Tuesday, July 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1095



লবঙ্গ লতিকা পর্ব-০৫

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ৫

তীব্র ক্লান্তি আর মাথা ব্যাথা নিয়ে শোয়া থেকে উঠলো সাদ। মাথার একটা পাশ ফুলে আলু হয়ে গিয়েছে। সাদ উঠে বসতেই সাদের ঘরে অবস্থানকৃত কয়েকজনের হাসি আওয়াজ শুনতে পেল সাদ। সাদ মাথা চেপে ধরে বিরক্তি নিয়েই বিছানা থেকে উঠে বসলো।

সাদকে উঠে বসতে দেখে নাদিয়া ছুটে এসে ছাঁদে সামনে বসলো। নাদিয়া সাদের চাচাতো বোন।সাদের ছোট চাচার মেয়েই নাদিয়া।নাদিয়া সাদের থেকে চার বছরের ছোট।

সাদের পাশে বসে নাদিয়া জোরে জোরে হাসতে হাসতে সাদকে বললো,” তুমি না কি চুরি করতে গিয়ে ধরা খেয়েছো ভাইয়া? দেখো মেরে তোমার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।”

নাদিয়া এটুকু বলেই মুখে হাত চেপে ধরে জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো। সাদ এক প্রকার বিপাকে পরে গেল।কী একটা অবস্থা! বাড়িতে জানাজানি হলে আর রক্ষা নেই। কী করবে ভেবে পেল না সাদ। এদিকে নাদিয়ার হাসির মাত্রা বেড়েই চলেছে। সাদ জোরে শোরে নাদিয়াকে একটা ধমক দিলো। নাদিয়া সাদের ধমক খেয়ে ক্ষনিকের জন্য শান্ত হলো। কিন্তু আবারও বকবক শুরু করলো। সাদ বিরক্তি মাখা মুখ নিয়ে আশেপাশে ফিরে তাকালো। মাথা ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ মাথায় হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছে।

আঙুর বালা খুড়িয়ে খুড়িয়ে সাদের কাছে এসে বসলেন। সাদ পেছন ঘুরে একবার আঙুর বালার মুখের দিকে তাকালো। আঙুর বালা সাদকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে হেসে ফেললেন। সাদ ক্যাবলা কান্তের মতো আঙুর বালার দিকে তাকালো। আঙুর বালা নিজের মতো হেসেই চলেছেন। এমন সময় সাদের সঙ্গে কথা বলতে অনিতা সাদের ঘরে প্রবেশ করলো। অনিতা সাদের ঘরে ঢোকা মাত্রই আঙুর বালা অনিতাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”ছেলেরে তোমরা বিয়া করাইতে চাও না। বিয়ার কথা শুইনা তোমাগো এত আপত্তি। তোমার পোলা তো রাইতের আন্ধারেও বউয়ের লগে দেহা করবার যায়। তোমরা তাও কইবা তোমগো পোলা বিয়া করবার চায় না। আসলে কও তোমরা বিয়া দিবার চাও না। নয় এমন বিয়া পাগল পোলা কইবো? আমি বিয়া করমু না? বউয়ের লাইগা কত আদর কত সোহাগ! বউয়ের লগে দ্যাহা করতে গিয়া চোর অপবাদ হুইনা মাথা ফাডাইয়া আইসে। তাও কইবা তোমার পোলা বিয়া করবার চায় না?”

অনিতা আঙুর বালার কথা শুনে সাদের দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন। সাদ লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেললো। আঙুর বালা মুখ টিপে মুচকি হাসতে অনিতাকে বললেন,” হুনো বউ, পোলাডারে আর কিছু কইয়ো না। বাইরের মাইনষের লগে তো আর দ্যাহা করতে যায় নাই। নিজের বউয়ের লগেই দ্যাহা করতে গেসে। আর পোলাডারে বইকো না। ”

আঙুর বালা এটুকু বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। আঙুর বালা সেখান থেকে চলে যেতেই, অনিতা সাদের সামনে বরাবর গিয়ে বসলো। সাদকে গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,” তুমি এত রাতে বাইরে গিয়েছিলে কেন? তাও আবার ওদেরই বাড়িতে! এত সাহস পেলে কোথায়? তোমাকে নিয়ে কত হাসাহাসি হচ্ছে জানো তুমি? কী বলবে লোকে? বিয়ের আগেই এই অবস্থা! বিয়ের পরে আমাকে আর চিনবেই না বোঝা যাচ্ছে! এত কষ্ট করে খাইয়ে, পরিয়ে মানুষ করলাম। এখন এইদিন ও দেখতে হচ্ছে! ”

সাদ আমতা আমতা করে বললো,”আম্মু তুমি তো জানো, ওদের বাড়ি ওই রাস্তার মোড়ের ওদিকে। কালকে রাতে তো কারেন্ট ছিল না। আমি গরমে সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম৷ বাড়ি থেকে হাঁটতে বের হয়েছিলাম। মোড়ের ওদিকে হাঁটাহাটির সময় কে যেন চোর বলে চিৎকার করলো। আর কে যেন আমাকে এসে মারলো। আমি জানতাম না এতকিছু। জানলে তো কখনোই যেতাম না।”

সাদ সত্য মিথ্যা মিলিয়ে যেটুকু পারলো বললো। সত্য কথা বললে কেউই কথা শোনাতে ছাড়তো না। অনিতা গাঢ় নিশ্বাস ফেলে সাদের ঘর থেকে প্রস্থান করলো। এদিকে সাদ জ্বলছে তীব্র প্রতিশোধের আগুনে। যেভাবেই হোক আজ তমাকে শায়েস্তা করতেই হবে! মেয়েটা অনেক ফাজি/ল! কাল শুধু শুধুই এতগুলো মার খাওয়ালো।

সাদ বহুক্ষন ভেবে ভেবে ফন্দি আঁটলো। বিকালে তমা আর তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা বাইরে টইটই করতে বের হয়। তখনই বেশ ভালো মতো তমাকে ধরবে। একেবারে ছাঁই দিয়ে ধরবে। যেন পালাতে না পারে।

প্ল্যান অনুসারে সাদ বিকেল বেলা বাড়ি থেকে বের হলো। শরীর খুব খারাপ সাদের। কিন্তু, তবুও সাদ আজকে বাড়ি থেকে বের হয়েছে। কারণ, তমার একটা শাস্তি প্রাপ্য। শুধু শুধু এতগুলো মার কেন খাওয়ালো সাদকে? ছোট্ট একটা বিষয় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা কী ঠিক?

সাদ হাঁটাহাটি করছে আর বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। আসলে গোপনে গোপনে সাদ তমাকে খুঁজছে। তমা এই সময়টায় সাঙ্গ পাঙ্গ নিয়ে ঘুরতে বের হয়। সাদ অনেকটা সময় অপেক্ষা করলো। কিছুক্ষন পর দেখলো তমা সহ তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা এদিকেই হাঁটতে হাঁটতে আসছে। তমা হাতে জুতোজোড়া নিয়ে খালি পায়ে হাঁটছে।

তমা সাদকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলো। সাদ তমাকে দেখে পেছন থেকে ডেকে বললো,”এই মেয়ে দাঁড়াও। ”

তমা তবুও দাঁড়ালো না। নিজের মতো পথ চলতে শুরু করলো। সাদ তমার দিকে দৌড়ে গিয়ে তমাকে বললো,” এই মেয়ে তোমাকে বলেছি না দাঁড়াতে? এতবার ডাকলাম তবুও সাড়া দিলে না কেন?”

তমা ভ্রু কুঁচকে বললো, “কেন আমার সঙ্গে এত কীসের দরকার? এত দরদ উঁতলে উঠলো হঠাৎ আমার জন্য? ”

সাদ তমার কোনো প্রশ্নের উত্তর দিলো না। নিজেই তমাকে প্রশ্ন করলো,” কাল আমার সঙ্গে এমন কেন করলে?”

তমা হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো,” কী করেছি আবার?”

সাদ নিজের কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,” কী করেছো মানে? কালকে আমাকে এতবড় অপবাদ কেন দিলে? আমি না কি চোর? এই! আমি তোমাদের বাড়িতে চুরি করতে গিয়েছিলাম না কি!”

তমা সাদের দিকে এক হাত এগিয়ে গিয়ে বললো,” চোর কী চোর বলবো না তো কী বলবো? ফাটা ফুচকা!”

সাদ অবাক হয়ে তমাকে বললো,” ফাটা ফুচকা কী জিনিস? ”

তমা হেসে বললো,” আয়নায় নিজেকে গিয়ে দেখুন। তারপর বলবেন ফাটা ফুচকা কী জিনিস। মাথা ফাটিয়ে পুরো ফাটা ফুচকা সেজে এখন বলছে ফাটা ফুচকা কী! হুহ! নাটকের শেষ নেই। ”

সাদ এত তীব্র অপমান মেনে নিতে পারলো না। তমার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,” বেশি বাড় বেড়ো না! খারাপ হবে কিন্তু! ”

তমা সাদকে কিছু বলার আগেই;তমার সমবয়সী আরেকট মেয়েকে তমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,” এই ছেলেটার নাম কীরে তমা?”

সাদ শার্টের কলার ঠিক করে বললো, “আমার নাম সাদ।”

মেয়েটি হঠাৎ জোরে হেসে ফেললো। অবাক হয়ে বললো,”পাদ? পাদ আবার কারো নাম হয় না কি?”

মেয়েটার কথা শুনে তমাও হেসে ফেললো। সাদ চিৎকার করে বললো,” আমার নাম সাদ।”

মেয়েটি সাদকে ব্যঙ্গ করে বললো,”সাদের নাম পাদ।”

সাদ এবার জিদ করে অন্য দিকে হাঁটা শুরু করলো। এই গ্রামের ছেলেমেয়ে গুলো বহুত বজ্জা/ত। এদের সাথে কথা বলা মানেই সময় নষ্ট। সাদ নিজের মতো এগিয়ে যেতে শুরু করলো। হঠাৎ পেছন থেকে স্লোগানের মতো কিছু একটা শুনতে পেয়ে ফিরে তাকালো। দেখলো তমা-সহ তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা সাদের দিকে আঙুল দিয়ে সমস্বরে জোরে জোরে বলছে” সাদ! দেয় খালি পাদ! সাদের নাম পাদ! সাদ দেয় খালি পাদ।”

সাদ সেখানেই মাথায় হাত দিয়ে বসে পরলো। কী একটা অবস্থা! রাস্তার মানুষ সব সাদের দিকো তাকিয়ে হাসাহাসি করছে। সাদ বিপদ বুঝতে পেরে জোরেশোরে দৌড় দিয়ে পালালো। পেছন থেকে হালকা-ভাবে আবারও শুনতে পেল “সাদ! দেয় খালি পাদ!”

চলবে…

লবঙ্গ লতিকা পর্ব-০৪

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ৪

গ্রামে বেড়াতে আসলে একটা জিনিস সবচেয়ে বিরক্ত লাগে সাদের। সন্ধ্যা হয়ে গেলেই সব একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এরমধ্যে আবার আজকে কারেন্ট চলে গেছে। গরমে অতিষ্ঠ সাদ! একে তো গরম এরমধ্যে সব অন্ধকার। বিরক্ত হয়ে ফোনটা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল সাদ। আর ভালো লাগে না! কবে যে বিয়েটা শেষ হবে। তাহলে অন্তত নিজের বাড়িতে গিয়ে একটা শান্তির ঘুম ঘুমানো যাবে।

সাদ ফোনের ফ্ল্যাশলাইট অন করে হাঁটতে শুরু করলো। কেমন একটা ঝিঁঝি আওয়াজ চারপাশে। হয়তো ঝিঁঝি পোকারই আওয়াজ হবে।

সাদ নিরব কবির ন্যায় পথ চলতে শুরু করলো। মাঝে রাস্তায় বেশ কয়েকজনকে টর্চ লাইট নিয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখেছে। অনেকেই রাতে ছিপ দিয়ে মাছ ধরে। রাতে মাছ ওঠেও ভালো। সাদ অজানা গন্তব্যের দিকে পা বাড়িয়েছে। একেবারে অজানাও বলা যায় না। তমাদের বাড়ি এদিকেই। এপাশেরই কোনো একটা বাড়ি হবে হয়তো। অন্ধকার হওয়ায় খুব একটা চেনা যাচ্ছে না।দিনের আলোয় সবকিছু স্পষ্ট চেনা গেলেও;রাতের বেলা খুব কষ্ট। অন্ধকারে সবকিছু ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা মনে হয়। চেনা জিনিসও প্রচন্ড অচেনা লাগে।

কারেন্ট চলে যাওয়াতে বাড়িতে গরম লাগলেও। বাইরে বেশ ঠান্ডা। সাদ ফোনের ফ্লাশলাইট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে শুরু করলো। সাদ হঠাৎ একটা বাড়ির দিকে আলো নিক্ষেপ করলো। হঠাৎ সেখান থেকে একটা মহিলার গলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে চমকে উঠলো সাদ। মহিলা কন্ঠটি চেঁচিয়ে উঠে সাদকে বলছে,”লাইট মারে ক্যাডারে? মহিলা মাইনষে খারায় রইসে। তাও কোনো শরম লজ্জা নাইগ্যা। আরও লাইট মাইরা তাকায়া তাকায়া দ্যাহে! বেশ/রম জানি কোনহানকার! ”

সাদ বিপদের সংকেত বুঝতে পেরে দ্রুত সেই স্থান হতে প্রস্থান করলো। এগোতে এগোতে বেশ সামনে চলে এলো। আরেকটু এগোলেই দু-রাস্তার মোড়। সাদ হালকা ভাবে কারো গলার স্বর শুনতে পেল। প্রথমবার আমলে না নিলেও দ্বিতীয়বার ব্যাপারটা খেয়াল করলো। আওয়াজের সূত্র ধরে কিছুটা এগিয়ে গেল। বড় উঠোনে একটা মেয়েসহ কিছু বাচ্চা ছেলেমেয়ে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে কী যেন পরছে।পাশে রাখা বেশ কয়েকটা মোমবাতি। বাতাসে বারবার নিভু নিভু করছে আলো। সাদ একটু সময় নিয়ে চারপাশটা তাকিয়ে দেখলো। ওহ! হ্যাঁ! মনে পরেছে! এটাই তো তমাদের বাড়ি। আচ্ছা, সামনে থাকা মেয়েটা কী তমা? সাদ কী তমাকে ডেকে কথা বলবে? সাদ এবার এক প্রকার বিড়ম্বনায় পরে গেল। একটু একটু অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে। এটা যদি তমা না হয়? তাহলে তো মানুষ অন্য কিছু ভাববে। সাদ হঠাৎ গলা খাখাড়ি দিলো। সাদের সামনে থাকা মেয়েটি চমকে উঠে সাদের দিকে তাকালো। সাদ হালকা শব্দ করে বললো,”তমা!”

তমা সাদের গলা শুনে বুঝতে পারলো এটা আসলে সাদ। তমা তাঁর সাথে থাকা বাচ্চাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললো,”এই তোরা পড়তে থাক। আমি একটু আসছি।”

তমা এটুকু বলেই উঠোন মাড়িয়ে সাদের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভ্রু কিছুটা কুচকে সাদকে বললো,” এত রাতের বেলায় এই দিকে কী? নিজের বাড়িতে এতই ভাতের অভাব বুঝি? মানুষের বাড়িতে রাত-বিরেতে এত ঘুরাঘুরি কীসের? ”

সাদ বড় একটা হাই তুলে তমাকে বললো,”এই গরমে ঘরে পঁচে মরার চেয়ে মানুষের বাড়ির সামনে ঘুরাঘুরি করে হাওয়া বাতাস খাওয়া কী ভালো না?”

তমা সাদের কথা শুনে মুখ বাঁকালো।নিজের মুখের এক পাশে হাত রেখে বললো,” বাড়ি যান তো আপনি। আমাদের বাড়ি চিনলেন কীভাবে? মাত্র তো একদিন এসেছিলেন।”

সাদ চোখ কুঁচকে বললো,” তোমার মতো ফাটা বাঁশ বাড়িতে থাকতে আমার পথ চেনার কী দরকার? যেই গলা তোমার! এলাকায় মাইকের কোনো দরকার নেই। তোমার মতো ফাটা বাঁশ একটা থাকলেই হবে।”

তমা সাদের কথা শুনে বেশ ক্ষেপে গেল। সাদ অবশ্য তমাকে রাগানোর জন্যই কথাটা বলেছে। সাদ ঠোঁট টিপে হাসতে শুরু করলো। তমাকে রাগাতে ক্ষ্যাপাতে সাদের বেশ লাগে। তমা সাদের দিকে এক পা এগিয়ে গিয়ে বললো,” তাই বলে যাঁর তাঁর বাড়িতে ঢুকে পরবেন? বেহা/য়া জানি কোথাকার! ”

তমার কথা শুনে সাদও বেশ রেগে গেল। সাদ রাগের প্রকাশ না ঘটিয়েই বললো,”আমাকে এত কিছু বললে। তো তুমি কী? কাকের মতো সারাদিন কা কা করে আমাকে বললে বেহা/য়া। সারাদিন কাজকর্ম বাদ দিয়ে শুধু টইটই। পড়াশোনার তো বালাই নেই। ”

সাদের মুখে পড়াশোনার কথা শুনতে পেয়ে তমা বেশ রেগে গেল। আঙুল উঁচু করে সাদের দিকে আবার তেড়ে এসে বললো,” এই আপনি দেখেছেন আমি পড়াশোনা করি না? এই দেখুন এখনও তো আমি পড়ছিলাম। আপনিই তো এসে আমার কাজে বাগড়া দিলেন। এখন আবার আমাকেই এত কথা শোনাচ্ছেন?”

সাদ তমার কথা শুনে খিলখিল করে হেসে ফেললো। তমার সাদের হাসির আওয়াজ শুনতে পেয়ে আরও এক দফা রেগে গেল। সাদ হাসি থামিয়ে তমাকে বললো,” তুমি তো অনেক পড়াশোনা করো তাই না?”

তমা ভ্রু নাড়িয়ে বললো,”হুম অবশ্যই, আমি ক্লাসের সবচেয়ে ভালো ছাত্রী। প্রতিবছর পরীক্ষার ফলাফল শেষে পুরস্কার পাই।”

সাদ তমার কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসলো। হাসির রেখা মুখ থেকে সরিয়ে বললো,”তাই না কি? তা আমি তো শুনলাম ক্লাস নাইনে না কি তুমি আরও একবার পড়েছো? ফেইল করলেও বুঝি তোমাদের স্কুলে পুরস্কৃত করে? এত ভালো স্কুল তোমাদের? ”

তমা সাদের কথা শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল।আমতা আমতা করে ইনিয়ে বিনিয়ে সাদকে বললো,”ওসব গুজব গুজব! গুজবে কান দিতে নেই। আমার ভালো দেখতে পারে না তো। তাই এসব গুজব রটিয়ে বেড়াচ্ছে। ওসবে কান দেবেন না। সব আমার বিরুদ্ধে করা চক্রান্ত।”

সাদ নিজের চুলে হাত বুলিয়ে বললো,”ওহ তাই না কি? তোমার ভাই তো আজ আমাকে নিজে বললো। তুমি না কি পরীক্ষায় ফেইল করে এই নিয়ে দুবার বাইনে পড়ছো। তোমার ভাইও বুঝি তোমার বিরুদ্ধে গুজব রটাচ্ছে?”

তমা আরেক দফা চমকে উঠলো। রেগে গিয়ে সাদকে বললো,” আপনি কিন্তু এবার বেশি বেশি করছেন! ভালো হচ্ছে না কিন্তু!”

সাদ তমার কথায় কান না দিয়ে বললো,”বেশ করেছি। আরও করবো;দেখি তুমি করতে পারো!”

তমা সাদের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, “দেখবেন কী করতে পারি?”

সাদ তমার কথায় কর্ণপাত না করে বললো,”দেখি তুমি কী এমন করো!”

তমা আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো। চিৎকার করে বললো,”ভাইয়া গো! বাড়িতে চোর ঢুকেছে! আমাকে বাঁচাও ভাইয়া! ও ভাইয়া কোথায় তুমি! আমাকে বাঁচাও গো!”

সাদ তমার কথা শুনে ক্যাবলা কান্তের মতো তমার দিকে তাকিয়ে রইলো। তমার ভাই শফিকুল ঘর থেকে বড় লাঠি নিয়ে বের হলেন। মোমবাতি হাতে তমার সাঙ্গপাঙ্গরা ছুটে এলো। তমার ভাই শফিকুল সাদকে চোর ভেবে সাদের মাথায় লাঠি দিয়ে জোরে আঘাত করলো। আঘাত পেয়ে সাদ মাথা ধরে মাটিতে বসে পরলো। চিৎকার করে সাদ বললো,” আমাকে বাঁচাও গো আমি ডাকাতের পাল্লায় পরেছি গো!”

তমা এবং শফিকুল দুজনেই সাদের কথা শুনে চমকে উঠলো। চোর নিজেই কিনা বলে সে ডাকাতের পাল্লায় পরেছে! হায় কপাল! শেষমেশ চোর কিনা পরলো ডাকাতের কবলে!

চলবে….

লবঙ্গ লতিকা পর্ব-০৩

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ৩

আজকে সাদদের পুরো বাড়িতে মিলাদ পরানো হবে। এটা যদিও আঙুর বালার ইচ্ছে। তাই কেউ আর দ্বিমত করেনি। তমাদের বাড়ি থেকে সাদদের বাড়ির দুরত্ব খুব বেশি নয়। তাই,সকাল সকাল তমাকেও চলে আসতে বলেছেন অনিতা। সাদও বাড়ির কাজে আজ বেশ ব্যস্ত। এতিমখানা থেকে বাচ্চাদের নিয়ে আসতে বলেছেন অনিতা সাদকে। এছাড়াও বাড়িতে আজ বেশ কাজের চাপ। বাবুর্চি দিয়ে রান্না করাচ্ছেন বাড়িতে।

তমা ধীর পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো। অনিতা বাড়ির উঠানে পিঁড়ি পেতে বসে ছিলেন। তমা ঘোমটা ঠিক করতে করতে অনিতার সামনে গিয়ে অনিতাকে সালাম দিলো। অনিতা তমার সালামের জবাব দিয়ে তমাকে পাশে বসতে বললো। এবং তমাকে প্রশ্ন করলেন “কার সাথে এসেছো?

তমা ধীর কন্ঠে উত্তর দিলো, “ভাইয়ার সঙ্গে” অনিতা তমাকে আবার বললেন,”এসো। এবার আমার পাশে চুপটি করে বসো।”

তমা অনিতার পাশে বসতেই অনিতা তমাকে ভালো মন্দের ব্যাপারে বলতে শুরু করলো। তমা অনিতার পাশে বসে অনিতার কথা শুনে যাচ্ছে। আর একটু পরপর মাথা নাড়াচ্ছে। যতই হোক অনিতা তমার গুরুজন। হবু শাশুড়ী বলে কথা।

বাড়ির কাজে নিয়োজিত একজন হঠাৎ এসে বললেন, “আম্মা আপনারে দাদীজান ডাকে।” অনিতা শাশুড়ির কথা শুনেই উঠে দাঁড়ালেন। দৌড়ে শাশুড়ির ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

তমা উঠানের এক পাশে একা বসে রইলো। আশেপাশে টুকটাক মানুষজন আছে। তবে, এদের কাউকেই তমা চেনে না। তাই আর আগ বাড়িয়ে কথা বলার প্রয়োজন বোধ করেনি।

তমার কথা সাদ জানে না। সাদ রান্নাঘর থেকে এক কাপ চা নিয়েই বাড়ির উঠানে গা এলিয়ে দিয়ে বসলো। হঠাৎ খেয়াল করলো তমা সেখানে। সাদ চায়ের কাপ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ক্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেল তমার দিকে। তমা সাদকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ঘোমটা ঠিক করে আঁটসাঁট হয়ে বসলো। সাদ চায়ে চুমুক দিতে দিতে তমার পাশে এসে বসলো।

সাদকে নিজের পাশে বসতে দেখেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো তমা। সাদ ঠাট্টার ছলে তমাকে বললো, “তোমাকে আবার কে দাওয়াত দিলো?” তমা কিছু বলার আগেই সাদ আবার তমাকে উদ্দেশ্য করে বললো,”ওহ, আমার তো মনেই নেই। তোমার আবার কোনো দাওয়াত ফাওয়াত লাগে না। তুমিই হচ্ছো বিনা দাওয়াতী মেহমান। ”

তমা রেগে গিয়ে সাদের দিকে তাকালো। সাদ তমাকে কটাক্ষের স্বরে বললো, “এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমি ভয় পেয়েছি সত্যি! দেখো ভয়ে আমার কিডনির হাড্ডি ভেঙে গেছে! ”

তমা আর সহ্য করতে না পেরে এবার সাদকে বলেই ফেললো, “আপনার খেয়ে দেয়ে কোনো কাজ নেই?যখনই দেখি শুধু আমার পেছনে পরে থাকেন। আমি জানি আমি সুন্দরী তাই বলে এত পেছনে পেছনে ঘুরতে হবে?”

সাদ চায়ের কাপটা পাশে রেখে তোমার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো,” আহারে পারাম সুন্দারী! সুন্দর আন্নের বায়ি বায়ি ফরে। এক্কান বালতি হাতি দি? তোমাকে পুরো জং/লী বিড়ালের মতো লাগছে! মনে হচ্ছে এখনি এগিয়ে এসে কামড়ে দেবে।”

তমা রেগে গিয়ে এবার সাদের হাতে বড় করে দুটো আঁচড় দিলো। সাদ ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো। সাদের চিৎকার শুনে তমা শান্তির নিঃশ্বাস ফেললো। সাদ তমাকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে বললো,” তুমি আসলেই একটা জং/লী বেড়াল! দেখো আমার হাতটা পুরো লাল হয়ে গেছে! বেয়া/দব মেয়ে!

তমা চেঁচিয়ে উঠে সাদকে বললো,” তাহলে আপনি কী? আপনি তো কুকুর! কালকে আমার আঙুলে ওভাবে কামড় বসালেন কেন?

সাদ উত্তেজিত হয়ে তমাকে বললো,” তো কী করবো? চুমু দেবো তোমায়? তুমি বেয়া/দবি করবে আর আমি শাসন করলেই দোষ? ”

তমা সাদের কথা শুনে জিহ্বা বের করে সাদ ভেংচি কাটলো। সাদ তোমার হাতদুটল জাপটে ধরে বললো,” কালকে কুকুর বললে কেন আমাকে? তোমার কী আমাকে কুকুর মনে হয়?”

তমা সাদের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,” তো কী বলবো? কুকুরকে তো আর বিড়াল বলা যায় না।”

সাদ তমার দিকে তাকিয়ে বললো, ” বিড়াল তো তুমি! একটা জংলি বিড়াল! শুধু মানুষকে খামঁচি দিয়ে বেড়াও। খামঁচি রানী!”

তমা উঠোন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাদকে উদ্দেশ্য করে বললো,” এর শোধ আমি তুলবোই তুলবো! বজ্জাত ছেলে!”

সাদ পেছন থেকে উচ্চস্বরে হাসতে শুরু করলো। তমা একবার রাগী চোখে পেছন ফিরে তাকালো। তাকিয়ে শুধু সাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখলো। এরপর আবার সোজা বরাবর হাঁটতে শুরু করলো। সাদ তমার রাগ দেখে আবারও হেসে ফেললো।

বাড়ির সবার সাথেই হাতে হাতে কাজ করছে তমা। তমার আচরণ দেখে আঙুর বালা তো বলেই ফেললেন “কী লক্ষী মেয়ে দেখেছো? কীভাবে সবাইকে আপন করে নিলো!”

অনিতা অবশ্য শাশুড়ীর কথায় চুপ করে ছিলেন। তমা আসলেই অতিরিক্ত লক্ষী একটা মেয়ে। সাদের বিয়ে নিয়ে অনিতার শাশুড়ির প্রতি চাপা একটা রাগ কাজ করলেও। এই রাগের প্রভাব তমার ওপরে অনিতা পরতে দেয়নি। যে কিছু জানে না বোঝে না তাঁর ওপর রাগ ঝেড়ে কোনো লাভ নেই। ছোট্ট মানুষ! এখন কিছু বলেও কোনো লাভ নেই। কিছুই বুঝবে না।

তমা সবার হাতে হাতে কাজ করার সময় খেয়াল করলো অনেকটা সময় ধরে সাদ তাঁর পিছু পিছু ঘুরছে। তমা সবার থেকে একটু দূরে গিয়ে সাদকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিস করে বললো,” যাদের কোনো কাজ নেই তাঁরাই মানুষের পেছনে ঘুরাঘুরি করে। আমি কিন্তু ভালো! আমি আজকে অনেক কাজ করেছি হুহ!”

সাদ তমার দিকে তেড়ে গিয়ে তমাকে বললো,” আমি সকাল থেকে গাধার মতো খাটা-খাটনি করেছি। তোমার থেকেও বহুগুণে বেশি কাজ করেছি আমি। এখন এটুকু করেই অহংকারে মাটিতে পা পরছে না তোমার।”

তমা সাদের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে বললো,” গাধা তো গাধার মতোই খাটবে!”

সাদ তমার কথা শুনে বেশ রেগে গেল। তমার একেবারে সামনে গিয়ে বললো,”তুমি আমাকে গাধা বললে?”

তমা বেশ ঢঙ্গি স্বরে বললো,”তো আমি কী গাধাকে ঘোড়া বলে ডাকবো?”

সাদ এবার তমার প্রতি বেশ রেগে গেল। তমা মাথার ঘোমটা ঠিক করতে করতে সাদকে বললো,” আর কী যেন বললেন একটু আগে? আমার মাটিতে পা পরছে না? তো আমি কী হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছি? হাত পা ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছি? ”

সাদ রাগ সহ্য না করতে পেরে তমাকে বললো,” বাচ্চা মানুষ ভেবে কিছু বলছি না তোমাকে। নাহলে দেখতে কী করতাম।”

তমা আঙুল উঁচু করে সাদের দিকে এগিয়ে গেল। রেগে গিয়ে বললো,” কী করবেন আপনি? দেখি কী করবেন!

সাদ টুপ করে তমার আঙুলে আগের বারের মতো কামড়ে দিলো। তমার দিকে আরও এক হাত এগিয়ে গিয়ে বললো,” এভাবে কামড়ে দেবো।”

তমা সাদের কথায় কোনো নজর না দিয়ে বললো,” ভালোই হলো। আমার আর হাত ধুতে হলো না।একটু আগে নাকের ময়লা পরিস্কার করেছিলাম এই আঙুল দিয়ে।”

তমা এটুকু বলেই আঙুলটা নিজের নাকের ভেতর গুঁজে দিলো। সাদ আর এক মুহুর্তে সেখান দাঁড়ালো না। ওয়াক! করে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল। পেছন থেকে শুধু শুনতে পেল তমার হাসির শব্দ।

চলবে…

লবঙ্গ লতিকা পর্ব-০২

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ২

সাদের সামনে একটি মেয়ে বসা। সাদ বিরক্ত হয়ে বেশ কয়েকবার মেয়েটার দিকে তাকিয়েছে। তবে, মেয়েটা এখনও একবারও সাদের দিকে তাকায়নি। অনিতা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললো, “নাম কী তোমার? ” মেয়েটি নিচের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,” তমা”

অনিতা চায়ের কাপটা নিচে রেখে বললো, “কোন ক্লাসে পড়ো যেন তুমি?” তমা আরও আড়ষ্ট হয়ে বললো,” ক্লাস নাইন”

সেদিনকার মতো কথাবার্তার সেখানেই সমাপ্তি। সাদ কিংবা তমা কেউই কারো সাথে কথা বলেনি। তমা তো একবার চোখ তুলে সাদের দিকে তাকায়ওনি।

সাদ বাড়ি ফিরে এসে বেশ বিরক্ত। মেয়েটা খুব ছোট। এত অল্প বয়সের মেয়ের সাথে সংসার কীভাবে করবে? দেখা যাবে, বিয়ের দিন রাতে মায়ের কাছে যাবো বলে মেয়েটা হেঁচকি তুলে কাঁদছে। কী একটা অবস্থা! সাদ না পারছে বলতে না পারছে সইতে। বিয়ের দিন সাধারণত মেয়েরা পালায়। সাদ এবার বিয়ের দিন বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করলো। মেয়েদের মতো জামাকাপড় পরে পালিয়ে যাবে। তাহলেই কাহিনি খতম! কষ্ট করে এইসব বিয়ে সাদির ঝামেলায় অন্তত জড়াতে হবে না।

পরদিন অনিতা আর মহসিন তোমা-দের বাড়িতে আবার গেলেন। কিন্তু,সঙ্গে সাদকে নিলেন না। বিয়ের পাকাপাকি কথা সেরেই বাড়িতে ফিরলেন। আঙুর বালার শরীরের কথা চিন্তা করে বিয়ের দিনটা এই সপ্তাহেই ফেলা হয়েছে। একেবারে হুটহাট করে বিয়ে আরকি।

সাদ চুপচাপ সব ঘটনাই শুনলো। পরিস্থিতি দেখে যা মনে হচ্ছে বিয়েটা আসলেই করতে হবে। ইতিমধ্যে সাদকে নিয়ে বাড়িতে হাসাহাসি পরে গেছে। এতদিন শুনে এসেছে মেয়েদের বাল্য বিবাহ হয়। এখন সবাই দেখবে ছেলেদেরও বাল্য বিবাহ হয়। সাদ এসব চিন্তা করতে করতে বাড়ি থেকে বের হলো। হাটাহাঁটি করতে করতে বহুদূরে চলে গেল। চারিদিকে আজান দিচ্ছে। সন্ধ্যা প্রায় নেমে এসেছে। সাদ ফের বাড়ির পথের দিকে রওনা হলো। গ্রামে সন্ধ্যা হলেই সবকিছু ঘুটঘুটে অন্ধকারে ছেয়ে যায়। তখন টর্চ লাইট নিয়ে বের হতে হয়।সন্ধ্যা হয়ে গেলে বাড়ি ফিরতে বেশ কষ্ট হয়ে যাবে সাদের। সাদ দ্রুত গতিতে বাড়ির দিকে অগ্রসর হলো। যাওয়ার পথে সাদ দেখতে পেল একটা মেয়েদের দলবল হাসতে হাসতে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। সবার মাঝখানের মেয়েটাকে সাদের বড্ড চেনা মনে হলো। সাদ ঘুরে তাকালো মেয়েটার দিকে। সাদ ফের তাকাতেই বুঝতে পারলো এই মেয়েটার সাথেই তাঁর বিয়ের কথা হচ্ছে। সাদ মেয়েদের দলটার দিকে এগিয়ে গেল। সবার হাতে পুকুর পার থেকে তোলা শাপলা। সাদ মেয়েদের দিকে এগিয়ে গিয়ে মাঝখানের মেয়েটাকে বললো,” এই তুমি আমার সাথে একটু আসো তো।” মেয়েটা মাথা নিচু করে ঘাড় এদিক ওদিক নাড়ালো। যাঁর অর্থ না। সাদ ধমকের স্বরে বললো,” আসতে বলেছি তোমাকে!” মেয়েটা ভীতগ্রস্ত দৃষ্টিতে প্রথমে সাদের দিকে তাকালো। এরপর ধীর পায়ে এগিয়ে গেল সাদের দিকে। সাদ মেয়েটাকে নিজের দিকে আসতে দেখে বাকি মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললো,” তোমরা এবার যাও” মেয়েরা প্রথমে না যেতে চাইলেও সাদের চোখ রাঙানো দেখে ভয়ে দৌড় দিলো। মেয়েটি সাদের পাশে এসে দাঁড়ালো। সাদ মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে বললো,”তোমার নাম তমা না?” মেয়েটি মাথা ঝাঁকালো। যাঁর অর্থ দাঁড়ায় হ্যাঁ। সাদ বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো, “তুমি আবার আমার সঙ্গে কী সংসার করবে? কী ছোট বাচ্চাদের মতো দেখতে তুমি। দেখে মনে হচ্ছে ক্লাস টুতে পড়ো। আসলেই ক্লাস নাইনে পড়ো তুমি? না কি এতেও কোনো ঘাপলা আছে?”

তমা রোশারক্ত দৃষ্টিতে সাদের দিকে তাকালো। সাদ বুঝতে পেরে তমাকে আবার বললো,” তুমি একটু সরে দাঁড়াও তো। তোমার মুখ থেকে এখনও দুধের গন্ধ বেরোচ্ছে। ”

তমা রাগান্বিত হয়ে সাদের দিকে তাকালো। তেড়ে এসে সাদকে বললো,” আমাকে কী বাচ্চা মনে হয় আপনি? আমি কিন্তু যথেষ্ট বড়! ক্লাস নাইনে পড়ি!”

সাদ তমার কথায় হালকা হাসলো।তমাকে আরও রাগানোর জন্য বললো,” তুমি আমার হাঁটুর বয়সী! তোমার থেকে আমি কতবড় জানো? নাক টিপলে এখনও দুধ বের হবে। তুমি আবার করবে সংসার! তোমার পুতুল পুতুল খেলা দেখে বিয়ে করার শখ হয়েছে না কি? আমার মতো নিষ্পাপ নিরীহ একটা মানুষের জীবন নিয়ে খেলছো।”

তমা সাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তেড়ে এলো। আরেকটু হলে সাদ পরেই যেতো। তমা আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো,”আপনি কিন্তু অপমান করছেন আমাকে!”

সাদ নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো, “ওহ, তোমার বোধ শক্তিও আছে? আমি জানতাম না আসলে। এত পিচ্চি মানুষদেরও বোধ শক্তি থাকে এটা আসলে প্রথম শুনলাম।”

তমা সাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আবার আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে বললো,” আপনি কিন্তু এবার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন! আমি আপনার মায়ের কাছে গিয়ে নালিশ করবো কিন্তু! ”

সাদ মায়ের কথা শুনতেই থেমে গেলে। হঠাৎ করে তমার আঙুলে একটা কামড় বসিয়ে দিলো। তমা ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো। সাদ থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে বললো,” আমার সাথে এভাবে আঙুল নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলবে না তমা। আমি কিন্তু তোমার অনেক বড়।”

সাদ এটুকু বলেই ফের উল্টো দিকে হাঁটা ধরলো। তমা পেছন থেকে সাদের চলে যাওয়া দেখলো। হাতের আঙুলটা ধরেই দাঁড়িয়ে রইলো। সাদ তোমার অবস্থান বোঝার জন্য পেছন ফিরে তাকালো। তমা সাদকে পেছন ফিরে তাকাতে দেখে দূর থেকেই ইশারা করে বললো, “কু/ত্তা!”

সাদ চোখ রাঙিয়ে তমার দিকে তাকালো। তমা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সাদকে জিহ্বা বের করে ভেঙিয়ে দৌড় দিলো। সাদ তমাকে ধরার জন্য তমার পিছু পিছু বেশ ক্ষানিকক্ষন ছুটলো। কিন্তু শেষে তমাকে না ধরতে পেরে ক্লান্ত হয়ে বাড়ির পথের দিকে পা বাড়ালো।

চলবে…

লবঙ্গ লতিকা পর্ব-০১

0

#লবঙ্গ লতিকা
#নুজহাত আদিবা
পর্ব ১

–ক্লাস নাইনে পড়া একটা মেয়েকে বিয়ে! এটা কী সম্ভব!
বিস্ফোরিত কন্ঠে সাদ বলে উঠলো। সাদের দাদী আঙুরবালা পালঙ্কের ওপরে হেলান দিয়ে বসে আছেন। একটু পরপর মাথাও চাপড়াচ্ছেন।

সাদের এত উৎকন্ঠা দেখে সাদের দাদী আঙুরবালা চোখ মুছতে মুছতে বললেন,
” তোর বয়সই বা কত রে? তুই তো মাত্র কলেজে পরিস!তোরা সবই করতে পারবি শুধু আমার বেলাতেই যত আপত্তি!”

সাদ তাঁর দাদীর কথা শুনে চুপ হয়ে গেল। যত যাইহোক এত অল্প বয়সে বিয়ে করবে না সে। সাদকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে সাদের বাবা মহসীন খান তাঁর মাকে বলে উঠলেন,
” আম্মা তুমি ভালো কিছু চাইলে না করতাম না। এটা তোমার কেমন আবদার? আমার ছেলেটা মাত্র কলেজে পড়ে। এরমধ্যেই ওর বিয়ে দিয়ে দেবো? ওর ভবিষ্যত তো পুরো অন্ধকার! তাও যেই মেয়েকে ঠিক করেছো সে পরে ক্লাস নাইনে। তুমি কী আমাদের পুলিশের ধাওয়া খাওয়াতে চাও? জানো না ১৮ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া নিষিদ্ধ? ”

আঙুরবালা ছেলে মহসীন খানের বলা কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ” হইসে! আর কথা কইস না তোরা। কয়দিন পরে যামুগা মইরা। তহন তো আর এতডি কথা হুনানের মানুষ পাবি না তোরা। কত শখ আছিলো নাতি নাতনীগো বিয়া দেইখা মরুম। সেই শখ আর মিটলো আমার। আমি মরলে তোরা শান্তি হবি!”

মহসীন খান আর পাল্টা যুক্তি খুঁজে পেলেন না। মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় শুধু হালকা ভাবে তাঁর মা আঙুরবালাকে বলতে শুনলেন,” আমার লগে এমন করিস না তোরা। মইরা যাওয়ার আগে এই একটাই ইচ্ছা আমার। তোর পোলাডার বিয়া দেইখা মরবার চাই। কবে তোর পোলা বড় হইবো। চাকরি-বাকরি করবো। ততদিন কী আর আমি বাঁইচা থাকুম?”

মহসীন খান চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। তাঁর মায়ের শরীর আসলেই খারাপ। যখন তখন কিছু একটা হয়ে যেতে পারে। সেজন্য সপরিবারে মায়ের সাথে দেখা করতে;গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন।এখানে এসেই দেখলেন আরেক কান্ড। তাঁর মা ক্লাস নাইনে পড়ুয়া এক মেয়ের ছবি দেখিয়ে বললেন তাঁর ছেলে সাদের সাথে বিয়ে দিতে। সাদ মাত্র ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পরছে। এই অবস্থায় ছেলের বিয়ে দেওয়া মানেই ছেলেকে অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেওয়া। একবার ছেলে-মেয়েদের সংসারের দিকে মন চলে গেলে তখন আর পড়াশোনায় মন বসে না। মহসীন খান এবার বেশ দুশ্চিন্তায় পরে গেলেন। মায়ের শেষ আবদার! আবার আরেক দিকে ছেলোর ভবিষ্যত। কোনটা রেখে কোনটা জলাঞ্জলি দেবেন!

মহসীন খান চিন্তা করতে করতে বাড়ির উঠোনে গিয়ে চেয়ার পেতে বসলেন। এরকম পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো উপায়ন্তর খুঁজতে শুরু করলেন। বাড়ির কাজের লোকটা হঠাৎ দৌড়ে এলো মহসীন খানের সামনে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,” চাচা! দাদী কেমন জানি করতাসে। হাত পা ঠান্ডা হইয়া আইতাসে। আপনে তাড়াতাড়ি আহেন।”

মহসীন খান পিলে চমকে উঠলেন। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দৌড়ে তাঁর মা আঙুরবালার ঘরের দিকে অগ্রসর হলেন। ঘরে গিয়ে দেখলেন তাঁর মা ব্যাথায় কোকাচ্ছে। আঙুর বালা তাঁর ছেলে মহসীন খানকে দেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,” মরন যন্ত্রণা যে কী কষ্টের আগে বুঝি নাইরে বাবা। আল্লাহ আমারে উঠায়া লয় না ক্যা? আমার তো এত কষ্ট আর সহ্য হইতাসে না রে বাপ। ভাল্লাগে না আর দিনদুনিয়া। এত মানুষ মরে। আমি মরি না ক্যা? আল্লাহ আমারে আর কত কষ্ট দিবো?”

মহসীন মায়ের হাত ধরে কেঁদে উঠলেন। আঙুর বালা বারবার ব্যাথায় গোঙ্গাছে। মহসীন এবার সবচেয়ে কঠিন আর চূড়ান্ত একটা সিদ্ধান্ত নিলেন। চোখ মুছতে মুছতে ঘরের বাইরে গিয়ে তাঁর স্ত্রী অনিতাকে ডাকলেন। অনিতা ঘোমটা ঠিক ঠিক করতো করতে তাঁর বর মহসীনের সামনে আসলো। মহসিন শক্ত গলায় অনিতাকে বললেন,” আম্মা সাদের জন্য যে-ই মেয়ে ঠিক করেছে ওর সাথেই সাদের বিয়ে দাও।আম্মার শরীরের প্রচন্ড খারাপ অবস্থা। কখন কী হয়ে যায় বলা যায় না। তুমি তাড়াতাড়ি ওই মেয়ের সাথে সাদের বিয়ে দাও। আম্মার শেষ ইচ্ছে এটাই যে উনি সাদের বিয়ে দেখেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। তুমি তাড়াতাড়ি বিয়ের কথাবার্তা শুরু করো।”

অনিতা থমকে গেলেন। ছেলেটার বয়স তো খুব বেশি না। এখনই বিয়ে! অনিতা মহসীনের কথাটা মেনে নিতে পারলেন না। রুদ্ধ কন্ঠে বললেন, ” আমার এতটুকু একটা ছেলে। এখনই বিয়ে দেবো! আমার ছেলের ভবিষ্যত কী তাহলে? আম্মা যে-ই মেয়েকে ঠিক করেছেন সেই মেয়েও তো ছোট। ক্লাস নাইনে পড়ছে মাত্র। বয়সও হবে ১৫ কী ১৬। এই পিচ্চি মেয়ে আবার সংসারের কী বুঝবে?”

মহসীন করুন দৃষ্টিতে অনিতার দিকে তাকালেন। তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আমিও সেই কথাই চিন্তা করছি। কী করি বলো তো! মায়ের কথাও ফেলতে পারছি না। আবার সামনে ছেলের উজ্জ্বল ভবিষ্যত। কোনটা রেখে কোনটার দিকে নজর দেবো বলো?”

অনিতা মহসীন খানের দিকে তাকিয়ে বললেন,” তুমি দাঁড়াও, আমি আম্মার সাথে কথা বলে দেখি কী হয়। এত অল্প বয়সে আমার ছেলেকে আমি বিয়ে দেবো না।”

অনিতা আর দাঁড়ালেন না। ক্রস্ত পায়ে এগিয়ে গেলেন আঙুর বালার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে।

আঙুর বালার ঘরে গিয়ে অনিতা দেখলেন আঙুর বালা হাত কপালে ঠেকিয়ে শুয়ে আছেন। অনিতা আঙুর বালার পায়ের কাছে গিয়ে বসলো। পায়ের কাছে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে, আঙুর বালা কপালের সামনে থেকে হাত সরিয়ে অনিতাকে দেখতে পেলেন। অনিতা আঙুর বালাকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে বলে উঠলেন,” আম্মা, আপনি না কি সাদের বিয়ে দিতে চান? এত অল্প বয়সে ওর বিয়ে দেই কীভাবে? যে-ই মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে চান। ও নিজেও তো খুব ছোট। আপনার কথাও থাক আর আমার কথাও থাক। বিয়েটা আরও কয়েকটা বছর পরে হোক। কথা দিলাম আম্মা যে-ই মেয়েকে আপনি পছন্দ করেছেন। সেই মেয়ের সাথেই আমি সাদের বিয়ে দেবো।”

আঙুর বালা অনিতার কথা মেনে নিতে পারলেন না। অসুস্থ শরীরেই উঠে বসলেন। উত্তেজিত কন্ঠে বললেন, ” মাইয়াডা কেলাস নাইনে পড়ে। অনেক বড় হইসে আর কত বড় হইবো। গেরাম গঞ্জে মাইয়ারা সেভেন এইটে পরলেই ওগো বিয়া হইয়া যায়। মাইয়াডারে আমার অনেক ভালো লাগসে। নিজের গেরামের বইলা কথা। তুমি সাদের লগে ওর বিয়া ঠিক করো জলদি। আমি সাদের বিয়াডা দেইখা চোখটা বন্ধ করবার চাই। আমার বংশের বড় নাতী সাদ। আমার ওরে লইয়া অনেক স্বপ্ন আশা। অয় বিয়া করবো সংসার করবো। বউ লইয়া ঘুরবো। আমার তো দিন শেষই। তোমরা আমারে নিরাশ কইরো না। সাদের বিয়াডা দেও জলদি। আমি একটু শান্তিতে মরতে চাই।”

আঙুর বালার এত আশা ভরসা দেখে অনিতা আর কোনো কথা বলতে পারলেন না। শয্যাশায়ী মানুষটার দিকে তাকিয়ে নিশ্চুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওই জায়গা থেকে সরে গেলেন। ছাঁদে গিয়ে দেখলেন সাদ সেখানে বসে আছে। সাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,” বাবা আমার, তোমার দাদী কী চান সেটা তো শুনেছো। তুমি দ্বিমত করো না বাবা। মৃত্যুর সময় তোমার দাদীর শেষ ইচ্ছে হলো, তোমার বিয়ে দেখা। তুমি বংশের বড় ছেলে। তোমাকে নিয়ে তোমার দাদীর শখ আহ্লাদের শেষ নেই। তুমি তৈরি থাকো। আমরা বিয়ের কথাবার্তা শুরু করবো খুব জলদি।”

সাদ তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। রোষারক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ” আম্মু আমার বন্ধু -বান্ধবরা এটা নিয়ে কত হাসাহাসি করবে তুমি জানো? প্রেম করবো ঘুরবো ফিরবো। এটাই হচ্ছে লাইফ! তোমরা আমাকে বিয়ে দিয়ে বিবাহিত বানাতে চাচ্ছো? কী একটা পিচ্চি মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করেছে দাদু! নাক টিপলে দুধ বের হবে। ওই মেয়ে করবে আবার সংসার! কী পছন্দ দাদুর! ইয়াক!

চলবে….

তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে পর্ব-১২(শেষ পর্ব)

0

#তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে
মৌলী আখন্দ
(শেষ পর্ব)
শহরের অপর প্রান্তে তাদের পরিত্যক্ত ব্রিজে পৌঁছানোর আগে কোনো কথা হলো না দুজনের মধ্যে। বাইকের স্টার্ট বন্ধ করে নামল রাইয়ান।
অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে তাদের প্রিয় ব্রিজের ভাঙা জায়গাটায় পা ঝুলিয়ে বসল এলিনা। নিচে নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে নদীর কালো পানি।
রাইয়ান এসে তার পাশে বসার পর এলিনা শুধু বলল, “বল।“
“তার আগে বল আমার এই ব্রেসলেটের বাগ দিয়ে সাউণ্ড ট্রান্সমিট হয়ে কোথায় যাচ্ছে?”
“রেকর্ড হচ্ছে অফিসে আমার ডেস্কটপের একটা ফোল্ডারে।“
“কে কে জানে এটার কথা?”
এলিনা নিচের কালো পানির ওপরে চোখ রেখে বলল, “সত্যি কথা বলতে, কেউই জানে না। প্রথমে জানাইনি কারণ আমি পুরোপুরি শিওর না হয়ে তোমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনতে চাইছিলাম না। আর পরেও কেন জানাইনি, আমি আসলে জানি না।“
এলিনার চোখে অশ্রু টলটল করছে।
“গুড”, আচমকাই বলে বসল রাইয়ান। “চলো আমরা পালিয়ে যাই। প্লিজ!”
“পালিয়ে কোথায় যাব? আর তুমি তো আমাকে এখনো বললে না যে তুমি কাদের জন্য কাজ কর?”
রাইয়ান ওর ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “খন্দকার গ্রুপ। আমাকে এসাইন করা হয়েছিল কিবরিয়া গ্রুপের উইক পয়েন্ট আর স্ট্রং পয়েন্ট বের করার জন্য। সো আমি তোমাকে টার্গেট করলাম। রাস্তায় সেই মেয়ের ওপর হুলিগানদের আক্রমণ, সবটাই ছিল আমার সাজানো। আমাদের বসকে তোমাদের সিইও ভীষণ অপমান করেছিল গত বছর। অপমানটা তিনি ভুলতে পারেননি। প্ল্যান ছিল এই শাড়িটা মার্কেটে এনে তোমাদের শেষ করে দেওয়ার। আর আমি এসব আমাদের ফ্ল্যাটে বলতে চাইনি কারণ ওখানে সিসি ক্যামেরা ফিট করা। আরিয়ান কেমিক্যালস কিছুই জানে না। নিহিলিন বিষটা পরে মেশানো হতো।“
“জানি, আমি শুনেছি।“
এলিনার হাত খপ করে ধরে ফেলল রাইয়ান। “সবই তো শুনলে, সখী, প্লিজ, চলো, আমরা এবার পালিয়ে যাই!”
উঠে দাঁড়াল এলিনা। “এখন আর তা সম্ভব নয়।“
ব্রিজের অন্ধকার থেকে হেঁটে হেঁটে আলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এলিনা, রাইয়ানও তার পেছনে ছুটতে ছুটতে পেছন থেকে কাকুতি মেশানো কন্ঠে বলল, “কিন্তু কেন? আই লাভ ইউ! প্লিজ! আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি! আমি…”
অন্ধকারের গা ফুঁড়ে কোথা থেকে উদয় হলো আরো দুজন লোক। কঠিন মুখে এগিয়ে যেতে শুরু করল রাইয়ানের দিকে।
অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রাইয়ান। “সখী, তুমি…”
এলিনা গিয়ে দাঁড়াল সেই লোক দুজনের সাথে। তার মুখ পাথরের মত, কোনো আবেগের ছাপ সেখানে পড়ল না।
রাইয়ানেরন শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। সে জানে ধরা পড়লে কী করা হবে তার সাথে।
প্রচণ্ড বেগে সে ছুটে যেতে লাগল ব্রিজের ভাঙা অংশের দিকে। এখান থেকে লাফ দিয়ে পানিতে পড়লে অন্তত বেঁচে যাওয়া যাবে।
অন্য লোক দুজনের গতি আরো বেশি। তারা ক্ষিপ্রগতিতে ধরে ফেলল রাইয়ানকে।
একজনের হাতে উঠে এল খাপখোলা ক্ষুর। চেঁচিয়ে উঠল এলিনা।
“এসব কী? বস বলেছেন ওকে জীবিত ধরে নিতে!“
রাইয়ান লড়ছে, কিন্তু এরা প্রফেশনাল। ক্ষুরটা কেড়ে নেওয়ার জন্য হাতাহাতির মাঝখানে পড়ল এলিনা।
প্রচণ্ড ভয়ে তার মাথা কাজ করছে না। ডিফেন্সের সব স্টেপ সে ভুলে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
নিজেও বুঝতে পারছে না এমন কেন হচ্ছে? অন্ধকারে কিছু দেখাও যাচ্ছে না ভালো।
আচমকা ক্ষুরটা হাতে চলে এল তার। কিন্তু একই সাথে অন্য লোকটা রাইয়ানকে আক্রমণ করল ছোরা হাতে।
রাইয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল এলিনা। কিন্তু নিজেও বুঝতে পারল না যে কখন সে চলে গেছে রাইয়ানের কাছে।
এলিনার বাম পাঁজরের নিচে আমূল গেঁথে গেছে ছোরাটা। তীক্ষ্ম ব্যথায় ককিয়ে উঠল এলিনা, তীব্র ভয়ে টান মেরে বের করে আনল সেটা।
ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, এলিনার পরনের লাল শাড়ি ভিজে উঠছে। অন্ধকারে সেই রক্তের রঙ মনে হচ্ছে কালো কালির মত।
এলিনা পড়ে যাবার আগে রাইয়ান ধরল তাকে।
সেই লোক দুজন আবার এগিয়ে আসছে, রাইয়ান এবার হিংস্রভাবে তাদের প্রতিহত করতে চেষ্টা করল। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
এলিনা আর রাইয়ান যখন ভাঙা ব্রিজটা দিয়ে একই সাথে নিচে পড়ছিল তখন রাইয়ান শেষ বারের মত বলার চেষ্টা করল, “সখী, তোকে আমি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিলাম রে! বিশ্বাস কর আমি সত্যিই পালাতে চেয়েছিলাম! কিন্তু কীভাবে বলবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছিলাম না…”
সবটুকু বলা হলো না, তার আগেই নদীর কালো পানি বুকে টেনে নিল ওদের। আহত ফুসফুস নিয়ে পানির সাথে লড়াই করে ভেসে থাকার মত যথেষ্ট শক্তি ওদের আর ছিল না।
ডুবে যেতে যেতে রাইয়ান ভাবছিল, আচ্ছা এলিনার বাচ্চাটা জন্মালে কার মত হতো দেখতে? ওর মত? নাকি এলিনার মত?
পরদিন খবরে প্রকাশিত হলো, “পরিত্যক্ত ব্রিজের নিচে তরুণ তরুণির লাশ উদ্ধার। সাথে থাকা ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে জানা যায়, তরুণের নাম রাইয়ান হাসান, বয়স ২৯ বছর। লাশের গায়ে ক্ষতচিহ্ন দেখে অনুমান করা হয় স্থানীয় দুর্বৃত্ত ও ছিনতাইকারীর ছুরির আঘাতে মৃত্যু। ব্রিজের ভাঙা অংশে স্ট্রীট ল্যাম্প ও সিসি ক্যামেরার অনুপস্থিতি কর্তৃপক্ষের দায়িত্বহীনতাই নির্দেশ করে। এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।“

সমাপ্ত,,

তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে পর্ব-১১

0

#তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে
মৌলী আখন্দ
পর্ব-১১

এলিনাকে বিশ্রাম দিতে গিয়ে রাইয়ান এখন বাজারের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছে স্বেচ্ছায়, এতদিন ওটা এলিনার ডিপার্টমেন্ট ছিল। বাজার করতে গিয়েই আজ দেরি হয়ে গেল তার।
দরজা খুলে ঢুকেই বরফের মত জমে গেল রাইয়ান।
এলিনার পরনে নতুন লটের একটা মসলিন শাড়ি!
বাজারের ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে ছুটে এসে ওর গা থেকে শাড়িটা টেনে খুলে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল রাইয়ান। আর প্রাণপণে চেঁচাতে লাগল, “খোলো এটা! কখন পরেছ? কতক্ষণ আগে!”
হিস্টিরিয়াগ্রস্ত রোগীর মত চিৎকার করছিল রাইয়ান। এলিনা শুধু নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে শীতল কণ্ঠে বলল, “কেন? এবোর্শন হয়ে যাবে তাই!”
পাথর হয়ে গেল রাইয়ান। এলিনার চোখে চকচক করছে জলের বিন্দু।
“এলি, প্লিজ, শান্ত হও, আই ক্যান এক্সপ্লেইন!”
“কে তুমি? কেন এসেছ আমার লাইফে!”
“আমি, আমি রাইয়ান!”
“লিকুইড নাইট্রোজেনে কী মিশিয়েছ তুমি? কেন মিশিয়েছ!”
পুরোপুরি ভেঙে পড়ল রাইয়ানের প্রতিরোধ। এলিনা তো সবটাই জেনে গেছে!
“তুমি লিকুইড নাইট্রোজেনে নিহিলিন বিষ মেশাওনি?”
নিহিলিন এক ধরণের উদ্বায়ী টক্সিন (কাল্পনিক), পরনের কাপড়ে যার উপস্থিতি থাকলে মানব ত্বকের সংস্পর্শে আসার পর যেটা ধীরে ধীরে কাপড় থেকে শ্বাসবায়ুর সাথে মিশে শরীরে প্রবেশ করে তীব্র মাথাব্যাথা, অবসাদ, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, শরীরের কিছু অংশ সাময়িক কিংবা পাকাপাকিভাবে অবশ হয়ে যাওয়া ছাড়াও অন্তঃসত্ত্বা নারীর জরায়ুর সময়ের আগেই সংকোচন সৃষ্টি করে এবর্শন বা প্রিম্যাচিওর ডেলিভারি করতে পারে এই নিহিলিন।
রাইয়ান দুই হাত তুলে শান্ত করার চেষ্টা করল এলিনাকে। ইশারায় বোঝাতে লাগল কী যেন।
“এলি, এসব কথা পরে হবে! আগে শাড়িটা খোলো প্লিজ!”
“ডোন্ট ওরি। তোমাদের ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। তুমি যেদিন আমার ল্যাপটপে পেন ড্রাইভ ঢুকিয়েছ সেদিনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। লিকুইড নাইট্রোজেনে নিহিলিন ডিজলভ করার প্ল্যান আমি সবটাই জেনেছি রাইয়ান! তুমি এখন শুধু আমাকে বল তুমি কার জন্য কাজ করছ?”
“তুমি এসব জানলে কীভাবে?”
ধীর পায়ে এগিয়ে এসে রাইয়ানের হাতের ব্রেসলেটে রাখল এলিনা। খুব ধীরে, প্রতিটা শব্দ আলাদা আলাদাভাবে উচ্চারণ করে বলল, “তোমার ব্রেসলেটটা আমি বদলে দিয়েছিলাম, রাইয়ান। এটা তোমার ব্রেসলেটটা নয়। এটা অবিকল একই রকম দেখতে আরেকটা ব্রেসলেট। এটার ভেতর একটা বাগ ঢোকানো ছিল। তোমার সব কথাই আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। প্রতিটা স্টেপ আমার জানা ছিল, রাইয়ান। শুধু জানতে পারিনি তুমি কাদের জন্য কাজ করছ। তুমি এই গেমটা আমার সাথে কেন খেললে?“
এলিনার চোখের ওপরে চকচক করছে জলের স্বচ্ছ পর্দা। রাইয়ান মরিয়া হয়ে বলল, “এলি, আর একটা কথাও নয়!”
“কেন এমন করলে আমার সাথে? আমি তো তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম! তোমার ব্যাকগ্রাউণ্ড চেক না করে তোমাকে ভালোবেসেই কি আমি ভুল করেছিলাম?”
এলিনার মুখের ওপরে হাত চাপা দিল রাইয়ান। “এলি চলো আমরা আমাদের সেই জায়গাটায় যাই! যাবে? প্লিজ!”
“কেন? আবার কী প্ল্যান করছ তুমি? ধাক্কা দিয়ে আমাকে পানিতে ফেলে দেবে? মেরে ফেলবে আমাকে?”
রাইয়ান জোরে জোরে বলল, “তোমাকে মেরে ফেললেও নিশ্চয়ই তোমার অফিসের সবাই এসব জানে, তাই না?”
অবাক হলো এলিনা। এসব কাকে শুনিয়ে বলছে রাইয়ান?
চোখের ইশারায় কী যেন বোঝাতে চাইল রাইয়ান। রাইয়ানের চোখে এমনই কাতরতা ছিল যে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে কী ভেবে যেন রাজি হয়ে গেল এলিনা।
চলবে,,

তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে পর্ব-১০

0

#তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে
মৌলী আখন্দ
পর্ব-১০

লিকুইড নাইট্রোজেনের কোয়ালিটিতে কোনো ফাঁক পায়নি এলিনার টিম। ডিল ফাইনাল হয়েছে।
অবশেষে প্রোডাকশন কস্ট ঠিক রেখেই সময়মতই মার্কেটে আসতে যাচ্ছে তাদের মসলিন। একই সাথে আরিয়ান কেমিক্যালসের সাথে কম খরচে ডিলটা পাইয়ে দেওয়ার জন্য প্রমোশন হয়েছে এলিনার।
এখন থেকে তার পোস্ট সিনিয়র এক্সিকিউটিভ, আলাদা রুম পাবে সে। কয়েকজনের সাথে কিউবিকলে বসতে হবে না।
আজকের রাতটা তাই সেলিব্রেট করছে তারা দুজন। রাতের খাবার বাইরে থেকে কিনে এনেছে আজকে।
স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে স্বচ্ছ গা পিচ্ছিল টকটকে এক রঙা আগুন লাল শাড়ি পরেছে এলিনা। আগুনের স্ফুলিঙ্গের মতই দেখতে লাগছে ওকে।
বহুদিন ধরে কোনো স্পেশাল পুরস্কার দেওয়া হয় না রাইয়ানকে। আসলেই একটা বিশেষ রাত উপহার পাওনা হয়েছে ওর।
স্বচ্ছ শাড়ির ফাঁকে উঁকি দিতে থাকা নাভিতে অতল সমুদ্রের আমন্ত্রণ। রাইয়ান ওর দিকে তাকাল চকচকে চোখে।
বহু বহু দিনের অভ্যাসে এই নারীর শরীরের প্রতিটি খাঁজ ভাঁজ তার মুখস্থ। তবুও এখনো নেশা জাগায়, প্রথম দিনের মতই।
অথচ আর কোনো মেয়ের জন্য এরকম অনুভূতি হয় না। হয়ত এটাকেই ভালোবাসা বলে।
পরনের টি শার্ট খুলে ফেলল রাইয়ান। হাসিমুখে ওর দিকে এগিয়ে গেল এলিনা।
এলিনাকে সরিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল রাইয়ান। অবাক হলো এলিনা। “কী ব্যাপার?’
“কি যে দারুণ জিনিস এনেছি তোমার জন্য সখী, ইউ জাস্ট ক্যান্ট ইমাজিন!”
“কী?”
ওদের ছোট্ট সংসারের জন্য কেনা ছোট্ট লাল টুকটুকে সাড়ে সাত সিএফটির ফ্রিজের ডালা খুলল রাইয়ান। হাসিমুখে বের করে আনল বোতলটা।
“শিভাস রিগ্যাল!”
“ইয়েস! অরিজিনাল! ম্যানেজ করেছি এক জায়গা থেকে। টু মেক দ্যা নাইট স্পেশাল!”
কিন্তু রাইয়ানের প্রত্যাশা অনুযায়ী ওর হাসিটা ছড়িয়ে পড়ল না এলিনার মুখেও। বরং ঠোঁটে লেগে থাকা ওর নিজস্ব হাসিটুকুও ধীরে ধীরে মুছে গেল।
এলিনার মধ্যে কোনো উচ্ছ্বাস না দেখতে পেয়ে রাইয়ান নামিয়ে রাখল বোতলটা। সিরিয়াস গলায় বলল, “কী হয়েছে, এলি? এনিথিং রঙ?”
“আই ক্যান্ট ড্রিংক, রাইয়ান! আমি এখন ড্রিংক করতে পারব না।“
“বাট হোয়াই? কী এমন হয়ে গেল আচমকা?”
“বিকজ…” চোখ নামিয়ে নিল এলিনা। “আয়াম এক্সপেক্টিং!”
“হোয়াট?”
“আমি সাইকেল মিস করেছি পনের দিন হয়ে গেল। স্ট্রিপ টেস্টে পজিটিভ এসেছে।“
“তুমি খুশি হওনি?”
নিজেকে তাড়াতাড়ি সামলে নিল রাইয়ান। “খুশি হব না কেন? নিশ্চয়ই হয়েছি!”
উৎকণ্ঠিত মুখে ওর দিকে এগিয়ে গেল এলিনা। দুই হাতে রাইয়ানের হাত চেপে ধরে বলল, “তাহলে হাসছ না কেন?”
“না মানে, এমন হুট করে খবরটা পেলাম…আমরা আরেকটু গুছিয়ে নিলে ভালো হতো না? আমরা দুজন তো এখনো প্রিপেয়ার্ড না! আম্মু আব্বুকেও এখনো বলা হয়নি যে আমরা বিয়ে করেছি কিংবা একসাথে থাকছি…”
“তোমার আম্মু আব্বুকে তুমি বলবে! আমার অফিসে আমি বলব। অফিসেও তো ট্রিট দিতে হবে!”
এলিনার খুশি দেখে রাইয়ানও হাসল। তবে কেমন যেন প্রাণহীন দেখাল হাসিটা।
তীক্ষ্ণ চোখে রাইয়ানকে লক্ষ্য করতে লাগল এলিনা।
চলবে,,

তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে পর্ব-০৯

0

#তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে
মৌলী আখন্দ
পর্ব-৯

এলিনা ঠিক করল আজ অফিস থেকে বাসায় ফিরে সরাসরি কথা বলবে রাইয়ানের সাথে। কথা বলা বন্ধ করে রেখে আসলে কোনো সমস্যার সমাধান হবে না।
চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকে কিছুটা অবাক হলো এলিনা। রাইয়ান ফেরেনি এখনো।
সাধারণত রাইয়ান আগেই বাসায় ফিরে আসে, এলিনারই দেরি হয় ফিরতে। ফ্রেশ হয়ে রাতের রান্নার প্রস্তুতি নিতে নিতে কথার ছক সাজাতে লাগল এলিনা।
যদিও জানে রাইয়ানকে দেখামাত্র সবকিছু এলোমেলো হয়ে যাবে তার। মাথায় চিন্তার ঝড় বইছে।
হাত চলছে, চপিং বোর্ডে টুকরো হচ্ছে ক্যাপসিকাম। অপেক্ষার প্রহর যেন আর কাটছে না।
দরজা খোলার শব্দ হতেই ন্যাপকিনে হাত মুছে এগিয়ে এল এলিনা। এদিকে পিঠ ফিরিয়ে দরজা বন্ধ করছে রাইয়ান।
এদিকে ফিরে এলিনাকে দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল সেও। তারপর এমন একটা কাজ করে ফেলল যার জন্য এলিনা মোটেও প্রস্তুত ছিল না।
কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে দুহাত বাড়িয়ে দিল। বয়ে গেল আরো একটা মুহূর্ত।
মাত্র একটা দ্বিধান্বিত মুহূর্ত, কিন্তু যেন কেটে গেল এক মহাকাল। এলিনা ছুটে এসে ঝাঁপ দিল রাইয়ানের বুকে।
পাঞ্চ ক্লিপ দিয়ে চূড়া করে বাঁধা এলিনার চুল খুলে দিল রাইয়ান। এলিনার অস্থির আঙুল তখন রাইয়ানের শার্টের বোতাম খুঁজছে।
কীভাবে যে তারা ভেতরের ঘর পর্যন্ত এল নিজেরাও বলতে পারবে না। সন্ধিটা হলো বড় অদ্ভুতভাবে।
অনেক দিন ধরে দূরে থাকা তৃষিত দম্পতির পরস্পরের কাছে আত্মসমর্পণের ঝড়ের বেগে উড়ে যাওয়া মাতাল সময় শেষে রাইয়ান যখন পাশে শুয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে এলিনা তখন ওর দিকে ফিরল।
“তুমি আরিয়ান কেমিক্যালসে জয়েন করল কবে?”
মুখ বাঁকাল রাইয়ান। “সেটা তোমার জানা থাকা উচিত ছিল! হাজব্যাণ্ডের কোনো খোঁজ খবরই তুমি রাখো না!”
সামান্য অপ্রস্তুত হলেও সেটা ঝেড়ে ফেলে দিল এলিনা, “বাজে কথা রাখো। তুমি আমাকে বলেছিলে তুমি ফ্রি ল্যান্সার। আর গত মাসেও তুমি সাইট ভিজিট করতে যেতে…“
“আমি ওদের সাথে গত বছর একটা প্রোজেক্টে ছিলাম। অনেক দিন ধরেই এপ্লাই করছিলাম। এবার পোস্ট ফাঁকা হওয়ার পর ইন্টারভিউতে রিকমেণ্ডেড হয়েছি। এ মাসেই জয়েন করেছি। আর কিছু?”
“না, আর কিছু না।“ উঠে পড়ল এলিনা।
“তাড়াতাড়ি রান্না শেষ কর”, হুকুমের সুরে বলল রাইয়ান। “অনেক দিন ধরেই ফাঁকিবাজি করছ, সব সুদে আসলে আদায় করা হবে আজকে।“
আর কথা বাড়াল না এলিনা। কিন্তু সে যখন চিন্তিত মুখে মাটিতে পড়ে থাকা ম্যাক্সিটা তুলে নিয়ে শরীরে গলাচ্ছিল তখনও তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সতর্ক করছিল তাকে।
কিছু একটা ঠিক নেই, কিছু একটা গোপন করে যাচ্ছে রাইয়ান। কিন্তু কী সেটা?
চলবে,,

তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে পর্ব-০৮

0

#তোমায় আমি দেখেছিলেম বলে
মৌলী আখন্দ
পর্ব-৮

ল্যাপটপ সংক্রান্ত ঝামেলার পর কথাবার্তা বন্ধ দুজনের মধ্যে। অপরিচিত দুই রুমমেটের মতই রুম শেয়ার করছে এলিনা আর রাইয়ান।
আজকে অফিসে আসতে একটু দেরিই হয়ে গেছে এলিনার। সামনের গাড়িটা আচমকা কোনো সিগনাল না দিয়েই লেন চেঞ্জ করল।
এক চুলের জন্য বড় মাত্রার একটা কলিশন হতে হতে হলো না। কিন্তু গাড়ির বাম্পারে লেগে ঠিকই ছিটকে পড়ে গেল এলিনা।
ফলাফল এক দফা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় আর অফিসে আসতে দেরি। ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে ঢুকে ব্যাগ টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে এলিনা দেখল সিমি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
রাগে গা জ্বলে গেল এলির। কিছু কিছু মানুষ অন্যকে বিপদে পড়তে দেখলে এত খুশি হয় কেন কে জানে?
গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করল সিমি। “এলি, তোমাকে স্যার ডেকেছেন।“
মৃদু গুঙিয়ে উঠল এলি। নিশ্চয়ই দেরি করে আসার জন্য এক দফা ঝাড়বেন।
এলির গোসল করে আসা খোলা চুল, হাতে পেঁচিয়ে রাখা মোটা রাবার ব্যাণ্ডটা দিয়ে চুলটা আটকে নিতে নিতে বলল, “যাচ্ছি!”
“দিন দিন যে রূপ খুলছে! অভিসার আজকাল বেশি হয়ে যাচ্ছে মনে হয়?”
চোখ টিপল সিমি। প্রত্যুত্তরে হাসল না এলি।
মাঝে মাঝে রাইয়ানের ফ্ল্যাটে থেকে যাওয়ার কথাটা জানে সিমি, তাই ইঙ্গিত করল আসলে। যদি জানত এক রুমে থেকেও দুজনের মধ্যে দূরত্ব দিন দিন বেড়েই চলছে…!
তাড়াহুড়ো করে স্যারের রুমের দরজা ফাঁক করে নক করল এলি। “মে আই কাম ইন স্যার?”
স্যার হাসিমুখে বললেন, “আরে, এসো, এসো! এত দেরি কেন এলিনা?”
‘জি মানে স্যার আসলে…” আমতা আমতা করল এলিনা। বাইক এক্সিডেন্টের কথাটা বলতে গিয়েও বলল না।
বড্ড বেশি অজুহাতের মত শোনাবে।
“থ্যাংক ইউ সো মাচ, এলিনা! অবশেষে তোমার জন্যই কম খরচে লিকুইড নাইট্রোজেনের ব্যবস্থা হয়েছে।“
“আমার জন্য?”
“এত অবাক হচ্ছ কেন? তুমি আরিয়ান কেমিক্যালসে যোগাযোগ করনি?”
“ও হ্যাঁ! জি স্যার, করেছিলাম, কিন্তু সেটা যে ক্লিক করবে আসলে বুঝতে পারিনি তো স্যার!”
“জেন্টলমেন, মিট হার, আমার সেকশনের জুনিয়র, এলিনা হক রাস্না। এলিনা, উনি আরিয়ান কেমিক্যালসের সেলস ম্যানেজার।“
বসের সামনে চেয়ারে যে লোকটি বসে ছিল, এতক্ষণ তার চেহারা দেখতে পায়নি এলিনা। এবার এলিনাও সামনে এল, আর উঠে দাঁড়াল লোকটিও।
এলিনার বাড়ানো হাতে হাত রেখে হাসিমুখে বলল, “রাইয়ান হাসান।“
“আমি এলিনা।“ রাইয়ানকে দেখে চমকে গেলেও দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল এলিনা।
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত হাতটা ধরে রাখল রাইয়ান, তর্জনী দিয়ে আঁচড় কাটল এলিনার হাতে। হাতটা ছাড়িয়ে নিল এলিনা।
রাইয়ানের হাতে কালো ব্রেসলেটটা দেখে অনেক দিন পর শরীরে অদ্ভুত শিহরণ ছড়িয়ে পড়ছে এলিনার। সব রাগ অভিমান ভুলে ওই হাতের কঠিন নিষ্পেষণে মোমের মত গলে যেতে মন চাইছে।
এলিনা ফিরল বসের দিকে। “স্যার আপনি কি ডীল ফাইনাল করে ফেলেছেন?”
“আমাদের হাতে সময় আছে আর কতদিন?”
“খুব বেশি সময় তো নেই। তারপরও এতটা কমও নেই স্যাম্পল টেস্ট দিয়ে পাইলটিং আর ইন্টার্নাল মিটিং কল না করে ডিসিশন নিতে হবে।“
হাত ওল্টালেন বস। “আমি তো ভেবেছিলাম তোমার রিকমেণ্ডেশন পেয়েই উনি এখানে এসেছেন।“
এলিনার মুখ পাথরের মত শক্ত, “কথাটা সত্যি। তারপরেও আমাদের প্রোটোকল মানা প্রয়োজন যাতে কোথাও কোনো ফাঁক না থাকে।“
“তুমি কীভাবে করতে চাও?”
“আমি আমার টিম নিয়ে পাইলটিং করে দেখব। টিম এপ্রোভাল দিলে তারপর আপনি ডীল ফাইনাল করবেন। আফটার অল”, এলিনা আড়চোখে রাইয়ানকে দেখে নিল একবার, “লো কস্টের জন্য কোয়ালিটি তো কম্প্রোমাইজ করতে পারি না আমরা!”
রাইয়ান ভীষণ অবাক হলেও চেহারায় প্রকাশ করল না তা। এলিনার ভাব দেখে মনে হচ্ছে অফারটা লুফে নেওয়ার বদলে সে বরং বাগড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে।
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! তুমি কাজ শুরু করে দাও।“
রাইয়ানের দিকে ফিরে ছোট্ট করে নড করে বেরিয়ে এল এলিনা। মুখে দুশ্চিন্তার রেখা।
চলবে,,