#হৃদয়_সায়রে_প্রণয়ের_ছন্দ|১০|
#শার্লিন_হাসান
এরই মাঝে কেটে যায় পনেরোদিন। সেরিনের ও ব্যস্ত লাইফ কাটছে। নিজের প্রাইভেট,পড়াশোনা,গান নিয়ে। এখন আর শুভ্রর সাথে জামেলা হয় না। আর না শুভ্রর আশেপাশে ঘেঁষে সেরিন। সময়টা বিকেল বেলা। সেরিনের মন ভালো নেই। সেরিন বের হবে নিশাত আসবে তারা একটু ঘুরবে। তাঁদের বাড়ীর থেকে অল্পেকটু দূরে একটা লেক আছে। যথাসময়ে রেডি হয়ে সেরিন বেড়িয়ে পড়ে।
লেকের কাছে এসে কিছুটা সময় কাটায় নিশাত আর সেরিন। শসীকে নিয়েই আসতো ওর কলেজ ছুটি হতে লেট হয় আবার প্রাইভেট বাড়ী ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সেজন্য শসী আসেনি। সেরিন,নিশাত দু’জন ঘুরে। ফাস্টফুড খেয়ে বেরুতে,বেরুতে মাগরিবের আজান হয়ে যায়। নিশাতের বাড়ী লেকের কাছাকাছি হলেও সেরিনকে একাই যেতে হবে। কিছুটা দূরে! যদিও এসবে সেরিনের মাথা ব্যথা নেই তবে আজকাল একটু ভয়ে,ভয়ে থাকে। কী জানি কখন কে কী ক্ষতি করে বসে।
নিশাতকে বিদায় দিয়ে সেরিন অটোতে বসে। অটোতে সে একা থাকলেও কিছুটা সামনে যেতে দু’টো ছেলে উঠে। তাঁদের মধ্য একজন আকাশ আরেকজন হয়ত আকাশের সাথের। সেরিনের চিনতে ভুল হয়নি তাঁদের। সেরিনকে একা দেখে আকাশ টিটকারি মেরে বলে,
‘শুভ্র স্যারের গার্লফ্রেন্ড আজকে একা দেখি। মামা আজকে একে কিছু তো করা যায়ই! সেদিনই রাস্তায় ফেলে মেরে দিতাম। শুধু শুভ্র স্যারের জন্য মারিনি।’
‘আমার গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগলে তোর ওই হাত আর হাত রাখবে না আমার পরিবার।’
তেজী স্বরে বলে সেরিন। তখন আকাশের সাথে ছেলেটা বলে,
‘উফফস ভুলে গিয়েছিলাম তোর পরিবারের তো আবার অনেক ক্ষমতা আছে এলাকায়। তার উপর এমপির পরিবারের সাথে ভালো সম্পর্ক। উফফ এমপির বড় ছেলের পূত্রবধু বলে কথা। আমাদের ও একটা দল আছে। দলের বড় ভাই ও আছে। তোকে নিয়ে তার হাতে দিলে মন্দ হবে না।’
ছেলেটার কথায় সেরিনের গা গুলিয়ে যায়। চিৎকার করে বলে,
‘অটো থামান আমি যাবো না।’
সাথে,সাথে অটো থামায় ড্রাইভার। জায়গাটা অনেকটা অন্ধকার হলেও সেরিন সাহস করে নেমে যায়। অন্য অটোতে করে যাবে। ভাড়া মিটাতে সেরিনের সাথে আকাশও নেমে পড়ে। তখন সেরিন বলে,
‘মামা আমায় একা নিয়ে যাবেন? বিশ টাকার ভাড়া আপনায় একশ টাকা দেবো।’
সেরিনের কথার মাঝে পোড়ন কেটে আকাশ বলে,
‘মামা পাঁচশ দেবো। আমাদেরকে নিতেই হবে।’
সেরিন আর এক মূহুর্ত ও দাঁড়ায়নি। ফোনের ফ্লাশ অন করে সামনে কয়েক কদম ফেলতে কেউ হাত ধরে টান দেয়। সেরিন ও কোনদিকে না তাকিয়ে ঠাস করে চ’ড় বসিয়ে দেয় হাত ধরে থাকা ব্যক্তির। রাগী স্বরে বলে,
‘তোর হাত আমি না ভে’ঙেছি। সেই কখন থেকে ডিস্টার্ব করছিস। আগামী কালকেই আমি কমপ্লেন করবো প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে। কথা গুলো আমি ভিডিও রেকর্ড করে রেখেছি।’
‘আমি শুভ্র।’
গম্ভীর কন্ঠে জবাব দেয় শুভ্র। সেরিনের হাত আপনাআপনি নিজের মুখে চলে যায়। শুভ্র নিজের ফোনের ফ্লাশ সেরিনের দিকে তাক করে। সেরিন আমতা আমতা করে বলে,
‘স্যরি আমি ভেবেছিলাম আকাশ আর জুম্মান।’
‘তা তো ভাববেই। আমাকে তো সবার সাথেই গুলিয়ে শরবত করো তুমি। সবসময় তো আমায় বকো তো আজকে ওদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করলে না?’
‘আমি একা তো! আর ওদের চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করলে ওরা আমার ক্ষতি করবে। আমি মানুষকে বকি তবে যাকে তাকে না।’
‘তোর একটা মাথা আছে তবে মাথার ব্রেইনটা হাঁটুতে।’
সেরিন মাথা নাড়ায়। তখন শুভ্র বলে,
‘ওদের দুজনকে কালকে একটু আদর সোহাগ করবো। এখন তুমি যেতে পারো। ভয় নেই।’
সেরিন নিজের ফোনের ফ্লাশটা শুভ্রর দিকে তাক করে। তখন শুভ্র বলে,
‘এভাবে দেখো না প্রেমে পড়ে যাবে।’
শুভ্রর কথায় সেরিন কাশতে থাকে। শুভ্র সেসবে পাত্তা না দিয়ে একটা অটো দাঁড় করায়। সেরিন অটোতে বসতে শুভ্র বলে,
‘বকবকানি সাবধানে যেও।’
সেরিন শুধু মাথা নাড়ায়। শুভ্র কিছুটা সামনে এগিয়ে আসে যেখানে আকাশ,জুম্মান আছে। তাঁদের দুজনকে শুভ্র আটকিয়ে রেখেছে আরো তিনজন দিয়ে। শুভ্রকে দেখে আকাশ ভয় পেয়ে যায়। শুভ্র দুটোকে গালে দু’টো চ’ড় মারে। তাতেও ক্ষোভ না কমায় আরো চারটা বসায় চ’ড়। তাঁদের জন্য সেরিনের হাতে একটা খেলো। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
‘ইভটিজিং তো ভালোই পারিস! তা তোরা আমার কলেজের স্টুডেন্ট তো? আমার কলেজে এমন বখাটে আছে জানা ছিলো না।’
তখন জুম্মান বলে,
‘আসলে স্যার….’
শুভ্র জুম্মানের লম্বা চুল গুলো টেনে ধরে গালে আরো দু’টো চ’ড় বসিয়ে দেয়। তাতেও জেনো শুভ্রর ক্ষোভ কমছে না। রাস্তায় দেখে বেশী কিছু বলেনি। কলেজে হলে গাড় বরাবর লা’থি তো মারতোই সাথে জায়গা মতো দু চারটা কিক মারতো। এমনিতে এদের জন্য দেশে ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এদের ভবিষ্যৎ তো অন্ধকারই যতটুকু আলো ছিলো শুভ্র ও বাকীটা নিভিয়ে দিতো।
আকাশ, জুম্মানকে ছেড়ে শুভ্র বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হয়। ছেলে তিনটাকেও চলে যেতে বলে। ওরা তার বাবারই লোক ছিলো। শুভ্র খবর পেয়েছে সেরিন লেকের কাছে আসবে। সবচেয়ে বড় কথা আকাশ ওত পেতে আছে সেরিনকে ধরার জন্য। শুভ্র তো কোন প্রকার রিস্ক নিতে রাজী নয়। এমনিতে সে মজে আছে ছোট্ট গায়িকার উপর। তাকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্বটাও তার উপরই অনেকটা। শুভ্রর ভবিষ্যত বড় গায়িকা। শুভ্রর মনে হয় সেরিন নিজেকে নিয়ে এতো আশা করে কীনা কে জানে! তবে সে আশাবাদী সেরিন একদিন অনেক বড় গায়িকা হবে। কনসার্ট করবে, দেশে বিদেশে যাবে। লোকে তাকে চিনবে! সেদিন সেরিন গর্বের সাথে বলবে, ‘সবটাই শুভ্রর চেষ্টা,চাওয়া।’
নিজের ভাবনায় নিজেই হেঁসে দেয় শুভ্র। সে জানে মেয়েটা অনেকটা ছোট। তাঁদের বয়সের ডিফারেন্স দশবছর তো হবেই। সমস্যা নেই বয়স কমানোর জন্য শুভ্র প্রয়োজনে পার্লারে যাবে।
বাড়ীতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রবেশ করে সেরিন। লিভিং রুমে তার বাবা আর চাচ্চু বসে আছে। সেরিনকে দেখে তার চাচ্চু কিরণ পাটওয়ারী বলেন,
‘মাহিকে সাথে নিয়ে গেলে কী হতো? রাস্তায় কেউ ডিস্টার্ব করেনি তো আবার?’
‘না,না কে ডিস্টার্ব করবে? কারোর এতো সাহস নেই পাটওয়ারী বাড়ীর মেয়েকে কিছু বলার।’
কথাটা বলে সেরিন কেটে পড়ে। কিরণ পাটওয়ারীর কথায় সেরিনের বাবা সিহান পাটওয়ারী বলেন,
‘এলাকায় আমাদের নাম ডাক থাকলেও আজকাল একদল এসেছে কাউকেই ভয় পায়না।’
‘যখন জেলের ভাত জুটবে তখন সব সোজা হয়ে যাবে।
*******
আর্থ রাতে শুভ্রর রুমে আসে। তখন শুভ্র ল্যাপটপে কাজ করছিলো। আর্থকে দেখে বলে,
‘আবার কোন নিউজ আছে নাকী?’
‘আরে না৷ একদিন চলো তোমায় আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। ‘
‘সেরিন নাকী শসী?’
‘শসী। সেরিন তো শসীর কাজিন।’
‘মেয়েটা বেশ চালাক। তোর মতো ব’লদ কেও বোকা বানিয়েছে।’
শুভ্রর কথায় আর্থ হেসে মজা নেয়। শুভ্রর এসবে মাথা ব্যথা নেই। সে তো জানে তার ভাই কোন লেভেলের গা’ধা। যে বাচ্চা মেয়েদের কাছে গুটি হয়েছে। সুন্দর ভাবেই নাচিয়েছে সেরিন।
আর্থর দিকে তাকিয়ে শুভ্র বলে,
‘যতই লাফাও,ভাষণ দেও,আমায় বাঁশ দেও আসল বাঁ’শ তো তুমি নিজেই খেয়ে বসে আছো। মাথায় ব্রেইন থাকলে তবেই না বুঝতে। ব্রেইন তো হাঁটুতে।’
‘তুমি আমায় অপমান করছো ভাইয়া? আমার ব্রেইন মাথায় আছে। আর আমায় কে বোকা বানিয়েছে শুনি? আমায় বোকা বানাবে এই ব্রেইন এখনো কারোর হয়নি।’
আর্থর কথায় শুভ্র কীবোর্ড থেকে হাত সরিয়ে কফির মগে হাত রাখে।
‘আমার চালাক নেতা। তাড়াতাড়ি বিয়েটা করে নে। আমি আবার মুখ খোললে তোর প্রেম জানালা দিয়ে পালাবে। তার চেয়ে বিয়েশাদী করে নে যাতে কিছু বললেও প্রেম রুমের মধ্যেই আটকে থাকে।’
‘প্রেম তো করে মানুষ রুমে বসেই। পাবলিক প্লেসে নাকী? ‘
‘ভাই প্লিজ যা। তোর প্রেমের কথা শোনার জন্য আমি বসে নেই।’
********
পরের দিন সকালে কলেজ আসতে নিজের রুমের দরজার সামনে একটা বক্স পায় শুভ্র। রঙিন কাগজে মোড়ানো। শুভ্র সেটা নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে। বক্স খোলতে অনেকগুলো খাম। শুভ্র একে,একে সবগুলো খাম খুলে। সবগুলোতে বিভিন্ন রঙের কাগজে ভিন্ন,ভিন্ন কলমের কালিতে ফুটিয়ে তোলা চিঠি।
শুভ্র একটা চিঠি হাতে নেয়। তাতে লেখা,
‘বাবুর আব্বু দিনদিন কিন্তু নরম হয়ে যাচ্ছে। আইমিন তার কঠোরতম ভাবটা কমে আসছে। বাবুর আম্মুকে রেখে আবার কার প্রেমে মজে গেলে?’
শুভৃর কনফিউজড হয়ে যায়। বাবুর আম্মুটা কে? অনেকদিন পর তাকে স্মরণ করলো। যদিও চিঠিটা পড়ে শুভ্রর হাসি পাচ্ছে। কে জানি হাসলে যদি আবার খবর পায়। তাহলে পুনরায় চিঠি লিখে বলবে, ‘বাবু আব্বু কী বাবুর আম্মুর চিঠির প্রেমে পড়লো নাকী? আজকাল বেশী, বেশী হাসা হচ্ছে।’
শুভ্র ভেবে পায়না চিঠিগুলো কে রুমে রেখে যায়? আচ্ছা তার রুমে তো সিসি ক্যামরা লাগানো আছে। তাহলে ফুটেজ চেক দিলেই তো লুকিয়ে থাকা বাবুর আম্মুকে খুঁজে পাওয়া যাবে। শুভ্র হাসে! যেই কাজটা করেছে সে হয়ত জানে না সিসি ক্যামরার কথা। শুভ্র আর দেরী না করে ফুটেজ চেক দিতে থাকে। সর্বপ্রথম যেই চিঠিটা এসেছে সেই দিনের ফুটেজ চেক করে। কখন কীভাবে আসলো সেটাও তো জানে না শুভ্র। অনেক ঘাটাঘাটির পর কোন কিছুই ফেলো না। না বাইরেী কারোর আসা যাওয়া। শুধু তার কলেজের দপ্তরি, বা দু একজন টিচারের আনাগোনা। শুভ্রর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা মূহুর্তে মলিন হয়ে যায়।
#চলবে