হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
০১.
হাসপাতালে শিশু বিভাগের নিজ চেম্বারে বসে রোগীর প্রেসক্রিপশন লিখছে ডক্টর তাহির মাহমুদ। সামনের চেয়ারে তিন বছরের ছেলেকে নিয়ে বসে আছেন তার বাব মা। ছেলেটা অসাবধানতা বসত ছাদের কার্নিশ থেকে পা পিছলে পরে যায়। নিচে পরার আগেই পাশের ছাদ থেকে লাফিয়ে এসে মধ্যবয়স্ক লোকটি দু হাত আকড়ে ধরে তার। ভয়ে কান্না শুরু করে বাচ্চাটি। উপরে উঠে আসার পরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছিলো। হাত পা ছিলেছে খানিক। সাথে ভয়ের চোটে জ্ঞানও হারিয়েছে। চাইল্ড সাইকাট্রিস্ট তাহিরের সাক্ষাতকার লাভেই এখানে আসা তাদের। বেশ অনেকক্ষন বাচ্চাটার সাথে গল্প করে চটোলেট দিয়ে তবেই তার ভীতি কমাতে সক্ষম হয়েছে তাহির। তবুও কয়েক মিনিটের ব্যবধানে কেঁপে উঠছে বেচারা। চেয়ারে বাবার কোলে বসেও ভয় পাচ্ছে নিচে পরে যাওয়ার। তাহির প্রেসক্রিপশন লিখে বাচ্চার বাবার হাতে দিলো। বাচ্চাটাকে মৃদু হেসে বিদায় জানিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দিলো সে। লম্বা শ্বাস টেনে হাত ঘড়িতে সময় দেখে উঠে দাঁড়ালো তাহির। পরনের নেভি ব্লু শার্টের কলার ঠিক করে হাতে এপ্রোন উঠিয়ে চেম্বার থেকে বেরুলো এবার। কিছুটা যেতেই কানে এলো চেঁচামেচি। হাসপাতালে অহরহই চেঁচামেচি হয়ে থাকে। পেশেন্টের বাড়ির লোকজন অহেতুক চেঁচিয়ে ডাক্তারদের মাথা খায়। বাকি পেশেন্টদেরও বিরক্ত করে প্রচুর। এই বিষয়টা খুব অসহ্যকর মনে হয় তাহিরের কাছে। ডাক্তার কি করবে না করবে, কিভাবে করবে সেটা নিশ্চয় অন্য কারো বলার অপেক্ষা রাখে না! তাদেরকে তাদের মতো কাজ করতে না দিয়ে আই সি ইউ এর সামনে ভীড় করে হল্লা করার কোনো মানে হয় না। তবুও তারা করে। প্রতিনিয়ত করে। এবারেও হয়তো একই কারনে করছে। নিজের মনে কথাগুলো ভেবে এগিয়ে যেতে গিয়েও থেমে গেলো তাহির। ঘাড় ঘুরিয়ে বা দিকে তাকালো। ছয় সাত জন তরুন তরুনী মধ্যে ছেলেদের মতো শার্ট প্যান্ট পরা মাথা ভর্তি লম্বা কোঁকড়ানো চুল ফর্সা দেখতে মেয়েটাকে এক নিমিষেই চিনে ফেললো তাহির। মেয়েটা অস্থির ভঙ্গীতে হাত পা নাচাচ্ছে। এক দন্ড দাঁড়াচ্ছে না এক জায়গায়। ঘাড়টাও অনবরত ঘুরাচ্ছে। সাথের কয়েকজন উচ্চ স্বরে চেঁচামেচি করে চলেছে। ব্যাপারটা বুঝতে তাহির তাদের দিকে এগুলো। বিনম্র গলায় বললো,
.
এক্সকিউজমি? এটা হাসপাতাল। এভাবে চেঁচামেচি করে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করছেন কেনো আপনারা? অন্যান্য রোগীদেরও অসুবিধা হচ্ছে এতে!
.
কোঁকড়ানো চুলের মেয়েটার নাম হিমি। সে তাহিরের দিকে তাকিয়েই ব্যস্ত ভঙ্গীতে বলে উঠলো,
.
তো? আমরা কি করবো শুনি? হাত পা গুটিয়ে বসে থাকবো?
.
তাহির ভ্রু কুঁচকালো। সবার দিকে একপলক দেখে বললো,
.
কি সমস্যা আমাকে বলুন। আমি দেখছি। আমি এখানের একজন ডক্টর!
.
আমাদের রোগীকে খোঁজে পাচ্ছি না। কাল রাত অব্দি এখানেই এই (হাতের ইশারায়) কেবিনে এডমিট ছিলেন আজ সকাল থেকেই তিনি নিখোঁজ! পুরো হাসপাতাল তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম অথচ হদিসই পেলাম না! রোগী কোথায় গেলো, বেঁচে আছে না কি মরে গেছে এটা কি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দেখার বিষয় নয়?
.
মেয়েটির কথায় তাহির তটস্থ হলো। চোখে মুখে রাগি ভাব এনে পেছন ঘুরেই ধমক দিলো দূরে দাঁড়িয়ে থাকা নার্সকে। তরুনী নার্স দৌড়ে এসে বলতে লাগলো,
.
স্যার আমাদের কোনো দোষ নেই। প্যাশেন্ট যদি নিজ দায়িত্বে হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ নিয়ে চলে যায় তাহলে আমরা কি করতে পারি? ওনাকে তো আর ধরে বেধে রাখতে পারি না।
.
নার্সের কথা শেষ হতেই শার্টের হাতা কনুই অব্দি ফোল্ড করে কোমরে হাত রাখলো ইমন। দাঁতে ঠোঁট চেপে বললো,
.
উনি ডিসচার্জ চাইলেন আর আপনারা দিয়ে দিলেন? রোগ না সারিয়েই রোগী চলে গেলো আর আপনারা বলছেন আপনাদের কোনো দোষ নেই! অদ্ভুত!
.
ডক্টর তারিহ তাদের থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
.
কি কারনে এডমিট করা হয়েছিলো ওনাকে?
.
নার্সকে বলার সুযোগ না দিয়েই হিমি বলে উঠলো,
.
এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। দুম করে গাড়ির সামনে পরে গিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় পরেছিলেন রাস্তায়। দরকারি কাজ থাকায় নার্স আর ডাক্তারের ভরসাতে রেখেই চলে গিয়েছিলাম আমি। আজ আমাদের আসার আগেই হাওয়া হয়ে গেলেন তা তো মানা যায় না ডাক্তার!
.
তাহির সন্দিহান হয়ে বললো,
.
আপনাদের পরিচিত ছিলো না রোগীর সাথে?
.
হিমি মাথা নাড়িয়ে অসম্মতি জানালো। তাহির কিছু একটা ভেবে নার্সের দিকে তাকিয়ে বললো,
.
পেশেন্ট কোনো নাম ঠিকানা দিয়ে গেছেন যাওয়ার আগে?
.
নো স্যার!
.
তাহলে ডিসচার্জ কি করে হলেন? হসপিটালের বিল?
.
স্যার রোগী নিজেই বিল পরিশোধ করেছেন। তাই আর আমরা ওনাকে আটকাই নি!
.
তাহির হাত ঘড়িতে আবারও চোখ বুলালো। কিছু একটা ভেবে বললো,
.
ওনার রিপোর্ট কি বলছে?
.
একদম নরমাল স্যার। সব ঠিক ঠাক আছে। উনি হার্টের রোগী তাই হঠাৎ গাড়ি দেখে সেন্স হারিয়েছিলেন। গাড়ি তো ওনাকে স্পর্ষই করে নি!
.
নার্সের কথা শুনে সবার চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। দোহা হিমির কাধে হাত রেখে ফিসফিস করে বললো,
.
এই নার্স কি বলে এসব?
.
হিমি ঠোঁট চওড়া করে বললো,
.
গাড়ি ওনাকে স্পর্ষ করে নি? উনি সেন্স হারিয়েছিলেন মাত্র? আমাদের বোকা মনে হয় আপনার না কি বোকা বানানোর চেষ্টায় আছেন?
.
তাহির নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে। নার্স মেয়েটি তাড়াহুড়া করে বললো,
.
আশ্চর্য, আমি আপনাদের বোকা কেনো বানাতে যাবো? যা সত্যি তাই তো বলছি!
.
তাই যদি হবে তাহলে পুরো শরীর রক্তে মাখামাখি ছিলো কেনো ওনার? আর হাসপাতালে আনা মাত্রই অটিতে ঢোকাবে কেনো?
.
দোহার কথায় নার্স এবার ভাবতে লাগলো কার কথা বলছে এরা। কিছুক্ষন ভাবার পর উত্তরটা পেয়েও গেলো। বললো,
.
আপনারা যার কথা বলছেন আমি তার কথা বলছি না। আর আমি যার কথা বলছি আপনারা সেটা জানতে চাইছেন না বা বুঝছেন না।
.
ইমন অবাক হওয়া কন্ঠে বললো,
.
আপনি কার কথা বলছেন?
.
জ্বি আমি তো গত দিন বিকেলে ভর্তি হওয়া বয়স্ক মহিলার কথা বলছিলাম। উনাকেও রাস্তা থেকে কয়েকজন উদ্ধার করে হাসপাতালে এডমিট করছে। উনারও এক্সিডেন্ট হয়েছে বলে ধারনা করা হয়েছিলো কিন্তু আসলে ওনার এক্সিডেন্ট হয় নি। সেন্স হারিয়ে রাস্তায় পরে যাওয়ার মাথায় চোট পেয়েছিলেন।
.
ইমন চরম রেগে বললো,
.
সেটা আগে বলবেন না? আজিব! কখন থেকে হাসপাতাল মাথায় নিয়ে ছুটছি আমরা। ধুর বাল!
.
নার্স মেয়েটি রাগি গলায় তাদের উদ্দেশ্যে বললো,
.
আপনারাই বা কোথায় বলতে দিলেন আমায়? এসেই তো ওই কেবিনে ঢুকে পরলেন। ওটা অন্য পেশেন্টের কেবিন ছিলো আপনাদের পেশেন্টের নয়। আমি কি করে জানতাম কাকে খোঁজছেন আপনারা? রিসেপশনেও কিছু বললেন না সোজা হামলা করে দিলেন।
.
তাহির কৌতুহলী গলায় বললো,
.
আপনারা পেশেন্টের কেবিন নং জানতেন না?
.
উহু! হিমি বললো না, কাল দরকারি কাজ পরে যাওয়ায় ওকে চলে যেতে হয়েছিলো। আমরাও ছিলাম না এখানে। অটিতে ঢোকানো হতেই হিমি বেরিয়ে গেছিলো। তাই আর জানা হয় নি। আজ এখানে এসেই রিসেপশনে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমরা। ওখান থেকে আমাদের এই কেবিনে আসতেই বলা হয়েছে। আমরা তো আর ওনার নাম ধাম জানি না, এক্সিডেন্ট কেইস বলতেই বললো, সাত নং কেবিনে আছেন। অথচ কেবিনে এসে দেখি পেশেন্ট গায়েব! মাথা তো গরম হবেই। এনিওয়ে, কোথায় আমাদের পেশেন্ট?
.
সোহিনীর কথার বিপরীতে মুখ কালো করে নার্স বললো,
.
আপনাদের পেশেন্ট স্টেবল আছেন এখন। সাধারন কেবিনে আছেন। উপরের তলায়!
.
ছেলেমেয়ে গুলো হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো উপরে। রয়ে গেলো শুধু হিমি। তাহিরকে বেশ অনেকক্ষন ধরেই পর্যবেক্ষন করছে সে। খুব চেনা চেনা লাগছে লোকটাকে কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটাই মনে নেই তার! তাহির নার্সের উদ্দেশ্যে বললো,
.
ওনারা উত্তেজিত থাকায় হয়তো সবটা খেয়াল করেন নি আপনার উচিত ছিলো তাদের থেকে ডিটেইলস জানা। সেটা না করে ওখানে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়েছিলেন কেনো? ফারদার যেনো আপনাদের বেখেয়ালি কর্মকান্ডের জন্য হাসপাতালে চিৎকার চেঁচামেচি না হয়!
.
মুখের কথা শেষ করেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো তাহির। নার্স মেয়েটা মুখ কালো করে আছে। তার কি দোষ ছিলো এখানে? এই ছেলে মেয়েগুলো একটা বারের জন্য তার কথা শুনে নি তাতে সে কি করতো? চেষ্টা তো করেছিলো! বেয়াদব মেয়ে একটা ধমকিয়ে চুপ করে দিয়েছে তাকে। সবশেষে তাকেই বকা খেতে হলো। তাও আবার তার ক্রাশ ডাক্তারের থেকে? মন ভেঙে গেলো একদম। এদিকে হিমিকে বরফের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার গ্যাঙের দু একজন ফিরে এলো তার কাছে।
.
কি বে? এখানে দাঁড়িয়েই থাকবি না কি উপরে যাবি?
.
হিমি অন্যমনস্ক হয়েই মাথা নাড়লো। পুতুলের ন্যায় তাদের সাথে পাও মেলালো। কিন্তু ভাবনা একটা রয়েই গেলো, লোকটাকে কি করে চেনে সে? কোথায় দেখেছে?
চলবে,,,,,,,,,