স্বপ্নীল
১৫
-“ভ্যাঁ ভ্যাঁ না করে কান্না থামা।একটু দেখতে দে পা টা আমায়” তৃণ বিরক্তি হয়ে বলে।
-” আমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করি, তুই কি করে বুঝবি আমি কেন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করছি।ব্যাথা তো আমি পাইছি।”
এটা বলে আবার ন্যাকা কান্না করতে থাকে। প্রাচ্য’র উপর খুব রাগ লাগছে তৃণ। কিন্তু তা প্রকাশ না করেই তার পা টা টেনে এনে ডান হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ধরে।এবার প্রাচ্য’র দিকে তাকিয়ে জোরে মোচড় দেয়।প্রাচ্য ব্যাথায় আহ্ করে উঠে,
-“মাগো আমার পা টা এই শয়তানটা ভেঙে দিল।আমি আর হাটতে পারবো না।সবাই আমাকে পঙ্গু প্রাচ্য বলবে।”
প্রাচ্য কে এরকম করতে দেখে তৃণ’র ইচ্ছা করছে মাথায় একটা ঠাটিয়ে মারতে।প্রাচ্য পা টেনে নিয়ে আসতে ব্যাথা অনুভব না করাই অবাক হয়।নিজের পায়ে ব্যথার জায়গা হাত দিয়ে দেখে ব্যথা নেই।একবার তৃণ’র দিকে তাকায় একবার পায়ের দিকে।একটু আগে ব্যাথার জন্য পা নাড়াচাড়া করতে পাড়েনি আর এক্ষন সম্পূর্ণ সুস্থ।বিষ্মিত হয়ে তাকায় সে তৃণ দিকে।স্মিত হেসে তৃণ বলল,
-“আমার কাছে জাদু আছে মেডাম।ম্যাজিক করে সারিয়ে দিয়েছি ব্যাথা।”
প্রাচ্য ভেঙচি কাটে।তৃণ বলল,
-“আর কোথায় কোথায় ছিঁলে গেছে দেখা তো।অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিলে ভালো হয়ে যাবে।”
ওয়েন্টমেন্ট কেড়ে নিয়ে বলে,
-“অনেক সেবা করেছেন।দয়া করে আর লাগবে না।এখন যেয়ে আপনার টিনা মিনার সেবা করুন।”
-“সব কথা মাঝে ওদের কে টানছিস কেন?
-“ওদের টানবো। একশোবার টানব।তোর কি?”
-“আমার কিছু না।তোর যত ইচ্ছা হবে তত টানবি।এবার শান্ত হয়ে বস।আর ছিঁলে গেছে কোথায় সেটা বল।”
কোমর থেকে টপস একটু উঠিয়ে বলল,
-“এখানে।”
ছিঁলে যাওয়া জায়গা লাল হয়ে গেছে। হাতের মধ্যে ওয়েমেন্ট নিয়ে ছিঁলে যাওয়া জায়গা লাগাতেই জ্বলে উঠে। প্রাচ্য সাথে সাথে চোখে বন্ধ করে ফেলে তৃণ’র অন্য একহাত খামচি দিয়ে ধরে।আলতো হাতে ছিঁলে যাওয়া জায়গা ওষুধ লাগিয়ে দেয়।
-“আর কোথায় আছে?
প্রাচ্য মাথা ঝাঁকায়।তৃণ বলল,
-“কোথায়?
-“পিঠে,কাঁধে আছে।”
তৃণ চোখ যায় টপসের চেইনের দিকে।সেখানে হাত দিলে প্রাচ্য বলে উঠে,
-“কি করছিস? ”
-“কি করছিস দেখতে পাবি।চুপ থাক! কোনো কথা বলবি না।কাজ করতে দে,
চেইন খুলে ফেলে সাদা ধবধবে পিঠটা ফেসে উঠে।পিঠে মাঝখানের মেরুদণ্ড পাশেই একটা লাল তিলে উপরে চোখ আটকে যায় তার।হাত দিয়ে ছুয়ে দেখে।তারপর যেন মনে হচ্ছে হাত দিলে ছুঁয়ে তার মন ভরবে না ঠোঁট দিয়ে ছুলে মন ভরবে। কিন্ত প্রাচ্যর পিঠে ঠোঁটে ছুয়ালে তাকে ফাসি দিবে।আগের বার সব বন্ধুদের বলে দিয়ে তার প্রেস্টিজ পাংচার করে দিয়েছে। নিজেকে সংযত করেই ওষুধ লাগাতে থাকে। ওষুধ লাগানো শেষ হলেই প্রাচ্য দিকে তাকায় সে দেখে চোখবন্ধ করে রেখেছে।এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে লাল তিলটাই ঠোঁট ছোঁয়ায়।পিঠে শীতল অনুভব করে প্রাচ্য তাই চোখ খুলে বলে,
-“কি করেছিস এখন! ”
-“কি আর করব ওষুধ লাগিয়েছি।
খাটের উপর থেকে উঠে।টপসের চেইন লাগাতে লাগাতে বলল,
-“আমার মনে হয়েছে তুই আমার পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ালি। ”
এই রে বুঝে গেলো,এখন কি করব। যাই বলি না কেন, সত্যি শিকার করা যাবে না।
-” ইদানীং তোর যা তা মনে হচ্ছে।আমি ঠোঁট ছোঁয়াতে যাবো কেন।ওইদিন আমার শিক্ষা হয়েছে।”
-“হলেই তো ভালো। এখন যা।”
সবাই রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।ছেলেরা তিনজন একসাথে,মেয়েরা তিনজন একসাথে ঘুমিয়েছ। নীলের কিছুতে ঘুম আসছে না। বিছানার এপাশ অপাশ করতে থাকে।ঘুম আসছে না দেখে উঠে বসে।নীলকে উঠতে দেখে রোদ উঠে বলে,
-“ঘুম আসছে না।”
অনেক চুপ থেকে তার পর উত্তর দেয়,
-“না।”
-“বাড়ি জন্য কি মন খারাপ।”
মন খারাপ।সে তো ওই সুরওয়ালা জন্য।দুইরাত সাজেকে ছিলাম। দুটো রাত ঘুমেতে গেলেই সেই সুর বেজে উঠত।সেই সুরের টানে ছুটে যেত।কিন্তু আজকে সেই সুর শুনছি না। হারিয়ে গেলো সেই সুরওয়ালা। খুঁজে কি পাবে তাকে । নিজের মনকে সে আবার বুঝ দিয়ে বলে, পাবে সে। তার মন বলছে খুজে পাবে।
-“কিছু কি ভাবছ নীল।”
রোদের কথা নীল তার দিকে তাকায়। মুচকি হেসে বলল,
-“না। মন খারাপ নয়।ঘুম আসছে না আজকে।
-“মেবি তিনজন এক বেড শেয়ার করছি। তাই বোধ হয়।”
নীলের খুব মন খারাপ। কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।রোদের কথায় সুর মিলিয়ে বলল,
-“মনে হয়।”
-“আজকে রাতে কষ্ট করে শেয়ার কর।কালকে রাতে আমরা ঢাকা পৌঁছে যাবো।ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট। ”
-“গুড নাইট। ”
বলে সে ব্যাঙ্কেট টেনে শুয়ে পড়ে।
★★★
সবাই বের হয় তৈদু ছড়া ঝর্ণা দেখার উদ্দেশ্য। প্রাচ্য আর তৃণ বাদে সবাই যায়।কালকে রাতে হালকা একটু জ্বর এসেছিল তার গায়ে। সেটা শুনে তৃণ তাকে যেতে দেয় নি।তাই মুখ ভার করে খাটের উপরে দুইহাটু জড়ো করে বসে আছে।তৃণ তার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে খাওয়ার জন্য। সে কিছুতে খাবে না বলে দিয়েছে। তৃণ তার দিকে দুই মিনিট তাকিয়ে তার পাশে এসে বোঝানোর জন্য বসে।
-“প্লিজ প্রাচ্য নাস্তা করে নেয়। নাস্তা না খেলে সকালের ওষুধ খেতে পারবি না। ওষুধ না খেলে তো জ্বর কমবে না।রাতে অনেক জার্নি করতে হবে।এই শরীর
রে জার্নি করতে কস্ট হবে তোর।”
এখন ও কিছু না বলে আগের অবস্থা আছে।তৃণ এবার প্রাচ্য হাত নিজের হাতের মুঠো নিয়ে বললো,
-“আমি তোর ভালো জন্য বলছি।
নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে প্রাচ্য বললো,
-“আমার তেমন কোনো বেশি জ্বর হয়নি। যার জন্য ওষুধ গিলতে হবে।তোর জন্য ঝর্ণা দেখাটা আমার মিস হয়ে গেছে।”
-“পরে বার আমি তোকে তৈদুছড়া ঝর্ণা দেখার জন্য নিজ দায়িত্ব নিয়ে আসব।
-“যার ঢাকা গেলে ফ্রেন্ডের খোঁজ নেওয়ার সময় থাকে না। সে আবার নিজ দায়িত্ব আমায় নিয়ে আসবে। ভাবা যায় এ গুলা।”
এটা বলে ঠাস করে বাথরুমের দরজা আটকায়। তৃণ বুঝতে পারে এত জোরে দরজা লাগানোর কারণ কি?তার রাগ সব বেচারা দরজা উপরে গিয়ে ঝাড়ছে।
খাগড়াছড়ি জেলারর দিঘিনাল উপজেলায়য় সবুজ পাহাড় আর বুনো জঙ্গলের মাঝে অবস্থিত নয়নাভিরাম ঝর্ণার দুটির নাম তৈদুছড়াঝর্ণা। ত্রিপুরা ভাষায় তৈদু মানে পানি দরজা আর ছড়া মানে ঝর্ণা। অসাধারণ সৌন্দর্য আর প্রাকৃতিক বৈচিত্রতা এই ঝর্ণা দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা।খাগড়াছড়িতে যে কয়টা দার্শনিক স্থান রয়েছে তৈদুছড়া তাদের মধ্যে অন্যতম। জঙ্গলের মধ্যে আকাঁবাঁকা পাহাড়ের ভাঁজ দিয়ে বয়ে চলে তৈদুছড়া ঝর্ণার জল।শীতল স্বচ্ছ টলমলে জলের কলকল করে ছুটে চলার শব্দে মুখরিত হয় চারপাশ।৩০০ফুট উঁচু পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়া পানি এসে পড়ে পাথুরে ভূমিতে।অন্য সকল ঝর্ণার মত এর পানি সরাসরি উপর হতে নিচে পড়ে না।পাহাড়ের গাঁয়ের সিঁড়ির মত তৈরী হওয়া পাথুরে ধাপ গুলো অতিক্রম করে নিচে পড়ে তৈদুছড়া ঝর্ণার পানি।
তৈদুছড়া ঝর্ণার ডান পাশ দিয়ে পাহাড়ের উপরব রয়েছে আরেকটি ঝর্ণা যার নাম থাংঝাং ঝর্ণা। এখানে প্রায় ৮০-৮৫ ডিগ্রি এঙ্গেলের ঢাল বেয়ে ১০০ফুট উপরে উঠতে হবে। উপরে উঠলে প্রথমে চোখে পড়বে ঝর্ণার মুখ যেখান থেকে তৈদুছড়া ঝর্নার পানি পড়ছে। থাংঝাং ঝর্ণা হতে ঝিরি পথে পানি আসছে এখানে। ঝিরিপথ ধরে আঁধাঘন্টা হাঁটলে পরে পৌঁছানো যায় থাংঝাং ঝর্ণাটিতে। এই চলার পথটি যেমন কষ্টকর তেমনই রোমাঞ্চকর ও সুন্দর হয় প্রিয়মানুষ সাথে থাকলে।উপর থেকে প্রচন্ড বেগে পানি নামছে এখানে।এই পানি বেগ ঠেলে বরাবরই হাঁটতে হয় সবাইকে। ডানে বায়ে যেখানে পানি স্রোত কম হয় সেখানে শ্যাওলা জমেছে। একটুতেই পা পিছলে যায় স্বপ্ন’র।
স্বপ্ন ধূসরকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“ধূসর, রোদের হাত আঁকড়ে ধরে হাট না হলে পড়ে যাবে সে।আমি নীলকে সামলাছি।”
-” আমি নিজেই যেন পড়ে যাবো বোধ হয়।রোদ কি আর সামলাবো।”
-“চেষ্টা কর হাঁটার জন্য।”
স্বপ্ন নীলের হাত নিজের হাতের মুঠোবন্দী করে পা টিপে টিপে হাঁটছে অনেক সাবধানে। মাঝে মাঝে এখানে পানির স্রোত খুব বেশি যে ধাক্কা দিয়ে নিচে নিয়ে যেতে চায়। একবার পিছলে গেলে কয়েকশ হাত দূরে নিক্ষিপ্ত হতে হবে। নীল পড়ে যেতে নিলে স্বপ্ন তাকে সামলাতে যেয়ে দুজন মিলে পড়ে যায় অনেক দূরে পানির স্রোতে।তাদেরকে পড়ে যেতে দেখে ধূসর রোদ কে ছেড়ে স্বপ্ন স্বপ্ন বলে চিৎকার করে আর রোদ পানির স্রোতের ধাক্কা সামলাতে না পেরে পা পিছলে পড়ে যায়। ধূসর দেখে রোদ পড়ে যেতেছে তাকে আকঁড়ে ধরতে যেয়ে সে পড়ে যায়। স্বপ্ন একহাত দিয়ে নিজের বুকে আঁগলে ধরেছে নীলকে যাতে পাথরে সাথে আঘাত না খায়।অন্যহাত দিয়ে পাথর আকঁড়ে ধরার চেষ্টা করছে।কিন্তু কিছুতে পাড়ছে না।তাই দুজন মিলে স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। দুজন ঘোরাতে ঘোরাতে পাথর সাথে ধাক্কা লেগে আটকে যায়। দুহাত ঝাপটে ধরে আছে নীলকে।নীল ভয়ে স্বপ্ন’র শার্ট আকঁড়ে ধরে আছে।তারপর ঘোরাতে ঘোরাতে রোদ আর ধূসর পৌঁছায়।রোদের হাত পা ছিঁলে যায় পাথরে ঘোঁষায়। ধূসর উঠে বসে।বিরক্তি সুরে বললো,
-“মন চাচ্ছে মাথা কয়েক গা মারতে।”
রোদ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে,
-“আমি কি করেছি।”
-“কি করেছিস নি তুই। তুই পড়েলি কি ভাবে।তুই না পড়লে আমি ও পড়তাম না।
-“আমি কি ইচ্ছা করে পড়েছি।এত স্রোতে যে কেউ পড়ে যাবে।”
স্বপ্ন বললো,
-“থাম তোরা!এখন চল।
রোদ উপর দিকে তাকায়। আগের জায়গা থেকে তার অনেক দূরে আছে। এখন আবার এত পথ হাঁটতে হবে। কেন যে পড়ে যেত গেলো।
-“এত পথ এখন আবার হাঁটতে হবে।”
ধূসর উঠে দাঁড়ায়। সে বললো,
-“পড়ার সময় মনে ছিলো না।”
স্বপ্ন পিছন নীলের দিকে তাকায়।তার শরীর কোনো ক্লান্ত নেই। সে চার পাশ মুগ্ধ হয়ে দেখছে।স্বপর চোখ যায় নীলের কনুই দিকে। পাথরে ঘোঁষা খেয়ে চাড়মা ছিঁলে গেছে।সে নীলের পাশে এসে দাঁড়ায়। বললো,
-“তোমার হাত ছিঁলে গেছে তো দেখি।
-” হুম, একটু!”
– রিসোর্ট গিয়ে ওষুধ লাগিয়ে নিও।”
-“হুম।”
এখান থেকে আরো উপরে উঠতে হবে। চলার পথে পাড়ি দিতে হবে বড় বড় পাথর আর কোমর সমান পানি। অতপর পেয়ে যায় তারা দ্বিতীয় তৈদুছড়াঝর্ণা।অপূর্ব অসাধারণ আর ননয়নাভিরাম সে ঝর্ণা। এটা এতই দৃষ্টিনন্দন আর ব্যতিক্রম কারো আর তড় সইবে না।ঝর্ণার নিচে সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঝর্ণাটি প্রায় ৮০ ফুট উঁচু। ঝর্ণার পানি এসে সরাসরি যেখানে পড়ছে। সেখানে সিঁড়ির মত অনেক গুলো পাথুরের ধাপ রয়েছে।ধাপগুলো বেয়ে পানি নিচে গড়িয়ে পড়ছে। ধাপগুলোতে দাঁড়িয়ে অনায়েসেই গোসলের কাজটি সেরে নেয় তারা। দীর্ঘ ক্লান্তকর হাটার কষ্ট মুহুর্তেই ধুয়ে যাবে ঝর্ণার জলে।ঝর্ণার জলের শীতল পরশ সবাইকে ক্ষণিকের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেবে।
চলবে
#কাউছার স্বর্ণা
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)