সাত সমুদ্রের তিমির পর্ব-২১

0
881

#সাত_সমুদ্রের_তিমির
পর্বঃ২১
#সুমাইয়া_আফরিন

রাফাত অনুর প্রশ্নের কি উত্তর দেবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ মুখে চিন্তিত ভাব এনে বলল,

‘অনু তুমি এসব কি বলছো? তোমার আমি কতো বড় উপকার করেছি তুমি জানো?’

অনু ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসা করল,

‘কি উপকার?’

রাফাত চোখ বড় বড় করে বলে উঠল,

‘আমি দেখি আমার মামি তোমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। উনি এসব মানুষদের পছন্দ করে না যারা বিয়ের পর স্বামীর সাথে থাকে না। উনি তোমাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছিলেন ঠিক ওই সময় আমি এসে বললাম যে,আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমাকে যেন না মারে। মামির আমার কথা অর্ধেক বিশ্বাস করেছেন আর অর্ধেক করেননি। তাই তিনি পরীক্ষা করার জন্য আমাকে বললেন তোমার কপালে কিস করতে তাই আমি করলাম।’

অনুর রাফাতের কথায় রাগ দ্বীগুন বেড়ে গেল। চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে রাফাতের দিকে। অনু নিজের রাগকে সামলাতে না পেরে দাঁত খিচিয়ে মুখ ভেংচে বলল,

‘ফালতু কথা বলার জায়গা পান না তাই না?কোথায় আপনার মামি, ডাকুন তাকে।’

‘ওই তো তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন।’

অনু তার চারপাশে চোখ বুলালো। কোথাও কোনো মানুষকে দেখতে পেল না। অনু বিরক্তিভরা কন্ঠে বলল,

‘কোথায়?এখানে তো কাউকে দেখতে পাচ্ছি না।’

রাফাত ঠোটের কোণায় ফিচেল হাসি এনে বলল,

‘ওহো….. আমি তো ভুলেই গেছিলাম। আমার মামিকে আমি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না। উনি তো আমার আট বছর বয়সেই মারা গেছেন। আর……

আর কিছু বলতে পারলো না রাফাত। অনু রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

‘রাফাত খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। বানিয়ে কথা বলার একটা লিমিট আছে। বিরক্তিকর।’

রাফাত কিছু একটা বলতে চাইল কিন্তু অনু তাকে বলার সুযোগ না দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। অনু রাফাতের থেকে জানতে পেরেছে কালকে তার বাবা আসবে। এতে অবশ্য অনু অনেক খুশি হয়েছে। তার কাজটা অনেক তাড়াতাড়ি ও দ্রুত হয়ে যাবে। অনু যেন আর অপেক্ষা করতে পারছে না রাফাতের বাবার আসার৷

পাঁচ মিনিট পর ফ্রেশ হয়ে অনু বাইরে বেরিয়ে এলো। রাফাত বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে আছে। অনুকে দেখেই ধড়ফড় করে উঠে গেল সে। অনু রাফাতের দিকে নজর না দিয়ে আয়নার সামনে চলে গেল। নিজেকে ভালো করে আয়নায় পরখ করে নিল সে। রাফাত অনুর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আয়নায় রাফাতের প্রতিচ্ছবি পড়ায় খুব ভালোভাবেই রাফাতকে দেখতে পাচ্ছে অনু। অনু খেয়াল করল রাফাত গভীর মনোযোগ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

অনু যদিও বিরক্ত হচ্ছে না তার এই ব্যবহারে কিন্তু কোনোকিছু বলছে না। অনু মাঝে মাঝেই ইচ্ছা করছে কয়েকটা কঠিন কথা শুনিয়ে দিতে কিন্তু তাও করছে না। এমন করার কারন অনুর বোধগম্য নয়।

অনু বারবার রাফাতের দিকে তাকাচ্ছে। রাফাত যেন খুব মজা নিচ্ছে অনুর এভাবে তাকানোতে। রাফাতের ঠোটের কোণে অস্ফুট হাসি বিরাজ করছে। অনু এবার আর নিজের রাগকে সামলাতে পারলো না। অনু হিংস্র চোখে রাফাতের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সমস্যাটা কি?কি দেখছেন তাকিয়ে তাকিয়ে?রুপ জ্বালিয়েছে আমার যে এভাবে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হবে।’

রাফাত তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে অনুকে উদ্দশ্য করে বলল,

‘এটা কেমন কথা?তোমার রুপ তো অনেক আগেই জ্বালিয়েছে। এখন হতে যাবে কেন?’

অনু রাফাতের কথায় আরো রেগে গেল। রেগে গিয়ে কিছু বলার উদ্যোগ নিল কিন্তু কিছু বলতে গিয়েও বলল না৷ কারন সে ভালোই বুঝতে পারছে এই লোকের সাথে সে কখনোই পেরে উঠবে না।

অনু নাক দিয়ে গরম হাওয়া বের করতে করতে হনহন করে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। অনুর এমন আচরন দেখে রাফাত ফিক করে হেসে দিল। ওয়াশরুমে চলে গেল ফ্রেশ হতে। অনু নিচে নামতেই দেখল ড্রয়িং রুমে রাফাতের চাচি বসে আছে। অনুকে দেখেই মুচকি এক হাসি দিলেন ভদ্রমহিলাটি। অনু হাত দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকলেন। অনু ঠোটের কোণে বিষ্ময়ের হাসি ঝুলিয়ে তার কাছে চলে গেল।

অনু মহিলাটির কাছে যেতেই মহিলাটি অনুর মাথায় হাত দিলেন। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,

‘কেমন আছো তুমি?’

‘জ্বি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।’

‘বড় ভাবী তোমাকে যা বলেছে তা নিয়ে তুমি কিছু মনে করো না। বড় ভাবী ভাইয়াকে অনেক ভালোবাসেন তাই তার কোনো অপরাধই চোখে পড়ছে না তার। বুঝতেই৷ তো পারছো?’

অনু কিছু বলল না। এখানে কিই বা বলার আছে তার! অনু এই একজন মানুষকেই পেল যে তার বিষয়টা বুঝতে পারছে, তার কথা শুনতে চাইছে। অনু তার দৃষ্টি নিচের দিকে আবদ্ধ করে রেখেছে। ভদ্রমহিলাটি অনুকে ডাক দিয়ে বললেন,

‘অনু কি হয়েছে?’

‘না আন্টি কিছুই হয়নি।’

অনু কথায় মহিলাটি শব্দ করে হেসে দিলেন। অনু মহলাটির হাসির কারন খুজে পেল না। চোখ কুচকে তাকিয়ে রইল তার হাস্যজ্জল মুখস্রির দিকে। মহিলাটি হাসতে হাসতে বললেন,

‘তোমরা আজকাল ছেলেমেয়েরা সবাইকে আন্টি বলো। কিন্তু জানো, রাফাত এতো মডার্ন ছেলে কিন্তু তবুও আমাকে কাকিমনি বলে ডাকে। তাই তুমিও যদি আমাকে কাকিমনি ডাকো আমার খুব ভালো লাগবে।’

অনু মহিলাটির কথায় সস্তি পেল। কারন আন্টি বলতে তারও ভালো লাগছিল না। অনু ফিচেল হাসি দিয়ে বলল,

‘আসলে কাকিমনি,এই বাড়িতে রাফাত হঠাৎ নিয়ে এসেছে। সবাইকে আপন করে নিতে চাচ্ছি কিন্তু এই বাড়ির মানুষজন আমাকে কতটা আপন করে নিতে চাইছে সেইটা বুঝতে পারছি না। তাই প্রথমে আন্টিই বললাম।’

রাফাতের কাকিমনি কিছু বলতে যাবে তার আগেই এক মেয়েলি কৌতুহলি কন্ঠেস্বর ভেসে আসল,

‘তাহলে তুমিই আমার ডেলিভারী করেছিলে?’

অনু পেছন ফিরে তাকাতেই কাকলি সরকারের দ্বিতীয় সন্তান স্নেহাকে আবিষ্কার করল। কাকলি সরকারের দুই ছেলে দুই মেয়ে। তার প্রথম সন্তান হলো রাফাত এবং দ্বিতীয় সন্তান স্নেহা। আর ফাইজা আর ইফতী জমজ ভাইবোন। ইফতবড় ফাইজা ছোট।

স্নেহার পেটে বেল্ট পড়া। সে যে এত কষ্ট করে এসেছে এটা ভাবতেই অনুর শরীরে কাটা দিয়ে উঠল। অনু স্নেহার কাছে গিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,

‘স্নেহা তুমি কেন উঠে এসেছো? তোমার এখন বিছানা থেকে ওঠাও ঠিক না।’

স্নেহা মুখ নিমিষেই বিষন্নতায় ভরে উঠল। মুখে অঝস্র কষ্ট হানা দিয়েছে তার। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,

‘ভাবী প্লিজ, খুব বোরিং লাগছে ওই বিছানায় শুয়ে থাকতে। জানো ভাবী আমার একটা বজ্জাত স্বামী আছে,সে তো পারে আমার পাশে একটু বসে থাকতে। কিন্তু নাহ,,তার এত কাজ যে আমার দিকে ঘুরেও তাকানো যাবে না।’

কথা বলার এক পর্যায়ে পেটে হাত দিয়ে স্নেহা হালকা আর্তনাদ করে উঠল। রাফাতের কাকিমনি ভয় পেয়ে দৌড়ে স্নেহার কাছে চলে আসলো। স্নেহা অনুর হাত শক্ত করে ধরে আছে। চোখ মুখ কুচকে গেছে তার। অনু দেরি না করে স্নেহাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। স্নেহার প্রেগনেন্সির কারনে কাকলি সরকার স্নেহার রুম উপর থেকে নিচে শিফট করে দিয়েছে। যার কারনে স্নেহাকে নিয়ে যেতে বেশি দেরি হলো না অনু।

অনু স্নেহাকে চেক আপ করে বুঝতে পারল স্নেহার কিছুই হয়নি। একটু হাঁটার কারনে পেটে পেইন উঠেছিল তার। অনু স্নেহাকে না হাঁটার জন্য কড়া আদেশ দিল। অনু স্নেহাকে পেইন কমার ওষুধ খাইয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল রুম থেকে।
_____________

‘এইটা হতে পারে না খালামনি।আজকে ওই মেয়েটা রাফাতের সাথে একই রুমে একই খাটে ঘুমাবে? না না, এটা হতে পারে না।’

সায়মার চোখ দিয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। নোনা জলগুলোতে মিশে আছে অঝস্র প্রতিহিংসা ও রাফাতকে না পাওয়ার ভয়। কাকলি সরকার মাথা চেপে ধরে সোফায় বসে আছেন। কিছুক্ষন আগে কি হয়ে গেল কিছু তার বোধগম্য নয়। সে শুধু এইটুকুই জানে অনুকে যে করেই হোক বাড়ি থেকে বের করতে হবে।

সায়মার এমন ন্যাকা কান্নায় বিরক্ত হয়ে কাকলি সরকার চিৎকার করে বলল,

‘তুই থামবি? একটু ভাবতে দে আমায়।’

সায়মা তার ন্যাকা কান্না থামিয়ে দিল। অশ্রু ভেজা চক্ষুতে তাকিয়ে আছে কাকলি সরকারের দিকে। কাকলি সরকার কিছুক্ষন চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকলেন। হঠাৎ তিনি উল্লাসে সোফা থেকে উঠে দাড়ালেন। তার ঠোটের কোণায় ক্রুর হাসি বিরাজ করছে। কাকলি সরকার সায়মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘সায়মা তুই দেখ এবার, রাফাত অনুকে বের করে দিতে বাধ্য হবে।’

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে