শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পর্ব-১২

0
783

#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_বারো

” এ’টা আত্মহত্যা ছিলো না খু’ন ছিলো”

কথা’টা মনে মনে আওড়াতে’ই তারিনের শরীরের সমস্ত শক্তি ক্রমশ কমতে লাগলো। যদি খু’ন হয়ে থাকে তাহলে ওর শরীরে খু’নের কোনো চিহ্ন পাওয়া গেলো না কেনো? এইসব ভাবছিলো তারিন। এর মাঝেই ওর কানে আবারো ভেসে আসলো। ডান পাশে থাকা লোক’টা কেমন একটা চাপা স্বরে হুমকি দেওয়ার মতো করে বলছে…..

–তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমি কে? প্রানের ভয় যদি থেকে থাকে তাহলে সমস্ত প্রমান গুলো আমাকে দিয়ে দাও…..

লোক’টার কথা শুনে তামজিদ হাসলো। হেসে উওর দিলো…

–প্রানের ভয় আমার নেই বুঝলেন। যদি প্রানের ভয় থাকতো তাহলে সবার চোখের আড়ালে আপনার বাড়িতে প্রমান খোঁজার জন্য যেতাম না। আর যখন একবার প্রমান গুলো সব আমার হাতে এসে পড়েছে তখন শাস্তি আপনাকে পেতে’ই হবে…..

তামজিদের কথা শুনে লোক’টা কেমন যেনো বিশ্রি ভাবে হাসতে লাগলো। এই কন্ঠস্বর’টা তারিনের খুব চেনা। কিন্তু কে? কেনো মনে করতে পারছে না ও? কোথায় শুনেছে এই স্বর? এই কন্ঠস্বরের মালিক কে হতে পারে? লোক’টা হাসতে হাসতে বলে উঠলো…..

–খুব বড় ভুল করে ফেললে তামজিদ। নিজের প্রানের মায়া এত তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিলে ইয়াং ম্যান….

তামজিদ এইবার বেশ করা ভাবে উওর দিলো….

–আপনাদের মতো বি’ষধর সা’পের খোলশ’টা সবাইকে দেখানোর জন্য কিছু সময় নিজের জীবন স্যাক্রিফাইস করতে হয়……..

কথা’টা শেষ হতে না হতে’ই বিকট চিৎকারের শব্দে পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠলো। তারিনের সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো সামনের দৃশ্য’টা দেখে। তামজিদ যে এত ক্ষনে নিচে পড়ে গেছে তা তারিন বেশ বুঝতে পারছে। লোক’টা তামজিদ’কে ধাক্কা মে’রে ফেলে দিয়েছে নিচে। তারিন তামজিদ বলে জোরে চেঁচিয়ে দৌড় দিলো সামনের দিকে। কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারিন নিচের দিকে তাঁকাতে’ই লাইটের আলোয় স্পষ্ট তামজিদের রক্তাক্ত দেহ’টা দেখতে পেলো। তারিন পাশে ফিরে তাঁকাতে’ই দেখলো লোক’টা এখনো এখানে দাড়িয়ে। তারিন’কে দেখেই লোক’টা দৌড় দিতে’ই তারিন পেছন থেকে লোক’টার শার্ট খামচে ধরলো। লোক’টা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে তারিন’কে ধাক্কা মে’রে ফেলে দিলো। তারিন নিচে পড়ে যেতে’ই লোক’টা হয়তো ইচ্ছাকৃত ভাবে জুতা দিয়ে ওর হাতের উপর আঘাত করে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো। তারিন ব্যাথায় মৃদ্যু আতৎনাদ করে উঠলো। এর মধ্যে’ই নিচে চিৎকার চেঁচামেচি শব্দ ভেসে আসলো তারিনের কানে। তারিন পাগলের মতো নিচে উঁকি দিতে’ই দেখলো সবাই তামজিদের দেহ’টাকে ঘিরে কান্নায় ভেঙে পড়েছে। একটা শোক সইতে না সইতে আরেক’টা শোক হাজির। তারিন কেমন যেনো শব্দ করে কান্না করে উঠলো। তারিনের কান্নার শব্দ শুনে নিচের সবাই উপরে তাঁকালো। তারিন’কে দেখতে পেয়ে সবার মুখের রং বদলে গেলো। তারিন দৌড়ে নিচে নেমে এলো। তারিন নিচে নেমে আসতে’ই ওর উপর হামলে পড়লো রাইমা বেগম। তারিনের দুই বাহুতে চে’পে বলতে লাগলো……

–আমার ছেলে’টাকে মে’রে ফেললি তুই। কি ক্ষতি করেছিলো ও তোর। তোকে সবসময় মেয়ের মতো ভালোবেসেছি। আর আজ আমার ভালোবাসার এই দাম দিলি তুই আমাকে। কেনো এমন করলি তারিন? কেনো?

রাইমা বেগমের কথা শুনে তারিনের মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো। কি বলছে এইসব তিনি? তারিন অশ্রুসিক্ত চোখে সবার দিকে একবার তাঁকালো। সবাই তারিনের দিকে অবাক চোখে তাঁকিয়ে আছে। শুধুমাত্র তাজওয়ার ছাড়া। তাজওয়ারের চোখে তারিন কোনো কিছু খুঁজে পেলো না। ওই চোখের চাহনী ছিলো নিস্প্রান। অবাক,বিস্ময়, ঘৃনা কিছু ছিলো না। তারিন যেনো কথা বলতে যেয়েও পারছে না। শুধু সবার দিকে বোকা চাহনি দিচ্ছে। তারিনের বুক চেপে আসচ্ছে। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারিন খুব কষ্টে বলে উঠলো…

–কি বলছো এইসব তুমি বড় মা? আমি তামজিদ’কে কেনো মা’রব? তুমি ভুল বুঝছো আমাকে। আমি কিছু করিনি বিশ্বাস করো বড়মা। বিশ্বাস করো আ…

আর বলতে পারলো না। তার আগেই পাশ থেকে রাহান সাহেব জোরে বলে উঠলো…..

–আমি নিজের চোখে দেখেছি তুবা। তুমি আর তামজিদ ছাদে কিছু নিয়ে তর্কাতর্কি করছিলে। আর তর্কাতর্কি’র এক পর্যায় তোমার ধাক্কা খেয়ে’ই তামজিদ নিচে পড়ে যায়। তাহলে, এখন এইসব মিথ্যা কথা কেনো বলছো? নিজের অপরাধ’টা স্বীকার করে নিতে ভয় পাচ্ছো নাকি?

তারিন আর তাজওয়ার উভয় আকাশ থেকে পড়লো। সাথে উপস্থিত সবাই অবাকের শেষ সীমানায়। যেই মেয়ে আজ অব্দি কোনোদিন জোরে চেঁচিয়ে কথা অব্দি বলে না। সেই মেয়ে কিনা রাগের বশে একজন’কে ধাক্কা মে’রে ফেলে দিবে। কথা’টা সবাই বিশ্বাস করলেও সালমান সাহেব আর জহির সাহেব বিশ্বাস করতে পারলো না। সালমান সাহেব মেয়ে’কে দুই হাতে আকড়ে নিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলতে লাগলো…..

–তোমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি? কি বলছো এইসব। তারিনের সাথে আজ অব্দি কারোর সামান্য কথাকাটা হয়’নি। তাহলে, আজ কি এমন কারন থাকতে পারে যে তামজিদের গায়ে হাত দিয়ে ফেললো? তামজিদ’কে ও নিজের ভাইয়ের চোখে দেখে রাইমা। তুমি সেটা ভুলে গেছো?

রাইমা বেগম কান্না করতে করতে নিচে বসে পড়লো। ছেলে’কে হারানো যন্ত্রনা সইতে পারছে না। জহির সাহেব ও শোকে নিস্তব্ধ হয়ে আছে। কেউ কোনো কথা বলার ভাষা খুজে পাচ্ছেনা। সালমান সাহেবের কথার বিপরীতে রায়হান সাহেব বললো…..

–তামজিদ তোর মেয়ের মৃ’ত্যুর কারন…….

এইবার উপস্থিত সবাই আরেক দফা অবাক হলো। রাইমা বেগম তৎক্ষনাৎ দাড়িয়ে প্রশ্ন করে বসলো…..

–আপনি এইসব কি বলছেন রায়হান ভাই?

জহির সাহেব সহ উপস্থিত সবাই প্রশ্নত্তুর চোখে তাঁকিয়ে আছে রায়হান সাহেবের দিকে। রায়হান সাহেব হালকা কেশে বিষন্ন মুখে বললো….

–আমাদের রাহা তামজিদ’রে বহুত ভালোবাসতো। আর তামজিদ সকলের সামনে৷ যেখানে সেখানে আমাদের রাহা’কে অপমান করতো। এই শোক সইতে না পেরে মেয়ে’টা…..

এইটুকু বলে কেমন যেনো মরা কান্না জুড়ে দিলো। তাজওয়ার এত ক্ষন পর গর্জে উঠে বললো….

–যথার্থ প্রমান ছাড়া আপনি আমার ভাই’কে দোষারপ করতে পারেন না আংকেল। আপনার কাছে কি প্রমান আছে যে রাহা তামজিদের জন্যই সুই’সাইড করেছে। রাহা তো কাল রাতে সুই’সাইড করেছে আর কাল রাতে রাহা আপনাদের ওইখানে ছিলো। কাল তো ওইখানে তামজিদ ছিলো না। তাহলে এর পেছনে অন্য কারন আছে। আর সেই কারন’টাকে ধামাচা’পা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে…..

তাজওয়ারের কথা শুনে রায়হান সাহেব ঢোক গিললো। আমতা আমতা করে বললো….

–তুমি কিন্তু আমাকে অপমান করছো তাহমিদ…

তাজওয়ার এইবার রায়হান সাহেবের সামনে এসে উনার চোখে চোখ রেখে বললো…..

–আপনি যেমন সত্যি’টা জানেন না। তেমনি আমরা ও জানিনা। তাহলে কোনো প্রমান ছাড়া আপনি কি করে আমার ভাইয়ের উপর দোষ দিচ্ছেন?

রায়হান সাহেব এইবার থামলো কিছুক্ষন। তারপর পুরো বিষয়’টা ঘুরিয়ে তারিন’কে উদ্দেশ্য করে বললো….

–ও’কে এটা না হয় প্রমান ছাড়া তোমরা বিশ্বাস করছো না। কিন্তু, তোমার ভাই’কে তো তোমাদের চোখের সামনে’ই তারিন ধাক্কা মে’রে ফেলে দিলো। নাকি এটাও বিশ্বাস করানোর জন্য প্রমান লাগবে তোমার?

এইবার তাজ চুপ করে গেলো। তারিন শক্ত মূতির মতো সব’টা শুনে যাচ্ছে। রাইমা বেগমের পাশেই শাহানাজ বেগম বসে আছে। কিছু বলছে না। এই পরিস্থিতিতে তার কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। তারিন’কে যতই অবহেলা করুক। কিন্তু, সে মনে প্রানে এটা বিশ্বাস করে যে তারিন কিছুতে’ই কাউকে মা’র’তে পারেনা। রাইমা বেগম এইবার চিৎকার করে বলে উঠলো….

–তোমরা আল্লাহ’রস্তে চুপ করো। আমার ছেলে’টাকে একটু দয়া করে হসপিটালে নিয়ে চলো। প্লিজ আমি তোমাদের কাছে হাত জোড় করছি ও বেচে আছে। দেখো আমার তামজিদ আমাকে এক্ষুনি মা বলে জড়িয়ে ধরবে। ও কিছুতে’ই ওর মায়ের কান্না সহ্য করতে পারে না৷ ও’কে একটু বলো না চোখ খুলতে । ওর কত রক্ত বের হচ্ছে দেখো? ওর কষ্ট হচ্ছে তো…..

পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো রাইমা বেগম। তাজওয়ারের চোখেও পানি। মা’কে স্বান্তনা দেওয়া ভাষা ওর জানা নেই। জহির সাহেব আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। কাঁদতে কাঁদতে ছেলের পায়ের কাছে বসে পড়লো। তাজওয়ার গিয়ে ওর মা’য়ের সামনে বসতে’ই রাইমা বেগম তাজ’কে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো আবারো বলে উঠলো…..

–আমার তামজিদ’কে একবার বলনা চোখ মেলে তাঁকাতে। তুই বললে ও শুনবে। তোর কোনো কথা কি ও ফেলতে পারে বল? তুই একবার বল তাহলে দেখিস ও উঠবে। বলনা একবার…..

তাজওয়ার আর সহ্য করতে পারলো না। জোরে চেঁচিয়ে বললো…..

–তামজিদ আর নেই মা। তামজিদ ম’রে গেছে। চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। চলে গেছে….

বলে রাইমা বেগম’কে জড়িয়ে কান্না করে উঠলো। তারিনের চোখের সামনে এত কিছু সহ্য করতে পারলো না। কেমন শূন্য হয়ে গেলো সব কিছু। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসলো। মাথা’টা ধরে আর ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারলো না। মুহূতে’ই নিচে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারালো….

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে