হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
২৮.
মধ্যরাতের নির্জন পরিবেশে গট গট আওয়াজ শুনে আরাম কেদারায় এলিয়ে রাখা মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকান মুহিব রহমান। দরজার পাশে এসেই থেমে যায় গট গট আওয়াজ। মুহিব রহমান গলা উঁচিয়ে বললেন,
-বাবা?
গম্ভীর গলায় আওয়াজ এলো,
-দরজা খুলো। কথা আছে।
-খোলাই আছে। ভেতরে চলে আসুন।
কথাটা বলে উঠে দাঁড়ালেন মুহিব রহমান। এগিয়ে গিয়ে লাইটের সুইচ চাপলেন। সাথে সাথে নিকষ অন্ধকার মিলিয়ে গেলো এক ঝাঁক ফর্সা আলোয়। মতিউর রহমান ঘরে ঢোকলেন। চোখ ঘুরিয়ে পুরো ঘরটা দেখলেন। রয়ে সয়ে বললেন,
-কিছু ভাবলে?
মুহিব রহমান চোখ সরু করে জানতে চাইলেন,
-কি বিষয়ে?
-নিহানের বিষয়টা। ওকে কি করে এসব থেকে সরানো যায় সেসব ভেবেছো? রাতে খেতে আসে নি। ছোট বউয়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। বাচ্চা ছেলে। হাত থেকে বেরিয়ে গেলেই মুশকিল।
মুহিব রহমান মৃদু গলায় বললেন,
-নিহান বাচ্চা নয় বাবা। বড় হয়েছে। আর কয়েক মাসের মধ্যে পড়াশোনাও শেষ হবে তার। চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছে। আমার মনে হয় ওকেই সিদ্ধান্ত নিতে দেয়া হোক।
মতিউর রহমান থমথমে গলায় বললেন,
-তোমার মনে হলেই তো হবে না। নিজের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনো বয়স হয় নি ওর
-যথেষ্ট হয়েছে। তবে আপনি মানতে চাইছেন না।
-তুমি আমার সাথে তর্ক করছো?
-জি না বাবা। আমি শুধু বলছি একবার ওর ব্যাপারটাও ভেবে দেখা উচিত।
মতিউর রহমান গলা নরম করলেন। বললেন,
-ভাবা ভাবির তো কিছু নেই। ও যা বলছে বা চাইছে সেটা কোনোদিন সম্ভব নয়।
-মিশ্মি হাসির ভাইঝি বলে? না কি নিহান ওকে ভালোবাসে বলে?
মতিউর রহমান দাঁতে দাঁত চেপে ধরলেন। মুহিব রহমান বাবাকে ধরে খাটে বসিয়ে বিনয়ী গলায় বললেন,
-সবকিছুই আমাদের চোখের সামনে ঘটছে বাবা। এই বয়সে একটু আধটু এমনটা হয়ই। বড় সড় কোনো ভুল করে ফেলার আগে আমাদের ওদের বিয়ে দেয়া উচিত। ছেলে মেয়ে দুজনই এডাল্ট। ওদের ইচ্ছা অনিচ্ছা আছে। সেসব মাথায় রেখেই,,,,,,
মুহিব রহমানের কথার মাঝেই ফুঁস ফুঁস নিশ্বাস ছেড়ে মতিউর রহমান বললেন,
-ওদের বিয়ে হবে না। এসব প্রেম ভালোবাসা আমি ঘেন্না করি। তুমি আমার মতবিরোধ করে বাড়ি ছেড়েছিলে তার ফলটাও ভুগেছো। মেয়ে জন্ম দিতে গিয়েই মরেছে হাফসা। আর একবার আমার মতবিরোধ করার চেষ্টা করো না মুহিব। তুমি আমার ছেলে ছিলে তাই সব মেনে নিয়েছিলাম। ক্ষমা করেছিলাম। নিহানকে করতে পারবো না।
মুহিব রহমান নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলেন। মাথা ঠান্ডা রেখে বললেন,
-আপনি যদি আমার কথা ভেবে সেদিন হাসিকে মেনে নিতেন তবে আমাদের জীবনটা অন্যরকম হতো বাবা। হাসি হয়তো আজ আমার সাথেই থাকতো। ভুলটা আমাদের ছিলো। কিন্তু আপনারাও নির্দোষ নন। অনুরোধ করছি আবারও একই ভুল করবেন না। মিশ্মি এখনো ছোট। নিহানও নিজের পায়ে দাঁড়ায় নি। আপনার আদেশ না মানতে পেরে যদি ওরাও আমার মতো কান্ড ঘটায় তাহলে শুধু ওদের ভবিষ্যত নয় বর্তমানটাও ধ্বংস হয়ে যাবে। সময় আছে এখনো। ভাবুন।
মতিউর রহমান বসা থেকে দাঁড়িয়ে পরেন। লাঠিতে অত্যধিক ভর দিয়ে ক্ষীণ গলায় বলেন,
-আমার ভাবা হয়ে গেছে। নতুন করে কিচ্ছু ভাবছি না আর। এখন তোমার ওই বেয়াদব, ছন্নছাড়া মেয়েকে এ বাড়ি থেকে বিদায় করবো আমি। ওই মেয়ের জন্যই আজ এই পরিস্থিতিতে আছি আমরা। তেইশ বছর আগে তোমার কারনে যে পরিস্থিতিতে ছিলাম, সেই একই পরিস্থিতিতে তোমার মেয়ে আবারও দাঁড় করিয়েছে।
মুহিব রহমান অবিশ্বাসী গলায় বলেন,
-নিহান মিশ্মির মাঝখানে হিমি কোত্থেকে এলো?
-এই দুই পরিবারের মাঝখানে হিমিই আছে মুহিব। ওই মেয়েই করেছে যা করার।
-বাবা এসব কি বলছেন আপনি? হিমি কেনো কিছু করতে যাবে? ও নিশ্চয় নিহানকে বলে নি মিশ্মিকে ভালোবাসতে চিঠি দিতে!
-বলতেও পারে। ও মেয়ের বিশ্বাস নেই। উচ্ছৃঙ্খল বেয়াদব মেয়ে। ওই মিশ্মির সাথে দেখা করিয়েছি নিহানের। যত নষ্টের গোড়া! রাত বিরেতে ঘরের বাইরে কোনো আকাম ঘটাচ্ছে কে জানে! নতুন আবার কোনো ঝড় বয়ে আনলে ওই মেয়েকে আমি ছেড়ে কথা বলবো না।
স্ত্রী হারা স্বামী হঠাৎ মেয়ের বাবা হয়ে উঠলেন। মেয়েকে বলা কটু কথা শোনা গেলো না ওনার দ্বারা। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। শক্ত গলায় বললেন,
-সবকথায় আমার মেয়েকে টেনে না আনলে হয় না? সাতেও নেই পাঁচেও নেই তবুও তাকে নিয়ে হাজারটা অভিযোগ। হিমি না থাকলেও নিহান মিশ্মিকে ভালোবাসতো। সেটা আপনি মানুন বা না মানুন। আর নিহানের কথা অনুযায়ি আপনি যদি নিহান আর মিশ্মির ভালোবাসার বিরোধ করে ওদের বিয়ে না হতে দেন তবে সে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যেতেও দু বার ভাববে না। হিমি কিন্তু ওই সময় বাড়িতে ছিলো না।
কয়েক সেকেন্ড থেমে বললেন,
-নিহান বাচ্চা নয় যে ওকে যে যা বলতে বলবে গড় গড় করে বলবে। একটা মেয়েকে ভালোবাসে তাকে বিয়ে করতে চায় এই কথাটাই বড় গলায় বলছে। ভুল তো কিছু করে নি। এসবের মধ্যে শুধু শুধু হিমিকে জড়াবেন না।
মতিউর রহমান অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালেন। তাচ্ছিল্য গলায় বললেন,
-মেয়ের জন্য এতো দরদ কোথায় ছিলো এতো বছর? আদিখ্যেতা দেখাও এখন?
-মেয়ের জন্য আজীবন দরদ ছিলো আমার। প্রথমে ভুল করেছি যে ভুল আপনারা কেউ ভাঙান নি। আর তারপর প্রকাশ করার সাহস পাই নি। লজ্জা হতো নিজের উপর। রাগ হতো। এখনও হয়। সাথে কষ্টও হয়। তবে চাইছি যেনো সব পেরিয়ে প্রকাশ্যে ওর প্রতি থাকা ভালোবাসাটুকু প্রকাশ করতে পারি। আপনার তো দেখছি তাতেও আদিখ্যেতা লাগছে!
মতিউর রহমান আড়ষ্ট হলেন। গাঢ় নিঃশ্বাস ফেলে উল্টো ঘুরলেন। ধীরে ধীরে ঘরের বাইরে বেরুলেন। শান্ত শীতল গলায় বললেন,
-নিহানের ভবিষ্যত নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। আমি আছি ওর বাবা মা আছে ওরা ভাববে। তুমি বরং ঘুমাও।
মুহিব রহমান মৃদু হাসলেন। সুপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা লাগিয়ে ঘর অন্ধকার করে আবারও আরাম কেদারায় বসলেন। চোখ বোজে রোজ রাতের মতোই পুরনো স্মৃতিতে হারাচ্ছেন নতুন করে। এতেই যেনো তার পরম শান্তি। সেই স্মৃতিই একাধারে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুখ আর সবচেয়ে বড় দুঃখ।
*************
ডিভানে দু পা ভাজ করে বসে হাতে প্লেইট নিয়ে আপন মনে খাচ্ছে হিমি। এই মাঝরাতে রান্নাঘর থেকে খাবার চুড়ি করা একটা আর্ট। যা শুধু হিমির মামু হানিফ শরীফ জানেন। হিমি এখনো এই চুড়ি রপ্ত করতে পারে নি। দু একবার চেষ্টা করেছিলো। ধরা পরে যাওয়ায় বেশ অপমানিত হতে হয় তাকে। অথচ মামু কি সুন্দর মাঝরাতে চুপি চুপি মামানির চোখ এড়িয়ে হিমির জন্য প্লেইট ভর্তি খাবার নিয়ে আসেন। কেউ কখনো টেরও পায় নি। কি করে? বাসন নাড়ার আওয়াজও শোনা যায় না। চলাচলের আওয়াজও না। কি অদ্ভুত ভাবে চলেন তিনি। ফিসফিস করে কথা বলেন। খাবার শেষে এঁটো প্লেইট নিজেই ধুয়ে রাখেন তাকে। এসব মাঝে মাঝেই হয়। হিমির বাড়ি ফিরতে দেরি হলে সবাই খেয়ে দেয়ে বাসন পত্র গুছিয়ে রেখে দেয়। খাবারগুলো ফ্রিজে রেখে দেয়। কখনো আবার ফেলেও দেয়। হানিফ শরীফ ভাগ্নির কথা ভেবে ঘুমানোর আগেই কিছু খাবার ফ্রিজ থেকে বের করে সরিয়ে রাখেন। মাঝরাতে হিমি ফিরলে ঠান্ডা খাবার নিয়েই ছুট লাগান তার ঘরে। মাইক্রো ওয়েভ চালাতে জানেন না তিনি। চুলায় আগুন জ্বালালে যদি কেউ জেগে যায়? এই ভয়েই খাবার গরম করা হয়ে উঠে না। হিমি কোনো অভিযোগ করে না। দিব্যি তৃপ্তি করে খায়। এবারও খাচ্ছে। হানিফ শরীফ চিন্তিত গলায় বললেন,
-তাহলে আমায় কি করতে বলছিস?
হিমি খেতে খেতে জবাব দিলো,
-মামানিকে রাজি করতে।
-কি বলে রাজি করাবো?
হিমির দায়সারা গলায় জবাব,
-সেটা তুমি জানো। আমি শুধু বলতে পারি কি করতে হবে, কখন করতে হবে। কি করে করবে না করবে সেসব তো আমার জানার বিষয় নয়!
হানিফ শরীফ উঠে এলেন। হিমির ডিভানের পাশে সিঙ্গেল সোফাটায় বসে কাতর গলায় বললেন,
-চিনিসই তো অনুকে। কেমন রাগ তার! পরে না হিতে বিপরীত হয়!
-হবে না। আমি জানি তুমি সব সামলে নেবে।
-আমি ছাড়া আর কেউ নেই? আমাকেই কেনো সব সময় দেখিস তুই?
হিমি খাওয়া থামিয়ে কপাল কঁচকে তাকালো। বললো,
-মামানির বর কে? তুমি। মামানিকে বুঝাবে কে? তুমি। সবকিছুই যখন তুমি করবে তখন আমি অন্য কাউকে দেখবো কি করে? আবোল তাবোল না বলে যাও।
হানিফ শরীফ কৌতুহলী গলায় বললেন,
-কোথায়?
-তোমার ঘরে।
-এক্ষুনি? না মা, এই মুহুর্তে বাঘিনীকে ডাকা যাবে না। আমার গর্দান যাবে।
-আরে মামু? এক্ষুনি কথা বলতে বলছি না। যাও গিয়ে ঘুমাও। আমার খাওয়া হয়ে গেছে। আমিও ঘুমাবো। মামানির ঘুম ভাঙলে কিন্তু তুমি শেষ। ফটাফট সুরক্ষিত জায়গায় আশ্রয় নাও। মানে খাটে গিয়ে শুয়ে পরো।
হানিফ শরীফ মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
-প্লেইটটা দে। ধুয়ে রেখে দেই।
-উহু,, আজ আমি ধুবো। যাও তুমি।
-আহা মা। দে না। আওয়াজ টাওয়াজ করবি তুই। দে এদিকে।
হিমি পানিতে চুমুক বসিয়ে প্লেইট উচিয়ে ধরে বললো,
-না। আমি রেখে দেবো। আওয়াজও হবে না। পারবো আমি। যাও না রে বাবা।
-যাচ্ছি উফ!
হানিফ শরীফ বেরিয়ে গেলেন। হিমিও পিছু পিছু বেরুলো। পা টিপে টিপে রান্নাঘরে ঢোকে আন্দাজ করে করে বেসিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে নল খোঁজে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। নল ছেড়ে খুব সাবধানে প্লেইট ধুয়ে উল্টো ঘুরলো। পা টিপে টিপে এগিয়ে চুলার পাশে কেবিনেটের উপর প্লেইট রাখলো। হাত বাড়িয়ে বহু কষ্টে যেই না তাকের নাগাল পাবে অমনি জ্বলে উঠলো রান্নাঘরের বাল্ব। হিমি জিব কেটে ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। কেনো যে মামুর কথা অমান্য করে বুঝদারি করে প্লেইট ধুতে এলো! এখন নিজের বুঝদারির উপর বেজায় রাগ লাগছে তার। ঢোক গিলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ভয়ে ভয়ে পেছন ঘুরলো হিমি। চিন্তিত চেহারায় রান্নাঘরের সুইচবোর্ডের কাছে রোশন আরাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চমকালো হিমি। ও তো মামানি ভেবেছিলো। ছোট মামী এতো রাতে এখানে কেনো এলেন? উনিও কি মামানির মতো কয়েক কথা শুনাবেন না কি চিৎকার চেঁচামেচি করে সয়ং মামানিকে ডেকে তুলবেন? হিমি ঠোঁট উল্টে তাকালো। সে ভালোই বুঝতে পারছে আজ তাল রক্ষে নেই।
চলবে,,,,,,,,,,,,
হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
২৯.
রোশন আরা চিকন স্বরে বললেন,
“ঘরে চল। কথা আছে।”
হিমি জোরপূর্বক হেসে মাথা নাড়লো। প্লেইট তাকে রেখে রান্নাঘরের বাতি নিভিয়ে রোশন আরার পেছনে চললো। রোশন আরা হিমির ঘরে ঢোকে অস্থির ভঙ্গীতে খাটে বসলেন। হিমি ধীর পায়ে ঘরে ঢোকলো। রোশন আরা স্মিত গলায় বললেন,
“দরজা লাগিয়ে আয়।”
হিমি ওনার কথা মতো দরজা লাগালো। জড়সড় হয়ে রোশন আরার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“আসলে মামী খুব খিদে পেয়েছিলো। তাই! আর হবে না। তুমি প্লিজ মামানিকে বলো না কিছু। আমি এখন থেকে বাইরেই খেয়ে আসবো নয়তো তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবো। সত্যি বলছি।”
রোশন আরা বিরক্তি গলায় বললেন,
“তোর কোনো বিষয় নিয়ে চর্চা করতে আসি নি আমি। আমার কথার উত্তর দে।”
হিমি মাথা দুলালো। রোশন আরা কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বললেন,
“তোর ওই মামাতো ভাই, নিহান, ও সত্যি বলছিলো?”
হিমি রোশন আরার কথার তাৎপর্য বুঝলেও না বুঝার ভান ধরে বললো,
“কোন কথা মামী?”
“আরে ওই যে বললো না, ভালোবাসে। ওকথা সত্যি?”
হিমি ইচ্ছাকৃত অবাক হয়ে বললো,
“কাকে বলেছে?”
“আমাদের সবার সামনেই বলেছে। দুপুরে গেছিলাম ও বাড়ি। তুই ছিলি না। এখন আমার কথার উত্তর দে। ছেলেটা সত্যি বলেছে না কি,,,,”
হিমি ঠোঁট টিপে হাসি আটকে বললো,
“বলেছে যখন তখন সত্যিই হবে। অবশ্য আমাকেও বলেছে এ কথা। এসব কেনো জানতে চাইছো মামী?”
“দরকার আছে তাই। আচ্ছা, ছবিগুলোও কি নিহানের?”
হিমি ধাতস্থ হলো। ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে বললো,
“নিহানকে জিজ্ঞেস করো নি তোমরা?”
রোশন আরা হ্যা সূচক মাথা দুলালেন। হিমি প্রশস্ত হেসে বললো,
“ওর উত্তর হ্যা হলে হ্যা না হলে না। আমায় জিজ্ঞেস করার কোনো কারন তো দেখছি না।”
“তোকে জিজ্ঞেস করতেও চাই নি। নেহাত দুজনকেই তুই চিনিস তাই।”
রোশন আরার ঝাঁঝ মেশানো গলায় আওয়াজে হিমির কোনো ভাবাবেগ হলো না। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থেকে বালিশ টেনে উপুর হয়ে শুয়ে পরলো সে। রোশন আরা চমকে উঠে বললেন,
“শুয়ে পরলি যে?”
ঘুমু ঘুমু গলায় হিমির জবাব,
“ঘুম পাচ্ছে মামী। তোমার তো কথা বলা শেষ। যাওয়ার সময় লাইট অফ করে দরজা ভেজিয়ে যেও। (হাই তুলে) গুট নাইট!”
রোশন আরা চোয়াল শক্ত করে তাকালেন। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন তিনি। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলেন। গলা কেশে বললেন,
“আমার মনে হচ্ছে তুই মিথ্যে বলছিস! মিশু যে ইয়াসিরকে ভালোবাসে সেটা কিন্তু আমি জানি হিমি। শুধু শুধু মিথ্যে বলে সব কিছু আড়াল করার চেষ্টায় বড় কোনো বিপদ ঘটাস না।”
হিমি বালিশে নাক মুখ গুঁজে রেখেই বললো,
“তাহলে মামানিকে গিয়ে বলে দেই ছবি গুলো ওনার জামাইয়ের? মিশ্মি অথৈর বরকে ভালোবেসে পাগল প্রায়?”
আঁতকে উঠা গলায় রোশন আরা বললেন,
“এসব কি বলছিস? আপা জানলে আমার মেয়েটাকে যে কি করবে কে জানে? আর অথৈ! সবে বিয়ে হয়েছে। বোনের সাথে সম্পর্ক যে একবারে শেষ হয়ে যাবে রে হিমি!”
হিমি চোখ বোজে রেখেই ক্ষীণ গলায় বললো,
“সেই জন্যই তো মিথ্যেটা বললাম। মিশ্মি যখন আগেই ইয়াসির থেকে সরে এসেছে তখন ওর স্মৃতি আর আবেগ থেকেও সরতে হবে। আর এজন্য ওকে বিয়ে করতে হবে। যাকে তাকে বিয়ে করার চাইতে ভালো তো আমাদের নিহানই। আর যাই হোক আমার এক কথায় মিশুর কথা ভেবে মিথ্যে বলতে রাজি হয়ে গেছে। ট্রাস্ট মি মামী, এই ছেলে আমাদের থুক্কু তোমার মিশুকে অনেক খুশি রাখবে। ভালোও রাখবে। ভেবে দেখতে পারো, আফসোস না হয় পরে!”
রোশন আরা হিমির কথাগুলো মনে মনে ভাবলেন। গালে গড়িয়ে পরা জ্বল হাত দিয়ে মুছে লম্বা ঘন শ্বাস টানলেন। অস্বস্তি নিয়েই বেরিয়ে গেলেন। লাইট বন্ধ করলেন না। দরজা ভেজালেন না। হিমিও উঠে নি। যেমন করে শুয়ে ছিলো তেমন করেই ঘুমের সাগরে তলিয়ে গেছে।
******************
ক্রিম কালারের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকলো দোহা। চুল খোপায় মোড়ানো তার। কানে গলায় পাতলা অলংকার। হাতে বড় মোটা দুই বালা। বাম হাতের অনামিকা আঙুলে স্বর্ণের আঙটি। কাধের ব্যাগ টায় বই নেই। এক গাদা ইনভিটেশন কার্ড। বন্ধুদের আর পরিচিত কয়েকজনকে বিয়ের দাওয়াত দিতেই আজ এসেছে সে। সাথে এসেছে তার হবু বর আমিন। গায়ে বেগুনী রঙের শার্ট। পরনে কালো জিন্স। সু স্বাস্থ্যের অধিকারি হলেও ভুরি নেই। সুঠাম দেহীই মনে হবে দেখলে। ওরা দুজনেই রেস্টুরেন্টে ঢুকে কাঙ্খিত মানুষদের খুঁজছিলো। কর্নারের একটা টেবিলে অধীর আগ্রহে বসে ছিলো দোহার পাঁচ বন্ধু। দোহাদের দেখেই সূর্য হাত তুলে ইশারা করে উঠে দাঁড়ালো। সূর্যের দৃষ্টি অনুসরণ করে সবাই সেদিকে দেখলো। দোহা অর আমিনকে দেখে মিষ্টি হেসে উঠে দাঁড়ালো সবাই। দোহা ভ্রু নাচিয়ে এগুতে এগুতে বললো,
“কেমন আছিস তোরা?”
তারা কেউ জবাব দিলো না। স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে দোহা দেখলো। চোখে মুখে তার উপচে পরা খুশি। মেঘ মৃদু গলায় বললো,
“তুই কেমন আছিস সেটা বল! এতোদিনে তবে মনে পরলো আমাদের সাথে দেখা করার কথা? তাও আবার বিয়ের দাওয়াত দিতে?”
দোহা মৃদু হাসলো। বললো,
“সরি গাইস। দরকার ছাড়া বাড়ি থেকে বের হওয়ারও স্কোপ নেই। তাই দেখা করতে পারছি না।”
কথাটা বলে দোহা তার হবু স্বামীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো বন্ধুদের। আমিন সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ার। বড় এক কোম্পানিতে কাজ করছে। উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের বলা চলে। আলাপ চারিতা শেষে সবাই চেয়ার টেনে যার যার জায়গায় বসলো। অর্ডার কৃত খাবার চলে আসায় খাওয়া দাওয়ার সাথে সাথে গল্প গুজব হলো খানিক। আমিন ভীষন মিশুক টাইপ হওয়ায় সবার সাথেই অল্পতে মিশে গেছে। কথা বার্তায় শিশুসুলভ আচার আচরণ স্পষ্ট। নির্দ্বিধায় লোকটি মার্জিত স্বভাবের, ভদ্র। বেশ অনেকক্ষন কথা বার্তার পর দোহা ব্যাগ থেকে ইনভিটেশন কার্ড বের করে বন্ধুদের দিলো। বিয়ের কদিন আগেই সবাইকে যেতে অনুরোধ করলো তারা। সবাই যদিও মাথা দুলিয়ে সায় জানিয়েছে তবে তারা এখনো ঠিক করে নি কিছু। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই বেরিয়ে গেলো তারা। বাকিরা বসে রইলো চেয়ারে। এখনো বিল দেয়া বাকি। সূর্য আগেই বড় গলায় বলেছে এই ট্রীট ওর তরফ থেকে। খাওয়ার বিলটাও ও একা পরিশোধ করবে। খাওয়ার শেষে বিল দেখে চক্ষু চড়কগাছ তার। মানিব্যাগে পাঁচশো টাকাও নেই তার। একটাই উপায় এখন। সবার পকেট হাতড়ে টুকটাক যা মেলে তাতেই বিল মেটাতে হবে বন্ধুদের। ইমন ঢেকুর তুলে বললো,
“আমার কাছে পাঁচশ আছে মামা। হিমি? তোর কাছে?”
হিমি হতাশ গলায় বললো,
“দুশো পঁচাত্তর!”
সোহিনী মুখ গোমরা করে দেড়শো টাকা বের করে বললো,
“আগে খেয়াল করবি না টাকা আছে কি নেই? আহাম্মক!”
সূর্য মুখ কালো না করে উল্টো ধমক দিয়ে বললো,
“চুপ কর তো। সবাই মিলেমিশে খেয়েছি তাহলে টাকাও সবাই মিলেমিশে দেবো। এতে ভালোবাসা বাড়ে। জানিস না! গাধী!”
মেঘ কিছু টাকা দিলো। সবকিছু মিলিয়েও রেস্টুরেন্টের বিল থেকে দুশো টাকা কম হলো। সবার মাথায় হাত। সোহিনী জিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও ব্যাগের চেইন খুললো। হাত মুঠো করে টেবিলের উপর রাখলো কিছু। হিমি কৌতুহলী চোখে সেদিকে দেখেই বললো,
“হয়েগেছে।”
সূর্য কিঞ্চিত রাগ নিয়ে বললো,
“এই দুশো টাকা আগে কই রাখছিলি বেদ্দপ? আগেই বাইর কইরা দিলে এখন মাথা চাপড়ানো লাগতো আমাগোরে। কিপ্টা মহিলা!”
চলবে,,,,,,,,,,,,