#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২|
#শার্লিন_হাসান
-“এসবের কিছুই আমি জানতে চাইনি। মুখটা বন্ধ রাখো। সব কথায় ঝড়ের গতিতে উত্তর দিতে হয়না। মাঝেমধ্যে চুপ থাকতে হয়। ধৈর্য তো নাই মনে হয় আর না আছে শালিনতা। কথায়,কথায় উত্তর দেওয়া লাগে।”
সেরিনকে ধমক দিয়ে বলে আরজিন। সেরিন নিশাতের দিকে তাকিয়ে আছে। এতো ধমকা ধমকি তার পছন্দ না। কিন্তু শুভ্র তাকে ধমকের উপরেই রাখছে।
কিছুক্ষণের মধ্যে পাটওয়ারী ভিলার গেট দিয়ে গাড়ী প্রবেশ করে। সেরিন গাড়ী থেকে নেমে নিশাতের হাত ধরে ভেতরে চলে যায়। বিশাল লিভিং রুমের সোফায় বসে আছে এমপি আরফান চৌধুরী শুভ। সাথে বসে আছেন কিরণ পাটওয়ারী এবং সিহান পাটওয়ারী।সেরিন আর নিশাতকে দেখে কিরণ পাটওয়ারী বলেন,
-বড়দের সালাম দাও মামনিরা।
সেরিন, নিশাত দু’জনে সালাম দেয়। তখন সেরিনের আম্মু সাইয়ারা আসে। তাঁদের দু’জনকে দেখে বলে,
-মিশাত, নিশাত যাও ফ্রেশ হয়ে এসো।
সেরিন, নিশাত উপরে চলে যেতে পেছন দিয়ে শুভ্র আসে। তাকে আর মাহিকে দেখে একজন সার্ভেন্ট ঠান্ডা পানীয় দেয়। সোফায় গা এলিয়ে বসে পড়ে শুভ্র। আরফিন চৌধুরী তখন বলেন,
-আর্থ তো আসলো না।
তখন শুভ্র বলে,
-হয়ত কোন কাজে চাচ্চুর সাথে আটকে গেছে।
-হয়ত!
মিশাত,নিশাত, শুভ্র,মাহি তারা ফ্রেশ হয়ে আসতে সবাই খেতে বসে পড়ে।
সাইয়ারা এবং কিরণ পাটওয়ারীর ওয়াইফ তুষি তারা খাবার সার্ভে হেল্প করছে।
খাওয়া দাওয়া শেষ হতে বড়রা সবাই গল্প গুজবে মেতে উঠে। শুভ্র মাহির রুমে সোফায় বসে,বসে ফোনে ইমফরটেন্ট কথা বলছে। সেরিন নিশাতকে বিদায় দিয়ে ভেতরে আসে। নিজের রুমে গিয়ে ফোন হাতে আর্থকে কল দেয়। কয়েকবার রিং হতে আর্থ কল রিসিভ করে। এপাশ থেকে সেরিন বলে,
-কোথায় আছো?
-চাচ্চুর সাথে কাজে আটকে গেছি শসী।
-ফিরবে কখন?
-একটু লেট হবে। কলেজ থেকে চলে এসেছো?
-হুম একটু আগেই এসেছি।
-আচ্ছা রেস্ট নেও।
-বায়।
সেরিন কল কেটে দিয়ে শুয়ে পড়ে। চোখে প্রচুর ঘুম জড়ো হয়েছে।
বিকেলের দিকে চৌধুরী পরিবারের সবাই চলে যায়। সন্ধ্যায় সিরাত পাটওয়ারী শসী আসে সেরিনের রুমে। কিরণ পাটওয়ারীর একমাত্র মেয়ে। সে এবার ইন্টার সেকন্ড ইয়ারে পড়ে। তবে তাঁদের দু’জনের কলেজ সম্পূর্ণ আলাদা। সেরিনকে ডেকে টেনেটুনে ঘুম থেকে উঠায় শসী। শসীকে দেখে সেরিন স্থির হয়ে বসে বলে,
-কখন আসলি?
-একঘন্টা আগে।
-কী দরকার ছিলো আমায় এই কলজে এডমিশন নেওয়ার। দূর তোর সাথে থাকতাম।
-এখানেই ঠিক আছে তোর।
-কেন জিজুর সাথে প্রেমের ডিস্টার্ব হয়ে যেতো নাকী?
-কে জানে বেডা কার পেছনে দৌড়াচ্ছে। সারাদিন তো এই কাজ,ওই কাজ ওর ছোট চাচ্চুর সাথে দৌড়ায়।
-জিজুর নাম কী?
-থাকুক! পরে একদিন বলবো।
সেরিন মাথা নাড়িয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়। শসী ফোন হাতে তার প্রেমিক পুরুষের একটা পিক বের করে। একনজরে তাতে তাকায়। ঠোঁটের কোণের হাসিটা কিছুটা প্রশস্থ হয়।
******
সন্ধ্যায় আফরান চৌধুরী আর্থ এবং আয়মান চৌধুরী বাড়ী ফিরে। আগামী কালকে আর্থর বাবা আরাফ চৌধুরী এবং তার আম্মু মিরা ঢাকায় চলে যাবে। তারা কয়েকদিনের জন্য বাড়ী এসেছিলো। আর্থ এখানেই থাকে এবং থাকবে। সে তার আম্মুর থেকে বেশী তার বড় আম্মুর জন্য পাগ’ল।
আজকে চৌধুরী পরিবারের সবাই একসাথে শুধু আর্থর বোন আর আয়মান চৌধুরীর মেয়ে ছাড়া। তারা ঢাকায় আছে। সন্ধ্যায় আর্থ আসতে আরজিনের আম্মু জান্নাতুল ফেরদৌস কোল্ড ড্রিং আর হালকা খাবার দেয়। পাশে আয়মান চৌধুরী সেসবে তার হেলদোল নেই। তার আর্থ ঠিকঠাক খেতে পারলেই হলো। বাড়ীতে সবাই আর্থকে একটু বেশী আদর যত্ন করে। তখন আয়মান চৌধুরী বলেন,
-আর্থকে এতো আদর করো কেন তোমারা?
তখন জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন,
-ও আমাদের পরিবারের ছোট ছেলে। আর ছোটরা আদর একটুু বেশিই পায়।আমার ছেলেটা সারাদিন কাজে দৌড়াদৌড়ি করে। সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে এটা চেয়ে আনন্দ আর কিছু আছে?
আয়মান চৌধুরীর মুখের দিকে তাকিয়ে আর্থ হেঁসে দেয়। আরজিন তখন নিচে আসে। আর্থকে দেখে বলে,
-ব্রো সারাদিন বাইরে দৌড়াদৌড়ি করলে হবে? নিজের দিকেও তো তাকাতে হবে। এসব রাজনীতি না করে ভালো কোন জব ধরো নাহয় কোম্পানি সামলাও। রাজনীতির পেছনে বাবা ছুটে, ছোট চাচ্চু ছুটে তুমি নাহয় মেঝো চাচ্চুর সাথে অফিসে জয়েন করো। দেখো আমি কলজে সামলানোর পাশাপাশি অফিসের কাজ ও করি।
তখন আরফিন চৌধুরী বলেন,
-আয়মান ঢাকায় চলে যাবে। সুলতানাকেও বলবো চলে যেতে। তারা অফিস সামলাবে। আর্থ আমার সাথে রাজনীতি করবে। আমার পর আর্থ হবে ঢাল।আমার পরিবারে রাজনীতি ওই জিইয়ে রাখবে।
আরজিন আর কিছু বলেনা। কফির মগ নিয়ে রুমে চলে আসে। তখন তার নাম্বারে একটা মেসেজ আসে। তাতে লেখা,
“শুভ্র স্যার! আমার ফিউচার বাবুর পাপা, বাবুর আম্মুকে তো উত্তরটা দিলে না। আসলে তুমি রাজী তো? দেখো আমি কিন্তু ওয়েট করে বসে আছি।”
মেসেজ দেখে মেজাজ গরম হয়ে যায় শুভ্রর। আবার সেরিন মেসেজ পাঠিয়েছে। মেয়েটাকে বকা দিয়েও কাজ হয়নি। এতো বাবুর আম্মু হওয়ার শখ তো বিয়ে করে নেক। এতে শুভ্রকে টানার কী আছে?
“বাবুর আম্মু আপনি কী জানেন শুভ্র বিবাহিত? এমনকি তার একটা বাচ্চাও আছে। তার বাবুর আম্মু আরেকজন আপনি না। আর আশাও করবেন না কখনো। আমার বাবু আছে,বাবুর আম্মুও আছে সো এসব ফাল’তু কাজ বাদ দিয়ে নিজের ক্যারিয়ারে ফোকাস করেন।”
মেসেজটা লিখে শুভ্র ব্লক করে দেয়। এসব শুভ্রর বিরক্ত লাগে। নারী সংক্রান্ত কোন বিষয়ে সে নেই। তার কলেজ সুন্দর ভাবে পরিচালনা করতে পারলেই হলো। বরাবরের মতো শুভ্রদের কলেজ উপজেলায় ফাস্ট হতো রেজাল্টের দিক দিয়ে। এই কলেজের প্রিন্সিপাল শুভ্রর দাদু ছিলেন। তার ইচ্ছে ছিলো তারপরে শুভ্র কলেজটা পরিচালনা করবে। কলেজটা তার পরিশ্রম, স্বপ্নের ফল। দাদুর কথা রাখতে শুভ্র এই পেশাটাই বেছে নেয়। লন্ডন থেকে এসে কয়েকমাস দেশের আবহাওয়ার সাথে পরিচিত হয়। শুভ্র ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে।
কিছুক্ষণ পর ফেসবুক স্ক্রোলিং করতে একটা ভিডিও সামনে আসে। ভিডিওটা মূলত অন্ধকার রুমে গাওয়া গানের। মেয়েলী ভয়েসটা শুভ্রকে টানলো। বর্তমানের ট্রেন্ড চলছে এটার। পুরো গানটা শুনে শুভ্র। গানটা ছিলো,
“যদি বারে,বারে একই সুরে প্রেম তোমায় কাঁদায়।
তবে প্রেমিকা কোথায় আর প্রেমই বা কোথায়?
যদি দিশেহারা ইশেরাতে প্রেমি ডেকে যায়।
তবে ইশারা কোথায় আর আশারা কোথায়?
যদি মিথ্যে মনে হয় সব পুরোনো কথা।
যদি চায়ের কাপেতে জমে নিরবতা,
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো কত নিরুপায়!”
শুভ্রর ভয়েসটা ভালো লাগে। আইডিটা স্টক করতে ভুলেনি। মোটামুটি ভালোই ফলোয়ার্স আছে। বেশীর ভাগ গানের ছোট,ছোট রিল ভিডিও। শুভ্র কয়েকটা গান শোনে। আইডিটা চিনে রাখে। মাঝেমধ্যে আসবে গান শোনে মন ভালো করবে। আইডির মালিকের কোন পিকচার আইডিতে নেই।
রাতে ডিনার করে সেরিন আর সিরাত গিটার হাতে বেলকনিতে বসে। চন্দ্রপ্রভায় গিটারের সুর তুলছে সিরাত। সেরিন গান গাইছে। সেরিন বরাবরের মতো গান গাইতে পছন্দ আর সে ভালো গায়। গান নাচ এই দু’টো গুণে একটু বেশী গুণান্বিত সেরিন। সিরাত গান পারে তবে খুব একটা গায় না। সে নাচে সেরিনকেও ছাড়িয়ে।
***
পরেরদিন সকালে প্রাইভেটের জন্য বেড়িয়ে পড়ে সেরিন সিরাত। দুজন দু’দিকে যাবে। সেরিন তার ব্যাচমেটদের সাথে প্রাইভেট শেষ করে পিটিতে যায়। মনে,মনে হাজারখানেক গা’লি শুভ্রকে দেয়। এখন কড়া রোদে না বসালেই হলো। আজকে শুভ্র পিটিতে এসেছে তবে কোন ভাষন দেয়নি। বিষয়টা অষ্টম আশ্চর্য। এমন কোন দিন যায়নি সে ভাষণ দেয়নি। আজকে শুভ্র ভাষণ দেয়নি বিষয়টা কেউ হজম করতে পারছে না। নিশাত সেরিনকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
-ইয়ে কেয়া হুয়া বান্দুফি? তোর এক বকায় বেডা সোজা! আমার মনে হয় এই শুভ্র স্যারকে একমাত্র তুই সোজা করতে পারবি।
-আরে ভাই আগামী কালকে দেখবো ঠিকই ভাষন দিচ্ছে।
-আর দিবেনা মনে হয়। কবে দেখা যাবে পিটিই বাদ দিয়ে দিলো।
-দিলে তো ভালোই। বা’লের পিটি করতে বিরক্ত লাগে।
শুভ্র পিটি শেষ হতে নিজের রুমে চলে যায়। আজকে সে ফাস্ট ইয়ারের প্রথম ক্লাসটা নিবে বলে ঠিক করে। ভাবনা অনুযায়ী ফাস্ট ইয়ারের সাইন্সের রুমে চলে যায়। শুভ্রকে দেখে অনেকেই বিরক্তবোধ করে। বিশেষ করে সেরিন,নিশাত। বেশীরভাগ মেয়েরা খুশি। তাদের ক্রাশ,হ্যান্ডসাম শুভ্র স্যার। যার কাছে এটেনশন পাওয়া যায় না।
সেরিন ভাবছে শুভ্র, না জানি কত ভাষন দেয়। শুভ্র ক্লাসে প্রবেশ করাতে ক্লাস ঠান্ডা। একটা শব্দও হচ্ছে না।
তখন শুভ্র ক্লাসে চোখ ভোলায়। ঠিক সেরিনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। চোখ দিয়ে ইশারা করতে সেরিন দাঁড়ায়। শুভ্র তখন বলে,
-পৃথিবীতে একজন মানুষ যার ব্রেইন সবচেয়ে বেশী চিন্তা করেছে বা খরচ করা হয়েছে। এমনকি তার মাথাটা সংরক্ষণ করা হয়েছে মিউজিয়ামে। কে সেই ব্যক্তি?
তখন সেরিন বলে,
-আইনস্টাইন।
– কত পার্সেন্ট খরচ করা হয়েছে?
– ১০০% এর ২.৫% মাত্র।
-গুড।
তখন শুভ্র বলতে শুরু করে,
– প্রতিষ্ঠিত হতে হলে পড়াশোনার বিকল্প নেই। একটা কথা মনে রাখবে “এডুকেশন ইজ দ্যা কে টু সাকসেস।”
অধ্যবসায় নিজেকে অভ্যস্ত করতে হবে। ভালো একটা রেজাল্ট নিয়ে ভালো ভার্সিটি এডমিশন নিবা। কেউবার স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে পড়াশোনার জন্য যাবা। সবচেয়ে বড় কথা মনে জোর,তেজ রাখতে হবে। এবং ছাত্রদের অবশ্যই সাপোর্ট প্রয়োজন।
তখন একটা ছেলের ফোনের সাইলেন্ট করা কলের শব্দ হয়। কথার মাঝে, শুভ্রর কানে আওয়াজ আসতে সে জিজ্ঞেস করে,
-শব্দটা কোথা থেকে এসেছে? কেউ বলতে পারবে?
তখন সেরিন বলে,
-এই ছেলেগুলোর থেকে।
-ক্লাসে ফোন নিয়ে এসেছে কে?
শুভ্র ছেলেদের সামনে যায়। তখন একটা দাঁড়িয়ে বলে,
-স্যার ওটা সেরিনের ব্যাগ থেকে শব্দ হয়েছে। আর দোষ দিচ্ছে আমাদের।
তখন শুভ্র ধমক দিয়ে বলে,
-লজ্জা করেনা? আমি বলেছি ক্যাম্পাসে ফোন এলাউ না। আমি ধরতে পারলে খবর করে ছেড়ে দেবো বলে দিলাম।
তখন আরেকটা ছেলে দাঁড়িয়ে বলে,
-স্যার সেরিন কলেজে ফোন এনেছে।
তখন সেরিন দাঁড়িয়ে বলে,
-নিজেদের দোষ আমার গাড়ে দিচ্ছিস কেন? লজ্জা করেনা? মেয়েদেরকে তো র্যাগ ভালো করিস। আমি বিচার দেইনা দেখে। যখন তোর হাত পা ভে’ঙে দেবো তখন বুঝবি এই সেরিন কী জিনিস।
তখন ছেলেটা বলে,
-তুই কী হাত পা ভাঙবি? বিচার দিয়েছিস না আমাদের নামে বাড়ী যাবি না? রাস্তায় ফেলে তোকে…. ”
ঠাস করে দু’টো চ’ড় পরে যায় ছেলেটার গালে। শুভ্র কলার ধরে টেবিল থেকে বের করে এনে ছেলেটার গাড় বরাবর একটা লা’থি মারে।
চিৎকার করে বলে,
-আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। আমার কলেজে না চলবে র্যাগিং না চলবে গুন্ডামি, না চলবে রাজনীতি, না চলবে নেতাগিরি। এই কলেজে কোন রাজনীতি চলবে না। তোর নাম কী?
ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলে। তখন একজন বলে,
-আকাশ।
#চলবে