শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় পর্ব-১১

0
1017

#শ্রাবণের_এক_সন্ধ্যায়
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#পর্ব_এগারো

সোফার উপর এলোমেলোহীন ভাবে হেলান দিয়ে বসে আছে তারিন। ওর চোখের দৃষ্টি উপরের দিকে স্থির হয়ে আছে। তারিনের চুল গুলো কেমন এলোমেলো। চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে জলে টইটম্বুর হয়ে আছে। হাতের মধ্যে খামচানোর দাগ। ক্ষত স্থান গুলো থেকে রক্ত বের হচ্ছে। হাতের তালু থেকে গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে। এমন করে কিছুক্ষন চলতে থাকলে তারিন রক্ত শূন্য হয়ে’ই মা’রা যাবে। গায়ের গহনা গুলো এখন আর সাথে নেই৷ সাদা লেহেঙ্গা’টায় রক্তের ছোপ ছোপ দাগ লেগে আছে। ও’কে দেখে বিধ্বস্ত লাগছে। ঠোঁট গুলো কাঁপছে। বুকের ভেতরের যন্ত্রনা’টা সইতে পারছে না। পুরো বাড়িতে তারিন একা। তাজওয়ার’কে সবাই মিলে হসপিটালে নিয়ে গেছে।তারিন চোখ দুটো বন্ধ করে নিয়ে ডুব দিলো অতীতে…..

🌼””অতীত””🌼

“তারিনের বাবা সালমান সাহেব ছিলেন নামকরা ব্যবসায়ী। ঢাকার বড় বড় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ স্থানে ছিলো তার নাম। সালমান সাহেব ও শাহানাজ বেগমের বড় মেয়ে তারিন। আর ছোট মেয়ে রাহা। তারিন আর রাহা ছিলো জমজ বোন। তবে কেউ ওদের বলবে না জমজ। তারিন ফর্সা তো রাহা ছিলো শ্যামবর্ণের অধিকারীনি। তারিনের চুল গুলো মাঝারী সাইজের বড় হলেও রাহার চুল ছিলো হাটু অব্দি। মূলত রাহার সৌন্দর্য প্রকাশ পেতো ওর চুলে। আর তারিনের সৌন্দর্য ওর মুখের অতল মায়ায়। ওদের ছোট্ট পরিবারে ছিলোনা কোনো কষ্ট। তারিন আর রাহা দুজনেই একসাথে পড়ালেখা করছিলো। জহির, রায়হান ও সালমান সাহেব ছিলো তিনবন্ধু। ব্যবসার খাতিরে ছিলো তাদের পরিচয়। কিন্তু জহির সাহেবের চেয়ে সালমান সাহেব ও রায়হান দেওয়ানের নাম ডাক ছিলো বেশি। তাই সালমান কিছু’টা অপছন্দ ও করতো জহির সাহেব’কে। অন্য’দিকে তাজওয়ার আর তামজিদ ছিলো বছর তিনেকের ছোট বড়। ছোট থেকেই তাজওয়ার আর তারিনের বড্ড ভাব ছিলো। তাজওয়ার তারিনের বয়সের তফাৎ বেশি ছিলো না। বন্ধুত্বের সম্পর্কে’র খাতিরে তারিন’দের বাসায় আসা যাওয়া চলতো তাজওয়ার’দের। এভাবেই বড় হয়ে উঠছিলো ওরা। যখন তারিন সবে এস এস সি ব্যাচ তখন তাজওয়ার নিজের অনুভূতির কথা তারিন’কে জানিয়েছিলো। তারিন ও সেদিন ফিরিয়ে দিতে পারে’নি তাজওয়ার’কে। মুচকি হেসে তাজওয়ারের ভালোবাসার চাদরে নিজেকে জড়িয়ে নেয়। তারিন ছোট থেকেই অনেক’টা ভীতু ছিলো। আর রাহা ছিলো রাগী বদমেজাজি, প্রতিবাদী। তামজিদের উপর রাহা বরাবর দূর্বল ছিলো। নিজেই তামজিদের কাছে ভালোবাসা দাবী নিয়ে গেলে তামজিদ বরাবরেই রাহা’কে অপমান, অবজ্ঞা করে ফিরিয়ে দিয়েছে। তামজিদ মূলত ছিলো প্লে বয় টাইপের। দিনে দুই তিন’টা মেয়ে’কে নিয়ে ঘোরাঘুরি করা ছিলো ওর শখের মধ্যে অন্যতম৷ তামজিদ খুব ভালো করেই জানে রাহা কেমন মেয়ে। রাহা’র সাথে রিলেশনে গেলে অন্য কোনো মেয়ের দিকে যে তাঁকাতে অব্দি পারবে না তাই রাহা’র প্রতি খানিক দূর্বল হলেও রাহা’র প্রোপজাল গ্রহন করে’নি।

“দিন’টা ছিলো শনিবার”

তারিন আর রাহা দুজনেই সবে মাত্র কলেজে নতুন। প্রথম দিন কলেজে যাওয়ার জন্য তারিন রেডি হয়ে রাহা’র রুমে আসতে’ই দেখলো ভেতর থেকে রাহা’র রুম’টা বন্ধ। আজ অব্দি কোনোদিন রাহা ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে না। দরজা’টা হঠাৎ বন্ধ দেখে তারিনের বুকের ভেতর’টা কেমন যেনো করে উঠলো। উচ্চস্বরে রাহা’কে ডাকতে লাগলো….

–রাহা কোথায় তুই? দরজা খোল। হঠাৎ আজ দরজা বন্ধ করেছিস কেনো? রাহা…..

তারিনে একাধারে অনেক ক্ষন যাবৎ ডাকাডাকি করার পর ও রাহা’র কোনো সাড়া না পেয়ে ওর বাবা-মা’কে ডেকে আনলো। সবাই মিলে অনেকক্ষন চেষ্টা করেও রাহা’র কোনো সাড়া পায় না। ভয়ে তারিন আর শাহানাজ বেগম দুজনে’ই কান্নাকাটি শুরু করে দিলো। দারোয়ান’কে ডেকে এনে সালমান সাহেব আর দারোয়ান মিলে দরজা’টা ভেঙে ভেতরে ঢুকতে’ই ফ্যানের সাথে রাহার দেহ’টা ঝুলতে দেখে সালমান সাহেব থমকে গেলো। শাহানাজ বেগম আর তারিন দুজনেই চিৎকার করে গিয়ে রাহা’র পা দুটো আকড়ে ধরলো। মুহূতে’ই হাসি খুশি একটা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে গেলো। প্রিয়জন হারানোর ব্যাথায় সেই বাড়ির বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। ছোট মেয়ে’কে হারিয়ে সালমান সাহেব আর শাহানাজ বেগম পাগল প্রায়। ছোট থেকেই শাহানাজ বেগমের সব থেকে আদরের ছিলো রাহা। আর সালমানের সাহেবের আদরের ছিলো তারিন। সালমান সাহেব দুই মেয়ে’কে সমান চোখে দেখলেও শাহানাজ বেগম ছোট থেকে’ই তারিন’কে সব কিছুতে কম গুরুত্ব দিয়েছে। এর কারন তারিন আজো জানেনা৷ মায়ের অবহেলা দেখেও সব’টা হাসি মুখে মেনে নেওয়ার পাত্রী ছিলো তারিন। রাহা’র লাশের খাটিয়ার সামনে তারিন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সবে মাত্র হসপিটালের থেকে রাহা’র লাশ’টা বাসায় দিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ একটা সাদা কাপড়ে মোড়ানো রাহার শরীর। পা দুটো বাইরে বের হয়ে রয়েছে। রাহা’র সারারুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনো সু”ইসাইড নোট পাওয়া যায়’নি। আবার মা”র্ডারের ও কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়’নি। ডাক্তার ও জানিয়েছে এটা কোনো মা”র্ডার নয় এটা আত্মহ’ত্যা। তারিন কাঁদতে পারছে না। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে কিন্তু ও কাদছে না। শুধু ভাবছে হঠাৎ কেনো রাহা এই ভয়ংকর সিদ্ধান্ত’টা নিলো। কি ঘটেছিলো ওর সাথে? কেনো এমন করলো? শাহানাজ বেগম’কে রাইমা বেগম স্বান্তনা দিচ্ছে। আর সালমান সাহেব শোকে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। মেয়ের নিস্তব্ধ দেহ’টার দিকে এক নজরে তাঁকিয়ে আছে৷ সালমান সাহেবের দুই পাশে’ বসে আছে রায়হান দেওয়ান আর জহির সাহেব। শোকের বাড়ি’তে সবার চোখের আড়ালে এক জোড়া লোভাতুর চোখ তারিনের দিকে তাঁকিয়ে আছে। সেই চোখে নেই কোনো শোক, নেই কোনো ভয়-ডর। আছে শুধু লোভ। রাহা’র লাশের দিকে তাঁকিয়ে পৈশাচিক আনন্দ নিয়ে তাঁকিয়ে আছে এক জোড়া নির্মম মায়াহীন চোখ। এই চোখ জোড়ার মালিকের খোঁজ উপস্থিত কেউ জানেনা। কেউ দেখতেও পায়’নি। তামজিদ আর তাজওয়ার দূরে দাড়িয়ে আছে। তারিনের বিধ্বস্ত চেহারা দেখেও তাজওয়ার সামনে এগিয়ে আসার সাহস পাচ্ছে না। মেয়ে’টাকে স্বান্তনা দেওয়ার জন্য বুকে জড়িয়ে নিতে পারছে না। তামজিদের চোখেও পানি। অজানা কষ্টে বুক’টা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ওর। মেয়ে’টা তো কাল রাতেও কত আনন্দ করছিলো। হঠাৎ কি হয়ে গেলো ভাবতে পারছে না কেউ?

ঘরের সব আলো নিভিয়ে রুমের দরজা আটকে বিছানায় হাত পা গুটিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তারিন। রাহা’কে বিকেলে দাফন করা হয়েছে। রাহা’কে যখন দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় তখন তারিন শুধু দূর থেকে দাড়িয়ে অশ্রু ভেজা চোখ নিয়ে দেখছিলো। ওর মনে হচ্ছিলো ওর কলিজা’টা কেউ ছিড়ে নিয়ে যাচ্ছে। কথাগুলো মনে উঠতে’ই তারিনের পাগলের মতো কাঁদতে লাগলো। দরজা’র ওপাশ থেকে একটা পুরুষানালী কন্ঠ স্বর ভেসে আসচ্ছে। তারিন বেশ বুঝতে পারছে কন্ঠ’টা কার। উঠে গিয়ে দরজা খুলে’ই হামলে পড়ে বাবা নামক পুরুষের বুকে। বোন আর বাবা নামক মানুষ দুটো’কে ঘিরেই তারিন বেঁচে ছিলো। কথায় আছে না” বেশি প্রিয়’রা কুয়াশার মতো হয়। একসময় রোদ উঠলে যেমন কুয়াশা’র চিহ্ন থাকে না। তেমনি বেশি প্রিয়’রাও খুব শিঘ্রই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়”। সালমান সাহেব মেয়ে’কে কি বলে স্বান্তনা দিবে খুঁজে পাচ্ছে না। তারিন কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো….

–বাবা কেনো আমার প্রিয় মানুষগুলো’কে হারাতে হয় বার বার? কি দোষ করেছি আমি?, জন্মের পর থেকে মায়ের অবহেলা পেয়ে এসেছি। দুই বোন’কে দুই চোখে দেখে আসতে দেখেছি। একটুও আফসোস ছিলোনা তার জন্য। তাহলে আজ কেনো আমার বোন’টা আমাকে ছেড়ে চলে গেলো? আমি সহ্য করতে পারছিনা বাবা। সহ্য করতে পারছি না……….

বলে সালমান সাহেব’কে ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে ছাদের দিকে চলে গেলো। আর সালমান সাহেব হুহু করে কান্নায় ভেঙে পড়লো। এক নিমিশেই তার হাসি খুশি পরিবার’টা ভেঙে গেলো। চোখের পলকে সব ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো।
____________________________________________
তারিন ছাদের দরজা’র সামনে আসতে’ই দুজনের কথপোকথন শুনতে পেলো। তামজিদের কন্ঠস্বর’টা চিনতে পারলেও অন্য পুরুষের কন্ঠস্বর’টা ঠিক আন্দাজ করতে পারলো না তারিন। কেমন যেনো খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু চিনতে পারছে না কন্ঠস্বর’টা কার? দরজা হালকা খুলে উঁকি দিতে’ই ছাদের পশ্চিম কর্নারে দুজন’কে মুখোমুখি দাড়িয়ে থাকতে দেখলো। কিন্তু অন্ধকারে দুজনের চেহারা’ই চিনতে পারা সম্ভব হচ্ছে না ওর। তামজিদের কন্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলো বাম পাশের’টা তামজিদ। তাহলে, ডান পাশের’টা কে? এই প্রশ্ন’টা মাথায় ঘুরপাক খেতে’ই ওদের দুজনের কথা তারিনের কানে এলো। চাদের আলোয় তারিন স্পষ্ট দেখতে পারছে তামজিদ লোক’টার কলার চেপে ধরে বলছে….

–আপনি এত’টা নিচ হতে কি করে পারলেন? ছিঃ লজ্জা হচ্ছে আমার আপনার উপর। মেয়ের বয়সী একটা মেয়ে’কে এত’টা নির্মম ভাবে মার’তে পারলেন আপনি? এমন’কি ওর পোস্টমর্টেম রির্পোট’টা অব্দি পাল্টে দিলেন। পুলিশ, ডাক্তার সবাই’কে হাত করে নিয়ে খুন’টাকে কত সুন্দর আত্মহত্যা বলে ধামাচাপা দিয়ে দিলেন। কি ক্ষতি করেছিলো ও আপনার? কেনো এমন করলেন আপনি? আমি এক্ষুনি পুরো সত্যি’টা সবাই’কে জানিয়ে দিব……..

কথাগুলো কানে আসতে’ই তারিনের মাথা ভনভন করে ঘুরতে লাগলো। রাহা’কে খু”ন করা হয়েছে? এই লোক’টা কে?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে