স্নিগ্ধ প্রেমের মায়ায় পর্ব-১২

0
1222

#স্নিগ্ধ প্রেমের মায়ায়
#পর্ব ১২
#লেখিকা সাদিয়া জান্নাত সর্মি

স্নিগ্ধা কোথায় তুই, তাড়াতাড়ি বাইরে আয় এই কি সর্বনাশ হলো রে তোর?
বাইরে থেকে ফুপির এমন চিৎকার চেঁচামেচি শুনে আমি তড়িঘরি করে ডায়েরি টা বন্ধ করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে নিচে এলাম। বাসায় কেউ নেই, বাসার বাইরে থেকে ফুপি এইভাবে চেঁচামেচি করছে আর আমাকে ডাকছে, কয়েকজনের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে একটু অবাক হয়ে বাইরে গেলাম। বাসার বাইরে গিয়ে আমার সামনের দিকে তাকিয়ে পাথর হয়ে গেলাম আমি,আর একটুও নড়াচড়া করার শক্তি নেই আমার মধ্যে। নিজের চোখ কেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে আমার, চোখের কোণা বেয়ে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো আমার। সামনে একটা লাশের খাটিয়া রাখা হয়েছে, লাশের মুখ টা খোলা।খাটিয়ার পাশে বসে হাহুতাস করে কাঁদছে মামা মামি সাথে আরো অনেকেই, আমি কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেলাম খাটিয়ার দিকে, এগিয়ে গিয়ে খাটিয়ার পাশে বসে পড়লাম।খাটিয়া তে যে শুয়ে আছে আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে আশেপাশের সবাই কে জিজ্ঞেস করলাম,,, এটা কি ধরনের নাটক হচ্ছে এখানে?হৃদান ভাই কে এইভাবে লাশ সাজিয়ে রাখার কি মানে হ্যা? একটু ঝাকুনি দিয়ে হৃদান ভাই কে বললাম,,,
নাটক বন্ধ করে এইবার উঠো তুমি,দেখো এইভাবে নাটক করা কিন্তু মোটেও উচিত নয়।
মামি আমার পাশে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন,,,আর উঠবে না রে আমার ছেলে টা, ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। বলেই মামি হু হু করে কাঁদতে শুরু করলেন, আমি মামির দিকে তাকিয়ে বললাম,, ছেড়ে চলে গেছে মানে কি?

কাজ শেষ করে আসার পথে হৃদানের এক্সিডেন্ট হয়েছিল তখনই ও,,,আর কোনো কথা কর্নগোচর হলো না আমার। ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ হয়ে এলো, সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে চোখের সামনে, শুধু একটা কথাই কানে এলো হৃদান ভাইয়ের এক্সিডেন্ট হয়েছিল।

যখন জ্ঞান ফিরে এলো আমার তখন মধ্য রাত।ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি মামনি মামি ফুপি সবাই আমার পাশে বসে আছে। আমার জ্ঞান ফিরতে দেখে মামনি আমাকে ধরে উঠে বসালো, আমি বসে মামনি কে বললাম,,, মামনি হৃদান ভাই কোথায়?ওই সময় মামী মিথ্যা কথা বলেছে তাই না,হৃদান ভাইয়ের কিছু হয় নি আমি জানি।
মামনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, তুমি ভুল জানো স্নিগ্ধা,হৃদান আর নেই।

আমি জিজ্ঞাসু সুচক দৃষ্টি তে মামনির দিকে তাকালাম,আমার চাহনি দেখে মামনি আস্তে আস্তে বললো,,,আজ হৃদানের বাসায় ফেরার কথা ছিল,ও আমাদের কে ফোন করে বলেছিল যেন ওর বাসায় আসার কথা আমরা তোমাকে না বলি তাই তুমি জানতে না। বাসায় ফেরার পথে হৃদানের গাড়ির সাথে একটা ট্রাকের মুখোমুখি এক্সিডেন্ট হয় আর হৃদান ওখানেই, এইটুকু বলে মামনি আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে শুরু করল। একটু পরে কান্না থামিয়ে বললো,, পুলিশ পরে গাড়ির মধ্যে হৃদানের আইডেন্টিটি চেক করে দেখে বাসায় লাশ নিয়ে আসে, প্রথমে পুলিশের কথা শুনে আমরা কেউই বিশ্বাস করিনি কিন্তু পরে হৃদানের লাশ দেখে এই নির্মম সত্যি টা মেনে নিতে হয়েছে। তুমি অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পরেই হৃদান কে দাফন করা হয়েছে, তোমার জ্ঞান ফিরে আসা অব্দি অপেক্ষা করেছিল সবাই কিন্তু তোমার জ্ঞান ফিরেনি দেখে দাফন করে ফেলেছে।

আমি মামনির কথা শুনে কিছুক্ষণ মুর্তির মতো বসে রইলাম তারপর কঠিন স্বরে বললাম,, আমার রুম থেকে এখন সবাই চলে যাও, আমার এখন কিছু ভালো লাগছে না একা থাকতে দাও আমাকে।
মামনি আমার কথায় সঙ্গে সঙ্গে উঠে চলে গেল সাথে ফুপি আর মামীও চলে গেল। ওরা চলে যাওয়ার পর আমি উঠে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ডায়েরি টা টেবিল থেকে নিয়ে এসে জানালার পাশে বসলাম।যেই পৃষ্ঠায় আমি কয়েক ঘণ্টা আগেই হৃদান ভাই কে নিয়ে লিখেছিলাম সেই পৃষ্ঠা বের করে তাতে হাত বুলাতে লাগলাম।কি আশ্চর্য আমার এখন একটুও কান্না পাচ্ছে না, বরং খুব অভিমান হচ্ছে হৃদান ভাইয়ের উপর।প্রথম ভালোবাসায় ধোঁকা খেয়ে তোমাকে মন প্রাণ দিয়ে ভালো বাসতে শুরু করেছিলাম এমন কি ভালোও বেসে ফেলেছিলাম আমি তোমাকে।যাকে নিয়ে ভাবা অনুভূতি গুলো মিথ্যে হয়েছিল তাকে ছেড়ে আমি তোমাকে নিয়ে ভাবা অনুভূতি গুলো সত্যি ভেবেছিলাম। মনের মধ্যে তোমাকে একটা জায়গা দিয়েছিলাম আমি, আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটার জায়গা আমি তোমাকে দিয়েছিলাম। এই পৃষ্ঠায় তোমাকে নিয়ে আমি আমার মনের অনুভূতি গুলো লিখতে শুরু করেছিলাম, ভেবেছিলাম একদিন তুমি আমার লিখা গুলো ঠিক দেখবে, বুঝতে পারবে আমিও তোমাকে ভালোবাসি। কিন্তু তুমি কি করলে? তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে অনত্র, আমার অনুভূতি গুলো প্রকাশ করার সুযোগ টুকু দিলে না আমাকে, তোমার স্নিগ্ধ প্রেমের মায়ায় জড়িয়ে যেতে দিলে না, তুমি বলেছিলে না তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো? তাহলে এই তোমার ভালোবাসা, বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে এখন একা করে ছেড়ে চলে যাওয়া টা কি তোমার ভালোবাসা? এখন আমাকে কে বলবে স্নিগ্ধ আমি তোকে খুব ভালোবাসি,কে আমার কথায় অভিমান করবে? স্নিগ্ধ বলে কে ডাকবে আমাকে? তুমি এই কাজ টা মোটেও ঠিক করো নি, আমাকে একা করে দিয়ে এতো তাড়াতাড়ি তোমার চলে যাওয়া উচিত হয় নি, তোমার উপর আমি রাগ করেছি খুব বেশি রাগ করেছি আমি।
এইসব ভাবতে ভাবতে হু হু করে কেঁদে উঠলাম আমি, আস্তে আস্তে সব কান্না একসাথে বের হয়ে আসছে আমার। বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করতে পারছি,হৃদান ভাই কে হাড়ানোর ব্যাথা। চোখের পানি তে ডায়েরীর পাতা গুলো ভিজে ভিজে লেখা গুলো ঝাপসা হয়ে গেল। আবছা বুঝা যাচ্ছে লেখা গুলো,কত স্বপ্ন দেখেছিলাম হৃদান ভাই কে নিয়ে, ভেবেছিলাম হৃদান ভাই আমাকে ছেড়ে কখনো চলে যাবে না, আয়াশের মতো হৃদান ভাই আমাকে কাদাবে না।কয় দিন হলো আর আমাকে বলার যে হৃদান ভাই আমাকে ভালোবাসে,এক মাস ও হয় নি হৃদান ভাই আমার জীবনে সুখ পাখি হয়ে এসেছিল,সুখ পাখি আর বেশি দিন রইল না সে তার আপন মায়ায় আমাকে ছেড়ে চলে গেলো আর দিয়ে গেল এক রাশ কষ্ট। আমি যে হৃদান ভাই কে ভালোবাসি সেই কথা টা আর বলা হলো না তাকে,আজ ভাবছিলাম হৃদান ভাই ফিরলে সবার আগে তাকে ভালোবাসি এই কথা টা বলবো, বলে দেবো তাকে আমার সমস্ত অনুভূতির কথা গুলো।তার প্রেমের মায়ায় আমি আস্তে আস্তে জড়িয়ে যাচ্ছি এই কথা বলবো তাকে কিন্তু তা বলার আগেই ও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। চোখের পানি তে ডায়েরীর পাতাটা এখন সম্পূর্ণ ভিজে গেছে,লেখা গুলো আর আলাদা করে বুঝা যাচ্ছে না।হৃদান ভাই চলে গেছে বলেই হয়তো লেখা গুলো ও আর আমার গোপন অনুভূতি হয়ে থাকতে চাইলো না। আমি চোখ মুছে ডায়েরী টা বন্ধ করে বাইরে আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললাম,, তোমার মতো আজ আমিও একা হয়ে গেলাম। দুই বার ভালোবেসে হাড়িয়েছি আর পারছি না কষ্ট সহ্য করতে। একজন বেঁচে থেকেও মরে গেছে আমার কাছে,আর যে আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছিল সে বাস্তবিকেই মরে গেছে। আমার কপালে ভালোবাসা সইলো না, এখন আমি কি করে থাকবো আমার হৃদান ভাই কে ছাড়া? সেই যে আমার জীবনের সবকিছু হয়ে উঠেছে, সমস্ত ধ্যান ধারণা যে তাকে নিয়েই আমার। আচ্ছা চাঁদ তুমি বলো তো,হৃদান ভাই তো আমাকে ভালবাসে তাহলে সে আমাকে ছেড়ে একা একা থাকবে কি করে?তার তো আমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে,ও না পুরো একটা বোকা ছেলে,কষ্টই যখন পাবে তাহলে আমাকে একা করে চলে গেলো কেন?

চলবে……. ইনশাআল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে