শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পর্ব-১৩

0
760

#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_তেরো

ছোট থেকেই মায়ের অবহেলা, অপমানে বেড়ে উঠা মেয়ে’টা জানে আপন মানুষ’গুলো বড্ড নিষ্ঠুর। তাই আজ প্রিয় মানুষ গুলো’র থেকে পাওয়া আঘাত সহ্য করতে পারছে ও। কারাগারে দুই হাটু’তে মুখ গুঁজে নিস্তব্দ হয়ে বসে আছে তারিন। ওর চোখ থেকে এখন আর পানি পড়ছে না। নিস্তব্দ কারাগারে’র ভাপসা গরমে কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ছে তারিনে’র।
কিছুক্ষন আগে…
তখন জ্ঞান ফির’তেই নিজের চারপাশ ভর্তি লোক দেখতে পেলো তারিন। শুনতে পেলো ছেলে হারানো মায়ের আতৎনাদ। লাফিয়ে উঠে বসে পড়তে’ই কয়েকজন পুলিশ’কে চোখের সামনে দেখতে পেলো। পুলিশ দেখে’ই তারিন অসহায় চোখে পাশে তাঁকালো। সালমান সাহেব’কে দেখে তারিন শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো বাবা নামক মানুষ ‘টা ‘কে। সালমান সাহেব মেয়ে’কে দুই হাতে আকড়ে নিয়ে কেমন যেনো ফুঁপিয়ে কেদে উঠলো। পুলিশ কর্মকতা’দের একজন এসে সালমান সাহেবের সামনে দাড়িয়ে বললো….

–জহির সাহেবের ছোট ছেলে’কে খু/ন করার অপরাধে আমরা আপনার মেয়ে’কে এরেস্ট করতে বাধ্য হলাম স্যার ….

পুলিশের কথা শুনে তারিন আরো জোরে বাবা’কে চেপে ধরে জোরে বলে উঠলো….

–নাহ। বিশ্বাস করুন আমি খু”ন করি’নি। আমাকে থানায় নিয়ে যাবেন না প্লিজ। ও বাবা বলো না আমি কাউকে খু’ন করিনি। তাজ তাজ কোথায়? তাজ….

বলে জোরে তাজওয়ার’কে ডাকতে ডাকতে ছুটে গিয়ে চারপাশের ভীড়ের মধ্যে তাজওয়ার’কে ডাকতে লাগলো তারিন। কিন্তু কোথাও তাজওয়ার’কে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে তারিন হাটু ভেঙে বসে জোরে কান্না করে উঠলো। তারমানে তাজওয়ার ও বিশ্বাস করে নিয়েছে যে তামজিদ’কে ও খু/ন করেছে। কথা’টা বিশ্বাস করতে পারলো না তারিন। তাই আবারো ছুটে গেলো সালমান সাহেবের কাছে। পাগলের মতো বলতে লাগলো….

–বাবা তাজ’কে ডাকো। সবাই আমাকে অবিশ্বাস করলেও আমি জানি আমার তাজ কিছুতে’ই আমাকে অবিশ্বাস করবে না।

সালমান সাহেব’কে ছেড়ে তারিন এইবার ছুটে গেলো শাহানাজ বেগমের দিকে। শাহানাজ বেগমের দুই বাহুতে হাত রেখে বলতে লাগলো…

–মা ও মা তুমি তো আমার মা। তুমি তো জানো আমি এই কাজ কখনো করব না। তাও কেনো বলছো না সবাই’কে যে আমি তামজিদ’কে মা’রতে পারি না। প্লিজ বলো না সবাই’কে……

তারিনের কথা শেষ হতে না হতে’ই শাহানাজ বেগম সপাটে তারিনের গালে থা’প্প’ড় মে’রে বসলো। রাগান্বিত কন্ঠে বললো….

–তোকে জন্ম দেওয়া’টা হয়তো আমার জীবনের সব থেকে বড় ভুল। এই দিন’টা দেখা’র আগে কেনো ম’রে গেলি না তুই। অফিসার ও’কে প্লিজ আমার চোখের সামনে থেকে নিয়ে যান। সহ্য করতে পারছি না ও’কে আমি….

কথা’টা বলে শাহানাজ বেগম রুমের দিকে চলে গেলো। সালমান সাহেব সোফায় বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। তামজিদের লাশ’টা পোস্টমর্টেমের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাইমা বেগম জ্ঞান হারিয়ে পাশের রুমে রয়েছে। জহির সাহেব ও তাজওয়ারের দেখা নেই চারদিকে। মায়ের ঘৃনা যুক্ত কথাগুলো শুনে তারিন শান্ত হয়ে গেলো। আর শব্দ করলো না। থেমে গেলো ওর পাগলামি। কাঁদছে না। এর মধ্যে’ই টের পেলো কেউ ওর বাহু’তে ধরে বলছে….
–চলুন আমাদের সাথে…
তারিন শব্দ করলো না। অশ্রু ভর্তি চোখ নিয়ে শেষ বার বাবা’র দিকে একবার তাঁকালো। দেখলো মানুষ’টা কাঁদছে। হয়তো আজ মানুষ’টা নিরুপায়। তাই আটকাচ্ছে না ওদের। তারিন আশাভর্তি চোখ নিয়ে আবারো চারদিকে তাজওয়ারের খোঁজে তাঁকালো। এবার ও ব্যর্থ হলো তারিন। চুপচাপ কোনো চিৎকার চেঁচামেচি না করে চলে এলো পুলিশের সাথে।
“তারিন মা” চেনা কন্ঠস্বর শুনে তারিন মাথা তুললো। চোখের সামনে জহির সাহেব’কে দেখতে পেলো। মনের কোনে আশা জেগে উঠলো ওর। ঝটপট উঠে দাড়িয়ে দৌড়ে গেলো জহির সাহেবের দিকে। কান্না মিশ্রিত কন্ঠে অসহায়ের মতো বলে উঠলো….

–বিশ্বাস করো বড় বাবা আমি খু’ন করিনি। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো প্লিজ। এখানে থাকতে আমার দম বন্ধ হয়ে আসচ্ছে…..

তারিনের কথা শুনে জহির সাহেব তারিনের হাত জোড়া আকড়ে নিয়ে বললো…

–আমি জানি তুই এই কাজ করতে পারিস না। আমি তোকে বিশ্বাস করি। তুই যে আমার মেয়ে তোকে অবিশ্বাস করি কি করে বল? তোর বাবা ও যে নিরুপায় তাই এখানে আসতে পারছে না। আমি তোকে এক্ষুনি আমার সাথে নিয়ে যাব। চিন্তা করিস না……

বলে পুলিশ অফিসারের দিকে চলে গেলো। আর তারিন সেদিকে চোখ ভর্তি আশা নিয়ে তাঁকিয়ে আছে। জহির সাহেব সামনের চেয়ার’টায় বসে শান্ত কন্ঠে বললো…

–অফিসার এই কেস’টা আমি তুলে নিতে চাচ্ছি। কারন, আমার ছেলের খু’ন এই মেয়ে’টা করে’নি। ও’টা একটা এক্সিডেন্ট ছিলো। ভুলবশত ওর হাত লেগে আমার ছেলে নিচে পড়ে গেছে। এতে ওর কোনো দোষ নেই। ও নির্দোষ। দয়া করে একটা নিদোর্ষ মেয়ে’কে শাস্তি দিবেন না।

জহির সাহেবের কথা শুনে পুলিশ অফিসার তারিন’কে ছেড়ে দেওয়ার জন্য আদেশ দিলো। যার ছেলে’কে খু”নের দায়ী তারিন’কে আসামী করা হয়েছে সে নিজেই যখন কেস’টা তুলে নিতে চাচ্ছে। তারিনের পক্ষে সাক্ষী দিচ্ছে সেহেতু এর মধ্যে আর তার কোন হাত নেই। তারিন’ ছাড়া পেয়ে’ই জহির সাহেব’কে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো। সেদিন বাড়ি ফিরে তারিন নিস্তব্ধ,স্থির জড়ো বস্তু হয়ে গিয়েছিলো। যাকে বলে অধিক শোকে পাথর। তারপর থেকে সারা’টা দিন নিজের রুমে বন্দি হয়ে থাকতো তারিন। সবার অবিশ্বাস মনে যত’টা দাগ কে’টেছে তার থেকেও বেশি দাগ কে’টেছে তাজওয়ারের অবিশ্বাস।

“এক সপ্তাহ পর”
সেদিনের পর এক সপ্তাহ কেটে গেছে। এই কয়েকদিন তাজওয়ার একবারের জন্য ও তারিনের খোঁজ নেয়’নি। তারিন সব ব্যাথা কষ্ট ভুলে যতবার তাজওয়ার’কে ফোন দিয়েছে ততবার ফোন বন্ধ পেয়েছে। এই সাত দিন তারিন দম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় মতো করে কেদেছে। প্রতি নিয়ত অপেক্ষা করেছে তাজওয়ারের জন্য। কিন্তু ও আসে’নি। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া মন নিয়ে সাত দিনের অপেক্ষা’র পর আজ ছুটলো তাজওয়ার’দের বাসায়। প্রায় ১৫ মিনিটের মাথায় তাজওয়ার’দের বাসায় সামনে এসে গাড়ি থামতে’ই তারিন নেমে পড়লো। ভেতরে ঢোকা’র জন্য পা বাড়াতে’ই একটা অচেনা দারোয়ান এসে তারিন’কে আটকে দিয়ে বললো”কি চাই মা?” তারিন কিছুক্ষন অপ্রস্তুত ভাবে তাঁকিয়ে রইলো লোক’টার দিকে। এই লোক’টাকে তো ও চিনেনা। এটা তো তাজওয়ার’দের দারোয়ান না। তাহলে এনি কে? নতুন কেউ? প্রশ্ন’টা করেই বসলো তারিন”আসসালামু আলাইকুম চাচা। আপনি কি এখানে নতুন?”
লোক’টা হাসিমুখে সালামের উওর নিয়ে “হ্যা” বললো।

–আমি জহির সাহেব’দের পরিচিত। আপনি নতুন বলে আমাকে চিনছেন না “হাসি মুখে বললো তারিন”

দারোয়ান এইবার কপাল কুচকে বললো”ক্ষমা করো মা। এখানে জহির সাহেব বলে কেউ থাকে না এখন। আমার মালিক এখানে এসেছে সবে মাত্র তিন কি চারদিন হবে”

কথা’টা শুনেই তারিনের মাথায় যেনো বাজ পড়লো। তাজওয়ার’রা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে? তাজওয়ার তারিন’কে ভুল বুঝে সত্যি সত্যি চলে গেলো? আর ভাবতে পারলো না তারিন। মাথা ঘুরিয়ে উঠলো। নিজেকে সামলে বললো” কি বলছেন কি চাচা? উনারা নিজেদের বাড়ি রেখে কোথায় যাবে? আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে। আপনি একবার ডাকুন ওদের?”

–না মা আমার ভুল হচ্ছে না। তুমি ঠিক বলছো যে এই বাড়ি’টা জহির সাহেবের ছিলো। কিন্তু এখন নেই। তারা এই বাড়ি বেচে চলে গেছে। আমি লোক মুখে শুনলাম তার ছোট ছেলে’টা নাকি খু/ন হয়েছে। তাই বড় ছেলে’কে নিয়ে এখান থেকে চলে গেছে”

লোক’টা কথা শেষ না হতে’ই পেছন থেকে কেউ একজন ডেকে উঠলো। তারিন সেদিকে তাঁকিয়ে অপরিচিত একজন মধ্য বয়স্ক লোক’কে দেখতে পেলো। দারোয়ান তার ডাক পেয়ে সেদিকে ছুটলো। আর তারিন ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো। চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। ধীর স্থির পায়ে গাড়িতে উঠে বসলো। বাসায় এসে’ই নিজের রুমে চলে গেলো দৌড়ে। নিজের রুমে এসে দরজা’টা লাগিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে মেঝে’তে বসে পড়লো। পাগলের মতো বলতে লাগলো…

–আমাকে কেনো ঠকালে তাজ? একবার কি বিশ্বাস করা যেতো না আমাকে? আমাদের ভালোবাসা কি তবে মিথ্যা ছিলো? আমাকে ছেড়ে চলে গেলে তাজ? যেই সময়’টায় তোমাকে আমার বড্ড প্রয়োজন সেই সময়ে তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে। কেনো? একবার ও ভাবলে না আমি এত আঘাত সহ্য করে কি করে বেঁচে থাকব? এত’টা নিষ্ঠুর হতে পারলে তুমি? আমি তোমাকে সত্যি বাঁচতে পারব না তাজ…..

হুহু করে কান্না করে উঠলো তারিন। সহ্য করতে না পে’রে ভয়ংকর সিদ্ধান্ত’টা নিয়ে ফেললো। নিজের ওড়না’টা ফ্যানের সাথে বাঁধতে লাগলো। চেয়ারের উপর দাড়িয়ে গলায় ওড়না’টা প্যাচ দিয়ে বললো”আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা। আমি এত আঘাত সহ্য করতে বেঁচে থাকতে পারব না। খু’নের অপবাদ মাথায় নিয়ে বেঁচে থাকা সম্ভব না আমার”

বলে চেয়ার’টা পা দিয়ে ফেলে দেওয়া’র জন্য প্রস্তুত হতে’ই নিচ থেকে জোরে কান্না’র শব্দ ভেসে আসলো তারিনের কানে। এই চিৎকার’টা ওর মায়ের। মা হঠাৎ কেনো চিৎকার করে উঠলো বুঝতে পারলো না ও? তড়িঘড়ি করে সব ফেলে দৌড়ে গেলো নিচে। সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে’ই তারিন বজ্রাহত ভাবে চমকালো। শাহানাজ বেগম কাঁদছে। তারিন দৌড়ে ওর মায়ের কাছে যেতে’ই এই প্রথম শাহানাজ বেগম ও’কে জড়িয়ে ধরলো। কান্নায় ভেঙে পড়ে বলতে লাগলো” তোর বাবা’র গু-লি লেগেছে তারিন” কথা’টা তারিনের কান কব্দি গেলো কিনা বুঝতে পারলো না। শব্দ করলো না। কাঁদলো না। প্রশ্ন করলো “বাবা কোথায় আছে মা?” দেরি না করে মা-মেয়ে মিলে বেড়িয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্য। হসপিটালের গিয়ে’ শুনতে পেলো গু-লি’টা বের করা যায়’নি। ওর বাবা’র হাতে মাত্র কয়েক মিনিট সময় আছে৷ এবার ও কাদলো না তারিন। কেবিনে ঢুকে দেখলো রায়হান সাহেব ওর বাবা’র সামনে বসে কাঁদছে। সালমান সাহেবের মুখে অক্সিজেন। মাথা’টা পুরো সাদা ব্যান্ডেজে আবদ্ধ। হাতে-পায়ে বুকে বিভিন্ন যন্ত্র লাগানো। শাহানাজ বেগম ঢুকে’ই কান্নায় ভেঙে পড়লো। তারিন গিয়ে “বাবা” বলে ডাকতে’ই সালমান সাহেব চোখ মেলে তাঁকালো। ওই চোখের মধ্যে জমে আছে তীব্র যন্ত্রনা। তারিন ওর বাবা’র হাতের উপর হাত রাখতে’ই সালমান সাহেব ইশারায় অক্সিজেন’টা খুলতে বললো। তারিন অক্সিজেন’টা সরিয়ে দিতে’ই সে অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলো “তাজ আমাকে বাঁচতে দিলো না। ওর ভাইয়ের খু/নের বদলা নিয়ে নিলো”

এইটুকু কথাবলতে’ই অনেক’টা সময় লাগলো তার। তারিন এবার চমকালো না। কাঁদলো না। অবিশ্বাস করলো না। স্থির চোখে তাঁকিয়ে রইলো বাবা নামক মানুষ’টার দিকে। কয়েক মিনিটের মাথায় তারিনের মাথার উপর থেকে শেষ ছায়া’টাও চলে গেলো। এবার তারিনের আপন বলতে সত্যি কেউ রইলো না আর। একের পর এক চার’টা আঘাত পেয়ে মেয়ে’টা শান্ত হয়ে গেলো। ……[বাকি অতীত পরের পর্বে জানবেন]
____________________________________________
জোরে কোনো কিছু ভাঙার শব্দে তারিনের হুশ ফিরলো না। হন্তদন্ত হয়ে চোখ মেললো। চারদিকে তাঁকাতে’ই বুঝলো ও এতক্ষন অতীতে ডুবে ছিলো। সামনে তাঁকাতে’ই দেখলো তাজওয়ার দাড়িয়ে আছে৷ তাজওয়ার’কে দেখেই পিলে চমকালো তারিনের। কিছুক্ষন আগে এই ছেলে’টাকেই তো গু-লি ছুড়েছিলো ও? হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হলো? তাহলে সুস্থ ভাবে এখন দাড়িয়ে আছে কি করে? প্রশ্ন গুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তারিনের। চোখ বড় বড় করে তাঁকিয়ে আছে ও তাজওয়ারের দিকে। এর মধ্যে’ই তারিন টের পেলো তাজওয়ার’ও’কে ঝাপটে ধরলো। তারিন রেসপন্স করলো না। শুধু শুনতে পেলো

–কি করে সহ্য করেছিলে এতগুলো আঘাত?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে