সুখ সন্ধানী পর্ব-১১

0
476

#সুখ_সন্ধানী
পর্ব-১১
#জাকিয়া_সুলতানা_ঝুমুর
★★★

মে মাস চলছে।আকাশে থালার মতো গোলগাল চাঁদের চেহারা ভাসে।চারপাশে ঝিরিঝিরি বাতাসে পরিবেশ খুবই ঠান্ডা।এমন পরিবেশে প্রিয়তমা না থাকলে কি চলে!না চলে না।আর প্রিয়তমার অপেক্ষারত পুরুষটি যদি হয় শিহাবের মতো পাগল প্রেমিক তাহলে তো কোন কথাই শোনার উপায় নেই।শিহাবের হাতে বেলীফুলের মালা।সেদিন মালা দিবে বলেও আর দেয়া হয় নি। অফিস থেকে জরুরি কাজে সিলেট যেতে হয়েছিল।যাবার সময় নিশিকে বলে যায় নি।পঁচিশ দিন পরে ঢাকা ফিরে এল।এই পঁচিশ দিন সে ইচ্ছে করেই নিশিকে ফোন দেয়নি।শিহাব দেখতে চায় যে সুতোর আগায় যে আগুনের লেলিহান শিখা লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছিল তা আধো দাবানলে পরিনত হয়েছে কি না!হাত ঘড়িতে সময় দেখল রাত একটা বেজে গেছে।এগারোটায় বাসায় এসেছে।জার্নি করে এসে ক্লান্ত হয়ে খুব ভালো একটা গোসল দিয়ে মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে খাবার খায়।রুমে গিয়ে সুই সুতো খুঁজে বেলীফুলের মালা গেথে নেয়।তারপর ছাদে আসে।চাঁদের আলোয় ছাদের এ-মাথা থেকে ও-মাথা ফকফকা দেখা যাচ্ছে।ফোন বের করে নিশির নাম্বারে ডায়াল করে।

নিশি কাঙ্খিত নাম্বার থেকে কল পেয়ে বিছানায় উঠে বসে।তার শরীর মৃদ্যু কাঁপছে।এতোদিন পরে মনে পড়ল!প্রতিটা দিন রাত নিশি একটা ফোনের অপেক্ষায় ছিল।অবশেষে ফোনটা এসেছে।নিশি রিসিভ করে কানে নেয়।কানে নিয়ে শুনতে পায় শিহাব বলছে,
“ছাদে আছি!দুই মিনিটের মধ্যে চলে আয়।”
তারপর নিশিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কট করে ফোনটা কেটে দেয়।নিশি বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়।ছাদে!তারমানে বাসায় এসেছে!এতরাতে কিভাবে ছাদে যাবে?রুমে পায়চারী করে কতক্ষন।অবাধ্য মন ছুটে বেরিয়ে যেতে চায়।অনেক ভেবে বলল তারপর মেইন দরজার কাছে এসে আস্তে করে দরজা খুলে বেরিয়ে আবার বন্ধ করে দেয়।মনে মনে বলে,”জীবনের প্রথম চুরি করে কোথাও যাচ্ছি।তাও এত রাতে ছাদে!ভাবা যায়।আবার কার জন্য যাকে খুব অপছন্দ করতাম।ইশ!কি হয়ে গেল আমার।”
ছাদের দরজা ভেজানো।নিশি ঠেলে ভেতরে ঢুকে।চারপাশে চোখ ভুলিয়ে দেখে ছাদের দক্ষিন পাশে শিহাব দাঁড়িয়ে।রেললিংয়ে হাত ঠেকিয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
নিশির এত উচ্ছাস মূহুর্তেই নিভে যায়।শরীরে ভয় কাটা দেয়।শিহাব গম্ভীর গলায় কাছে ডাকে।সে যেতে পারেনা পা যেন আটকে গেছে তাও ছোট ছোট পা ফেলে কাছে যায়।

শিহাব জানত নিশি আসবে।তার প্রেম প্রকাশ যেহেতু পেয়েছে নিশি উপেক্ষা করে থাকতে পারবেনা। নিশিকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে বিছানার আলোথালু বেশেই চলে এসেছে।শিহাব নিশির দিকে তাকিয়েই বলে,
—“ভাল আছিস?”

নিশির নিজের উপর হঠাৎ করেই খুব রাগ হলো।না বলে চলে গেল!পঁচিশ দিনে না ফোন না মেসেজ।এখন এত রাতে হুট করে একটা কথায় ছাদে চলে এলো!ইশ নিশি খুব বেহায়া হয়ে গেল না?সেদিন আদর আদর কথা বলে উধাও হয়ে গিয়ে এখন হুট করে এসে ফোন দিয়ে ডেকে নিচ্ছে,আবার খবর-ও নিচ্ছে।কি পেয়েছে কি? যখন ইচ্ছা মনে কড়া নাড়বে আবার চলে যাবে?নিশির মন অভিমানে নুয়ে গেল।অভিমান সারা অঙ্গে লেপ্টে গেল।নিশির চেহারা খুব সহয এই যে অভিমান করে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে এটা শিহাবের চোখে পড়ছে।ওমা আবার কথাও বলছেনা!শিহাব এক কবির উপন্যাসে পড়েছিল নারীরা প্রেমিকের উপরেই অভিমান করে তারা চায় প্রেমিক অভিমান ভাঙ্গাক।আগুনে শিখা বুঝি গা ছুয়ে দিল।এবার দাবানলের অপেক্ষা শিহাব হাসল।দু’কদম এগিয়ে এসে নিশির দু’হাত টেনে নিজের হাতে নিল।সেদিনের মতোই আদর গলায় বলল,
—“আমার পাখিটা রাগ করেছে?”

নিশি চোখে চোখ রাখল।শিহাবের মুখে তাকে পাখি বলতে শুনতে পেয়ে তার নরম মন কলমী লতার মতো কেঁপে উঠল।ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
—“আমি কারো পাখি না।”

শিহাব মাথায় মাথা ঠেকাল।লম্বা চওড়া শিহাবের কাছে নিশির শরীরটা একটা চড়ুইপাখির সাইজ।বলিষ্ঠ হাতে যখন কোমড়ে হাত রেখে আরেকটু কাছে টানল,নিশির সারা শরীর অজানা ভয়ে কেঁপে উঠল।রাতের শীতল বাতাসে নাকি শিহাবের ছোঁয়ায় কে যানে নিশির গায়ের প্রতিটা পশম দাঁড়িয়ে যায়।নিঃশ্বব্দে দাঁড়িয়ে তাদের অসস্থি জানান দেয়।চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিল।নিশির ভয় পাওয়া চেহারা দেখে শিহাব মজা পেল,
—“আমি যদি ফিরে না আসতাম সেটাই ভালো হতো।”

নিশির চোখে পানি এসে জমল।জলভরা চোখে সামনের বিরক্তিকর পুরুষটির দিকে তাকাল বলা বাহুল্য এই বিরক্তিকর পুরুষটি এখন তার প্রিয় পুরুষের জায়গায় দাঁড়িয়ে।শিহাব নিশির জলভরা চোখ দেখে আরেকটু বাজিয়ে দেখার জন্য বলল,
—“আজকে আসার সময় আমার সামনের বাসটা ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে খাদে পড়ে গেল।ওই বাসে আমি থাকলেই বোধহয় ভালো হতো।এখন কারো অন্ধকার মুখ দেখতে হতোনা।”

প্রিয়জনকে হারানোর ভয়ে নিশি আকুল হয়ে শিহাবের চোখে চোখ রাখে।দু’হাত দিয়ে শিহাবের গলা আকড়ে ধরে।ফিসফিস করে বলে,
—“এসব বলবেন না প্লিজ।”

নিশি যে এভাবে শিহাবকে আঁকড়ে ধরে নিজের কথা জানাবে এটা শিহাব কখনোই কল্পনা করেনি।আবেশে গলা ধরে এলো।ধরা গলায়ই বলল,
—‘আমার পাখিটা যে আমার সাথে কথা বলেনা!”

নিশি চোখ বন্ধ করে বলল,
—“কথা বলবে।”

শিহাব নিশির বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়েই বলল,
—“পাখির কি আমাকে চাই?”

নিশি আদরীভাবে তাকিয়ে বলল,
—“খুব চাই।”

শিহাব উত্তরটা পেয়ে খুশি হল।এত বছরের অপেক্ষা তবে শেষ হবার পথে!বুকের ভেতর অনুভূতিরা আনন্দে উল্লাসে ছুটোছুটি করে।শিহাব নিশিকে হ্যাচকা টানে বুকে মিশিয়ে নেয়।নিশি প্রথমে খুব ভয় পায়।এই প্রথম কোন পুরুষের বুকে আশ্রয় পেল।লজ্জায় মন কাটাকাটা।আড়ষ্ট হয়ে চুপচাপ শিহাবের বলিষ্ঠ বুকে মাথা দিয়ে লেপ্টে রইল।প্রিয় পুরুষের আলিঙ্গন পেয়ে মনটা ভয়ে,খুশীতে নেচে উঠল।উনিশ বছরের বসন্ত এই রাতের বেলায় দোলা দিল।চোখ বন্ধ করে মিষ্টি ছোঁয়া অনুভব করল।তখনি শুনতে পেল শিহাব বলছে,
—“আমায় ভালোবাসিস পাখি?”

নিশি শিহাবের বুক থেকে সরে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ায়।খুব আস্তে করে বলে,
—“আমি জানি না।”

শিহাব হাসল।ছাদের রেললিং থেকে বেলীফুলের মালা হাতে নিয়ে নিশির হাতে পড়িয়ে দিয়ে বলল,
—“সমস্যা নেই।আমি জানিয়ে দেব।”

নিশি বেলীফুলের দিকে তাকায়।সবসময় শিহাব বেলীফুল দেয় আজকে প্রথমই মালা দিল।নিশি ব্যাস্ত হয়ে বলল,
—“শিহাব ভাই!এটা কেন দিলেন? আমি এটার যত্ন নিতে পারব না।”

শিহাব চোখে চোখ রেখে হাসল।আজকে শিহাবের আনন্দের দিন।দাবানলে যে সে নিজেও পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাবে সেটা খুব উপলব্ধি করতে পারছে।নিশির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
—“ভয় পায় না পাখি।আমি সব শিখিয়ে দেব।”
নিশি লজ্জায় ঠোঁট কামড়ে ধরে দূরে সরে দাঁড়ায়।

★★★
আজকে অনেক দিন নোহা রাফিকে জ্বালায় না।কি দরকার এত বিরক্ত করার?সে তার মতো থাকুক।দূর থেকেও ভালোবাসার মানুষকে দেখে শান্তি।আজকে তার খালাতো ভাই রাসেল কানাডা থেকে আসছে।এই তো সামনের মোড়ের পরের বাড়িটায় ভাড়া থাকে।সেইজন্য বাসার সবাই গিয়েছে।নোহা যায় নি।রাফি আসবে,খাবার দেবার বাহানায় ও কিছুটা বেশি সময় তাকে দেখতে পারবে।সেই আশায় বসে আছে।রাত নয়টা বাজার পরেও যখন রাফি এল না তখন নোহার চিন্তা হলো।সচরাচর রাফি এতো দেরী করে না।সাতটা থেকে আটটার মধ্যে চলে আসে।রাফির আসার সময়টা নোহার মুখস্থ।লুকিয়ে দেখে লোকটা যখন ক্লান্ত দেহ নিয়ে বাসায় ঢোকে গলার টাই আলগা হাতে খুলে নেয় তখন নিশি অপলক দেখে।পুরুষ মানুষের এত সুন্দর হওয়ার দরকার আছে?নোহার ভাবনার অবসান ঘটিয়ে সাড়ে নয়টায় কলিং বেল বাজল।নোহা হাসি মুখে উচ্ছল তরুনীর মতো ছুটে গিয়ে দরজা খুলল,দরজা খুলে নোহার খুব বিষাদের রঙে ছেয়ে গেল।জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে দেখল,রাফির পাশে খুব সুন্দরী এক মেয়ে মর্ডান ড্রেস পরে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।

—চলবে—

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে