হৃদয় সায়রে প্রণয়ের ছন্দ পর্ব-২৫+২৬

0
501

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২৫|
#শার্লিন_হাসান

সেরিন মুচকি হেঁসে বলে,
“কঠোর ব্যক্তিত্বের সুন্দর মনের মানুষটা।”
তখন শুভ্রকে মেহের বলে,

‘জিজু তুমি কী দেখো আয়নায়?”
তখন শুভ্র মুচকি হেসে আয়নায় সেরিনের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আকাশ থেকে নেমে আসা চঞ্চল পরীটা আমার অর্ধাঙ্গিনী।”

উপস্থিত সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলে। আরফিন চৌধুরী তাদের দুই হাত এক করে চার হাত করে দেন। শুভ্র এবং সেরিনের দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘সবসময় একে অপরের পাশে থেকো। সুন্দর একটা অধ্যায় শুরু করো। অনেক দোয়া এবং শুভকামনা রইলো তোমাদের জন্য।’

সেরিন শুভ্রর দিকে পলক ফেলে। তখন তুষি এবং সুলতানা খানম মিষ্টি সাথে খেজুর নিয়ে আসেন। সবাইকে মিষ্টি মুখ করান। সেরিন,শুভ্র খেজুর খায়। তাঁদের বিয়ে সম্পূর্ণ হতে ফটোশুট চলে কিছুক্ষণ। চৌধুরী পরিবারের সবাই লান্স করতে বসে গেছে। আর্থ,মাহী,অক্ষর, কিরণ পাটওয়ারী খাবার সার্ভ করছে।
এদিকে সেরিন শুভ্রকে নাচাচ্ছে। মানে ভিডিও বানাচ্ছে মিররে। শুভ্র নিরামিষ হলেও সেরিনের কথায় ভাবভঙ্গি চেন্জ করে ভিডিওতে আসতে হচ্ছে। শুভ্র মেয়েটার দিকে তাকায়! সে এসব একদম পছন্দ করে না বললে ভুল হবে এসব ছবি,ভিডিও,শো অফ করে না। কিন্তু তার বউটা সম্পূর্ণ তার বিপরীত। পিক তুলে ফেসবুক ওয়ালে ঝুলাতে হবেই হবে। ভিডিও বানাতেই হবে।

তাঁদের পিক তোলা হতে খাওয়ার জন্য বসে পড়ে। সব কাজিনরা মিলে একসাথে বসেছে। শশী,মেহের,রাফা,সাফা,শুভ্র,সেরিন,অক্ষর, আদ্রিতা,অধরা। আদ্রিতা মেয়েটা সেরিনের পাশেই বসেছে। সে যে ভীষণ খুশি সেরিনকে দেখে। তাঁদের বাকী গল্প চৌধুরী বাড়ীতে হবে। খাওয়া দাওয়া শেষ হতে তারা সবাই ফ্যামিলি পিকচার তুলে। চৌধুরী পরিবারের সাথে সেরিনের শশুর শাশুড়ী,শুভ্র এবং সেরিন। তাঁদের মেইন ছোট্টো পরিবার।

সবশেষে তাঁদের বিয়ের জন্য একটা কেক আনা হয়। সেটাই কেটে খাওয়া হয়। ভীষণ সুন্দর একটা দিন কাটে তাঁদের। পাটওয়ারী বাড়ী থেকে বিদায় নিতে,নিতে সন্ধ্যার পর হয়ে যায়। সেরিনের সাথে শশী,মেহের,সাফা,রাফা,মাহী যাবে। তারা রুম সাজিয়ে আবার একটা,দুইটার দিকে চলে আসবে পাটওয়ারী বাড়ীতে। যেহেতু তাঁদের নিজস্ব গাড়ী নিয়েই যাবে সেজন্য জামেলা হবে না।

সেরিনকে নিয়ে চৌধুরী বাড়ীতে রওনা হয় আটটার দিকে। বিদায়ের সময় সেরিনের সে কী কান্না! তবে একটু অভিমান জমেছে তার বাবার উপর সাথে শুভ্রর উপর ও। সেসব এখন প্রকাশ করবে না তবে অভিনান তোলা রইলো।

অক্ষর সেরিনকে বিদায় দিয়ে বাকীদের থেকেও বিদায় নিয়ে তার বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয়। বাড়ীতে যাবে কী! তার তো মন ভীষণ খারাপ। শুভ্র কীভাবে থাবা মেরে তার জিনিস নিয়ে গেলো। ভাবলে রাগে শরীর জ্বলে অক্ষরের। সে চাইলে জোর করে সেরিনকে বিয়ে করতে পারতো। করেনি! কারণ তার পারিবারিক শিক্ষা এতোটাও ঠুনকো নয়। পছন্দ করেছে, অনুভূতি জমিয়েছে তবে প্রকাশ করেনি। সেজন্য কারোর কাছে হাসির পাত্র হয়নি! সামনে তার জন্য ভালো কেউ আছে এটাই মনে করে অক্ষর।

নতুন বউ চৌধুরী বাড়ীতে প্রবেশ করে। সেরিন এর আগে কখনো এই গেট দিয়ে প্রবেশ করেনি। বাইরে থেকেই বাড়ীর আকৃতি ভেবে নিয়েছে। তবে তার কল্পনার থেকে কোন অংশে কম নয় বাড়ীটি। বিশাল লিভিং রুমের একটা সোফায় সেরিনকে বসানো হয়। সার্ভেন্ট তাদের সবাইকে ওয়েলকাম ড্রিং দেয়। সেই সাথে কফি, টুকটাক খাবার দেয়।

কাজের বুয়া রান্না অনেকটা চাপিয়ে নিয়েছে। তবে জান্নাতুল ফেরদৌস ফ্রেশ হয়ে কিচেনে উঁকি মারেন।
বাকীরা সেরিনকে নিয়ে গল্পে বসেছে।

শুভ্র নিজেও ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে। সেরিনকে নিয়ে বাকীরা গল্প করছে। সেও তাতে যোগ দেয়। তবে বেশী কথা বলেনা। কী জানি একটা বলবে আর সেটা সেরিনের পছন্দ হবে না। তখন সেরিন সবার সামনেই তাকে তুই তোকারী, গা’লি দিবে। শুভ্র সব বিশ্বাস করতে পারলেও সেরিনের রাগ আর তুই তোকারী উইথ গা’লি না দেওয়াকে বিশ্বাস করে না। ওটা যেকোনো জায়গায় চলে আসে।

আর্থ, মাহী,মেহের,সাফা তারা শুভ্রর রুম ফুল দিয়ে সাজাচ্ছে। তবে বাকীরাও ভাগ আছে এটায়। তারা এখন গল্প করছে বাকীদের সাথে।

মিরা ইসলাম শশীকে দেখছে। মেয়েটাও তাঁদের বাড়ীতে আসবে বেশী দেরী নেই। বেশ শান্তশিষ্ট,নিরব প্রকৃতির। কথাবার্তায় কী যে মাধুর্যতা। মেয়েটাকে দেখলেই কাছে টেনে আদর করতে মন চায়। কিন্তু তার যেই ছেলে! প্রকাশ না করলেও জানে ছেলেটা কেমন ঠোঁট কাটা। কখন বলে বসে আম্মু ওটা আমার হক। ওতো আদর করতে হবে না।

ভাবতে মুচকি হাসেন মিরা ইসলাম। তাঁদের গল্প,আড্ডায় রাত প্রায় বারোটা বেজে যায়। সবাই রাতে হালকা ডিনার করে নেয়। সেরিন চেঞ্জ করার সুযোগ পায়নি। তাকে আগে,আগে শুভ্রর রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
শুভ্র কফির মগ নিয়ে রুমের সামনে আসতে তাকে আটকে দেওয়া হয়। এমনিতে সে প্রচুর টায়ার্ড। সেজন্য আর বেশী কিছু বলেনি। টাকার বান্ডেল আর্থর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,
” তোর বিয়েতে তার থেকে দ্বিগুণ উশুল করবো আমি।”

“ঠিক আছে সমস্যা নেই। শালিকা মহলের কাছে তোমায় ছেড়ে দিয়ে আমি বাসর ঘরে ঢুকবো। বলবো যা দরকার আমার ভাই দিবে। কেউ আবার নেগেটিভ ভাবে নিও না।”
মাথা চুলকে বলে আর্থ। তখন শুভ্র তার পিঠে দুটো লাগিয়ে বলে,
“মুখটা সামলা ছোটো। সেরিন জানলে তোর খবর করে দিতো এখনি।”

“খবর মানে ওই সেরিন আমার আর্থর মুখটাই ভে’ঙে দিতো।”

মনে, মনে বলে শশী। টাকা নিয়ে বাকীরা সরে যায়। শুভ্র রুমে ঢুকেই দরজা লক করে দেয়। সেরিন তার জামাকাপড় বের করতে ব্যস্ত। তখন শুভ্র কফির মগ রেখে বলে,

“নতুন বউরা লজ্জা,লজ্জা মুখ করে বসে থাকে। আর তুমি লজ্জা তো নাই আবার এখানে দাঁড়িয়ে আছো?”

“লজ্জা পেয়ে লাভ আছে বলুন? সেই তো আপনিই! আর ওতো লজ্জা পেলে চিঠি দিতাম না।”

শুভ্র কিছু বলেনা। সে সোফায় বসে কফিতে চুমুক দিচ্ছে। সেরিন গহনা খুলে চেন্জ হতে চলে যায়। অনেকক্ষণ পার হতে শুভ্র উঠে বেলকনিতে যায়। রাত অনেক গভীর। নিচের দিকে তাকাতে দেখে অন্ধকারে কেউ বাড়ীর পেছন দিক থেকে এসে মেইন ডোর দিয়ে প্রবেশ করছে। আশ্চার্য ব্যপার লাইট এখন অফ কেনো? পাটওয়ারী বাড়ীর সদস্যরা চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে। শুভ্রর কৌতুহল বেড়েই চলেছে। না আর নিজেকে দমিয়ে রাখা সম্ভব না। রুমে এসে ফোনের ফ্লাশ অন করে বাইরে বের হয়। পুরো বাড়ী অন্ধকার। হাত মেললে হাত দেখা যাবে না। লিভিং রুমে ড্রিম লাইট ও অন করেনি কেউ। শুভ্র ফোনের ফ্লাশ দিয়েই মেইনডোর খোলে বাইরে বের হয়। বাইরের লাইট অন আছে। সাত পাঁচ না ভেবে বাড়ীর পেছনে যায় শুভ্র। কিন্তু নতুন কিছুই পেলো না বা দেখলো না। শুভ্র লম্বা করে একটা শ্বাস নেয়। পেছনে শুধুই দেওয়াল এখানে কিছুই নেই। দ্রুত পা ফেলে প্রস্থান করে শুভ্র। এসব শুধুই তার চোখের ভুল। আর বাড়ীর প্রত্যেকটা কোণ সম্পর্কে ধারণা আছে শুভ্রর। তারউপর সিসি ক্যামেরা তো আছেই। অন্ধকার কিছুই নেই এই বাড়ীতে।

রুমে আসতে দেখে সেরিন বসে আছে সোফায়। তার হাতে ফোন। শুভ্রকে দেখে অনেকটা চমকে যায় সেরিন। শুভ্র ফোনটা বেডের পাশের টেবিলটায় রাখে। সেরিনের দিকে একনজর তাকায়। ব্লাক কালার শাড়ী পরিধান করেছে মেয়েটা। সেরিন শুভ্রর দিকে তাকিয়ে শুধায়,
“এই কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”

“বাইরে।”

“এতো রাতে?”

“না বেলকনি দিয়ে দেখলাম কেউ বাড়ীর পেছন থেকে ভেতরে প্রবেশ করছে।”

“মাথাটা গেছে আপনার। এই রাতে বাইরের লোক তাও বাড়ীর ভেতরে? সবাই টায়ার্ড তাই ঘুমাচ্ছে।”

“হুম হয়ত আমার দেখার ভুল।”

“চলো তোমায় একটা কিছু দেখাই।”

শুভ্র উঠে সেরিনের হাত ধরে। তাকে নিয়ে বেলকনিতে যায় শুভ্র। হাত দিয়ে বাড়ীর সামনের পূর্ব সাইডের একটা কোণ দেখায় শুভ্র। সেরিন সেদিকটায় তাকায়। শুভ্রর হাত খামচে ধরে বলে,
“এই রাতে আপনি আমায় সাদা দেওয়াল দেখাচ্ছেন? এটা তে কারোর ক’বর মনে হচ্ছে। এই আপনার মতলব টা কী? আপনি আমায় রাতের বেলায় এসব কী দেখাচ্ছেন?”

“আরে ওটা আমার আম্মুর ক’বর।”

“কিন্তু আপনার আম্মু তো ওই আন্টি।”

“না ওনি আমার আসল মা না।”

সেরিন আর কিছু বলেনা। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্য বলে,
“আচ্ছা চলুন আমার ঘুম পাচ্ছে।”

শুভ্র ও আর কথা বাড়ায়না। তারা দুজনে রুমে প্রবেশ করে। শুভ্র বেলকনির দরজা লাগিয়ে দিয়ে খাটের কাছে আসতে,আসতে দেখে সেরিন চোখ বন্ধ করে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়েছে। মনে হয় বেশী টায়ার্ড। শুভ্র ডাক দিবে যদি গা’লি শোনে সেইজন্য ভয়ে ডাক দিচ্ছে না।

বিছানায় গা লাগাতেই ঘুমের ঘোরে তলিয়ে যায় সেরিন। শুভ্র সেরিনের পাশে শুয়ে পড়ে। উপরে খাঁচার মতো ফুলগুলো ঝুলছে। কত সুন্দর একটা মূহুর্ত অথচ তার বউ ঘুমাচ্ছে। শুভ্র যতটা দেখায় ততোটাও আনরোমান্টিক না। কিন্তু সেরিন যতটা শো অফ দেকায় ততোটা রোমান্টিক না। শুভ্র আজা ইরা ওভার থিংকিং করছে। পরক্ষনে মনে পড়ে সেরিনের জন্য কিছু গিফ্ট এনেছিলো। কিন্তু দিবে কী? মেয়েটা তো ঘুমিয়ে গেছে। সবকিছুতেই তাড়াহুড়ো এমনকি ঘুমানোর সময়ও।

শুভ্রর জল মার্কা বাসর কাটলো। এই শোকে তো চার দিন তালে পাথর হয়ে থাকতে হবে। সমান্য গিফ্ট দিবে সেটার ও সুযোগ নেই। বাকী সব তো পরের হিসাব। সেরিন এখনো ছোটো। তার শশুরকে দেওয়া কথা মনে পড়ে শুভ্রর। আহারে শশুর মশাই কী একটা বাচ্চা আমার কপালে জুটিয়ে দিলেন। থাক আমিই তো নিলাম একে।

সকাল বেলা শুভ্রর এলার্মে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ঘুম ভেঙে যায় সেরিনের। তার মাথার পাশের টেবিলটায় রাখা এর্লাম। চোখ বন্ধ করে হাতড়ে সেটা হাতে নিয়ে সামনের দিকে ছুঁড়ে মারে। পড়ার কোন শব্দ হয়নি দেখে সেরিন পিটপিট চোখ মেলে তাকায়। সামনে তার প্রাণপ্রিয় স্বামী মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

সেরিন তড়িঘড়ি উঠে শুভ্রর কাছে যায়। কী বলবে,কী করবে ভেবে পাচ্ছে না তারউপর ঘুম থেকে উঠেছে মাত্র। সেরিন একবার এদিকে যায় তো আরেকবার ওইদিকে। ব্যথা সত্যি পেয়েছে নাকী পায়নি সেটা জানে না। সে ফাস্ট এইড বক্সের জন্য ছুটাছুটি করছে। শুভ্র কপাল থেকে হাত সরিয়ে সেরিনের কান্ড দেখছে। সবগুলো ড্রয়ার টেনেটুনে শেষ। কয়টা খোলতে পেরেছে কয়টা পারেনি লক করা। তবে ফাস্ট এইড বক্স সে আবিষ্কার করতে পারেনি। হতাশ হয়ে শুভ্রর কাছে এসে বলে,
“বেশী ব্যথা পেয়েছেন? ঘড়িটা মাথায় গিয়ে লেগেছে?”

“আমি তোমাকে একবার ও বলেছি ঘড়িটা আমার মাথায় লেগেছে বা ব্যথা পেয়েছি?”

“ওহ কই না তো বলেননি।”

“তাহলে ব্যাঙের মতো লাফাচ্ছো কেন?”

“না আসলে। আমি ভেবেছিলাম?”

“ভেবেছো ভালো করেছো এখন এটা এক্সপ্লেইন করতে হবে না।”

“এমাহ সকাল,সকাল মুড এতো কড়া কেন?”

শুভ্র সেসবে পাত্তা দেয়নি। শুভ্রর এমন মেজাজ দেখানো সেরিন ও বেশী পাত্তা দেয়নি। সে আশেপাশে তাকিয়ে ফ্লোর থেকে ঘড়িটা তুলে টেবিলের উপর রেখে দেয়।

ফ্রেশ হয়ে আসতে দেখে শুভ্র ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছে। সেরিন সেসবে পাত্তা দেয়নি। সে নিচে যায়। বাড়ীর কেউই এখনো উঠেনি। ঘড়ির দিকে তাকাতে দেখে সকাল ছয়টা বাজে। সেরিনকে দেখে একজন সার্ভেন্ট কফির মগ দিয়ে বলে,
“শুভ্র স্যারের কফি।”

“এতো তাড়াতাড়ি?”

“স্যার নামাজ পড়ে কফি খেয়ে হাঁটতে বের হোন সবসময়।”

সেরিন কফির মগ নিয়ে রুমে প্রবেশ করে। শুভ্রর সামনে কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“আপনার কফি।”

“তোমার থেকে কফি চেয়েছি আমি?”

“না।”

“তো?”

শুভ্র উঠে বেলকনিতে যায়। সেরিনও পেছন,পেছন কফির মগ নিয়ে যায়। শুভ্র তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। শুভ্র বেলকনি থেকে রুমে আসে। সেরিন ও রুমে আসে। সে বাইরে যায় লিভিং রুমে। সেরিনও কফির মগ নিয়ে তার পেছনে ঘুরতে থাকে। কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করিয়ে রুমে আসে শুভ্র। সেরিন সেই কফির মগ নিয়েই রুমে আসে। শুভ্র সোফায় বসতে সেরিন কফির মগ পুনরায় এগিয়ে দিয়ে বলে,
“স্যরি! আসলে আমার প্রচুর ঘুম এসেছিলো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। আসলে আমি বুঝতে পারিনি। যাই হোক যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে সেই তো সকাল হলে আপনি এভাবেই আমায় ঘুরাতেন আপনার পেছনে।”

” কিছুই ঠিক হয়নি! গতকাল রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর শাস্তি এটা। এই যে আমার পেছনে তোমায় ঘুরালাম কিছুক্ষণ।”

“আরে আমি এখনো বাচ্চা গতকাল রাতে জেগে থাকলেও….

” তো তোমার কী মনে হয় গতকাল রাতে আমি তোমার সাথে বাসর করতাম?”

সেরিনের কথায় পোড়ন কেটে বলে শুভ্র। সেরিন চুপসে গিয়ে দৃষ্টি নত করে নেয়।
#চলবে

#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|২৬|
#শার্লিন_হাসান

“তো তোমার কী মনে হয় গতকাল রাতে আমি তোমার সাথে বাসর করতাম?”

সেরিনের কথায় পোড়ন কেটে বলে শুভ্র। সেরিন চুপসে গিয়ে দৃষ্টি নত করে নেয়। শুভ্র কফিতে চুমুক দেয়। সেরিন খাটের উপর গিয়ে বসে। তখন শুভ্র বলে,
“ব্রেকফাস্ট করার সময় হয়ে আসছে। আবার তো তোমার তৈরী হতে লেট হবে।”

“হোক সময়। ভাল্লাগেনা আমার ঘুম আসছে।”

“তাহলে ঘুমাও। আমি জাগিয়ে দেবো।”

সেরিন আর কথা বাড়ায়না। চুপচাপ শুয়ে পড়ে। শুভ্র কফিটা শেষ করে ল্যাপটপ নিয়ে বসে।

বাকীরা অনেকটা লেট করে ঘুম থেকে উঠে। ব্রেকফাস্ট করার সময় হতে শুভ্র সেরিনকে ডেকে তুলে। তারা দু’জন এক সাথে নিচে যায়। সেরিন তার শাশুড়ীদের সাথেই বসেছে। সামনের সারিতে শুভ্র,আর্থ,আয়মান চৌধুরী তারা বসেছে। আর্থ শুভ্রকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
“কেমন কাটলো ফুলসজ্জা? ”

“ভীষণ বাজে।”

“থাক সামনে আরেকবার আছে। তখন সুন্দর কাটলেই হবে।”

“ছোট ছোটর মতো থাকতে পারিস না? বড় ভাই,ভাবীর পার্সোনাল ম্যটারে ঢুকছিস কেন?”

“কিসের ছোট? কে ছোটরে ভাই? আমি হাইটে তোমার থেকে কোন অংশে কম না। বয়সটা তো ম্যটার করে না।”

তাঁদের নাস্তা খাওয়া হতে সেরিন আদ্রিতা আর অধরার সাথে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগামী কালকে পাটওয়ারী বাড়ীর সদস্যরা আসবে। শুভ্র ব্রেকফাস্ট করে রেডি হয়ে চলে যায় কলেজের উদ্দেশ্য। আজকে একটু লেট হয়ে গেছে তার। আদ্রিতার সাথে যত কথা আছে আজকের মতো শেষ করে সেরিন। অনেকটা সমশ তাঁদের সাথে কাটিয়ে শুভ্রর রুমে আসে সেরিন। রুমটা গুছিয়ে নিয়ে শুভ্রকে কল লাগায়। বেশ কয়েকবার রিং হতে শুভ্র কল তোলে। তখন সেরিন বলে,
“আচ্ছা চিঠিগুলো কোন ড্রয়ারে?”

“তিন নাম্বার ড্রয়ারে। চাবি ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে।”

“আচ্ছা।”

“শোনো? ”

“বলুন?”

“তুমি আজকে চিঠি পাঠিয়েছো?”

“মাথা খারাপ আপনার? আমি চিঠি পাঠাবো কেন? আর কখনই বা পাঠাবো? আপনি তো সাথেই ছিলেন।”

“তাহলে কে পাঠালো?”

“জানি না।”

সেরিন মুখের উপর কল কেটে দেয়। সে ড্রয়ার থেকে চিঠি বের করে তাতে হাত ভোলায়। তবে কয়েকটা চিঠি অচেনা লাগলো। যেগুলো সে দেয়নি তবে তার হ্যান্ড রাইটিং এর মতোই। সেরিন চিঠিগুলো সাইড করে রাখে। শুভ্র আসলেই জিজ্ঞেস করবে।

********

শুভ্রর বিয়ের খবর কোন ভাবে তার স্টুডেন্টদের কেউ জেনে যায়। তবে তার বউ কে সেটা কেউ জানে না। জানে শুধু বিয়ে করেছে। বিশেষ করে কলেজের স্টুডেন্টরা জানে। সেকন্ড ইয়ার টু ফাস্ট ইয়ার। অনেকের দিল ভে’ঙে গেছে। তারউপর শুনেছে রিলেশনের বিয়ে। সত্য মিথ্যে সেসব জানার প্রয়োজন নেই হুজুগে বাঙালি বলে কথা।

শুভ্র কলেজ ছুটি হতে বেশী লেট করেনি। সোজা বাড়ীতে চলে আসে। আর্থ,আয়মান চৌধুরী বাজারে গেছে। আগামী কালকের অনুষ্ঠানের বাজার। শুভ্র শাওয়ার নিয়ে লান্স করতে চলে যায়। বাকীরা করে নিয়েছে কিছুক্ষণ আগে। শুভ্র রুমে আসতে দেখে সেরিন কলে কারোর সাথে কথা বলছে। সেসবে আর পাত্তা দেয়নি শুভ্র। সেরিন কল কেটে শুভ্রর সামনে দু’টো চিঠি রাখে। শুভ্র ব্রু কুঁচকে শুধায়,
“এগুলোতে কী হয়েছে?”

“এগুলো কে দিয়েছে আপনায়?”

“তুমি!কেনো?”

“আমি দেইনি। আমি যখন ঢাকায় ছিলাম তখন কোন চিঠি দেইনি। আর পরে যখন দিলাম ধরাই তো খেয়ে গেলাম।”

“তোহ এতোগুলা চিঠি কে দিলো?”

“বাকীগুলো কই?”

” ভালো লাগেনি। টান আসেনি তাই পুড়িয়ে ফেলেছি।”

“গুড। এবার একে খুঁজে বের করুন যে বা হাত ঢুকাতে চেয়েছে।”

“আচ্ছা করবো একটু সময় দাও।”

সেরিন চিঠিগুলো ডাস্টবিনে ফেলে দেয়। সোফায় বসতে,বসতে বলে,
“আচ্ছা বলুন তো সেদিন আমায় চ’ড় মারতে গিয়েছিলেন কেন?”

“কবে?”

“ওই যে সেন্সলেস হয়ে গেলাম।”

“যেই মেয়ে আমার ধমকে সেন্স লেস হয়ে যায় সেই মেয়ে এখন আমায় ধমকায়।”

“আরে বলুন তো?”

“তুমি তো ঢাকায় চলে যাইবা। তাই একটু কিছু লিখে দিয়েছিলাম। কী লিখেছি আপাতত মনে নেই। সেদিন কোন কারণে রাগ উঠেছিলো তোমার ফুফির উপর। আর আমি তোমার রুমের লেখাগুলো দেখেই বুঝে নিয়েছি তুমি চিঠি দেও আমাকে।”

সেরিন হা হয়ে যায়। মুখ বাকিয়ে বলে,
“ওই উল্টাপাল্টা ঘুরানো লেখা আপনি এক দেখায় বুঝে নিয়েছেন?”

“তোহ কেমন লাগে? নিজেকে এতো চালাক ভাবো তুমি?”

“না।”

“কী জেনো লেখা ছিলো?”

“Nizar Roshat rbuab Apaap”

“প্রথমটা আরজিন এর উল্টাপাল্টা দ্বিতীয়টা শুভ্রর লাস্ট দুটো অক্ষর আর মিশাত নামের লাস্ট চারটা অক্ষর। বাকীটা হলো বাবুর পাপা।”

“যাই হোক আপনার মতো চালাক ব্যক্তিকে যতটুকু বেকা বানিয়েছি আমার মতো মেয়ে সেটাই কম কী?”

“আসলেই! যাই হোক তুমি পাশ করেছো জিতেছো।”

“আসতাগফিরুল্লাহ আমি টিচার বিয়ে করেছি। ছিঃ! আপনার লজ্জা করলো না আমার বাড়ী বিয়ের প্রপোজাল পাঠাতে।”

“এই তুমি খোটা দিচ্ছো?”

“না।”

**********

পরের দিন সকালে চৌধুরী বাড়ীতে কাজের ব্যস্ততা পড়ে যায়। পাটওয়ারী বাড়ীর মেহমান আসবে। তবে শুভ্র বা সেরিন এখন যাবে না। তারা কয়েকদিন পর যাবে। সেরিনকে অফ হোয়াইট কালারের গাউন পড়ানো হয়। খুবই সিম্পলের মধ্যে একটা গাউন। নেই তেমন কোন সাজ। তবে তার চুলগুলো ফুল দিয়ে মোড়ানো হয়েছে। সবাই মিলে সুন্দর একটা দুপুর কাটালো। প্রায় সন্ধ্যার দিকে বিদায় নিয়ে সবাই চলে যায়। সেরিন শুভ্রর দিনগুলো সুন্দরই কাটছে। তবে সেরিনকে পুনরায় টিসি নিয়ে শুভ্রর কলেজে চলে আসবে। মিউজিক একাডেমি তে এখন আর যাওয়া হবে না। কী জানি! আবার কবে এডমিশন নেয়।

এরই মাঝে কেটে যায় বেশ কয়েকদিন। সেরিন এখনো কলেজে নিয়মিত হয়নি। হবে আস্তেধীরে তবে বাড়ীতে শুভ্র তাকে ভালোই গাইডলাইন দেয়। সময়টা সন্ধ্যা বেলা। নাস্তা করে শুভ্র ল্যপটপ নিয়ে বসেছে। সেরিন ফোন নিয়ে ব্যস্ত। আজকাল ফোনে একটু বেশী সময় দিচ্ছে সেরিন। যেটা শুভ্রর পছন্দ না। ক্যারিয়ার গড়ীর বয়সে কিসের আবার ফোন? শুভ্র প্রথমে কিছু বলেনি। সেরিনের কথা ছিলো সন্ধ্যায় বই নিয়ে বসবে। কিন্তু সেসবে তার হেলদোল নেই দেখে শুভ্র প্রথমে বলে,
“সেরিন ফোন রাখো।”

“শশীর সাথে কথা বলছি।”

“আমি এক কথা দুইবার বলতে পছন্দ করি না।”

“তাতে আমি কী করবো শুনি? আমার কাজ দেখেই তো…..

শুভ্র চোখ গরম করে বলে,
” আবার বলো কথাটা?”

“না থাক। আচ্ছা রেখে দিচ্ছি ফোন।”

সেরিন ফোন বিছানায়া রেখে বই একটা হাতে নিয়ে শুভ্রর সামনের সোফায় বসে। তখন শুভ্র ধমকে বলে,
“এর পর থেকে ত্যাড়ামী করলে বা ফোন নিয়ে বসে থাকলে একটা থা’প্পড় দেবো একবারে কালা হয়ে যাইবা।”

“আমি বিয়ে করেছি কেনো শুনি?”

“কেনো?”

“জামাইকে নিয়ে পিক তুলতে। জামাইয়ের সাথে রোমান্স করতে পড়ালেখা করার জন্য না।”

“তোমার বাপ শর্ত দিয়েছে তার মেয়ের স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। সো এখন এসব পিকচার, রোমান্স সাইডে রেখে পড়াশোনায় মনোযোগ দাও নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবো।”

“আরে বিয়ের পর কিসের আবার ক্যারিয়ার?”

“আসলে তুমি একটা বেয়াদ’ব। বিয়ের পর কিসের ক্যারিয়ার মানে? বিয়ে হয়েছে বলেই কী সব শেষ? তোমায় সংসার করতে হবে না। তুমি ক্যারিয়ারে ফোকাস করো। নিজের অবস্থান শক্ত করো।”

“আপনার মতো কয়জন এভাবে ভাবে বলুন তো? সবাই তো বলে বিয়ের পর মেয়েদের কিসের পড়ালেখা কিসের আবার ক্যারিয়ার। ঠিক আপনি যেভাবে আমার বাবাকে কথা দিয়েছেন এমন অনেকেই দেয়। কিন্তু দিনশেষে দেখা যায় এসবের দাম থাকে না। দুইদিন না যেতে বাচ্চা তখন বলে কিসের ক্যারিয়ার আর পড়াশোনা মনোযোগ দিয়ে সংসার করো আর বাচ্চা সামলাও।”

“এসব ভাবার জন্য সুন্দর একটা মন মানসীকতা লাগে।”

“ভালো। কিন্তু আপনি জানেন কী আমার পড়াশোনা করার ইচ্ছে আর নেই। পড়ালেখা যেই কঠিন।”

“তাহলে তোমায় বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দেবো। একবারে উচ্চ মাধ্যমিক হলে নিয়ে আসবো। এমনকি তুমি আমার উপর স্ত্রীর অধিকার খাটাতে পারবে না এই দেড়বছরে। কলেজে গেলে একবারে অচেনা। আগে তো বেশী প্যারা দেইনি এখন বেশী দেবো। বুঝবে শুভ্র কী জিনিস। আর
তুমি এসব ফাজলামো বাদ দিয়ে সিরিয়াস হও। নাহলে তোমায় সিরিয়াস বানাতে সময় লাগবে না আমার।”

“দুই লাইন কথার জন্য ছয় লাইন জ্ঞান। ভাই কী হিটলার কপালে জুটলো। ফাঁকিবাজি করা যাবে না। আলাহ আমার কী হবে? আমি শুধু মানুষকে দেখাই আমি পড়াশোনায় সিরিয়াস এবং পড়াশোনা পছন্দ করি। কিন্তু আমি তো জাস্ট শো অফ করি। পড়াশোনা আমি ভালো লাগে না। আবার ক্যারিয়ার!”

সেরিন চুপচাপ কথাগুলো ভাবে। এগুলো প্রকাশ করলে থাপ্পড় দিয়ে শুভ্র তাকে সোফা থেকে ফেলে দিবে। তবুও সাহস নিয়ে বলে,
“আসলে বলছিলাম….

” পড়া শেষে কথা।”

সেরিনের কান্না পাচ্ছে। শুভ্র তাকে দেড় বছরে পাগ’ল বানিয়ে দিবে। বিরক্তি নিয়ে পড়ায় মনযোগ দেয় সেরিন। শুভ্র ল্যাপটপে কাজ করছে। সেরিন ভুলভাল পড়ছে। তাও মেজাজ দেখিয়ে!

সেরিন শুভ্রর সাথে কথা বলেনা। তার জীবনের সুখ সব কেড়ে নিয়েছে তার জামাই আর পড়ালেখা। এই বাড়ীতে থাকলে পড়ালেখা ওই বাড়ীতে গেলে পড়ালেখা সাথে শুভ্রর ইগনোর সহ্য করতে হবে। ডিনার করে খাটের এক কোণে শুয়ে পড়ে সেরিন। একটা কথাও বলেনি সে শুভ্রর সাথে। কিন্তু তাতে শুভ্রর কিছুই যায় আসে না। সে জানে মন ভালো হলে সেরিন নিজেই তার কাছে আসবে। দুজন খাটের দুই মেরুতে অবস্থান করেছে। কেউই কারোর সাথে কথা বলছে না। সেরিন পড়ালেখার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করছে। একমাত্র পড়ালেখা। পড়ালেখার জন্য আজকে তার স্বামীর সাথে তার দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে