শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পর্ব-১৪

0
1056

#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_চৌদ্দ

তারিন নিস্তব্দ। যেই মানুষটার এখন হসপিটালের বেডে মৃ’ত্যুর মুখে থাকার কথা সে ওর সামনে কি করে দাড়িয়ে আছে? ভাবতে পারলো না। চেষ্টা ও করছে না। নয়ন জোড়া জলে টইটম্বুর। জলের দাগ পড়ে গেছে গালে। ঠোঁট জোড়া চেপে আছে ও। হয়তো কান্না নিবারনের চেষ্টা। তাজওয়ার তারিন কে ছেড়ে ওর দুই গালে হাত রাখলো। অসহায়ের মতো করে বললো,
“আমি তোমাকে ঠকাইনি বৃষ্টি কন্যা। বিশ্বাস করো। ঠকাইনি তোমাকে।”

তারিন চেয়ে রইলো তাজওয়ারের মুখপানে। কিছু না বলে নিজের গাল থেকে তাজওয়ারের হাতটা ছাড়িয়ে নিলো। দূরত্বে সরে গেলো। কঠিন স্বরে বললো,,
“আপনি সুস্থ আছেন কি করে? আপনার তো এখন..?”
বলতে পারলো না। তার আগে তাজওয়ার ওর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললো,,
“আমার তো এখন হসপিটালে থাকার কথা তাইনা?”
তাজওয়ারের কথায় মাথা নাড়ালো তারিন। যার অর্থ দাড়ালো “হ্যাঁ “। তারিনের মাথা ঝুলানো দেখে তাজওয়ার হাসলো। শেরওয়ানির সামনের বোতাম গুলো খুলে “বুলেট প্রুফ” জ্যাকেট’টা দেখালো। তারিন কয়েকবার চোখের পাতা ঝাপটালো। অবাক নয়ন জোড়া নিয়ে তাঁকিয়ে রইলো তাজওয়ার দিকে। তাজওয়ারের মুখে হাসি। চোখে রহস্য। তারিন বুঝতে পারলো না কিছু। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাজওয়ার দিকে তাঁকিয়ে থাকায় তাজওয়ার উওর সমেত বললো,,,

“আমি জানতাম আমার লেডি কিলার কিছুতেই আমাকে অন্যের হতে দিবে না। যে মেয়ে স্বয়ং সুপারস্টারের দিকে গান তাক করে ভালোবাসাময় আবেদন দিতে পারে। আমার বিয়ের কথা শুনে। সে মেয়ে কিছুতেই বসে থাকবেনা। তোমার কথা অনুযায়ী আমি তোমার প্রতিশোধ। আবার ভালোবাসো? কি করে? ভালোবাসা আর প্রতিশোধ কি একসাথে হয়? হয়না তো। তোমার সাথে দেখা হওয়ার পর প্রত্যেক’টা মুহূত ভাবতাম। আমি কি করেছি? তোমার কোন ক্ষতিটা করেছি? তোমাকে তো আগে চিনতাম না জানতাম না। তাহলে, কেনো? কিসের এত রাগ আমার উপর? কিসের প্রতিশোধ নিতে চাও তুমি? কিন্তু উওর খুঁজে পাইনি। তোমার বিষয় বার বার জানতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছি আমি। মা সেদিন বিয়ের প্রোপজালটা দিতেই এই বুদ্ধিটা মাথায় আসলো। তাসনিমকে সাথে নিয়ে একটা রিস্ক নিয়েই নিলাম। কেনো যেনো মনে হয়েছিলো তুমি আমার বা তাসনিমের ক্ষতি করবেই। মনে না শিউর ছিলাম। তাও কোনো এক জায়গায় খটকা ছিলো। তাই তাসনিম আর আমার দুজনের বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পড়া ছিলো। আর আমার জানা মতে মানুষ যখন খুব বেশি রেগে থাকে। তখন গু’লিটা বুকের মধ্যে করে। এটা ভুল আমি জানি। মানুষ রেগে গেলে তার হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। যেকোনো জায়গায় আঘাত করতে পারে। এটাও জানি। কিন্তু তাও কোন আশায় ছিলাম আমি তাও জানিনা। যদি গু’লিটা তুমি বুকে না করে মাথায় করতে তাহলে, আমি এতক্ষনে উপর ওয়ালার কাছে ঠিকি চলে যেতাম। বলতে হবে আমি লাকি। তাই বেঁচে গেছি। তার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া।”

কথাগুলো শুনে তারিনের কপালে ভাঁজ পড়লো কয়েকটা। নেত্রজোড়া স্থির। হাত দুটো কাঁপছে। অনেক ক্ষন হাত থেকে রক্ত পড়ে সেই রক্ত শুকিয়ে রয়েছে। হাত দুটো সেই রক্তে লাল হয়ে আছে। তাজওয়ার এতক্ষন খেয়াল না করলেও এইবার ওর চোখ তারিনের হাতের দিকে গেলো। চোখ বড় বড় করে তাঁকালো সেদিকে। মেয়েটা কি সাইকো? কি করেছে নিজের? ভাবতেই এগিয়ে গেলো সেদিকে। তারিনের হাত জোড়া ধরতেই তারিন সরিয়ে নিলো নিজেকে। তাজওয়ার চেঁচিয়ে বললো,
“কি করেছো এইসব? ওহ মাই গড! কত রক্ত বেরিয়ে গেছে। আল্লাহ! প্লিজ চলো আগে হাতে ব্যান্ডেজ করে নাও। তারপর না হয় সব হিসেব মেটানো যাবে। প্লিজ চলো।”
তাজওয়ারের চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠলো অসহায়ত্ব। তারিন সেই চোখে তাঁকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো। ছেলেটা কি চায়? তারিন উওর দিতে সময় নিলো না। মুখ ফুটে বললো,,
“আমার বাবাকে কেনো কেড়ে নিয়েছিলেন তাজ? আমাকে তো ভালোবাসতেন তাহলে একবার কেনো আমাকে বিশ্বাস করেননি? আমাকে একা ফেলে কেনো চলে গিয়েছিলেন? এইসব প্রশ্নের উওর আপনাকে আজ দিতে’ই হবে।”

তারিনের প্রশ্নে তাজওয়ার থমকালো। অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো তারিনের দিকে। এই প্রশ্ন গুলোর উওর কি করে দিবে ও? ওর তো কিছু মনেই নেই? তাজওয়ার’কে চুপ থাকতে দেখে তারিন চেঁচালো। জিজ্ঞেস করলো,
“চুপ করে আছেন যে? উওর দিন প্লিজ। ”
তাজওয়ার কিছু বলার জন্য মুখ খুললো। তার আগেই তারিনের গালে সপাটে থা’প্প’ড় পড়লো। তারিন অবাক হলো না। ব্যাথা পেলো না। নিস্তব্দ থাকলো। ডানে মাথা ঘুরালো। জহির সাহেবের রাগী মুখখানা চোখে পড়লো। তা দেখে তারিন কেমন যেনো হাসলো। এ হাসিতে কষ্ট ছিলো না। সুখ ছিলো না। দুঃখ ছিলোনা। অভিমান ছিলো না। ছিলো এক আকাশ সমান আফসোস। বড্ড আফসোস। তারিন’কে থা’প্প’ড় মে’রেই জহির সাহেব চেঁচিয়ে বললো,
“তোকে এতটা ভালোবাসার দাম আমাকে এভাবে দিলি? এত বছর ছেলের শোক বুকে চা’পা দিয়ে তোর অপেক্ষায় ছিলাম। বিশ্বাস ছিলো তুই আসবি। খুঁজে বের করবি আমাদের। সবার ভুল ভেঙে দিবি। কিন্তু আজ তুই এ কি করলি? আমার সব বিশ্বাস,ভরসা ভেঙে দিলি।”

লাস্টের কথাটা খুব অসহায় শুনালো তার মুখে। তারিনের চোখ ছলছল করে উঠলো। রাইমা বেগম কেমন যেনো শান্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। তাজওয়ার এইবার গর্জে উঠলো। চেঁচিয়ে শুধালো,
“তুমি ও’কে দোষ দিচ্ছে কেনো বাবা? ওর জায়গায় তুমি, আমি বা যে কেউ থাকলে হয়তো এমনি করতাম। ও তো আমাকে ভালোবেসে পাঁচ বছর ধরে নিজে কষ্টে পেয়েছে তাও আমাকে আঘাত করে’নি। আর আমি হলে পাঁচ মিনিট ও অপেক্ষা করতাম না। ”
এইবার জহির সাহেবের টনক নড়লো। তাজওয়ারের কথায় রাইমা বেগম অবাক হলো। ওর তো কিছু মনে নেই তাহলে ও এতসব কিছু কি করে জানলো? প্রশ্নটা চেপে রাখতে পারলো না। মুখ ফুটে বললো,
“তাহমিদ বাবা৷ তোর সব মনে পড়ে গেছে? তুমি আমাকে চিনতে পারছিস? এখন আর মা’কে দূরে সরিয়ে রাখবি না তো? বল না তোর সব মনে পড়ে গেছে।”

উপস্থিত সবাই তার কথা বুঝলেও তারিন বুঝলো না। কি মনে পড়ে যাওয়ার কথা বলছে তিনি? কি হয়েছিলো? বুকের মধ্যে কেনো যেনো ঢিপঢিপ আওয়াজ শোনা গেলো। ভয় লাগছে কেনো ওর এত? আর কোন সত্যি জানা বাকি আছে? বুঝতে পারলো না। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে তাঁকালো ওদের দিকে। অস্পষ্ট স্বরে এলোমেলো ভাবে বললো,
“কি মনে পড়বে ওর? বড় মা বলো না কি মনে পড়বে ওর? বুঝতে পারছি না আমি কিছু?”

তারিনের প্রশ্নে উপস্থিত সবাই অবাক হলেও তাজওয়ার অবাক হলো না। কারন ও সবটা জানে। রাইমা বেগম চেঁচালো। ভারী কন্ঠে বললো,
“আর কত নাটক করবি তুই? আমার ছোট ছেলে’টাকে তো আমার বুক থেকে কেড়ে নিয়েছিস সাথে আমার বড় ছেলেটাকেও কেড়ে নিয়েছিস। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে আমার গর্ভের সন্তান আমাকে মন থেকে মা ডাকেনা। কাছে ঘেষতে দেয়না। দূরে দূরে রেখেছে আমাদের। শুধু মাত্র তোর জন্য আমার ছেলেটা আমার কাছে থেকেও দূরে ছিলো। তোর কাছে হাত জোড় করছি আমি। প্লিজ আর নাটক করিস না। ”

তারিন কয়েকপা পেছালো। মাথা ঘুরতে লাগলো। চোখ দুটো জ্বালাপোড়া করছে বড্ড। বুকের ভেতর খালি হয়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছে না কিছু। কথা ও বলতে পারছে না। কি করবে ও? প্রশ্ন করবে? কি প্রশ্ন করবে? বিশ্বাস করবে না তো কেউ। সবাই ভাববে নাটক করছি। তামজিদের কথা মনে পড়তে’ই দুই কানে হাত দিয়ে জোরে চেঁচিয়ে উঠলো। কান্নায় ভেঙে পড়লো। শব্দ করে বললো,
“আমি খু-ন করিনি। আমি খু-নি না। তোমার ছেলের খু-নি ওই রায়হান দেওয়ান। আমি খু-ন করিনি বিশ্বাস করো আমাকে। প্লিজ একটু বিশ্বাস করো। তোমাদের পায়ে পড়ছি আমাকে বিশ্বাস করো।”

বলে কাদতে কাদতে নিচে বসে পড়লো। শক্ত, দৃঢ়চেতা,প্রতিবাদী একটা মেয়ে’কে মুহূতেই এতটা দূর্বল হয়ে পড়তে দেখে তাজওয়ারের বুকের ভেতর এলোমেলো হয়ে গেলো। মেয়েটা আর কত কষ্ট সহ্য করবে। খু-নীর অপবাদ মাথায় নিয়ে এত বছর বেঁচে থাকা যায়?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে