শেষ বিকেলের প্রণয় পর্ব-০১

0
823

‘১’
#শেষ_বিকেলের_প্রণয়
#লেখিকা_আলো_ইসলাম

“” একজন বিবাহিত ছেলেকে আমি বিয়ে করবো এটা ভাবলে কি করে আব্বু? মেয়ের এমন কথায় বিচলিত হয়ে তাকায় আরমান তালুকদার। চোখ মুখে তার হতাশার ছাপ স্পষ্ট। দুদিন ধরে মেয়েকে বোঝাচ্ছে তারা। কিন্তু ‘ছুটি’ কোনো কিছু শুনতে বা মানতে নারাজ। আর মানবেই বা কেনো? সত্যি তো সে একজন অবিবাহিত মেয়ে হয়ে একজন বিবাহিত ছেলেকে কেনো বিয়ে করবে?

— দেখো ছুটি অনেক বাড়াবাড়ি সহ্য করছি তোমার আর নয়। আমরা তোমার বাবা-মা! আমরা তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিতেই পারি! ছাবিনা তালুকদার বলেন কিছুটা রেগে (ছুটির মা)।
– অবশ্যই আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে পারো তোমরা এবং সে অধিকারও তোমাদের আছে। তাই বলে কোনো ভুল সিদ্ধান্ত আমি সমর্থন করতে পারিনা। যেখানে আমার জীবনের প্রশ্ন আমার ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। ছুটি বলে বিরক্ত হয়ে।
– তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি ‘ছুটি’। আমরা তোমার ভালো ছাড়া খারাপ করবো না, এই ভরসাটুকু নিশ্চয়ই আছে আমাদের উপর তোমার? আরমান তালুকদার কঠোর গলায় বলেন এবার।

– আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না আব্বু তোমরা কোন ভালোটা দেখছো এখানে আমার? দেশে কি এতোই ছেলের অভাব পড়ে গেলো যে আমাকে একটা বিবাহিত ছেলে বিয়ে করে উদ্ধার হতে হবে বা তোমরা উদ্ধার হবে।
” ছুটি! উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠেন ছাবিনা তালুকদার। মায়ের ধমকে ছুটি দমে যায়।

— তোমার বাবা কথা দিয়েছেন রানীমা’কে। তাই সে কথা ফেরানো সম্ভব নয়। আমরা যেটা করবো তোমাকে সেটাই মানতে হবে।
– তোমরা এমনটা করতে পারো না আমার সাথে! আমার মতের বিরুদ্ধে কোনো ভাবেই বিয়ে দিতে পারো না তোমরা। তাছাড়া আমি একজন এডাল্ট মেয়ে! আমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে।

— শুনো ছুটি, আমরা তোমাকে এবং তোমার মতামত কে সম্মান করি৷ কিন্তু তুমি কি আমাদের কথা ভাববে না? যাদের অনুপ্রেরণায়, যাদের দয়ায় আমরা আজ এতদুর এসেছি তাদের প্রতি কি কোনোই কৃতজ্ঞতা নেই আমাদের? আরমান তালুকদার বলেন হতাশ কন্ঠে।

– এখানে কৃতজ্ঞতা দেখানোর কিছু নেই আব্বু! তারা তোমাকে এমনি এমনি কিছু দেয়না। তুমি চাকরি করো, শ্রম দাও বিধায় তোমাকে পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। এখানে আলাদা ভাবে দেখা বা নেওয়ার কিছু নেই। তুমি যদি তাদের কোম্পানিতে চাকরি না করে অন্য কোম্পানিতে থাকতে, তারাও তোমাকে বেতন দিতো এটা নিশ্চয় অস্বীকার করবে না?

“” হ্যাঁ তা অবশ্যই দিতো! কিন্তু এই যে সাম্রাজ্য দেখছো, যে বিলাসিতা তুমি ভোগ করো তার অর্ধেকও থাকতো না আমাদের জীবনে। একজন মধ্যবিত্তের সংসার কেমন হয় তুমি এখনো বুঝোনি ছুটি আর আমি চাইও না তুমি কখনো সেটা উপলব্ধি করো। যার জন্য আমরা তোমার জীবনে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিই।

— শুধুমাত্র টাকার লোভে আমার সাথে এমন করছো তোমরা আব্বু? আমার কোনো ধন-সম্পদ, টাকা পয়সা চাইনা। আমি মনের মতো একজন ভালো জীবন সঙ্গী চাই। তোমরা বরং আমাকে কুঁড়েঘর দেখে বিয়ে দাও তাও মানতে রাজি কিন্তু ওই তাশরিফ খানকে আমি কোনো ভাবেই বিয়ে করবো না। ছুটি তার সিদ্ধান্তে অনড়।

— আমি এটাই বুঝতে পারছি না তোমার সমস্যা টা কি তাশরিফ বাবাকে বিয়ে করতে? অনেক ভালো একটা ছেলে তাছাড়া এমন ছেলে পেতে ভাগ্য লাগে বুঝলে!
– এমন ভাগ্য যেনো কোনো মেয়ের না হয়। তাচ্ছিল্যের সুরে বলে ছুটি।

— তুমি তো অনেক পছন্দ করতে তাশরিফকে। তার গান শুনে দিনরাত প্রশংসায় ডুবে থাকতে। তুমি তো তার অনেক বড় ফ্যান। তাহলে আজ কেনো এমন হেয় করছো তুমি জানতে পারি? তাশরিফ বিবাহিত এটাই কি সমস্যা? ছাবিনা তালুকদার ভ্রু কুচকে বিস্ময় নিয়ে বলে।

– যদি বলো বিবাহিত বলে, তো আমি বলবো এটাও একটা কারণ আর মূল যেটা সমস্যা তা হলো সে একজন খু’নী। সে তার প্রথম স্ত্রীকে খু’ন করেছে। তোমরা সব জানার পরও আমাকে ওই মানুষটার সাথে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লেগেছো? কেনো আম্মু? তোমরা কি মেয়ের লা’শ দেখে তবে ক্ষান্ত হবে?

–ছুটি!! আরমান তালুকদার হাত ওঠায় ছুটিকে মা”রতে। ছুটি অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
— আব্বু কি করছো তুমি এটা? আপাইকে মা’রবে নাকি? ছুটির ছোট বোন ছায়া। দুজনের বয়সের তফাত ২-৩ বছর হবে। ছোট মেয়ের কথায় আরমান তালুকদার হাত নামিয়ে নেয়। ছুটির চোখে পানিতে টলমল করছে৷ এই প্রথম তার বাবা তাকে মা’রতে উদ্বিগ্ন হয় তাও একটা খু’নির জন্য।

– থামলে কেনো আব্বু, মা’রো না আমাকে। ওই লোকটার হাতে ম’রার চেয়ে তোমরাই আমাকে মে’রে ফেলো। ছুটির কথায় আরমান তালুকদার অসহায় চোখে তাকিয়ে সোফায় বসে পড়েন মাথায় হাত রেখে।

– ছায়া বাবার এমন অবস্থা দেখে বাবার কাছে ছুটে যায়।
-আব্বু তোমার কি শরীর খারাপ করছে? ছায়ার কথায় আরমান তালুকদার করুণ চাহনি রেখে বলে তোর বোনকে বোঝা মা। আমরা ওর ভালো ছাড়া কখনো খারাপ চাইনা। তাশরিফ অনেক ভালো ছেলে, ওকে সবাই যেমন টা ভাবে জানে ও তেমন ছেলে নয়। আমি ছোট থেকে চিনি তাশরিফকে৷ জীবনের ২২ টা বছর ওই পরিবারের সুখ-দুঃখের সাথে জড়িয়ে আছি। অনেক কৃতজ্ঞতা জমে আছে সেখানে। এই প্রথম রানীমা আমার কাছে একটা আবদার করে তার ছেলের জন্য। ছুটি কে যে খুব দরকার তাশরিফের জন্য। নাহলে যে ছেলেটা ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যাবে। রানীমা অনুনয় করে চেয়েছেন আমার ছুটিকে, আমি পারিনি তাকে ফেরাতে। আর কেনো বা ফেরাবো বল। এমন মানুষ, এমন পরিবার যে খুব কম মেয়ে পাই ভাগ্য করে। সেটা আমি কিভাবে বোঝাবো তোর আপাইকে। কেনো আমার দিকটা সে ভাবছে না৷ তোদের বাবার কি কথার কোনোই দাম নেই?

— তুমি শান্ত হও, অসুস্থ হয়ে পড়বে এমন করলে। ছাবিনা তালুকদার বলেন চিন্তিত হয়ে।
— কিভাবে শান্ত হবো ছাবিনা৷ তোমার মেয়ে আমাকে ছোট করে দিয়েছে সবার সামনে। রানীমা কে দেওয়া কথা যদি আমি রাখতে না পারি তাহলে কোন মুখ নিয়ে আমি সেখানে যাবো বলতো পারো? কিভাবে গিয়ে বলবো রানীমা কে আমার মেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছে আমাকে। যেখানে আমি বড় মুখ নিয়ে বলে এসেছি আমার মেয়েরা আমার সিদ্ধান্তের বাইরে কথা বলে না৷

— ছুটির চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। না তার অনুভূতি কেউ বুঝতে চাইছে আর না ছুটি তার বাবা-মায়ের অনুভূতি বোঝার ক্ষমতায় আছে । সে তাশরিফকে ঘৃণা করে এখন। যার জন্য মনের মধ্যে একটা ভালো লাগা,ভালোবাসায় জায়গা ছিলো ফ্যান হিসেবে, সেটা অনেক আগেই হারিয়ে গেছে তার কৃতকর্মের জন্য । এখন ছুটির মনে যা আছে তা হলো একরাশ ঘৃণা।

– তুমি শান্ত হও আব্বু! আমি আপাইকে বুঝিয়ে বলবো। ছায়া আশ্বস্ত করে বলে।

– তোমাকে লালন পালন করে বড় করার এই প্রতিদান দিলে ছুটি? বাবা-মায়ের প্রতি কি কোনোই দায়িত্ব নেই তোমার? নূন্যতম কৃতজ্ঞতা’টাও নেই আমাদের প্রতি তাইনা?

– এ-সব কি বলছো মা? ছুটি বিস্ময় নিয়ে বলে।

– ঠিকই তো বলছি ছুটি! যদি আমাদের মানসম্মানের কথা ভাবতে তাহলে আজ আমাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বিতীয়বার কোনো কথা বলতে না। আমাদের এইভাবে ছোট করতে পারতে না৷ আজ মনে হচ্ছে জীবনে বড় পাপ করেছি তোমাকে জন্ম দিয়ে। তোমার মা হয়ে অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি।

– এইভাবে বলো না মা! দয়া করে আমাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করো না৷ ওই তাশরিফ খানকে বাদে তোমরা যাকে বিয়ে করতে বলবে, যার সাথে বিয়ে দেবে আমি রাজি। কিন্তু ওই মানুষটার সাথে একদম নয় কথাটা বলে ছুটি ঘরে চলে যায় ছুটে। সবাই হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছুটির দিকে তাকিয়ে থাকে।

– ছুটি আর ছায়া দুই বোন! ছুটি অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করছে, আর ছায়া অনার্স ৩য় বর্ষে মাত্র। দু-বোনের গলায় গলায় ভাব। যেনো দুটি বোন নয় বেস্ট ফ্রেন্ড তারা। দুই মেয়েকে নিয়ে আরমান তালুকদার আর ছাবিনা তালুকদার বেশ সুখে জীবন-যাপন করছেন। আরমান তালুকদার তাশরিফ খানের মা, যাকে সবাই রানীমা বলে সম্বোধন করে, তার পার্সোনাল সেক্রেটারি। তাশরিফ খানের বাবা আরমান তালুকদার’কে নিয়োগ করেন তার সেক্রেটারি হিসেবে। বিশ্বস্ততার সাথে কাজ করে এসেছে আরমান তালুকদার। যার জন্য সমস্ত দায়ভার, সব কিছু দেখাশোনার দায়িত্ব নিশ্চিন্তে তাকে দিয়ে রেখেছে। তাশরিফ খানের বাবা মা’রা যায় কয়েক বছর আগে। এরপর কোম্পানির হাল ধরেন তাশরিফের মা মমতা খান (রানীমা) ।

– তাশরিফ খান বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিলো, যেটা এখন অন্ধকারে তলিয়ে গেছে জীবনের কিছু টানাপোড়ন এসে। বিখ্যাত একজন গায়ক ছিলেন তাশরিফ খান। দেশে বিদেশে বেশ নাম-জশ ছিলো। সবাই তাশরিফ খানের গান, তার কন্ঠে মাতোয়ারা হয়ে যেতো। তার মধ্যে ছুটিও একজন। কিন্তু একটা দমকা হাওয়া এসে সব তছনছ করে দেয়, এলোমেলো করে দিয়ে যায় তাশরিফ খানের জীবন। চিরদিনের মতো গান হারিয়ে ফেলে সে, যতটা ভালোবাসা নিয়ে মানুষের মনে ছিলো সে আজ ঠিক ততটাই ঘৃণা তার জন্য সবার মনে। সবার মনের আড়ালে চলে গেছে তাশরিফ খানের নাম তাশরিফ খানের গান। হারিয়ে গেছে সে কন্ঠ, সে মুখ। এখন সবাই তাকে একজন খু’নি হিসেবে চেনে। নিজের স্ত্রীকে সে নিজ হাতে খু’ন করেছে। যার জন্য এতে তিক্ততা তার প্রতি সবার।

— মা তোর জন্য মেয়ে দেখেছে তাশরিফ! এবার অন্তত দ্বিমত করিস না বিয়ে নিয়ে। মা অনেক চিন্তিত তোকে নিয়ে কেনো বুঝিস না? দেখ ভাই! এইভাবে জীবন চলে না। একটু বোঝার চেষ্টা কর আবির অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে তাশরিফ খানকে। হাইওয়ের ওপর গাড়ি থামিয়ে ব্রিজের ধারে দাঁড়িয়ে আছে দুজন। রাত ঠিক একটার কাটা ছুঁই ছুঁই। বাড়ি ফেরার পথে তাশরিফ এখানে থামে। কেনো জানি শান্তি অনুভব তার এখানে আসলে। জীবনের কিছু সময় স্বস্তি খুঁজে পাই সে এখানে।

– তাশরিফ খানকে চুপ থাকতে দেখে আবির বিরক্ত নিয়ে বলে কিছু বলছিস না যে? তাশরিফ ছোট ছোট চোখ করে তাকায় আবিরের দিকে!

– আমার উত্তর কি হবে বা কি হতে পারে তুই খুব ভালো করে জানিস আবির। তাই বলবো আমাকে না বুঝিয়ে আম্মাকে গিয়ে বোঝা! আমি কোনো বিয়ে করবো না। জীবনে একবার বিয়ে হয় আর সেটা আমার হয়ে গেছে। আর কেউ আমার জীবনে আসবে না। কথাটা বলে তাশরিফ গাড়িতে উঠে বসে৷ আবির ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলে এবারও মা ছেলের একটা যুদ্ধ হবে।

– আসুন আবিরের পরিচয় টা দিই,,,,, থাক পরের পর্বে বলবো।
চলবে……
চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে