হিমি পর্ব-৫৭+৫৮

0
868

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৫৭.

ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে জ্যাম পাউরুটি চিবোচ্ছে হৃদি। দৃষ্টি মোবাইলের স্ক্রিনে। তাহির সোফায় বসে প্যাশেন্টের ফাইল দেখছে। মাঝে মাঝে চামচে অমলেট তুলে মুখে পুরছে। হিমির খাওয়ায় মনোযোগ নেই। কাল রাতেই খবর পেয়েছে বন্ধুমহলে অঘটন ঘটেছে। ইমন সুপ্তিকে নিয়ে পালিয়ে গেছে। কারনটা এখনো অজানা তার। যার সাথে ইমনের বিয়ে ঠিক তাকে নিয়ে হঠাৎ পালানোর কি কারন থাকতে পারে বুঝে উঠতে পারছে না হিমি। বন্ধুদের সাথে দেখা করে আসল রহস্যের উন্মোচন করতে হবে। এবং এটা আ‌জ‌ই করতে হবে। কিন্তু এ ব্যাপারে কাউকে কিছু বলাও যাচ্ছে না। হাঁসফাঁস করছে সে। হিমির অস্বস্তি চোখ এড়ায় নি মায়মুনার। খাবার খাওয়ার ফাঁকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে হিমির দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘কি সমস্যা? খাচ্ছো না কেনো?’

ভাবনায় ছন্দপতন হ‌ওয়ায় চমকালো হিমি। জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে ব্ল্যাক কফিতে চুমুক বসালো। মায়মুনা জামান খেতে খেতে বললেন,

‘হৃদি? মোবাইল বন্ধ করো এখন।’

হৃদি মাথা দুলিয়ে প্লেটের পাশেই মুঠোফোন বন্ধ করে রাখলো। হিমি অপ্রস্তুত গলায় বললো,

‘আজ একবার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে যাবো? দরকার ছিলো।’

‘সেদিন না দেখা করলে!’

‘সেদিন তো চলে গেছে। মানে কতোদিন আগে দেখা করেছি।’

‘বিয়ের পর ঘনঘন এতো বন্ধু বন্ধু করলে চলে না। মাসে একবার দেখা করতেই পারো। তা বলে কদিন অন্তর অন্তর?’

চুপসে যাওয়া মুখ নিয়ে আবার‌ও বললো হিমি,

‘আজকে যাই। খুব দরকার না হলে বলতাম না।’

‘কি দরকার?’

ঢোক গিললো হিমি। শাশুড়ি যদি জানেন বন্ধু মেয়ে নিয়ে পালিয়েছে তাহলে আর কখনোই ওদের সাথে সম্পর্ক রাখতে দিবেন না। একথা কিছুতেই বলা যাবে না। হিমি তাই ভেবে চিন্তে বললো,

‘ওই আসলে, আমার এক বন্ধুর বিয়ে সামনে।’

‘ওহহ আচ্ছা। যেও।’

হিমি মুখটা হাসি হাসি করলো। বললো,

‘ওনার সাথে যাই?’

মায়মুনা দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বললেন,

‘জিজ্ঞেস করে দেখো ওর সময় হবে কি না।’

হিমি মাথা নেড়ে তাহিরের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বললো,

‘বাচ্চা ডা,,,’

সাথে সাথেই গম্ভীর গলায় মায়মুনা বলে উঠলেন,

‘উম,,মানা করেছি না?’

হিমি জিব কামড়ে শুকনো হাসলো। কি বলে ডাকবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ‌ই জোরে বলে উঠলো,

‘স্বামী?’

হৃদি পানি খাচ্ছিলো। হিমির ডাক শুনে বিষম খেলো সে। মুখ থেকে ছিটকে পানি বাইরে পরলো। তাহির গোল গোল চোখে পেছন ফিরে তাকালো। মায়মুনা রাগান্বিত গলায় বললেন,

‘হৃদি?’

হৃদি কাঁশতে কাঁশতে মুখ মুছে বললো,

‘সরি ফুপ্পি। ভাবির ডাক শুনে বিষম খেয়ে গেছি।’

মায়মুনা অস্থির চোখে তাকালেন। হিমি খানিকটা লজ্জা পেলো বোধ হয়। তবুও ওই এক‌ই ভাবে ডেকে বললো,

‘আপনি এখন বেরুবেন?’

ঘোর কাটলো তাহিরের। গলা পরিষ্কার করে বললো,

‘হ্যা।’

‘আমিও যাবো। বন্ধুদের সাথে দেখা করতে হবে। ওরা ভার্সিটির কাছের ক্যাফেতে থাকবে।’

তাহির ছোট্ট করে বললো,

‘আচ্ছা।’

.

হিমি হন্তদন্ত হয়ে ক্যাফেতে ঢোকতেই চেয়ারে গা এলিয়ে রাখা সূর্য সোজা হয়ে বসলো। মেঘ সচেতন চোখে তাকালো। দোহা সোহিনীর নিজেদের মধ্যকার কথা থামালো। হিমি টেবিলে কাছাকাছি এসেই প্রশ্ন করলো,

‘ঘটনা কি? কাল যা শুনলাম তা সত্যিই?’

কেউ কোনো জবাব দিলো না। শুধু মাথা দুলিয়ে সায় জানালো। হিমি চেয়ার টেনে বসলো। চেহারায় চিন্তার ছাপ বজায় রেখে বললো,

‘কিন্তু কেনো? সব তো ঠিক ঠাক‌ই ছিলো।’

‘কিয়ের কি ঠিক আছিল? শালারে কতো ক‌ইরা ক‌ইলাম খুইলা ক সমস্যা কি। একটা কথাও জানায় নি! হারামখোর!’

‘কি কথা জানায় নি সূর্য? বলবি তো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।’

মেঘ লম্বা নিশ্বাস টেনে বললো,

‘ইমনের বড় খালা মানে সুপ্তির মা মারা গেছেন।’

হিমি মুখ হা করে বললো,

‘কি! সুপ্তির মা মারা গেছেন? কবে? কি হয়েছিলো ওনার?’

সোহিনী শোকাহত গলায় বললো,

‘দু সপ্তাহ আগে। শুক্রবার রাত আটটার দিকে। সুপ্তির মা তো অনেক দিন যাবত‌ই অসুস্থ ছিলেন। স্ট্রোক করেছিলেন। কয়েক সপ্তাহ আগে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিলো। ইমন বলেছিলো কিছু একটা ঝামেলা হচ্ছে পরিবারে। তখন তো জানতাম না। পরে জানলাম।’

‘কি জানলি?’

‘সুপ্তির বাবা নাকি ইমন আর সুপ্তির বিয়ে মেনে নিচ্ছিলেন না। তার‌পর স্ত্রীর কথা ভেবে নিমরাজি হয়েছিলেন। এর মধ্যে হঠাৎ আন্টির অসুস্থতা বেড়ে যায়। মারা যান তিনি। এরপর‌ই বেঁকে বসেন সুপ্তির বাবা। যার কথা রক্ষার্থে বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন সেই যখন নেই তাহলে এই বিয়ের কোনো মানে নেই। উনি কিছুতেই ইমন আর সুপ্তির বিয়ে দেবেন না।’

‘এইটুকু কারনে পালিয়ে গেলো?’

হিমির কৌতুহলী প্রশ্নের জবাবে মাথা নাড়লো দোহা। বললো,

‘এটা এইটুকু কারন নয়। এই কথার প্রেক্ষিতেই ওরা পালাতে পারতো। কিন্তু ঘটনা সেখানে শেষ হয় নি। আন্টির মৃত্যুর তিন দিন পরেই সুপ্তির বাবা তার ভাইয়ের ছেলের সাথে সুপ্তির বিয়ে দেয়ার কথা তুলেন। ওনার ভাইয়ের ছেলে এক পায়ে খাড়া। সুপ্তি কেঁদে কেটে পাগল হয়ে যাচ্ছে। ইমন তার পরিবার সমেত তাদের বাড়ি গেলে সুপ্তির বাবা না কি গেইট থেকেই বিদায় করে দেন তাদের। ইমনের পরিবারের সাথে কোনো প্রকার সম্পর্ক রাখতেও তিনি ইচ্ছুক নন। কোনো এক অজ্ঞাত কারনে ইমনের বাবার সাথে আজীবনের রেশারেশি ওনার। ইমন তবুও তার বাবাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে সুপ্তির বাবার সাথে কথা বলতে বলে। ছেলের কথা ভেবে আঙ্কেল ফোন করেছিলেন। সুপ্তির বাবা ফোন তুলে যাচ্ছেতাই বলে বিশেষ করে অতীতের কিছু কথা তুলে অপমান করেন। এবার আর কিছুতেই সুপ্তির বাবার সাথে যোগাযোগ করতে চান নি আঙ্কেল। বলে দিয়েছেন জোর করে কিছু হয় না। তাই ইমনের সরে আসা উচিত।’

দোহা থামতেই মেঘ বলতে লাগলো,

‘এদিকে সুপ্তির বাবা জোর জবরদস্তি করে মেয়ের বিয়ে দিতে চাইছিলেন। রাজি হচ্ছে না দেখে সুপ্তির উপর হাত‌ও উঠিয়েছেন শুনেছি। সেই সময় তাদের কাছে একটাই রাস্তা খোলা ছিলো। পালানো। সুপ্তির মায়ের জন্য কোন এক মাজারে শিরনির ব্যবস্থা করেছিলেন ওর বাবা। গতকাল সেখান থেকেই ইমনের সাথে পালিয়েছে সুপ্তি।’

হিমির ঘাম ছুটছে। থমথমে গলায় বললো,

‘এতোকিছু ঘটে গেছে? তোরা কি করে জানলি? এক সেকেন্ড! ‌ইমন তোদের এসব বলেছে? সামহাও তোরা তাদের পালাতে সাহায্য করিস নি তো?’

বিরক্তি চোখে তাকালো সূর্য। বললো,

‘আরেহ না। এইটা ঠিক যে ওই আমাগো সব কথা ক‌ইছে। কিন্তু আমরা জানতাম না ওরা এমনে পালাইবো। কাল বিকালে ফোন দিছিলাম খবর জানতে। তখন বলে, “আমি সুপ্তিরে নিয়া যাইতাছি দোস্ত। এদিক টা সামলায় নিছ। ফোন দিলে পাবি না। সিম ফালায় দিতাছি। সুযোগ বুইঝা আমি যোগাযোগ করমু তোগো লগে।” এখন আবার ওর বাপ মায় ফোন দিয়া জ্বালাইতাছে। ক‌ই আছে? কি করে? কবে আইবো? বিয়া করছে নি? এমন সব প্রশ্ন ক‌ইরা ক‌ইরা মাথা খারাপ ক‌ইরা দিতাছে। সুপ্তির বাপ‌ও তাদের গালমন্দ করতাছে।’

এটুকুতে থেমে অস্ফুট স্বরে সূর্য বললো,

‘শালা গেলোটা ক‌ই?’

হিমি মাথায় হাত দিয়ে বসে র‌ইলো। মনে হলো পরিবার ছেড়ে এভাবে শুধু ভালোবাসা পাওয়ার আশায় পালানো উচিত নয়। পরিবারের উপর ছেলে মেয়ে পালানোর ভয়াবহ প্রভাব পরে। তখন‌ই তার অনুশোচনা হলো। তাহিরের হবু ব‌উকে ভাগিয়ে দেয়ার অনুশোচনা। তাকে পালানোতে সাহায্য করার অনুশোচনা। ইমন যেখানে তাদের বন্ধু সেখানে সামিয়া তাহিরের হবু ব‌উ ছিলো। ইমন পালানোয় তাদের যতোটা টেনশন হচ্ছে তার থেকে কয়েক গুন বেশি টেন‌শন হচ্ছে তার পরিবারের। ঠিক তেমন ভাবেই টেনশন হচ্ছিলো সামিয়ার বাবা মায়ের। সন্তানদের থেকে এসব তো কখনোই প্রাপ্য নয় বাবা মায়ের। ভুল করে ফেলেছে হিমি। ইমন সুপ্তিরাও ভুল করেছে। যে করেই হোক তাদের ফেরাতে হবে। কিন্তু কি করে ফিরাবে? ওরা কোথায় আছে সেটাই তো জানে না কেউ। আর যদি ইমনদের দেখা পায় তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় তবে কি সব ঠিক হয়ে যাবে? না তো। উল্টো আরো ঘোলাটে হবে। সুপ্তির বাবার রাগ সপ্তম আসমান পেরিয়ে যাবে। ইমনের বাবা মায়ের‌ও লজ্জার, অপমানের শেষ থাকবে না। উফ, কি করলো ইমন? একটা বার পরিবারের মানুষগুলোর কথা ভাবলো না? হাত পা কাঁপতে থাকে হিমির। সেই সাথে বন্ধুদের ভয় বাড়তে থাকে। কষ্ট হতে থাকে। সুপ্তির বাবা পুলিশ কেইস করে দেবে না তো? কোনোভাবে কি ওরাও জড়িয়ে যাবে এসবে? মাথা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে তাদের। এই মুহুর্তে ইমনের উপর ভয়ানক রাগ লাগছে। সবাই এক সাথে বসে কথা বললে হয়তো কোনো না কোনো রাস্তা পেতো। সেসবের সময় না দিয়েই উড়াল দিলো সে। পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যত সবকিছুই ছুড়ে ফেলে দিলো ইমন। এমনটা তো হ‌ওয়ার কথা ছিলো না!

নিজ কেবিনে টেবিলের উল্টো দিকে বসা তাহিরের দৃষ্টি মুখোমুখি চেয়ারে বসা হিমির দিকে। তার এই অসময়ে হাসপাতালে আসার পেছনে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলেই জানিয়েছে হিমি। কিন্তু এখনো বলছে না সেই কথা। তাহির বার বার ঘড়ি দেখছে। বাইরে প্যাশেন্টরা বসে আছেন। কাজ ফেলে অহেতুক বসে থাকতে তার মোটেও ভালো লাগছে না। থাকতে হচ্ছে তবুও। হিমি কিছু একটা বলতে গিয়েও চুপ করে যাচ্ছে। মাথা নুইয়ে রেখে ডান হাতের নখ দিয়ে টেবিলে খট খট শব্দ তুলছে। তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

‘আপনার দরকারি কথা বাড়ি গিয়ে শুনলে হয় না?’

হিমি ডানে বামে মাথা নাড়লো। তাহির আরো কিছুক্ষন অপেক্ষা করে গম্ভীর গলায় বললো,

‘আপনি কি সত্যিই কিছু বলবেন? না বলার থাকলে আসুন। সময় নষ্ট হচ্ছে আমার। আমি টাইম ওয়েস্ট করতে আর প্যাশেন্টসদের অপেক্ষা করিয়ে রাখতে পছন্দ করি না।’

হিমি শুকনো ঢোক গিলে বললো,

‘সরি।’

‘কি বলবেন সেটা বলুন।’

‘সরিই তো বলতে চাইছিলাম।’

ভ্রু কুঁচকালো তাহির। বললো,

‘কেনো? সরি বলার মতো এমন কোনো কাজ করেছেন না কি?’

‘হুম।’

মাথা উপর নিচ করলো হিমি। গাল দুটো ফুলে আছে। সেই সাথে বিষন্নতা গ্রাস করছে তাকে। তাহির জানতে চাইলো কি এমন করেছে যার জন্য এক্ষুনি সরি বলতে হচ্ছে তাকে। হিমি নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে বললো,

‘সামিয়া নিজে থেকে পালায় নি বাচ্চা ডাক্তার। আমি ওকে পালাতে বলেছি।’

প্রথমদফায় কিছু বুঝলো না তাহির। হিমির কথাগুলো বুঝার চেষ্টা করলো। যখন‌ই বুঝলো তখন‌ই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার। হিমি নিজ থেকেই বললো,

‘খুব খুব সরি। আসলে আমি চাই নি আপনার বিয়ে হোক। তাই এটা করে ফেলেছি। ইচ্ছে করেই করেছি। তখন বুঝিনি কি ভুল করছি এখন বুঝেছি। প্লিজ, সরি।’

মুখটা কাঁদো কাঁদো করে ফেললো হিমি। তাহির উঠে দাঁড়ালো। কোমরে হাত রেখে শব্দ করে শ্বাস ফেলে বললো,

‘আপনার এই কাজটা করা উচিত হয় নি হিমি। আই অ্যাম ট্রুলি ডিজাপয়েন্টেড।’

হিমি কাঁদো কাঁদো চেহারায় উঠে দাঁড়ালো। টেবিলে দু হাত রেখে বললো,

‘আসলে আমি না ওই সময়,,,,,’

হিমিকে আর কিছু বলতে দিলো না তাহির। হাতের ইশারায় বেরিয়ে যেতে বললো। হিমি তাহিরের ইশারা বুঝেও নড়লো না। ভ্রু কুঁচকে ঠোঁট ফুলিয়ে কিছু বলবে তার আগেই তাহির গমগমে ভরাট গলায় বললো,

‘বাড়ি যান। কাজ আছে আমার।’

হিমি আর কিছু বলার সাহস করলো না। তাহিরের মুখ দেখে মনে হচ্ছে হিমির উপর তীব্র রেগে আছে সে। ভয়ঙ্কর কিছু করে দিতে পারে। বাধ্য মেয়ের মতো হিমি কেবিনের বাইরে বেরুলো। নিজের উপর ভীষন অসন্তুষ্ট সে। তাহিরের মনটাও খারাপ করে দিলো। হিমি ধিক্কার জানালো নিজেকে। কি দরকার ছিলো এসব করার? ‌আর করলেই বা বললো কেনো এখন? কেউ তো জানতে চায় নি। জ্যাঠুমনিও বলেছিলো যেনো কাউকে কিছু না জানায়। তবুও অনুশোচনার ভারে নুইয়ে পরছিলো কি না, সাধু সেজে দোষ স্বীকার করতে এসে আরো সব বিগড়ে দিলো।

চলবে,,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৫৮.

খাটের কোনায় ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে আছে হিমি। তাহির হাসপাতাল থেকে ফিরেছে প্রায় এক ঘন্টা হলো। এই এক ঘন্টা যাবত‌‌ই হিমি দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে তাহির তাকে নিশ্চুপ হয়ে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকা শাস্তি দিয়েছে। কিন্তু আসলে তা নয়। হিমির কেবিন থেকে বেরুনোর পর থেকে এখন অব্দি একটা কথাও বলে নি তাহির। বাড়ি ফিরে যখন হিমির ভয়ার্ত চেহারা দেখেছে তখন‌ও বলে নি। এখনো বলছে না। দিব্যি নিজের কাজ সেরে নিচে ডিনার করতে চলে গেছে। তবে তাহির নিচে নেমে যেতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে হিমি। তার মনে হতে লাগলো এতক্ষনে দম নিতে পেরেছে সে। হিমি তাড়াহুড়া করে মুঠোফোন উঠিয়ে মোজাম্মেল সাহেবের নাম্বারে ডায়াল করলো। রিং হ‌ওয়া মাত্র‌ই রিসিভ হলো কল। মোজাম্মেল সাহেব উচ্ছ্বাসিত গলায় বললেন,

“কেমন আছিস মা?”

“একটা ভুল করে ফেলেছি জ্যাঠুমনি।”

“ভুল! কি ভুল?”

“আমি ওনাকে সব বলে দিয়েছি।”

হিমির কথার আগামাথা বুঝলেন না মোজাম্মেল সাহেব। বললেন,

“কাকে কি বলে দিয়েছিস?”

“ওনাকে। মানে বাচ্চা ডাক্তারকে। আমি ওনাকে বলে দিয়েছি যে সামিয়াকে আমি পালাতে সাহায্য করেছি। এমনকি আমিই ওকে পালাতে বলেছি।”

“কেনো বলেছিস?”

“আমার কেমন জেনো লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো খুব বড় ভুল করেছি। আর ভুলটা ওনার থেকে গোপন রেখে আরো ভুল করছি। তাই না পেরে বলে দিয়েছি। কিন্তু বলার পর বুঝেছি না বলাই ভালো ছিলো। সব সত্যি বলে ভুল করে ফেলেছি।”

মোজাম্মেল সাহেবের গলা কড়া হলো,

“ভুল আর ভুল। আগে তো এমন ছিলি না হিমি। যা মন চাইতো তাই করতি। কাউকে কোনো কৈফিয়ত দিস নি। ভালো খারাপ যাই হতো নিজেই সামলে নিতে পারতি। তাহলে এখন কেনো পারছিস না? ভুল স্বীকার করছিস ভালো কথা কিন্তু গন্ডগোল করে ফেলছিস কেনো?”

“আমি জানি না জ্যাঠুমনি। কি করতে কি করে ফেলছি বুঝতে পারছি না। প্লিজ হেল্প করো না!”

“কি হেল্প?”

“বাচ্চা ডাক্তার আমার সাথে কথা বলছেন না। উনি রেগে আছেন কি না তাও বুঝছি না। তবে যখন আমি ওসব বলেছিলাম তখন তিনি রেগে গেছিলেন। আমায় কেবিন থেকে চলে যেতেও বলেছিলেন। তারপর থেকে একটা শব্দ‌ও বলেন নি।”

“ও তোর সাথে কথা বলছে না মানেই তো ভয়ঙ্কর রেগে আছে। রেগে থাকার‌ও কথা।”

হিমি তাড়াহুড়া করে বললো,

“না না জ্যাঠুমনি। ওনার কথা বলা না বলার পেছনে রাগ মূখ্য নয়। মূখ্য হচ্ছে কষ্ট। উনি কষ্ট পেয়েছেন বলেই কথা বলছেন না। রেগে থাকলে বলতেন।”

“রেগে থাকলে কথা বলতো?”

“হ্যা। উনার রাগ এমন যে কেউ ধরতে পারে না। খুব স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেন। আজ বলছেন না। এর মানে উনি রাগ করেন নি। তবে কষ্ট পেয়েছেন। নিশ্চয় আমার থেকে এমনটা আশা করেন নি বলে কষ্ট পেয়েছেন নয়তো ওনাদের অপমানের পেছনে আসল দায়ি আমি বলে কষ্ট পেয়েছেন। দুটো কাজ‌‌ই আমি করেছি। তাই হয়তো কষ্টটা বেশি।”

থম মেরে গেলেন মোজাম্মেল সাহেব। হিমিকে কখনো এতোটা ভাবতে দেখেন নি তিনি। এতোটা বুঝদার‌ও ছিলো না সে। পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম। হিমিও সেই নিয়মে পা মিলিয়েছে দেখে ভালো লাগছে মোজাম্মেল সাহেবের। হিমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

“ভয় হচ্ছে জ্যাঠুমনি।”

“কিসের ভয়? ‌তুই তো বললি মনের ডাক্তার রাগ করে নি। যেহেতু রাগ করে নি তাহলে তেমন কিছু হ‌ওয়ার কথা নয়। ভয় পাবি কেনো?”

“রেগে থাকলে তো ভয় পেতাম না। ওনার রাগ ভাঙাতে পারতাম। কি করে কি করেছি, কেনো করেছি সবটাও বলতাম। উনি তো কষ্ট পেয়েছেন। আমার দিকে তাকাচ্ছেন‌ও না। ইগনোর করছেন। কি করে কথা বলবো? কথা না বললেও যে উনি আগ বাড়িয়ে কথা বলবেন না। ভয় হবে না?”

তটস্থ হলেন মোজাম্মেল সাহেব। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

“আমি জানতাম হিমি কাউকে ভয় পায় না। হিমি দাদুকে ভয় পায় না, চাচামনি ছোটমাকে ভয় পায় না, মামানিকে ভয় পায় না। কিন্তু তুই তো দেখছি ভয় পাস। ভয়ানক ভয় পাস। তাও আবার নিজের বরকে।”

ভরাট গলায় জবাব এলো,

“আমি ভয় পাই জ্যাঠুমনি। সব সময়‌ই ভয় পাই। তোমরা কেউ বুঝোনি। আমিও বুঝতে দেই নি। আমি দাদুকে যতোটা না ভয় পাই তার চেয়ে বেশি ভয় পাই বাবাকে। আমার ভয় হয় কখন মায়ের মতো বাবাও আমায় ফেলে চলে যায় আর যাওয়ার আগে একবার আমায় আদর না করে। বাবার ভালোবাসা কখনো পাবো কি না সেটা ভাবলেও আমার ভয় হয়। মামানিকে ভয় পেতাম ছোটবেলায়। বড় হতে হতে ভয় কেটে গেছে। সত্যি বলতে এখন মামানির জন্য অনুভুতিই নেই। আমার মনেই হয় না মামানি বলতে ব্যক্তিটি আমার জীবনের অংশ। চাচামনিকে শেষবার তখন ভয় পেয়েছিলাম যখন পরীক্ষায় ফেইল করার জন্য ওনার থেকে বেতের বারি খেয়েছিলাম। তারপর থেকে রাগ হয়। ভয় হয় না। আর ছোটমা! আমার অদ্ভুত লাগে ওই মানুষটাকে। বিরক্ত লাগে। ভয় লাগে না।”

“মনের ডাক্তারকে কেনো ভয় পাচ্ছিস?”

“ওনাকে ভয় পাচ্ছি না তো। ভয় পাচ্ছি ওনার কষ্ট থেকে সৃষ্ট ঘৃণাকে। আমার মনে হচ্ছে অতি শিঘ্র‌ই উনি আমায় ঘৃণা করবেন। আমার উপর বিরক্ত বোধ করবেন। অবিশ্বাস করবেন। ওনার আরা আমার মধ্যে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক ছাড়া আরো একটা অদৃশ্য সম্পর্ক আছে। বিয়ের আগেই হয়তো সেই সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। বুঝি নি। তবে এখন বুঝছি। আমি চাই না কোনোভাবে সেই সম্পর্ক নষ্ট হোক। আমি যাই চেয়েছি তাই হারিয়েছি। বার বার আফসোস করেছি। কখনো কখনো দোষারোপ করেছি অন্যকে। অথচ শুধু এই মানুষটাকেই কেনো জানি আমার মনে হয়। মনে হয়, আমি ওনাকে চেয়েছিলাম। পেয়েছি। প্রথমবারের মতো নিজেকে সুখী মনে হয়েছে। হচ্ছেও। আমি চাই না এই সুখটা চলে যাক। জ্যাঠুমনি? আমার ভয় হয় কখন আমাকে ওনার ঘৃণার বস্তু মনে হয়। কখন না আর সবার মতো আমাকে ফেলনা ভেবে বসেন। আমি বাবার কাছে ফেলনা হয়েও শক্ত থেকেছি। কিন্তু বাচ্চা ডাক্তারের কাছে ফেলনা হয়ে গেলে আর পারবো না। বিশ্বাস করো। আমার খুব অদ্ভুত লাগছে। হাত পা কাঁপছে। কান্না পাচ্ছে। নিজেকে ভীষন অপরাধী লাগছে জ্যাঠুমনি।”

হিমির প্রত্যেকটা কথা মন দিয়ে শুনলেন মোজাম্মেল সাহেব। ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

“কি করতে হবে বল। দেখি তোর বাচ্চা ডাক্তারের মন হালকা করতে পারি কি না।”

হিমি জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললো,

“তোমায় ওনার সাথে কথা বলতে হবে। ওনাকে সবটা বলতে হবে। আমি বুঝিয়ে বলতে পারবো কি না জানি না। তাই বলছি তুমিই বলে দিও। তুমি তো সব জানো। ঠিকমতো বুঝিয়ে বলবে কিন্তু। তারপর ওনাকে বলবে যে, দোষ আমার। তাই যেনো আমায় বকেন। রাগ করেন। বাকিটা আমি সামলে নেবো। উনার মন একবার হালকা হলেই আমার সাথে কথা বলবেন। আমি তখন মাপ চেয়ে নেবো। রাগ ভাঙাবো, সরি বলবো। তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। বলবে তো জ্যাঠুমনি?”

মোজাম্মেল সাহেব ঘোরে চলে গেছিলেন। হিমির প্রশ্নে ঘোর কাটে তার। ব্যস্ত হয়ে বলেন,

“অবশ্য‌ই বলবো। তুই বলেছিস মানে বলতে হবেই। এক্ষুনি ফোন করছি আমি। দেখি কি করে রেগে থাকে সরি মানে কষ্ট পেয়ে মুখ ভার করে থাকে! ওর মন প্রাণ সব সতেজ করে দেবো। রাগ‌ও করবে না তোর উপর। আমার সাথে কথা বলার পর পর‌ই দেখবি কেমন স্বাভাবিক হয়ে যাবে মনের ডাক্তার। হাসবে। হেসে হেসে কথা বলবে তোর সাথে। তুই এতো ভাবিস না।”

“হুম। কিন্তু তুমি এখন ফোন করো না। উনি ডিনার করছেন। পরে করো।”

“বেশ। তুই ডিনার করেছিস?”

“না। খিদে পায় নি।”

“খিদে পাবে না কেনো? মানুষের খিদে পাবে স্বাভাবিক। খিদে না পাওয়া হলো অস্বাভাবিক। তুই মানুষ হয়ে তোর খিদে পাচ্ছে না? এটা তো অস্বাভাবিক ঘটনা হিমি! এই অস্বাভাবিকতা, অসামঞ্জস্যতা মেনে নেয়া যায় না। তুই খেতে যা। জোর করে হলেও খেয়ে নে।”

_____________________

ব্যালকনির রেলিংএ এক হাত রেখে ফোনে কথা বলছে তাহির। শোবার ঘর অন্ধকার। হিমি ঘুমাচ্ছে। তার ঘুমে ডিস্টার্ব হবে ভেবেই ফোন এট্যান্ড করতে বাইরে এসেছে তাহির। ফোনের অপর প্রান্তে মোজাম্মেল সাহেব কথা বলছেন।

“হিমির উপর রেগে আছো?”

“জি না। আমি রাগ করি নি।”

“হিমিও তাই বলেছে। আমার বিশ্বাস হয় নি। কারন, আমার যতদূর মনে হয় হিমির কনফেশন শুনে তোমার রেগে যাওয়া উচিত ছিলো। রাগলে না কেনো?”

“রাগার কোনো কারন খুঁজে পাই নি। তবে ওনার কথা শুনে অবাক হয়েছি। আমার কাছে ওনার কাজ গোলমেলে লেগেছে। আমি বুঝতে পারছি না কি ভাবে রিয়েক্ট করবো। ওনার সাথে কথাও বলতে পারছি না। আটকে যাচ্ছি। অস্বস্তি হচ্ছে।”

“তোমায় আমি মনের ডাক্তার বলে সম্বোধন করি বলে কিছু মনে করো না তো?”

“জি না। আপনার যা ইচ্ছা ডাকতে পারেন।”

আশ্বস্ত হলেন মোজাম্মেল সাহেব। ছোট্ট শ্বাস ফেলে রকিং চেয়ারে বসে বললেন,

“মনের ডাক্তার? আমি জানি, হিমির কাজে তুমি কষ্ট পেয়েছো, অপমানিত হয়েছো বুঝতে পারছি। আমি মানি হিমি যা করেছে তা ঠিক করে নি। কিন্তু তোমার বিয়ে আটকানোর আর কোনো রাস্তা ছিলো না ওর কাছে। বাধ্য হয়েই করেছে।”

তাহির বিস্মিত হলো। বললো,

“আমার বিয়ে আটকানোর পেছনে ওনার কি স্বার্থ ছিলো সেটাই তো বুঝতে পারছি না আঙ্কেল। কি এমন কারন যার জন্য কনেকে পালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন তিনি?”

“তোমায় একটা গোপন কথা বলি। টপ সিক্রেট। কাউকে বলো না যেনো। বিশেষ করে হিমিকে। আমি আর আমার স্ত্রী, হিমির বড়মা, হিমিকে যতোটা চিনি ততোটা হয়তো ওও নিজেকে চিনে না। কথাটা বলার কারন হচ্ছে হিমির স্বার্থ সম্পর্কে আমরা অবগত। হিমি ভালোবাসার কাঙাল। আজীবন ভালোবাসা চেয়েছে। আপন মানুষদের থেকে ভালোবাসা না পেতে পেতে এতোটাই ভেঙে গেছে যে কাউকে কাছে পেলেই আকড়ে ধরতে চায়। তোমার কি মনে হয় বলোতো! হিমি কেনো তোমার বিয়ে আটকাতে চাইছিলো?”

কয়েক সেকেন্ড মতো ভেবে তাহির জবাব দিলো,

“বলতে পারছি না।”

“হিমি তোমাকে ভালোবাসে। তোমাকে চাইতো বলেই অন্য কারো সাথে তোমাকে জড়িয়ে যেতে দেখতে চায়নি। তোমার স্ত্রী ভীষন বোকা। ও জানে না ও তোমায় ভালোবাসে। তখন‌ও জানতো না। তোমার বিয়ের দুদিন আগে মাঝরাতে হঠাৎ আমায় ফোন করে বলে তার কান্না পাচ্ছে। কারন জিজ্ঞেস করায় বললো তুমি তার ফোন তুলছো না। কথা বলছো না। তাই তার কষ্ট হচ্ছে। আমি বুঝতে পারছিলাম তুমি তার থেকে দূরে চলে যাচ্ছো বিষয়টা মেনে নিতে পারছে না সে। তাই বলেছিলাম তোমার বিয়ে হয়ে গেলে তুমি তাকে আরো সময় দেবে না। কথা বলবে না। নিজের স্ত্রীর তুলনায় হিমি তুচ্ছ। হিমিকে ভাবতে বাধ্য করেছিলাম ও তোমাকে ভালোবাসে। কিন্তু আফসোস। বোকা মেয়েটা বুঝে নি। আর বুঝে নি বলেই কনেকে পালিয়ে যেতে বলেছিলো। প্ল্যান করে কনেকে বিয়ের আসর থেকে সরিয়ে দিয়েছে। ওর ধারনা ছিলো কনে চলে গেলে তোমার বিয়ে হবে না। তুমি আবার তার সাথে কথা বলবে। সময় দেবে। হিমি সেটাই চাইছিলো। ও তোমাকে ভালোবাসে বলেই তোমাকে নিজের করে রাখতে চায়। ও চায় যেনো তুমি ওকে ভালোবাসো। ওকে আপন করে রাখো। হিমি কখনোই তার এক্সপেক্টেশন অনুযায়ি কিছু পায় নি। অথচ তোমায় পেয়েছে। এক্সপেক্ট করেছিলো হয়তো মনে মনে। পেয়ে যাবে ভাবে নি। যখন পেয়েই গেছে তখন সারাজীবনের পেতে চায়। তুমি ওর ভালোবাসা বুঝো না?”

তাহির নিঃশব্দে পায়চারি করলো ব্যালকনিতে। কোনো জবাব দিলো না। নিজে থেকেও কিছু জানতে চাইলো না। মোজাম্মেল সাহেব বললেন,

“আরো একটা সিক্রেট বলি তোমায়। তুমি জানো হিমি কেনো ছেলেদের পোশাক পরতো? জানো না নিশ্চয়! শুনো, ওর যখন বয়স চার বা সাড়ে চার তখন ও জানতে পারে ওর বাবা মা ওকে ভালোবাসে না। ওর বাবা মা ওকে চায় নি। ওর ছেলে বাবু চেয়েছিলো। মেয়ে হয়েছে বলেই ওকে ফেলে চলে গেছে সবাই। কেউ ওকে পছন্দ করে না। ছোট ব‌উ মানে হিমির ছোটমা এসব ওকে বুঝিয়েছে। আমি ভীষন রাগারাগি করেছি ছোটব‌উ এর উপর তখন। আমিনা আর আমি হিমিকে বুঝিয়েছি এসব মিথ্যে। ওর বাবা ওকে ভালোবাসে। হিমি মানে নি। ওর চোখের সামনে তখন এক ট্রাঙ্ক ভর্তি ছেলে শিশুদের জামা কাপড়। খেলতে গিয়ে স্টোর রুমে সেসব দেখেছে সে। জামা কাপড়গুলো মুহিব আর হাফসার কেনা ছিলো। হিমি বিশ্বাস করে নিলো ওর বাবা মা ওকে চায় নি। ছেলে চেয়েছে। এসব পোশাক ছেলের জন্য কিনেছে। হিমির ধারনা হলো ও যদি ছেলে হয়ে যায় তবে মুহিব ওকে ভালোবাসবে। ব্যস! ‌ওই মুহুর্তে ট্রাঙ্ক থেকে জামা প্যান্ট বের করে পরার বায়না ধরলো। ওইসব জামা নবজাতকের জন্য ছিলো। হিমির পরার উপযুক্ত ছিলো না। কিন্তু তার জেদ ভয়ঙ্কর। নিহানের জামা পরবে না। নিজের জামা চাই। ওর বাবার কেনা জামা চাই। রাতের বেলা বৃষ্টি মাথায় ছুটে গেছি ছেলেদের জামা কিনতে। কিনেওছিলাম। বাড়ি ফিরে ওকে বলেছি ওর বাবা কিনে দিয়েছে। হিমি খুশি হয়েছিলো। কান্না থামিয়ে হেসেছিলো। ছেলেদের পোশাক পরে লাফিয়ে বেরিয়েছে। পরদিন নতুন আবদার। চুল কাটবে। নিহানের মতো ছোট ছোট চুল হলে ও ছেলে হয়ে যাবে। আমরা কেউ মানি নি। ওর দাদু ভীষন বকেছিলেন। মেয়ে কারো কথা শুনলে তো! নিজে নিজেই কাচি দিয়ে কেটে দিয়েছিলো কাঁধের উপর থাকা চুল। বিকেলে সেলুনে গিয়ে চুল ছাটিয়ে দিয়েছিলাম। এরপর থেকে এটাই তার অভ্যাসে পরিণত হলো। হিমি ভাবতো ছেলেদের পোশাক আর ছেলের মতো চুল থাকলেই সে ছেলে হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে নিজের খেলনা পাল্টে ফেললো। চলা ফেরা পাল্টালো। ওর বাবা যেদিন ফিরলো সেদিন খুব আগ্রহ নিয়ে মুহিবের সামনে দাঁড়িয়েছিলো হিমি। মুহিব চিনে নি। বাবা যখন বললো ও মুহিবের মেয়ে হিমি। তখন মুহিব কোনো প্রতিক্রিয়া করে নি। উঠে ঘরে চলে গেছিলো। হিমির অভিমান হলো। মুহিবের প্রতিদিনকার ব্যবহার হিমির অভিমান বাড়িয়ে দিলো। তবুও বাবার ভালোবাসা পাওয়ার আশা ছাড়ে নি। বাবার উপর যতো রাগ অভিমান থাকুক না কেনো কখনোই বাবার মুখের উপর কথা বলে নি। মুহিব ইন্ডাইরেক্টলি কথা বলতো হিমির সাথে। হিমি সব কথা রাখতো। শুনতো। কথা উল্টায় নি। চুপ করে থেকেছে। তার হাজার‌ও জেদ মুহিবের কথা ভেবে চুপসে গেছে। ভাবতে পারছো তার ভালোবাসার আকাঙ্খা কতোটা প্রগাঢ়?”

চলবে,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে