সুখ সন্ধানী পর্ব-১৫

0
479

#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-১৫
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
★★★

রাতের হিমেল বাতাসে শরীর ঠান্ডা হয় কিন্তু মন তো ঠান্ডা হয় না।সেই দুপুর থেকে রাফির মনে চিন্তার কাটা গেথে গেছে।অসহ্য যন্ত্রনায় ছটফট করে বারবার নোহার মলিন মুখের দিকে তাকিয়েছে।কিন্তু নোহা ভুলক্রমেও রাফির দিকে তাকায়নি।রাফি বুঝতে পারছেনা হাসিখুশি উচ্ছল মেয়েটার হঠাৎ কি হলো যে চোখ মুখ এমন ফুলে চেহারা ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।ফিরে আসার পথে নোহা বিনাবাক্যে রাফির গাড়িতে উঠেছে,সিটে শরীর এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে।চোখ বন্ধ করে রাখলেও সবার অগোচরে চোখ দিয়ে বেয়ে পড়া পানি হাত দিয়ে টোপ করে মুছে নিচ্ছে।আর কেউ না দেখলেও লুকিং গ্লাসে রাফি ঠিকই দেখে নিয়েছে।নোহা চোখের পানি তার বুকে গরম শিশার মতো পড়ছে।অদৃশ্য হাত বুকের ভেতরে কলিজা খামচে ধরেছে।রাফি নিচের ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শান্ত করল।বাসার সামনে আসার পরে সবাই নামার পরেও নোহা যখন নামল না তখন রাফি তাকিয়ে দেখল আগের ভঙ্গিতেই শুয়ে আছে।চোখ দিয়ে একতালে পানি পড়ছে,আর কান্না আটকানোর বৃথা চেষ্টা করায় ঠোঁট ফুলে উঠছে বারংবার।রাফি ব্যার্থ চোখে তার অব্যাক্ত সুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।খানিকক্ষণ পরে নরম স্বরে বলে,
—“চলে এসেছি!”

নোহা যেন রাফির ডাকের অপেক্ষা করছিল।চোখ খুলে রাফির দিকে তাকাল,নোহার কান্নারত চোখ দেখে রাফির মনটা কেঁপে ওঠে।বৃদ্ধাজ্ঞুলি দিয়ে ভ্রু চেপে ধরে।
নোহা অপলক চেয়ে থেকে বলে,
—“হুম চলে যাচ্ছি সারা’জীবনের জন্য।”
এটা বলে হনহনিয়ে বের হয়ে যায়।রাফি অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে সারাজীবনের জন্য!এর মানে কি?

★★★
নিশির মনে আজকাল বসন্তের বাতাস লাগে বেশি।অন্য যেকোনো মাসকেই বসন্ত মনে হয়।আজকে সারাটাদিন শিহাব চোখের সামনে ছিল।শিহাবকে দেখলেও মনে শান্তি লাগে।যাকে দেখলে আগে ভয়ে,রাগে দশ হাত দূরে থাকত আজকাল তার সানিধ্য পাওয়ার জন্যই মনটা বড় উতলা হয়ে থাকে।এতশত ভাবনার অবশান ঘটিয়ে মেসেঞ্জারের টোংটাং শব্দে ঘোর কাটল।মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল,কাংখিত পুরুষের ম্যাসেজ।মোবাইল রেখে হাসিমুখে রুম থেকে বেরিয়ে চোরের মত গন্তব্যে ছুটে গেল।
শিহাবের মনে হচ্ছে আর এভাবে থাকা সম্ভব না।চোখের সামনে প্রিয় নারী এভাবে ঘুরে বেরালে পুরুষালি মন আটকানো বড় দায়!তার মা নুরজাহান বোধহয় শিহাবের মনের খবর কিছুটা পেয়েছেন।তাইতো নিশির কথা আসলেই শিহাবের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসে।শিহাব পাত্তা দেয় না নিজের মতো থাকে।এখন ভাবছে উনাকেই বলবে সে নিশিকে বিয়ে করতে চায় আর খুব তাড়াতাড়ি।যদিও নিশির বয়স কম তারপরেও শিহাব আর অপেক্ষা করতে রাজি না।শিহাবের অপেক্ষার অবশান ঘটিয়ে অবশেষে তিনি ছাদে আসলেন।গুটিগুটি পায়ে নিশি এগিয়ে শিহাবের কাছে গেল,এই লোকটা কাছে এলে শরীর কেমন জমে যায় কিন্তু মনটা নেচে উঠে।ওরনার এককোণা কনিষ্ঠ আঙুলে পেঁচিয়ে আবার খুলে আবার পেঁচাচ্ছে।শিহাব দু’হাত ট্রাউজারের পকেটে রেখে ঘাড় কিছুটা কাত করে নিশির দিকে তাকাল।
—“ভূতের বাড়িতে কি বলেছিলাম?উত্তর কই?”

নিশি চোখ তুলে তাকাল।লাজুক হেসে বলল,
—“ভূতের বাড়িতে ভূতের কথা ছাড়া আর কারো কথা শুনা বারণ।কে কি বলেছে আমি সব ভূলে গেছি।”

শিহাব হাসল নিশি যে তার থেকে আবারও কায়দা করে প্রেমের প্রস্তাব শুনতে চাচ্ছে এটা বুঝে এগিয়ে গেল।
শিরশিরানি স্পর্শে শিহাব নিশির হাত ধরল পুরুষালী গমগমে গলায় ধীরসুরে বলল,
—“তোকে খুব জ্বালাব পাখি!এত অত্যাচার করব যে নিশ্বাস ফেলার সময় পাবি না।বেলীফুলের রাজ্যে তোকে রানীর আসনে বসাব।আচ্ছা এত কথা বাদ!আমার বেলীফুলের সুভাস গায়ে মাখতে আপত্তি নেই তো?”

নিশির চোখ লজ্জায় বন্ধ হয়ে যায়।এমন’ও প্রেমের প্রস্তাব হয়!নিশির লজ্জাবনত মুখশ্রী দেখে শিহাবের পুরু ঠোঁটে মুচকি হাসির আভা ছেঁয়ে যায়।নত করা মুখ দুহাতের তালুতে নিয়ে তার দিলে মুখ ফিরায়।নিশি তখনো চোখ বন্ধ করে রেখেছে।নিশিকে আরেকটু লজ্জা দিতে শিহাব মাথা নামিয়ে চোখের পাতায় ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দেয়।নিশির শরীর কেঁপে ওঠে,লাজুক মন নেতিয়ে যায়,হাত দিয়ে শিহাবের টিশার্ট আঁকড়ে ধরে।তবুও চোখ খুলে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না।শিহাব নিশির লজ্জা বুঝতে পেরে তাকে ছেড়ে দূরে দাঁড়ায়।নিশি চোখ খুলে শিহাবকে দূরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
শিহাব গভীর চোখে নিশিকে দেখল,ঘন হয়ে আসা গলায় বলল,
—“আমি কি না ধরে নেব?”

নিশি আৎকে উঠে তাকায়।জ্বিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়।
শিহাব নাছোড়বান্দার মতো বলে —“আজকে মুখে বলতে হবে।”

এই লোকটা জন্ম থেকেই ঘাড়তেড়া,নিশি জানে কথা বলিয়েই ছাড়বে,ফিসফিস করে বলল,
—“আমার খুব ভয় লাগে শিহাব ভাই।”

শিহাব নিশির একটা হাত নিজের হাতে নিল,ভরসায় আসস্থ করে বলল,
—“আমি থাকতে ভয় কিসের পাখি!”

নিশি শিহাবের গভীর চোখে তাকাল।আগেও অনেকবার শিহাব নিশি দিকে এমন ঘন দৃষ্টি নিক্ষেপ করতো তখন এই চোখের ভাষা না বুঝলেও এখন ঠিকি বুঝে আর তাই তো লজ্জায় কান দিয়ে গরম বাতাস ছুঁটেছে।
শিহাবের মনে কাছে পাওয়ার ইচ্ছা ক্রমশ বেড়েই যাচ্ছে আর তাই নিশিকে ঝটপট বলল,
—“পাখি!তুই সুভাস গায়ে মাখতে পারবি না?”
নিশি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে দৌড়ে বাসায় চলে আসে।আজকে থেকে সে শিহাবের বেলী সম্রাজ্যের রানী।সেই বেলীর দেশে চলবে শুধু নিশির আধিপত্য।লাজুক হেসে কাথা দিয়ে মুখ ঢাকে।

★★★
পিকনিক থেকে আসার পঞ্চম দিন আজ।এই পাঁচদিন নোহা ভূল করেও রাফির সামনে যায়নি,কেন যাবে!রাফি যে নোহাকে গোপনে ভালোবাসে সেদিনের সেই ছবিগুলো না দেখলে তো বুঝতেই পারতো না।নোহার নিজের উপর নিজের খুব রাগ হলো,এতদিন এই কথাটাই জানতে পারেনি,এই জন্যই বোধহয় রাফি কখনোই নোহার কোন কাজে তার বাবাকে বলতো না।নোহা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখন থেকে সে রাফির থেকে দূরে থাকবে।রাফির কথায় বোঝা গিয়েছে সে রাসেলের ব্যাপারে জেলাস।তাই নোহা ঠিক করল,এখন থেকে রাফিকে দেখিয়ে দেখিয়ে রাসেলের সাথেই বেশি কথা বলবে।রাফির মুখ দিয়েই শিকার করাবে রাফি নোহাকে ভালোবাসে।যেভাবেই হোক!
যেই ভাবা সেই কাজ নোহা রাফির সামনে কয়েকদিন গেল না রাফি ঠিকই খোঁজ নিল,চায়ের অজুহাতে নোহাকে ডাকল নোহা গেল না।ডাইনিং এ বসে নোহার রুমের দিকে আড়চোখে বারবার তাকাল,কিন্তু নোহার কোন পাত্তা পেল না।

শুক্রবার বিকাল চারটা রাসেল হাটার অজুহাতে নোহাদের বাসায় এসেছে।সোফায় আয়েশ করে বসে নোহার সাথে তার ভার্সিটি লাইফের গল্প করল।হাত দেখার বাহানায় নোহার কাছে বসল।নোহা আজকে কারনে অকারণে উচ্চস্বরে হাসছে।কারন নোহা জানে রাফি আজ বাসায়।নোহার উচ্চস্বরে হাসি শুনে অবশ্যই আসবে।রাফিকে এড়িয়ে গিয়ে এখন এত হাসির কারন অবশ্যই চোখে পরার মতো!
রাফি রুমে নোহার ছবি দেখছিল।এ কোন যন্ত্রনা!মেয়েটা এমন করছে কেন?ভালোবাসা ফুরিয়ে গেছে!ঠিক তখনি কর্নপাত হয় নোহার দেয়াল কাঁপানো হাসি।ভ্রু কুঁচকে ভাবে কার সাথে এভাবে হাসছে?পায়ে জোতা গলিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়,দরজা খুলে দেখে,রাসেল নোহার গা ছুঁয়ে বসে নোহার ডানহাত দেখে গম্ভীর ভাব নিয়ে এটা সেটা বলছে আর নোহা হাসতে হাসতে রাসেলের গায়ে পড়ে যাচ্ছে।এমন বিশ্রী দৃশ্য দেখে রাফির পায়ের রক্ত তড়াক করে মাথায় উঠে যায়।হাত মুঠো করে তাকিয়ে থাকে।রাগে চোয়াল শক্ত হয়,তারপর রাসেলকে বলতে শুনল
—“নোহা রাতে ডিনারে যাই।প্লিজ না করবে না প্লিজ।”

রাসেলের আকুতি শুনে নোহা হাসে।একজন যে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকেই দেখছে এটা অনেক আগেই বুঝেছে।তাইতো এই গায়েপড়া রাসেলের সাথে একটু ওভার এক্টিং করতে হচ্ছে।সেই সুযোগে রাসেল ডিনারের প্রস্তাব দিয়ে বসে,নোহা রাফিকে রাগানোর জন্য মিষ্টি করে বলল,
—“ইশ!রাসেল ভাইয়া এভাবে বলতে হবে কেন?আমি যাব ঠিক আছে।”

রাসেলের চোখেমুখে খুশীর ঝিলিক লেপ্টে গেল।
—“ঠিক আছে।সাতটায় আমি নিতে আসব।”
—“অকে।”

—“আচ্ছা এখন উঠি।”

—“হুম ”

রাসেল চলে গেলে নোহা তার রুমে ফিরে গেল।নোহা এমন ভাব করল যেন রাফিকে দেখতেই পায়নি।
রাফি চুপচাপ দরজা থেকে সরে এলো।চোখের সামনে ঘটে যাওয়া সবকিছু রাফির অবিশ্বাস্য লাগছে।মানে কিভাবে সম্ভব?এতটা ভালোবাসার পরে কিভাবে এসব সম্ভব?বিদেশী বাবু পেয়ে রাফিকে ভুলে গেল?এত সস্তা ভালোবাসা!ধরাম করে দরজা আটকে বিছানা ঘেষে ফ্লোরে বসে পড়ে।তার মনে ভালোবাসার আগুন জ্বেলে এখন আরেকজনের সঙ্গে এসব করা তো রাফি বরদাস্ত করবে না।রাফি বিরবির করে বলল,
“নোহা উল্টাপাল্টা কিছু করলে আমি তোকে জানে মেরে ফেলব।আই সয়্যার।”

সন্ধ্যা সাতটায় রাফি ড্রয়িংরুমে বসে থাকে সে দেখতে চায় নোহা যায় কিনা।কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সোনালী শাড়ী পরে টিপটপ রেডি হয়ে চলে যায়।রাফি অবাক হয়ে দেখে!কই কখনো তো তার সামনে এভাবে ললনা সেজে আসে না!আজকে সেজে যাচ্ছে তাও বিলাতি ছাগলের জন্য!
নোহার মনে হয় রাফি এভার ধরা দিবে।কেমন করে তাকাচ্ছিল।নোহা বের হওয়ার আগে শুনল তার মায়ের কাছে রাফি বলছে আজকে বাসায় আসবে না বন্ধুর বাসায় থাকবে।

—চলবে—

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে