হিমি পর্ব-২+৩

0
1218

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

০২.

ভার্সিটি চত্বরে ঘাসের উপর গোল হয়ে বসে আছে একদল ছেলে মেয়ে। চেহারায় তাদের সুখী সুখী ভাব। আজকের ক্লাসটেস্ট সবার‌ই ভালো হয়েছে। অথৈ উৎসাহিত কন্ঠে বললো,

“এই আজ কে ট্রীট দিবি রে?”

নীতু বিষ্মিত কন্ঠে বললো,

“কিসের ট্রীট?

“কিসের আবার? পরীক্ষা ভালো হয়েছে সো ট্রীট তো চাই ইয়ার!”

অথৈয়ের জবাবে নীতু মুখ কাঁচুমাচু করে বললো,

“আমার পরীক্ষা তো ভালো হয় নি। যার পরীক্ষা ভালো হয়েছে সে দিক। আমি ওসবে নেই।”

তৎক্ষনাৎ গর্জে উঠলো লিজা,

“থাপ্পড় খাবি হারামী! ট্রীট তো তুইই দিবি। ভুলে যাস না আজ তোর দেয়ার কথা ছিলো!”

“আমার? কেনো? আমার কেনো?”

“কেনো মানে? তোর কি স্মৃতিশক্তি লোপ পাইছে? তোর পয়দা দিবসে এক গাদা টাকা খরচ করে গিফ্টের মেলা লাগাইছিলাম। পরিবর্তে তোর ট্রীট দেয়ার কথা মনে নাই? গিফ্ট তো একটাও ছাড়োছ নাই আর ট্রীটের বেলায় ন্যাকামো!”

পলাশের কথার রেশ ধরে সবাই চাপ দিতে লাগলো নীতুকে। বেচারি শেষমেষ রাজি হলো। অথৈ সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

“বান্ধবী আমরা কিন্তু সমুচা, সিঙারা আর চা খেতে যাচ্ছি না। রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভর পেট খাবো।”

নীতু অসহায়ত্ব নিয়ে দেখলো সবাইকে। অথচ তারা অনায়াসেই নীতুর অসহায়ত্ব হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে হাসি মুখে বসে আছে। নীতু অনেক ভেবে মেনে নিলো তাদের কথা। অথৈরা উঠে দাঁড়াতেই কালো রঙের বাইক এসে ব্রেক কষলো তাদের সামনে। বন্ধুমহল ঘাবড়ে গেছে তাতে। বাইক চালক মাথা থেকে হেলমেট খোলে দু হাতের তালুতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকালো। থমথমে গলায় বললো,

“মামানি কল দিচ্ছে কখন থেকে। উঠাস না কেনো?”

হিমির প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় অথৈ। তাড়াহুড়া করে ব্যাগ থেকে মুঠোফোন বের করে চোখ বুলায় তাতে। মায়ের সাত খানা মিস্ড কল! ‌হিমি বিরক্তি নিয়ে বললো,

“এতোক্ষন যখন ফোন চেক করিস নি এখন করার‌ও কোনো দরকার নাই। চল জলদি। আমার কাজ আছে।”

অথৈ দ্বিধা নিয়ে বন্ধুদের দিকে তাকালো। পলাশ বিরোধীতা করে বললো,

“অথৈ এখন যেতে পারবে না।”

হিমি স্থির নয়নে তাকিয়ে বললো,

“কেনো?”

পলাশ ঢোক গিলে বললো,

” আমরা একটু খাওয়া দাওয়া করবো। দেরি হবে তো।”

হিমি চুইঙ্গাম চিবোতে চিবোতে বললো,

“তোমরা খেয়ে নাও। ও এখন বাড়ি ফিরবে। মামানি ডেকে পাঠিয়েছে দেরি হলে দু চার ঘা খেতে পারে।”

বন্ধুদের মুখ ছোট হয়ে গেলো। তারা জানে হিমি চাইলেই অথৈকে রেখে যেতে পারে। অথৈয়ের মাকেও সামলে নিতে পারে। কিন্তু সে করবে না। কোনো কারনে হয়তো রেগে আছে হিমি। চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে ঠেকছে তার। হিমি শান্ত গলায় বললো,

“তুই আসছিস?”

অথৈ এক মুহুর্ত না ভেবে চটপট বাইকে চেপে বসলো। সাই করে বেরিয়ে গেলো হিমির বাইক। পলাশ, নীতু, লিজা, তপন, সৃষ্টি সবাই আক্ষেপ নিয়ে তাকিয়ে আছে।

_________________

অথৈকে বাড়ি পৌঁছিয়ে আবার‌ও বাইক ছুটিয়ে চলছে হিমি। মেয়েদের বাইক চালানোয় হাজার‌ও আপত্তি থাকে সমাজের। কিন্তু হিমির পরিবারের নেই। তার দুই পরিবার‌ই তার কোনো কার্যকলাপে আপত্তি করে না। আবার প্রশংসাও করে না। বাধাও দেয় না আবার পরামর্শ‌ও দেয় না। তারা আসলে হিমিকে নিয়ে কিছুই ভাবে না। হিমিকে নিয়ে ভাবার একমাত্র সেই আছে। ভাবলেই হাসি পায় হিমির। মুঠোফোন তুমুল ধ্বনি তুলে বাজতে লাগলো। হিমি বাইক দাঁড় করিয়ে হেলমেট খোলে রাখলো । পকেট থেকে ফোন বের করে কানে ঠেকালো সে। ওপাশ থেকে সোহিনী কিছু বলবে তার আগেই হিমি বলে উঠলো,

“পাঁচ মিনিট লাগবে আসতে। অপেক্ষা কর তোরা। আসছি।”

তারপর ফট করে কেটে দিলো ফোন। অন্য পাশের ব্যক্তির‌ও যে কিছু বলার থাকতে পারে তা হিমির মাথায় এলো না। সে আপন গতিতে চলছে আবার। রাস্তার পাশে বড় এক গাড়ির সামনে ডক্টর তাহিরকে দেখে বাইক থামালো হিমি। উজ্জল শ্যামবর্ণ গায়ে হলদে শার্ট। পরনে জিন্স, কালো শু। চোখে পাতলা ফ্রেমের চশমা, বাম হাতে সিলভার রঙের ঘড়ি, ডান হাতে এপ্রোন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটি। তাকে ভালো করে নিরক্ষন করেও সেদিনের আগে কোথায় দেখেছে তা হিমি মনে করতে পারলো না। পায়ে দিয়ে ঠেলে ঠেলে বাইক নিয়ে দাঁড়ালো লোকটার সামনে। তাহিরের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে এই অসময়ে। আর্জেন্টলি হাসপাতালে যেতে হবে তাকে। অথচ কোনো গাড়ি রিকশা পাচ্ছে না সে। হিমিকে দেখেই কপাল কুঁচকালো তাহির।

“মে আই হেল্প ইউ ডক্টর?”

তাহির আমতা আমতা করে বললো,

“আসলে, আমার গাড়ি খারাপ হয়ে গেছে। এক্ষুনি হসপিটালে যেতে হবে কিন্তু কিছু পাচ্ছি না যে,,,,”

তাহিরের কথার মাঝেই হিমি বললো,

“আমি ড্রপ করে দিচ্ছি।”

তাহির আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ বাইকের পেছন উঠে বসলো। হাসপাতাল যাওয়া পর্যন্ত কারো মধ্যে কোনো কথা হলো না। দু একবার হিমির ফোন বাজলেও যথারীতি কেটে গেলো। হিমি কল রিসিভ করে নি। বাইক থামলো সোজা হাসপাতালের সামনের পার্কিং জোনে। তাহির বাইক থেকে নেমে ছোট্ট করে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ জানিয়ে চলে যেতে নিলো। পেছন থেকে হিমি ডেকে উঠলো,

“ডাক্তার?”

তাহির পেছন ঘুরলো। হিমি বাইক সাইডে রেখে দৌড়ে তাহিরের কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো। খোপা থেকে বেরিয়ে পরা চুলগুলো কানের পাশে গুজে দিয়ে বললো,

“আমি কি আপনাকে চিনি? মানে, এর আগে কোথাও দেখা হয়েছে আমাদের?”

তাহির শান্ত গলায় বললো,

“ওই দিন এখানেই দেখা হয়েছিলো। প্যাশেন্ট খোঁজে পাচ্ছিলেন না বলে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন।”

হিমি চটপট মাথা নাড়লো। হাতের উল্টো পিঠে নাকের নিচে জমে থাকা ঘাম মুছে নিয়ে বললো,

“সেদিনের কথা মনে আছে আমার। এর‌ও আগে কখনো দেখা হয়েছিলো কি? আমি মনে করতে পারছি না। আচ্ছা ডাক্তার, আপনার‌ও কি তাই মনে হয়?”

তাহির কপাল কুঁচকে তাকালো। এই মেয়েটা ডাক্তার ডাক্তার করছে কেনো? পাঁচ বছরের ডাক্তারি জীবনে কেউ তাকে ডাক্তার বলে সম্বোধন করে নি। হয় ডক্টর তাহির, নয় ডাক্তার বাবু অথবা সাহেব। অথচ এই মেয়ে কেমন অদ্ভুত ভাবে ডাক্তার ডেকে চলেছে। তাহিরের অস্বস্তি হিমির চোখে পরলো না। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

“কি হলো? বললেন না যে?”

তাহির ঘড়িতে সময় দেখে নিয়ে বললো,

“হ্যাঁ। মিনিমাম দু সপ্তাহ আগে ব্রীজে আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছিলো! তখন‌ই আমার সাথে দেখা। আর সময় দিতে পারছি না। আই হেভ টু গো!”

কথাটা বলে হনহন করে হাসপাতালের ভেতর ঢুকে পরলো তাহির। হিমি অবাক হ‌ওয়া চোখে তাকিয়ে দেখছে তাহিরের যাওয়া। দু সপ্তাহ আগের কথা হিমি এতো তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো? তার তো এতো ভুলো মন নয়! তবে? পরোক্ষনে ভাবতে লাগলো লোকটাই কি তাকে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে?

*******
রাত পৌনে বারোটা বাজে। বন্ধুরা সব বাড়ি ফিরেছে দশটায়। হিমিই এখনো রাস্তায় রাস্তায় বাইক নিয়ে ছুটছে। ব্রীজের উপর দিয়ে যেতে নিলেই সামনে থেকে হুট করে চলে এলো এক ট্রাক! পাশ কাটানোর চেষ্টায় বাইক নিয়েই উল্টে পরেছিলো সে। ডান পায়ের গোরালির উপর থেকে ঠাকনু অব্দি চামড়া উঠে গেছে। কনুই, হাতের কবজ্বি‌ও জখম হয়েছে। কোমরেও লেগেছে অনেক। উঠে দাঁড়ানোর শক্তি নেই মোটেও। বাইকের ডান মিরর টাও ভেঙে গেছে তার। আরো কিছু ক্ষয় ক্ষতি হয়েছে হয়তো। হিমির তখন এতো ভাবার সময় নেই। কোনোরকম হাটুতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আশেপাশে দেখতে লাগলো। কোনো যানবাহনের দেখা মিললো না কয়েক মিনিট। পরে যাও মিলেছে কেউ দাঁড়ায় নি। পকেট হাতড়ে মোবাইল বের করলো হিমি। মোবাইল অক্ষত দেখে খানিক খুশি হলো সে। তাড়াতাড়ি ডায়াল করলো বড় মামা হানিফ শরীফের কাছে। তিনি তাড়াতাড়ি আসছেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। হিমি যখন বাইক টেনে তুলার চেষ্টায় তখন‌ই বিনা নোটিশে সাদা রঙের কার এসে থামলো তার সামনে। হিমি তো তাকে দাঁড়াতে বলে নি। আর না সাহায্য চেয়েছে। তবুও কার থেকে বেরিয়ে এলো ছয় ফুট উচ্চতার এক ব্যক্তি। হিমিকে একপলক দেখেই প্রশ্ন করলো,

“আপনার কি এক্সিডেন্ট হয়েছে? আমি একজন ডক্টর। চাইলে হ্যাল্প করতে পারি।”

হিমি উত্তর দিলো না। নিজের কাজেই ব্যস্ত সে। লোকটি কিছুক্ষন অপেক্ষা করে নিজের কারে ফিরে গেলো। আবার‌ও ফিরে আসলো হাতে একটা বক্স নিয়ে। হিমির কাছে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে বললো,

“এদিকে আসুন। প্রাথমিক চিকিৎসা করে দিই!”

হিমি ভ্রু কুঁচকালো। ফু দিয়ে মুখের উপর উড়ে আসা চুল উড়িয়ে দিয়ে বললো,

“আপনার থেকে সাহায্য চেয়েছি আমি? এতোক্ষন ধরে যাদের থেকে সাহায্য চাইলাম তারা তো দাঁড়ালোই না, আর এখন যখন বাড়ির লোক আসছে তখন যেচে পরে একজন এসেছে মায়া দেখাতে। যান তো আপনি। কোনো চিকিৎসার দরকার নেই আমার।”

লোকটা হিমির কথা কানে তুললো না। বরং ওখানেই নিচে বসে পরলো। হিমির ডান পা তুলে নিলো নিজের উড়ুর পর। হিমি ভড়কে গিয়ে লোকটির চুল মুঠো করে ধরলো।

“কি করছেন কি? বলেছি তো সাহায্য চাই না। কেনো যেচে পরে আসছেন বলুন তো? নিজের কাজে যান না রে ভাই!”

না, লোকটার তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। দিব্যি পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে উঠে দাড়ালো। হাত টেনে নিয়ে তাতেও মলম লাগিয়ে দিলো। সব শেষ করে তবেই চোখ তুলে তাকালো হিমির দিকে। মৃদু গলায় বললো,

“ডাক্তারের থেকে কেউ সাহায্য চাইবে তারপর সে চিকিৎসা করবে এ কথায় আমি বিশ্বাসী ন‌ই। আমার মতে আমার চোখের সামনে যেকোনো রুগ্ন ব্যক্তি থাকলেই তার চিকিৎসা করা বাঞ্চনীয়! ‌এই স্প্রে টা রাখুন। কোথাও ব্যাথা পেয়ে থাকলে ইউজ করবেন। আর কোথাও লেগেছে?”

হিমি মাথা নাড়লো। কোমরে আর ঘাড়ে পাওয়া ব্যাথার কথা মুখ ফুটে বললো না। লোকটা হিমির বাইক তুলে সাইডে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“আপনাকে নিতে কেউ আসবে? না কি ড্রপ করে দেবো?”

হিমি গমগমে গলায় বললো,

“প্রয়োজন নেই। ফ্যামিলি মেম্বার আসছেন।”

লোকটা ঘাড় ঝাঁকিয়ে কারে চেপে নিজ গন্তব্যে ছুটলো। হিমি দু একবার ডেকেছিলো ফিস দেবে বলে। কিন্তু সে তা না শুনার ভান ধরে চলে গেলো।

******
ওইদিন প্রায় মিনিট পনেরো লোকটার থেকে চিকিৎসা নিলেও নাম জানা হয় নি তার। ল্যাম্প পোস্টের আলোয় লোকটার চেহারা‌ও মনে গাঁথে নি হিমির। সুতরাং, ভুলে যাওয়াটা ভয়ঙ্কর কিছু না। কিন্তু তাকে ধন্যবাদ জানানো উচিত ছিলো। ভাবনার মাঝে আবার‌ও বেজে উঠলো হিমির ফোন। বিরক্তির শীষ টেনে ফোন তুলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো গম্ভীর এক কন্ঠ,

“বাসায় আসো!”

ব্যাস। এইটুকু বলেই ফোন কাটলেন হিমির বাবা মুহিব রহমান। হিমি ভেবেছিলো হয়তো তার পল্টনের কেউ ফোন করেছে। কিন্তু বাবার কন্ঠ শুনেই থম মেরে গেলো সে। তাড়াহুড়া করে ফোন পকেটে পুরে বাইকে বসলো। দ্বিগুন স্পীডে উল্টো দিকের রাস্তায় যেতে লাগলো হিমি।

চলবে,,,,,,,,,,

হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার

০৩.

হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকেই বাবাকে টেলিভিশনের সামনে বসে থাকতে দেখলো হিমি। চোখ মুখ সব সময়ের মতো গম্ভীর। হিমি কিছু না বলে বাবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। মুহিব রহমান টিভির চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন। দুপুরের নিউজ দেখতে পারেন নি বলেই এখন নিউজ খুঁজছেন তিনি। সবগুলো চ্যানেলেই বাংলা ছবি নাটক চলছে। এসবের মাঝে হঠাৎই চোখ গেলো মেয়ে হিমির দিকে। তিনি রিমোট নামিয়ে রাখলেন সোফায়। উঠে দাঁড়িয়ে পেছনে দু হাত বাধলেন। দৃষ্টি টিভির দিকে রেখেই কাঠ কাঠ গলায় বললেন,

“অথৈকে দেখতে আসছে। তোমার ওখানে না থাকাই ভালো।”

হিমি মাথা নেড়ে সায় জানালো। মুহিব রহমান ছোট ছোট পা ফেলে নিজের ঘরে চললেন। হিমি লম্বা শ্বাস টানলো। উল্টো ঘুরে বসার ঘরের টিভি বন্ধ করে দিয়ে রান্নাঘরে উকি দিলো। বড়মা খুন্তি অনবরত নাড়াচাড়া করছেন। ছোটমা চায়ের যোগার করছেন। বিকেলে এক কাপ চা না খেলে তার মাথা ধরে যায়। হিমি শার্টের কলার ঠিক করে শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলো। কেডস খোলে ছুড়ে দিলো আলনার দিকে। দুটো কেডস দুদিকে গিয়ে পরলো। প্যান্টের পকেট থেকে চুইঙ্গাম বের করে মুখে পুরলো হিমি। চুইঙ্গাম চিবোতে চিবোতে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো সে। আচ্ছা, সে কি বাজে? খুউব বাজে? বাবা কেনো তার সাথে ঠিক করে কথা বলে না? বড় মামা যেমন অথৈকে ভালোবাসে, ছোট চাচামনি যেমন নিহানকে ভালোবাসে অমনি করে বাবা তাকে ভালোবাসে না কেনো? আজ হিমির মা বেঁচে থাকলে হয়তো বাবাও তাকে ভালোবাসতো! আদর করে কথা বলতো নিশ্চয়! না কি এখনের মতোই রাগি চোখে থমথমে গলায় দু এক শব্দ বলতো শুধু? হিমি ভাবে। তার ভাবনার অন্ত নেই। ভাবতে ভাবতেই লম্বা কোঁকড়ানো চুলে চিরুনি চালায় হিমি। জটে আটকে যায় চিরুনি। টেনে টুনে চিরুনি খোলে জট থেকে। চুলে তেল দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু হিমি দেবে না। তেল দিলে মাথা ব্যাথা করে তার। লম্বা চুল কখনোই পছন্দনীয় নয় হিমির। ছোটবেলায় ছেলেদের মতোই চুল ছিলো। চুল বেরে গেলে ছেলেদের মতোই কেটে ছোট করা হতো। একদিন বাবা আটকে দেয় হিমিকে। মুহিব রহমান মেয়ের কোঁকড়ানো চুল কাটতে দেখে ছোট্ট করে বলেছিলেন, ‘থাকুক না। কাটার কি দরকার?’ হিমি চুল কাটে নি আর। যত্ন‌ও করে নি কখনো। তবুও চুল বাড়ে। ঝরে পরে না, ছিড়ে যায় না। কোঁকড়ানো চুল কোমর অব্দি পৌঁছে গেছে। তীব্র বিরক্তি নিয়ে চুলগুলো হাতখোপা করে রেখে দেয় সে। চুল বাধতেও রাগ লাগে তার। অথৈদের বরাবর‌ই দেখে চুল ঝুটি করতে, বিনুনি গাঁথতে, খোপায় ফুল লাগাতে। হিমি তার করে না। কোনোরকম চুল গুলো খোপা করে রেখে দেয় নয়তো পিঠেই ছড়িয়ে রাখে। চুলগুলো উস্কখুস্ক হয়ে উড়তে থাকে। হিমি পাত্তা দেয় না তাতে। উল্টো হেটে জানালার গ্রিলে হাত রাখলো হিমি। গরম লাগছে ভীষন। অস্বস্তিও হচ্ছে। খিদে পেয়েছে হিমির। কিছু খেতে পারলে ভালো হতো। কাউকে বলবে? না থাক, ছোটমা মুখ ঝামটাবে। বড়মা দিবে হয়তো! সন্তানহীন জননীর যে সবার প্রতি মায়া থাকে। ঘরের দরজায় টোকা পরায় ঘাড় ঘুরায় হিমি। বড় চাচা মতিউর রহমানের স্ত্রী আমিনা বেগম খাবারের প্ল্যাট নিয়ে হাজির। হিমি মৃদু গলায় বললো,

“কি ব্যাপার বড়মা?”

“তোর জন্য খাবার নিয়ে এলাম। ওবাড়িতে কিছু খেয়েছিলি দুপুরে?”

হিমি মনে করার চেষ্টা করে বললো,

“না।”

দুপুরে অথৈকে ওবাড়িতে ড্রপ করে দিলেও কেউ তাকে খেতে বলেনি। সেও আগ বাড়িয়ে খেতে চায় নি।আমিনা বেগম গোল গোল চোখে দেখেন তাকে। তাড়াহুড়া করে প্ল্যাট নামিয়ে রাখেন টি টেবিলে। হিমিকে টেনে বসান খাটে। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলেন,

“সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে কখন খাবি তুই? হা কর! ‌আমি খাইয়ে দি।”

হিমি মুখের চুইঙ্গাম ট্যিসুতে নিয়ে জানালার বাইরে ছুড়ে ফেলে। হা করে মুখ বারিয়ে দেয়। আমিনা বেগম খুশি মনে খাইয়ে দিতে থাকেন তাকে। এই একমাত্র মহিলা যিনি হিমিকে খাইয়ে দেন। কখনো কখনো জোর করে চুলে তেল দিয়েও দেন তিনি। গল্প‌ও করেন কখনো তার সাথে। হিমিকে খাইয়ে দিতে গিয়ে আমিনা বেগমের চোখে মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তি।

অথৈকে নীল রঙা শাড়ি পরিয়ে পাত্র পক্ষের সামনে বসানো হয়েছে। অথৈ এখন‌ই বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু মাকে যমের মতো ভয় পায় সে। সারাদিন বক বক করতে পারা অথৈয়ের মুখ খোলে না মায়ের সামনে। এখনো তাই মুখ বোজে অপরিচিত লোকজনদের সামনে বসে সে। বুক দুরু দুরু করছে। হাতপাও মৃদু কাঁপছে তার। চোখ তুলে সামনে বসে থাকা পাত্রকে দেখছে না অব্দি। পাত্র সরকারি কলেজের প্রফেসর। কথাটা শুনা মাত্র‌ই অথৈয়ের বুকে চাপা আর্তনাদ বয়ে গেলো। প্রফেসররা সাধারনত বুড়ো হয়ে থাকে। তবে কি তার বর‌ও বুড়ো! আবার ভাবে বিয়েটা নাও তো হতে পারে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে অথৈয়ের মা অনাহিতা নাহার বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দেন। ছেলে মেয়েকে আলাদা কথা বলার সুযোগটুকুও দিলেন না তিনি। অথৈয়ের কান্না পাচ্ছে। প্রথমবার দেখেই কেউ বিয়ে করে ফেলে না কি? মা কি তাকে একটুও বুঝবে না? অথৈয়ের হাতে আঙটি পরান ছেলের মা। সবাই খুশিতে ঝুমছে। শুধু চোখ ভিজে উঠছে পর্দার আড়ালে থাকা অথৈয়ের চাচাতো বোন মিশ্মির! যা কারো চোখেই পরে নি।

__________________

রাত এগারোটা বাজে। ঢাকায় নিজ বাসভবনে তাহির ঢুকেছে সবে। ক্লান্ত লাগছে তাকে। শার্টের বুকের উপরের দুটো বোতাম খোলে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেললো তাহির। সিড়ি ভেঙে শোবার ঘরে ঢুকলো এসে। দরজার পাশেই সুইচ বোর্ড। হাত বাড়িয়ে রুমের লাইট জ্বালালো তাহির। হাতের এপ্রোন চেয়ারের হাতলে রেখে আলমারি থেকে পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেশ হতে। কিছুক্ষনের মধ্যেই গোসল সেরে বেরুলো সে। ছাই রঙের ট্রাউজাড়, সাদা রঙের ঢোলা টি শার্ট গায়ে তার। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছচে সে। খেয়াল হলো ডিম লাইট জ্বলছে। অথচ ওয়াশরুমে ঢোকার আগে বড় বাতিটাই জ্বলছিলো। নিশ্চয় তার মা এসেছিলো ঘরে। মৃদু হেসে তোয়ালে র‌্যাকের উপর রেখে স্টাডি টেবিলে এসে বসলো তাহির। স্টাডি ল্যাম্প জালিয়ে খানিক বসে র‌ইলো। মাথার পেছনে হাত রেখে ঘাড় অব্দি টানলো। ব্যাগ খোলে কোনো এক পেশেন্টের ফাইল ঘাটলো সে। বাচ্চাটার মানসিক অবস্থা খুব একটা ভালো না। রোজ রোজ এক স্বপ্ন দেখে কেঁদে উঠে। কি স্বপ্ন দেখে তাও ঠিকঠাক বলতে পারে না। এখন তো ঘুমাতেও চায় না। তাহিরের কাজের মাঝেই দরজা ঠেলে ভেতরে আসেন মায়মুনা জামান। ঘরে ঢোকেই দুধ ভর্তি গ্লাস টেবিলের উপর রাখেন তিনি। তাহির চমকায় নি মোটে। এই সময় মা যদি তার হরলিক্সের গ্লাস দিয়ে যেতেন তবুও চমকাতো না সে। কিন্তু সমস্যা একটাই। তাহিরের দুধ খেতে ইচ্ছে করছে না। ক্লান্তি দূর করার মূখ্য ঔষধ চায়ের প্রয়োজন খুব। সেটা মাকে বলা দুষ্কর। মায়ের বাধ্যগত সন্তানরা মাকে কোনো কিছুতে মানা করতে পারে না। তাহির‌ও তাই। মা ভক্ত বা ‘মামা’স বয়’ হিসেবে ছোটবেলা থেকে এখনো পর্যন্ত বন্ধুদের কাছে পরিচিত সে। বাস্তবেও তাই। মায়ের হ্যাঁ তে হ্যাঁ না তে না। এখন কি করে বলে, ‘মা আমি দুধ খাবো না। চা খাবো। শুনেছি চা খেলে ক্লান্তি দূর হয়। এক কাপ চা হবে। পুরো এক কাপ না দিলেও চলবে আধা কাপ দিও!’ হাসপাতালে একবার খেয়েছিলো মিটিংএ। বেশ লেগেছিলো তার। আর খাওয়া হয় নি। অখাদ্য পানীয় চিনি ছাড়া ব্ল্যাক কফিই খায় সে রোজ। বাসায় ফিরে দুধ। সে বাচ্চা নয়। মা কি বুঝে না? সব মাই কি একরকম?

“এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? খেয়ে নে। ভালো লাগবে।”

মায়ের কথায় মাথা নাড়লো তাহির। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দু ঢোক গিললো। সাথে সাথে বেজে উঠলো মুঠোফোন। তাহির ফোন রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দিলো। মায়ের সামনে কখনোই ফোন কানে ঠেকায় না তাহির। তার ধারনা এতে বেয়াদবি করা হয়। তাই প্রতিবারের মতো এবার‌ও নম্র গলায় সালাম দিলো তাহির। ওপাশ থেকে রূঢ় গলায় মেয়েলি গলায় জবাব এলো,

“ক‌ই আপনি? কি চাইছেন টা কি? মেয়েটা মরে যাক? ‌আরে ভাই, বিয়েই যখন করবি না তবে প্রেম করেছিস কেনো? আগে পরিবার ছিলো না তোর? ‌এখন দুম করে উদয় হয়ে গেলো! লিসেন, আমারে তো চিনিস না তুই! একবার কাছে পাইলে শরীর থেকে ঘাড় আলাদা করে দিবো। ক‌ই আছিস সেটা বল।”

তাহির ভড়কে গেলো এতে। মায়মুনা জামানের ঘাম ছুটছে। কি বলছে এই মেয়ে? ছেলে তার প্রেম করছে? এমন শিক্ষা তো তাকে দেন নি মায়মুনা। তাহির কিছু বলবে তার আগেই মুঠোফোনের অপর প্রান্ত থেকে বিচ্ছিরি কিছু গালি শোনা গেলো। তাহির ফোনের স্পিকার অফ করে দৌড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। উদ্বিগ্ন কন্ঠে বললো,

“কে আপনি? এসব কি কথা বলছেন?”

“কি বলছি বুঝিস না তুই? সোহিনীরে ধোকা দেয়ার সাহস হ‌ইলো কেমনে তোর? শালা, মেয়েদেরকে হাতের পুতুল ভাবো? তোর ওই হাত‌ই ভেঙে দিবো। ক‌ই তুই? আইজ যদি সোহিনীর কিছু হয় তাইলে তুই শেষ। এই হিমি তোরে জ্যান্ত পুতে দিবে। বুজছিস? কাজ ফাজ ফেলে চটপট সরকারি হাসপাতালে আয়। দশমিনিট। দশমিনিটের মধ্যে এইখানে তোরে না পাইলে তোর অবস্থা কি করবো আমি নিজেও শিওরিটি দিতে পারছি না।”

কথাটা বলেই ফোন কাটলো হিমি। প্রেমিকের ধোকা সহ্য করতে না পেরে হাত কেটে বিদিগিস্তা অবস্থা করেছে সোহিনী। শহরে সে একাই থাকে। রুম মেইট মেয়েটা সোহিনীকে সুইসাইড এটেম্প্ট করতে দেখে আটকানোর চেষ্টা করেছিলো। সফল হয় নি তাতে। বাধ্য হয়ে হিমিদের ফোন লাগায় সে। প্রাণের বান্ধবীর এমন হাল মেনে নিতে পারছে না বন্ধুরা। রক্ত মাথায় উঠে যাচ্ছে তাদের। সোহিনীর ডায়েরি থেকে বয়ফ্রেন্ড নামক চিটারের নাম্বার বের করে কল লাগিয়েছে হিমি। এদিকে তাহির ভেবে পাচ্ছে না কে এই সোহিনী। তার জানা মতে আজ অব্দি সে কারোর প্রেমে পরে নি , প্রেম করা তো দূরের কথা। কিন্তু মেয়েটার কথা শুনে মনে হলো ভয়ানক কিছুই হয়েছে। একবার যাওয়া উচিত। এট লিস্ট আসল ঘটনা তো জানবে। যেই ভাবা সেই কাজ। ফোন পকেটে পুরে ঘরের পোশাক নিয়েই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো তাহির। দরজায় ঠেস দিয়ে মায়মুনা জামান ছেলেকে দেখছেন। মাকে না বলে কখনোই কোথাও যায় না তাহির। অথচ আজ এই মাঝরাতে এক মেয়ের ফোন পেয়ে কিছু না বলেই ছুটে বেরিয়ে গেলো। ছেলে কি তবে সত্যি প্রেমে টেমে জড়িয়েছে! মায়মুনা জামান অজু করে জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পরেন। সেজদায় গিয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকেন তিনি। ছেলেকে যেনো ফিরিয়ে আনতে পারেন সেই দোয়া। প্রেমের মতো পাপ থেকে ছেলে যেনো বেঁচে ফিরতে পারে সেই দোয়া।

চলবে,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে