#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|১৭|
#শার্লিন_হাসান
ডক্টর শুভ্রকে ব্যান্ডেজ করে মেডিসিন লিখে দেয়। সবাই শুভ্রর রুমে ভীড় জমিয়েছে। শুভ্রকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কোন উত্তরই দিচ্ছে না সে। আরফিন চৌধুরী রেগে আছেন। তার বাড়ীতে কে আসলো পারমিশন ছাড়া। দারোয়ান কোথায় ছিলো ইত্যাদি,ইত্যাদি। তাঁদের কলেজের সাথেই যেহেতু বাড়ী তাই তেমন সিকিউরিটি রাখেনি মানুষ আসা যাওয়া করে এমনিতেও। তবে বিল্ডিংয়ের চারপাশটায় সিসি ক্যামেরা লাগানো। এখন একমাত্র ভরসা সিসিটিভি ফুটেজ।
শুভ্রকে নিয়ে সবাই একটু বেশী উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। সিসিটিভি ফুটেজ পরেও চেক করা যাবে। আর্থ শুভ্রকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। তবে খবরটা পাটওয়ারী বাড়ীতে চলে যায়। সেরিন না শোনলেও নিশাতের থেকে পায় খবর তখন প্রায় রাত বারোটার উর্ধ্বে। মাহি নাকী নিশাতকে বলেছে। সেরিনের নিজেকে ভিন্ন গ্রহের প্রাণী মনে হলো। তবে নিশাতের সাথে কথা বললো। সেরিনের মতে একাবারে ঠিক হয়েছে। মাথায় বা’রি মেরেছে ভালোই করেছে যদি এবার মাথা ঠিক হয়। রুলস কিছুটা কমে আসে। সেরিন নিজেই তো সেই কবে বারি টা মারতো শুধু পারমিশন নেই। বহুত জ্বালিয়েছে শুভ্র তাঁদের। এখন কয়েকদিন বেড রেস্টে থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা সেরিনের টিসি মনে হয়না এই জনমে পাবে। এটা ভেবে খারাপ লাগছে।
পরের দিন সকালে শুভ্র কলেজে উপস্থিত হয়। এটা নিয়ে অনেকের মনে আঘাত লেগেছে। ভেবেছে শুভ্র আসবে না একটু চিল করবে। তার আর হলো না। সেরিন তো সেই খুশি আজকে তার টিসি নেওয়া কেউ আটকাতে পারবে না। খুশি মনে পিটি শেষ করে শুভ্রর রুমে উপস্থিত হয় সেরিন। তখন শুভ্র কিছু পেপার্স নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে। সেরিনকে দেখে ভেতরে আসার পারমিশন দেয়। সেরিন ও একা গাল হেঁসে ভেতরে যায়। শুভ্র তাকে দেখে বলে,
‘এতো তাড়া কিসের ঢাকা যাওয়ার?’
‘আসলে স্যার এই কলেজটা আমার একদম পছন্দ না। সেজন্যই এতো তাড়া।’
‘ঘুমাও তাহলে টিসি পাবা না।’
‘কিন্তু কেনো স্যার?’
‘আমার কলেজের নামে বদনাম করেছো মানে এই কলেজেই তোমায় থাকতে হবে।’
‘ওটা তো জাস্ট কথার কথা। এমনিতে কলেজ ক্যাম্পাস সাথে মডুলাস মার্কা রুলস একদম ঠিক আছে। আসলেই ঠিক আছে আপনার দেওয়া রুলস গুলো। আমার ধৈর্য থাকলে অবশ্যই মানতাম আর থেকে যেতাম।’
‘প্রশংসা করলে নাকী অপমান?’
‘আরে না প্রশংসা। এবার আমার টিসি?’
শুভ্র একটা পেপার্স এগিয়ে দেয় সেরিনকে। সেরিন সেটা দেখে ধন্যবাদ দিয়ে বেড়িয়ে আসে। দরজার সামনে আসতে পেছন থেকে শুভ্রর গাওয়া গুনগুন করে গান কানে ভাসছে। সেরিন শোনার চেষ্টা করছে। শুভ্র গুনগুন করে গাওয়া বাদ দিয়ে একটু জোরেই গায়,
‘তুমি আর তো কারোর নও শুধু আমার।
যত দূরে সরে যাবে রবে আমার।
তবে আজ কেন একা আমি?’
সেরিন পেছনে তাকাতে শুভ্র মলিন হেঁসে বলে,
‘তোমার মতো ওতো ভালো গাইতে পারি না।’
‘আসলেই!’
সেরিন প্রস্থান করতে শুভ্র হাসে। ভেবেছিলো সেরিন বলবে, ‘না সুন্দর হয়েছে।’ তা না অহংকার করে চলে গেলো। সেরিন যেতে শুভ্র আজকে আসা চিঠিটা হাতে নেয়। তাতে লেখা, ‘হয়ত মাঝেমধ্যে চিঠি আসবে। আমার ব্যস্ততা বেড়ে গেছে বাবুর আব্বু।তবে হ্যাঁ একদিন হুট করে সামনে এসে সারপ্রাইজ দিবো আপনায়। সেদিন ফিরিয়ে দিলে খবর আছে। তবে একটা অভিমান বার্তা আছে আপনার জন্য। অচিরেই সেটা পেয়ে যাবেন। দোয়া করবেন বাবুর আম্মু আর বাবু যাতে সুস্থ থাকে।’
চিঠি পড়ে শুভ্রর মুখ দিয়ে একটা কথাই বের হলো সেটা হলো, ‘বাবু সুস্থ থাকা মানে? আসলেই কী অপরিচিতা প্রেগন্যান্ট? তাহলে তো বাবুর আব্বু আমি না। ধুর অন্যের বাচ্চা আমার গাড়ে চাপাতে আসে। যাক বাঁচলাম চিঠিগুলো কী তাহলে ভুল জায়গায় আসে?’
না তাহলে আমার নাম আর আর্থর নাম ওই অপরিচিতা জানবে কীভাবে?’
টিসি নিয়ে মনের আনন্দে ক্লাসে মনোযোগ দেয় সেরিন। আজকেই শেষ ক্লাস। ভাবতে কী যে আনন্দ লাগছে তার। তবে আনন্দটা বেশীক্ষণ স্থায়ী হলো না। কোথা থেকে ভরা পানির বোতল এসে ঠাস করে সেরিনের কপালে লাগে। সেরিন পানির বোতল হাতে নিয়ে পাশে তাকাতে দেখে আকাশ ছেলেটা তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ক্লাসে থাকা টিচার সেরিনের দিকে তাকায়। পাশে বসা মেয়েটাও সেরিনের কপাল দেখে। মূহুর্তে ফুলে লাল হয়ে গেছে। সেরিন কপালে হাত রাখে। ভীষণ মাথা যন্ত্রণা করছে তার।
আকাশকে দাঁড় করায় স্যার। ধমক দিয়ে বলে,
‘ওকে বোতল ছুঁড়লে কেন?’
‘স্যার বোতলটা ওরই। একটু আগে নিয়েছিলাম পানির জন্য। এখন ওকে দিতে গিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম ও হাতে নিতে পারবে।’
আকাশের সাজানো মিথ্যে কথা শোনে সেরিনের বেশ রাগ হয়। তবে এখন জামেলা বাড়াতে মন চাচ্ছে না। মাথা ব্যাথা করছে তার। সেরিনকে প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে পাঠানো হয়। স্যার কল দিয়ে বলে দিয়েছে। তবে এটা বলেনি কীভাবে কী হয়েছে।
আকাশ বসতে,বসতে জুম্মানকে বলে,
‘ভেবেছিলাম চোখটাই ন’ষ্ট করে দিবো। ভাগ্য ভালো কপালে পড়েছে। যাই হোক ব্যাথা ভালোই পেয়েছে।’
‘সাব্বাশ! আজকে একটা ট্রিট পাবো বড় ভাইয়ার থেকে।’
********
সেরিনের কপালে বরফ দেওয়া হয়। ডক্টর আনানো হয়। শুভ্র তো বকেই যাচ্ছে সেরিনকে কীভাবে কী হলো সেটাও বলছে না মেয়েটা। নিশাত সেরিনকে আগলে রাখছে। শুভ্র বার কয়েক জিজ্ঞেস করার পর কিছুই বলেনি তারা। নিষেধাজ্ঞা থাকায়! শুভ্র তো নাছোড়বান্দা। সেরিন কিছু বলেনি দেখে আর তাকে ধমক দিয়ে জো করেনি। যদি আবার সত্যি সেন্স লেস হয়ে যায়। তবে নিশাতকে তো ছাড়া যায় না। ধমক একটা দিয়ে শুভ্র শুধায়,
‘ও কিসের সাথে আঘাত পেয়েছে? সত্যি করে বলো?’
‘ও..ওই হাটার সময় স্যার দেওয়ালের সাথে।’
নিশাতের কথায় শুভ্র ধমকে বলে,
‘হ্যাঁ চোখ তো কপালে লাগিয়ে হাঁটো। বেশী ছটফট করলে এমনই হবে। আমার কলেজ থেকপ চলে যাবে সুস্থ মতোই যাও। পরে তো তোমার বাবা আমায় ধরবে তার মেয়েকে আমি মেরে পাঠিয়েছি।’
মিশাত, সেরিন দু’জনে চুপ। কিছুক্ষণ পর শুভ্র সেরিনকে গাড়ী ঠিক করে দিয়ে বাড়ীতে পাঠিয়ে দেয়। মাহিকে বলে দেয় দেয়ালের সাথে আঘাত পেয়েছে সেরিন।
********
চৌধুরী বাড়ীতে আরেক ঝড় উঠেছে। সেটা হলো গতকাল সন্ধ্যার সিসিটিভি ফুটেজ কেউ ডিলিট করে দেয়। ব্যপারটা কেমন জেনো! সবার মাথায় তালগোল পাকানোর মতো হয়ে গেছে। তবে আর্থ বেশ ভালো বুঝেছে এই চার দেওয়ালের মাঝে এমন কিছু আছে যেটা তাঁদের সবার অবগত নয়। কিছু তো আছে যেটা তারা কেউই জানে না তবে একজন ব্যক্তি জানে। যে প্রথমবারের মতো ধরা পড়তে গিয়েও পড়েনি। আরফিন চৌধুরী এই নিয়ে চিল্লাচিল্লি করেছে সন্ধ্যা থেকে। আয়মান চৌধুরী সুলতানা খানমকে বকাঝকা করছে। কেনো সবকিছুতে নজর রাখে না। অবশেষে শুভ্রর মা জান্নাতুল ফেরদৌস সিদ্ধান্ত নেন, ‘বাড়ীর সার্ভেন্ট, কাজের বুয়া সব চেন্জ করার।’
এতে সবাই একমত দেয়। জান্নাতুল ফেরদৌস শুভ্রর পাশে বসা। তিনি শুভ্রর কফির মগ এগিয়ে দিতে,দিতে বলেন,
‘গতকাল সন্ধ্যায় যা হলো! এখন আবার সিসিটিভি ফুটেজ উধাও। এসব কী এমনি এমনি হয়ে যায়? কারোর তো হাত আছে এসবের পেছনে।’
তখন আর্থ বলে,
‘যেখানে ফুটেজ,ল্যাপটপ, মেশিন রাখা ওই রুমটায় কে প্রবেশ করেছে লাস্টে সেটা কেউ দেখেছো?’
আর্থর কথায় সুলতানা খানম বলেন,
‘আমরা সবাই ব্যস্ত। এসবে নজর রাখবে কে? যেমন তুমি তোমার চাচ্চু, ভাইয়া তারা বাইরে দৌড়াদৌড়ি করে। আমি ভাবী অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। শুভ্র তো কলেজ নিয়ে। আর ভেতরে সার্ভেন্ট আর কাজের লোকই থাকে। তারাও তাঁদের মতো ব্যস্ত।’
তাঁদের এতোসব চিন্তা ভাবনায় শুভ্রর অনিহা। এসবে তার মনোযোগ আসছে না। সবার সাথে কিছু সময় কাটিয়ে শুভ্র নিজের রুমে চলে যায়। আজকে কাজ করার ইচ্ছে নেই তাই ল্যাপটপের সামনে বসেনি। মাথা ব্যথা করছে প্রচুর সেজন্য মেডিসিন নিয়ে শুয়ে পড়ে। গতকাল সে মাথায় আঘাত পেলো আজকে সেরিন! তাঁদের মধ্যে কিছু একটা মিল আছে। ভেবে শুভ্র হাসে। যদিও সেরিন চলে যাবে আর আসবে না তার ক্যাম্পাসে।
সেরিনকে নিয়ে এক্সট্রা চিন্তা ঢুকে গেছে কিরণ পাটওয়ারীর মনে। তার মনে হয় কেউ কোন কারণে সেরিনের পেছনে পড়েছে। আগামী কালকে সেরিন ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিবে। কিরণ পাটওয়ারী নিজে তাকে নিয়ে যাবে। সেজন্য তুষি সেরিনের একটু বেশী যত্ন করছে। যদিও সেরিন অলওয়েজ স্ট্রং। আজকের রাতটা সে তার রুমটা ঘুরেঘুরে দেখছে। তার সাজানো রুমটা আবার কবে না কবে আসা হয়।
দেওয়ালে তার নাম বসানো সাথে স্পেশাল কিছু লেখা বসানো। তাতে হাত ভোলায় সেরিন। নামটা এমন ভাবে বসানো না ভাবলে কেউ বুঝতে পারবে না কী লেখা। সেরিন নি৷ জের কাজে নিজেই হাসে।
********
বাবুর আব্বুর দেওয়া চিঠিটা পড়ে মুচকি হাসে অপরিচিতা। মনে,মনে বলে,
‘হুট করে একদিন দেখা হবে আমাদের। হয়ত গল্পের পূর্ণতায় নাহয় গল্পের শূন্যতায় কল্পনার শহরে। তবে তুমি ভুলে যেও না আমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি তোমাকে।’ (কপি করা নিষেধ)
লেখা:শার্লিন হাসান
#চলবে
#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|১৮|
#শার্লিন_হাসান
দীর্ঘ তিনঘন্টার বাস জার্নির পর ঢাকায় এসে পৌঁছায় সেরিন এবং কিরণ পাটওয়ারী। সেরিনের আন্টির বাসায় তারা প্রথমে যায়। সেরিনের আন্টি সানজিদা শারমিন তাঁদের জন্য লান্স রেডি করে। ফ্রেশ হয়ে সেরিন তাঁদের সাথে দুপুরের লান্স করে নেয়। বাসায় সানজিদা শারমিনের একটা মেয়ে এবং ছেলে আছে তবে তারা স্কুলল। তারা একজন ফাইভে আরেকজন সেভেনে পড়ে। টুকটাক গল্প করে সেরিন রুমে এসে রেস্ট নেয়। আগামী কালকে নতুন কলেজে যাবে সে। এই বাসায় এর আগেও আসা যাওয়া থাকা হয়েছে। অনেকটা নিজের বাড়ীর মতোই সেরিনের কাছে। মা আন্টি একই হিসাব! সেরিনকেও তার আন্টি অনেক বেশী আদর যত্ন করে।
সন্ধ্যায় তারা নাস্তা করে। সেরিন তার আন্টির ছেলে মেয়ে সিদাত এবং আয়াশের সাথে টুকটাক গল্প করে। সিদাত একটু বুঝরুক হলেও আয়াশ একটু কমই। তবে সেরিনের কাছে দু’জনই ছোট বন্ধুর মতো। সেও ছোট বাচ্চাদের সঙ্গ পছন্দ করে।
সেরিন তার প্রয়োজনীয় জামাকাপড়,জিনিসপত্র আনলেও তার গিটার টা আগে নিয়েছে। সে এখানের গানের স্কুলে এডমিশন নিবে। পার্ট টাইমটা তার শখের পেছনে ওয়েস্ট করবে।
শশীর কল আসতে সেরিন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে শশী অভিমানী স্বরে বলে,
‘থেকে গেলে খুব কী ক্ষতি হতো?’
‘না হতো না। তবে ক্ষতি না হলেও ক্ষত হতো।’
‘হুম! ভালো। তোকে অনেক বেশী মিস করি চঞ্চল মেয়ে।’
‘আমি ও মিস করি। আবার তাড়াতাড়ি দেখা হবে আমাদের।’
‘আমার এক্সামের আগে আসবি? প্লিজ,প্লিজ!’
‘আচ্ছা দেখি।’
‘দেখি না তোকে আসতে হবে। বায় দ্যা ওয়ে তুই চলে যাওয়ার পর ফুফি কী বলেছে জানিস?’
‘কী?’
‘বলেছে সেরিনকে ঢাকা নেওয়ার কী আছে? শশী তো এখানেই পড়াশোনা করছে। বেশী সমস্যা হলে কলেজ এক্স চেন্জ করে নেক। আর অক্ষর তো তিন দিন পর বিডি আসছেই।’
‘অক্ষর ভাইয়া আসলে সবাই নিশ্চয়ই বেশী মজা করবে। কত প্লানিং করবে,পিকনিক করবে তাই না?’
‘সে তো করবেই। ফুফির একমাত্র ছেলে তাও কতবছর পর দেশে আসবে। বিয়েটা করে নে তাহলে আরো বেশী মজা হবে।’
‘ধুর! কিসের বিয়ে?’
‘তোর রুমে কিছু পেপার্স দেখলাম রঙিন। এগুলো আবার কবে আনলি? সাথে নিয়ে যাসনি?’
‘মনে ছিলো না। থাক আমি কয়েকদিন পর যাবো দরকারী কিছু আনবো।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে।’
কিছুক্ষণ কথা বলে সেরিন রেখে দেয় কল।
*******
এরই মাঝে কয়েকদিন কেটে যায়। অক্ষর দেশে আসে। সেরিন নতুন কলেজে এডমিশন নেয়। কুমিল্লা আর যাওয়া হয়নি তার। সবার জীবন সুন্দর ভাবে চলছে। তবে অক্ষর সেরিনকে দেখার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। দিনটা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা বেলা। চৌধুরী পরিবার সবাই বসেছে এনগেজমেন্টের ডেট ফিক্সড করা নিয়ে। আগামী কাল শুক্রবার এনগেজমেন্ট হবে। পাটওয়ারী বাড়ীতে জানিয়ে দেওয়া হয়। আর্থর এন্গেজ, বিয়ে হয়ে যাবে অথচ শুভ্রর বিয়ের খবর নেই। তবে তাকে বার কয়েক জিজ্ঞেস করা হয়েছে পছন্দের কেউ থাকলে বলতে প্রস্তাব পাঠাবে। শুভ্র না বলে। তার পছন্দের কেউই নেই। তবে আরফিন চৌধুরী ঠিক করেন অন্য কোথাও মেয়ে দেখবেন। দুই ভাইকে একসাথেই বিয়েটা দিবেন।
এতে আয়মান চৌধুরী সম্মতি দেয়নি। আর্থও দেয়নি।তাতে কী আরফিন চৌধুরী ঠিক করে নিয়েছেন তার এক বন্ধু মিনিস্টারের মেয়ে তার জন্য প্রস্তাব পাঠাবে। কথাটা প্রকাশ করতে জেনো লিভিং রুমে বোম পড়লো। শুভ্র মূহুর্তে মেজাজ হারায়। আয়মান চৌধুরী তাকে চোখ দিয়ে ইশারা করছে চুপ থাকার জন্য। তাঁদের এই কথা ওই কথার মাঝে আর্থ সাহস করে বলে উঠে,
‘সেরিন পাটওয়ারী মেয়েটা কেমন বাবা?’
‘ভালোই তো।’
আরাফ চৌধুরী এবং আরফিন চৌধুরী উৎসুক হয়ে বসে আছে। তখন আর্থ বলে,
‘ভাবছি দুই ভাই এক বাড়ীতে বিয়ে করবো।’
‘ওনাদের মেয়েকে ওনারা বিয়ে দিবেন না এখন।’
গম্ভীর মুখ করে বলে শুভ্র। শুভ্রর কথায় আর্থ বলে,
‘তুমি চুপ থাকো। দিবেনা কেনো? অবশ্যই দিবে!’
‘তোহ আমি তো সেদিন বলেছিলাম।ওনারা হ্যাঁ না কিছুই বলেননি।’
আয়মান চৌধুরীর কথায় আরাফ চৌধুরী বলেন,
‘তোহ সেরিনের জন্য কী গেছে? ভাইয়া তো বললো তার কোন বন্ধুর মেয়ে আছে। শুভ্রর জন্য যোগ্য পাত্রী সেই হবে। আর সেরিন অনেক ছোট! শুভ্রর সাথে যায় না। আর অন্যদিকে স্টুডেন্ট ব্যপারটা বা’জে দেখায়।’
আরাফ চৌধুরীর কথায় আর কেউ কিছু বলেনি। সেদিনের মতো তাঁদের কথাবার্তা শেষ হতে নিজেদের কাজে যে যার মতো রুমে চলে যায়। কাজের বুয়া
ডিনারের জন্য রান্না বসায়। জান্নাতুল ফেরদৌস সেসবে হেল্প করছেন। তবে নিরা এবং সুলতানা খানম তারা তাঁদের অফিসের কাজে ব্যস্ত।
রান্না বান্না শেষ হতে বুয়াকে টেবিল সাজাতে বলেন জান্নাতুল ফেরদৌস। বুয়া যেতে তিনি নরমাল একটা প্লেটে কিছু ভাত এবং দুপুরের রান্না করা তরকারি নেয়। তাও খুবই স্বল্প পরিমানে। সেটাও একসাইডে ঢেকে রেখে দেন তিনি।
আর্থ শশীর সাথে কলে কথা বলছে। বিশেষ করে শুভ্রর জন্য আফসোস করছে সে। শশীকে বলছে কিছু একটা করতে। তখন শশী বলে,
‘অক্ষর ভাইয়া দেশে এসেছে। আর ফুফি থাকতে সেরিনকে অন্য কোথাও দিবে না। প্রয়োজনে অপেক্ষা করবে দুইবছর। তাও সেরিনকে তার ছেলের বউ হিসাবে চাই।’
‘তোমার ফুফির এতো শখ কেন? আমার ভাইয়ার বাবুর আম্মুকে অন্যের বাবুর আম্মু বানানোর।’
‘এহহ বাবুটা বুঝি সেরিনের সাথেই আছে?’
‘নেই যাই হোক! ইন্টারেস্টিং! ভাইয়াকে কেউ বাবুর আম্মু সেজে চিঠি দেয়।’
‘তোহ? তাই বলে আমার বোন বুঝি সেই বাবুর আম্মু?’
‘সেটাই কেউ জানে না এখনো।আমার ভাইটাও দেখো! দুনিয়া কাঁপায় অথচ তার হৃদপিণ্ড কাঁপায় কোন এক অষ্ঠাদশী অপরিচিতা!’
‘ভালোই তো! তা বাবুর আম্মুর চিঠি পড়ে শুভ্র স্যার খুশি হোন নাকী বিরক্ত হোন?’
‘দাঁড়াও জিজ্ঞেস করছি।’
আর্থ উঠে সোজা শুভ্রর রুমে চলে যায়। শুভ্র ল্যাপটপে ব্যস্ত। আর্থ তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘ব্রো বাবুর আম্মুর চিঠিতে তুমি বিরক্ত?’
শুভ্র তাকায়। আমতা আমতা করে বলে,
‘হঠাত তার কথা কেন?’
‘বলো না?’
‘আরে না এসব আমি ভাবি না। বিরক্ত তো দূরের কথা।’
‘চিঠি আসেনা?’
‘আসে তো!’
‘আজকে এসেছে?’
‘হুম! গতকাল ও এসেছে।’
‘তোহ বলো না?’
‘হুম ভালো। তবে অপরিচিতা ভীষণ ছটফটে চঞ্চলতা। তার লেখার ধরণে বুঝা যায়।’
‘তুমি বিরক্ত কীনা সেটা বলো।’
‘না একদম না! ব্যপারটা ভালো লাগে।’
আর্থ প্রস্থান করে। শশী হেঁসে বলে,
‘তোমার ভাই কাকে চায়? অপরিচিতা বাবুর আম্মু নাকী সেরিনকে?’
‘কাউকেই চায় না। অপরিচিতার চিঠি সুন্দর। আর সেরিনের গানের ভয়েস। দু’জন আলাদা ব্যক্তি!’
‘ভালো।’
আর্থ শশীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে রেখে দেয়। পুনরায় নিজের ল্যাপটপের সামনে বসে পড়ে।
********
পাটওয়ারী বাড়ীতে অক্ষর এবং সাহিনূর পাটওয়ারী আসেন। মাহি এবং কিরণ পাটওয়ারী বাজার থেকে এসেছে একটু আগে। শশীর কয়েকজন মেয়ে কাজিন আগামী কালকে আসবে। অক্ষরকে কোল্ড ড্রিং দেয় শশী। তবে তার কফি লাগবে। শশী নিজে কফি বানিয়ে অক্ষরের জন্য নিয়ে আসে। সেরিনের রুমের ফ্যানের নিচে বসেছে অক্ষর। রুমটা সাজানো গোছানো হলেও রুমের মালিক নেই। কত বছর হয়েছে সেরিনকে দেখেনি অক্ষর তবে দেওয়ালে জুলানো ফটোর অ্যালবাম গুলো দেখছে। এর আগেও এখানেই চোখ ভোলাতো সে। অবশ্য মনে,মনে জব্দ করে নিয়েছে রুমটায় একদিন তার ও অধিকার থাকবে।এবং সেটা খুব শীঘ্রই। মাহি অক্ষরের সাথে বসে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অক্ষরের কথায় মাহি সেরিনকে ইন্সটায় ভিডিও কল দেয়।
তখন সেরিন প্রেকটিক্যাল লেখছিলো। মাহির কল পেতে রিসিভ করে সালাম দেয়। মাহি এক গাল হেঁসে বলে,
‘অক্ষরের সাথে কথা বল। বেচারা তোকে দেখার জন্য উতালা হয়ে আছে।’
কথাটা বলে অক্ষরকে ফোনটা দেয়। সেরিন নিজেকে কিছুটা প্রস্তুত করে নেয়। তখন একটা সুমিষ্টি শান্ত পুরুষালি কন্ঠ সেরিনের কানে আসে৷ সেটাতে সে খুব ভ্দ্র ভাবে বলছে,
“কেমন আছো সেরিন?’
প্রতিত্তোরে সেরিন বলে,
‘আলহামদুলিল্লাহ, তুমি?’
‘এই তো আলহামদুলিল্লাহ। তা কুমিল্লায় আসছো কবে?’
‘এক্সাম দুইদিন পর। লেট আছে!’
‘গান কেমন চলছে?’
‘মোটামুটি তেমন সময় হয়না।’
‘হ্যাঁ যাই হোক আগে তোমার পড়াশোনা। গানের জন্য সময় আছে সামনে।’
‘হ্যাঁ!’
সেরিন অক্ষরের মুখের আদল খেয়াল করে। গোলাপী অধর জোড়ায় কী প্রানবন্তর হাসি। সেরিন ও হাসে। অক্ষরের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে বিদায় নিয়ে নিজের লেখায় মনোযোগ দেয় সেরিন।
অক্ষর উঠে দেওয়ালে সেরিনের লাগানো নাম গুলো দেখে। Serin Patwary Mishat. সাথে Music Lover
ঠিক ঠাক লাগলেও পরের নামগুলো কেমন জেনো! Nizar Roshat rbuab Apaap.
মাহীকে ডেকে আনে অক্ষর। লেখা গুলো দেখিয়ে বলে,
‘এগুলো কী কোন ব্র্যান্ডের মেম্বারদের নাম?’
‘কী জানি! সেরিন ভালো জানে।’
অক্ষর আর সেসব নিয়ে ভাবেনি। সে প্রস্থান করে। তার আম্মু এবং মামনিরা কাজে ব্যস্ত। শশী বড়দের খাবার সার্ভ করে দেয়।
******
চৌধুরী বাড়ীতে সবার খাওয়া দাওয়া হতে যে যার রুমে চলে যায়। সার্ভেন্ট, কাজের বুয়া তারাও খেয়ে দেয়ে যে যার মতো শুয়ে পড়ে। জান্নাতুল ফেরদৌস এই দিকটা ফাঁকা করে খাবারের প্লেটটা হাতে নিয়ে বাইরের সব লাইট অফ করে দেয়। মেইনডোর দিয়ে বেড়িয়ে সে বাড়ীর পেছনের দিকটায় চলে যায়। তখন আবার আর্থ ও ফোন হাতে লিভিং রুমে আসে। পানি নেওয়ার জন্যই! মেইনডোর খোলা! কেউ তালা দেয়নি বাইরের যে কেউ প্রবেশ করতে পারবে ভেতরে। আর্থ জগটা টেবিলের উপর রেখে ফোন কানে নিয়েই বাইরে আসে। কিছুটা ঘাবড়ে যায় সে। কল কেটে ফোনের ফ্লাশ অন করে। জোরে চেঁচিয়ে সার্ভেন্ট দের ডাকে। আর্থর ডাকে বাকীরাও বেড়িয়ে আসে। আর্থ চেঁচিয়ে বলে,
‘কী কাজ করো তোমরা? রাত বাজে বারোটা! বাইরের লাইট অফ কেনো? বাড়ীতে আউটডোর কে আসে না আসে কিছুই তো সিসিটিভিতে উঠবে না। এই জন্যই সেদিন শুভ্র ভাইয়ার উপর অ্যাটাক হয়েছে। এখন যদি আমি যেতাম নিশ্চয়ই আমার উপর ও এট্যাক হতো। বাইরে শত্রুর অভাব নেই তারউপর তোমরাও শুরু করলে। কারোর কোন ক্ষতি হলে কাউকে ছাড়বো না আমি। লাইট অন করো।’
একজন সার্ভেন্ট তড়িঘড়ি লাইট অন করে। আর্থর চেঁচামেচি দেখে একজন বলে,
‘লাইট অন ছিলো। কেউ বাইরে গিয়েছে হয়ত।’
‘কে যাবে বাইরে?’
‘এখানে যিনি উপস্থিত নেই তিনিই। আর হয়ত ওনি এসব জানেন। রাতের বেলায় লাইট অফ হয়ে যাওয়া। শুভ্র স্যারের উপর অ্যাটাক হওয়া।’
তখন আয়মান চৌধুরী সবাইকে দেখে বলেন,
‘ছোট বৌদি আমাদের সাথে নেই।’
‘কী হয়েছে এতো ভীড় আর চিৎকার চেঁচামেচি কিসের?’
জান্নাতুল ফেরদৌস সিঁড়ি দিয়ে নামতে, নামতে বলেন। বাকীরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। তখন আর্থ সব বলে। জান্নাতুল ফেরদৌস ক্ষিপ্ত মেজাজে বলেন,
‘আগামী কালকে এনগেজড সেরে তারপর সব কয়টাকে আমি ছাঁটাই করছি। আমাদের বাড়ী থেকে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’
কেউ আর কিছুই বলেনি। যে যার মতো পুনরায় রুমে চলে যায়।
********
‘এতো, এতো আনন্দের মাঝে কেউ একজনের মনে একরত্তি শান্তি মিলছে না। কারোর জন্য মনটা হাহাকার করছে। খুব করে তার কাছে টানছে। কিছু,কিছু সময় অনেক কিছু মিথ্যে মনে হয় তো আবার সত্যি বলেও প্রমাণিত হয়। মন টানে! ইশশ আড়ালে কেউ আছে। একটু তো ঘেঁটে দেখা দরকার। কেউ আমায় স্মরণ করছে। কারোর পাশে আমায় টানছে। ভীষণ করে টানছে! তবুও যে বাস্তবতায় এসব নিত্যান্ত মিছে নাটক আর কল্পনা মনে হয়।’
#চলবে