হৃদয় কোঠায় চাঁদের পূর্ণিমা পর্ব-০৪

0
487

#হৃদয়_কোঠায়_চাঁদের_পূর্ণিমা|৪|
#শার্লিন_হাসান

জায়ানের সাথে কথাবার্তা শেষ হতে সীতারা আহমেদ সাথে জায়ানের মা নিরুপা ইসলাম ডিনারের ব্যবস্থা করেন শামিম সরদারের জন্য।

ডিনার করে বেড়িয়ে পড়ে শামিম সরদার। সে তার বাংলোতে যাবে এখন। তার দলের কয়টা আছে তাঁদের সাথে সারারাত ধরে ম’দ পান করবে।

নিবরাস আনায়াকে কল দিয়ে জানায় সে আজকে ভার্সিটিতে যাবে। আনায়াকে মির্জা ভিলাতে নিয়ে আসবে। এখান থেকে যা পড়াশোনা করার করবে। কোন রকমের রিস্ক নিবরাস নিতে চায় না। আনায়া কিছু বলেনি।

সকাল,সকাল রেডি হয়ে নাস্তা করে নেয়। জিয়াউর রহমানকে বলে দিয়েছে তাকে নিবরাস নিতে আসবে। যদিও আগে নিবরাস কথা বলে নিয়েছে জিয়াউর রহমানের সাথে।

বাবা মেয়ে একসাথে বের হয়। আনায়াকে ভার্সিটির সামনে নামিয়ে দিয়ে জিয়াউর রহমান তার অফিসের উদ্দেশ্য রওনা হয়।

আনায়া অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের স্টুডেন্ট আহিয়া তার থেকে সিনিয়র। সে মাস্টার্স করছে তবে এক ভার্সিটিতে না। দু’জন ভিন্ন ভার্সিটিতে। আহিয়ার সাথে আনায়ার ওতো গলায়,গলায় ভাব নেই। এই দেখা হলে যা কথা হয়। মূলত তার মা চলে যাওয়ার পর মামুদের সাথে সম্পর্ক ফ্যাকাশে হয়ে যায়। এখন হয়ত তার মায়ের দ্বিতীয় সংসারে আসা যাওয়া হয় তার মামুর পরিবারের। আনায়াও যায় না মামুর বাড়ীতে। তার বিয়েতে শুধু আহিয়া এসেছে আর কেউই আসেনি।

ভার্সিটিতে আসতে আজকে তার বান্ধবীকে পেলো না আনায়া। মারিয়া আজকে আসেনি! মন মরা হয়ে ক্লাস গুলো শেষ করে নেয়। নিবরাস মেসেজ দিয়ে রেখেছে সে আসছে বিশ মিনিট পরেই।

আনায়া কিছুটা দূরে বড় মেহগনি গাছটার নিচে শান দিয়ে বাঁধাই করা গোলাকৃতি স্থান। সেখানে বসে পড়ে। ফোনের দিকে ধ্যান দেয়। বেশী একটা লোকের সমাগম নেই এই দিকটায়।

নিবরাসের লাস্ট মেসেজ পেতে উঠে দাঁড়ায় আনায়া। এই নিবরাস আসবে!

দূর থেকে এক জোড়া চোখ আনায়ার উপর দৃষ্টি ফেলছে। কানে ব্লুটুথ গুঁজে রাখা। কলের অপরপাশের ব্যক্তিকে বলছে,

-আসছে নাকী জনগণের নেতা?

-হ্যাঁ কাছাকাছি।

-তার বউ আরেকজনে আলিঙ্গন করলো বলে! তাড়াতাড়ি এসে দেখো।

-ওয়েট করো এই ছাঁদে আসছি।

নিবরাসের হাটার সাথে,সাথে গতি মিলিয়ে লোকটা পাশের বিল্ডিংয়ে চলে যায়। দ্রুত পায়ে ছাঁদের কাছে যায়। যেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নিবরাসের আগে একটা ছেলে আনায়াকে হুট করে জড়িয়ে ধরেছে।

ছেলেটার এমন কাজে আনায়া ভ্যবাছ্যাকা খেয়ে যায়। নিজের রাগকে সামলাতে না পেরে কষে দু’টো থাপ্পড় মেরে দেয় ছেলেটার গালে। নিবরাস আনায়ার কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ায়।

-সাহস তো কম না বলা নেই কওয়া নেই হুট হাট জড়িয়ে ধরলি?

তখন নিবরাস এসে ছেলেটাকে প্রশ্ন করে,

-কে পাঠিয়েছে তোকে এখানে?

ছেলেটা কথা বলছে না। আনায়া নিবরাসের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বলে,
-একে জেলে দিবেন নাহলে আপনাকে আমি জেলে ঢুকিয়ে দেবো। সাহস কত একটা মেয়েকে হুটহাট জড়িয়ে ধরা।

-আনায়া তুমি এসব কী বলছো? আমাকে ভুলে গেলে তুমি? আমি রাজ তোমার বয়ফ্রেন্ড। আর এই ছেলেটা কে আনায়া?

থাপ্পড় খাওয়ার পর ছেলেটা এই কথা বলে। আনায়া অবাক চোখে তাকায়। নিবরাস আনায়ার দিকে তাকায়।

-এসব কী আনায়া?

আনায়া বেশ চটে যায়। কপাট রাগ দেখিয়ে বলে,

-আমার কোন বফ নেই। আর এ কে তো আমি কোনদিন দেখিনি। কোথা থেকে এসে কী বলছে?

তখন রাজ হেঁসে বলে,
-সেদিন বেড শেয়ার করলা এখন খাওয়া শেষ ভুলেও গেলা? বাহ আনায়া বাহ!

আনায়ার রাগে গা জ্বলছে। নিবরাসের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আশ্চর্য আপনি দাঁড়িয়ে দেখছেন টা কী? এই ছেলে আমার নামে অপবাদ দিচ্ছে।

তখন রাজ বলে,
-আনায়া একে বলে কী লাভ? তুমি ভাবছো এই নেতাকে দেখলে আমি ভয় পাবো?

-আর একটা কথা বললে তোর দাঁত সব কয়টা আমি ফেলে দেবো। জন্মের ঠিক আছে তোর? বাসায় মা বোন নেই তোর? কার কথায় নাটক সাজাতে এসেছিস?

-আশ্চর্য কার কথা আসবো মানে? তুমি না আমার গফ।

তখন নিবরাস চিৎকার করে উঠে,

-চুপ একদম চুপ। আর একটা কথা বলবে না কেউ। আনায়া আপনি গাড়ীতে গিয়ে বসুন!

নিবরাসের কথায় আনায়া স্বস্তি পেলো না। চেঁচিয়ে বলে,
-যান আপনি গিয়ে গাড়ীতে বসুন। ওর সাহস কত আমায় এসব অপবাদ দিচ্ছে? কী প্রমাণ আছে ওর কাছে? ওর মুখ না ভাঙা অব্দি আমার শান্তি হবে না। আর আপনি কী নিয়ে আসেন? কই আপনার সাথে পুলিশ নেই কেন? এক্ষুনি থানায় কল করুন! একে…

তার আগে নিবরাস আনায়ার হাত টেনে নিয়ে আসে।
আনায়া নিবরাসের যাওয়া দেখে রাজ হাসে।

-কাজ হয়ে গেছে।

অপরপাশের মেয়েটি বলে,
-এবার নিজ গন্তব্যে চলে যাও।

নিবরাস আনায়াকে গাড়ীতে বসিয়ে নিজেও বসে পড়ে। নিবরাসের এমন ভাব ভঙ্গি আনায়ার বিরক্ত লাগছে! লোকটাকে এভাবে ছেড়ে দিবে?

গাড়িতে বসতে,বসতে নিবরাস মেসেজ সেন্ড করে দেয় তার লোকেদের। দু-ঘন্টার মধ্যে সে গোডাউনে আসবে।

আনায়া কথা বলছে না। নিবরাস চুপচাপ গাড়ী চালাচ্ছে। দু’জনের মাঝে পূর্ণ নিরবতা বিরাজ করছে। তখন নিবরাস বলে,

-ওইসব আর মাথায় রাখবেন না। সব ওদের প্লানিং করে করা।

-আপনি পাঠিয়েছেন লোকটাকে?

-আপনার এটা মনে হয়? আমি তো পাগ’ল হয়েছি আমি থাকতে নিজের বউকে জড়িয়ে ধরার জন্য লোক পাঠাবো?

-তো এখন কিছু বললেন না?

-পাবলিক প্লেস! চিন্তা করবেন না লোকটা আমার গোডাউনে পৌঁছে গেছে অলরেডি।

-এই আপনি গুন্ডা?

আনায়ার প্রশ্নে নিবরাস ভ্যাবাছ্যাকা খেয়ে যায়। কিঞ্চিৎ রাগ দেখিয়ে বলে,

-আমাকে গুন্ডা মনে হয় আপনার?

-তা নয়ত কী? গুন্ডাদেরই তো গোডাউন থাকে। নেতা যদি হয় গুন্ডা তাহলে জনগণের কী হবে?

-এই শুনুন আজকাল সুষ্ঠু রাজনীতি করতে গেলে একমাস পরে নিজেকেই ব’লি হতে হবে। এরকম দু’একটা দল আড়ালে রাখা লাগে। নাহলে টিকে থাকা দায়!

– দেখতে নেতা আসলে সে গুন্ডা, এমন লোকের সাথে বাবা আমায় বিয়ে দিলো? তারউপর আগে একটা বিয়ে করছে।

আনায়ার কথা নিবরাস ব্রেক কষে। আনায়া তাকায়। নিবরাস চোখ মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে তারদিকে। আনায়া দৃষ্টি সরিয়ে নিবরাসের হাতের দিকে তাকায়। এই বুঝি দাবাং মার্কা হাত দিয়ে তাকে চড়টা দিলোওওও।

কোন রেসপন্স আসেনি। আনায়া নিবরাসকে বলে,

-গাড়ী স্টার্ট দিন না?

-আপনার মুখটা দয়া করে বন্ধ রাখবেন?

-আসলেই আপনি গুন্ডা? আচ্ছা আপনি চাঁদাবাজি করেন?

-হ্যাঁ করি তো! আপনার বাবার থেকেই জোর করে টাকা নিয়ে চাঁদাবাজি করি আমি। এবার শান্তি হয়েছে?

-এমন করেন কেন? আচ্ছা আপনি এতো চুপচাপ থাকেন কেন?

নিবরাস উত্তর দেয়না চুপচাপ গাড়ী স্টার্ট দেয়। আনায়া ও আর প্রশ্ন করেনা। তার মনে হচ্ছে এসব জিজ্ঞেস করা উচিত হয়নি তার। আর জিজ্ঞেস করলেই কী? সে তো রাজনীতি নিয়ে তেমন কিছু জানে না। জামাইয়ের সম্পর্কে সব জানার অধিকার তো তার আছে।

-কী একটা মেয়ে বিয়ে করলাম। নিজের বরকে নেতা থেকে সোজা গুন্ডা আর গুন্ডা থেকে ডিরেক্ট চাঁদাবাজ বানিয়ে দিলো?

ও কী বুঝবে এসবের? মাথায় আছে টা কী?

আনায়াকে মির্জা ভিলাতে নামিয়ে দিয়ে নিবরাস চলে যায় গোডাউনের দিকে। আনায়া গাড়ী থেকে নামতে দেখলো পেছনে আরো দু’টো গাড়ী ছিলো। সেগুলোও নিবরাসের গাড়ীর পেছনে যাচ্ছে।

আনায়া সেসবে পাত্তা দেয়না। ভেতরে যেতে মরিয়ম নওয়াজ তার কাছে আসে। আনায়া তাকে সালাম দেয়। তার পেছন দিয়ে মিসবাহ দৌড়ে আসে। স্কুল ইউনিফর্ম পড়া। আনায়াকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। তখন মরিয়ম নওয়াজ বলেন,

-নিবরাস আসেনি?

-এসেছে একটা দরকারে বাইরে গেছে।

তখন তারিশা,মাইশা আসে। মাইশাকে সালাম দেয় আনায়া। তারিশাকে দেখেও ভালো মন্দ খোঁজ খবর নিয়ে পরিচিত হয় আনায়া। মরিয়ম নওয়াজ তাকে ফ্রেয় হতে রুমে পাঠায়। আনায়ার পেছন দিয়েত তারিশা যায় নিবরাসের রুমে।

তারিশাকে দেখে বসতে বলে আনায়া। ব্যাগ থেকে থ্রিপিস বের করে ওয়াশরুম ঢুকে যায় আনায়া। তারিশা খাটের উপর বসে রুমটায় চোখ বুলায়। সব এখন আনায়ার হয়ে গেলো।

বেশীক্ষণ বসেনি তারিশা। চলে আসে রুম থেকে।

*****

রাজকে বেঁধে রেখেছে চেয়ারের সাথে। নিবরাস সাথে তার কয়েকজন লোক যায় গোডাউনে। রাজকে দেখে হাসে নিবরাস।

হাতের পিস্তলটার দিকে একবার তাকায়। পরক্ষণে রাজের মাথা বরাবর পিস্তলটা ধরে বলে,

-আমি আসলে অতি সাধারণ ভাবে নিজেকে তুলে ধরতে পছন্দ করি। তবে কী জানিস? এই রাজনীতির মঞ্চে এসে কেউই সৎভাবে চলতে পারে না। এরকম দু একটা গ্যাং রাখা লাগে। যাদের সম্পর্কে কেউ জানে না। নাহলে শত্রুর জন্য একমাস না যেতে রাজনীতির মঞ্চ থেকে ঠাস করে নিচে পড়ে যেতে হয়। আচ্ছা তুই বল! এতো কষ্ট করে এমপি পদে নির্বাচিত হয়ে কেউ রাজনীতির রংমহলের মঞ্চ থেকে ঠাস করে নিচে পড়ে যেতে চায়? তাও কয়টা গ্যাং না রাখার জন্য? একদম না! তোর এতো সাহস! নেতার বউকে স্পর্শ করেছিস।

নিবরাসের কঠিনগলায় বলা কথাগুলো রাজকে কাঁপিয়ে তুলে। ভার্সিটিতে তখন তেমন কোন রিয়েক্ট করেনি নিবরাস! এমন ভাব করেছে জেনো কিছুই হয়নি। সাধারণ কিছু ঘটেছে।

নিবরাস হুংকার ছেড়ে বলে,

-কে পাঠিয়েছে তোকে?

-ম্যাম।

-কোন ম্যাম?

-আছে তাকে আমি চিনি না।

-না চিনে চলে আসলি নাটক সাজাতে?

-টাকার জন্য!

-গুড! তা এখন তোকে কী করা যায়? হাত দু’টো ভেঙে আজীবনের জন্য পু’ঙ্গ নাকী মাথাটা গলা থেকে আলাদা করে দেওয়া যায়?

-যা খুশি কর নেতা! আপনার সব সত্যও একদিন সামনে আসবে।

হাসে নিবরাস। ভয়ংকর রকমের ধ্বনি তুলছে তার এই হাসি। বাকীরা তাকিয়ে আছে নিবরাসের দিকে। আজকে নিবরাস সাদা পান্জাবি পড়ে আসেনি। কালো শার্ট পড়ে এসেছে। আর বাক্যব্যয়,সময়ব্যয় না করেই পিস্তাল থেকে দুটো বুলেট রাজের নামে দান করে দেয়। রক্ত কিছু ছিটকে নিবরাসের শার্টে আসে। সেটা সে টিস্যু দিয়ে মুছে নেয়।

-আসলে কী জানো? সাদা মানে শুভ্র আর পবিত্র! সেজন্য সাদা পান্জাবি পড়ে আমি খু’ন করে শুভ্র রংটা নষ্ট করতে চাই না। কালো মানে কুৎসিত! যেটা খু’ন করার সময় পরে থাকার জন্য উত্তম একটা রং। যেটায় রক্তের দাগ লাগলে কেউ বুঝবে না। কিন্তু! সাদা রংটায় রক্তের দাগ লাগলে সবাই বুঝে যাবে শুভ্র নিবরাস খু’নি।

গোডাউনটা পুড়িয়ে দিয়ে চলে আসো। তবে খেয়াল রাখবে যাতে সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

নিবরাসের কথা অনুযায়ী কিছু লোক কাজে লেগে পড়ে। রোহীত নিবরাসের পেছনে আসে।

-স্যার আপনার কী মনে হয় ওই মেয়েটা কে?

-আহিয়া।

-কিন্তু!

-আমায় রাজনীতির মঞ্চ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে চায় এই আহিয়া। হয়ত শামিম সরদারের সাথে হাত আছে ওর। পুরোনো ক্ষোভ না নেওয়া অব্দি এই মেয়ে ক্ষেন্ত হবে না।

-ওটাতে তো আপনার ভুল নেই! ওর বোনের দোষ। আপনার কী? মেয়েটার মাথা নিশ্চয়ই পাগ’ল হয়ে গেছে সেজন্য সাদরে মৃ’ত্যু গ্রহণ করতে চাইছে।

-কলিজাটা ভীষণ বড় ওর। আজকে যখন আমি ভার্সিটিতে যাই তখন দেখেছি ও পাশের বিল্ডিংটায় দাঁড়িয়ে আনায়ার উপর নজর রেখেছিলো।

-কিন্তু!

-নিবরাসকে চেনো তো রোহীত? অবশ্য চিনবে না চেনার কী আছে? এতোবছর ধরে আছো। আমি কাঁচা খেলোয়াড় নই!

-আজকে একটা খু’ন হলো!

-সব এখানেই শেষ রোহীত। কেউ জানবে না এটা।

-যদি পুলিশ তদন্ত করে?

-প্রমাণ কোথায়?

-আপনি স্যার এলাকার এমপি কিন্তু আপনি যদি মানুষ খু’ন করেন?

-আবর্জনা দূর করছি এলাকা থেকে।

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে