শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পর্ব-১৯ এবং শেষ পর্ব

0
1322

#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#অন্তিম_পর্ব

মায়ের অবহেলা অনেকটা বিষাক্ত। এই বিষাক্ত অনুভূতি গুচ্ছকে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। তারিন এক নজর ওর মায়ের দিকে তাঁকালো। শাহানাজ বেগমের মুখটা অসহায়ত্বের ছোঁয়ায় ভরে উঠেছে। দীর্ঘ নিশ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিঁড়ে।পরিবেশটা থমথমে। টু’শব্দ নেই। মুখের ভাষা নেই। কেমন যেনো বুকের ভেতর দুমড়ে-মুষড়ে এলো তারিনের। আগের প্রশ্নের উওর না পেয়ে পূর্নরায় প্রশ্ন করলো,
“চুপ করে আছেন যে মিস্টার দেওয়ান। কেনো আমার বাবাকে মে’রেছেন?”
তারিনের প্রশ্নে রায়হান দেওয়ান হকচকালো। নুয়ে যাওয়া কন্ঠস্বর তার। থেমে থেমে বললো,
” আমার বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা আছে। এমনকি মেয়ে পাচার কাজে আমি যুক্ত। এইসব কিছুতে আমার পথের কা’টা ছিলো সালমান। বার বার আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটাতে লাগলো। আমার বিরুদ্ধে সব প্রমান জোগাড় করে পুলিশের হাতে দেওয়ার হু’মকি দিচ্ছিলো। তখন আমি বুদ্ধি খাটিয়ে সালমানের হাতে পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়েছিলাম। বলেছিলাম এই পথ থেকে ফিরে আসব। কয়েকদিন এইসব কাজ বন্ধ রেখে সালমানের বিশ্বস্ত হয়ে গেলাম। যখন সালমানের প্রতি রাগ, ক্ষোভটা কিছুতেই মিটাতে পারলাম না। তখন ভাবলাম সালমানের বড় দূর্বলতা তো ওর দুই মেয়ে। যদি এই দুই মেয়েকে কেড়ে নেওয়া যায় তাহলে ও’কে কাবু করা সম্ভব। সেই প্লান অনুযায়ী প্রথমে রাহাকে কেড়ে নিলাম। তারপরের কথাগুলো তুমি জানো। আমার প্লান ছিলো তোমাকে সারাজীবনের জন্য খু”নের দায়ে কারাগারে পাঠানো। কিন্তু যখন সব প্লান জহির এলোমেলো করে দিলো, তখন নতুন প্লান করেছিলাম। যে আমার পথের কা’টা তাকেই সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সেই অনুযায়ী সব প্লান সাজিয়েছিলাম। সেদিন সালমান অফিস থেকে বের হতেই আমি ওকে বলেছিলাম, আমার গাড়িটা খারাপ হয়ে গেছে তাই লিফট দিতে। অর্ধেক রাস্তায় এসে আমি সিগারেট কেনার জন্য গাড়ি থেকে নামতেই, আমার লোকেরাই ওকে গু/লি করেছিলো। তখন ভালো সাজার জন্য সালমানকে হসপিটালে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম। সারা রাস্তা ওকে বুঝিয়েছি তাজওয়ার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এইসব করেছে। আমি নিজের চোখে দেখেছি সবটা। ওর ভাইয়ের মৃত্যুর প্রতিশোধ নিয়েছে। তারপরের টুকু তোমাদের জানা।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বললো রায়হান দেওয়ান। সবটা শুনে উপস্থিত সবাই শোকে স্তব্ধ। তারিন এতক্ষন পড়ে এইবার আর নিজেকে সামলাতে না পেরে এক হাটু ভেঙে ধপ করে বসে পড়লো। কেমন করে যেনো নিজেকে গুটিয়ে নিতে লাগলো দুই হাটুর ভাজে। কিছুক্ষন স্তব্ধ থেকে হঠাৎ করেই ভুবন কাঁপানো চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। ওর কান্নার শব্দে চারপাশটা কেঁপে উঠছে বারবার৷ তাজওয়ার আগের মতোই শান্ত। ওর বলার কিছু নেই। মাথার মধ্যে তীব্র ব্যাথা অনুভব করছে। হয়তো কিছু মনে করার চেষ্টা করছে। কিন্তু যেই স্মৃতি একবার মুছে যায় তা কি আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মনে করতে না পেরে মাথা চেপে বসে পড়লো। চোখ ফেটে অশ্রুকনা বেরিয়ে আসতে চাইলো। বিয়ের দিন তারিনের অতীত সম্পর্কে শাহানাজ বেগম বলেছে। তারিনের বিষয় সব জানতে গিয়ে শাহানাজ বেগমকে খুঁজে বের করেছিলো তাজওয়ার। জানতে পেরেছিলো শাহানাজ বেগম তারিনের মা। তাই বিয়ের দিন রাইমা বেগম আর জহির কে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলো সবটা জানার জন্য। আর তখনেই ওরা তিন জন মিলে সবটা তাজওয়ারকে বলেছে। তারিন ফুঁপিয়ে কাদছে এখন। ওমরের চোখ ভর্তি পানি। কতটা নিচে নামতে পারে একটা মানুষ ভেবে পেলো না। শাহানাজ বেগম হয়তো শোকে একদমেই শান্ত হয়ে গেছে। চুপচাপ, শান্ত হয়ে বসে রইলো এক জায়গায়। হুট করে তারিন উঠে দাড়ালো। কান্না থামালো বহু কষ্টে। বড় করে একটা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো। ওমরের সামনে গিয়ে ওমরের দুই বাহুতে হাত রেখে মুখে হাসি টানার চেষ্টা করলো। যথাসাধ্য হাসি রেখে বললো,
“তুই কি ভেবেছিলি? তারিনের থেকে সত্যিটা লুকিয়ে যাবি আর তারিন কিছু জানবে না।”
কথাটা শুনে ওমর কেমন আঁতকে উঠলো। তারিন কোন সত্যির কথা বলছে? বিস্ফোরিত চোখে তাঁকালো সবাই তারিনের দিকে। তা দেখে তারিন মুচকি হাসলো। ঝাপটে ধরলো ওমরকে। ভাঙা কন্ঠে বললো,
“আমি জানি এই খারাপ লোকটা তোর বাবা বলে আজো তুই কষ্ট পাস। কিন্তু, বিশ্বাস কর তুই আমার ভাই ছিলি। আছিস। থাকবি। কোনোদিন দূরে যাব না। কোনোদিন না। ”
তারিনের কথায় ওমর নিজেকে সামলাতে পারলো না। পরম আবেশে বোনকে আগলে নিলো। স্নেহের হাত বাড়িয়ে দিলো বোনের মাথায়৷ চোখ থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে। বুকের মধ্যে প্রশান্তির হাওয়া বইছে। ওমর তারিনকে ছেড়ে ওর দুই গালে হাত রেখে বললো,
“তুই আমার বোন ছিলি। আছিস। থাকবি। কোনোদিন দূরে যাব না। প্রমিস। পাক্কা প্রমিস। ”
বলে তারিনের নাক টেনে দিলো। তাতে তারিন হেসে উঠলো খানিকটা। এত কষ্টের মাঝে ও মেয়েটা কি করে হাসতে পারে? তাজওয়ার ওর দিকে এক ধ্যান্ব তাঁকিয়ে ভাবলো কথাটা। মেয়েটার মধ্যে আলাদা এক শক্তি আছে। যেই শক্তির জন্য মেয়েটা হাসতে পারে। এগিয়ে এলো তারিনের দিকে। শান্ত কন্ঠে বললো,
“আমাকে কি ক্ষমা করা যাবে না? মেনে নিবে না কোনোদিন? নাকি এখনো ঘৃনা করবে?”
হঠাৎ তাজওয়ারের কথা শুনে তারিনের হাসিটা মিলিয়ে গেলো। মায়া ভরা চোখে তাঁকালো তাজওয়ারের দিকে। কোনো দ্বিধা ছাড়াই তাজওয়ারের দুই গালে হাত রাখলো। অভিমান, অভিযোগবিহীন কন্ঠে বললো,
“তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ নেই আমার তাজ। আমি অনেক বড় অপরাধ করে ফেলেছি। যাকে ভালোবাসি তাকেই আঘাত করেছি। আমাকে কোনোদিন ক্ষমা করো না প্লিজ। ”
তারিনের চোখের জল টুকু তাজওয়ার দুই হাতে মুছে নিয়ে, ওর দুই গালে হাত দিয়ে আদুরে স্বরে বললো,
“তুমি কোনো অন্যায়, অপরাধ কিছু করো নি। আমরা বিষাক্ত অতীত ভুলে সব নতুন করে শুরু করব। ”
তাজওয়ারের কথা শুনে তারিন কেমন করে একটু হাসলো। হয়তো তাচ্ছিল্যের হাসি। তা তাজওয়ার বুঝলো না। তারিনের মাথাটা বুকে চেপে ধরলো। শান্ত বানীতে শুধালো,
“আজকে সব প্রতিশোধ, প্রতিশোধ খেলা শেষ করে নাও। এর পর আর তোমাকে কোনোদিন এইসব রি’ভলবার, টিভলবার ধরতে দিব না। যদি আমার কথা না শুনেছো তাহলে দেখবে তাহমিদ তাজওয়ারের ভয়ংকর রুপ।”
তাজওয়ারের কথা শুনে তারিন হেসে দিলো। সাথে তাজওয়ার আর ওমর ও হাসলো। সবাই নিজেদের মাইন্ড ফ্রেশ করলো এইটুকু সময়ে। তারিন একবার ঘৃনা ভরা চোখে শাহানাজ বেগম আর রায়হান দেওয়ানের দিকে তাঁকালো। শাহানাজ বেগমের দিকে তাঁকিয়ে বলল,
“আমার অতি শত্রুকেও আমি দিনশেষে ক্ষমা করে দিয়ে ঘুমাতে যাই। কিন্তু আপনাকে আমি কোনোদিন ক্ষমা করব না। ”
বলে রিভলবার টা হাতে তুলে নিলো। রায়হান দেওয়ানের শরীর এতক্ষনে ঠান্ডায় অবশ হয়ে গেছে। নড়াচড়া করার শক্তিটুকু তার নেই। নেতিয়ে পড়েছে। তারিন দেরি করলো না। হাতে তুলে নিলো ধারালো একটা ছু*ড়ি। এগিয়ে গেলো রায়হান দেওয়ানের দিকে। রহস্যময় হাসি টেনে বললো,
“তোর মৃ’ত্যু যন্ত্রনা আমি চোখের সামনে দেখে নিজের চোখ দুটোকে শান্ত করতে চাই। ”
বলে সময় নিলো না। ছু*ড়িটা রায়হান দেওয়ানের গলায় চালিয়ে দিলো। তৎক্ষনাৎ ফিনকি দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হতে লাগলো। চিৎকার করার সময় টুকু পেলো না সে। কেমন একটা বিভৎস আওয়াজ বের হচ্ছে তার কন্ঠস্বর থেকে। ওমর দৃশ্যটা সহ্য করতে পারলো না চোখ বন্ধ করে নিলো। তাজওয়ার অন্যদিকে ঘুরে দাড়ালো। শাহানাজ বেগম মুখে কাপড় চা’পা দিয়ে কেঁদে উঠলেন। কয়েক মিনিট গলা কা*টা মু’রগির মতো ছটফট করতে করতে রায়হান দেওয়ানের শরীরটা শান্ত হয়ে গেলো। দেহ থেকে প্রানপাখিটা উড়ে গেলো। তা দেখে যেনো ক্ষান্ত হলো তারিন। এতদিনের সব অন্যায়ের অবসান ঘটালো। একনজরে তাঁকিয়ে থাকলো রায়হান দেওয়ানের লা’শটার দিকে। হঠাৎ করেই তারিনের শরীরটা অবশ হয়ে আসতে থাকলো। মাথা ঘুরতে লাগলো। কথা বা চিৎকার করার মতো শক্তি পাচ্ছে না। দাড়িয়ে থাকার মতো পা দুটো সচল থাকলো না। ভেঙে পড়তে লাগলো। হঠাৎ এমন হওয়ার কারন বুঝতে পারলো না তারিন। কেনো এমন হচ্ছে? বুকেদ ভেতর অসম্ভব, অসহনীয় ব্যাথা হচ্ছে। তারিন চিৎকার করতে চাইলো কিন্তু পারলো না। লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। লুটিয়ে পড়ার সাথে সাথে খিচুনি উঠে গেলো তারিনের। তারিনকে লুটিয়ে পড়তে দেখে শাহানাজ বেগম চিৎকার করে উঠলো। দৌড়ে গিয়ে ঝাপটে ধরলো তারিনকে। উনার চিৎকার তাজওয়ার আর ওমর দুজনেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো। সামনের দৃশ্যটা দেখে ওরা দুজনেই জমে গেলো। এগিয়ে যাওয়ার সাহস পেলো না। একসাথে দুজনেই দৌড়ে গেলো। তাজওয়ার তারিনের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিলো। কন্ঠস্বর রোধ হয়ে আসতে লাগলো ওর। কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না। ওমর আতৎনাদ করে বলতে লাগলো,
“বোন, এই বোন তোর কি হলো? তারিন কথা বল? একবার কথা বল? কি হয়েছে তোর? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
আর বলতে পারলো না। কান্নায় গলা চেপে আসচ্ছে। শাহানাজ বেগম পাগলের মতো কেঁদে উঠলো। বলতে লাগলো,
“আমাকে একবার ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দে মা। আমি পৃথিবীর সবথেকে ভালো মা হওয়ার চেষ্টা করব। একবার কথা বল প্লিজ।”
তাজওয়ার এইবার অনেক কষ্টে মুখ খুললো,
“কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো প্লিজ? কি হয়েছে তোমার? কেনো এমন করছো? ভয় পাচ্ছো? আমি আছি তো। কিছু হবে না তোমার। অনেক কষ্টে হচ্ছে তোমার। বলো না একবার? বলো।”
লাস্টের কথাটা চেঁচিয়ে বললো তাজওয়ার। তারিন কথা বলতে পারছে না। অশ্রু ভর্তি চোখের ওদের দিকে তাঁকিয়ে রইলো। কিছুক্ষন পর পর খিচ দিয়ে উঠছে। তাজওয়ার আর দেরি করলো না। তারিনকে কোলে তুলে নিলো। অস্থির হয়ে বলতে লাগলো,
“তোমার কিছু হবে না। আমি কিছু হতে দিব না তোমাকে। এক্ষুনি তোমাকে হসপিটালে নিয়ে যাব। প্লিজ চোখ বন্ধ করো না। আমার ভয় হচ্ছে। তুমি একদম ঠিক হয়ে যাবে। ”
বলে বেরিয়ে গেলো। ওমর আর শাহানাজ বেগম ও ছুটলো ওর পিছু পিছু। প্রায় বিশ মিনিটের মাথায় হসপিটালের সামনে এসে গাড়ি থামলো। তাজওয়ার তারিনকে নিয়ে ছুটে গেলো হসপিটালের ভেতর। ভেতরে ঢুকে ওমর চেঁচিয়ে ডাক্তার ডাকতে লাগলো। ওর চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে। তাও নিজেকে সামলে বোনের মাথায় কিছুক্ষন পর পর হাত বুলিয়ে বলছে,
“কিচ্ছু হবে না তোর। এই দেখ আমরা হসপিটালে চলে এসেছি। এক্ষুনি তুই সুস্থ হয়ে যাবি। ”
বলে আবারো ডাক্তার কে খুঁজতে ব্যস্ত হলো। মিনিটের মাথায় ডাক্তার কে ডেকে এনে বলতে লাগলো,
“দেখুন না ওর কি হয়েছে? কেনো এমন করছে ও?প্লিজ ডাক্তার একটু তাড়াতাড়ি দেখুন।”
ওমরের কথা শেষ হতে না হতেই তাজওয়ার অনুরোধ বাক্যে বললো,
“আপনার কাছে আমি হাত জোড় করছি ডাক্তার। ওকে প্লিজ সুস্থ করে দেন। ও তো কিছুক্ষন আগেও সুস্থ ছিলো। তাহলে হঠাৎ কেনো এমন হলো? দেখুন না প্লিজ।”
ওদের শান্ত করতে ডাক্তার নার্সদের ডেকে ওকে কেবিনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। ডাক্তার তারিন কে দেখেই বুঝতে পারলো, ওর অবস্থা ভালো নয়। তারিনকে ভেতরে নিয়ে যেতেই তাজওয়ার শব্দ করে কেঁদে উঠলো। হারানোর ভয়ে ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো। ওমর নিরবে চোখে পানি ফেলছে। আর শাহানাজ বেগম এক প্রকার বিলাপ করে কাঁদছেন। নিজের করা অপরাধ গুলো মনে করে আরো বেশি করে কেঁদে উঠছেন। প্রায় আধা ঘন্টা পর ডাক্তার বেরিয়ে আসতেই তাজওয়ার আর ওমর মিলে তাকে ঘিরে ধরলো। দুজনেই অসহায় কন্ঠে বললো,
“তারিন কেমন আছে?”
ওদের দুজনের অস্থির কন্ঠস্বর শুনে ডাক্তারের মুখটা চুপসে গেলো। তাজওয়ারকে কম বেশি সবাই চিনে। ডাক্তার অনেকটা গম্ভীর স্বরে বললো,
-সি ইজ নো মোর। আ’ম সরি মিস্টার তাহমিদ।
কথাটা তাজওয়ারের কানে পৌঁছালো না। তার আগেই তাজওয়ার কয়েকপা পিছিয়ে গেলো। ঘুরে পড়ে যেতে নিলে ওমর ধরে ফেললো। তাজওয়ারকে দুই হাতে আকঁড়ে ধরে শক্ত গলায় ডাক্তারের দিকে প্রশ্ন ছু-ড়ে দিলো,,
“কি বলছেন এইসব আপনি? আমার বোন তো কিছুক্ষন আগেও সুস্থ ছিলো৷ প্লিজ ডাঃ আপনি একটু দেখুন ওর কি হয়েছে? আমি আপনার কাছে হাত জোর করছি।”
ওমরের কন্ঠস্বর নিভে আসচ্ছিলো। চাপা আতৎনাদ বুক চিড়ে আসচ্ছিলো। কথা বলতে পারছে না। শরীর কাঁপছে। ওমরের কথা শুনে ডাঃ দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। মুখটা’কে আধার করে বললো,,
“নিজেদের সামলাও প্লিজ। তারিন সত্যি বেঁচে নেই। অতিরিক্ত মেন্টাল চাপে ব্রেন-স্টোক হয়েছে ওর। হসপিটালে নিয়ে আসতে তোমরা বড্ড দেরি করে ফেলেছো। আ’ম সো স্যারি। আমার কিছু করার নেই।”
বলে সে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। ওদের দুজনকে ফেস করার মতো শক্তি তার নেই। তাজওয়ার আর ওমর দুজনেই স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে আছে। শাহানাজ বেগম গলা ফাটিয়ে কেঁদে উঠলেন। আতৎনাদ করে বলে উঠলো,
“আমার পাপের শাস্তি এভাবে দিলি মা।”
তাজওয়ার নিজেকে আর সামলাতে পারলো না। দৌড়ে গেলো তারিনের কেবিনে। তারিনের নিস্তব্ধ দেহটা দেখে শক্ত করে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলো। চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“এই মেয়ে এই। চোখ খোলো। কি ভেবেছো আমাকে আঘাত করে এইভাবে বেঁচে যাবে। তাহলে ভুল ভাবছো। আমাকে আঘাত করার শাস্তি তোমাকে পেতেই হবে। চোখ খোলো বলছি। এই এই কথা বলো। দেখো আমি কিন্তু একদম মজা করছি না। এই মেয়ে শুনতে পারছো তুমি। আমার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু। বুক ফেটে যাচ্ছে। দেখো তুমি আমাকে এভাবে কষ্ট দিতে পারো না। চোখ খোলো না প্লিজ। একবার চোখ খোলো। আমরা আবার নতুন করে বাঁচব৷ আমাদের তো একসাথে নতুন করে সব শুরু করার কথা ছিলো। তাহলে তুমি হঠাৎ শান্ত হয়ে গেলে কেনো? চোখ খোলো না। তুমি এভাবে যেতে পারো না। স্বার্থপরের মতো আমাকে একা ছেড়ে যেতে পারো না। এই মেয়ে শুনতে পারছো? একবার ভাবলে না আমি কি করে বাঁচব?”
বলে কান্নায় ভেঙে পড়লো তাজওয়ার। ওমর দরজার সামনে দাড়িয়ে কাঁদছে। মেয়েটা এভাবে ধোকা দিয়ে দিলো সবাই? এটা কি স্বপ্ন নাকি সত্যি?
__

তারিনের লা’শটা তাজওয়ারদের বাসায় আনা হলো। পুরো বাড়ি জুড়ে শোকের ছায়া নেমে এলো। শাহানাজ বেগমকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে। মেয়েকে হারিয়ে আজ মেয়ের মূল্য বুঝতে পেরেছে। কথায় আছেনা হারানোর আগে মানুষ মূল্য দিতে জানে না। হারিয়ে গেলে মূল্য বুঝে৷ তার অবস্থা ও আজ তেমনি। তাজওয়ারকে কিছুতেই শান্ত করা যাচ্ছে না। ওমর কূল কিনারা পাচ্ছে না। তাজওয়ারকে রুমে বন্দি করে রাখা হয়েছে। নয়তো তাজওয়ারের থেকে তারিনকে ছাড়ানো যাচ্ছিলো না। শক্ত করে ধরে রেখেছিলো তারিন কে। তাই গোসল করানোর জন্য তারিনের লা’শটা নিয়ে যাওয়ার সময় অনেকে মিলে তাজওয়ারকে রুমে এনে বন্দী করে রেখেছে। তাও সে শান্ত হয় নি। দরজার ওপাশ থেকে ওর আতৎনাদ ভেসে আসচ্ছে। তারিনকে গোসল করানো শেষ হতেই দাফন করার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো। তখন ওমর তাজওয়ারকে নিতে আসলো। ওমরকে দেখেই তাজওয়ার ওর উপর হামলে পড়লো। অনেক কষ্টে সামলালো তাজওয়ারকে। নিয়ে গেলো কবরস্থানে। তারিনকে মাটির মধ্যে রাখতেই তাজওয়ার দৌড়ে গেলো। সবাইকে ধাক্কা মে’রে দূরে সরিয়ে দিতে দিতে বললো,
“এই কি করছেন আপনারা? ওর ঠান্ডা লেগে যাবে।”
বলে তারিনকে উঠানোর চেষ্টা করলো। তার আগেই সবাই ওকে ধরে ফেললো। তাজওয়ার এত জনের সাথে পেরে উঠলো না। খালি পাগলের মতো একেক টা বলতে লাগলো। তারিনকে মাটি দেওয়া শেষ হতেই হঠাৎই তাজওয়ার শান্ত হয়ে গেলো। হাটু ভেঙে বসে পড়লো নিচে। এর মধ্যেই আকাশের বুক ভেঙে নামলো শ্রাবন ধারা। সবাই ছুটে এদিক সেদিক চলে গেলো। ওমর আর তাজওয়ার শুধু বসে রইলো কবরের পাশে। তাজওয়ার অনেক ক্ষম থম মে’রে বসে থেকে বৃষ্টির শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে কেদে উঠলো। কবরটাকে জড়িয়ে ধরে গলা ফাটিয়ে আতৎনাদ করে উঠলো। ওমর হুহু করে কাঁদছে। তাজওয়ার তারিনের কবরটা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো,
“এমন শ্রাবনের এক সন্ধ্যায়৷ তুমি এসেছিলে ভুলে গেছো বুঝি। আর ঠিক তেমনি শ্রাবনের এক সন্ধ্যায় আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। অনেক স্বার্থপর তুমি। আচ্ছা ওরা কেনো আমাকে তোমার থেকে দূরে রাখতে চায়? একসাথে দুজনকে এখানে রেখেই হলো তাইনা। খুব ভালো হতো। একসাথে দুজন থাকতাম।”
বলে হাসলো। ওমর ওর কথায় আরো বেশি কেঁদে উঠলো। তাজওয়ার না থেমেই আবার বলতে লাগলো,
“দেখো সবাই চলে গেছে আমি যাই নি তোমাকে একা ফেলে। তোমার তো ভয় লাগবে তাইনা। আমি এখানেই থাকব। তোমাকে এভাবেই জড়িয়ে ধরে রাখব। এক মিনিটের জন্য ছাড়ব না। প্রমিস ছাড়ব না। ভালোবাসি তো তোমাকে। অনেক ভালোবাসি। তুমি স্বার্থপর। তাই বলে কি আমিও স্বার্থপর হবো। কখনোই না। এভাবেই থাকব আমি। এভাবেই।”

তখনের পর কে’টে গেলো এক সপ্তাহ। এই এক সপ্তাহে হাজার চেষ্টা করেও তাজওয়ারকে কবরের কাছ থেকে আনতে পারেনি কেউ। কেউ এগিয়ে গেলেই তাজওয়ার পাগলের মতো করে। কখনো ইট ছু’ড়ে মা’রে সবাইকে। আবার কখনো সেই ইট দিয়ে নিজেই নিজেকে আঘাত করে। ওমর প্রতিদিন বুঝিয়ে শুনিয়ে অল্পস্বল্প খাইয়ে দেয় তাজওয়ারকে। ওমর ছাড়া আর কেউ ওর গা ঘেষতে পারে না। ছেলেটা এক অনিশ্চিত জীবনে পা বাড়িয়েছে। এর শেষ কোথায় কারোর জানা নেই।

সবার জীবনে সুখ শব্দটা মানায় না। সবার জীবনের গল্পটা সুখ দিয়ে শেষ হয়না। কেউ কেউ সুখের ছোঁয়া পেলেই দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। সবার জীবন রঙিন হয় না। কারোর কারোর জীবন আধারেই ঢেকে থেকে। আলো ফুটে না চারদিকে। ভালোবাসা সুন্দর। ভালোবাসার মানুষগুলো আরো বেশি সুন্দর।

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে