মত টাইম মায়ার কাছে ছিল না। গম্ভীর কন্ঠে মায়া প্রশ্ন করে, বাঁধন বলে এই গ্রামে একটা ডাক্তার আছে। তুমি চিনো ওর বাড়ি???
মায়ার প্রশ্নের জবাবে পিচ্চিটা হাসি দিল। আর ঐভাবে হাসতে হাসতেই পুকুরের পানিতে ঝাপ দিল। মায়া পিছু পিছু পুকুরপাড়ের ঐ স্থানটাই যায়। প্রশ্ন করে আবারো- ঐ পিচ্চি, বলো না। আমি আসলে ওনার বাড়ি চিনি না।
পিচ্চিটা হাসতে হাসতে বলে, এ্যা, মিছা কথা কয়। চিনে না বলে…..!!!
ব্যর্থ হয়ে মায়া ফিরে যায় পিছনে ফেলে আসা বাজারটাই। ততক্ষণে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে ওর। মায়া আবারো ঐ হোটেলে ঢুকে, যে হোটেল থেকে মিনিট ত্রিশেক আগেও খেয়ে গিয়েছিল। নাহ! এবার আর ভাজিভুজি খেতে বসেনি মায়া, এবার ভাতের অর্ডার দিয়েছে। ভাতের প্লেট সামনে এনে রাখতেই মায়া নাক ছিটকায় উঠে দাঁড়ায়। তারপর অত্যন্ত নরম স্বরে বলে, আংকেল! ভর্তা নেই কোনো??? আসলে জার্নি করে আসছি তো, কেমন যেন বমি বমি লাগছে। ঝাল জাতীয় কোনো কিছু মানে ভর্তা হলে ভালো হতো।
—— মা, আমার হোটেলে তো কোনো ভর্তা নেই। ভর্তার হোটেল তো ঐযে সামনেরটা।
মায়া সামনের হোটেলের দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। তারপর নিচু গলায় বলে, আসলে আংকেল! ঐ হোটেলে অনেকগুলো ছেলের শব্দ শুনছিলাম, তাই যায় নি।
——– এখন এই ভাত তো ফেলে দিতে হবে।

মায়া মনে মনে ভাবে, আমার কারণে লোকটার লস হবে? না, না! খেয়েই নেই। একদিনই তো। খেলে কিচ্ছু হবে না। সাত পাঁচ ভেবে মায়া ওর হাতটা ধূয়ে প্লেটটা নিয়ে যখন বসতে যাবে, তখনি বয়স্ক লোকটা একটা বাটিতে করে কয়েক রকমের ভর্তা নিয়ে হাজির। মায়া একবার ভর্তা তো আরেকবার ঐ বয়স্ক লোক মানে হোটেল মালিকের দিকে তাকাচ্ছে। লোকটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে, দাও মা! তোমাকে আরেক প্লেট ভাত এনে দেই।
মায়া কিছু না বলে প্লেটটা লোকটার দিকে এগিয়ে দেয়। লোকটা ঐ প্লেটটা রেখে আরেকটা প্লেটে ভাত নিয়ে হাজির হয়।
মায়া লোকটার দিকে তাকিয়ে একটা কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়ে ভর্তা দিয়ে পরম তৃপ্তিতে ভাত খেতে শুরু করে।
এদিকে বাঁধন?!!!
হোটেলে বন্ধুদের সাথে বসেছিল খেতে। খেতে বসে মোবাইলে গুঁতাগুঁতি করা ওর চিরাচরিত অভ্যাস। ডাটা চালু করতেই মেসেঞ্জারে টুংটাং শব্দে কতগুলো মেসেজ আসে। মেসেজ চেক করতে গিয়ে বাঁধনের চক্ষু চরকগাছ। মায়ার এক ফ্রেন্ড মেসেজ দিয়ে বলল, মায়া এই মুহূর্তে ওদের বাজারে কোনোএক হোটেলেই আছে। কিসের খাওয়া, কিসের কি?!!!
বাঁধনসহ ওর বন্ধুরা পুরো বাজার জুড়ে ঘুরতে থাকে আর হোটেলে হোটেলে মায়াকে খুঁজতে থাকে। সবশেষে বাঁধন আসে ওর আপন ছোট চাচার দোকানে।
——— আয়! বস…. খেয়ে যা……
— কাকা, শফিক ভাই বলল তুমি নাকি আমার ভর্তার বাটি নিয়ে আসছ?ব্যাপার কি???
——– আস্তে কথা বল, একটা মাইয়্যা। মাংস খায় না। ওর জন্য আনছি। তোকে পাইনি, তাই শফিক বলল নিয়ে আইতে।
–……….
——— আয়, হোটেলের ভিতরে আয়!
— আচ্ছা, কাকা! সাদা কলেজ ড্রেস পরিহিত, কোনো মেয়ে কি তোমার এখানে আসছিল???
——- সাদা?!! শুকনো করে একটা মেয়ে! হ্যা, আইছিল তো।
— কাকা, ও কোনদিকে গেছে জানো???
——- এই মেয়ের জন্যই তো ভর্তা আনলাম।ভেতরে, খাচ্ছে।

কোনো কথা না বলে রীতিমত একটা লাফ দিয়ে বাঁধন ভিতরে ঢুকে। অনেকদিন পর তৃপ্তিসহকারে প্লেটের সবকয়টা ভাত খেয়ে ফেলেছে মায়া। হাত ধূয়ে একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুলে টেবিলে রাখা পার্সটা থেকে টাকা বের করতে যাচ্ছিল মায়া, তখনি সামনে থেকে কেউ একজন বলে উঠে,
” আরেক প্লেট দেই?”
——– না, আং……(…..)….????
— ???
——– আ আ আপনি???
— ????

চলবে……

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০৬

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বাঁধনের প্রশ্নের কোনো জবাব না দিয়ে চুপচাপ বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে পরলো মায়া। ” কি হলো? আমার প্রশ্নের কোথায় কোথায়?” বাঁধন মায়াকে ধাক্কা দিয়ে প্রশ্নটা করে।
মায়া উঠে বসে। বাঁধনের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে, আপনি আমার গায়ে হাত দিলেন কেন?
বাঁধন বিস্মিত নয়নে মায়ার দিকে তাকালো। তারপর কি যেন বলতে গিয়েও থেমে যায়। এদিকে মায়া থেমে নেই। ওর মুখ চলছে তো চলছেই।
” আপনাকে আমি যায় বলতাম না কেন মনে মনে আমি আপনাকে ভালোই জানতাম। কিন্তু আপনি আজ রেকর্ড ভেঙে দিলেন। প্রমাণ করে দিলেন আপনি আসলেই আমার……(…….)…….???”
পুরো কথা বলতে পারেনি মায়া। তার আগেই খাট থেকে নেমে বাহিরে চলে যায় বাঁধন। যাওয়ার আগে বলে যায়-
” দরজা দিয়ে শুয়ে পরো। কতক্ষণ পর ফজর আজান দিবে। আমি নামাজ পড়ে মাকে নিয়ে বাসায় চলে যাব।”
চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে মায়া, দরজা লাগাবো মানে? আপনি রুমে ঘুমাবেন না?
শান্ত গলায় বাঁধনের জবাব, বলাতো যায় না কখন আপনার উপর হাত উঠিয়ে দেই ঘুমের ঘোরে। ধূর! ঘুমের ঘোর কেন বলছি? বলাতো যায় না কখন আপনার উপর ঝাপিয়ে পরি, লুচু বলে কথা। তাই, তাই আমি নিজেকে সর্বোপরি নিজের ভিতরের পুরুষসত্তাকে কন্ট্রোল করার জন্য বাহিরে চলে যাচ্ছি।
মায়াকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাহিরে বারান্দায় চলে যায় বাঁধন। এই মুহূর্তে বাঁধন বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। নাহ! নিজের ভেতরের পুরুষসত্তাকে কন্ট্রোলের জন্য নয়, নিজের আবেগটাকে কন্ট্রোল করার জন্য বাঁধনের এখানে দাঁড়িয়ে থাকা। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে বাঁধন, আর চোখ থেকে জল বৃষ্টির ফোঁটার মতই নিচে ঝরে পরছে।
এদিকে বাঁধন রুম থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর মায়া কিন্তু ঘুমিয়ে যায়নি। একটু পর পর উঁকি দিয়ে বাঁধনকে দেখছিল। বার বার বলতে গিয়েও বলতে পারল না, স্যরি! রুমে আসুন এখন।

সকালে ব্রেকফাস্ট করে বাঁধন যখন ওর মায়ের কাছে যাবে ভাবছে, তখনি মায়ার নানু বাড়ি থেকে খবর আসে মায়ার নানু খুব অসুস্থ। খবরটা শুনার পর বাঁধন কিংবা বাঁধনের মা এভাবে বাসায় চলে যেতে পারল না। বাঁধনের বাবা ওর মাকে নিতে আসলে বাঁধনের মা মায়ার নানুর অসুস্থতার কথা জানায়।
আর তাই সেদিন দুপুরের খাবার খেয়ে সবাই মায়ার নানুর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বিকেল ৪টা কি সাড়ে ৪টার দিকে ওরা সবাই ও বাড়িতে গিয়ে উঠে।
বাঁধনের বাবা মা ভেবেছিল রাত পোহালেই ওরা বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দিবে, কিন্তু এখানে এসে তার উল্টোটা হলো। অসুস্থতার খবর শুনে সবাই এখানে আসলেও জানা যায়, শুক্রবার মানে পরদিন’ই বাঁধনের মামা শ্বশুরের বিয়ে। ওরা কিছুতেই তাই ওদেরকে ছাড়তে রাজি নয়।
বাধ্য বাঁধনের বাবা মা বিয়েটা খেয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দেয়।

ঘড়ির কাটা বলছে সময় এখন রাত্রি ৮বেজে ৫৯মিনিট। অর্থাৎ আরো একটা দিন অতিবাহিত হয়ে গেল। এই পুরো দিনের ভিতর বাঁধন একটাবারের জন্য মায়ার কাছে যায়নি। মায়াকে খাওয়ানো, গোসল করার ব্যপারে একটুও জোর করেনি। কিংবা রোজকার ঐ মায়ার নাকে, গালে, কপালে ভালোবাসার কোনো উষ্ণ পরশও এঁকে দেয়নি। সর্বোপরি বাঁধন মায়ার থেকে দুরে দুরেই থেকেছে।
অন্যদিকে মায়া?!
বাঁধনের এই নিরবতা মেনে নিতে পারেনি। প্রচন্ড অভিমানে রুমে সবার আনন্দ উৎসব থেকে বেরিয়ে বাইরে চেয়ার পেতে চুপটি করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।
ব্যাপারটা মায়ার কাজিন তানিয়া লক্ষ করল। তানিয়া সম্পূর্ণ না বুঝলেও এটুকু বুঝতে পারলো ওদের মধ্যে কিছু একটা চলছে। আর তাই ব্যাপারটা ক্লিয়ার করার জন্য তানিয়া রুমভর্তি সকল ছেলে মেয়েদের লক্ষ করে বলে, রুমে তো অনেক হৈহুল্লুর করলা। এবার না হয় বাহিরে চলো। উঠোনে মাদুর পেতে গানের কলি খেলব। সবাই একসাথে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল।
তানিয়া খুঁজে খুঁজে ২টা মাদুর আর কিছু চেয়ার আনল। তারপর সেটা উঠোনে পেতে সবাইকে বসতে দিল। ওদের অবস্থানটা মায়ার ঠিক পাশেই। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাই আনন্দ করছে, বাঁধন মায়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোর গলায় ওদের সাথে হাসি আনন্দ আর গানের সুরে মেতে উঠছে। অভিমানী মায়া খুব বেশীক্ষণ কানে আঙুল দিয়ে বসে থাকতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর দৌঁড়ে রুমে চলে যায় সে।
একাধারে রোগী এবং বিয়ে বাড়ি। কে যে কোথায় ঘুমিয়েছে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। মায়া হাজার খুঁজ করেও জানতে পারেনি বাঁধন কোন রুমে কার সাথে ঘুমিয়েছে! কিন্তু বাঁধন?! বাঁধন ঠিক জেনে নিয়েছে মায়ার ব্যাপারে। একে একে সবাই নির্লজ্জের মত কল দেওয়ার পর অবশেষে জানা গেছে, মায়া ওর কবিতা আন্টির সাথে ওনার রুমে ঘুমিয়েছে। মায়া অসুস্থ, ওর জ্বর+কাশি, পা’টাও ভাঙা, ও ঘুমানোর সময় যাতে ওর পায়ের ওপর কেউ পা রাখে, এমন হাজার সব কথা শুনিয়ে তবেই ফোন রাখে বাঁধন। আহ! কি ভালোবাসার টান?! কথাটা বলেই লাইটটা অফ করে কবিতা। কবিতা মায়ার আন্টি হলেও বয়সে মায়ার থেকে ৪বছরের জুনিয়র সে। মাত্র স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রেখেছে কবিতা। কিন্তু এই অল্প বয়সেই ডজনখানি প্রেমের অভিজ্ঞতা আছে ওর। বাঁধন এবং মায়া দু’জনই কবিতাকে বিচারক মানে। সবসময় বিভিন্নসব বিচার নিয়েই কবিতাকে কল করত ওরা। কবিতা মাঝে মাঝে তো এদের বিচারের জ্বালায় ফোন অফ করে রাখত।

পরদিন সকাল সকাল বাঁধন ঘুম থেকে উঠে।
ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট করার এক পর্যায়ে বাঁধন ওর শ্বশুর মারফত জানতে পারে গতকাল সকাল থেকে কিচ্ছু খায়নি মায়া।
বাঁধনের মাথা নষ্টর উপক্রম। কাল থেকে কিচ্ছু খাচ্ছে না, অথচ ওরা আমাকে মাত্র জানায়? মানলাম ওর আগে পরে না খেয়ে থাকার অভ্যাস আছে, তাই বলে এই অসুস্থ শরীরেও???
সবার সামনে ভদ্রতার খাতিরে ব্রেকফাস্ট পুরোটা করে তবেই উঠল বাঁধন। ব্রেকফাস্ট টেবিল থেকে উঠে একমুহূর্তও দেরী করেনি বাঁধন, সোজা মায়ার কাছে চলে যায়। মায়া এখনো হাত পা ছেড়ে দিয়ে ঘুমুচ্ছে। বাঁধন কাছে গিয়ে মাথায় একটু হাত বুলিয়ে ধীর গলায় ডাক দেয়, মায়া!
মায়া তাড়াহুড়ো করে বিছানায় উঠে বসে এলোমেলো চুল বাঁধতে লাগে। বাঁধন ঘড়ির দিকে একনজর তাকিয়ে মায়ার দিকে তাকালো। ” ঘড়িতে সময় এখন ৮টা বেজে ২২মিনিট।” এতক্ষণ কেউ ঘুমায়?
মায়া কোনো কথা না বলে কাথা বালিশ ভাঁজ করে সব একপাশে রাখল। তারপর কি মনে করে যেন চুপটি করে ফোনটা ওপেন করল, তারপর ডাটা অন করে জানালার পাশে হেলান দিয়ে রাখল।
বাঁধন চোখ বড় বড় করে মায়ার দিকে তাকালো। ” এই যে মহারানী ভিক্টোরিয়া!আপনাকে আমি ফেসবুকে ঢুকার জন্য ডেকে উঠাইনি, সাড়ে আটটা বাজে। চলুন, খাবেন!”
মায়া ভ্রু কিঞ্চিৎ বাঁকা করে বলে, আমি ফেসবুক চালানোর জন্য ঢুকিনি। বাঁশেরকেল্লা নামক পেইজ থেকে নিউজ শুনার জন্য ঢুকেছি। দেশের এখন কি অবস্থা সেটা জানার জন্য ঢুকেছি।
বাঁধন এবার কিছুটা জোর গলায় বলে, শুনোন! দেশ কিংবা আন্দোলন কোনোটাই আপনার জন্য থেমে নেই। আর শুনোন, যেসকল ছেলে মেয়েরা আন্দোলন করছে তারাও কিন্তু খাচ্ছে। খাওয়া বাদ দেই নি। তাই চলুন, খাবেন!
একে তো গত একটা দিনে একটা বারের জন্যও ওর কাছে আসেনি, আজ এভাবে আপনি আপনি কথা বলা, মেনে নিতে পারেনি মায়া।
রাগে উচ্চস্বরে বলে উঠে মায়া, দেখুন! ভদ্রতা দেখাতে আসবেন না এখানে। ভদ্রতা অন্য জায়গায় গিয়ে দেখান। আর লেকচার শুনাবেন না আমাকে। আমি আপনার মেডিকেলের স্টুডেন্ট না যে আপনি লেকচার দিবেন, আর আমি গভীর মনোযোগে সেগুলো শুনে প্র্যাক্টিকেলি করে দেখাবো আপনাকে। যান, এ রুম থেকে বেরিয়ে যান।
বাঁধন হাসিমুখে বলে, যাবো তো! তবে তোমাকে সাথে নিয়ে। এই বলে বাঁধন মায়ার একটা হাত ধরে।
মায়া হেঁচকা টানে ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয়। আমি খাব না, খাব না, খাব না। এখন আমি খা বো না। আমার মায়ের কসম এখন আমি মরে গেলেও খাবো না।
বাঁধন অবাক দৃষ্টিতে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণায় জল চিক চিক করছে কিন্তু সেটাকে বেরুতে দিচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকার পর নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করে বাঁধন।

সকাল ১০টা_
মায়া চুপচাপ বসে খাচ্ছে। হঠাৎ’ই রুমে প্রবেশ করে মায়ার ছোট খালা আঁখি। ” তুই এখানে বসে আছিস? তোর জামাই এই পাগলামী কেন করছে। কত করে বললাম, চলে কেন যাচ্ছে? মানুষজনকে এখন কি বলব?
মায়া ভাতের প্লেটে হাত ধূয়ে রুম থেকে বের হয়ে দৌড় দেয়। বাঁধন ততক্ষণে যাওয়ার জন্য সিএনজি আনতে মোড়ে চলে গেছে। মায়া পিছন পিছন ডাকছে। “দাঁড়ান, দাঁড়ান! বাঁধন একমুহূর্ত দাঁড়ায়নি। মায়ার পৌঁছার আগেই বাঁধন সিএনজিতে উঠে পরে। চলন্ত সিএনজি থেকে বাঁধন মায়াকে শুধু এটুকু বলে, আমার তাড়া আছে।
” তাড়া না ছাই!”
রাস্তা থেকে বাসায় ফেরার পর একেকজনের একেক কথা, সহ্য করতে পারছিল না মায়া। যার দরুন বিয়ে না খেয়েই সকাল ১১টার দিকে রাগে নানু বাড়ি থেকে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দেয়।
শূন্য বাসা মায়ার ভেতরের শূন্যতাকে বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মায়া। তখনি ওর ফোনটা বেজে উঠে। ফোন দিয়েছে বাঁধনের বন্ধু হৃদয়। হৃদয়ের সাথে মায়ার কথা হতো আগে বাঁধনের সাথে রিলেশন চলাকালীন সময়ে। মায়া ওকে ভাইয়া বলে সম্ভোধন করত, আর হৃদয়ও ওকে বোন বলে ডাকত।
আজ এতদিন পর হৃদয়ের ফোন পেয়ে অনেকটা অবাক হলো মায়া।

কলটা রিসিভ করে কুশল বিনিময় করতেই হৃদয়ের প্রশ্ন-
” খুব বেশী হয়ে গেল না মায়া?”
মায়া অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে,
ভাইয়া আপনি জানেন??? হৃদয় গম্ভীর কন্ঠে বলে, হ্যাঁ আমি জানি। আর এটাও জানি তুই রাগে এরকমটি করেছিস।
— ………
তোর কি মনে হয় না তুই প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশীই কষ্ট দিয়ে ফেলেছিস ওকে?
মায়া আমি জানি তুই ওকে ভুল বুঝিসনি, সেদিনের ব্যাবহারে রেগে গিয়ে ওকে শাস্তিটা দিয়েছিস। আমি কি ঠিক বলেছি???
নিচু গলায় মায়ার জবাব- জি, ভাইয়া! আসলে সেদিন বাসায় আসার পর মনে জেদ জন্ম নেয়। ওকে শায়েস্তা না করা অবধি আমি শান্তি পাবো না, সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম। তাই এমন করলাম।
— শায়েস্তা করার আর রাস্তা খুঁজে পেলি না? আর তোর কি একটুও মনে হয়নি এটা ঠিক হচ্ছে না?!
মনে হয়ছে ভাইয়া, আর যখন মনে হয়ছে আমি ভুল করছি, তখন ও চলে গেল।
বড়দের শত বারণ অমান্য করে ও চলে গেল।
— এবার বুঝ তাহলে কতটা কষ্ট পেয়েছে!
স্যরি, ভাইয়া! আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি সত্যিই অনুতপ্ত আমার কৃতকর্মের জন্য।
— ……….
ভাইয়া আমার সত্যিই খুব খারাপ লাগছে।

খারাপ লাগাটা তো কেবল শুরু, কথাটা বলেই টুট টুট করে কলটা কেটে দেয় হৃদয়।
মায়া বালিশে মুখ গুঁজে গুমড়ে গুমড়ে কাঁদছে।

সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ মায়া বাঁধনকে কল দেয়। মায়া জানে যত জ্যামই হোক, এতক্ষণে নিশ্চয় বাঁধন বাসায় পৌঁছেছে। কিন্তু একি?!!! ফোন যে বন্ধ……..

চলবে…..

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০৫

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

সারারাত কান্না করে সকালের দিকে চোখ দুটো এক করে বাঁধন।
এদিকে দুপুর হয়ে গেছে বাঁধনকে হসপিটালে খুঁজতে গিয়ে না পেয়ে বাসায় চলে আসে ওর বন্ধু হৃদয়। দরজা খুলা পাওয়াতে রুমের ভিতরে ঢুকতে বেগ পেতে হয়নি হৃদয়কে। কপালে হাত দিয়ে চোখ বোজে শুয়ে ছিল বাঁধন।
” শরীর খারাপ?”
চোখ খুলে বন্ধু হৃদয়ের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নেয় বাঁধন। বিছানা থেকে উঠে খাটের সাথে হেলান দিয়ে জবাব দেয়, নাহ!
” তাহলে অবেলায় শুয়ে আছিস যে?”

এমনি…..
কিছু বলবি???
ব্লাডডোনার খুঁজতে হসপিটালে গিয়েছিলাম। ভাবলাম তোর সাথে দেখা করে আসি। পাইনি তোকে। তাই দেখতে আসা এই আর কি!
” ওহ……”
তোর কি কোনো কারনে মন খারাপ???
বন্ধু হৃদয়ের প্রশ্নে মুখে শুকনো হাসির রেখা টেনে বাঁধনের জবাব, কই নাতো!

হাসিখুশি ও চঞ্চল মনের মানুষের হঠাৎ এভাবে গম্ভীর হয়ে যাওয়া, চোখ দুটো ফুলে তালগাছের মত হওয়া, এসব কিছুর মানে আমি কিছুটা হলেও বুঝি বাঁধন! যাক, তুই যদি আমায় না বলতে চাস জোর করব না। আচ্ছা, আসিরে….
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হৃদয় চলে যাচ্ছিলো,
পিছন থেকে হাতটা ধরে বাঁধন। হৃদয় বিছানার এককোণে বসে পরে। বাঁধন শুয়া থেকে চুপটি করে উঠে বসে।
” চা খাবি?”
——–সেতো খাওয়ায়’ই যায়…….
” আচ্ছা, তুই বস! আমি আসছি”

বন্ধু হৃদয়কে বসিয়ে রেখে রুমের বাহিরে চলে যায় বাঁধন। মিনিট পাঁচেক পর হাতে দু’কাপ চা নিয়ে হাজির হয় বাঁধন।
” চা খা, আমারটাও এখানে রাখলাম। আমি একমিনিট, জাস্ট ১মিনিট পর আসছি।”
হৃদয়ের দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে ফোন হাতে সোজা পাশের রুমের বারান্দায় চলে যায় বাঁধন। কল করে ওর মায়াকে। রাত্রের ন্যায় মায়া এখনো উল্টাপাল্টা কথা বলে বাঁধনের সাথে। ব্যর্থ বাঁধন কলটা কেটে জল ছলছল চোখে পিছনে ঘুরে তাকাতেই ঘাবড়ে যায়। হৃদয় জিজ্ঞাসসো দৃষ্টিতে বাঁধনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছে, এটা দেখে তাড়াতাড়ি বাঁধন ওর চোখের জল মুছে নেয়।
” খুব তো চোখের জল আড়াল করে ফেললি! আমি যে তোর ভিতরের কান্না’টাও শুনে নিয়েছি সেটার কি হবে?”
” এখানে কেন তুই? আয়! রুমে আয়! চা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে…..”
কথাটা বলেই বাঁধন ওর রুমের দিকে পা বাড়ালো। বাঁধনের সাথে সাথে হৃদয়ও গেল।
” কি হলো?! বস!!!”
হৃদয় বাঁধনের দিকে তাকিয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। বাঁধন সেটা দেখে আবারো বলল, বুঝলাম না, এভাবে স্টেচুর মত দাঁড়িয়ে কেন আছিস? কি প্রবলেম?
হৃদয় গম্ভীর কন্ঠে বলে, তুই আমায় এভাবে পর করে দিলি? এত বড় একটা ঘটনা তুই আমার থেকে গোপন রাখতে পারলি?
বাঁধন একটানে ওর পাশে হৃদয়কে বসায়।
” আসলে ও যে আমায় এত বড় ভুল বুঝে আছে, সেটা আমি কাল রাত্রেই জানতে পারলাম। আমি কি করব কিচ্ছু বুঝতে পারছি না দোস্ত। আমার আসলে কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আর তুই তো জানিস আমাদের রিলেশনের ব্যাপারে। তোকে নতুন করে আর কি বলব? এখন বল আমি কি করব? আমার মাথায় কিচ্ছু কাজ করছে নারে….”
হৃদয় বাঁধনের পিঠে ভরসার হাত রেখে বলে, আরে ব্যাটা! একটু ধৈর্য্য ধর। এভাবে ভেঙে পরলে তো হবে না। তোদের মধ্যে একটা Misunderstanding চলছে, সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে মায়াকে ভালো ভাবে বুঝাতে হবে। না হলে জানিস তো, সম্পর্কে Understanding না থাকলে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়!
হৃদয়ের কথায় কান্নাভেঁজা কন্ঠে বাঁধনের জবাব, তাহলে আমি এখন কি করব? কিভাবে ওর ভুলটা ভাঙাবো?
প্রতিউত্তরে হৃদয়ের জবাব, তোদের এখন সামনাসামনি কথা বলা দরকার। তুই এখানকার কাজ শেষ করে যত শিগ্রয় পারিস তোর শ্বশুর বাড়িতে যা। মায়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বল। ব্যাপারটা বুঝানোর চেষ্টা কর। আমার মনে হয় এতে ফলাফল কিছুটা হলেও ভালো হবে।
বাঁধন যেন হৃদয়ের কথায় কিছুটা স্বস্তি পেল। হৃদয়ের দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আগামী বোধ বার দিন আমি ফ্রি থাকব। ঐদিনই তাহলে রওয়ানা দিব।
হৃদয় চলে গেল। যাওয়ার আগে বলে গেল, কি হয়, না হয় আমায় কিন্তু জানাবি!

কথামতো বুধবার দিন বাঁধন ওর শ্বশুরালয়ে গিয়ে হাজির হলো। বাঁধনকে দেখে ওর মা হাসোজ্জ্বল মুখে বলে, এসেছিস! আমি তো তোকেই ফোন করতাম আজকে। আসলে কালকে চলে যাব। এদিকে মেয়েটাও অসুস্থ। তাই ভাবছিলাম তোকে ফোন করে বলে দিব। ভালোই হলো। কালকে তোর বাবা আসবে আমাকে নিতে। ওখানে গিয়ে আমার আর টেনশন করতে হবে না। এখন থেকে যে কয়দিন পরীক্ষা হবে, তুই’ই নিয়ে আসা যাওয়া করবি।
বাঁধনের হাসি মুখটা নিমিষেই মলিন হয়ে গেল। অবাক বিস্ময়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে বাঁধন, অসুস্থ্য?
বাঁধনের মায়ের আর কষ্ট করে প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়নি। উত্তর দেওয়ার আগেই পাশের রুম থেকে খুঁকখুঁক করে কাশির শব্দ আসে। বাঁধন কোনো কথা না বলে চটজলদি ঐ রুমে প্রবেশ করে।
এই মুহূর্তে বাঁধনের চোখ বিছানায়, যেখানে নিথর হয়ে ওর মায়া পরে আছে। কিছুক্ষণ পর পর কাশি আর শীতে কাঁপছে মায়া। বাঁধনের চোখ একবার মায়ার মুখের দিকে, আবার পায়ের দিকে। কি হয়েছে এটা ঠিক বুঝতে পারছে না বাঁধন। একদিকে মায়ার কাশি, অন্যদিকে পায়ে ব্যান্ডেজ। মায়ার সত্যিকার অর্থে কি হয়েছে সেটাই বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে বাঁধনের।
ধীর গলায় বাঁধন মায়াকে ডাকতে ডাকতে বিছানায় উঠে। মায়া… সন্ধ্যা হয়েছে, মাগরিবের আজান দিচ্ছে মসজিদে, উঠে বসো। কথাটা বলতে বলতেই মায়ার গালে হাত ছুঁয়ায় বাঁধন। শিউরে উঠে মায়া।
উহ, করে চোখ মেলতেই বাঁধনকে খুব কাছে দেখতে পায়। বিছানা থেকে উঠে বসে চাদর দিয়ে শরীরটা ডেকে নেয় মায়া। অস্ফুট স্বরে বলে, আ আ আপনি???
বাঁধন মায়ার বোন হিয়াকে ডাকে।
ডাক শুনে দৌঁড়ে আসে হিয়া। ” জি, ভাইয়া! কিছু বলবেন???
উৎকন্ঠার সাথে বাঁধন ওর শ্যালিকাকে প্রশ্ন করে, এত জ্বর ওর শরীরে! কখন এলো?
” কাল সকাল থেকে জ্বর। আজকে আপুর পরীক্ষা ছিল। এই জ্বরের কারণে আজকে তো আপু বিছানা থেকেই দাঁড়াতে পারছিল না। তবুও বহুকষ্টে পরীক্ষা হলে নিয়ে গেলাম আপুকে। কিন্তু নিয়ে গেলে কি হবে? আপু পরীক্ষা দিতে পারেনি। শুনেছি ওখানে গিয়ে নাকি বেঞ্চে মাথা রেখে শুয়ে পরে। তারপর ধরাধরি করে ওকে সেমিনারে নেওয়া হয়। সেখান থেকে একটু রেস্ট নেওয়ার পর, আপুকে নিয়ে বাসায় চলে আসলাম।”
“আর পা? পা কিভাবে ভাঙলো?”
বাঁধনের প্রশ্নের জবাবে হিয়া বলতে শুরু করে, ঢাকা থেকে আসার পরদিন দুপুরে আপু গোসল করতে গিয়েছিল। ওখানে অসাবধানতাবশত সাবানে পা পিছলে পরে গিয়ে এ অবস্থা। তবে ডাক্তার বলেছে পা ভাঙেনি, মচকে গেছে।
বাঁধন এবার কিছুটা ধমকের স্বরে বলে, এতকিছু হয়ে গেল তোমরা আমায় জানাও নি কেন???
হিয়া মাথা নিচু করে বলে, আসলে ভাইয়া আন্টি মানা করছিল, আপনি নাকি টেনশন করবেন!
বাঁধন দাঁতে দাঁত চেপে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আন্টি কতকিছু বলবে……

রাত্রি ১১টা বেজে ৩৫মিনিট_
একই বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে দু’জন। মাঝখানে দেয়াল হিসেবে বিরাট বড় একটা কোলবালিশ রাখা। নিশ্চুপ মায়া একদৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকিয়ে আছে। আর বাঁধন সেই কখন থেকে পলকহীনভাবে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে।
এভাবে কেটে যায় আরো কিছুটা সময়।
রাত্রি তখন আনুমানিক ১টা কি দেড়টা। বাঁধনের চোখটা লেগে এসেছিল প্রায়। হুট করে ঘুমটা ভেঙে যায়। প্রাণের মায়াকে দেখার জন্য পাশ ফিরে কিছুটা অবাক হয় বাঁধন। মাঝখানে দেয়াল হিসেবে রাখা বালিশটা আর নেই। তার পরিবর্তে মায়া সেখানে শুয়ে আছে। বলতে গেলে বাঁধনের অনেকটা কাছেই শুয়ে আছে মায়া।
” কি সুন্দর! মায়াবী’ই না লাগছে দেখতে।”
মাথার উপর ধীর গতিতে ফ্যান ঘুরছিল। সেই বাতাসে মায়ার চুলগুলো কেমন উড়ছিল। ড্রিমলাইটের মৃদু আলোয় বাঁধন দেখতে পায় অবাধ্য চুলগুলো কেমন বার বার মায়ার চোখে মুখে এসে ছিটকে পরছে। বাঁধন সেই চুলগুলো মায়ার কানের কাছে গুজে দেওয়ার জন্য হাত এগিয়ে নিতেই চোখ মেলে তাকায় মায়া।
মায়ার এভাবে দেখে ফেলাতে ইতস্তত বাঁধন ওর হাতটা সরিয়ে নেয়।

দু’জনেই চুপচাপ শুয়ে। কারো মুখেই যেন কোনো কথা নেই। অথচ দু’জনার বুকের ভিতরই দুরমুশ পেটাচ্ছে অনেক না বলা কথারা…..
হঠাৎ’ই মায়া কি মনে করে যেন বাঁধনের বুকে মাথা রাখে। স্তব্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মায়ার দিকে তাকিয়ে থাকলেও মায়া শক্ত করে জাপটে ধরাতে ঘোর কাটে বাঁধনের।
বাঁধন মনে মনে ভাবে, এই সুযোগ! ঐদিনের ব্যবহারের জন্য স্যরি বলা, আর ওর ভুলটা ভাঙানোর। মুখ খুলল বাঁধন,
” আমি স্যরি মায়া। আমি আসলে জানতাম না তুমি……(……)….???
ধূর! স্যরি কেন বলছেন? আপনি তো আপনার বউয়ের দিকেই হাত বাড়িয়েছেন।
এতে এতো ইতস্তত করার কি আছে? নিজের বউকেই তো আদর করতে চাচ্ছিলেন। তার জন্য এতো ভয় পাওয়ার কি আছে???
বাঁধন মায়াকে স্যরি বলতে চাচ্ছিল ঐ রাত্রের জন্য, আর মায়া ভাবছে বাঁধন ওর দিকে হাত বাড়াচ্ছিল এটা দেখে ফেলাতেই হয়তো স্যরি বলছে। আর তাইতো পূর্বের ন্যায় ওয়াজ করা শুরু করে দেয়।
বাঁধন মায়াকে থামানোর জন্য মুখ খুলে। মায়া আমি স্যরি বলছি….(…..)…..????

মায়া বাঁধনের ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বাঁধনকে থামিয়ে দেয়। তারপর চুপিসারে বলে,
টেনশনের কিছু নেই। রাত এখনো শেষ হয়নি। আপনি চাইলে এখনি শুরু করতে…..(……)……???

পুরো কথা বলতে পারেনি মায়া। তার আগেই মায়ার মাথাটা বাঁধন ওর বুক থেকে সরিয়ে বিছানায় উঠে বসে।
একে তো জ্বর, কাশি, তারউপর প্রচন্ড মাথা ব্যথা। বিছানা থেকে উঠতে পারছিল না মায়া, তবুও বহুকষ্টে উঠে বসল। একটু জোরে কথা বললেই কাশি উঠে যাবে ওর, আর কাশি উঠলে বুকে প্রচন্ড ব্যথা করে ওর, তাই অত্যন্ত ধীর গলায় বলল,
ঘড়িতে সময় এখন ২টা কি আড়াইটা। ঘড়ির কাটা বলছে সময় এখনো চলে যায়নি। আপনি চাইলে এখনো হতে পারে……(…….)……???

কথাটা বলতে দেরী, ঠাস করে বাঁধন ওর হাতটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারতে দেরী করে নি।
ভড়কে যায় মায়া। কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে,
” কি করছেন এসব? ব্যথা পাবেন তো।”

বাঁধন মায়ার চোখের দিকে তাকালো।
” তুমি শুধু আমার বাইরের দিকটাই দেখলে। ভিতরে যে কি বয়ে যাচ্ছে সেটা একটা বারের জন্যও বুঝলে না…..”

চলবে……

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০৪

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

রাত্রি ৯টা নাগাদ বাঁধন কল দেয় মায়াকে। পরপর দু’তিনবার কল দেওয়ার পরও রিসিভ করেনি মায়া। ফোনটা টেবিলের উপর রেখে তরকারী গরম করে বাঁধন বাবাকে খেতে দিয়ে নিজেও কিছু খেয়ে নেয়। রাত্রি ১১টা। বাঁধনের ইচ্ছে হচ্ছে ওর পুতুলবউটার ভয়েচটা শুনতে। কিন্তু ও কি এখন জেগে আছে? আর জেগে থাকলেই বা কি? এত রাত্রে ও কি আমার কল রিসিভ করবে?
নাম্বারটা ডায়াল করেও কেটে দেয় বাঁধন। বিছানায় ছটফট করতে করতে কখন যে ঘুমের জগতে চলে যায় টের পায় না বাঁধন।

রাত্রি ২টা বেজে ২৩মিনিট_
বাঁধনের ফোনটা বেজে উঠে। ঘুমন্ত বাঁধন পাশেই টেবিলের উপর থেকে হাতড়ে ফোনটা খুঁজে বের করে। চোখের সামনে এনে রিসিভ করতে গিয়ে ‘থ’ হয়ে যায় বাঁধন। এ যে মায়ার কল। স্বয়ং মায়া ওকে কল দিয়েছে, তাও এত রাত্রে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল বাঁধনের। কিন্তু কষ্ট হলেও এটাই সত্যি যে মায়া কল দিয়েছে। সাত, পাঁচ ভাবতে ভাবতেই ফোনটা কেটে যায়। বাঁধন নিজেই কল দেওয়ার জন্য স্ক্রিনে হাত রাখতেই আবারো কল। তাড়াতাড়ি কলটা রিসিভ করে বাঁধন। হ্যাঁলো, বলে কিছু বলতে যাচ্ছিল বাঁধন ওর পুতুলবউটাকে। কিন্তু তার আগেই কথা শুরু করে মায়া। মায়ার কথা শুনে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে যায় বাঁধন। নিশ্চুপ শ্রোতার মত বাঁধন নিরব থেকে ওর পুতুলবউয়ের কথা শুনছে।
মায়ার যে একটা কথায় বাঁধন বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে একটি কথা ছিল-
” স্যরি, ৯টায় কল দিয়েছিলেন রিসিভ করতে পারিনি। আসলে তখন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। আর ঘুম থেকে যখন জাগলাম তখন মনে হলো আপনাকে একবার কল দেওয়া দরকার।…..”
বাঁধনের বাকরুদ্ধ হওয়ার কারণ-
এর আগে মায়া কখনো বাঁধনের ইচ্ছের প্রাধাণ্য দেয়নি। মায়ার কাছে সবার উপরে ওর ক্যারিয়ার, ওর স্বপ্ন। আর সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য ও যেকোনো কাজ করতে রাজি। যেমনটি বাঁধনের সাথে করেছে। বিয়ের ৯মাস অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও মায়া বাঁধনকে তার প্রাপ্য অধিকারটুকু দেয়নি। মায়ার এককথা- আমি এ বিয়ে চাইনি। আমার মনের মধ্যে ছোট্ট থেকে যে স্বপ্ন লালিত হয়ে আসছে সেটা হলো আমার লেখাপড়া। আমি আমার সম্পূর্ণ লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বাবা মায়ের কষ্টের একটু হলেও প্রতিদান দিতে চেয়েছিলাম। তারপর বিয়ে, অন্যান্য চিন্তা। আমার পড়াশুনা আমার কাছে কম্পোলসারি, আর আমার বিয়ে-ঘর-সংসার এসব অফশনাল। কম্পোলসারি বাদ দিয়ে আমি অপশনালকে গুরুত্ব দিতে কখনো পারিনি, আজও পারব না। মায়া অতি সুন্দর করে বাঁধনকে বুঝিয়ে দিত, ওর জীবনে স্বপ্ন বলতে লেখাপড়াটাই অন্যতম।
বাঁধন যখন ভালোবেসে মায়াকে খাওয়াতে আসত, মায়া তখন একবুক ঘৃণা নিয়ে দুরে সরে যেত। ওর একটাই কথা-
” কাছে আসবেন না একদম। শেষ করে দিব আমি নিজেকে। আমি এখন এসব কিছুর জন্য প্রস্তুত না।”
বাধ্য বাঁধন বিয়ের ৭দিনের মাথায় মায়াকে শ্বশুরালয়ে মায়ার বাবার বাড়িতে রেখে আসে। সেই থেকে মায়া নিজের ইচ্ছে মতই চলত। মন চাইলে শ্বশুর শাশুড়িকে কল দিত, মন না চাইলে দিত না। কখনো কখনো নিজ ইচ্ছেতেই সুদূর নরসিংদী থেকে ঢাকায় বাঁধনের কাছে যেত, আবার ঝগড়া করে বাঁধনকে টেনশনে রাখার জন্য পালিয়ে চলে আসত। বাঁধন কিচ্ছু বলত না মায়াকে। শুধু নির্বাক শ্রোতাদর্শকের মতই সবকিছু নিরবে দেখে শুনে যেত।
বাঁধন কোনো প্রতিদানের আশা করে ভালোবাসেনি মায়াকে, আজও বাসবে না। আর তাইতো বাঁধন কখনো স্বামীর অধিকার নিয়ে মায়ার কাছে যায়নি। যদিও মাঝে মাঝে ভেতরের পুরুষসত্তাটা জেগে উঠত, আবার বহুকষ্টে নিজেকে কন্ট্রোলও করত।
বাঁধন চাইনা ওর কারণে ওর ভালোবাসার মানুষটির স্বপ্ন ভেঙে যাক। আর চাই না বলেই বাঁধন ওর বাবা মাকে জানিয়ে দিয়েছে, মায়ার লেখাপড়া শেষ হওয়ার আগে ওকে যেন শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য ফোর্স না করা হয়। বাঁধনের ফেরেস্তার মত বাবা মা বিনাবাক্যে বাঁধনের কথা মেনে নিল। ওদেরও এক কথা- মায়ার লেখাপড়া শেষ হোক! তারপর না হয় ধূমধাম করে বিয়ে করিয়ে ওকে এ বাড়িতে নিয়ে আসব।
আজ এতগুলো দিন পর সেই মায়ার মুখ থেকে এমন নরম কথা শুনে বাঁধন তাই স্তব্ধবাক! একমুহূর্তের জন্য বাঁধন ওর কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললেও মায়ার প্রশ্নে মুখ খুলে। প্রশ্ন করে মায়া-
” কল দিয়েছিলেন! কিছু বলবেন?”
জবাবে বাঁধন বলে, শরীর ভালো আছে তো তোমার? মায়ার শান্ত জবাব, হুম।
মনে হচ্ছে ঘুম পাচ্ছে তোমার। কন্ঠ’টা কেমন যেন শুনাচ্ছে! আজ না হয় থাক।ঘুমিয়ে পড় তুমি।
বাঁধনের কথা শুনে টানটান কন্ঠে মায়ার জবাব, না! না! আমি ঠিক আছি। আপনি বলতে পারেন….
এবার বাঁধন ধমক দেই মায়াকে। মায়া আচ্ছা বলে চুপটি করে ভদ্র বালিকাদের মত কলটা কেটে দেয়।
সে রাত্রে বাঁধন আর ঘুমুতে পারেনি এই ভেবে যে, ওর বউটা হঠাৎ করে কিভাবে এত ভদ্র হয়ে গেল!

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই কল দেয় বাঁধন ওর পুতুলবউ মায়াকে। কল দেওয়ার মিনিট পাঁচেক পর কল ব্যাক করে মায়া। অনুনয়ের স্বরে স্যরি বলে এটা জানায় যে ও ওয়াশরুমে ছিল, যার কারণে কলটা রিসিভ করতে পারেনি। যতই সময় যাচ্ছে বাঁধনের অবাক হওয়ার মাত্রাটা ততই যেন বেড়েই চলছে। খাবার খেতে বললে ভদ্র শিশুর মত আচ্ছা বলে খেতে যাওয়া, গোসল করতে বললে গোসল করা, ঘুমাতে বললে ঘুমাতে যাওয়া। কোনোটাতেই এখন আর মায়ার অনীহা নেই। বাঁধন যা বলে মায়া তাই করে। হঠাৎ করে এভাবে চেঞ্জ হয়ে যাওয়া, ব্যপারটা ভাবিয়ে তুলে বাঁধনকে।
” আমার যে করেই হোক জানতে হবে ওর ভিতর কি চলছে? না হলে আমি শান্তি পাচ্ছি না”
সেদিন রাত্রে ঘুম আসছিল না বাঁধনের। নানান টেনশন যেন বাঁধনের উপর ভালো করে ঝেকে বসেছে। ভিতরটা কেমন অস্থির অস্থির লাগছিল বাঁধনের। ঘুমানোর জন্য হাজারো চেষ্টা করলেও ঘুম আসছিল না বাঁধনের। বার বার চোখের সামনে মায়ার মায়াবী মুখটা ভেসে উঠছিল। খুব ইচ্ছে হচ্ছে অভিমানীটার সাথে কথা বলতে। ওর ভয়েচটা শুনতে। আমি কি ওকে কল দিব?
কল দিবে না দিবে না করেও মায়ার কাটা হাতের কথা মনে পরতেই কল দিয়েই দেয় বাঁধন। ওপাশ থেকে ছোঁ মেরে কল রিসিভ করে মায়া। মনে হচ্ছে এত রাত অবধি জেগে মায়াও এই কলেরই অপেক্ষায় ছিল।
” ঘুমাওনি এখনো?”
শান্তস্বরে মায়ার জবাব, নাহ! আপনি? আপনি ঘুমাননি কেন এখনো?
—– ঘুম আসছিল না।
– ওহ……..
——- মায়া, একটা কথা বলব?
– একটা কেন? হাজারটা বলুন। তার জন্য অনুমতির কি আছে?
– আসলে আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল আমার অভিমানীর চাঁদমুখটা দেখতে। আমি কি ঘুমানোর আগে তাকে একটু দেখতে পারি? বাঁধন কথা বলে উত্তরের অপেক্ষায় আছে। ও জানে মায়ার জবাব কি? সবসময় যে কথাটি শুনে ও মুখস্ত করে ফেলেছে সেই কথাটিই বলবে মায়া। মায়া বলবে-
” স্যরি, সম্ভব না। ভিডিও কলে আমি আমার পরিবার পরিজনের সাথে পর্যন্ত কখনো কথা বলিনি। সেখানে আপনার সাথে কথা বলব ভাবলেন কি করে?”
কিন্তু মায়া কি করল জানেন? বাঁধনকে অবাক করে দিয়ে সেদিন মায়া নিজেই ভিডিও কল করে। অবাক বাঁধন কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হয়েছিল। ঘোর কাটে মায়ার ডাকে, শুধু তাকিয়েই থাকবেন? কিছু বলবেন না?
দু’দিন ধরে মায়ার এমন অদ্ভুত রকম চেঞ্জ এমনিতেই বাঁধনের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে, তারউপর আজকে এভাবে ভিডিও কলে মুখোমুখি কথা বলা বাঁধন জাস্ট নিতে পারছে না। কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে ও। তাইতো মায়ার মনে কি চলছে সেটা বুঝার জন্য অপলক দৃষ্টিতে মায়ার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা। কিন্তু নাহ! কোনো কূলকিনারা পায়নি বাঁধন।
আচ্ছা! দেখলামই তো। এবার তাহলে রাখি। এমনিতেও অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পরো তুমি। কথাটা বলে বিদায় নিয়ে বাঁধন কলটা কেটে দেয়।
নাহ! কিচ্ছু বুঝছি না এই মেয়ের মনে কি চলছে। উফফ! মাথাটা কেমন ব্যথা করছে। মাথায় হাত ধরে বাঁধন বিছানাতে উঠে বসতেই মায়ার হাতের কথা মনে পড়ে। ইস! আমার তো ওর হাতটাই দেখা হলো না।
মায়া তো মনে হয় এখনো ঘুমাইনি। আচ্ছা, একটা মেসেজ করে বলি ডাটা অন করতে।
যদিও শিউর না বাঁধন আদৌ মায়া ডাটা অন করবে কি না! তবুও মায়ার ফোনে একটা মেসেজ দিয়েই দিল।
” লক্ষ্মী! ডাটাটা অন করবা একটু? একটা জিনিস দেখতে ভুলে গেছিলাম।”
বাঁধনের মেসেজটা সাথে সাথেই সিন হয় ওপাশ থেকে। এবারো মায়া বাঁধনকে অবাক করে দিয়ে সাথে সাথে কল করে। ভিডিও কল। বাঁধন ওর মায়ার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন এই প্রথম ও ওর মায়াকে দেখছে। আর দু’দিন ধরে মায়া যা করা শুরু করছে তাতে এমন মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক।

– কি যেন দেখতে চেয়েছিলেন আপনি!
—– তোমার কাটা হাত। হাতের অবস্থা কি রকম এখন?
মায়া ওর ডান হাতটা উঁচু করে ক্যামেরার সামনে ধরে। বাঁধন কিছুক্ষণ হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর মায়ার চোখের দিকে তাকাতেই বুঝতে পারে ঘুমে ঢুলুঢুলু ও।
দেখা শেষ। এবার কলটা কেটে লক্ষ্মী মেয়ের মত ঘুমিয়ে পরো কেমন?
মায়া ওর ঘুমন্ত ভাবটা দুর করার জন্য চোখটা জোর করে টানা দিয়ে বড় করে। তারপর ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলে, এটুকুতেই দেখা শেষ? আর কিছু দেখবেন না? অবাক বিস্ময়ে মায়ার দিকে তাকায় বাঁধন, আর কিছু মানে? শান্ত গলায় মায়ার জবাব, মানে শুধু কি হাতই দেখবেন অন্য কিছু দেখবেন না?
How do you mean, Maya?
তেমন কিছু না। আমি তো জাস্ট এটাই বলতে চাচ্ছি, হাত ছাড়াও আরো কিছু দেখার ইচ্ছে থাকলে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। আমি আপনাকে তাই দেখাবো।

বাঁধনের চোখ দুটো জলে টলমল করে উঠল। ওর আর বুঝতে বাকি নেই মায়া ঠিক কি বুঝাতে চাইছে। অনেক কষ্টে চোখের জল আটকিয়ে কাঁপা গলায় বাঁধন প্রশ্ন করে, মায়া! তুমি আমায় এমন ভাবলে? আমি তোমার হাত দেখতে চেয়েছি, আর তুমি কি না বিষয়টা অন্য ভাবে নিয়ে গেলে? এভাবে ভুল বুঝলে তুমি আমায়? এটাই বুঝি আমার প্রাপ্য ছিল মায়া?!
মায়া একটা শুকনো হাসি দিয়ে বলে, ঐ! আপনি কাঁদছেন কেন? আর আমি মোটেও আপনাকে ভুল বুঝিনি। আপনি চাইতেই পারেন এমন কিছু। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো আমি আপনার বিয়ে করা বউ। আমার উপর আপনার যথেষ্ট অধিকার আছে। আর তাই আপনি চাইলে আমি হাত কেন সব, সব দেখাতে বাধ্য।
বাঁধনের চোখের জল আর বাধ মানছিল না। নিমিষেই দু’চোখের নোনাজলে বাঁধনের গাল ভিঁজে যায়। মায়া নিশ্চুপ দর্শকের মত সেটা চেয়ে চেয়ে দেখছে শুধু।
বহুকষ্টে কান্না থামিয়ে চোখের জল মুছে নেয় বাঁধন। তারপর ঢোক গিলে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে বলে, লক্ষ্মী! এভাবে তুমি আমায় ভুল বুঝো না। আমি দম আটকে মরে যাব। লক্ষ্মী! প্লিজ আমায় বুঝার চেষ্টা করো। আমি ঐ রকম কিছু মনে করে তোমার সাথে কথা বলতে চাইনি। তুমি আমায় ভুল বুঝছ লক্ষ্মী! অনেক বড় ভুল বুঝছ?
ভুল?!!!
মায়া একটা অট্টহাসিতে মেতে উঠে। কোনটা ভুল? আমার কারণে আপনার জীবন নষ্ট হয়ে গেছে এটা নাকি অন্য ৮,১০টা মেয়ের মত আমি হতে পারিনি এটা? কোনটা ভুল আপনি সত্যি করে বলতে পারবেন?
কথার মাঝখানে থামিয়ে দেয় বাঁধন।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, স্যরি, লক্ষ্মী! মাথা ঠিক ছিল না ঐদিন। তাই কি বলতে কি বলছি নিজেও জানি না। আর তুমি যা করছ তাতে যে কারো মাথা নষ্ট হওয়ারই কথা! তুমি জানো পুরো বাসা খুঁজেও যখন তোমাকে পায়নি, তখন আমার ভিতরে কি চলছিল?
এতকিছু আমাকে কেন বলছেন? আমি কি আপনাকে এসবের জন্য কিছু বলেছি? আর স্যরি কেন বলছেন? আপনাকে তো আমার ধন্যবাদ দেওয়ার দরকার। আপনি আসলে সেদিন যদি আমায় চোখে আঙুল দিয়ে আমার ভুলগুলো না দেখিয়ে দিতেন, তাহলে আমি কখনো’ই আমার ভুলগুলো শুধরে নিতে পারতাম না। সবচেয়ে বড় কথা যেটা সেটা হলো, আমি কল্পনাতেই ভাবতে পারতাম না যে আমার কারণে কারো জীবন নষ্ট হয়ে গেছে। আমি দিনের পর দিন আপনাকে আপনার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছি। কিন্তু আর নয়! এখন থেকে আপনার সবটুকু অধিকার আপনি আমার উপর…..(…..)….???
চুপ! একদম চুপ! আর একটা কথা যদি শুনি তাহলে খারাপ হয়ে যাবে। চুপচাপ আমার কথা শুনো….
মায়া কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল, প্লিজ! আমায় একটু সুযোগ দেন। কথা দিচ্ছি আমি আমার ভুলগুলো শুধরে নিব। অন্য ৮,১০টা মেয়ের মতই হয়ে যাব। আপনার সব কথা শুনব। প্লিজ আপনি আমাকে এই সুযোগটা দিন। কথা দিচ্ছি, আমি আর পাগলামী করব না। আপনার যেভাবে সেভাবেই আমায়….(…..)…..????

বাঁধন আর নিতে পারছিল না। কল কেটে দিয়ে ফোনটা বন্ধ করে ফেলে বাঁধন। হু, হু করে কেঁদে উঠে বাঁধন। তুমি আমায় এতটা খারাপ ভেবেছ? সেদিনের এই একটু কথাকে এভাবে নেগেটিভ মাইন্ডে নিয়ে গেলে? আমি তোমার দেহ চাই, দেহ, নাহ? অন্য ৮,১০টা মেয়ের মতো হওয়া বলতে তুমি এটাই বুঝলে? এত বড় ভুল আমি আমায় বুঝতে পারলে মায়া! তোমার চোখে ভালোবাসার মানুষ থেকে এখন আমি নারী মাংস লোভী দানব হয়ে গেলাম? এতবড় অপবাদ তুমি আমায় দিতে পারলে???

চলবে…..

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০৩

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

কামড়টা এতটাই জোরে দিয়েছে যে দাঁতের দাঁগ হয়ে গেছে বাঁধনের হাতে। কিন্তু সেদিকে পরোয়া না করে ভাতের প্লেট নিয়ে বাঁধন মায়ার পিছুপিছু রুমের দিকে ছুটলো। রুমে গিয়ে কোনো কথা না বলে বাঁধন মায়ার পাশেই বসল। তারপর নিঃশব্দে তরকারী দিয়ে কিছু ভাত মেখে একমুঠো ভাত বাঁধন মায়ার দিকে এগিয়ে দেয়। মায়া বসা থেকে উঠে পরতে চাইলে বাঁধন আবারো মায়ার হাতটা ধরে বসিয়ে মুখের দিকে একমুঠো ভাত এগিয়ে নিয়ে যায়।
মায়া মুখটা ঘোর কালো অন্ধকারের ন্যায় করে জবাব দেয়, খাব না আমি! মরে গেলেও এই মুহূর্তে আমি ভাত খাব না। আর একবার যেহেতু আমি খাব না বলছি, সেহেতু আমি খাব না।
মায়ার এভাবে ‘না’ বলা সত্ত্বেও বাঁধন অশ্রুভেঁজা চোখে আরো ৪,৫বার খাবে কি না জিজ্ঞেস করছে। প্রতিবারই মায়ার কাছ থেকে না বোধক জবাব আসে। রাগে দুঃখে বাঁধন কিছু মুখে না দিয়েই খাবার প্লেটে পানি ঢেলে দিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। সন্ধ্যার বেশকিছু ক্ষণ আগে বাসায় ফিরে বাঁধন। ক্লান্ত বাঁধন প্রতিদিনের মত সেদিন চেম্বার থেকে ফিরে মায়ার নাকে, মুখে, কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়নি। কানের কাছে গিয়ে বলেনি, ভালোবাসি লক্ষ্মী! রুমে প্রবেশ টেবিলে ব্যাগটা রেখে মায়াকে দেখেও না দেখার ভান করে মাথা নিচু করে ওয়াশরুমে চলে যায় বাঁধন। ওয়াশরুম থেকে ফিরে আসলে চুপটি করে সোফায় গা এলিয়ে দেয় সে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। দুরের মসজিদ থেকে আজানের স্বর প্রতিধ্বণিত হচ্ছে। বাঁধন শুয়া থেকে উঠে ওজু করে টুপিটা নিয়ে মাথা নিচু করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
পুরো ব্যাপারটাই খেয়াল করেছে মায়া। বাঁধন বাইরে চলে গেলে সেও চটজলদি নামাজটা আদায় করে রান্নার কাজে লেগে যায়। সেই যে মাগরিবের আজানের সময় বাসা থেকে বের হয়েছিল বাঁধন, আসে রাত্রি ১০টায়। মায়া যেন বাঁধনের আসার’ই অপেক্ষায় ছিল। বাঁধন রুমে প্রবেশ করা মাত্র’ই খাবার টেবিলে খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পরে মায়া।

টেবিলে খাবার দিয়ে মায়া বাঁধনের দিকে তাকালো। বাঁধনের দৃষ্টিও সেই সময় মায়ার দিকে ছিল। মায়ার ঐভাবে তাকানোর মানে, খাবার দিয়েছি টেবিলে, খেতে আসুন।
এটা বেশ বুঝতে পারে বাঁধন। তাইতো মায়ার থেকে সাথে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সে। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বাঁধন কিছুক্ষণ পর আড়চোখে মায়ার দিকে তাকাচ্ছিল। মায়া তখনো পূর্বের ন্যায় খাবার টেবিলে খাবার সামনে নিয়ে চুপটি করে বসে আছে।
“ওহ! তুমি তাহলে বোবার মত চোখে চোখেই কথা বলবে শুধু! মুখে আর বলবে না। বেশতো! আমি দেখতে চাই কতক্ষণ তুমি আমার সাথে কথা না বলে থাকতে পারো। কথাগুলো মনে মনে ভেবেই বাঁধন ওর রুমের লাইটটা অফ করে দেয়।”
মায়া অন্ধকার রুমের দিকে একবার তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাবারগুলো ঢেকে রেখে কিচেনের লাইটটা অফ করে রুমে প্রবেশ করে। নাহ! বাঁধনের রুমে নয়….
এ বাসায় আরো একটা রুম আছে। মায়া সেই ছোট্ট রুমটাতে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। নিশ্চুপ থেকে বাঁধন সবটা লক্ষ্য করেছে কিন্তু মুখে কিছু বলেনি। কিছুক্ষণ ছটফট যন্ত্রণায় বিছানায় এপাশ ওপাশ করে একটা সময় ঘুমিয়ে যায় বাঁধন।
শেষ রাত্রে বিছানা থেকে উঠে বসে মায়া। প্রচন্ড ক্ষিদের জ্বালায় ভেতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে ওর। হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে ঢেকে রাখা খাবারগুলো মেলে মুখে দিতে গিয়ে থেমে যায় মায়া।
” আমি ক্ষিদের জ্বালা সইতে পারছি না, ও কি করে আছে এতক্ষণ? আমি বাসায় বসে থেকেও এতটা ক্ষিদে পেয়েছে, আর ও তো সারাটা দিন অভুক্ত থেকে রোগীদের সাথে কথা বলেছে, ওদের বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়েছে। আমার থেকে বেশী তো ওর ক্ষিদে পেয়েছে মনে হয়।”
সাত পাঁচ ভেবে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় মায়া। উদ্দেশ্য বাঁধনের রুমের দরজায় কড়াঘাত। বাঁধন ডাকার জন্য দরজায় হাত দিতেই দরজা খুলে যায়। আসলে বাঁধন রাত্রিতে মেইন দরজাটা দিয়ে এই দরজা হালকা একটু মিশিয়ে রেখেছে, যাতে করে মায়া রুমে আসতে চাইলে খুব সহজেই ঢুকতে পারে। রুমের দরজাটা ক্ষাণিকটা ফাঁক করে রুমে প্রবেশ করে মায়া। লাইটটা অন করে বিছানার দিকে এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে ডাক দেয় মায়া, শুনছেন? বাঁধন চোখ মেলে তাকাই।
মায়া ঢোক গিলে মাথা নিচু করে বলে, আমার না খুব ক্ষিদে পেয়েছে……
বাঁধন গম্ভীর মুখে বলে, ক্ষিদে পেয়েছে তো আমি কি করব? আমি কি তোমার খাবার ধরে রেখেছি?
এতটুকু কথাতেই কেল্লাফতে। বাঁধনের এই একটু কথা’ই অভিমানী মায়ার ভিতরে আঘাত করে। দু’চোখের লোনাজল ছেড়ে দিয়ে মায়া ছুটে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। রুমের দরজা দিয়ে বালিশে মুখ গুজে গুমড়ে গুমড়ে কেঁদেছে মায়া। বেশকিছু ক্ষণ কাঁদার পর হঠাৎ করে কি মনে করে যেন মায়া চোখের জল মুছে চোখ মুখ শক্ত করে ফেলে। ধীরপায়ে রুম থেকে বের হয়ে টেবিল এবং ফ্রিজে রাখা খাবারগুলো গপাগপ করে দুটো ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে আসে।

ফজর নামাজ পড়ে সকালের দিকে বিছানায় একটু গা এলিয়ে দিয়েছিল বাঁধন, হঠাৎ কোথা থেকে যেন একটা পোঁড়া গন্ধ ওর নাকে এসে ঠেকল। বিছানা থেকে উঠে বসল বাঁধন। কোথা থেকে আসছে এই গন্ধ?
কিছুক্ষণ নাক খাড়া ভালো ভাবে শুকে বুঝতে পেল গন্ধটা কিচের থেকেই আসছে।
সকাল সকাল কিচেন থেকে পোঁড়া গন্ধ? ভড়কে উঠে দৌঁড়ে যায় বাঁধন কিচেনের দিকে। কিচেনের বাইরে থেকেই বাঁধন মায়াকে কিচেনে দাঁড়িয়ে একমনে কি যে পোঁড়াতে দেখে। ধীর পায়ে বাঁধন মায়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। “কি করছ কি? এভাবে ভালো ওড়নাটা কেন পুঁড়ছ?”
বাঁধনের প্রশ্ন শুনেও মাথা তুলে তাকায়নি মায়া। চুপচাপ আনমনে ওড়না পুঁড়িয়েই চলছে মায়া। বাঁধন বুঝতে সেদিন রাত্রের বলা কথাগুলোর পর যে অভিমানটা করেছিল, সে অভিমানটা এখনো মনে ঝেকে বসে আছে মায়ার। বাঁধন জানে এখন এই মেয়েকে কিছু বললে হিতে বিপরীত হবে।আর বাঁধন কথা না বাড়িয়ে মায়াকে ওড়না পোঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। বাঁধন বাহিরে চলে যাওয়ার পর অর্ধ পোঁড়া ওড়নাটা ময়লা ফেলার ঝুড়িতে রেখে সেগুলো রাস্তার পাশে ফেলে দিয়ে আসে। ততক্ষণে বাঁধনও হাতে কয়টা পরোটা সবজিসহ প্যাক করে নিয়ে হাজির হয়। প্লেটে কয়টা পরোটা এবং সবজি দিয়ে বাঁধন মায়ার সামনে দিয়ে আসে। মায়া একবার পরোটা, আবার সোফায় বসে থাকা বাঁধনের দিকে তাকাচ্ছে। একমনে বাঁধন খেয়েই চলছে। খাওয়া শেষে আমি গেলাম, খেয়ে নিও বলে হসপিটালে চলে যায় বাঁধন।
হসপিটালে গিয়েও শান্তি পাচ্ছে না বাঁধন। কেমন যেন অস্বস্তিতে ভুগছে। ছটফট বাঁধন দুপুরের দিকে বাসায় চলে আসে। মায়া তখন ভাতের প্লেট নিয়ে বসছিল। বাঁধন একবার সেদিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে রুমের খাটে বসে পরল। বাঁধন লক্ষ করছে, মায়া কিছুক্ষণ পর পর প্লেটের দিকে হাত নিয়েও ফিরিয়ে আনছে। বাঁধনের দৃষ্টি ওর দিকে সেটা বুঝতে পেরে জোর করে অনেকটা বুকে সাহস নিয়ে তরকরী দিয়ে ভাত মাখানোর জন্য তরকারী হাত রাখে মায়া। বাঁধন বসা থেকে উঠে শার্ট আর গেঞ্জিটা খুলে কেবল দাঁড়ালো, তখনি মায়ার একটা চিৎকার শুনা যায়। ওহ বলে চোখ বন্ধ করে ফেলে মায়া। বাঁধন সেই অবস্থায়’ই দৌঁড়ে মায়ার কাছে গিয়ে হাতটা ধরে ফেলে।
” এত গরম ভাত খাইতে কে বলছে?”
কথাটা বলেই বাঁধন মায়ার হাতের দিকে তাকাতেই চমকে উঠে। একি! হাত কাটছ কিভাবে?”
জবাবে মায়া কিছুই বলে না।
কাটা হাত, ব্যান্ডেজ না করে ভাত নিয়ে বসে পরেছ। কেন? আমায় বাসায় আসছি দেখো নি তুমি? একবার আমাকে বললেই তো হতো। মায়া কিছু না বলে একঝটকায় বাঁধনের মুঠো থেকে ওর হাতটা ছাড়িয়ে রুম থেকে ফোনটা কানে নিয়ে আলমারির উপর থেকে গেইটের চাবিটা নিয়ে কার সাথে কথা বলতে বলতে যেন নিচে চলে যায়।

মিনিট পাঁচেক পর মায়া ফিরে আসে। তবে সে একা নই। সাথে আছে ওর শ্বশুর শাশুড়ি।

বাঁধন কিছুটা ঘোরের মধ্যেই বাবা মাকে সালাম জানাই। অতঃপর অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে বাবা মাকে, মা- বাবা! তোমরা?!!
আসলে কাল রাত্রিতে কল দিয়েছিলাম তোর শ্বশুর বাড়িতে। মায়ার জন্য খারাপ লাগছিল, ভাবলাম একটু কথা বলি। কিন্তু পরে জানতে পারলাম, ও তোর কাছে। তাই সকাল সকাল রওয়ানা দিয়ে দিলাম। বাঁধন হাসোজ্জ্বল মুখে বলে, ভালো হয়েছে এসেছ। কয়টা দিন বউ শ্বাশুড়ি মিলে চুটিয়ে আড্ডা দিবা। বাঁধনের কথার জবাবে মুখটা মলিন করে বাঁধনের মা বলে, তা আর পারলাম কই? মায়ার নাকি পরীক্ষা। ও আজই বাড়িতে চলে যেতে চাচ্ছে। আমায় বারবার রিকোয়েস্ট করছে, যাতে নিয়ে দিয়ে আসি। তোর হসপিটাল আছে, তাই তোকে বলেনি।
বাঁধন এক নজর মায়ার দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়। “ওহ! কথা বার্তা পাকা করে ফেলেছে তাহলে।”

আচ্ছা, পরেরটা পরে। এখন ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নাও, কথাটা বলে বাঁধন ছাদে চলে গেল।

এমনি বয়স হয়েছে, তারউপর জার্নি করে ক্লান্ত শরীর। সেদিন আর যাওয়া হয়নি মায়ার। পরদিন বাঁধন চেম্বারে চলে যাওয়ার পর পাগলের মত হয়ে যায় মায়া। শাশুড়ির কানের কাছে গিয়ে বার বার প্যানপ্যান করতে থাকে কখন বাসায় যাব মা? এভাবে হেলায় দিন কাটালে আমি যে পরীক্ষায় ফেল করব। মা, প্লিজ আমায় দিয়ে আসুন না হয় টিকিট কেটে দিন। আমিই যেতে পারব। বাধ্য শাশুড়ি একমাত্র আদরের বউমার কথায় রাজি হয়। সেদিনই মায়া ওর শাশুড়ির সাথে বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে বাঁধন ওর বাবার থেকে জানতে পারে মায়া ওর মাকে পটিয়ে নিয়ে গেছে বাপের বাড়ি।
ও কি সেদিন রাত্রের ব্যবহারে আমায় ভুল বুঝছে?
বাঁধনের ভিতরটা অজানা আশঙ্কায় মুচড় দিয়ে উঠে। সন্ধ্যার একটু পরই কল করে বাঁধন ওর মাকে। ওর মায়ের থেকে জানতে পারে, এই মাত্রই ওরা ভালো ভাবে বাসায় পৌঁছে’ছে…….

চলবে……

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০২

0

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

খাটের নিচ থেকে মায়ার বের হতে দেরী, ওর গালে শুভ্রর দেওয়া থাপ্পরটা পরতে এক মুহূর্তও দেরী হয়নি। তারপরের ঘটনা তো সবাই জানেন।
একে তো বাঁধনের সাথে রাগ করে সারাটা দিন অনাহারে থেকেছে, তারউপর কান্নাকাটি। মায়ার মাথাটা কিরকম ভারী ভারী লাগছে। মনে হচ্ছে উঠে দাঁড়ালেই বুঝি মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু দাঁড়াতে তো হবেই। বহুকষ্টে হেঁটে হেঁটে ওয়াশরুমে যায় মায়া। চোখেমুখে পানিরছিটা দিয়ে কোমড়ে আঁচল বেঁধে রান্না করতে দাঁড়ায়। যদিও রান্নার ‘র’ ও পারে না ও। তথাপি আজ মায়া রান্না করতে ঢুকেছে মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে, আমাকে পারতে হবে। যে করেই হোক আমাকে পারতেই হবে।
সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে বাঁধন। ব্রাশ হাতে ওয়াশরুমের দিকে এগুনোর সময় চোখ যায় কিচেনের দিকে। বটিতে বসে চোখ বন্ধ করে হাতে পেয়াজ নিয়ে বসে আছে। চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পরছে ওর। মায়া রান্নায় অভ্যস্ত না সেটা বাঁধনসহ ওর পরিবারের সবাই জানে। আর জানে বলেই ওরা কখনো ওদের
পুত্রবধূকে রান্নার জন্য চাপ দেই নি। যদিও মায়া ৮মাসের বৈবাহিক জীবনে হাতে গোনা কয়েক দিন শ্বশুর বাড়িতে থেকেছে। আর যে কয়দিন থেকেছে মায়া সে কয়দিন ঐ বাড়িতে মেহমানের মতই ছিল। আজই প্রথম মায়া নিজ ইচ্ছেতে কিচেনে ঢুকেছে। আর প্রথম দিনেই এই অবস্থা। হেসে দিল বাঁধন। ব্রাশটা রেখে তাড়াতাড়ি চোখে মুখে পানিরছিটা দিয়ে বাঁধন এগিয়ে যায় মায়ার দিকে। হয়ছে তোমার রান্না আমার খাওয়া হয়ে গেছে, এবার আমাকে দাও দেখি আমি পারি কি না। কথাটা বলে বাঁধন মায়ার হাতের পেয়াজটা নিতে যাচ্ছিল। মুহূর্তেই মায়া চোখ খুলে বাঁধনের দিকে তাকাই। তারপর ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে চোখের জল মুছে পেয়াজ কাটতে শুরু করে। বাঁধন বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরে মায়ার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে। বাঁধনের বলা রাতের ঐ কথাগুলোই মায়ার ফর্সা মুখটাকে অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় করে দেয়। রাগে একটার পর একটা পেয়াজ কাটতেই থাকে মায়া। কাজের অসাবধানতায় মায়ার আঙ্গুলের ক্ষাণিকটা কেঁটে যায়। ওহ স্বরে কুঁকিয়ে উঠতেই দাঁড়ানো থেকে বসে মায়ার হাতটা ধরে ফেলে বাঁধন। কিছুক্ষণের জন্য মায়া রাতের ঘটনাটার কথা ভুলে গিয়ে বাঁধনের চোখের গহীনে হারিয়ে যায়। ভেঁজা চোখে বাঁধন তখন মায়ার আঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে।উৎকন্ঠার সাথে বাঁধন বলে উঠে, কি যে করনা তুমি! ২দিনের জন্য আমার কাছে এসেছ, এতেই কিচেনে ঢুকে গেছ। বাঁধনের কথায় ঘোর কাটে মায়ার। বাঁধন যখন আঙ্গুল কতটুকু কাটছে এটা দেখায় ব্যস্ত, মায়া তখনই একঝটকায় ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয় বাঁধনের থেকে। তারপর আবার কাজে লেগে যায়। পিছন থেকে বাঁধনের হাজারো নিষেধ, হাজারো কথা কোনোটাই শুনেনি মায়া। রান্না শেষে খাবারগুলো থরে বিথরে টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখছিল মায়া, তখনি সেখানে উপস্থিত হয় বাঁধন। চেয়ার টেনে টেবিলের কাছে বসে মায়ার দিকে অশ্রুভেঁজা চোখে তাকিয়ে আছে বাঁধন। মায়ার সেদিকে একটুও ক্রক্ষেপ নেই। একমনে পাক্কা গৃহিনীদের মত মুখটা ভার করে প্লেটে খাবার দিয়ে তরকারীর বাটিগুলো সামনে রাখে। বাঁধন খাবারের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে তখনই চুপিসারে অভিমানী মায়া সে স্থান ত্যাগ করছিল। নিচের দিকে তাকিয়েই মায়ার হাতটা ধরে ফেলে বাঁধন।

মায়া বাঁধনের হাত থেকে ওর হাতটা ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, কিন্তু কোনো ভাবেই পেরে উঠছে না। বাধ্য মায়া মুখ খুলে, ছাড়ুন! কিন্তু বাঁধন আগের মতই শক্ত করে ধরে মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সেটা দেখে অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। অন্যদিকে তাকিয়েই ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলে, আমি এখন খাবো না। বাঁধন এবার বসা থেকে উঠে যায়। একটানে মায়াকে কাছে নিয়ে এসে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে, স্যরি লক্ষ্মী! মায়া কোনো কথা না বলে চোখ বন্ধ করে আছে। দু’চোখের লোনাজলে মায়ার গাল ভিঁজে একাকার। বাঁধন মায়াকে দু’বাহু ধরে ওর দিকে ফিরায়। চোখের জল মুছে দিয়ে বলে, ভালোবাসি তো লক্ষ্মী! মায়া চোখ মেলে বাঁধনের চোখের দিকে তাকায়। জল ছলছল চোখে কিরকম করুণ দৃষ্টিতে বাঁধন মায়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখেরই মায়ায় বাঁধা পরার আগেই চোখ ফিরিয়ে নেয় মায়া। অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, আমি খাব না এখন। ছাড়ুন আমাকে। বাঁধন ছাড়ার পরিবর্তে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মায়াকে। একটানে ওর কাছে নিয়ে জোর করে মায়ার নাকে, মুখে, গালে, কপালে ভালোবাসার এক উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। তারপর মায়ার দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে বলে, স্যরি! আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ আমায় মাফ করে দাও। আর কখনো এমনটি হবে না। মায়া কোনো কথা না বলে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। বেশকিছু ক্ষণ পর বাঁধন ওর চোখ মুছে বলে, আচ্ছা! মাফ করতে হবে না। বসো এখন খাবে। টেবিলে বসাতে দেরী, কিন্তু বাঁধনের হাতে কামড় দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করতে এক মুহূর্তও দেরী হয়নি মায়ার।

চলবে…….

এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০১

1

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

রুমভর্তি মানুষের সামনে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল বাঁধন মায়ার গালে। একে তো সারাদিনের অভুক্ত, তার উপর আবার চড়। তাল সামলাতে পারে নি মায়া। গালে হাত দিয়েই সোফায় বসে পরে সে। রুমে উপস্থিত মানুষজন আস্তে আস্তে যে যার বাসায় চলে যেতে শুরু করে।
এই মুহূর্তে মায়ার অবস্থান বাঁধনের খাটে। নিশ্চুপ মায়া খাটের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আর বাঁধন তারই পাশে। কিছুক্ষণ নিরবতা চলে দু’জনের মাঝে। বেশ কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে মুখ খুলে বাঁধন। প্রশ্ন করে মায়াকে, কি? কি মনে করো তুমি নিজেকে? চুপিসারে মাথা নিচু করে আছে মায়া। বাঁধন ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর না পেয়ে আরো জোরালো কন্ঠে বলে উঠে, চুপ করে আছো কেন? জবাব দাও। এভাবে আর কত? আমি যে আর পারছি না। পাগল হয়ে যাচ্ছি। এবার তো একটু শান্তি দাও! মানুষের মত বেঁচে থাকতে দাও। মায়া তখনো চুপ। মায়ার এই মৌনতা মেনে নিতে পারছে না বাঁধন। আর পারছে না বলেই আরো জোরে হুংকার দিয়ে উঠে সে- ” তোমার মত বয়সের/তোমার থেকেও ছোট এমন হাজারো মেয়ে আছে যারা শান্তিতে স্বামীর সংসার করছে। ওরা যদি পারে তবে তুমি কেন পারো না? কেন পারো না ৮,১০টা মেয়ের মত সংসার করতে? কেন আমার জীবনটাকে এভাবে শেষ করে দিচ্ছ ?” শেষ কথাটা শুনে অশ্রুভেঁজা চোখে বাঁধনের দিকে তাকাই মায়া। হয়তো এখনি কেঁদে দিবে। কিন্তু নাহ! মায়া কাঁদল না। শুধু খাট থেকে একটু নড়েচড়ে বসল। আর বাঁধন?!!! ওর রাগটা তখনো ছিল। ও জানে ও যদি এ রুমে থাকে মায়াকে আরো উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ও সেটা চাচ্ছে না। চাচ্ছে না বলেই ও সোজা রুম থেকে বের হয়ে বাহিরে চলে যায়। বাঁধন চলে যাওয়ার পর ধীরপায়ে মায়া বারান্দায় চলে যায়।

ঘন্টাখানেক পর বাসায় আসে বাঁধন। রাগটা এতক্ষণে সম্পূর্ণ চলে গেছে ওর। নিজেকে সম্পূর্ণ কন্ট্রোলে নিয়ে এসেছে ও। বাঁধন বুঝতে পারে রাগের বশবর্তী হয়ে ও কতটা জঘন্যভাবে আঘাত করেছে মায়াকে। যার চোখের একফোঁটা জল দেখলে পাগল হয়ে যেতাম, দিশেহারা হয়ে যেতাম, আজ তাকে খুব নির্মমভাবে আঘাত করলাম। অনেক কটুকাব্য শুনিয়ে দিলাম। যেই আমি ওর এই পাগলামীর প্রেমে পরে ভালোবেসেছিলাম ওকে, সেই আমি আজ এই পাগলামীর জন্য ওকে আঘাত করলাম? ওর মনে কষ্ট দিলাম? কি করে পারলাম আমি এতটা নির্দয় হতে? বাসায় ঢুকে উন্মাদ বাঁধন মায়াকে এদিক, ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ রুম, ওরুম, বাথরুম, কিচেন। সব, সব জায়গায় খুঁজ করেছে বাঁধন মায়ার। কোথাও মায়াকে খুঁজে পায়নি। নিচের তলায় ভাবীর কাছে গিয়েছে কি? আমি কি দেখে আসব নিচে? দেখেই আসি একবার।ছাঁদ থেকে খুঁজে এসে বাঁধন নিচতলায় ওর মামাত ভাই-ভাবির বাসায় খুঁজ করে। নাহ, এখানেও আসেনি। তবে কোথায় গিয়েছে ও? দিশেহারা বাঁধন দোতলায় ছুটে আসে আবারও। রুমটা ভালো করে খুঁজে কি মনে করে যেন বারান্দায় যায় সে। ওখানেই আবিস্কার করে বাঁধন তার স্ত্রী মায়াকে। বাঁধন চলে যাওয়ার পর হয়তো খুব করে কেঁদেছে, তারপর এখানে হেলান দিয়ে বসেই ঘুমিয়ে পরেছে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুকণা তারই জানান দিচ্ছে। কোনো কথা না বলে কোলে করে বাঁধন মায়াকে বিছানার কাছে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর কপালে আলতু করে চুমুর পরশ এঁকে দেয়।ফ্যানটা চালিয়ে গায়ে পাতলা চাদর টেনে দেয়।
বারান্দার গ্রিল ধরে একদৃষ্টিতে বাহির পানে তাকিয়ে আছে বাঁধন। চোখের কোণে জমে থাকা জলগুলো চিকচিক করছে ওর। আনমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেকেই গালি দিচ্ছে বাঁধন। এ আমি কি করলাম? সামান্য কারণে ওর গায়ে হাত তুললাম? ইচ্ছে হচ্ছে হাতটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে।
সারারাত ছটফট যন্ত্রণায় কাটিয়ে মাঝ রাত্রে ঘুমানোর জন্য বিছানায় যায় বাঁধন। হাতে ভর দিয়ে ঘুমন্ত মায়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাঁধন। এভাবে রাত্রি কাটিয়ে শেষ রাত্রিতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় বাঁধন।
ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যায় মায়ার। ঘুম ভাঙলে নিজেকে আবিষ্কার করে বাঁধনের খাটে। পাশেই বাঁধন শুয়ে। ঘুমন্ত বাঁধনের দিকে একবার তাকিয়ে বাঁধনের হাতটা আস্তে আস্তে মায়া ওর উপর থেকে সরিয়ে ফেলে। বিছানা থেকে উঠার সময় মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠে। দাঁড়াতে চেয়েও বসে পরে বিছানায়। মনে করার চেষ্টা করে কি হয়েছিল রাত্রে। মায়ার খুব ভালো করেই মনে পড়ে যায় গত রাত্রের ঘটনা।
প্রতিদিনকার মত সেদিনও বাঁধনের চেম্বার থেকে ফিরতে দেরী হয়। আর এতেই রেগে গিয়ে বাঁধনের রুমের খাটের নিচে লুকিয়ে পরে মায়া বাঁধনকে শায়েস্তা করার জন্য। এদিকে বাঁধন? অফিস থেকে এসে দরজা খোলা পেয়ে ব্যাগটা রুমে রেখে ওয়াশরুমে চলে যায় বাঁধন। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতেই বাঁধন মায়াকে ডাকে। মায়ার সাড়া না পেয়ে ও রুমে যায়। কিন্তু ঐ রুমে তো মেহমান শুয়ে আছে। এভাবে দরজা ফাঁকা রেখে কোথায় গেল তাহলে ও? প্রথমে ছাদ, বারান্দা, কিচেন, বাথরুম তারপর উপরতলা, নিচতলার প্রতিটি বাসা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে বাঁধন। যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছিল বাঁধন ততই পাগল হয়ে যাচ্ছিল। উন্মাদের মত চিৎকার করতে করতে বাঁধন ওর মায়াকে ডাকতে থাকে। বাঁধনের চিৎকারে উপরতলা, নিচতলার সব ভাড়াটিয়ারা এসে হাজির হয়। উপস্থিত হয় বাঁধনের আপন মামাতো ভাই এবং ভাবি। যাদের ফ্ল্যাটে বাঁধন থাকে। সবার মুখেই শুধু এক কথা, কোথায় গেছে এই পাগলী? এ তো শহরের কিচ্ছু চিনে না। আচ্ছা, ঝগড়া হয়ছিল নাকি তোমাদের মাঝে? বাঁধন তুই কি মায়ারে কিছু বলছিস? মানে কোনো কারনে ওর সাথে রাগ দেখায়ছিস? একেকজনের একেক প্রশ্ন। পারছিল না বাঁধন। চেঁচিয়ে উঠে বলে, আমি কিচ্ছু জানিনা। আমার মায়াকে চাই, মায়া। ওকে ছাড়া আমার চলবে না। খাটের নিচে বালিশ পেতে শুয়েছিল মায়া। বাঁধনের কথা শুনে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল ওর। হাসি হাসি মুখে ভাবছে, ঠিকই আছে। আচ্ছা জব্দ হয়েছে ব্যাটা। মায়া এবার বেরিয়ে পর। সময় হয়েছে তোর ব্যাটা বজ্জাতের সামনে নিজেকে হাজির করার। সবাই যখন একে অপরের সাথে কথা বলছে মায়া তখন একটু একটু করে খাটের নিচ থেকে মাথা বের করে উঁকি দেয় ওর বাঁধনের দিকে। উপস্থিত জনতার চোখ বড় বড় হয়ে যায় খাটের নিচের দিকে তাকিয়ে। বাঁধনের দৃষ্টিও সেদিকে যায়;

চলবে……..

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ১৯(অন্তিম পর্ব)

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১৯(অন্তিম পর্ব)
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

শুভ্রর পরশে ক্ষাণিক’টা কেঁপে উঠে লাবণ্য কিন্তু নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোনো চেষ্টা’ই করেনি। প্রিয় মানুষের স্পর্শ, ভালো’ই তো লাগছে। থাকুক না এভাবে, চুপচাপ, নিরবে। লাবণ্য পূর্বের ন্যায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মুখে কোনো কথা নেই। চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুধু রাতের শহরটাকে দেখছে। বেশকিছু ক্ষণ এভাবে থাকার পর নিরবতা ভাঙে শুভ্র। একইরকমভাবে লাবণ্যকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখে’ই প্রশ্ন করে, হঠাৎ কেন এই জরুরী তলব বললে না তো? প্রশ্ন শুনে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে শুভ্রর থেকে পিছিয়ে যায় লাবণ্য কিন্তু মুখে কোনো কথা বলে না। শুভ্র এতক্ষণে লাবণ্যর দিকে ফিরে তাকাই। প্রশ্ন করে আবারো, কি হলো? বললে না যে? কেন ডেকেছ আমায়? চুপচাপ লাবণ্য একহাত দিয়ে অন্য হাতের নখ কাটায় ব্যস্ত। শুভ্র আবারো প্রশ্ন করে, কি বলছি বলছি শুনতে পাচ্ছো? ডেকেছ কেন আমায়?
শুভ্রর প্রশ্নের উত্তরটা লাবণ্যর মুখস্ত থাকলেও, জড়তার কারণে এই মুহূর্তে সেটা বলতে পারছে না। আর পারছে না বলেই লাবণ্য তখনো একমনে নখ কেটেই যাচ্ছে। এদিকে শুভ্র?!!! লাবণ্যর থেকে মৌনতা ছাড়া কোনো জবাব না পেয়ে লাবণ্যর একদম কাছে চলে যায়। কাছে গিয়ে দু’হাত দিয়ে আলতু করে লাবণ্যর গালে স্পর্শ করে। লাবণ্যর মুখটা উপরের দিকে তুলে প্রশ্ন করে শুভ্র, শুনো! এদিকে আমার চোখের দিকে তাকাও। লাবণ্য ভয়ে ভয়ে শুভ্রর চোখের দিকে তাকালো।
শুভ্র রাগী কন্ঠে বলে, ” আমি তোমাকে নখ কাটতে বলিনি লাবণ্য। আমি তোমাকে প্রশ্ন করেছি, প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তরটা দাও। কেন ডেকেছ তুমি আমায়?”
শুভ্র দু’হাত দিয়ে তখনো লাবণ্যর মুখটা ওর দিকে রেখেছে। অসহায় লাবণ্য দু’চোখের পাতা বন্ধ করে আমতা আমতা স্বরে বলে উঠে, আ আ আমি আপনাকে…..(……)…..????
পরম আগ্রহের সাথে শুভ্র বলে, হ্যাঁ! বলো লাবণ্য। তুমি আমাকে কি? লাবণ্য ঢোক গিলে আবারো আমতা আমতা করে বলে, আমি আপনাকে…..(….)…..???
এভাবে যতবার শুভ্র লাবণ্যকে প্রশ্ন করেছে, বলো লাবণ্য! তুমি আমাকে কি? ততবারই লাবণ্য আমি আপনাকে বলে থেমে গেছে। সর্বশেষে বুকে সাহস সঞ্চয় করে ঢোক করে চোখটা বন্ধ করে একনিশ্বাসে বলে ফেলে লাবণ্য, আমি আপনাকে নিয়ে ঘুরতে যাব বললাম তো।
শুভ্রর হাসি মুখটা নিমিষেই কালো হয়ে যায়। লাবণ্যর থেকে শুভ্র এটা প্রত্যাশা করেনি। শুভ্র ভেবেছিল আজ লাবণ্য বুঝি ওকে বলেই দিবে না বলা ভালোবাসার কথা। কিন্তু সে গুড়েবালি। শুভ্রর সব ভাবনাকে মিথ্যে প্রমাণ করে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে লাবণ্য জানায় ও ঘুরতে যেতে চায়।
লাবণ্যর দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে শুভ্র, ঘুরতে যেতে চাও না? ঘুরতে যাওয়ার জন্য কি এ বাড়িতে কেউ ছিল না? আমাকেই ডেকে আনতে হলো? আমাকে কি তোমার এতটাই অকর্মা মনে হয়ছে? আমার কি কোনো কাজ নেই? তুমি জানো তুমি আমার কতটা মূল্যবান সময় নষ্ট করেছ? একনিশ্বাসে করা একগাদা প্রশ্ন। নিচু কন্ঠে লাবণ্যর জবাব, ভেবেছিলাম আপনি…..(…….)……???
পুরো কথা বলতে পারেনি লাবণ্য। তার আগেই শুভ্র আটকিয়ে দেয়। রাগ দেখিয়ে লাবণ্যর থেকে কিছুটা দুরে সরে গিয়ে বলে, থাকো তোমার ভাবনা নিয়ে। আমি গেলাম।
দু’লাফে ছাঁদ থেকে নেমে যায় শুভ্র। ছাদে সেই একই জায়গায় স্টেচুর মত দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্য। ওর গাল গড়িয়ে অজস্র অশ্রুকণারা নিচে পরছে।

অতিবাহিত হয়ে যায় ৩টা দিন। এই ৩দিনে শুভ্র একটা বারের জন্যও এ বাসায় আসেনি। লাবণ্যকে ফোন দেয়নি। লাবণ্যও কোনো এক অজানা অভিমানে শুভ্রকে কল দেইনি। ৩দিন পর কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন হাতে নিয়ে শুভ্রর নাম্বারে কল দেয়। শুভ্র যেন সে ফোনেরই অপেক্ষায় ছিল। লাবণ্য কল দেওয়ার সাথে সাথে ছোঁ মেরে সেই কল রিসিভ করে শুভ্র। কল রিসিভ করে দু’জনেই নিরব। কেউ কোনো কথা বলছে না। দু’তিন মিনিট পর নিরবতা ভেঙে মুখ খুলে লাবণ্য। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে__
হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম…..
ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর কন্ঠে শুভ্রর ওয়ালাইকুম আসসালাম।
আবার নিরব…..
মিনিট দুয়েক নিরব থাকার পর আবারো মুখ খুলে লাবণ্য, একটা কথা বলব?
এবার কিছুটা নরম স্বরে শুভ্রর জবাব, জি, বলো। লাবণ্য ভয়ে ভয়ে বলে, আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই। প্লিজ না করবেন না। শুধু ৫মিনিট, ৫মিনিট সময় আপনি আমায় দিবেন। আমি একটা কথা বলেই চলবে আসব। প্লিজ, আমার এই কথাটা রাখুন।
গম্ভীর কন্ঠে শুভ্র বলে, সকাল ৯টায় গলির মোড়ে এসো তাহলে। ৫মিনিট না হয় ওখানেই কাটাবো। অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুমাবো। রাখলাম। আল্লাহ হাফেজ।
লাবণ্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয় শুভ্র। পরদিন সকাল নয়টা বাজা’র আধঘন্টা আগেই লাবণ্য সেই গলির মোড়ে একটা দোকানের সামনে এসে দাঁড়াই। শুভ্রও সেদিন তাড়াতাড়ি’ই বাসা থেকে বের হয়ছিল। তাই লাবণ্যকে ওর জন্য বেশীক্ষণ ওয়েট করতে হয়নি।
লাবণ্যকে দেখে ঘড়ির দিকে তাকাই শুভ্র।
ওহ, এসে গেছ তাহলে? ভালো’ই হলো। আমার আর অপেক্ষা করতে হলো না।
লাবণ্য মৃদু স্বরে বলে, হুম।
তারপর? কি অবস্থা? কেমন চলছে দিনকাল? শুভ্রর প্রশ্নের জবাবে ঠোঁটের কোণে একটা শুকনো হাসির রেখা টেনে লাবণ্য বলে উঠে,
” আছি এরকম। আপনি? আপনি কেমন আছেন?”
স্মিতহাস্যে শুভ্রর জবাব, মন্দ না! ভালো’ই আছি। মনে মনে শুভ্রকে বকে ওর বংশ উদ্ধার করে লাবণ্য। ব্যাটা! অন্যের মনে আগুন জ্বালিয়ে বেশ ভালো’ই আছিস! তোর ভালো থাকার ১২টা বাজাবো আজ আমি। ভালোবাসি বলে আড়ালে লুকিয়ে যাব আমি। এমন আড়ালে যে কেঁদে কেঁদে তুই অর্ধেক শেষ হয়ে যাবে।
ঘোর কাটে শুভ্রর ডাকে। ওহ, হ্যালো! কোথায় হারিয়ে গেলেন? চমকে উঠে শুভ্রর দিকে তাকাই লাবণ্য। শুভ্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাবণ্যর মুখের দিকে তাকাই। কি হলো? বলো? কি বলবা? ৫মিনিট যে হয়ে গেল। লাবণ্য ঢোক গিলে বলে, ইয়ে মানে আমি আপনাকে…..(…..)…..???
হ্যাঁ, বলো। তুমি আমাকে কি? লাবণ্য বার কয়েক কথাটা বলে। কথাটার একই জায়গায় প্রতিবারই লাবণ্য থেমে যাচ্ছে। এবার রেগে গিয়েই শুভ্র বলল, তুমি আমাকে নিয়ে আজও কোথাও না কোথাও ঘুরতে যেতে চাও, তাই তো? কিন্তু মাফ চাচ্ছি লাবণ্য। আমি পারব না। আমার অনেক কাজ আছে। ঘুরার মত টাইম এই মুহূর্তে আমার হাতে নেই। আমি গেলাম। কথাগুলো বলেই শুভ্র হনহনিয়ে রিক্সা দিয়ে চলে যায়। নিশ্চুপ লাবণ্য ফ্যালফ্যালিয়ে শুভ্রর সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

কেটে যায় আরো ১টা সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে শুভ্র একটা বারের জন্য লাবণ্যকে কল দেয়নি। লাবণ্যও শুভ্রকে কল দেওয়ার সাহস পায়নি। সেদিন ছিল শুক্রবার। যেদিন লাবণ্য শুভ্রকে আবারো কল দিয়ে দেখা করতে বলে। শুভ্র রাজি হয়ে যায়। লাবণ্যর কথামতো সেদিন বিকেলে বাসার অদূরে’ই একটা পার্কে শুভ্র লাবণ্যর সাথে দেখা করতে যায়। কথা বলার এক পর্যায়ে শুভ্র প্রশ্ন করে লাবণ্যকে, তুমি না কি বলতে চেয়েছিলে? যদিও না বলাটা বলার সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল শুভ্র। কিন্তু শুভ্রর মায়া মাখা মুখ, হাসি, কথা বলায় তন্ময় হয়ে থেকে সেসব কিছু গুলিয়ে ফেলে লাবণ্য। শুভ্রের প্রশ্নের কাঙ্খিত উত্তর লাবণ্য দিতে পারেনি সেদিন। এদিকে শুভ্র প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছে, লাবণ্যর মুখ থেকে ঐ চার অক্ষরের একটি শব্দ শুনার জন্য। শুভ্রর মনটা ব্যাকুল হয়ে আছে লাবণ্যর মুখের ঐ ভালোবাসি কথাটা শুনার জন্য। কিন্তু বোকা লাবণ্য করলো কি জানেন?
শুভ্রর প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল। শুভ্র ধমক দিয়ে লাবণ্যকে ওর দিকে ফিরায়। কি হলো? ঐ দিকে কি দেখছ? লাবণ্য বোকার মত শুধু হাসে। শুভ্র রেগে গিয়ে বলে, হাসার কিছু বলছি আমি? লাবণ্য আবারো হাসে। একগাল হেসে দুরে এক কাপলের দিকে আঙ্গুল ইশারা করে যারা ওদের বাচ্চা দু’দিক দিয়ে ধরে পার্কের ভিতর হাটাহাটি করছে।
শুভ্র গম্ভীর হয়ে বলে, ওরা হাটাহাটি করছে। তো এখানে হাসার কি হলো? লাবণ্য আবারো বোকার মত একগাল হেসে বলে, চিন্তা করতেছি এরকমই কতগুলো বাচ্চা যখন আপনাকে জাপটে ধরবে, আপনার ব্যাগ, সানগ্লাস, টাই নিয়ে যখন দৌঁড়াদৌঁড়ি করবে তখন আপনি কিভাবে হসপিটালে যাবেন। What nonsense!
এগুলো আমার প্রশ্নের উত্তর….??? শুভ্র রেগে গিয়ে লাবণ্যর দিকে তাকাই। লাবণ্য ভয় পেয়ে মুখটা বাচ্চাদের মত করে ফেলে। তারপর ঢোক গিলে বলে, রাগ করলেন? আমি তো আপনাকে বন্ধু ভেবেই কথাগুলো বলছি। শুভ্র হাতে থাকা সানগ্লাসটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বসা থেকে উঠে পরে। তারপর রাগান্বিত দৃষ্টিতে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে বলে, আমাকে তোমার পাগল মনে হয়, না? তাই এভাবে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছো, তাই না? কিন্তু মিসেস লাবণ্য! অনেক হয়েছে। আর নয়। আর কখনো যাতে আমায় কল না দেওয়া হয়। আজ থেকে মনে করবা, শুভ্র নামের কেউ ছিল না তোমার জীবনে। যে ছিল সে মারা গেছে। হনহনিয়ে লাবণ্যর সামনে দিয়ে শুভ্র চলে যাচ্ছে রাগ দেখিয়ে। পিছন থেকে লাবণ্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে শুভ্রকে আটকানোর। এই শুনোন, শুনোন বলছি, আমি আপনাকে কথাটা বলব। একটু এসে বসুন, প্লিজ। আমায় একা রেখে যাবেন না। আপনি চলে গেলে কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম। আমি কিন্তু এখানে আপনার জন্য বসে থাকব। রাগ কমলে চলে আসবেন, মনে থাকে যেন! চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথাগুলো বলছিল লাবণ্য শুভ্রকে। কিন্তু শুভ্র সেই কথাগুলো শুনেও না শুনার ভাব করে লাবণ্যকে একা রেখে বাসায় চলে যায়।

সন্ধ্যা ০৭টা__
পার্ক থেকে এসে একঘুম দিয়ে উঠে পরেছে শুভ্র।ঘুমের জন্য মাগরিবের নামাজও মিস হয়ে গেছে ওর। বাহিরে প্রচুর ঝড় বইছে। জানালাগুলো কেমন উল্টে পাল্টে একটার সাথে আরেকটা ধাক্কা খাচ্ছে। আর সেই ধাক্কাতে প্রচন্ড শব্দ হচ্ছে। এদিকে কারেন্টও চলে গেছে।বহুকষ্টে জানালাগুলো লাগিয়ে এসে অন্ধকার রুমে হাতড়ে হাতড়ে ফোন খুঁজছে শুভ্র। মৃদু শব্দে তখনো কল বাজছে। বাসা থেকে কল দিয়েছে। আশ্চর্য! এ সময় বাসা থেকে কেন কল দিচ্ছে? মায়ের কি শরীর খারাপ হয়েছে নাকি? সাত, পাঁচ ভাবতে ভাবতেই কলটা কেটে যায়। কল কেটে যাওয়ার পর চক্ষু চড়কগাছ শুভ্রর। ১০০এর উপরে কল দিয়েছে বাসা থেকে। কারো কিছু হয়ে গেল নাতো? ভিতরটা শিউরে উঠে শুভ্রর। কল ব্রেক করবে ভাবতেই শিশিরের নাম্বার থেকে কল। তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করে শুভ্র। উৎকন্ঠার সাথে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে শিশির? সব ঠিকঠাক আছে তো?! কান্নাজড়ানো কন্ঠে রোকসানা বেগমের জবাব, আমি শিশির না, তোর মা। শুভ্রর গলাটা শুকিয়ে যায়। মা, কাঁদছ কেন তুমি? কি হয়েছে? বাবা, শিশির ওরা ঠিক আছে তো? রোকসানা বেগম কান্নাজড়ানো কন্ঠে বলে, লাবণ্য ওর বান্ধবীর বাসায় যাবে বলে বের হয়েছিল বিকেলে, তারপর আর ফিরে আসেনি। এদিকে ওর বান্ধবীকে কল দিলাম, ওর বান্ধবী জানায় লাবণ্য ঐ বাসায় যায় নি। ঐ বাসায় যায়নি, ওদের গ্রামের বাড়িতেও যায়নি। কোথায় গিয়েছে তাহলে ও? বাবা, ও কি তোর কাছে গিয়েছে? আমরা তোর বাসায় খুঁজ করতে গিয়েছিলাম। খুঁজ নিয়ে জানলাম ওখানে তুই নেই। বাবা, লাবণ্য কি তোর কাছে? তুই নিয়ে গেছিস ওকে? মায়ের কথা শুনে শুভ্রর গলাটা কেমন শুকিয়ে যায়। অনেক কষ্টে মাকে বলে, মা! আমি রাখছি। পরে কথা হবে। ফোনটা কেটে শুভ্র তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হয়। বাইকটা নিয়ে রাস্তায় যখন বের হয় শুভ্র ততক্ষণে ঝড়ো হাওয়া থেমে যায়। আকাশ একটু একটু পরিষ্কার হতে থাকে। তবে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি থেমে নেয়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভিঁজে বাইক নিয়ে শুভ্র এগিয়ে যাচ্ছে ঐ স্থানে, যে স্থান থেকে বিকেলে ও রাগারাগি করে চলে আসছিল। বাইকটা রাস্তার পাশে রেখেই ঝুপের আড়ালের ঐ স্থানটিতে চলে যায় শুভ্র, যে স্থানে বেঞ্চে বসে লাবণ্য বোকার মত হাসছিল, পাগলামি করছিল। বেঞ্চের কাছে ঝুপের ভেতরে তাকাতেই শুভ্রর চোখ ছানাভরা হয়ে যায়। শুভ্র স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, লাবণ্য গায়ের ওড়না জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। শুভ্রের কান্নাভেঁজা কন্ঠের লাবণ্য ডাক শুনে উপরের দিকে মাথা তুলে তাকায় ও। শুভ্রকে একনজর দেখে নিচের দিকে চোখ ফিরিয়ে নেয় লাবণ্য। আচমকা লাবণ্যর একটা হাত ধরে ফেলে শুভ্র। তারপর টানতে টানতে ঝুপ থেকে বের করে। অভিমানী কন্ঠে লাবণ্যর জবাব, আমি বৃষ্টিতে ভিঁজতেছি। আমায় এভাবে টেনে আনলেন কেন? তখনি ঠাস শব্দে লাবণ্যর গালে একটা থাপ্পর পরল। আশ্চর্য! আপনি আমাকে থাপ্পর কেন মারলেন? কোনো কথা শুনতে চাচ্ছি না আমি। আসো, আমার সাথে আসো। শুভ্র লাবণ্যকে টানতে টানতে বাইকের কাছে নিয়ে যায়। লাবণ্য মুখভার করে বলে, এখানে কেন আনলেন আমায়?
রাগান্বিত দৃষ্টিতে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে শুভ্রর জবাব, আর একটা কথাও যাতে না শুনি। জেদি কন্ঠে লাবণ্য বলে উঠে, কি করবেন? আরেকটা কথা বললে কি করবেন? দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয় শুভ্র, এই যে হাতটা দেখছ? এটা দিয়ে থাপ্পর মারব। এমন থাপ্পর দিব, সারাজীবনেও ভুলতে পারবে না।
অভিমানের সাথে কিছুটা রাগ মিশিয়ে লাবণ্যর জবাব, পারেন তো শুধু এটাই। আর কিছু পারেন রাগ আর থাপ্পর দেওয়া ছাড়া?
এবার আর না হেসে পারল না শুভ্র। লাবণ্যর বাচ্চাদের মত ওমন নাক ফুলিয়ে কথা বলা দেখে হেসে দিল শুভ্র। তারপর মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলল, এর ছাড়াও আমি অনেক কিছুই পারি। শুধু পাবলিক প্লেস দেখে কিছু করিনি এখনো। বাসায় থাকলে এতক্ষণে বুঝিয়ে দিতাম আমি কি পারি না পারি। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলল লাবণ্য। নরম স্বরে বলল, আমি কি ঐভাবে বলছি নাকি? শুভ্র মুচকি হেসে বলে, হয়ছে! আর লজ্জা পেতে হবে না। বাইকে উঠো। লাবণ্য লজ্জায় আর কোনো কথা বলতে পারেনি। চুপচাপ বাইকে উঠে পরে লাবণ্য।
এদিকে মোড় নিয়েছেন কেন? শুভ্র সিরিয়াস মুডে বলে, তোমার স্বপ্ন পূরণের জন্য। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে লাবণ্য, আমার স্বপ্ন? সেটা আবার কি? দুষ্টু হাসি দিয়ে শুভ্রর জবাব, এই যে অনেকগুলো বাচ্চা থাকবে আমার বাসায়। একজন আমার নাক ধরে তো আরেকজন কান ধরে, একজন চুল ধরে তো, আরেকজন সানগ্লাস ধরে টানবে। একজন কোর্ট ধরে তো আরেকজন টাই ধরে টানবে। ওহ, হ্যাঁ! আমি যাতে হসপিটালে যেতে না পারি এই জন্য আমার আরেক বাচ্চা আমার ব্যাগ ধরেও টানবে। এসব কিছুই তো তোমার তো তোমার স্বপ্ন, তাই না? শুভ্রর কথায় লজ্জায় চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে লাবণ্যর। মনে মনে তখনকার বোকামির জন্য নিজে নিজেকে গালি দিচ্ছে লাবণ্য।
কি হলো? আমার বউটা চুপ হয়ে গেল যে? কিছু বলতেছ না যে? নিচু স্বরে লাবণ্যর জবাব, কি বলব? শুভ্র মুখে দুষ্টু হাসির রেখা টেনে বলে, এই যে! প্রস্তুত নাকি ক্রিকেট টিম তৈরির জন্য? লাবণ্য মুখে হাসি চোখে জল নিয়ে শুভ্রকে কিলাতে শুরু করে। একটা বৃহৎ ভুলের পরিসমাপ্তি হয় যেখানে ভালোবাসার সূচনাটা সেখানে’ই। বেঁচে থাকুক ভালোবাসারা যুগ, যুগ ধরে প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে।

♪The End♪

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ১৮

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১৮
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ফোনটা কেটে বন্ধ করে টেবিলে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদে উঠে লাবণ্য। মাথার নিচে খোলা বইয়ের পাতাগুলো একটু একটু করে ভিঁজে একাকার হয়ে যাচ্ছে লাবণ্যর চোখে জলে। গোসল সেরে রুমে আসে শিশির। এই অসময়ে ভাবিকে এভাবে টেবিলে ঝিমুতে দেখে ভাবির পাশে গিয়ে দাঁড়ায় শিশির।
” ভাবি তোমার শরীর খারাপ?”
চমকে উঠে মাথা তুলে তাকাই লাবণ্য। শিশিরকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চোখের জলটুকু মুছে নেয় সে। শিশির ওর ভাবির মুখটা ওর দিকে ফিরিয়ে নেয়। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে, সেকি! তোমার চোখে জল? তুমি কাঁদছ ভাবি?!!! কান্না লুকিয়ে লাবণ্যর জবাব, কই! না তো। আসলে চোখে কি যেন পরছিল তাই…..(….)…..????
তাই চোখ থেকে গড়িয়ে অশ্রু পরছে। আর সেই সব অশ্রুকণা দিয়ে বইয়ের পাতা ভিঁজে একাকার, সাথে চোখ দুটোও ফুলে তালগাছ হয়ে গেছে। এইসব তুমি বললে, আর আমি বিশ্বাস করে নিব তাই না?
লাবণ্য শিশিরের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। লাবণ্যর চোখ থেকে এখনো একটু একটু করে অশ্রু ঝরছে। শিশির সেটা লক্ষ করেছে। আর তাইতো লাবণ্যর মুখটা ওর দিকে ফিরিয়ে নেই আবারো। দু’গাল গড়িয়ে পরা জলটুকু মুছে দিয়ে প্রশ্ন করে, কি হয়েছে তোমার? বলবা না আমাকে? আমাকে না তুমি তোমার বোনের মত দেখো। এই তার নমুনা? শিশিরের দিকে তাকিয়েই লাবণ্য কেঁদে দেয়। অনর্গল বলতে শুরু করে, আমি ওকে ভালোবাসি না, একদম না। আমি তো শুধু এমনিই দেখা করতে বলছিলাম। আর ও কি না মিটিমিটি হাসছিল আমার কথা শুনে। আচ্ছা, তুমিই বলো শিশির আমি কি জোকার? আমাকে কি তোমার জোকার মনে হয়? শিশির টেবিলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, নাহ! একদম না। আমার ভাবি কেন জোকার হবে? জোকার তো ঐ ব্যাটা যে আমার ভাবিকে জোকার বলে। কাঁদায়। লাবণ্য টেবিল থেকে উঠে গিয়ে গম্ভীর হয়ে খাটে বসে। লাবণ্যর ঠিক পাশে গিয়ে শিশিরও বসে। শিশির মুচকি হেসে বলে, তারপর কি হয়েছে ভাবি? লাবণ্য কিছু একটা বলতে গিয়ে শিশিরের দিকে তাকিয়ে দেখে সেও হাসছে। মেজাজটা চরম পর্যায়ে উঠে যায় ওর। রাগে অভিমানে রুম ত্যাগ করে ও। লাবণ্য চলে যাওয়ার পর ভাইকে কল দেয় শিশির। ভাই বোনে মিলে অট্টহাসিতে মেতে উঠে।

হুহ, আমাকে কি মনে করে? ছেঁড়া পলিথিন? আমার কোনো’ই মূল্য নেই? সব মূল্য শুধু ওনার’ই? হুহ! খুব প্রায়োরিটি দেই তো, তাই এতো উপরে উঠে গেছে। উপর থেকে যে কিভাবে নামাতে হয় সেটা আমি জানি। কল দিব না আর ওকে। এই ফোনটা অফ করে আলমারিতে রাখলাম। আগামী ৩০দিনে ফোন হাতে নিব না।
মনে মনে জটিল প্রতিজ্ঞা করে লাবণ্য নিজেই নিজের সাথে। ফোনটা আলমারিতে রাখছে বিকেল ৫টা নাগাদ। এখন ৬টা বেজে ১৯মিনিট। এরই ভিতর বার কয়েক আলমারির কাছে গিয়েও কি মনে করে যেন ফিরে এসেছে লাবণ্য।
সন্ধ্যা ৭টা। খুলবে না খুলবে না করেও অবশেষে খুলেই ফেলে আলমারিটা। ফোন হাতে নিয়ে ওপেন করে চাতকের ন্যায় ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে লাবণ্য। কিন্তু কোনো কল বা এসএমএস আসেনি। ফোনটা বন্ধ করে আবারো আলমারির ভিতর রেখে দেয়। এবার মনে মনে এই বলে রাখে, যত যায় হোক ফোনে আর হাত দিবে না। ফোন আলমারিতে রেখে কিছুক্ষণ পর পর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে লাবণ্য। কোনো রকম ২০মিনিট চুপসে থেকে সন্ধ্যে ৭টা ২১মিনিটে আলমারিটা আবারো খুলে। ফোনে হাত দিবে না দিবে না করেও দিয়ে ফেলে। তারপর ওপেন করে হাতে নিয়ে চাতকের ন্যায় একটা ফোন কলের আশায় বসে আছে। রাত্রি ১১টা। শুভ্রর ফোনটা বেজে উঠে। ভাব নিয়ে হ্যালো বলে শুভ্রর প্রশ্ন- কিছু বলবে? নরম স্বরে লাবণ্যর জবাব, খুব বিজি?
— সেরকম বিজি না।
লাবণ্য এবার কিছুটা উঁচু কন্ঠে বলে, কালকে কয়টায় হসপিটালে যাবেন? শুভ্র ভেবে বলে, প্রতিদিনই তো ৯টায় যায়, কিন্তু কালকে একটু জলদিই যেতে হবে। একটু দরকার আছে। লাবণ্য একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, তারপর কখন ফ্রি হবেন? শুভ্র কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলে, ফ্রি বলতে লাঞ্চ টাইমে যতটুকু সময় পাই আর কি।
এবার কন্ঠ কিছুটা নীচু করে লাবণ্যর প্রশ্ন, রাত্রিতে তো আপনি ফ্রি’ই থাকেন। আমি রাত্রে আপনার সাথে দেখা করতে চাই যদি আপনি চান….
– আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার কষ্ট করতে হবে না। আপনি আসব কালকে। তুমি প্রস্তুত থেকো। পরে কথা হবে। এখন রাখি। টেইক কেয়ার। শুভ রাত্রি।
কল কেটে দিয়ে শুভ্র হো, হো করে হেসে উঠল। হাসি দেখে মনে হবে যেন বিশ্বজয় করে ফেলেছে সে।
বিছানার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে গড়াগড়ি করতে করতে বালিশ বুকে নিয়ে একটা সময় ঘুমিয়ে পরে শুভ্র।

পরদিন__
লাবণ্যর সময় যেন কাটছে’ই না। কখন রাত্রি হবে, আর কখন শুভ্র আসবে। ওর শুভ্রকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। সারাটা দিন বহুকষ্টে কাটল লাবণ্যর। কখনো খাটে বসে, কখনো শুয়ে, কখনো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে, কখনো বারান্দায় গিয়ে, কখনো ছাদে, কখনো বা টিভির সামনে বসে থেকে। সারাটা দিন এভাবেই কাটল লাবণ্যর। সন্ধ্যে ৮টা নাগাদ লাবণ্যকে নেওয়ার জন্য এ বাসায় আসে শুভ্র। বাসায় এসে মায়ের সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারল সেটা হলো, এই রাত্রের বেলা মা কিছুতেই ওর সঙ্গে লাবণ্যকে দিবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যেটা সেটা হলো, রোকসানা বেগম এখনো ছেলের প্রতি প্রচন্ড রেগে। আচ্ছা, ঠিক আছে। তোমার মেয়ে, আই মিন তোমার বান্ধবীর মেয়েকে তুমি সারাজীবন এভাবেই ঘরে বসিয়ে রেখো। অনেকটা রাগ দেখিয়ে মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে উপরে শিশিরের রুমের দিকে পা বাড়াই শুভ্র। রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নক করে শুভ্র, আসতে পারি? ভিতর থেকে শিশিরের জবাব, এখানে এসে কি করবি? ছাদে চলে যা। ছাদে পাবি তোর মানুষকে…..

শুভ্র আর কোনো কথা না বলেই ছাদের দিকে পা বাড়াই। ছাদে পা দিতেই শুভ্রর মাথা ঘুরার উপক্রম। গোলাপী কালার শাড়ি পরিহিত, হাতে সেইম কালার চুড়ি, আর খোলা চুলে এক অপূর্ব সুন্দরী রমনী ছাদের এককোণে দাঁড়িয়ে। এহেম কাশি দিতেই পিছু ফিরে সুন্দরী রমনী। এ যে আর কেউ নয়। তারই লাবণ্য। চোখ ফেরাতে পারছে না ওর থেকে শুভ্র। শুভ্রর এমন পলকহীনভাবে তাকিয়ে থাকায় কিছুটা লজ্জা পেয়ে যায় লাবণ্য। আমতা আমতা করে বলে,
” ইয়ে মানে ঘুরতে যাব ভাবছিলাম তো, তাই…….. (…..)….???
ঘোর কাটে শুভ্রর। মুচকি হেসে জবাব দেয়, শুধু কি ঘুরতে যাওয়ার জন্য’ই এ সাজ নাকি এর পিছনে বড় কোনো কারন আছে?
লাবণ্যর মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তুতলিয়ে তুতলিয়ে বলে, কা কা কারন?
শুভ্র কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলে, হুম কা কা কারন কি? শুভ্রর কথায় লাবণ্য লজ্জা পেয়ে যায়। নাক মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বলে আসলে শাঁড়িতে অভ্যস্ত নেই তো তাই….(…..)…..???
হা, হা। জীবনভর শুনে এসেছি শাঁড়িতে অভ্যস্ত না থাকলে মেয়েরা হোচট খেয়ে পরে যায়, প্যাঁচ লেগে পরে যায়। আজ এও শুনার ছিল? শাঁড়িতে অভ্যস্ত নাই বিধায় তুতল্লাচ্ছে। সাথে চোখ মুখ ফ্যাকাশেও হয়ে গেছে। থ্যাংক্স গড! আমাকে এখানে আসার তৌফিক দান করার জন্য। নতুন একটা অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। কথাগুলো বলে শুভ্র হাসছে, আর লাবণ্য লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্র হাসি থামিয়ে লাবণ্যর কাছে যায়। তারপর ছোট্ট করে বলে, স্যরি! মজা করলাম একটু।
লাবণ্য তখনো কোনো কথা না বলে নিচের দিকে তাকিয়ে চুপসে দাঁড়িয়ে আছে। নিরবতা ভাঙার জন্য শুভ্র লাবণ্যের কানের খুব কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে আস্তে করে বলে, tnx a lot….
মাথা তুলে তাকাই লাবণ্য। কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করে, কিসের থ্যাংক্স? শুভ্র মুচকি হেসে বলে, এই যে ঘুরতে যাওয়ার বাহানায় আমার জন্য শাঁড়িটা পরছ…..!!!!
লজ্জায় লাবণ্যর মুখ থেকে কথা সরছে না। এভাবে এত তাড়াতাড়ি ও ধরা খেয়ে যাবে বুঝতে পারেনি। যে লজ্জার হাত থেকে বাঁচার জন্য ঘুরতে যাওয়ার মিথ্যে অজুহাত দেখিয়েছিল ও, সেই লজ্জাটাই পেয়ে গেল। লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে লাবণ্যর।
তোমার ঠোঁটগুলো খুব সুন্দর, আরো বেশী সুন্দর দেখায় যখন তুমি লজ্জা পাও। লাবণ্য! তুমি কি জানো তুমি লজ্জা পেলে তোমার নাক ঘামে, ঠোঁটগুলো কাঁপে। লাবণ্য যেন শুভ্রর বলা এক একটা কথায় লজ্জাবতী পাতার মতই একটু একটু করে চুপসে যাচ্ছে। লাবণ্যর সেই করুণ অবস্থার সুযোগটাই নিয়েছে শুভ্র। বার বার শুভ্র লাবণ্যকে একেক কথা দ্বারা খোঁচা দিচ্ছে। লাবণ্য না পারছে সেখান থেকে যেতে, না পারছে কিছু বলতে।
আচমকা শুভ্র লাবণ্যর একটা হাত ধরে ফেলে। কাঁপা দৃষ্টিতে লাবণ্য শুভ্রর দিকে তাকাই। শুভ্র মুচকি হেসে বলে, আমার সাথে রাগ করে হাতের আঙুল কি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছ নাকি?
ইয়ে, না, মানে আসলে….. আমি তো…..(….)……????

শুভ্র একগাল হেসে বলে, বুঝতে পারছি ইয়ে না মানে তুমি আসলে আমার কথায় লজ্জা পেয়েছ। আর তাই বোবার মত চুপসে শুধু একহাত দিয়ে আরেক হাতের আঙুল মুচড়াচ্ছিলে। তাই না?
লাবণ্য কোনো কথা না বলে নিরব থাকে।
নিরব দৃষ্টিতে ছাদের কর্ণারে দাঁড়িয়ে দুর, বহুদুর তাকিয়ে আছে। শুভ্র মুচকি হেসে লাবণ্যর পাশে দাঁড়িয়ে একটা হাত দিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।

চলবে…..

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ১৭

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ১৭
লেখা- অনামিকা ইসলাম “অন্তরা”

লাবণ্যর সঙ্গে শুভ্রর কখনো সেভাবে চোখাচোখি হয়নি। শুভ্র যখনই লাবণ্যর চোখের দিকে তাকাতো, তখনই ও চোখ ফিরিয়ে নিত।
আবার শুভ্র যখন এদিক-ওদিক তাকাতো, তখন লাবণ্য শুভ্রর দুই চোখে বিচরণ করত। শুভ্র আড়চোখে দেখত। লাবণ্য কখনো কখনো ধরা পড়ে যেত।

কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছালো ওরা। নদীর পাড়ে কোলাহল মুক্ত একটা জায়গায় গিয়ে বসল।
নদীর তীরে চুপচাপ বসে আছে একজোড়া কপোত-কপোতী। কারো মুখেই যেন কোনো কথা নেই, যদিও অনেক কথায় জমা আছে দু’জনের মনে।
পাশাপাশি বসলেও দুজনের মধ্যে বেশক্ষাণিক’টা দূরত্ব বজায় রাখা। শুভ্র চুপচাপ নদীর ঢেউগুলোর দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। আর লাবণ্য? লাবণ্য পলকহীন দৃষ্টিতে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে আছে। যদিও শুভ্রর দৃষ্টি নদীর দিকে তথাপি সে লাবণ্যর কৃর্তিকলাপ আড়চোখে লক্ষ্য করছে।
মনে মনে লাবণ্য শুভ্রকে একশ একটা গালি দিল। শয়তান একটা, খাটাশ একটা! ভদ্রতা দেখাতে আসছে। একটু কাছাকাছি বসলে কি এমন ক্ষতি হতো?
লাবণ্যর খুব ইচ্ছে হচ্ছে শুভ্রর পাশে বসে ওর কাঁধে মাথা রাখতে। কিন্তু তাতো আর সম্ভব নয়! আচ্ছা, কাঁধে মাথা নাইবা রাখলাম হাতটা তো ধরতে পারি। মনের এই ছোট্ট চাওয়ার প্রাধান্য তো দেওয়াই যায়।

লাবণ্য দুর থেকেই শুভ্রর হাতের দিকে ওর একটা হাত বাড়িয়ে দিল। কাঁপা, কাঁপা দুটি হাত শুভ্রর হাতের খুব কাছে নিয়ে গেলেও রাখতে পারল না। লাবণ্য ওর হাতটা ফিরিয়ে নিয়ে এসে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দুর অজানার দিকে।
আড়চোখে এতক্ষণ সব লক্ষ্য করছিল শুভ্র। এইমুহূর্তে লাবণ্যর মনটা যে খুব বেশী ভালো নয় সেটাও বুঝতে পেরে গেছে সে। তাইতো দুর থেকেই শুভ্র ওর একটা হাত লাবণ্যর হাতের উপর রাখে। মৃদু কেঁপে উঠে লাবণ্য হাতের দিকে তাকাই। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।
মনে মনে হাসছে শুভ্র। মুখে কিছু না বলেই দুর থেকে লাবণ্যর অনেকটা কাছে, পাশাপাশি গাঁ ঘেষে বসে যায়। লাবণ্যর পুরো শরীর শিহরণ দিয়ে উঠে শুভ্র যখন শক্ত থেকে আরো শক্ত করে ওর হাতটা চেপে ধরে।

বেশকিছু ক্ষণ চুপ থাকার পর নিরবতা ভাঙ্গে শুভ্র। লাবণ্য, সুন্দর না জায়গাটা? লাবণ্য মৃদুস্বরে জবাব দেয়, হুম। লাবণ্য চলো আমরা ওপাশে গিয়ে বসি। শুভ্র লাবণ্যকে নিয়ে নদীর অপর পাশে চলে যায়।
সত্যিই জায়গাটা অনেক সুন্দর। নদীর ধারে ফুটন্ত কাশফুল সেই সৌন্দর্যকে আরো বহুগুনে বাড়িয়ে দিয়েছে। জায়গাটা এতই সুন্দর যে লাবণ্য বিমোহিত হয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই মুহূর্তে লাবণ্য প্রজাপতির পিছনে দৌঁড়াচ্ছে আর তাকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। শুভ্র সেই মুহূর্তকে তার কাছে থাকা গোপন ক্যামেরা’ই বন্দি করে ফেলে।

সারাটা দিন এভাবেই কেটে যায়। কখনো নৌকায় চড়ে, কখনো বা নদীর আশেপাশের সৌন্দর্য দেখে। এক ফাঁকে দুপুরের খাবারটাও খেয়ে নেয় ওরা পার্শ্ববর্তী হোটেল থেকে। বিকেল হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরতে চায় লাবণ্য। শুভ্র রিকশায় করে লাবণ্যকে বাড়ি পৌঁছে দেয়। যাবার সময়ও দু’জন বেশ চুপচাপ। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। নিশ্চুপ লাবণ্যর ইচ্ছে হচ্ছিল শুভ্র ওর হাতটা ধরুক, কিন্তু মানুষের সব ইচ্ছে তো আর পূর্ণ হয় না। সেদিন লাবণ্যকে অবাক করে দিয়ে শুভ্র একহাতে লাবণ্যর দুটো হাত আলতু করে চেপে ধরে আরেকহাত দিয়ে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। লাবণ্যর ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুটে উঠে। ব্যাপারটা শুভ্রর নজর এড়ায় না।
লাবণ্যকে বাসার সামনে পৌঁছে দিয়ে শুভ্র রওয়ানা হয়ে যায় ঢাকার উদ্দেশ্যে। নিশ্চুপ লাবণ্য বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে ভেঁজা চোখে শুভ্রর সেই চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।

লাবণ্য বরিশাল থেকে শ্বশুর শাশুড়ির সঙ্গে ঢাকায় ফিরে আসছে একসপ্তাহ হলো,
এর ভিতরে একটা বারের জন্য শুভ্র ওকে কল দেয়নি। আজকাল খুব বেশী এড়িয়ে চলছেন ওনি আমাকে। আগের মত কলও দেই না। বোধ হয় সময়ের সাথে সাথে আমার প্রতি টানটাও কমে গেছে। ধূর! কি ভাবছি এসব? ওনি তো ব্যস্তও থাকতে পারেন। আর তাছাড়া কিসের টানের কথা বলছি আমি? কোন সম্পর্কের টানে ওনি আমার কাছে আসবেন? আমাদের মধ্যে আদৌ কি কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে? লাবণ্য নিজের মাথায় নিজেই আঘাত করে এই ভেবে যে, ধূর!কি ভাবছি এসব?
সেদিন সারা রাত্রি বিছানায় শুয়ে ছটফট করেছে লাবণ্য। হাজার চেষ্টা করেও কেন ঘুমাতে পারছিল না। বার বার হৃদয়ের ক্যানভাসে শুধু একটি নাম ভেসে উঠে, সে শুভ্র। তবুও লাবণ্য নিজে নিজেকে এই বলে বাঁধা দেয় যে, না, না! এ হতে পারে না। আমি ওর বন্ধু। স্রেফ বন্ধু হয়েই থাকতে চাই।

সকাল সকাল লাবণ্য কলেজের দিকে রওয়ানা হয়। উদ্দেশ্য একটাই আর সেটা হলো মাস্টার্সে ভর্তির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কলেজে জমা দিয়ে আসা। কলেজ থেকে আসবার কালে লাবণ্য ওর শ্বশুরের পরিচিত একটা দোকানে যায়। কয়দিন আগে একটা ফোন দেখে গিয়েছিল লাবণ্য, আজ আসছে সেই ফোনটা নিতে। অনেক কষ্টে, শ্বশুর শাশুড়ির দেওয়া টাকা থেকে কিছু কিছু জমিয়ে আজ এসেছে ফোনটা কিনতে। যদিও ওর শ্বশুর বলে দিয়েছে, ওর পছন্দমত সেট নিতে। টাকা ওনিই দিবে। কিন্তু লাবণ্য ওর জমানো টাকার মধ্যেই একটা ফোন কিনল। সাথে একটা সিমকার্ড। রিচার্জ করে নিয়েছে ১০০টাকা। ফোন হাতে পেয়ে লাবণ্যর খুশি আর দেখে কে? খুশিতে আত্মহারা লাবণ্য মনে মনে ভাবছে, যাক! এখন আমার যখন ইচ্ছে তখন’ই শুভ্রকে কল দিতে পারব। ওর সাথে কথা বলতে পারব। দোকান থেকে বেরিয়ে পরম খুশি মনে শুভ্র লাবণ্যকে কল দেয়। ব্যস্ত শুভ্র ব্যস্ততার মাঝেও কল রিসিভ করে। কানে নিয়ে হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে লাবণ্য লম্বা করে সালাম দেই। সালামের জবাব জানিয়ে কুশল বিনিময় করে শুভ্র। সবকিছুর জবাবই আজ লাবণ্য হেসে হেসে দিয়েছে।
কি ব্যাপার? আজ ম্যাডামকে এত খুশি খুশি লাগছে? শুভ্রর এই কথায় লাবণ্য কোনো জবাব দেয় না। শুধু বোকার মত একটা হাসি দিল। এদিকে রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ব্যস্ত শুভ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে, আচ্ছা! আমি পরে কথা বলছি, এখন ব্যস্ত আছি। লাবণ্যকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দেয় শুভ্র। হাসিমুখটা নিমিষেই কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। গুমড়া মুখে বাসায় ফিরে যায় লাবণ্য।
ওহ, নিজেকে কি মনে করে? বোম্বের নায়ক? হুহ, আমি ওকে কল’ই দিব না। রাগে দুঃখে ফোনটা বন্ধ করে রাখে লাবণ্য। এদিকে শুভ্র? সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাসায় এসে রান্না করে খেয়ে’ই বিছানায় গাঁ এলিয়ে দেয়। একে তো ক্লান্ত শরীর, তারউপর সেই ক্লান্ত শরীরে এসে রান্না করে খাওয়া। নিদ্রাদেবী চোখে তাড়াতাড়িই ভর করে। আর শুভ্র তলিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে।

লাবণ্য ফোন বন্ধ করেছে দুপুরের দিকে। এখন রাত্রি ৯টা বাজে। আচ্ছা, ওনি তো এখনো মায়ের ফোনে কল দিচ্ছে না। তবে কি ওনি আমার নাম্বারেই শুধু ট্রাই করছে। আচ্ছা, আমার নাম্বারে কল দিয়ে ওতো ফোন বন্ধ পেয়েছে। তারপর কি ও কল দিয়েছিল? কল দিলে তো তখনো নাম্বার বন্ধ পেয়েছে। বন্ধ পেয়ে কি ওনি চিন্তিত হয়ে পরেছিল? আমায় মেসেজের পর মেসেজ দিয়েছিল? ইস! আমি তো মনে হচ্ছে আজকে ব্যাটাকে জব্দ করে দিয়েছে। এখন তো মনে হয় ওনার অবস্থা নাজেহাল। নিশ্চয় কান্না করে করে শেষ? খুশিতে লাফিয়ে উঠে বিছানায় উঠে বসে লাবণ্য। বালিশের নিচ থেকে ফোনটা এনে চালু করে সেটা। পরম কৌতূহলের সাথে স্ক্রিনে মেসেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে আছে লাবণ্য। ৫মিনিট হয়ে গেল, এখনো একটাও মেসেজ আসছে না। আচ্ছা, তবে কি ওনি একটা মেসেজও দেয়নি? না, না! এ হতে পারে না। ওনি নিশ্চয় এসএমএস দিয়েছে। হয়তো নেট প্রবলেমের কারনে এসএমএস আসছে না। লাবণ্য বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ফোন হাতে রুমের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো কখনো ফোনটা উপরের দিকে তুলছে নেটের জন্য। মনে মনে হাজারটা বকাও দিয়ে দিয়েছে অলরেডি গ্রামীণফোনের নেটকে।
গালি দিতে দিতে বারান্দায় চলে যায় লাবণ্য। সেখানে গিয়েও ফোনটা মাথার উপর নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরাচ্ছে। তখনই রিংটনের আওয়াজ হয়। খুশিতে লাফিয়ে উঠে ফোন রিসিভ করে উৎকন্ঠার সাথে বলে, হ্যাঁলো….
ওপাশ থেকে ভেসে আসে এক মধ্য বয়স্ক লোকের কন্ঠ। “মা” এত রাত্রে বারান্দায় কি করো? লাবণ্যর হাসোজ্জল মুখটা মলিন হয়ে যায় শ্বশুরের কন্ঠ শুনে। ওর কিছু বলার আগেই শ্বশুর বলে উঠো, এখন নিশ্চয় বুঝতে পারছ ফোনে তোমার সম্পূর্ণ নেট আছে! যাও এবার নিশ্চিন্তে রুমে যাও। কল/মেসেজ দিলে রুমেও আসবে। জি, বাবা…. বলেই কলটা কেটে দেয় লাবণ্য।
আমি এখানে মাথার উপর ফোন ঘুরাচ্ছি, এটা নিশ্চয় বাবা দেখে গেছে। ইস! কি লজ্জা! সব’ই ঐ ব্যাটা হারামির জন্য। মনে মনে একশ একটা গালি দিল লাবণ্য শুভ্রকে। তারপর রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পরল।

ভোরে ঘুম ভাঙ্গে লাবণ্য। ঘুম চোখে ফোনটা চোখের সামনে এনে দেখে কোনো কল আসছে কি না ফোনে। একটাও কল এসএমএস আসেনি দেখে মুখটা কালো হয়ে যায় ওর। ফোনটা বিছানায়া রেখে ফ্রেশ হয়ে অজু করে নামাজ আদায় করে নেয় লাবণ্য। নামাজটা কোনো মতে শেষ করেই দৌঁড়ে আসে ফোনের কাছে। নাহ, একটাও কল আসল না। ওনি বোধ হয় আমায় ভুলেই গেছে। ওনি বোধ হয় আমাকে আর কল দিবে না। এসব ভেবে ভেবেও লাবণ্য বার বার ফোনের দিকে চাতকের ন্যায় শুভ্রর ফোন আসার প্রতিক্ষায়। সারাদিন গেল। শুভ্র একটা বারও কল দিল না। রাত্রিতে সাত, পাঁচ ভেবে লাবণ্য নিজেই কল দিয়ে ফেলে। ২,৩বার কল বেজে যাওয়ার পর রিসিভ করে শুভ্র।
– হ্যাঁলো…..
এপাশে লাবণ্য নিশ্চুপ……
– হ্যাঁলো, কে বলছেন?
লাবণ্য তখনো নিশ্চুপ………..
– হ্যাঁলো, কথা বলুন……….
এভাবে মানুষ, মানুষকে পর করে দেয়, সেটা আপনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।
– ওহ, লাবণ্য তুমি? এটা তোমার নতুন ফোন নাকি?
শুভ্রর প্রশ্নে লাবণ্য অভিমানী স্বরে বলে, থাক! চিনতে হবে না আর। ভালো থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ। রাগ দেখিয়ে কল কেটে দিয়ে লাবণ্য নিজেই বোকা হয়ে গেছে, ভাবছিল শুভ্র কল ব্যাক করে ওর রাগ ভাঙাবে। কিন্তু তা আর হলো কই? উল্টো ওকে শুভ্রর ফোনের প্রতিক্ষায় সারা রাত ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে হলো। সকালের দিকে লাবণ্য শুভ্রকে কল দেয়। ঘুম চোখে শুভ্র কল রিসিভ করে। হ্যাঁ, বলো লাবণ্য। লাবণ্য কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলে ইয়ে মানে বলছিলাম কি আপনি কি আজকে ফ্রি আছেন? শুভ্র বিছানায় উঠে বসে, কোনোরকম হাসি আটকিয়ে বলে হুম, কেন? লাবণ্য নিচু গলায় বলে, আমরা কি আজকে দেখা করতে পারি? হাসি আটকিয়ে ভ্রু জোড়া নাচিয়ে শুভ্রর জবাব, দেখা করাটা খুব কি বেশী দরকার? মানে আজকে তো অফ ডে, আমার একটু ঘুমাতে হবে আর কি। কথাটা বলে জিহ্বায় কামড় দেয় শুভ্র। লাবণ্য কি বলবে বুঝতে পারতেছে না। আসলে এ প্রশ্নের উত্তর কি হওয়া উচিৎ ওর নিজেরও জানা নেই। তবুও বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করে বলল, ওহ! আচ্ছা। সমস্যা নাই। আপনি ঘুমান। ঘুম না আসলে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমান। তবুও ঘুমান। আসতে হবে না আপনার। কথাগুলো একনিশ্বাসে বলে কলটা কেটে ফোনটা বন্ধ করে ফেলে লাবণ্য।

চলবে…….

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ১৬

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১৬
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

ইতোমধ্যে’ই ইনজেকশনটা দেওয়া শেষ। এই মুহূর্তে শুভ্র লাবণ্যর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য এখনো দু’চোখ বন্ধ করে মুখটা বাচ্চাদের মত করে আছে। নিশ্চুপ শুভ্র একবার লাবণ্যর মুখের দিকে তো আরেকবার ওর কাঁধের দিকে তাকাচ্ছে। বেশ ক্ষাণিকটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর চোখ খুলে লাবণ্য। চোখাচোখি হয় দু’জনের। মুগ্ধ দৃষ্টিতে কিছুটা সময় একজনের আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ চোখ যায় শুভ্রর কাঁধের দিকে। লাবণ্য তাড়াতাড়ি হাতটা নিয়ে আসে কাঁধ থেকে। শুভ্রর থেকে চোখ সরিয়ে অনেকটা নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে লাবণ্য। শুভ্রও কোনো কথা না বলে অনেকক্ষণ লাবণ্যর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।

মিনিট পাঁচেক পর নিরবতা ভেঙে মুখ খুলে শুভ্র। প্রশ্ন করে লাবণ্যকে, কেন এমনটি করেছ? লাবণ্য বুঝেও না বুঝার ভান করে অনেকটা দুরে সরে যায়। লাবণ্যর সাথে সাথে শুভ্রও দাঁড়িয়ে পরে। লাবণ্যর দু’বাহু ধরে মুখটা শুভ্র ওর নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। তারপর আবারো প্রশ্ন করে, কি হলো? বলছ না যে? কেন কেঁটেছ হাত? চুপ করে থেকো না, উত্তর দাও। লাবণ্য বিষণ্ন মনে শুভ্রর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে চোখটা ফিরিয়ে নেয়। শুভ্র চেঁচিয়ে বলে উঠে, চোখ সরিয়ে নিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না লাবণ্য। লাবণ্য শুভ্রর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দুরে সরে গিয়ে নিয়ে মৃদু স্বরে বলে, আমি হাত কাটিনি, অসাবধানতায় কেটে গেছে। শুভ্র লাবণ্যর দু’বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলে, তবে চোখ কেন ফিরিয়ে নিয়েছ তুমি? কেন আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতেছ না? তুমি কি ভেবেছ? আমি কিচ্ছু বুঝি না? কিচ্ছু না?!!! আরে এতটা বোকা আমি নয়, যতটা তুমি ভেবেছ। আমায় তুমি ভালোবাসো এটা তোমার মুখ নয়, তোমার চোখ জানান দিচ্ছে। অনুভূতিগুলো যতই লুকানোর চেষ্টা করো না কেন, তোমার এই চোখের ভাষা কিন্তু আমি ঠিক পড়ে নিয়েছি। তুমি আমাকে কতটা ভালোবাসো সেটা তোমার চোখ দেখেই বুঝে গেছি। লাবণ্য অসহায় চোখে একবার শুভ্রর দিকে তাকালো, তারপর ওর দু’বাহু থেকে শুভ্রর হাত দুইটা সরিয়ে নিয়ে ক্ষাণিকটা দুরে গিয়ে দাঁড়ায়।
হা, হা, হা…..
দুরে দাঁড়িয়ে’ই শুভ্র হেসে উঠে। তারপর লাবণ্যর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে, শুনো! তুমি শুধু আমার থেকে এতটুকু দুরেই যেতে পারবা, এর চেয়ে বেশী নয়। কি মনে করেছ তুমি? দুরে গেলেই আমি তোমাকে দুরে যেতে দিব? ভালোবাসি তোমাকে। বড্ড বেশী ভালোবাসি। কি করে আমি সে ভালোবাসার মানুষটাকে দুরে সরে যেতে দেই, বলো? আর লাবণ্য! আমি তো তোমাকে স্যরি বলেছি, আমার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়েছি, ভুল স্বীকার করেছি। তবুও কেন তুমি আমার থেকে এভাবে দুরে দুরে থাকতেছ? লাবণ্য চোখ মুখ শক্ত করে বলে, কারন আপনি ভালোবাসলেও আমি আপনাকে ভালোবাসি না। ভালোবাসতে পারব না? শুভ্র লাবণ্যর দু’বাহু ধরে বলে, কেন ভালোবাসতে পারবে না? লাবণ্য আবারো ওর বাহুদ্বয় থেকে শুভ্রর হাতটা সরিয়ে নেয়। তারপর কিছুটা সামনে এগিয়ে বলে, কারন- আমার সব অনুভূতিগুলো অনেক আগেই ভোতা হয়ে গেছে। আমি আর এখন ভালোবাসতে পারব না আপনাকে। শুভ্র দু’হাত দিয়ে লাবণ্যর একটা হাত আকড়ে ধরে বলে, প্লিজ লাবণ্য! এমন করো না। বললাম তো আমার ভুল হয়ে গেছে। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও লাবণ্য। প্লিজ, আমায় একটা বার তোমায় ভালোবাসার সুযোগ করে দাও। লাবণ্য হ্যাচকা টানে ওর হাতটা সরিয়ে নেয় শুভ্রর থেকে। তারপর তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে, হুহ! ভালোবাসা? সেতো কবে’ই গলে পঁচে গেছে। আমার অনুভূতিগুলো মরা বকুলের মতো শুকিয়ে শেষ হয়ে গেছে। শুভ্র লাবণ্যর দিকে একধাপ এগিয়ে বিনয়ী স্বরে বলে উঠে, আমাকে আর একটা সুযোগ দাও না প্লিজ? লাবণ্য কিছুটা পিছুহটে পূর্বের ন্যায় গম্ভীর কন্ঠে বলে- ঝরা ফুল, যার পাপড়িগুলো শুকিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে, যার সুভাস প্রায় নেই বললেই চলে; আপনি পারবেন সে ফুল দিয়ে মালা গাঁথতে? শুভ্র কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে, আমায় একটা সুযোগ দাও লাবণ্য। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রাতের কালো অন্ধকার কেটে গিয়ে আমাদের জীবনেও একদিন সোনালী আলোর রেখা উঁকি দিবে। এর জন্য দরকার তোমার একটু বিশ্বাস। লাবণ্য প্লিজ তুমি আমার উপর একটু বিশ্বাস রাখো। লাবণ্য ক্ষাণিকটা দুরে সরে গিয়ে বলে, পারব না। যে ভুল একবার করছি, সে ভুল দ্বিত্বীয় বার করে আমি আমার জীবনটাকে এভাবে নিজ হাতে শেষ করে দিতে পারব না। আমি আর বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়াতে চাই না। কোথায় আমি, আর কোথায় আপনি? লাবণ্য যেন শুভ্রর বলা কথাগুলো দিয়েই শুভ্রকে খোঁচা দিল। শুভ্র তবুও লাবণ্যকে বুঝালো। লাবণ্য বুঝতে চাইলো না। লাবণ্যর এক কথা, আগের মতো আবারো আপনি আমায় ভুল বুঝে তাড়িয়ে দিবেন। আর আমি? ঝরা ফুলের পাপড়ির মতো কিংবা পার্কে ছড়িয়ে থাকা বাদামের খোসার মতো পড়ে থাকব। লাবণ্যর কথায় শুভ্র অবাক হয়ে গেল এই ভেবে, ওহ! আমার প্রতি এই তাহলে তোমার বিশ্বাস?
একটু থেমে লাবণ্য আবার বলল, আমার প্রতি আপনার যত ভুল ছিল সব যদি দুর হয়ে গিয়ে থাকে, আমাকে যদি আপনার সত্যিই ভালো লাগে তাহলে আমাকে বন্ধু হিসেবে পেতে পারেন। তাতে না পাওয়ার বেদনা থাকবে না। হারিয়ে যাওয়ার ভয়ও থাকবে না।
লাবণ্যর এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলার কাছে শুভ্র হেরে গেল। শুভ্রর অন্তরাত্মা শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেল। তার পরও শুভ্র হাল ছাড়লো না।
ডাক্তারদের আবার ঈদ। কোনোরকম ঈদের দিনটা গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন’ই ঢাকার উদ্দেশ্যে একা একা রওয়ানা দেয় শুভ্র। আসার সময় লাবণ্যকে অনেক রিকোয়েস্ট করেছে ওর সাথে ওর বাসায় যাওয়ার জন্য কিন্তু লাবণ্য ওর সিদ্ধান্তে অটল। ও শুভ্রর বন্ধু হয়ে থাকতে চাই। আর সেটা শুভ্রর সাথে নয়, শুভ্রর বাবা মায়ের সাথে ঢাকায় আলাদা বাসায়। শুভ্র লাবণ্যর কথায় মেনে নিল। প্রতি শুক্রবার লাবণ্যর সাথে দেখা করার জন্য শুভ্র ওর বাবা মায়ের বাসায় চলে আসত। তাছাড়া ওদের ইউনিয়নের কোনো ওয়ার্ডে রোগী দেখতে গেলেও শুভ্র দেখা করত লাবণ্যর সাথে।
লাবণ্যর নিজস্ব যে ফোন ছিল সেটা ভেঙে ফেলেছে। মায়ের ফোন দিয়ে লুকিয়ে লাবণ্য শুভ্রর সাথে কথা বলত। তবে সেই কথাটা প্রতিদিন নয়, মাঝেমধ্যে হতো।
কথা বলার ফাঁকে শুভ্র বুঝতে পারল, লাবণ্যর মনে ওর প্রতি যে অভিমানের পাহাড় ছিল, সেটা একটু একটু করে গলতে শুরু করেছে। লাবণ্য ওকে নতুন করে ভালোবাসতে শুরু করেছে।
শুভ্র ওকে একটা ফোন কিনে দিতে চাইল। কিন্তু লাবণ্য পড়াশুনার ক্ষতি হবে ভেবে নিতে চাইল না।

কেটে যায় আরো একটা বছর। এরই মাঝে লাবণ্যর অনার্স কমপ্লিট হয়ে যায়। শুভ্র একদিন ঠিক করলো লাবণ্যকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। বিশেষ কারনে লাবণ্যর শশুর শাশুড়ি সেদিন বরিশাল গিয়েছিল লাবণ্যকে সাথে নিয়ে। পাগল শুভ্রও সেখানে ছুটে যায় প্রিয়তমার সাথে দেখা করার জন্য। লুকিয়ে দেখা করল প্রাণের প্রিয়ার সাথে। তারপর রিকশায় চেপে দু’জন রওয়ানা দিল একটা স্টিমার ঘাটের দিকে।
রিকশায় বসে লাবণ্যর একটা হাত ধরলো শুভ্র। লাবণ্য ছাড়িয়ে নিতে চাইল। কিন্তু পারল না।
কখন যেন হাত দুটির উপর লাবণ্যর আরেকটি হাত এসে ভর করল। শুভ্র লক্ষ্য করল, লাবণ্যর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সে আরো খেয়াল করল, ওর হাতের মধ্যে রাখা লাবণ্যর হাত দুটো মৃদু কাঁপছে।

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ১৫

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ১৫
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

লাবণ্য একটু একটু করে পিছনে যাচ্ছে আর শুভ্র একটু একটু করে সেদিকেই এগুচ্ছে। এ ঘটনা সুমন- নাইমা এবং হিমেল- লামিয়ার চোখও এড়ায় না। পলাশ মৌরির সাথে সাথে ওদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে দুই,দু’জোড়া কপোত কপোতী তাকিয়ে আছে। এসব কিছুই টের পায়নি শুভ্র। খাবার টেবিল থেকে আচমকা এহেম বলে একটা মেকি কাশি দিয়ে উঠে পলাশ। লাবণ্য কাঁপা দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। হায় আল্লাহ! ওনারা এভাবে তাকিয়ে আছেন। ইস! কি লজ্জা…..
ভাসুরা’রা এবং ওনাদের বউদের সামনে এভাবে ধরা খেলাম! আমার তো লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। একহাতে লাবণ্য শুভ্রকে ধাক্কা দেয়। ধাক্কা খেয়ে লাবণ্যর থেকে সরতে যাওয়ার সময় শুভ্রর কনুই থেকে কনুইয়ের নিচ থেকে গায়ে জড়ানো তোয়ালে’টা সরে যায়। মুহূর্তেই ব্যান্ডেজে জড়ানো হাতটা সকলের চোখে পরে।
চোখ বড় বড় করে-
” ওরে আল্লাহ! তোর হাতের এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে তোর? এক্সিডেন্ট’টা হলো কিভাবে? কখন এ অবস্থা হইছে? আল্লাহ, শুভ্র এ অবস্থা কিভাবে করছ? আম্মা জানে? একটু দেখে কাজ করতে পারো না?”
পলাশ আর লাবণ্য বাদে উপস্থিত সকলে শুভ্রর দিকে একঝাক প্রশ্ন ছুড়ে দেই। নিশ্চুপ শুভ্র মাথা নিচু করে আছে। কি করে বলবে এসব? হাজার হোক ওরা তো বড় ভাই ভাবি। ওদের সামনে কিভাবে লাবণ্যর কথা বলে। ওকে ছোট করে? সবচেয়ে বড় কথা ঘরের খবর বাইরে যাক এটা শুভ্র চাচ্ছে না। চাচ্ছে না এ নিয়ে কোনো ঝামেলা হোক। আর তাই চাচ্ছে না বলেই শুভ্র ওর ভাইদের দিকে তাকিয়ে বলে, সে কিছু না! একটু কেটেছে। বাদ দাও তো তোমরা! শুভ্রর ভাই ভাবি খাবার রেখে শুভ্রর পাশে এসে ঝেকে বসল। ওহ গড! এত্তখানি জায়গা জোড়ে ব্যান্ডেজ আর তুই বলছিস কিচ্ছু হয়নি? শুভ্র ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে বলে, কেবল ব্যান্ডেজ করে ফিরছি। ছাড়ো তো, ব্যাথা পাচ্ছি। পাশ থেকে পলাশ বলে উঠে, সে তো পাবে’ই। বলছিলাম না ডাক্তার কিছু ঔষধ দিবে সেগুলো নিয়ে আসতে! আনিস নি, ভালো হয়ে যাবি বলে চলে আসলি। এখন কি? ব্যাথা সেরে গেছে, তাই না? শুভ্রর কাছ থেকে সরে এবার সবাই পলাশের দিকে আসলো। ” পলাশ! তুই জানিস কি হয়ছে?”
পলাশ শুভ্রর দিকে একনজর তাকাই। শুভ্র তখন মাথা নাড়িয়ে ইশারা করতেছে যাতে না বলে। কিন্তু পলাশ?!!! মুচকি হাসি দিয়ে গড়গড় করে বলা শুরু করে,
” আমাদের শুভ্র বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছিল, ভাইয়া- ভাবি! গড়াগড়ি’টা এতটাই বেশী হয়ে গেছে যে খাট থেকে’ই ধপাস করে পরে গেছে। আমরা যে জিনিসগুলো বড় আম্মাকে দিয়ে এসেছি, মানে দা, বটি,ছুড়ি ঐগুলো কাকিমা ফ্লোরে রেখেছিল। দূর্ভাগ্যক্রমে আমাদের ভাইটা সেখানেই গিয়ে গড়িয়ে পরেছে। এই আর কি…..”
সকলের দৃষ্টি তখন লাবণ্যর দিকে। লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল সবাই।
” গড়াগড়ির আর সময় পাইলা না। ফজরের নামাজের সময় গেছো বিছানায় গড়াগড়ি করতে, কথাটা বলেই একটা রহস্যজনক হাসি দিল শুভ্রর দুই ভাবি।”
পলাশ ভাবিদের সাথে পাল্লা দিয়ে টিপ্পনী কাটলো, আরে ভাবি’রা! বুঝো না কেন? এখন সময় ভালো…..!
পলাশের কথায় আর সবাই হো, হো করে হেসে উঠল। লজ্জায় কষ্টে লাবণ্যর চোখ’জোড়া ছলছল করে উঠল। লজ্জা পাচ্ছে ভাসুর বউ মানে ভাবিদের টিপ্পনী শুনে, আর কষ্ট হচ্ছে খাট থেকে ও নিজেই তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে! আর ওর কারনে আজকে শুভ্র এতটা কষ্ট পাচ্ছে। ব্যাপারটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে লাবণ্য। আজ যেন চোখের জলও বাধ মানছে না। অঝোরে গড়িয়ে পরছে চোখ থেকে অশ্রকণারা। অজস্র জলকণারা ভীড় করছে লাবণ্যর নেত্রকোণে। খাবার সামনে থেকেও কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না লাবণ্য। চোখ দুটো যেন ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে। হাতধূয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে যায় লাবণ্য। ভাসুর বউরা চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে, সেকি লাবণ্য! ঝালমুখ না করেই চলে যাবে? লাবণ্য মাথা নাড়িয়ে কিছু একটা বলল, যেটা কেউ বুঝতে পারল না। কিচেনে চাচী শাশুড়িকে কিছু একটা বলে বিদায় নিল লাবণ্য।
” কিরে! তোর বউ আবার কি হলো?”
হিমেলের প্রশ্নে শুভ্রর জবাব, হয়তো পেট ভরে গেছে হিমেল ভাই।”
পাশ থেকে সুমন বলে উঠে,
” পেট ভরে গেছে নাকি নাইমা, লামিয়া ভাবির কথা শুনে কিছু মনে করল?”
শুভ্র জোর গলায় বলে উঠে, কি যে বলো না সুমন ভাই। ও এরকম মেয়ে না। লামিয়া বলে বলে উঠে, তাহলে কিরকম মেয়ে? শুভ্র ঢোক গিলে বলে, ভাবি! ওর একটু বেশী লজ্জা। সেখানে ভাসুরদের সামনে রেখে এভাবে মজা করছ, তাই বোধ হয় লজ্জা পেয়ে চলে গেছে। পলাশ শুভ্রর কথার সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠে, হ্যাঁ ভাবি! সেটাই। দেখো নি খাবার সময় কেমন পেছন দিকে যাচ্ছিল? স্মিতহাস্যে নাইমার জবাব, পেছনে যাবে না? তোমার ভাই লাখে একটা বলতে হয়। ঘরভর্তি মানুষ রেখেও খাবার সময় আসছে রোমাঞ্চ করতে। শুভ্র মাথা নিচু করে ফেলে। ” ইয়ে মানে আমি আসছি….”
সবাই হেসে উঠে শুভ্রর আমতা আমতা করে কথা বলা দেখে। সবাই যখন হাসাহাসিতে ব্যস্ত শুভ্র তখন কেটে পরে ঐ স্থান থেকে।

সকাল সাড়ে ৮টা। ঈদের নামাজের সময় গেছে। আশেপাশের ঈদগাহ ময়দানের মাইক থেকে সে স্বর’ই ভেসে আসছে। সমস্ত মুসলমান ভাইদের ঈদগাহে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান করা হচ্ছে। নতুন পাঞ্জাবী পাজামা গায়ে জড়িয়ে, কাঁধে জায়নামাজ’টা নিয়ে বাপ, চাচা, চাচাতো, জ্যাঠাতো ভাইদের সাথে এগিয়ে চলছে শুভ্র ঈদগাহের দিকে। বাড়ি থেকে বের হয়ে দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায় ওরা। বাড়ির মুরুব্বী’রা যাচ্ছে বাড়ির কাছের নতুন ঈদগাহে আর ছেলেপিলেরা যাচ্ছে কিলোখানেক দুরে ওদের স্কুলের ঐ পুরনো ঈদগাহে। রাস্তায় গিয়ে পিছু ফিরে তাকায় শুভ্র। বিশাল জামগাছের আড়াল থেকে মুখ বের করে শুভ্রকে দেখছিল একজোড়া চোখ। শুভ্রর পিছনে তাকানো দেখে গাছের আড়ালে লুকিয়ে যায় মানুষটা।
” কিরে! বার বার পিছনে কি দেখছিস?”
কাজিনের প্রশ্নে সে কিছু না বলে একটা মুচকি হাসি দিয়ে পথচলতে থাকে শুভ্র। ওরা সকাল ১১টা নাগাদ ঈদগাহ থেকে নামাজ এবং একটা ছোট্ট আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরল। ঈদগাহ থেকে বাড়ির ছেলেরা সরাসরি শুভ্রদের বাসায় চলে আসে। কারণ, ঈদগাহে যাওয়ার আগে বাড়ির মুরুব্বি বড় আম্মা মানে একমাত্র জ্যাঠিমা বলে দিয়েছে, নামাজ শেষে যেন এ বাসায় চলে আসা হয়।
আর সেই মতেই ওরা এখানে এসে উপস্থিত হলো। বাড়িতে পা রাখতেই শুভ্রর কানে ভেসে মায়ের কন্ঠ। কন্ঠ শুনে মনে হচ্ছে ভিষণ রেগে আছে। শুভ্র ওর কাজিনদের রুমে বসতে বলে কেইসটা কি জানার জন্য মায়ের রুমের দিকে পা বাড়ায়। রুমে প্রবেশ করা মাত্র’ই আঁতকে উঠে শুভ্র। মায়ের রুমের বিছানার চাঁদরের অনেকাংশ ফোঁটা ফোঁটা রক্তে ভেঁজা। আর তার ঠিক পাশেই মাথা নিচু করে বসে আছে লাবণ্য। তারপাশেই ডাক্তারসহ ওর বাবা মা এবং বোন। অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করে শুভ্র,
শিশির! এত রক্ত কিসের এখানে? শিশির ভেঁজা গলায় বলে উঠে, ভাবি পেয়াজ কাটতে গিয়ে হাত কেঁটে ফেলেছে। শুভ্রর ভিতরটা মুচড় দিয়ে উঠে। চোখ চলে যায় লাবণ্যর হাতের দিকে। ডান হাতের ৪টা আঙ্গুল ব্যান্ডেজে জড়ানো। চোখ বড় বড় করে শুভ্রর প্রশ্ন, পেয়াজ কাটলে কারো এভাবে হাত কাটে? তুই আমাকে শিখাতে আসছিস? শিশির কাঁপা গলায় বলে, কিন্তু ভাবিতো পেয়াজ’ই কাটতেছিল……!
” কাটতেছিল কিন্তু পেয়াজ কাটায় হাতের এ অবস্থা হয়নি ওর। রক্ত দেখছিস? দেখে মনে হচ্ছে গরু জবাই করা হয়ছে এখানে।”
লাবণ্য তখনো মাথা নিচু করে চুপটি করে বসে আছে। শুভ্র অশ্রুভেঁজা চোখে লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জানি লাবণ্য। তুমি পেয়াজ কেটে নয়, অন্যভাবে হাত কেটেছ।
দেখি বাপ! সরতো…..
ডাক্তারের কথায় হুশ হয় শুভ্রর। হাতে একটা ইনজেকশন নিয়ে ডাক্তার দাঁড়িয়ে। সেটা দেখে পথ সরে দাঁড়ায় শুভ্র। ডাক্তার কাকা লাবণ্যর দিকে ইনজেকশনের সিরিজ নিয়ে এগুতো থাকে। ভয়ে চিৎকার দিয়ে খাটের একপাশ থেকে মধ্যিখানে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকে লাবণ্য। ডাক্তার একটা হাসি দিয়ে বলল, আরে মা! কিচ্ছু হবে না তোর। তুই খুঁজও পাবি না। আয়। এদিকে আয়….
লাবণ্য নিজেকে গুটিয়ে আরো জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে খাটের মধ্যিখানে। শুভ্রর বাবা বলল, লাবণ্য! এদিকে আসো। তুমি একটুও ব্যাথা পাইবা না। লাবণ্য চোখ বন্ধ করে বলতেছে, না বাবা! আমি পারব না। আমি ইনজেকশন দিব না। লাবণ্যর শ্বশুর শাশুড়ি, ডাক্তার চাচা, কারো কথা শুনেনি লাবণ্য। সেটা দেখে খাটে লাবণ্যর কাছে যায় শিশির। ভাবি! তোমার কিচ্ছু হবে না। ভয় পাওয়ার কিচ্ছু নেই ভাবি। ইনজেকশনটা দিয়েই দেখো না ভাবি। মনে হবে যেন পিঁপড়া কামড় দিয়েছে। ব্যাস, এটুকুই। আর ব্যাথা পাবে না। লাবণ্য দাতে দাত চেঁপে বলল, বললাম তো আমি আমি দিব না ইনজেকশন। লাবণ্যর শাশুড়ি রাগে কটমট করে বলে উঠে, ” অনেক শিশির! আর না…
তুই উঠ ওখান থেকে। আর একে রুমে নিয়ে যা। এর যা ইচ্ছা তা করুক। সেসব আমার দেখার বিষয় না।”
শিশির ওর ভাবিকে নিয়ে রুমে চলে যায়।
” আসলে যেভাবে রক্তক্ষরন হয়েছে ইনজেকশনটা দেওয়া খুব জরুরী ছিল। এই বলে ব্যাগ গুছিয়ে ডাক্তার চলে যাচ্ছিল। শুভ্র পিছন থেকে ডাক দেয়, কাকা!
ডাক্তার দাঁড়িয়ে পরে। শুভ্র ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলে, কাকা! ইনজেকশনটা আমার কাছে দিয়ে যান। আমি বুঝিয়ে শুনিয়ে এটা পুষ করে দিব। ডাক্তার শুভ্রর হাতে ইনজেকশনটা দিয়ে যায়। শুভ্রর মা কিচেনে চলে যায়। শুভ্র শিশিরের রুমের দিকে পা বাড়ায়। শুভ্র গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়। ভাইকে দেখে শিশির রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ” ভাইয়া কিছু বলবি?”
শুভ্র লুকিয়ে রাখা ইনজেকশনের দিকে চোখ ইশারা করে। লাবণ্য সেটা দেখে মুচকি হাসে। শুভ্র জানায়, শিশির! ওরা সবাই খেতে আসছে। যা, মায়ের সাথে গিয়ে হেল্প কর। আমি আছি তোর ভাবির পাশে। মুচকি হেসে শিশির সেখান চলে যায়।

ইনজেকশনের সিরিজ হাতে পিছনে হাত রেখে রুমে প্রবেশ করে শুভ্র। শুভ্রকে দেখে কিছুটা ইজিলি বসে লাবণ্য। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বলে, আহ্! বাঁচা গেল। ভোরের ঘটনাটার জন্য স্যরি বলার এখন’ই উপযুক্ত সময়। লাবণ্য খাটের মধ্যিখানে বসেই শুভ্রর দিকে তাকায়। তারপর নিচু স্বরে বলে, স্যরি…..
শুভ্র লাবণ্যর দিকে তাকায়। লাবণ্য ভেঁজা কন্ঠে বলে, আসলে আমি জানতাম না নিচে দা, বটি রাখা আছে। আমি সত্যি’ই দুঃখিত তখনকার ঘটনাটার জন্য। শুভ্র একটা অট্টহাসি দেয়। বোকার মত লাবণ্য শুভ্রর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, কি হলো?
শুভ্র নীচু স্বরে বলে, আরে বোকা মেয়ে! আমার তো কোনো হাত’ই কাটেনি। লাবণ্য চোখ বড় বড় করে প্রশ্ন করে, মানে? শুভ্র ব্যান্ডেজে জড়ানো হাতটা লুকিয়ে অন্য হাত লাবণ্যর সামনে উপস্থাপন করে। এই দেখো। কিচ্ছু নেই। কোনো ব্যান্ডেজ নেই।
” আমি বিশ্বাস করি না বলেই লাবণ্য খাট থেকে নেমে শুভ্রর অন্য হাতের দিকে এগিয়ে যায়। তারপর শরীর তোয়ালে টা ফেলে দেয়। শুভ্রর তখন পাঞ্জাবী গায়ে ছিল, তাই লাবণ্য ব্যান্ডেজ’টা দেখতে পায়নি। তবে যা দেখতে পায় তা দেখে ওর শরীরটা শিউরে উঠে। শুভ্রকে কিছু না বলেই দৌঁড়ে পালাতে চাচ্ছিল লাবণ্য। দরজার সামনে আড়ি পেতে ছিল শিশির। লাবণ্যর রুম থেকে বের হওয়ার আগেই দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ করে দেয় শিশির। অট্টহাসিতে মেতে উঠে ডাক্তার শুভ্র। ইনজেকশন হাতে লাবণ্যর দিকে এগুতে থাকে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম লাবণ্যর। দেয়ালের সাথে একদম মিশে যায় সে। ধীরপায়ে শুভ্র সেদিকেই এগুচ্ছো। একটু একটু করে পৌঁছে যায় দরজার পাশে, লাবণ্যর কাছে। একহাত দিয়ে প্রাণপণে লাবণ্য শুভ্রকে দুরে সরানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু শুভ্রর সাথে কিছুতেই পেরে উঠতে পারছে না। চোখ দুটো বন্ধ করে কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠে লাবণ্য, আমি ইনজেকশন দিব না। তবুও আপনি কেন এমন করতেছেন আমার সাথে? কেন এভাবে আমার পিছু লেগেছেন? কি ক্ষতি করেছি আমি আপনার? চোখ বন্ধ করে কথাগুলো বলছিল লাবণ্য। জবাবে শুভ্র বলে উঠে, ভুলিনি এখনো ভোরের ঘটনা। এখনো হাতটা ব্যাথা করতেছে। শুভ্রর এমন কথা শুনে চোখ মেলে তাকায় লাবণ্য। জল ছলছল চোখে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলে, স্যরি বলছি তো।
—- তাহলে ইনজেকশনটা দাও, স্যরি একসেপ্ট করব, প্রমিজ।
লাবণ্য শুভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে গায়ের জোর ছেড়ে দেয়। এইমুহূর্তে একদম ইজিলি দাঁড়িয়ে আছে লাবণ্য। শুভ্র সেই সুযোগটাই কাজে লাগালো। জলদি ইনজেকশনটা রেডি করে লাবণ্যর দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে, তাহলে প্রস্তুত? লাবণ্য মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি জানায়। শুভ্র লাবণ্যর হাত ধরে খাটে নিয়ে বসায়। লাবণ্য তখনো শুভ্রর চোখের দিকে তাকিয়ে। ধারালো সুচ দেখে ঘোর কাটে লাবণ্যর। শুভ্র ততক্ষণে কাজ সেরে ফেলতেছে। একহাতে লাবণ্য শুভ্রর কাঁধের কাপড় চেপে ধরে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে।

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ১৪

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ১৪
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

কম্বলের ভিতর প্রবেশ করে আস্তে আস্তে শুভ্র ওর লাবণ্যকে জড়িয়ে ধরে। শুভ্রর শীতল হাতের ছোঁয়ায় ঘুমের মাঝেই লাবণ্য ক্ষাণিকটা কেঁপে উঠে। লাবণ্যকে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে ধরতে চেয়েও কি মনে করে যেন ধরে নি। ঘুমের ঘোরে কম্বল’টা গাঁ থেকে ফেলে দিয়ে শুভ্রর বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে পরে লাবণ্য। শুভ্রর চোখে মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। শীতের প্রকোপ ভুলে প্রেয়সীকে দেখায় ব্যস্ত হয়ে পরে শুভ্র। হাতে ভর দিয়ে শুয়ে মাথা ক্ষাণিকটা উঁচু করে মুগ্ধ নয়নে শুভ্র তাকিয়ে আছে ওর প্রেয়সীর মুখপানে। লাবণ্য তখনো অঘোরে ঘুমুচ্ছে। শুভ্র দুষ্টু হাসি দিয়ে ওর হাতের শীতল পৃষ্ট’টা লাবণ্যর গালে ছুঁয়ায়। শীতে কেঁপে উঠে লাবণ্য শুভ্রমুখী হয়ে শুইলো। পূর্বের ন্যায় এখনো শুভ্র হাতে ভর দিয়ে প্রেয়সীকে দেখায় ব্যস্ত। মুগ্ধ শুভ্র কিছুক্ষণ এভাবে থাকার পর এগিয়ে যেতে থাকে লাবণ্যর দিকে। লাবণ্য তখনো ঘুমের ঘোরে। শুভ্র লাবণ্যর কাছ থেকে আরো কাছে চলে যায়। তারপর লাবণ্যর নাকে ঠান্ডা আঙ্গুল পরশ বুলিয়ে দেয়। লাবণ্য কেঁপে উঠে, ঘুমের মাঝেই শুভ্রকে জড়িয়ে ধরে। মৃদু হেসে শুভ্র লাবণ্যকে ওর বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে। কপালে ভালোবাসার এক উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। লাবণ্যকে বুকে জড়িয়ে কল্পনার গভীরে হারিয়ে যায় শুভ্র। নিঃশ্বাস ক্রমশ ভারী হয়ে আসে ওর। লাবণ্য জেগে উঠে। চোখ মেলে শুভ্রর বুকে এভাবে মুখগুজে থাকতে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় লাবণ্য। একি! ওনি এখানে এভাবে? শিশির?! শিশির কোথায়? আমি তো শিশিরের সাথে ঘুমিয়েছিলাম। তবে কি রাত্রে ওনি শিশিরকে সরিয়ে…..(….)….???
না, না, এ হতে পারে না।
শুভ্রর কিছু বুঝে উঠার লাবণ্য শুভ্রকে খাট থেকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। বেচারা শুভ্রর হাত গিয়ে পরল ঐখানে, যেখানে কিছুক্ষণ আগে ওর কাজিনরা দা,বটি,ছুড়ি রেখে গেছে গরুর মাংস প্রস্তুত করা শেষে। ধারালো কিছুর সাথে হাত লেগে শুভ্রর হাতের অনেকটা কেঁটে যায়। শুভ্রর হাতে কোনো খেয়াল নেই। বেচারা শুভ্র তখনো লাবণ্যর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা কি হলো সেটা বুঝার চেষ্টা করছে। লাবণ্য শুভ্রর দিকে তাকিয়ে রাগান্বিত স্বরে বলল, ” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ধাক্কা মেরেছি, ধাক্কা। আমি আপনাকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দিয়েছি। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন বিষয়টা? প্লিজ এখন আপনি এখান থেকে বেরিয়ে যান…..”
শুভ্র ওর কনুইয়ের দিকে তাকালো। ফুল হাতার শার্টের অনেকাংশে ইতিমধ্যে রক্ত ছড়িয়ে গেছে। শুভ্রর এতে বিন্দুমাত্র
কু-ক্ষেপ নেই। নিশ্চুপ শুভ্র নিজের কাটাস্থানের পরোয়া না করে লাবণ্যকে বুঝানোর জন্য উঠে দাঁড়ালো। লাবণ্যর চোখে মুখে বিরক্তির ছাঁপ সুস্পষ্ট। শুভ্র ওর দিকে এগুতোই একরাশ বিরক্তির স্বরে বলে উঠে লাবণ্য, আপনাকে আমি যতটা ভালো ভেবেছিলাম না, আপনি ঠিক ততটা ভালো নয়। আপনি আসলে একটা লু…… (…..)….???

শুভ্র কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে, হ্যাঁ! বলো আমি কি? লাবণ্য কিছুটা ভড়কে যায়। ঢোক গিলে বলে উঠে, আ আ আপনি এভাবে এদিকে আসছেন কেন? শুভ্র আবারো বলে, আমি জানি কি বলছ? আমি লুচ…….(…)…??? শুভ্রর মুখ থেকে কথা কেড়ে নেয় লাবণ্য, না, না! আমি আপনাকে সে কথা বলিনি। আমি তো আপনাকে……….
– হ্যাঁ, বলো! তুমি তো আমাকে কি???
লাবণ্যর আর প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় নি। তার আগেই দরজায় কড়া নাড়ে শিশির। লাবণ্য মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে বিছানায়। দরজায় একের এক নক পরতেছে দেখে দরজা খুলে শুভ্র। শিশিরকে দেখে ভ্রু কুচকে রুম থেকে চলে যায় শুভ্র।

রুমে প্রবেশ করেই ভাবির সাথে হাসি মসকারা’ই মেতে উঠে ননদ শিশির।
” এই ছিল তোমাদের মনে, নাহ?”
লাবণ্য মাথা উচু করে শিশিরের দিকে জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে তাকালো। শিশির পেত্নী মার্কা হাসি দিয়ে বলল, হয়ছে! আর বুঝতে হবে না। আমি যা বুঝার বুঝে গেছি। তাইতো বলি ব্যাটা এবার প্রথমে আমায় কেন ডাকল? ও আমায় জাগিয়ে দেওয়ার জন্য জাগেনি, ও ডেকেছে ওর কাজে………
কথাটা বলেই হো হো করে হেসে দেয় শিশির। রাগান্বিত চোখে ননদের দিকে তাকাই লাবণ্য। এটা দেখে ওর হাসি থেমে যায়। কোনো রকম হাসি থামিয়ে বলে, স্যরি! স্যরি,ভাবি! আর মজা করব না। এই মুখে পিন মারলাম। দু’জনেই চুপচাপ, স্বাভাবিক হয়ে গেছে। এই প্রথম ঈদ, যে ঈদে শিশির গোসল করে ২য় স্থান অধীকার করেছে। ব্যাপারটা লাবণ্যর সাথে শেয়ার করার জন্য ওর দিকে এগিয়ে গেল। ভাবি জানো…..(….)…..???
কথাটা বলেই স্তব্ধ হয়ে যায় শিশির। লাবণ্য শিশিরের দিকে তাকালো। হ্যাঁ, বলো…..
শিশির কিছুক্ষণ লাবণ্যর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হো হো করে হেসে দিল। এমন হাসি, যা থামতেই চাইছে না। লাবণ্য বিরক্তিকর স্বরে বলল, কি হলো? বলছ না কেন? অনেক কষ্টে হাসি থামায় শিশির। তারপর- ” ভাবি তোমার লিপ…(….)…?””
কথা পুরো বলতে পারেনি। তার আগেই হাসতে হাসতে রুম ছাড়ে শিশির। বেচারী লাবণ্য কিছু বুঝে উঠতে না পেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাল রাত্রে শিশির বায়না ধরেছিল লাবণ্যকে বউ সাজে দেখবে। তারই কথা মত সাজতে সাজতে অনেক রাত হয়ে গেছে। তাই এগুলো না ধুয়েই ঘুমিয়ে পরেছিল ওরা। এখন তো সেসব সাজের মধ্যে লিপস্টিক’টা লেপ্টে আছে। আর এটা দেখেই না জানি শিশির উল্টাপাল্টা কি ভাবছে। ইস! কি লজ্জা….
আয়নার সামনে থেকে সরে যায় লাবণ্য। চটজলদি কাপড় এনে ওয়াশরুমে প্রবেশ করে সে।

লাবণ্যর রুমে থেকে বের হয়ে সরাসরি কাজিন পলাশের কাছে চলে যায় শুভ্র। কেননা, এ এলাকার কম বেশী সবাই জানে পলাশের ঘরটা ছোট খাটো ফার্মেসীর মতই। কোনো ছোট খাটো এক্সিডেন্ট হলে সবার আগে সবাই পলাশের কাছে ছুটে আসে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। আর হসপিটালে রোগীদের নিয়ে আসা যাওয়া করতে করতে অনেক কিছুই ওর রপ্ত হয়ে গেছে। শুভ্র অনেক খুঁজে কাজিন পলাশকে বের করল। ততক্ষণে শুভ্রর সাদা শার্টের হাতা পুরোটাই রক্তে ভিঁজে গেছে। শুভ্রকে এভাবে দেখে পলাশ হেসে বলে উঠল,
” ডাক্তার সাহেবেরই যদি এমন অবস্থা হয়, তাহলে আমরা সাধারণ মানুষের কি হাল হবে?” শুভ্র ব্যাথায় কিছুটা কুকিয়ে উঠে বলল, পরামর্শ পরে দিস আগে আমায় কি করবি কর! ব্যাটা, তোর থেকে দেড়মাসের বড় আছি। সম্মান দিয়ে কথা বল। কথাটা বলেই পলাশ শুভ্রর গা থেকে শার্ট’টাই খুলে ফেলে। তারপর কাটাস্থান ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে পলাশের সারা শরীর শিউরে উঠে। ” এমনভাবে কাজ করিস না?”
উফ, করে ব্যাথায় আর্তনাদ দিয়ে উঠে শুভ্র। পলাশ ভালো ভাবে ক্ষতস্থান ধৌত করে ব্যান্ডেজ করে দেয়। শুভ্র উঠে চলে যাচ্ছিল, পলাশ ধরে ফেলে পিছন থেকে। পিছু ফিরে শুভ্রর জবাব, আর কি? চোখ বড় বড় করে পলাশ বলে উঠে, আর কি মানে? ইনজেকশন দিতে হবে। এখন আমার সাথে ফার্মেসীতে চল। পলাশ ওর ভাই শুভ্রকে নিয়ে যায় ফার্মেসীতে। সেখান থেকে ইনজেকশন দিয়ে তবেই ছাড়ে ওকে। ছাড়ার আগে বলে দেয়, শুন! আজকে কোথাও যাবি না আর। এখন গিয়ে বিছানায় শুয়ে রেস্ট নিবি। শুভ্র মৃদু হেসে বলে, পাগল! সামান্য আঘাতে এত কেয়ার……

বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিল শুভ্র, তার আগেই রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে যায় ওকে ওর ছোট চাচী মরিয়ম। শুভ্র বার বার বলতেছে, কাকী মা! আমি বাসা থেকে দেখা দিয়ে আসি একবার। ওর কাকীমার একটাই জবাব, দেখা পরে করবি। আর ঈদের দিন ওরা কিছু বলবে না। আগে আমাদের বাসা থেকে খেয়ে তারপর যাবি। শুভ্রকে একরকম জোর করে ওর কাকীমা কাকার বাসায় নিয়ে যায়। পিঠা পায়েস এবং নানা রকম মিষ্টান্ন শুভ্রর সামনে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে। শুভ্র চোখ বড় বড় করে কাকীমাকে প্রশ্ন করে, আমাকে কি খাবারের ভিতর ডুবিয়ে মারবে তোমরা? শুভ্রর কাকীমা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, তুই একা খাবি নাকি? বউমাও আসছে। ওকে আনতে পাঠিয়েছি আমি। শুভ্র মনে মনে বলে, ওহ! সব আয়োজন তাহলে একমাত্র বউয়ের জন্য। বড় খাদক তাহলে মেমসাহেব!
ভাবতে ভাবতেই মেমসাহেব হাজির। শুভ্র সেদিকে না তাকানোর ভান করে খাওয়া শুরু করে। এদিকে লাবণ্য?!!!
শুভ্রকে দেখে দাঁড়িয়ে যায়। ” এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য আনিনি। এই যে সামনে খাবার রাখা, এগুলো খেতে হবে। ডাক্তারসাহেব খাবার দেখেই পালিয়ে যাচ্ছিল, তোমার কথা বলে বসিয়ে রাখলাম।
লাবণ্য মাথা নিচু করে খাটের একপাশে পা দুলিয়ে বসলো। কাকীমা লাবণ্যর পাশে এসে দাঁড়ালো। এভাবে পা দুলিয়ে বসলে হবে না। পা উঠিয়ে শুভ্রর পাশে গিয়ে বসো। পলাশ, পলাশের বউও আসছে। আরো আসছে সুমন আর বউ, হিমেল আর ওর বউ। ওদেরও দাওয়াত আজকে। ওরা সবাই এখানে টেবিলে খাবে, শুধু পলাশ আর ওর বউ তোদের সাথে বসবে। শুভ্র এতক্ষণে চোখ তুলে তাকায়। কাকীমা! নতুন বউয়ের সামনে আমরা খাবো? ব্যাপারটা কেমন কেমন না?
– ব্যাপার আবার কেমন কেমন হবে? পলাশ তোর বড়। হতে পারে বিয়েটা পরে করেছে, কিন্তু বয়সে পলাশ তোর চেয়ে বড়। শুভ্র আমতা আমতা করে বলল, হ্যাঁ জানি। কিন্তু তবুও কেমন যেন লাগছে। কথা শেষ না হতেই পলাশ ওর বউকে নিয়ে হাজির। হাসি হাসি মুখ নিয়ে পলাশ বলে উঠে,
” কি ব্যাপার? কি নিয়ে কথা চলছে এখানে?”
শুভ্র কথা ঘুরিয়ে বলল, সে কিছু না ভাইয়া।
ইতিমধ্যে হিমেল সুমনও ওদের বউ নিয়ে হাজির। কাকীমা লাবণ্যকে উপরে উঠে শুভ্রর পাশে গিয়ে বসতে বলল। নিশ্চুপ লাবণ্য শুভ্রর পাশে গিয়ে বসল। একপাশে লাবণ্য শুভ্র, আরেক পাশে পলাশ-মৌরি। আর রুমে টেবিলে বসে খাচ্ছে সুমন-নাইমা, হিমেল-লামিয়া। সবাই বেশ চুপচাপ খেয়ে চলছে। শুধু লাবণ্যই ইতস্তত করতেছে। শুভ্র বারবার ওর হাঁটু দ্বারা লাবণ্যর হাঁটুতে মৃদু আঘাত করছে। আর লাবণ্য একটু একটু করে পিছনের দিকে সরতেছে। আড়চোখে পলাশের বউ পলাশকে সেটা দেখায়। দু’জনেই বেশ কৌতূহলের সাথে খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে শুভ্র-লাবণ্যর দিকে তাকাচ্ছ।

চলবে……

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব- ১৩

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব- ১৩
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

এতক্ষণে সময় হলো গোসলখানা থেকে আসার? ড্রেসিংটেবিলে আয়নার সামনে বসে ভেঁজা চুলগুলো আচড়াচ্ছিল লাবণ্য। শাশুড়ির কথায় পিছু ফিরে তাকাই সে।
– ইয়ে না মানে মা….(….)….
হয়ছে! আর আমতা আমতা করতে হবে না। টেবিলে খাবার দিয়েছি। খেয়ে যা।
– কিন্তু মা আমি তো রোজা রা….(….)…..?
চলে যাচ্ছিল লাবণ্যর শাশুড়ির, ওর কথা শুনে থেমে যান তিনি। পিছু ফিরে তাকান।
হাসি দিয়ে বলেন, এ রোজা নয় এ উপুষ। দু’দিন ধরে কিচ্ছু খাস না, এভাবে না খেয়ে শুধু শুধু কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস? রোজা রাখলে নামাজও পড়তে হয়, কাল সেহরির পর থেকে এ পর্যন্ত কয় ওয়াক্ত নামাজ পড়েছিস শুনি?
লাবণ্য লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। সত্যি’ই কাল সেহরির পর থেকে একওয়াক্ত নামাজও পড়িনি। যে আমি এক ওয়াক্ত নামাজ যদি ঘুমের জন্য মিস হতো, কান্না শুরু করে দিতাম কেন জাগিয়ে দেয়নি, সেই আমি কি করে দু’দু’ওয়াক্ত নামাজ মিস করলাম? কিভাবে আমায় শয়তান ধরলো?
লাবণ্যর শাশুড়ি ওর কাছে গিয়ে বলে, হয়ছে থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। টেবিলে খাবার দিয়েছি, খেয়ে যান। খেয়ে উপুষটা ভঙ্গ করেন। শাশুড়ি চলে যাওয়ার পরও লাবণ্য একমনে আয়নার দিকে তাকিয়ে ভেঁজা চুলগুলো আঁচড়াচ্ছিল। তখন’ই সেখানে উপস্থিত হয় শিশির। জোরগলায় বলে উঠে, “ভাবি! তুমি এখনো বসে আছ? মা ডাকতেছে তুমি কি শুনতে পাচ্ছো না?”
ননদ শিশিরের কথায় সম্ভিত ফিরে লাবণ্যর। আয়নার সামনে থেকে চটজলদি উঠে পরে।
মৃদু হাসি দিয়ে ননদকে বলে, তুমি যাও! আমি আসছি। শিশির মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে শুভ্রর রুমের দিকে পা বাড়ালো। লাবণ্য গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো। খাবার সামনেই রাখা, কিন্তু কেন যেন ও মুখে দিতে সাহস পাচ্ছে না! কেমন যেন লাগছে ওর! এই কেমন লাগাটা কি ওর রোজার জন্য? হবে হয়তো!
” কি হলো? খাবার নিয়ে আবার ধ্যানে বসছিস নাকি? শুন রোজা রাখছি। বেশী কথা যাতে না বলতে হয় আর। লাবণ্য শাশুড়ির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকালো।
“মা, আমি রোজা রাখব, না খেলে হয় না?”
লাবণ্যর শাশুড়ি লাবণ্যর দিকে গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। লাবণ্য পূর্বের ন্যায় বিনীত ভঙ্গিতে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলতেছে, ” মা! প্লিজ…..”
শাশুড়ি এবার চেঁচিয়ে উঠল,
“তুই আমার কথা শুনবি কি না?”
লাবণ্য মনে মনে আল্লাহর কাছে দু’হাত তুললো। এ আল্লাহ মাফ করো আমায়। তারপর কোনো কথা না বলে বিসমিল্লাহ বলে ঢোক গিলে একের পর এক লঙ্কা গিলতে লাগল। ভয়ে শাশুড়ির দিকে মুখ তুলে তাকানোরও সাহস পাচ্ছে না লাবণ্য। সেই কখন থেকে শুধু গিলেই যাচ্ছে তো, গিলেই যাচ্ছে। ঠিক সে সময় শিশিরের সাথে উপস্থিত হয় শুভ্র। খাবার টেবিলের সামনে এসে লাবণ্যর দিকে হা করে তাকিয়ে আছে শিশির- শুভ্র। শিশির ওর মাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই হাত ইশারায় মুখে আঙ্গুল দিয়ে চুপ করতে বলেন ওনি ওনার মেয়েকে। শুভ্রকে ইশারায় পাশে বসতে বলে শিশির সেখান থেকে চলে যায়। শুভ্রর সামনে খাবার আর পানির জগ এবং গ্লাস দিয়ে শুভ্রর মা ও সেখান থেকে চলে যায়। পুরো একপ্লেট ভাত খেয়ে তবেই মাথা উঁচু করল লাবণ্য। সামনে তাকাতেই দেখে শুভ্র গালে হাত দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে। লাবণ্য চোখ ফিরিয়ে নেয় শুভ্রর থেকে। শুভ্র গ্লাসে পানি ঢেলে ভরে, নাও! খাও। না হলে যে হারে খেয়েছ গলায় আটকে যাবে। লাবণ্য কিছু না বলে ঢকঢক করে দু’তিন গ্লাস পানি খেয়ে নেয়। সবশেষে প্লেটে পানি ঢালতে গেলে শুভ্র চোখ বড় বড় করে বলে উঠে, আরে আরে! একি করছ? আম্মা তোমার জন্য এই যে আরো একপ্লেট ভাত দিয়ে গেছে। এগুলো না খেয়ে হাত ধুচ্ছো যে? লাবণ্য চোখ বড় বড় করে বলে, এগুলো আমার নাকি আপনার? মা আপনাকে দিয়ে গেছে! শুভ্র গম্ভীর কন্ঠে বলে, তওবা, তওবা! রোজাদার ব্যক্তির এসব শুনাও যে পাপ।
– কি? আপনি রোজা?!!!(লাবণ্য)
~ হ্যাঁ, তুমি জানো না? আমি রোজা ভাঙ্গি না জীবনেও। (শুভ্র)
শুভ্রর কথা শুনে লাবণ্য কিছুটা লজ্জা পেল। তারপর নিচের দিকেই তাকিয়ে বলল, না মানে আপনার তো রোজা হবে না, তাহলে আপনি রোজা রাখলেন কিভাবে? শুভ্র চোখে মুখে গাম্ভীর্য্যের ছাপ এনে বলে, শুনো! আমি ছেলে। আমি মেয়ে না যে আমার একসাথে ৩টা, ৫টা, ৭টা রোজা কাযা হবে। কি লজ্জা! আমি কি বুঝাতে চাইলাম আর ওনি কি বুঝলেন! লজ্জায় চোখ মুখ লালবর্ণ ধারণ করেছে লাবণ্য। আর তাইতো অন্যদিকে তাকিয়েই বলে, ইয়ে মানে আমি এসব বুঝাতে চাইনি। আমি তো বলতে চাইছিলাম…..(……)…..???
– রোজা ভঙ্গের যতগুলো কারণ আছে শুভ্র এবার সেগুলো গড়গড় করে বলা শুরু করল। লাবণ্যর লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার অবস্থা। শুভ্র সেটা লক্ষ করে মিটিমিটি হাসছে আর বলতেছে, এসব কারণের মধ্যে কোনটা আমাদের সাথে আই মিন আমার সাথে হইছে বলো? তাহলে আমার রোজা কেন হবে না?
লাবণ্য এবার তাড়াতাড়ি হাত ধূয়ে টেবিল থেকে উঠে দাঁড়াল। শুভ্র স্মিতহাস্য পিছু ডাকল, কি হলো? বলে তো যাও আমার রোজা ঠিক কোন কারণে হবে না? লাবণ্য কোনো কথা না বলে চটজলদি সে স্থান পরিত্যাগ করে। খাবারগুলো ঢেকে রেখে উঠে যাচ্ছিল শুভ্র, সামনে বাবার মুখোমুখি হয়। মুচকি হাসি দিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে ওর বাবার জবাব, সাবাস ব্যাটা! এভাবেই পিছনে আঠার মতো লেগে থাক। শুভ্র মাথা চুলকিয়ে সে স্থান ত্যাগ করে।

আসরের নামাজের আযান দিয়েছে। সবাই যে যার মত নামাজ আদায় করতে চলে গেল। নামাজ শেষে এদিক ওদিক ভালো ভাবে দেখে লাবণ্য যে রুমে থাকে সে রুমে ঢুকে পরে শুভ্র। ফ্লোরে জায়নামাজ পেতে সেখানে বসেই কুরআন তেলওয়াত করছিল লাবণ্য। শুভ্রকে দেখে কুরআন শরীফটা বন্ধ করে বক্সের ভিতর রেখে দেয়। কাশি দিতে দিতেই দরজার বাহির থেকে রুমের ভিতরে ঢুকে সে। লাবণ্য খাটের একপাশে মাথা নিচু করে বসেছিল, শুভ্র তার ঠিক সামনের সোফায় বসে। একটা কাশি দিয়ে বলে উঠে শুভ্র, তা মিসেস লাবণ্যর রোজা তো আজকে দিনেই মনে হয় ১৭টা পূর্ণ হলো তাই না? লাবণ্য কোনো কথা না বলে মাথা নিচু করে আছে। শুভ্র হেসে বলল, আল্লাহ! আম্মা তোমায় খাওয়ানোর জন্য একটু মিথ্যে বলল, আর তাতেই তুমি খেয়ে উঠলে?! তুমি তো দেখছি ছোট বাচ্চাদের মতই। ছোটবেলায় রোজা রাখতাম বলে মা কত্ত কিছু বলে রোজা ভাঙাতো। বলত যে, খেয়ে নে। একরোজা হয়ে যাবে। ডাক না দিলে না খেয়েই রোজা রাখতাম, আর আম্মা কত কথা যে বলত। সেসব কথা আজকে তোমায়ও বলছে। আর বাচ্চা মেয়ে সেটা বিশ্বাস করে দিনের বেলায় ইফতার করে ফেলেছে। যাকগে, চিন্তা একটা হয়ে গেছে তোমার। হি, হা, হা, হা……..
শুভ্র হাসছে। লাবণ্য মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে হাসির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,
ইস! কত সুন্দর করে হেসে, হাসিয়ে অনর্গল কথা বলতেছে। কি করে পারে মানুষ এতসুন্দর করে কথা বলতে? এতই সুন্দর যে সারাজীবন ধরে সে কথা শুনলেও মুগ্ধতার রেশ কাটবে না। এই মুখ, এই হাসি, এই কথায় বিভোর হয়েই তো একদিন ওর প্রেমে মজেছিলাম। তারপর? কি পেলাম আমি বিনিময়ে? লাঞ্চনা-গঞ্চনা আর একবুক বেদনা। লাবণ্যর সুন্দর ফর্সা মুখটা নিমিষেই কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। মনে মনে, আমি যে ওর প্রতি দিনকে দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। না, না! এ হতে পারে না। ওর দেওয়া আঘাত, ক্ষত এখনো বুকের ভেতরে তাজা হয়ে রয়ে গেছে। সেই সব ক্ষতের দাগ এখনো শুকাইনি। না, না! আমি এভাবে হেরে যেতে পারি না। ওর প্রতি আমার কোনো মায়া, কোনো টান থাকতে পারে না। লাবণ্য একলাফে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বিড়বিড় করে কি যেন বলে সে রুম ত্যাগ করল।

চোখের পলকে মাহে রমজান বিদায় নিল। আজ পবিত্র ঈদুল ফিতর। চিরাচয়িত নিয়মে আজও সবার আগে মানে কাকপক্ষী জাগার আগে শুভ্র জেগে যায়। যেহেতু প্রতিবছর ওরা গ্রামে দাদার বাড়িতে ঈদ করে সেহেতু প্রতিযোগীতাটা শুভ্র ওর বোন এবং কাজিনের সাথেই করত। কার আগে কে গোসল করতে পারে সেই প্রতিযোগীতা। প্রচন্ড শীতের মধ্যে কেঁপে কেঁপে গোসল করার মাঝেও আনন্দ আছে, যদি সেটা কোনো উৎসব বিশেষ করে ঈদের জন্য হয়। শীতে রীতিমত কাঁপছিল শুভ্র, তবুও গোসলটা সেরে আসে। সবার আগে গোসল করতে যেয়ে মনে হচ্ছে এতটাই আগে গোসল করে ফেলেছে যে এখনো ফজরের আযান’ই দিচ্ছে না। কাঁপা কাঁপা শরীরে শুভ্র ওর বোন শিশিরকে ডাক দেয়। শিশির ঘুম থেকে উঠে চিৎকার দিয়ে বলে, আজও তুই প্রথম হয়ে গেলি? এ্যাহেেএ্যাএ্যাএ্যা…….
শুভ্র কাঁপা কাঁপা স্বরেই বোনকে ব্যঙ্গালো ব্যা ব্যা……. শিশির রাগে গজগজ করে মাকে গালগাল দিতে দিতে কাজিনদের ডেকে উঠানোর জন্য বাহিরে চলে যায়। শুভ্র ঠিক এ সুযোগটার জন্য’ই ছিল। শিশির রুম থেকে চলে যাওয়ার সাথে সাথে শুভ্র ঐ রুমে প্রবেশ করে দরজা ভিতর থেকে আটকে দেয়। কম্বল গায়ে লাবণ্য তখনো অঘোরে ঘুমুচ্ছে। ধীর পায়ে শুভ্র বিছানার দিকে এগুতে থাকে। এই মুহূর্ত লাবণ্যর বিছানার একদম পাশে দাঁড়িয়ে শুভ্র। মনে মনে ভাবছে, আমার কি কাজটা করা ঠিক হবে? ও যদি রেগে যায় কিংবা ভুল বুঝে?! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই শুভ্রর দাঁতে দাঁত লেগে যায়। প্রচন্ড শীতে দাঁতের দাঁতের ঘর্ষণে কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে। শুভ্রর শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে। না, না! আর একমুহূর্তও ভাবতে পারব না। যা হয় হোক। আমি আগে আমাকে বাঁচায়। এই বলে আগেপাছে কিচ্ছু না ভেবেই শুভ্র লাবণ্যর কম্বলের ভিতর ঢুকে যায়।

তারপর…….

চলবে………

ভুল এবং ভালোবাসা পর্ব:- ১২

0

ভুল এবং ভালোবাসা
পর্ব:- ১২
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

অবশেষে দরজা ভেঙে’ই রুমে প্রবেশ করা হলো। একসাথে দু’দুটো দরজা ভাঙবে এটা সত্ত্বেও শুভ্রর বাবা মনে মনে হাসছিলেন আর ছেলেকে বাহবা দিচ্ছিলেন আর মনে মনেই বলছিলেন-
” সাবাস ব্যাটা! এতদিন পর একটা কাজের মত কাজ করছিস। বউ নিয়ে পালাইছিস।”
কিন্তু একি?! এ ছেলে যে এখনো রুমে পরম নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। শুভ্রকে রুমে দেখে বাপ মাইয়্যা দুজনের মুখ’ই অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় হয়ে যায়। ঘুমড়া মুখে শিশির শুভ্রর পাশে দাঁড়িয়ে আছে। শুভ্রর মা মনে মনে আল্লাহর অশেষ শোকরিয়া আদায় করলেন। যাক বাবা! রুমে’ই আছে তবে। কাছে গিয়ে ছেলেকে ধাক্কা দিলেন রোকসানা বেগম। কারো হাতের ধাক্কা পেয়ে চমকে উঠল শুভ্র। চটজলদি বিছানা ছেড়ে উঠে বসল সে। চতুর্দিকে সবাইকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ ছানাভরা হয়ে যায় শুভ্রর। চোখ কচলে প্রশ্ন করে,
” তোমরা? তোমরা এ ঘরে কেন? আর এভাবে তাকিয়ে কেন আছ?”
কেউ কোনো কথা বলছে না দেখে কাজের মেয়ের দিকে তাকাই শুভ্র। কাজের মেয়ে চোখ ইশারায় ঘড়ির দিকে তাকাতে বললো। শুভ্র ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে যায়। Oh, my god! তিনটা বাজে? এতবেলা অবধি ঘুমালাম? ইনোসেন্ট লুক নিয়ে বাবা মায়ের মুখের দিকে তাকালো শুভ্র। তারপর ছোট্ট বাচ্চাদের মত বলতে শুরু করল-
” Sorry, baba.Sorry, Maa.I am extremely sorry…..”
আসলে সারাদিনের অভুক্ত শরীর তো। তাই এমন হয়েছে। আর কেউ না জানুক তোমরা তো জানো না খেয়ে ঘুমোলে আমি আর সেদিন বিছানা থেকে উঠতে পারি না। আমাকে ধরে উঠাতে হয়। এখানে আমার কিবা করার আছে বলো?!”
কেউ কিচ্ছু না বলে নিরবে রুম ত্যাগ করে লাবণ্যর রুমে যায় ওর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। থাকার মধ্যে শুধু শুভ্রর বাবা’ই শুভ্রর রুমে থেকে গেল। সবাই রুম থেকে বেরিয়ে গেলে ছেলের পাশে গিয়ে বসেন ওনি। পাশে বসে ছেলের দিকে এমনভাবে তাকিয়ে আছেন যে, মনে হচ্ছে পারলে এখনি গিলে খেত। ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে শুভ্র ওর বাবার দিকে তাকাই।
” সেই কখন থেকে এমনভাবে তাকিয়ে আছ মনে হচ্ছে আমি যেন মহাভারত অশুদ্ধ করে ফেলছি।” ?
শুভ্রর বাবা আরো ভয়ংকর দৃষ্টি নিয়ে শুভ্রর দিকে তাকালো।
” কি হলো? এভাবে রাগ দেখাচ্ছ কেন?”?

মুখ খুলে শুভ্রর বাবা, গর্দভ কোথাকার! এতকিছুর পরও এখানে পরে আছিস কি করে? বউ নিয়ে পালিয়ে যেতে পারিস না?

শুভ্র অবাক চোখে বাবার মুখের দিকে তাকান। কি বলছেন এসব ওনি? প্রশ্ন করেন বাবাকে, কিন্তু বাবা ও যদি না যায় আমার সাথে??

একরাশ বিরক্তি নিয়ে ছেলের দিকে তাকান মিস্টার চৌধুরী। তারপর গম্ভীর গলায় বলেন, ব্যাটা বোকা কোথাকার! যেতে না চাইলে জোর করে তুলে নিয়ে যাবি। প্রথম প্রথম নাক ফুলিয়ে, মুখ ফুলিয়ে থাকবে। পরে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। শুভ্র মৃদু হেসে বাপের দিকে তাকাই। ওর বাবা বলতে থাকে, ” তোর মায়ের সাথে আমার একবার গন্ডগোল হয়ছিল। তোর মা আমায় ছেড়ে তোর নানাবাড়ি চলে যায়। তোর নানাবাড়ির সবাইও একসাথে জোট বেঁধে লাগে যে, তোর মাকে আর আমার কাছে দিবে না।”
তো আমি কি করলাম জানিস? আমি আমার চাচা শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নেই। তোর চাচাতো মামি ছিল একটা অনেক ভালো। ওনি তোর মাকে মিথ্যে অজুহাতে বাইরে বের করে আনে। গ্রাম এলাকা। তখন বিদ্যুৎও ছিল না। চারদিকে অন্ধকার। সেই অন্ধকারটাকেই আমি কাজে লাগালাম। তোর মামিকে আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে দুরে সরিয়ে তোর মাকে কাঁধে তুলে দৌঁড়’ই দৌঁড়। তোর মা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে যায় আমার গলার আওয়াজ শুনে। হাজার হোক স্বামী তো। স্বামীর সম্মান বাঁচাতে চিৎকার আর দিলো না। তবে হাত পা ছুড়াছুড়ি করেছিল অনেক।”
শুভ্রর বাবা এটুকু বলে থেমে যায়। বাপ- ব্যাটা দু’জনে দু’জনের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠে। রুমে উপস্থিত হয় শুভ্রর মা। ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করে,
” বলি রং কি বেয়ে বেয়ে পরতেছে? এত হাসাহাসি কিসের?”
বাপ পুত্র দু’জনেই চুপসে যায়।
” সে কিছু না। লাবণ্যর রুমে গিয়েছিলা?”
শুভ্রর বাবার প্রশ্নে ওর মা বলে, হুম গিয়েছিলাম। ঘুম আসছিল না, সেই জন্য ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুম দিয়েছিল নাকি। এখনো মনে হয় ঘুম পুরোটা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছে সেহরি খাওয়ার টাইম হইছে। আমায় বলতেছে মা, তোমরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছ কেন? সেহরির সময় যে চলে যাচ্ছে? খাবে না নাকি আজকে? আমি বলে এসেছি, হাত মুখ ধূয়ে পারলে গোসলটাও করে আসিস। সেহরির সাথে আজকে ইফতারটাও করতে পারবি।”
এই অবস্থা? হা, হা করে হেসে দিল শুভ্রর বাবা। শুভ্রর মা ভ্রু কুচকে বলেন, হুম। এখন তুমি উঠে আসো। আর হ্যাঁ, ওকে বলে আসো ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে আসতে। রোজা’তো আজকে দু’দিন ধরে রাখতেছে। ইফতারটাও না হয় তিনঘন্টা আগ থেকেই করা শুরু করবে। শুভ্রর মা চলে যায়।
” যা ব্যাটা! গোসল করে আয়। পরে বুদ্ধি যা করার করা যাবে। মনে রাখিস, এমনি এমনি কোনো কিছু তোর হাতে ধরা দিবে না। অধিকারের সাথে সাথে জোরটাও খাটাতে হবে।” বাবার কথায় অনেকটা শক্তি পেল শুভ্র। তাইতো বাবার দিকে তাকিয়ে একটা ভুবনজয়ী হাসি দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াই শুভ্র।

এদিকে লাবণ্য। শিশিরের থেকে যখন শুনলো যে এটা রাত নয়, দিন। এখন দিনের সাড়ে তিনটে বাজে। তখন থেকেই লাবণ্যর দৌঁড়ানোর শুরু। একবার ব্রাশ নিয়ে ওয়াশরুমে যাচ্ছে তো, আবার ফিরে এসে জামা কাপড় নিয়ে যাচ্ছে গোসলের জন্য। একবার তোয়ালে তো আরেকবার শ্যাম্পুর জন্য রুমের দিকে দৌঁড়াচ্ছে। তাড়াহুড়ো কাজ করলে যা হয় আর কি! তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে গোসলখানার দরজা আটকাতেই ভুলে গেছে লাবণ্য। দরজা খুলা রেখে লাবণ্য যখন ওর চুলে শ্যাম্পু করতেছিল তখন’ই পিছন থেকে একজন বলে উঠে, কয়টা খেয়েছিলে ট্যাবলেট? লাবণ্য পিছু না ফিরেই আঙুল উচিয়ে দেখায়, তিনটা। তারপর আর কোনো কথা নেই। চুলে শ্যাম্পু করা শেষে চুল ভালো ভাবে ধূয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় লাবণ্য। শাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়াতেই খেয়াল হয়, কি ব্যাপার? কে প্রশ্ন করেছিল আমায় ঔষধের ব্যাপারে? আর আমি কাকে উত্তর দিলাম? শাওয়ারের নিচ থেকে ক্ষাণিকটা সরে ভেঁজা শরীরেই পিছু ফিরে তাকাই লাবণ্য। গোসলখানার দরজার সামনের দেয়ালে হেলান দিয়ে একমনে দাঁড়িয়ে মুচকি মুচকি হাসছে শুভ্র। খালি গা, শরীরে কাপড় বলতে একটা তোয়ালে ঝুলানো আছে গলায়। শুভ্রকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে ফেলে লাবণ্য। মনে মনে-
” ওনি? কখন এলেন চেম্বার থেকে? আর এভাবে খালি গায়ে এখানে কেন দাঁড়িয়ে? আমি ঘুমের ঔষধ খেয়েছি এটা ওনি কিভাবে জানেন? আর ওনি এভাবে হাসছেন কেন?” এলোমেলো সব প্রশ্ন নিজে নিজেকেই করে যাচ্ছে লাবণ্য।
” কি হলো? এভাবে দাঁড়িয়ে’ই থাকবা নাকি আরো যে মানুষ রয়েছে ওদেরকে জায়গা দিবা?” পানির ট্যাব বন্ধ করে ঢোক গিলে লাবণ্যর জবাব, আমি এখন কাউকে জায়গা দিতে পারব না। আমি গোসল করব। কিছুটা রাগী গলায় শুভ্রর পাল্টা প্রশ্ন, তো আমি কি এখানে নাচতে এসেছি? আমিও গোসল করতেই এসেছি। আর শুনো! গোসলখানা’টা কারো একার সম্পত্তি না…… শুভ্র দরজা ঠেলে গোসলখানায় প্রবেশ করল। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে লাবণ্য। শুভ্র ছিটকিনিটা ভালো ভাবে আটকিয়ে শাওয়ারটা ছেড়ে নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। লজ্জায় লাবণ্য না পারছে কিছু বলতে না পারছে কিছু করতে। শুধু নিশ্চুপ হয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। শুভ্র শরীরে সাবান লাগাচ্ছে আর আড়চোখে লাবণ্যর দিকে তাকাচ্ছে। মাঝে মাঝে না দেখার ভান করে ইচ্ছে করে’ই পানিরছিটা দ্বারা লাবণ্যকে ভিঁজিয়ে দিচ্ছে।
এতক্ষণ ধরে সব সহ্য করে গেলেও এবার মুখ খুলে লাবণ্য। ধীর গলায় বলে-
” কি করছেন এসব? আমি যে ভিঁজে যাচ্ছি!”
আচমকা শুভ্র বালতি থেকে এক মগ পানি এনে, লাবণ্যর মাথায় ঢেলে দেই। লাবণ্য মুখটা অন্ধকারের মত করে বলে-
” এটা কি করলেন?”
মুচকি হেসে শুভ্রর জবাব, এতক্ষণ পুরোপুরি ভিঁজনি, তাই এখন পুরোপুরি ভিঁজিয়ে দিলাম। এখন আসো গোসল করিয়ে দেই।
লাবণ্য কিছুটা পিছু সরে যায়। শুভ্র লাবণ্যর দিকে এগিয়ে যায়। কি হলো? এভাবে পিছনে যাচ্ছ কেন? লাবণ্যর শেষ সীমানা দরজাতে গিয়ে মিশে যায়। শুভ্র লাবণ্যর সামনে গিয়ে দাঁড়াই। লজ্জায় লাবণ্য শুভ্রর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না। আবার ভেঁজা শরীর নিয়ে বাইরেও যেতে পারছে না। নিরুপায় লাবণ্য তাই মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। লাবণ্যর লজ্জা রাঙ্গা মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চট করে হাতটা ধরে একটানে শাওয়ারের নিচে গিয়ে দাঁড়ায়। লাবণ্য তখনও মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে। থুতনি ধরে মুখটা উপরের দিকে তুলে মুখের দিকে একটা আঙ্গুল নিয়ে যায় শুভ্র। লজ্জায় চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে লাবণ্য। গোলাপের পাপড়ির ন্যায় ঠোঁটজোড়াতে মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে। ভীরু চোখের পাতা দুটি কাঁপছে। লাবণ্যর পুরো মুখ লজ্জায় লাল বর্ণ ধারণ করেছে। শুভ্র দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে সে দৃশ্য’ই দেখছে। কিছু করছে না দেখে চোখ খুলে লাবণ্য। শুভ্র তখনো লাবণ্যর মায়া মায়া মুখপানে’ই তাকিয়ে ছিল। লাবণ্যর ডাকে ঘোর কাটে ওর। ছাড়েন….. শুভ্র ওর একহাত দ্বারা লাবণ্যর কোমড়ে ধরে রেখেছিল। লাবণ্যর কথায় কোমর ছেড়ে দু’হাতে শুভ্র লাবণ্যর গাল চেপে ধরে। লাবণ্য ফ্যালফ্যাল করে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে ভাবছে, আজ এমন কেন করতেছেন ওনি? আর ওনার এত সাহস এলো কোথা থেকে আজকে? শুভ্র লাবণ্যর দু’গাল চেপে ধরে বলতে শুরু করে-
” আমি স্যরি লাবণ্য। আমি আসলে জানতাম না তোমার আব্বু আম্মু নেই। আর তুমিও তো আমাকে জানাওনি। জানালে এতকিছু হতো না। জানো আমি তোমায় কিভাবে খুঁজেছি? তোমার নাম্বার বন্ধ পেয়ে আমি পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। এদিকে আমি তোমার ঢাকার বাসার ঠিকানাও জানতাম। তোমাকে এ শহরে কত জায়গায় যে খুঁজেছি, যদি তুমি বুঝতে পারতা! সবসময় একটা ভয় আমায় তাড়িয়ে বেড়াতো, ও ঠিক আছে তো?! আমি তোমার সব বান্ধবীদের কাছে তোমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছি, ওরা কিচ্ছু বলেনি। আমি তোমার গ্রামের বাড়ির ঠিকানাও চেয়েছিলাম ওদের কাছে, ওরা ঠিকানাটাও দেয়নি। তখন যে আমার কেমন অবস্থা হয়ছিল যদি তখন দেখতা তাহলে বুঝতে পারতা! লাবণ্য আমি ইচ্ছে করে এমন করিনি। আমার বন্ধুরা আমায় পাগল বানিয়ে দিয়েছিল। তোমায় নিয়ে বাজে কথা বলত। বলত-
” আরে ব্যাটা! ঐ মাইয়্যা তো মনে হয় সুখেই দিন কাটাচ্ছে, তুই কেন এমন দেবদাস মার্কা চেহারা বানিয়েছিস? খুঁজ নিয়ে দ্যাখ! ও হয়তো নতুন কাউকে পেয়ে গেছে।”
এরকম হাজারো কথা প্রতিনিয়ত ওদের থেকে শুনতে হতো আমার। একটা সময় ওদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেই। তবুও ওদের কথা পাত্তা দেইনি। কিন্তু সেদিন যখন হসপিটাল থেকে ফিরার সময় তোমাকে একটা অচেনা ছেলের সাথে দেখি, তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমি জানতাম না এ তোমার কাজিন ছিল। জানলে এমন ধারণা মনে পোষতাম না। লাবণ্য জানো তোমার সাথে এই যে আমি এত খারাপ ব্যবহার করতাম, আমার খুব কষ্ট হতো। খুব বেশী কষ্ট হতো। তবুও কষ্ট দিতাম। কারণ, তোমার দেওয়া কষ্ট গুলো আমি বুকের মধ্যে পুষে রেখে দিয়েছিলাম। যতবারই চেয়েছি তোমার কাছে যেতে, ততবারই মনে পরে গেছে এ তো সেই মেয়ে! যে তোর স্বাভাবিক জীবন নষ্ট করে দিয়েছিল। রেগে গিয়ে তখনি তোমার সাথে উল্টাপাল্টা আচরণ করতাম। লাবণ্য জানো, তুমি চলে আসার পর থেকে একটা রাতও আমি শান্তিতে ঘুমোতে পারিনি। অজানা এক শূন্যতায় ভেতরটা কেমন খাঁ, খাঁ করেছে। ছন্নছাড়া পাখির মত আমি শুধু ডানা ঝাপটাইতাম। তুমি চলে আসার পর থেকে একটা রাতও আমি ভালো ভাবে ঘুমোতে পারিনি লাবণ্য। সেদিন শিশিরের থেকে যখন জানতে পারলাম তোমার এবং পরিবারের কথা, তখন আমার সব, সব ভুল কেটে গেছে লাবণ্য। আমি বুঝতে পারছি লাবণ্য আমি অনেক বড় ভুল করেছি, যার কোনো ক্ষমা নেই। এখন তুমি যদি আমায় ক্ষমা করতে না চাও তাহলে করো না। এতে আমার একটুও আফসোস নেই। কিন্তু প্লিজ লাবণ্য তুমি আর এভাবে মুখ ফিরিয়ে থেকো না। আমার কষ্ট হয়। ভালোবাসা না দাও, শাস্তিটুকু দাও লাবণ্য। তবুও প্লিজ এভাবে আর এমন করে থেকো না।”
লাবণ্যর চোখ জলে টলমল করছে। শুভ্রর হাতের মুঠো থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, ” মা ডাকতেছে। তাড়াতাড়ি বের হোন। আমি চেঞ্জ করব।”
শুভ্র মায়ের ভয়ে তাড়াতাড়ি গোসল সেরে চলে যায়। শুভ্র চলে যাওয়ার পর শুকনো মুখে একটা হাসির রেখা টেনে লাবণ্যর জবাব,
” হা, হা শাস্তি! সেতো আপনাকে দিব’ই, এমন শাস্তি যা আপনি কখনো কল্পনাও করতে পারবেন না।”

চলবে…….