হিমি পর্ব-৫৫+৫৬

0
932

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৫৫.

“Bulaave tujhe yaar aaj meri galiyan
Basau tere sang main alag dunia
Na aaye kabhi dono main jara bhi faasle
Bas ek tu ho, ek main aur koi na

Hai mera subkuch tera tu samajhle
To chahe meri haq ke zammen rakhle
Tu sason pe bhi naam tera likh de
Main jiyu jab jab tera dil dhadke”

সাউন্ডবক্সে অনবরত গানটি বেজে চলেছে। এই নিয়ে দুবার বাজানো হয়েছে। এর আগেও তুলসী কুমারের ‘তেরি বান যাউঙ্গী’ গানটা দুবার শুনা হয়েছে। হিমির মনে হচ্ছে এদের কাছে গানের স্টক সীমিত। তাই এক‌ই গান দুবার করে বাজানো হচ্ছে। এমন‌ও হতে পারে শেষ মেষ গান না পেয়ে এক নাগারে বাজতে থাকবে কোনো এক হিন্দি গান। হিন্দি গান গুলো হিমির খুব একটা পছন্দ নয়। প্রচুর ইন্সট্রুমেন্টের আওয়াজ আর গলা ফাটিয়ে গাওয়া গানের আগা মাথা বুঝে না সে। এর চেয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীত ভালো। যদিও চার পাঁচটা গান‌ই শুনেছে হিমি তবুও তার মনে হচ্ছে এসব হিন্দি গানের চেয়ে বাংলা গানগুলোই স্রুতিমধুর।

স্টেইজে বরপক্ষের কয়েকজন নাচছে। স্টেইজের সামনেই মাঝখানে সোফা। বর কনে দুজনে সেখানে বসে। সোফার দু দিকে এবং পেছনে প্লাস্টিকের চেয়ার অতিথিরা বসে আছেন। এখন সবার দৃষ্টি স্টেইজের দিকে। নিহানের‌ও। মিশ্মির তাতে কোনো উত্তেজনা কাজ করছে না। অবশ্য বিয়ে নিয়েও উত্তেজনা ছিলো না তার। সবাই যখন করতালি আর উচ্ছল হেসে নাচ দেখতে মগ্ন তখন মিশ্মির দৃষ্টি শূণ্যে। মুখ বেজার। চোখ শুষ্ক। তাকে কেমন রুগ্ন দেখাচ্ছে। নিহান একবার মিশ্মির দিকে চেপে বসে ফিসফিস করে বললো,

‘আন‌কম্ফোরটেবল লাগছে?’

মিশ্মি বোধ হয় শুনলো না নিহানের কথা। নিহান বুঝলো কি বুঝলো না হঠাৎ‌ই ডান হাত বাড়িয়ে মিশ্মির হাতের উপর রাখলো। মিশ্মি চমকে উঠলো। একবার নিহানের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার তার মুখের দিকে তাকালো। নিহানের ভাবান্তর নেই। ঠোঁটে ঝুলছে দুষ্টু হাসি। মিশ্মি এক প্রকার ঝাড়া দিয়েই হাত সরিয়ে নিলো নিজের। দুটো হাত মুঠো করে নিজের কোলের উপর নিয়ে বসে র‌ইলো। নিহান ভড়কে গেলেও বুঝালো নিজেকে, মিশ্মি হয়তো লজ্জা পাচ্ছে। তাই হাত সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আসল ব্যাপার তো তা নয়। নিহান যদি ভালো করে একবার মিশ্মির মুখের দিকে তাকাতো তবে দেখতো তার মুখে কষ্টের ছাপ। আকুলতা।

গান নাচের মাঝখানে বিরতি টেনে বর কনেকে হলুদ লাগানোর কার্যক্রম শুরু হলো। একে একে পরিবারের বড়রা তাদের হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছেন। নিহান হেসে হেসে সবার সাথে কুশল বিনিময় করলেও মিশ্মি চোখ তুলে তাকালো না। নিহানের মতোই আর সবাই ভেবে নিয়েছে লজ্জায় কুঁকড়ে আছে মিশ্মি। এক সময় অথৈ আর ইয়াসির উঠে এলো নিজেদের জায়গা থেকে। হলুদের বাটি থেকে আঙুলে একটু হলুদ নিয়ে নিহান আর মিশ্মিকে ছুঁয়ে দিলো অথৈ। ইয়াসির হাত ভর্তি করে হলুদ নিয়ে বললো,

‘এভাবে হলুদ দেয়? ‌আরে বিয়েটা ওদের। হলুদের দিন ভালো করে হলুদ মাখতে হয়। বেশি করে লাগাবে। এই দেখো আমাকে। দুজনকে কি করে ভুত করি দেখো।’

অথৈ চোখ পাকালো। ইয়াসির সেসবের তোয়াক্কা না করে মিশ্মির দু গালে হাতের হলুদ লাগিয়ে দিলো। ইয়াসিরের মুখটা তখন মিশ্মির মুখের সামনে। মিশ্মি এই প্রথম চোখ তোলে তাকালো। বুকটা ধ্‌ক করে উঠলো তার। এতোটা কাছ থেকে কখনোই ইয়াসিরকে দেখে নি মিশ্মি। আজ দেখছে। এমন একটা দিন‌ও যে দেখতে হতে পারে তা তো সে কখনোই ভাবে নি। কেনো ভাবে নি? ভাবা উচিত ছিলো তো! ইয়াসির মিশ্মির নাকে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে মিষ্টি করে হাসলো। বললো,

‘শালী সাহেবা? হ্যাপী হলদী! কাল দেখবে আমার দেয়া এই হলুদের গুণ। চাঁদের আলো বাদ দাও দিনের আলোও কম পরবে তোমার রুপের কাছে। সবাই হা করে শুধু দেখতেই থাকবে।’

মিশ্মির থমকালো। ঠোঁ দুটো কেঁপে কেঁপে উঠলো। চোখে ফুটলো অবিশ্বাস হৃদয়ে জাগলো অপমান। অভিমানগুলো হুট করেই রাগে পরিণত হলো। তার চেয়ে থাকার মাঝেই অথৈ ঝাঁকুনি দিলো মিশ্মিকে। বললো,

‘কি রে? কোথায় হারালি? আজ তোর দিন আর তুইই চুপচাপ! ‌একটু তো হাস!’

মিশ্মি শুকনো একটা হাসি দিলো। ইয়াসির তখন হাত ঘুরিয়ে অথৈর গালে একটু হলুদ লাগিয়ে দিয়ে বললো,

‘তোমার‌ও হলুদ লাগানো উচিত। নিহান নাহয় শালী সাহেবাকে দেখে চোখ জুড়াবে। আমি কি করবো?’

হেসে উঠলো অথৈ। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে গাল মুছতে মুছতে নিচে নামলো সে। ইয়াসির টিস্যুতে হাত মুছে অথৈর সাথে নিচে নামলো। থমথমে অথচ রুষ্ট দৃষ্টিতে স্বামী স্ত্রী দুজনের নিঃশব্দে ভালোবাসা দেখলো মিশ্মি। নিজেকে সংযত করলো। পাশ ফিরে নিহানের দিকে তাকালো। এই মানুষটার কি দোষ? কাল থেকেই তো তার হয়ে যাবে মিশ্মি। তাকে কেনো ধোঁকায় রাখবে? আচ্ছা, নিহানকে কি সব বলে দেয়া উচিত? না কি আড়াল করাই শ্রেয়? বুঝলো না মিশ্মি। সবার হলুদ লাগানো শেষে যখন অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হবে ঠিক তখন‌ই অদ্ভুত এক কান্ড ঘটালো মিশ্মি। টিস্যু পেপার দিয়ে নিজের আর নিহানের চেহারায় লেগে থাকা হলুদ মুছলো। তারপর হলুদের বাটিতে হাত ডুবিয়ে এক গাদা হলুদ তুলে নিয়ে নিহানের সাড়া মুখে লাগিয়ে দিলো। অতিথিদের সাথে সাথে অবাক হলেন দু পরিবারের লোকজন। রোশন আরার মনে হলো মেয়ে বুঝি সব মেনে নিয়েছে। অথৈ ইয়াসির ওরা সহ কাজিনরা ‘ওহ, হো’ বলে আওয়াজ তুললো। নিহান নিজেও অবিশ্বাস্য চোখে তাকাচ্ছে। মিশ্মি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। শুধু নিহানের দিকে কিছুটা বেঁকে নিচু আওয়াজে বললো,

‘সবার শেষে বরের হাতের হলুদ ছুঁয়াতে চাই আমি। আমায় হলুদ দেবেন না?’

নিহান যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। চ‌ওড়া হেসে সেও হলুদ লাগালো মিশ্মিকে। বিপরীতে হালকা হেসে আড়চোখে কারো দিকে তাকালো মিশ্মি। হিমির বিস্ময় থামছেই না। মিশ্মি এতো তাড়াতাড়ি সব মেনে নেয়ার মেয়ে নয়। তবে? এতক্ষন তো চুপচাপ ছিলো সে। আর কেউ না বুঝলেও হিমি বুঝেছে মিশ্মির হতাশা, দীর্ঘশ্বাস। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে আমূল পরিবর্তন হলো কি করে? যে নিহানের দিকে তাকাতো অব্দি না তাকে আজ নিজ হাতে হলুদ লাগাচ্ছে? এখন আবার লাজুক হাসছে। ঘাপলা আছে। অবশ্য‌ই আছে। হিমির ভেতরকার বুঝদার প্রতীতি ষড়যন্ত্রের স্বরে বললো, -মিশুর মনে ভয়াবহ কিছু চলছে। বড়সড় কিছু না ঘটালেও এমন কিছু ঘটাতে পারে যাতে সব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। চোখে চোখে রাখ তাকে। ওর মনে কি চলছে জানতে না পারলেও কি করতে চাইছে ধরতে পারবি। বি কেয়ারফুল।

______________________

খাটে গা এলিয়ে দিয়ে লম্বালম্বি করা এক পায়ের উপর আরেক পা তুললো হিমি। আনমনে সিলিংএর দিকে তাকিয়ে গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ভ্রু কুঁচকালো তাহির। খাটে বসে হিমিকে পর্যবেক্ষন করে বললো,

‘কি ভাবছেন?’

‘ভাবছি কাল কি হবে?’

‘ভাবার কি আছে? জানেন‌ই তো, বিয়ে হবে।’

হিমি চোখ সরিয়ে দেখলো তাহিরকে। বললো,

‘আপনি বুঝবেন না। ছাড়ুন।’

তাহির আর প্রত্যুত্তর করলো না। চশমা খোলে খাটে শুতেই হিমি উঠে বসলো। দুই পা মুড়িয়ে বসে ক্ষুদ্ধ গলায় বললো,

‘আমি ছাড়তে বললাম আর আপনি ছেড়ে দিলেন?’

তাহির ক্যাচ করতে পারলো না হিমির কথা। কপাল কুঁচকে রেখে বললো,

‘মানে?’

‘মানেটা হলো আমি কি ভাবছিলাম কেনো ভাবছিলাম সেসব জানার ইচ্ছে করলো না আপনার?’

‘ইচ্ছে তো করছিলো। জানতেও চাইলাম। আপনিই তো বললেন না।’

‘বললাম না তো কি আর জানতে চাইবেন না? আশ্চর্য! ‌কোনো কৌতুহল নেই আপনার?’

তাহির উঠে বসলো। বেড সাইড টেবিল থেকে চশমা নিয়ে আবা‌রো চোখে পরলো। বললো,

‘কিছুটা কৌতুহল আছে। আর আছে বলেই নিজ মনে এর উত্তর সাজিয়েছি।’

ভ্রু উঁচালো হিমি,

‘তাই না কি? তা কি উত্তর সাজালেন শুনি!’

‘প্রত্যেক মানুষ বিশেষ করে প্রত্যেক মেয়েই তার বিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিছু মেয়ে ছোটবেলা থেকে দেখে কিছু কৈশোরে আর কিছু মেয়ে যৌবনে। মেইনলি তাদের নিজের বিয়ে নিয়ে অনেক প্ল্যানিং থাকে। মনে মনে অনেক কিছু সাজায়। ভাবে তাদের বর কেমন হবে, বিয়েতে কি কি হবে, শাড়ি না লেহেঙ্গা পরবে, মেক আপ কেমন করবে, কি কি অনুষ্ঠান হবে এটসেটেরা! আপনিও নিশ্চয় ভেবেছিলেন। কিন্তু সেসব কিছুই হয় নি। এখন চাচাতো মামাতো ভাই বোনের বিয়ে দেখে আফসোস হচ্ছে। নিজের ভাবনাগুলোর সাথে বাস্তবতা মিলিয়ে হতাশ হচ্ছেন আপনি। না চাইলেও আপনার মস্তিস্ক এসব আপনাকে ভাবাচ্ছে।’

মুখ বাঁকালো হিমি।

‘মোটেও না। আপনি আসলে আমায় ঠিক করে চিনতেই পারেন নি। আমি কখনোই এসব নিয়ে চিন্তা ভাবনা করি নি। বিয়ে নিয়ে লোকে চিন্তা করে সেটাও অথৈকে না দেখলে জানতাম না। আমার খুব অবাক লাগতো ওকে এসব নিয়ে কল্পনা করতে দেখলে। হাসি পেতো। আমি ভাবতেও পারি নি আমার কখনো বিয়ে হবে। আমি শুধু জানতাম আমাকে আমার বাবাকে ফেরাতে হবে। বাবার ভালোবাসা পেতে হবে। যে করেই হোক বাবার প্রিয় হয়ে উঠতে হবে। হ‌ই নি। হতে পারি নি আর পারবোও না। এটা ঠিক যে আপনার সাথে হুট করে বিয়েটা হয়ে যাওয়ায় আমি থমকেছিলাম। এবং কল্পনা আর বাস্তব মিলে নি আমার। তবে কল্পনাতেও কখনো নিজের বিয়ে দেখি নি আমি। দেখেছি আমার সুখ।’

দীর্ঘশ্বাস ফেললো তাহির। দরজায় করাঘাত শোনা গেলো।

‘ঘুমিয়ে পরেছিস হিমি?’

খাট থেকে নামলো হিমি। গলা উচিয়ে বললো,

‘না মামানি। আসছি।’

দরজা খুলতেই হাতে ট্রে নিয়ে ঘরে ঢোকলেন অনাহিতা। হেসে হেসে ট্রেটা টি টেবিলের উপর রেখে বললেন,

‘তোমরা তো মিষ্টি খেলে না তখন। তাই দিয়ে গেলাম। খেয়ে নিও।’

হিমি জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়লো। হিমির প্রতি সবার দরদ উতলে উঠছে টাইপ ব্যাপার স্যাপার। এখানে আসার দিন থেকে সবাই বেশ যত্ন করছে তার। যা এতগুলো বছর এদের সাথে থেকেও পায় নি তা আজ শুধু বিয়ে হয়েছে এবং স্বামী নিয়ে থাকতে এসেছে বলেই পাচ্ছে। অনাহিতার যেনো মুখ দিয়ে মধু ঝড়ে। হিমির মায়া হয়। বিয়ে হয়েছে বলে অনাহিতা হিমিকে বকা ঝকা করছেন না। নিশ্চয় বুক ফেটে কথাগুলো বাইরে বেরুতে চাইছে! একবার সুযোগ করে দেয়া উচিত তার। সময় বুঝে এমন কিছু করা উচিত যাতে অনাহিতা বুক উজার করে হিমিকে কয়েকটা কথা শুনাতে পারেন। তিনিও শান্তি পাবেন আর হিমির‌ও প্রাণ জুড়াবে।

আবার‌ও দরজায় ঠক ঠক শব্দ হলো। তাহির শুতে গিয়েও উঠে বসলো। হিমি স্পষ্ট দেখলো তাহিরের চেহারায় বিরক্তি। হবেই তো। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মাঝরাতেও ঘুমাতে পারছে না। কেউ না কেউ সমানে বিরক্ত করছে। হিমি দরজা খুলতেই দেখলো মাথায় টাওয়াল জড়িয়ে মিশ্মিকে।

‘সরি। বিরক্ত করতে চাই নি। একটু দরকার ছিলো। আসবে?’

হিমি অবাক হলো। গত দুদিন মিশ্মি একবারের জন্য‌ও একটা শব্দ বলে নি হিমিকে। হিমির দিকে যখন‌ই তাকিয়েছে চোখে মুখে আক্রোশ ছিলো তার। অথচ এখন কি সাবলীল ভাবে কথা বলছে। হিমি কৌতুহলী গলায় বললো,

‘খুব ইম্পর্টেন্ট?’

‘হ্যা।’

‘ভেতরে আয়।’

‘না। দুলাভাই ঘুমাক। তুমি এসো। কথা আছে আমার।’

হিমি সায় জানিয়ে পেছন ফিরে তাকালো। তাহির চোখের ইশারায় হিমিকে যেতে বললো। হিমিও তাই দরজা ভেজিয়ে রেখে মিশ্মির সাথে বাইরে বেরুলো। সব স্বাভাবিক লাগছে হিমির কাছে। ঠিক আগের মতোই। যেমনটা মিশ্মি করতো। অথৈ করতো। যেকোনো দরকারে হিমিকে খুঁজতো। ভণিতা ছাড়াই বলতো, আপু কথা আছে। হিমি কখনো মনোযোগ দিয়ে শুনতো কখনো ব্যস্ততায় অন্যমনস্ক হয়ে। আজ আবার‌ও মিশ্মি ডাকলো তাকে। মিশ্মির স্বাভাবিকতায় যেনো খটকা বেড়ে গেলো হিমির। মিশ্মি হিমিকে নিয়ে নিজের শোবার ঘরে ঢুকলো। দরজা ভেতর থেকে আটকে দিয়ে মাথা থেকে টাওয়াল খোলে বললো,

‘চুলটা ঝেড়ে দেবে?’

‘এটা তোর দরকারি কথা?’

‘আরে নারে বাবা। তুমি আমার চুল ঝেড়ে দাও। আমি বলছি কি বলতে চাইছিলাম।’

হিমি টাওয়াল হাতে নিতেই উল্টোদিকে ঘুরে মাথাটা পেছনের দিকে খানিক নিচু করলো মিশ্মি। হিমি আলতো করে চুল ঝেড়ে দিতে লাগলো। মিশ্মি থমথমে গলায় বললো,

‘নিহানকে সব বলে দেবো?’

হিমি বুঝলো না মিশ্মির প্রশ্ন। জানতে চাইলো কি বলার কথা বলছে। মিশ্মি আগের মতোই কন্ঠে থমথমে ভাব রেখে বললো,

‘ইয়াসির স্যারকে ভালোবাসার কথা?’

হিমির হাত থেমে গেলো। কয়েক মুহুর্ত পর বললো,

‘বলে লাভ?’

‘কিছুই না শুধু সে আড়ালে থাকলো না। আমি তো এখন থেকে তার‌ই। তাকে সবটা না জানালে কষ্ট পেতে পারে।’

‘এই মাত্র‌ই না বললি তুই তার। সুতরাং, তুই সব সময়‌ই তার। অতীত জানালেই বরং সে কষ্ট পাবে।’

‘পরে যদি অন্যকারো থেকে জানতে পারে তখন?’

‘কে জানাবে? তুই না জানালে আর তো কেউ নেই তাকে কিছু জানানোর। আমি বলবো না। মামীও বলবে না। জানার কোনো চান্স নেই। আর তাছাড়া অতীতে এমন কিছু হয় নি যা না জানলে তোদের ভবিষ্যত নষ্ট হবে। তুই কোনো সম্পর্কে জড়াস নি। ভালোবেসেছিস‌। ভুলেও গেছিস। আবার নতুন করে মনে করে গিল্টি ফিল করার দরকার নেই তো।’

চলবে,,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

৫৬.

কমিউনিটি সেন্টারে সবে বরের গাড়ি ঢোকেছে। গেইটে লাল ফিতা লাগিয়ে ফুল, মিষ্টি ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তুত কনের ভাই বোনেরা। নিহান গাড়ি থেকে নেমে মোজাম্মেল সাহেবের কাছাকাছি দাঁড়ালো। পকেট থেকে টাকার বান্ডিল ওনার পকেটের কাছে রেখে ফিসফিস কন্ঠে বললো,

-জ্যাঠুমনি? এই টাকা গুলো তোমার কাছেই রাখো।

মোজাম্মেল সাহেব হাত বাড়িয়ে টাকাগুলো নিজ পকেটে নিলেন। বললেন,

-কতো আছে?

-পনেরো হাজার।

-মাত্র?

-দাদু তো দশ হাজার দিয়েছিলো। বাবা আরো পাঁচ হাজার এড করে বললো চেষ্টা করতে যেনো কম দেয়া যায়। ওরা জেদ না ছাড়লে যেনো পুরোটাই দেই।

মুখ বাঁকালেন মোজাম্মেল সাহেব। কটমটে গলায় বললেন,

-তোর বাপের‌ও বুদ্ধি শুদ্ধি হবে না। গেইটে কতজন দাঁড়িয়ে আছে দেখেছিস? কম হলেও ওরা পঞ্চাশ চাইবে। আর তুই কিনা পনেরো দিবি?

-তাহলে কতো দেবো?

-ত্রিশ। এট লিস্ট ত্রিশ হাজার দিতে হবে। এতে করে আমাদের ভালো ইম্প্রেশন পরবে। তা নাহলে এদের জেদ বেড়ে যাবে। পরে দেখা গেলো তোকে এন্ট্রি নিতেই দিলো না। গেইট থেকেই বর বিদায়।

নিহান অপ্রস্তুত গলায় বললো,

-তা বলে ত্রিশ?

-কিপ্টামি করিস কেনো বাপ দাদার মতো? আমার মতো হো।

-তা নাহয় হলাম। কিন্তু বাকি টাকা আসবে কোত্থেকে?

-আমার কাছে আছে।

-তুমি সাথে নিয়ে বেরিয়েছিলে?

কন্ঠে কৌতুহল তার। মোজাম্মেল সাহেব চ‌ওড়া হেসে বললেন,

-তোর দাদুর থেকে চেয়ে এনেছি। গতকালের অনুষ্ঠানের আয়োজকদের টাকা দিতে হবে তো! এর মধ্যে থেকে পনেরো হাজার এদিকে চলে যাবে। পরে বাবার থেকে হিসাব করে নেবো। তুই টেনশন নিবি না। টাকা গুলো তুইই রাখ। ওরা যখন‌ই বলবে আমাদের এতো টাকা চাই নাহলে নো এন্ট্রি সাথে সাথে তুই টাকাগুলো তাদের হাতে ধরিয়ে দিবি। বড় গলায় বলবি, আপাতত ত্রিশ আছে। রাখো। পরে লাগলে দেবো। এখন বিয়ে করবো। ব‌উ ওয়েট করছে।

নিহান মাথা দুলালো। গেইট থেকে আওয়াজ এলো,

-কি হলো দুলাভাই? টাকা দিতে হবে বলে গেইটেই আসছেন না যে! বিয়ে করার চিন্তা বাদ দিলেন?

____________________

কাজি সাহেব বিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সবকিছু ঠিকঠাক লিখা হয়েছে কি না সেসব দ্বিতীয় বারের মতো পর্যালোচনা করছেন। বরের বাবা চাচা আর কনের বাবা চাচারা সেখানে বসে নিজেদের মধ্যে বিবিধ আলাপ জুড়ে দিলেন। মোজাম্মেল সাহেবকে অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে কথা পারলেন হানিফ শরীফ,

-কাউকে খুঁজছেন?

-হ্যা। হিমিকে দেখছি না যে!

ঠোঁটে হাসি ফুটলো হানিফ শরীফের। হিমির কথা উঠলেই উনি হাসেন। ওর নাম শুনলেও হাসেন। তৃপ্তি পান। হাসি মুখে বললেন,

-আপনাকে চমকানোর পাঁয়তারা করছে বোধ হয়।

-আমাকে চমকানোর মানে?

-ওর হঠাৎ করেই সবাইকে চমকে দিতে ইচ্ছে করছে। সেদিন অবশ্য বলেছিলো বিয়ের দিন আমাদের সবার মাথা ঘুরিয়ে দেবে। দিয়েছেও। এবার আপনাদের চমকানোর পালা। আমার মনে হচ্ছে আপনার জন্য বিশেষ কিছু প্ল্যান করছে।

কপালে চিন্তার ভাজ ফেলে উঠে দাঁড়ালেন মোজাম্মেল সাহেব। বললেন,

-এখানে আমার আর প্রয়োজন নেই। আপনারা দেখুন। সব ঠিক থাকলে বিয়া পড়ানোও শুরু করুন। আমি আসছি একটু।

সকলেই মাথা নেড়ে জানালেন। মোজাম্মেল সাহেব প্রস্থান করলেন। মহিলা সেক্টরে যেতে যেতে যাকেই চোখে পরছে তাকেই জিজ্ঞেস করছেন, ‘হিমিকে দেখছো?’ সবার উত্তর ‘না’ হচ্ছে না। কেউ বলছে এদিকে, কেউ বলছে ওদিকে। শেষমেষ মিশ্মির পাশেই দেখা মি‌‌ললো হিমির। প্রথম দফায় তাকে দেখে চিনলেন না মোজাম্মেল সাহেব। অন্যরাও চিনেনি। দিন দিন হিমির বেশ ভুষা পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে হিমি নিজেও।

-ও মাই গড! করেছিস কি!

হিমি উচ্ছল হেসে উঠে এলো জ্যাঠুমনির কাছে। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,

-কেমন লাগছে আমায়? তোমার দেয়া শাড়িটাই পরেছি। তবে লেহেঙ্গা স্টাইলে। এখন‌ই শাড়ি পরতে পারি নি।

মৃদু হাসলেন মোজাম্মেল সাহেব। চোখে উপচে পরা খুশি। বললেন,

-মাশা অল্লাহ। এতো সুন্দর দেখাচ্ছে যে মুখে প্রকাশ করতে পারছি না।

কদিন আগেই হিমিকে গাঢ় গোলাপি আর সাদা রঙের মিশ্রণের শাড়ি উপহার দিয়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন যেনো নিহান মিশ্মির বিয়েতে পরে। হিমি তখন রাজি হয় নি। হ‌ওয়ার কথাও না। এক মাসের ব্যবধানে যে মেয়ে বহু কষ্টে প্যান্ট শার্টের বদলে কুর্তি, সালোয়াড় পরা শিখেছে তার কাছে শাড়ি পরা টাফ। তবুও আজকে পরেছিলো। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিন চারবার হোঁচট খেয়ে কুচি খুলে নাজেহাল অবস্থা। পার্লারেই তারপর শাড়িকে লেহেঙ্গা স্টাইলে পরিয়ে দিয়েছে। কুচি নেই তাই শাড়ি খুলার চান্স নেই। তার‌উপর লেহেঙ্গার নিচ ফুলে আছে। গায়ের সাথে লেগে অস্বস্তি হচ্ছে না তার। আরাম‌ই লাগছে। কানে গলায় ম্যাচিং জুয়েলারি। প্রথমবারের মতো মুখে খুব সামান্য মেক আপ। হাতে চুড়ির সংখ্যা বেড়েছে। কোঁকড়ানো চুলে কোনো স্টাইল নেই। প্রত্যেক বারের মতো খোলাই। অথৈর সব রকমের রিকুয়েস্টকে বুড়ো আঙু্ল দেখিয়ে দু ইঞ্চি মতো উঁচু হিল পরে আছে সে।

অথৈ কতো করে বোঝালো তাহিরের কাছাকাছি দাঁড়ালে হিমিকে খাটো লাগবে। কাঁধ বরাবর হতে হলে পেন্সিল হিল পরতে হবে। আর নাহলে পাঁচ ইঞ্চির বেশি উঁচু হিল পরতে হবে। হিমি শুনে নি। তার মতে সে যথেষ্ট লম্বা। শুধু শুধু সুপারি গাছের মতো আকাশ ছুঁয়া লম্বা হতে হবে না। দরকার পরলে বিয়ের অনুষ্ঠানে সে তাহিরের কাছেই ঘেষবে না। বাধ্য হয়ে হার মেনেছে অথৈ। হিমিকে এমন বেশে দেখে চমকেছেন সবাই। তাহির নিজেও বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

মায়মুনা জামান থেকে থেকেই হিমিকে দেখছেন। ভালো লাগছে ওনার। মনে হচ্ছে একদম ছেলের সাথে যাচ্ছে। কোনো খুঁত নেই। মিষ্টি পুতুলের মতো দেখতে হিমিকে আজ একটু বেশিই সুন্দরী লাগছে। অন্যান্য দিনের মতো মুখ গোমরা নেই তার। অযথাই বিরক্ত হচ্ছে না। হাসছে। কাজিনদের সাথে গল্প করছে। মিশ্মির আশেপাশে থাকছে। ব‌উ ব‌উ লাগছে তাকে।

_____________________

বিয়ে পড়ানো শেষ হ‌ওয়ার পর দোয়া করলেন কাজি সাহেব। হাত তুলে দোয়ায় সামিল হলেন উপস্থিত সকলেই। মিশ্মির চোখ পানিতে টলমল করছে। বুক কাঁপছে। কারো প্রতি তুমুল বিদ্বেষ জন্মাচ্ছে। তো কারো প্রতি মায়া। কারো প্রতি ভালোবাসা তো কারো প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

বিদায়ের সময় রোশন আরাকে জড়িয়ে ধরে স্বল্প কেঁদেছে মিশ্মি। বাবা, জ্যাঠু, জ্যাঠিমা, অথৈ এদের থেকে হাসি মুখেই বিদায় নিয়েছে সে। হিমির কাছাকাছি গিয়েই জাপটে ধরছে তাকে। হয়তো একারনেই যে হিমি সব জানে। মিশ্মিকে বুঝে। মিশ্মির ভেতরকার উথাল পাতাল হিমি উপলব্ধি করতে পারছে। হিমি আলতো করে মিশ্মির মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করলো। ঘাড় থেকে মুখ সরিয়ে দুগালে হাত রাখলো হিমি। চোখের ইশারায় কিছু একটা বললো। মিশ্মির কান্না বন্ধ হলো। ঠোঁটের কোনায় এক চিলতে হাসিকে সঙ্গী করেই নিহানের ধরে থাকা হাতটা শক্ত করলো।

বরের গাড়ি গেইটে থামতেই হাতে বরনের সামগ্রী দিয়ে ঠেলে রাদিবাকে দরজার দাঁড় করিয়ে দিলেন আমিনা বেগম। ওনারা দুজন‌ই বিয়েতে যান নি। মতিউর রহমান‌ও থেকে গেছেন বাড়িতে। এতক্ষন বাড়ি নিরব ছিলো। বর কনে আসতেই সমাগম শুরু হয়েছে। বরণ শেষে ঘরে ঢোকানো হলো বর কনেকে। বসার ঘরের সোফায় নিহান আর মিশ্মিকে বসিয়ে রেখে মিষ্টি, শরবত খাওয়ানো হলো। তাদের দুজনকে সবদিক থেকেই ঘিরে রেখেছে নিহানের কাজিনরা। ছবি তুলছে, ভিডিও করছে সর্বোপরি মজা করছে তাদের নিয়ে। কাজিনদের লাগাম ছাড়া কথায় মিশ্মি যেমন লজ্জায় রাঙা হচ্ছিলো তেমনি রেগে যাচ্ছিলো নিহান। প্রতিবেশী রা এই রাতের বেলাতেও কনে দেখতে চলে এসেছেন। তাদের সবার জন্য চা নাস্তা তৈরি হচ্ছে। নিহান বন্ধু বান্ধবদের সাথে অন‌্য ঘরে চলে গেছে ইতিমধ্যে। এদিকে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হযে বেশিক্ষন বসে থাকা গেলো না মিশ্মির। ভারী পোশাক আর গয়নার চাপে অস্বস্তি হতে লাগলো। মাথা ঘুরতে লাগলো। গা গুলিয়ে উঠলো। না পেরে আমিনা বেগমকেই ইশারায় ডাকলো সে।

-আন্টি? আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছে। পোশাক পাল্টালে ভালো লাগতো।

-ওহ হ্যা তাইতো। অনেকক্ষন ধরে বসে আছো। এই দিনা? এদিকে এসো না মা!

নিহানের মামাতো বোনকে ডেকে উঠলেন আমিনা। বললেন,

-মিশ্মি ঘরে দিয়ে এসো। কাপড় চোপড় পাল্টাক।

মিশ্মির দিকে ফিরে বললেন,

-তোমার লাগেজ ঘরেই রাখা আছে। গেলেই পাবে। দিনা একটু থেকো ওখানে। ওর যদি কিছু দরকার হয়। আমি আসছি একটু পর।

মিশ্মি মাথা দুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। দিনা সাথে করে তার চাচাতো বোন ঝর্ণাকেও ডাকলো। মিশ্মিকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে তারা দুজনেও ঘরে বসে গল্প জুড়ে দিলো। বেশ খানিক ক্ষন পর অর্ধেক শাড়ি পরে ওয়াশরুমের বাইরে বেরুলো মিশ্মি। বললো,

-আমায় কুচি করে দেবে? আমি আসলে কুচি করতে পারি না। তার উপর জর্জেট শাড়ি। সামলানোই মুশকিল হয়ে পরছে। মনে হচ্ছে শরীর থেকে খুলে যাবে।

দিনা ঝর্ণার দিকে তাকালো। ঝর্ণা শুকনো হেসে বললো,

-ব‌উমনি? আমরা কখনো একা শাড়ি পরি নি। মা কাকিয়া পরিয়ে দেয়। ঠিক মতো পারবো না বোধ হয়।

মিশ্মি আহত দৃষ্টিতে তাকালো। দিনা হেসে উঠে বললো,

-আমরা তিনজন‌ই একরকম। ইউ টিউব দেখে তিনজন মিলে চেষ্টা করে দেখি না। ঠিক পারবো। ঝর্ণা, মোবাইল দে তোর।

যেই কথা সেই কাজ। ইউ টিউবে হাজারটা শাড়ি পরার টিউটোরিয়ালের মধ্যে সবচেয়ে সহজ উপায়ে শাড়ি পরার পদ্ধতি খুঁজে বের করলো দিনা ঝর্ণা। তারপর তিনজন মিলেই কুচি করলো। শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে মিশ্মি বার কয়েক হেঁটে নিলো ঘরের ভেতর। সবার সামনে শাড়ি খুলে গেলেই মুসিবত।

চলবে,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে