শেষ বিকেলের রোদ-৩য় পর্ব
©শাহরিয়ার
— রিক্সাওয়ালা মামার ডাকে বাস্তবে ফিরে আসলাম। রিক্সা ভাড়া দিয়ে এক দৌড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকতে যাবো অমনি দরজার সামনে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেলাম।
— উফ বলে চোখ মেলে তাকাতেই দেখতে পেলাম সোহান আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে।
— দেখে চলতে পারো না?
— সোহান চোখ কপালে থাকলে কি আর দেখে চলা যায়রে ফুলটুসি? বলেই আমার কপালে হাত দিয়ে চশমাটা নামিয়ে চোখে পড়িয়ে দিলো।
— সকালে কোথায় ছিলে?
–সোহান তোকে বলতে হবে নাকি আমার?
— হ্যাঁ আমাকে বলতে হবে।
— সোহান তার আগে তুই বল এভাবে পাগলের দৌঁড়ে বাড়ির ভিতর ঢুকতেছিলি কেন? পাগলা কুকুর তাড়া করছিলো?
— একদম ভালো হবে না উল্টা পাল্টা কথা বলবে না বলে দিলাম। কথাটা বলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে বুঝতে পাড়লাম ধাক্কা লেগে পড়ে যাবার পর পায়ে ব্যাথা পেয়েছি। তাই চুপ করে সেখানেই বসে রইলাম ততক্ষণে সোহান উঠে দাঁড়িয়েছে।
— সোহান হাত বাড়িয়ে দিয়ে এভাবেই বসে থাকবি নাকি বাড়ির ভিতর ঢুকবি?
— অভিমান করে বললাম একাই উঠতে পারবো। তারপর আরেক বার উঠার চেষ্টা করেও বিফল হলাম।
— সোহান এবার নিজেই হাত ধরে টেনে তুলতে শুরু করলো।
— ব্যথায় উফ করে উঠলাম।
— দেখে চলতে পারিস না।
— আমি বোধয় আর হাঁটতেই পারবো না বলেই আবার মাটিতে বসে পড়লাম।
— সোহান এই তোর কি সত্যি সত্যি ব্যাথা লেগেছে?
— রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে তোমার সাথে কি আমি ইয়ার্কি করছি?
— সোহান না ঠিক তা না তবুও বলাতো যায়না।
— কি বলা যায় না?
— সোহান কিছুনা বলেই পাজা করে কোলে তুলে নিলো,
— এই কি করছো ছাড়ো আমাকে পড়ে যাবো বলেই আরও শক্ত করে সোহানের কাঁধ চেঁপে ধরলাম। (মনে মনে মজা বোঝ কেমন লাগে)
— সোহান বাড়ির ভিতর ঢুকতে ঢুকতে আচ্ছা ফুলটুসি তোকেতো অতটা মোটা দেখায় না যতটা তোর ওজন।
— কি বললা তুমি আমি মোটা আমার অনেক ওজন?
— সোহান কখন বললাম তুই মোটা? আমিতো বললাম
— থাক হয়েছে আর কিছু বলতে হবে না। আমি যেমন তেমনি ভালো।
— সোহান রুমের দরজার সামনে এসে ছোট মা ও ছোট মা।
— মা কিরে বাবা কি হয়েছে আর ওরো কোলে তুলে রাখছিস কেন?
— সোহান তোমার মেয়ে পাগলের মত কোথায় থেকে যেন দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এসে আমার গায়ের উপড় পড়লো। দেখতো ছোট মা আমার কোথাও লাগছে নাকি, কোথাও ফাটছে নাকি?
— মা তোরতো কোথাও লাগেনি,
— সোহান আমিও তো তাই বলি, আমার কোথাও লাগেনি কিন্তু তোমার মেয়ের কোমড় ভেঙেছে আমার উপড়ে পড়ে। নেও তোমার মেয়েকে ঘরে নিয়ে যাও বলে কোল থেকে নামিয়ে দিলো।
— মা আমাকে ধরে ঘরে ঢুকাচ্ছে, সোহান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, আমি চোখ বড় বড় করে তাকাতেই সে হেসে চলে গেলো।
— সন্ধ্যার দিকে পায়ের ব্যাথা কিছুটা কমার পর নিচে নেমে দেখি সোহান ঘরে নেই। আমি কিচেনে যেয়ে দুই মগ চা বানিয়ে নিয়ে ছাদে আসতেই সোহান আমাকে দেখে বলতে শুরু করলো কিরে তোর পা ভালো হয়ে গেছে?
— চায়ের মগ এগিয়ে দিতে দিতে তুমি কি চাও আমি পা ভেঙে সারা জীবন ঘরে বসে থাকি?
— সোহান আমি কখন তা বললাম?
— তাইতো মনে হয় তোমার কথা শুনে।
— সোহান চায়ের মগে চুমুক দিতে দিতে নারে আমার এমন কোন চাওয়া নেই।
— সরি!
— সোহান কেন?
— তোমার সাথে গতকাল আমার এমন ব্যবহার করা মোটেও উচিৎ হয়নি।
— সোহান তুই সরি বলবি কেন? সরিতো আমার বলা উচিৎ আসলেইতো এমন হুটহাট করে তোর রুমে যাওয়া আমার উচিৎ নয়।
— হয়েছে হয়েছে এতো কিছু বলতে হবে না এখন। তোমার দেয়া বই দু’টো আমার খুব পছন্দ হইছে। নতুন বই কবে দিবে তা বলো।
— সোহান কবে লাগবে তা বল?
— তার আগে বলো সকালে কোথায় গিয়েছিলে?
— সোহান আর বলিস না এক স্টুডেন্টের পরীক্ষা চলছে তাই খুব ভোরে উঠে ওকে পড়াতে চলে গিয়েছিলাম।
— স্টুডেন্ট ছেলে নাকি মেয়ে?
— সোহান আমার দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ছেলে কেন?
— না এমনি। তা স্টুডেন্টের কোন বড় বোন আছে নাকি?
— সোহান আছেতো কেন কি করবি?
— ভাবতাছি ভালো একটা মেয়ে পেলে তোমাকে বিয়ে দিয়ে দিবো।
— সোহান ও আচ্ছা তাহলে স্টুডেন্টের বড় বোনকে বলতে হবে তার স্বামীকে ছেড়ে তোর সাথে দেখা করার জন্য।
— আমার সাথে ফাজলামো করো বলেই কফির মগ রেখে সোহানের বুকে ঘুষি মারতে শুরু করলাম।
— সোহান এই কি করছিস ব্যাথা পাচ্ছিতো। বলতে বলতে দু’হাত চেঁপে ধরলো।
— ছাড়ো ব্যথা পাচ্ছিতো।
— সোহান না ছাড়বো না, আমি ব্যাথা পাইনা যখন আমাকে মারিস?
— আমার এই নরম হাতের মারে তুমি ব্যথা পাও?
— সোহান ও তাই বুঝি?
— হ্যাঁ তাইতো দেখ দেখ কেমন লাল বানিয়ে ফেলেছো।
— সোহান হাতটা ছেড়ে দিয়ে আচ্ছা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু মনে রাখিস এরপর যদি আমার সাথে লাগতে আসিস তো খবর আছে।
— কি খবর করবে তুমি শুনি?
— সোহান তখনি টের পাবি কি খবর করি।
— সাহস আছে তোমার বলেই সোহানের দিকে তাকালাম, বাতাসে আমার খোলা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে সব চোখের সামনে এসে পড়লো।
সোহান হাত দিয়ে সেগুলে সরিয়ে দিতে দিতে বললো সব জায়গায় আর সবার সাথে সব রকম সাহস দেখাতে নেই।
— আমি অপলক সোহানের দিকে চেয়ে রইলাম, সে আস্তে আস্তে হেঁটে ছাদ থেকে নেমে যাচ্ছে। আমি কফির মগ দু’টো হাতে নিয়ে আরও কিছুটা সময় সেখানে দাঁড়িয়ে রইলাম। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হতেই আমি দ্রুত নেমে পড়লাম ছাদ থেকে। রুমে এসে বই নিয়ে টেবিলে পড়তে বসলাম।
— রাতে মা এস খাবার জন্য ডাক দিলো, আমি বই গুলো গুছিয়ে ফারজুর বিয়ের কার্ডটা হাতে নিয়ে ডাইনিং এ চলে আসলাম। সেখানে বাড়ির সকলে উপস্থিত আছে। আমি কার্ডটা বাবার হাতে দিয়ে বললাম ফারজুর বিয়ে শুক্রবার।
— বাবা কার্ডটা খুলে হাতিয়ে দেখে কিন্তু মা আমিতো তোকে নিয়ে যেতে পারবো না। ঐদিন আমি আর তোর বড় চাচা একটু ব্যবসার কাজে বাহিরে থাকবো।
— তাহলে আমাকে কে নিয়ে যাবে?
— বড় চাচা কে আবার? এ বাড়িতে একজন বেকার ছেলে আছে তা কি ভুলে গেছিস? ওই তোকে নিয়ে যাবে।
— এভাবে কেন বলো তোমরা সব সময়? ভাইয়া কি ইচ্ছে করে বাড়িতে বসে থাকে? জব হচ্ছে না তাই বসে আছে।
— বড় চাচা মানুষ কি লেখাপড়া শেষে শুধুই জব করে? তারা কি ব্যবসা বানিজ্য কিছু করে না? কতদিন বলেছি আমাদের পারিবারিক এতো বড় ব্যবসা বুঝে নেবার জন্য সেতো তা নিবে না।
— হয়েছে হয়েছে এখন খাওতো তোমরা। সোহান মাথা নিচু করে খাবার খাচ্ছে কোন কথা বলছে না। একটা মানুষের এতো ধৈর্য হয় কি করে তা আমার জানা নেই।
— বড় চাচা আমি টাকা রেখে যাবো ইকরাকে সঙ্গে নিয়ে যেয়ে ভালো দেখে গিফট কিনে নিয়ে আসবি কাল।
— সোহান জ্বি টাকা লাগবে না আমার কাছে টাকা আছে।
— বড় চাচা বিয়াদপ কোথাকার কত টাকা আছে তোর? কত কোটি টাকার মালিক?
— সোহান চুপ করে মাথা নামিয়ে বলতে শুরু করলো তোমার যা সব কিছুইতো আমার।
— বড় চাচা কিছুই দিবো না তোকে যা আছে সব ইকরাকে দিবো, এক কানা পয়সাও তুই পাবি না।
— বাবা বললেই হলো নাকি আমাদের যা আছে সবই সোহানের।
— সোহান দেখলেতো ছোট চাচ্চু তুমি ছাড়া এ বাড়িতে কেউ আমাকে দেখতে পারে না। বলতে বলতে খাওয়া শেষ করে টেবিল থেকে উঠে চলে গেলো।
— বড় চাচা তুই ও আছিস এই তোর আদরে আদরে ও এতোটা বাদর হয়েছে।
— বাবা হাসতে হাসতে ভাইজান ওইতো এই বংশের একমাত্র ছেলে সব কিছুইতো ওর জন্য।
— সকলের খাওয়া শেষ হলে আমি আর বড় চাচি মিলে সব কিছু গুছিয়ে রেখে যার যার রুমে চলে আসলাম। দরজা লাগিয়ে সোহানের দেয়া বই গুলো হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
— সকালের নাস্তা শেষ হতেই বড় চাচা আমাকে বললো তোর বড় চাচীর কাছে আমি টাকা রেখে দিয়েছি, তুই সোহানকে নিয়ে যেয়ে গিফট কিনে নিয়ে আসিস। আমরা বেড়িয়ে গেলাম বলে বড় চাচা আর বাবা বাসা থেকে চলে গেলো।
— আমি যেয়ে সোহানের দরজায় কয়েক বার টোকা দিলাম ভিতর থেকে কোন সারা শব্দ না পাওয়াতে দরজার লক মোচড় দিতেই দরজা খুলে গেলো। ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম সোহান ঘুমিয়ে আছে। আমি মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইলাম অনেকটা সময়, ঘুমন্ত অবস্থায় এতো সুন্দর লাগছে সোহানকে ইচ্ছে করে ওর কপালে আলতো করে ঠোটের পরশ বুলিয়ে দিতে। কি সব ভাবছি ভেবে নিজেরই লজ্জা লাগছে। আমি সোহানকে কয়েকবার ডাক দিতেই সোহান লাফিয়ে উঠলো।
— ঘুম থেকে উঠে ভুত দেখার মত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।
— এমন করে তাকিয়ে আছো কেন?
— সোহান তুই কখন আসলি রুমে?
— কখন আবার যখন তুমি ঘুমিয়ে ছিলে, বাহির থেকে কতবার ডাকলাম উঠলে না, তাই ভিতরে ঢুকে ডেকে তুললাম।
— সোহান এই তোর লজ্জা ভয় কিছু নেই?
— কিসের লজ্জা ভয়?
— সোহান লুঙ্গী পড়ে শুয়ে আছি যদি ঠিক না থাকে? কিংবা যদি লাফিয়ে উঠে তোকে জড়িয়ে ধরি তখন কি হবে।
— হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি খাবার অবস্থা আমার হাসি দেখে রাগে সোহানের চোখ মুখ লাল টকটকে হয়ে যাচ্ছে। আমি সোহানের ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করতে করতে বললাম আর আমি যদি চিৎকার করি?
— সোহান কথাটা শুনে এক লাফে খাটের শেষ কর্ণারে যেয়ে বসে, এই তুই ঘরের বাহিরে যা তোকে কোন বিশ্বাস নাই।
— আমি হাসতে হাসতে বলতে শুরু করলাম তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো, নাস্তা করে মার্কেটে যেতে হবে। আর আড় চোখে দেখছি সোহানের ভয়ার্ত মুখটা ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। আমি আর দাঁড়ালাম না সেখানে।
চলবে..