অপূর্নতার সংসার পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0
4819

#পর্ব১৬_সমাপ্ত।
#অপূর্নতার_সংসার
#লেখিকাঃতানজিনা_মেহরিন_মিশু

কেটে গেলো সময় সময়ের গতিতে। দেখতে দেখতে অনেক বছর কেটে গেলো, রোজার চুলে এখন পাক ধরেছে। চশমা ছাড়াও যেনো স্পষ্ট দেখতে পায় না কোনোকিছুই! আর রওশন তো রোজার উপর নির্ভর করে চলেছে। তাদের রেস্টুরেন্ট এখন অনেক সুনাম হয়েছে। বেস সুখেই কাটছে ওদের জিবন।

দুপুরের কড়কড়ে রোদ উঁকি মেরে সবাইকে নাজেহাল করে দিচ্ছে! যেনো সূর্য্যি মামা মাথার উপর ওঠে নাচছে! এর মাঝে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমে পরিবেশ টাকে শীতল করে তুললো। এরই মাঝে রওশন রোজাকে ডাকতে লাগলো,

রোজা এবার কিন্তু সত্যি ই খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে! তুমি কি আদৌও আসবে আমার সাথে?

উফফ রওশন এতো ডাকার কি আছে বলোতো? আমি আসছি তো নাকি! আর একটু অপেক্ষা করো আমার প্রায় হয়ে যাচ্ছে। বাবা, রহিমা খালা আর ড্রাইভার কাকু তৈরী হয়েছে?

হ্যাঁ সবাই তৈরী নিচে অপেক্ষা করছে তোমার জন্য। এবার তুমি আসলেই আমরা বেড়িয়ে পড়বো সবাই মিলে।

পুরো পরিবার সবাই মিলে রওশন এর মায়ের কবর জিয়ারত করতে যাচ্ছে। আর তারই উদ্দেশ্য এতিমখানায় কিছু লোকদের খাওয়ানোর আয়োজন করেছে।

কবর জিয়ারত শেষে রোজা নিজের হাতে পরিবেশন করে লোকদের খাওয়াচ্ছে তখনি দেখতে পেলো একজন লোক বসে আছে!

পরনে তার ময়লা একটি পাঞ্জাবী যার বুকপকেটের দিকে অর্ধেকটা প্রায় ছিড়ে গেছে। মাথার চুলগুলো জট পাকিয়ে এক দলা হয়ে গেছে, মুখ ভর্তি দাড়ি লোকটার তবুও রোজার এই বয়সে এসেও এরকম মানুষটিকে চিনতে একটুও অসুবিধা হলো না!

অস্ফুট স্বরে রোজার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,

আদিল তুমি! এখানে, এরকম পাগলের মতন অবস্থায় কি করছো?

রোজার কথা শুনে রওশন ও চলে আসলো সাথে সাথে, করিম সাহবে আর রহিমা বাচ্চাদের সাথে কথা বলছে বিধায় এদিক টা তেমন নজর কাড়েনি ওদের। তাই জানতেও পারছে না কি হচ্ছে এখানে!

আদিলকে এরকম অবস্থায় দেখে রোজার যেনো কেমন খারাপ লাগতে শুরু করলো। তক্ষনি রওশন এসে জিগেস করলো,

রোজা এমন করছো কেনো? কি হয়েছ?

রোজা বলে উঠলো,
রওশন এটা আদিল! আদিল বসে আছে এখানে।

সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেলো শিলা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে!

রোজার শিলাকে চিনতে একটুও কষ্ট হলো না। শিলা এসেই আগে আদিলকে বলতে লাগলো,

ভাইয়া তুই আবার এই এতিমখানায় এসে বসে রয়েছিস? আমি কতো চিন্তা করছিলাম তোকে নিয়ে আর তুই এখানে এভাবে বসে আছিস!

শিলার চোখ গেলো রোজার দিকে,
সঙ্গে সঙ্গে শিলা গিয়ে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরলো!

ভাবি তুমি এখানে? কেমন আছো? কতোদিন পরে দেখলাম তোমাকে। ওইদিন কি হয়েছিলো তোমার? একটা ফোন ওতো করলে না আমায়? আমি অনেক খোঁজ নিয়েছিলাম তোমাদের কিন্তু কোনো খোঁজই পাই নি। কি হয়েছিলো তোমাদের?

একে একে শুরু থেকে ড্রাইভারের কথা থেকে সব কথা রোজা শিলাকে গুছিয়ে বলতে লাগলো। আর বলতে লগলো যে রওশন কে পেয়ে ও আদিল এর কথা ভুলেই গেছে। রওশন ওর জিবনে সবটুকু দিয়ে ওকে সুখি রেখেছে।

তারপর রোজা প্রশ্ন করলো, কিন্তু শিলা আদিল এর পাগলের মতন অবস্থা কেনো? আর রিনিই বা কোথায়? কি হয়েছে আমাকে একটু খুলে বলো?

শিলা বলতে লাগলো, আজ থেকে ঠিক ২০ বছর আগের কথাঃ——

সেদিন আদিল আর রিনির গাড়ির সাথে একটি ট্রাক এক্সিডেন্ট হয়। রিনি অজ্ঞান হলেও আদিল পুরোপুরি অজ্ঞান হয়ে যায়নি সে তক্ষুনি এ্যাম্বুলেন্সে ফোন করে।

ডাক্তার আদিল আর রিনিকে আলাদা রুমে শিফট করে। আদিল এর মাথায় ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দেয়। আর রিনির ও তেমন ক্ষতি হয়নি। আদিল এর জ্ঞান ফিরে আসলে নার্স তাকে খবর দেয় রিনির নাকি জমজ মেয়ে সন্তান হয়েছে।

এ কথা শুনে আদিল কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো কিছুই বললো না। তারপর তড়িৎ গতিতে সে বাড়ি চলে গেলো। বাড়িতে গিয়েই মা আর আমাকে রিনির মেয়েদের কথা বলেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইলো। এক সপ্তাহ পর হাসপাতাল থেকে যখন রিনি বাড়িতে আসলে পরের দিনই বাড়িতে আবার পুলিশ আসে। পুলিশের বক্তব্য রিনি নাকি ভাইয়ার আগে আরো অধিক ছেলের সাথে সম্পর্ক করেছে এবং তাদের টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে এবং ভাইয়ার সাথে বিয়ে করে এখানে পালিয়ে রয়েছে।

পুলিশের এই কথা শুনে মা বলতে লাগলো ভাবিকে,

ইদারা বেগমঃ ছিহঃ অলুক্ষুনে মেয়ে, লজ্জা শরম নেই বেহায়া কোথাকারের! এতো ছেলেদের সাথে তুই মেলামেশা করে আমার ছেলেটার মাথা চিবিয়ে এখানে এসে রাজরানী হয়ে বসেছিলি! তোর জন্য আমার ফুলের মতন বউমা কোথায় গেছে কিচ্ছু জানি না। দূর হ তুই! তুই জেলে গিয়ে পঁচে মর!

এই বলে ঠাস ঠাস করে কতোগুলো চড় মেরে দিলেন ইদারা বেগম। রিনি আক্রোশে বলতে লাগলো

হ্যাঁ আমি আদিলকে কোনোদিনই ভালোবাসিনি! ভালোবেসেছি শুধু ওর টাকাকে! বেশ করেছি এসব কিছু করে। আপনার ছেলেও তো ধোয়া তুলসি পাতা নয়! আমি না টাকার লোভে এসব করেছি, আপনারা কি করেছেন রোজার সাথে মনে নেই? এখন রোজার জন্য দরদ উতলে পড়ছে বুঝি? তাহলে যান না রোজার পা ধরে গিয়ে ক্ষমা চান। এখন আমার মেয়ে হয়েছে বলে বুঝি আর ভালো লাগছে না তাই না? শুনুন আপনার ওই ছেলের থেকে ঢেরগুন ভালো ছেলে আমি পটাতে পারি।

সঙ্গে সঙ্গে রিনির গালে কতোগুলো থাপ্পড় মারলো আদিল! টাল সামলাতে না পেরে রিনি ফ্লোরে পড়ে গেলো! তাও আদিল রিনিকে ওঠিয়ে পরপর চড় মেরেই যাচ্ছে। অবশেষে পুলিশ তাকে থামালো।

সত্যি আমি তোর মতো মানুষকে ঘরে এনে নিজের পায়ে নিজেই কুড়োল মেরেছি। অন্ধ হয়ে গেছিলাম আমি ছেলের আশায়! এতে অবশ্য আমার মায়েরও অবদান কিছু কম নয়।

ছেলের কথা শুনে ইদারা বেগম লজ্জায় মাথা নুইয়ে রেখেছে! সত্যি এতে তারও অবদান কিছু কম নয়।

তোর জন্য আমি রোজাকে ছেড়ে দিয়েছি। তুই তো রোজার নখেরও যোগ্য নস! রোজাকে তো আমি খুঁজে বের করবো। যদি খুঁজে নাও পাই তাহলে আমার এই মেয়েদেরকে আমি মানুষ করবো রোজার মতন করে, কোনোদিনও ওদের জানতে দেবো না যে তুই ওর মা! তোর এই মুখোস যদি আগে জানতাম কোনোদিনও ফিরেও তাকাতাম না তোর দিকে। তুই কোনেদিনও এ বাড়ির এিসীমানায় ও আসবি না ।

রিনিকে নিয়ে পুলিশ চলে গেলো। ইদারা বেগম মাটিতে বসে কাঁদছে! তার নিজের ভুলে তার ছেলের সংসার টা এমন হয়ে গেলো।

অপরদিকে আদিল রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে রইলো। পরপর চারদিন ভাইয়া রুম থেকে বেরোয়নি! মাঝে মাঝে রোজা আর মেয়েদের নাম ধরে চিৎকার করতো। কখনো ও বা আলোর খেলনা নিয়ে বসে থাকতো। কিছু মাস পরে ডাক্তার বললো ভাইয়া মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে! তাকে মানসিক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু মায়ের কথায় ভাইয়া আমাদের এখানে বাড়িতেই ছিলো।

আস্তে আস্তে ভাইয়ার পাগলামি বাড়তে থাকে। ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রাএেবেলা বাচ্চাদের রুমে গিয়ে বসে থাকতো। ভাইয়ার এ অবস্থা মা সহ্য করতে না পেরে একদিন মরেই গেলো! মারা যাবার আগের দিন শুধু বলেছিলো কোনোদিন যদি তোমার দেখা পাই যাতে মায়ের হয়ে আমি ক্ষমাটুকু চেয়ে নিই তোমার কাছে।
______________________________________

ব্যস এভাবেই চলতে লাগলো আজ ২০ বছর। রিনির মেয়েদেরকে আমি যতোটা পেরেছি মানুষ করার চেষ্টা করেছি। ভাইয়া তো বুঝতেই পারে না যে তার আরো দুটো মেয়ে রয়েছে। আজকে দুপুরে ভাইয়াকে রুমে দিয়ে এসে দেখি ভাইয়া নেই। খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসে পেয়ে গেলাম।

রোজা শিলাকে বলতে লাগলো,
আমার মায়ের উপর কোনো রাগ নেই। আর আদিলের উপর ও না। আদিল এর জন্যই তো আমি রওশন এর মতো একটা ভালো জিবন সঙ্গিকে পেয়েছি। তবে হ্যাঁ করুনা হচ্ছে খুব আদিল এর এই অবস্থা দেখে।

যাই হোক ভাবি তুমি বলো আলো আর মিষ্টি কোথায়? ওদের খবর কি?

আলো পড়াশোনায় ভালো রেজাল্ট করে বিদেশে গিয়েছিলো পড়াশোনা করতে ব্যস ওখানে জব পেয়ে যায়। আর ওখানেই রওশন এর বন্ধুর ছেলের সাথে বিয়ে করে সেটেল সেটেল্ড হয়ে যায়। এখন আর দু বছর পর একেবারে চলে আসবে। আর মিষ্টি তো পড়াশোনা শেষ করে কলেজে চাকরি করছে আলো ফিরলে তখন মিষ্টির বিয়ে দিবো। আমার দু মেয়েই আমি যেমন চেয়েছি ঠিক তেমন করেই মানুষ হয়েছে।

শিলাঃ- হ্যাঁ ভাবি আমিও চাই ওরা সুখে থাকুক। শুধুমাএ ভাইয়া আর মায়ের মুর্খামির জন্য ওরা আজ আমাদের থেকে দূরে।

রোজাঃ- তা শিলা তুমি বলো তোমার খোঁজ খবর কি?

শিলাঃ- ভাবি মায়ের মৃত্যুর পর আমার বিয়ে হয়। হাজবেন্ড সরকারি জব করে আর আমার একটা ছেলেই আছে। ছেলে আর ভাইয়াকে দেখেই আমার সারাদিন কেটে যায়।

রোজাঃ- সুখে থাকো শিলা। জীবন যেখানে যেমন। আদিল এর ভুলের জন্যই ওর এই অবস্থা। আমিও চায়নি আদিলকে ছেড়ে থাকতে। সবটাই হয়েছে আদিল এর কারনে। এখন তুমি আদিলকে একটি মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দাও এভাবে তুমি আর কতোদিন দেখবে বলো? এর চেয়ে ভালো হাসপাতালে ওর চিকিৎসা চলবে। আর রিনি কি ফিরে আসে নি?

শিলাঃ- ফিরে এসেছিলো, তবে যখনি দেখলো ভাইয়ার এই অবস্থা তখনি কোথায় চলে গেলো ক জানে? আর ফিরে আসেনি। তবে তুমি যাও এবার আমাকে আলো আর মিষ্টির নাম্বার দিও আমি ওদের সাথে কথা বলে নিবো। তুমি ভালো থেকো। আজ আসছি ভাইয়াকে নিয়ে।

রোজাঃ- ঠিকআছে ভালো থেকো তুমিও । আর একটু দাড়াও আমি আদিল এর সাথে একটু বলি!

রোজার একটু হলেও কষ্ট লাগছে কারন আদিল এর সাথে বারোটা বছর সংসার করেছে। রোজা গিয়ে আদিল এর সামনে দাড়াতেই আদিল বললো,

রোজা, রোজা, রোজা, তুমি রোজা না? আমি চিনেছি তোমাকে। কি মজা, কি মজা রোজা ফিরে এসেছে।

এই বলে আদিল হাততালি দিতে লাগলো। আবার বললো,

রোজা আমার মেয়েরা কই?

আদিল তোমার বড়ো মেয়ে বিদেশে চাকরি করছে ওখানেই বিয়ে করেছে। আর তোমার ছোটো মেয়ে কলেজে চাকরি করছে। দেখেছো আমার মেয়েরাই আমার ছেলে হয়ে ওঠেছে।

আদিল আবারো হাততালি দিতে লাগলো। এবার কেঁদে ওঠলো! রোজার পায় ধরে ক্ষমা চাইলো। আমার মেয়েদরকে একটু দেখাবে রোজা। আমি ভুল করেছি ওদের বলো একটু ক্ষমা করে দিতে আমায়।

এই বলে আদিল আবারো কাঁদতে লাগলো।

আদিলকে কাঁদতে দেখে রোজারও খারাপ লাগলো। রোজা বললো মেয়েরা আসবে তোমার সাথে দেখা করতে আদিল। ততক্ষণে তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। আর সুস্থ হয়ে ওঠতে হলে তো তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে তাই তুমি আগে হাসপাতালে গিয়ে সুস্থ হয়ে ওঠবে তারপর আলো আর মিষ্টি আসবে তোমার কাছে।

কি মজা! তুমি যখন বলেছো তখন আমি হাস্পাতালে যাবো। তাহলেই তো আমার মেয়েরা আসবে। এই শিলা তাড়াতাড়ি চল? নাহলে ওরা আর আসবে না!

এই বলে আদিল শিলার সাথে চলে গেলো। ওদিকে রোজা তাকিয়ে দেখছে আদিল এর নিষ্ঠুর পরিনতি! আদিল তার কর্মফল ভোগ করছে।

রওশন এসে রোজাকে বাড়িতে নিয়ে গেলো। আবার আগের মতন সে তার রোজাকে নিয়ে সুখে জিবন কাটাতে লাগলো।

#সমাপ্ত।

বিঃদ্রঃ ভুল এুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে