ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে আছে আঁখির গলা।
” কিরে? কে এসেছে?”
ভয়ার্ত কন্ঠে নুহার জবাব, ‘ছেছেছেলে ধরা…’
ছেলে ধরা মানে? কিসব বলছিস নুহা?
এগিয়ে আসে আঁখি। দরকার সামনে এসে থমকে দাঁড়ায় সেও।
‘ভাবি, আপনি? অনেকটা কাঁপা গলায় আঁখি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটিকে প্রশ্নটা করে। চমকে যায় নুহা।
আঁখির কথার পুনরাবৃত্তি ঘটায়। জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে আঁখির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে- ‘ভাবি…?’
কিচ্ছু বলতে পারেনি আঁখি। তার আগেই সেখানে উপস্থিত হয় আঁখির মা তথা হিয়া আন্টি। আঁখির মতোই চমকে উঠেন ওনি। প্রশ্ন করেন, ‘ফারহানা তুতুতুমি?’
নিচু গলায় কতিপয় ভদ্রমহিলা তথা ফারহানার জবাব, অনেক রাস্তা জার্নি করে এসেছি ফুপ্পি। মায়ের শরীরটাও খুব বেশী ভালো নেই। পুরো রাস্তা বমি করে এসেছে। মায়ের একটু বিশ্রাম দরকার। ভিতরে আসতে পারি কি?
ইতস্তত হিয়া ফারহানা এবং তার মাকে রুমে আসার অনুমতি দিয়ে দরজার সামনে থেকে সরে যায়।
ঘটনা কোনদিকে মোড় নিচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না হিয়া। শুভ বিশেষ দরকারে বাজারে গেছে। যেকোনো মুহূর্তে বাসায় চলে আসতে পারে। আর শুভর আগমন মানেই বড়ো কোন অনর্থের ইঙ্গিত। এই মুহূর্তে হিয়া ওর হাজবেন্ডের উপস্থিতিটা বড্ড বেশী কামনা করছে। হিয়া জানে, ওর হাজবেন্ড আসলে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু সামাল দিতে পারবে। কারণ, এ বাসায় শুভ যদি কারো কথা মেনে থাকেন সে শুভর ফুপা তথা হিয়ার হাজবেন্ড। যার প্রত্যেকটা কথা বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে চলে শুভ। ছোট থেকে এই ফুপা’ই পিতৃ আদর দিয়েছে কি না….!
ফোনে না পেয়ে হিয়া মেসেজের পর মেসেজ দিয়ে যাচ্ছে ওর হাজবেন্ডকে। হিয়া জানে, পুরো সপ্তাহের মধ্যে এই একটা দিনই ওনি কাজ থেকে অবসর পান আর বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেন। এই সময় ওনাকে ডিস্টার্ব করতে মানা। তা সত্ত্বেও হিয়া মেসেজ দিচ্ছে। দুটোর বেশী কল দেয়নি কারণ ওনার আগে থেকেই বারণ আছে, যত জরুরীই হোক দুটো কলের বেশী যেন না দেয়া হয়। কিন্তু মেসেজ দেয়া তো বারণ করেনি তাই হিয়া একের পর এক মেসেজ দিয়েই যাচ্ছে।
? “বড় এক অনর্থ ঘটে গেছে। যত দ্রুত সম্ভব বাসায় চলে আসো।
? বাসায় আসো।
?প্লিজ বাসায় আসো।
?প্লিজ, প্লিজ, প্লিজ। বাসায় আসো….”
বন্ধুদের সাথে লুডু খেলায় ভিষণ ব্যস্ত ছিল হৃদয়। একটা সময় সাইলেন্ট করা ফোনের স্ক্রিনের দিকে কি মনে করে যেন দৃষ্টি দেয়। মুহূর্তেই ভেসে উঠে চোখে স্ত্রী হিয়ার মেসেজ। অবিরত মেসেজ আসছেই তখনো। ‘বাসায় কারো কিছু হলো না তো?’ ভয় পেয়ে যায় হৃদয়। ডায়াল করে হিয়ার নাম্বার। রিং একটু বাজতে না বাজতেই রিসিভ হয়ে যায়। চিন্তিত গলায় হৃদয় প্রশ্ন করে-
” ওহ, হ্যালো!
কি হয়েছে হিয়া? শরীর ঠিক আছে তো তোমার?”
ওপাশ থেকে ভেসে আসে আঁখির কন্ঠ।
– বাবা! আমি আঁখি…
— হ্যাঁ- মা! কি হয়েছে বাসায়?
– বাবা! ফারহানা ভাবি এসেছে।
— কিহ? শুভর ববববউ এসেছে?
– হ্যাঁ, বাবা! আমার খুব ভয় হচ্ছে বাবা।
— শুভ ভাইয়া যেকোন মুহূর্তে চলে আসতে পারে বাসায়। তখন যদি ওনাদের দেখে কি যে…
– চিন্তা করিস না মা। আমি আসছি এখনি।
জনাব হৃদয় সাহেব কল কেটে দ্রুত বন্ধুর বাইকে উঠেন। মিনিট তিনেকের মধ্যে বাসার সামনে এসে নামেন। বন্ধুকে বিদায় দিয়ে তড়িগড়ি রুমে ঢুকেন।
রান্না করছিল হিয়া। হাজবেন্ডকে দেখে চিন্তিত মুখে কাছে এসে দাঁড়ায়।
– দেখো না! কোথায় থেকে চলে আসছে এই আপদ!
— প্রশ্ন এটা নয়। প্রশ্ন হলো- কি মতলব নিয়ে এই মাইয়্যা আবার এই বাসায় এসে উঠেছে?
– মেয়ে নয় শুধু। মেয়ের সাথে মা’ও এসেছে…!
— কিহ?
– হু। মা মেয়ে দুজনই এসেছে…
— আমি কি গিয়ে জিজ্ঞেস করব মতলব কি?
– আমার মনে হয় সেটাই ভালো হবে। দ্রুত যাও। শুভ আসার আগেই দেখো কিছু করা যায় কি না…!
— আচ্ছা, দেখছি…
গেস্টরুমের দিকে যাচ্ছিল হৃদয়। পথ বেঁধে দাঁড়ায় নুহা। রান্নাঘর থেকে একরকম দৌঁড়ে আসে হিয়া।
– কি করছিস? আদিরা ওনাকে যেতে দে…
— মাফ করবেন আন্টি। ছোট মুখে বড় কথা বলছি। আসলে আপনারা যা করতেছেন তা ঠিক নয়। মেহমান বাড়ির লক্ষ্মীর ন্যায়। লক্ষ্মীকে এভাবে তাড়িয়ে দিতে নেই।
– তুই জানিস ওরা কে বা কারা?
— শুভ ভাইয়ার প্রাক্তন স্ত্রী এবং ওনার শাশুড়ি।
– জেনেও তুই নীতিকথা শুনাতে এসেছিস?
— আন্টি! আমি নীতিকথা বলিনি। হাজার হোক ওনারা এ বাড়ির অতিথি। আর অতিথিকে এভাবে তাড়িয়ে দিবেন না। এটা ঠিক না…
– তুই ছোট, আদিরা! ভুল-ঠিকের তুই বুঝবিনা…
— হয়তো। তবে এখন ওনাদের কিছু না বলে, যথাযথ আপ্যায়নের পর, রেস্ট নিয়ে, সর্বসম্মুখে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলে ভালো হয় আন্টি।
– কিন্তু শুভ….
পুরো কথা বলতে পারেনি হিয়া। থামিয়ে দেয় হৃদয়। ফিরে তাকায় হিয়ার দিকে।
– সত্যিই হিয়া! বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে আমাদের বুদ্ধিও হ্রাস পেয়েছে অনেক। রাগের মাথায় কি অভদ্রতার পরিচয়’ই না দিতে যাচ্ছিলাম…
— মানে কি?
– চিন্তা করো না। যাও। রান্না করো গিয়ে।
— কিন্তু শু…
– ওর জন্য আমি আছি। ড্রয়িংরুমে বসছি। ও ভিতরে ঢুকা মাত্রই সবকিছু বুঝিয়ে বলবো।
— তারপর?
– তারপরেরটা পরে বুঝা যাবে। আপাতত তুমি যাও।
হিয়া রোজির মা তথা এ বাসার বুয়ার সাথে রান্নায় হেল্প করতে রান্নাঘরে চলে যায়।
মিনিট পাঁচেক পর রুম থেকে বেরিয়ে আসে ফারহানার মা।
– বেয়াইন এই ভর সন্ধ্যায় কি করছেনটা কি এসব?
— আরে তেমন কিছু না! খাবারগুলো গরম করছি…
– এতকিছু করার কি দরকার ছিল?
— এতদুর থেকে এসেছেন। কিছু তো একটা সামনে দেয়া দরকার…
– এত উতলা হবেন না। লাঞ্চ আমরা বাইরে থেকে করে এসেছি…
ফারহানার মা রুমে চলে গেলে মুখ ভেংচি দেয় হিয়া।
‘হুহ! বয়েই গেছে আমার উতলা হতে…’
খাবারগুলো গরম করা শেষে সেগুলো মেহমানের সামনে উপস্থাপন করা হয়। খাবার উপস্থাপন করে নুহা। খাবার সামনে আসার পর বিনা বাক্যব্যয়ে সেগুলো গলার্দকরন করে নেয় মা মেয়ে। খাওয়া শেষে মেহমানদের সামনে উপস্থিত হয় হিয়া। দৃষ্টি যায় ফারহানার দিকে।
– ওহ, ফারহানা! জিজ্ঞেস করাই তো হলো না। হুইলচেয়ারে কেন তুমি? কোন সমস্যা হয়েছে কি?
— আসলে ফুপ্পি আমার একটা পা পঙ্গু হয়ে গেছে।
– কি বলছ এসব? পঙ্গু হয়ে গেছে মানে?
— আসলে সেদিন আদনানের বাবাকে না বলেই বাসায় চলে গেছিলাম মাকে দেখার জন্য। ফেরার পথে গাড়ির নিচে চাপা পড়ে আমি আমার একটা পা হারাই…
– কিন্তু আমরা তো শুনেছি…
— আপনারা ভুল শুনেছেন ফুপ্পি। ওরা আপনাকে ভুল শুনিয়েছে। আমি কোন ব্যাংকারের হাত ধরে পালিয়ে যাইনি। আমাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে হয়েছিল।
– আচ্ছা, মানলাম! মানলাম তুমি কারো হাত ধরে পালিয়ে যাওনি। পা গিয়েছে। এজন্য তুমি এ বাসায় আসতে পারোনি। কিন্তু হাত তো ছিল। সেই হাত দিয়ে কি একটা কল দেয়ার শক্তি পাওনি?
— আসলে ফুপ্পি! ফোনটা রাস্তায় পরে ভেঙ্গে গেছিল। মায়ের ফোনেও ব্যালেন্স ছিল না।
” পুরো বাংলাদেশের কারো ফোনেই কি ব্যালেন্স ছিল না, মিসেস ফারহানা জাহিদ?”
উপরিউক্ত উক্তিটা করতে করতে রুমে প্রবেশ করে শুভ। ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে তাকায় হিয়া। শুরু হয় ফারহানা শুভর কথোপকথন।
” আসলে মা ফোন সম্পর্কে তেমন কিছুই বুঝে না সেটাতো তুমি জানো’ই। তারপরও সেদিন মা তোমার নাম্বারটা নিয়ে দোকানে গিয়েছিল ফোন করার জন্য।”
– তারপর?
— সেদিনই মায়ের ফোনটা ছিনতাই হয়।
– তোমার মা তো কাগজে নাম্বারটা লিখে দোকানে গিয়েছিল। ফোন কি ছিনতাইকারীরা বাসায় থেকে এসে নিয়ে গিয়েছিল?
— আরে! মায়ের হাতে ফোনও ছিল…
– ওহ, আচ্ছা, আচ্ছা! তখন ছিনতাইকারী তোমার মায়ের হাত থেকে ফোন নিয়ে দৌঁড় দিয়েছে?
— সেরকমই। তবে মা বুড়ো মানুষ তো। তাই টের পায়নি ফোনটা কখন কে নিয়ে গেছে?
– পরে?
— মা, ফুপ্পি তোমরা একটু বাহিরে যাবে?
ফারহানার কথামতো ওর মা এবং হিয়া আন্টি বাহিরে চলে যায়। ওরা বাহিরে যাওয়া মাত্রই ফারহানা জড়িয়ে ধরে শুভর পা।
– প্লিজ, শুভ! আমায় মাফ করে দাও। আমার ভুল হয়ে গেছে।
— আরে, আরে! তোমার না এক পা পঙ্গু? ভালো হয়ে গেলো কখন?
শুভর কথায় থতমত খেয়ে যায় ফারহানা। দ্রুত ফ্লোর থেকে উঠে হুইল চেয়ারে গিয়ে বসে। হাসতে শুরু করে শুভ।
– হাঃ হাঃ হাঃ… রাগ করলে নাকি?
— না…
– Good…
— ……..
– তারপর?
— কি তারপর?
– ঐ যে কিচ্ছার বাকি অংশ শুনতে চাচ্ছি।
— তুমি অনেক বদলে গেছ শুভ।
– কি সাংঘাতিক! কিচ্ছার ভেতর আমাকে কেন টানছো?
— শুভ প্লিজ! রসিকতা করো না। আমার শরীরের অবস্থা খুব একটা ভালো নেই।
– ওহ, তাই নাকি?
— আমার জন্য তোমার কি একটুও মায়া হয়না শুভ?
– মায়া? হো হো হো….
— হাসছো যে?
– ব্যাংক ম্যানেজারের টাকায় কমতি পরেছে নাকি?
— ………..
– কি হলো? দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলে কেন? আমার দিকে তাকাও?
— কেউ মনে হয় পর্দার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে শুভ…
হাসোজ্জল মুখে দরজার পানে তাকায় শুভ। ছোট্ট একটা ছায়ার মতোন দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, ছায়াটা কাঁপছে। ভ্রু- কুচকে প্রশ্ন করে শুভ।
“কে ওখানে? রুমে আসেন….”
মাথা নিচু করে রুমে প্রবেশ করে নুহা। পা দুটো তখনো কাঁপছে। কাঁপুনি এতটাই বেশী ছিল যে এক ঠ্যাং আরেক ঠ্যাংয়ের সাথে বার বার লেগে যাচ্ছিল।
বিস্ময়ের সাথে প্রশ্ন করে শুভ-
” কি ব্যাপার? তুমি এই দিন দুপুরে এভাবে কাঁপছো কেন? শীতও তো নেই তেমন আজকে…”
নুহার পিছন পিছন শুভও বাহির হয়ে চলে যাচ্ছিল নামাজের জন্য। পিছু ডাকে ফারহানা।
” বাহ! দারুণ পরিবর্তন। ঠ্যালে ধাক্কা দিয়ে দিয়েও যাকে কি না আগে জুম্মার নামাজের জন্য মসজিদে পাঠানো যেতো না, সে কি না এখন এক কথায় নামাজে চলে যাচ্ছে? সেটাও কি না বাড়ির কাজের মেয়ের কথা’য়….”
শুভ ফিরে তাকায় নুহার দিকে। নুহা দৃষ্টি নিয়ে যায় নিচের দিকে। অতঃপর ঝাপসা চোখে সে স্থান পরিত্যাগ করে।
প্রচন্ড রাগে অগ্নিশর্মা শুভ তেড়ে যায় ফারহানার দিকে। কিছু বুঝে উঠার আগেই ঠাস করে একটা থাপ্পর মারে ফারহানার গালে।
ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মামুন নুহার পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। বাসায় ফিরে যায় নুহা। বাগানের ভেতরের ঐ ঝুপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে শুভ। পিছন থেকে ডাক দেয় মামুনকে। থমকে দাঁড়ায় মামুন। শুভ গিয়ে মামুনের ঠিক সামনে দাঁড়ায়। মেলে ধরে নিজের পরিচয়। লজ্জায়, ভয়ে শুভর দিকে তাকাতে পারছে না মামুন। ধীর গলায় শুভ জানায়,
” ভয় নেই মামুন! নেই কোন লজ্জা। এ ব্যাপারে আমি তোমাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করব না। তবে তোমার প্রতি আমার একটা রিকোয়েস্ট! তোমার জীবনে ওর আগমনটাকে একটা দূর্ঘটনা ভেবে ভুলে যাও। সম্মুখে রঙ্গীন ভবিষ্যৎ তোমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তুমি বরং সেদিকেই এগিয়ে যাও। কারো পিছনে ছুটে জীবনের মূল্যবান সবাইটাকে নষ্ট করো না। বরং জীবনটাকে সুন্দরভাবে গঠন করো। দেখবে একদিন হাজারো তরুণী তোমাকে পাওয়ার স্বপ্ন দেখবে। ভালো থেকো। শুভ কামনা রইল।”
” ঠিক আছে ভাইয়া। আমি আসি। আসসালামু আলাইকুম।”
শুভর থেকে বিদায় নিয়ে মামুন চলে যায়। শুভও বাসায় ফিরে যায়।
দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় নুহা মুখোমুখি হয় শুভর। প্রশ্ন করে শুভকে-
” এভাবে কারণে অকারণে আদনানের গায়ে হাত তুলেন কেন আপনি? কি সমস্যা আপনার?”
শুভর পাল্টা প্রশ্ন-
” তুমি বাসা থেকে বের হয়ে কোথায় দাঁড়িয়ে? কার সাথে? কিভাবে কথা বলো? সে সম্পর্কে আমি কি কখনো তোমাকে প্রশ্ন করেছি?”
দুপুরের কথা মনে হতেই পুরো মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায় নুহার। ঘাবড়ে যায় সে। ভয়ে ঢোক গিলে নুহা। নিচের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল মুচড়াতে মুচড়াতে বলে, আমি আবার কাকাকার সাথে দাদাদাঁড়িয়ে কথা বললাম আজকে?
হাসি আটকে জবাব দেয় শুভ, সেটা তো তুমিই ভালো জানো।
আর কোন কথা বলে না নুহা। নিশ্চুপ হয়ে অপরাধীর ন্যায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে।শুভ রুমে চলে যায়।
রাত্রে সবাই একত্রে খাবার টেবিলে খেতে বসেছে কিন্তু নুহার আসার নাম নেই। শুভর ফুপ্পি হিয়া আদনানকে জিজ্ঞেস করে, কিরে ভাই? আজকে পিরিতের মা’রে ছাড়াই যে খেতে বসলি? পাশ থেকে শুভর প্রশ্ন, হ্যাঁ, তাইতো। নুহা কোথায়? ও আজকে আসলো না যে….!
বিজ্ঞদের মতো উত্তর দেয় আদনান।
” আম্মুর আজকে মন ভালো না। তাই খাবে না…!”
বড়সড় নিশ্বাস ফেলে শুভ। ফিরে তাকায় আদনানের দিকে। আদনান তখন গম্ভীর হয়ে ভাতের উপর আঙুলের রেখা টেনে যাচ্ছে। পিছন দিয়ে ছেলের পিঠে হাত রাখে শুভ। আদনান ফিরে তাকায় বাবার দিকে। একটা মলিন হাসি হেসে শুভ ছেলেকে বলে- “মানচিত্র তো অনেক’ই আঁকলে। এবার খেয়ে নাও বাবা….”
আদনান হাতের প্লেটটা শুভর দিকে ধাক্কা দিয়ে খাবার টেবিল ছেড়ে রুমে চলে যায়। যাওয়ার আগে শুভকে বলে যায়, “তুমি খাও! আমার খিদে নেই….!
কাঁথা গায়ে চুপটি করে শুয়েছিল নুহা। কাঁথা ধরে টানতে থাকে আদনান। “আম্মু! ভাত খাবো।”
কাঁথার ভেতর থেকে মুখ বের করে নুহা। দৃষ্টি যায় আদনানের দিকে। অতঃপর ভেঁজা গলায় জবাব দেয়, ‘যাও, বাবা! খেয়ে নাও তুমি। আমার ভালো লাগতেছে না….
চোখ টিপে কাঁদতে কাঁদতে দরজাটা মিশিয়ে নুহার পাশে এসে শুয়ে পড়ে আদনান। কান্না চলে আসে নুহার। জাপটে ধরে আদনানকে। অনেকক্ষণ এভাবে জড়িয়ে রেখে দু’জনেই খাবার টেবিলের দিকে চলে যায়। খেয়ে নেয় রাতের খাবার।
খাওয়া শেষে শুভ আদনানকে ওর রুমে নিয়ে গেলে নুহা একা শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
মাঝরাত্রিতে আদনানের চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় নুহার। দ্রুত দরজা খুলে। আদনানকে কোলে নিয়ে শুভ তখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে দেয় নুহা। শুভ আদনানকে নুহার দিকে এগিয়ে দিয়ে রুমে চলে যায়। আদনানকে খাটে বসানো হয়। তখনো সে বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। কি দিয়ে কান্না থামাবে সেটাই ভেবে পাচ্ছে না নুহা।
” বাবা! শিমের বিচি খাইবা?”
আদনান মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ-বোধক জানান দিলে নুহা রুমে থাকা ভাঁজা শিমের বিচি থেকে কিছু বিচি এগিয়ে দেয় আদনানের দিকে।
ঘুমে ঢুলুঢুলু নুহা আদনানকে শিমের বিচি দিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে আদনানের পাশেই কাঁথা জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে ছোট্ট আদনান ছোট ছোট ইঁদুরের মতো দাত দিয়ে কুটকুট করে শিমের বিচি খাওয়া শুরু করে। প্রায় ৩০মিনিটের মতো আদনান শিমের বিচি খায়। মিনিট ত্রিশেক পর শিমের বিচি খাওয়া শেষে আরো বিচি বিছানায় পড়েছে কি না সেটা দেখার জন্য হাতড়াতে থাকে। ঘুম ভেঙ্গে যায় নুহার। ফিরে তাকায় আদনানের দিকে।
‘ বাবা! খাওয়া হয়েছে?’ আদনানের ছোট্ট জবাব, হু…
নুহা আদনানকে টেনে ওর পাশে শুয়ে দিয়ে গায়ে কাঁথা জড়িয়ে দেয়। মিনিট পাঁচেক পরের ঘটনা। নুহার চোখটা মাত্র লেগে এসেছিল। তখনি আবারো সেই কুটকুট আওয়াজ…!
চোখ থেকে ঘুম চলে যায় নুহার। প্রশ্ন করে আদনানকে, ‘আদনান! তুমি না বলছ বিচি খাওয়া শেষ?’
প্রতিউত্তরে কিচ্ছু বলেনি আদনান। চুপচাপ শুধু শিমের বিচি খেয়েই যাচ্ছে….!
তখন বিছানা হাতড়িয়ে কি তাহলে এই বিচিগুলোই পেয়েছিল….!
শব্দ করে হেসে উঠে নুহা….
পরদিন ছিল শুক্রবার। শুক্রবার ছুটির দিন। নুহাকে কলেজে যেতে হবে না। আর সেজন্যই বোধ হয় কোন রকম ব্রেকফাস্টটা সেরে নুহা বেরিয়ে পড়ে আদনানকে কোলে নিয়ে। বোরকা গায়ে নুহা আদনানকে নিয়ে পুরো এলাকা চষে ফেলেছে। ফেরার পথে এক মহিলার হাতে লিচুর প্যাকেজ দেখে আদনান কান্না করা শুরু করে-
” আম্মু! লিচু খাবো। আম্মু লিচু খাবো…..!”
নুহা আদনানকে সান্ত্বনা দেয়ার বৃথা চেষ্টা করছে-
” বাবা! বাসায় চলে আসছি। লিচু পাবো কোথায় এখন? তারচেয়ে বরং ভিতরে চলো। আঁখি আন্টিকে বলি গিয়ে। ওনি তোমাকে লিচু এনে দেবে।”
আদনান কিছুতেই সান্ত্বনা মানতে রাজি নয়। লিচু,লিচু করতে করতে নেমে যায় কোল থেকে। দৌঁড়ে চলে যায় রাস্তার ওপাশে হুইলচেয়ালে বসে থাকা মহিলাটির কাছে। আবদার করে-
“আমারে একটা লিচু দিবা….?”
মহিলাটি চোখ থেকে চশমাটা নামিয়ে ঝাপসা চোখে ফিরে তাকায় আদনানের দিকে। অতঃপর হাতের থাকা লিচুর প্যাঁকটা বাড়িয়ে দেয় আদনানের দিকে। রাস্তার এপাশ থেকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল নুহা। তার আগেই কোথায় থেকে যেন উদয় হয় শুভ। আদনানকে একটা বিকট ধমক দিয়ে মহিলাটির দিকে ছুড়ে মারে লিচুর প্যাকেজ। প্যাকেজটি মহিলাটির পায়ের নিচে গিয়ে পরে। আদনান আবারো লিচুর জন্য কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। শুভ আদনানকে জোর করে কোলে নিয়ে বাসার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এদিকে প্রচন্ড লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যাচ্ছে নুহা। প্রশ্ন করে শুভকে, আপনি ভদ্রমহিলার সাথে এমন না করলেও পারতেন….!
ভয়ানক দৃষ্টি নিয়ে শুভ নুহার দিকে ফিরে তাকায়। ভয়ে ঢোক গিলে নুহার জবাব, না মানে ওনি তো যেচে এসে লিচু সাধেননি কাউকে….!
শুভর কঠোর জবাব, ওনার সাধার ধরণটা অন্য রকম। আর কি যেন বলছিলে? ভদ্রমহিলা? আজকাল ছেলেধরা’রা এরকমই ভদ্রতার মুখোশ পরে আসে। আর একটাও কথা হবে না। রুমে চলো…!
পিছন থেকে ভেসে আসে ভদ্রমহিলার কন্ঠে শুভ নামের প্রতিধ্বণি।
থমকে যায় নুহা। ডাক দেয় শুভকে। এই শুনোন না। ওনি তো আপনার নাম ধরেও ডাকছে…
প্রচন্ড রাগে গর্জে উঠে শুভ। দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে নুহাকে, আমি ঐ বাজে মহিলার সম্পর্কে কোন কথায় শুনতে চাচ্ছি না নুহা। তুমি বাসায় ঢুকবে কি না….!
আর কোন কথা বাড়ায়নি নুহা। শুভর পিছুপিছু বাসায় ঢুকে পরে।
বিকেলে ড্রয়িংরুমে বসেছিল নুহা। ভদ্রমহিলার প্রতি সকালে শুভর আচরণটা কেন জানি অদ্ভুত ঠেকছিল নুহার কাছে। আর তাই ডায়েরী হাতে ভদ্র মহিলার সম্পর্কে দু’কলম লিখার চেষ্টা করছে-
” আটসাট গড়ন। লম্বা টিকালো নাক। কথা বলত কাটা কাটা। খুব চটপটে। বয়স হয়েছিল ঢের। কিন্তু বয়সের ছাপ ছিল না…!”
পুরো ঘটনা লিখতে পারেনি নুহা। তার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। কিচেন থেকে হিয়া আন্টির গলার স্বর ভেসে আসে।
” আদিরা! দেখতো মা কে এসেছে….?”
নুহা দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলে। স্তব্ধ নুহা দরজার ওপাশের মানুষটাকে দেখে যেন কথা বলার শক্তি হারিয়েছে। কোন কথায় ওর মুখ থেকে বের হচ্ছে না। ড্রয়িংরুম থেকে ভেসে আসে আঁখির গলা-
” কিরে? কে এসেছে….?”
ভয়ার্ত গলায় নুহার জবাব, ছেছেছেলে ধরা….
রেজাল্ট দিলো। 4.83 পেয়ে উত্তীর্ণ হলো নুহা। বিদায়ের মুহূর্ত ঘনিয়ে এলো। সেদিন ছিল স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠান। বিদান অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র নুহাকে খাওয়ানোর জন্য মামুন ষাট জন ছাত্র ছাত্রীকে চকোলেট খাইয়েছিল। কিন্তু নুহা চকোলেট নেয়নি।
পরীক্ষা শুরু হলো। দেড় বছরের ছোট্ট আদনানের বয়স তখন চার বছরে দাঁড়ায়। এসএসসি পরীক্ষার প্রাক্কালে নুহার রুটিন করা কিছু কাজ ছিল।
সেগুলো হলো- তিনবেলা নিয়ম করে খাওয়া, গোসল, পড়াশুনা আর নিয়ম করে ঘুমানো। এর ছাড়া নুহার বেশি কোন কাজ ছিল না। নুহা যখন পড়ত, আদনান তখন চুপ করে নুহার কোলে এসে বসে থাকত। কখনো বা নিজেও স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ বই নিয়ে এসে নুহার পাশে বসে পড়তো। শুভ দুর থেকে নুহার গতিবিধি লক্ষ্য রাখতো। লক্ষ্য রাখতো আদনান নুহাকে ডিস্টার্ব করছে কি না…!
পরীক্ষা শুরু হলো। পরীক্ষার আগমুহূর্ত শুভ নুহাকে পড়াশুনার জন্য এক নতুন রুটিন করে দেয়। যেখানে পড়াশুনার চেয়ে নুহার দৈহিক সুস্থতাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। রুটিনে স্পষ্ট লিখাঃ-
” ভালো ভাবে পরীক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বশর্ত তোমার দৈহিক সুস্থতা। আর সেই দৈহিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজন নিয়ম মেনে চলা। এক্ষেত্রে ঠিক মতো খাওয়া, গোসল আর ঘুমের কোন বিকল্প নেই। তুমি একজন বুদ্ধিমতি এবং মেধাবী ছাত্রী। আশা করি, পরীক্ষার আগমুহূর্তে বই নিয়ে কোমর বেধে লেগে পরে, নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিবে না। মস্তিষ্ককে বিরাম দাও। সফল হয়ে ফিরে এসো….”
হ্যাঁ, নুহা সফল হয়েই ফিরে এসেছে।
বইয়ের সাথে পূর্বসংযোগ থাকায় নুহাকে পরীক্ষার দিনগুলোতে কোমর বেধে লাগতে হয়নি। অন্যান্য দিনের মতই স্বাভাবিক নিয়মেই নুহা ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করে, খানেকক্ষণ কুরআন তেলওয়াত করেছে। অতঃপর পুরো বইয়ে একবার চোখ বুলিয়ে, সকলের থেকে দোয়া নিয়ে, আল্লাহর নাম নিয়ে বেরিয়ে যেতো রুম থেকে। এভাবেই নুহা ওর পরীক্ষাগুলো দেয়।
দু’মাস পর রেজাল্ট দেয়া হয়। নুহা জি.পি.এ-০৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয় এসএসসিতে। নুহার সাফল্যে সবাই খুব খুশি। শুভও খুশি। অফিসে বসে নেট থেকে রেজাল্ট জেনে নেয় সবার আগে। অতঃপর দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে মিষ্টির দোকানে চলে যায়। মিষ্টি শুভ আগেই অর্ডার দিয়ে রেখেছিল। শুভ যাওয়ার পর মিষ্টি বিক্রেতা প্যাকগুলো শুধু গাড়ির মধ্যে উঠিয়ে দেয়। নুহার সাফল্য উপলক্ষ্যে পুরো মহল্লায় মিষ্টি বিতরণ করা হয়।
মিষ্টি এবং হিয়া আন্টিকে সাথে করে নুহা দাদীমা এবং ছোট ভাইকে দেখতে যায়। ওখানে গিয়ে দেখতে পায় আরো বড় সড় উৎসব করে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে পুরো গ্রামে। নুহার ছোট ভাই নীলয় সেও এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। এটা তারই মিষ্টি। পরীক্ষার ব্যস্ততার জন্য অনেকগুলো মাস নুহা কিংবা নীলয় একে অপরের সাথে দেখা করতে পারে নি। মিষ্টি হাতে নুহাকে দেখতে পেয়ে কি যে খুশি হয় নীলয়, তা বলে বুঝানো যাবে না।
নীলয় ভিষণ মিষ্টি প্রিয়। প্রচুর মিষ্টি খায় ও। এই জন্য দাদীমার বকাও খায় অনেক। নুহাকে মিষ্টি হাতে দেখে হাত থেকে একটা কার্টুন নিয়ে নেয় সে। দেখতে দেখতে, চোখের পলকে কার্টুনের অর্ধেক মিষ্টি সাবাড় করে ফেলে নীলয়।
হেসে দেয় হিয়া। কাছে গিয়ে মুখটা মুছে দিয়ে প্রাণের বান্ধবী নীলিমার ছেলে নীলয়কে জড়িয়ে ধরে হিয়া। চুমু খায় কপালে।
হাসি মুখে নীলয় জানায়, আন্টি! আমি না পাস করেছি। ট্রিপল-4 পেয়েছি।
শব্দ করে হেসে দেয় নুহা। ট্রিপল-4? সেটা আবার কেমন রেজাল্টরে?
গর্বিত ভঙ্গিতে নীলয়ের জবাব, আরে তুই বুঝবি না। এটা আমার নতুন আবিষ্কার। ট্রিপল- 4 মানে 4.44………..
নুহা এবং হিয়া দু’জনেই হা, হা করে হেসে দেয়।
কলেজে ভর্তি উপলক্ষ্যে স্কুল থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র নিয়ে শুভদের বাসায় ফিরছিল নুহা। পথ আগলে দাঁড়ায় মামুন। থমকে যায় নুহার পথ চলা। ফিরে তাকায় মামুনের দিকে। বিনীত ভঙ্গিতে মামুন নুহার হাতে একটা খামবিহীন ভাঁজ করা চিঠি তুলে দেয়। নুহা চিঠিটা গ্রহন করলে মামুন দ্রুত সে স্থান প্রস্থান করে।
নুহা পড়ার টেবিলে বসে বসে হাদিস বইয়ের পাতা নাড়ছিল। পড়া আর হলো না। শুধু সময় অতিবাহিত হতে লাগল। নুহার মন পড়ায় নয়, ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে রাখা হাতের ঐ চিঠিটার দিকে আছে। মামুন কি লিখেছে তাতে, এটা দেখার জন্য ওর যত ব্যাকুলতা। কিন্তু পাছে কেউ দেখে ফেলে সেই ভয়ে চিঠিটা খুলতেও পারছে না। সন্ধ্যার দিকে নুহা একা টেবিলে বসে ছিল। রুমেও কেউ ছিল না। নুহা ভাবলো এটাই সুযোগ। এই সুযোগকে হেলায় নষ্ট করতে নারাজ সে। আবারো নুহা চারিদিকটা ভালো করে পরখ করে নিল। না, কোথায় ও কেউ নেই। নুহা দ্রুত ওড়নার আড়াল থেকে হাতটা বের করলো। মেলে ধরলো চিঠিটা চোখের সামনে। নুহা মনোযোগ সহকারে পড়তে লাগল মামুনের না বলা কথাগুলোঃ-
নুহা,
প্রথমেই আমার শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা গ্রহন করিও। তুমি যে খুব ভালো আছো তা তোমার চোখেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আমি ততটা ভালো নেই। যতটা ভালো থাকলে মন খুলে দুটি কথা বলা যায়। তোমার ঐ হৃদয়হরণকারী আঁখিদ্বয় আমার হৃদয়ে বার বার হানা দেয় তোমায় কিছু বলার জন্য। হয়ত তাই কাগজের বুকে কিছু না বলা কথা এঁকে দিলাম।
জানি আমার ভালো থাকা আর না থাকা নিয়ে তোমার কোন ভাবনা নেই। আর থাকবেই বা কেন? আমি তোমার কে? আর তুমিই বা আমার কে? হয়ত এই প্রশ্বদ্বয় তোমার মনের ঘরে কড়া নাড়তে পারে। কিন্তু তোমাকে ছাড়া যে আমার চলবে না। বল আমি এখন কি করব? কি করণীয় আমার?
একজোড়া চোখ দেখেই তোমাকে আমার ভালো লেগেছিল। আর প্রতিনিয়ত দেখতে দেখতে একসময় নিজের অজান্তে মনের ঘরে তোমায় ঠাঁই দিয়ে ফেলি। তাই তোমার ভালোবাসা পাবার জন্যই আজ আমি তোমার শরণাপন্ন হলাম।
বিশ্বাস করো নুহা, আমি তোমায় ভুলে যেতে চেয়েছি বার বার। দিবানিশি সারাক্ষণ চেষ্টা করেছি তোমায় ভুলে থাকতে। কিন্তু পারলাম না। তোমার কাছে ফিরে আসতেই হলো। এবার তুমিই বলে দাও-
কি করতে পারি আমি? এমন পরিস্থিতিতে কি করা যায়? নুহা, আমি তোমায় বলবো না যে, আমায় ভালোবাসতেই হবে। কারণ আমি জানি জোর করে ভালোবাসা হয় না। তবে শুধু এইটুকু জেনো, আমি তোমায় ভীষণ, ভীষণ ভালোবাসি। তাই বলছি, যদি পারো আমায় সামান্যতম ভালোবাসা দিও। তোমার ভালোবাসা দিয়ে আমার অশান্ত মনকে শান্ত করে দিও।
ইতি,
মামুন।
চিঠি পড়ে মেজাজ পুরো গরম হয়ে গেছে নুহার। রাগ উঠে যায় নুহার। সেই মুহূর্তেই রুমে আসে আদনান। চিকন এবং টানা টানা স্বরে বলে উঠে,
“আম…..মু… কি ক……রো……”
ডাক শুনে কলিজা জড়িয়ে যায় নুহার। সমস্ত রাগ নিমিষেই পানি হয়ে যায়। নিজের কাছে টেনে নেয় আদনানকে। জড়িয়ে ধরে কপালে, গালে চুমু খায়।
অতঃপর চিঠির জবাবসরূপ কাগজের বুকে এঁকে দেয়-
” আমি বিবাহিতা, মামুন।”
পরদিন কলেজ থেকে ভর্তির কাজ সেরে ফিরছিল নুহা। আগের দিনের মতই পথ আগলে দাঁড়ায় মামুন। ভয় পেয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে নুহা। কারণ, এই মুহূর্তে নুহা ঐ বাসায় সামনেই দাঁড়িয়ে, যে বাসায় ও বিগত কয়েক বছর ধরে আছে।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। নুহার পথ আগলে দাঁড় করানো হয় শুভদের বাসার সামনেই। শুভর নিজস্ব বাসা এটা। শুভর বাবা নেই, মা নিজের সুখের জন্য অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছেন। মায়ের বিয়ের পর শুভ হয়ে গিয়েছিল একা। হিয়া তাই একমাত্র ভাইয়ার ছেলে শুভর সুষ্ঠুভাবে বেড়ে উঠা ও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে স্বামী সন্তান নিয়ে ভাইয়ার বাসায় উঠেছে। নুহও সেই বাসায়’ই থাকে।
ভয়ে যখন নুহার কলিজা শুকানোর উপক্রম, পাশ থেকে তখনই মামুনের তাড়াঃ-
” আমার চিঠির জবাব চাই….
ভালোবাসো কি না সেটা বলো?”
নুহা ব্যাগ থেকে চিরকুট’টা বের করে কাঁপা হাতে সেটা এগিয়ে দেয় মামুনের দিকে। যাতে লিখাঃ-
” আমি বিবাহিতা, মামুন।”
চিঠি পড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় মামুন। যেন সে কথা বলার ভাষা হারিয়েছে। বহুকষ্টে মামুন ফিরে তাকায় নুহার চোখের দিকে। মনে মনে বলেঃ-
” না। এ চোখ তো মিথ্যে বলছে না। তবে সত্যটাকে মেনে নিতে আমার কেন এত কষ্ট হচ্ছে? তবে কি আমার বুঝার ভুল হচ্ছে কোথায় ও? ও কি আমায় মিথ্যে বলছে? কিন্তু ও তো নামাজী এবং পর্দানশীন মেয়ে। আমায় কি ও মিথ্যে বলবে? যাক। জিজ্ঞেস করেই দেখি….”
মামুন ফিরে তাকায় নুহার দিকে।
” নুহা, তুমি কি আমার সাথে মজা করতেছ? তুমি তো নামাজ পড়ো। তুমি কিভা…”
পুরো কথা বলতে পারেনি মামুন। গেইটের ভেতরের বাগান থেকে দৌঁড়ে আসে আদনান। জাপটে ধরে নুহাকে। নাকের পানি, মুখের পানি নুহার বোরকায় মুছতে থাকে আর কান্না করতে থাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠে-
” আম্মু, আব্বু আমায় মেরেছে।”
ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে যায় মামুন।
“নুহা তোমার বা বা…..”
কোলে তুলে নেয় নুহা আদনানকে। আদনানের গালের সাথে গাল মিশিয়ে স্মিতহাস্যে বলে উঠে-
” জ্বি, আমার বাচ্চাও আছে…….”
” ইঁদুর মারার যন্ত্রগুলো বিছানায় রাখা। আর তার পাশেই বসে ভিতর থেকে কলা বের করে চপচপ করে কলা খাচ্ছে নুহা…..”
খোলা জানালা দিয়ে ভিতর পানে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিল শুভ। একে একে তিনটা মেশিন থেকেই কলা বের করে খেয়ে নিয়েছে নুহা। খাওয়া শেষে অত্যন্ত সংগোপনে নুহা ইঁদুর মারার যন্ত্রগুলো পূর্বের স্থানে রেখে দেয়। তারপর চুপ করে লাইটটা অফ করে ড্রিম লাইটের আলোয় আদনানের পাশে শুয়ে পরে। শুভও ভিষণ সাবধানে সে স্থান পরিত্যাগ করে।
সকালে স্টাডি রুমে পড়তে বসছিল নুহা। তখনি ড্রয়িংরুমে ডাক পড়ে ওর। ডাক দিয়েছে শুভ। ছুটে যায় নুহা। ইঁদুর মারার তিনটা যন্ত্র’ই সামনে নিয়ে বসে আছে শুভ। তার পাশে বসেছে হিয়া আন্টি।
বিনীত ভঙ্গিতে মাথা নীচু করে নুহা গিয়ে দাঁড়ায় হিয়া আন্টির পাশেই।
প্রশ্ন করে শুভ, তিন তিনটে কলা দিয়ে আসছিলাম যন্ত্রের ভিতর। একটা যন্ত্রেও কলা অবশিষ্ট নেই। তো ইঁদুর কোথায় যন্ত্রের?
প্রশ্ন শুনে নুহার পুরো মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। আসলে কি বলবে সেটাই বুঝতে পারছে না ও।
পাশ থেকে শুভর তাড়া, তাড়াতাড়ি বলো। ইঁদুর কোথায়?
ঢোক গিলে নুহা। আঙ্গুল দিয়ে নিজের দিকেই নির্দেশ করে। চমকে যায় হিয়া। প্রশ্ন করে নুহাকে, নুহা! তোকে জিজ্ঞেস করছে ইঁদুরের কথা, তোর কথা নয়।
নিচের দিকে তাকিয়ে ধীর গলায় নুহার জবাব, আমি মিছে কথা বলি না আন্টি।
কিচ্ছু বলেনি শুভ। নুহাকে শুধু ভেতরে যেতে বলল। নুহা চলে গেলে শুভ ওর ফুপ্পির সাথে রাতের ঘটনাটা শেয়ার করল।
হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গেছে হিয়ার। ‘Oh, my god!’ একি শুনালি তুই? এটাও শুনার ছিল?
হাসছিল শুভও। হাসি থামিয়ে জবাব দেয়, বড় ইঁদুর বিছানায়’ই বসে ছিল। আমি সেটা জানতাম না। উৎ পেতে ছিল কখন রাত্রি গভীর হবে।
হাত ইশারায় হিয়ার জবাব, আর বলিস না বাপ। আমি আর পারছি না…..
সকালে স্কুলে যাচ্ছিল নুহা, পথ আগলে দাঁড়ালো আদনান। “আমু যাম, আমু যাম, আমু যাম….”
শুভ, আঁখি, হিয়া কিংবা ওর হাজবেন্ড কেউ পারেনি আদনানকে শান্ত করতে। কান্নাজড়িত কন্ঠে ওর একটাই জবাব, “আমু যাম, আমু যাম….!”
বাধ্য নুহা কোলে তুলে নেয় আদনানকে। কোলে উঠে কান্না করতে করতেই নুহার বোরকার মুখোশ ধরে টানতে থাকে আদনান। নুহা একটা সেফ্টিপিন খুলে আদনানকে ওর মুখ দেখায়। মিটে যায় আদনানের কৌতূহল, থেমে যায় কান্না। পাশ থেকে সেফ্টিপিনটা যথা স্থানে লাগিয়ে দেয় আঁখি। আদনানকে কোলে নিয়ে নিচে যেতেই দেখতে পায় রিক্সাওয়ালা দাঁড়িয়ে। বিলম্ব না করে নুহা রিক্সায় গিয়ে বসে।
মিনিট দশেক পর কাঙ্খিত স্থানে গিয়ে পৌঁছে নুহা। কোল থেকে আদনানকে নামিয়ে রেখে ভাড়া মিটিয়ে আদনানের ছোট আঙুল ধরে স্কুলের গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে।
বাচ্চা কোলে নিয়ে কমন রুমের কর্ণারের একটা ছোট্ট বেঞ্চিতে বসে ছিল নুহা। আলাপ জমে উঠেছিল দুজনের মধ্যে। পাশে এসে দাঁড়ায় কিছু মেয়েরা। পরিচিত হয় নতুন ক্লাসমেট নুহার সাথে। দৃষ্টি যায় আদনানের দিকে। আদনানের নিষ্পাপ চাহনি আর আধো আধো বুলি বিমোহিত করল ওদের। কোলে নেয়ার টানাটানি করতে থাকে মেয়েরা। কেউ কেউ তো আদনানের মাংসালু গোল গাল দুটো ধরে টানতে থাকে।
” আমু মারে, বলে চিৎকার দিয়ে উঠে আদনান।”
চমকে যায় মেয়েরা। প্রশ্ন করে নুহাকে,
– নুহা তুমি বিবাহিতা?
সম্মতি সূচক জবাবসরূপ মাথা ঝাকায় নুহা।
” ওয়াও! আমরা খালামনি হয়ে গেছি। ওলে বাবাটা আসো…..”
আবারো মেয়েরা টানাটানি করতে থাকে আদনানকে নিয়ে।
এভাবেই নুহা নতুন স্কুলের নতুন সহপাঠীদের সকলের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছিল। জুটিয়ে ফেলেছিল অনেকগুলো বান্ধবী।
নুহাদের ব্যাচে চল্লিশজন মেয়ে আর বিশজন ছেলে ছিল। বেশির ভাগ মেয়ে বোরকা পরত।
নবম শ্রেণীর ফার্স্ট বয় ছিল ‘মামুন’। একদিন মামুনকে ওর সহপাঠী মিনহাজ বলল, দোস্ত, ক্লাসে কয়েকজন সুন্দর মেয়ে আছে, লক্ষ্য করেছিস?
মামুন বলল, না।
পরদিন মিনহাজ মামুনকে তাদের দেখালো। তাদের মধ্যে একজনের চোখে মামুনের চোখ স্থির হয়ে গেল। পর্দা করার কারণে তার চেহারা দেখার উপায় ছিল না। চোখ দুটো ছিল অসাধারণ। সেই চোখ মামুনকে খুন করল। যেন নীরব ঘাতক। অনেকটা ইজিপটের রানি ক্লিওপাট্রার মতো। যার চাহনির কাছে হার মেনেছেন রোম সম্রাট সিজার ও পরে অ্যান্টনি। এমনকি অক্টোভিয়া যখন ক্লিওপাট্রার সঙ্গে কথা বলতেন তখন মেঝের দিকে চোখ রেখে কথা বলতেন। তার ধারণা ছিল, তিনি যদি ক্লিওপাট্রার চোখের দিকে তাকান, তবে সঙ্গে সঙ্গে তার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে।
কিছুদিন যাওয়ার পর মামুনের মনে হলো সে যেন কিছু হারিয়ে ফেলেছে। হৃদয়ের প্রতিটি কোণে বোরকা পরা সেই মেয়েটির উপস্থিতি টের পাচ্ছিলো। মামুন বুঝলো, এরই নাম প্রেম। অনেক চেষ্টা করেও মামুন মেয়েটিকে তার ভালোবাসার কথা বুঝাতে পারেনি। চিঠি লিখে কাজিনের মাধ্যমে পাঠালো।
চিঠিতে লিখলোঃ-
“তোমাকে দেখার পর থেকে কিরকম পাল্টে গেল আমার আকাশ। সেখানে এখন শুধু চাঁদের বদলে তুমি উঠো, আর একটাই উঠে সন্ধ্যা তারা, সেও তুমি। বইগুলো খুলে দেখি সব গ্রন্থ জুড়ে শুধু এই একটাই শব্দ তাতে লেখা- তোমাকে দেখার পর অসম্ভব বদলে গেছে আমার ভুবন, বদলে গেছে জলবায়ু, দিন রাত্রি, ঋতু।”
চিঠিটা পৌঁছে দেয়া হলো নুহার হাতে। হ্যাঁ, নুহাই সেই মেয়ে, যার এক জোড়া চোখের কাছে হার মেনেছে একটি হৃদয়। চিঠি পড়ে নুহা খুব রাগ করল। মামুন ভয়ে ছিল, যদি প্রধান শিক্ষকের কাছে বলে দেয়। কিন্তু নুহা বলেনি। স্রস্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালো মামুন, প্রথমবারের মতো বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য।
ক্লাসে কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিল না মামুন।
কয়েকদিন পর আবার কবিতা লিখে পাঠালোঃ-
” রাগ করে একটি কথাও যদি বলো
ফেনিল সাগরে আমি ঝাপ দেবো,
ঘৃণা করে একটি কথাও যদি বলো
সহস্র ঘুমের বড়ি একসঙ্গে খাবো।
আমি শুধু ভালোবাসা চাই মেয়ে
অন্য কিছু নয়।”
অনেক আশা করেছিল মামুন, নুহা পজিটিভ উত্তর দেবে। কিন্তু নুহা কোনো উত্তর দিলো না। খুব কষ্ট পেলো মামুন স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেখে।
এক প্যাকেট সিগারেট কিনে তখনি সাবাড় করল।
নুহার ক্ষতির কোনো চেষ্টা করল না। কেননা সে শুনেছে, যাকে ভালোবাসা যায়, তার ক্ষতি করা যায় না। কারণ, প্রিয়ার দেয়া কষ্টগুলো প্রিয়ার মতোই প্রিয়।
সামনে বার্ষিক পরীক্ষা। তাই পুরোদমে পড়াশুনা শুরু করলো মামুন। এমনও রাত গেছে, পড়তে পড়তে সকাল হয়ে যেত। একটুও ঘুমাতো না। যখন রাতে বিদ্যুৎ থাকতো না, তখন রাস্তায় ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে পড়ত।
ডিসেম্বরের ৩১তারিখ রেজাল্ট বের হলো। চার নাম্বারের জন্য প্রথম হতে পারলো না মামুন। ১ম স্থান অধিকার করেছে নুহা।
দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন দিন অতিবাহিত হয়ে যায়। ঘনিয়ে আসে নুহার টেস্ট পরীক্ষার সময়। পূর্বেকার মতই বোরকা পরে, মুখ ঢেকে হলে উপস্থিত হয় নুহা। পরীক্ষা আরম্ভ হলো। স্কুলে নতুন যে শিক্ষকটি এসেছেন, ওনার গার্ড পরলো নুহাদের রুমে। খাতা সাক্ষরের সময় এডমিট কার্ডের সাথে নুহার মুখটা মিলিয়ে দেখতে চাইলে বাঁধ সাধে নুহা। ও কিছুতেই ওর এডমিট কার্ডের ছবি এবং ওর মুখ কোনো পর পুরুষকে দেখাতে রাজি নয়। রাগান্বিত শিক্ষক একসময় একটা জ্বালাময়ী মন্তব্য ছুড়ে দেয় নুহার দিকে। প্রশ্ন করে নুহাকে-
” তোমার ছবি কি তোমার জামাইরে দিয়ে উঠাইছো?”
স্তব্ধ হয়ে যায় নুহা। সেই সাথে নিস্তব্ধ হয়ে যায় পুরো রুম। সবার দৃষ্টি নুহার দিকে। নুহার চোখ দুটো ছলছল করে উঠে। তবুও অনেকটা স্বাভাবিক কন্ঠে শিক্ষককে জানায়, স্যার! আপনি মেডামকে বলেন। আমি ওনাকে মুখ দেখাচ্ছি। রাগে খাতা ছুড়ে দিয়ে পিছনে চলে যায় শিক্ষকটা। পিছনে গিয়ে অপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেডামকে জানায়, মেডাম, আপনি ঐ মেয়েটাকে একটু চেক করে আসুন।
মেডাম সামনে এসে দাঁড়ালে নুহা মেডামকে ওর কাছে ডেকে আনে। মুখটা আংশিক ফাঁক করে মেডাম বলে, “এই যে মেডাম! আমার এডমিট কার্ড আর আমি। মিলিয়ে দেখুন।”
স্মিতহাস্য মেডামের জবাব, ইটস ওকে। ঢাকতে পারো মুখ। কষ্ট পেয়ো না তুমি। আসলে এটা নিয়ম।
বিনীত ভঙ্গিতে নুহার জবাব, জ্বি, ম্যাডাম। বুঝতে পারছি আমি।
পাশ থেকে মামুনের জবাব, মেডামের ঐ স্যার কি হিন্দু? জিহ্বায় কামড় দেয় ম্যাডামটা। ধীর গলায় বলে, ‘আরে না! ওনি মুসলমান। ‘
দাঁতে দাঁত চেপে মামুনের জবাব, একজন মুসলমান হয়ে আরেকজন মুসলমানকে কিভাবে ওনি এমনভাবে আঘাত করতে পারলেন? মামুনের সাথে তাল মিলিয়ে অন্যান্য স্টুডেন্টসরাও একই কথা বলা শুরু করে।
কথা বাড়াননি মেডাম। কোনো মতে, দ্রুত সে স্থান পরিত্যাগ করেন।
(বিঃদ্রঃ- বাচ্চা মানুষ, বকা ঝকা দিও না বন্ধুরা। কেঁদে দেবো তাহলে। পরীক্ষা শেষ। পরের দুই পরীক্ষা একমাস পর হবে। তাই আশা করা যায়, আপনারা আপনাদের গল্প এখন থেকে নিয়মিত’ই পাবেন, ইনশআল্লাহ।)
মোনাজাত শেষে নুহা কোরআন শরিফ নিয়ে। গুন গুন করে কুরআন তেলাওয়াত করা শুরু করে সে।পাশে বসা ছোট্ট আদনান মিনিট পাঁচেক চুপ করে ছিল। মুখ খুলে এবার। নুহার মতই গুন গুন করে কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে সে। সে আওয়াজ শুনে চোখ তোলে তাকায় নুহা। আদনানকে দেখেই স্মিতহাস্য নুহা পবিত্র কোরআন বন্ধ করে দেয়। কোরআন শরিফের গায়ে চুমু খেয়ে সেটা যথা স্থানে রেখে আদনানের গালেও একটা চুমু খায়। জায়নামাজটা যথা স্থানে রেখে কোলে তুলে নেয় আদনানকে। দরজার দিকে এগুতেই থমকে যায় সে। দরজার পর্দাটা আংশিক ফাঁক করে একজোড়া চোখ ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চক্ষু দুইটা কার সেটা চিনে নিতে খুব বেশী কষ্ট পেতে হয়নি নুহার। আর তাই দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয় সে।
প্রচন্ড ভয়ে নুহা যখন ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে, কিচ্ছু না বলে শুভ তখন সে স্থান ত্যাগ করে।
দুপুরে খাওয়ার পর সবকিছু গুছিয়ে রান্নার দাদীমা যখন চলে যায় তখনই আদনান মারফত শুভ নুহাকে ডাক পাঠায়। আদনান নুহার কাছে খবরটা এভাবে পৌঁছায় – “আমু (আম্মু) বাবাই যাইতা। আমু (আম্মু) বাবাই যাইতা।”
হেসে দেয় নুহা। বাবা! আমার নাম নুহা। আমাকে তুমি আন্টি ডাকবা।
‘ ই- তুমি আন্নি না। তুমি আমু(আম্মু)। তুমি আমু(আম্মু)। তুমি আমু(আম্মু)। তুমি আমু(আম্মু)
গম্ভীর গলায় নুহা জানায়, না বাবা! আমি তোমার আন্টি হই। আমাকে তুমি আন্টি ডাকবা। আন্টি। শুনোনি, তোমার বাবাই কাল কি বলেছে? বলেছে আমায় আন্টি ডাকার জন্য। আমায় আন্টি না ডাকলে ওনি বকবে তোমায়….!
‘ তুমি আন্নি না। তুমি আমু। তুমি আন্নি না, আমু।’
উফ্….. ব্যর্থ নুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আদনানের একটা হাত ধরে সে। ‘ ঠিক আছে, ডেকো।’
এবার চলো তো। দেখে আসি কে ডাকে?
রুম থেকে বের হতেই শুভর মুখোমুখি হয়।
দাঁড়িয়ে পড়ে নুহা। রাগান্বিত দৃষ্টিতে শুভ তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ভয়ে ভয়ে নুহা শুভকে সালাম দেয়, আসসালামু আলাইকুম….
প্রতি উত্তরে শুভর জবাব ছিল, সমস্যা কোথায় তোমার? কি চাও তুমি?
কিছুটা অবাক হয় নুহা। উত্তরে জানায়, কই? আমার তো কোনো সমস্যা নেই…!
” ওহ, হ্যা! তাইতো… তোমার তো কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা তো আমার। আর সেই সমস্যা সমাধানের জন্যই তোমার কাছে আসা।”
জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে নুহা ফিরে তাকায় শুভর দিকে।
অনেকটা আক্রোশের সাথে শুভর জবাব, অনুগ্রহ করে আদনানকে কোল থেকে নামাও। ওর ঘুমের সময় হয়েছে, আমি এখন ওকে ঘুম পাড়াবো।
নুহা আদনানকে কোল থেকে নামিয়ে দেয়। ছুঁ মারার ন্যায় তখনি শুভ আদনানকে কোলে তুলে সে স্থান ত্যাগ করে।
এক রাতের ঘটনা_
খাইয়ে দাইয়ে আদনানকে ঘুম পাড়িয়েছিল শুভ। মাঝ রাত্রে ঘুম ভেঙ্গে যায় আদনানের। চিৎকার করে বিছানায় উঠে বসে। ঘুম ভেঙ্গে যায় শুভর। কোলে তুলে নেয় ছেলে আদনানকে। পুরো রুম জোড়ে ঘুরতে থাকে আর কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করে সে। কান্না থামার পরিবর্তে দ্বিগুন বেড়ে যায় আদনানের। কোল থেকে নামিয়ে বিছানায় বসায় শুভ আদনানকে। বাজার থেকে কিনে আনা ডিম আর ফলমূল সামনে রাখে। এতেও কান্না থামানো যাচ্ছে না। কান্নার শব্দ আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। পাশের রুম থেকে ছুটে আসে শুভর ফুপ্পি হিয়া। কোলে তুলে নেন ভাই পুত্রের ঘরের নাতি আদনানকে। জিজ্ঞেস করেন, ভাইয়া কি হয়েছে? কান্নায় নাক মুখের পানি একত্রিত হয়ে গেছে আদনানের। সেই অবস্থায়’ই বলতে থাকে সে, নু আমু যাম(নুহা আম্মুর কাছে যাব), নু আমু যাম, নু আমু যাম….
ছোট্ট আদনানের কথার আগা-গোড়া কিচ্ছু বুঝেনি হিয়া। ফিরে তাকায় শুভর দিকে।
শুভ পাল্টা প্রশ্ন করে ফুপ্পিকে, এটা কি কোন জায়গার নাম নাকি?
হেসে দেয় হিয়া। যা শুনাইলি না..! আঁখিকে ডাক।
ঘুম ঘুম চোখে আঁখি আসে। কোলে নেয় আদনানকে।
নাহ..! সেও পারছে না আদনানকে শান্ত করতে। শুভর কোলে দিয়ে ঢুলতে ঢুলতে রুমে চলে যায় আঁখি। যাওয়ার আগে বলে যায়- ভাইয়া, নু আমু আবার কোন দেশী খাবারের নাম? জীবনেও যা শুনিনি, সেই নাম গুলোই তোমার ছেলের মুখ থেকে শুনতেছি….
প্রচন্ড রাগে শুভ ছেলেকে বিছানায় ফেলে দেয়। বিছানায় পরে কান্নার মাত্রাটা আরো বেড়ে যায় আদনানের। পড়াশুনা+ডায়েরীতে লিখালিখি করে সদ্য ঘুমিয়েছিল নুহা। কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায় ওর। ছুটে আসে শুভর রুমে। বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে কান্না করতেছে আদনান। তার পাশে শুভ এবং ওর ফুপ্পি বসা। কোনো কথা বার্তা ছাড়া’ই নুহা কোলে তুলে দেয় আদনানকে।
” কি হয়েছে বাবা…? কে মেরেছে তোমায়…?”
শান্ত হয়ে যায় আদনান। নুহা পিঠে হাত বুলাচ্ছে আর রুমের মধ্যে হাটাহাটি করছে। আদনান নুহার কাঁধে নাকের পানি, মুখের লালা ছেড়ে দিয়েছে। সেই মুহূর্তে কান্নাটা নেই ওর কিন্তু ফুপাচ্ছে।
নুহা আদনানকে খাটে বসায়। তারপর পরনের ওড়না দিয়েই আদনানের নাক মুখ ভালো করে পরিষ্কার করে দেয়। পাশে রাখা ডিমটা হাতে নেয়। খোসা ছাড়িয়ে সেটা আদনানের হাতে তুলে দেয়। আদনান কামড়ে কামড়ে ডিম খেতে থাকে। খাওয়া শেষে নুহার দিকে ফিরে তাকায়। বলতে থাকে-
‘আমু কোলো, আমু কোলো।
আবারো কোলে তুলে নেয় নুহা আদনানকে। কাঁধে মাথাটা শুইয়ে দিয়ে পিঠে হাত বুলাতে থাকে। ঘুমিয়ে পরে আদনান। শুইয়ে দিয়ে নিজ রুমে চলে যায় নুহা।
ফুফু-ভাই পুত্র দু’জনেই অবাক দৃষ্টিতে দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানে ওরা কিছুতেই কান্না থামাতে পারেনি, সেখানে এতটুকু পুচকে মেয়ে কি না খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়েও চলে গেল। ভাবা যায়…!
সেদিনও রাত্রি আড়াইটা নাগাদ একই ভঙ্গিতে চিৎকার দিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে আদনান। সেদিনও কান্নার শব্দে নুহা ছুটে আসে, কান্না থামায়, ঘুম পাড়ায়। বিছানায় শুয়ানোর সময় সাথে সাথে কান্না করে উঠে। সজাগ হয়ে যায়। চোখ মেলে তাকায়। জাপটে ধরে নুহাকে। আদো আদো বুলিতে বারংবার বলতে থাকে, আমু তোমা থাকু(আম্মু তোমার সাথে থাকব), আমু তোমা থাকু, আমু তোমা থাকু।
পাশ থেকে হিয়ার স্বামীর জবাব, যাও আদিরা! আদনানকে আজকে তোমার রুমেই থাকতে দাও।
এমনিতে ও তোমার ভক্ত। রাত্রে খাইয়ে দাইয়ে তোমার রুমে ঘুম পাড়ালে মাঝ রাত্রে আর সকলকে এভাবে হয়রানি হতে হয় না।
বাবার সাথে তাল মিলিয়ে মেয়ের জবাব-
হ্যা, বাবা! আমিও সেটাই বলছিলাম। নুহা তুমি বরং ওকে সাথে নিয়েই ঘুমিও।
ভয়ে ভয়ে শুভর দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে নুহা।
‘ আচ্ছা, আমি তবে এখন ওকে রুমে নিয়ে যাই….’
কিচ্ছু বলেনি শুভ। সবাই চলে গেলে নুহার রুমের জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় সে। নুহা একটা বাচ্চা ইঁদুরকে সুতায় বেধে টানছে আর বাচ্চাদের মতো দৌঁড়াচ্ছে। তার পিছু পিছু দু’হাতে তালি দিয়ে হেসে কুটিকুটি হয়ে যাচ্ছে আদনান।
দুঃখের মাঝেও হেসে দেয় শুভ। দ্রুত রুমে চলে যায়। ফিরে আসে তিনটা ইঁদুর মারার যন্ত্র আর তিনটা পাকা কলা হাতে করে। রুমে এনে তিনটা যন্ত্রের ভিতরই কায়দা করে তিনটা কলা গেঁথে দেয়। ইঁদুর যখনই কলা যাওয়ার জন্য ভিতরে ঢুকবে তখনি মরন ফাঁদে আটকা পরবে। রুমে ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে গেছে। সেই জন্যই মূলত এই ব্যবস্থা। যন্ত্র তিনটা সাবধানে তিন স্থানে রেখে রুম ত্যাগ করে শুভ।
রাত্রি শেষের দিকে ওয়াশরুমে গিয়েছিল শুভ। নুহার রুমের সামনে দিয়েই ফিরে আসছিল। আসার সময় কিছু একটার আওয়াজ শুনতে পায় সে। কি চলছে ভিতরে সেটা দেখার জন্য উঁকি দেয় খোলা জানালা দিয়ে। ‘থ’ হয়ে যায় শুভ। চোখ দুটো গোল মার্বেলের মত হয়ে যায় ওর।
” ইঁদুর মারার যন্ত্রগুলো বিছানায় রাখা। আর তার পাশেই বসে ভিতর থেকে কলা বের করে কুটকুট করে নুহা কলা খাচ্ছে…..’
ছোট্ট আদনানকে কোলে নিয়ে স্বয়ং নুহা দাঁড়িয়ে। সেই নুহা যার সাথে শুভর পিকনিকে দেখা হয়েছিল।
চমকিত নয়নে শুভ তাকিয়ে আছে নুহার মুখপানে। আদনানকে বুকে চেপে ধরে নুহাও পরম বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে শুভর মুখপানে।
নিরবতা। ঘোর নিরবতা বিরাজ করছে। কারো মুখেই কোন কথা নেই। অথচ দুজনের মনেই ভিড় করে আছে অব্যক্ত সব কথারা।
ঘটনার আকস্মিকতায় রুমে প্রবেশ করে নীলিমার বান্ধবী ডাঃ হিয়া।
ওহ, তুই এখানে? আমি তো তোকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হয়ে গেছি।
ঘোর কাটে নুহার। দৃষ্টি নিয়ে যায় দরজার দিকে। পিছু ফিরে তাকায় শুভও।
‘একি! তুই গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে কেন? যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি তো এসেই গেছি। আজ না হয় আমিই আদনানকে খাওয়াবো। আদিরা যা তুইও ফ্রেশ হয়ে আয়।’
চমকিত নয়নে শুভ ফিরে তাকায় ফুপ্পির পানে। কিছুটা টান টান কন্ঠে প্রশ্ন করে, আ…দিরা???
ক্ষাণিক হাসে হিয়া। ওহ, তোকে তো পরিচয় করানোই হয়নি। এ আমার একমাত্র বান্ধবী ডাক্তার নীলিমার মেয়ে আদিরা। যার আসার কথা কালকে রাত্রে তোদের বলেছিলাম।
বিস্ময়টা কাটেনি। তবুও স্বাভাবিক ভাবে শুভ ওর একটা হাত নুহার দিকে বাড়িয়ে দেয়। Hlw! I am Shuvo. Nice too meet you.
আদনানের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে নুহার জবাব, আসসালামু আলাইকুম। আমি আদিরা মাহমুদ নুহা।
হাতটা ফিরিয়ে নেয় শুভ। অতঃপর সালামের জবাব দিয়ে ফের ওয়াশরুমের দিকে প্রস্থান করে।
নুহার দিকে এগিয়ে আসে হিয়া। দে, আদনানকে আমার কোলে দে। ওকে খাইয়ে দেই তাড়াতাড়ি। ততক্ষণে তুই ফ্রেশ হয়ে নে। তোদের খাইয়ে দিয়ে আমার আবার চেম্বারের দিকে যেতে হবে।
আদনানকে হিয়ার কোলে দিয়ে নুহা চলে যায়।
মিনিট দশেক পর ফিরে আসে নুহা। বিছানায় বসিয়ে আহ্লাদী স্বরে কথা বলতে বলতে হিয়া আদনানের মুখে খাবার তুলে দেয়ার বৃথা চেষ্টা করছে।
বৃথা চেষ্টা বললাম কারণ এখন অবধি হিয়া পারেনি আদনানের মুখে খাবারের এতটুকু অংশ তুলে দিতে। পাশে এসে বসে নুহা। প্রশ্ন করে হিয়াকে, আন্টি বাবুর মা কোথায়?
নুহার দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় হিয়া। আদনানকে খাওয়ানোর বৃথা চেষ্টা করতে করতে বলে, যা বলছিস তো বলছিস’ই! সাবধান এ কথা যেন শুভর সামনে না বলা হয়।
চোখ বড় বড় করে হিয়ার মুখপানে তাকায় নুহা। প্রশ্ন করে আবারো, কেন আন্টি? বললে কি হবে?
আশপাশটা একবার ভালো ভাবে দেখে চাপা গলায় হিয়ার জবাব, আদিরা! আস্তে। তোকে বলেছিলাম না আমার এক ভাইপুর কথা। যার বউ ২মাসের ছোট্ট বাচ্চাকে রেখে ব্যাংক ম্যানেজারের সাথে পালিয়ে গেছে? এ সেই বাচ্চা। ওর এখনকার বয়স ১বছর ৬মাস।
মায়াবী চাহনীতে নুহা আদনানকে দেখছে। তারপর অনেকটা ভেঁজা গলায় বলে উঠে, আহারে! এমন দুধের শিশুদের রেখে মানুষ কিভাবে এসব করতে পারে? এদেরকে কি দিয়ে গড়েছে আল্লাহ? এমন একটা বাচ্চাকে রেখে চলে যাওয়ার সময় একটুও বুক কাঁপেনি ঐ মহিলার? আচ্ছা, আন্টি আপনার ভাইপু আশিক কোথায়? আসার পর থেকে দাদীমা আর শুভ ভাইকে ছাড়া তো আর কাউকে দেখলাম না।
প্রশ্নোত্তরে হিয়ার জবাব, শুভ’ই আশিক। আশিক আহমেদ শুভ।
স্তব্ধ হয়ে যায় নুহা। চমকিত নয়নে ফিরে তাকায় খাটে বসে থাকা আদনানের মুখপানে। প্রশ্ন করে হিয়াকে, মামমমমমমানে? আদনানের বাবা শুভ?
নির্লিপ্ত গলায় হিয়ার জবাব, হ্যা! আশিকের(শুভ) ছেলে আদনান।
বসা থেকে উঠে পড়ে নুহা। নিঃশব্দে প্রস্থান করে রুম থেকে।
দুপুরে টেবিলে খেতে বসেছিল শুভ। রুমে ঢুকে আঁখি। কাঁধ থেকে কলেজ ব্যাগটা খুলে ছুঁড়ে মারে ড্রয়িংরুমের সোফায়। প্রশ্ন করে শুভকে, ভাইয়া! আমাদের বাসায় আজ না নতুন অতিথি আসবে?
শুভ ফিরে তাকায় ফুপাতো বোন আঁখির দিকে। ভ্রু- কুচকে প্রশ্ন করে, তো?!
রেগে যায় আঁখি। তো মানে? কি বলেছিলাম রাত্রে? নতুন অতিথি আসলে সবাই মিলে একসাথে লাঞ্চ করব। তুমি আগে আগে খেয়ে উঠছ যে?
পানি খেয়ে গ্লাসটা যথা স্থানে রেখে শুভর জবাব, এসেছে। নতুন অতিথি এসে গেছে। কিন্তু অতিথি এখন খাবে না জানালো। আমাকে খাবার দিয়ে ফুপ্পিও তাই চলে গেছে চেম্বারে। যা। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নে।
ওহ, আচ্ছা বলে মন খারাপ করে রুমে চলে যায় আঁখি।
রাত্রের খাবারের পর চুপিচুপি শুভ নুহার দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। নক করে দরজায়। দরজা খুলে আঁখি। ঘাবড়ে যায় শুভ।
“কি, কিছু বলবা?”
ইতস্তত শুভ ঘুরে দাঁড়ায়। ইয়ে, না মানে আদনানকে পাচ্ছি না তো। তাই দেখতে এলাম তুই এনেছিস কি না…..!
চলে যাচ্ছিল শুভ, পিছন থেকে আঁখির জবাব- ভাইয়া! আদনান মনে হয় ছাদে নুহার সাথে গল্প করছে।
শুভ নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে ছাদে গিয়ে হাজির হয়। দেখতে পায় নুহাকে। নুহা ওর গায়ের ওড়না দ্বারা আদনানের পুরো শরীর ঢেকে ছাদের একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হাঁটাহাঁটি করছে। হালকা ঝাকুনির সাথে আদনানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ছড়া বলছে। ছড়া শুনতে শুনতেই একসময় ঘুমিয়ে যায় আদনান।
“ঢাকা শহরে প্রচন্ড শীত পরেছে। শীতে রীতিমত জমে যাচ্ছে মানুষজন। কারো কারো তো ঠান্ডায় গলা জমেও গেছে। আর তুমি কি না সেই শীতের মধ্যে এ ছোট্ট বাচ্চাকে নিয়ে এখানে হাঁটাহাঁটি করছ?”
থমকে দাঁড়ায় নুহা। ভয়ে ভয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। ‘ইয়ে! আমার তো একটুও শীত করছে না।’
কিছুটা ধমকের স্বরে শুভর জবাব, কোথায় তুমি আর কোথায় ও? কিসের সাথে কিসের তুলনা দিচ্ছ? দাও। ওকে আমার কোলে দাও।
ভয়ে ভয়ে নুহা আদনানকে শুভর কোলে তোলে দেয়।
কিছুটা রাগান্বিত কন্ঠে শুভর প্রশ্ন, কি হলো? ওড়নাও কি দিয়ে দিবে নাকি?
ওড়নাটা টেনে এনে, গায়ে জড়িয়ে নেয় নুহা। অতঃপর মাথা নিচু করে ছাদ থেকে নেমে যায়।
সপ্তাহখানেক পরের ঘটনা_
শুভ আপ্রাণ চেষ্টা করছে আদনানকে খাওয়ানোর জন্য কিন্তু পারছে না। যতবার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে ততবার আদনান মুখ থেকে খাবার বের করে ফেলে দিচ্ছে। রেগে যায় শুভ। ধমক দেয় আদনানকে। ঠোঁট ভেঙ্গে কাঁদতে থাকে আদনান।
ছুটে আসে আঁখি। কোলে তুলে নেয় আদনানকে। ভাইয়া মারছ কেন?
– মারছি না, ধমক দিয়েছি।
— সেটাই বা দিবা কেন?
– কখন থেকে বলছি খা, খা! খাচ্ছে না। যা মুখে দিচ্ছি, ফেলে দিচ্ছে সব। এদিকে আমার আবার একটা কোম্পানিতে চাকরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য যেতে হবে।
— মানে? কোম্পানিতে জব মানে? তুমি না কলেজে জব করতা?
– করতাম। তবে সেটা গেস্ট টিচার হিসেবে।
— ওহ, আচ্ছা! তুমি যাও তাহলে। তোমার তো মনে হয় লেট হয়ে যাচ্ছে।
– কিন্তু ও যে খাচ্ছে না। ওকে না খাইয়ে আমি যাই কি করে? দে, আরেকবার ট্রাই করে দেখি।
শুভ আঁখির কোল থেকে আদনানকে নিয়ে ছোট্ট চেয়ারে বসায়। তারপর পিঠে হাত বুলিয়ে খাবার মুখের সামনে নিয়ে অত্যন্ত আদুরে গলায় বলে- আমার লক্ষ্মী বাবা, আমার সোনা বাবা। খাও। খেলেই তোমায় আমি ফোনে গান দেখাবো।
আরো জোরে জোরে কেঁদে দেয় আদনান। পূর্বের ন্যায় লালার সাথে মুখ থেকে খাবারগুলো বের হয়ে দেয়।
অধৈর্য্য হয়ে যায় আঁখিও। ভাইয়া! এ তো আজকে গানের কথা শুনেও শান্ত হচ্ছে না। এদিকে আম্মুর হাতেও খায়নি। কি চাচ্ছেটা কি তোমার ছেলে?
দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় নুহা। নুহাকে দেখে কান্না থামিয়ে দেয় আদনান। চেয়ার থেকে নেমে পিলপিল করে হেঁটে আদনান পৌঁছে যায় নুহার কাছে। আমু টাত খাম, আমু টাত খাম বলে নুহার আঙ্গুল ধরে টানতে থাকে আদনান।
টানতে টানতে চেয়ারের কাছে নিয়ে যায়। তারপর নিজে নিজেই চেয়ারে উঠে বসে। নুহা দাঁড়িয়ে আছে চেয়ারের পাশেই।
ছোট্ট আদনান ফিরে তাকায় নুহার মুখপানে। আদো আদো বুলিতে আবারো বলতে থাকে, আমু টাত খাম। আমু টাত খাম।
বিলম্ব না করে হাতটা ধুয়ে ভাত মেখে নুহা বসে পরে আদনানের চেয়ারের পাশে। এগিয়ে দেয় ভাত আদনানের মুখের দিকে। পরম তৃপ্তি সহকারে আদনান প্লেটের সবগুলো ভাত খেয়ে নেয়। হাত মুখ ধুতে যাবে তখনি আদো আদো বুলিতে আবারো বলে উঠে, টাত খাম। আমু টাত খাম।
নুহা অল্প কিছু ভাত নিয়ে মাছ দিয়ে মেখে এগিয়ে দেয় আদনানের দিকে। এবার আদনান কোন কথা ছাড়া’য় নিজ হাতে ভাতগুলো খেয়ে নেয়।
শুভ এবং আঁখি ২ভাই বোন এ হেন ঘটনায় একে অপরের দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
নুহা…. মেয়েটাই এরকম। অতি সহজে মানুষকে নিজের মায়ায় ফেলে দেয়ার ক্ষমতা রাখে। অদ্ভুত সে মায়া। যে মায়া থেকে বেরিয়ে আসার সাধ্য কারো নেই। ছোট্ট আদনানেরও তাই হয়েছে। মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে আদনান নুহা ভক্ত হয়ে যায়। জড়িয়ে যায় নুহার মায়ায়। আজকাল শুভ নয় নুহার সাথেই সময়
কাটাতে পছন্দ করে আদনান। বিষয়টা শুভকে ভাবিয়ে তুলে। সেদিন আর বাহিরে কোথাও যায়নি শুভ। ইজি চেয়ারে গা এলিয়ো দিয়ে বসে আছে শুভ। নিশ্চুপ শুভ ভাবছে গত হয়ে যাওয়ার দিনগুলোর কথা। ফারহানা চলে যাওয়ার পর ভেঙ্গে পড়েছিল একদম। দীর্ঘ ছ’মাস লেগেছে নিজেকে গুছাতে। নিজের স্বপ্নগুলোকে নতুন করে সাজাতে।
হ্যা, নতুন স্বপ্ন। শুভ চেয়েছিল একমাত্র ছেলে আদনানকে বুকে জড়িয়ে বাকি সময়টা কাটিয়ে দিতে। শুভ চেয়েছিল একজন আদর্শ বাবা হতে।
আজ কেন জানি মনে হচ্ছে ওর স্বপ্নগুলো একটু একটু করে সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এরকম মনে হওয়ার কোন যুক্তিসংগত কারণ শুভ খুঁজে পাচ্ছে না।
এক দুপুরবেলার ঘটনা বলছি_
শুভ খাবার টেবিলে খেতে বসেছিল আদনানকে নিয়ে। কিন্তু কিছুতেই শুভ আদনানকে খাওয়াতে পারছে না। ওর এক কথা। ও নুহার সাথে খাবে। না হয় কিছুতেই খাবে না। রাগে একটা থাপ্পর মারে শুভ আদনানকে। ভ্যাঁ, ভ্যাঁ করে কাঁদতে কাঁদতে আদনান নুহার রুমের দিকে চলে যায়।
আদনান চলে যাওয়ার পর ভাতের প্লেটটা ধাক্কা দিয়ে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে শুভ রুমে চলে যায়। রুমে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠে শুভ। ‘নুহা, নুহা, নুহা। খাইতে, বসতে, ঘুমুতে সব জায়গায় ও। কি পেয়েছেটা কি ঐ মেয়ে? কি চায় ও? কেন আমার ছেলেকে এভাবে দখলে নিয়ে যাচ্ছে? না, আর বসে থাকলে চলবে না। আমার জানতে হবে।’
শুভ নুহার রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বন্ধ দরজা ধাক্কা দিতেই মেলে যায়। উত্তেজিত শুভ কিছু একটা বলতে যাবে তখনি ‘থ’ হয়ে যায়। ফ্লোরে জায়নামাজে বসে নুহা যোহরের নামাজ শেষে মোনাজাত করছে। আর ঠিক সেরকমভাবেই ২বছরের ছোট্ট আদনান জায়নামাজের সামনে বসে মোনাজাতের ভঙ্গিতে হাত দুটো উঁচু করে রেখেছে।
পরদিন ভোরের ট্রেনে শুভ নুহাকে নিয়ে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। দুপুর নাগাদ নরসিংদী এসে পৌঁছে ওরা। নরসিংদী থেকে রুহুলের ফ্রেন্ডকে সাথে করে নিয়ে শুভ রওয়ানা দেয় গাজীপুরের উদ্দেশ্যে। যেহেতু শুভ ছোট্ট নুহাকে ভরসা করতে পারছিল না। পথিমধ্যে শুভ নুহাকে প্রশ্ন করে —
‘ আচ্ছা, তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?’
জবাব আসে, গাজীপুরের শ্রীপুর।
তুমি কি জানো গাজীপুরের একজন কীর্তি সন্তান ছিল? যিনি তার কর্মগুনে আজো স্মরনীয় হয়ে আছেন?
শুভর এমন প্রশ্নে নুহার জটপট জবাব ছিল, তাজউদ্দীন আহমেদ।
আচ্ছা, শ্রীপুর অর্থ কি জানো?
এবারো নির্লিপ্ত কন্ঠে নুহার জবাব, এককভাবে শ্রীপুরের কোন অর্থ আমার জানা নেই। তবে আমার মতানুসারে যদি বলি তাহলে বলবো শ্রী অর্থ সুন্দর আর পুর অর্থ পরিপূর্ণ। অর্থাৎ শ্রীপুর অর্থ সুন্দরে পরিপূর্ণ।
এমন তাৎক্ষণিক জবাবে মুগ্ধ শুভ তাকিয়ে আছে নুহার দিকে। ভাবা যায় এরকম একটা পিচ্চি মেয়ে একাধারে এতগুলো গুনের অধিকারি? ঘোর লেগে যায় শুভর। এক মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই সে জড়িয়ে যাচ্ছে আরো মুগ্ধতার আবেশে। মুগ্ধতার এ রেশ কবে, কখন কাটবে সেটা শুভ নিজেও জানে না।
যায় হোক। যে কথাটি বলছিলাম। বিকেল ৩টা নাগাদ শুভ নুহাদের গ্রামে পৌঁছে। বাসার পাশে এসে নুহাকে নামিয়ে দেয়া হয়। তারপর গাড়ি উল্টো দিকে মোড় নেয়। যদিও শুভর ইচ্ছে ছিল নুহাকে বাসায় অবধি পৌঁছে দিয়ে আসা। কিন্তু রুহুলের বন্ধু আতিকের জন্য সামনে আগাতে আর সাহস পায়নি শুভ। আতিকের ভাষ্যমতে,
‘ শুভ ভাই আর সামনে যাবেন না। শুনেছি এ এলাকার মানুষ ভালো না। অনর্থক ফাসিয়ে দিবে আপনাকে। তাই সেধে সেধে এভাবে বিপদ ডেকে আনার কোন মানেই হয় না। চলুন। যাওয়া যাক।’
আতিকের কথা শুনে আর সামনে এগিয়ে যায়নি শুভ। কোন কথা না বাড়িয়ে আতিকের গাড়িতে গিয়ে বসে। গাড়ি স্টার্ট দেয় আতিক। স্তব্ধ নুহা রাস্তার পাশে তেতুল গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটু একটু করে চোখের আড়াল হয়ে যায় গাড়িটি। বুকের ভেতর ধুরমুশ পেটাতে শুরু করে নুহার। সাহস পাচ্ছে না বাসার দিকে এগুনোর। কোন মুখে এগুবে আর কিবা বলবে সেটা ভেবেই কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে নুহার।
এদিকে কেউ একজন নুহাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বাসায় গিয়ে খবর দেয়। খবর পেয়ে ছুটে আসে নুহার আশপড়শি চাচি জ্যাঠিমাসহ আপন দাদীমা। ছুটে আসে একমাত্র প্রাণের ভাই নিলয়। নুহার দাদীর চিল্লানো শুনে ছুটে আসে পাড়া প্রতিবেশী।
নুহার দাদীর একটাই প্রশ্ন ছিল। আর সেটা হলো – “সম্মান সব ধুলোর সাথে মিশিয়ে দিয়ে এখন এখানে এসে দাঁড়িয়েছিস কোন মুখে?” এছাড়াও নুহাকে সম্মুখীন হতে হয়েছে পাড়া প্রতিবেশীদের অপ্রিয় কিছু প্রশ্নের। বুকে সাহস সঞ্চয় করে ভিষণ ধৈর্য্য সহকারে নুহা তুলে ধরে গত ২দিনে ওর সাথে ঘটে যাওয়া নানা অপ্রীতিকর ঘটনার কথা। তুলে ধরেনি শুধু বিয়ের কথাটা। পুরো ২দিনের ঘটনার মধ্যে একই রুমে রাত্রি যাপন আর বিয়ের কথাটা নুহা গোপন রাখে সবার থেকে। তারপরও নুহাকে শুনতে হয়েছে ভিষন অপ্রিয় কিছু কথা। যে কথা গুলো শুনে নুহা রাগে ফেটে পরছিল। কিন্তু পরমুহূর্তে মাটির দিকে তাকিয়ে নিজেকে কন্ট্রোল করে। আল্লাহ, আল্লাহ করতে করতে সে স্থান ত্যাগ করে বাসায় চলে যায় নুহা।
মাগরিবের নামাজ পড়ে অনেকটা অপরাধীর ন্যায় মাথানিচু করে চুপচাপ রুমে বসেছিল নুহা। তখনি ভিতরে ঢুকে ২জন পড়শি। খুটিয়ে খুটিয়ে নুহার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বাকা দৃষ্টিতে দেখে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় ওর দিকে। নুহা মহিলা দুজনের সবগুলো প্রশ্ন পরম ধৈর্য্য সহকারে দেয়। নুহার সুন্দর গুছানো জবাবে ওরা সন্তুষ্ট নয়। আর তাই কথার প্যাঁচে ফেলার জন্য বিভিন্ন এঙ্গেলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রশ্ন করতে থাকে বাচ্চা মেয়েটাকে। ছোট্ট নুহা সুন্দর গুছানো জবাব দ্বারা প্রতিবারই পরম ধৈর্য্যের পরিচয় দেয়। সবশেষে ব্যর্থ হয়ে কানাঘুষা করতে করতে মহিলা দুটো চলে যায়।
পরদিন স্কুলে গেলে নুহাকে সম্মুখীন হতে হয় শিক্ষকদের নানান প্রশ্নের। মুখোমুখী হতে হয় ক্লাসমেটসহ বড় আপুদের টিপ্পনীমূলক বাক্যের। সেই সাথে হতে হয় সবার উপহাসের পাত্রী। দুর থেকে বান্ধবীরা ওকে দেখে হাসাহাসি করত। হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর ঢলে পড়ত। ওকে নিয়ে কানাঘুষা করত। নুহা সেসব দেখেও না দেখার ভান করত। তবে ভিতরে ভিতরে ও খুব কষ্ট পেতো। কারণ ওর সকল বন্ধুরা একটু একটু করে ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। কাছের যে তিনজন বান্ধবী ছিল তাদের মধ্যে ২জনই নুহাকে নিয়ে খেয়ে ছেড়ে দিয়েছে টাইপের মন্তব্য করেছে। খুব কাছের মানুষের দেয়া আঘাত সহ্য করার মত ক্ষমতা কারো নেই। নুহাও পারেনি। একটু একটু করে ও সকলের থেকে আলাদা হয়ে যায়। আলাদা হয়ে গেছে বললে ভুল হবে ওকে আলাদা করে দেয়া হয়। মুখে না বললেও ওর ক্লাসমেটরা ওকে ইশারাতে বুঝিয়ে দিত, যে মেয়ে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে টানা তিনদিন দু’রাত বাহির দেশে পরপুরুষের সাথে কাটাতে পারে সে আর যায় হোক আমাদের ফ্রেন্ড হওয়ার যোগ্য নয়। নুহাও ওদের ইশারা বুঝে গিয়েছিল। আর তাইতো স্কুলে গেলেও কারো সাথে তেমন মিশত না। সবসময় ক্লাসমেটদের থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ দূরত্ব বজায় রেখে চুপটি করে বসে থাকত। মন খারাপের অনেকগুলো টিফিনের মুহূর্ত নুহা কাটিয়েছে কমনরুমের কর্নারের জানালার পাশের বেঞ্চটিতে বসে বাহির পানে তাকিয়ে।
নুহার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী একমাত্র শুভাকাঙ্খী জান্নাত জানিয়েছে, “আমি আমার বান্ধবীকে একবছরের মধ্যে হাতে গুনা তিন চার দিন ছাড়া বাকি সময়গুলো আনমনে জানালার পাশে বসে ডায়েরী লিখে সময় কাটাতে দেখেছি। হাসিখুশি প্রাণ চঞ্চল মেয়ে যার কাজই ছিল ছোট বড় সবাইকে পাঁকা পাঁকা কথা দ্বারা উপদেশ দেয়া। যে সবসময় চারপাশটা মাতিয়ে রাখত। মানুষের মন মুহূর্তেই ভালো করে দেয়ার এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে যে মেয়েটি জন্মেছিল। যাকে স্কুলে অনেকেই মন খারাপের ঔষধ বলে ডাকত। যার কাজই ছিল হাসাহাসি করা। নিজে হাসবে সেই সাথে অন্যকে হাসাবে। সেই মেয়েটাকে আমি দেখেছি। আমি দেখেছি সেই মেয়েটা কিভাবে একটু একটু করে বিষণ্নতাকে বরণ করে নিয়েছে। নুহার ঠোঁটের কোণের হাসিটা একেবারে ম্লান হয়ে যেতে দেখেও আমি চুপ করে ছিলাম। কিন্তু যেদিন আমাদের জেসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিল সেদিন আমি স্কুল থেকে ওদের বাসার পিছন দিয়ে যাচ্ছিলাম। নুহা পুরো গাজীপুরের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। সেটা নুহাকে জানানোর জন্য আমি ওদের উঠোনে গিয়ে দাঁড়ায়। নাম ধরে ডাক দেবো তখনি শুনতে পেলাম ওর আপন দাদী ওকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতেছে। আর নুহা সেটা সইতে না পেরে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। সেদিনই মনে হলো সময় হয়েছে এবার ওর জন্য কিছু করার। আর সেই মতেই আমি নুহার ছোট ভাই নীলয়ের থেকে আবির আঙ্কেলের নাম্বারটা যোগার করি।”
হু, যা শুনতেছিলেন। জান্নাত উপস্থিত বুদ্ধির জোরে আবিরের নাম্বারটা সংগ্রহ করে ঐ নাম্বারে একটা মিসড কল দেয়। সেদিন বিকেলেই আবির কল করে। ইতস্তত জান্নাত প্রথমেই সুন্দর করে নিজের পরিচয় দেয়। অতঃপর সকল প্রকার লজ্জা ভয়কে দুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বুকে সাহস সঞ্চয় করে। নির্লিপ্ত কন্ঠে আবিরকে জানায় নুহার সাথে ঘটে যাওয়া অপ্রীতিকর ঘটনার কথা। আরো জানায় বিগত একটা বছর নুহা কিরকম মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কাটিয়েছে।
একমাত্র মেয়ের কাছের বান্ধবী জান্নাতের থেকে এমন ধরনের অপ্রিয় সব কথা শুনে আবির যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে আবির ওর বিশস্ত এক বন্ধুকে ওর এলাকায় ডেকে পাঠায়। আবিরের কথামত ওর ঐ বন্ধুটি শ্রীপুর আসে। বিয়ের জন্য পাত্রী হিসেবে নুহা মেয়েটা কিরকম এটা আবিরের বন্ধু আশপড়শি মহিলাদের জিজ্ঞেস করলে গ্রামের মহিলারা নুহা প্রসঙ্গে ভিষণ বাজে কথা শুনিয়ে দেয়। আবিরের বন্ধুটি ফিরে যায়। কল করে আবিরকে পুরো বিষয়টা জানায়।
চিন্তিত আবির সেদিন রাত্রে কল করে হিয়াকে। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করে হিয়া ওর কলেজ শিক্ষক আবিরকে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দেয়। জানতে চায় বান্ধবীর বর্তমান অবস্থার কথা। হিয়ার কোন প্রশ্নের জবাব না দিয়ে আবির পাল্টা প্রশ্ন করে ওকে। ” ভিষণ বিপদে পড়ে তোমার শরণাপণ্ন হওয়া। তুমি কি আমায় হেল্প করবে?”
লজ্জা পেয়ে যায় হিয়া। ছি! ছি স্যার! এভাবে কেন বলছেন? আপনি আমার গুরুজন। আর গুরুজনের জন্য কিছু করতে পারা তো পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। স্যার, আপনি শুধু আদেশ করেন কি করতে হবে। আমি প্রাণ দিয়ে হলেও সে কাজটা করার চেষ্টা করব।
আবির হিয়াকে পুরো ঘটনা জানায়। আবির আরো জানায়, নুহাকে সে ঢাকায় নিরাপদে হিয়ার বাসায় রাখতে চাচ্ছে।
প্রথমে নুহার সাথে করা অন্যায়গুলোর জন্য মন খারাপ হলেও পরে যখন জানতে পারে নুহা ওর মেয়ের সাথে ওর বাসায় থাকবে তখন আনন্দে চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে হিয়ার।
স্যারকে আশস্ত করে হিয়া পরদিন ভোরে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যায় গ্রাম থেকে নুহাকে আনতে। আবিরের কথা মতো নুহা স্কুল থেকে সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় সকল কাগজপত্র এনে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রাখে। প্রাণের আন্টি হিয়াকে দেখা মাত্র’ই দুতলা বাসার নিচে নেমে আসে। নিচে নেমে বিনীত ভঙ্গিতে সালাম দিয়ে হিয়ার সাথে কুশল বিনিময় করে। ‘ওরে আমার মা’টা তো দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে’ কথাটা বলেই একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে হিয়া বুকে জড়িয়ে নেয় নুহাকে।
নীলিমার শাশুড়ি ওরফে নুহার দাদীমার থেকে বিদায় নিয়ে হিয়া তারই কলিজার টুকরা জুনিয়র নীলিমাকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। বিকেল ৫টা নাগাদ নুহাকে সাথে করে নিয়ে ঢাকায় নিজ বাসায় এসে পৌঁছে হিয়া। নুহা গাড়ি থেকে নামলে একটা মিষ্টি হাসি দেয় হিয়া। বাসায় এসে গেছি মা। চলো, চলো। নিশ্চুপ নুহা নিঃশব্দে হিয়াকে অনুসরন করে দোতলা বাসার উপরে উঠে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল চাপে হিয়া। পরপর কয়েকবার কলিং বেল চাপার পর দরজা খুলে কাজের মহিলা শিরি। নুহাকে দেখেই একটা হাসি দেয় মহিলাটা। ওহ, নতুন সতীন এসে গেছে আমার? হেসে দেয় হিয়া। স্মিতহাস্যে নুহার দিকে তাকিয়ে বলে, নুহা মা! ইনি তোমার দাদীমা হয়। জিজ্ঞেস করো কেমন আছে?
সালাম দিয়ে বিনীত ভঙ্গিতে নুহা কুশল বিনিময় করে মহিলাটির সাথে।
হঠাৎ করেই পাশের রুম থেকে বাচ্চার কান্নার স্বর ভেসে আসে। ড্রেস চেঞ্জ করতে করতে হিয়া ডাকতে থাকে। শুভ, শুভ কইরে তুই? আদনান তো পুরো বাসা মাথায় তুলে নিয়েছে কান্না করে। একবার দেখা দিয়ে যা। প্রতিউত্তরে ওয়াশরুম থেকে ভেসে আছে- ‘আমি গোসল করতেছি ফুপ্পি। দাদীমাকে বলো একটু কোলে নিতে।’
ক্ষাণিক বাদে শরীরে কোন রকম তোয়ালে প্যাঁচিয়ে হাত দিয়ে চুল থেকে পানি ফেলতে ফেলতে রুমে ঢুকে শুভ। কোথায় আমার বাবাটা? বাসা নাকি মাথায় তুলে ফেলেছ? কথাটা বলে সামনে তাকাতেই ভূত দেখার ন্যায় চমকে যায় শুভ।
কি হলো? এভাবে তাকিয়ে কেন আছেন? যান, নামাজ পড়ে আসেন।
কিচ্ছু বলেনি শুভ। ছিটকিনি আটকে চুপ করে খাটে গিয়ে বসে কম্বল মেলতে থাকে। সেটা দেখে চোখ কপালে তুলে ফেলে নুহা। প্রশ্ন করে শুভকে, কি হলো? শুয়ে পরার ব্যবস্থা করতেছেন যে? নামাজটা কে পড়বে?
রাগান্বিত দৃষ্টিতে শুভ নুহার দিকে তাকায়। ‘দেখুন মিস! একটু ভালো ভাবে কথা বলেছি তার মানে এই নয় আপনি আমার কাধে ঝেকে বসবেন। ভুলে যাচ্ছেন কেন সকাল হওয়ার পরই আমাদের দু’জনের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে। তাই দয়া করে পার্সোনাল এটার্ক করা থেকে বিরত থাকুন।
পার্সোনাল এটার্ক? তাচ্ছিল্যের স্বরে হেসে উঠে নুহা। যাক! বেশ ভালো বলেছেন। তবে একটা কথা স্যার। আমি মোটেও পার্সোনাল এটার্ক করিনি। একজন মুসলমান হিসেবে আরেকজন মুসলমানকে ইসলামের দাওয়াত দিলাম। ইসলামের পথে আসার আহ্বান করলাম। ব্যস, এটুকুই। এখন আপনার যদি মনে হয় আমি আপনার পার্সোনাল লাইফে এটার্ক করছি তাহলে যে আমার আর কিচ্ছু বলার থাকল না। আচ্ছা, শুয়ে পরেন। আর ডিস্টার্ব করার জন্য স্যরি।
শুয়ে পড়তেছিল শুভ, নুহার শেষ কথা শুনে সোজা হয়ে বসে। দেখুন মিস নুহা আপনি কিন্তু একটু বেশিই ভুল বুঝতেছেন। আপনি কথাকে যেভাবে নিয়ে যাচ্ছেন আমি কিন্তু সেভাবে বলিনি। আমি জাস্ট এটাই বুঝাতে চাচ্ছি যে নামাজ বলেন, রোজা বলেন এগুলো ব্যক্তির নিজস্ব ব্যাপার। হ্যা, আপনি ইসলামের দাওয়াত দিয়েছেন সেটা ঠিক আছে। কিন্তু একটা কথা আপনার জানা খুব দরকার। যে ব্যক্তি আল্লাহকে কোনো ক্রমেই মানে না তার কাছে নামাজ পড়ুন, রোখা রাখুন, আল্লাহর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেন এসব বলাটা অরণ্য রোদন বৈ কিছুই নয়। তাই ভবিষ্যতে কাউকে ইসলামের দাওয়াত দিতে যাওয়ার এ জিনিসটা মাথায় রেখে যাবেন।
হেসে উঠে নুহা। আপনি ভুল বলেছেন স্যার। কেউ আল্লাহকে মানে না তাই বলে কি আমি আমার দাওয়াত দেয়া বন্ধ করে দেবো? না। এটা আমি মানতে পারছি না। কারন একজন মুসলমান হিসেবে আমার দায়িত্ব আরেকজন মুসলমানের কাছে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছে দেয়া। সেটাকে যদি মানুষ ভালোভাবে গ্রহন করে তাহলে আলহামদুলিল্লাহ। আর যদি ভালো ভাবে গ্রহন না করে তাহলে তার জন্য সমবেদনা। কেননা, আমি শুনেছি আল্লাহ যাদের ভালোবাসেন তাদের’ই হেদায়াত করেন তাড়াতাড়ি। আচ্ছা, বাদ দেন। আপনি একটু ঘুমান। আমি ভাবির রুমে গিয়ে দেখি ফোনটা চার্জে দিয়ে খুলতে পারি কি না। স্যারদের কাছে একটু ফোন দিতে হবে।
নুহা রুম থেকে বের হয়ে সোজা রাকিবদের রুমের দরজায় নক করে। ঘুম ঘুম চোখে স্বর্ণা দরজা খুলে। চোখ কপালে উঠে যায় নুহার। সেকি ভাবি? মাত্র ঘুম থেকে উঠছেন? নামাজ পড়েন না আপনারা? কিছুটা নিচু গলায় স্বর্ণার জবাব, ইয়ে মাঝে মধ্যে পড়া হয়।
দরজার সামনে দাঁড়ানো থেকেই প্রশ্ন করে নুহা, খাবারও কি মাঝে মধ্যে খান নাকি?
ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা হয়ে যায় স্বর্ণার। ‘মানে? বুঝলাম না নুহা।’
হেসে দেয় নুহা, না বুঝার তো কিছু বলিনি। আচ্ছা, বাদ দেন। ভেতরে কি ভাইয়া আছে।
হু, ঘুমিয়ে আছে। স্বর্ণার কথা শুনে তাড়াতাড়ি পুরো শরীর ঢেকে নেয় নুহা। আচ্ছা, আমি তবে পরে আসি।
নুহা চলে গেলে স্বর্ণা একটা মুখ ভেংচি দেয়। এতটুকু বাচ্চা মেয়ে আসছে জ্ঞান দিতে। যত্তসব। ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয় স্বর্ণা।
সকালে আবারো স্বর্ণাদের রুমের দরজায় এসে নক করে নুহা। দরজা খুলে স্বর্ণা। নুহা স্বর্ণাকে সালাম দেয়। জবাবে স্বর্ণা বলল, ‘ওহ, নুহা! আসো। ভিতরে আসো।’
রুমে রাকিব আছে কি না এ বিষয়ে ক্লিয়ার হয়েই ভিতরে ঢুকে নুহা। বন্ধ ফোনটা চার্জে লাগিয়ে খুলে নেয়। সেভ করা বান্ধবীদের নাম্বারের মধ্য থেকে প্রিয় বান্ধবী জান্নাতের নাম্বারে কল দেয়। মুহূর্তেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে, আপনার কাঙ্খিত নাম্বারে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। একটু পরে আবার চেষ্টা করুন। মনটা খারাপ হয়ে যায় নুহার। বিষণ্ন মনে ডায়াল করে বাংলা মেডামের নাম্বার। রিং হচ্ছে কিন্তু রিসিভ করছে না। বাধ্য নুহা জম স্যার ওরফে ইংরেজী স্যারের নাম্বারে কল দেয়। ওনি অবশ্য রিসিভ করেছেন কিন্তু কথা বুঝা যাচ্ছে না। শুনার মধ্যে কেবল বাচ্চাকাচ্চার আওয়াজ’ই শুনতে পাচ্ছে নুহা। কল কেটে প্রধান শিক্ষকের নাম্বার ডায়াল করে নুহা। এবারো ফোন রিসিভ হয়েছে। কিন্তু গাড়ির হর্ণ ছাড়া কিচ্ছু শুনতে পায়নি নুহা।
তবে কি ওরা চলে যাচ্ছে? ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে নুহার। কলটা কেটে কল দেয় বান্ধবি জান্নাতকে। বরাবরের মতই ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। বুকের ভেতর রীতিমত ধুরমুশ পেটাতে শুরু করে দিয়েছে ওর। দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে শুভর রুমে যায়। ডাক দেয়, শুনছেন? কম্বলের ভেতর থেকে মাথা বের করে তাকায় শুভ। প্রশ্ন করে নুহাকে, কি সমস্যা?
ভেঁজা কন্ঠে নুহার জবাব, ওরা মনে হয় রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে। আমার ভালো লাগছে না একদম। আমি এখন কি করব?
শুয়া থেকে উঠে বসে শুভ। হাত দিয়ে চুলগুলো ঠিকঠাক করে নিয়ে নুহার দিকে তাকায়। ‘চলুন….
দৌঁড়ে গিয়ে স্বর্ণাদের রুম থেকে ফোনটা এনে রুমের দরজায় এসে দাঁড়ায় নুহা। শুভর দিকে লক্ষ্য করে বলে, চলুন…..
শুভ এবং নুহা সকালের নাস্তা না করেই বিদায় নেয় রাকিব এবং তার স্ত্রী স্বর্ণার থেকে। প্রচন্ড শীতে জড়োসড়ো শুভ গাড়িতে বসে নুহার দিকে তাকিয়ে দেখে এত শীতের মধ্যে নুহা রীতিমত ঘামছে।
কিছুটা আশ্চর্য হয় শুভ। তবে কিচ্ছু বলেনি নুহাকে। মিনিট ত্রিশেক পর কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে নুহা এবং শুভ। সমুদ্র পাড়ে অসংখ্য মানুষকে দেখা গেলেও নুহা পায়নি ওর স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী কিংবা স্যার’দের।
‘আমি এখন কি করব?’ বিষণ্ন মনে নুহা শুভর দিকে ফিরে তাকায়। জবাব আসে, তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি আমাদের ঐ স্যার’রা আছে ওনাদের সাথে দেখা করে আসি। নুহা বাচ্চাদের মত মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
একটু একটু করে শুভ এগিয়ে যায় স্টুডেন্টসদের দিকে। মেয়েরা কেমন আছ তোমরা? সেখানে উপস্থিত ছাত্রীরা ফিরে তাকায় পিছনের দিকে। হারিয়ে যাওয়া স্যারকে দেখা মাত্রই ঘিরে ধরে সবাই। ‘স্যার কোথায় ছিলেন? স্যার আপনি নাকি হারিয়ে গিয়েছিলেন? পরে আপনার ফ্রেন্ড নাকি উদ্ধার করেছে?’ এটা সেটা আরো কত প্রশ্ন।
স্মিতহাস্যে শুভর জবাব, আমাকে আমার বন্ধু নয় এক সুপারম্যান এসে বাঁচিয়েছে। আচ্ছা, তোমরা সমুদ্রতীরের সুন্দর দৃশ্য উপভোগ করো। আমি স্যারদের সাথে একটু সাক্ষাত করে আসি।
মেয়েরা যে যার মত এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলে শুভ স্যারদের মুখোমুখি হয়। টিচার্সদের মধ্যে একজন টিচার ছিল শুভর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শুভ বন্ধু রুহুলকে আড়ালে ঢেকে নিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলে হেল্প চায়। রুহুল সমবেদনা প্রকাশ করে এবং রুহুলকে আশ্বস্ত করে। রুহুল জানায়, তুই ঐ মেয়েকে নিয়ে আপাতত তোর ঐ বন্ধুর বাসায় চলে যা। কাল থেকে তো মনে হয় মেয়েটা কিছু খায়নি, তাই ওকে ওখানে নিয়ে গিয়ে জোর করে কিছু খাওয়া। তারপর সন্ধ্যার ট্রেনে নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দে। নরসিংদী পৌঁছে গেলে আর সমস্যা নেই। ওখানে আমার এক ফ্রেন্ড থাকে। ও তোকে গাজীপুর যাওয়ার সব বলে দিবে। এদিকে আমি সামলিয়ে ফেলব স্যারদেরকে। স্যারদের বলব, তোর বাসা থেকে জরুরী কল আসায় তুই চলে গেছিস।
Thanks a lot, sir.(হাসি দিয়ে) আমি আপনার এ উপকারের কথা কখনো ভুলব না।(স্মিতহাস্যে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকার ইমুজি হবে।)
হেসে দেয় রুহুল। আচ্ছা, এখন তবে বের হয়ে যান স্যার। ইনশাআল্লাহ ঢাকায় পৌঁছে কথা হবে।
বন্ধুর থেকে বিদায় নিয়ে শুভ নুহার কাছে এসে দাঁড়ায়। নুহা ততক্ষণে অনেকগুলো ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে। শুভকে আসতে দেখে ওদের থেকে বিদায় নিয়ে সামনে আগায়। মুখোমুখী হয় শুভর।
আচ্ছা, চলো। আমরা আবার রাকিবের বাসায় যাই। তারপর সন্ধ্যার ট্টেনে আমি নিজে তোমাকে নিয়ে দিয়ে আসব তোমার গ্রামের বাড়িতে।
আচ্ছা, বলে পথ চলতে শুরু করে নুহা। ক্ষাণিক দুর যেতেই শুভ টের পায় নুহা ওর পিছনে নেই। দাঁড়িয়ে পরে শুভ। পিছনে তাকাতেই দেখতে পায় অদুরের পানে ঝিনুক বেঁচে ছেলেটাকে যেখানে মেয়েরা ঘিরে আছে নুহা সেখানেই তাকিয়ে আছে। দৌঁড়ে ঝিনুক বেঁচে ছেলেটার কাছে যায় শুভ। প্রশ্ন করে ছেলেটাকে বাবু কত টাকা করে এগুলো? স্যারকে আসতে দেখে সরে যায় কলেজের মেয়েরা। জবাব দেয় ছেলেটা, ২০টাকা। পকেট থেকে একটা ৫০০টাকার নোট বের করে শুভ এগিয়ে দেয় ছেলেটার দিকে। আমাকে ১০টা মালা দাও। ছেলেটা গুনে গুনে ১০টা মালা তুলে দেয় শুভর হাতে। মালার টাকা বাবদ ২০০টাকা নিয়ে ছেলেটা ৩০০টাকা শুভর হাতে দিতে গেলে শুভ টাকা নিতে অস্বীকার করে। শুভ জানায়, টাকাটা তোমার কাছেই রাখো আব্বু। এটা আমি তোমাকে এটা গিফ্ট করেছি। শীতের কাপড় কিনে নিও। হাসি ফুটে উঠে ছেলেটার মুখে। দু’চোখ জলে চিকচিক করছে। যেন সে চোখের জলের মাধ্যমেই দাতার প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছে।
মালা হাতে নুহার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় শুভ। পিছন থেকে বলে, নাও। ভয়ে কেঁপে উঠে নুহা। শুভকে বুকে থু থু দিয়ে বলে- ওহ আপনি?
হাসোজ্জল মুখে শুভ নুহার দিকে মালাগুলো এগিয়ে দেয়। নুহা হা হয়ে যায়। মুখে হাত দিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে। নাও বলে শুভ আবারো মালা সাধে। ইতস্তত নুহা একসময় মালাগুলো নিয়েই নেয়। কিছুদুর এগুতেই ক্যামেরাম্যান সামনে এসে দাঁড়ায়। ছবি তোলার জন্য বিনীত অনুরোধ জানায়। শুভ নুহার দিকে ফিরে তাকায়। নুহার চোখ মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে অস্বস্তিতে ভুগছে। স্যরি, আরেকদিন বলে ক্যামেরাম্যানকে বিদায় করে দেয় শুভ।
সকাল ১১টার দিকে আবারো বন্ধু রাকিবের বাসায় গিয়ে পৌঁছে শুভ এবং নুহা। শুভ নুহাকে দেখে রাকিব এতটা খুশি হয়েছে যা বলে বুঝানো যাবে না। মুহূর্তেই বাজার থেকে এটা সেটা আনা শুরু করে দিয়েছে। হেসে দেয় শুভ। শান্ত হো বৎস, শান্ত হো। তাড়াহুড়োর কিচ্ছু নেই। আমরা সন্ধ্যার ট্রেনেই রওয়ানা দেবো। আশ্চর্য হয় রাকিব। সন্ধ্যার ট্রেন? তুই জানিস না আগামীকাল ভোরের আগে আর কোন ট্রেন যাবে না? চমকে যায় শুভ। কি বলিস তুই এসব? আমি এখন ওকে নিয়ে কোথায় যাব? রেগে যায় রাকিব। কোথায় যাবি মানে? তোরা কি বানের জলে ভেসে এসেছিস নাকি? কালকের মত আজও এখানেই থাকবি। তারপর ভোরের ট্রেনে রওয়ানা দিবি। একটা বড় নিশ্বাস ছেড়ে শুভ বলে, এটা ছাড়া আর কি বা করার আছে? আচ্ছা, রুমে যাই আমি।
শুভ রুমে গিয়ে বিষয়টা বুঝিয়ে বলে নুহাকে। আশ্চর্য হলো শুভ। যখন দেখল মেয়েটার চোখ মুখে বিন্দুমাত্র দুশ্চিন্তার ছাপ নেই। নেই কোন ভয়ের রেখা। আশ্চর্য! ওকি তবে আমায় বিশ্বাস করে ফেলেছে? কৌতূহল মেটাতে প্রশ্নটা করেই ফেলে নুহাকে। জবাব আসে, যেখানে স্বয়ং আল্লাহ আছেন মাথার উপর, সেখানে ভয় পাওয়ার তো কোন প্রশ্নই উঠে না। শুনেছি আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
অদ্ভুত প্রকৃতির মানবি। এমন মানবি এ ধরাতে পূর্বে দ্বিতীয়টি আর দেখিনি। আনমনেই নিজেই নিজের সাথে কথাটা বলে উঠে শুভ।
দুপুরে খাওয়ার জন্য শুভ নুহার ডাক পড়ে আবারো। নুহা এবারো খাবে না বলে জানিয়ে দেয়। স্বর্ণা রুম থেকে বেরিয়ে গেলে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে শুভ নুহার দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে নুহাকে, কি! সমস্যা কি তোমার? সকালেও এত বার করে বলল। তারপর ব্রেকফাস্ট করোনি। এখনো খাবে না বলছ। সমস্যা কি তোমার?
ধীর গলায় নুহার জবাব, সমস্যা আমার নয় সমস্যা এ বাসার গিন্নী+রাধুনী স্বর্ণা আপুর। চমকে উঠে শুভ। মানে? What do you mean?
নির্লিপ্ত কন্ঠে নুহার জবাব, আমি বেনামাজির হাতের খাবার খেতে পারি না।
পর্দার আড়াল থেকে সরে যায় স্বর্ণা। সে ভিষণ লজ্জা পেয়েছে। সেই সাথে ওর ইগুতে গিয়ে আঘাত করেছে কথাগুলো। একটা ছোট্ট মেয়ে, যে কি না আমার থেকে বছর সাতেকের ছোট হবে সে আমাকে এভাবে লজ্জা দিল? তৃতীয় চক্ষু খুলে যায় স্বর্ণার। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে চলে যায় ওয়াশরুমে। দ্রুত কাপড় পাল্টে ওজু করে নামাজটা আদায় করে নেয়।
নামাজ ছেড়ে ড্রয়িংরুমে যেতেই আশ্চর্য হয়ে যায় স্বর্ণা। পরম তৃপ্তি সহকারে নিজে নিজেই খাবার নিয়ে খেয়ে চলছে নুহা।
ওজুর পানি এখনো চোখে মুখে লেগে আছে স্বর্ণার। পানি মুছতে যাবে তখনি নুহা বলে উঠে, এ পানি মুছো না ভাবি। এ পানি রহমতের পানি।
রুম থেকে বেরিয়ে আসে শুভ। হুট করে নুহার এভাবে খাবার নিয়ে বসে পরার কারন বুঝতে পারে এতক্ষণে।
অদুরে বসে থাকা শুভর চোখ দুটিও কখন যে জলে ভিঁজে একাকার হয়ে গেছে, সে নিজেও জানে না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে দেয় নুহা। বলতে শুরু করে আবারো। জানেন তো, আমার এসবে একদম মন খারাপ হয় না। আমার ভালোই লাগে। ওরা আমায় কটু কথা বলে আর আমি সেখান থেকে শক্তি পাই। সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পাই। নিন্দুকের কথার আঘাতে জর্জরিত আমি প্রতিবার সম্মুখ পথে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সঞ্চয় করি ওদের বিষমাখা কথা থেকেই। ওরা আমাকে দাবাতে চায়, কিন্তু পারে না। কারন ওরা হয়তো জানে না কালো কিংবা শ্যাম বর্ণে আমার কিচ্ছু যায় আসে না। বিশ্বাস করোন গায়ের রঙ নিয়ে আমি একটুও হীনমন্যতায় ভুগি না। কারন আমার আছে অগাধ আত্মবিশ্বাস। আর সেই আত্মবিশ্বাসের জোরেই আমি সামনে এগিয়ে যাই। আমি ওদের বুঝিয়ে দিতে চাই, হেরে আমি যাইনি। হেরে গেছিস তোরা। আমি বুঝিয়ে দিতে চাই আমিও পারি।
অবাক শুভ বিস্মিত দৃষ্টিতে নুহার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে, কি সাংঘাতিক মেয়ে! মুহূর্তে কাঁদাতে পারে আবার মুহূর্তেই হাসিয়ে দিতে পারে। ভাবতে ভাবতেই ভাবনার অতল গহ্বরে হারিয়ে যায় শুভ। ঘোর কাটে নুহার ডাকে।
‘ ঘুমিয়ে গেছেন?’
ফিরে তাকায় শুভ। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলে, তুমি ঘুমাবে না? রাত তো অনেক হয়েছে। মাথা নাড়িয়ে না-বোধক জবাব দেয় নুহা। তারপর প্রশ্ন করে শুভকে, কয়টা বাজে আপনার হাত ঘড়িতে? শুভ ঘড়িতে সময় দেখে জানায়, তিনটে বেজে সতেরো।
বসা থেকে লাফিয়ে উঠে নুহা। উত্তেজিত গলায় বলে, হায়! হায়! সময় যে বয়ে গেল।
পাশ থেকে প্রশ্ন করে শুভ, কিসের সময়? কিচ্ছু বলেনি নুহা। একরকম দৌঁড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। ফিরে আসে মিনিট দুয়েক পর। চোখে মুখে ছিটা লেগে আছে। দু’হাতও পানিতে ভেঁজা। মাথা ওড়না দিয়ে ঢাকা।
প্রশ্ন করতে চাচ্ছিল শুভ, এই শীতে আপনি শরীর কেন ভিঁজিয়েছেন? কিন্তু পারেনি। কৌতূহলী শুভ পারে নি ওর কৌতূহল মেটাতে। তার আগেই নুহার প্রশ্ন, কিছুক্ষণের জন্য একটু কি বাহিরে যেতে পারবেন? আসলে আমার একটা কাজ বাকি আছে।
” Oh, sure…” বলে রুম থেকে বেরিয়ে যায় শুভ। দরজা বন্ধ করে দেয় নুহা। শূন্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে শুভ। মিনিট পাঁচেক অতিবাহিত হলে দরজায় কড়া নাড়ে। ‘তোমার হলো?’ প্রতিউত্তরে কোনো সাড়া আসে নি ভিতর থেকে। শুভ ভাবছে, হয়তো বা চেঞ্জ করছে নুহা। তাই আবারো বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কেটে যায় আরো পাঁচ মিনিট। এবার মনে হয় হয়ে গেছে। শীতে জড়োসড়ো শুভ আবারো দরজায় কড়া নাড়ে, মিস নুহা! আপনার কাজ হয়েছে কি? এবারো কোন সাড়া নেই। ব্যাপার কি? আমায় বাইরে রেখে দরজা দিয়ে ঘুমিয়ে গেল না’তো…!
জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় শুভ। পর্দাটা সরিয়ে ভিতরে দৃষ্টি দিতেই একটা স্থানে চোখ আটকে যায় শুভর। বিছানায় রেখে আসা ওর গায়ের চাঁদর বিছিয়ে গভীর ধ্যানে নামাজে বসেছে নুহা। কিন্তু এখনো তো ফজরের আজানই দেয়নি। কিসের নামাজ এটা? কোন নামাজের সময় হতে পারে এটা? ভাবতে থাকে শুভ। পিছন থেকে বাচ্চা কন্ঠে ডাক আসে, শুনছেন? ঘোর কাটে শুভর। পিছনে ফিরে তাকায়। মাথা নিচু করে নুহা দাঁড়িয়ে।
প্রশ্ন করে শুভ, ওহ! হয়ে গেল তোমার? চলো রুমে যাই। নিচু স্বরে শুভর জবাব, স্যরি। অবাক হয়ে যায় শুভ। প্রশ্ন করে নুহাকে, ‘কিন্তু কেন?’
জবাব আসে, আসলে আপনার চাদরে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ব কথাটা আপনাকে আগেই জানানো দরকার ছিল।
হেসে দেয় শুভ। ও, আল্লাহ! এই কথা? আমি ভাবলাম কি না কি…! আচ্ছা, বাদ দাও।
রুমে চলে যায় শুভ। তার পিছুপিছু নুহাও রুমে ঢুকে।
সোফায় শুয়ে ওড়না দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে নেয় নুহা। আশ্চর্য শুভ প্রশ্ন করে, এত তাড়াতাড়ি আপনার সব দুশ্চিন্তা দুর হয়ে গেল?
মাথা তুলে তাকায় নুহা। মিষ্টি হেসে বলে, বারে! আল্লাহর প্রিয় বান্দার মন খারাপ। আর সেই মন খারাপি দুর করার জন্য তার বান্দা প্রচন্ড শীতকে উপেক্ষা করে ওজু করে নামাজে দাঁড়িয়েছে। তার দরবারে কিছু চেয়েছে। আল্লাহ কি তার মন ভালো না করে দিয়ে পারে?
স্তব্ধ হয়ে যায় শুভ। প্রতি পলে পলে শুভ এক নতুন নুহাকে আবিষ্কার করছে। আর সেই নতুন নুহাকে প্রত্যেকটা নতুন রূপেই লাগছে অমায়িক সুন্দর। এক মুগ্ধতার রেশ কাটতে না কাটতেই আরো মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে যাচ্ছে।
এসব নিয়ে ভাবতে গিয়ে ভাবনার অতলে হারিয়ে গিয়েছিল শুভ। ভাবনাচ্ছেদ ঘটে দরজায় করাঘাতের আওয়াজে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেয় শুভ। দরজার সামনে বন্ধু রাকিব দাঁড়িয়ে। এভাবে বাথরুম- বারান্দা, বারান্দা- জানালার পাশে দৌঁড়াদৌঁড়ি কেন করতেছিস? তোদের কি এ রুমে থাকতে কোন সমস্যা হচ্ছে?
‘আরে না..’ বলে মাথা ঝাকায় শুভ। লাজুক হেসে বন্ধু রাকিবের আরো একটা প্রশ্ন, কিরে কেমন কাটলো মধুরাত? মধু কেমন আহরণ করলি?
ঠাস করে থাপ্পর বসিয়ে দেয় শুভ ওর বন্ধুর গালে। গালে হাত বুলাতে বুলাতে রাকিবের জবাব- স্যরি, আমি তো ভুলে গেছিলাম তুই রক্তমাংসে তৈরি মানব নয়, তুই হইলি যন্ত্র মানব। যার কোন ফিলিংস নেই। দাঁতে দাঁত চেপে কলার ধরে টানতে টানতে শুভ ওর বন্ধুকে ওর রুমে ঢুকিয়ে তার স্ত্রীকে বলে আসে, সকালে চলে যাব। তার আগ পর্যন্ত ভাবি আপনি অমানুষটারে রুমে আটকে রাখেন। হেসে দেয় রাকিবের স্ত্রী স্বর্ণা। হা, হা দেবর মশায়! মেজাজ এত চড়া কেন? মধু আহরণে কি ব্যর্থ হয়েছেন নাকি? রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে রাকিবের স্ত্রীর দিকে তাকায় শুভ। স্বর্ণা আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। মুখ চেপে ধরে রাকিব। বইন শান্ত হো! আল্লাহর ওয়াস্তে বইন তুই মুখে তালা লাগা। না হলে যন্ত্রমানব আমাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিবে। স্বামীর মুখে বইন ডাক শুনে মুখ চেপে ধরে রাখা অবস্থায়’ই চোখ বড় বড় করে ফেলে স্বর্ণা। মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে উঠে শুভ, পুরো তার ছিড়া দুই মানব মানবি। রুম থেকে বেরিয়ে যায় শুভ।
দরজায় সামনে গিয়ে লজ্জায় ঘরের দিকে পা বাড়াতে পারছে না শুভ। ইস! কি লজ্জার কথাটাই না বলে গেল। না জানি কি ভেবেছে মেয়েটা। প্রচন্ড লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় শুভর। সেই মাথা নিচু অবস্থাতেই রুমে ঢুকে। দরজা আংশিক মিশিয়ে খাটে গিয়ে বসে। পাকনা বুড়ির ভাবমূর্তিটা এখন কেমন সেটা দেখার জন্য আড়চোখে সোফার দিকে তাকায় শুভ। থ হয়ে যায় সে। পা থেকে গলা পর্যন্ত পুরো শরীর সুন্দর করে ওড়না দিয়ে ঢেকে সোফায় ঘুমিয়ে আছে নুহা।
ঘাড়টা সোজা করে এবার ভালোভাবেই সোফার দিকে দৃষ্টি নেয় শুভ। নড়ে চড়ে উঠে নুহা। ফিরে তাকায় শুভর দিকে। ক্ষাণিকটা লজ্জায় শুভ ওর দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় অন্য দিকে।
ধীর গলায় বলে উঠে নুহা, জানতাম একজোড়া চোখ আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। এই জন্যই আমার কেমন জানি লাগছিল। চোখ বোজেও শান্তি পাচ্ছিলাম না।
জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে শুভ ফিরে তাকায় নুহার দিকে। স্মিতহাস্যে নুহার জবাব, অাপনিও অবাক হলেন না? কিন্তু বিশ্বাস করেন কেউ যদি আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমি সত্যি’ই চোখ বোজা অবস্থায় সেটা টের পায়।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শুভ। কি জানি হতে পারে।
হতে পারে নয়, এটাই সত্যি। আমি সত্যিই ব….(…)..? পুরো কথা বলতে পারেনি নুহা। তার আগেই ফজর নামাজের আজান দিয়ে দেয়। পুরো আজানটা চুপ করে শুনে সোফা থেকে উঠে বসে নুহা। ফিরে তাকায় শুভর দিকে। মৃদু হেসে বাহিরে চলে যায় শুভ।
রুমে ফিরে আসে নুহার নামাজ পড়া শেষে। দরজাটা কেবল আটকাতে গিয়েছিল শুভ। তখনি পিছন থেকে বাচ্চা কন্ঠে ভেসে এলো, ওজু করে তবেই দরজা আটকান। বেনামাজির স্থান নেই আমার ঘরে। চমকে উঠে পিছনে তাকায় শুভ।
বিয়েটা যখন হয়েই গেছে, তখন আর কেঁদে কি হবে?এখন চলুন শুরু করা যাক।
চমকে উঠে নুহা। শুভ নামের এক অচেনা যুবক, যার সাথে মাত্র কয়েক পরিচয় ওর। তার মুখ থেকে আচমকা এ ধরনের কথা শুনেছে। চমকে উঠার’ই কথা। বিস্মিত নুহা শুভ’র মুখের দিকে ফিরে তাকায়। ভয়ার্ত গলায় প্রশ্ন করে। মানে? শুশুশুশুরু ক্কককরব মমানে? কিকিকিকিকিকিকি বুবুঝাতে চাচ্ছেন আপনি? হেসে উঠে শুভ। আশ্চর্য! শুরু করব কথাটা শুনে আপনি এত তুতলাচ্ছেন কেন? এবারো কাঁপা গলায় নুহার জবাব, তুতলাচ্ছি আপনার উদ্ভট কথা শুনে। ভ্রু’টা কিঞ্চিৎ বাঁকা করে ফেলে শুভ। Strength! উদ্ভটের কিছু তো আমি বলিনি। আমি জাস্ট বলেছি, শুরু করা যাক। কি শুরু যাক সেটা তো শুনবেন আগে, নাকি? নুহা হাত দুইটা বুকের মধ্যে নিয়ে ভয়ে কুঁকড়ে দেয়ালের সাথে মিশে যায়। আমি কোন কথা শুনতে চাই না। উফফ! কপালে জমে থাকা ঘামগুলো মুছে নেয় শুভ। তারপর নুহার দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, শুনোন মিস নুহা! আপনি যে ভয়টা পাচ্ছেন সেটা সম্পূর্ণ অমূলক এবং ভিত্তিহীনও বটে। আপনি হয়তো ভাবছেন, যেভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েই গেছে। এখন ওনি নিশ্চয় আমার উপর অধিকার খাটানোর জন্য ঝাপিয়ে পরবেন। না, মিস নুহা! আমার এসবে ইন্টারেস্ট নেই। বিশেষ করে আপনার মত পিচ্চি মেয়ের সাথে তো এসব করার প্রশ্নই উঠে না। আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা শুরু করতে চাচ্ছিলাম। আর সেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটা হলো রাত পোহালে আমাদের দু’জনের রাস্তা আলাদা হয়ে যাবে। আজকের পরে আমার সাথে আপনার কখনো দেখা হবে না। এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত থাকুন।
কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে নুহা। আর বিয়ে? ঐটার কি হবে? একটা বড়সড় নিশ্বাস ফেলে শুভ। মিস নুহা! বিয়েটা জাস্ট একটা এক্সিডেন্ট। আর সে এক্সিডেন্ট’টাও আপনার কারনেই হয়েছে। আপনি মানুষ না চিনে এক বখাটের সাথে এফবিতে ফ্রেন্ডশিপ করেছেন। তারপর স্কুল থেকে শিক্ষাসফরে এসে সেই বখাটের সাথে দেখা করেছেন। বখাটে আপনাকে একটা বানোয়াট কাহিনী শুনালো। আপনি সেই কাহিনী বিশ্বাস করে ফেললেন। শুধু বিশ্বাস করেই ক্ষান্ত হননি। ফ্রেন্ডস সার্কেল আর স্যারদের সবার চোখ এড়িয়ে বখাটের সাথে চলে গেলেন বখাটের অসুস্থ মাকে দেখার জন্য। ব্যাস, হয়ে গেল। ঘটে গেল ঘটনা। আপনি ওখানে গিয়ে জানতে পারেন বখাটে আপনাকে বানোয়াট কাহিনী শুনিয়ে ফাঁদে ফেলানোর চেষ্টায় ছিল এতদিন। আজ সফল হয়েছে। এদিকে কলেজের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে নিয়ে আমিও সফরে এসেছি। সবুজের সমারোহ আর প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে কখন যে গহীন অরণ্যে ঢুকে পরেছি, বুঝতে পারিনি। হঠাৎ করে আপনার চিৎকার শুনতে পেলাম। ছুটে গেলাম। বখাটে ছেলেটা চলে গেল দৌঁড়ে। স্থানীয় লোকজন এসে আমাকে আপনাকে নির্জন স্থানে দেখতে পেল। ঘটনা হয়ে গেল রটনা।ওরা বিয়ে পরিয়ে দিল। শুধু বিয়ে পরিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। আমাদের বাবা মায়ের ফোন নাম্বার নেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। মান সম্মান অবশিষ্ট বলে যেটুকু ছিল, সেটুকু বাঁচানোর জন্য কৌশল করে বন্ধুকে ভাই বানিয়ে ফেললাম। কল করলাম ওকে। ও আসল। আমাদের উদ্ধার করে ওর বাসায় আশ্রয় দিল। বোকামি করেছেন আপনি আর তার খেসারত গুনছি আমি। এখন আবার বলছেন, বিয়ে? গুষ্টি কিলায় এমন বিয়ের। সকালটা হোক। আপনাকে আপনার স্যারদের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমি আমার রাস্তা মাপতো।
এটুকু বলে লাইট জ্বালিয়েই শুয়ে পড়ে শুভ। ক্ষাণিক বাদে মাথা উঁচু করে। প্রশ্ন করে নুহাকে। আচ্ছা কিসে পড়েন আপনি? দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়েছিল নুহা। শুভর প্রশ্নে মাথা তুলে তাকায়। জ্বি, আমি এইটে পড়ি। শুয়া থেকে উঠে বসে পড়ে শুভ। ‘কি? এইটে পড়েন আপনি? এইটে পড়া একটা বাচ্চা মেয়ে কি না ফেসবুক চালায়?’ দুঃখের মাঝেও হেসে দেয় নুহা। অামি তো ভালোই। এইটে পড়ি। অথচ আমাদের পাশের বাসার এক আন্টি আছে। ওনার ছেলেও এফবি চালান। ওনার ছেলে কিসে পড়ে জানেন? ভ্রু-কুঁচকে তাকায় শুভ। প্রশ্নবোধক জবাব দেয়, সেভেনে? খিলখিলিয়ে হেসে দেয় নুহা। আরে না, ক্লাস থ্রিতে। কপালে ভাঁজ পড়ে যায় শুভর। কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই ভেসে এলো নুহার প্রশ্ন। সাথে উত্তরও। তার কয়টা আইডি আছে জানেন? ৭টা। শুনবেন কি, কি আইডি? শুভ নুহার দিকে ফিরে তাকালো শুধু। শুভ’র উত্তরের অপেক্ষা না করে নুহা আঙ্গুল খাড়া করে গিটগুলো গুনতে লাগল-
১) অবুঝ বালক।
২) শান্ত বালক।
৩) দুষ্টু বালক।
৪) রোমান্টিক পোলা।
৫) ঢাকার কিং।
৬) বসন্ত বাতাসে, লুঙ্গি আকাশে।
৭) কিশোরগঞ্জের পোলা জিকু।
সাতটা নাম বলে নুহা আঙ্গুলের গিটগুলো আবারো প্রথম থেকে গুনা শুরু করে। শুভ সে দৃশ্য দেখে আনমনেই হেসে দেয়। প্রশ্ন করে নুহাকে। ‘তা তোমার সেই পাশের বাসার আন্টির ছেলে জিকুর সাথে তোমার কতদিনের রিলেশন?’ শুভ’র এমন প্রশ্নে নুহা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নেয় নুহা। তারপর লম্বা স্বরে বলে উঠে, এ্যা মা! এসব কি বলছেন? জিকু তো আমার ৫বছরের জুনিয়র। ওর সাথে আমার যায় নাকি? হেসে দেয় শুভ। আনমনেই বলে উঠে, বাব্বাহ! বেশ চতুর। প্রশ্ন করে নুহা। কিছু বলছেন? কথা ঘুরায় শুভ। ‘আমার বড্ড ঘুম পাচ্ছে, আমি ঘুমাচ্ছি। তুমি বরং আমায় পাহাড়া দাও বসে। ‘হু, আচ্ছা বলে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে পূর্বের ন্যায় দু’হাঁটুর ফাঁকের ভিতর মাথা রেখে নিচু হয়ে বসে পড়ে নুহা।
শুভ চোখ দুটো বন্ধ করবে তখনি খেয়াল হয় কথার ছলে নুহাকে সে হুট করে আপনি থেকে তুমি সম্বোধন করে ফেলেছে। চোখ মেলে তাকায় শুভ। উঠে বসে বিছানায়। ডাক দেয় নুহাকে। শুনোন… মাথা তুলে তাকায় নুহা। ধীর গলায় বলে উঠে শুভ- আমি, স্যরি। চোখ দুটো মার্বেলের মত গোলগোল করে ফেলে নুহা। ‘কেন? আর কিসের স্যরি?’ জবাব দেয় শুভ। আমি তোমাকে ভুলে তুমি ডেকে ফেলেছি। সে জন্য স্যরি। খিলখিল শব্দে হেসে উঠে নুহা। আপনি তো এখনো আমায় তুমি ডাকছেন। তবে মন্দ লাগছে না। আর এমনিতেও আমি আপনার থেকে কম করে হলেও ১০,১২বছরের ছোট হবো। তাই এ হিসেবে ডাকতেই পারেন। আপনি করে ডাকলে আমার আবার নিজেকে মুরুব্বী মুরুব্বী লাগে। হেসে দেয় শুভ। ঠিক আছে। আমি তোমাকে তুমি বলেই ডাকব। আচ্ছা, গুড নাইট। প্রতিউত্তরে ‘উম্মমমম, নাইট’ বলেই আবারো পূর্বের ভঙ্গিতে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে পড়ে নুহা।
মাঝ রাত্রিতে ঘুম ভেঙে যায় শুভর। মনে পড়ে নুহা নামের সেই পাকনা বুড়িটির কথা। ভাবছে রাত তো অনেক হয়েছে। নিশ্চয় সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পরেছে। সোফার দিকে তাকিয়ে হতাশ হয় শুভ। ফ্লোরের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পায় সেই পূর্বের ন্যায় দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে, মাথাটা হাটুর ভিতর ঢুকিয়ে বসে আছে মেয়েটি। বাচ্চা বাচ্চা হাত দুটো সামনের দিকে ছড়ানো। দীঘল কালো কেশগুলো এলোমেলো অবিন্যস্ত ভাবে এদিক ওদিক ছড়ানো। না চাইতেও ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে শুভর। বিছানা থেকে নেমে কাছে যাচ্ছিল। পায়ের শব্দে চুলগুলো আংশিক ফাঁক করে মাথা তুলে তাকায় নুহা। শুভকে এভাবে ওর দিকে আসতে দেখে ভয়ে জড়োজড়ো হয়ে যায়। ‘ওহ, জেগে আছ? আমি ভাবছি ঘুমিয়ে গেছ। এভাবে বসে ঘুমাচ্ছো, অসুবিধে হচ্ছে কি না! তাই ভাবলাম সোফায় শুইয়ে দেই।’ হেসে দেয় নুহা। না, না! আমি ঘুমাইনি। প্রশ্ন করে শুভ। এভাবে বসে থাকতে থাকতে তো মনে হয় ঘাড় ব্যথা হয়ে গেছে তোমার। না ঘুমালেও অন্তত সোফায় গিয়ে শুয়ে থাকো। জবাব আসে, মন খারাপের সময় আমি শুই না। এভাবেই বসে থাকি। এতে আমার চিন্তা কিছুটা সময়ের জন্য হলেও দুর হয়ে যায়। মনে মনে হেসে উঠে শুভ, ‘ওরে পাকনা বুড়িটা। এই বয়সে আবার চিন্তা।’ প্রশ্ন করে শুভ, তা এখন কিসের চিন্তা করছ? কার জন্য মন খারাপ? অপ্রত্যাশিত বিয়ের জন্য কি? গম্ভীর গলায় নুহার জবাব- মায়ের জন্য মনটা বড্ড পুড়ছে। পুনরায় প্রশ্ন করে শুভ। কোথায় থাকে তোমার মা? জবাব আসে, বিদেশ। কৌতূহলী মনে শুভ আবারো প্রশ্ন করে। সে কি! তোমার বাবা নেই? নুহার ছোট্ট জবাব, আছে। প্রশ্ন করে শুভ, তাহলে বাবা থাকতে মা কেন বিদেশ?
শুভর দিকে ফিরে তাকায় নুহা।
” আমার দাদা এক্সিডেন্টে মারা গেছে আমি যখন ফাইভে পড়ি তখন। আর এক্সিডেন্ট’টা মায়ের চোখের সামনেই হয়েছিল। সেই থেকে আমার মা পাগল। প্রথমে একটু একটু পাগলামি করত। পরে সম্পূর্ণ পাগল হয়ে যায়। চিকিৎসা করিয়েছে অনেক। কিন্তু ভালো হয়নি। বাধ্য হয়ে আব্বু শিক্ষকতার চাকরী ছেড়ে দিয়ে আম্মুকে নিয়ে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য চলে যান। ২বছর হলো বিদেশে আম্মুর চিকিৎসা চলছে। এখনো আগের মতই পাগলামি করে। আমাদের ভাই-বোনদের কাউকে আর বাপজান, আম্মাজান বলে ডাকে না আম্মু। আব্বুর মুখেও আদিরা মামনি কিংবা নীলয় বাবাই ডাকটা আর আমরা শুনি না। বাসায় দাদিমা শুধু নীলয়কেই আদর করেন। আমি দেখতে মায়ের মত কালো হয়েছি। এই জন্য আমায় সহ্য করতে পারেন না ওনি। বলে কি, লেখাপড়া করে আর কি করবি? দেখতে তো একদম পাতিলের তলার মত। কে বিয়ে করবে তোকে? আমি কি করব বলুন। যে যা ক্রিমের কথা বলে, সেই ক্রিম’ই মুখে লাগাই। কিন্তু স্থায়ীভাবে ফর্সা আর হইনা। এটুকু বলে থেমে যায় নুহা। বোধ হয় গলাটা ধরে এসেছে কিংবা আর বলতে পারতেছে না। অদুরে বসে থাকা শুভর চোখ দুটিও কখন যে জলে ভিঁজে একাকার হয়ে গেছে, সে নিজেও জানে না।
ফুলশয্যা(সিজন-০২)
পর্ব- ২৬ এবং অন্তিম পর্ব
লেখা- অনামিকা ইসলাম।
বিছানার পাশে কলাগুলো রেখে শুয়ে পরে আবির। মিনিট ত্রিশেক পর শুনতে পায় চপচপ শব্দ। শব্দটা ঠিক পাশ থেকেই আসছিল। মনে হচ্ছে আদিরার কলার উপর ইঁদুর হামলা করেছে। আস্তে আস্তে ফোনটা হাতে নিয়ে টর্চটা জ্বেলে দেয়। কিন্তু একি?
” এ যে ছোট ইঁদুর….”
হেসে দেয় আবির। ঘুমে ঢুলুঢুলু আদিরা মিটমিট চোখে কলা খাচ্ছে……
‘ওরে আমার পিচ্চি কলা পাগলী’টা….’
হাত থেকে ফোনটা রেখেই আবির আদিরাকে জাপটে ধরে। নাকে, মুখে, কপালে চুমু দেয়। আদিরা প্রচন্ড রাগান্বিত ভঙ্গিতে জানান দিচ্ছে, ‘ওর কলা খাওয়াতে আবির বিঘ্ন ঘটিয়েছে।’ সরে যায় আবির। সরে গিয়ে সুযোগ করে দেয় কলা খেতে। আদিরা আপনমনে কলা খেয়ে চলছে।
পরদিন___
সকাল সকাল’ই জেগে উঠে আবির। বলতে গেলে বলতে হয় অনেকটা বাধ্য হয়েই উঠেছে। না হলে ছুটির দিনে এত তাড়াতাড়ি উঠার লোক আবির না। আসলে ফজর নামাজ শেষে একটু শুয়েছিল, কিন্তু পিচ্চি আদিরার কলকলানির আওয়াজে আর টিকতে পারল না।
‘ বাপরে বাপ!’ এত্ত কথা পারে কিভাবে? কথাটা বলেই আবির ঘুম ঘুম চোখে আদিরাকে নিয়ে পাশের যে রুমে নীলিমা শুয়েছে সে রুমে যায়। আদিরাকে কোলে নিয়ে’ই ওরুমের দরজা আংশিক ফাঁকা করে উঁকি দেয়। কিন্তু একি?!
নীলিমা যে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে ভেঁজা চুল আঁচড়াচ্ছে! দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে আবির। চোখ বড় বড় করে নীলিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘কি ব্যাপার? সকাল সকাল গোসল, ঘটনা কি?’ আবিরের দিকে তাকায় নীলিমা-
” ঘটনা মানে?”
আবিরের কোল থেকে নেমে আদিরা দৌঁড়ে নীলয়ের কাছে চলে যায়। নীলিমা তখনো জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। মাথা চুলকায় আবির।
” ইয়ে, না মানে আমি তো কালকে তো আমি ঐ রুমে ছিলাম! তবে কি তুমি স্বপ্নে…..(…)….???”
রেগে যায় নীলিমা। কথার মাঝখানে থামিয়ে দেয় আবিরকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠে, ‘স্বপ্নে নয় বাস্তবে! আপনার গুনধর পুত্র প্রস্রাব করে পরনের জামা ভিঁজিয়ে দিয়েছে।’ মুখে দুষ্টু হাসির রেখা ফুটে আবিরের।
” উহ! আমি ভাবলাম কি না কি হয়েছে।”
কিছু বলতে গিয়েও বলেনি নীলিমা। প্রচন্ড রাগে রুম থেকে হনহনিয়ে বের হয়ে যায়।
ব্রেকফাস্টের পর___
আবির রুমে বাচ্চাদের সাথে খেলতেছে আর নীলিমা কিচেনে বাচ্চাদের জন্য খাবার তৈরি করতেছে। পাশে এসে দাঁড়ায় নীলিমার শাশুড়ি। পিছনে না ফিরেই প্রশ্ন করে নীলিমা- “মা! কিছু লাগবে?”
বাঁকা মুখে শাশুড়ির জবাব,
নাহ! আদিবার শ্বশুর বাড়ি থেকে কল এসেছে। ওর ননদের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ওরা বলেছে, বিয়ের কেনাকাটা করতে হবে। আদিবা যেন আদিত্যকে নিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। আর আমাদেরও দাওয়াত দিয়েছে, বিয়ের দু’দিন আগে বিয়ে বাড়িতে উপস্থিত থাকতে হবে। আমার শরীরটা’তো বেশী ভালো যাচ্ছে না। তাই আমি কোনো বিয়েটিয়েতে যেতে পারব না। কিন্তু তোমরা যেও। না হলে ব্যাপারটা খারাপ দেখা যায়। আর হ্যা, বিয়ের যেহেতু এখনো ১৫দিন বাকি তাই মুখে একটু ক্রিম-ট্রিম মেখে দেখো একটু সাদা হওয়া যায় কি না। বাজারে তো আজকাল অনেক ক্রিম’ই বিক্রি করে। একটা ক্রিম কিনে দেখো, রঙ’টা একটু ফর্সা হয় কি না।
কথাগুলো বলে’ই নীলিমার শাশুড়ি চলে যায়। নিঃশব্দে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলে বাচ্চাদের খাবার নিয়ে রুমের দিকে পা বাড়ায় নীলিমা।
নীলিমা রুমে ঢুকে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে আর আবির নীলিমাকে হেল্প করছে। খাওয়ানো শেষে বসা থেকে উঠে পরে আবির। হাটতে হাটতে দরজার কাছে চলে যায়। পিছন থেকে ডাক দেয় নীলিনা-
” শুনছেন?”
পিছনে ফিরে তাকায় আবির। তারপর—
আবির:- কিছু বলবে?
নীলিমা:- কোথাও যাচ্ছেন নাকি?
আবির:- হুঁ, মায়ের রুমে।
নীলিমা:- আচ্ছা, তবে যান।
আবির:- কিছু লাগবে তোমার?
নীলিমা:- না, আপনি যান।
আবির:- না, আগে তোমার কথা বলো। কি বলতে চাইছিলে? কিছু লাগবে কি?
মাথা নিচু করে নীলিমা। তারপর নিচু স্বরেই বলে, আমার একটা জিনিস আনা খুব দরকার ছিল। ভাবলাম আপনি বাজারে যাচ্ছেন……
আবির:- ওহ! এই কথা? কি জিনিস?
‘দাঁড়ান, আমি কাগজে লিখে দিচ্ছি।’
নীলিমা কাগজে ছোট্ট অক্ষরে ত্বক ফর্সাকারী একটা ক্রিমের নাম লিখে দিল। কলেজে থাকাকালীন সময়ে অনেক মেয়েরা নীলিমাকে কটাক্ষ করে, ওকে নিয়ে ঠাট্টা করে বিভিন্ন ক্রিম ব্যবহার করার কথা বলত। তখন ওদের কথায় অপমানিত হলেও কষ্ট পায়নি। কথাগুলো এক কান দিয়ে শুনলে আরেক কান দিয়ে বের করে দিত। আজ শাশুড়ির কথাটা ভিতরে গিয়ে আঘাত করেছে। মনে কষ্ট পেয়েছে নীলিমা। তাই সেদিন বান্ধবীদের সাজেস্ট করা ক্রিমের থেকে একটা ক্রিমের নাম লিখে দেয়। আবির কাগজটা ভাঁজ করে প্যান্টের পকেটে রেখে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, ঠিক আছে! আমি তবে এখনি নিয়ে আসছি….
কথাটা বলেই আবির বাজারের দিকে পা বাড়ায়। পুরো বাজারের কসমেটিকসের দোকান ঘুরে সবশেষে একটা দোকানে ক্রিমটার খুঁজ পাওয়া যায়। ক্রিমটা হাতে নিয়ে আবির বাসায় ফিরছিল। রাস্তায় বোন আদিবার সাথে দেখা হয়। ছেলে নিয়ে রিক্সাতে করে চলে যাচ্ছে বাসস্টপের দিকে। আবিরকে দেখে রিক্সাওয়ালাকে থামায়। প্রশ্ন করে আদিবা-
“দেখি তো ক্রিমটা?”
আবির বোনের দিকে ক্রিমটা এগিয়ে দেয়।
ক্রিমটার দিকে একনজর তাকিয়ে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় আদিবা। প্রশ্ন করে ছোট ভাইকে- ‘ নীলিমা নিতে বলেছে?’
মাথা ঝাকায় আবির। অনেকটা জোরেই হেসে দেয় আদিবা।
‘ আচ্ছা, নিয়ে দে ওকে।
দ্যাখ, এটা দিয়ে একটু সাদা হতে পারে কি না। শাশুড়ির মন রক্ষা করতে পারে কি না।কথাটা বলেই আদিবা চলে যায়।’
আবির এতক্ষণে বুঝতে পারল তখন দোকানের ছেলেটা কেন বলছিল, বাব্বাহ! ভাবিও রূপচর্চা করে তাহলে? রাগে পুরো শরীর কাপছে আবিরের। ৭মিনিটের রাস্তাও ৫মিনিটে গেল। ড্রয়িংরুমে বসে নীলিমা তখন টিভিতে রূপচর্চা বিষয়ক একটা অনুষ্ঠান দেখছিল। আবিরকে দেখেই চ্যানেলে পাল্টে টিভি বন্ধ করে ফেলল। নীলিমাকে কিচ্ছু না বলে আবির হনহনিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। নীলিমা নিচে বাচ্চাদের রেখেই আবিরের পিছু নেয়। আবির ওর রুমে না ঢুকে সরাসরি মায়ের রুমে ঢুকে। নীলিমাও পিছু নেয়। রুমে কাউকে না দেখতে পেয়ে প্রশ্ন করে, মা কোথায়? নীলিমার জবাব, এইতো পাশের বাসায় গেছে। ওহ, বলে রুমে চলে যায় আবির। আবিরের পিছু পিছু নীলিমাও রুমে যায়। আবির হাত থেকে ক্রিমটা ড্রেসিংটেবিলের দিকে ছুঁড়ে মারে। নীলিমা ক্রিমটা ধরতে গেলে আবির বাঁধা দেয়। ‘খবরদার! ক্রিমে হাত দিবা না।’
চমকে যায় নীলিমা। হাত দিব না মানে? উগ্র মেজাজে আবিরের জবাব, হাত দিবা না মানে হাত দিবা না। প্রশ্ন করে নীলিমা, তবে এটা এনেছেন কেন? নির্লিপ্ত কন্ঠে আবিরের জবাব, এটা মায়ের জন্য। মাকে দিব। বুঝতে পারছ এবার? ভ্রু-জোড়া কিঞ্চিৎ বাঁকা করে নীলিমার প্রশ্ন, মানে? মায়ের জন্য এনেছেন মানে? ক্রিমটা হাতে নিয়ে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে আবির জবাব দেয়, মানে খুব সহজ। এই ক্রিমটা মায়ের জন্য এনেছি। নীলিমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, উফ! আপনি বুঝতে পারছেন না কেন? এই ক্রিমটা ত্বক…..(…..)….???
পাশ থেকে আবিরের জবাব, ফর্সা করে তাইতো? আমি এ ক্রিমটা আমার মাকে ফর্সা করার জন্য’ই দিব। তবে সেটা বাহ্যিক সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য নয়। আমি এটা মাকে দিব অভ্যন্তরিন সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্য। আমি এটা ওনাকে দিব। তবে মুখের নয়, মনের কালো দুর করার জন্য। এটুকু বলে আবির রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। কলার চেপে ধরে নীলিমা-
নীলিমা:- কি করছেন কি?
আবির:- ছাড়ো, ছাড়ো বলছি….
নীলিমা:- মাথা নষ্ট হয়ে গেছে আপনার?
আবির:- হ্যা, আমার মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। আমাকে ছাড়ো তুমি, ঐ মহিলার সাথে আজ’ই আমার শেষ দিন।
নীলিমা:- খবরদার! আর কখনো যাতে এরকম বাজে কথা না শুনি।(মুখ চেপে)
আবির:- আর কখনো বলতেও চাইনা। আজই শেষ বুঝাপড়া হবে ঐ মহিলার সাথে।
নীলিমা:- এবার কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আরেক বার যদি মহিলা শব্দটা শুনি না তাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে। আর আপনার একটুও বিবেকে বাঁধছে না নিজের জন্মদাত্রী মাকে ঐ মহিলা মহিলা করে বলতে? কেন এভাবে রেগে যাচ্ছেন? কি করেছেন ওনি?
আবির:- আজ ওনার পরামর্শেই তুমি ত্বক ফর্সাকারী ক্রিমটা আনছ তাই না?
নীলিমা:-……. (স্তব্ধ হয়ে)
আবির:- কি হলো? মুখের বুলি শেষ হয়ে গেল এখনি?
নীলিমা:- দেখুন, আপনি অযথায় রাগ করছেন। ওনি আমাকে জাস্ট ক্রিমটা সাজেস্ট করছেন, এটুকুই। ওনি আমাকে ছোট বা অপমান করার মত কিছুই বলেননি। তাই প্লিজ শান্ত হোন।
রেগে যায় আবির। নীলিমার থেকে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে। তারপর জোর গলায় বলতে শুরু করেন-
এতকিছুর পরও তুমি বলছ অপমান করেনি? দিনের পর দিন তোমার বংশ নিয়ে, তোমার গায়ের রঙ নিয়ে কথা শুনিয়েই যাচ্ছে, তারপরও বলছ অপমান করেনি? একটু কাজে ভুল না হতেই মা বাবা তুলে গালি দেয়, তাও বলছ অপমান করেনি? বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে সামান্য একটু খেতে চাইতা, তার জন্য কথার আঘাতে জর্জরিত হতে হয়েছে। তারপরও বলছ অপমান করেনি? আদিরা একটু কালো হয়েছে, এই জন্যও তুমি দায়ী। কথা শুনতে হয়েছে তোমাকে। নীলি, নিজেকে খুব চালাক আর আমাকে খুব বোকা মনে করো, তাই না? ভেবেছ আমি কিছু’ই জানি না? বাচ্চাদের ১ম জন্মদিনে মায়ের তিক্ত কথা সহ্য করতে না পেরে আদিরার মুখ পরিষ্কার করার জন্য সাবান দিয়ে মুখ ঘষতে ঘষতে রক্ত বের করে দিয়েছিলা, তুমি কি মনে করেছ? আমি সেসব জানি না? তোমার কি মনে হয়, আমি সুদুর ঢাকা থেকে প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার দিন বাসায় শুধু বাচ্চা দেখতেই আসি? তোমার কি মনে হয় আমি তোমাকে আড়ালে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে দেখিনি? তোমার কি মনে হয় আমি দেখিনি বাচ্চা পেটে থাকা অবস্থায়ও মা তোমার সাথে কিরকম বাজে ব্যবহার করত? তোমার কি মনে হয় আমি তোমার হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকা কষ্টকে অনুভব করতে পারি না? আমি সব জানি, সব বুঝি, সব দেখি। কিন্তু কিচ্ছু বলিনি এতদিন। মনে করেছিলাম, যাক না কিছুদিন! তারপর ভালো হয়ে যাবে আমার মা। শুধরে নিবে নিজেকে। কিন্তু নাহ। আমার মা ভালো হয়নি। পরিবর্তন হয়নি দৃষ্টি ভঙ্গির। আসলে কি জানো? ওনি কখনো শুধরাবার নয়। আজ তাই আমি ওনাকে কিছু কথা শুনাতে চাই। তারপর ওনাকে গুডবাই জানিয়ে আমি আমার বউ বাচ্চাদের নিয়ে ঢাকা চলে যেতে চাই।
চলে যাচ্ছিল আবির। দৌঁড়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে আবিরের পথ আগলে দাঁড়ায় নীলিমা। প্লিজ, আপনি শান্ত হোন। একটু শান্ত হোন। রাগের বশবর্তী হয়ে এত বড় অন্যায় করবেন না। যত যায় হোক, আপনি ওনার সাথে এমন করতে পারেন না। কারন, ওনি আপনার মা। আপনাকে জন্ম দিয়েছেন। মানুষ করেছেন। আজ সামান্য কারনে আপনি ওনার সাথে এমন করতে পারেন না। এত বড় পাপ করতে পারেন না। মানছি ওনি আমাকে অনেক সময় অনেক কটু কথা শুনিয়ে দিয়েছেন তার মানে এই নয় ওনি আমাকে ভালোবাসেন না! ওনি আমাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন। বিশ্বাস করেন ওনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন। আর ভালোবাসেন বলেই আমার সাথে রাগ দেখাতে পারেন। আর তাছাড়া ওনিও আমার মতো একটা জীবন অতিক্রম করে এসেছেন। যে জীবনে ওনিও আমার মতই বউ ছিল। আপনি একটা কথা বুঝতে পারছেন, এই যে ওনি আমাকে বলত এটা খাবে না, ওটা খাবে না। বেশী খাবে না। এগুলো আমার প্রতি কোনো রাগ থেকে বলেনি। এগুলো বলেছে কারণ ওনার সাথেও এরকম হয়েছে। ওনিও একসময় মুরুব্বীদের এসব কথা শুনেছে, মেনেছে। আর আমাকে এসব বলেছে বাচ্চার ভালোর জন্যই। কারন, ওনি এখনো মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন বেশী খেলে বাচ্চা জন্ম দেয়ার সময় কষ্ট হয়। টাকি মাছ খেলে বাচ্চার গায়ের রঙ কালো হয়। এগুলো কুসংস্কার। সুপ্রাচীন কাল থেকেই এসব চলে আসছে। তাই এসব বিষয়ে এককভাবে ওনাকে দোষারোপ করা যায় না। আর সবচেয়ে বড় কথা যেটা সেটা হলো ওনার বয়স হয়েছে। এই সময় মানুষের মস্তিষ্কের..(………..)……পরিবর্তন ঘটে। যার ধরুন বুড়ো মানুষরা বেশী কথা সহ্য করতে পারে না, প্যানপ্যান করে। ওনার অনেক বয়স হয়েছে। তাই ওনার এসব করাটাই স্বাভাবিক। এখন আমরা যদি ওনার এসব কথাকে মনে নিয়ে বসে থাকি, তাহলে তো হবে না। সবচেয়ে বড় কথা হলো, আমি ওনাকে আমার মা বলে মেনে নিয়েছি। তাই আমি বেঁচে থাকতে, একজন মেয়ে বেঁচে থাকতে তার মাকে কেউ কষ্ট দিতে পারে না, আপনিও পারবেন না। দয়া করে শান্ত হোন। প্লিজ……
আবির চুপ হয়ে যায়। এত্ত সুন্দর কথা শুনার পর, আর কি বা কথা থাকতে পারে। রাগটা এতক্ষণে অনেকটা কন্ট্রোলে চলে আসে আবিরের। নীলিমাকে সরানোর চেষ্টা করে বলে, তবুও প্লিজ তুমি একটু সরো। আমি জাস্ট মাকে দুটো কথা বলে আসব।
বাঁধা দেয় নীলিমা। ‘কোথায়ও যাবেন না আপনি। একটা কথাও বলতে পারবেন না আপনি ওনাকে।’ আবির নীলিমাকে সরানোর চেষ্টা করছে, নীলিমা যেতে দিচ্ছে না। একপর্যায়ে নীলিমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। ছিটছিনিতে হাত দেয় আবির, তখনি বসা থেকেই কাঁদতে শুরু করে নীলিমা। আবির তাকিয়ে দেখে নীলিমা ফ্লোরে পরে আছে। আমি ছিটকিনি না খুলে নীলিমাকে উঠায় আগে। ‘স্যরি….’
কাঁদতে থাকে নীলিমা। কাঁদতে কাঁদতেই আবিরের একটা হাত চেপে ধরে।
” দয়া করে আপনি ওনাকে কিছু বলবেন না। আপনাকে ওনি অনেক ভালোবাসেন। মেনে নিতে পারবেন না ওনি আপনার কথাগুলো। কষ্ট পাবেন ওনি, ভিষণ কষ্ট। প্লিজ, নিজেকে একটু শান্ত করেন। এভাবে রাগ দেখাবেন না। এতে সংসারে ফাঁটল ধরবে। আপনি একটু বুঝার চেষ্টা করেন। মাকে এভাবে কথা শুনালে আমার নিজেকে বড্ড ছোট মনে হবে। এরপর আমি মায়ের সামনে দিয়ে হাঁটতেই পারব না। তাই আমার কথাটা শুনুন…..
আবির নীলিমার হাত থেকে ওর হাতটা সরিয়ে নিয়ে নীলিমার চোখের জল মুছে দেয়। তারপর মুখে জোর করে হাসির রেখা টেনে বলে, ঠিক আছে! আমি কিচ্ছু বলব না। তুমি যাও রেডি হয়ে নাও। ঢাকায় যাব আমরা।
আবির চলে যাচ্ছিল। পিছন থেকে নীলিমার প্রশ্ন, পালিয়ে যাচ্ছেন? পিছনে তাকায় আবির। নীলিমা বলে উঠে, কিন্তু পালিয়ে কিংবা এড়িয়ে গেলে যে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায় না। আঘাতের বদলে আঘাত নয়, ভালোবাসা ফিরিয়ে দিতে হয়। কবি জসীমউদ্দীনের ‘প্রতিদান’ পড়েননি? কবিতায় ওনি বলেছেন,
ওনার ঘর যে ভেঙেছে ওনি তার ঘর বাঁধে, ওনাকে যে পর ভেবে দুরে সরিয়ে দিয়েছে, তাকেই আপন করার জন্য কাঁদে। যে ওনার দিকে বিষে ভরা তীর ছুঁড়ে দিয়েছেন, ওনি তাকেই বুক ভরা গান দেন। যে কুল ভেঙেছেন, ওনি তারই কূল বাঁধেন। যে ওনাকে বুকেতে আঘাত করেছে, ওনি তারই জন্য কাঁদেন। প্রকৃতপক্ষে জীবনের সার্থকতা তো এখানেই বুড়ো। দরজার সামনে থেকে আবারও ফিরে আসে আবির। নীলিমাকে বুকে টেনে নেয়। কপালে উষ্ণ ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিয়ে বলে, ঠিক আছে আমার পাকনা বুড়ি’টা। আমি পালিয়ে যাব না। তবে কাল কিন্তু যেতেই হবে। বাচ্চারা মোটামুটি বড়’ই হয়েছে, আর ওখানে শ্যালিকা শাশুড়ি মাও আছেন। তাই আর কিন্তু না করা যাবে না। হেসে দেয় নীলিমা। ঠিক আছে। কাল যাব। আজকে রাত্রে বাবা আসলে মা-বাবাকে কথাটা জানাবো আগে। কেমন? একটা মৃদু হাসি দিয়ে আবির বলে, ওকে।
সেদিন রাত্রে শ্বশুরের অনুমতি নেয়ার পর নীলিমা ওর শাশুড়ি মায়ের রুমের দিকে যাচ্ছিল। দরজার সামনে গিয়ে থমকে যায় নীলিমা। নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না সে। ওর শাশুড়ি কাঁদছে। খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে আস্তে, আস্তে কাঁদছে। বুকের ভেতরটায় কিরকম হাঁহাকার করে উঠল। এতবছরের বৈবাহিক জীবনে আজই প্রথম নীলিমা ওর শাশুড়ির চোখে পানি দেখছে। এখন ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে না এই ভেবে নীলিমা দরজার সামনে থেকে বিদায় নিচ্ছিল, ডাক দেয় শাশুড়ি। ” ভিতরে আসো….”
নীলিমা ভীরু পায়ে ভেতরে প্রবেশ করে।
“বসো….”
বিছানার পাশে বসে আমতাআমতা করতেছে নীলিমা। ইয়ে না মানে মা আমরা….(……)…..???
“কালকে চলে যাবে, তাই না?”
শাশুড়ির দিকে হা করে তাকায় নীলিমা। কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই নীলিমার একটা হাত চেপে ধরে শাশুড়ি।
‘ মারে! আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি ইচ্ছে করে তোর সাথে অনেক অন্যায় করেছি, তোকে কাঁদিয়েছি। গালি দিয়েছি মা বাপ তুলে। আমি বড্ড ভুল করেছিরে মা। ছাই ভেবে আমি হিরাকেই দুরে সরিয়ে দিয়েছি। খুব অন্যায় করে ফেলেছি আমি, আমায় মাফ করে দে মা। আমাকে একা করে দিয়ে যাস না। আমি আমার নাতি-নাতনিকে নিয়ে জীবনের শেষ সময়টা কাটাতে চায়।”
শাশুড়ির মুখ থেকে এমন কথা শুনে বড্ড মায়া হয় নীলিমার। কিন্তু কিচ্ছু করার ছিল না চোখের দু’ফোঁটা জল ফেলা ছাড়া। কারন, নীলিমা আবিরকে কথা দিয়ে ফেলেছে কাল চলে যাবে ওর সাথে।
‘মা! আমাদের কাল যেতে হবে। সকাল সকাল’ই রওয়ানা দিব।’
কথাটা বলেই নীলিমা রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আবিরের মা চোখের জল ছেড়ে দেয়। এ জল অনুশোচনার। একটা খাটি হিরার টুকরাকে হাতের কাছে পেয়েও হারিয়ে ফেলল, সেই অনুশোচনায়। সকালে পাশের বাড়ি থেকে ফিরে আদিরা নীলয়কে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখে প্রচন্ড রেগে ওদের নিয়ে যাচ্ছিল আবিরের রুমের দিকে নীলিমার কাছে। তখন’ই ওদের কথা শুনতে পায়। বাচ্চা দুটোকে ছেড়ে দিয়ে সব কথা শুনে নেয় আবিরের মা। অনুশোচনার জন্মটা ঠিক তখন থেকেই। পরদিন সকালে আবির ওর বউ বাচ্চা নিয়ে রওয়ানা হয়ে যায় ঢাকার দিকে। ছোট্ট নীলয় বার বার দাদীর দিকে ফিরে তাকিয়ে চিৎকার করছিল কোলে উঠার জন্য, দাদীও ছুটে আসছিল কোলে নিতে কিন্তু আবির দেয়নি। জোর করে বাচ্চাদের নিয়ে গাড়িতে উঠে বসে। হু, হু করে কেঁদে দেয় আবিরের মা। দু’চোখের লোনাজলে গাল ভিঁজে একাকার। এ কান্নার শেষ কোথায় ওনি নিজেও জানেন না…..
দেখতে দেখতে ৭বছর অতিবাহিত হয়ে যায়। ছোট্ট আদিরা-নীলয় ৯বছর বয়সে পদার্পণ করে। আবির নীলিমার বিবাহের বয়স তখন আঠারো। নভেম্বরের কোন এক তারিখে আবির ওর কলেজ স্টার্ভদের সাথে সফরে বের হয়। পুরো ৭দিনের সে সফর।
নভেম্বরের ১৩ তারিখ ছিল ওদের ১৮তম বিবাহবার্ষিকী।
নীলিমা ফোন দিল, ১৮তম বিবাহবার্ষিকী পালন করার জন্য বাসায় আসতে হবে। আবির তখন সিলেট সফরে গিয়েছিল। বলল, ৭দিনের সফর। তার আগে আসা যাবে না। তাই এবার বিবাহবার্ষিকী পালন করা হবে না। সত্যি বলতে নীলিমার জন্য একটা হার বানাতে দিয়েছিল আবির। বিশ হাজার টাকা বাকি ছিল। চিন্তা করল, হারের বকেয়া টাকাটা পরিশোধ করে নীলি বুড়িকে আঠারো তম বিবাহবার্ষিকীর একটা চমক তো দেয়া যায়। আইডিয়া অনুযায়ী বেতনসহ কলিগ মারুফের কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করল। সফরে কলিগদের থেকে বিদায় নিয়ে চারদিন আগেই রাতে বাড়ির দিকে রওনা হলো। নীলির হার তৈরি করতে দেয়া হয়েছিল ওর বাবার বাড়িতে। আবির শ্যালিকাকে ফোন করে বলল, লিমা, তুমি বকেয়া টাকা পরিশোধ করে হারটা বানিয়ে রাখো, আমি গিয়ে টাকা দিয়ে নিয়ে আসব। কিন্তু তোমার বোন যেন না জানে। এদিকে আবির ওর বোন আদিবাকে ফোন করে বলল, আদিরা-নীলয়কে যেন ২দিনের জন্য ওদের বাড়িতে নিয়ে যায়। ভাইয়ের কথামতই আদিরা নীলয়কে নিয়ে গেল আদিবা। ১২ তারিখে খুব ভোরে গিয়ে দরজায় নক করল আবির।
কে?
আমি, দরজা খুলো।
নীলিমা প্রথমে দরজা খুলতে চাইল না।
তারপর শিউর হওয়ার পর দরজা খুলে আবিরকে জড়িয়ে ধরতে এলে আবির ওকে থামিয়ে দিল। নীলিমার তো অনেক প্রশ্ন, কেন ফোন দিলেন না? সফর রেখে হঠাৎ চলে এলেন যে? নাকি শরীর খারাপ… ইত্যাদি।
আবির শুধু বলল, আমি তো আর আকাশপথে আসিনি? আমি সারারাত জেগে বাসে করে এসেছি। একটু ঘুমাতে হবে। নীলিমা খুব মন খারাপ করল। আবির শুয়ে পড়লে নীলিমাও শুয়ে পড়ল।
একটু পর আস্তে আস্তে আবিরের দিকে এগিয়ে এসে আবিরের শরীরের সঙ্গে লেগে গেল। আবির ওকে একঝটকায় সরিয়ে দিয়ে রাগত স্বরে বলল, একটু ঘুমোতে দেবে? নীলিমা খুব ভয় পেল। কিছু না বলে রান্না করার জন্য উঠল। টুকটাক শব্দে আবিরের ঘুম ভাঙল। তখন সকাল প্রায় দশটা। ঘুম থেকে উঠে আদিরা-নীলয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে গোসল সেরে রুমে এল আবির। নীলিমা ভাত বেড়ে টেবিলে বসে ছিল। আবির রুমে আসতেই নীলিমা আবিরের হাত জড়িয়ে ধরে বলল, বলুন, আমি কি অপরাধ করেছি, আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন? বলেন, কি ভুল করেছি আমি। পাশ থেকে আবির বলে উঠল, দোষ তোমার না, ভুল-দোষ সবই আমার। আমার এই পোড়া কপালের।
“ভাত খান।”
যদি তোমার ক্ষিধে লাগে আর যার জন্য রান্না করেছ তাকে খাওয়াও। এই বলে ভাত না খেয়ে শার্ট-প্যান্ট পরে রওনা দিতেই নীলিমা পা ধরে জোর গলায় কাঁদতে লাগল। নীলিমা শেষবারের মত বলল, একবার বলুন, কোথায় যান?
আবির বলল, সুখের খুঁজে।
ঘর থেকে বের হয়ে রাস্তায় এসে শ্যালিকাকে ফোন দিল আবির। জিজ্ঞেস করল, কোথায় আছ? লিমা বলল, ভাইয়া এইতো বাজারের কাছাকাছি।
লিমা, নীলি যেন কোনোভাবেই না জানে। আমি কিন্তু বাসা থেকে রাগারাগি করে এসেছি। ফোন দিলে বলবা না যে আমি তোমাদের বাড়িতে আসছি। আর হারের কথা তো বলবেই না।
ওদের শ্যালিকা-দুলাভাইয়ের খেলা আবিরের শাশুড়িও জানতেন না। দুপুর দুটোর দিকে শ্বশুর বাড়িতে গেল আবির। শাশুড়ি তো অবাক।
বাবা, তুমি? নীলিমা কই?
আবির কোনো কথা না বলে ঘরে গিয়ে বসল। আবিরের শাশুড়ি পিছু পিছু গিয়ে আবিরের পাশে বসে বলল, বাবা, আমাকে বলো কি হয়েছে? আবির কিছু না বলে চুপ করে থাকল। শ্যালিকা হারটা এনে মাকে দেখালো। আবিরের শাশুড়ি বললেন, এই তাহলে শ্যালিকা-দুলাভাইয়ের খেলা? আবির শাশুড়িকে বলল, মা, এই কথা নীলিমাকে বলবেন না। খাওয়া-দাওয়া করার সময় শাশুড়ি বললেন, ভাগ্যিস লিমা ঢাকা থেকে আসার সময় মাংস এনেছিল। তা না হলে আলু ছানা দিয়ে ভাত খাওয়া লাগত।
তারপর আবির ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিল। সরাসরি বাসায় না গিয়ে বাজারে দেরী করে রাত আটটায় বাসায় গেল। সারাদিন ফোনও বন্ধ ছিল। বাসায় এসে না খেয়েই শুয়ে পড়ল আবির। নীলিমা আবার পায়ের কাছে এসে প্যানপ্যানানি শুরু করল, কি দোষ আমার? কেন এমন করলেন? আপনার ফোনও সারাদিন বন্ধ। আমি সারাদিন কিছুই খাইনি। একটু পর বলল, ঠিক আছে, কথা না বললে না বলেন, চলেন খাবেন। আবির তবু গেলো না। ঘুমানোর ভান করে শুয়ে থাকল। ঘন্টাখানেক পর নীলিমা কেঁদে শুয়ে পড়ল। তবে আবিরের শরীর ঘেষে নয়। এভাবে রাত এগারোটা পঞ্চাশ মিনিট পর্যন্ত ছিল। নীলিমা কেঁদে কেঁদে ঘুমিয়ে পড়েছিল। নীলিমাকে জাগিয়ে ঠিক এগারোটা ঊনষাট মিনিটে আবির বলল, চোখ বন্ধ করো। নীলিমা চোখ বন্ধ করতেই আবির হারটা বের করে নীলিমার গলায় পরিয়ে দিয়ে বলল, চোখ খুলো।
চোখ খুলে নীলিমা তো অবাক। প্রায় পাঁচ মিনিট আবিরের দিকে চেয়ে থেকে কেঁদে ফেলল। তারপর আবিরের বুকে মুখ লুকাল। আবির নীলিমার মাথায় হাত রেখে ডাকল। নীলিমা এমন হাসি দিল, মনে হলো সারা ঘর ওর হাসিতে কেঁপে উঠল। দালান ঘরে হাসিটা চার দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। আবির বিশ্বাস করতে পারছিল না, নীলিমা এভাবে হাসতে পারে। সেদিনই মানল, নীলিমার মতো পৃথিবীতে আর কেউ হাসতে পারে না। আবির মুগ্ধ হয়ে ওর হাসি দেখছিল। তা দেখে নীলিমা লজ্জা পেয়ে আবিরের বুকে মাথা রাখল। আবির নীলিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে গেল। তারপর আচমকায় গেয়ে উঠল-
সানাইটা আজ বলছে কি
আমি জানি সেই কথা
রাত জেগে কেউ শুনছে কি
আমি শুধু শুনছি তা
কি করে বলি এই প্রাণ চায় যা।
আজ মধুর রাত আমার ফুলশয্যা….
লজ্জায় ক্ষাণিকটা দুরে সরে গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল নীলিমা। আবির চুপিচুপি বলল, ওঠো, খেয়ে নেই। আজ তোমাকে অনেক ভালোবাসা দেব। আর তা নিতে তো শক্তির প্রয়োজন আছে, তাই না? নীলিমা হেসে বলল, চলেন খেয়ে নিই। তারপর আবার সেই হাসি।
” আল্লাহর রহমতে মা এবং সন্তান তিনজন’ই সুস্থ আছেন।”
মলিন মুখে হাসি ফুটে উঠে আবিরের। বিনীত প্রশ্ন করে ডাঃ নুসরাতকে-
” আমরা এখন ভিতরে যেতে পারি?”
ডাঃ নুসরাত মিষ্টি হেসে বলেন,
কেন নয়? রোগীকে কেবিনে নেয়া হয়েছে। আপনারা এখন যেতে পারেন সেখানে। অত্যন্ত খুশি মনে থ্যাংক ইউ মেডাম বলেই আবির দৌঁড় দেয়। আবিরের পিছু পিছু আর সবাই আসে। বেডের উপর চুপটি করে নীলিমা শুইয়ে আছে। বাচ্চা দুটি তার ঠিক পাশের একটা দোলনায় শুয়ে আসে। ধীর পায়ে আবির এগিয়ে যায় দোলনার দিকে। আদিবার ছেলে আদিত্য তো পাগল বানিয়ে দিয়েছে বাবু দেখব, বাবু দেখব বলে। আদিত্যকে কোলে তুলে নেয় আবির। তারপর দোলনার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দুটো নিস্পাপ বাচ্চা দোলনায় একসাথে শুয়ে পা নাড়াচ্ছে। খিলখিল শব্দে হেসে উঠে আদিত্য-
” আম্মু ২বাবু, আম্মু ২বাবু….”
আদিত্যর এমন হাসি এবং আবিরের অপলক চাহনীর রহস্যটা বোধ হয় ছোট্ট দুই বাচ্চা জেনে গিয়েছিল। আর তাইতো পায়ের পাশাপাশি এখন হাত উপরের দিকে দিচ্ছে। আশ্চর্য ব্যাপার হলো-
দুটি বাচ্চায় একসাথে একই ভঙ্গিতে পা নাড়াচ্ছিল, এখন সেই একই ভঙ্গিতে হাত উঁচু করে নাড়াচ্ছে। আবিরের কাছে মনে হচ্ছিল যেন, বাচ্চা দুটো ওকে হাত বাড়িয়ে কোলে নেয়ার জন্য বলছে। আবির ধরতেও চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি।
” ভাইয়া সরেন তো!
অনেক দেখছেন। পরে দেখবেন আবার। এখন আমাদের দেখার সুযোগ করে দেন।”
নীলিমার বোন লিমা কথাটা বলেই আবিরকে সরিয়ে দেয়। আবিরের বোন দুলাভাই, হিয়া, লিমা সবাই হুড়মুড়িয়ে দোলনার কাছে যায়। উপর থেকে বাচ্চার হাত পা ধরে নাড়িয়ে মুরুব্বীদের সুযোগ করে দেয় দেখার জন্য। আবির এবং নীলিমার মা দুজনেই যেন খুশিতে আত্মহারা। দুই বেয়াইন’ই বাচ্চার কাছে গিয়ে একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে বাচ্চা কোলে তুলে নেয়।
” ওরে আমার ভাইটারে”
কথাটা বলেই আবিরের মা ছেলেটাকে কোলে তুলে নেন। বাচ্চাকে নিয়ে হেঁটে, ঝাকিয়ে নিজে নিজেই কথা বলতে শুরু করেন। মেয়েটাকে কোলে নেন নীলিমার মা। পলকহীনভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কপালে চুমুর পরশ এঁকে দেন। সেই কখন থেকে মা তার সন্তানদের বুকে জড়িয়ে নেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছেন। নীলিমার মা ব্যাপারটা বুঝতে পারেন। মেয়েটাকে নীলিমার কাছে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেন ওনি। কোলের কাছে মেয়েকে পেয়ে পরম আবেশে বুকে জড়িয়ে নেয় নীলিমা। চুমু খায় মেয়ের নাকে, কপালে। এদিকে মা ছোট বোনকে আদর করছে এটা যেন সহ্য’ই করতে পারছিল ছোট্ট ছেলেটা। তাইতো আচমকায় ঠোঁট ভেঙে কান্না শুরু করে। শত অভিনয় করেও দাদী তার নাতির কান্না থামাতে পারেনি। এদিকে নীলিমার কোলে থাকা মেয়েটাও অনর্থক ভ্যাঁ, ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠে। এ ঘটনায় সবাই অবাক। অবাক হয়নি হিয়া। তাইতো নীলিমার শাশুড়ির কাছে গিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেন-
” আন্টি! ওদের মনে হয় খিদে পেয়েছে।”
“ওহ, হ্যা….”
কথাটা বলেই নীলিমার শাশুড়ি ছেলেটাকে নিয়েও নীলিমার পাশে শুইয়ে দেয়।
আবির ছাড়া বাকি সবাই বের হয়ে যায় রুম থেকে। নীলিমার কাছে যায় আবির।
জিজ্ঞেস করে, কেমন বোধ করছ এখন?
ধীর কন্ঠে ভালো বলে মাথা ঝাকায় নীলিমা। আবির নীলিমার কপালে উষ্ণ পরশ এঁকে দিয়ে মিষ্টি হেসে বলে-
” Thank you.Thank you so much,
আমাকে এত মূল্যবান দুটো গিফ্ট দেয়ার জন্য।”
মৃদু হাসে নীলিমা। বাচ্চা দুটোকে খাওয়ানো হলে দুটো বাচ্চার কাছে যায় আবির। দু’হাতে বাচ্চা দুটোকে আদর করে আলতো করে নাকে, মুখে চুমু খায়।
আবির মনে মনে ভাবে আমাকে তো বলা হয়েছিল এক বাচ্চা হবে। মেয়ে বাবু। আমি তো ছেলে বাবুর নাম রাখিনি…..
আচ্ছা, বাবুদের নাম কি….(…)…???
পুরো কথা বলতে পারেনি আবির। তার আগেই পাশ থেকে বলে উঠে নীলিমা-
” নীলয়, আদিরা…”
বিস্মিত দৃষ্টিতে নীলিমার দিকে ফিরে তাকায় আবির। প্রশ্ন করে-
” মানে তুমি আগে থেকেই…..(…..)….???”
হুঁ, তোমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য বলিনি। হেসে দেয় নীলিমা। নীলিমার সাথে আবিরও হেসে দেয় পরম সুখে।
৭দিন পর রাত্রে__
বাচ্চাদের কাপড় চোপড় গুছিয়ে চেয়ার টেনে এসে বিছানার পাশে বসে আবির।
” তাহলে বাচ্চার নাম কি স্থির হলো?”
পাশ থেকে নীলিমার জবাব, ওদের নানী মেয়ের নাম রাখছে নুহা, দাদী রাখছে ছেলের নাম আশফাক।
চিন্তিত মনে গালে আঙুল টুকে বিজ্ঞের মত বলে উঠে আবির-
সার্বিক দিক বিবেচনায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে-
আমার বাবার নাম___
আশফাক মাহমুদ ‘নীলয়’
আর মায়ের নাম__
আদিরা মাহমুদ ‘নুহা’…..
দেখতে দেখতে বাবুদের বয়স একমাস পূর্ণ হয়ে যায়। এদিকে আবিরের ছুটির দিনও শেষ হয়ে আসে। ফিরে যায় আবির ঢাকায়। যাওয়ার আগে নীলিমা ও তার বাচ্চাদের যাতে কোনো অযত্ন না হয় সেজন্য আবির গ্রাম থেকে নীলিমার মাকে এনে রেখে যায়। যদিও নীলিমার মা দিন পনেরো এখানেই ছিল। যায় হোক! গ্রাম থেকে নীলিমার মা এসে সারাক্ষণ বাচ্চাদের পিছনেই পরে থাকত। এটাই যেন ওনার একমাত্র কাজ। এর ছাড়া বাসায় তেমন কাজও ছিল না। রান্নাবান্নার কাজ করার জন্য আবির আগেই আলাদা মহিলা রেখে দিয়ে গেছে। সেদিন বিকেলে বাচ্চারা ঘুমালে রুমে খোলা জানালার পাশে গিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি মেলে দেয় নীলিমা। তখনি কেউ একজন বলে উঠে-
” মারে!
এই জাহেলকে কি কখনো’ই কি
আর ক্ষমা করা যাবে না?”
কিছুটা চমকে পিছনে ফিরে তাকায় নীলিমা। মাকে দেখে স্বাভাবিক হয়। নীলিমার মা আবারো বলে উঠেন-
” জেদের বশে এ আমি কি করলাম?
কিভাবে পারলাম আমি এটা করতে? তরতাজা একটা আঙ্গুল’ই কেটে ফেললাম আমি? এ জীবনে কখনোই যে নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না! এই একটা অপরাধের জন্য সারাটা জীবন প্রস্তাতে হবে। নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারব না। বিবেকের কাছে অপরাধী হয়েই থেকে যাব মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।”
মৃত্যু কথাটা শুনা মাত্রই মায়ের হাতটা চেপে ধরে নীলিমা। চুপ হয়ে যায় মা। মেয়ের মুখের দিকে তাকায়। জল ছলছল দৃষ্টিতে নীলিমা তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। আবার একই কথা শুরু করলে কথার মাঝখানে থামিয়ে দেয় নীলিমা।
” মা! জন্মের পর থেকেই দেখেছি আপনি বাবা, চাচা-চাচি, ফুফু, দাদা-দাদী, নানা-নানীকে কিরকম শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন, সম্মান করতেন। উচ্চস্বরে কথা তো দুরে থাক, শত কিছুর পরও কখনো ওনাদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতেন না। তার’ই মেয়ে আমি। যে আমাকে আপনি নিজে নৈতিকতার শিক্ষা দিয়েছেন, সেই আমি আপনার সাথে চোখ রাঙ্গিয়ে কথা বলেছি। শুধু চোখে রাঙ্গিয়েই ক্ষান্ত হইনি, আপনাকে তুই তুকারি করে গালিগালাজ করেছি। মাগো, যেখানে আমার কথা ছিল পুরো ঘটনা আপনাকে খুলে বলা, সেখানে আমি তা না করে আমার জামাইকেও গালিগালাজ করেছি। একজন আদর্শ পরিবারের সন্তান হয়ে, আদর্শ মায়ের সন্তান হয়ে আমি এরকম কাজ করছি। মা আপনি তো আমার আঙ্গুল কেটেছেন, এখানে অন্য কোনো মা হলে হাতটাই কেটে দিত। মা, আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি। আর এটাও বুঝতে পারছি আমি আমার দোষেই আঙ্গুল হারিয়েছি, আমার পাপের সাজা পেয়েছি। মা, এখানে আপনার কোনো হাত নেই। তাই দয়া করে ‘ক্ষমা কর, ক্ষমা কর’ করে আমার পাপের বোজাটা ভারী করে দিবেন না। হাতজোর করছি আপনার কাছে, দয়া করে আর কখনো ক্ষমা করার কথা বলে আমাকে ছোট করে দিবেন না।”
আনন্দে দু’চোখের জল ছেড়ে দিয়ে সে স্থান ত্যাগ করেন নীলিমার মা। মসজিদ থেকে আসরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসলে ওজু করে নামাজ পড়ে নেয় নীলিমার মা। নামাজ শেষে মোনাজাতে বসে অনেকটা গর্বের সাথে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানায় নীলিমার মত মেয়ে যাতে বাংলার প্রতিটি ঘরে জন্ম নেয়।
মাসখানেক থাকার পর খবর আসে নীলিমার ছোট ভাই লিমন হোস্টেল থেকে ফিরে এসেছে বাসায়। ও নাকি অনেক অসুস্থ। নীলিমার মা নীলিমার থেকে বিদায় নিয়ে গ্রামে চলে যায়। এদিকে আদিবা আপুর হাজবেন্ডও ব্যবসায়ের কাজে বিদেশে চলে যায়। আদিবা তাই ছেলে আদিত্যকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে আসে। বাসায় আদিবার কোনো কাজ ছিল না বিধায় নীলিমার বাচ্চা নিয়ে বসে থাকত। বাসায় শ্বশুর ননাসের ভরসায় আবারো চেম্বারে বসতে শুরু করে নীলিমা। এক দুপুরে আদিবা সোফায় ওর মা এবং ছোট্ট নীলয়ের পাশে আদিরাকে রেখে মিনিট দশেকের জন্য রান্নাঘরে যায়। ঠিক তখনি আবিরের কাজিন রুবেলের সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী লিজা আসে বাচ্চা দেখতে। আবিরের মা খুশিতে গদগদ হয়ে নাতি নীলয়কে লিজার কোলে তুলে দেন। লিজাকে যেন ছেলে নীলয়ের চেয়ে মেয়ে আদিরা’য় বেশী টানছিল। সোফায় আদিত্যর পাশে বসেও কিরকম মায়াবী চাহনীতে লিজার দিকে তাকিয়ে ছিল। একটা হাসি দিয়ে নীলয়কে দাদীর কোলে দিয়ে লিজা আদিরাকে কোলে তুলে নেয়। দু’গালে, নাকে চুমু দিয়ে অনর্গল কথা বলতে থাকে বাঁচাল প্রকৃতির লিজা। হাপিয়ে উঠলে বিরাম নেয়ার জন্য থেমে যায়। থেমে গিয়েও প্রশ্ন করে আবিরের মাকে-
” কাকিমা! আদিরা কার মত হইছে?”
কার মত আর হবে? মা যখন কালো তখন আর কার মত হবে? মায়ের রং’ই পাইছে। রাখো তো ওকে কোল থেকে। তোমার নতুন বিয়ে হয়েছে। কয়দিন পর বাচ্চা হবে। এখন এরকম কালো বাচ্চাকাচ্চা কোলে নিও না। এখন যত পারো সুন্দর সুন্দর ছেলে বাচ্চা দেখবা, সুন্দর ছেলে বাচ্চাদের ক্যালেন্ডার টানিয়ে রাখবা ঘরে। তবেই না সুন্দর ছেলে হবে। অত্যন্ত সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের মাধ্যমে আবিরের মা রুবেলের বউ লিজাকে কথাগুলো বুঝাচ্ছিল। এর মাঝে কখন যে ছোট্ট আদিরা আদিত্যর কোল থেকে পরে গিয়ে নিস্তেজ হয়ে গেছে কিছুই টের পায়নি। টের পায় তখন যখন আদিবা বলতেছে-
” এই নীলিমা! কি হয়েছে তোর? এভাবে ঠাপাচ্ছিস কেন ওকে?”
আবিরের মা এবং লিজা দুজনেই পাশে ফিরে তাকায়। ততক্ষণে ছোট্ট আদিরা চিৎকার দেয়। মেয়েকে বুকে জড়িয়ে হু, হু করে কেঁদে উঠে নীলিমা। আজ ওনারা যেভাবে আমার বাচ্চাটাকে আদিত্যর কোলে তোলে গল্প মশগুল ছিল, আজ আমি আসলে বোধ হয় আমার মেয়েটা মরেই যেত। কথাটা বলেই মেয়েটাকে বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে নীলিমা।
আদিবা আদিত্যকে ধমক দিলে আদিত্য গড়গড় করে বলতে থাকে-
” আমার কি দোষ! নানু’ই তো ওকে ঐ নতুন মামির কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে। তারপর সোফায় ঠাস করে বসিয়ে রেখে দিছে। নতুন মামীকে বলতেছে বোন নাকি কালো, ওর মায়ের মত। ওরে যাতে কোলে না নেয়।”
কথাটা বলেই মায়ের কোল থেকে ছোট নীলয়কে নিয়ে রুমে চলে যায় আদিবা।
২বছর পর__
সেদিন রাত্রি ৮টার দিকে ঢাকা থেকে আবির আসে। হন্যে হয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকেই দেখে সবাই বসে টিভি দেখছে। আবির সে অবস্থায়’ই ওর বাবার কোল থেকে ছেলে নীলয়কে নেয়। কিছুক্ষণ আদর করে বলে, আপু আদিরাকে যে দেখছি না? ও কোথায়? আদিবা কিছুটা মলিন মুখে বলে, উপরে নীলিমার সাথে নিজের রুমেই আছে। আবির দৌঁড়ে উপরে উঠে।
দরজার বাইরে থেকেই বলে উঠে,
মামনি! আমি এসে গেছি…..
কিন্তু একি?!!!
আদিরা কাঁদছে কেন? আবির দৌঁড়ে রুমে ঢুকে দেখে আদিরাকে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে আছে নীলিমা। এমন শক্ত যে ওর নিশ্বাস নিতেই কষ্ট হচ্ছিল। ‘এসব কি করছ? ওকে এভাবে কেন জাপটে ধরে আছ?’ কথাটা বলেই নীলিমার হাতটা সরিয়ে আদিরাকে কোলে নিতে চাচ্ছিল আবির। নীলিমা এক ধাক্কায় আবিরকে ফেলে দিয়ে শুয়া থেকে উঠে বসে।
” আশ্চর্য! তুমি এমন করছ কেন?”
নীলিমা আরো শক্ত করে ধরে রাখছে আদিরাকে। আবির আবারো কোলে নিতে গেলে ধাক্কা দিয়ে ফেলে অন্য রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে রাখে।
আশ্চর্য!
এর আবার কি হলো?
কথাটা বলতে পিছনে ফিরতেই দেখে আদিত্য দাঁড়িয়ে।
” মামা, মামা!
জানো, আজকে নীলি মামীরে নানু বকছে। মামী কেন কালো এজন্য নাকি আদিরাও কালো হয়েছে। আদিরাকে আদর করে না নানু। নানু আরো বলছে, আদিরা’কে নাকি টাকা দিয়ে বিয়ে দিতে হবে।
মোটামুটি বড়’ই হয়েছে আদিত্য। যা শুনে, যার বিরুদ্ধেই শুনে তাকে গিয়েই লাগিয়ে দিতে পারে কথা। আবির ক্ষেপে যায়। জার্নি করে বাসায় ফিরছে, তবুও একদন্ডের জন্যও বিশ্রাম নেয়নি। বাজারে চলে যায়। বাজার থেকে ফিরে আসে। নীলিমাকে জোর করে ভাত খাইয়ে দিয়ে নিজেও কিছু খেয়ে নিল। তারপর আদিরাকে দখল করে নিল। কিচ্ছু বলেনি নীলিমা। চুপচাপ নীলয়কে কোলে নিয়ে অন্য রুমে গিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে। কথা বাড়ায়নি আবির। যা হবার সকালেই হবে। বাজার থেকে কিনে আনা কলার মধ্যে কিছু কলা দরজার ফাঁক দিয়ে নীলিমার বিছানার উপর ছুঁড়ে দেয়। তারপর আদিরাকে নিয়ে অন্যরুমে শুয়ে পরে। মাঝরাত্রে বিছানায় প্রস্রাব করে দেয় আদিরা। বিছানা থেকে প্রস্রাব মুছে শুয়ে পরছিল আবির, তখনই কান্না শুরু করে আদিরা। কিছুক্ষণ কোলে রেখে পিঠে হাত বুলিয়ে, কান চুলকিয়ে দিলে ঘুমিয়ে পরে আদিরা। বিছানার পাশে কলাগুলো রেখে শুয়ে পরে আবির। মিনিট ত্রিশেক পর শুনতে পায় চপচপ শব্দ। শব্দটা ঠিক পাশ থেকেই আসছিল। মনে হচ্ছে আদিরার কলার উপর ইঁদুর হামলা করেছে। আস্তে আস্তে ফোনটা হাতে নিয়ে টর্চটা জ্বেলে দেয়। কিন্তু একি?
” এ যে ছোট ইঁদুর….”
হেসে দেয় আবির। ঘুমে ঢুলুঢুলু আদিরা মিটমিট চোখে কলা খাচ্ছে……
“আর যায় হোক!
এম.বি.বি.এস নীলিমার সন্তান কখনো অপুষ্টিতে ভুগতেই পারে না…..”
কথাটা বলে একটা রহস্যজনক হাসি দেয় নীলিমা…..
সারাটা ক্ষণ ক্লান্ত নীলিমাকে আবির আরো ক্লান্ত করে দিত এটা খাও, ওটা খাও করে। রান্না করার সময় হলে নীলিমা যখন ধীর পায়ে রান্না ঘরে যেত আবির তখন চেয়ার হাতে পিছনে এসে দাঁড়াত। নীলিমাকে জোর করে রান্নাঘরের এককোণে চেয়ারে বসিয়ে নিজেই রান্নায় লেগে পরত। রান্নাটা আবির বেশ পারে কারণ ঢাকায় থেকে আবির যখন পড়াশুনা করত তখন বন্ধুরা মিলে রান্না করে খেত। তারপর আবিরের চাকরী হলো, এদিকে ওর বাবাও ফ্ল্যাট কিনল। নতুন বাসায়ও আবির নিজে নিজেই রান্না করে খেয়ে কলেজে যেত। যদিও ওর বাবা বলেছিল কাজের জন্য কোনো লোক রাখতে। অন্তত পক্ষে রান্নাটা যাতে করে দিতে পারে। কিন্তু আবির একটু অন্যরকম। উচ্চবংশে জন্ম নিয়েও খুব অনাড়ম্বর জীবন যাপন করত। সর্বোপরি, নিজের কাজ নিজে করে খেতে পছন্দ করত। আবির ছুটি নিয়ে বাসায় আসার পর নীলিমা হাতে গুনা কয়েকদিন রান্না করেছে। বাকিদিনগুলো বলতে গেলে বলতে হয় আবির’ই রান্না করেছে। মায়ের নজর এড়িয়ে আড়ালে লুকিয়ে আবির নীলিমাকে রান্নায় হেল্প করেছে। কখনো তরকারী কুটে দিয়েছে, কখনো বা মাছ কেটে দিয়েছে। কারো পায়ের শব্দ পেলে কিচেন থেকে দৌঁড়ে বের হয়ে বাথরুমে ঢুকে যেত আবির আর নীলিমা রান্নায় দাঁড়িয়ে পরত।
দিন এভাবেই কাটছিল__
সেদিন নীলিমাকে দেখতে ওর বান্ধবী হিয়া এসেছিল। নীলিমার ছোট বোন লিমা ভার্সিটিতে ভর্তির জন্য কোচিং করত ঢাকা, ফার্মগেইট। হিয়া আসার সময় লিমাকেও সাথে করে নিয়ে আসে। প্রিয়জনদের পেয়ে খুশিতে আত্মহারা নীলিমা ভুলেই যায় ওরা অনেক দুর থেকে এসেছে। ওদের ফ্রেশ হওয়া দরকার, আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা দরকার। সব ভুলে খুশিতে আত্মহারা নীলিমা এক বিরাট গল্প জোড়ে দেয় বান্ধবী এবং বোনের সাথে। দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় নীলিমার শাশুড়ি। দুর থেকে ইশারায় ডাক দেয় নীলিমাকে। শাশুড়ির ডাকে সাড়া দেয় নীলিমা। নীলিমার শাশুড়ি ফিসফিসিয়ে বলেন, গল্প যে জুড়ে দিয়েছ বাসায় রান্না করার মত কিছু আছে? নীলিমা নিচু স্বরে না-বোধক জবাব দেয়। অনেকটা রাগ দেখিয়ে বলেন-
কিছুই নাই, এদিকে বাসায় মেহমান এসেছে। কোথায় আবিরকে ফোন দিবা, তা না করে গল্প জুড়ে দিয়েছ? ওরা কতদুর থেকে এসেছ জানো? এবারো নীলিমা নিচু স্বরে বলে উঠে, দিচ্ছি কল মা। নীলিমা আবিরের নাম্বারটা ডায়াল করতেই ওর শাশুড়ি হাত থেকে ফোনটা নিয়ে গিয়ে নিজের কানের কাছে ধরে। নীলিমা তো পুরা’ই থ। কানে ফোন রেখেই গম্ভীর মুখে শাশুড়ির প্রশ্ন-
“কি হলো? এখানে দাঁড়িয়ে কেন আছ? ওদেরকে শরবত দাও। আমি ফ্রিজে রেখে আসছি। আর নুডলস রান্না করছি দেখো। এগুলোও সামনে এনে দাও।”
দিচ্ছি বলে নীলিমা কিচেনের দিকে পা বাড়ায়….
নীলিমার শাশুড়ি এমনিতে ওকে যত তিক্ত কথায় শুনাক না কেন, বাসায় মেহমান আসলে দৌঁড়াতে থাকে কি খাওয়াবে না খাওয়াবে। এটা একটা ওনার বিশেষ গুন।
আবির সওদা করে তাড়াতাড়ি’ই ফিরে আসে। আবির ফিরে আসলে ওর হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে দ্রুত রান্না ঘরে চলে যায় নীলিমার শাশুড়ি। নীলিমা চুপসে দাঁড়িয়ে আছে শাশুড়ির পিছনে আর ওর শাশুড়ি রান্না করছে। পিছনে ফিরে নীলিমার শাশুড়ি-
” কি হলো? এখানে দাঁড়িয়ে কেন আছ? ফ্রিজে দেখো ফল রাখা আছে, ভালোভাবে ধূয়ে ঐগুলো ওদের সামনে দাও।”
নীলিমা শাশুড়ির কথা মত ফ্রিজ থেকে ফল বের করে নিঃশব্দে রান্নাঘর ত্যাগ করে।
রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর নীলিমা ওর বান্ধবী হিয়া এবং বোন লিমাকে নিয়ে গেস্টরুমে যায়। ফিরে আসছিল নীলিমা, পিছন থেকে বলে উঠে লিমা-
” আমি দুনিয়াতে অনেক অনেক মানুষ দেখেছি কিন্তু আমার আপুর মত মানুষ দেখিনি।”
পিছনে ফিরে তাকায় নীলিমা। গড়গড় করে বলতে থাকে লিমা-
” তুই কিরে আপু? একজন শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত মেয়ে হয়ে কি করে তুই তোর শাশুড়ির এত অত্যাচার সহ্য করছিস?”
রেগে যায় নীলিমা-
” খবরদার! আর একটাও কথা বলবি না।”
পাশ থেকে বলে উঠে হিয়া-
” কেন? বললে কি করবি? ও কি মিথ্যে কিছু বলছে নাকি?”
বান্ধবীর কথায় চেহারায় বিরক্তি ফুঁটে উঠে নীলিমার। মুখে বিরক্তি ভাব নিয়েই প্রশ্ন করে, চুপ করবি?
—– কেন চুপ করব? আর কত? আর কত ঐ মহিলার অত্যাচার সহ্য করবি? এমনভাবে মানসিক অত্যাচার চলতে থাকলে তুই তো পাগল হয়ে যাবি! আর তুই একটা শিক্ষিত মেয়ে হয়ে কি করে এসব সহ্য করছিস? কেন প্রতিবাদ করছিস না? তুই বুঝতে পারছিস খাওয়ার অভাবে, শুধুভাবে খাওয়ার অভাবে তোর কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে? তুই বুঝতে পারছিস পরিবর্তিতে এটা বাচ্চার উপর কতবড় প্রভাব ফেলতে পারে?
হিয়া থামতে না থামতেই লিমা বলে উঠে-
” কাকে কি বুঝাচ্ছ আপু? ওনি তো তোমার আমার মত সাধারণ কোনো মানুষ না যে আমাদের কথা বুঝবেন! ওনি হচ্ছেন নায়িকা সাবানা। সেই মহৎ হৃদয়ের সাবানা যিনি শাশুড়ির অবর্নণীয় অত্যাচার সহ্য করেও কিচ্ছু বলবে না। ওনি মহান হিয়া আপু। তোমার কি মনে হয় এরকম মহান হৃদয়ের অধিকারী নায়িকা সাবানা আমাদের কথা শুনবে? শাশুড়ি যদি ওনাকে তিনবেলা ভাত নাও দেয় তবুও ওনি মুখ খুলবেন না।”
হিয়া লিমাকে থামিয়ে দিয়ে নীলিমার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁধে হাত রেখে বলেন-
” নীলিমা! আমার মনে হয় তোর শাশুড়ির ব্যাপারটা আবির স্যারকে খুলে বলা দরকার। এভাবে তো চলতে পারে না। আর কত? আর কত দিন অভুক্ত থাকবি? শুধু তো কথায় মারেন না ওনি, ভাতেও মারেন। এ অবস্থা চলতে থাকলে তো তোর বাচ্চার ক্ষতি হবে। তাই বলছি প্লিজ স্যারকে খুলে বল সবটা।”
কথাগুলো বলে নিশ্বাসও ফেলতে পারেনি হিয়া, তার আগেই পেছন থেকে বলে উঠে আবির,
“ওর বলতে হবে না, আমি সব জানি।”
চমকে উঠে পিছনে তাকায় হিয়া। আবিরকে এভাবে রুমে এগিয়ে আসতে দেখে কলিজার পানি শুকিয়ে যায় হিয়াসহ লিমার। নীলিমারও অবস্থা যায় যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে পেছনে না ঘুরলে ও বুঝতে পারে আবির সব শুনে নিয়েছে।
আমতা আমতা করে হিয়া যখন আবিরকে কিছু বলতে যাচ্ছিল, তখন থামিয়ে দেয় আবির। তোমরা ক্লান্ত। কথা না বাড়িয়ে দরজা লাগিয়ে শুয়ে পড়ো। আবির নীলিমার কাঁধে হাত রেখে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে। “চলো……..”
নীলিমা ধীরগতিতে আবিরের সাথে হাঁটতে থাকে।
রাত্রি অনেক হয়েছিল, আর তাছাড়া নীলিমার শরীরটাও বেশী ভালো যাচ্ছে না আজকাল। তাই আবির মায়ের কথা তুলে নীলিমাকে উত্তেজিত করতে চায়নি। আর চায়নি বলেই বিছানা পরিষ্কার করে নীলিমাকে ধরে শুইয়ে দেয়। নীলিমা কথা বলতে চাইলে আবির থামিয়ে দেয়।
” চুপ! আমি আর এ সম্পর্কে কোনো কথা এখন শুনতে চাই না। যা শুনব, বাচ্চাটা ভালোভাবে হওয়ার পর। আর মায়ের সাথে শেষ বোঝাপড়াটা সেদিন’ই হবে।”
কথা বাড়ায়নি নীলিমা। চুপটি করে আবিরের বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। মাঝরাত্রে ঘুম ভেঙে যায় নীলিমার। বিছানায় উঠে বসে। আবিরও জেগে যায়। তাড়াতাড়ি উঠে লাইট জ্বেলে নীলিমার কাঁধে হাত রাখে। ঘুমে ঢুলুঢুলু নীলিমা বসে বসেই ঘুমুচ্ছে। বিছানা থেকে উঠে গিয়ে খাবারের নানা আইটেম নীলিমার সামনে এনে রাখে। নীলিমা তখনো বসে বসে ঝিমুচ্ছে। বিভিন্ন খাবারের নাম বলে বলে প্রশ্ন করে আবির-
” খাবে?”
প্রত্যেকবার’ই মাথা ঝাঁকিয়ে না-বোধক জবাব দেয় নীলিমা। প্রশ্ন করে-
” তাহলে….. কলা খাবে?”
” উম্মমমম কলা বলে মাথা নাড়ে নীলিমা।”
হেসে দেয় আবির।
ওরে কলা পাগলীটা আমার….!
তোমার কলা খাওয়ার খিদে পেয়েছে সেটা বলবা না? কলা খেতে নীলিমা ভালোবাসে। ফলের মধ্যে এই একটা ফল’ই বলা ছাড়া খায় নীলিমা। আবিরও তাই প্রত্যেকদিন রাত্রে মোড়ের দোকান থেকে কলা নিয়ে এসে টেবিলে’ই রেখে দেয়। মাঝরাত্রে অন্য খাবার খাওয়ার আগে কলাটা ওর চাই’ই চাই।
কিন্তু আজতো নীলিমা ঘুমে ঢুলুঢুলু তাই আবির কলাগুলো দু’বালিশের ফাঁকে রেখে নীলিমাকে শুয়ে দেয়। নীলিমার কপালে আলতো করে চুমুর পরশ এঁকে দেয় আবির—
” তোমার চোখে ঘুম। কলাটা ঘুম থেকে উঠে খেও।”
বাধ্য বালিকার মতো চোখ বোজে নীলিমা।
লাইটটা নিভিয়ে পাশ বালিশে শুয়ে পরে আবির। মিনিট দশেক যেতে না যেতেই আবির মাথার পাশেই কুটকুট শব্দ শুনতে পায়। অনেক খেয়াল করে শুনার পর আবির সিদ্ধান্তে এলো এটা ইঁদুরের শব্দ। নিশ্চয় কলার উপর হামলা। ওরে ইঁদুর আজ তোর একদিন কি আমার একদিন মনে মনে কথাটা বলেই আবির নিঃশব্দে লাইট জ্বেলে দেয়। রাগান্বিত মুখে হাসি ফুটে উঠে আবিরের। “এ যে বড় ইঁদুর….”
ঘুমন্ত চোখজোড়া মিটমিট করে নীলিমা শুয়ে শুয়েই কলা খাচ্ছে। চোখগুলো ঘুমের কারণে খুলতে পারছে না, তারপরও কলা খাচ্ছে…..
দেখতে দেখতে নীলিমার বাচ্চা প্রসবের দিন এগিয়ে আসে। আবির এখন একমুহূর্তের জন্যও নীলিমাকে চোখের আড়াল করে না। সবসময় নীলিমার পাশে পাশে থাকে। গোসল করিয়ে দেয়, খাইয়ে দেয়। সেদিন আবিরের বাবাকে বিশেষ একটা কারণে দেশের বাহিরে যেতে হচ্ছিল। আবিরের মা ছেলেকে বলেন, বাবাকে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দিয়ে আসতে। আবির যেতে চাচ্ছিল না নীলিমাকে ছেড়ে।
নীলিমার গম্ভীর জবাব-
” সময় এখনো দেরী আছে। আজ মাত্র ৪তারিখ। ডাক্তার এ মাসের ১৭তারিখ আর ২৩তারিখের কথা বলেছে। আপনি প্লিজ বাবাকে দিয়ে আসেন। আমার জন্য টেনশন করবেন না। আর তাছাড়া গাড়ি তো আছে’ই। আপনি যাবেন আর আসবেন।”
নীলিমার জোড়াজুড়িতে আর মায়ের কথায় শেষমেষ আবির বাবাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যেতে রাজি হয়। বাবাকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে একমুহূর্তও দেরী করেনি আবির। বাসায় আসতেই নীলিমার চাপা আর্তনাদ শুনতে পায়। শব্দটা নিচ তলার’ই এক রুম থেকে আসছে। কিন্তু ও রুমে নীলিমা কেন আসল? আর ও এভাবে কাঁদছে কেন? ওর কিছু হলো নাতো? ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় কেঁপে উঠে আবিরের। দৌঁড়ে দরজার কাছে যেতেই পাশ থেকে বাঁধা দেয় আবিরের মা। আবির ভয়ার্ত চোখে মায়ের দিকে তাকায়। গম্ভীর কন্ঠে আবিরের মায়ের জবাব,
” তোর বউ অসুস্থ। ভিতরে যাওয়া যাবে না। ভিতরে দাই মহিলারা গেছেন মাত্র।”
চমকে গিয়ে প্রশ্ন করেন আবির-
” What?”
উত্তর দেয় আবিরের মা,
” ঘন্টা খানেক হলো বউ অসুস্থ হয়ে পরছে। তোর উত্তর পাড়ার জ্যাঠি তো দাইয়ের কাজ করেন। ওনাকে আনছি। ওনারা তিনজন কেবল ভিতরে গেছেন বউকে দেখতে। আল্লাহকে ডাক।”
অবাকের চূড়ান্ত সীমায় আবির। একঘন্টা ধরে ও অসুস্থ, আর তুমি মাত্র মানুষ ডেকে এনেছ। তাও দাই। যাদের হাতে আমার ২ভাই মরেছে তুমি নার্স না ডেকে তাদের ডেকে এনেছ? তাদের হাতে আমার বউকে ছেড়ে দিয়েছ? তুমি পারো নি লোক ডেকে ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে? একঘন্টা হয়ে গেল আমাকে কল কেন দাওনি….?
আবিরকে থামায় ওর মা।
” দ্যাখ, আবির। আমাদের বংশে কারো সিজার হয়নি। নীলিমারও হবে না। নীলিমার নরমাল ডেলিভারি হবে।”
উত্তেজিত হয়ে উঠে আবির,
” কারো হয়নি, কিন্তু নীলিমার হবে। ডাক্তার বলেছে ওর শরীরের যা কন্ডিশন ওর নরমাল ডেলিভারি হতে পারে না।”
” কিন্তু…..”
আবির একমুহূর্তও এখানে দাঁড়ায়নি। মাকে সরিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। মহিলাদের সরিয়ে কোলে তুলে নেয় নীলিমাকে। গাড়ির পেছনে শুইয়ে দিয়ে আদিবা আপুকে ফোন করে আসতে বলে দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। নীলিমাকে অটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আবিরের মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করেছে। চিন্তিত মনে বাইরে পায়চারি করছে। মিনিট ত্রিশেকের মধ্যে হসপিটালে পৌঁছে যায় আদিবা ও তার স্বামী। তারাও চিন্তিত মুখে এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করছে। কিছুক্ষণ পর অটি থেকে বেরিয়ে আসে একজন নার্স।
উতলা কন্ঠে প্রশ্ন করে আবির, কি হলো সিস্টার? উত্তরে নার্স বলে,
” রোগীর রক্ত লাগবে। জরুরী ভিত্তিতে রোগীর রক্ত লাগবে।”
আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল আদিবা।
” আমি, আমি দিব রক্ত। আমার রক্তের গ্রুপ ও নেগেটিভ।”
আসুন, টেস্ট করে দেখি….
নার্স আদিবাকে চলে যায়। রক্ত দেয়া হলে আদিবা চলে আসে, কিন্তু নীলিমার কোনো খুঁজ নেই। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম সবার। খবর পেয়ে নীলিমার মা চলে আসছে, চলে আসছে বোন লিমা ও বান্ধবী হিয়া। চিন্তিত মুখে হিয়ার প্রশ্ন-
” এতক্ষণ ধরে ওরা কি করছে? এতক্ষণ তো লাগার কথা নয়।”
হিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে ডাক্তার নুসরাত। মিষ্টি হেসে আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে-
” Double Congratulation, Mr. Abir.”
চমকে যায় আবির। Double Congratulation মানে?
হেসে দেয় ডাঃ নুসরাত। মুখে হাসির রেখা নিয়েই বলে উঠে, আপনি একসাথে দু’সন্তানের বাবা হয়ে গেলেন। একটা ছেলে, একটা মেয়ে। খবরটা শুনার পর চারদিকে খুশির বন্যা বয়ে গেল। সবার মুখেই হাসি। শুধু হাসি নেয় আবিরের মুখে। চিন্তিত মুখেই আবারো প্রশ্ন করেন ডাঃ নুসরাতকে-
” আর নীলিমা? ও, ও কেমন আছে?”
” আল্লাহর রহমতে মা এবং সন্তান তিনজন’ই সুস্থ আছেন।”
আবির হাঁটতে হাঁটতে নীলিমার কাছে চলে যায়। ‘কি ব্যাপার? অন্ধকারে বসে আছো যে?’ মুহূর্তেই বলে উঠে নীলিমা, আমি কিছু খাইনি। হা, হা করে অট্টোহাসিতে মেতে উঠে আবির। এ যেন সেই পুরনো প্রবাদ, ‘ঠাকুর ঘরে কে’রে, আমি তো কলা খাইনি’ কথাটার মতই। কথাটা বলে থতমত খেয়ে যায় নীলিমা। আবিরের হাসি শুনে টের পায় কত বড় বোকামীর পরিচয় দিয়েছে। বোকামীর জন্য আনমনে নীলিমা নিজে নিজেকেই গালি দিচ্ছে।
হাসি থামালো আবির। নীলিমার সামনে একটা চেয়ার টেনে বসে পরল। মৃদু হেসে প্রশ্ন করল- ‘খিদে পেয়েছে, খাবে। এজন্য এত ভয় পাওয়ার কি আছে?’
লাইট’টা জ্বালিয়ে ধীরে সুস্থে বসে খেলেই তো হতো। অত্যন্ত নীচু গলায় নীলিমার জবাব, না মানে আপনি ঘুমুচ্ছিলেন তো তাই ঘুমের ডিস্টার্ব হবে ভেবে লাইটটা জ্বালাইনি।
ওকে, ফাইন। হয়েছে তো। এবার তো কার্টুনটা সামনে আনো…..!!!
নীলিমা কার্টুন’টা সামনে এনে আপনমনে খাওয়া শুরু করছে, আবির চেয়ারে বসে গালে হাত দিয়ে নীলিমার খাওয়া দেখছে। একটা সময় তৃপ্তির ঢেকুর তুলে উঠে দাঁড়ায়। বসা থেকে উঠে নীলিমার একটা হাত ধরে আবির। ধীর পায়ে নীলিমা বিছানার দিকে এগুচ্ছে।
বিছানায় শুইয়ে দেয় আবির নীলিমাকে। তারপর লাইটটা অফ করে নিজেও গিয়ে শুয়ে পড়ে নীলিমার পাশে। অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে আছে আবির। মিনিট ত্রিশেক এভাবে শুয়ে থেকে ঘুরে শুয়ার জন্য নীলিমার দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে যায়। ড্রিমলাইটের মৃদু আলোয় আবির দেখতে পায় নীলিমা কেমন ঢ্যাবঢ্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে। ‘ঘুমাওনি এখনো?’
মাথাটা আংশিক তুলে প্রশ্ন করে আবির।
‘উহু, ঘুম আসছে না উত্তর দেয় নীলিমা।’
মৃদু হেসে আবির এগিয়ে যায় নীলিমার দিকে। স্পর্শ করে নীলিমার গাল, এলোমেলো চুলগুলো গুজে দেয় কানের পাশে। কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দিয়ে টেনে নেয় বুকে, ভালোবাসার সাথে মাথায় হাত বুলাতে থাকে। ঘুমিয়ে পড়ে নীলিমা, ওর ভারী হয়ে গরম নিশ্বাসগুলো তার’ই ইঙ্গিত দিচ্ছে। একহাতে আবির ওর পাশে রাখা চাদরটা নীলিমার গায়ে জড়িয়ে দেয়। মুখে মৃদু হাসির রেখা টেনে আবির নীলিমার কপালে আবারো ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়েই একসময় ঘুমিয়ে পড়ে আবিরও।
নীলিমার গর্ভের সময়কাল ৭মাস__
হাত পা গুলো অসম্ভব রকমের ফুলে যায় ওর। পা’গুলো ফুলে তো তালগাছের মতই হয়ে গিয়েছিল। নড়াচড়া করতে খুব কষ্ট হতো বিধায় কিচেনে কোনো রকম রান্না বসিয়ে দিয়ে বেশীর ভাগ সময় রুমে এসে বসে থাকত। কখনো কখনো লুকিয়ে লুকিয়ে আবিরের কিনে আনা ফলমূল, দুধ কখনো বা মায়ের পাঠানো গম+ডাল+চাল+চিনি মিশ্রিত গুড়ো খেতো। নজর এড়ায় না শাশুড়ির। এ নিয়ে অনেকগুলো কথা শুনিয়ে দেয় নীলিমাকে। ওনার এক কথা, মা ওনিও হয়েছেন। এভাবে খাই, খাই করেননি কখনো। একবেলা খেয়ে আরেকবেলা না খেয়ে থেকেছেন। নীলিমার ভাষ্যমতে, খাওয়া নিয়ে আমার শাশুড়ি আমাকে যতগুলো কথা শুনিয়েছেন ততগুলো কথা বোধ হয় আমি কালো হয়ে জন্ম নেওয়া’তেও শুনিনি।”
সেদিন নীলিমার শরীরটা প্রচন্ড খারাপ লাগছিল। এই সময় বাসার কাজের লোক তাড়িয়ে দেয়ার জন্য মনে মনে বাসার সকলকে বকে এক করে ফেলে আবির। চাল, ডাল, গম, চিনির যৌথ মিশ্রণে তৈরি পুষ্টিকর খাবার নীলিমাকে খাইয়ে দিয়ে, প্লেটে কিছু ফল ধুয়ে নীলিমাকে খেতে বলে, সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরি করার জন্য দ্রুত কিচেনের দিকে পা বাড়ায় আবির। দ্রুত বাবা মায়ের পছন্দের খাবার তৈরি করে নীলিমার জন্য ভাত বসিয়ে দেয়। নীলিমার আবার ভাত হলে কিচ্ছু লাগে না। বড্ড খেতে চায় মেয়েটা। কিন্তু খাবার সামনে নিলে একমুঠো ভাতের বেশী খেতে পারে না। যাও খায় সেটা আবিরের জুড়াজুড়িতে। ভাত বসিয়ে দিয়ে দ্রুত তরকারী কুটছিল আবির। পিছন থেকে কিচেনে ঢুকে ওর মা। আবির তরকারী কুটে চুলোয় তরকারী বসিয়ে দিয়েছে। নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থেকে মা, ছেলের পাক্কা রাধুনীর মত রান্না করার দৃশ্য দেখে নিঃশব্দেই আবার কিচেন থেকে প্রস্থান করেন। কিচেন থেকে বেরিয়ে উগ্র মেজাজ নিয়ে সোজা আবিরের রুমে ঢুকেন। নীলিমা তখন খাটে হেলান দিয়ে বসে এক একটা করে আঙুর মুখে দিচ্ছিল। হঠাৎ’ই পায়ের শব্দ পেয়ে দরজার দিকে তাকায়। আচমকা শাশুড়িকে থেকে থতমত খেয়ে যায় নীলিমা। হাত থেকে ফলটা পরে যায়। কাছে আসেন আবিরের মা। তাচ্ছিল্যের হাসি এসে বলেন, কালে কালে আরো কত কি দেখতে হবে! বউ নবাবজাদির মত পালংকে শুয়ে থাকবে আর জামাই গিয়ে রান্না করবে….!!!
হায়রে, একটা বাচ্চা পেটে ধরে মনে হচ্ছে বিশ্বজয় করে ফেলেছে। ভয়ে ঢোক গিলে নীলিমার জবাব, মা! শরীর’টা খুব দুর্বল দুর্বল লাগছিল তাই……
হাত উঁচু করে নীলিমার শাশুড়ি ওরফে আবিরের মা। তারপর মুখ বাঁকিয়ে বলে,
” এ্যা, দুর্বল লাগে…!
সারাদিন শুয়ে বসে থেকে বলে দুর্বল লাগে। ওরে, পেটে আমিও বাচ্চা ধরেছিলাম। তোমার মত এত পায়ে পা তুলে শুয়ে থাকিনি। ৭মাসের বাচ্চা পেটে রেখেও রান্না করছি, কুয়া থেকে পানি তুলে আনছি, ঢেকিতে ধান বানছি। অথচ কোনো নিচু বংশ থেকে আসিনি আমি। নামকরা পুরনো ধনী ছিলেন আমার দাদা। তার’ই সন্তান আমার বাবা। মঠখোলাতে বিরাট বড় কাপড়ের দোকান ছিল ওনার। বছর শেষেও ঢুলি ভরা ধান, গম থাকত’ই। এত বড় খানদানি বংশের মেয়ে হয়েও শ্বশুর বাড়িতে দিন কাটিয়েছি খেয়ে না খেয়ে। আর ওনি খাবারের নিচে ডুবেই থাকেন সব সময়। কাজের বেলায় যত অজুহাত।”
অনেকগুলো তিক্ত কথা শুনান আবিরের মা নীলিমাকে। কারো পায়ের আওয়াজ শুনে দ্রুত বের হয়ে যান রুম থেকে। খাটে মাথা রেখে দু’চোখের নোনাজল ছেড়ে দেয় নীলিমা। রুমে প্রবেশ করে আবির। আবিরের আসার শব্দ পেয়ে দ্রুত চোখের জল মুছে নেয় নীলিমা।
“কি ব্যাপার? এভাবে শুয়ে আছ কেন?”
বলেই কাছে আসে আবির। ফলের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বলেন, কি হলো? এগুলো খাওনি যে? ভেঁজা গলায় নীলিমার জবাব- খেয়েছি, আর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। একটু পরে খাই? মুখে হাসির রেখা ফুঁটিয়ে তুলে আবির, ঠিক আছে। এখন একটু রেস্ট নাও। একটু পর ভাত খাইবা। তারপর ভরা পেটে ফলগুলো খেয়ে নিও। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় নীলিমা। ‘আচ্ছা, আমি মা বাবাকে বলে আসি ব্রেকফাস্ট করে নিতে।’
চলে যাচ্ছিল আবির, ফিরে আসে।
‘ আচ্ছা! মাকে দেখলাম এদিকে থেকে যেতে।” মা কি রুমে আসছিল নাকি? মাথা নাড়ে নীলিমা, ‘জ্বি, আসছিলেন।’
উতলা কন্ঠে প্রশ্ন করেন আবির-
“মা, আজকেও তোমাকে প্রাচীনকালের কাহিনী বলে চড়া কথা শুনিয়েছে?”
হেসে দেই নীলিমা,
” কি যে বলো না! ওনি কেন কথা শুনাবেন? ওনি তো আসছিলেন বলতে এভাবে শুয়ে বসে না থেকে একটু হাঁটাহাঁটি করতে। এতে আমার ভালো হবে।”
মুখ থেকে চিন্তার ছাপ সরে যায় আবিরের। কারণ- ও জানে ওর নীলিমা কখনো ওকে মিথ্যে বলবে না, বলতে পারেই না। মুখে মৃদু হাসির রেখা নিয়ে নীলিমার কপালে একটা আলতো করে চুমুর পরশ এঁকে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায় আবির।
আবির চলে যাওয়ার পর প্রত্যেক বারের পর আজও নীলিমা বলে উঠে,
” ক্ষমা করো আমায়। এ নিয়ে শতেক বার মিথ্যে কথা বললাম তোমায়। কিন্তু কি করব বলো? আমার যে এর ছাড়া কোনো তোমায় নেই। এসব কথার জের ধরে সংসারে ভাঙোক ধরোক এটা আমি কোনো কালেই চাইতে পারব না। হাজার হোক শাশুড়ি তো। শাশুড়ি তো মায়ের’ই সমান। মা সন্তানকে কতকিছুই তো বলতে পারে, সেগুলো মনে ধরলে চলবে কিভাবে? আর তাছাড়া ওনি বুড়ো হয়ে গেছেন। বয়স হয়েছে। এখন একটু আধটু এসব বলবে। এসব মনে নিয়ে বসে থাকলে যে হয় না। কারণ, আমরা মেয়েজাত…”
কিহ?!!!
ট্রিপল বেবি মানে?
নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আবির, মানে আমার তিনটা বেবি হবে।
নীলিমা চোখ বড় বড় করে আবিরের দিকে তাকায়। মুখটাও কেমন হা হয়ে আছে। হওয়ার কথা’ই। আবির যা বলেছে তা শুনে শুধু নীলিমা নয় পাঠকরাও ‘থ’ হয়ে গেছে।
যায় হোক, পাঠকদের কথা রেখে এখন আসা যাক ওদের প্রসঙ্গে। আবিরের গ্রামের বাড়ি থেকে কল করেছে আবিরের বাবা। সুখবরটা শুনার পর থেকেই উতলা হয়ে আছেন ওনি কখন নীলিমাকে দেখবেন আর ওকে বাসায় নিয়ে যাবেন। আবিরের বাবা এত বেশী খুশি হয়েছেন যে ওনার আর তর সইছিল না সাথে সাথেই রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে শহরের উদ্দেশ্যে। ওনি চাচ্ছেন ওনার পুত্রবধূ গ্রামের বাড়িতে ওনাদের চোখের সামনে থাকুক। হ্যা, নীলিমা হসপিটালেও যাবে, রোগী দেখবে তবে সেটা ঢাকা নয়, গ্রামের নিকতস্থ ক্লিনিকে বসে।
কথা অনুযায়ী আবিরের বাবা ঢাকায় এসে পৌঁছে। সেখানে একদিন থেকে পরদিন সকাল সকাল রওয়ানা দিয়ে দেয় পুত্রবধূ্কে নিয়ে। নীলিমা যেতে চাচ্ছিল না কিন্তু আবিরের জোরাজুরিতে যেতে বাধ্য হলো। আবির নিজে গিয়ে ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে আসে। ওদের বিদায় দিয়ে বাসায় ফিরে আসে। খুব খারাপ লাগছিল আবিরের। বাসাটাও কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। সেদিন আর কলেজে যায়নি আবির। পুরো দিনটাই কাটিয়ে দিয়েছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে। কিন্তু শত ব্যস্ততার পরও আবির যখন বাসায় ফিরে আসে তখন শূন্যতারা ওকে গভীর ভাবে আকড়ে ধরে। বারান্দায় ঝুলে থাকা নীলিমার ওড়না, ড্রেসিংটেবিলের উপর পরে থাকা দুটো চুড়ি, আয়না, চিরুনি আর কাজল দেখে আবিরের ভেতরটা গুমড়ে কেঁদে উঠে।
যেদিকে তাকায়, সেদিকেই শুধু শূন্যতা। এই শূন্যতার সাথে আবির বেশী দিন লড়াই করতে পারেনি। ৫মাস অতিবাহিত হতে না হতেই আবির কলেজ থেকে ছুটি নেয়। স্ত্রীর অসুস্থতার কথা শুনে এবং প্রিন্সিপালের আন্তরিকতায় আবিরের দরখাস্ত মঞ্জুর হয়ে যায়। আবির ছুটি পেয়ে যায় ৬মাসের। যদিও এই ৫মাসের ভিতর আবির অনেক বার গ্রামের বাড়িতে গিয়ে নীলিমাকে দেখে এসেছে কিন্তু আজ কেন জানি আবিরের অন্য রকম এক ভালো লাগা কাজ করছে। টানা ৪ঘন্টা জার্নি শেষে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আবির গ্রামের রাস্তায় পৌঁছে। নামাজ শেষে শাশুড়ির জন্য চা তৈরি করতে গিয়েছিল নীলিমা। অকস্মাৎ পেটের ভিতর কি যেন মোচড় দিয়ে উঠে। ওহ, মাগো করে পেট চেপে ধরে নীলিমা। খুব খারাপ লাগছিল নীলিমার, তাই চোখ বোজে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিল। পরমুহূর্তে শাশুড়ির ডাক পরাতে তাড়াতাড়ি কাপে চা ঢেলে শাশুড়ির রুমে যায়। চা দিয়ে নীলিমা ধীর পায়ে দরজার কাছেও পৌঁছাতে পারেনি, তার আগেই নীলিমা শাশুড়ির ঝারি শুনতে পায়।
” এসব কি চা নাকি অন্য কিছু?”
ভয়ে কেঁপে উঠে নীলিমা। কাঁপা গলায় বলে- মা! আসলে আমার পেটে একটু খারাপ লাগছিল তাই চা’টা একটু লেগে গেছে। ধমক দেয় শাশুড়ি। বাচ্চা আমরাও পেটে ধরেছি। কিছু না হতেই তোমার মত ওহ, আহ করিনি। বলি পেটে কয় বাচ্চা ধরেছ যে এখনি হাপিয়ে উঠেছ?
কোনো কথা বলেনি নীলিমা। নিঃশব্দে শাশুড়ির রুম থেকে বিদায় নেয়। দরজার সামনেই আবির দাঁড়িয়ে। চমকে যায় নীলিমা। আআআআআপনি?
গম্ভীর মুখে জবাব দেয় আবির, হুম আমি।
আবিরের মুখ দেখে নীলিমা বুঝতে পারে ওদের বউ শাশুড়ির কথোপকথনগুলো অন্তঃরাল থেকে শুনে নিয়েছে আবির। নীলিমা চাচ্ছে না এসব নিয়ে এখন সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হোক, মা ছেলের মধ্যে মনো-মালিন্য হোক। আর ঠিক সে কারনেই আবিরের সামনে থেকে কেটে পরার জন্য ধীরপায়ে নীলিমা সামনের দিকে এগুচ্ছে। ‘দাঁড়াও’ পিছন থেকে ডাক দেয় আবির। থেমে যায় নীলিমা। দৌঁড়ে গিয়ে ব্যাগটা রুমে রেখে এসে নীলিমার কাঁধে হাত রাখে আবির। তারপর সাবধানে নীলিমাকে নিয়ে রুমে পৌঁছে। বিছানার একপাশে নীলিমাকে বসিয়ে ব্যাগ থেকে আঙুর, আপেল বের করে। নীলিমা ক্লান্ত চোখে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। “কি হলো? নাও…..”
নীলিমা কথা বাড়ায়নি। আবিরের হাত থেকে কয়েকটা আঙুর নেয়। নীলিমা আঙুর খাচ্ছে আর আবির ফ্লোরে নীলিমার পায়ের কাছে বসে নীলিমার খাওয়া দেখছে। বড্ড খিদে পেয়েছিল নীলিমার। তাইতো হাতেরগুলো খাওয়া শেষ হলে আবিরের আর কিছু বলতে হয়নি। নীলিমা নিজে নিজেই আবিরের হাত থেকে আঙুর নিয়ে খাওয়া শুরু করে। হঠাৎ’ই আবিরের চোখের দিকে চোখ পরতেই লজ্জা পেয়ে যায় নীলিমা। চোখ ফিরিয়ে নিয়ে উঠতে চাইলে আবির হাত টেনে ধরে। নীলিমা আবারো বসে। তবে এবার আবিরের দিকে তাকায়নি। অন্যদিকে তাকিয়েই বলে আমি আর খাব না। আবির ধমক দেয়। একদম না করতে পারবা না। এটা খাও বলেই আবির নীলিমার হাতে একটা আপেল ধরিয়ে দেয়। তারপর ফ্রেস হতে চলে যায়। আবির ফ্রেস হয়ে আসে। ততক্ষণে নীলিমার অর্ধেক আপেল খাওয়া শেষ। আবিরকে দেখেই বিনীত ভঙ্গিতে নীলিমা বলে উঠে, আমি আর খেতে পারছি না, একদম খিদে নেই। এটা ফেলে দেই???
নীলিমা জানালা দিয়ে আপেলটা ছুঁড়ে ফেলার জন্য হাত উঁচু করতেই আবির হাতটা ধরে ফেলে। আপেলটা নীলিমার হাতে থাকা অবস্থাতেই আপেলে আলতো করে কামড় দেয় আবির। খেতে শুরু করে আপেল। নীলিমার হাতে রেখেই আবির নীলিমার অর্ধ খাওয়া আপেলটা খেতে শুরু করে। সবশেষের অংশটি নীলিমার একদম হাতের তালুতে চলে যায়। আবির সেটা নিয়েও খেয়ে ফেলে। নীলিমা ঢ্যাবঢ্যাব করে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির একটা মৃদু হাসি দিয়ে বলে, তোমার খিদে নেই কিন্তু আমার খিদে ছিল।
তাই বলে আপনি, পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা তার আগেই থামিয়ে দেয় আবির। এটা মাকে দিয়ে আসি বলেই ফলের একটা কার্টুন নিয়ে আবির রুম থেকে বেরিয়ে যায়। একটু আগে আবির শুনেছে ওর মা অত্যন্ত বাজেভাবে নীলিমার সাথে কথা বলেছে। এই জন্য আবিরের মনটা খুব খারাপ। কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না ওর তারপরও মা তো। মনের কষ্ট মনেই চাপা রেখে আবির ওর মাকে সালাম দিয়ে, কুশল বিনিময় করে। সবশেষে ফলের কার্টুনটা মায়ের সামনে রেখে চলে আসে।
রাতের খাবার খাওয়ার জন্য খাবার টেবিলে বসেছে আবির এবং ওর বাবা-মা। নীলিমা ধীর পায়ে সবার দিকে খাবার এগিয়ে দিচ্ছে। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রান্না করার ফলে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল নীলিমা। তাই একটু ধীর পায়েই এগুচ্ছিল শ্বশুরের দিকে। এরই মাঝে শাশুড়ির মন্তব্য, আবার কি ঘন্টাখানেক পরে তরকারী দিবা নাকি?
ক্লান্ত নীলিমা মলিন মুখে শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বলে, আসছি মা।
পাশ থেকে আবির বলে উঠে, কি ব্যাপার? সবাইকে যে খাওয়াচ্ছ তুমি কখন খাবে? নীলিমার ওর শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে, আপনারা খেয়ে উঠুন। আমার এখন খিদে নেই। আমি পরে ধীরে সুস্থে খাবো। ব্যাপারটা ভালো ঠেকেনি আবিরের কাছে।
রাত্রে সবার খাওয়া শেষে নিচে মাদুর পেতে বসে নীলিমা। প্রতিদিনের মত সেদিনও নীলিমার শাশুড়ি প্লেটের মাঝখানে করে কিছু ভাত আর তরকারী এনে দিয়ে যায়। প্রচন্ড খিদে পেটে গপগপ করে খাওয়া শুরু করে নীলিমা। নিমিষেই শেষ হয়ে যায় প্লেটের সকল ভাত। ধীরে ধীরে উঁঠে দাঁড়িয়ে নীলিমা এগিয়ে যায় কিচেনের দিকে। কিচেনে দাঁড়িয়েই তাড়াতাড়ি করে কয়েকমুঠো ভাত মুখে পুরে দেয়। মাছের ভাজা দেখে লোভ সামলাতে পারেনি নীলিমা। মাছের ভাজিটা হাতে নিয়ে খাবার টেবিলের কাছে ফিরে যাচ্ছিল নীলিমা, অমনি থমকে দাঁড়ায়। ওর চোখের সামনে শাশুড়ি অগ্নিমূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে। শাশুড়িকে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম নীলিমার। আমতা আমতা করা শুরু করে নীলিমা।
” ইয়ে না মানে মা আমার খিদে….”
পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা। তার আগেই হাত থেকে মাছের ভাজিটা ছিনিয়ে নেয় শাশুড়ি। গড় গড় করে বলতে থাকে।
” কত বার করে বলেছি কৈ মাছ,
টাকি মাছ এসব খাবি না। এসব খেলে বাচ্চা কালো হয়। তুই আমার কথা কানেই নিস না। নিবি কেন? তোর তো খাওয়া হলে কিচ্ছু লাগে না। না হলে আমি তোকে কতবার করে বলছি, বেশী খাবি না। বেশি খেলে সন্তান বড় হয়ে যাবে। প্রসবের সময় কষ্ট হবে। বান্দার জানের ভয়ও নাই। খালি খাই, খাই।”
মা, টাকি মাছ বলেন,কৈ মাছ বলেন এসবে গর্ভবতীর কোনো ক্ষতি হয় না। এসব গর্ভের শিশুর জন্য ভালো, পুষ্টিকর। বাচ্চা পেটে আসার পর থেকে ৬মাস পর্যন্ত শিশুর….. পুরো কথা বলতে পারেনি নীলিমা। মুখ থেকে কথা ছিনিয়ে নেয় ওর শাশুড়ি। বেয়াদবের মতো মুখে মুখে তর্ক করবে না। বাচ্চা আমরাও প্রসব করছি। তাই কিসে বাচ্চার ভালো, কিসে মন্দ সে বিষয়ে আমরা একটু বেশীই জানি। যাও, হাত ধূয়ে ঘুমোতে যাও…..
হাতটা ধূয়ে নিঃশব্দে নিচের দিকে তাকিয়ে সে স্থান ত্যাগ করে নীলিমা।
মাঝ রাত্রে ঘুম ভেঙে যায় নীলিমার। প্রচন্ড খিদের জ্বালায় ভিতরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। শুয়া থেকে উঠে বসে নীলিমা। ড্রিমলাইটের আলোয় হাতড়ে হাতড়ে আবিরের আনা ফলের কার্টুনটা খুঁজে বের করে।
কুটকুট শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আবিরের। কি হলো? আলমারির কাছে কি শব্দ হচ্ছে? ইঁদুর নয়তো? হুট করে লাইটটা জ্বালিয়ে দেয় আবির। আলমারির দিকে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে যায় আবির। আলমারির পাশেই ছোট্ট সোফায় বসে কলার খোসা ছাড়িয়ে আপনমনে কলা খাচ্ছে নীলিমা।
আবির নীলিমার নরম অধরে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। সেই মুহূর্তে নীলিমাকে একান্তভাবে পাবার ইচ্ছে জেগে উঠল মনে। বাতাসের শোঁ, শোঁ, বজ্রপাতের গুড়ুম গুড়ুম কোনো কিছুই এখন তার কানে যাচ্ছে না। এত তীব্র আকর্ষণ এর আগে আবির কোনোদিন অনুভব করে নি। কাঁধ থেকে খসে পড়ল আঁচলটা….
সকালে ব্রেকফাস্ট রেডি করছিল নীলিমা। এদিকে আবির ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ডাক দেয় নীলিমাকে। “কোথায় গেলে? তাড়াতাড়ি রেডি হও। সকালের খাবার আর দুপুরের খাবার একসাথে না হয় নরসিংদী গিয়েই করো।”
ব্রেকফাস্ট রেডি করে আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এগিয়ে আসে নীলিমা। মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় করে রেখেছে। সেটা দেখে মৃদু হাসল আবির। ডায়াল করে শাশুড়ি মায়ের নাম। রিসিভ করে শ্যালিকা লিমা। আপনাদের বুঝার সুবিধার্থে ওদের কথোপকথনগুলো নিন্মে তুলে ধরা হলো-
আবির- আসসালামু আলাইকুম, মা…
লিমা- ওয়ালাইকুম আসসালাম ভাইয়া।
আবির- ওহ, লিমা? কেমন আছ?
লিমা- ভালো আর থাকলাম কোথায়?
আবির- মা কেমন আছে?
লিমা- কিছুটা ভালো। আপুকে নিয়ে কখন আসছেন?
আবির- আঁকাশ ঘোর কালো অন্ধকারে ঢেকে গেছে লিমা। যেকোনো মুহূর্তে বৃষ্টি শুরু হতে পারে। তাই বলছিলাম কি তোমরা চলে আসো লিমা।
লিমা- মানে কি ভাইয়া? আপু কি…..
পুরো কথা বলতে পারেনি লিমা। তার আগেই আবির রুম থেকে সরে বারান্দায় গিয়ে ফোনটা মুখের কাছে নিয়ে ফিসফিসিয়ে জবাব দেয়, বোন আমার। বেশী কথা বলো না। তাড়াতাড়ি রওয়ানা দিয়ে দাও তোমরা। আমি রাস্তা থেকে তোমাদের গিয়ে এগিয়ে নিয়ে আসব। এখন বেশী কথা বলা যাবে না। তোমরা আগে আসো, তারপর মজার ঘটনা বলব।
রাখলাম, বাই।
কল কেটে রুমে ফিরে আসে আবির। নীলিমা তখন কোমড়ে হাত দিয়ে রাগান্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। সেটা দেখেও না দেখার ভাব করে বিছানায় ফোনটা রাখতে রাখতে আবির বলে, খিদে পেয়েছে। খাবার দাও।
নিঃশব্দে নীলিমা খাবার দিয়ে রুমে চলে আসে। খাওয়া শেষে স্টাডিরুমে তাকাতেই আবির নীলিমাকে রেডি দেখতে পায়। চোখ কপালে তুলে প্রশ্ন করে আবির-
” সে কি? কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
জবাব আসে, বাপের বাড়ি।
—- যেতে হবে না। আম্মাকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তো? লিমা, আম্মাকে নিয়ে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছে মনে হয়। নীলিমা আর কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ রুম থেকে বের হয়ে কিচেনে চলে যায়।
রাত্রি ৮টায় বাসায় পৌঁছে নীলিমার বোন ও মা। যদিও দুপুর ২টায় রওয়ানা দিয়েছিল কিন্তু রাস্তায় অত্যাধিক মাত্রায় জ্যামের কারনে আসতে এত দেরী হলো। মায়ের প্রতি অভিমান কিংবা রাগ যতই থাকুক না কেন মা আসবে এ খবর পাওয়ার পর থেকে বাহারি নানা ধরনের খাবার রান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলিমা। মা বোন বাসায় ঢুকতেই কি খাওয়াবে না খাওয়াবে সেসব কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওরা ফ্রেশ হয়ে রুমে ঢুকতেই সামনে এনে দেয় ঠান্ডা পানিয় জাতীয় কিছু। বোনের এককথা,
” আপু! এখন শীতকাল। এ শরবত টরবত কেন আনছিস?”
নীলিমার পাল্টা জবাব, সারাদিন জার্নি করে এসেছিস। খেয়ে নে। ভালো লাগবে। নীলিমা যেন নাছোড়বান্দা। বাধ্য মা মেয়ে পানিয় জলটা পান করেই নেয়। তার কিছুক্ষণ পর সামনে আনে পায়েস। পায়েস খাওয়া শেষ হতে না হতেই ঝালমুখ করানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যস্ত হয়ে পড়ে সারাদিন ধরে রান্না করা সকল আইটেম পরিবেশনের। নীলিমা কিচেন থেকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে আর আবির দৌঁড়ে দৌঁড়ে সেগুলো নিয়ে বিছানায় শ্যালিকা এবং শাশুড়ির সামনে রাখছে। ওদের এ হেন ব্যস্ততা দেখে হেসে দেয় নীলিমার বোন লিমা। টিপ্পনী কেটে বলে,
এমন ভাবে খাবার দিচ্ছেন, মনে হচ্ছে আমাদের চেয়ে বড় খাদক পৃথিবীতে আরেকটাও নেই। ক্ষাণিক হাসে আবির।
“তোমরা শুরু করো। আমরা দুজন পরে একসাথে খাবো।”
নীলিমার মায়ের মন খারাপ।
‘এতদিন পর মেয়ের জামাইয়ের বাড়ি আসলাম আর এখনো কি না মেয়ের মুখটা’ই দেখতে পেলাম না।’
অনেকটা আক্ষেপের সাথে অভিমান মিশ্রিত করে নীলিমার মায়ের কথাটা ছিল। আবির কিচেনে গিয়ে অনেকটা রাগান্বিত স্বরে বলে, এই তোমার আদব? মেহমান বাসায় আসছে ওদেরকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করবে না? নিশ্চুপ নীলিমা মাথা নিচু করে বলে, আমি তো ভাবছিলাম পরে বলব।
“পরে নয়, এখনি বলবা। ওরা বসে আছে খাবার মুখে না দিয়ে। এখনি মাকে সালাম করে কুশল বিনিময় করবা।”
আবির একহাতে কিচেন থেকে দুইটা প্লেট নিয়ে আরেক হাতে নীলিমাকে টানতে টানতে শাশুড়ি মায়ের সামনে উপস্থিত হয়। নীলিমা মাথা নিচু করে মাকে সালাম দেয়,
” আসসালামু আলাইকুম, মা।”
ফিরে তাকায় নীলিমার মা। মেয়েটা কিরকম শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। সবই হয়েছে আমার বুঝার ভুলের জন্য। চোখে জল এসে যায় নীলিমার মায়ের। বহুকষ্টে সে জল আটকে মুখে হাসি এনে মেয়ের সালামের জবাব সরূপ বলে,
” ওয়ালাইকুম আসসালাম….”
তারপর মা মেয়ে দুজনেই চুপচাপ। আবির পাশ থেকে ধাক্কা দেয় নীলিমাকে।
“মাকে জিজ্ঞেস করো, কেমন আছে?” নীলিমা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
মা আপনার শরীর ভালো তো?
নীলিমার মা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ, এখন ভালোই আছি। তো দাঁড়িয়ে আসিস কেন? জামাইকে নিয়ে বসে পর। রাত তো আর কম হয়নি।”
” জ্বি, আম্মা। আমরা বসছি বলেই আবির দুইটা চেয়ার টেনে একটাতে নীলিমাকে বসিয়ে তার পাশেরটাই বসে পরে।
সবাই খাওয়া শুরু করছে। নীলিমার মা ফ্যালফ্যাল করে নীলিমার হাতের আঙুলের দিকে তাকিয়ে আছেন। নীলিমাও যেন একটা বিব্রতিকর অবস্থায় পড়ে গেল। মায়ের সামনে না বসে থাকতে পারছে না বাম হাতে খাবার মুখে দিতে পারছে। ব্যাপারটা আবির লক্ষ করে। বিষয়টা ধামাচাপা দেয়ার জন্য নীলিমার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলে, তোমার না গতকাল হাত কেটে গেছে। এখন ভাত মাখবে কিভাবে? প্লেট রাখো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।
………………………………..
কি হলো? হা, করো…!!!
নীলিমা কোনো কথা বাড়ায়নি। আবিরের কথা মতই হা করে। আবির নীলিমাকে খাইয়ে দিচ্ছে ফাঁকে ফাঁকে নিজেও মুখে দিচ্ছে। ওদের দিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়েছিল নীলিমার মা। মুচকি হেসে পাশ থেকে ধাক্কা দেয় লিমা। ফিসফিসিয়ে বলে, কি হলো মা? ঐদিকে তাকিয়ে আছ কেন? খাও…..
চোখের জল মুছে নীলিমার মা খাওয়া শুরু করে।
কয়েকদিন পর সকালে__
সকালের খাবার রেডি করে সবাইকে খাইয়ে নিজেও খেতে বসছিল নীলিমা। তখনি গড়গড় করে বমি করে দেয়। পেটে এতক্ষণ ধরে যা ভাত দিয়েছিল সব বেরিয়ে আসে বমির সাথে। নীলিমা দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। ওয়াশরুমে আবির কলেজে যাবে বলে ফ্রেশ হচ্ছিল, নীলিমা আবিরের পায়ের উপর গড়গড় করে বমি ছেড়ে দেয়। বিরক্তিকর ভঙ্গিতে ভ্রু-কুঁচকে আবির পিছনের দিকে তাকায়। নীলিমাকে এ অবস্থায় দেখে সব বিরক্তি নিমিষেই উদাও হয়ে যায়। তাড়াতাড়ি নীলিমার কাছে গিয়ে নীলিমার মাথায় চেপে ধরে। নীলিমা বমি করতে করতে একসময় হাপিয়ে উঠে, ক্লান্ত হয়ে যায়। আবির নিজ হাত দিয়ে নীলিমার মুখ পরিষ্কার করে ডাক দেয় শ্যালিকা লিমাকে। দৌঁড়ে আসে নীলিমার ছোট বোন লিমা। আবিরের কথামতো একগ্লাস পানি এনে দেয়। নীলিমা গড় গড় করে কুলি করলে ওকে ধরে রুমে নিয়ে যায়।
” কলেজে যেতে হবে আমার। লিমা, তুমি একটু নীলিমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাও। আর হ্যাঁ, তোমরা আজকে যেতে পারবে না। নীলিমা তোমারও আজকে চেম্বারে যাওয়ার দরকার নেই। আর তোমরা কিন্তু যাচ্ছো না। নীলিমার কি হয় না হয়। তাই তোমরা কিছুদিন থাকবে।”
আবির লিমার হাতে একহাজার টাকা ধরিয়ে দিয়ে কলেজে চলে যায়।
” আপা চলো তো!
ডাক্তারের কাছে যেতে হবে।”
নীলিমা ওর বোনের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিচেনে চলে যায়। সবকিছু গুছিয়ে রেডি হয়ে নেয় চেম্বারে যাওয়ার জন্য। ছুটে আসে লিমা।
” আপা, তোমায় যে ভাইয়া বলে গেছে আজকে চেম্বারে যেতে হবে না! তারপরও কেন যাচ্ছ?”
দ্যাখ, লিমা। বাঁধা দিস না। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে। বমি আমার কয়েকদিন ধরেই হচ্ছে। আজকে হসপিটাল থেকে চেকআপ করে আসব নে। তুই একদম চিন্তা করিস না। মা নিচতলা থেকে ফিরলে মাকে পিঠা পায়েস দিস। আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে, আমি গেলাম। কথাগুলো বলেই নীলিমা চেম্বারে চলে যায়। বিকেলে ফেরার পথে দোকান থেকে টিউব কিনে আনে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা করার জন্য। পরদিন ঘুম থেকে উঠেই আগে পরীক্ষা করে নেয়। তার পরদিন বিকেলে চা তৈরি করার সময় টিউবটা কিচেনের জানালা দিয়ে ফেলে দিতে গেলে পেছন থেকে হাতটা ধরে ফেলে কেউ।
” কি হলো? পজিটিভ না নেগেটিভ?”
নীলিমা ফিরে তাকায়। স্মিতহাস্যে আবির দাঁড়িয়ে পিছনে।
” কি হলো? চুপ কেন?রিপোর্ট কি বলছে?”
লজ্জায় নীল হয়ে গেছে নীলিমা। মাথা নিচু করে বলে, জানি না। স্মিতহাস্যে জবাব দেয় আবির, কিন্তু আমি জানি। চমকে উঠে আবিরের মুখের দিকে তাকায় নীলিমা। “মানে?”
একটু কাশি দিয়ে নেয় আবির। তারপর সুরে সুরে বলে, আমি টিউবটা চুরি করে নিয়ে……. ফার্মেসীতে……গিয়ে……ছিলাম। বাদল ভাই বলল……..(…….)……???
পিছন থেকে লিমা বলে উঠে, কি বলল?
আবির চোখ বড় বড় করে পিছনে তাকায়। লিমা, তোমার কি কমন সেঞ্চ বলতে কিচ্ছু নেই। এমন সময়’ই আসতে হলো তোমার?
” স্যরি, ভাইয়া। আমি সত্যিই স্যরি।”
কথাটা বলে মাথা চুলকাতে চুলকাতে সে স্থান ত্যাগ করে লিমা। নীলিমা তখনো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। আবির আবারো সুরে সুরে বলা শুরু করে, বাদল ভাই…. বলে….ছে……. আমার…..বউ….টা……(……)…..???
“আপনার বউটা মা হতে চলেছে।”
নীলিমার মুখ থেকে কথাটা শুনে আবির চোখ বড় বড় নীলিমার দিকে তাকায়। নীলিমা অন্য দিকে তাকিয়ে বলে কথাটা এভাবে ঘুরিয়ে বলে লজ্জা না দিলেই কি নয়? চলে যাচ্ছিল নীলিমা, হাতটা ধরে ফেলে আবির।
” আমি যে কত্ত খুশি হয়েছি সেটা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না নীলিমা। উফফ! আমার অনেকদিনের শখ ট্রিপল বেবির। এবার বুঝি ইচ্ছেটা পূরণ হতে চলেছে।”
কিহ?!!!
ট্রিপল বেবি মানে?
নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আবির। মানে আমার তিনটা বেবি হবে।
একি করছ?!!!
দৌঁড়ে গিয়ে নীলিমার পাশে বসে আবির। ঠোঁট থেকে কাঁচগুলো সরিয়ে নিতেই আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠে নীলিমা। “ওমাগো, জ্বাল।
মরে গেলাম গো, জ্বলে যাচ্ছে গো…..”
আবির ওর ময়লা হাতের দিকে তাকায়। হাতে তখনো হলুদ, মরিচের গোঁড়া লেগে আছে। দিগ্বিদিক শূন্য আবির তখনি নীলিমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। শুষে নেয় নীলিমার ঠোঁটের সবটুকু জ্বাল। কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে ছিল নীলিমা। হুশ ফিরে যখন তখন আবির ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
তোমার ঠোঁটের কাটাস্থানে অসাবধানতাবশত মরিচের গোড়া লেগে গিয়েছিল তাই, পুরো কথা বলতে পারে নি আবির। নীলিমা হাত উঁচু করে আবিরকে থামতে বলে। আবির থেমে যায়। রাগে হনহনিয়ে স্টাডিরুমে ঢুকে দরজা আটকে দেয় নীলিমা।
রান্না শেষে ভিঁজানো চাদর এবং কম্বল ধুয়ে ছাদে নিয়ে যায় আবির। এরই মাঝে নীলিমা ভাত নিয়ে খেতে বসে পরে। ছাদ থেকে ফিরে আবির আলমারি থেকে একটা নতুন চাদর বের করে বিছানা করে নেয়। বারান্দা থেকে বালিশ দুটো এনে ময়লা পরিষ্কার করে খাটে রাখে। খাটের নিচ থেকে কোলবালিশটা এনে খাটের একপাশে রাখে। সবশেষে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে।
আবির ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে আসে। ততক্ষণে নীলিমার খাওয়া শেষ। পরনে তোয়ালে চেঞ্জ করে নীলিমার দিকে তাকায়। ” ভালো’ই হলো খাওয়া দাওয়া সেরে নিয়েছেন। এবার রেডি হন। আমি আপনাকে নরসিংদী দিয়ে আসি।”
চলে যাচ্ছিল নীলিমা, আবিরের কথা শুনে থমকে দাঁড়ায়। চোখ বড় বড় করে তাকায়।
” এভাবে তাকিয়ে কেন আছেন? আমি কি বলছি বুঝতে পারেন নি? নাকি বাংলা বুঝেন না? আপনাকে আমি নরসিংদী আপনার গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে চাচ্ছি, তাই দয়া করে রেডি হোন। কোনো কথা না বলে স্টাডিরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় নীলিমা। অভিমানে গুমড়ে কেঁদে উঠে। লাঞ্চ সেরে আবির স্টাডিরুমের দরজায় নক করে। আবিরের শব্দ শুনেই হো, হো শব্দে অভিনয় করে কেঁদে উঠে নীলিমা।
” ওহ,মাগো। মরে গেলাম গো। ব্যথা।”
ভড়কে যায় আবির। নীলিমার কান্নায় ভেতরটা মুচড় দিয়ে উঠে। নীলিমাকে দরজা খুলার জন্য একের পর এক দরজায় কড়াঘাত করছে আবির। কিন্তু ভুলে দরজা খুলছে না নীলিমা। যদি নরসিংদী নিয়ে রেখে আসে সেই ভয়ে দরজা খুলার সাহস পাচ্ছে না।
অনেকক্ষণ পর দরজা খুলে নীলিমা। আবির তখনো দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিল। নীলিমা হন্যে হয়ে রুমে ঢুকে আবির।
” কি হয়েছে নীলিমা? কোথায় ব্যথা করছে? খুব ব্যথা করছে? এটা সেটা আরো কত কি।” আবিরের কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়নি নীলিমা। শুধু গাল থেকে আবিরের দু’হাত ছাড়িয়ে দিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পরে। আবির বিছানার পাশে বসে কিছুক্ষণ নীলিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়, তারপর ঘুমানোর কথা বলে চলে আসে।
রাত্রের খাবার শেষে স্টাডিরুমে চলে যায়।
স্টাডিরুমের দরজা আংশিক মিশিয়ে শুয়ে পরে নীলিমা।
একি?! ওনি আজকে আমাকে এ রুম থেকে নিচ্ছেন না কেন? তবে কি ওনি সকালের ঘটনায় সত্যি সত্যি রেগে গেছেন? ওনি কি সত্যি সত্যি আমায় নরসিংদী রেখে আসবেন? না, না। এ হতে পারে না। শুয়া থেকে উঠে বসে নীলিমা।
আস্তে আস্তে দরজা ফাঁকা করে আবিরের রুমের দিকে উঁকি দেয়। কপালে হাত দিয়ে আনমনে কি যেন ভাবছে আবির।
যাই,
কাছে গিয়ে শুই,
আমার কারণেই তো এরকম করছেন আজকে। আমি’ই গিয়ে রাগটা ভাঙায়।
নীলিমা স্টাডিরুমের দরজা মিশিয়ে আবিরের রুমে ঢুকে। আবির তখনো আনমনে ভেবেই চলছে। দরজাটা লক করে আবিরের গা ঘেষে শুইলে হুশ ফিরে আবিরের। ক্ষাণিকটা সরে আসে আবির। কিছুক্ষণ চুপ থাকে নীলিমা। তারপর আবারো আবিরের কাছে গিয়ে ওর উপরে একটা হাত উঠিয়ে দেয়। হাত সরিয়ে দেয় আবির। আবারো হাত রাখে নীলিমা, হাত সরিয়ে দেয় আবির। এবার একহাতে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে তাকায়। আবির তখন বিপরীতমুখী হয়ে শুয়ে। পিছন থেকে আবিরকে জড়িয়ে ধরে আবিরের গালে হাত রাখে নীলিমা। এবার অনেকটা ভ্রু কুঁচকে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে আবির নীলিমার হাতটা ছাড়িয়ে নীলিমার দিকে ফিরে তাকায়। মুখটা অমাবস্যার কালো অন্ধকারের ন্যায় কালো করে নীলিমা দুরে সরে যায়। আবিরের থেকে অনেকটা দুরত্ব রেখে মাঝখানে কোলবালিশ রেখে শুয়ে পরে নীলিমা। বাকি রাতের মধ্যে একবারও আবিরের কাছে ঘেষার চেষ্টা করেনি। তবে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজটা শুনেছে আবির। ভোরে টুংটাং আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে আবিরের। আবিরের জন্য রান্নাবান্নায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে নীলিমা। খাওয়া দাওয়া মিস করেনি আবির, তবে নীলিমার সাথে কথাটা বলেনি। সারাদিনে একটা কথাও বলেনি। খাওয়া দাওয়া করেই বাইরে চলে যায় আবির। নামাজের টাইমে ফিরে আসে। ওজু করে আবার বাইরে চলে যায়।
কতভাবে নীলিমা আবিরের কাছে ক্ষমা চাইতে গিয়েছে, কিন্তু নীলিমাকে পাত্তাই দেয়নি আবির। রাত্রে খাওয়া দাওয়া করে নিজ রুমে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিল আবির। তখনি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে নীলিমা। পরনে গোলাপী কালার শাঁড়ি, তার মিলিয়ে হাতে একগোছা চুড়ি, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর চোখে গাঢ় কালো কাজল।
ব্যস এটুকুই…..
চুড়ির রিনিঝিনি শব্দে আবির শুধু একবার দরজার দিকে তাকিয়েছে, নীলিমাকে একনজর দেখে সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে আবির। লাইটটা অফ করে কম্বলে মুখ ঢেকে শুয়ে পড়ে আবির। ভিতরটা ফেটে চৌচির হয়ে যায় নীলিমার। সবকিছু সহ্য করা গেলেও প্রিয় কারো অবহেলা সহ্য করা যায় না। নীলিমাও পারে নি। বাইরে প্রচন্ড বেগে ঝড় বইছে ঠিক তেমনি ভেতরটাও অজানা ঝড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। দৌঁড়ে স্টাডিরুমে চলে যায়। বিছানার মাঝখানে গিয়ে বসে নীলিমা। হাতের চুড়িগুলো একটা একটা করে খুলে ফেলে। খুলে ফেলে শাঁড়ির সাথে মিলিয়ে পরা কানের লম্বা লম্বা দুল আর গলার মালা। শাঁড়িটাও চেঞ্জ করতে হবে। আর শাঁড়িটা চেঞ্জ করার জন্য আঁচলটা সরিয়ে রাখে। ঠিক তখনি রুমে প্রবেশ করে আবির। পায়ের শব্দ পেয়ে আঁচল দিয়ে দ্রুত শরীর ঢেকে নিল নীলিমা। কিন্তু ততক্ষণে যা দেখার দেখে ফেলেছে আবির।
আবির টের পেল ওর সমস্ত রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে। সে আস্তে করে গিয়ে বসল নীলিমার পাশে।
নীলিমা বলল, ‘ আমি বড্ড বেশী করে ফেলেছি, না?”
অবাক হলো আবির। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?
নীলিমা তাকিয়ে রইল আবিরের দিকে। আপনি খুব ভালো মানুষ মি. আবির। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। কাল আমি চলে যাব। তবে আপনাকে কোনোদিন ভুলতে পারব বলে মনে হয় না। দরজার দিকে পা বাড়াল নীলিমা, ঘুরে দাঁড়ালো আবার। গুড নাইট মি. আবির। দরজা বন্ধ করে চলে গেল নীলিমা।
আবির তাকালো নীলিমার দিকে।
” ও কি বলে গেল- কোন দিন ভুলতে পারবে না। মানে কি এ কথার?” নীলিমাকে ম্লান আর বিষণ্ন লাগল। উত্তর দিল,
‘জানি না আমি।’
কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল দু’জনে। বাতাসের আর্তনাদ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। আবির চেষ্টাকৃত হাসি দিল। বৃষ্টিতে ভিঁজবে? মাথা নাড়ল নীলিমা। ভিঁজবে না। চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়াচ্ছে, ওর হাত ধরে ফেলল আবির।
” যেয়ো না। তুমি জানো এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করেছিলাম আমি। তোমার সাথে কথা বলতে চাই। তোমার মিষ্টি কন্ঠটা শুনতে চাই।”
আবির উঠে বাতি নিভিয়ে দিল। শুধু ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় আলোকিত হয়ে থাকল ঘর। আবির বসল নীলিমার গা ঘেঁষে।
” এখন আরো রোমান্টিক লাগছে না?”
আবির দু’হাত দিয়ে নীলিমার গাল স্পর্শ করে কথাটা বলল। হাতটা সরিয়ে দিল নীলিমা। ‘আমি ঘুমাবো।’ জবাব আসে, রাত তেমন বেশি হয়নি। বাহির ভিতর একসাথেই মাতাল হাওয়া বইছে। পরস্পরকে জেনে নেয়ার এই সুযোগটা হারাতে চাচ্ছি না।
এবারও আবিরের হাত দুটো সরিয়ে দিল নীলিমা। ‘ আমি যাই। সত্যি মি. আবির, আপনার সঙ্গে আমার থাকা সম্ভব নয়। এটা- এটা ঠিক না।’
মিস্টার বাদ দাও। আমাকে স্রেফ আবির বলে ডাকতে পারো না? আমি তো তোমার’ই বুড়ো। আর তাছাড়া বাহিরে ঝড় বইছে, ভিতরে আমরা দু’জন অন্ধকারে বসে আসি। ব্যাপারটা রোমাঞ্চকর লাগছে না তোমার কাছে? আমার কাছে তো রূপকথার মত মনে হচ্ছে।
আমি বুঝতে পারছি আবির। কিন্তু আমি আর এখানে থাকতে চাচ্ছি না। আমার ঘুম পাচ্ছে। নীলিমার মাথার পিছনে হাত চালিয়ে দিল আবির, ঝুঁকে এল ওর দিকে। ঘুম গোল্লায় যাক। একটা ঘন্টা অন্তত সময়টাকে স্থির করে দিতে পারো না? তোমাকে ভালোবাসি এই কথাটা আমাকে বলতে দাও। বলতে দাও এই কুৎসিত পৃথিবীতে তুমি’ই একমাত্র সুন্দর মানবী। তোমার সৌন্দর্যের কাছে ম্লান হয়ে গেছে ঝড়ের শক্তি। আমার দিকে তাকাও, নীলিমা। একটা ঘন্টার জন্য কি আমরা রূপকথার রাজ্য থেকে ঘুরে আসতে পারি না? সব ভুলে আমরা কি এক হতে পারি না? নীলিমাকে নিজের কাছে টেনে আনল আবির। রাগে কাঁপছে নীলিমা। কাঁপতে কাঁপতেই নিজেকে সমর্পণ করল আবিরের কাছে।
আবির নীলিমার নরম অধরে নিজের ঠোঁট চেপে ধরল। সেই মুহূর্তে নীলিমাকে একান্তভাবে পাবার ইচ্ছে জেগে উঠল মনে…..
পিছনে ফিরে তাকায় নীলিমা। গম্ভীর মুডে আবির দাঁড়িয়ে। কথা বলেনি কোনো। রিক্সাওয়ালাকে নীলিমার ভাড়াসহ ঐ স্যারের ভাড়াটাও দিয়ে দেয়।
রিক্সা চলে যায়। হাঁটা শুরু করে আবির। আবিরের পিছু পিছু নিঃশব্দে হাঁটছে নীলিমা। কারো মুখেই কোনো কথা নেই। নীলিমা অবশ্য এরই মাঝে বার কয়েক আবিরের দিকে ফিরে তাকিয়েছে, কিন্তু আবিরের সেদিকে একটুও খেয়াল নেই। বরাবরের মতই মাথা নিচু করে চুপচাপ হাঁটছে আবির। বাসায় পৌঁছে দু’জনেই।
” ব্যাগে টাকা আছে, ভাড়া বাবদ যত টাকা লাগে নিয়ে নিও।” নীলিমার হাতে আবির ওর মানিব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে বাহিরে চলে যায়। নীলিমা সেদিকে ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকিয়ে আছে।
আবির চলে গেলে ব্যাগ হাতে বিছানায় বসে নীলিমা। মানিব্যাগের একপাশে দুটো এক হাজার টাকার নোট, আর ৫টা একশ টাকার নোট রাখা। ৫টা একশ টাকার নোট ব্যাগ থেকে বের করে টাকাগুলো ছোট করে ভাঁজ করে নীলিমা ওর আঁচলে বেধে রাখে। তারপর শাঁড়িটা ঠিক করে আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নেয়। আবির তখনো আসেনি, তাই ওর আসার আগেই বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নীলিমা বের হয়ে যায় বাসা থেকে।
দুপুর ১টা__
সিএনজির অপেক্ষায় বাসার সামনে দাঁড়িয়ে নীলিমা। সেই সাড়ে ১২টা থেকে এখানে দাঁড়িয়ে, এখবো অবধি কোনো খালি সিএনজি কিংবা রিক্সা আসার নাম নেই। মেজাজ গরম হয়ে যায় নীলিমার। রাস্তার ওপাশের ছোট্ট বেঞ্চে বসার জন্য এগিয়ে যেতেই নীলিমা ছেলেদের হাসির শব্দ শুনতে পায়। বেঞ্চে বসে হাসিটা কোথা থেকে আসছে সেটা বুঝার চেষ্টা করে। পাশেই একটা বিল্ডিং মেরামতের কাজ চলছে। সেই বিল্ডিংয়ের ছাদের উপর কিছু ছেলেপুলে বসে গল্প করছে, হাসিটা সেখান থেকেই আসছে। দৃষ্টি ফিরিয়ে আনার আগে আবারো ছেলেদের দিকে তাকায়। ৫,৬টা ছেলের মাঝে আবিরও বসে ছিল সেখানে। অপলক ভাবে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে নীলিমা। হঠাৎ’ই রিক্সাওয়ালার ডাক পরে,
ও আপা যাবেন? যাব বলে নীলিমা রিক্সার কাছে যায়। রিক্সার কাছে গিয়ে আবারো বিল্ডিংটার ছাদের দিকে তাকায়। আবির তখনো গল্পে মশগুল। রিক্সাওয়ালা আবারো বলে, আপা দাঁড়িয়ে ক্যান? কেউ আইব? কোনো উত্তর না দিয়ে নীলিমা আবারো ঐ বিল্ডিংটার ছাদে তাকায়। আবির তখনো গল্পে মগ্ন। ইস! একবার নিচে তাকা, শুধু একবার তাকা। মনে মনে কথাগুলো বলছিল নীলিমা।
আজব লোক’ তো…..!!!
এটা বলে রিক্সাওয়ালা চলে যায়। ফিরে তাকায় নীলিমা। ততক্ষণে রিক্সাওয়ালা চলে গেছে। উফ! চলে গেল বলে নীলিমা পুনরায় বেঞ্চে গিয়ে বসে। আরেকটা সিএনজি আসে। নীলিমা সিএনজিকে না করে দেয়। তারপর আবারো উপরে আবিরের দিকে ফিরে তাকায়। আবির তখনো গভীর গল্পে মশগুল। এরই মধ্যে আরো একটা সিএনজি আসে। এবার নিঃশব্দে নীলিমা সিএনজির কাছে যায়। শেষ বারের মত ফিরে তাকায় উপরে। ততক্ষণে আবিরের দৃষ্টিও নীলিমার দিকে চলে এসেছে। মনে মনে একটা হাসি দিয়ে সিএনজিতে উঠে বসে নীলিমা। আবির দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে আবারো গল্পে মন দেয়।
দুপুর ১টা বেজে ৪৫মিনিট__
নীলিমা বাসস্টপের ছোট্ট বেঞ্চে চুপ করে বসে আছে। বাস চলে যাওয়ার হুইসেল দিচ্ছে তবুও নীলিমা টিকিট কাটেনি। বার বার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। প্রায় মিনিট দশেক পর বাস ছেড়ে দেয়। নীলিমা তখনও রাস্তার এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ২টা বেজে গেছে। মনটা কালো অন্ধকারের ন্যায় করে ওপাশে তাকাতেই দেখে আবির আসছে। মুখে হাসি ফুটে উঠে নীলিমার। তাড়াতাড়ি বেঞ্চ থেকে উঠে দাঁড়ায়।
কিন্তু একি?!!!
ওনি আমার কাছে আসছেন না কেন? এদিকে কোথায় যাচ্ছেন???
মিনিট ত্রিশেক পর হাতে একগাদা সওদা নিয়ে আবির ফিরে। এবার নিশ্চয় আমার কাছে আসবে আমায় বাসায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য? ভাব নিয়ে দাঁড়ায় নীলিমা।
কিন্তু মুহূর্তেই ‘থ’ হয়ে যায় নীলিমা যখন দেখল আবির ওকে কিছু না বলে বাজার সওদা করে আপনমনে বাসায় চলে যাচ্ছে। রাগ হয় নীলিমার কিন্তু প্রকাশ করেনি। কিছুক্ষণ বেঞ্চে বসে থেকে পা বাড়ায় বাসার দিকে। মিনিট দশেক বছর বাসায় পৌঁছে নীলিমা। দরজা খোলায় ছিল তাই কলিং বেল আর চাপতে হয়নি। ভিতরে প্রবেশ করে নীলিমা। আঁচল থেকে টাকাগুলো খুলে বিছানার নিচে রেখে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়। আবির তখন গভীর মনোযোগের সাথে রান্না করছে। কিছুক্ষণ দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নীলিমা। তারপর মুখ খুলে_
” আমি চলে যাচ্ছি…..”
আবির চুপচাপ থেকে রান্না করে চলেছে। নীলিমা আবারো বলে উঠে, আমি গ্রামের বাড়িতে চলে যাচ্ছি। আবির এবারো চুপচাপ। নীলিমা আবারো বলে উঠে, শুনতে পাচ্ছেন আমি নরসিংদী চলে যাচ্ছি। রান্না করা অবস্থায়’ই জবাব দেয় আবির, সেতো আমি দেখেই আসছি আপনি চলে যাচ্ছেন। তো ফিরে আসলেন যে? কিছু রেখে গেছেন নাকি? এত কষ্ট করে আবার আসতে গেলেন কেন? আমায় কল করে বলতেন। আমি দিয়ে আসতাম।
” কোথায় আমাকে আটকাবে তা না,
উনি আমায় চলে যেতে হেল্প করবেন।”
প্রচন্ড রাগে কাঁপতে শুরু করে নীলিমা। ফেলতে থাকে ঘনঘন নিশ্বাস। দাঁতে দাঁত চেপে আবিরকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। ফিরে যায় রুমে। এত শীতের মধ্যে ঘামছে নীলিমা। ফুলস্পিডে ফ্যানটা ছেড়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পরে। চোখ থেকে দু’ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে নীলিমার। হঠাৎ’ই অস্পষ্ট গানের স্বর ভেসে আসে। বিছানা থেকে উঠে বসে নীলিমা। মনে হচ্ছে কিচেন থেকেই শব্দটা আসছে। কিন্তু কে গায়ছে? বন্ধ করে ফেলে ফ্যানটা। নীলিমা স্পষ্ট শুনতে পায় আবির গান গাচ্ছে-
” চলে গেছো তাতে কি, নতুন একটা পেয়েছি।”
” ওহ, এই জন্য’ই বুঝি আমায় এভাবে যেতে দেয়া?”
মেজাজ বিগড়ে যায় নীলিমার। প্রচন্ড রাগে নিজের মাথার চুল নিজে’ই দু’হাত দিয়ে এলোমেলো করে ফেলে। খামচে ধরে মুখ। নিজে নিজেই নিজের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়। গালে দু’য়েক জায়গা থেকে রক্ত বের হচ্ছে আর হাতে দাঁতের দাগ বসে গেছে। রাগ তবুও কমছে না। বিছানার পাশেই ছিল আবিরের সদ্য কিনে আনা একটা ছোট্ট সুন্দর ডায়েরী। ডায়েরী কামড়ে ধরে নীলিমা। ডায়েরীর কিচ্ছু হয়নি, কিন্তু ডায়েরীর শক্ত অংশ দাঁতের মাড়িতে লাগার সাথে সাথে মাড়ি থেকে রক্ত বের হওয়া শুরু হয়। এতেও রাগ কমেনি নীলিমার। হাতের কাছে পেল বালিশ, তুলতুলে নরম সুন্দর বালিশটা নিয়ে নীলিমা বারান্দায় ঝুড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। আরেকটা বালিশ ছুঁড়ে মারে বারান্দায়, কোল বালিশটা এক ধাক্কা দিয়ে খাটের নিচে ফেলে দেয়। রাগ তাতেও কমছে না দেখে বিছানা থেকে নেমে চাঁদরটা জড়ো করে বাথরুমে পানি ভর্তি বালতি’তে ডুবিয়ে রেখে আসে, সাথে কম্বলটাও ফ্লোরে ময়লার মধ্যে ঘষে পানিতে ভিঁজিয়ে রেখে আসে। আবিরের চশমাটা ড্রেসিংটেবিলের উপর রাখা ছিল। চশমা হাতে চোখের সামনে এদিক ওদিক করে চশমার একটা গ্লাস কামড়ে ধরে নীলিমা। তেজি মেয়ের এক কামড়ে চশমার ফ্রেম ভেঙে কাঁচগুলো ঠোঁটে গিয়ে বিধে। ওহ, মাগো বলে চশমাটা হাত থেকে ফেলে ঠোঁট ধরে প্রচন্ড জোরে চিৎকার দেয় নীলিমা।
নীলিমার চিৎকার আবিরের কান অবধি বুঝতে বেশী সময় নেয়নি। কেঁপে উঠে আবিরের কলিজা। রান্না রেখে ছুটে আসে রুমে। নীলিমার এ হেন অবস্থা থেকে আবির ভড়কে গেলেও পাশে পরে থাকা ভাঙা চশমা আর রুমের অবস্থা দেখে আবির খুব শিগ্রয়ই বুঝে যায় আসল ঘটনা। একি করছ?!!!
দৌঁড়ে গিয়ে নীলিমার পাশে বসে আবির। ঠোঁট থেকে কাঁচগুলো সরিয়ে নিতেই আরো জোরে চেঁচিয়ে উঠে নীলিমা। “ওমাগো, জ্বাল।
মরে গেলাম গো, জ্বলে যাচ্ছে গো…..”
আবির ওর ময়লা হাতের দিকে তাকায়। হাতে তখনো হলুদ, মরিচের গোঁড়া লেগে আছে। দিগ্বিদিক শূন্য আবির তখনি নীলিমার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়।
[বিঃদ্র:- খুব সমস্যায় আছি, তাই তিন তিনটা দিন আপনাদের অপেক্ষা করতে হয়েছে। এজন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। তবে এখন থেকে গল্পের পর্বগুলো সকাল এবং রাত্রে দু’বার করে দিয়ে আপনাদের ক্ষতিটা পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করব। ধন্যবাদ]
আবিরের কথা শুনে দৌঁড় দিচ্ছিল নীলিমা, ধরে ফেলে আবির। একটানে কোলে তুলে নেয়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নীলিমা। দুষ্টু হেসে আবিরের প্রশ্ন-
পালাবে কোথায়?
খুব ক্লান্ত, ঘুমোতে চাই আমি। প্লিজ যেতে দিন আমায়। অনেকটা অসহায়ের মত আবিরের মুখের দিকে তাকায় নীলিমা। দুষ্টু হেসে আবিরের জবাব, ঘুম এখনি উদাও হয়ে যাবে, সাথে ক্লান্ত ভাবটাও। তাই কোনো কথা হবে না…..
“দেখুন! আপনি কিন্তু এখন বেশি বেশি করছেন। জোর করে উঠিয়ে নিয়ে আসছেন, তারউপর এখন এভাবে তেড়ে আসছেন। একবার যদি ছাড়া পাই না খুব খারাপ হয়ে যাবে। আপনার নামে মামলা করব।”
অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে আবির।
“আচ্ছা, তাই নাকি? কিসের ভিত্তিতে মামলা করবে? মানে কোন অপরাধে আমার নামে মামলা করবে?”
জবাব আসে, নারী নির্যাতন। আপনার নামে আমি নারী নির্যাতনের মামলা ককক……
হাসতে থাকে আবির। আচ্ছা, নারী নির্যাতনের মানেটা জানো তো?
রাগে কিচ্ছু বলতে পারে নি নীলিমা। দু’চোখের পাতা এক করে ফেলে। বিছানায় শুইয়ে দেয় আবির নীলিমাকে। দরজাটা বন্ধ করে রুমের লাইট’টা অফ করে দেয়। ড্রিমলাইটের মৃদু আলোয় আবির এগিয়ে যায় নীলিমার দিকে। নীলিমা তখনও চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কাছে যায় আবির। হাতটা ছুঁয়ে দেয়। কেঁপে উঠে নীলিমা কিন্তু কিচ্ছু বলেনি। বুকের কাছে নিয়ে দু’হাতে নীলিমার হাতটা মুঠোয় বন্দি করে। প্রায় মিনিট ত্রিশেক হয়ে গেল আবিরের কোনো সাড়া না পেয়ে পাশ বালিশে ফিরে তাকায় নীলিমা। চোখ যায় আবিরের মাথার দিকে। কিরকম বালিশবিহীন শুয়ে আছে। আস্তে আস্তে হাতটা ছাড়িয়ে নীলিমা ওর মাথার নিচের বালিশটা আবিরের মাথার নিচে দিয়ে দেয়। চলে যাচ্ছিল নীলিমা, পিছন থেকে হাতটা টেনে ধরে আবির।
” পালিয়ে কোথায় যাবে?”
অনেকটা রাগান্বিত কন্ঠে জবাব দেয় নীলিমা, আজব! পালাবো কেন? এ রুমে বালিশ নেই তাই ঐ রুমে যাচ্ছিলাম বা….
থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে আবির, বালিশ তো এ রুমেই আছে।
সেটা তো আপনার মাথার নিচে দিয়ে দিলাম।
মৃদু হাসে আবির- সেটা তো ছোট বালিশ। এর চেয়েও বড়সড় বালিশ কিন্তু তার উপর পড়ে আছে।
মানে?!!!
মানে সেই বড় বালিশে শুধু মাথা নয়, অনায়াসে তুলে দিতে পারবে হাত-পা’ও। এমনকি জাপটেও ধরতে পারবে। ইচ্ছে হলে চুমুও খেতে পারবে। জীবন্ত বালিশ কি না….?
রেগে যায় নীলিমা, আপনি এত খারাপ ক্যা?
হেসে দেয় আবির, তুমি এত ভালো ক্যান?
দেখুন, আপনি কিন্তু বেশী বেশী করছেন।
দেখো, তুমি কিন্তু কম কম করছ!
বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় নীলিমা। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ইয়া আল্লাহ! উঠিয়ে নিচ্ছ না কেন আমায়?
বিছানায় উঠে বসে আবির, ইয়া আল্লাহ! নিচে রাখছ কেন আমায়?
এবার কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাবে…!
এবার কিন্তু ভালো কিছু ঘটে যাবে।
উফফ! মরেই গেলাম বুঝি …..
জীবন্ত করে তোলার জন্য পাশেই রয়েছি আমি। আঙুল নাচিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল নীলিমা, একটানে বিছানায় নিয়ে যায়। হুড়হুড়িয়ে আবিরের বুকের উপর গিয়ে পরে নীলিমা। কিছুক্ষণ ঢ্যাবঢ্যাব করে আবিরের মুখের দিকে তাকিয়ে যেই ঝগড়া শুরু করতে চাচ্ছিল ওমনি আবির নীলিমাকে একটানে ওর খুব কাছে নিয়ে যায়। নীলিমার মুখ আবিরের মুখের খুব কাছে। নীলিমার খোলা চুল দুপাশে ছড়িয়ে যেন এক পর্দা তৈরি করে দিয়েছে। অনেকক্ষণ ধরে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। নীলিমার নিশ্বাস ধীরে ধীরে ঘন থেকে আরো ঘন হচ্ছে। খুব কাছ থেকে আবির নীলিমার নিশ্বাসের শব্দগুলো শুনছে। সেই নিশ্বাস আবিরকে মাতাল করে দিচ্ছে। আচমকায় উপর থেকে একটা ইঁদুর ছিটকে পড়ে। ভয়ে চিৎকার দেয় নীলিমা। জাপটে ধরে আবিরকে। দু’হাত খামচে আবিরের শার্টের কলার ধরে আছে। নীলিমার নখের আচড়ে আবিরের গলার ক্ষাণিক জায়গা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। কিছু একটা পরে আছে আমার উপর, দেখুন না প্লিজ…. আরো জোরে খামচে ধরে নীলিমা আবিরের ঘাড়। আবিরের শরীরের অনেকাংশে ক্ষত হয়ে জ্বলছে। তারপরও আবির নড়ছে না। এ যেন এক অন্যরকম সুখ। নীলিমার নিশ্বাস ক্রমে ঘন থেকে ঘনতর হচ্ছে। হাত দিয়ে নীলিমার ঘাড়ের উপর পড়ে থাকা সদ্য জন্ম নেয়া ইঁদুরের বাচ্চাটাকে পাশে টেবিলের উপর রাখে আবির। একবার শুধু সেদিকে তাকায় নীলিমা। মনে মনে ভাবে, বিচ্ছু জাতীয় কিছু নয়তো?!!!
ভয়ে জাপটে ধরে আবিরকে। প্লিজ, প্লিজ লাইটটা জ্বালান। ঐটা বিচ্ছু। প্লিজ, লাইট জ্বালান। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
মনে মনে হাসে আবির।
ওহ! ম্যাডাম তাহলে বিচ্ছুকে ভয় পায়? দাঁড়াও দেখাচ্ছি মজা…..
” নীলি! প্লিজ কথা বলো না এখন। আমার খুব ভয় করছে। তোমার ঘাড়ে একটা নয়, দুটো বিচ্ছু পরছিল। লাইট জ্বালাতে হবে না। তাড়াতাড়ি উঠো। আজকে এ রুমে থাকা নিরাপদ হবে না। আমাদের স্টাডিরুমে’ই ঘুমোতে হবে আজকে।”
লাইট না জ্বালিয়ে নীলিমাকে টানতে টানতে অন্য রুমে নিয়ে যায় আবির। তারপর লাইট জ্বালিয়ে তাড়াতাড়ি করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। বোকার মত দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা। কি করবে বুঝতে পারছে না আবার শুইতেও পারছে না। শুবে কোথায়? স্টাডি রুমের বেডটা এত ছোট যে একজনের থাকতে কষ্ট হবে। নীলিমা শুকনো এবং খাটো বিধায় ওর শুতে তেমন অসুবিধে হতো না। আজ সেই বিছানায় শুয়েছে বিশাল বড় সুঠামদেহের অধিকারী আবির।
” বুইড়ার’ই জায়গা হচ্ছে না, আমি আর কোথায় থাকব?”
লাইট’টা অফ করে চুপ করে ছোট্ট সোফার উপর পা তুলে ওড়না দিয়ে পুরো শরীর ঢেকে জড়োসড়ো হয়ে বসে নীলিমা। তখনি আবির বিছানা থেকে উঠে একটা টানে বুকে নিয়ে যায় নীলিমাকে।
কিছুক্ষণ পর-
” গলায় হাত দিবেন না একদম। কাতুকুতু লাগে আমার।”
চুপ! কোনো কথা হবে না…..
” এই অনাচার আল্লাহ সইবে না। এর বিচার একদিন ঠিক করবে আল্লাহ….”
বড্ড জ্বালাচ্ছো তুমি। দাঁড়াও তোমার মুখ আমি বন্ধ করছি। অতঃপর……..
সকালে__
বাজার থেকে কেবল পরোটা আর সবজি নিয়ে বাসায় ফিরছিল আবির। রুমে ঢুকে’তো রীতিমতো ‘থ’ হয়ে যায়। এ আমি কি দেখছি? এও কি সম্ভব? চোখ কচলায় আবির। চোখ কচলিয়ে আবারো সোফার দিকে ফিরে তাকায়-
” আবিরের পাঞ্জাবি পাজামা পরে সোফায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে নীলিমা।”
খাবার টেবিলে পরোটার প্যাকেজ রেখে চুপটি করে সোফায় নীলিমার পাশে গিয়ে বসে। চরম হাসি পাচ্ছে আবিরের কিন্তু হাসছে না। কারণ, এ অবস্থার জন্য যে আবির নিজেই দায়ী। রাত্রে একটু বেশী ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছিল কি না…!! এখন এ বাসায়ও নীলিমার কোনো কাপড় নেই। যার কারণে ওর এই বেহাল দশা….!!!
যায় হোক….
বহু কষ্টে হাসি আটকায় আবির-
” নীলি! চলো খাবে….”
—- নীলিমা নিশ্চুপ…!
—- কি হলো, চলো……(আবির)
—- নীলিমা এবারো নিশ্চুপ।
—- কি হলো? খাবে না???(আবির)
—– নীলিমা এবারো পূর্বের ন্যায় মাথা নিচু করে বসে আছে। সেটা দেখে শরীরে ধরে নাড়া দেয় আবির। প্রশ্ন করে- কি হয়েছে? এভাবে বসে আছ কেন?
তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে নীলিমা। অগ্নি চোখে আবিরের দিকে তাকায়। একদম শরীরে হাত দিবি না শয়তান, ইন্দুর, বান্দর, ফাজিল, তেলাপোকা…..
–এসব কি ভাষা বলছ? চলো, খাবে…
ওরে শয়তান! আমার কথা কি তোর কানে যায়নি? আবার কেন শরীরে হাত দিয়েছিসরে বদমাইশ?!!! আর কি জানি বলছিস, ভাষা? তোর মত লুচ্চার জন্য এসব’ই পারফেক্ট। আমার অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তুই রাত্রে আমার সাথে যা করছস তার বিচার ঐ আল্লাহ করবে……
” নীলি প্লিজ শান্ত হও।”
বাঘের মত হুংকার নেয় নীলিমা। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে বলে, আপনি আমার সামনে থেকে যান।
ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।
তোমার জন্য কাপড় কিনে আনি। ততক্ষণে তুমি ব্রেকফাস্ট’টা সেরে নাও। কথাটা বলে আবির চলে যাচ্ছিল, দরজার কাছ থেকে আবার ফিরে আসে। মুচকি হেসে বলে-
“তোমায় কিন্তু বেশ কিউট লাগছে।”
দাঁতে দাঁত চেপে অগ্নিচোখে আবিরের দিকে তাকায় নীলিমা। ভয়ে ঢোক গিলে আবির। না, মানে যাচ্ছি বলে তাড়াতাড়ি রুম থেকে কেটে পড়ে। সকাল ১১টা নাগাদ হাতে বেশ কতগুলো শপিং ব্যাগ নিয়ে বাসায় ফিরে আবির। বার কয়েক কলিং বেল চাপার পরও দরজা খুলছে না নীলিমা।
” আহারে বেচারি! পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় কে না কে দেখে ফেলে সেজন্য ভয়ে দরজাও খুলছে না।”
জোর গলায় বলে উঠে আবির- বুড়া মানুষকে আর কত দাঁড় করিয়ে রাখবা? এবার তো দরজাটা খুলো।
এবারো কোনো সাড়া নাই। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে আবারো ডাক দেয় আবির।
“নীলি! প্লিজ দরজাটা খুলো….”
সাড়া নেই এবারো। কলিং বেলে চাপ দিয়ে ডাক দেয় আবার। সাথে সাথে দরজা খুলে যায়। পুরো শপিং ব্যাগ এখনো বিছানায় রাখেনি, তার আগেই দরজার ছিটকিনি আটকানোর আওয়াজ পায়। পিছনে ফিরে তাকায় আবির। ‘থ’ হয়ে যায়। মুখ হা হয়েছে তো হয়েছে। আর বন্ধ হচ্ছে না। সেটা দেখে লজ্জায় মাথা নিচু করে জবাব দেয় নীলিমা-
” বাথরুমে গিয়েছিলাম।
পাজামার ফিতায় গিট্টু লাগছে। গিট্টু খুলতে পারিনি। ব্লেড দিয়ে কেটে ফেলেছি। আলমারির চাবি খুঁজে পাইনি। বারান্দায় এ লুঙ্গিটা পেয়েছি। তাই……..”
ঘোর কাটে আবিরের। ও মাই গড!শেষমেষ তুমি লুঙ্গি পরলে? হা, হা করে হাসতে শুরু করে আবির। হাত থেকে শপিং ব্যাগ নীলিমাকে দেখেই পড়ে গিয়েছিল, এখন আবির নিজেই পড়ে গেছে। পড়ে গিয়েও হা, হা, হু, হু করে হেসেই যাচ্ছে আবির। বিছানা থেকে ফ্লোরে পড়ে যায় আবির। ফ্লোরে পড়ে গিয়েও হাসতে থাকে। একপর্যায়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি দিয়ে হাসতে থাকে।
রাগে কান্না চলে আসছে নীলিমার। আবিরকে ফ্লোর থেকে টেনে তুলে ওর পরনের শার্টের কলার ধরে টানা শুরু করে। টানতে টানতে শার্টের বোতাম ছিড়ে ফেলেছে কয়েক জায়গায়। উন্মুক্ত হয়ে যায় আবিরের বুক। খামচে ধরে সেখানে। খামচে, খামচে বুকের বেশ কিছু জায়গা থেকে রক্তও বের করে দিয়েছে। সেদিকে আবিরের কোনো খেয়াল’ই নেই। আবির তখনো হেসেই যাচ্ছে। ধাক্কা মেরে আবিরকে বিছানায় ফেলে দেয়া হয়।আবির তখনো হেসে চলছে। এবার বিছানা থেকে উঠিয়ে কলার ধরে টানতে টানতে দরজার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। দরজা খুলে নীলিমা। তারপর এক ধাক্কা দিয়ে আবিরকে বাইরে ফেলে দেয়। বাইরে গিয়েও হাসতে থাকে আবির। হাসতে হাসতেই দরজায় টোকা দিতে থাকে-
” নীলি! প্লিজ দরজা খুলো। একটা সেল্ফি তুলব দুজনে….”
দরজায় ছিটকিনি আটকে ফ্লোর থেকে শপিং ব্যাগ গুলো তুলে বিছানায় রাখে। সবগুলো ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে। মেজাজ চরম খারাপ হয়ে যায় নীলিমার। একটা থ্রি-পিছ কিংবা লেহেঙ্গা কিচ্ছু আনেনি। যা এনেছে সব শাঁড়ি। রাগে দুঃখে দেয়ালে মাথা ঠুকতে ইচ্ছে করছে ওর। বহু কষ্টে রাগকে কন্ট্রোল করে। ৫টা শাঁড়ির মধ্যে থেকে একটা শাঁড়ি বেছে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে নীলিমা। কিছুক্ষণ পর পাঞ্জাবি লুঙ্গি পাল্টে গায়ে কোনোরকম শাঁড়ি জড়িয়ে রুমে ঢুকে। আবির তখনো দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে হাসছে আর বলছে-
” প্লিজ নীলি!
একটা, জাস্ট একটা সেল্ফি তুলবো তোমার সাথে। প্লিজ, দরজাটা খুলো।”
মুহূর্তেই দরজাটা খুলে যায়।
কিছু একটা বলতে যাবে আবির তখনি চোখ যায় নীলিমার দিকে। ‘থ’ হয়ে যায় আবির। হা করে তাকিয়ে আছে নীলিমার দিকো।
” এ আমি কি দেখছি?
এ যে স্বর্গের অপ্সরিকেও হার মানাবে।”
মনে মনে বলে উঠে, সুবহানআল্লাহ!
— দাঁতে দাঁত চেপে প্রশ্ন করে নীলিমা,
এখানে হাবার মত এভাবে দাঁড়িয়ে কেন আছেন? বের হোন রুম থেকে। স্টাডি রুমে যান। আমি এখন শাঁড়ি’টা ভালো ভাবে পরব।
—– ইয়ে না মানে টিভিতে নিউজ দেখব। কথাটা বলেই ভেঁজা বিড়ালের মত সোফায় গিয়ে বসে আবির। ভ্রু- কুচকে অনেকটা বিরক্তি নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় নীলিমা। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শাঁড়ির আঁচল ঠিক করছিল নীলিমা, এরই মাঝে চুরের মত বার কয়েক সেদিকে তাকিয়ে ফেলেছে আবির। দৃষ্টি এড়ায় না নীলিমার। প্রথম কয়েকবার পাত্তা দিলেও একসময় তেড়ে যায় আবিরের দিকে।
” আপনি যে শিক্ষকতার পাশাপাশি লুচু কোম্পানির ম্যানেজার পদে আছেন সেটা কি আপনার কলেজে জানে?”
—- What???(আবির)
বার বার এভাবে চুরের মত আমার দিকে কেন তাকাচ্ছেন?(নীলিমা)
জবাব আসে, তোমাকে নয় আমি তো আয়না দেখছিলাম…..
পাল্টা জবাব নীলিমার- আর সেই আয়নার ভিতর আপনাকে না, আমাকে দেখা যাচ্ছিল।
কি সাংঘাতিক! আমি তোমার দিকে তাকাবো কেন?(আবির)
নীলিমার জটপট উত্তর, কারণ আপনি লুচ্চা….
ধমক দেয় আবির, কিসব আজেবাজে বকে যাচ্ছ সকাল থেকে। এসব কি ধরনের ভাষা? একজন শিক্ষিত, ভদ্র মানুষ হয়ে এসব ভাষা বলো কি করে?
চুপসে যায় নীলিমা। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে সে স্থানেই। ভ্রু-কুঁচকে রুম ত্যাগ করে আবির।
রুম থেকে বের হয়ে সোজা ছাদে চলে যায় আবির। তখনি ওর ফোনে শ্বশুর বাড়ি অর্থাৎ নীলিমার গ্রামের বাড়ি থেকে কল আসে। রিসিভ করে আবির-
লিমা- আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।
আবির:- ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছে আমার বোনটা?(শ্যালিকা)
লিমা- ভালো নেই ভাইয়া….
আবির:- কেন? কি হয়েছে?
লিমা- মায়ের শরীর’টা খুব খারাপ। অচেতন হয়ে বিছানায় পরে আছে। বার বার আপুর নাম নিচ্ছে। আপুকে ফোন দিয়ে বলছিলাম মা কথা বলবে, না শুনেই কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে রেখেছে। প্লিজ, ভাইয়া একটা বার আপুকে বুঝিয়ে নিয়ে আসুন না। মা খুব খুশি হবে।
আবির:- কিন্তু ও কি আসবে?
লিমা- হ্যা, আসবে ভাইয়া। আপনি শুধু ওকে একটু ভালো করে বুঝিয়ে বলবেন মা ওর….(….)…..???
আবির:- লিমা আমি তোমার সাথে পরে কথা বলছি। রাখি এখন…
পুরো কথা বলতে পারেনি লিমা, তার আগেই কল কেটে দেয় আবির। কারণ, ছাদে দাঁড়িয়ে ও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে নীলিমা নিচে দাঁড়িয়ে চলন্ত সিএনজি থামানোর চেষ্টা করছে। তার মানে ও বাড়ি থেকে পালাতে চাচ্ছে। দৌঁড়ে নিচে নামে আবির। ততক্ষণে একটা সিএনজিকে দাঁড় করিয়ে ফেলছে নীলিমা। আবির হাত ইশারায় পিছন থেকে সিএনজি ড্রাইভারকে চলে যেতে বলে। সিএনজি চলে যায়। উফ, চলে গেল বলে পিছনে তাকাতেই চমকে উঠে আবির। আআআআপনি….?!!!
– জ্বি, আমি। এভাবে পালিয়ে আমার থেকে পাড় পেয়ে যাবে ভাবছ?(আবির)
-………. (নীলিমা)
– এত সহজে তোমার নিস্তার নেয়ার। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আমার কাছ থেকে তোমায় কেউ আলাদা করতে পারবে না। সো, বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। চলো…..
আবির নীলিমার হাত ধরে টান দেয় আবির। হ্যাচকা টানে সে হাত ছাড়িয়ে নেয় নীলিমা। ভ্রু-কুঁচকে ফিরে তাকায় আবির।
” কি হলো? কথা কি কানে যাচ্ছে না? ভিতরে চলো। ”
আমি যাব না। কিছুতেই যাব না। যায় হোক, আজ আর আপনি আমায় জোর করে নিয়ে যেতে পারবেন না। ভুলে যাবেন না কালকে রাত ছিল বিধায় আমি নিরুপায় ছিলাম। কিন্তু এখন দিন। এখন আপনি আরেকবার জোর করেই দেখেন না, চিল্লিয়ে মানুষ জড়ো করে ফেলব। আপনার ইজ্জতের বারোটা বাজিয়ে দিব।
আচ্ছা, তাই নাকি? দেখা যাক কি করতে পারো। আবির নীলিমাকে কোলে তুলে নেয়। নীলিমা চিৎকার করতে থাকে কিন্তু কেউ আসছে না। দুর থেকে যারা দেখেছে তারা হাসছে। কারণ, ওরা আবিরকে শিক্ষক এবং একাধারে বাড়িওয়ালার পুত্র বলে খুব ভালো করেই জানে। সেই হিসেবে নীলিমাকেও ওরা বেশ চিনে। আবির কোলে করেই নীলিমাকে রুমে নিয়ে যায়। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তার পাশে বসে। রাগে থরথর করে কাঁপছে নীলিমা, কিচ্ছু বলতে পারছে না।
নীলিমার পাশে বসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে অনেকক্ষণ বুঝিয়েছে আবির, কৃতকর্মের জন্য ক্ষমাও চেয়েছে। বাথরুমের ডাক পড়ে আবিরের। অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে বাথরুমে যায়। এবারো দরজা খুলে দু’লাফে রুম থেকে বেরিয়ে যায় নীলিমা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে আসে আবির। আবারো পালিয়েছে?!!!
মেজাজ প্রচন্ড বিগড়ে যায় আবিরের। বারান্দায় গিয়ে দেখতে পায় নিচে কিচ্ছু না পেয়ে হাঁটা শুরু করেছে নীলিমা। দৌঁড়ে নামে আবির। নীলিমাকে ডাক দেয়, শুনেনি সে। এবার না ডেকে দৌঁড় দিয়ে নীলিমাকে ধরে।
” থাপ্পর খাওয়া হয় না অনেকদিন ধরে, তাই না?”
আবির শক্ত হাতে নীলিমাকে ধরে রাখে। নীলিমা সেই হাত মুচড়াতে থাকে। ছাড়াতে পারছে না। হঠাৎ’ই একটা রিক্সা পাশ কাটিয়ে চলে যায়। পিছন থেকে চেঁচিয়ে উঠে নীলিমা, স্যার! প্লিজ দাঁড়ান। এই বখাটে আমায় নিয়ে যাচ্ছে। রিক্সায় বসে থাকা যাত্রীটা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায় সাথে রিক্সাওয়ালাও। সেদিকে তাকিয়ে হাত ছেড়ে দেয় আবির। একদৌঁড়ে নীলিমা রিক্সায় অচেনা ভদ্রলোকের পাশে গিয়ে বসে। রিক্সা চলছে। ভদ্রলোকটি ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পিছনে তো আরেকবার নীলিমার দিকে তাকাচ্ছে__
” উফ! ভাগ্যিস বুদ্ধি খাটিয়ে লোকটাকে স্যার ডাকলাম……”
হঠাৎ’ই পাশ থেকে ভদ্রলোকটির প্রশ্ন,
” তোমাকে মনে হয় আমি দেখেছি কিন্তু খেয়াল নেই। আচ্ছা তুমি কোন ব্যাচের?”
জিহ্বায় কামড় দেয় নীলিমা, খাইছেরে! এতো দেখছি সত্যি সত্যি শিক্ষক। জোর করে মুখে হাসির রেখা টানে নীলিমা। হেসে বলে আমি অমুক কলেজের ২০** সালের ব্যাচের স্টুডেন্ট ছিলাম। আপনি আমাকে চিনবেন না স্যার। ক্ষণিক হাসে ভদ্রলোকটি। সানগ্লাস’টা চোখ থেকে নামিয়ে পরিষ্কার করে পরে নেয়। নীলিমা সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
” তুমি সিউর ঐ লোকটা লোকটা তোমাকে ডিস্টার্ব করে?”
ঢোক গিলে নীলিমা। মনে মনে ভদ্রলোকের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলেছে ছেলেকে শিক্ষক বানানোর জন্য।
“কি হলো? বলো….”
বুকে সাহস সঞ্চয় করে নীলিমা, হ্যা! ওনি শুধু আজ নয় আমায় রোজ ডিস্টার্ব করে। আমায় উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয়। মাঝেমাঝে তো হাতও ধরে ফেলে।
নীলিমার কথা শুনে মিনিট খানেক নীলিমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন লোকটা। তারপর হঠাৎ’ই রিক্সা থামায়-
” ভাই একটু দাঁড়াও তো আমি একটু ফোন করে নেই। আমাদের কলেজের মেয়েকে ডিস্টার্ব করা ব্যাটার সাহস কত….!!!”
পকেট থেকে ফোন বের করে ভদ্র লোকটি নীলিমার দিকে ফিরে তাকায়। নীলিমা আমতাআমতা করে বলে, আআআআআমাদের কলেজ???
জবাব আসে, হু! আমাদের কলেজ। ঢাকা *** কলেজের স্টুডেন্ট না তুমি?
অচেনা শিক্ষকের মুখে নিজ কলেজের নাম শুনে গলা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম নীলিমার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলায়। কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে, আপনি আমায় চিনেন?
হেসে দেয় লোকটি। কি যে বলো না। কলেজের সেরা স্টুডেন্ট নীলিমা একাধারে এম.বি.বি.এস’কে কে না চিনে? প্রসপেক্টাসে তোমার ছবি আমি বহুবার দেখেছি, তুমি আমায় চিনবে না। আমি কলেজে জয়েন করেছি তুমি আসার পর।
ইয়া আল্লাহ! তাহলে তো ইনি আবিরকে চিনে ফেলছে। আর ঘাড় ঘুরিয়ে সেই জন্য’ই বার বার পিছনে তাকাচ্ছিল। আচমকা রিক্সা থেকে নেমে দাঁড়ায় নীলিমা। মনে মনে, নীলিমা তুই কেটে পর।
রিক্সাওয়ালাকে ভাড়া মিটাতে গিয়ে ধরা খায় নীলিমা। এইরে! আমার কাছে তো টাকা নেই। স্যার মানে ভদ্রলোকটার দিকে দিকে করুণ চোখে তাকায় নীলিমা। ভদ্রলোকটা তখন মেসেজ চালাচালিতে ব্যস্ত। উফ! কি করব আমি….!!!
কি হলো ভাই? দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো। আমার এমনিতেও দেরী হয়ে গেছে।
” আপা তো ভাড়া দিচ্ছে না যাব কিভাবে?”
নীলিমার দিকে তাকিয়ে একটা রহস্যজনক হাসি দেয় ভদ্র লোকটা। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলে, ও আমার ছাত্রী। দাঁড়াও ওর ভাড়া আমি দিয়ে দিচ্ছি। এটা বলে মানিব্যাগ বের করে ভদ্রলোক। উফ! মানিব্যাগে তো ভাংতি নেই।
পাশ থেকে রিক্সাওয়ালা, আমার কাছে এত টাকার ভাংতি হবে না।
অসহায়ের মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে নীলিমা। কি করবে বুঝতে পারছে না। পিছন থেকে কাধে হাত রাখে কেউ –
” খেলে তো ধরা সবদিক থেকে?!!!”
চলবে……
[বি:দ্র:- আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত বন্ধুরা রাত্রে হঠাৎ’টি অসুস্থ হয়ে পরেছিলাম, তাই এফবিতে আসতে পারিনি। আর কথামতো গল্পটাও দিতে পারিনি।]
কথাটা বলে হু, হু করে হেসে উঠে আদিত্যর বাবা। তার সাথে সাথে হেসে উঠে আদিত্যর দাদা-দাদী, হেসে উঠে আদিত্যর ছোট কাকা ও তার স্ত্রী। মোটামুটি সবার মুখেই হাসি, শুধু হাসি নেই আদিবার মুখে। ভাই আবির যে এমন কান্ড করবে সেটা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। অথচ তাই হয়ে গেল, শেষমেষ বউ চুরি করে নিয়ে গেল। লজ্জায় কুঁকড়ে যায় আদিবা কিন্তু হেরে যেতে রাজি নন। দৌঁড়ে বাড়ির পিছনে জাম গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়ান। ততক্ষণে আবির নীলিমাকে কোলে নিয়ে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির কাছে চলে গেছে। আদিবা একদৌঁড়ে গাড়ির কাছে যায়। আবির ততক্ষণে গাড়ির ভিতরে বসিয়ে দিয়েছে নীলিমাকে।
” ঐ বদমাইশ! তুই বউরে নিয়া কই যাস? নীলিমা বেরিয়ে আসো।”
গাড়ির ভিতরে হাত দিয়ে আবিরের বোন আদিবা নীলিমাকে টানছে কিন্তু নীলিমার কোনো সাড়া নেই। সাড়া দিবে কিভাবে? পিছন থেকে হঠাৎ মুখ বেধে ফেলা, তারপর আচমকা পিছনে তাকিয়ে আবিরের গায়ের সাদা গেঞ্জিতে কঙ্কাল এবং তার সাথে লাল জিহ্বার ছাপ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল নীলিমা। যদিও ভূত-প্রেতে ওর বিশ্বাস নেই কিন্তু গত পরশুদিন দুপুরে পুকুরপাড়ে ঘুরতে গিয়ে এক অচেনা যুবকের ঝুলন্ত ভয়ানক লাশ দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আজ তাই মুখ বাধার পর আবিরের গেঞ্জির কঙ্কাল এবং লাল জিহ্বার ছাপ দেখে ভয় পেয়ে জ্ঞান হারায়। আদিবা যখন নীলিমাকে ধরে টানাটানি করছিল, তখন পিছন থেকে আদিত্যর বাবা এসে স্ত্রীকে জোর করে সরিয়ে নিয়ে যায়। যাওয়ার আগে শ্যালক আবিরের উদ্দেশ্যে বলে-
” ওরে গাধা! তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দে।”
আবির গাড়িতে উঠে তাড়াতাড়ি গাড়ি স্টার্ট দেয়। বোনের শ্বশুরবাড়ি থেকে বেশ ক্ষাণিকটা দুরে গিয়ে গাড়ি থামায়। বোতল থেকে পানি নিয়ে নীলিমার চোখে মুখে ছিটিয়ে দেয়। জ্ঞান ফিরে নীলিমার। আবিরের দিকে একবার তাকিয়ে গেঞ্জির দিকে তাকায় সে। তারপর’ই কেমন ঢোক গিলে। মূল কাহিনী বুঝতে পারে আবির। শরীর থেকে গেঞ্জিটা খুলে ফেলে আবির। গাড়ি পুনরায় স্টার্ট দিবে আবির, তখনি একটান দিয়ে মুখ থেকে বাধনটা খুলে ফেলে নীলিমা। এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারে এখনো তেমন রাত হয়নি। গ্রামের বাজারে টং দোকানে তখনো মানুষজন বসে চা খাচ্ছিল। তারমানে আমি এখন চিৎকার দিলে মানুষ আসবে!
আবিরের দিকে একবার তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠে নীলিমা,
কেউ আছেন….!!!
পানি খাচ্ছিল আবির। মুখ থেকে পানি ছিটকে পরে যায়। মুখ চেপে ধরে নীলিমার-
” চুপ! একদম চুপ!”
বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে নীলিমা। আবির তখনো মুখটা চেপে ধরে আছে। নীলিমা কথা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হাতটা সরিয়ে নেয় আবির। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে নীলিমা। গাড়ি স্টার্ট দেয় আবির। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। কিছুক্ষণ পর মুখ খুলে নীলিমা-
” আমায় নামিয়ে দেন নতুবা আমি লোক ডাকব।”
গাড়ি থামায় আবির,
নীলিমাকে অবাক করে দিয়ে চেঁচাতে থাকে আবির-
” বাঁচান! বাঁচান! হেল্প! হেল্প! এক বদমাইশ আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ, হেল্প মি।”
চোখ বড় বড় করে তাকায় নীলিমা।
একটা শয়তান মার্কা হাসি দিয়ে বলে,
কি হলো? লোক ডাকো। আমি তো শুরু করে দিলাম….. রাগে দুঃখে দাঁতে দাঁত চেপে অন্য দিকে মুখ করে তাকায় নীলিমা। জয়ের হাসি হেসে গাড়ি চালাতে শুরু করে আবির। মাঝ রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ’রা আবিরের গাড়ি থামায়। সামনে আরো অনেক গাড়ি, সিরিয়ালের সবচেয়ে শেষে আবিরের গাড়িটা। ঘন্টা দু’য়েক যে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে সেটা আবির বেশ বুঝতে পারছে। এদিকে চারিদিকে যেন বরফ পরছে। গাড়ির কাঁচ ভেঙে মনে হচ্ছে সেগুলো ভেতরে চলে আসবে। নীলিমার গায়ে শীতের চাদর ছিল বিধায় দিব্যি বসে আছে কিন্তু বেচারা আবির? শীতে ওর যায় যায় অবস্থা….
শীতে দু’হাত একসাথে করে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। প্রচন্ড শীতে কুকড়ে যাচ্ছে আবির। একবার হাতে হাত ঘষাচ্ছে তো আরেকবার পাশে রাখা ঐ হাতাকাটা গেঞ্জি দিয়ে শরীর ঢাকার চেষ্টা করছে। পাশ থেকে অফার করে নীলিমা।
” এটা নিন।”
ফিরে তাকায় আবির। তারপর চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলে-
” চাদর তো একটা। এটা নিয়ে নিলে তুমি কি গায়ে দিবে?”
মাথা নিচু করে জবাব দেয় নীলিমা, আমার আসলে তেমন শীত করছে না এখন। আপনি গায়ে দিন।
জবাব দেয় আবির-
” চাদরটা নিতে পারি এক শর্তে…”
জিজ্ঞাসো দৃষ্টিতে চোখ তুলে তাকায় নীলিমা। ক্ষাণিক মাথা চুলকিয়ে আবির বলে- না মানে তুমি যদি আমার সাথে চাদরের নিচে আসো,
তবেই আমি তোমার চাদর নিব।
” Impossible….!”
কথাটা বলেই অন্যদিকে মুখ করে বাইরে তাকায় নীলিমা। আবিরও আর কিছু বলেনি। শুধু জড়োসড়ো বসে আছে। কেটে যায় মিনিট দশেক। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসে নীলিমা। এদিকে রাত যত বাড়ছে শীতের প্রকোপটাও ততই বাড়ছে। শীতের দাপটে দাঁতে দাঁত লেগে আসে আবির।
প্রচন্ড শীতের যন্ত্রনায় “উহ” করে উঠে আবির। পাশ থেকে একটু একটু করে এগিয়ে আসে নীলিমা। আসতে আসতে আবিরের একদম কাছে চলে আসছে। সেটা দেখেও আবির না দেখার ভান করে বিপরীতমুখী তাকিয়ে আছে। গায়ের চাঁদর’টা নিজহাতে আবিরের শরীরে জড়িয়ে দিয়ে তার ভিতরে গিয়ে চুপটি করে বসে। নড়ে বসে আবির। ঠোঁটে মৃদু হাসির রেখা ফুটে উঠে। জাপটে ধরে নীলিমাকে। আবিরের ঠান্ডা হাতের ছোঁয়ায় শিহরিত হয়ে উঠে নীলিমা। কিন্তু মুখে কোনো রাগ দেখায়নি। কারন, রাগ দেখালে আবির যদি চাঁদরের নিচ থেকে বেরিয়ে যায় তাই। এদিকে আবির?!
এক হাতে নীলিমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আরেক হাত দিয়ে নীলিমার মুখের উপর সরিয়ে ছিটিয়ে থাকা চুলগুলো কানের পাশে গুজে দেয়। তারপর মুখটা নীলিমার ঘাড়ের কাছে নিয়ে যায়। নাক ডুবিয়ে দেয় নীলিমার ঘাড়ে। কেঁপে উঠে নীলিমা কিন্তু সরে যায় নি। আবির যেন সেই সুযোগের’ই সদ্ব্যবহার করছে। ঘাড় থেকে মুখটা সরিয়ে নেয় আবির। একটানে নীলিমাকে ওর দিকে ফিরিয়ে নেয়। নীলিমার গালের পাশে আবির ওর আঙুল দ্বারা ভালোবাসার রেখা টেনে দিচ্ছে, শিহরিত নীলিমা পরম সুখে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। নীলিমাকে কাছে টানে আবির। কপালে ভালোবাসার উষ্ণ পরশ এঁকে দেয়। চোখ খুলে আবিরের দিকে তাকায় নীলিমা। একটা হাসি দিয়ে বুকে টেনে নেয়।
গাড়িতে জোরে জোরে টোকা দেয়া হচ্ছিল বাহির থেকে। ঘোর কাটে নীলিমার। আবিরের থেকে ক্ষাণিকটা দুরে সরে মাথা নিচু করে রাখে। চেঁচিয়ে উঠে গাড়ি থেকে মাথা বের করে আবির-
” ও ভাই! কি শুরু করছেন? শান্তি মতো একটু রোমাঞ্চও করতে দিবেন না নাকি?”
কথাটা বলে পুলিশের দিকে তাকাতেই চমকে যায় আবির, আরে সজিব? তুই?
আবিরও মতো বন্ধু সজিবও চমকে উঠে প্রশ্ন করে-
” আরে আবির না? কেমন আছিস? আর তুই এত রাত্রে এখানে?”
পুরো ঘটনা সংক্ষেপে সজিবকে জানায় আবির। নীলিমার সাথে কথা বলার জন্য গাড়ির ভিতরে তাকায় সজিব_
” আরে ভাবি?! কি করছেন? ঠোঁটে কি চুইংগাম লাগছে নাকি? এভাবে ঘষাচ্ছেন কেন?”
প্রচন্ড রাগে আবিরের দিকে তাকিয়ে কেঁদে দেয় নীলিমা। সজিব ঘটনা কি বুঝার জন্য আবিরের দিকে তাকায়। আবির ইঙ্গিতে ওর ঠোঁটে হাত দিয়ে চোখ টিপ মারে সজিবকে। বিষম খায় সজিব। হাসি আটকিয়ে বলে- আসলে খবর পেয়েছি এ এলাকা থেকে মাদকদ্রব্য চালান হয়। তাই এভাবে জেরা করা আর কি….
আচ্ছা তুই ভিতরে গিয়ে বস। আমি ওদের গিয়ে বলছি তোকে তাড়াতাড়ি দেখে ছেড়ে দেয়ার জন্য।
সমস্ত ঝামেলা কাটিয়ে রাত্রি আড়াইটার দিকে বাসায় গিয়ে পৌঁছে আবির।
আহ! ফ্রেস হয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে ক্লান্ত দেহটা বিছানায় এলিয়ে দেয় নীলিমা। এদিকে আবির?
ওর দুলাভাইকে ফোন করে বাসায় আসার কথা জানিয়ে রুমে প্রবেশ করে। রুমে এসে নীলিমাকে না দেখে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। স্টাডিরুমে কেবল শুয়েছিল নীলিমা। দরজা ঠেলে ভেতরে গিয়ে একটানে নীলিমাকে উঠিয়ে দেয়। চোখ বড় বড় করে তাকায় নীলিমা। কোনো কথা না বলে টানতে টানতে আবির নীলিমাকে ওর রুমে নিয়ে যায়। হাতটা ছাড়িয়ে ‘আমি ঘুমাবো’ এটা বলে চলে যাচ্ছিল নীলিমা। পিছন থেকে ওড়নায় টান দিয়ে ধরে আবির। একহাতে গলার কাছে চলে আসা ওড়নার মাথায় ধরে বিপরীতমুখী হয়েই প্রশ্ন করে নীলিমা-
” কি করছেন এসব?”
উত্তর আসে, করিনি তবে করব।
ঢোক গিলে নিচু গলায় নীলিমা বলে, ছাড়ুন! আমি ঘুমাবো…..
অনেক ঘুমিয়েছ আর নয়, আবির নীলিমার ওড়না ধরে টানতে টানতে কাছে নিয়ে আসে। কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে নীলিমা, কেন এমন করছেন? কেন এভাবে আমায় জ্বালাচ্ছেন?
জবাব আসে,
অন্যের বাচ্চা নিয়ে আর যাতে তারা গুনতে না হয় সেই জন্য এমন করছি। তোমায় জ্বালানোর জন্য আরো একজন সদস্য আনার প্রয়োজন বোধ করছি আমি।
আবিরের কথা শুনে দৌঁড় দিচ্ছিল নীলিমা, ধরে ফেলে আবির। একটানে কোলে তোলে নেয়। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে নীলিমা। দুষ্টু হেসে আবিরের প্রশ্ন, পালাবে কোথায়?