#সিঁদূর_রাঙা_মেঘ
#সুরাইয়া সাত্তার ঊর্মি
পর্ব_৭,৮
–“রাতের আধার দূর করতে যেমন এক ফালি সূর্যের আলো যথেষ্ট! তেমনি আমার জীবনের আধার দূর করতে তোমার সেই ঠোঁটের হাসি যথেষ্ট। ”
কুহুর মাথার কাছে বসে আছে ইউসুফ। কুহুর বাম হাতটি তার হাতে মুঠোয়। ইউসুফের চোখে পানি। আজ তিন দিন জাবত কুহুর হুশ নেই। কুহুকে সেদিন হসপিটালে আনার পর এক মুহূর্তেও শান্তিতে বসেনি ইউসুফ পাগলের মতো করেছে। ইউসুফের পুরো পরিবার তখন ইউসুফে পাগলামো দেখে হতভম্ব। তার দুই বন্ধু আর মহসিন আর তুহিন মিলেও সামলাতে পারেনি। কুহুর পরিবার তখন এসে পৌঁছায় নি। ইউসুফের মা মাইশা আঁচলে মুখ লুকিয়ে শুধু কেঁদেইছে। তিনি কিছুই বুঝতে পারেন নি।তার ছেলেটা কবে কুহুকে এত ভালবেসে ফেলেছে। সেদিন পুরো পরিবার জানতে পড়েছিল কুহুর প্রতি ইউসুফের গভীর ভালবাসার কথা। এতটা গভীর যে অপারেশন থিয়েটারে যেন কুহু নয় যেন তার প্রাণ পাখি আটকে আছে।ইউসুফ খনে খনে চেক করেই গেছে ডাক্তার কখন বের হবে! তার কুহুকে সে কখন দেখবে। তার এরূপ অস্থিরতায় হাতশ পুড়ো পরিবার। এদিকে কুহুর বাবা আসাদ পা রাখতেই বুঝে যান তার মেয়েটি ইউসুফের পুরোটা জুড়ে। মনে মনে তিনি খুশি হয়েছিলেন। হবেনি বা না কেন? ইউসুফের মতো সুদর্শন, বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং তার ব্যক্তিত্ব সব দিক থেকেই পারফেক্ট। এমন ছেলের হাতে কুহুকে তুলে দিতে পাড়লে তিনি মরেও শান্তি পাবেন তিনি। মনে মনে ঠিক করেই ফেললেন আসাদ তার মেয়ে আল্লাহ রহমতে সহি সালামাত ঘরে ফিরলে মহসিন ভাইয়ের সাথে কথা বলবেন।
এদিকে ইউসুফের অধির অপেক্ষার অবসান ঘটে ডাক্তার বের হতেই এক প্রকার ছুটে তার কাছে যেয়ে বলে ইউসুফ,,
—” ডাক্তার? আমার, আমার বাবুইপাখি ঠিক আছে তো? কি হলো? কথা বলছেন না কেন? চুপ কেন আপনি কিছু বলুন?”
ডাক্তার তখন বিমর্ষ মুখে বললেন,,
—” আমরা যথেষ্ট ট্রাই করেছি স্যার। উনার হুশ না আসা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। এখন আল্লাহর উপর ভরসা!”
কুহুর যেন মুহূর্তেই মাথায় রক্ত চেপে গেল। ডাক্তারের শার্টের কলার চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল,,
—” আপনারা কি করেছেন তাহলে এতখন ভিতরে? ওর হুশ এখনো ফিরছে না কেন? আপনারা নিশ্চয় চিকিৎসা করেন নি ঠিক মত? আমার বাবুইপাখির কিছু হলে আপাদের কাউকে ছাড়বো না। কাউকে না! পুলিশ কেস করবো বলে দিলাম!”
কলার ছেড়ে এবার ডাক্তারের গলা চেপে ধরে ইউসুফ। ডাক্তার ইউসুফকে ধাক্কে সরানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে পারছে না। এদিকে সাবিত আর জায়েদ ইউসুফকে ছাড়াতে চাইছে কিন্তু পারছেই না যেন অসুরের শক্তি ভর করছে ইউসুফের শরীরে। ইউসুফ এবার পাগলের মতো প্রলেপ ছুড়ে দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত কেউ না পেরে এক নার্স এসে পিছন থেকে ইউসুফকে বেহুশ হওয়ার ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। ইউসুফ প্রায় সাথে সাথে ঢুলে পরে। সেদিন ইউসুফের এ রূপ পুড়ো পরিবারকে ভয় পাইয়ে দেয়। তাদের শান্ত শিষ্ট ইউসুফ এত ভয়ানক রূপ দেখে তারা বিস্ময়ের শেষ চূড়ান্ত পর্যায়।
কুহু পিটপিট করে চোখ খুললো। ইউসুফ তখন চোখের পানি মুছে ডাক্তার ডাক্তার বলে চেঁচাতে লাগলো। তারপর কুহুর দিক ঝুকে বলল,,
—” বাবুইপাখি এখন কেমন লাগচ্ছে তোর? খারাপ বেশী লাগচ্ছে? মাথায় বেশি ব্যাথা পাচ্ছিস?”
ইউসুফ মুহূর্তে বিচলিত হয়ে উঠলো। কুহু তখন অবাক হয়ে বলল,,
—” আপনি কে?”
ইউসুফের যেন তখন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। চাপা হাসার চেষ্টা করে ব্যথাতুর কন্ঠে বলল,,
—” বাবুইপাখি আমাকে চিন্তে পাড়চ্ছিস না? আমি আমি তোর ইউসুফ ভাই!”
কুহু ভয় ভয় চোখে তাকালো। এদিকে ইউসুফের হৃদয় ভেঙ্গে-চুড়ে একাকার। তার বাবুইপাখি তাকে চিন্তে পাড়চ্ছে না, ভেবেই মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। ততখনে ডাক্তারের সাথে কুহুর বাবা-মা এসেও হাজির। কুহু তার বাবা-মাকে দেখেও একি বুলি আওড়ালো। সুমি তখন মুখ গুঁজে কেঁদে দিলেন। ডাক্তার বলল,,
—“অনেক সময় মাথায় বেশি পেশার পড়লে শর্ট টাইম সেমোরি লস হয়। রোগীর এখন ঘুমের প্রয়োজন। হয়তো ঘুম থেকে উঠলেই সবাইকে আবার চিন্তে পাড়বে!”
কুহু তখন অসহায় ভাবে তাকিয়ে ছিল কুহুর দিক। কুহুর মখ ভঙ্গিমা তখন এমন যেন এক গাদা অপরিচিত মানুষের সামনে তাকে বসিয়ে জেরা করা হচ্ছে।
ডাক্তার কুহুকে ঘুমের ইনজেকশন দিলেন। সেই ঘুম ভাঙ্গলো পড়ের দিন ভোরে। ইউসুফ তখনো কুহুর মাথার কাছে তার হাত ধরে ঘুমিয়েছিল। কুহু মৃদু চোখ মেলে খানিকটা ভয় পেয়ে গেল ইউসুফকে। না জানি তার কথা না শোনায় তার কি হাল করে ইউসুফ। কুহু নড়ে চড়ে উঠলো। এতেই ঘুম ছুটে গেল ইউসুফের। কুহুকে জেগে যেতে দেখেই মৃদু কন্ঠে বলল,,
—” আর ইউ ওকে বাবুইপাখি? ”
ইউসুফের কন্ঠ স্বাভাবিক দেখে কুহু ভয় পেয়ে গেল। কোনো কিছু না ভেবে কেঁদে কুটে বলতে লাগলো,,
—” আমাকে মাফ করবেন ইউসুফ ভাই আমি সত্যি জানতাম না এমন কিছু হবে তাহলে মোটেও যেতাম না। ”
ইউসুফ ঠিক এ মুহূর্তে কি বলবে বুঝতে পারলো না। আগের মতোই বলল,,
—” রিলাক্স বাবুইপাখি! ইটস এ এক্সিডেন্ট।
কুহু এবার চুপ হলেও কান্নার দমক থেকে গেল। ইউসুফ কুহুকে আবার বলল,,
—” তোর এখন কেমন লাগচ্ছে?”
কুহু নাকে নাকে বলল,,
—” মাথা ব্যথা করছে চিন চিন করে!”
ইউসুফ খানিকটা রেগে বলল,,
–” কথা তো একটাও শুনিস না আমার। যেন আমি চিড় শত্রু তোর এমন ভাব করিস। সেদিন না করেছি বলে মুখে মুখে তর্ক করে সেইতো গেলি নিজের এত বড় ক্ষতি করে এলি। কি লাভ হলো বল? আর ওই বান্দন্নীরা কই যাদের জন্য ডেই ডেই করে নেচে গেলি! এলো তা না তোকে দেখতে! ”
—” আমি কি জানতাম নাকি এমন গন্ডোগোল! দোষটাতো আপনারো ছিল! সব সময় আধা কথা বলেন। বললেই পাড়তেন গন্ডোগোল আছে তাহলে তো আর যাই না।”
ইউসুফ এবার ছোট শ্বাস ছেড়ে বলল,,
–” দোষটা আমারি হয়েছে! খুশি?”
কুহু মুখ ভেঙ্গচি কেটে অন্যদিকে মুখ করে বলল,,
–” এমন ভাবে বলছেন যেন ামার উপর এহসান করছেন হুহ!”
ইউসুফ কিছু বলল না নিরবে হাসলো। কতটা দিন পর তার বাবুইপাখি তার সাথে কথা বলছে। যখন কুহু তাকে চিন্তে পাড়ছিল না তখন ইউসুফের যেন দম আটকে গেছিল। মনেই হচ্ছিল কুহুকে সে একে বাড়েই হারিয়ে ফেলেছে।
সকাল সকাল ডাক্তার চেক আপ করতে এসে কুহুকে বলল,,
—” আপনি তো আমাদে ভয় পাইয়ে দিয়ে ছিলেন। ধরেই নিয়েছিলাম আমরা এবার জেলের ভাত খাবো। ”
হাসলো ডাক্তার। কুহু আবাক হয়ে বলল,,
—” কেন?”
পিছন থেকে মিহু বলল,,
—” আপু তোমার যেদিন এক্সিডেন্ট হয় সেদিন ভাইয়া যা পাগলামি করেছিল উনাদের ধরে মরেছিল পর্যন্ত। তোমার হুশ না ফেরা বেচারা ডাক্তারদের শাসিয়েছে অনেক। তিন দিন পর যখন তোমার জ্ঞান ফিরে তখন আবার তুমি কাউকে চিন্তে পাড়লেই না। ইউসুফ যেন পুড়ো হসপিটাল মাথায় করে ফেলেছিল।”
ধীরে ধীরে সব খুলে বলল মিহু। কুহু হা হয়ে সব কথা গিলেছিল। সেদিন সে বুঝতে পারেনি তার ইউসুফ ভাই নামক ব্যক্তিটি তার মনের গভীর থেকে অফুরন্ত ভালবেসে ফেলেছে। এ ব্যক্তির কথা প্রতিটি টর্চার যে তার ভালবাসার একটি অংশ ছিল তার, সেদিন ইউসুফ তাকে বৃষ্টি বিলাসের সেই ছাদটিতে পুরো গায়ে জোসনা মাখাতে মাখতে কুহুর সামনে কনফেশন করে ছিল। কুহুর ছোট মনেও ততদিনে ইউসুফের প্রতি ভালবাসর ছোট সুরঙ্গ সরু রাস্তা করে হৃদপিন্ডে পৌঁছে গেছিলো। ইউসুফের কথা প্রতিটি পাগলামি ছিল তার ভালবাসার অন্যরকম রূপ। যা প্রথমে কুহু কাছে বিরক্তি লাগলেও ধীরে ধীরে তার কাছে টক, ঝাল, মিষ্টির মতো লাগতো।
কুহুকে সেদিন বিকেলেই ডাক্তারা বাসায় যাওয়ার পারমিশন দিয়ে দিল। যাওয়ার আগে একটি মহিলা তার বাচ্চা সহ আসলো কুহু সাথে দেখা করতে। বলল,,
—“মা সেদিন তুমি না থাকলে আমার মেয়ের যে কি হতো! আমার মেয়েকে বাচ্চাতে গিয়ে তোমার আজ এ হাল হলো। তোমাকে যে কি বল ধন্যবাদ দেই।”
কুহু বাচ্চাটিকে কাছে টেনে আদর করে বলল,,
–” আন্টি তেমন কিছু না। দোয়া করবেন শুধু আমার জন্য। ”
মহিলা সেদিন খুশি মনে কুহুর জন্য দোয়া করে যান। কুহুর এখনো সে ঘটনাটি মনে পড়লে রুহ কেঁপে উঠে। মানুস গুলো কত নিষ্ঠুর হয় তা সে সেদিন দেখছিল। একটি বাচ্চা মেয়ে গায়ে হাত তুলতে হাত কাঁপে নি তাদের। কুহু ছোট শ্বাস ছাড়লো। চার বছর আগে হয়ে যাওয়া এক্সিডেন্টের দাগ কঁপালে এখনো রয়ে গেছে। কুহু ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো। দাগটি এখনো ভাসমান। কুহু হাত বুলালো দাগটিতে। মনে পড়লো ইউসুফের এ দাগটি ছুয়ে দিয়ার কথা।
কুহু সুস্থ হওয়ার কয়েক মাস পড়েও এ দাগটি যাচ্ছিল না। তা দেখে নাক মুখ কুচকে বলেছিল,,
—” কি বিচ্ছিরি লাগে এ দাগের জন্য আমাকে!”
ইউসুফ তখন আপেল খাচ্ছিল। আপেলের এক বাইট মুখে নিয়ে বলল,,
–” আমার কাছে তো ভালই লাগে! একদম কিউট।”
কুহু নাক ফুলিয়ে বলল,,
—” মজা করছেন?”
—“মোটেও না! সত্যি বলছি সুন্দর লাগচ্ছে এ দাগে!”
কুহু এবার নাক টেনে কাঁদতে লাগলো। ইউসুফ আধো খাওয়া আপেল ড্রেসিং টেবিলের উপরে রেখে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো কুহুকে। ইউসুফ তাকে স্পর্শ করাতে তড়িৎ গতিতে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। ইউসুফ কুহু আরো শক্ত করে ধরলো। কুহু চুপটি মেরে মাথা নত করে রইলো। যতবার ইউসুফের স্পর্শ তার দেহে লাগে সে যেন দিশেহারা হয়ে যায়। ইউসুফ কুহুর ঘাড়র থুতনি রাখলো। তাতে কুহুর কাতুকুতু লাগতে লাগলো। সে নড়চড়ে উঠতেই ইউসুফ তার বাহুডোরে আরো শক্ত করে ধরে ধমকে বললে উঠলো,,
—” একদম নড়বি না।
কুহু নড়লো না। ইউসুফ তখন কুহু কানের কাছে মৃদু আওয়াজে বলল,,
—” তাকা আয়নার দিকে। দেখ একবার!”
কুহু তাকালো। ইশশ! কি সুন্দর প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে আয়নায় তাদের।ইউসুফ আয়নায় চোখ রেখে আবার ফিসফিস করে বলল,,
—“দেখ এবার আমার চোখ দিয়ে! কতটা মায়বী লাগচ্ছে তোকে। তোর এই দাগটি যেন আরো দিগুণ সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।”
কুহু এবার লজ্জা পেয়ে মাথা নত করে ফেললো। কুহুর এই কাজটি ইউসুফের সোজা দিলে গিয়ে বিঁধল। ইউসুফ ঠিক সেই মুহূর্তে কন্ট্রোল হারা হয়ে এক অভাবনীয় কাজ করে বসে। কুহু ঘাড়ে গারো করে ভিজা চুমু খেয়ে বসলো। কুহু তখন আবেশে চোখ বুজে ইউসুফের হাতে খামচে ধরলো। দুজনেই যেন অন্য দুনিয়ায় হারিয়ে যেতে লাগলো। ইউসুফের স্পর্শ গুলো আরো গারো হতেই, কিছু মুহূর্তের মাথা কুহুকে ছেড়ে দিল। কুহু তখন অবাক হয়ে তাকালো ইউসুফের দিকে! ইউসুফের মুখে তখন অপরাধ বোধ টুকু দেখে কুহুর নিজেরো খারাপ লাগলো। ইউসুফ আর সেখানে এক মুহূর্তে না দাঁড়িয়ে বাহিরে চলে গেল।
আজও চোখ বুঝলে ইউসুফের গভীর স্পর্ষ অনুভব করে কুহু। আয়নায় তাকালো কুহু। আজ শুধু এ আয়নায় তার প্রতিবিম্বটি ফুঁটে উঠেছে। তার পাশে ইউসুফ নেই। না হবে। সে পথ নিজ হাতেই বন্ধ করে দিয়েছে। ভেবে হু হু করে উঠলো কুহুর বুক। মাথাটাও ভাড়ি ভাড়ি লাগচ্ছে। এ মুহূর্তে কড়া লিকারে এক কাপ চা খেলে মাথার ভাড়টা অত্যন্ত ছাড়বে।
কুহু গরম পানি বসিয়ে দিল চুলায়। তার মাঝে একে একে চায়ের পাতা, দুধ দিয়ে দিল। এবার চায়ের কাপে চিনি নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো পাশে। খাবার টেবিল থেকে সেই সময়ই কিছু পড়ার আওয়াজে রান্না ঘর থেকে বের হয় কুহু। এ বুষ্টি বিলাস বাড়িটিতে বিড়ালের অভাব নেই। কোন ফাক দিয়ে বাসার ভিতর ডুকে যায় আল্লাহ মালুম। খাবারে আবার মুখ দেয় নি তো? তা ভেবেই খাবার টেবিলের সামনে এসে থমকে যায়। ইউসুফ দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে বললে ভুল হবে। এক প্রকার ঢুলছে। কিন্তু কেনো? কুহু এগিয়ে গেল। একটি কাঁচের গ্লাস ভেঙ্গে নিচে পড়ে আছে। কুহু বলল,,
—” আপনার কিছু লাগবে?”
ইউসুফ বাঁকা চোখে তাকালো। কুহুকে দেখে কাঠ গলায় বলল,,
—” নাহ্। যা লাগবে আমি নিজেই নিতে পাড়বো।”
ইউসুফ আরেকটি গ্লাসে পানি ঢেলে নিতে চাইলো হাতে।কিন্তু নিতে পারছিল না। হাত থেকে পড়ে যাওয়ার আগেই কুহু ধরে ফেললো। এতে রাগ উঠলো ইউসুফের সে কুহুকে ধাক্কা দিতে গিয়ে নিজেই পড়ে গেল। আর ইউসুফের হাত পড়লো আগের ভেঙ্গে যাওয়া কাচের টুকুরের উপর। সাথে সাথে যেন ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো।রক্ত বের হতে দেখে আত্মকে উঠলো কুহু। ছোট থেকেই রক্ত সহ্য করতে পারে না সে। রক্ত দেখেই কুহুর হাত পা কাঁপতে শুরু করলো। রক্তের বন্যা বয়ে যাচ্ছে যেন মুহূর্তেই। সেদিকে ইউসুফের কোনে খায়াল নেই সে উঠতে চাইলো। সেই হাতে ভর দিয়েই। কাচের টুকুরো এবার ভাল করে বিঁধল ইউসুফের হাতে। ব্যথায় “আহ্” শব্দটি করে উঠলো। কুহু তখন যেন ডড় ভয় ছু মন্তর হয়ে ইউসুফকে ধরলো উঠানোর জন্য। ইউসুফ নাছর বান্দা। কোনো মতেই উঠবে না। সে কুহুকে আবার ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলল,,
–” একদম ছুঁবি না আমায়। সে অধিকার তোর নেই!”
কুহু এ মুহূর্তে তার চেঁচামেচিকে প্রাধান্য দিলো না। রাগে ধমকে উঠলো উল্টো ইউসুফকে। ইউসুফ হতবুদ্ধি হয়ে বলল,,
—” এই এই তোর সাহসতো কম না আমাকে ধমক দিস! ফাজিল মেয়ে! মেরে গাল ফাটিয়ে দিব বেয়াদব!”
কুহু পাত্তা দিলো না। স্বাভাবিক ভাবে বলল,,
—” আচ্ছা দিয়েন আমি গাল এগিয়ে দিব বরং। এখন উঠুন রক্ত অনেক পড়চ্ছে!”
–“পড়লে পড়ুক তাতে তোর কি?এত চিন্তা কিসের তোর? হোসটা কে তুই আমার?”
কুহু নিরবে সুপ্ত শ্বাস ছাড়লো। লোকটি সারা জীবনের ঘাড়তেড়া। ভুলেই গেছিল সে। কুহু বলল,,
—” আমি আপনার ফুপাতো বোন এবার উঠুন!”
ইউসুফ এবার চোখ রাঙ্গালো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
—“বোন হোস তুই আমার আবার বল!”
কুহুর চুল টেনে ধরলো ইউসুফ। বোন বলাতে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে তার। কুহু ব্যথা পাচ্ছে খুব নেশার ঘোরেও লোকটি শক্তি এক ফোঁটাও কমেনি। কুহ অসহায় ভাবে তাকালো। বলল,,
—“আপনি উঠুন ইউসুফ ভাই প্লীজ। দেখুন হাতে দিকে!”
ইউসুফ তাকালো না সেদিকে তাকিয়ে রইলো কুহুর চোখ দুটোর দিক। তার বাবুইপাখির চোখে জল। এটি কি তার জন্য? সে ব্যথা পেয়েছে বলেই কি কুহু কাঁদছে? কুহু এবার টেনেটুনে ইউসুফকে উঠলো। তারপর সোফার উপর বসিয়ে ফাস্টেড বক্স নিয়ে এলো। ইউসুফের সামন্য হাটু গেড়ে বসে কাঁচের টুকুরোটি উঠাতে চাইলো। ইউসুফ ব্যথায় হাত সরিয়ে নিলো। কুহু আবার টেনে ধরে কাঁচের টুকরো তুললো। তখন তার মুখ ভঙ্গিমা এমন ছিল ব্যথাটা ইউসুফ না কুহুই পেয়েছে যেন।ইউসুফ তাকিয়ে রইলো কুহুর মুখ খানার দিক। কুহুর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। বলল,,
—” এতটুকু ব্যাথা কিছুই না তোর দেয়া ব্যথার কাছে। এটাতো সেরে যাবে। কিন্তু ভিতরে যে ব্যথা তুই দিয়েছিস তা কিভাবে যাবে??
কুহু থমকে গেল। এ মুহূর্তে এর প্রতি উত্তর কি দিবে সে ভেবে পেলো না। ইউসুফ জবাবের আশায় তাকিয়ে রইলো। কুহু হাতে ব্যান্ডেজ করা শেষ করে উঠে দাঁড়ালো। ফার্স্ট এইড বক্স সোফার পাশের টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে পানির এক গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,,
—” হাতে মেডিসিন দিয়ে দিয়েছি। পানি খেয়ে শুতে যান ইউসুফ ভাইয়া। আপনার নেশা প্রচুর হয়ে গেছে ঘুম দিন গিয়ে!”
চলে যেতে নেয় কুহু। ইউসুফের তখন মাথা গরম হয়ে যায়। দুই রতি মনে গুনে গুনে ইউসুফের ৭ বছরের ছোট। কত সাহস তার সাথে ভাব দেখায়? ইউসুফ পিছন থেকে কুহুর হাত টেনে মুচড়ে ধরে। ব্যথায় কুকড়ে উঠে কুহু। তখন ইউসুফ কুহুর কানে হিস হিস করে বলে,,
—“এতো ভাব কাকে দেখাস তই? আমাকে ইগনোর করিস? আমার কথার দাম নেই না?”
কুহু নিজে ছাড়াবার চেষ্টা করে বলল,,
—” মোটেও তেমন না ইউসুফ ভাই! আপনি রুমে যান আপনার নেশা মথায় চড়ে বসেছে তাই আবল-তাবল ভাবছেন?”
ইউসুফ ছাড়লো না কুহুর কথায় রাগ বাড়লো। বলল,,
—” আমি যতই নেশা করি না কেন নেশা আমার মাথায় চড়ে না। যেটা চড়ে তোর নেশা। তোকে খুন করার নেশা!”
কুহুর পিলে চমকে উঠে। ছুটাছুটি দিগুন শুরু হয়ে যায়। তা দেখে ইউসুফ হাসে বলে,,
—” মরার কত ভয় তাই নারে কুহু!”
কুহু চমকে উঠলো তার ইউসুফ ভাই তাকে কুহু বলে ডাকলো? ইউসুফ এবার কুহুকে ছেড়ে দিয়ে সোফায় পা ছড়িয়ে বসলো। মাথাটা হেলে দিয়ে বলল,,
—” আমার চোখে সামনে থেকে যা। নয়তো সত্যি খুন করে ফেলবো।”
ইউসুফের কন্ঠে গম্ভীর শুনালো। কিছু না বলে চলে গেল রুমে। তার ইউসুফ ভাইকে বড্ড অচেনা মনে হয় এখন। লোকটি আগে সিগারেট পর্যন্ত খেত না এখন সে ড্রিংকস করে । এসব বাজে স্বভাব কিভাবে হলো তার?
পর্ব-৮
–” আপা আপনি এহানে কেন ঘুমাইতেসেন?
টুম্পার কন্ঠে ঘুম ভাঙ্গে কুহুর। চোখ মেলে চারিদিক ফকফকা রোদ দেখ ভ্রু কুঁচকায়। চোখ ঢলে, আড়মোড়া ভেঙ্গে বলল,,
–“কয়টা বাজেরে টুম্পা? ”
–” আপা ১২ টা বাজে।”
চিত্রা চমকে উঠে দাঁড়ায়। চোখ বড় বড় করে বলে,,
–” এত বেজে গেছে? বাবা নিশ্চয় না খেয়ে গেছে? হায় আল্লাহ্ এত কমনে ঘুমালাম আমি?
–” আপনে চিন্তা কইরেন না খালুজানরে নাস্তা বানাইয়া দিছি তিনি খাইয়া গেছেন। যাইতে যাইতে কইলেন আপনারে যাতে না ডাকি। ঘুমাইতে দেই। কিন্তু রুমে গিয়া দেখি আপনে নাই। এহানে হুইয়া আছেন।”
চেয়ারে হেলে ঘুমানোর ফলে ঘাড় ব্যথা করতে লাগলো চিত্রার। ঘাড় ধরে এদিক ওদিক ঘোরালো। বলল,,
—” একটি বই পড়ছিলামরে কখন ঘুমিয়ে গেছি টের পাইনি। আচ্ছা যাতো এক কাপ চা দে আমায় মাথা আর ঘাড় প্রচুর ধরেছে।”
টুম্পা আচ্ছা বলে চলে গেল। চিত্রা ডায়রিটা ভাজ করে রেখে নিজের রুমে গেল। গোসল করা দরকার! গোসল করে বের হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো চিত্রা। চুলের মাঝে টাওয়াল পেঁচিয়ে রেখেছে। চুল থেকে পাসি পড়ে চিত্রার ঘাড়, গলা, বুকের কিছুটা কাপড় এমনকি পিঠের কাপড় ভিজে লেপ্টে আছে শরীরের সাথে। চিত্রায় তাকালো। আয়নায় নিজের প্রতিছবি দেখে মনে পড়লো ইউসুফ-কুহুর রোমান্টিক মুহূর্তের কথা। ইউসুফ অনেক রোমান্টিক ডায়রিটা পড়েই বুঝেছে।ইশশ!! তারো এমন একটি বফ থাকতো? চিত্রা এবার লজ্জা লাগলো। কি ভাচ্ছে সে? পর মুহূর্তে এই দুই মানব-মানবীকে দেখার প্রবল ইচ্ছে জাগলো। যেহেতু এ বাসটি তাদের ইনফ্যাক্ট
প্রতিটি আসবাব তাদের। তাহলে নিশ্চয় ইউসুফ কুহুর ছবিও আছে? চিত্রা এবার চট জলধি পরিপাটী হয়ে রুম থেকে বের হলো। তখন টুম্পা চা হাতে এলো। কুহু চা হাতে নিয়েই প্রতিটি রুমে খুঁজতে লাগলো। এই দোতালা বাড়িটিতে উপর-নিচ মিলিয়ে মোট ১০টি কামরা। তার মাঝে কিছু কিছু তালা বদ্ধ করা। চিত্রা হতাশ হলো। তালা খোলো রুম গুলোতে তেমন কিছুই পেল না সে। বন্ধ রুম গুলোর মাঝেই হয়তো আছে যা সে খুঁজছে। কি করবে সে?
চিত্রা মুখ ভাড় করে বাগানের পাশে বসলো। হাতে তার ডায়রিটা। কিন্তু এখন মোটেও পড়তে ইচ্ছে করছে না। শুধু দেখতে ইচ্ছে করছে। কি করবে সে? ভাবতেই মনে পড়লো এবাড়ির কেয়ার টেকার আনসার মামার কথা। চিত্রার সাথে ভালই ভাব আছে তার। চিত্রা সময় নষ্ট না করে আনসার মামার কাছে গেল। যে এই বাগের পাশেই ছোট একটি ঘরে থাকেন। চিত্রাকে দেখে হাসি হাসি মুখে জিগ্যেস করলো আনসার মিয়া,,
—“কিছু বলবেন আম্মা? ”
চিত্রা মাথা নাড়ালো। কোনো ভনিতা ছাড়াই বলল,,
–” এ বাগির বন্ধ রুম গুলোর চাবি চাই?”
আনসার অবাক হয়ে বলল,,
—“কিন্তু কেন আম্মা?”
চিত্রা বিরক্তি হয়ে বলল,,
–“দেখবো!”
আনসার আমতা আমতা করতে লাগলো। তাকে কড়া ভাবে নিষেধ করেছে এ বাড়ির মালকিন যেন বন্ধ রুমে কোনো ভাড়াটিয়া না আসে। কিন্তু চিত্রাকে সে নাও করতে পাড়চ্ছে না। মা মরা মেয়ে তাকে কতই না আদর করে? তিনি দোনামোনা করে চাবি দিলেন আর বললেন,,
—” আম্মা চাবি হারাইয়েন না? তাহলে ছোট সাহেব আমার গর্দান নিবেন।”
চিত্রা মাথা নাড়িয়ে আশ্বাস দিলো হারাবে না। তারপর দৌড়ে চলে গেল ভিতরে। প্রথমে নিচ তলার ডান পাশের রুম খুললো। এটি এ বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক নাহারের রুম। চিত্রা বন্ধ করে অন্যটি খুলল সেটি ছিল মহসিন আর মাইশার রুম।তারপর খুলল তুহিন আর আয়শার রুম। চিত্রা তার সাথে অবাক হলো মাইশা আর আইশা প্রায় একি রকম চেহারা। তার মানে তারা দু বোন!
চিত্রা এবার একে একে নুশরা, বুশরার রুম দেখে উপরের রুম গুলোদিক গেল। এক পাশে মিশু আর অন্য পাশে কুহুর রুম ছিল। লাষ্ট যে রুমটি খুললো তা হলো ইউসুফের রুম। সেটি খুলতেই অবাক হয়ে গেল চিত্রা এত সুন্দর রুম সে আগে দেখেনি।বাড়ি প্রদতিটা জিনিষ আর ঘর খুব চমৎকার ভাবে সাজানো। কিন্তু ইউসুফে রুমটি যেন ভিন্ন রকম সুন্দর। চিত্রা ছুয়ে ছুয়ে দেখতে লাগলো। খাটের কাছে আসতে চোখ পড়লো ইউসুফের হাস্যজ্জল ছবি। কুহু মুখ হা হয়ে গেল ইয়া বড়। ডায়রির দিয়া বর্ণনাতে বুঝতে বাকি নেই এটাই ইউসুফ। যার প্রমান সরূপ ইউসুফের বিলাই চোখ। ডায়রির বর্ণনা আরো মিলাতে লাগলো। ডায়রিতে একটি জায়গায় উল্লেখ্য আছে ইউসুপের ভ্রুর সাথে একটি লাল তিল আছে। চিত্রা তা স্পষ্ট দেখতে পেল। তার সাথে আরো মিলল, ইউসুফের গালের টোল পড়া বাঁকা হাসি। থুতনি মতে খাঁজ আছে। মনে হচ্ছে কেউ খুব সুন্দর করে খোদাই করে রেখেছে। একটা মানুষ এত সুন্দর কিভাবে হয়? যেমন লম্বা তেমন চুল, নাক, মুখ সব দিক দিয়েই পারফেক্ট। চিত্রার মুখ দিয়ে মাসাআল্লাহ্ বের হয়ে এলো যেন। চিত্রড়া মুগ্ধ নয়নে ইউসুফকে দেখে বলেই ফললো,,
—” ইশশ! আমারো যদি এমন হাব্বি থাকতো? ”
নিজের কথায় নিজেই লজ্জা পেল চিত্রা পর মুহূর্তে ড়কি ভেবে আবার এদিক অদিক খুঁজতে লাগলো। কিন্তু কুহুর কোনো ছবি পেল না। হতাশ হলো চিত্রা। পুরো বাড়ি জুড়ে এত মানুষের ভিড়ে কুহু ছবি নেই মনে হচ্ছে? কারণ ডায়রিটিতে যে বর্ণনা কুহুর দিয়া তাতে এখানো কারো ছবির সাথে মিললো না। চিত্রার মনে ভয় ঢুকলো। এমনতো নয়? হুরের সাথে ইউসুফের বিয়ে হয়ে গেছিল? সেই হয়তো পুড়িয়ে ফেলেছে সব? নাকি ইউসুফ তার রাগ অভিমান এতই ভাড়ি হয়ে গেছি যে সব নষ্ট করে দিয়েছে? চিত্রার মনে মনে ভয় লাগলো। কি হয়েছিল তাদের তা জানতেই আবার ডায়রিটা নিয়ে বসে পড়লো চিত্রা।
চলবে,